সৈ য় দ ম ন জু রু ল ই স লা ম
আধুনিক চিত্রকলার বড় বড় সব ঢেউয়ের উৎপত্তি পশ্চিমে। সেসব ঢেউয়ের কোনোটা আমাদের তীরে এসে বেশ জোরে আছড়ে পড়েছে, কোনোটা একটা ধাক্কা খেয়ে মিলিয়ে গেছে; কোনোটার রেশ থেকেছে কিছুদিন, কোনোটার অনেককাল। পুব থেকে তেমন কোনো ঢেউ পৌঁছায়নি পশ্চিমে। অথবা, আরো নির্দিষ্ট করে বললে, পশ্চিমের পাথুরে সমুদ্রতীরে এর কোনোটা পৌঁছালেও কোনো অভিঘাত সৃষ্টি করতে পারেনি। ঢেউ পশ্চিমে তুলেছিলেন রবীন্দ্রনাথ, কিন্তু সেটি তাঁর জীবনকালেই মিলিয়ে গেল। পশ্চিমা জ্ঞান-বিজ্ঞান, পশ্চিমা উপনিবেশী শক্তি, পশ্চিমা সওদাগরি ব্যবসা দীর্ঘদিন ধরে পুবের ভূগোল পর্যন্ত যে-রাস্তাটা কেটেছিল, তা ধরেই পশ্চিমা চিত্রকলা এসেছে আমাদের দেশে এবং পশ্চিমা জ্ঞান-বিজ্ঞানের মতো এই চিত্রকলাকেও আমরা নিজেদের জ্ঞানচর্চা ও নন্দনচিন্তায় স্থান দিয়েছি।
এজন্য, যখন রবীন্দ্রনাথও পরিচিতি পাননি চিত্রকর হিসেবে, গত শতাব্দীর সেই কুড়ির দশকে, এদেশের শিক্ষিতজনের অনেকে পিকাসো অথবা জর্জ ব্রাক অথবা পল ক্লের নাম জানতেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা হয়েছে ১৯২১ সালে। প্রতিষ্ঠার শুরু থেকেই ইংরেজি বিভাগের শিক্ষার্থীরা যে পশ্চিমা চিত্রকলা সম্পর্কে জেনেছেন শিক্ষকদের কাছ থেকে, বইপত্র পড়ে, সে-সম্পর্কে কারো কারো স্মৃতিচারণ থেকে জানা যায়। অথচ, এদেশে ১৯৪৮-এর আগে প্রাতিষ্ঠানিক শিল্পচর্চা সীমাবদ্ধ ছিল খুলনার একটি ছোট আর্ট স্কুলের মাত্র কয়েক বছরের কার্যক্রমে। তারপরও শিল্প সম্পর্কে জানার আগ্রহটা শিক্ষিতজনের মধ্যে ছিল।
তবে ওই ১৯৪৮-এ জয়নুল আবেদিন ও তাঁর কিছু সতীর্থের চেষ্টায় ঢাকায় একটি আর্ট ইনস্টিটিউট প্রতিষ্ঠার পর থেকে পশ্চিমা শিল্পকলা নিয়ে জানার একটা পাকাপোক্ত ব্যবস্থা হলো। মাত্র দশ-বারো বছরে এর শিক্ষকরাও পশ্চিমা ধারার শিল্পচর্চাকে নিজেদের মতো করে আয়ত্ত করে নিলেন। যে
পিকাসো-ক্লে-ব্রাককে হয়তো ভাসা-ভাসা জানতেন ইংরেজির শিক্ষার্থীরা, তাঁরা ইনস্টিটিউটের শিল্প-শিক্ষার্থী, শিক্ষক ও শিল্পীদের কাছে তাঁদের পূর্ণতা নিয়ে ধরা দিলেন। একসময় পিকাসোর কিউববাদ তাঁদের মধ্যে একটা উত্তেজনা সৃষ্টি করলেও তা থেকে বেরিয়ে নিজেদের মতো এর ব্যাখ্যাও দিতে থাকলেন অনেক শিল্পী; বিমূর্ত শিল্পকলাকেও পরীক্ষা করতে লাগলেন; এর নতুন প্রকাশ ঘটাতে থাকলেন নিজেদের সংস্কৃতি, চিত্র-ঐতিহ্য, রং-ভাবনা, পরিসর ও ফর্ম-চিন্তার পরিপ্রেক্ষিত থেকে।
পশ্চিম থেকে এরপর আরো ঢেউ এলো, কিন্তু বরাবর এই ঢেউগুলি তীরের কাছাকাছি আসতে না আসতেই এদেশের ভূ-প্রকৃতি, জল ও ডাঙার চরিত্রও জীবনের প্রভাবে কিছুটা হলেও বদলে গেল, স্থানীয় হয়ে গেল। আমাদের শিল্পকলায় গ্রহণ-পরিবর্তন-সংযোজনের এ-প্রক্রিয়াটি এর আধুনিকতার চরিত্রকে একটা নিজস্বতা দিয়েছে, তাতে কোনো সন্দেহ নেই।
পশ্চিমের চিত্রকলা সম্পর্কে আমরা দীর্ঘদিন জেনেছি বই ও সাময়িকী থেকে, হঠাৎ হঠাৎ পাওয়া ছবির প্রতিলিপি থেকে। যেহেতু আর্টের বই দামে আক্রা, খুব বেশি ছবি বা প্রতিলিপি দেখার সুযোগও আমাদের ছিল না। তারপর স্লাইডের দিন যখন এলো, ছবির সংখ্যাও বাড়ল। সাদা-কালোর পরিবর্তে সব ছবি রঙিন দেখার সুযোগ হতে থাকল। কিন্তু ইন্টারনেটের যুগে এসে অসংখ্য ছবি দেখার সুবিধা চলে এলো আমাদের হাতের মুঠোয়। এখন পশ্চিমের যে-কোনো শিল্পীর প্রায় সব ছবি দেখা সম্ভব ঘরের মধ্যে বসে, একটি কম্পিউটারের পর্দায়। এবং ছবিগুলির আদি রঙের সঙ্গে পর্দায় দেখা ছবির রঙের তফাৎ থাকে সামান্যই। এখন কম্পিউটারের পর্দা হচ্ছে ভার্চুয়াল গ্যালারি।
তারপরও একজন শিল্পীর কাজ ছবিতে দেখা আর নিজের চোখে দেখার মধ্যে তফাৎটা আকাশ-পাতালের। সামনাসামনি ছবি দেখা একটা জীবন এবং একটা ইতিহাস দেখার মতো। মনে আছে, অসলোর মাঙ্ক মিউজিয়ামে যখন এডভার্ড মাঙ্কের ‘দ্য স্ক্রিম’ বা ‘চিৎকার’ ছবিটি দেখেছিলাম, বেশ অবাক হয়েছিলাম। অবাক এবং হতাশও – প্রধানত ছবিটার আকৃতির জন্য। এত সাড়া জাগানো ছবি এমন মামুলি আকারের! কিন্তু আকারজনিত হতাশা-বিস্ময়ের পর যখন ছবিটার সামনে দাঁড়ালাম, একটা বিশাল উত্তেজনা অনুভব করতে থাকলাম। এই সেই ছবি! এই উত্তেজনার কোনো তুলনা হয় না। আর যে-শিল্পী অাঁকেন বড় মাপের ক্যানভাসে, মাঝে মাঝে যার ব্যাপ্তি বেড়ে হয়ে দাঁড়ায় ডিপটিচ বা ট্রিপটিচ এবং যার ক্যানভাসজুড়ে থাকে তীব্র গতিময়তা, রঙের ঝাপটা, এবং বিষয়ের বলিষ্ঠতা, যেমন ফ্রান্সিস বেকন, তখন সেসব ছবি সামনে দাঁড়িয়ে দেখার অভিজ্ঞতাটা হয় প্রকৃতই অতুলনীয়।
পশ্চিমের যে কজন চিত্রকরের ছবি আমি গ্যালারিতে-জাদুঘরে-প্রতিষ্ঠানের সংগ্রহে দেখেছি, তার মধ্যে বেকন একজন। তাঁর ছবি দেখার অভিজ্ঞতাটাই একটা বড় লেখার বিষয় হতে পারে। কিন্তু সেই ব্যক্তিগত গ্রন্থনে যাওয়াটা ভিন্ন একটি মেজাজের এবং ভিন্ন কোনো সাময়িকী বা প্রকাশনার জন্য তোলা থাকতে পারে। আপাতত বেকনের ছবি নিয়ে দু-চারটা কথা বলা যায়। তবে এ-বিষয়টি প্রথমেই স্বীকার করে নেওয়া ভালো, বেকনের ছবির বিশাল একটি প্রদর্শনী না দেখলে তাঁর ছবির অন্তরঙ্গ ভুবনটাকে চেনা হতো না, তাঁকে জানাটাও হতো খন্ডিত, অসম্পূর্ণ। প্রদর্শনীটা দেখে যে বেকনকে সম্পূর্ণ জানা গেছে, তা নয়; বস্ত্তত ওই দাবি তাঁর কোনো জীবনীকারও হয়তো করবেন না। তবে তাঁকে জানায় যে-অসম্পূর্ণতা ছিল আগে, তার কিছুটা হলেও দূর হয়েছে বলে আমার বিশ্বাস।
শুরুতে পুব-পশ্চিমের সংযোগের যে-উপক্রমণিকাটি এবং পশ্চিমা শিল্পের পুবে আছড়ে পড়ার যে-উৎপ্রেক্ষাটি দিয়েছি, তাও যে নেহাত কথার কথা নয়, বেকনের ছবির আলোচনায় তা দেখা যাবে। বেকন আমাদের অনেক তরুণ শিল্পীকে অনুপ্রাণিত করেছেন (বেকন নামের ঢেউটি বেশ আলোড়ন তুলেছে); কিন্তু তার বাইরেও পুব-পশ্চিমের বয়ানে তাঁর একটা ভূমিকা আছে। বেকন পশ্চিমের দৃষ্টিভঙ্গি, এর শক্তিকেন্দ্রগুলি, এর সামাজিক-রাজনৈতিক আচার এবং ভূ-দর্শনকে একটা বড় ধাক্কা দিয়েছিলেন। মাঙ্কের মতোই চিৎকার দিয়েছেন, পশ্চিমকে সন্ত্রস্ত করেছেন। এবং পুবের অন্তত একটি রসবোধ তাঁর ছবিকে এতখানি অপ্রতিরোধ্য করেছে – পুবের বীভৎস-রস ও দর্শনের ভেতরের চিন্তা ও শক্তিটি। আমাদের শিল্পীরা হয়তো এজন্য সহজেই তাঁর কাছে পৌঁছাতে পেরেছেন, যেমন তিনি পৌঁছে গেছেন আমাদের তরুণ শিল্পীদের কাছে।
বেকনের সেই প্রদর্শনীটি হয়েছিল নিউইয়র্কের মেট্রোপলিটান আর্ট মিউজিয়ামে, ২০০৯ সালে, তাঁর জন্মের শতবার্ষিকী উপলক্ষে। তাঁর বিখ্যাত অনেক ছবিই ছিল সেই প্রদর্শনীতে, তবে সবচেয়ে বড় কথা, প্রদর্শনীটি ছিল প্রতিনিধিত্বমূলক। অর্থাৎ তাঁর শিল্পীজীবনের প্রায় সকল পর্যায়ের ছবি থেকে বাছাই করে প্রদর্শনীটি সাজানো হয়েছিল। মোট নববইটির মতো ছবি ছিল, যার মধ্যে কুড়িটির মতো ছিল ড্রইং। বেকন বিখ্যাত ছিলেন যেসব ছবির কারণে, সেগুলির মধ্যে ছিল ‘ক্রুসিফিকশন’ এবং ‘পোপ’ সিরিজের বেশ কিছু কাজ এবং কিছু স্টাডি, কিছু ট্রিপটিচ। প্রদর্শনী ঘরগুলির একটি বরাদ্দ ছিল ‘ক্রুসিফিকশন’ সিরিজের ছবিগুলির জন্য, আরেকটি ছিল ‘পোপ’ সিরিজের জন্য। এছাড়া এক সমকামী বন্ধু জর্জ ডায়ারের মৃত্যুর পর বেকন যেসব ছবি এঁকেছিলেন, সেগুলির মধ্য থেকে দুটি ট্রিপটিচসহ কিছু চিত্রকর্ম রাখা ছিল আরেকটি ঘরে। জর্জ ডায়ার ছিলেন সন্দেহজনক চরিত্রের এক লোক, চোর এবং মিথ্যাবাদী। তাঁর সঙ্গে গাঢ় একটা সম্পর্ক ছিল বেকনের। বিষয়টা ছিল অবাক করার মতো, অনেকটাই যেন অতিপ্রাকৃতিক। বেকনের সমকামিতা এবং তাঁর জীবনে ও শিল্পে এর প্রভাব নিয়ে একটু পরে আলোচনা করা যাবে। আপাতত ওই প্রদর্শনীতে ফিরে যাওয়া যাক। এটি শুরু হয়েছিল মে মাসের শেষ দিকে, শেষ হয়েছে আগস্টের মাঝামাঝি। আমি গিয়েছিলাম শেষের দিকে। সেজন্য যাকে বলে উপচে-পড়া ভিড়, তা তেমন ছিল না। গায়ে গা লাগানো ভিড় না থাকায় ছবিগুলি থেকে অনেকটা দূরে গিয়ে সেগুলি দেখতে পেরেছি। বড় কাজ দূর থেকে দেখলে একরকম লাগে, সামনে দাঁড়িয়ে দেখলে অন্যরকম। আমি জানতাম, বেকনের রং দর্শককে ঝাপটা দেয়, অস্বস্তিতে ফেলে, যেমনটা করে তাঁর বিষয়বস্ত্ত, তাঁর খন্ডিত, বিকৃত, কিমাকার অবয়ব। প্রদর্শনীর জন্য বেকনের ১৯৫০-এর দশক থেকে নিয়ে করা চিত্রকর্ম বাছা হয়েছিল। দেখা গেল, শুরুর ছবিগুলিতে রং একরকম, ষাটের দশক থেকে হতে শুরু করল ভিন্ন রকম। শুরুর কাজে রঙে কিছুটা পরিমিতি বোধ এবং হালকা দু-এক রঙের ব্যবহার থাকলেও ষাট থেকে কড়া রং, রঙের দ্বন্দ্ব এবং রঙের চিৎকার শুরু হয়ে গেল। কসাইখানা একটা প্রিয় জায়গা ছিল তাঁর – অনেককে বলেছেন কসাইয়ের ঝুলিয়ে রাখা মাংসের রংটা তাঁর খুব পছন্দ। মাংসের রঙের সঙ্গে মাংস কাটা, মানুষের মাংসকে নানা উপায়ে কাটার সম্পর্কটা তৈরি হতে সময় লাগে না। চিত্রকর্মগুলি দেখলে বোঝা যায়, জীবনকে কতটা আদিম, রক্তাক্ত এবং জান্তব প্রেক্ষাপটে ফেলে তিনি বিচার করেছিলেন। এর পেছনে অবশ্য ছিল প্রথম মহাযুদ্ধের বীভৎসতা এবং মৃত্যুর উৎসব। বিজয়ী ইংলন্ড অথবা বিজিত জার্মানি, কেউ এই বীভৎসতার অভিঘাত থেকে সুরক্ষিত ছিল না। বেকন এই বীভৎসতার জবাব দিয়েছেন বীভৎসতাকে ইন্দ্রিয়ের ভেতরে একটা আদিম অসুখের মতো ছড়িয়ে দিয়ে। তাঁর প্রদর্শনী খুঁটিয়ে দেখা মানে দীর্ঘ সময়ের জন্য মনের স্বস্তি চলে যাওয়া। তাঁর ক্যানভাস জীবন্ত একটা প্রাণীর মতো নিঃশ্বাস ফেলে, আঘাত দেয়, নিদেনপক্ষে ভয় দেখায়, ভাবায়। এই শিল্পীর ছবিকে কোনো প্রতিলিপিতে, এমনকি ইন্টারনেটে দেখে ‘সেবন করা’ হয়তো সম্ভব নয়। এই ‘সেবন করা’র বিষয়টি প্রথম তুলেছিলেন ব্রিটিশ
শিল্প-সমালোচক পিটার ফুলার (১৯৪৭-১৯৯০)। বেকনকে তিনি পছন্দ করতেন না, কিন্তু তাঁকে বুঝতে হলে যে তাঁর কাজের সামনে দাঁড়িয়ে পুরোটার স্বাদ নিতে হয়, সেবন করতে হয়, যেমন আমরা স্বাস্থ্যের জন্য পান করি তেতো ওষুধ – এরকম কথা তিনি অনেকবার বলেছেন। তাছাড়া বেকনের বায়োমর্ফিক কাজ – অর্থাৎ যেসব কাজের ফর্ম জীবন্ত প্রাণী অথবা প্রাণিসত্তার বাধাহীন, বর্ধমান আকৃতির মতো স্পন্দিত, অনির্দিষ্ট এবং শারীরিক – সেগুলির চরিত্র বোঝার জন্য একটু পরিসর নিয়ে সামনে দাঁড়াতে হয়।
বেকনকে নিয়ে ইংলন্ডে, ইউরোপে কৌতূহলের সীমা নেই। দেখা গেল, আমেরিকাতেও তার কমতি নেই। প্রদর্শনীর একজন কর্মকর্তা জানালেন, পিকাসো আর ওয়ার্হোলের পরই বেকনের ছবির দাম। একটা ছবি তো বিক্রি হয়েছে প্রায় নয় কোটি ডলারে, বাংলাদেশের কেউ কিনতে গেলে যার জন্য দিতে হতো প্রায় সাতশো ষাট কোটি টাকা। এরকম কুড়িটা ছবির দাম দিয়ে বোধহয় একটা পদ্মা সেতু হয়ে যায়! এই কৌতূহলের আবার দুটো দিক আছে। একদল যদি পিটার ফুলারের মতো একটা নৈতিক বা তাত্ত্বিক (ফুলার আবার মার্কসবাদী বীক্ষণে বিশ্বাসী ছিলেন, সেজন্য বেকনকে তিনি অধঃপতনের ছবি অাঁকার জন্য তিরস্কার করেছেন, যদিও অধঃপতনের কোনো ব্যাখ্যা তিনি দেননি) দৃষ্টিকোণ থেকে তাঁর ছবিকে দেখে, এবং সমালোচনা করে, তাঁর কাজকে সহিংস, অস্বস্তিকর, নৈতিকতাবিবর্জিত, শরীরী, ভীতিকর – এসব বিশেষণে ভূষিত করে, অন্য একটি দল ডেভিড সিলভেস্টারের সঙ্গে সুর মিলিয়ে বলবে, বেকনের কাজ আমাদের সময়ের সত্যনিষ্ঠ দলিল, মানুষের প্রাণশক্তিকে যা নিরন্তর ‘হ্যাঁ’ বলছে, মৃত্যুর সামনে দাঁড়িয়ে চিৎকার করে বলছে, তোকে মানি না। উইন্ডহ্যাম লিউয়িস লিখেছিলেন, ১৭ নভেম্বর ১৯৪৯ সালে দ্য লিসেনার-এ ‘বেকনের মতো সুন্দর ছবি আর কেউ অাঁকতে পারে না।’ যদিও তিনি স্বীকার করেছিলেন, বেকন আদতে অমঙ্গলের চিত্রকর, মৌলিকভাবে তা-ই।
সুন্দর ছবি, না সুন্দর করে অাঁকা ছবি? দুবার পড়ে দেখা গেল, লিউয়িস সুন্দর ছবিই বলেছেন। বেকনের ছবিকে আর যে-কোনো বিশেষণ দেওয়া যাক, সুন্দর বলা যাবে না। অমঙ্গলের বিষয়টা বোঝা যায় – আমাদের চোখ জুড়ে তা দাঁড়িয়ে থাকে। কিন্তু সুন্দরের বিষয়টা তাহলে কোথায়? অনেক ভেবেচিন্তে মনে হলো, সুন্দর বলতে লিউয়িস নিশ্চয় বেকনের শিল্পের হয়ে-ওঠাকে বোঝাচ্ছেন : তার রং ও রেখার তীব্রতাকে, মূর্তি ও রঙের পারস্পরিকতাকে, তাদের স্থানবদলের বিষয়টিকে এবং জীবনের পক্ষে বিকট চিৎকার দিয়ে ওঠাকে বোঝাচ্ছেন। তাহলে অবশ্য সুন্দরের বর্ণনাটি মানা যায়। অন্যথায় একবেলা বেকনের কাজ দেখে মনে হয়েছিল একটা তীব্র অমঙ্গলবোধ যেন তিনি তাঁর কাজের নেপথ্যে সক্রিয় হতে দিয়েছেন, যাতে মানুষ অস্বস্তি নিয়ে ঘরে ফেরে এবং অমঙ্গলকেই প্রশ্ন করতে থাকে, তদন্ত করতে থাকে। তারপর কী হয়, মানুষ কী উত্তর পায়, অমঙ্গল থেকে কতটা নিষ্কৃতি পায়, সে তাদের নিজেদের বিষয়।
চিৎকার ছিল বেকনের ছবির একটি বিষয়। জীবন, অথবা আরো নির্দিষ্ট করে বললে, মরতে মরতে বেঁচে ওঠা, যেমন পাথুরে জমির ভেতর থেকে হঠাৎ একটি সবুজ পাতার জেগে ওঠা ছিল আরেকটি; ক্রুশবিদ্ধতা ছিল তৃতীয় একটি এবং চতুর্থ একটি বিষয় ছিল আবদ্ধ একটি চৌকোনা জায়গায় মানুষের সবচেয়ে তীব্র অনুভূতিগুলির – ভয়ের, বিবমিষার, রিরংসার, হিংস্রতার খেলা। ছোটবেলায় একটা ক্লোজেটে তাঁকে ঘণ্টার পর ঘণ্টা আটকে রাখত কাজের একটি মেয়ে এবং তিনি ওই আবদ্ধ অন্ধকারকে নিঃশব্দ চিৎকারে বিদীর্ণ করতেন। ১৯৩৫ সালে আইজেনস্টাইনের ক্লাসিক ছবি দ্য ব্যাটলশিপ পটেমকিন (১৯২৫) দেখে চশমা ভাঙা, রক্তাক্ত গালের সেই নার্সটির আতঙ্কিত চিৎকারটি তিনি ভুলতে পারেননি। নিজের চিৎকারের সঙ্গে যুক্ত হয়েছে ওই নার্সের চিৎকার এবং বোধ করি মাঙ্কের সেই বিখ্যাত চিৎকার। প্রদর্শনীর ছবিগুলির সামনে কিছুক্ষণ কান পেতে দাঁড়ালে হয়তো শোনা যেত সেই চিৎকার।
প্রদর্শনীর ট্রিপটিচগুলির সামনে মানুষের জটলা লেগেই ছিল। মানুষ অনেকক্ষণ ধরে বিখ্যাত ট্রিপটিচগুলি দেখেছে, ফলে ভিড় বেড়েছে। এগুলিকে বেকন নিজস্ব একটি পরিচিতি দিয়েছেন। ট্রিপটিচ আরো অনেকে এঁকেছেন, কিন্তু তাঁর মতো এত কুশলতায় তিন খন্ডে একটি ইমেজকে এমনভাবে বাড়তে দিতে পারেননি কেউ। অনেকে বলেন, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের মানবতাবিধ্বংসী ভূমিকার কারণে বেকনের ভেতরে জীবন নিয়ে এমন প্রতিক্রিয়া হয়েছিল। জীবনকে তিনি খন্ডিত, চূর্ণিত এবং অনেক সময় নিরাময়-অযোগ্য বলে ভেবেছেন – এমন দাবি অনেক সমালোচকের। ট্রিপটিচের বিশাল বিস্তার জুড়ে বেকনের নানান বিন্যাস দেখে আমার মনে হয়েছে, যেন জীবনের ভাঙা টুকরাগুলি জোড়া লাগাতে চাইছেন তিনি।
ভাঙা বা চূর্ণিত সময়কে জোড়া দেওয়ার আরেকটা প্রয়াস তাঁর কাচের ব্যবহারে, সোনালি ফ্রেমিংয়ে। না, এ-কাচ ফ্রেমে বসানো নয়, এ-কাচ তিনি এঁকেছেন। সেই আবদ্ধ, চৌখোপ চৌহদ্দির চারদিকে। বেকন তাঁর ছবির উপরিতলের ঠিক পেছনেই এরকম এক চৌখোপ খাঁচা অাঁকেন এবং সেগুলি যখন হয় কাচের তখন একটা গা-শিরশির করা অনুভূতি জাগে আমাদের মনে। কাচের খাঁচায় বসা মানুষকে – যেমন কোনো পোপকে – তখন আমাদের মনে হয় জাঁ পল সার্ত্রের নো এক্সিট নাটকের কোনো চরিত্র, অথবা কাচের বৈয়ামে আটকেপড়া মাছির মতো। প্রদর্শনীর একটি অংশ ছিল এই খাঁচা নিয়ে, ‘খাঁচায় আবদ্ধ’ শিরোনামে। এই খাঁচা যেন পুরনো কালের কোনো সমাধিকক্ষ। অথবা, শুধুই খাঁচা, যা আটকে রাখে প্রাণীদের। এই চৌখোপ জায়গায় মাঝে মধ্যে আলো ফেলেন বেকন, যেমন মঞ্চের ওপর আলো পড়ে যখন কোনো চরিত্রকে একটি গুরুত্বপূর্ণ কিছু বলতে বা করতে হয়। এরকম খাঁচায় যখন বসে থাকেন কেউ, যেমন পোপ, তাঁর পেছনে ঝুলে ভারী পর্দা এবং তাঁর মুখ থাকে বিকৃত, মুখটা হাঁ করা, যেন তিনি একটি তীব্র চিৎকার করছেন। অবয়বপ্রধান এই ছবিগুলি শক্তিশালী প্রকাশবাদী ধারার – বস্ত্তত প্রকাশবাদকে এক প্রচন্ড তীব্রতা এবং গতি দিয়ে বেকন নতুন এক ব্যাখ্যায় হাজির করেন। তাঁর ব্যাখ্যায় যে বিকার-বিক্ষোভ এবং বীভৎসতার দেখা পাওয়া যায়, তা আমাদের সময়ের স্খলন এবং দুঃস্বপ্নগুলিকে নিপুণভাবে ধরে রাখে।
বেকন তাঁর প্রকাশবাদী ছবির জন্য খুব একটা ঘরের বাইরে যেতেন না। তাঁর কিছু ছবিতে আছে রাস্তা, বাড়িঘর বা গাছপালা; কিন্তু ওই পর্যন্তই। তার বেশিরভাগ ছবিতে ঘরের ভেতর, আবদ্ধ কোনো জায়গা অথবা মাংস ঝুলতে থাকা কসাইখানার সীমিত পরিসর মুখ্য; অথবা সেসব ছবিতে মানুষের মুখ, অবয়ব অথবা তাঁর নিজের মুখ প্রাধান্য পায়। কোথাও খোলামেলা ভাব নেই, রৌদ্রছায়ার দেখা নেই। আকীর্ণ, শ্বাস বন্ধ করা একটা অনুভূতিই যেন জেগে থাকে বরং। ক্যানভাসের মানুষের মুখের জায়গায় অনেক সময় থাকে বিকৃত শূন্যতা : নাক আছে তো চোখ নেই, চোখ আছে তো কান নেই। আর অবয়বগুলিতে তাল-তাল রং জমে একটা ঘূর্ণিত ও স্পন্দিত গতিশীলতার সৃষ্টি করে; রংগুলি ফর্ম ভেঙে যেন বাইরে বেরিয়ে আসে, নিজের মতো করে বাড়তে থাকে, কাঁপতে থাকে। বীভৎস একটি অবয়বের বা ইমেজের সামনে দাঁড়িয়ে অস্পষ্ট গলায় ‘মাগো!’ বা এই ধরনের কিছু বলতে শুনেছি দু-এক দর্শককে, একজন তো বেশ জোরে বললেন, ‘ক্রাইস্ট!’ অথচ ছবিগুলির সামনে দাঁড়িয়ে তাঁরা দেখতেই থাকলেন, যেরকম পশু জবাইয়ের সময় অনেকে অভিনিবেশ নিয়ে তা দেখতে থাকেন, অথবা কোনো মানুষকে গণধোলাই দিয়ে তার নাক-মুখ থেঁতলে দেওয়ার সময়। বেকন জানতেন, মানুষ বীভৎসতার সঙ্গে দ্বিমুখী সম্পর্কে জড়িত। বীভৎসতা দেখলে মানুষ অাঁতকে ওঠে, আবার গোপন একটা সম্মতি পায় নিজেদের ভেতর থেকে, তাতে অংশ নিতে। বীভৎসতার ইমেজ এঁকে বেকন হয়তো আমাদের দাঁড় করিয়ে দেন নিজেদেরই মুখোমুখি। যেমন ‘গুয়ের্নিকা’ ছবিতে পিকাসো যুদ্ধের বীভৎসতার ছবিগুলিকে আত্মদর্শনের একটি উপলক্ষ হিসেবে তুলে আনেন, যুদ্ধ ও সমরবাদ এবং এর নানা কৌশলকে নগ্ন আলোয় তুলে আনার পাশাপাশি।
বেকনের অনেক ছবিতে গরুর বা অন্য কোনো প্রাণীর বড় বড় টুকরা মাংস ঝুলে থাকে অথবা মেঝেতে পড়ে থাকে। মাংস মানে রক্ত এবং কুপিয়ে আলাদা করা বিভিন্ন খন্ড। শরীর থেকে আলাদা করা অঙ্গ, অঙ্গ থেকে প্রত্যঙ্গ। বেকন বলতেন, আমরা সবাই মাংস, চামড়ার আবরণে ঢেকেঢুকে রেখেছি শুধু, কিন্তু সকলেই মৃতদেহ হওয়ার অপেক্ষায় আছি। বেকন আরো বলতেন, কসাইখানায় গেলে তাঁর মধ্যে এরকম একটা ভাব আসত, এই প্রাণীগুলির জায়গায় তিনিও তো থাকতে পারতেন। কসাইখানা তাঁকে মানুষের অরক্ষিত অবস্থা, তার ভয়ানক দুর্বলতা সম্পর্কে সচেতন করত। ডেগার অাঁকা একটি প্যাস্টেলের উল্লেখ তিনি করতেন,
যে-ছবিতে একটি মেয়ে তার পিঠ ঘষছে স্পঞ্জ দিয়ে। মেয়েটির শিরদাঁড়া ঘাড়ের নিচে যেন মাংস ফুঁড়ে বেরিয়ে এসেছে। এটি দেখে দর্শক একটি ধাক্কা খায়; মেয়েটির এবং মানুষের শরীর যে কত ঠুনকো তা আরেকবার তাঁকে মনে করিয়ে দেয়। বেকনের মতে ছবিটি শুধু শিরদাঁড়া নয়, মাংসের জেগে থাকার এবং একসময় মরে যাওয়ার গল্পও শোনায়।
এ-প্রসঙ্গে বেকন এক্স-রে ছবির প্রতি তাঁর মোহের কথা জানান। এক্স-রে শরীরের ভেতরের ছবিটি সাদা-কালোর উল্টো হিসেবে তুলে আনে, অসুখের অবস্থা জানায়। সুস্থ মানুষ শরীরের এক্স-রে করতে যায় না। বেকন উপজীব্য করেছেন অসুস্থ সমাজ এবং সমাজের অসুস্থতাকে। সেজন্য তাঁর ছবিতে এক্স-রে প্লেটের আপাত-নিস্পৃহার পেছনে ভয়ানক অসুখের অথবা বিচলনের খবর থাকে। অনেক এক্স-রে প্লেটের মতোই নির্দয় বেকনের ছবি।
তবে মাংসের রং যে তাঁর প্রিয় ছিল,
এ-কথাটিও বেকন জানান। মাংসের রং লাল ও গোলাপির মাঝখানে, আবার রক্ত লাগলে যে রং লাল হয়, একই সঙ্গে লাইলাক বা পার্পল (পোপের পোশাকে এ রং আছে) বেশ জায়গা জুড়ে থাকে তাঁর ক্যানভাসে। অনেক সময় তিনি ক্যানভাসে একটা রং চাপিয়ে তার ওপর দিয়ে দ্রুত হালকা ব্রাশ চালিয়ে নিতেন, তাতে একটা গতির ধারণা মূর্ত হতো। কখনো আবার রং তাঁর ক্যানভাসে থাকে জোট বেঁধে, কখনো ঘন অথবা হালকা নিটোল প্রলেপে স্থির প্রত্যয়ে। রঙের এত রকম বিচিত্র ব্যবহার তিনি করেছিলেন অনেকগুলি উদ্দেশ্যে। এক তো রঙের মাধ্যমে বিষয়কে ফুটিয়ে তোলা, তারপর রংকে ফর্মের একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশে পরিণত করা; অথবা রং দিয়ে জীবনের আতঙ্ক আর ভয়াবহতাকে প্রকট করা। এগুলির পাশাপাশি রং দিয়ে তিনি রংহীনতার শঙ্কাকেও জাগিয়ে তুলতেন। কেমন হয়, যদি রংগুলি আমাদের তীব্র তীক্ষ্ণ অনুভূতিগুলি জাগিয়ে হঠাৎ নিরুদ্দেশ হয়ে যায়? আর আমাদের চারপাশে জেগে থাকে ধূসর এক রংহীন জগৎ?
এরকম ভাবার কারণ আছে। বেকনের ছবিগুলির দিকে তাকালে বোঝা যায়, কিছু কিছু চিত্রকল্প, বস্ত্ত বা ভাবনা ঘুরেফিরে আসে। চিৎকার দিতে থাকা মুখের ছবি যেমন, অথবা মৃত জন্তু অথবা কাচের খাঁচা, অথবা কালো ছাতা। অনেক ছবিতে ভাবনাকে অধিকার করে থাকে অসুখ এবং মাদকের ছোবলে অনুভূতি হারানো মনের ও শরীরের অবশ একটি ভাব। বেকন নিজে এরকম অসুখ ও অবশতার শিকার হয়েছেন, আয়ারল্যান্ডে অথবা বার্লিনের সমকামী সমাজে প্রচুর সহিংসতার সাক্ষাৎ পেয়েছেন। কিন্তু সহিংসতাকে, অসুখকে তিনি চূড়ান্ত বলে স্বীকার করতে চাননি। আতঙ্ক যেমন আছে জীবনে, একটা স্থির কেন্দ্রও নিশ্চয় আছে। মাংস যদি নিষ্ঠুরতার কথা মনে করিয়ে দেয়, তার রং তো একটা বিপরীত চিন্তাকেও জাগাতে পারে। বেকন বিশ্বাস করতেন, শিল্প কখনো কোনো দৃষ্টিভঙ্গি, ভাবনা, আদর্শবাদ অথবা প্রবণতায় সীমাবদ্ধ হতে পারে না। শিল্পের অঞ্চল ক্রমপরিবর্তনশীল ও বর্ধমান। তবে শিল্প আমাদের জীবনের ভয়াবহ বাস্তবতা থেকে, মনস্তত্ত্বের জটিল এবং দুঃস্বপ্নতাড়িত অঞ্চল থেকে চোখ ফিরিয়ে নিতে পারে না। শিল্প ও শিল্পীকে এ ভয়াবহ বাস্তবতাকে উপজীব্য করতেই হয়, কিন্তু শেষ পর্যন্ত সুড়ঙ্গের শেষে একটা সরু আলো হলেও তা শিল্পীকে দেখাতে হয়, অথবা দেখানোর অভিপ্রায় তাঁর থাকতে হয়।
বেকন বিশ্বাস করতেন, শিল্প কোনো বস্ত্তর রূপায়ণ নয় বরং অনুভূতির অঞ্চলগুলিতে আলো ফেলা, তাদের আলাদা করা। তিনি বলতেন, একটা শামুক যখন যায় একটা পথ দিয়ে, তখন সে যেমন তার শরীরের একটা স্পর্শ রেখে যায় তার চলার দাগজুড়ে, শরীরকে ক্ষয় করে করে, শিল্পও
সেরকম – যেখান দিয়ে তা যায়, রক্তমাংসে জীবনের চলার দাগটি টেনে যায়। জীবনকে বেকন দেখতেন এক যুক্তিহীন খেলা হিসেবে। তিনি বলতেন, মানুষ একটি দুর্ঘটনার নাম এবং তার জীবনটা নিরর্থক। তাহলে এই দাগ রেখে যাওয়া কেন? শতবর্ষ-প্রদর্শনীটি দেখতে দেখতে আমার মনে হয়েছে, জীবন যুক্তিহীন খেলা বটে, কিন্তু এই যুক্তিহীনতাই আমাদের যুক্তি। আমাদের বিজ্ঞানের যুক্তিগুলি একসময় আণবিক বোমা তৈরি করেছে, স্কুলের বাচ্চাদের এক গ্রীষ্মদিনের শুরুতে বার-বি-কিউ করার জন্য। আমাদের অর্থনীতির যুক্তিগুলি গরিবের পেটে লাথি মেরে ধনীর বর্তনে পোলাও-কোর্মা ঢেলে দিচ্ছে। তাহলে জীবনের যুক্তি কী? নাকি বেকনের ‘থ্রি স্টাডিজ ফর ফিগারস অ্যাট দ্য বেস অফ এ ক্রুসিফিকশন’ (১৯৪৪)-এর যুক্তিটাই যুক্তি, যেখানে একটি মাঠে নামছে শকুনের মতো দানবীয় একটি পাখি (শুরুতে বেকনের চিন্তা ছিল ঘাসের মধ্যে একটি শিম্পাঞ্জি অাঁকার)? পাখিটি কার প্রতিনিধিত্ব করে – এই প্রশ্ন ওঠার সঙ্গে সঙ্গে আমরা বুঝি, পাখিটি আমরা নিজে। আর এই ক্রুশবিদ্ধতা কেন এত প্রিয় বেকনের কাছে? কারণ ক্রুশবিদ্ধতা হচ্ছে, সেই যিশুর সময় থেকে, মানুষকে টাঙ্গিয়ে-লটকিয়ে-ঝুলিয়ে-শূলে চড়িয়ে তাকে রক্তাক্ত করে বীভৎস এক আনন্দের, এবং তা দেখার প্রতিফলিত বীভৎস আনন্দের, প্রতীক। মানুষ যে মানুষকে রক্তাক্ত করে আনন্দ পায়, এর পেছনে একটা যুক্তি মানুষ খাড়া করে বটে – নৈতিকতার, ধর্মের অথবা আইনবিধির। কিম
এ-বাস্তবতায় নীতি-ধর্ম-আইন এসব কিছুই নেই, আছে অপার বীভৎসতা। তবে বেকনের ছবিতে ধর্মীয় বিষয় আসেনি তাঁর প্রায় জঙ্গিবাদী নাস্তিকতার জন্য। তিনি মানুষের ও প্রতিষ্ঠানের নীতি-নৈতিকতাকেও দেখেছেন সন্দেহ-অবজ্ঞা-করুণার চোখে। এসবের আড়ালে মানুষ একেকটা মাংসের পিন্ড। আর কিছু নয়। আর পোপদের নিয়ে যে অনেক ছবি এঁকেছেন বেকন, সেগুলিতে তাঁরাও তো সেই খাঁচায় আবদ্ধ প্রাণী। এক পরিত্রাণহীন চিৎকারে বিশ্ব কাঁপান অনেকে। এই অরক্ষিত বিশ্বে কে বা পোপ, কে পাপী; কে ক্ষত্রিয়, কে নমঃশূদ্র।
পোপ দশম ইনোসেন্টের প্রতিকৃতি এঁকেছিলেন ভেলাসকুয়েস। সেটি চোখে লেগেছিল বেকনের সারা জীবন। ভেলাসকুয়েসকে তাঁর মনে হতো ‘দৈব’ এবং ‘রহস্যময়তা’র সংমিশ্রণ, মানুষের গভীরতম অনুভূতিগুলিও যিনি সহজে ফুটিয়ে তুলতে পারতেন। ভেলাসকুয়েস ছিলেন বেকনের এক নায়ক, অন্য নায়ক ছিলেন পিকাসো। প্যারিসের পল রোজেনবার্গ গ্যালারিতে ১৯২৮ সালে পিকাসোর ছবির প্রদর্শনী দেখে বেকন মজে গিয়েছিলেন। তাঁর আরেক পছন্দের শিল্পী ছিলেন ষোড়শ শতকের মাথিয়াস গ্রুয়েনওয়াল্ড, যাঁর জ্যামিতিক ভাবনা বেকনের অনেক ফর্মকে সঞ্জীবিত করেছে এবং যাঁর ‘এপিলেপটিক প্রলাপে’র তীব্রতাও বেকন তাঁর ছবিতে ধরে রেখেছেন। কিন্তু বেকন যখন পোপ এঁকেছেন, ফর্মের ও ফিগারের ভাংচুর করেছেন, ভীতিকর এবং আতঙ্কিত চিৎকারের ছবি এঁকেছেন, তখন এই তিন শিল্পী থেকে অনেকটা দূরে, স্বতন্ত্র একটি চিত্রভাষা তিনি নির্মাণ করেছেন, যাতে শব্দ যোগ হয়েছে, স্পর্শও যোগ হয়েছে। আমি দেখেছি, বিরাট নিষেধ থাকা সত্ত্বেও মেট-এর প্রদর্শনীতে কোনো কোনো দর্শক ক্যানভাসের দিকে হাত বাড়িয়েছেন। এরকম তীব্র, নিঃশ্বাস বন্ধ করা ক্যানভাস তো একটিবার ছুঁয়ে দেখতেই হয়।
কিন্তু বেকন যে জীবনকে যুক্তিহীন বললেন এবং মানুষের জীবন একটি দুর্ঘটনা ও নিরর্থক একটি বিষয় বললেন, তার পেছনে কী কারণ সক্রিয় ছিল? তাঁর যে-কোনো জীবনীগ্রন্থ অথবা তাঁকে নিয়ে লেখা দু-একটি বই, যেমন মাইকেল পেপিয়াটের অত্যন্ত মনোগ্রাহী ফ্রান্সিস বেকন : অ্যানাটমি অফ এন এনিগমা (নিউইয়র্ক, স্কাইহর্স পাবলিকেশনস, ২০০৯) পড়লে বোঝা যাবে, এর পেছনে ছিল বেকনের বেড়ে ওঠা, তাঁর জীবনের নানা ঘটনা-দুর্ঘটনা, তাঁর সমকামিতা এবং যৌনতা, তাঁর অসুস্থতা (অ্যাজমার রোগী ছিলেন সারাজীবন) ক্ষোভ-বেদনা এবং অপূর্ণতার নানা সূত্র। তাঁকে পরিবারের মধ্যে সবচেয়ে দুর্বল, পলায়নপর ইত্যাদি বলা হয়েছে, শুরুর যৌবনে তিনি ছন্নছাড়া জীবন কাটিয়েছেন, যৌনসুখের সন্ধান করেছেন এবং শিল্পী হিসেবে নিজের মূল্যায়নকে বিলম্বিত হতে দেখেছেন। কিন্তু পেপিয়াট যে ‘এনিগমা’ বা রহস্যের ব্যবচ্ছেদ করতে চেয়েছেন তাঁর বইতে, তা প্রধানত বেকনের জীবনের নানা বৈপরীত্য ও অসংগতি থেকে উদ্ভূত। সেগুলিকে একটা যুক্তিযুক্ত ব্যাখ্যায় দাঁড় করানোর চেষ্টা করেছেন পেপিয়াট। এর বাইরেও ছিল কিছু ঘটনা, যা একদিকে বেকনকে হতাশ করছে, অন্যদিকে নিজের একটা পথ খুঁজে নেওয়ার তাগিদ দিচ্ছে। যেমন, বাবার সঙ্গে বেকনের প্রায় ছাড়াছাড়িই হয়ে গেয়েছিল দুজনের দৃষ্টিভঙ্গিগত পার্থক্যের জন্য। কিন্তু বাবার মৃত্যু হলে তাঁর মধ্যে তীব্র হতাশার সৃষ্টি হয়। এর মধ্যে ছিল তাঁর শৈল্পিক উচ্চাশার ঘরে অপ্রাপ্তি। কিন্তু এর মধ্যেই যুদ্ধের বছরগুলিতে, ত্রিশ-চল্লিশের দশকে, তিনি শিল্পী হিসেবে নিজেকে সংগঠিত করেছেন। একসময় যুদ্ধের সৈনিক হিসেবে নাম লেখানোর চেষ্টা করেছেন, কিন্তু অ্যাজমা রোগের জন্য ডাক্তারি তদন্তে বাদ পড়ে গেলেন। তাঁর পরিবারের ইতিহাসে যুদ্ধে যোগ দেওয়ার উদাহরণ ছিল – হয়তো এ-কারণে একটা চেষ্টা করেছিলেন, কিন্তু শেষ পর্যন্ত যোগ দিলেন সিভিল ডিফেন্সে এবং এয়ার রেইড প্রিকশনসে স্বেচ্ছাসেবী হিসেবে কিছু সময় কাজ করলেন। পেপিয়াট জানান, সম্মিলিত যুদ্ধ-প্রয়াস বেকনের কাছে অগ্রহণযোগ্য ছিল। ‘শিল্পী তাঁর চারদিকে যে ভয়াবহ কষ্ট ও দুর্গতি দেখেছেন, সেসবের প্রতি অত্যন্ত সংবেদনশীল ছিলেন। তিনি দেখেছেন ঘরবাড়ি বোমার আগুনে পুড়েছে, ছাদটাদ সব উড়ে গেছে, গৃহবাসীরা মারা পড়েছে, অথবা অঙ্গ হারিয়েছে এবং বিধ্বস্ত ঘরবাড়ির নিচে চাপা পড়েছে’ (১০১)। বিমান হামলার জন্য অপেক্ষাটা প্রায়শই হামলার চেয়েও ভয়াবহ হয়ে দাঁড়াত। পেপিয়াট আরো জানান, কমলা রঙের আগুনের শিখায় যখন পুড়ত চারপাশ তখন তিনি ভাবতেন, শুধু যে চোখের সামনের একটা ধ্বংসযজ্ঞ আমাদের ভীত করে তা নয়, সম্ভাব্য সকল ধ্বংসের জন্য আমরা বসে থাকি, প্রতিদিন।
বেকন সারাজীবন দেখেছেন, জীবন ক্রমাগত কঠিন হচ্ছে, জীবনের দরজাগুলি মানুষের মুখের ওপর বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। যুদ্ধকালীন তাঁর অভিজ্ঞতা তাঁকে শেখালো, মানুষের সবচেয়ে সাজানো সংসার, জীবন, চিন্তা, শিল্প – সবই মুহূর্তের ঝাপটায় হারিয়ে যেতে পারে। এই যে শূন্যতার অভিজ্ঞা, নেতির ভাবনা – এর সামনে জীবনের যুক্তিগুলি কি টিকে থাকতে পারে? অথবা যখন বিধ্বস্ত দালানের নিচ থেকে তিনি উদ্ধার করছেন একটি শিশুর লাশ, তখন কি তাঁর চিন্তায় জীবনকে খুব অর্থপূর্ণ মনে হতে পারে? তিনি ভাবতে পারেন, মানুষ খুব বড় উদ্দেশ্য থেকে জন্মায়? অথচ তিনি নিজে যুদ্ধে যেতে চেয়েছিলেন; না গিয়ে মানুষকে বাঁচানোর কাজে নামলেন। তাঁর কাছে জীবন খুব যুক্তিযুক্ত হলে নিশ্চয় এই বিপরীত প্রয়াসে তিনি যুক্ত হতেন না।
প্রদর্শনীতে বেকনের ছবি দেখতে দেখতে আমার মনে হয়েছিল, তিনি যে যুক্তিহীনতা আর অর্থহীনতার কথাগুলি বলেছেন, সেগুলির একটি ব্যাখ্যা আমদের সময়ের প্রেক্ষাপটেও তো দেওয়া যায়। এবং এই ব্যাখ্যাটিতে উত্তরাধুনিকতার একটা মাত্রা যুক্ত হতে পারে। এ-কথাটি মনে হওয়ার পর প্রদর্শনীটি আরেকটু সময় নিয়ে দেখলাম। আমার মনে হলো, বেকন আজীবন প্রতিষ্ঠানের, শক্তিকেন্দ্রের, কাঠামোচিন্তার বিপরীতে দাঁড়িয়েছেন। এই যে পোপের ছবিকে আতঙ্কের আর অসহায়ত্বের আবরণে তিনি নিয়ে আসেন, তাতে এই শক্তিধর প্রতিষ্ঠানটি তার প্রাতিষ্ঠানিক শক্তি হারায়। তাঁর ছবিতে ঠাট্টার বিষয়টি হৃদয়হীন; তাঁর আয়রনি ভাবনাকে বিপর্যস্ত করে। তাঁর ছবিতে তিনি নিজে থাকেন কিছুটা জায়গাজুড়ে এবং যতক্ষণ থাকেন, তিনি নিজেকেও যেন পরীক্ষা করে যান, নিজেকে শক্তিশালী কেউ হিসেবে দেখান না। বরং দু-এক আত্মপ্রতিকৃতিতে তিনি বিপন্ন, যেন যা ঘটছে চারদিকে তার প্রভাবে তিনি কেন্দ্রচ্যুত হয়েছেন। উত্তরাধুনিক শিল্পের মতো তাঁর ছবিতেও নানান জন্রা এসে জড়ো হয়। ফটোগ্রাফির প্রতি দুর্বলতা ছিল বেকনের – এই প্রদর্শনীতে তাঁর স্টুডিও থেকে সংগৃহীত যে চৌষট্টিটির মতো অন্যান্য কাজ স্থান পেয়েছে, সেগুলির মধ্যে ফটোগ্রাফও আছে। সিনেমা থেকেও তিনি অনুপ্রেরণা নিয়েছেন। ‘দ্য পিকচারস্ জেনারেশন’ নামে ফটোগ্রাফির আদল বদলে দেওয়া শিল্পীদের (যেমন এডওয়ার্ড মুইব্রিজ ১৮৩০-১৯০৪) কাজ থেকেও অনুপ্রেরণা পেয়েছেন বেকন। মঞ্চনাটকের কিছু উপাদানও গ্রহণ করেছেন; বিশেষ করে নাটকের কোনো চরিত্রের ওপর আঘাত আসা, সেই আঘাত সামলে নেওয়া, বা সেই আঘাতে লুটিয়ে পড়া এবং সীমিত একটি পরিসরে কীভাবে তীব্র অনুভূতিগুলি প্রকাশ করা যায়, সেই বিষয়গুলি। প্রদর্শনীতে বেকনের টুকরো টুকরো অনেক কাজও দেখানো হয়েছে, যেমন ছোট কাগজে অাঁকিবুঁকি রং চালানো, কোনো ম্যাগাজিনের একটি লেখার ওপর রক্তের ঘষামাজা। একটি ছবিতে দেখা যাচ্ছে, ভারতীয় ক্রিকেট দলের একসময়ের উইকেটরক্ষক সৈয়দ কিরমানি ক্যাচ ধরে আকাশে লাফ দিয়েছেন। সেই ছবিতেও রং চালিয়েছেন বেকন। অর্থাৎ তাঁর ছবিকে শুধু রং-তুলিতে সীমাবদ্ধ না রেখে নানাভাবে বিস্তৃত হতে দিয়েছেন। কিন্তু উত্তরাধুনিক শিল্পের সঙ্গে শুধু এ পর্যন্তই তাঁর মিল। তারপরে যা ঘটে তাঁর ছবিতে, তা প্রকাশবাদের শক্তিশালী চিন্তার স্ফুরণ। কিন্তু উত্তরাধুনিক উপাদানগুলি তাঁকে সাহায্য করে জীবনের মিল-অমিল, যুক্তি-যুক্তিহীনতার একটা খতিয়ান নিতে। এবং হয়তো এ-কারণে তাঁর ছবিতে সিদ্ধান্তমূলক কিছু নেই, যেমন আগে বলেছি, আতঙ্ক ও ভয়াবহতাও কোনো চূড়ান্ত সত্য নয় তাঁর ছবিতে। তিনি স্বীকার করতেন, তাঁর চরিত্রগুলিকে দেখে হয়তো মনে হতে পারে, তাদের কোনো নির্বাণ নেই এবং তারা সংকটের মধ্য দিয়ে চলছে। তিনি তাদের মরণশীলতার বিষয়টি দেখাতে চেয়েছেন, কিন্তু একই সঙ্গে একটা বৈপরীত্যকেও। যদি জীবন আপনাকে উত্তেজিত করে তাহলে এর ছায়া, অর্থাৎ মৃত্যুরও তা করা উচিত। বেকন বিশ্বাস করতেন, একই মানুষ একই সঙ্গে খুব আশাবাদী এবং খুব হতাশ হতে পারে। তিনি যে অর্থহীনতা ইত্যাদির কথা বলেন জীবন নিয়ে, তার একটা সমাধানের ইঙ্গিত (সমাধান নয়) পাওয়া যায় তাঁর নিজের কথা থেকেই। তিনি জানাচ্ছেন, সতেরো বছর বয়সে রাস্তায় কুকুরের বিষ্ঠা পড়ে থাকতে দেখে তাঁর মনে হয়েছিল, মানুষের জীবন যেন এই বিষ্ঠার মতো। অর্থহীন। কয়েক মাস চিন্তাটি তাঁকে পীড়িত করেছে। কিন্তু শেষ পর্যন্ত তিনি এরকম ভেবেছেন যে, আমরা আমাদের জীবনের অর্থহীনতাকে হয়তো জয় করতে পারি কিছু করার একটা ইচ্ছা থেকে। তিনি বিশ্বাস করতেন, কিছু করার একটা ইচ্ছা থেকে শিল্প তৈরি হয়।
বেকনের ট্রিপটিচগুলি সম্বন্ধে কিছু না লিখলে এই লেখাটি অসম্পূর্ণ থেকে যাবে। এ প্রদর্শনীতে বেশ কয়েকটি ট্রিপটিচ ছিল, যার দুটিতে তিনি তাঁর সমকামী বন্ধু জর্জ ডায়ারের সঙ্গে তাঁর সম্পর্কের জটিলতা, তাঁর প্রতি তাঁর আকর্ষণ এবং অপরাধবোধের এক কঠিন সমীকরণের চেষ্টা করেছেন। ডায়ারের অবয়ব অনেকটা জায়গাজুড়ে এঁকেছেন তিনি। একটিতে ডায়ার বসেছেন টয়লেটের সিটে এবং বমি করছেন। এ ছবিতে ডায়ারকে মনে হবে দুর্বল একজন মানুষ, যাকে সহায়তা ও যত্ন দিতে হয়। যত্ন দেওয়ার ব্যাপারটা অবশ্য বেকনের কাছে খুব স্বাভাবিক ছিল না। তাঁকে একবার প্রশ্ন করা হয়েছিল, তিনি ট্রিপটিচে কেন অাঁকেন? বেকন জবাব দিয়েছিলেন, মাঝে মাঝে তিন খন্ডে একটি বিষয়কে দেখতে তাঁর ইচ্ছা জাগে, যেহেতু একটি বিষয় শুধু একটি দৃষ্টিকোণ থেকে দেখলে তা সংকীর্ণ হয়ে যায়। তাঁর বিষয়-আশয় ছিল বিচিত্র এবং তাঁর ছবির একটি বড় উপাদান ছিল গতিশীলতা। এই গতিশীলতা ট্রিপটিচের তিন খন্ডে সঞ্চারিত হলে তা জীবনের নানা অনিবার্যতাকেই তুলে ধরতে পারে। তাছাড়া একটি ট্রিপটিচে তিনি একটি চলমান জীবনের ছন্দ অথবা ছন্দহীনতা যে ক্রমাগতায় তুলে আনতে পারেন, তা একটি চৌকোনো ক্যানভাসে হয়তো সবসময় সম্ভব নয়। তাঁর দুটি ট্রিপটিচ তিনি এঁকেছেন ইসকাইলাসের অরেসটেইয়া এবং টি এস এলিয়টের ‘সুইনি এগোনিস্টেস’ কবিতা পড়ে অনুপ্রাণিত হয়ে। এই অনুপ্রেরণা যে একটা বিশিষ্ট নির্মাণের দিকে তাঁকে নিয়ে গেছে, তা প্রতিটি ট্রিপটিচই তাদের বিস্তারের মাধ্যমে আমাদের জানিয়ে দেয়।
বেকন জন্মেছিলেন ডাবলিনে। তাঁর পূর্বসূরি ছিলেন সেই ফ্রান্সিস বেকন (১৫৬১-১৬২৬), যিনি ষোড়শ ও সপ্তদশ শতকের বিখ্যাত একজন লেখক, চিন্তাবিদ ও রাষ্ট্রনায়ক ছিলেন। শিল্পী ফ্রান্সিস বেকন তাঁর পূর্বসূরি নিয়ে খানিকটা মজাই পেতেন। কারণ পূর্বসূরিও ছিলেন সমকামী। তবে একসময় যে বলা হতো শেক্সপিয়ারের নাটকগুলি আসলে লিখেছিলেন ফ্রান্সিস বেকন, এই সম্ভাবনাটা শিল্পী বেকনকে পুলকিত করত, যেহেতু শেক্সপিয়রের নাটক ও কবিতার তিনি দারুণ ভক্ত ছিলেন। বেকন অবশ্য আরো অনেকের লেখা পড়তেন, পছন্দ করতেন, যেমন ইবসেন এবং নিৎসে। নিৎসের প্রশংসা করে তিনি বলতেন, ফ্রয়েডের চিন্তাগুলি সব নিৎসেতেই আছে।
আর ফ্রয়েডের তত্ত্বগুলি বহুবার বেকনের জটিল মনস্তত্ব বুঝতে প্রয়োগ করেছেন তাঁর জীবনীকার ও গবেষকরা।
তবে বেকন শেষ পর্যন্ত তাঁর সব জটিলতা সত্ত্বেও শিল্পী হিসেবে অপাঠযোগ্য মোটেও নয়। তাঁর প্রথাগত শিক্ষা ছিল সামান্যই এবং মাঝে মাঝে নিজেকে প্রকাশ করতে তাঁর বেশ সমস্যা হতো। কিন্তু যা বলতেন, পষ্টাপষ্টি বলতেন। সেজন্য একটা মাত্রায় তিনি বেশ অনর্গল কথা বলে যেতেন। ইউটিউবে সম্প্রতি বেকনের দুটি সাক্ষাৎকার শুনে মনে হলো, তিনি যেন একসময় জটিলতাকে অজটিল করে তুলছেন, আর যা অজটিল, তাকে কোনো কোনো সময় নেহাতই জটিল করে তুলছেন। অথচ সাক্ষাৎকার দুটি তাঁর ছবির পরিপ্রেক্ষিতে স্থাপন করলে তাঁর চিন্তাগুলি বুঝতে কোনো অসুবিধা হয় না।
তাঁর ছবিও জটিল-অজটিলের একটি ধূসর সমীকরণ তৈরি করে চলে, যদিও ছবির দর্শক শেষ পর্যন্ত বুঝতে পারেন, বেকন কী বলতে চান। এখানেই তাঁর বিশেষত্ব।