logo

রবিশঙ্কর

এ বা দু ল  হ ক  সৈ ক ত
গত ১২ ডিসেম্বর সকাল ৯টা নাগাদ রেওয়াজে বসার প্রস্তুতি নিচ্ছিলাম প্রতিদিনের মতো। হঠাৎ আমার এক প্রিয় ভাই বন্ধু হাসানের ফোন। ও বলল, ‘দাদা জানেন কি রবিশঙ্করজি…?’ আমি বললাম, কখন? ও বলল, একটু আগে টেলিভিশন স্ক্রল দেখে জানলাম। খবরটা শুনেই বুকের ভেতর একটা প্রচণ্ড কষ্ট অনুভব করলাম, যা আমি হয়তো এ জীবনে কখনো পাইনি।
ছোটবেলা থেকে গানবাজনার প্রতি আমার আগ্রহ ছিল বটে, কিন্তু গানবাজনাই আমার নেশা-পেশা হবে সেটা কখনো ভাবিনি সে-সময়। যখন আমি অষ্টম শ্রেণির ছাত্র তখন প্রথম পণ্ডিত রবিশঙ্করের বাজনা শুনে সেতারের প্রেমে পড়ে যাই এবং ভাগ্যচক্রে আজ আমি মাইহার ঘরানার রবিশঙ্কর বাজের ধারক ও বাহক। আমার পূর্বতন গুরু স্বর্গীয় পণ্ডিত দীপক চৌধুরী ও বর্তমান গুরু পণ্ডিত কার্তিক শেষাদ্রি দুজনই রবিশঙ্করের সুযোগ্য শিষ্য এবং তাঁদের সান্নিধ্যে এসে এই আমি অসামান্য মানুষটির সংগীতে অবদান সম্পর্কে বুঝতে শিখেছি। ভারতীয় মার্গসংগীত হলো ‘কর্তাবিদ্যা’, মানে দাঁড়ায় আগে করো তবে এর মর্ম অনুধাবন করতে পারবে। আমি জানি না, তা কতদূর করতে পেরেছি।
সারা পৃথিবীতে রবিশঙ্কর পণ্ডিতজি নামে পরিচিত। তিনি রাগ-রাগিণীর শুদ্ধতার ক্ষেত্রে তাঁর গুরুবাবা আলাউদ্দিন খাঁ সাহেবের শিক্ষার বাইরে কোনোদিন এক বিন্দু পরিমাণ হাঁটেননি। সেদিক থেকে তিনি সিদ্ধ পুরুষ। তিনি রাগ-রাগিণীর দাবি অনুযায়ী সারাজীবন তার রূপায়ণ করে গেছেন এবং তাঁর বাজনার যে গভীরতা, যে নির্মল আনন্দ, তা খুব কম মানুষের বাজনায় রয়েছে। সেদিক থেকে তিনি সত্যিই অনন্য।
পণ্ডিত রবিশঙ্কর ভারতীয় শাস্ত্রীয় সংগীতকে সারা পৃথিবীতে ছড়িয়ে দিয়েছেন। আজ আমাদের সংগীতের এত শ্রোতা তৈরির মূল কারিগর তিনি।
পণ্ডিত রবিশঙ্কর গুরুবাবা আলাউদ্দিন খাঁ সাহেবের কাছে শিক্ষা শুরুর আগে প্যারিসে থাকতেন তাঁর দাদা পণ্ডিত উদয়শঙ্করের সঙ্গে। প্যারিসেই আলাউদ্দিন খাঁর সঙ্গে রবিশঙ্করের একটা সম্পর্ক গড়ে ওঠে। তিনি তাঁর শিষ্যত্ব গ্রহণ করে সোজা মাইহারে চলে আসেন। পণ্ডিতজি মাইহারে থাকাকালীন আলাউদ্দিন খাঁ সাহেবের মেয়ে অন্নপূর্ণার সঙ্গে তাঁর বিয়ে হয়। মাইহারের শিক্ষা পর্ব শেষ করে রবিশঙ্কর বোম্বে চলে যান। সেখানে তিনি কিছুকাল আইপিটিএর সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। তিনি কিছু সময় অল ইন্ডিয়া রেডিওতে কাজ করেছেন। রবিশঙ্কর জীবনে বেশকিছু চলচ্চিত্রে সংগীত পরিচালনা করেছেন। অনেক গান রচনা করেছেন, অনেক গানে সুরারোপ করেছেন। এগুলো গেল তাঁর একটা দিক, অন্যদিকে তিনি একজন সত্যিকারের শিল্পী, মানুষ ও গুরু। তাঁর বেশকিছু শিষ্য রয়েছেন। তাঁরা প্রত্যেকেই সংগীতকে সমৃদ্ধ করছেন।
অসামান্য জীবনবোধ, রসবোধ, রুচিবোধ, সৃষ্টি ও বাজনার মাধুর্যে পণ্ডিত রবিশঙ্কর বেঁচে থাকবেন আমাদের মাঝে।
রবিশঙ্কর বেশকিছু রাগ-রাগিণী সৃষ্টি করে গেছেন – পরমেশ্বরী, তিলকশ্যাম, যোগেশ্বরী, কালেশ্বরী, ইয়ামন মান্বা, রসিয়া প্রভৃতি। তাঁর বাদনশৈলীতে মুগ্ধ হয়ে ইয়েহুদি মেনুহিন আলোড়িত হয়েছেন। জর্জ হ্যারিসনসহ বহু পাশ্চাত্য সংগীতজ্ঞ তাঁর শিষ্যত্ব গ্রহণ করেছেন। এভাবেই প্রাচ্য ও পাশ্চাত্যের মিলন সম্ভব হয়েছিল।
রবিশঙ্করের জীবনের মূল চালিকাশক্তি ছিলেন আলাউদ্দিন খাঁ সাহেব, তাঁর শিক্ষা, তাঁর দর্শন।
১৯৭১ সালে সেই ম্যাডিসন স্কয়ারের কনসার্টের কথা সবারই জানা। রবিশঙ্কর ওস্তাদ আলী আকবর খাঁ সাহেবকে সঙ্গে নিয়ে অসংখ্য যুগলবন্দি বাজিয়েছেন, যদিও তাঁদের জীবনের শেষ যুগলবন্দি ১৯৮৩ সালে নিউইয়র্কের কার্নেগি হলে। একটা সময় তাঁদের যুগলবন্দি খুবই জনপ্রিয় ছিল রসিক শ্রোতার কাছে এবং সংগীতের ইতিহাসে এত ভালো যুগলবন্দি খুব কম রয়েছে। তিনি সবসময় নিয়মের মধ্যে থেকে নিয়ম ভেঙেছেন এবং প্রাচ্য ও পাশ্চাত্যের সংগীতের মিলমিশ ঘটিয়েছেন, তৈরি করেছেন প্রচুর কম্পোজিশন, যা এক কথায় অসামান্য।
মোটাদাগে বলতে গেলে পণ্ডিত রবিশঙ্কর একজন সত্যিকার অর্থে মানুষ, শিল্পী ও গুরু। তিনি আমাদের ছেড়ে চলে গেছেন ঠিক, কিন্তু তাঁর সৃষ্টির মাধ্যমে আমাদের মাঝে বেঁচে আছেন, থাকবেন।

Leave a Reply