logo

গ্র ন্থ প রি চি তি

ছবির রবীন্দ্রনাথ

মৃণাল ঘোষ

অভিযান পাবলিশার্স

কলকাতা ১২৪

মূল্য : ৪৫০ টাকা

 

রবীন্দ্র-প্রতিভা বনস্পতির মতো, বিচিত্র ধারায় বহুদূর বিস্তৃত। প্রতিটি ধারাই স্বকীয় মৌলিকতায় অভিনব। ভাবনার বিস্তার প্রচলিত রীতি-পদ্ধতির একেবারে বাইরে। তাঁর চিত্রকলা সম্পর্কেও একই কথার পুনরাবৃত্তি করতে হয়। জীবনের অপরাহ্ণ বেলায় আঁকা ছবির সামনে দাঁড়ালে বিস্ময়ে বিমূঢ় হতে হয়। শেষ বয়সে ছবি আঁকার অতুগ্র নেশায় মশগুল হয়েছিলেন। ১৯৩০-এ প্রতিমা দেবীকে এক পত্রে রবীন্দ্রনাথ লিখছেন, ‘ছবি কোনদিন আঁকিনি। আঁকব বলে স্বপ্নেও বিশ্বাস করিনি … জীবন গ্রন্থের সব অধ্যায় যখন শেষ হয়ে এল, তখন অভূতপূর্ব উপায়ে জীবন দেবতা এর পরিশিষ্ট রচনার উপকরণ যুগিয়ে দিলেন।’

সতেরো বছর বয়সে লেখা ‘মালতী’র

পাণ্ডুলিপিতে প্রথম লক্ষ করা যায়, রবীন্দ্রনাথ সংশোধনের খাতিরে লেখার সঙ্গে কাটাকুটি করা রেখাকে সুসংঘবদ্ধ করার চেষ্টা করছেন।

এ-প্রবণতা প্রবল হতে থাকে ১৯ সালে পূরবী কাব্যগ্রন্থ রচনার সময় থেকে, এবং ক্রমেই রেখা জালের অন্তর থেকে উদ্ভাসিত হয়ে উঠতে থাকে অদ্ভুত দর্শন সব আকার-আকৃতি। ক্রমপরিণতিতে ওই আকার আয়তন চিত্রময় হয়ে উঠতে থাকে। রং দিয়ে ছবি আঁকার সূত্রপাত অবশ্য অনেক পরে। নিসর্গ, নগ্নমূর্তি, কিম্ভূতকিমাকার জীবজন্তু এবং কিছু মুখাকৃতি দেখা যায় ছবির রূপ পরিকল্পনায়। শিল্পবেত্তারা রবীন্দ্র চিত্রলেখায় যেমন বিমূর্ত ব্যঞ্জনা লক্ষ করেছেন, তেমনি আবার অভিব্যক্তিবাদ এবং অন্যান্য অনুপ্রেরণার কথাও বলেছেন। কিন্তু মনে হয় যেটা বলা হয়েছে সেটা নিতান্তই ছবির আঙ্গিক সম্পর্কে দর্শককে একটা ধারণা দেওয়ার উদ্দেশ্যে। কিছুটা প্রভাব বা অনুপ্রেরণা থাকলেও তা কখনো ছবির স্বতন্ত্র স্বতঃস্ফূর্ত স্বাধীন সংবেদনাকে ভারাক্রান্ত করেনি। তাই রবীন্দ্র-চিত্রকলা কোনো নির্দিষ্ট শিল্পরীতি-পদ্ধতির অন্ধ অনুসরণ বা অনুকরণ নয়। চোখে দেখা অভ্যস্ত ধ্যান-ধারণার একেবারে বাইরের ছবি। এসব কথা আজ আর নতুন করে বলার অপেক্ষা রাখে না। তবে জীবনসন্ধ্যায় রচিত চিত্রকলার গুণাগুণ ও মান সম্পর্কে রবীন্দ্রনাথের মনে যে কিছুটা সংশয় ছিল তা কবির নানা মন্তব্যে সুস্পষ্ট। এখানে একটির উল্লেখ করি। ২১ ভাদ্র ১৩৩৮-এ ধুর্জটিপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়কে লেখা এক পত্রে কবি লিখেছেন, ‘শেষ বয়সে আমার গ্রহ আমাকে ছবিতে লাগিয়েছেন, কি তার মতলব জানিনে, কিন্তু ব্যাপারখানা একই। কোন শ্রেণীতে অর্থাৎ কোন ভদ্র পঙ্ক্তিতে এগুলোকে বসানো যেতে পারে তা নিয়ে তর্ক উঠবে। একটা সুবিধে এই যে, যদিও কবিতা পনেরোআনা লোকে লেখে, গান বারো আনা লোকে গায়, ছবি ছ আনার বেশি আঁকে না। তাই আওয়াজটা কম হবে।’

রবীন্দ্রনাথ পরলোকগমন করেছেন ১৯৪১ সালে। ইতিমধ্যে প্রায় একাত্তর বছর অতিক্রান্ত হয়েছে। প্রকৃতির স্বাভাবিক নিয়মে জীবন, সমাজ, শিল্প-সংস্কৃতির অনেক পরিবর্তন হয়েছে। প্রতিনিয়ত হচ্ছে। মানুষের চিন্তাভাবনা, মূল্যবোধ নবীন ভাবনায় নিরন্তর আলোড়িত হচ্ছে। শিল্পকলার সনাতন বোধগুলো ক্রমেই অপস্রিয়মাণ ছায়ার মতো দূরে সরে যাচ্ছে। মডার্নকে অতিক্রম করে শিল্পকলা হাঁটতে শুরু করেছে আরো অতি আধুনিকতার পথে। শিল্পবেত্তারা একে ‘পোস্ট-মডার্ন’ নামে চিহ্নিত করেছেন, যদিও এই ‘পোস্ট-মডার্ন’ শিল্পকলা এবং তার কাল নির্ণয় নিয়ে বিতর্ক আছে। যাই হোক, এখানে আর সে-প্রসঙ্গে যাচ্ছি না। তবে এটা ঠিক আঙ্গিক, উপাদান, রূপকল্প প্রভৃতি দিক থেকেই শিল্পকলার বৈপ্লবিক পরিবর্তন ঘটতে শুরু করেছে। সমকালীন দ্রুত পরিবর্তিত এই পটভূমিতে বহুমাত্রিক রবীন্দ্র-সৃষ্টিকে নানান দৃষ্টিকোণ থেকে ফিরে দেখা হচ্ছে। তাঁর সার্ধশত জন্মবর্ষ উপলক্ষে দেশব্যাপী উৎসব-অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়েছে। বহুমুখীচিত্র কর্মকাণ্ড নিয়ে আলাপ-আলোচনা হচ্ছে। চিত্রকলা নিয়েও প্রদর্শনী হয়েছে। লেখালেখি হচ্ছে। কয়েকটি পুস্তকও প্রকাশিত হয়েছে।

এই বছরের জানুয়ারিতে প্রকাশিত ছবির রবীন্দ্রনাথ নামে ১৮৪ পৃষ্ঠার সুমুদ্রিত একটি বই আমার হাতে এলো। বইটির লেখক মৃণাল ঘোষ। তিনি শিল্পভাবুক ও গবেষক। একটি বহুল প্রচারিত সংবাদপত্রে প্রায় দুই দশকের ওপর নিয়মিত শিল্পসমালোচনা লিখে আসছেন। বিভিন্ন

পত্র-পত্রিকায় পাঠকরা তাঁর লেখা পড়ে থাকবেন। এছাড়া তিনি বেশ কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ শিল্পকলা গ্রন্থের লেখক।

আলোচ্য গ্রন্থটি মৃণাল ঘোষের লেখা আটটি রবীন্দ্রনাথের চিত্রকলাবিষয়ক প্রবন্ধের সংকলন। বিভিন্ন সময়ে পত্র-পত্রিকায় লেখাগুলো ছাপা হয়েছে। সেগুলো এখানে দুই মলাটে একত্রিত হয়েছে। প্রথম রচনাটি রবীন্দ্রনাথের গান ও ছবি নিয়ে। এই দুটি বিষয়েই কবির অনুরাগ ছিল গভীর। ছিন্নপত্রাবলীতে একটি চিঠিতে তিনি লিখছেন, ‘সেই জন্যে আমার মনে হয় বিশুদ্ধ আর্ট হচ্ছে ছবি এবং গান – সাহিত্য নয়।’ (১৮৯৪-এর ১৩ জুলাই)। গানের প্রতি কবির আসক্তি আশৈশব। এই লেখাটি পড়ে জানতে পারি প্রথম গানটি ‘গগনের থালে রবি চন্দ্র দীপক জ্বলে’ রচিত হয়েছিল মাত্র এগারো বছর বয়সে। তারপর জীবনভর এই চর্চা অব্যাহত ছিল। কিন্তু চিত্র রচনার শুরু অনেক পরে, ১৯২৩-২৪ সাল থেকে জীবনের প্রায় প্রত্যন্ত বেলায়। তখন তাঁর বয়স তেষট্টি-চৌষট্টি বছর। ১৯২৩-এ রক্তকরবী এবং পরের বছর লেখা পূরবী কাব্যগ্রন্থের পাণ্ডুলিপিতে কাটাকুটির সূত্র ধরে চিত্র রচনার বিষয় পাঠকেরা বোধকরি অনেকেই জানেন। লেখক জানিয়েছেন, এরও আগে ১৯০৫ সালে (২১ আশ্বিন ১৩১২) লেখা খেয়া কাব্যের একটি গানের কাটাকুটিকে এমন সুন্দরভাবে করেছিলেন যে তার মধ্যে চিত্রকল্প ফুটে উঠেছিল। এই দেশাত্মবোধক গানটি হলো ‘বিধির বাঁধন কাটবে তুমি/এমন শক্তিমান!’ শব্দ ও সুর ছন্দবোধ এই দৃশ্য-শিল্প রচনায় অনেকটা সহায়ক হয়েছে। সংযত পরিমিত কাটাকুটির মধ্য দিয়ে পাণ্ডুলিপির পৃষ্ঠাগুলো বিমূর্ততা, অভিব্যক্তিবাদী, লোকায়ত কিংবা আদিমতার আভাসে কেমন করে স্বতন্ত্র প্রকাশভঙ্গিতে আধুনিক হয়ে ওঠে তা লেখক দৃষ্টান্তসহকারে আলোচনা করেছেন। পরের প্রবন্ধ ‘রবীন্দ্রনাথের ছবির নন্দন’। ১৯২৮ থেকে ১৯৪১ পর্যন্ত রবীন্দ্রনাথ পুরোমাত্রায় আত্মনিয়োগ করেছেন রূপলেখায়। এই সময়ে ভারতীয় নন্দন ক্ষেত্রে নব্যবঙ্গীয় চিত্রশৈলীর সঙ্গে সমান্তরালভাবে প্রসারিত ছিল ইউরোপীয় স্বাভাবিকতা-আশ্রিত চিত্রচর্চা। ইতোপূর্বে ইউরোপে প্রায় একশ বছর ধরে ইম্প্রেশনিজম, এক্সপ্রেশনিজম, ডাডাইজম, কিউবিজম, সুররিয়ালিজম, বাওহাউস, ফিউচারিজম, ইত্যাদি শিল্প আন্দোলন সংঘটিত হয়েছে ক্রমান্বয়ে। এসবের সঙ্গে চীন, জাপানের আদর্শায়িত শিল্পকলার সঙ্গেও পরিচিত হয়েছেন। হৃদয়ঙ্গম করেছেন বহুমাত্রিক শিল্পকলার

সারাৎসারকে। মনে হয়, এভাবেই তাঁর শিল্প দৃষ্টির দীক্ষা হয়েছিল। নীরবে নিভৃতে এবং শিল্প রচনা কোনো বিশেষ পিঞ্জরে বন্দিদশাপ্রাপ্ত না হয়ে স্বাধীন চিন্তায় স্বছন্দ বিচরণ করেছেন। শুধু নিজের ছবি আঁকাতে নয়, এই মুক্ত আলোর বিশ্ব-দৃষ্টি তিনি এদেশের মাটিতে ছড়িয়ে দিতে চেয়েছিলেন। ‘বঙ্গীয় কলা সংসদ’ (১৯০৫), ‘বিচিত্রা স্টুডিও’ (১৯১৫), শান্তিনিকেতনের ‘কলাভবন’ (১৯২১) প্রভৃতির মাধ্যমে আজীবন চেষ্টা করে গেছেন শিল্পচর্চায় আধুনিকতাকে প্রসারিত করতে। নিজের আঁকা চিত্রকলাতেও তিনি এ কাজ হাতেনাতে করে দেখিয়েছেন। সেই অভিনব নন্দন স্বাদুতায় অভিষিক্ত রূপকর্মের ইমারত কীভাবে ধাপে ধাপে গড়ে উঠেছে তার বিশ্লেষণ রয়েছে ‘রবীন্দ্রনাথ : ছবির সমগ্রতা’ প্রবন্ধে। ১৯২৩-২৪ থেকে শুরু করে ১৯৪১ পর্যন্ত রবীন্দ্রনাথের চিত্রচর্চার ক্রমবিবর্তন, ছবির আঙ্গিক বৈশিষ্ট্য, রূপকল্পনার উৎস প্রভৃতি ব্যাখ্যা করা হয়েছে দৃষ্টান্তসহকারে। এ ব্যাপারে বিনোদবিহারী মুখোপাধ্যায়, পৃথ্বীশ নিয়োগী, সোমেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়, রতন পরিমু, স্টেলা ক্রামরিশ, দীনকর কৌশিক, বিষ্ণু দে, শঙ্ঘ ঘোষ, শিবনারায়ণ রায়, লোকনাথ ভট্টাচার্য, কৃষ্ণ কৃপালিনী প্রমুখ শিল্পবিদের লেখার প্রসঙ্গ উল্লিখিত হয়েছে, কখনো কখনো উদ্ধৃতি-সহযোগে। এই কাজটি করতে গিয়ে লেখক কী পরিমাণে অনুসন্ধিৎসু ছিলেন তা আঁচ করা যায় উল্লিখিত প্রবন্ধ ও গ্রন্থমালা থেকে। গ্রন্থের পরিশেষে অবশ্য মৃণাল ঘোষ সহায়ক লেখার একটি তালিকা পেশ করেছেন, যা উৎসাহী, শিল্পানুরাগী পাঠককে রবীন্দ্র-চিত্রকলা সম্পর্কে আরো গভীরে যেতে সাহায্য করবে বলে মনে হয়। কবির ছবির মূল্যায়নের কিছু প্রতিধ্বনি শুনতে পাওয়া যায় ‘রবীন্দ্রনাথের ছবির নন্দন’ প্রবন্ধে। ভারতীয় শিল্প-ঐতিহ্য, স্বাদেশিকতা, আধুনিকতা ও বিশ্ব শিল্পের ঘর ও ঘরানা সম্পর্কে সচেতন রবীন্দ্রনাথের স্বকীয় শিল্পচিন্তার পথে সাহসী পদচারণার বিষয়টি তথ্যসহ তুলনামূলক বিচারে পরিস্ফুট হয়েছে।

রবীন্দ্র-সৃষ্টিতে গান, কবিতা, ছবি একাত্ম ও একাকার হয়ে আছে। একে অনেক ক্ষেত্রেই অপরের সঙ্গে সম্বন্ধযুক্ত। গান ও ছবির সম্পর্ক নিয়ে আলোচনার পাশাপাশি এই পুস্তকে রবীন্দ্রনাথের ছবি ও কবিতার পারস্পরিক সম্পর্ক নিয়ে দুটি প্রবন্ধ সন্নিবদ্ধ হয়েছে। একটি ‘চিত্রস্থানিক ধ্বনি – কবিতা ও ছবি’,

অন্যটি ‘রবীন্দ্রনাথ : ছবির কবিতা, কবিতার ছবি’ এই শিরোনামে। প্রকৃতিতে জীবনে প্রত্যক্ষে-অপ্রত্যক্ষে, সর্বত্রই পরিব্যাপ্ত হয়ে আছে কবিতা ও ছবি। দুটি শিল্পই উৎসারিত হয় একই উৎস থেকে। পার্থক্য প্রকাশভঙ্গি ও মাধ্যমের। কবিতা কানে শোনার। ছবি কেবল চোখে দেখার। কবিতায় ভাবমূর্তি গড়ে ওঠে শব্দ সমষ্টির বিন্যাসে। চিত্রে লীলায়িত রেখা ও রঙের ছোপে। ধ্বনিময়, অর্থপূর্ণ এবং আরো কিছু তত্ত্ব প্রয়োগে কবিতায় চিত্রপ্রতিমা বা ইমেজ তৈরি হয়, যাকে বলা যেতে পারে কথার চিত্র। রবীন্দ্র-সৃজনী কল্পনায় এই কথাচিত্র ও পটচিত্রের অন্তর্নিহিত সম্বন্ধ সবিস্তারে বিশ্লেষিত হয়েছে উপরোক্ত দুটি প্রবন্ধে। ‘আজ জ্যোৎøারাতে সবাই গেছে বনে’, ‘কেন চোখের জলে ভিজিয়ে দিলাম না’, ‘তুমি যে সুরের আগুন লাগিয়ে দিলে মোর প্রাণে’ প্রভৃতি গানের উল্লেখ করে দেখানো হয়েছে কবিতার অন্তর্গত চিত্রময়তাকে। অন্যদিকে আবার আলোচিত হয়েছে চিত্রকলার ভেতর ছবির ইমেজারি প্রসঙ্গে। এ বিষয়ে পর্যায়ক্রমে এসে পড়েছে ১৯৪০ সালে কবির লেখা ‘চিত্রলিপি’ এবং ১৩৪০ বঙ্গাব্দে রচিত ‘বিচিত্রিতা’র কিছু প্রসঙ্গ, যা আমাদের পরস্পর নিবিড় সম্পর্কযুক্ত চিত্র ইমেজারি এবং কবিতার চিত্রকে বুঝতে সাহায্য করে। রবীন্দ্র সাহিত্যকে অবলম্বন করে বিভিন্ন পত্র-পত্রিকা ও পুস্তকে অবনীন্দ্রনাথ, গগনেন্দ্রনাথ, নন্দলাল, বিনোদবিহারী মুখোপাধ্যায়, দেবীপ্রসাদ রায় চৌধুরী প্রমুখ বেশ কিছু শিল্পী ছবি এঁকেছেন তাঁদের অনুভূতির রঙে রাঙিয়ে। এই রকম কিছু শিল্প নিদর্শন নিয়ে ২০১০ সালের ডিসেম্বরে একটি প্রদর্শনী হয়েছিল কলকাতায়। এ উপলক্ষে ‘রবীন্দ্র সৃষ্টির অলংকরণ’ নামে একটি পুস্তিকার কথাও লেখক উল্লেখ করেছেন। অভীক কুমার দের গবেষণাপ্রসূত এই প্রদর্শনীটি দেখে আমরা খুবই উপকৃত হয়েছিলাম। রবীন্দ্রনাথের সার্ধশত জন্মবর্ষ উপলক্ষে তাঁর কবিতা, গান, সাহিত্যকে অবলম্বন করে এই সময়ের শিল্পীরা বেশ কয়েকটি অনুষ্ঠানের মাধ্যমে ছবি এঁকেছেন। আকৃতি আর্ট গ্যালারি আয়োজিত ‘টেলস ফ্রম টেগোর’ এবং নন্দন প্রেক্ষাগৃহে প্রদর্শিত সঞ্জয় ঘোষের ভিডিও সম্পর্কে মৃণাল ঘোষ সংক্ষিপ্ত আলোচনায় বলেছেন সমকালীন কয়েকজন রূপকার কীভাবে রবীন্দ্র সাহিত্যকে নিজেদের চেতনার আলোকে রঙে-রসে উদ্ভাসিত করেছেন। এই পুস্তক প্রকাশের পরবর্তীকালে আরো কয়েকটি রবীন্দ্র বিষয় ও সাহিত্যকে ভিত্তি করে আর্ট ক্যাম্প হয়েছে। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য দুটি শিল্প শিবিরের কথা বলি। একটির আয়োজক ছিল ‘ক্যালকাটা পেন্টার্স’ শিল্পগোষ্ঠী। এই গ্র“পের সভ্যরা এবং বাংলাদেশের আমন্ত্রিত কিছু শিল্পী একত্রিত হয়ে সাঁতরাগাছির ফরচুন পার্কে আয়োজিত ওয়ার্কশপে রবীন্দ্র-চিন্তার নানা দিক নিয়ে ছবি এঁকেছেন।

অনুরূপ অন্য শিল্প শিবিরটি অনুষ্ঠিত হয়েছিল শান্তিনিকেতনে এই বছরের মে মাসের গোড়ার দিকে। এ শিবিরে সম্মিলিতভাবে ছবি এঁকেছেন শান্তিনিকেতনের কলাভবনের শিল্পীদের সঙ্গে বাংলাদেশের আমন্ত্রিত কয়েকজন চিত্রশিল্পী। অংশগ্রহণকারী ওইসব শিল্পীর রূপকর্মে উদ্ভাসিত হয়েছে রবীন্দ্র সাহিত্য সম্পর্কে তাঁদের সৃজন-প্রতিক্রিয়া।

পুস্তকের শেষ রচনা শিল্পবেত্তা অস্ট্রিয়াবাসিনী স্টেলা ক্রামরিশ ও রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে। উভয়ের মধ্যে প্রথম সাক্ষাৎ সম্ভবত ১৯২০ সালের জুন মাসে অক্সফোর্ডে। স্টেলা অক্সফোর্ডে ‘হিন্দু টেম্পল’ সম্পর্কে তিনটি বক্তৃতা দিয়েছিলেন। পাশ্চাত্য ছাড়াও ভারতীয় শিল্প ইতিহাস ও তত্ত্ব সম্পর্কে তাঁর গভীর আগ্রহ এবং জ্ঞান ছিল অগাধ। তাঁর সম্পর্কে কিছু কথা শুনেছি তাঁরই সুযোগ্য ছাত্র প্রখ্যাত পুরাতাত্ত্বিক ও ইতিহাসবিদ কল্যাণ কুমার গঙ্গোপাধ্যায়ের মুখে। তিনি স্টেলাকে অধ্যাপিকা হিসেবে পেয়েছিলেন কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে। বাংলার ভাস্কর্য গ্রন্থে কল্যাণবাবু ভূমিকাতে এক জায়গায় লিখছেন, ‘বিস্ময়ের সঙ্গে লক্ষ্য করতে হয় যে, যাঁরা ভারত-মানসে প্রতিভাসিত রূপলোকের আভাস প্রত্যক্ষ করেছেন সেই সীমিতসংখ্যক অনুরাগীর প্রায় সকলেই ছিলেন বিদেশাগতা। ভগিনী নিবেদিতা ও কুমারস্বামী ছাড়া যাঁদের নাম শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করা যেতে পারে – আমার শ্রদ্ধাভাজন অধ্যাপিকা স্টেলা ক্রামরিশ ও সম্প্রতি প্রয়াতা তপস্বিনী সুইস মহিলা এলিস বোনেরের নাম এই প্রসঙ্গে উল্লেখনীয়।’ প্রসঙ্গক্রমে স্মরণ করা যেতে পারে, তাঁর কৃতী অন্যান্য ছাত্রের মধ্যে রয়েছেন শিল্প-বিশারদ নীহাররঞ্জন রায়, পৃথ্বীশ নিয়োগী, দেবপ্রসাদ ঘোষ প্রমুখ।

রবীন্দ্রনাথের আমন্ত্রণেই স্টেলা বিশ্বভারতীর অন্তর্গত কলাভবনে শিক্ষকতার কাজে যোগ দিয়েছিলেন। ১৯২২ সালে দেওয়া তাঁর ধারাবাহিক উল্লেখযোগ্য আলোচনার বিষয় ছিল ইউরোপের প্রাগৈতিহাসিক যুগ থেকে মডার্ন আর্ট এবং পরে প্রাচ্য শিল্পকলার নানা দিগন্ত। রবীন্দ্রনাথ চেয়েছিলেন কলাভবনের শিক্ষার্থীদের সঙ্গে বিশেষ করে পাশ্চাত্য ও দূরপ্রাচ্যের শিল্পকলার সঙ্গে পরিচয় ঘটুক। স্বাদেশিক, জাতীয়তাবাদী, এমনকি অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর অনুসৃত নব্যবঙ্গীয় চিত্রশৈলীর আবদ্ধতা থেকে বেরিয়ে গিয়ে রবীন্দ্রনাথ চেয়েছিলেন প্রসারিত আন্তর্জাতিক বহুমাত্রিক শিল্পচেতনার সঙ্গে ছাত্রছাত্রীদের সংযোগ ঘটাতে। সেই সময়ে অবনীন্দ্রনাথের শিল্প আন্দোলনের সঙ্গে জীবনের যোগসূত্র ক্রমেই কমে আসছিল। চলমান সমাজ ও চর্চিত শিল্প আন্তর্জাতিকতার সঙ্গে তাঁর কোনো সম্পর্ক তৈরি হচ্ছিল না। সচেতন রবীন্দ্রনাথ এ বিষয়ে বারবার সতর্ক হতে বলেছিলেন। এক চিঠিতে তিনি লিখছেন, ‘অবনের যদি প্রাচ্য শিল্পের প্রেরণা থাকে, সেটা ভিতর থেকেই কাজ করবে, তার চিত্রদেহের বাইরের রূপ যদি কেবলই অজন্তা, কাংড়া ভ্যালি আর মোগল আর্টের দাগাবুলানো হতে থাকে, তাহলে ব্যবসায়ী যাচনদারেরা তাকেই ওরিয়েন্টাল আর্ট বলে খাতির করবে বটে, কিন্তু তাকে স্বভাবসিদ্ধ সজীব আর্ট বলা চলবে না।’ আসলে সব বিষয়ের মতো শিল্পকলায়ও রবীন্দ্রনাথের দৃষ্টি ছিল সুদূরপ্রসারী। এ বিষয়ে তাঁর লেখা পড়ে ও অঙ্কিত ছবি দেখে তা হৃদয়ঙ্গম করা যায়। তিনি প্রায় বিশ্বব্যাপী মডার্ন আর্টের অন্তর অনুভূতিকে, তথা তার সত্যের স্বরূপকে উপলব্ধি করেছিলেন। তারই প্রকাশ ঘটেছে খেদের সঙ্গে লেখা কিছু ব্যক্তিগত চিঠি ও মতামতে। বিশ্বভারতী পত্রিকার ১৯৫৩ মাঘ-চৈত্র সংখ্যায় প্রকাশিত অবনীন্দ্রনাথকে লেখা একটি চিঠির অংশ এখানে উদ্ধৃত করছি, ‘অবন, জাপানে যতই ঘুরলুম দেখলুম ক্রমাগতই বারবার এইটেই মনে হল যে আমার সঙ্গে তোমাদের আসা খুবই উচিৎ ছিল। আমাদের দেশের আর্টের পুনর্জীবন সঞ্চারের জন্যে এখানকার সজীব আর্টের কত দরকার সে তোমরা তোমাদের দক্ষিণের বারন্দায় বসে কখনও বুঝতে পারবে না। আমাদের দেশে আর্টের হাওয়া বয়নি, সমাজ জীবনের সঙ্গে আর্টের কোন নাড়ীর যোগ নেই।’ যাই হোক, রবীন্দ্রনাথের এই আক্ষেপ, বিশেষ করে কলাভবনের শিক্ষার্থীদের ব্যাপারে কিছুটা কমেছিল স্টেলা ক্রামরিশের ধারাবাহিক বক্তৃতার মধ্য দিয়ে। এই রচনায় স্টেলার কর্মবহুল সংক্ষিপ্ত জীবনী এবং পরিশিষ্টে রবীন্দ্রনাথকে লেখা তাঁর চারটি চিঠি ও সংগৃহীত সাতটি রবীন্দ্রনাথ অঙ্কিত চিত্র প্রতিলিপি পাঠকের কৌতূহলকে অনেকটা পরিতৃপ্ত করবে বলে আশা রাখি।

‘জাতীয়তাবাদ ও ভারতের আধুনিক চিত্রকলা রবি বর্মা থেকে রবীন্দ্রনাথ’ লেখাটিও গুরুত্বপূর্ণ। নব্য ভারতীয় ঘরানার জাতীয়তাবাদী শিল্প-চিন্তার ক্রমবিকাশ, জাতীয়তা ও আন্তর্জাতিকতার টানাপড়েন এবং রাজা রবি বর্মা, হ্যাভেল, অবনীন্দ্রনাথ, গগেন্দ্রনাথ, নন্দলাল, বিনোদবিহারী প্রমুখের হাত ধরে ভারতশিল্পের বিশ্বায়ত বিস্তারের বিষয় এই লেখায় সুন্দরভাবে আলোচিত হয়েছে। দেখানো হয়েছে রবীন্দ্রনাথের দৃষ্টি ছিল ইটার্নাল ইউনিভার্সিলিটির দিকে। লেখার মতো ছবিতেও আমরা তার প্রকাশ দেখি। চিত্রী হিসেবেও তিনি নিজেকে নিছক বাঙালি হিসেবে কখনো ভাবেননি। নিজের ছবি সম্পর্কে নির্মলকুমারী মহলানবিশকে এক পত্রে রবীন্দ্রনাথ লিখছেন, ‘ছবি যখন আঁকি তখন রেখা বলো রং বলো কোন বিশেষ প্রদোষের পরিচয় নিয়ে আসে না। অতএব এ জিনিসটা যারা পছন্দ করে তাদেরই, আমি বাঙালি বলে এটা আপন হতেই বাঙালির জিনিস নয়। এই জন্যে স্বতঃই এই ছবিগুলোকে পশ্চিমের হাতে দান করেছি। আমার দেশের লোক বোধহয় একটা জিনিস জানতে পেরেছে যে আমি কোন বিশেষ জাতের মানুষ নই; এই জন্যেই ভিতরে ভিতরে তারা আমার প্রতি বিমুখ, কটূক্তি তাদের একটু বাধে না। আমি যে শতকরা একশো হারে বাঙালি নই আমি যে সমান পরিমাণে য়ুরোপেরও, ওই কথাটারই প্রমাণ হোক আমার ছবি দিয়ে।’ এই মন্তব্যের মধ্য দিয়ে স্বাধীনচেতা কবির মুক্তচিন্তা ও প্রসারিত বিশ্বদৃষ্টির পরিচয় সুস্পষ্ট হয়।

রবীন্দ্র-চিত্রকলাকে নানান দৃষ্টিভঙ্গিতে দেখার চেষ্টা হয়েছে পুস্তকে সংকলিত আটটি সুনির্দিষ্ট প্রবন্ধের মাধ্যমে। রবীন্দ্রনাথের চিত্র রচনার সূচনা থেকে শেষ পর্যন্ত ক্রমবিবর্তন এবং তার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট বহু বিষয় উঠে এসেছে তথ্যনির্ভর হয়ে। ছবির নির্মাণ পদ্ধতি, রূপকল্প, আঙ্গিকের পাশাপাশি চিত্রী হিসেবে তাঁর অবস্থান দেশ-কালের পরিপ্রেক্ষিতে এবং উত্তরসূরিদের শিল্পকর্মে তার প্রভাব আলোচনায় আলোকিত হয়েছে। এরই সঙ্গে স্থান পেয়েছে কবির আঁকা ছবির সঙ্গে গান ও কবিতার পারস্পরিক সম্বন্ধ বিচার। গ্রন্থ পরিশেষে মুদ্রিত স্টেলা ক্রামরিশের ওপর লেখাটিও গুরুত্বপূর্ণ। লেখার সঙ্গে সংগতি বজায় রেখে আলোকচিত্র ও রঙিন চিত্র মিলিয়ে মোট একশ পাঁচটি ছাপা ছবি বইটিকে সমৃদ্ধ করেছে। একটু বড় টাইপে ঝরঝরে ছাপা বইটি একটানা পড়ে যেতে কোনো অসুবিধা হয় না। শিল্পবিদ মৃণাল ঘোষের পরিশ্রমসাধ্য ‘ছবির রবীন্দ্রনাথ’ পড়ে পাঠক অনেক নতুন তথ্যের সন্ধান পাবেন বলে মনে হয়। রবীন্দ্রনাথের চিত্রকলা বিষয়ক বেশ কয়েকটি পুস্তক ইতোপূর্বে শিল্পরসিকদের হাতে এসেছে। আলোচিত গ্রন্থটি এই তালিকায় আরো একটি তাৎপর্যপূর্ণ সংযোজন বলে আমার বিশ্বাস।

 

-প্রশান্ত দাঁ

 

 

আমি রং ও রেখার মধ্যে তাদের খুঁজি

বোরহানউদ্দিন খান জাহাঙ্গীর

শুদ্ধস্বর

ঢাকা

মূল্য : ১০০ টাকা

 

বাংলাদেশের শিল্প-আন্দোলনের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত যাঁরা তাঁদের মধ্যে বোরহানউদ্দিন খান জাহাঙ্গীর অন্যতম।

শিল্প-আলোচনার পথযাত্রায় তাঁর ঝুড়ি অভিজ্ঞতায় পরিপুষ্ট। এই সুদীর্ঘ পথচলায় তিনি যাঁদের একেবারে কাছে থেকে দেখেছেন, চিনেছেন, জেনেছেন তাঁরা এদেশের

শিল্প-আন্দোলনের প্রতিভূস্বরূপ। সেই সব রেনেসাঁস শিল্পীর অনেকেই এখন শেষ খেয়া পাড়ি দিয়েছেন, অনেকে চালিয়ে যাচ্ছেন তুলি আপন মহিমায়। এমনই কজন রেনেসাঁস শিল্পীকে নিয়ে বোরহানউদ্দিন খান জাহাঙ্গীরের সুপাঠ্য সংকলন আমি রং ও রেখার মধ্যে তাদের খুঁজি। সুপাঠ্য বলার কারণ এ-গ্রন্থে সংকলিত পাঁচটি প্রবন্ধের মধ্যে পাঁচজন খ্যাতিমান শিল্পী সম্পর্কে লেখক আলোকপাত করেছেন যাঁরা কি না এদেশের শিল্পচর্চাকে এগিয়ে নেওয়ার ক্ষেত্রে রেখেছেন অগ্রণী ভূমিকা। অবশ্য এক্ষেত্রে শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিন সম্পর্কিত কোনো প্রবন্ধ গ্রন্থটিতে স্থান পায়নি। হয়তো শিল্পাচার্যের সঙ্গে লেখকের সেমতো বন্ধুত্ব ছিল না, যা এই পাঁচ গুণীর সঙ্গে ছিল এবং আছে।

গ্রন্থটির প্রথম প্রবন্ধ ‘আমিনুল কখনো হারিয়ে যাবেন না’ শুরু হয়েছে ঘটনাক্রম বর্ণনার ঢংয়ে। পরম শ্রদ্ধেয় শিল্পী আমিনুল ইসলাম ইহধাম ত্যাগ করার পর বোরহানউদ্দিন খান জাহাঙ্গীর এদেশের মাটি স্পর্শ করেন। শিল্পীর অন্তিম প্রয়াণের ব্যথা বেজে উঠেছে প্রবন্ধকারের কলমের টানে – ‘আকাশ, শেষহীন আকাশের দিকে আমিনুল চলে যাচ্ছেন। আমি তাকিয়ে আছি শেষহীনতার দিকে।’ আমিনুল ইসলামের সঙ্গে শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিনের যে দূরত্ব ছিল সেই দূরত্বের মধ্যেই বেড়ে উঠেছিল এদেশের শিল্পকলা। র‌্যাডিক্যাল পরিবর্তনের ধারা সূচিত করেছিলেন আমিনুল ইসলাম। অবনীন্দ্রনাথ, জয়নুলদের ধারার আঙিনা পেরিয়ে অন্য এক ধারা, এক সমাজতান্ত্রিক স্বপ্ন-দেখা চোখ নিয়ে কাজ করে গেছেন আমিনুল। তাঁর রেখার টান, অবয়বের ধরন-ধারণ আর বিমূর্ততার বোধ এদেশে প্রাচ্য-পাশ্চাত্যের মিশেলে নতুন শিল্পের সন্ধান দিয়েছে নবীন প্রজন্মকে, রেখেছে দূরস্পর্শী প্রভাব। এই বিপুল প্রভাবসঞ্চারী শিল্পীকে বোরহানউদ্দিন খান জাহাঙ্গীর তাঁর লেখনীর মাধ্যমে জানিয়েছেন সশ্রদ্ধ সালাম।

‘সেনসি’ একটি জাপানি শব্দ যার অর্থ নেতা বা শিক্ষক। বোরহানউদ্দিন খান জাহাঙ্গীর আধুনিক বিমূর্ত ধারার শিল্পের যুগ-প্রদর্শনকারী শিল্পী মোহাম্মদ কিবরিয়াকে সম্বোধন করেছেন ‘সেনসি’। বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর এদেশের শিল্পকলা-আন্দোলনকে বেগবান করতে এবং একটি শিল্পশিক্ষা প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলতে কলকাতা থেকে জয়নুল আবেদিনের সঙ্গে ঢাকায় চলে আসেন মোহাম্মদ কিবরিয়া। একহারা গড়নের শান্ত, প্রখর মনোযোগী আর একনিষ্ঠ কিবরিয়া এদেশের শিল্পধারায় এক অবিস্মরণীয় নাম। জাপানে উচ্চতর শিক্ষাগ্রহণের ফলে কিবরিয়ার মধ্যে একধরনের অ্যাবস্ট্রাকশন ভর করে, যা সে-সময় জাপানে বিরাজিত ছিল। তিনি যুদ্ধবিধ্বস্ত আর দানোয় পাওয়া জাপানকে ধারণ করেছেন মনের গভীরে; এঁকেছেন বিস্ফোরণ, পিকটোরিয়াল এলিমেন্ট ব্যবহার করে। বিভিন্নভাবে বিভিন্ন বিষয়ে তাঁর তুলি আঁচড় কেটেছে – এ যেন এক সংগ্রাম। আর এই সংগ্রাম তিনি করেছেন স্থির, নিষ্কম্প মনোবলে। রং নিয়ে কিবরিয়ার মনে একটি ভীতি কি কাজ করতো? – লেখকের ভাষায়। কিবরিয়া তাঁর ক্যানভাস ভরেছেন রং দিয়ে – উজ্জ্বল রঙে বর্ণিল হয়ে উঠেছে চিত্রপট। এতসব গুণের যিনি আধার তাঁকে সেনসি সম্বোধন করে বোরহানউদ্দিন খান জাহাঙ্গীর যথার্থ বিবেচকের প্রমাণ দিয়েছেন।

‘লিভিং লেজেন্ড’ বলে একটি শব্দ প্রচলিত আছে, যা হয়তো এদেশের খ্যাতিমান শিল্পী কাইয়ুম চৌধুরীর বেলায় প্রযোজ্য। জয়নুল আবেদিন, কামরুল হাসান, সফিউদ্দীন আহমেদ, আমিনুল ইসলাম, মোহাম্মদ কিবরিয়ার পর যাঁর নাম সবচেয়ে বেশি উচ্চারিত এদেশের শিল্পাঙ্গনে তিনি কাইয়ুম চৌধুরী। সম্প্রতি অশীতিতম জন্মদিবস উদ্যাপন করলেও তাঁর কবজির জোর এখনো তারুণ্যের প্রতিচ্ছবি। বোরহানউদ্দিন খান জাহাঙ্গীরের চোখে কাইয়ুম চৌধুরী বিষণ্ন দৃষ্টির ধারক। ‘কাইয়ুম চৌধুরী জীবনকে কাঁচামাল হিসেবে দেখেন, যে কাঁচামাল তাঁর ছবিতে প্রবেশ করার জন্য দাঁড়িয়ে।’ – লেখকের ভাষ্য অনুযায়ী। আসলেই কাইয়ুম চৌধুরীর ছবি যেন জীবনবাস্তবতার এক সুবিশাল চিত্র। এদেশের প্রকৃতি, মানুষ আর আবহাওয়া যেন তাঁর ছবির প্রাণ। শুধু ছবি কেন, ইলাস্ট্রেশনে তাঁর দক্ষতা নিঃসন্দেহে এখন পর্যন্ত অতুলনীয়। এদেশের গ্রন্থশিল্পে তাঁর হাতের ছোঁয়া এনে দিয়েছে বৈপ্লবিক ধারা। একই সঙ্গে দেশজ রাজনীতি, সমাজনীতি আর শিল্প-সম্পর্কিত নিজ ধারণায় তিনি অটুট ছিলেন, আছেন এবং থাকবেন বলে প্রতীয়মান হয়। ‘এই মৃদুভাষী ব্যক্তিটির চোখের মধ্যে, কবজির মধ্যে বিপ্লবের একটি আকাক্সক্ষা আছে। … তাঁর স্টাইল সংগীতের কাছাকাছি, তাঁর চোখে অসীম সহ্যশক্তি।’ এভাবেই কাইয়ুম চৌধুরীকে মূল্যায়ন করেছেন শিল্পবোদ্ধা বোরহানউদ্দিন খান জাহাঙ্গীর।

যাঁর ল্যান্ডস্কেপ থেকে এদেশের ঐতিহাসিক, ভৌগোলিক পরিবেশ-প্রতিবেশ পরিস্ফুটিত হয় তিনি নিঃসন্দেহে হাশেম খান। বোরহানউদ্দিন খান জাহাঙ্গীরের দৃষ্টিতে হাশেম খানের ‘চারপাশে বাংলাদেশ আবার পৃথিবীর অন্যান্য দেশ, এসব মিলিয়ে তাঁর ভৌগোলিক অ্যাডভেঞ্চার।’ হাশেম খানের কাজে

জয়নুল-রবীন্দ্রনাথ যেন মিশে একাকার। প্রকৃতির ছন্দ অনুধাবনে সবসময় উন্মুখ শিল্পী। এদেশের নদী-নিসর্গ-ভূমি থেকে হাশেম খানের অভিজ্ঞতা উৎসারিত। ঝঞ্ঝাবিক্ষুব্ধ পথ বেয়ে আসা স্বাধীন এদেশের মানুষের দুঃখ-কষ্ট তাঁর শিল্পাভিজ্ঞতার ভিত্তিমূল। ভুল করেননি প্রবন্ধকার হাশেম খানের জাত চিনতে। ল্যান্ডস্কেপে তিনি যে প্রচণ্ড রকম শক্তি ধারণ করেন তা বোঝা যায় তাঁর চিত্রপটে চোখ বোলালেই। তিনি একাধারে ভালো ও মন্দের স্বরূপ ক্যানভাসে তুলে ধরেছেন। তাঁর সরল স্ট্রোকে ভালো-মন্দ (ডেভিল আর অ্যাঞ্জেল) দুপক্ষই পালিয়ে যায়। তিনি সবাইকে পবিত্র করেন সরলতার মানস সরোবরে। আর আমরা তা দেখি দুচোখ মেলে, মনের দর্পণে।

‘মনিরের কাজ প্রধানত তিন দেশের নিসর্গে ভরপুর। প্রথম হচ্ছে : বাংলাদেশ। দ্বিতীয় হচ্ছে স্পেন। তৃতীয় হচ্ছে ভিন্ন এক গ্রহ।’ মনিরুল ইসলাম সম্পর্কিত প্রবন্ধের প্রথম কটা লাইন দিয়ে বোরহানউদ্দিন খান জাহাঙ্গীর শিল্পীর মানস আমাদের সামনে চিত্রায়িত করেছেন। মনিরুল ইসলাম এদেশের শিল্পাঙ্গনে অনন্য উচ্চতায় অধিষ্ঠিত। তাঁর কাজে যেমন ইউরোপীয় স্পর্শ আছে, তেমনি আছে এদেশের মাটির ঘ্রাণ। আর সবকিছুকে ছাপিয়ে তিনি যেন ভিন্ন এক গ্রহের ছবি ফুটিয়ে তোলেন ক্যানভাসে, যেখানে আছে রোদের উজ্জ্বলতা, পানির স্নিগ্ধতা, বাতাসের কোমলতা এবং শূন্যতা। তাঁর কাজে যেন সুরের অনুরণন ওঠে; কখনো তা এদেশের ভাটিয়ালী টানে, কখনোবা স্প্যানিশ মিউজিকের মতো। নিসর্গপ্রিয় এই শিল্পী এঁকেছেন স্পেনের নিসর্গ, একই সঙ্গে এদেশের গল্প। একসময় সব ছাপিয়ে সেই অন্য গ্রহের রূপই পরিস্ফুট হয় তাঁর হাতের কবজির মোচড়ে। তাঁর শিল্পসাধনা আর অফুরন্ত কাজের দিকে দৃকপাত করলে বোরহানউদ্দিন খান জাহাঙ্গীরের ধারণাই স্পষ্ট হয় – ‘শিল্পী, বড় মাপের শিল্পী, কোনো দেশের নয়, সমগ্র বিশ্বের।’ মনিরুল ইসলাম তা-ই।

মাত্র ৫৬ পৃষ্ঠার ছোট্ট এই সংকলনে বোরহানউদ্দিন খান জাহাঙ্গীর যেভাবে এই পাঁচ কৃতী শিল্পীকে মূল্যায়নপর্বের অবতারণা করেছেন তা অবশ্যই এদেশের শিল্পকলা সংশ্লিষ্ট সবার পাঠ প্রয়োজন বলেই বিবেচনা করি। লেখার ধরন আর বর্ণনাগুণে, একই সঙ্গে শিল্পকলার খুঁটিনাটি বর্ণনায় গ্রন্থটি অনন্য। হয়তো সংকলনের পরিধি আরো বড় হলে অজানা আরো অনেক বিষয় পাঠকের সামনে লেখক তুলে ধরতে পারতেন বিশদভাবে। গ্রন্থটিতে অন্তর্ভুক্ত চিত্রসমূহ রঙিন হলে শিল্পীগণের রং-রেখার স্বরূপ আরো স্পষ্ট হতে পারত। তারপরও সব মিলিয়ে একটি সুপাঠ্য গ্রন্থ হিসেবেই বিবেচ্য আমি রং ও রেখার মধ্যে তাদের খুঁজি।

 

-আশফাক খান

Leave a Reply