উড়াজাহাজে দীর্ঘ ভ্রমণ বোধহয় সবচেয়ে ক্লান্তি আর বিরক্তিকর। ঢাকা ছেড়ে কুয়ালালামপুরে বড়সড় বিরতির পর আরো ছয় ঘণ্টা উড়ে ওসাকার কানসাই আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে যখন আমাদের ১৬ জনের দলটি পা রাখল, তখন উড্ডয়ন-ক্লান্তি আর ভরদুপুরের ক্ষুধায় সকলের ত্রাহি অবস্থা। আমরা এখানে এসেছি জাপানের সেতউচি ত্রিবার্ষিক প্রদর্শনীর দ্বিতীয় আয়োজনে যোগ দিতে, যাতে বাংলাদেশকে প্রদর্শনীর বিশেষ ফোকাস হিসেবে রাখা হয়েছে এবং সে-উপলক্ষে আমাদের সাম্প্রতিক চারুশিল্পের প্রদর্শনী ছাড়াও পঁয়তাল্লিশ দিনব্যাপী কারু ও লোকজ শিল্পীদের সাক্ষাৎ-কারুকর্ম, সংগীত-নৃত্য, আলোচনা ইত্যাদি নানা আয়োজন রয়েছে। গুরুত্বপূর্ণ এ-আয়োজন উপলক্ষে সংগীত, নৃত্য ও কারুশিল্পের শিল্পীরা ছাড়াও জনাতিনেক মন্ত্রী ও উপদেষ্টা, সরকারি আমলা, সাংবাদিক আর ব্যবসায়ীদের একটি প্রতিনিধিদল আলাদাভাবে এসেছে। সাধারণত আমরা চারুশিল্পের দ্বিবার্ষিক-ত্রিবার্ষিক প্রদর্শনী বলতে যা বুঝে থাকি সেতউচি ত্রিবার্ষিক মোটেই সেরকমটি নয়, রওনা হওয়ার আগ পর্যন্ত আমাদেরও এ-সম্পর্কে ধারণা বিশেষ পরিষ্কার ছিল না। সে-বর্ণনায় আসার আগে আমাদের জায়গামতো পৌঁছে নেওয়াটাই ভালো।
উদ্যোক্তাদের পক্ষে বিমানবন্দরে উপস্থিত অতিবিনয়ী জাপানি তরুণীটি দীর্ঘ বাসযাত্রা শেষে আমাদের থাকার জায়গা তাকামাৎশু দ্বীপের নির্ধারিত হোটেলে পৌঁছে দিয়ে ঘোষণা করল যে, যেহেতু উদ্যোক্তারা আমাদের থাকা ও যাতায়াতের দায়িত্ব নিয়েছেন, খাবারের দায়িত্ব নেননি, অতএব তার দায়িত্ব শেষ। আমাদের খাওয়ার ব্যবস্থা আমাদেরই করতে হবে, শুধু এ-বেলা নয়, সব বেলাতেই। আমাদের তো মাথায় বজ্রাঘাত। সরকার-প্রদত্ত ফরমান ওকে দেখালাম, যাতে পরিষ্কার লেখা ‘লোকাল হসপিটালিটি’ দেবে প্রদর্শনীর উদ্যোক্তা। মেয়েটি শান্তমুখে জানাল, লোকাল হসপিটালিটিতে যেহেতু ‘ফুড’ লেখা নেই, তাই ফুডের দায়িত্ব ওর নেই। প্রচুর চেঁচামেচি ও রাগারাগির পর যখন বোঝা গেল যে, খাদ্যসমস্যা সমাধানের ক্ষমতা মেয়েটির নেই, তখন আবার তারই সহযোগিতা চেয়ে কাছাকাছি এক খাবার দোকানে কিছু খেয়ে নেওয়া গেল। জাপানে যেহেতু ইংরেজি জানা মানুষের সাক্ষাৎ পাওয়া অতি কঠিন, তাই এ ছাড়া উপায় ছিল না। জাপানি খাদ্য, যার অধিকাংশই অপরিচিত ও অরন্ধিত, গলাধঃকরণ সকলের জন্য সহজ নয়। শিল্পীরা এসব সহজেই মোকাবেলা করতে পারেন বলে বেশিরভাগেরই তেমন সমস্যা হলো না।
যাকে সেতউচি ত্রিবার্ষিক বললাম তার পোশাকি নাম ‘সেতউচি ইন্টারন্যাশনাল আর্ট ফেস্টিভাল’। এর সূচনা মাত্র ২০১০ সালে। এবার এর দ্বিতীয় আয়োজন। তবে অন্যান্য ত্রিবার্ষিক আয়োজনের মতো তিন বছর পরপর শুধু একটি করে প্রদর্শনী আয়োজন এর উদ্দেশ্য নয়। প্রদর্শনীর বছরে এটি চলে সারা বছর ধরে তিনটি মূল পর্বে বিভক্ত হয়ে – সামার, উইন্টার ও স্প্রিং ফেস্টিভাল নামে। আমরা এসেছি এবারের সামার ফেস্টিভালে। এর সবচেয়ে স্বতন্ত্র ব্যাপারটি হলো, বারোটি আলাদা আলাদা দ্বীপজুড়ে এ-আয়োজনের বিস্তার আর শিল্পকর্মের বৈচিত্র্যপূর্ণ নির্মাণ ও উপস্থাপনের বৈশিষ্ট্য। এ বারোটি দ্বীপের নাম এরকম – তাকামাৎশু, নাওশিমা, শোদোশিমা, তেশিমা, ইনুজিমা, মেগিজিমা, ওগিজিমা, শামিজিমা, হনজিমা, তাকাজিমা, আওয়াশিমা ও ইবুকিজিমা। মনে রাখতে গেলে গুলিয়ে যাওয়ার সমূহ সম্ভাবনা। এ দ্বীপগুলোর অবস্থান, সে তো নামের প্রায় স্থলবেষ্টিত উপসাগরে, যেটি হনশু আর শিকুকো দ্বীপকে বিচ্ছিন্ন করেছে। ফলে একে সাগর মনেই হয় না, অবিকল আমাদের কাপ্তাই হ্রদ যেন। তবে জাপান বলে কথা, দ্বীপগুলো বেশকিছু দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতর সেতু দিয়ে সংযুক্ত, কোনো কোনোটি আমাদের স্বপ্নের পদ্মা সেতুর চেয়ে কম হবে না। যেখানে সেতু নেই, সেখানে আরামদায়ক ফেরিব্যবস্থা। তবে আমরা যে সামার ফেস্টিভালে এসেছি, সেটি হাড়ে হাড়েই টের পাওয়া যাচ্ছিল, তাপমাত্রা কখনোই ৩৫ ডিগ্রি সেলসিয়াসের নিচে নয়।
বাংলাদেশের সমকালীন চারুশিল্পের প্রদর্শনীটিতে পঁয়ত্রিশজন শিল্পীর সাম্প্রতিক শিল্পকর্ম প্রদর্শিত হচ্ছে। আমাদের দলে শিল্পী ছিলেন দশজন – কাইয়ুম চৌধুরী, মুস্তাফা মনোয়ার, হাশেম খান, রফিকুন নবী, মাহমুদুল হক, নাজলী লায়লা মনসুর, ফরিদা জামান, খালিদ মাহমুদ মিঠু, কনকচাঁপা চাকমা ও বিশ্বজিৎ গোস্বামী। এ ছাড়া আমরা তিনজন সেমিনার-বক্তা – রামেন্দু মজুমদার, আমি ও শাওন আখন্দ। আমাদের সঙ্গে এসেছে মিঠু-কনকচাঁপার দুই ছেলেমেয়ে আর আমাদের এ ছোট-বড় বিভিন্ন মেজাজের মানুষগুলোকে দেখভাল করার দায়িত্ব নিয়ে সমন্বয়ক হিসেবে রয়েছেন বেঙ্গল শিল্পালয়ের কর্ণধার সদা-তৎপর সুবীর চৌধুরী। সব মিলে আমরা ১৬ জনের দল।
সেতউচি ইন্টারন্যাশনাল আর্ট ফেস্টিভালের ধারণা রূপ পাওয়ার পটভূমিটি বেশ কৌতূহলব্যঞ্জক। সেতো উপসাগরীয় দ্বীপগুলো ছিল মূলত জেলেপল্লি। জাপানের অর্থনৈতিক সমৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে এসব প্রান্তিক অঞ্চলের তরুণ অধিবাসীরা স্বাভাবিক প্রবণতাতেই অধিক সুযোগসম্পন্ন বড় শহরগুলোর দিকে চলে যেতে থাকে, রয়ে যান মূলত বয়স্করা। এসব অঞ্চলে কর্মক্ষম জনসংখ্যা আশঙ্কাজনকভাবে কমে যেতে থাকে, বৃদ্ধরা হয়ে পড়েন অসহায়। এ প্রবণতাকে উল্টোমুখী করা ও সেতো উপসাগরকে ঘিরে অসংখ্য দ্বীপমালার প্রতি মানুষকে আকৃষ্ট করার জন্য স্থানীয় প্রশাসন এক অভিনব উদ্যোগ গ্রহণ করে। প্রধান দ্বীপ তাকামাৎশুকে কেন্দ্র করে আরো ১৫-২০টি দ্বীপকে নিয়ে দৃশ্যকলা ও পর্যটনের একটি ব্যাপক তৎপরতা গড়ে তোলার পরিকল্পনা করা হয়। এগিয়ে আসেন শিল্পপ্রেমিক বিত্তবান ব্যক্তি ও ব্যবসা প্রতিষ্ঠান। এগুলোর মধ্যে বেনেসি আর্ট হাউস একটি প্রধান ভূমিকা গ্রহণ করে এবং মূলত তাদের প্রচেষ্টায় নাওশিমা দ্বীপ এ-শিল্পোদ্যোগের মূল আকর্ষণ হিসেবে গড়ে উঠেছে। জাপানের খ্যাতিমান স্থপতিদের ডাকা হয় দেশ ও বিদেশের বিখ্যাত শিল্পীদের সঙ্গে যৌথ প্রয়াসে কিছু আর্ট গ্যালারি বা আর্ট হাউস নির্মাণের জন্য। এর ফলে এসব দুর্গম ও জনবিরল দ্বীপে নির্মিত হয়েছে স্থাপত্য, চারুশিল্প আর প্রকৃতির ত্রিবেণী সম্মিলনে কিছু অতুলনীয় শিল্পালয়।
আমরা তাকামাৎশু দ্বীপে পৌঁছলাম ১৯ জুলাই। ওইদিনই সন্ধ্যায় রিসেপশন, মোটামুটি সাদামাটা অনুষ্ঠান হলো বাংলাদেশকে মূল আকর্ষণ রেখে। বাংলাদেশ সরকারের পক্ষে উপস্থিত থাকলেন অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত, সংস্কৃতিবিষয়ক মন্ত্রী আবুল কালাম আজাদ, প্রধানমন্ত্রীর উপদেষ্টা গওহর রিজভী, জাপানে নিযুক্ত বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত ও অন্যান্য সরকারি লোকজন। বেশ ভালো সমাগম এবং বিভিন্ন দেশের মানুষের উপস্থিতি মালুম হলেও সমস্ত কথাবার্তা ও কাগজপত্র জাপানি ভাষায় হওয়ায় কত দেশের বা কোন দেশের লোকজন এলো তা বোঝার উপায় ছিল না। তবে বাংলাদেশের সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে সংগীত ও নৃত্যের আবেদন উপস্থিত সমাগমকে ভালোই আকর্ষণ করেছে বলে মনে হলো। সেইসঙ্গে খাদ্য ও পানীয়ের ব্যবস্থায় কোনো ঘাটতি ছিল না। বাংলাদেশের চারুশিল্পের প্রদর্শনীটি উদ্বোধন করা হলো ২০ জুলাই সকালে তাকামাৎশু সিটি মিউজিয়াম অব আর্টের সানপোর্ট আর্ট স্পেসে। অনেকে মিলে বিরাট লম্বা রিবন কাটার মাধ্যমে উদ্বোধন হলো, মন্ত্রী ও উপদেষ্টা মহোদয়রা আর আমাদের রাষ্ট্রদূত ছিলেন মঞ্চে। বাংলাদেশের পক্ষে সবচেয়ে আকর্ষণীয় উপস্থাপন ছিল ওইদিন সন্ধ্যায় মাটি-বাঁশ-বেত-পাট-কাঠ-শোলা-শঙ্খ প্রভৃতি উপকরণ দিয়ে আমাদের গ্রামীণ কারুশিল্পীদের নির্মাণ-দক্ষতার হাতেকলমে প্রদর্শন – স্থান ‘বাংলাদেশ দ্বীপে’র উদ্বোধন। ভালো লাগল আসল জামদানি-শিল্পীদের এনে জামদানির বুনন আর আমাদের আদিবাসীদের কোমরতাঁতের বুননের উপস্থাপন। বাংলাদেশের রিকশা-অলংকরণ শিল্প বিদেশিদের কাছে অন্যতম একটি আকর্ষণের বস্ত্ত। প্রায় ২৫টি সজ্জিত রিকশা আর রিকশা-শিল্পীদের অঙ্কন-দক্ষতা দেখাবার ব্যবস্থাও এ-আয়োজনে ছিল। প্রকৃত গ্রামীণ কারুশিল্পীদের নির্বাচনের ফলে এ-উপস্থাপনটি হয়ে উঠেছিল সমগ্র আয়োজনের অন্যতম আকর্ষণ। দেখা গেল, জাপানিদের কাছে বিশেষভাবে জনপ্রিয় হয়েছে হাতে মেহেদির অলংকরণ, মেহেদি রাঙানোর স্টলে উপচেপড়া ভিড়! বাংলাদেশের কারুশিল্পীদের সঙ্গে বিভিন্ন স্টলে জাপানের তরুণ শিল্পীদের অংশগ্রহণ ও স্থানে স্থানে বাঁশ-কাগজ আর আলোর সমন্বয়ে তৈরি হালকা মেজাজের স্থাপনাগুলো অনুষ্ঠানস্থলকে আরো বর্ণিল করে তুলেছিল।
২০ ও ২১ জুলাই আমাদের জন্য নির্ধারিত ছিল কয়েকটি দ্বীপে স্থাপিত আর্ট গ্যালারি ও চলমান ফেস্টিভালের অংশ হিসেবে বিভিন্ন দেশের শিল্পীদের নির্মিত স্থাপনাশিল্পগুলো পরিদর্শন। আর আমরা তিন সেমিনার-বক্তার জন্য নির্ধারিত ছিল ২১ জুলাই শোদোশিমা দ্বীপে বাংলাদেশের সাম্প্রতিক দৃশ্য ও পরিবেশন শিল্পের গতিপ্রকৃতি নিয়ে সচিত্র উপস্থাপন। সেমিনারটি আয়োজন করা হয় ফুকুতাকে হাউস জিমনেসিয়াম কক্ষে। দ্বীপে জনবসতি কমে যাওয়ায় জিমনেসিয়ামের মালিক স্কুলটি বন্ধ হয়ে যায়, ফলে এটিকে এখন একটি মিলনায়তনে রূপান্তরের কাজ চলছে। আয়োজনের সব ব্যবস্থা নিখুঁত পরিপাটি; কিন্তু জিমনেসিয়ামটিতে শীতাতপ নিয়ন্ত্রণের কোনো ব্যবস্থা নেই! ৩৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস গরমে ভিজে জবজবে হয়ে কোনোমতে সেমিনার সেরে বাঁচলাম যেন। শ্রোতা বলতেও মূলত আমাদের সঙ্গে ফেরিতে করে নিয়ে আসা অভ্যাগত আর আমাদের সঙ্গের শিল্পীদল। তবে জাপানিদের কোনো ভাবান্তর বা অনুযোগ করতে দেখলাম না। ২০১১ সালের ভয়াবহ সুনামিতে ফুকুশিমা পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রটি অচল হয়ে যাওয়ার পর জাপানে বিদ্যুতের কিছুটা রেশনিং ব্যবস্থা চালু রয়েছে এবং সে-কারণে জিমনেসিয়ামের শীতাতপনিয়ন্ত্রণ কার্যক্রম স্থগিত রয়েছে। শুনলাম সারাদেশে শীতাতপনিয়ন্ত্রণ যন্ত্রে তাপমাত্রা ২৮ ডিগ্রি সেলসিয়াসের নিচে নামানো নিষেধ! প্রত্যেকটি জাপানি নাগরিক এটি শতভাগ পালন করে এবং এ নিয়ে কারো কোনো অনুযোগ নেই। দেশপ্রেমের ও ব্যক্তিগত সততার এ-দৃষ্টান্ত অবশ্যই অনুকরণযোগ্য।
সেতউচি ত্রিবার্ষিকে আমাদের অভিজ্ঞতার ঝুলিতে সবচেয়ে সমৃদ্ধ সংগ্রহ কোনটি – এ-প্রশ্ন কেউ করলে অবলীলায় বলা যাবে কয়েকটি দ্বীপে নিসর্গের অনাবিল বিস্তারের সঙ্গে সংগতিপূর্ণ অনুপম স্থাপত্য আর তার মধ্যে বিশেষত নানাবিধ স্থাপনাশিল্পের অপূর্ব সমন্বিত উপস্থাপন। সেইসঙ্গে কয়েকটি দ্বীপে বেলাভূমিতে বিশালাকৃতির স্থাপনাশিল্পের নির্মাণ ও উপস্থাপন দেখাটিও অভূতপূর্ব অভিজ্ঞতা। আরো একটি একেবারে ভিন্ন অভিজ্ঞতা আমাদের চমৎকৃত করেছে, শিল্পকর্মগুলোর সঙ্গে স্থানীয় মানুষের সম্পৃক্ততা আর শিল্পকর্মের প্রতি স্থানীয়-অস্থানীয় নির্বিশেষে জাপানিদের অনুরাগ ও শ্রদ্ধা। চাক্ষুষ দর্শন ছাড়া দৃশ্যকলার লিখিত বিবরণ বিশেষ কাজে আসবে না, পরিপার্শ্বের আবহের মধ্যে স্থাপিত বৃহদাকার বা পরিবর্তনশীল স্থাপনাশিল্পের ক্ষেত্রে কাজটি আরো কঠিন। তবু এ-ভ্রমণের সবচেয়ে উলে�খযোগ্য অভিজ্ঞতার কিছুটা পাঠকের সঙ্গে ভাগ করে না নিলে এ-লেখাটি তাৎপর্যহীন মনে হবে।
প্রথমত, জাপানের প্রত্যন্ত একটি উপসাগরীয় অঞ্চলে দ্বীপ থেকে দ্বীপান্তরে ঘোরার সুযোগটিই একটি বিরল অভিজ্ঞতা। বলেছিলাম শান্ত উপসাগরটি অনেকটাই আমাদের কাপ্তাই বা রাঙামাটির মতো। তবে দ্বীপগুলোর গঠন একটু ভিন্ন, কারণ এগুলো মূলত গঠিত হয়েছে ‘ভলক্যানিক অ্যাশ’ বা আগ্নেয়গিরির উদ্গীরিত ভস্মরাশি জমে। জাপানের ভূমিকম্পের কথা আমাদের সবারই জানা। একটা সময়কালে আগ্নেয়গিরির উদ্গিরণও ছিল প্রাত্যহিক ঘটনা আর প্রকৃতির সে টালমাটাল সময়ে ভূ-গঠনের অনেক এদিক-সেদিক হয়েছে, দ্বীপগুলির জন্ম মূলত ওইভাবেই। জাপানিদের উন্নতির সুবিধাগুলো সমানভাবে বণ্টনের প্রয়াসটিও দেখবার মতো। ছোট ছোট জনবিরল দ্বীপেও রাস্তাঘাট ঝকঝকে আর রাস্তার পাশে ঝুঁকে আসা গাছের ডাল বা ঝোপঝাড় বড় শহরের মতোই সমান করে ছাঁটা, কোথাও একটা ঝরাপাতাও পড়ে নেই। পথেঘাটে লোকজন দেখাই যায় না, কারা এগুলো এমন পরিপাটি রাখে ভেবে অবাক হতে হয়। আমাদের জন্য ব্যবস্থাদিও নিখুঁত। সময়মতো হোটেলের সামনে বাস উপস্থিত, ভলান্টিয়াররা সারিবদ্ধভাবে একহাত বা দুহাত বাড়িয়ে এমনভাবে দাঁড়িয়ে থাকে, আপনি নির্দিষ্ট বাস বা ফেরিতে না উঠে অন্যদিকে মাথা ঘোরানোর কোনো উপায় নেই। বাসে-ফেরিতে আঙুলে বা যন্ত্রে মাথা গোনার শেষ নেই। একবার যদি সংখ্যায় না মেলে, তাহলে ভলান্টিয়ার মেয়েগুলোর উদ্বিগ্ন কিচিরমিচিরে আমরা বেশ আমোদ পেতাম। ঘড়ি ধরে ফেরি ঘাটে ভেড়ার সঙ্গে সঙ্গে আবার একই তৎপরতা, বাসে উঠিয়ে নির্দিষ্ট গন্তব্যে যাত্রা। দুপুরের লাঞ্চবক্স-পানির বোতল বিলি করেই ঘোষণা করা হতো বাসে বা ফেরিতে খাওয়া শেষ করতে হবে, দ্বীপগুলিতে খাওয়া বা কোনো উচ্ছিষ্ট নিক্ষেপ নিষেধ। জাপানিদের এ পরিচ্ছন্নতা ও সৌন্দর্যপ্রিয়তা অসাধারণ, যা দ্বীপের যে-কোনো সাধারণ জেলেবাড়িতে গেলেও টের পাওয়া যায়।
দুদিনের ভ্রমণে খুব বেশি দ্বীপে যাওয়ার সুযোগ ছিল না। আমরা যে-কটা দ্বীপ দেখতে পেরেছি, তার মধ্যে তেশিমা আর নাওশিমাই সম্ভবত সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। এ দুটি দ্বীপে দেখা কয়েকটি শিল্পকর্মের অভিজ্ঞতা ভাগ করে নেওয়ার খানিকটা চেষ্টা করা যেতে পারে। তেশিমা দ্বীপে দেখা দুটি শিল্পকর্ম আমাদের সবাইকে অভিভূত করেছে। আগেই বলেছি, এগুলো মূলত স্থাপনাশিল্প আর প্রকৃতি ও স্থাপত্যের সঙ্গে সহাবস্থানেই এগুলোর নান্দনিক বিস্তার হয়েছে এতটা মনোগ্রাহী। তেশিমা দ্বীপের কাছাকাছি ফেরিতে আসতে আসতে নজর কাড়ে রসুন-আকৃতির একটি বিশাল কাঠামো, যেন সমুদ্রে ভেসে আসা কোনো ফল বা বীজ পড়ে আছে সমুদ্রতটে। এবং ব্যাপারটি আসলেও তা-ই, যদিও এর একটি বাস্তব ও দার্শনিক পটভূমি রয়েছে। তাইওয়ানের নামজাদা শিল্পী লিন শুয়েন-লংকে সেতউচি ফেস্টিভালে আমন্ত্রণ জানানো হয় ফেস্টিভালের মূল থিম ‘রেস্টোরেশন অব দ্য সি’ নিয়ে কাজ করার জন্য। শিল্পী লিন এ-কাজের জন্য বিষয় হিসেবে নির্বাচন করেন তাইওয়ানের সমুদ্রতটে জন্মানো ‘সি পয়জন ট্রি’ বা সাগরের বিষবৃক্ষ নামের একটি গাছের ফলকে। এ গাছকে ক্ষতিকারক মনে করা হলেও এর ফল সমুদ্রের ঢেউ-বাহিত হয়ে জাপানের বিভিন্ন দ্বীপের উপকূলে পৌঁছায় এবং শত শত মাইল দূরে ওই বৃক্ষের বংশবৃদ্ধির কাজ করে। শিল্পী লিন প্রকৃতির
এ-ব্যবস্থাকে প্রাচীনকাল থেকে মহাসাগর পাড়ি দিয়ে এক দেশ থেকে আরেক দেশে মানুষের গমনাগমন ও সহাবস্থানের প্রতীক হিসেবে নিয়ে ওই ফলের আকারে একটি বিশাল জাহাজ বানানোর পরিকল্পনা করেছেন, যেটি তেশিমা দ্বীপের তটভূমিতে অবস্থান করে তাইওয়ান ও জাপানের মধ্যে ঐতিহাসিক যাতায়াত ও সৌহার্দ্যের কথা স্মরণ করাবে। এর নাম দিয়েছেন তিনি ‘ওভার দ্য বর্ডার, সি’। এর কাঠামোটি তিনি তৈরি করেছেন সম্পূর্ণভাবে সমুদ্রে ভেসে আসা কাঠ ব্যবহার করে, যা সামুদ্রিক ঝড়ে তাইওয়ানের উপকূল থেকে জাপানে ভেসে এসেছে। এর ভেতরে থাকবে বক্তৃতা ও পারফরম্যান্সের আয়োজন। এ বিশাল কর্মযজ্ঞে অংশগ্রহণ করছেন তাইওয়ান থেকে আসা শিল্পীর সহকারীরা আর জাপানের স্থানীয় মানুষ। আনুভূমিক তটরেখার বিস্তারের বিপরীতে আকৃতির বিশালত্ব নিয়ে দাঁড়ানো কাঠামোটি এক সুদূরস্পর্শী অনুভূতি সঞ্চার করে।
তবে আমাদের পুরো দলকে বিমোহিত করেছে শিল্পী রেই নাইতো ও স্থপতি রুয়ে নিশিজাওয়ার যুগলকীর্তি তেশিমা আর্ট মিউজিয়াম। প্রকৃতি, স্থাপত্য ও দৃশ্যকলার এর চেয়ে কাব্যিক ও সংবেদনশীল সম্মিলন চিন্তা করা যায় না। পাহাড়, বৃক্ষ ও সিঁড়িময় ধানক্ষেতশোভিত পরিপার্শ্বের মধ্যে স্থপতি নিশিজাওয়া মিউজিয়াম-স্থাপত্যটি নির্মাণ করেছেন প্রায় মাটির নিচে; বলা যায়, নিস্তব্ধ নিসর্গের ধ্যান ভঙ্গ না করে। পুরো স্থাপত্যে কোনো পিলার বা বিম ব্যবহার না করে একটি ওভাল আকৃতির ঝিনুকের আকারে এটি নির্মিত, আলো-হাওয়া আর বৃষ্টিজলের সঙ্গে সম্পর্ক রচনার জন্য ওপরে শুধু দুটি বৃত্তাকার ছিদ্র। মিউজিয়ামে যাওয়ার হাঁটা রাস্তাটি ঘুরে ঘুরে গেছে গভীর বৃক্ষরাজির মধ্য দিয়ে, যাতে ভেতরের পরিসরে ঢোকার আগে পরিবেশের অনুভূতি দর্শকের পাওয়া হয়ে যায়। নিশিজাওয়া তাঁর এ স্থাপত্যকে বলেন একটি পানির ফোঁটার মতো। বাইরের আলো থেকে ভেতরের
আলো-আঁধারিতে ঢুকে বিস্তীর্ণ স্পেসটিকে মনে হয় শূন্য, কিছু দৃষ্টিগোচর হয় না। ঢোকার আগে পাদুকা খুলে রাখতে হয় এবং ভলান্টিয়াররা সাবধানে পা ফেলার জন্য সতর্ক করে দেন। আস্তে আস্তে দৃষ্টিগোচর হয় রেই নাইতোর শিল্পকর্ম। শিল্পকর্ম বলতে ফুটবলমাঠের মতো বিশাল মেঝেতে স্থানে স্থানে জমে আছে পানি। নানা আকৃতি ধরে জমে থাকা পানি, যেমনটি আমরা অহরহ দেখতে পাই। এ আর এমন কী – ভেবে তাকিয়ে থাকতে থাকতে দেখা গেল হঠাৎ একটি পানির জমাট চলতে শুরু করে আরেকটির সঙ্গে মিলে গেল, তারা আবার ভেঙে গিয়ে সাপের মতো বিভিন্ন দিকে ছুটে গেল। চলতে চলতে হঠাৎ কোনটা থমকে দাঁড়াল। মাঝে মাঝে ছোট ছোট মার্বেলের মতো বস্ত্ত, এগুলোর গা বেয়ে পানি উঠছে আর কোথাও কোথাও ওই রকমই ছোট ছিদ্র গলে পানি অন্তর্হিত হয়ে যাচ্ছে। এ ভাঙাগড়া আর চলা-অচলার খেলা চলছেই, চলছে নানান বিচিত্র রূপের নির্মাণ ও অন্তর্ধান প্রক্রিয়া।
জৈব-অজৈব সত্তাকে একাকার করা এ-খেলাকে শিল্পী বলছেন জন্ম, মৃত্যু ও পুনর্জন্মের এ অবিরাম আবর্তনের মধ্য দিয়ে তিনি প্রকাশ করতে চান সমস্ত বস্ত্তর অবিনাশী অস্তিত্বকে। আমরা বুঝতে পারছিলাম, দেখতে সরল হলেও এ-উপস্থাপনটি তৈরি করতে মেঝের নিচে জটিল কারিগরি পরিকল্পনা বাস্তবায়িত করতে হয়েছে। তবু সামান্য পানিকে মাধ্যম করে এমন অবিস্মরণীয় দৃশ্যরূপ ও তার দার্শনিক উপলব্ধিকে বাস্তব রূপ দেওয়া সত্যই তুলনাহীন।
নাওশিমা দ্বীপের বেনেসি হাউস মিউজিয়াম আর চিচু আর্ট মিউজিয়ামের কথাও সংক্ষেপে উল্লেখ না করলেই নয়। বেনেসি হাউস মিউজিয়াম আর চিচু আর্ট মিউজিয়ামের স্থাপত্যনকশা করেছেন জাপানের অন্যতম খ্যাতিমান স্থপতি তাদাও আন্দো। বেনেসি হাউস কমপ্লেক্স আসলে চারটি আলাদা বিষয়কে একত্রিত করে নির্মাণ করা, যাতে প্রকৃতির ভেতরে বসবাস করে সব সুবিধা পাওয়া যায়। এগুলো হলো – বেনেসি হোটেল, মিউজিয়াম, পার্ক ও বিচ, যার সবগুলোর নকশা ও পরিকল্পনা করেছেন স্থপতি আন্দো। স্থপতি রুয়ে নিশিজাওয়ার স্থাপত্যে আমরা যে ডিম্বাকৃতির পাতলা আবরণের চরিত্র দেখলাম, তাদাও আন্দোর কাজ তার বিপরীত। বেনেসি হাউস মিউজিয়াম ভবনটি ভারী কংক্রিটের ভাবগম্ভীর স্থাপত্য, তবে প্রচুর খোলামেলা স্পেসের কারণে প্রকৃতির সঙ্গে অবিরল দেওয়া-নেওয়াও চলছে। এখানকার শিল্পকর্মগুলোও সাজানো হয়েছে শুধু দেয়ালের গায়ে নয়, তারা অভ্যন্তর ছেড়ে ভবনের বাইরের পরিসর, বাগান, জঙ্গল এমনকি সমুদ্রতটেও ছড়ানো রয়েছে। বেনেসি কালেকশনে পৃথিবীখ্যাত বহু শিল্পীর কাজ রয়েছে। রয়েছেন যেমন জ্যাকসন পোলক, জ্যাসপার জন্স, অ্যান্ডি ওয়ারহল, অ্যালবার্তো জিয়াকোমেত্তি, টম ওয়েসেলম্যান বা জর্জ সেগালের মতো প্রয়াত গুরুরা, তেমনই আছেন ডেভিড হকনি, ড্যান ফ্লেভিন, রিচার্ড লং অথবা ড্যান গ্রাহামের মতো সাম্প্রতিককালের বিশ্বসেরারা। জাপানের শিনো ওতাকে, হিরোশি সুগিমোতো প্রমুখ বিশ্বখ্যাতের কাজ তো রয়েছেই। তবে বেনেসি হাউস মিউজিয়ামের তুলনায় স্বল্পপরিসরে হলেও স্থপতি তাদাও আন্দোরই করা চিচু আর্ট মিউজিয়াম অনেক মনোমুগ্ধকর লেগেছে। কংক্রিট, ইস্পাত, কাচ আর কাঠের সমন্বয়ে করা চিচু মিউজিয়ামটি প্রায় পুরোটাই মাটির অভ্যন্তরে, ওপর থেকে শুধু কিছু জ্যামিতিক আকৃতির দেয়াল দৃশ্যমান। ভেতরে ন্যূনতম নির্মাণ ও উপকরণের সংবেদনশীল ব্যবহার আর শিল্পকর্ম সাজানোয় বিস্তৃত পরিসরের ব্যবস্থা একটি আধ্যাত্মিক মৌনতার আবহ নির্মাণ করে। চিচু আর্ট মিউজিয়ামের অন্যতম আকর্ষণ ইমপ্রেশনিস্ট শিল্পী ক্লদ মনের ‘ওয়াটার লিলি’ সিরিজের পাঁচটি তেলরংচিত্র। মিউজিয়ামের কর্মকর্তা ও দর্শকরা এগুলোর প্রতি যে সম্মান ও শ্রদ্ধা প্রদর্শন করছেন তা দেখার মতো। শ্রদ্ধার নিদর্শন স্বরূপ মনের ওয়াটার লিলি গার্ডেনের আদলে এখানে একটি ছোট গার্ডেনও তৈরি করা হয়েছে! দুটি উল্লেখযোগ্য শিল্পকর্ম হচ্ছে – ওয়াল্টার দে মারিয়াকৃত ‘টাইম/টাইমলেস/নো টাইম’ নামের স্থাপনাকর্ম আর জেমস টারেলের ‘ওপেন স্কাই’, যা শুধুমাত্র মিউজিয়ামের একটি কক্ষের ছাদে একটি চতুষ্কোণ ছিদ্র, যা দিয়ে আলো আসে ও আকাশ দেখা যায়। নিচের স্থাপনাটির ওপর শুয়ে আকাশের বিবিধ রূপ পর্যবেক্ষণের মাধ্যমে প্রকৃতির বৈচিত্র্যকে অনুধাবন করাতে চান শিল্পী। ওয়াল্টার মারিয়াও তাঁর বিশাল গোলক ও পরিপার্শ্বের স্থাপনাগুলোর সমন্বয়কে সূর্যোদয় থেকে সূর্যাস্ত পর্যন্ত আলো-ছায়ার পরিবর্তনের রূপবৈচিত্র্যের মাধ্যমেই দর্শকের কাছে তাঁর বার্তাটি পৌঁছাতে চান।
মিউজিয়াম বা গ্যালারির আওতার বাইরে জেলেপল্লিগুলোর কোনো একটি কক্ষে বা একটু খোলা পরিসরে করা শিল্পকর্মগুলোর কোনো কোনোটিও ভীষণভাবে নাড়া দেওয়ার মতো। মাটি ও জলের সমন্বিত এক বিশাল এলাকাকে ঘিরে শিল্পের এত ব্যাপক কর্মকান্ড আর দ্বিতীয়টি আছে কি-না জানা নেই। একটি অঞ্চলকে জনবিরল হয়ে পড়ার হাত থেকে বাঁচানোর উপায় হিসেবে দৃশ্যকলাকে ব্যবহার এবং স্থানীয় জনগণকে তার অংশীদার করে সাফল্যের সঙ্গে অঞ্চলটিকে পুনর্জীবিত করাও এক অনন্য উদাহরণ। এদিক থেকে সেতউচি ত্রিবার্ষিক আয়োজন এ-ধরনের অন্যান্য উদ্যোগ থেকে একেবারেই স্বতন্ত্র। এমন একটি আয়োজনে বাংলাদেশকে মূল আকর্ষণ হিসেবে বিবেচনা করা ও বাংলাদেশের চারু ও কারুশিল্প এবং সংগীত ও নৃত্যের ব্যাপক আয়োজনের জন্য সেতউচি ইন্টারন্যাশনাল আর্ট ফেস্টিভালের উদ্যোক্তাদের সাধুবাদ জানাতেই হয়। আর এমন একটি ব্যতিক্রমী আয়োজনের সঙ্গী হয়ে এক ভিন্ন জাপানের অভিজ্ঞতাটিও স্মরণীয় হয়ে থাকবে।