ফাহমিদা আক্তার
প্রাককথন
অধিকাংশ সেনসিটিভ মানুষের ব্যক্তিত্বে দুটি পরস্পরবিরোধী সত্তা সর্বদা বিদ্যমান। যার একটি জীবনীশক্তি খুঁজে পায় কঠোর বাস্তবে। অপরটি ফ্যান্টাসিতে। তাই স্বভাবতই এই শ্রেণির মানুষের আত্মজীবনীতেও বাস্তবতা ও ফ্যান্টাসির এক অদ্ভুত সংমিশ্রণ ঘটে তার অজান্তে।২
আলমগীর কবিরের এই উক্তিতে তাঁর ফ্যান্টাসিপ্রিয়তার চিত্র স্পষ্ট। সূর্যকন্যা ছবিতে তিনি মধ্যবিত্তের বাস্তব জীবনপ্রবাহের মাঝে ফ্যান্টাসির পারসোনাল আবহ গড়েন বাস্তবের শরীরে গতিময় প্রাণস্পন্দনরূপে। স্বাধীনতা-উত্তর নিম্নমধ্যবিত্ত সমাজের এক অতিপরিচিত আইডিয়ালিস্ট চরিত্র লেনিন। পেশায় শিল্পী। মননে স্বপ্নচারী। তার বাস্তব অস্তিত্ব তথা সামাজিক অস্তিত্বের ঊষর পথে স্বপ্ন আসে সংশয় হয়ে কিংবা বলা যায় বাস্তবতা আর দৈনন্দিন জীবনের প্রাপ্তি-অপ্রাপ্তির জটিল সংশয়ে সে হয়ে ওঠে স্বপ্নবোনা এক ভাস্কর। অস্তিত্ববাদী দর্শন আর ফ্রয়েডীয় মনোবিকলন সূত্রজাত এক চরিত্র লেনিন। নিম্নমধ্যবিত্ত জীবনের বাস্তবতায় তার অপূর্ণতা আর আকাঙ্ক্ষাসমূহ ‘হয়ে ওঠা’র বা পূর্ণতার দিকে ধাবমান হয় নিয়ত তার কল্পনায়। সেখানে সে একান্তই স্বাধীন ও একাকী।
বাস্তবের অর্বাচীন বালকদের হাততালি আর হেসে কুটিকুটি হবার ভঙ্গি দেখে সে ফিরে আসে বাস্তবের পোড় ভূমিতে। এভাবেই মুহুর্মুহু বাস্তব আর কল্পনাময় ফ্যান্টাসির দ্বান্দ্বিক প্রয়োগে কেন্দ্রীয় চরিত্র লেনিনের পাওয়া না পাওয়ার সাইকো অ্যানালাইসিস বর্ণিত হয়েছে সূর্যকন্যা ছবিতে।
চলচ্চিত্রটির সূর্যকন্যা নামকরণে এক কন্যার প্রসঙ্গ বিধৃত। লেনিনের কল্পিত এক নারীমূর্তি এই সূর্যকন্যা। উচ্চবিত্ত বন্ধু রাসেলের দোকানের জন্য ম্যানিকিন গড়ে লেনিন আর ম্যানিকিনের মাঝেই সে অর্পিত করে তার আকাঙ্ক্ষিত নারীর অবয়ব। লাবণ্য, ইউরিডিস, তানিয়া কিংবা ভিনাসের মিথতুল্য সৌন্দর্যের অবয়বে এই নারীমূর্তি আবির্ভূত হয় লেনিনের ফ্যান্টাসির জগতে। অসূর্যস্পশ্যা এই কল্পিত চরিত্রটির মাঝে বিধৃত হয়েছে নারীর বন্দিত্ব এবং সেই বন্দিত্ব থেকে মুক্তির তীব্র আকাঙ্ক্ষা। যুগ যুগ ধরে পুরুষের নিপীড়ন আর অবদমনে প্রান্তিকায়িত এই বন্দিত্বের ইতিহাস বর্ণিত হয়েছে।
নারীর ঊনমানব বা অসম্পূর্ণ অস্তিত্বের প্রসঙ্গটি তুলে আনেন আলমগীর কবির লেনিনের কল্পনার নারীমূর্তির মধ্য দিয়ে। সত্যিকার অর্থে প্রচলিত বাণিজ্যিক ছবিতে ‘নারী ব্যক্তিমানুষ হিসেবে আসে না, আসে যৌনতার নৈর্ব্যক্তিক প্রতীক হিসেবে। এ যৌনতা আন্ডারটোনে চিহ্নিত জীবনানুগ যৌনতা নয়, কুৎসিত যৌনতা। তা জীবনের eroticism নয় বলেই ভালগার সেক্স। ব্যবসায়িক ছবিতে গণিকার উপস্থিতি প্রত্যক্ষভাবে না থাকলেও এক ধরনের গণিকামনস্কতা, ব্রথেল মেনটালিটি কাজ করে নির্মাতা ও দর্শক উভয়ের দিক থেকে।’৩ বাংলাদেশের চলচ্চিত্রশিল্প, সংকটে জনসংস্কৃতি শীর্ষক গবেষণাগ্রন্থে গীতি আরা নাসরিন ও ফাহমিদুল হক এ সিদ্ধান্তে উপনীত হন যে, এদেশের সিংহভাগ ছবিতে নারী প্রধানত যৌন উপকরণ হিসেবে উপস্থাপিত হয়েছে। আর ধর্ষণের মতো একটি ভয়ংকর যৌন অপরাধকে প্রধানত যৌন-উত্তেজনা প্রদানের জন্যই বারংবার ব্যবহার করা হয়েছে এ সকল ছবিতে।৪ সুতরাং এদেশীয় বাণিজ্যিক ছবিতে নারীকে যৌনতার প্রতীক হিসেবে চিত্রায়িত করার যে প্রবণতা তার ঊর্ধ্বে উঠে নারীর শৃঙ্খল মুক্তির প্রসঙ্গ সূর্যকন্যা চলচ্চিত্রে উপস্থাপন নিঃসন্দেহে একটি যুগান্তকারী উদ্যোগ। তবে এই যুগান্তকারী উদ্যোগকে শেষাবধি নারীর মুক্তি বা শৃঙ্খল ভাঙার তীব্র উচ্চারণের পর্যায়ে নিয়ে যেতে পারেন না আলমগীর কবির। শেষ দৃশ্যে মানবী চরিত্রকে লেনিনের বোন ক্লিওর বান্ধবী সুজলার বাস্তব রূপে প্রয়োগ ও ‘অতঃপর তাহাদের সুখে শান্তিতে কালাতিপাত’-এর মধ্য দিয়ে কবির নারীর ‘গৃহবধূ’ বা ‘ভার্যা’ ইমেজের ফিউডাল দৃষ্টিভঙ্গি চিত্রায়ণ করেন প্রকারান্তরে। হয়তো প্রযোজকের পুঁজির কাছে আত্মসমর্পণ করেছিলেন আলমগীর কবির। তাই পিতৃতন্ত্রের পরাক্রম পেরিয়ে নারীমুক্তির পুনঃপাঠ নির্মাণে অপারগ হন তিনি শেষ পর্যন্ত। কিংবা লেনিন চরিত্রের অবদমিত আকাঙ্ক্ষা আর মধ্যবিত্ত প্রবণতাজাত স্ববিরোধিতায় আলমগীর কবির প্রচলিত ইতিহাসকে ভাঙতে পারেন না। তিনি প্রান্তিকায়িত নারীসত্তার আর্তি, যন্ত্রণা, স্বপ্নভঙ্গ চিত্রায়িত করলেও শেষাবধি পুরুষের ভালোবাসা প্রাপ্তিতেই নারীর মুক্তি ও লৈঙ্গিকভাবে নির্ধারিত নারীসত্তার এক পিতৃতান্ত্রিক রূপই প্রতিভাত করেন এই ছবিতে। কবির তাঁর চলচ্চিত্রে নারীমুক্তির মীমাংসায় অপারগ ছিলেন বলেই চিত্রনাট্য যখন প্রকাশ করলেন বই আকারে, তখন চিত্রনাট্যের শেষে লেনিনকে পুরোপুরি schizophrenic হিসেবে উলে�খ করতে ভুললেন না।৫ এ যেন চলচ্চিত্রে নিজেকে যথাযথভাবে প্রকাশের অপারগতাকে আবারো জানান দেওয়ার এক লিপিবদ্ধ স্বীকৃতি। অর্থাৎ চলচ্চিত্রে এই যে দুজনার মিলন তা যেন লেনিনের মানসিক বিভ্রান্তির এক রূপ – তা স্বপ্ন না বাস্তব এ-প্রসঙ্গে লেনিনের মতোই তিনি নিজেও বিভ্রান্ত।
চলচ্চিত্রের কাহিনি সংক্ষেপ
নিম্নমধ্যবিত্ত পরিবারের একজন বেকার চিত্রশিল্পী লেনিন। লেনিন প্রায়শই কল্পনায় ভেসে বেড়ায় নিম্নমধ্যবিত্ত জীবনের বাস্তবতার তীব্রতা থেকে পলায়নের উদ্দেশ্যে। বাস্তব জীবনের ব্যর্থতাগুলোকে সে তার কল্পনায় সার্থক করে নেয়। কেরানি বাবার স্বপ্ন ছিল তাকে ডাক্তার বানানোর। সেবাধর্মে ব্রতী হয়ে এ স্বপ্ন তিনি দেখেননি, বরং প্রচলিত অর্থে ডাক্তার হলে কাঁড়ি কাঁড়ি অর্থ উপার্জন করা যেত। কিন্তু ছেলে তার ডাক্তার না হয়ে একজন বেকার পেইন্টার হয়েছে, যাকে কি না এখনো তার ভরণপোষণ দিতে হয়। অন্য আর দুজন সন্তানকে নিয়ে এখনো তিনি আশাবাদী। ছোট ছেলে বুলুকে ডাক্তার বানাবেন, মেয়ে ক্লিওকে বিয়ে দেবেন ভালো ঘর কিংবা আমলা দেখে। নিজে কেরানি হয়েও সন্তানদের দিয়ে উচ্চবিত্ত মহলে পা রাখার এই গোপন অথচ একান্ত আকাঙ্ক্ষা তার ষোলোআনা। লেনিনের বেকারত্ব আর নিষ্ক্রিয়তা নিয়ে একদিন বাবা গালমন্দ করায় রাগ করে বাড়ি থেকে বেরিয়ে যায় লেনিন। পথে হঠাৎ করেই দেখা হয় পুরনো কলেজ বন্ধু রাসেলের সঙ্গে। রাসেল উচ্চবিত্ত পরিবারের ছেলে। আর্থিক প্রতিপত্তির কারণে তার মানসিকতায় লেনিনের মতো কল্পনাপ্রবণতা বা দ্বিধাগ্রস্ত কোনো বৈশিষ্ট্য নেই। সে বাস্তববাদী। বিলেতে পড়াশোনার কারণে তার চালচলন আর মানসিক গড়নে বিলিতি ছাপটা স্পষ্ট। তথাকথিক প্লেটোনিক প্রেমে তার আস্থা ততটা নেই, সে মনে করে বিয়ের ঘানিতে সব ভালোবাসা কিংবা আবেগ নিংড়ে বেরিয়ে পড়ে। এ কারণেই তার বিয়েটা বেশিদিন টেকেওনি। এখন প্রেম চলছে পাঁচতারা হোটেলে তার স্টেশনারিজ শপের সেলস এক্সিকিউটিভ মনিকার সঙ্গে – শারীরিক প্রেম। মনিকা এই প্রেমের স্বীকৃতি চায়, কিন্তু রাসেল বিয়ের ঘেরাটোপে পড়তে নারাজ। প্রত্যাখ্যাত হয়ে মনিকা রাসেলের সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করে বিদেশ পাড়ি দেবার পরিকল্পনা করে। মনিকার চলে যাবার পর রাসেল বুঝতে পারে মনিকাকে ছাড়া তার অস্তিত্বের অসাড়তা। শেষ পর্যন্ত সে মনিকাকে ফিরিয়ে আনতে বাধ্য হয়।
রাসেলের প্রস্তাবে লেনিন তার দোকানে ডিসপে� আর্টিস্টের কাজ নেয়। শুরু হয় অফিস আওয়ারের পর লেনিনের মূর্তি বানানোর এক একান্ত ও একাকী মুহূর্তগুলোর। একদিন ম্যানিকিনটি অর্থাৎ মানবী মূর্তিটি জেগে ওঠে। প্রথমে ভয় পেলেও পরে ধীরে ধীরে এই মানবী মূর্তির প্রেমে পড়ে লেনিন। এই মানবী মূর্তিটি সূর্যকন্যা। সে লেনিনের কাছে বলে চলে পুরাকালে ঘটে যাওয়া তার জীবনকাহিনি। একদিন সে ছিল মুক্ত, তারপর শক্তিতে মত্ত পুরুষ বন্দি করে তাকে। এরপরের ইতিহাস নারীর তথা সূর্যকন্যার বন্দিত্বের ইতিহাস। সে মুক্ত হতে চায়। লেনিনের কামনাবিহীন প্রেমই পারবে তাকে মুক্ত করতে। কিন্তু রক্ত-মাংসের লেনিন তাতে প্রথমে অসম্মত হলেও শেষ পর্যন্ত চাওয়া-পাওয়াবিহীন নিঃশর্ত প্রেমে প্রতিশ্রুত হয়। মানবী তাকে এও প্রতিশ্রুতি করিয়ে নেয় যে, মুক্ত অবস্থায় লেনিন যেন তাকে তার পূর্বের এই জীবন আর মনে করিয়ে না দেয়। মুক্তির দিন ঘনিয়ে এলে পরের দিন ভোর চারটায় মানবী তাকে আসতে বলে এবং লেনিনের সান্নিধ্যেই তার মুক্তি ঘটবে। লেনিন রাসেল আর মনিকার বিয়েকে উপলক্ষ করে রাসেলের অনুরোধে ড্রিংক করে – যথারীতি ঘুমিয়েও পড়ে। রাত চারটার কিছু আগে ঘুম ভাঙলে সে দৌড়ে যায় উদ্ভ্রান্তের মতো হোটেলের উদ্দেশে। শেষ দৃশ্যে দেখা যায়, হাত-পা কেটে আহত লেনিন শুয়ে আছে হাসপাতালের বিছানায়। মনে পড়ে হোটেলে রাতে উদ্ভ্রান্তের মতো দৌড়ে যাবার সময় কাচ ভেঙে ওর আহত হবার ঘটনা। হঠাৎ হাসপাতালের বিছানার পাশে দেখে মানবীকে। মা মানবীকে পরিচয় করিয়ে দেয় ক্লিওর বান্ধবী সুজলা হিসেবে। লেনিন তার পূর্ব প্রতিজ্ঞা অনুযায়ী চুপ থাকে। তারপর বিভিন্ন শটে লেনিন ও সুজলার মিলনাত্মক দৃশ্য ও শেষে গ্রাফিক্সে দৃশ্যমান হয় ‘তারপর তারা পরমসুখে কালাতিপাত করিতে লাগিল’ – এরপর ছবির পরিসমাপ্তি হয়।
প্রটাগনিস্ট লেনিন : অবদমিত আকাঙ্ক্ষা ও
অন্বিষ্ট অস্তিত্বের প্রত্যাশা
এদেশীয় প্রচলিত বাণিজ্যিক ছবিতে আমরা বহুগুণে অভিষিক্ত নায়ক দেখে অভ্যস্ত। সে একইসঙ্গে সুদর্শন, উদার, শক্তিমান ও বুদ্ধিতে নরশ্রেষ্ঠ। মুহূর্তেই সে তার পেশির শক্তিতে এক হাতেই কুপোকাত করে দুর্ধর্ষ গুন্ডার দল। সাময়িকভাবে কিছুটা বিপর্যয় বা দারিদ্র্য থাকলেও শেষ পর্যন্ত রাজকন্যাসহ (নায়িকা) রাজ্যের একচ্ছত্র প্রাপ্তি ঘটে তার ছবির পরিসমাপ্তিতে আপন বাহু ও মেধাবলে। এভাবেই বাংলা ছবির গতানুগতিক ধারা দর্শকের কাল্পনিক স্বপ্ন পূরণের ইচ্ছায় ঘৃত ঢেলে এসেছে বছরের পর বছর, ‘মহান নায়ক’ চরিত্রের ইমেজ সৃষ্টির মধ্য দিয়ে। ঠিক এই রূপ চলচ্চিত্র বাস্তবতায় একজন কেন্দ্রীয় চরিত্র লেনিনের আবির্ভাব দেখি সূর্যকন্যায় ব্যক্তির পারা না পারার হিসাব-নিকাশ আর সেই সূত্রে কল্পনায় পলায়নের এক ফ্রয়েডীয় চরিত্ররূপে। পুঁজিবাদী সমাজবাস্তবতায় লেনিন তার অতৃপ্ত আর বুভুক্ষু আকাঙ্ক্ষাগুলো দ্বারা তাড়িত হয়ে ক্রমেই কলান্ত আর বিপর্যস্ত এক অ্যান্টিহিরো।
আলমগীর কবিরের ভাষায় লেনিন হলো ‘আমাদের উঠতি মধ্যবিত্ত সমাজের অতি পরিচিত একটি চরিত্র। নির্ভেজাল, নিম্নবিত্ত আইডিয়ালিস্ট। অন্তরটা ওর আসল লেনিনের মতোই উদার। কিন্তু বাস্তবে, কর্মক্ষমতার মাপকাঠিতে, একজন মধ্যবিত্তের মতোই এফিশিয়েন্ট বা ইনএফিশিয়েন্ট। আশপাশের দারিদ্র্য তাকে ভীষণ রকম বিব্রত করে। কলমের খোঁচায় বা ছবি এঁকে যদি এই অসম সমাজব্যবস্থার একটা বিহিত করা সম্ভব হতো তাহলে সে আজই তা করে দিত। কিন্তু যেহেতু বিপ�ব ছাড়া আমূল পরিবর্তন সম্ভব নয়, সেহেতু সে গোলমাল এড়িয়ে কল্পনার রাজ্যে পালিয়ে বেড়ায়।’৬ শুধুমাত্র দারিদ্র্যজনিত অসম সমাজব্যবস্থায় লেনিনের এই এসকেপিজম বা পলায়ন নয়। নারীর আকাঙ্ক্ষা বা নারীসঙ্গের অতৃপ্তিও আছে তার মাঝে। এই অতৃপ্তি থেকেই সে তার গড়া ম্যানিকিন মূর্তিটির মাঝে আরোপ করে ওর আকাঙ্ক্ষিত নারী চরিত্রের সকল সৌন্দর্য। ম্যানিকিনের কল্পমানবীর বাস্তবে জেগে ওঠার যে ফ্যান্টাসি এই ছবিতে নির্মিত হয় তাও লেনিনের ফ্রয়েডিক চেতনার এক মনোবিকলন মাত্র। লেনিন তার কল্পলোকের মানবীকে নিয়ে সূর্যকন্যা ছবিতে যে ফ্যান্টাসির জগৎ রচনা করে তা একান্তই তার বা আলমগীর কবিরের ‘mise-en-scene of desire’।
নিজ দারিদ্রে্যর কথা ভেবেই কলেজে পড়ার সময় মেয়েদের প্রতি লেনিনের মুগ্ধতা থাকলেও প্রেম করার সাহস হয়নি কারো সঙ্গে। বন্ধু রাসেল গাড়ি হাঁকিয়ে কলেজে আসত, ওকে দেখলেই মেয়েদের চোখের পাতায় যে কাঁপন ধরত তা চোখ এড়াত না লেনিনের। অর্থাৎ মেয়েদের পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে অবলোকন ও সেই অবলোকন থেকে অন্য পুরুষের প্রতি মুগ্ধতার যে প্রমাণ সে পেত তাতে তার মাঝে একধরনের আত্মবিশ্বাসের অভাব আর হতাশা যে ছিল তা স্পষ্ট হয়ে ওঠে।
সুযোগের অভাবেই লেনিন নারীসঙ্গ থেকে বঞ্চিত। এ-প্রসঙ্গে সে কৈশোরের এক ব্যর্থ প্রয়াসের স্মৃতিও রোমন্থন করে। প্রতিবেশী শিপ্রার মা যখন দুপুরবেলায় ঘুমোচ্ছিল তখন শিপ্রার সঙ্গে হিপনোটিজম খেলতে খেলতে লেনিন খুব কাছাকাছি আসে শিপ্রার। ফ্ল্যাশব্যাক এই দৃশ্যটিতে দুজন কৈশোর-উত্তীর্ণ ছেলেমেয়ের এক শারীরিক প্রেমের দৃশ্য সৃষ্টির পূর্বমুহূর্তের উত্তেজনা সৃষ্টি হয়। পরমুহূর্তেই বাজখাঁই গলায় শিপ্রার মায়ের প্রবেশে আভাঁ-গার্দীয় কৌশলে এদেশীয় কৈশোর রোমান্সের ব্যর্থতার এক বাস্তব ব্যঙ্গচিত্র নির্মিত হয়। এভাবে এ চলচ্চিত্রে লেনিনের নারী আকাঙ্ক্ষাজনিত হতাশাগুলো কখনো ব্যঙ্গচ্ছলে, কখনো হাসিঠাট্টায় উঠে এলেও এগুলো মূলত লেনিনের নারীবিষয়ক অপ্রাপ্তির খন্ডচিত্র। আর এই অপ্রাপ্তিসমূহ তাকে কল্পনাপ্রবণ করে তোলে। সে নিজেকে পূর্ণতার দিকে ধাবিত করে কল্পিত এক মানবী মূর্তি সৃষ্টির মধ্য দিয়ে এবং সেই মানবীর ভালোবাসাপ্রাপ্তির এক কাল্পনিক সম্ভাবনা সৃষ্টির মধ্য দিয়ে। লেনিনের এই কল্পনাচারিতার স্তরটিতে একই সঙ্গে যেমন ফ্রয়েডীয় মনোবিকলনের ধ্বনি স্পষ্ট, তেমনি অস্তিত্ববাদী দর্শনের প্রণোদনাও দুর্লক্ষ্য নয়। কারণ ‘অস্তিত্ববাদী দার্শনিকদের মতে, ক্রিয়াশীল অবস্থাটি হচ্ছে ‘হয়ে ওঠা’, কোনো একটি অপূর্ণাঙ্গ অবস্থান থেকে পূর্ণতার দিকে নতুন কিছু হয়ে ওঠা।…মানুষের এই হয়ে ওঠার প্রবণতা ও প্রক্রিয়ার ক্ষেত্রে সে সম্পূর্ণ স্বাধীন এবং নিঃসঙ্গ।’৮ লক্ষণীয়, লেনিনও এই চলচ্চিত্রে তার অপূর্ণতাগুলোকে পূর্ণতা দিতে চায় কল্পনার ভূমিতে এবং তার এই কল্পনারাজ্যে বিচরণ কিংবা কাল্পনিক অনুষঙ্গসমূহ একান্তই তার। এ কারণেই মানবীকে লেনিন ছাড়া অন্য কেউ দেখতে পায় না। এ মানবী তার নিজস্ব এবং এর বৈশিষ্ট্যসমূহও লেনিনের স্বসৃষ্টিজাত। কিংবা বাঁশির আওয়াজের অনুষঙ্গে লেনিন যখনই কল্পনার রাজ্যে প্রবেশ করে তখন আমরা লক্ষ করি বাস্তবের অপ্রাপ্তি বা ব্যর্থতাগুলোর ‘হয়ে ওঠা’র প্রবণতা। এ কারণেই কল্পনায় সে সহজেই হাইজ্যাকারকে পরাস্ত করে ফেলে কিংবা শ্রেষ্ঠ বোলার লারউডের অফ স্টাম্পের ওপরে ওভারপিচ ধরনের বলকে সজোরে পাঠিয়ে দেয় প্যাভিলিয়ন ছাড়িয়ে পল্টন পেরিয়ে এক্কেবারে রেললাইনের ওপারে। এ যেন ফ্রয়েডীয় রফের এক সিনেমাটিক ভার্সন, যেখানে লেনিনের কল্পনার জগৎ প্রতিনিয়তই instinctive drive to create-এর দিকে ধাবমান।
লেনিন চরিত্রের সামগ্রিক গঠনে ফ্রয়েডীয় মনোবিকলন তত্ত্বজাত সাইকো অ্যানালাইসিস স্পষ্ট। লেনিন শিল্পী। শিল্পে তার প্যাশন বা নিমগ্নতার উৎসটি অনেক ক্ষেত্রেই দ্বিধাগ্রস্ত। ছবি অাঁকার বিনিময়ে অর্থপ্রাপ্তির বিষয়টি তার কল্পনায় বা অবচেতনের এক অবদমিত আকাঙ্ক্ষা। অবদমিত আকাঙ্ক্ষা এই কারণে যে, বাস্তবে সে তার ছবিকে সেই শৈল্পিক সার্থকতা দিতে পারে না, যার কারণে তার ছবি বিক্রিও হয় না। ফলস্বরূপ বাবার অর্জিত আয়ের ওপরই নির্ভর করতে হয় তাকে। বাবার গঞ্জনায় লেনিন মুহূর্তেই চলে যায় কল্পনায়, বিশ-ত্রিশ হাজার টাকায় বিক্রি করে চলে তার ছবি। উচ্চবিত্ত ক্রেতা যখন কল্পনায় তাকে অর্থ পরিশোধ করে, তখন সে টাকার ভেতরই দেখতে পায় নিজের ছবি। এভাবে বুর্জোয়া বাস্তবতায় ব্যক্তির ব্যর্থতার এক সুররিয়ালিস্টিক ডিসকোর্স রচনা করেন আলমগীর কবির। আবার প্যারিস যেতে না পারাকে একটি কারণ হিসেবে দাঁড় করিয়ে নিজ শিল্পীজীবনের ব্যর্থতার যে আক্ষেপ আমরা লক্ষ করি লেনিনের মাঝে তাও তার ব্যর্থতা ঢাকারই একটা উপায়মাত্র।
লেনিন তার সব ব্যর্থতা আর আকাঙ্ক্ষাগুলোকে পূর্ণতাদানের কৌশল হিসেবে সৃষ্টি করে মানবীর। আর এই মানবীর মধ্য দিয়ে নারীমুক্তির যে আকাঙ্ক্ষা ব্যক্ত হয়েছে তাও লেনিনের নিজস্ব সৃষ্টি। মধ্যবিত্ত জীবনে সে তার মা-বোনকে দেখেছে দৈনন্দিন গৃহস্থালি কাজের চার দেয়ালে। পিতৃতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থার নিষ্পেষণ আর বৈষয়িক চিন্তার বেড়াজালে তাদের মুক্তচিন্তা যেন সেখানে অসম্পূর্ণ। এ কারণেই ক্লিওর প্রেমিকের কবিতা লেখার প্রসঙ্গে ক্লিওর বৈষয়িক চিন্তা স্পষ্ট হয়ে ওঠে।
এবার আসা যাক মায়ের প্রসঙ্গে। বাবার আধিপত্য, ইচ্ছায় পরিচালিত হয়েছে মায়ের ইচ্ছা, কর্ম কিংবা চিন্তাভাবনা। এ কারণেই দেখি লেনিন যখন তার চাকরির খবর মাকে দেয় তখন সঙ্গে সঙ্গেই মা বলেন :
মা : প্রথম মাসের মাইনের টাকাটা পেয়ে তোর বাবার হাতে দিস। খুশি হবেন!
মায়ের এই জীবনকে তার অবচেতনে হয়তো মনে হয়েছে বন্দিত্বেরই অপর এক রূপ। এ কারণেই সেও তার কল্পিত নারীমূর্তিকে সেই বন্দিত্বের বেড়াজালেই আবিষ্কার করে। এবং সে নিজেই হয়ে ওঠে মানবীর এই বন্দিত্ব অপনোদনের এক কল্পিত নায়ক। ফ্রয়েডের মনোবিকলন তত্ত্বের ব্যাখ্যাকার ফরাসি আকরণবাদী তাত্ত্বিক জাক লাকাঁর মতে, ‘বাবা হলেন ‘আইনগত বিধি’র চিহ্নায়ক, যার মধ্য দিয়ে সামাজিক বিধিনিষেধ ব্যক্ত হতে থাকে। মায়ের সঙ্গে শিশুর লিবিডোগত সম্পর্কে ছেদ পড়ে; তখন বাবার প্রবল উপস্থিতির মধ্যে শিশু সেই পারিবারিক ও সামাজিক বিধিবিন্যাসের ব্যাপক বয়ানকে অনুভব করে, সে নিজেও যার অপরিহার্য অংশ। [….] বাবার উপস্থিতি শিশুকে মা থেকে বিচ্ছিন্ন করে না কেবল; ক্রমে ক্রমে তার আকাঙ্ক্ষার কোরকগুলি উন্মীলিত হওয়ার বদলে পাতালচারী হতে থাকে। অবচেতনে গুহায়িত হয়ে যায় তার উন্মেষপ্রবণ সত্তার বিপুল পরিধি।’১১ সূর্যকন্যা ছবিতেও দেখি লেনিনের বাবা তার চিন্তাভাবনার বিপরীত মেরুর এক বিধিনিষেধের প্রতীক। বাবা চেয়েছিলেন তাকে ডাক্তার বানাতে, কাঁড়ি কাঁড়ি অর্থ উপার্জন সম্ভব হতো তাতে। লেনিনের ছবি অাঁকার বিষয়টি তার কাছে কখনোই একটি ভালো কিংবা সৃষ্টিশীল কাজের স্বীকৃতি হয়ে দেখা দেয়নি। বরং বাবার খেদোক্তিতে ছবি অাঁকার প্রসঙ্গটি অমানুষ হয়ে যাওয়া হিসেবেই উঠে এসেছে পরোক্ষভাবে।
বাবার বিধিনিষেধের বেড়াজালে নিজেকে যেমন বন্দি মনে হতো লেনিনের, তেমনি মায়ের বন্দিত্বও তার অবচেতনে সক্রিয় ছিল। আর এ কারণেই কল্পিত মানবী তার সম্মুখে হাজির হয় নারীর হাজার বছরের শৃঙ্খলিত ইতিহাসসমেত। আর এই শৃঙ্খল ভাঙার ক্ষেত্রে লেনিন শর্তহীন ভালোবাসা ছাড়া তেমন কোনো সক্রিয় উদ্যোগ গ্রহণে অপারগ। কারণ পুরো বিষয়টিই ঘটেছে তার কল্পনায়। আর এ কারণেই শেষ পর্যন্ত কল্পিত নারীকে বাস্তবে সুজলা হিসেবে পাওয়ার মধ্য দিয়েও লেনিনের কল্পনা আর বাস্তবের একাকার হওয়া এক সিজোফ্রেনিক অবস্থাই উঠে আসে। যদি কেউ এতে নারীমুক্তি বিষয়ে আলমগীর কবিরের ব্যর্থতার ইঙ্গিত দেন তবে তাতে লেনিনের মধ্যবিত্ত জীবন উদ্গত ব্যর্থতা বা আকাঙ্ক্ষাসমূহের ভাষ্য পঠনের অপারগতাই তীব্রতর হয়।
সমালোচক এই ছবিতে যুগপৎ পুঁজিবাদ ও পুরুষতন্ত্রের জয়ের চিত্রায়ণে নারীমুক্তির প্রসঙ্গে আলমগীর কবিরের ব্যর্থতার প্রসঙ্গ টেনে বলেন, ‘[….] এ চলচ্চিত্রে আলমগীর কবিরের বিনির্মিত নারীমুক্তির জ্ঞানে কর্তৃত্ব করেছে পুঁজিবাদ ও পুরুষতন্ত্রের ভাষাবলয়।’১২ সমালোচক মাহমুদুল হোসেনের মতে, সূর্যকন্যার চিহ্নিত সমস্যা পুরুষশাসিত সমাজে নারী শোষণ এবং তার মুক্তি। মূল কাহিনিতে একটি রূপকে তিনি বিষয়টি তুলে ধরতে চেয়েছেন। রূপকের যথার্থতা অনেক ক্ষেত্রেই প্রশ্নসাপেক্ষ। নিম্নমধ্যবিত্ত শিল্পী লেনিনকে যদি সংস্কারমুক্ত এবং মূলপ্রবাহ থেকে বিচ্ছিন্ন একজন পুরুষ হিসেবেও গ্রহণ করা যায়, তবু তার প্রায় নিষ্ক্রিয় তপস্যা (!) কী করে মূর্তির পাষাণ মুক্তি ঘটায় তা বোধগম্য নয়। অর্থাৎ সচেতন পুরুষের উদ্যোগকে যদি কবির কামনা করেন তাতে আপত্তি নেই; কিন্তু নারীমুক্তি আন্দোলনে যে পুরুষের ভূমিকা কিংবা নারীর নিজস্ব উদ্যোগ এর কোনো কিছুই নির্দেশায়িত হয় না ছবিতে।১৩
এ-প্রসঙ্গে উলে�খ্য, নারীমুক্তি বিষয়ে আলমগীর কবিরের দর্শনের ব্যর্থতা নয়, বরং লেনিনের দৈনন্দিন জীবন থেকে উদ্ভূত নারীর অবস্থান আর আকাঙ্ক্ষাগুলো এই ছবিতে উঠে এসেছে। যেখানে লেনিনের মধ্যবিত্ত যাপিতজীবন ও সেই জীবনব্যবস্থায় অপারগ আর অবদমিত চাওয়া-পাওয়াগুলো এসেছে ফ্যান্টাসির খোলসে। এখানে নারীর মুক্তির আকাঙ্ক্ষা আছে, আছে প্রচলিত বুর্জোয়া সমাজব্যবস্থা থেকে উত্তরণের তীব্র চাওয়া। কিন্তু শেষ পর্যন্ত এই বাস্তবের পোড় ভূমিতে তার একার ইচ্ছাগুলো সত্যি হয়ে আসে না, আর ইচ্ছেগুলোর এই পরিণতিকে আলমগীর কবিরের ব্যর্থতা হিসেবে যাঁরা সংজ্ঞায়িত করতে চান তাঁরা মধ্যবিত্ত এই কল্পনাপ্রবণ অ্যান্টিহিরো চরিত্র লেনিনের ব্যক্তিচরিত্রের প্রবণতাসমূহের বিশ্লেষণে কতটা সুবিবেচনা করেছেন সে প্রশ্ন থেকেই যায়। বিপ্লব ছাড়া নারীর এই মুক্তি যে সম্ভব নয় তা ছবির মধ্যেই বর্ণিত হয়েছে। সভ্যতার আদিতে মেয়েদের কর্তৃত্ব ছিল কিন্তু তারপরেও কেমন করে সে ইতিহাস উলটো পথে হেঁটে পুরুষের কর্তৃত্বাধীন হলো তা জানতে লেনিন তার ইতিহাসবিদ মামার কাছে যায়। তখন মামা সম্পদের উত্তরাধিকার সন্তানের মাঝে বণ্টনের উদ্দেশ্যে পুরুষ কর্তৃক নারীর বন্দিত্বের ইতিহাস বর্ণনা করেন। অ্যানিমেশনচিত্রে সভ্যতার এই জটিলতর অধ্যায়টি মামার অফ ভয়েসে চমৎকারভাবে উঠে আসে।
সত্যিকার অর্থেই লেনিন বাঙালি নিম্নমধ্যবিত্ত সমাজের এক চারিত্রিক আয়না। তার মাঝে আকাঙ্ক্ষা আছে, আছে চিন্তাপ্রবণ ভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গি। এ কারণেই সে সমাজের অসামঞ্জস্য আর ত্রুটিগুলো সহজেই ধরতে পারে। কিন্তু মধ্যবিত্তের দ্বিধাগ্রস্ত প্রবণতাও তার মাঝে ক্রিয়াশীল সম্পূর্ণরূপে। ফলস্বরূপ অসামঞ্জস্য বা খন্ডিত সমাজব্যবস্থার ত্রুটিগুলোর অপনোদনে তার নেই কোনো ক্রিয়াশীল উদ্যোগ। অন্বিষ্ট অস্তিত্বের পূর্ণতায় সে কেবলই ভেসে বেড়ায় ফ্যান্টাসির অলীক জগতে, এ যেন ফ্রয়েডীয় prospect of lasting existence-এর রূপায়ণের এক নিদারুণ ও সার্থক কৃৎকৌশল।
দ্বান্দ্বিকতার থিসিস চরিত্র রাসেল
রাসেলের চারিত্রিক প্রবণতা লেনিনের বিপরীত কোঠায়। লেনিন যদি হয় অ্যান্টিহিরো তবে রাসেলের অবস্থান ‘হিরোয়িক’ প্রবণতার সঙ্গে সংগতিপূর্ণ। কিংবা এভাবেও বলা চলে, লেনিন যদি হয় সূর্যকন্যা ছবির মূল কাহিনি পর্বের অ্যান্টিথিসিস তবে সেখানে রাসেলের অবস্থান থিসিস আকারে উঠে এসেছে। এভাবে সমাজের দুপ্রান্তের দুটি শ্রেণিচরিত্র রাসেল ও লেনিনের সহাবস্থান ও দ্বান্দ্বিকতায় সূর্যকন্যা ছবিতে যে অ্যালিয়েশন রচিত হয় তাতেই ছবিটির প্রাগ্রসরতা ও নির্মিতি। কল্পনাবিলাসিতা নেই রাসেল চরিত্রে। উচ্চবিত্তে তার শ্রেণিগত অবস্থানের কারণেই তার চাওয়া-পাওয়া অবদমিত নয়। সেক্স কিংবা যৌনতা বিষয়েও তার সিদ্ধান্ত খুব স্পষ্ট ও সরল। এ কারণেই মনিকার সঙ্গে তার শারীরিক সম্পর্কের বিষয়টি প্রথমে প্রাধান্য পায়, পরে শরীরজাত প্রেমের সূত্র ধরেই তার ভালোবাসার বিস্তার। সমালোচকের ভাষায় – রাসেলের মধ্যে আমরা উন্মূললক্ষণাক্রান্ত বুর্জোয়ার একাকিত্ব দেখতে পাই – নারী সম্পর্কে যার দৃষ্টিভঙ্গি একান্তই ভোগবাদী, যে হোটেলের ডাবল ডিলাক্স রুমে তার দোকানের কর্মচারী মনিকাকে নিয়ে শারীরিক প্রেম করে এবং বিয়ের প্রশ্নে এড়িয়ে যায়। ফেমিনিস্টের ভাষায় এই রাসেল যথার্থই এমসিপি।১৪
রাসেলের এই শারীরিক প্রেমের অনুষঙ্গে তাকে ভোগবাদী বলা হলেও একজন ভোগসর্বস্ব ব্যক্তির নিপীড়নপ্রবণতা তার মাঝে অনুপস্থিত। এ কারণেই শারীরিক সম্পর্কে লিপ্ত হবার ক্ষেত্রে মানসিক সংশ্লিষ্টতাও ঘটে তার অলক্ষ্যে। হোটেলরুমে মনিকার মন খারাপ দেখে রিচার্ড দ্য থার্ড থেকে লরেন্স অলিভিয়ার অভিনয়ের প্যারোডি করে দেখানোর মাঝে মনিকার মানসিক অবস্থার নিরিখে তার সংবেদনশীল সম্পর্ক রচনার ইঙ্গিত স্পষ্ট। অর্থাৎ ভোগবাদী শারীরিক সম্পর্কের শুধুমাত্র শরীর-নির্ভরতার সমীকরণের বদলে শরীর ও মন দুটোই তার কাছে গুরুত্বপূর্ণ। এ কারণেই মনিকা চলে যাবার পর অস্তিত্বের শূন্যতা ক্রমেই প্রকাশ পেয়েছে রাসেলের নানা অস্থির আচরণে। নতুন এয়ারপোর্টের রানওয়েতে রাসেলের নিঃসঙ্গ আর অস্থির পায়চারিতে পরিচালক মনিকাবিহীন রাসেলের তীব্র একাকিত্বকে তুলে আনেন সিনেমাটিক মন্তাজের সমান্তরালে। কিংবা বার্ডস আই ভিউ থেকে ফাস্ট ফরওয়ার্ডে রাসেলের গাড়ির দ্রুত যাওয়া ও আসার শটে রাসেলের জীবনের ক্লান্তি বা রিপিটেশনকে আলমগীর কবির যখন সিনেমাটিক ব্যঞ্জনায় প্রকাশ করেন তখন ভোগবাদী রাসেলের ওপর দর্শকের করুণা জাগ্রত হয় অনায়াসেই। আত্মগত অনুশোচনা আর আবেগের জটিলতায় রাসেল চরিত্রটি অনেক বেশি ক্রিয়াশীল। এ কারণেই মনিকা চলে যাবার পর নিঃসঙ্গ রাসেলের মনোলগে ভালোবাসার কাছে বিলিতি ছাঁটে গড়ে ওঠা রাসেলে বুর্জোয়া মানসের পরাস্ত হবার চিত্র স্পষ্ট হয়ে ওঠে।
সূর্যকন্যার সিনেমাভাষ্য
সূর্যকন্যা আলমগীর কবিরের দ্বিতীয় কাহিনিচিত্র। প্রথম ছবির মতো এ ছবিতেও আলমগীর কবির মগ্ন থেকেছেন চলচ্চিত্রমাধ্যমের সম্ভাবনাকে নানা মাত্রায় প্রকাশের নিরীক্ষায়। প্রচলিত গল্প বলার স্টাইলকে ভেঙে নিম্নমধ্যবিত্তের অদ্ভুত বিষণ্ণতা আর মনোজগতের ভাষাকে চলচ্চিত্রের ফ্রেমে আলমগীর কবির নিয়ে এসেছেন ফরাসি ‘ন্যুভেল ভাগ’ পরিচালকের স্বভাবে। নিজের লেখা কাহিনি ও চিত্রনাট্যে সিনেমার প্রকরণকে ভেঙেছেন, গড়েছেন দ্বান্দ্বিকতা আর অাঁদ্রে বাঁজা কথিত personal factor চিত্রণের অনুষঙ্গে। ছবির শুরুতেই দেখি নির্মীয়মাণ এয়ারপোর্টে লেনিনের স্কেচ অঙ্কন ও সত্তরের দশকে নাগরিক ঢাকার উপপ্রান্তের এক নৈসর্গিক আবহ নির্মাণের প্রয়াস।
তারপর যাত্রীবোঝাই করা বাসে চড়ে ঢাকার কেন্দ্রে ফিরে আসা ও নগরের রাস্তায় লেনিনের হেঁটে চলার ভেতর দিয়ে কবির বলে চলেন নাগরিক ঢাকার নির্জন-বিষণ্ণ রূপের নান্দী। হঠাৎই এই নির্জনতার মাঝে পথচারীর ছিনতাই হবার প্রসঙ্গের অবতারণা যেন সিনেমাটিক দ্বান্দ্বিকতা নির্মাণের অনুষঙ্গেই সৃষ্ট। ছিনতাই রোধে কোনো কার্যকর পদক্ষেপ নিতে পারে না লেনিন। ওর ক্লোজআপ শটে বাঁশির আওয়াজ, দর্শককে যেন জানান দেওয়া হয় বর্তমান কাল থেকে লেনিনের কল্পনার জগতে প্রবেশের ব্রেখটীয় সাইরেনরূপে। পিছিয়ে যায় present continuous tense। বাস্তবের সময়কে ভেঙে লেনিনের ফ্যান্টাসির ভাষ্যে দর্শকের প্রবেশ – হাইজ্যাকারকে এবার কুপোকাত করে লেলিন, অসহায় পথচারীর হাতে ফেরত দেওয়া তার হৃত অর্থ। আবারও বাঁশির আওয়াজ, লেনিন ও তার পোড় বাস্তব ব্যঙ্গ হয়ে ঝুলে থাকে, যেখানে হৃত পথচারীকে পকেট থেকে সামান্য কিছু অর্থ সাহায্য করা ছাড়া আর কিছুই করার সামর্থ্য নেই এই চিত্রশিল্পী লেনিনের। এভাবে ‘La politique des Auteurs’ বা ‘অঁতর থিওরি’জাত প্রবণতায় এই ছবিতে নিয়তই উচ্চারিত হয়েছে চৈতন্যের গভীর মনস্তাত্ত্বিক ফ্যানটাসি আর নির্মম বাস্তবের ডায়লেকটিকস।
লেনিনের মনোজাগতিক ফ্যান্টাসি রচনায় কবিরের এই চলচ্চৈত্রিক প্রকরণ সত্যিকার অর্থেই এদেশীয় ছবির ধারায় এক আধুনিক উদাহরণ আজো। কারণ, ‘Fantasy is inextricably linked with desire, which, accroding to Lacan, is located in the Imaginary Ñ that is, the unconscious. Fantasy, then, is the conscious articulation of desire, through either images or stories – it is, then, the mise-en-scene of desire.’১৫ সত্যিকার অর্থেই, mise-en-scene of desire-এর রূপকল্পে কবির যেন সুররিয়ালিস্টিক চিত্রশিল্পীর প্রবণতায় এ ছবিতে চলচ্চিত্রমাধ্যমকে ব্যবহার করেছেন লেনিনের মনোসমীক্ষণের ভিস্যুয়াল নির্মাণের লক্ষ্যে।
নিজে সক্রিয় বাম আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন তবু ভাবপ্রবণতা এড়াতে পারেননি কবির। তাঁর ভাবপ্রবণতায় লেনিনের মনোজগৎ যেমন নির্মিত হয়েছে এ চলচ্চিত্রের ফ্রেমময়, তেমনি আছে নিম্নমধ্যবিত্ত জীবনের দৈনন্দিন বাস্তবতা। কলেজের চাকরি পাবার প্রসঙ্গে লেনিন ও বাবার কথোপকথনে মন্ত্রীর তদবিরে চাকরি পাবার প্রসঙ্গে এদেশীয় কর্মসংস্থানের যে বাস্তবতা ফুটে ওঠে তা আজো এই ২০১০ সালের বাস্তবতায় এক ধ্রুব সত্য।
এদেশীয় মধ্যবিত্তের জীবনের চিরকালীন বাস্তবতাকে কবির নিয়ে এসেছেন সমাজতাত্ত্বিকের নিরেট দৃষ্টিতে। তবু এই বাস্তবতায় কাব্যিক আবহ গড়েন কবির। কখনো বর্ষাস্নাত রজনীতে লেনিনের পুরনো কাঁথা মুড়িয়ে বর্ষাসিক্ত নাগরিক ঢাকার সৌন্দর্য উপভোগের মাঝে মধ্যবিত্তের জীবনে বর্ষার প্রশান্তি ও প্রণোদনা উঠে আসে। আবার কখনোবা লেনিনের কল্পনার নারীর হাত ধরে প্রাগৈতিহাসিক স্থাপনায় ঘুরে বেড়ানোর মাঝে পুরাণের ধুলো সরিয়ে মানব-মানবীর এক চিরকালীন প্রেমের সৌন্দর্যের আবহ নির্মিত হয় এই চলচ্চিত্রভাষ্যে।
এই ছবিতে লেনিনের ফ্যান্টাসির জগতের সমান্তরালে কবির তুলে আনেন শিশুর কল্পনায় প্রাচ্যদেশীয় রূপকথার গল্পের এক আদি সমীকরণ। ঠাকুরমার কোলে রূপকথার গল্প শোনা ছোট্ট শিশু কল্পনাতেই নিজেকে রাজপুত্রের আসনে অভিষিক্ত করে। কল্পনায় সে মুহূর্তেই চলে যায় পাতালপুরীতে। সেখান থেকে দৈত্যদের হটিয়ে রাজকন্যাকে উদ্ধার করার অসীম সাহসের ফ্যান্টাসির জগৎ শিশুর মনে গড়ে ওঠে তার অজান্তেই। এ চলচ্চিত্রেও লেনিনের ফ্যান্টাসির জগৎ নির্মিত হয়েছে তার শৈশব থেকেই। এ কারণেই আজো স্বপ্নে যখন সে শৈশবে ফিরে যায় নিজেকে রাজার মুকুট পরা এক অবয়বে দাঁড় করায়। লেনিনের শৈশবে ফিরে যাওয়ার যে স্বাপ্নিক বাতাবরণ এ ছবিতে কবির নির্মাণ করেন, তা যেন নাগরিক জীবনের ক্লান্তি থেকে মুক্তির এক চলচ্চৈত্রিক ব্যঞ্জনা। একইসঙ্গে শৈশবীয় চেতনা-স্মৃতিকে আশ্রয় নির্মাণের এই প্রবণতায় ইঙ্গমার বার্গম্যানের চলচ্চৈত্রিক প্রবণতা অনুরণিত হয় আলমগীর কবিরের চলচ্চৈত্রিক প্রকরণে।
এ চলচ্চিত্রে পে�-ব্যাক আলমগীর কবিরের সৃষ্টিশীলতায় জারিত হয়ে নতুন এক মাত্রা সৃষ্টি করে। ‘আমি যে অাঁধারে বন্দিনী’ গানটি একইসঙ্গে নারীর বন্দিত্ব থেকে মুক্তির ব্যাকুলতা ও রহস্যময়তা সৃষ্টির অভিঘাতে অনন্য। গানটির চিত্রায়ণেও আলো-অাঁধারের বিপরীতমুখী খেলায় ধরা-অধরার এক বিমূর্ত আবহ নির্মিত হয়। এই বিমূর্ততা লেনিনের কল্পনার অবচেতনের সমান্তরালে চিত্রিত এবং তা সার্থক ও কাব্যিক। ছবিটির প্রায় শেষ পর্যায়ে রাসেল ও মনিকার মিলনের অনুষঙ্গে এসেছে ‘চেনা চেনা লাগে তবু অচেনা’ গানটি। অভিনেত্রীর মুখে গান প্রয়োগের প্রচলিত সূত্রের ঊর্ধ্বে উঠে গাড়িতে রেডিওতে বাজানো হয়েছে গানটি। সঙ্গে ছিল চলমান গাড়ির দোলায় রাসেল-মনিকার মিলনের অভিব্যক্তির দোলা। এই চলচ্চিত্রে একটি ইংরেজি গানও ব্যবহার করেছেন কবির পে�-ব্যাক হিসেবে। মনিকা চলে যাবার পর অস্থির রাসেলের স্বপ্নে মনিকা আসে সাগরপারে এই গান নিয়ে – Once, on a night like this, rains came down. বিলিতি ঢঙে বেড়ে ওঠা রাসেল তার স্বপ্নে মনিকাকে যেরূপে দেখতে চায় তার ভাষ্য রচনার অনুষঙ্গেই কবির এই ইংরেজি গানটি প্রয়োগ করেন। অযথা কোনো চমক বা সুড়সুড়ি প্রদানের উদ্দেশ্যে কবির এই ইংরেজি গানের ব্যবহার করেননি। যদিও সমালোচক এই গানটিকে লরা মালভে প্রবর্তিত ‘দেখার মজা’ বা স্কোপোফিলিয়ার আওতায় ফেলতে চেয়েছেন।১৬ সত্যিকার অর্থে রাসেল চরিত্রের যে প্রবণতা এ ছবির শুরু থেকেই বর্ণিত হয়ে এসেছে তাতে দেহজ প্রেমের প্রতি তার আগ্রহের বিষয়টি স্পষ্ট। অতএব এমন একটি চরিত্র তার কল্পনায় বা স্বপ্নে কাঙ্ক্ষিত নারীকে দেহজ আকর্ষণসহই দেখবে এটাই স্বাভাবিক। তবে দৃশ্যটিতে সাগরপারে রাসেলের আকাঙ্ক্ষার নারী মনিকা আসে শুধু দেহনির্ভরতার মধ্য দিয়ে নয়। সেখানে সাগরের এক কাব্যিক স্বপ্নময় স্থানের আভাসও নির্মাণ করেন কবির তাঁর অনন্য শিল্পকুশলতায়।
এ ছবিতে অ্যানিমেশন প্রয়োগে কবিরের সিনেমাটিক স্বাতন্ত্র্যের আরো একটি দৃষ্টান্ত দৃশ্যমান হয়। ইতিহাসবিদ মামা যখন লেনিনকে নারীর বন্দিত্বের প্রাগৈতিহাসিক ইতিহাস বর্ণনা করেন তখন পুরো বিষয়টিই চলচ্চিত্রে ভিস্যুয়ালাইজড করা হয় অ্যানিমেশনের প্রয়োগে। অ্যানিমেশনে পুরুষ কর্তৃক নারীর বন্দিত্বের সামাজিক ইতিহাসটি সামাজিক ব্যঙ্গচিত্র নির্মাণের এক অভিনব প্রকরণ কিংবা উপায় হিসেবে উঠে আসে। তানভীর মোকাম্মেলের মতে, ‘[…] এই ছবির অ্যানিমেশন চিত্রের ব্যবহার আমার জানা মতে এপার বাংলায় কাহিনিচিত্রে অ্যানিমেশন চিত্রের প্রথম প্রয়োগ।’১৭ এভাবেই বাংলা ন্যারেটিভ ছবির লিনিয়ার প্রগ্রেসনে আলমগীর কবির অ্যানিমেশন, হুইসেল, শটের পুনরাবৃত্তি, মনোস্তাত্ত্বিক ভাব প্রকাশে দৃশ্যের প্রয়োগসহ নানা নিরীক্ষায় ব্রতী হন ব্রেখটীয় এলিয়েনেশন সৃষ্টির অভিঘাতে।
নানামুখী প্রতিক্রিয়া
সত্যিকার অর্থেই, নানা নিরীক্ষার প্রয়োগে সূর্যকন্যা আলমগীর কবিরের অনবদ্য সিনেমাভাষ্য। যদিও সমকালে সূর্যকন্যাকে নিয়ে সমালোচনার খড়্গ প্রত্যক্ষ করেছেন আলমগীর কবির। কেউ বলেছেন, এ ছবিতে বৃহত্তর জনগোষ্ঠীর ভাবনা প্রতিফলিত হয়নি।১৮ আবার কেউ কেউ অভিযোগ আকারে দেখিয়েছেন
বাস্তবতার ঊর্ধ্বে কল্পলোকে আলমগীর কবিরের বিচরণকে।১৯ আলমগীর কবির নিজেও ছবিটিকে বলেছেন ‘নরোম’ ছবি।২০ ‘নরোম’ শব্দটি প্রচলিত বাণিজ্যিক ছবির সমান্তরাল অর্থ বহনকারী হিসেবে তিনি ব্যবহার করেননি। বরং লেনিনের মধ্যবিত্ত প্রবণতায় এই শ্রেণির যে চারিত্রিক আয়না তিনি নির্মাণ করেন সেখানে মধ্যবিত্তের চারিত্রিক ইনএফিশিয়েন্সি রচনার অনুষঙ্গে এসেছে ‘নরোম’ শব্দটি। সমালোচনার তীব্রতার উত্তরও কবির দিয়েছেন কোথাও কোথাও, ব্যাখ্যা করেছেন নিজ সিনেমাভাষ্যের প্রয়াস ও প্রণোদনা –
সূর্যকন্যা নিয়ে বাগ্বিতন্ডা হয়েছে প্রচুর। অনেকের কাছে ভীষণ ভালো লেগেছে। আবার অনেকে এর তীব্র সমালোচনা করেছেন। দুঃখের বিষয়, উভয় ক্ষেত্রেই প্রতিক্রিয়া হয়েছে ভুল কারণে। অন্তত বেশ কিছু ক্ষেত্রে। অনেকের ছবিটি ভালো লেগেছে এর আধুনিক (এদেশের পরিপ্রেক্ষিতে) খোলসটার জন্যে। কিন্তু তাতে আনন্দে বিহবল হবার খুব একটা কারণ খুঁজে পাই না। কারণ বর্তমানকালে যে-কোনো চলচ্চিত্র শিক্ষিত শিল্পীই অন্তত এইটুকু চলচ্চিত্রিক স্লিকনেস আনতে পারবেন নিঃসন্দেহে। পক্ষান্তরে বিরূপ সমালোচকদের অধিকাংশই লেনিনকে ভুল করে হিরো অর্থাৎ পজিটিভ প্রটাগনিস্ট ভেবে তার ভ্রান্তিবিলাসকে অযথা আক্রমণ করে নিজ নিজ রাজনৈতিক তত্ত্বজ্ঞানকে অপ্রাসঙ্গিকভাবে প্রচার করার প্রয়াস পেয়েছেন।২১
শেষ কথা
একটি সৃষ্টিকর্মে পূর্ণাঙ্গ শৈল্পিক প্রয়াস নির্মিত হবার যে প্রত্যাশা আমরা করি তাতে শিল্পস্রষ্টার প্রতি অকারণেই আমাদের চাহিদার ব্যারোমিটারটি হাজির হয় একটি চূড়ান্ত অবস্থানে। শিল্পের সীমাবদ্ধতাগুলো তখন আমরা প্রকট করে তুলি শিল্পের ভাব, বস্ত্ত, রীতি, অলংকার কিংবা স্রষ্টার মানস দৃষ্টি পর্যালোচনার পরিবর্তে। সেক্ষেত্রে অধিকাংশ সময়ই সমালোচকের personal impression বা ব্যক্তিগত ভালো লাগা, মন্দ লাগার আস্ফালনে শিল্পকর্মটি সহজেই অপাঙ্ক্তেয়র তালিকায় পর্যবসিত হতে পারে। সূর্যকন্যা ছবিটি বিশ্লেষণের ক্ষেত্রে অনেক সমালোচকের সেই দৃষ্টিভঙ্গি দুর্লক্ষ্য নয়। সূর্যকন্যা মূলত প্রচলিত বাংলা ছবির idiological ডিসকোর্সে এক ভিন্ন সিনেমাভাষ্য। এ ছবিতে এদেশীয় নিম্নমধ্যবিত্ত জীবনের বাস্তবতা আর অন্তর্ভেদী অবচেতনের দ্বান্দ্বিকতায় আলমগীর কবিরের ধ্রুপদী চলচ্চিত্র নির্মাণের প্রয়াস স্পষ্ট। ব্যর্থতা যাই থাক না কেন, এ ছবিতে কবিরের প্রত্যক্ষণজাত সমকালীন বাংলাদেশের মধ্যবিত্ত জীবনের বাস্তবতা আর বুভুক্ষু অবচেতনের আকাঙ্ক্ষামালা হাজির হয়েছে আবেগময় চলচ্চিত্রিক ব্যঞ্জনায়। আর চলচ্চিত্রের শরীরে অধরা মনস্তত্ত্বের এই রূপায়ণে আজো এ ছবি বাংলা ছবির ইতিহাসে এক অনন্য সংযোজন ও দৃষ্টান্ততুল্য চলচ্চিত্র।
টীকা ও তথ্যপঞ্জি
১. কবির, আলমগীর (১৯৭৯), চিত্রনাট্য ধীরে বহে মেঘনা, সূর্যকন্যা, সীমানা পেরিয়ে, ঢাকা : বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমী, চিত্রনাট্যের শুরুর পাতা।
২. কবির, আলমগীর (১৯৭৭), চলার পথে কিছু ভাবনা, ত্রৈমাসিক চলচ্চিত্রিক ১ম বর্ষ, ২য় সংখ্যা, ঢাকা : চিত্রণ ফিল্ম সোসাইটি, পৃ ২৩।
৩. দেব, মলয় (১৯৮৭), ‘সিনেমা, সময় সমাজ’, বাণিজ্যিক চলচ্চিত্রে সমাজ ও মানুষ, রজত রায় ও সোমেশ্বর ভৌমিক (সম্পাদিত), কলিকাতা : অনুষ্টুপ প্রকাশনী, পৃ ২৫।
৪. ‘এ গবেষণার আওতায় যতগুলো চলচ্চিত্র দেখা হয়েছে তার সিংহভাগেই নারী প্রধানত যৌন উপকরণ হিসেবে উপস্থাপিত। এছাড়া ধর্ষণের মতো একটি ভয়ংকর যৌন-অপরাধকে প্রধানত যৌন-উত্তেজনা প্রদানের জন্য বারংবার ব্যবহার করা হয়েছে।’
নাসরীন, গীতি আরা ও ফাহমিদুল হক (২০০৮), বাংলাদেশের চলচ্চিত্র শিল্প সংকটে জনসংস্কৃতি, ঢাকা : শ্রাবণ প্রকাশনী, পৃ ৬৯।
৫. ‘তারপরে ওদের দুজনকে দেখা যায় সেই পুরনো বাড়িতে। চাঁদনী রাতে নদীর ঘাটে, না হয় ছোট নৌকায়। লেনিন কি এখনো স্বপ্ন দেখছে? না বাস্তবে আছে? এ প্রশ্নের উত্তর নেই। কারণ আজ সে এই তারতম্য বিচার করতে অক্ষম। তার কাছে সব একাকার। সে এখন পুরোপুরি schizophrenic।’
কবির, আলমগীর (১৯৭৯), চিত্রনাট্য ধীরে বহে মেঘনা, সূর্যকন্যা, সীমানা পেরিয়ে, ঢাকা : বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমী, পৃ ৮৯।
৬. কবির, আলমগীর (১৯৭৭), চলার পথে কিছু ভাবনা, ত্রৈমাসিক চলচ্চিত্রিক, ১ম বর্ষ, ২য় সংখ্যা, ঢাকা : চিত্রণ ফিল্ম সোসাইটি, পৃ ২৫।
৭. Hayward, Susan (2005), Cinema studies : The Key Concepts, London : Routledge, P 288.
৮. হোসেন, মো. শওকত (১৯৯৮), সমকালীন পাশ্চাত্য দর্শনের রূপরেখা, ঢাকা : তিথী পাবলিকেশন, পৃ ২৬৭।
৯. Hayward, Susan (2005), Cinema studies : The Key Concepts, London : Routledge, P 288.
১০. (http://en.wikipedia.org/wiki/Superego#Ego)
১১. ভট্টাচার্য, তপোধীর (২০০৭), প্রতীচ্যের সাহিত্যতত্ত্ব, ঢাকা : নবযুগ প্রকাশনী, পৃ ২২৩, ২২৪।
১২. রিবেরু, বিধান (২০০৯), ‘সূর্যকন্যা : আলমগীর কবিরের চলচ্চিত্রে নারীমুক্তির দর্শন’, বাংলাদেশ ফিল্ম আর্কাইভ জার্নাল, দ্বিতীয় বর্ষ, সংখ্যা : ০২/২০০৯, পৃ-৪৩।
১৩. হোসেন, মাহমুদুল (২০০৬), ‘আলমগীর কবিরের ছবিতে সমাজচেতনা’, চলচ্চিত্রাচার্য আলমগীর, মুনিরা মোরশেদ মুন্নী (সম্পাদিত), ঢাকা : সোনারং, পৃ ১০৭।
১৪. মোকাম্মেল, তানভীর (১৯৯১), ‘আলমগীর কবির : বায়োস্কোপের দেশে একজন অথর পরিচালক’, চলচ্চিত্রাচার্য আলমগীর, মুনিরা মোরশেদ মুন্নী (সম্পাদিত), ঢাকা : সোনারং, পৃ ৫৫।
১৫. Hayward, Susan (2005), Cinema studies : The Key Concepts, London: Routledge, Hayward, P 288.
১৬. ‘পর্দায় মনিকার ওই নৃত্য ও গীত পুরুষ দর্শককে আকৃষ্ট করবে, তাতে সন্দেহ নেই। লরা মালভে একেই বলেছেন ‘দেখার মজা’ বা স্কোপোফেলিয়া।’
রিবেরু, বিধান (২০০৯), ‘সূর্যকন্যা : আলমগীর কবিরের চলচ্চিত্রে নারীমুক্তির দর্শন’, বাংলাদেশ ফিল্ম আর্কাইভ জার্নাল, দ্বিতীয় বর্ষ, সংখ্যা : ০২/২০০৯, পৃ ৪৩।
১৭. মোকাম্মেল, তানভীর (১৯৯১), আলমগীর কবির : বায়োস্কোপের দেশে একজন অথর পরিচালক, আলমগীর কবির স্মারকগ্রন্থ, ঢাকা : বাংলাদেশ ফেডারেশন অব ফিল্ম সোসাইটিজ, পৃ ৫৪।
১৮. ‘পুঁজিবাদী সমাজে সম্ভবপর হলেও অন্তত স্বল্পোন্নত ও উন্নয়নকামী দেশে তা সম্ভব নয় – যে-কোন শিল্পকর্মেই সেখানে বৃহত্তর জনগোষ্ঠীর ভাবনা অপ্রত্যক্ষভাবে প্রতিফলিত হবেই। একদার প্রগতিশীল আন্দোলনের সোচ্চার কণ্ঠ আলমগীর কবিরের সূর্যকন্যায় কারণহীনভাবেই জীবনের সেইসব দাবি অনুপস্থিত।’
আলমগীর, ফারুক (১৯৭৭), ‘কালো সূর্যের নীচে অপবৃত্ত সংলাপ’, উদ্ধৃত অনুপম হায়াৎ, বাংলাদেশের চলচ্চিত্রের ইতিহাস, ঢাকা : বাংলাদেশ চলচ্চিত্র উন্নয়ন করপোরেশন, পৃ ৯৭। তেজগাঁও, ঢাকা।
১৯. ‘সূর্যকন্যা এবং সীমানা পেরিয়ের আলমগীর কবির বাস্তবতার অনেক দূরে স্বীয় কল্পলোকে বাস করেছেন। ব্যঞ্জনাময় কোনো বোধের জন্ম দেয় না এ দুটোর একটাও।’
ভট্টাচার্য, পল�ল (১৯৭৭), চলচ্চিত্রে ব্যঞ্জনা, ত্রৈমাসিক চলচ্চিত্রিক, ১ম বর্ষ, ২য় সংখ্যা, ঢাকা : চিত্রণ ফিল্ম সোসাইটি, ঢাকা, পৃ ৮২।
২০. ‘[…] প্রদর্শক পরিবেশকদের আস্থা কিছুটা পুনরুদ্ধারের মানসে পরপর দুটি ‘নরোম’ ছবি বানালাম – সূর্যকন্যা (১৯৭৬) ও সীমানা পেরিয়ে (১৯৭৭)।’
কবির, আলমগীর (১৯৮৪), ‘অন্য চলচ্চিত্র’, চিত্রনাট্য মোহনা, ঢাকা : ভিন্টেজ প্রকাশনী, ভূমিকা অংশ।
২১. কবির, আলমগীর (১৯৭৭), চলার পথে কিছু ভাবনা, ত্রৈমাসিক চলচ্চিত্রিক, ১ম বর্ষ, ২য় সংখ্যা, ঢাকা : চিত্রণ ফিল্ম সোসাইটি, পৃ ২৫, ২৬।
২২. রফিকুজ্জামান (গ্রন্থনা) (১৯৮৯) স্মরণিকা, ঢাকা : বাংলাদেশ সৎচলচ্চিত্র ফ্রন্ট, পৃ ১৬।