আ হ মে দ হা সা ন
বাংলাদেশের চারুকলা আন্দোলনের পথিকৃৎ এবং শিল্প-সংস্কৃতির পুরোধা শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিনের জন্মশতবর্ষকে সামনে রেখে বেঙ্গল ফাউন্ডেশন এবং ইতালির আন্তর্জাতিক প্রকাশনা সংস্থা স্কিরা যৌথভাবে প্রকাশ করেছে গ্রেট মাস্টার্স অব বাংলাদেশ : জয়নুল আবেদিন শীর্ষক বিশ্বমানের গ্রন্থ। এই গ্রন্থটিতে শিল্পাচার্যের সৃজন ও জীবনবৃত্তান্ত বিধৃত হয়েছে।
গত ৬ অক্টোবর ২০১৩ রোববার বিকেল ৪টায় র্যাডিসন ব্লু ওয়াটার গার্ডেন হোটেলের উৎসব হলে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের মহামান্য রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদ প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত থেকে গ্রেট মাস্টার্স অব বাংলাদেশ : জয়নুল আবেদিন গ্রন্থের মোড়ক উন্মোচন এবং শিল্পাচার্যের জন্মশতবর্ষ উপলক্ষে বেঙ্গল ফাউন্ডেশন-আয়োজিত বছরব্যাপী অনুষ্ঠানমালার উদ্বোধন করেন। অনুষ্ঠানে বিশেষ অতিথি ছিলেন গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের মাননীয় অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত, বাংলাদেশে ইউরোপীয় ইউনিয়নের মান্যবর রাষ্ট্রদূত মি. উইলিয়াম হানা এবং শিল্পাচার্যের সহধর্মিণী বেগম জাহানারা আবেদিন। অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করেন বরেণ্য শিল্পী কাইয়ুম চৌধুরী। অনুষ্ঠানে স্বাগত বক্তব্য রাখেন বেঙ্গল ফাউন্ডেশনের চেয়ারম্যান আবুল খায়ের এবং ধন্যবাদ জ্ঞাপন করেন বেঙ্গল ফাউন্ডেশনের মহাপরিচালক লুভা নাহিদ চৌধুরী।
স্বাগত বক্তব্যে বেঙ্গল ফাউন্ডেশনের চেয়ারম্যান আবুল খায়ের বলেন, ‘শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিন এদেশের চিত্রকলা আন্দোলনের প্রাণপুরুষ ও স্থপতি ছিলেন। আমার সুযোগ হয়েছিল এই মানুষটির সান্নিধ্যে আসার। আমার পিতৃব্য জ্ঞানতাপস আব্দুর রাজ্জাকের সঙ্গে তাঁর সখ্য ছিল। তাঁরা দেশ, সমাজ, সংস্কৃতি নিয়ে যখন কথা বলতেন সেসব আলাপচারিতায় আমি প্রখর জ্ঞানবুদ্ধির স্পর্শ পেতাম।’
রাষ্ট্রপতি আবদুল হামিদ তাঁর বক্তৃতায় বলেন, জয়নুল আবেদিন চল্লিশের দশকেই চমৎকার নিসর্গ চিত্র অঙ্কনের মধ্য দিয়ে অল্পদিনের মধ্যেই খ্যাতিমান হয়ে ওঠেন। ছাত্র থাকাকালীন সময়ে তাঁর সৃজন উৎকর্ষ নবীন মাত্রা অর্জন করে। শিল্পানুরাগীরা তাঁর সৃজনের মধ্যে শিল্পের মহৎ গুণাবলি প্রত্যক্ষ করেছিলেন। স্কুলের নবীন শিক্ষক থাকাকালীন ১৯৪৩ সালের দুর্ভিক্ষ বিষয়ক চিত্রমালা অঙ্কনের মধ্য দিয়ে ভারতবর্ষে খ্যাতিমান শিল্পী হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হন। ভয়াবহ দুর্ভিক্ষ তাঁর শিল্পীসত্তাকে প্রবলভাবে নাড়া দেয়। তিনি দুর্ভিক্ষপীড়িত মানুষের বেঁচে থাকার আর্তিকে মোটা তুলিতে যেভাবে রূপায়িত করেছিলেন তার কোনো তুলনা নেই। এই চিত্রমালা একদিকে মানবিক বিপর্যয়ের আশ্চর্য দলিল হয়ে আছে, অন্যদিকে এই চিত্রগুচ্ছ অঙ্কনের মধ্য দিয়ে তিনি হয়ে উঠেছেন একজন আন্তর্জাতিক মানের খ্যাতনামা শিল্পী।
ষাটের ও সত্তরের দশকে যে-কোনো জাতীয় দুর্যোগ, সংগ্রাম ও স্বাধিকার আন্দোলনে তিনি সক্রিয় ভূমিকা রাখেন। একই সঙ্গে তাঁর সৃজনও এই সময়ে নানা মাত্রিক ও অঙ্গীকারের চেতনালগ্ন হয়ে ওঠে।
আচার্য জয়নুল আবেদিনের সহধর্মিণী জাহানারা আবেদিন বলেন, ‘আজ আমি খুশি ও আনন্দিত যে, জয়নুল আবেদিনকে নিয়ে যে বিশাল বইটি প্রকাশিত হয়েছে তা শুধু অঙ্গসৌষ্ঠব, মুদ্রণ পারিপাট্যে সমৃদ্ধ নয় – এতে জয়নুল আবেদিনের শিল্পবোধ ও জীবনের বহু দিক নিয়ে আলোচনা করা হয়েছে। বিশেষ করে এই মানুষটির চিত্রকলা, সৃজন ও জীবন নিয়ে যে আলোচনাগুলো করা হয়েছে তা খুবই উন্নতমানের। এছাড়া বইটিতে শিল্পাচার্যের কাজের কিছু প্রতিলিপি আছে। এগুলোর মান খুবই ভালো। ভবিষ্যৎ প্রজন্ম এবং শিল্পানুরাগীরা এই প্রতিলিপি থেকে তাঁর শক্তিমত্তা ও শিল্পীর জীবন সম্পর্কে জানতে পারবেন।’
প্রবীণ শিল্পী কাইয়ুম চৌধুরী তাঁর সভাপতির ভাষণে বলেন, জয়নুল আবেদিন তাঁর সৃজন উৎকর্ষ দিয়ে এদেশের চিত্রকলাকে শুধু সমৃদ্ধ করেননি, তিনি এদেশের আধুনিকতারও প্রাণপুরুষ। শিল্পরুচি তৈরি করেছেন এবং শিল্পচর্চার পরিবেশ সৃষ্টির জন্যও সংগ্রাম করেছেন।
স্কিরা ও বেঙ্গলের যৌথ প্রয়াসে বাংলাদেশের শিল্পগুরুদের জীবন ও কাজ নিয়ে ইতোমধ্যে চারটি গ্রন্থ প্রকাশিত হয়েছে এবং আরো কিছু বই প্রকাশিত হবে।
স্কিরা-বেঙ্গলের এই বই ছাপা, বাঁধাই সবই হয়েছে ইতালিতে। সেজন্য মুদ্রণ পারিপাট্য শুধু উন্নতমানের হয়নি, সামগ্রিকভাবে একটি বই যে কত গুরুত্ববহ হয় নানা দিক থেকে এ যেন তারই নিদর্শন। চিত্রকলা বিষয়ক এ বইটি স্কিরা সারাবিশ্বে বিপণন করবে। এটি সম্পাদনা করেছেন রোসা মারিয়া ফালভো। তিনটি প্রবন্ধ, একটি সাক্ষাৎকার, জীবনপঞ্জি ও দশক অনুসারে তাঁর কাজের প্রকৃতি ও শিল্পাচার্যের বিভিন্ন সময়ের আলোকচিত্র নিয়ে ৩৩৬ পৃষ্ঠার এই বই।
‘শিল্পাচার্য’ নামের প্রথম প্রবন্ধটি লিখেছেন শিল্পী আবুল মনসুর। তিনি শিল্পাচার্যের ছাত্র। আলোচনা শুরু করেছেন শিক্ষাগুরুর একটি কথা দিয়ে, যা তিনি শিক্ষার্থীদের বলতেন, ‘নৌকা অাঁকতে হলে ঘরে বসে না এঁকে নদীর পাড়ে যেতে হবে। রক্তের মধ্যে যদি নৌকার দুলনিটাই অনুভব করতে না পারো, তবে যথার্থ নৌকা অাঁকবে কেমন করে।’ এ প্রবন্ধে তিনি তুলে ধরেছেন জয়নুলের কাজের বৈশিষ্ট্য, তাঁর শিক্ষা ও তৎকালীন সামাজিক প্রেক্ষাপট।
‘পাইওনিয়ারিং মডার্ন আর্ট ইন বাংলাদেশ’ নামের দ্বিতীয় প্রবন্ধটি শিল্প-সমালোচক নজরুল ইসলামের। এখানে তিনি গুরুত্ব আরোপ করেছেন বাংলাদেশের চারুকলা আন্দোলনের প্রেক্ষাপট নির্মাণে শিল্পাচার্যের ভূমিকার প্রতি। জয়নুল ও তাঁর নানা ধরনের কাজ সম্পর্কে জানা-অজানা তথ্যে সমৃদ্ধ এ প্রবন্ধটি।
আবুল হাসনাত তাঁর ‘ইমেজেস অব ফ্যামিন’ নামের প্রবন্ধে তুলে এনেছেন কাজগুলোর কথা, যা তাঁকে খ্যাতির শীর্ষে নিয়ে গেছে। ১৯৪৩ সালের দুর্ভিক্ষে স্রোতের মতো অনাহারী মানুষ আসছে কলকাতায়। পথে মরে পড়ে আছে ভুখানাঙ্গা শিশু, উচ্ছিষ্ট খাবার খুঁজছে ডাস্টবিনে কাকের সঙ্গে। শিল্পাচার্য এই বিপন্ন মানবতার এক মহাকাব্যিক দৃশ্যমালা তুলে ধরেছিলেন চায়না কালি ও মোটা তুলির টানে। কাগজও ছিল অল্প দামের, যা সাধারণত জিনিসপত্র মোড়ানোর জন্য ব্যবহৃত হয়। এ প্রবন্ধে দুর্ভিক্ষের প্রেক্ষাপট ও শিল্পাচার্যের কাজের ধারা
বিস্তারিতভাবে আলোচিত হয়েছে।
কলকাতার উচ্চ মধ্যবিত্ত ও শিক্ষিতজনদের মধ্যে মোটা ব্রাশের এই স্কেচগুলো যে কতভাবে সাহিত্য ও ভাবুক সমাজকে নাড়া দিয়েছিল তা সবিস্তারে আলোকপাত করা হয়েছে। জয়নুলের রেখাচিত্রের পাশে সে-সময়ের কিছু আলোকচিত্রও ব্যবহার করা হয়েছে গ্রন্থটিতে। শেষে আছে তাঁর স্ত্রী বেগম জাহানারা আবেদিনের একটি সাক্ষাৎকার ও শিল্পাচার্যের জীবনপঞ্জি। সাক্ষাৎকারটি গ্রহণ করেছেন আবুল হাসনাত।
এই তিনটি প্রবন্ধের পর রয়েছে ১৯৩০, ১৯৪০, ১৯৫০, ১৯৬০ ও ১৯৭০-এর দশকে অাঁকা শিল্পাচার্যের ছবি। সব মিলিয়ে এ বইতে জয়নুল আবেদিনের ২৭০টি কাজের ছবি রয়েছে। ‘দুর্ভিক্ষের রেখাচিত্র’, ‘দুমকার জলরং’, ‘সাঁওতাল দম্পতি’, ‘গুণটানা’, ‘আয়না ও নারী’, ‘বিদ্রোহী ষাঁড়’, ‘মনপুরার জলোচ্ছ্বাস ও নবান্ন স্ক্রল’, ‘মুক্তিযুদ্ধ’, ‘পাইন্যার মা’, ‘ক্রুদ্ধ কাক’ – এসব বিখ্যাত ছবি তো আছেই। এছাড়া বইতে আছে আরো বহু কাজ, যা এখনো অনেকেরই দেখার বাইরে। তাঁর ‘দুর্ভিক্ষের
রেখাচিত্র’-এর কথা সবার জানা; কিন্তু এই বিষয়ে তিনি কিছু ড্রাই পয়েন্ট ও লিনোকাটের ছাপাই ছবিও করেছিলেন। বইতে সেগুলোও অন্তর্ভুক্ত হয়েছে। বিশেষত, দশকভিত্তিক ক্রমানুসারে ছবিগুলো আনুষঙ্গিক তথ্যসহ বিন্যস্ত করায় শিল্পাচার্যের কাজের বিষয়, বৈশিষ্ট্য, রীতি, আঙ্গিক – এসবের বিবর্তন সম্পর্কেও একটি ধারণা পাওয়া যাবে।