logo

২১তম জাতীয় চারুকলা প্রদর্শনী ২০১৫ ঐতিহ্যের পথ ধরে আধুনিকতা

ব স ন্ত  রা য়  চৌ ধু রী

বাংলাদেশের শিল্পান্দোলনের বয়স ছয় দশকের কিছু বেশি। এর মাঝে পৃথিবীর শিল্পকলায় নানা পরিবর্তন ঘটেছে। সে পরিবর্তন হলো নিউ মিডিয়া বা নতুন মাধ্যমের শিল্পকলা। গত তিনটি জাতীয় প্রদর্শনীতে নতুন মাধ্যম অর্থাৎ ভিডিও আর্ট, স্থাপনা শিল্প, পারফরম্যান্স বা শরীরী শিল্প দর্শক দেখতে পাচ্ছেন। দর্শকের কাছে বিশ্বশিল্পকলার এ নতুন আঙ্গিক বিস্ময়ের। যাঁরা শিল্পের ধারাবাহিক ইতিহাসের পাঠ নিয়ে এ সৃষ্টিকর্ম করে যাচ্ছেন তাঁদের কাছে নব সৃষ্টির নব আনন্দ বিদ্যমান। আজ একথা বলা যায়, বাংলাদেশ একদল শিল্পীর সৃষ্টিকর্মের মাধ্যমে বিশ্বশিল্পকলার সমাবেশে পরিণত হয়ে যোগ দিয়েছে। ২১তম জাতীয় চারুকলা প্রদর্শনী বেশ কিছু পরিণতির ইঙ্গিত দেয়, সঙ্গে শিল্পের নামে অশিল্পের প্রদর্শনও দেখা যায়। গুরুশিল্পী জয়নুল আবেদিন, কামরুল হাসান, সফিউদ্দীন আহমেদ, মোহাম্মদ কিবরিয়া, কাইয়ুম চৌধুরী বাংলাদেশের শিল্পান্দোলনকে একটি সাফল্যের দিকে ধাবিত করতে চেয়েছেন। সে-আন্দোলনের ফলে একটি জাতির মননশীলতা, বিবেকবোধ, মনুষ্যত্ব আর নন্দন জ্ঞানসম্পন্ন নাগরিক গড়ে তোলার চেষ্টা ছিল। তাদের চেষ্টা সফল হয়েছে। বাংলাদেশের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে শিল্পকলা শিক্ষার বিভাগ প্রতিষ্ঠা হয়েছে। শিক্ষাক্রমে চারুকলা ও নন্দনতত্ত্ব শেখার চর্চা গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচিত হচ্ছে। দুটি ধারায় চর্চিত হচ্ছে শিল্পকলা। একটি প্রাতিষ্ঠানিক ধারা, যেটি শিল্পকলার বাজার সৃষ্টিতে সহায়ক। অন্যটি নিরীক্ষাধর্মী স্বাধীন শিল্পকলা চর্চার ধারা। দুটো ধারা সমানতালে চলছে – এটি বলা সহজ নয়। সাধারণ্যের চোখে শিল্পকলার বোধ তৈরি হয়েছে এমন, শিল্পকলা মানে যা দেখব হুবহু তাই অনুকরণ করবে শিল্পীরা – এটিই শিল্পের মূল সূত্র। না, শিল্পের ইতিহাস আছে, ঐতিহ্য আছে, পরস্পরের সঙ্গে শিল্পকলা ওতপ্রোতভাবে জড়িত। এবারের জাতীয় প্রদর্শনীর কাজে আমরা অ্যাকাডেমিক রীতির বহুচর্চিত কাজের উপস্থিতি বেশি দেখতে পাই। বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমী পুরস্কারপ্রাপ্ত রুহুল করিম রুমীর ‘সন্দেহজনক’ শিরোনামের কাজে আমরা বাস্তবানুগ আচরণ লক্ষ করি। বিষয়ের মাঝে নিরীক্ষা ও বাস্তবতা ও অতিনাটকীয়তা দেখা যায়। কিন্তু ছাপচিত্রের আদলে খোদিত কাঠের পাটাতন সরাসরি জুড়ে দিয়ে একধরনের ফভিজমকে স্মরণ করা বলা যায় এ কাজে। মানুষ তার মনস্তত্ত্বের স্তর অতিক্রম করে আরেকটি স্তরে পৌঁছে যায়, রুমীর মানুষের মুখগুলোতে সে অভিব্যক্তির রূপসজ্জা পাওয়া যায়। বেঙ্গল ফাউন্ডেশন পুরস্কারপ্রাপ্ত আব্দুল মোমেন মিল্টনের স্থাপনা শিল্প ‘একটি গাছের জন্য’ কাজটিতে একটি গাছকে ঘিরে কাঠের তৈরি অনেকগুলো পাখির সমাবেশ, গাছটিকে প্রতীকী চারাগাছের সঙ্গে তুলনা করেছে কেটে ফেলা আরেকটি গাছের তৈরি পাখি, যে পাখির বসবাস ওই গাছের ডালে। গাছের গুঁড়িতে পুঁতে রাখা কুড়াল, ছুরি, এসব আমাদের অশনিসংকেত দেয়। প্রকৃতিবাদী এ শিল্পীর স্থাপনা শিল্পটিতে বাস্তব নির্মাণরীতি যেমন আমাদের শিল্পের সঙ্গে যুক্ত হতে সাহায্য করে, সঙ্গে চিন্তার ক্ষেত্রে খানিক মোটাদাগের সম্ভাবনার ইঙ্গিত দেয়। রাসেল কান্তি দাস পেয়েছেন এসপিবিএ (স্কয়ার) পুরস্কার, তাঁর কাজের শিরোনাম ‘পরিস্থিতি’-২২ জাতীয় সংসদ ভবনের আকৃতির ভেতর থেকে বেরিয়ে পড়া জনৈক ভাষণদাতা নিচে তাকিয়ে দেখে সংসদ ভবনের লেক থেকে ভেসে আসছে লোলুপ সাপ, মানুষের মুখ তাকিয়ে আছে ভাষণদাতার দিকে। বক্তৃতারত মানুষটির হাতদুটি স্পষ্ট জ্বলজ্বলে বাস্তবানুগ রীতিতে গড়া আমাদের রাজনীতির অশনিসংকেত দেয় এ পরিস্থিতি। আরিফ আল করিম ভুঁইয়া এবি ব্যাংক পুরস্কার পেয়েছেন ‘রাশেদ আমার বন্ধু ছিল’ শিরোনামের ছাপচিত্রের জন্য। ইফফাত রেজোয়ানা রিয়া ‘দন্ডপ্রাপ্ত জনতা’ শিরোনামের স্থাপনাশিল্পের জন্য পেয়েছেন ভাষাসৈনিক গাজীউল হক পুরস্কার। সিলিং থেকে ঝুলন্ত ফাঁসির দড়ি নির্দেশ করে যেন প্রতিনিয়ত জনতাকেই দন্ড দিচ্ছে। হাবিবা আকতার পাপিয়া ‘বিলুণ্ঠিত সুর’ তৈরি করেছেন ব্রোঞ্জ মাধ্যমে। তিনি পেয়েছেন বেগম আজিজুন্নেসা পুরস্কার। তাঁর কাজে হারিয়ে যাওয়া বেহালার সঙ্গে তৈরি করেছেন স্প্যানিশ গিটারের আকৃতি। সানাউল্লাহ ‘দৃষ্টি’ শিরোনামে নারিকেলের ভেতর চোখের আকৃতি তৈরি করেছেন। স্থাপনাশিল্পটিতে চোখের দৃষ্টি মানবদেহের সবচেয়ে কাঙ্ক্ষিত সাধনা সেটি প্রমাণ করে। সানাউল্লাহ এ কাজটিতে পেয়েছেন দীপা হক পুরস্কার। শিমুল সাহার ‘টুওয়ার্ডস দ্য বিং’ স্থাপনায় আটটি ক্যানভাস আট দিকে দিকনির্দেশনা দিচ্ছে। ইমেজপ্রধান শিল্পকর্মের জন্য শিমুল পেয়েছেন বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমীর সম্মান পুরস্কার।

রুহুল আমিন তারেকের ‘কমপ্লেক্সিটি অফ টাইম অ্যান্ড
রিয়েলিটি’-২০ ছবিটি কাঠখোদাই চিত্র। ছাপচিত্রের আলোছায়ার করণকৌশলের সঙ্গে বিষয় নির্বাচনে অভিনবত্ব এ কাজের বৈশিষ্ট্য। মিঠুন কুমার সাহার ‘দ্য ক্লিক’ শিরোনামের কাজটি তার দিয়ে তৈরি, মানবদেহের চলতি সময়ের উল্টা চলো নীতির ভঙ্গি তাঁর ভাস্কর্যের বিষয়। এ কাজের জন্য মিঠুন পেয়েছেন বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমী সম্মান পুরস্কার। দুইশো একষট্টি জন শিল্পীর মোট ২৭৩টি শিল্পকর্মে দেখা যায় বাস্তবানুগ গড়নের জ্যামিতিক ভাঙন কোনো কাজে হুবহু অ্যাকাডেমিক প্রবণতা। ভাস্কর্যের ক্ষেত্রে বলা যায় মনীন্দ্র পালের
ধ্যান-৭, ফাহাদ হোসেনের ‘জাতি হত্যা’, বুদ্ধদেব মন্ডলের ‘নন্দন’, শ্যামল চন্দ্র সরকারের ‘সাম্রাজ্যবাদ খেলা’, সুব্রত সাহার ‘বিগলিত নয়ন’ কাজগুলোতে মাধ্যমের ও বিষয়ের নিরীক্ষার প্রবণতা; চিত্রকলায় তানভীর জালাল, আজমীর হোসেন, শুভমিতা সরকার, নগরবাসী বর্মণ, অসীত মিত্র, তাসাদ্দুক হোসেন দুলু, তাহমিনা হাফিজ লিসা, অপূর্ব রঞ্জন বিশ্বাসের কাজে মাধ্যম ও বিষয়ের নিরীক্ষার ঝোঁক বোঝা যায়। গতানুগতিক চিত্ররচনার বাইরে এসে নিরীক্ষা প্রবণতা সমকালীন শিল্পকর্মের দাবি। অতীতের সঙ্গে সেতুবন্ধ রচনা করে সমকালীন শিল্পীদের সৃষ্টিতে ভেসে ওঠে বিশ্বশিল্পকলার আভাস। ভিডিও আর্ট বা স্থাপনা শিল্পের মধ্যে উল্লেখযোগ্য কাজ করেছেন তৈয়বা বেগম লিপি ‘আহা জল’ শিরোনামে, সুমনা আক্তারের ‘আইডেনটিটি ক্রাইসিস’, নিলুফার চামানের ‘দক্ষিণ এশিয়ার পেঁয়াজের প্রতিদিনের গল্প’, জুবলী দেওয়ানের ‘ছোটগল্প’ ও ইয়াসমিন জাহান নূপুরের ‘স্থানবিহীন’ শিরোনামের শিল্পকর্ম গুরুত্বপূর্ণ।

২১তম এ প্রদর্শনীতে একনজরে বাংলাদেশের সর্বশেষ শিল্পকলার অবস্থা জানার সুযোগ রয়েছে। কিছু কাজে পূর্বসূরিদের অনুকরণের প্রবণতা দেখা যায় আবার বেশ কিছু কাজে নিজস্ব সৃজনীশক্তির প্রয়োগ বোঝা যায়। তবে আয়োজন তখনই সার্থক বলা যায়, যখন অধিকাংশ কাজই শিল্পমান উত্তীর্ণ হয়। প্রদর্শনীতে অংশগ্রহণ আর পুরস্কার জয়ের লক্ষ্যে সৃষ্টিকর্ম কখনোই মহাকাল মনে রাখে না। সময়ের স্রোতে টিকে থাকে শুধু মৌলিক চিন্তাশীল শিল্পসম্ভার। যুগের দাবি সেটাই। ২১তম জাতীয় প্রদর্শনী পাঠ করে শিল্পবোদ্ধারা ভাবতে চান কতটুকু এগিয়েছে আমাদের সৃষ্টিকর্ম। শিল্পকর্মগুলো বিশ্বশিল্পকলায় যুক্ত হবার প্রত্যাশিত কিনা। শিল্পের রস আহরণের জন্য যে শিল্পকর্ম প্রয়োজন সেটি সৃষ্টি হোক, সে আহবান শিল্পপিপাসু মানুষের। n

 

Leave a Reply