সা গ র চৌ ধু রী
ইতালির ধনাঢ্য ব্যক্তিদের প্রাসাদের বিশাল অভ্যর্থনা কক্ষকে বলা হতো salone (মূল sala শব্দটি থেকে চয়িত)। ফরাসি ভাষায় এই শব্দটির অমত্মর্ভুক্তি ঘটেছে আনুমানিক ১৬৬৪ সাল নাগাদ, তবে ফরাসি বানানরীতি মেনে এর বানানের শেষে e অক্ষরটি বাদ পড়েছে, সুতরাং ফরাসি শব্দটি হলো Salon (স্যালঁ)। আভিধানিক সংজ্ঞা অনুসারে বলা যায় যে এটা হলো একজন অতিথিবৎসল পৃষ্ঠপোষকের আবাসে এমন কিছু লোকের সমাবেশ, যারা সেখানে একত্রিত হচ্ছে নানাভাবে পরস্পরের মনোরঞ্জন বা চিত্তবিনোদন করার অথবা গল্পগুজব, মতবিনিময়, আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে নিজেদের রম্নচি-প্রবৃত্তি আরো পরিশীলিত করে তোলার বা তাদের জ্ঞান বৃদ্ধি করার উদ্দেশ্যে। এধরনের সমাবেশের চিমত্মাধারা যেন রোমান সম্রাট অগাস্টাস সিজারের সময়কার কবি ও দার্শনিক হোরেসের (Quintus Horatius Flaccus) প্রায় সচেতন অনুসারী, যিনি বলতেন যে কাব্যের লক্ষ্য হলো ‘হয় মনোরঞ্জন করা, নয়তো শিক্ষাদান করা’ (‘aut delectare aut prodesse est’)। সপ্তদশ ও অষ্টাদশ শতাব্দীতে বিভিন্ন ফরাসি সাহিত্যিক ও দার্শনিক আন্দোলনের সঙ্গে সাধারণভাবে সম্পৃক্ত এইসব স্যালঁ তখন থেকে শুরম্ন করে কমপক্ষে ১৯৪০-এর দশক পর্যমত্ম শহুরে শিল্পী-বুদ্ধিজীবী সম্প্রদায়ের জীবনের কার্যকর অঙ্গ ছিল। ১৭২৫ সালে সূচনার পর প্যারিস শহরের স্যালঁ ফ্রান্সের চারম্নকলা অ্যাকাডেমির (Académie des Beaux-Arts) অনুমোদিত শিল্প-প্রদর্শশালা হিসেবে স্বীকৃতিলাভ করে। ১৭৪৮ সাল থেকে ১৮৯০ পর্যমত্ম প্যারিস স্যালঁ ছিল পাশ্চাত্য জগতের সর্বপ্রধান বার্ষিক বা ষাণ্মাসিক শিল্পোৎসবের কেন্দ্র। তবে ওই সময়ে কেবলমাত্র ফ্রান্সের জীবিত শিল্পীরাই স্যালঁতে নিজেদের শিল্পকর্ম প্রদর্শনের সুযোগ লাভ করত। প্রধানত চিত্রশিল্পের প্রদর্শশালা হলেও এখন স্যালঁ সাধারণভাবে সংগীত, নাটক ইত্যাদি পরিবেশনের স্থানকেও বোঝায়।
ঊনবিংশ শতাব্দীর ইয়োরোপে সবচেয়ে উলেস্নখযোগ্য ও পেশাদার চারম্নকলা প্রতিষ্ঠানগুলি ছিল ১৬৪৮ সালে প্রতিষ্ঠিত প্যারিস অ্যাকাডেমি এবং ১৭৬৮ সালে প্রতিষ্ঠিত ইংল্যান্ডের লন্ডন শহরের পিকাডিলি এলাকায় অবস্থিত রয়াল অ্যাকাডেমি অভ্ আর্টস্ (Royal Academy of Arts), অথবা কেবল রয়াল অ্যাকাডেমি (RA)। একেবারে গোড়ায় প্যারিস অ্যাকাডেমির নামের আগেও ‘রয়াল’ শব্দটি যুক্ত ছিল, কারণ এই প্রতিষ্ঠান গঠিত হয়েছিল সম্রাট পঞ্চদশ ল্যুইয়ের আমলে, যখন রাজকীয় অনুমোদন ছাড়া প্রায় কোনোকিছুই আত্মপ্রকাশ করতে পারত না। ফরাসি বিপস্নবের পর থেকে এই বিধির অবসান ঘটে, বিপস্নব-পরবর্তী সময়ে নেপোলিয়ন বোনাপার্ট নিজেকে সম্রাট ঘোষণা করার পরেও এর ব্যতিক্রম হয়নি। তখনই অ্যাকাডেমির, এবং ওই জাতীয় অন্যান্য প্রতিষ্ঠানের, নামের সঙ্গে ‘রয়াল’ শব্দটি যুক্ত করার প্রথা বাতিল হয়ে যায়। প্যারিস অ্যাকাডেমির স্যালঁর বার্ষিক চিত্রশিল্প প্রদর্শনীর জন্য সরকারি পৃষ্ঠপোষকতাও প্রত্যাহার করে নেওয়া হয় ১৮৬১ সালে, তার পর থেকে এই অনুষ্ঠান পরিচালনা করার দায়িত্ব গ্রহণ করে ফরাসি শিল্পীদেরই দ্বারা সংগঠিত একটি সমিতি (Société des Artistes Français)। এদিক থেকে বিচার করলে, ইংল্যান্ড বোধহয় কিছুটা বেশি রক্ষণশীল, কিংবা বলা যেতে পারে যে দেশটিতে এখনো যেহেতু রাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত (সরকার যদিও সংসদীয় পদ্ধতিতে নির্বাচিত) এবং রাজপরিবার বর্তমানকালেও যেহেতু সেদেশের অধিকাংশ লোকের প্রিয়, প্রায় সমসত্ম সরকারি প্রতিষ্ঠানই আজো তাদের নামের সঙ্গে ‘রয়াল’ বিশেষণটিকে বহন করে। বহু ‘বারা’ (borough) বা পৌর এলাকার নামের আগে এই শব্দটি যুক্ত থাকে, যেমন রয়াল লন্ডন বারা অভ্ ওয়েস্টমিনস্টার, রয়াল লন্ডন বারা অভ্ চেলসি ইত্যাদি। ঠিক সরকারি নয়, কিংবা আগে সরকারি ছিল কিন্তু এখন হয়তো সেভাবে নয়, এমন কিছু প্রতিষ্ঠানের নামেও ‘রয়াল’ শব্দটি আছে, যেমন রয়াল লন্ডন হসপিটাল বা রয়াল জিওগ্রাফিক্যাল সোসাইটি। তবে এখন প্যারিস অ্যাকাডেমির মতো লন্ডনের অ্যাকাডেমিও পরিচালিত হয় বেসরকারি উদ্যোগে ও অর্থসংস্থানে, সরকারি অনুদান পাওয়া বা না পাওয়া নিয়ে তাদের বিশেষ মাথাব্যথা নেই, তবে নাম থেকে ‘রয়াল’ শব্দটি বর্জিত হয়নি। প্রসঙ্গত, সমসাময়িক ইয়োরোপের বৃহত্তম তথা অন্যতম সর্বাধিক মর্যাদাসম্পন্ন আমত্মর্জাতিক শিল্পমেলা ‘FIAC’ (Foire Internationale d’art Contemporain) আয়োজিত হয় ফ্রান্সে। ‘প্যারিস ফোটো’ (Paris Photo) নামে একটি বিখ্যাত আমত্মর্জাতিক আলোকচিত্র প্রদর্শনীর স্থানও ফ্রান্সের রাজধানীতে।
লন্ডনের রয়াল অ্যাকাডেমি পরিচালনার দায়িত্ব পালন করেন যৌথভাবে ব্রিটেনের একদল প্রখ্যাত শিল্পী ও স্থপতি। শিল্প-প্রদর্শনী ও প্রশিক্ষণ এবং শিল্পবিষয়ক আলোচনা ও বিতর্ক সভার আয়োজনের মাধ্যমে দৃষ্টিগোচর শিল্পকর্ম সৃষ্টি এবং তা উপভোগ ও উপলব্ধির প্রসারসাধন এই প্রতিষ্ঠানের মূল লক্ষ্য। ফ্রান্সের চারম্নকলা অ্যাকাডেমির মূল উদ্দেশ্য বা লক্ষ্যও মোটামুটি একই। দুই প্রতিষ্ঠানই প্রথম থেকেই উদীয়মান শিল্পীদের প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করত, বছরে এক বা একাধিক প্রদর্শনীর আয়োজন করত এবং এইসব শিল্পীর কাজ যাতে শিল্পরসিকদের মনোযোগ ও গঠনমূলক সমালোচনা আকর্ষণ করতে পারে তা নিশ্চিত করার চেষ্টা করত। ফলে নতুন ও অনভিজ্ঞ শিল্পীরা অনেক সময়েই সহানুভূতিশীল পৃষ্ঠপোষকদের দাক্ষিণ্যলাভের সুযোগ পেয়ে পরিণত হয়ে উঠতে পারত। অষ্টাদশ শতাব্দীর শেষার্ধে, যখন ফ্রান্স ও ইংল্যান্ডের শিল্পজগৎ প্রায় শাসিতই বলা চলে যথাক্রমে জাকস লুই ডেভিড (Jacques Louis David) এবং জোশুয়া রেনল্ড্মের (Joshua Reynolds) মতো শিল্পীদের দ্বারা, তখন সর্বসাধারণের শিল্পবোধ ও রম্নচি, তৎসহ সরকারি পৃষ্ঠপোষকতার ক্ষেত্র, সম্পূর্ণ কার্যকরভাবেই নিয়ন্ত্রণ করত স্যালঁ এবং রয়াল অ্যাকাডেমির মতো প্রতিষ্ঠানগুলিই। প্রাতিষ্ঠানিক শিল্পকলার চর্চা ও প্রভাব, যার ভিত্তি ছিল চিরাচরিত ধ্রম্নপদী শিল্পকলা, ইয়োরোপীয় পরম্পরা এবং চিত্রশিল্পে ও ভাস্কর্যে প্রধান উপাদান হিসেবে ব্যবহৃত ঐতিহাসিক বিষয়বস্ত্তসমূহ, গোটা ঊনবিংশ শতাব্দী ধরেই কার্যকর ছিল এবং ১৮৫০-এর দশক থেকে পাশ্চাত্য দুনিয়ায় যে অসংখ্য বিশ্ব শিল্পমেলা আয়োজিত হতে থাকে তাদের মধ্যে উপস্থিতির সুবাদে এই ধরনের শিল্পকলার ধারা পরিপুষ্ট হয়ে চলে।
তবে ঊনবিংশ শতাব্দীর মধ্যভাগে ইয়োরোপের সর্বত্রই শিল্প অ্যাকাডেমিগুলির বাড়বাড়মত্ম অবস্থা কিছুটা সিত্মমিত হতে শুরম্ন করে, তথাকথিত আভাঁ-গার্দ (avant-garde) আন্দোলন ক্রমশ জোরদার হয়ে ওঠার কারণে। আক্ষরিক অর্থে আভাঁ-গার্দ হলো ‘advanced guard’ – ‘অগ্রদূত’ বা ‘পথিকৃৎ’। শিল্পকলা, সংগীত, সাহিত্য, এমনকি রাজনীতির অঙ্গনেও নতুন নতুন পরীক্ষামূলক চিমত্মাভাবনা ও পদ্ধতির প্রয়োগ এই আন্দোলনের মূল বৈশিষ্ট্য। আন্দোলনের শরিক শিল্পীদের অনেকেই প্রথাসিদ্ধ শিল্পধারা অগ্রাহ্য করে সম্পূর্ণ নতুন অদৃষ্টপূর্ব আঙ্গিকে কাজ করতে এবং তাঁদের এইসব কাজ প্যারিস স্যালঁ বা লন্ডন রয়াল অ্যাকাডেমির মতো অনুমোদিত প্রদর্শশালায় পাঠাতে শুরম্ন করলেন। অবশ্য স্বীকার করা উচিত যে ইংল্যান্ডের উইলিয়ম হলম্যান হান্ট (William Holman Hunt), আর্থার হিউজ (Arthur Hughes) বা জন এভারেট মিলেইসের (John Everett Millais) মতো ‘প্রাক্-রাফায়েল’ ঘরানার শিল্পীদের (pre-Raphaelites), কিংবা ফ্রান্সের গুসত্মাভ কুরবে (Gustave Courbet), জাঁ-ফ্রাঁসোয়া মিলে (Jean-François Millet) ও এদুয়ার্দ ম্যানে (Édouard Manet) প্রমুখ ‘বাসত্মববাদী’ শিল্পীর (the Realists) প্রাতিষ্ঠানিক সমালোচনা সত্ত্বেও প্যারিস অ্যাকাডেমি ও লন্ডন রয়াল অ্যাকাডেমি এই দুই প্রতিষ্ঠানই যথেষ্ট মুক্ত মনের পরিচয় দিয়েছিল এবং তাদের প্রদর্শশালার জন্য
আভাঁ-গার্দ শিল্পীদের কাজ একাধিকবার গ্রহণ করেছিল। ১৮৭৮ সালে লন্ডনের নিউ বন্ড স্ট্রিটে অবস্থিত গ্রভ্নর (ইংরেজি বানান Grosvenor, কিন্তু উচ্চারণে s অক্ষরটি উহ্য) গ্যালারিতে এডওয়ার্ড বার্ন জোনসের (Edward Burne-Jones) ‘ঈস্থেটিসিস্ট’ (Aestheticist) বা মহান নান্দনিক সৌন্দর্যম–ত চিত্র ‘দ্য লাভ সং’ (The Love Song) এবং আরো আটটি কাজ প্রদর্শিত হয়েছিল। এর তিন-চার বছর আগে, ১৫ এপ্রিল থেকে ১৫ মে ১৮৭৪, প্যারিস শহরেও সংগঠিত হয়েছিল Société Anonyme des Artistes, Peintres, Sculpteurs, Graveurs (Anonymous Society of Artists, Painters, Sculptors, Printmakers) নামক এক শিল্পীগোষ্ঠীর চিত্রসম্ভারের প্রদর্শনী। শিল্পে Impressionism মতবাদের – Impressionist আন্দোলনের – সূচনা এই প্রদর্শনী থেকেই এবং সংগঠক শিল্পীবৃন্দের মধ্যে ছিলেন ক্লদ মনে (Claude Monet), এডগার দেগা (Edgar Degas) ও ক্যামিল পিসারো (Camille Pissarro)। এই বিশেষ ধরনের অঙ্কনশৈলীর অনুসারী শিল্পীরা কোনো বস্ত্ত বা দৃশ্যের সেই রূপটি ফুটিয়ে তোলার চেষ্টা করেন, যা হয়তো মাত্র কয়েক মুহূর্তের জন্য শিল্পীর দৃষ্টির সামনে প্রতিভাত হলো এবং অধিকাংশ ছবিই অাঁকা হয়ে থাকে ঘরের বাইরে খোলা জায়গায়। উজ্জ্বল বর্ণময়তা এধরনের চিত্রের আরেকটি প্রধান বৈশিষ্ট্য। লন্ডন রয়াল অ্যাকাডেমি এবং প্যারিস অ্যাকাডেমির প্রদর্শশালার জন্মলগ্নের কিছুদিন পর থেকেই তাদের দেয়ালে শোভা পেয়ে এসেছে ‘আভাঁ-গার্দ’ তথা ‘ইমপ্রেশনিস্ট’ শিল্পকর্ম।
লন্ডনের রয়াল অ্যাকাডেমি অভ্ আর্টস্ প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল রাজা তৃতীয় জর্জের ব্যক্তিগত উদ্যোগে, ১০ ডিসেম্বার ১৭৬৮ তারিখে। উদ্দেশ্য ছিল প্রশিক্ষণ ও প্রদর্শনীর আয়োজনের মাধ্যমে ব্রিটেনে ব্যবহারিক শিল্পকলার উন্নতিসাধন। অ্যাকাডেমি প্রতিষ্ঠার পেছনে যে চিমত্মাভাবনা কাজ করেছিল তা হলো, প্রথমত, সুষ্ঠু প্রশিক্ষণের এবং শিক্ষার্থী শিল্পীরা যাতে ক্রমে নিজেদের ও অন্যদের শিল্পকর্মের উৎকর্ষ বিচারের বিশেষ ক্ষমতার অধিকারী হয়ে উঠতে পারে সেজন্য উপযুক্ত কর্মসূচি গ্রহণের মাধ্যমে তাদের পেশাদারিত্বের সত্মর উন্নত করা; দ্বিতীয়ত, সমকালীন শিল্পকর্মের নিয়মিত প্রদর্শনীর আয়োজন করা, যাদের অভিজ্ঞতা শিল্পীদের কাম্য মান অর্জনের সহায়ক হবে। এইসব চিমত্মাভাবনার সমর্থকরা চেয়েছিলেন যে জাতীয় সত্মরে যেন একটা উপযুক্ত শিক্ষাকেন্দ্র গড়ে তোলা হয় এবং চারম্নশিল্পের মর্ম উপলব্ধি করার মতো রম্নচি ও আগ্রহ যেন সর্বসাধারণের মধ্যে সঞ্চারিত করা যায়।
অষ্টাদশ শতাব্দীর ব্রিটেনে ‘কন্টিনেন্টাল’ বা মহাদেশীয়, বিশেষত ইয়োরোপীয় এবং চিরাচরিত ঐতিহ্যগত শিল্পই ছিল তখনকার ফ্যাশন। সমসাময়িক ব্রিটিশ শিল্পীদের মধ্যে যারা এই ধারার বাইরে গিয়ে কাজ করার চেষ্টা করত তারা নিজেদের শিল্পকর্ম প্রদর্শিত বা বিক্রি করার বিশেষ সুযোগ পেত না। ওই সময়ে উইলিয়াম হগার্থ (William Hogarth) নামে একজন চিত্রশিল্পী – যিনি ছবি অাঁকা ছাড়াও ছবি ছাপাইয়ের কাজে, ব্যঙ্গচিত্র অঙ্কনে, বিশেষ করে আমরা যাকে ‘কমিক স্ট্রিপ’ (comic strip) বলি তার রচনায় পারদর্শী ছিলেন – এই পরিস্থিতি বদলানোর উদ্যোগ নেন। কয়েক বছর আগে টমাস কোরাম (Thomas Coram) নামে রাজকীয় নৌবাহিনীর একজন অবসরপ্রাপ্ত অফিসার অনাথ পথশিশুদের আশ্রয়দানের উদ্দেশ্যে ‘ফাউন্ডলিং হসপিটাল’ (Foundling Hospital) নামে লন্ডনে একটা দাতব্য প্রতিষ্ঠান স্থাপন করেছিলেন। এই প্রতিষ্ঠান পরে অন্য ঠিকানায় উঠে যায় এবং ১৭৪৬ সালে ওই বাড়িতেই উইলিয়াম হগার্থ ওই সময়কার ব্রিটেনের ‘স্ট্রাগলিং’ শিল্পীদের জন্য একটা কর্মশালা তথা প্রদর্শশালা খোলেন। এই উদ্যোগে তাঁর সঙ্গে ছিলেন প্রখ্যাত সুরকার, শিল্পের সমঝদার জর্জ ফ্রিডরিক হ্যান্ডেল (Greorge Frideric Handel)। তাঁদের এই উদ্যোগের সাফল্যের জের ধরেই স্থাপিত হয় ‘সোসাইটি অভ্ আর্টিস্টস্ অভ্ গ্রেট ব্রিটেন’ (Society of Artists of Great Britain) এবং ‘ফ্রি সোসাইটি অভ্ আর্টিস্টস্’ (Free Society of Artists)। যেসব শিল্পী তাদের কাজ জনসমক্ষে তুলে ধরার সুযোগ পাচ্ছিল না, এই দুই প্রতিষ্ঠান তাদের খুবই সাহায্য করতে পেরেছিল। কিন্তু পরিতাপের বিষয়, উভয় প্রতিষ্ঠানেই সদস্যদের অমত্মঃকলহ কয়েক বছরের মধ্যে এমন পর্যায়ে গিয়ে পৌঁছায় যে কর্মশালা ও প্রদর্শশালা চালু রাখা কার্যত অসম্ভব হয়ে দাঁড়ায়। তখনই শিল্পশিক্ষা ও শিল্প প্রদর্শনকে একত্রিত করে একটা জাতীয় প্রতিষ্ঠান গঠন করার ব্যাপারে চিমত্মাভাবনা শুরম্ন হয়, যাদের ভিত্তিতে প্রতিষ্ঠিত হয় রয়াল অ্যাকাডেমি অভ্ আর্টস্, ১৭৬৮ সালে। রাজা তৃতীয় জর্জের ঘনিষ্ঠ সেসময়কার একজন নামকরা স্থপতি স্যার উইলিয়ম চেম্বারস (Sir William Chambers), রয়াল অ্যাকাডেমির জন্য রাজকীয় অনুমোদন ও আর্থিক অনুদান লাভ করতে সমর্থ হন। শিল্পী জোশুয়া রেনল্ড্স অ্যাকাডেমির প্রথম প্রেসিডেন্ট বা সভাপতি নির্বাচিত হন, প্রথম সেক্রেটারি বা সচিব নিযুক্ত হন আরেকজন সুখ্যাত শিল্পী ফ্রান্সিস মিলনার নিউটন (Francis Milner Newton)। জন্মলাভ করার পর অষ্টাদশ ও ঊনবিংশ শতাব্দীর ব্রিটেনে শিল্পকলা চর্চার ক্ষেত্রে অন্য শিল্পপ্রতিষ্ঠানগুলির তুলনায় রয়াল অ্যাকাডেমির আধিপত্য ছিল সন্দেহাতীত। আজো শিল্পজগৎ ও শিল্পীদের কাছে এই প্রতিষ্ঠানটির ভূমিকার গুরম্নত্ব সর্বজনস্বীকৃত।
রয়াল অ্যাকাডেমির দ্বারা আয়োজিত সমসত্ম শিল্পীর জন্য অবাধ সমকালীন শিল্পের সর্বপ্রথম প্রদর্শনীর উদ্বোধন হয়েছিল ১৭৬৯ সালের ২৫ এপ্রিল এবং এটা চলেছিল ওই বছরের ২৭ মে তারিখ পর্যমত্ম। এই প্রদর্শনীতে স্থান পেয়েছিল একশো ছত্রিশটি শিল্পকর্ম। এখনো বছরের মোটামুটি একই সময়ে এই প্রদর্শনী আয়োজিত হয়ে থাকে। ‘রয়াল অ্যাকাডেমি সামার এক্সিবিশন’ (Royal Academy Summer Exhibition) নামে সুপরিচিত এই গ্রীষ্মকালীন শিল্পকলা প্রদর্শনী বিশ্বের সবচেয়ে প্রাচীন নিয়মিত শিল্পোৎসব। প্রথম দিন থেকে শুরম্ন করে আজ পর্যমত্ম এই বার্ষিক প্রদর্শনী আয়োজিত হয়ে আসছে এক বছরও বাদ না গিয়ে। এর আরেকটা প্রধান বৈশিষ্ট্য হলো যে এই প্রদর্শনীতে আগত সাধারণ দর্শকরা তাদের সাধ্যের মধ্যে দামে মৌলিক শিল্পকর্ম কেনার এবং একই সঙ্গে রয়াল অ্যাকাডেমির দ্বারা পরিচালিত শিক্ষাকেন্দ্রগুলিকে সাহায্য করার সুযোগ পায়। প্রায় ২৫০ বছর ধরে রয়াল অ্যাকাডেমির বিনামূল্যে শিক্ষাদান কর্মসূচির ব্যয়নির্বাহে দর্শকদের এই অবদান বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ। n