আ না ই স লা ম
ভারতীয় জীবন, নান্দনিক দর্শন ও ইউরোপীয় শিল্প-সংক্রান্ত ভাব-ভাবনা, শিল্পরীতি যাবতীয় স্মৃতি, অভিজ্ঞতা, স্বপ্ন সবই সংশ্লেষিত শিল্পী শক্তি বর্মণের কাজে। জলে ভেসে আসা গুল্মের মতো ফেলে আসা জীবনের স্মৃতি এসে ভর করে তাঁর ক্যানভাসে। আর ভ্রমণসূত্রে পাওয়া অভিজ্ঞতা বারবার এসে কড়া নাড়ে তাঁর চৈতন্যে।
স্বদেশ এবং ফ্রান্সের জল-হাওয়ায় বর্ধিত হয়েছে শক্তির চিত্রকর্ম। তাঁর শিল্পসৃষ্টির ক্রমবিবর্তনের সূত্রটি বুঝতে হলে দুই সমাজ-সংস্কৃতির উপাদান ও উপাচারের কথা মনে রাখা প্রয়োজন। ভারতীয় জীবনবোধ, আনন্দ-দুঃখ, স্মৃতি, প্রকৃতি, মাটির গন্ধ যেমন তাঁর মনের গভীর প্রদেশে অবিরত ক্রিয়াশীল, তেমনি ফরাসি দেশের পরিবেশ-প্রকৃতির মেদুরতাও তাঁর মনের পেলব কোণে উষ্ণতা ছড়ায়।
ভারতীয় আর ইউরোপীয় ভাবনার সংশ্লেষে যে নিজস্ব চিত্রজগৎ সৃষ্টি করেছেন, সেই কথা ও কাহিনির জগৎ একান্তই তাঁর। তিনি স্বপ্ন দেখেন এবং দেখাতে ভালোবাসেন। রূপ ও সৌন্দর্যের উপাসক শক্তির কাজ স্মৃতি এবং স্বপ্নের সহোদর। তিনি স্বপ্ন ও বাস্তবের মিত্রতা গড়ে তুলতে চান শিল্পের নির্মল বন্ধনে।
১৯৫৬ সাল, মাত্র ২১ বছর বয়সে শিল্পী হবার বাসনা বুকে নিয়ে জাহাজে উঠেছিলেন এক তরুণ। অচেনা এক শহর প্যারিস। পুঁজি বলতে বইয়ে পড়া প্যারিসের শিল্প ও সংস্কৃতি জীবনের ছবি।
কলকাতা আর্ট কলেজের পড়া শেষ করে এক ভিন্ন জগতে এসে পড়লেন যে-তরুণ তাঁর তখন জগৎটাই ছিল রূপকথার। বুকের ভেতর সৃষ্টির সিমফনি। ’৫৬ থেকে ২০১১ – অর্ধশতাব্দীর বেশি প্যারিসবাসী। জীবনের দুটি অধ্যায় দুদেশে কেটেছে বলেই শিল্পী শক্তি বর্মণের শিল্পকর্ম প্রসঙ্গে, বিশ্লেষণে পরিপ্রেক্ষিত ভারত আর ফরাসি দেশের কথা ওঠে।
শিল্পীর পরিচয়সন্ধানী পাঠকের কাছে তাঁর শিল্পী হবার নেপথ্য বৃত্তান্ত জানানোটা অপরিহার্য। এতে বোঝা যায়, শিল্পীর সৃষ্টি ও শৈলীতে কতটা স্পষ্ট তাঁর দেশ, সংস্কৃতি, নৃতত্ত্ব, ইতিহাস, এমনকি দুটো সংস্কৃতির সাযুজ্যও।
শক্তি বর্মণের জন্ম কলকাতায় ১৯৩৫ সালে। কিন্তু শৈশবের দিনগুলো কেটেছে বাংলাদেশে। ব্রাহ্মণবাড়িয়ার বিদ্যাকুট গ্রামে। ঠাকুরদাদা ছিলেন তালুকদার। কিন্তু বাবা-চাচারা ব্যবসাসূত্রে কলকাতাবাসী ছিলেন। মা উমাতারা আর বাবা আদিনাথ বর্মণ কলকাতার বাড়িতে থাকতেন। অবশ্য প্রথম জন্মদিন পালন করতে মা শক্তিকে নিয়ে বিদ্যাকুট গ্রামে আসেন আর সেখানেই তিনি বেড়ে ওঠেন।
গ্রামে বেড়ে ওঠার দিনগুলো শক্তির জীবন ও সৃষ্টিসত্তায় জন্মদাগের মতো লেপটে আছে। মেজ বোনের বিয়ের অনুষ্ঠানের স্মৃতি এখনো উজ্জ্বল, সজীব। একদল বাজনা বাদকের বরকে নিয়ে আসা, তাঁদের পশ্চিমা ধাঁচের ঝলমলে পোশাক শিশুশক্তির জন্য ছিল রুদ্ধশ্বাস আনন্দ। সেই রঙিন শোভাযাত্রার উদ্যাপন ডুবে ছিল চৈতন্যলোকে, পরবর্তীকালে তাঁর সৃষ্টিতে শিশুর মতো হামাগুড়ি দিয়ে এসেছে শৈশব।
বিদ্যাকুট গ্রামের মাটি, জল, বাতাসের গন্ধ শক্তির চিত্রকলার নির্যাস। তাঁর ছবিতে মিথ বা রূপকথার যে, উপস্থিতি সেসবও কিন্তু শৈশবের ঘুমপাড়ানি গানের সুরের মতো ঘুরে ঘুরে আসে। মেঘনা নদীর পারে গ্রাম। বর্ষায় কূল ভেসে যাওয়া পানিতে ডুবন্ত জনপদ। বাড়ির বিস্তৃত উঠান ঘিরে অনেকগুলো ঘর, গাছপালা জলমগ্ন। যোগাযোগ বলতে নৌকা। পরবাসী শক্তি দূরান্তের ছায়ায় বসে এখনো শুনতে পান নৌকা আর জলের ছলছল শব্দ। বাড়ির বাগানজুড়ে ফলের গাছ। বানররা রাতে আম, লিচু খেয়ে যেত আর ভোরে শিশুরা সব পড়া ফল কুড়াতে যেত। শুনতেন, পড়তেন রূপকথা, রামায়ণের গল্প। বাড়িতে হতো দুর্গাপূজাসহ নানা পার্বণ। আলপনা, ব্রত অনুষ্ঠান করতেন দিদিরা। এসবই পরে শিল্পীর সৃষ্টিতে ভিড় করেছে নানা চিত্রকল্পে।
আট বছর পর্যন্ত গ্রামে ছিলেন। দেশভাগের আগে চলে আসেন কলকাতায় (দেশভাগের জন্য নয়)। শিল্পীর প্যারিসের ফ্ল্যাটে আলাপচারিতায় বলেছিলেন, মনের গভীরে অবিরত সেই স্মৃতিরা ঘোরাফেরা করে। শৈশবের দিনগুলো এত বেশি সজীব যে, তিনি ফেলে আসা গ্রামের বিশদ চিত্র এঁকে দিতে পারেন এখনো।
বাড়িতে পূজার সময় শখের নাটক হতো। মঞ্চের নির্মাণ ও অঙ্গসজ্জা শিশু শক্তির জন্য ছিল বিস্ময়কর। মনে হতো লার্জার দ্যান লাইফ। বড় ভাই স্বপন ডিমের খোসায় ছবি আঁকতেন। রং-রেখার আলপনা, গল্পকথা, সার্কাস দেখা – সব মিলে তার ভেতর জন্ম হচ্ছিল বিস্ময়াবিষ্ট অনুভূতিমালা। সে-সময়টাতেই তিনি আবিষ্কার করেছিলেন যে, তিনিও ছবি আঁকতে পারেন। শক্তির ভাষায় – দেবী সরস্বতী তাঁকে হয়তো তখন আশীর্বাদ করেছিলেন এ-শিশু বড় হয়ে শিল্পী হবে।
কেউ অসুস্থ বা মারা যাওয়া ছাড়া বাড়িতে নানা উদ্যাপনে বিরতির পর্দা নামত না। মা, মাসি, দিদিরা আলপনা করতেন চালের গুঁড়া আর পানি মিশিয়ে। আলপনা সাধারণত হয় ফুল, লতাপাতার মোটিফে। সুললিত সর্পিল রেখায় ফুটে ওঠা ইমেজ শক্তি চোখ ভরে দেখতেন।
মৃত্যু সম্পর্কে বোঝার জ্ঞান হয়নি এমন বয়সে মাকে হারিয়েছিলেন শক্তি। শিশুকে সান্ত্বনা দেওয়া হয়েছিল, মা কোথাও গেছেন, ফিরে আসবেন। কিন্তু বড় হতে মাকে যখন অনুভব করতেন, জেদ করে কাঁদতেন। শক্তির কাছে মায়ের স্মৃতি মানেই তাঁর সৌন্দর্য। বাড়িতে সবাই বলত, মা ছিলেন খুব সুন্দরী আর বিদুষী। পরবর্তীকালে ভালো কোনো কাজ করলে বাড়িতে সবাই বলত তিনি মায়ের সূত্রে পেয়েছেন।
আলপনা, বিছানার চাদর, কাঁথা সেলাই করাতে মা ছিলেন পারদর্শী। তাঁর সেলাই করা কাঁথা শহরের প্রদর্শনীতে পুরস্কার পেয়েছে।
বলা বাহুল্য, মায়ের সান্নিধ্যেই এক বালকের সৃষ্টিসত্তার বীজ অঙ্কুরিত হয়েছিল।
শক্তির স্কুলজীবন কেটেছে আসামের ডিব্র“গড়ে। ছোট ব্যবসায়িক শহর। শিল্প-সংস্কৃতির কোনো ছোঁয়া সেখানে ছিল না। বাবা আপাদমস্তক সংস্কৃতিমনা, সংগীতের গুণগ্রাহী। বাবার প্রযতেœ সংগীত ও চিত্রকলায় আকর্ষণ, উদ্দীপনা। কলকাতা গভর্নমেন্ট কলেজে পড়ার সময় হোস্টেলে নিয়মিত সেতার রেওয়াজ করতেন। শিখতেন বিখ্যাত সেতারবাদক বিমলকান্তি রায় চৌধুরীর কাছে। ডিব্র“গড়ের পুরনো বাদ্যযন্ত্রটির স্থলে পরে বাবা তাঁকে নতুন সেতার কিনে দেন। সেই সেতারটি এখনো তাঁর প্যারিসের বাড়িতে আছে। সরস্বতীর দুসত্তাকে সমান্তরাল বয়ে নেওয়া দুরূহ হয়ে পড়লে তিনি তুলিকে নমস্য বলে হাতে তুলে নেন। কারণ রেওয়াজের পর আঙুলে ব্যথা হতো, কখনো বা কিছু সময়ের জন্য অসাড় বোধ করতেন। ফলে কাজের সময় তুলি ধরা কঠিন হয়ে পড়ত।
ডিব্র“গড়ে দাদার দোকানের কর্মচারীদের অবসর বিনোদনের জন্য দাবার বোর্ড রাখা ছিল। মাঝে মাঝে বাবাও যেতেন বন্ধুদের নিয়ে খেলতে। দাবা খেলায় শক্তির কোনো আগ্রহ ছিল না কিন্তু সাদাকালো ছককাটা নিখুঁত কলানৈপুণ্য তাঁকে আকর্ষণ করত। অবাক হয়ে দেখতেন। আট বছর বয়সে এসেছিলেন ডিব্র“গড়ে। বছরটা ছিল ১৯৪৩। স্মরণাতীতকালে ভয়াবহ দুর্ভিক্ষের বছর, গ্রামবাংলার অগণিত লোক মারা গিয়েছিল অনাহারে। তার আগের বছর গান্ধী জাতীয় আন্দোলনের ডাক দিয়েছিলেন। স্বাধীনতার আগে সেটাই ছিল শেষ বড় ধরনের আন্দোলন। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ চলছে। বিশ্বজুড়ে সেই ধ্বংসযজ্ঞের প্রতিক্রিয়া। ব্রিটিশ-শাসিত ভারতেও তার আঁচ। এই সময়টাতে শক্তি প্রথম দেখেন শ্বেতবর্ণের মানুষ। মিত্রবাহিনীর সৈন্যরা ডিব্র“গড়ে ঘাঁটি গড়েছিল। প্রায় প্রতিদিন অনেক শ্বেত চামড়ার মানুষ দেখেছেন। যারা ছিল মূলত সৈনিক। এই সৈনিকদের একজন কিছু ছবি নিয়ে আসেন ফ্রেমের দোকানে। শক্তি উপস্থিত ছিলেন সেখানে। নিসর্গদৃশ্যের চিত্রকর আমেরিকান সৈনিক। বালক শক্তি বর্ণিল নিসর্গচিত্র দেখে উদ্বেলিত। বলা যায় শিল্পের অভিষেক সম্পন্ন হয়েছিল তখনই ভবিষ্যতের চিত্রশিল্পী শক্তি বর্মণের।
ডিব্র“গড় শহরে দু-তিনজন চিত্রশিল্পী ছিলেন, কলকাতা আর্ট কলেজ থেকে পাশ করা। কিন্তু তাঁদের কেউই ছবি এঁকে জীবন ধারণ করতেন না। বুকের মধ্যে কারুবাসনা; স্কুলের বই, ম্যাগাজিন, ক্যালেন্ডারের ইলাস্ট্রেশন কপি করতেন শক্তি। স্থানীয় শিল্পীদের উপদেশে নির্সগদৃশ্যও আঁকার চেষ্টা করেছেন। বিখ্যাত ব্যক্তিদের প্রতিকৃতি কপি করতেন খুব। ম্যাগাজিন, পোস্টার, সংবাদপত্রে প্রকাশিত ছবি দেখে। প্রিয় ছিলেন রবীন্দ্রনাথ, গান্ধী, নেহরু, সুভাষ বসু প্রমুখ।
কিশোর শক্তির জন্য ১৯৫০ ছিল স্মরণীয় বছর। স্বাধীনতার পর ১৯৪৯ সালে ভূমিকম্পে আসামের বিভিন্ন অঞ্চল ক্ষতিগ্রস্ত হয়। উপদ্রুত এলাকা পরিদর্শন শেষে প্রধানমন্ত্রী নেহরু ডিব্র“গড়ে বিশাল জনসভায় বক্তৃতা করেন। শক্তি সেই জনসভায় উপস্থিত থেকে একেবারে কাছ থেকে তাঁর প্রতিকৃতি করেছিলেন। উপস্থিত অনেকেই শক্তির ছবি আঁকার প্রতিভা সম্পর্কে জানতেন। তাই সাংবাদিক, আলোকচিত্রী, রাজনৈতিক কর্মীদের ভিড়ে সুযোগ হয়েছিল মঞ্চের কাছাকাছি বসার। সেখানে বসে আঁকেন নেহরুর প্রতিকৃতি। ছবিটি দেখে সবাই প্রধানমন্ত্রীকে দেখাতে বলেন। কিন্তু সভা শেষে অন্যত্র অনুষ্ঠান থাকায় প্রধানমন্ত্রী দ্রুত গাড়িতে প্রস্থান করেন। একজন নিরাপত্তাকর্মী আশাহত কিশোরকে সান্ত্বনা দিয়ে ছবিটা নিয়ে যান প্রধানমন্ত্রীকে দেখিয়ে স্বাক্ষর করিয়ে দেবেন বলে। নেহরুর স্বাক্ষর করা প্রতিকৃতিটি এখন তাঁদের পরিবারের মূল্যবান সংগ্রহের তালিকায় রয়েছে।
আর্ট কলেজে ভর্তি হবার সময় শক্তিকে অভিভাবকের ইচ্ছা-অভিপ্রায়ের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে হয়নি। অন্যসব বাবার মতো শক্তির বাবাও চাইতেন ছেলে চিকিৎসক হোক আর্থিক নিশ্চয়তার জন্য। কিন্তু বড় দাদা, দিদিদের সমঝোতায় বাবা মত দেন। ডিব্র“গড়ে স্কুল শেষ করে তিনি শিল্পী হবার পথে পা রাখেন কলকাতা আর্ট কলেজে। শেষ করেন পাঁচ বছরের কোর্স।
কলকাতায় আর্ট কলেজে পড়ার সময় গেছেন উত্তর ও মধ্য ভারতে। ভ্রমণসূত্রে অজস্র আউটডোর ড্রইং করেছেন – মানুষ, শহর, ঐতিহাসিক স্থাপত্য ও স্থাপনার। দেখেন ন্যাশনাল গ্যালারি অব মডার্ন আর্টে ভারতের বিখ্যাত আধুনিক শিল্পীদের কাজ। বিশেষ করে রবিভার্মা, অবনীন্দ্রনাথ, রবীন্দ্রনাথ, অমৃতা শেরগিল। আর কলকাতায় ইন্ডিয়ান মিউজিয়ামে দেখেছিলেন অবনীন্দ্রনাথের মিনিয়েচার পেইন্টিংসহ সমসাময়িক অন্যান্য বিখ্যাত শিল্পীর কাজ।
ঘোরাঘুরির মাঝেই মনের স্বতঃস্ফূর্ত আনন্দকে মুক্তি দিয়েছেন চিত্রে। তাঁর অভিজ্ঞতার নির্যাস তাঁর চিত্রকর্ম। তাই বলেছেন – … my model was nature, but back home, removed from nature, works were judged by the standards of art, not of nature. ঐতিহ্যকে পাশে রেখে কোনো শিল্পই চৈতন্যের প্রকৃত প্রকাশ ঘটাতে পারে না। স্পেনীয় ঐতিহ্যে ভেলাসকাথ, পরে পিকাসো, দালি থেকে অন্য শিল্পীদের মতো শক্তি বর্মণও। নন্দলালের রেট্রোসপেকটিভ আর রাশিয়ার শিল্পীদের প্রদর্শনী দেখাটাও ছিল তাঁর ছাত্রজীবনের গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা।
কলেজে শিক্ষকদের মধ্যে অনেকে বিখ্যাত ছিলেন। তবে গোপাল ঘোষ ছিলেন ক্যারিশম্যাটিক ব্যক্তিত্ব। শিক্ষক গোপাল ঘোষের কাছেই শেখেন – জলরং কোনো নিয়মের দাস নয়। পিকাসোর প্রতিকৃতির আলোকচিত্রও দেখেছিলেন প্রথম গোপাল ঘোষের স্টুডিওতে। কলেজ লাইব্রেরিতে দেখেছিলেন ইতালীয় রেনেসাঁসের ভিঞ্চি, রাফায়েল, বতিচেল্লি, তিশিয়ান, মাইকেল অ্যাঞ্জেলো।
আর্ট কলেজে ছাত্রাবস্থায় ১৯৫৪ সালে প্রদর্শনী করেছিলেন। শিক্ষক দিলীপ দাশগুপ্ত ছিলেন জয়নুল আবেদিনের বিশেষ বন্ধু। তিনি নিয়ে এসেছিলেন শিল্পী আবেদিনকে। সুদর্শন শিল্পী জয়নুল আবেদিনের কথা খুব মনে আছে শক্তি বর্মণের। মাস্টার মশাই দিলীপ দাশ গল্প করতেন প্যারিসের। তাছাড়া কলেজে পড়ার সময়ই পড়া হয়েছিল আরভিং স্টোনের লাস্ট ফর লাইফ (১৯৩৪) আর সমারসেট মমের দি মুন অ্যান্ড সিক্রপেন্স (১৯১৯)। বিখ্যাত চলচ্চিত্র মুলারুজও দেখেছিলেন। আর স্যারদের মুখে ইম্প্রেশনিস্ট শিল্পীদের ত্যাগ, কষ্ট, জীবনসংগ্রাম শুনে প্রতিক্রিয়া হতো খুব। মনের অজ্ঞাতসারে স্বপ্ন দেখা শুরু হলো। প্যারিসে আসার ইচ্ছাটা তখনো অন্তর্ভুবনের ভাবনা বুনন। বাস্তব চেহারাটা ভিন্ন। কলকাতা আর্ট কলেজের পাঁচ বছরের শিক্ষায় মন ভরল না। আবার পাশ করার পর বৃত্তির জন্য অপেক্ষা করতে হবে, সে ধৈর্যও ছিল না। তাই বাবার প্রেরণা, সাহায্যে ’৫৬ সালে এলো সেই স্বপ্নপূরণের মাহেন্দ্রক্ষণ। জাহাজে চড়ে পাড়ি দিলেন শিল্পের বীক্ষায় আস্থা রেখে প্যারিসে। জাহাজেই সহযাত্রী এক ফরাসি দম্পতির সঙ্গে পরিচয় হলো। তাঁদের সহায়তায় প্যারিসে পৌঁছে শক্তি থাকার বাসস্থান পান।
সীমিত অর্থে প্যারিসের জীবন চালাতে হতো। কিন্তু মনে আশা, শিল্পচর্চার তৃষ্ণা তীব্র। প্যারিসে তাঁর শিল্পক্ষমতা বিকাশের পটভূমিটিও স্পষ্টত ভিন্ন। ছোট্ট স্টুডিওতে থাকতেন ইরানি বন্ধুর সঙ্গে। ঘরে একটা ছোট আয়না ছিল, তার সামনে ফল-ফুল রেখে ছবি এঁকেছেন। আয়নাটা এমনভাবে রাখা ছিল, যাতে বাইরের প্রকৃতি প্রতিবিম্বিত হতো। শক্তির সেপর্বের কাজে ফরাসি শিল্পী বোনারের প্রভাব ছিল। মাতিসের কাজও তাঁকে অনুপ্রাণিত করত। পারসপেকটিভ বা প্রেক্ষিত স্পেসে আছে বা নেই। শিল্পীর কথা – এটা ঠিক আসল পারসপেকটিভ নয়। রিয়েল বা ভিজ্যুয়ালও নয়। ইনটেরিয়র পারসপেকটিভ।
শক্তির বয়স তখন বাইশ। বয়সটাই এমন যে স্বপ্নের মধ্যে দিয়ে একজন মানুষ দেখতে পান নিজের পৃথিবী। শৈলীতে প্রবলভাবে প্রকাশিত বোনার, মাতিস, কখনোবা শাগাল। ব্রাকও ভালো লাগত, আর পিকাসোর প্রতি আকর্ষণ আরো পরে।
প্যারিসে একটা দলীয় প্রদর্শনীতে প্রথম ছবি বিক্রি হয় শিল্পীর। তার পরপরই লন্ডনের পিকাডেলি গ্যালারি শক্তির স্টুডিও দেখার আগ্রহ জানিয়ে চিঠি দেয়। তারা বেশ কয়েকটি চিত্রকর্ম নিয়ে যায়। আর সেটাই ছিল শিল্পীর প্রথম যোগাযোগ গ্যালারির সঙ্গে। পরে এই গ্যালারিতে শক্তির একক প্রদর্শনীও হয় ১৯৬১ সালে।
প্যারিসে পড়া শেষ করে দেশে ফিরে গিয়েছিলেন শক্তি। প্রদর্শনী করেছিলেন কলকাতার অশোকা গ্যালারিতে। দিল্লিতে করেছিলেন একটি প্রদর্শনী। কিন্তু সে-সময়ে ছবি এঁকে জীবনযাপন করা সহজ ছিল না। ’৬২-তে দেশে ফিরে এলেও পরের বছরই প্রাণের টানে ফিরে আসেন প্যারিসে। ফরাসি বান্ধবী মাইতের সঙ্গে সখ্য গড়ে উঠেছিল প্যারিসে শাপলা মিত্তির স্টুডিওতে শিল্পশিক্ষার সময়। ব্যক্তিজীবনে দিনবদলের পালা। ফলে প্যারিসে ফিরে আসাটাই নিয়তি নির্ধারণ করে দিলো। তবে এখন ভাবেন দেশে যদি বর্তমানের মতো শিল্পচর্চার পরিবেশ থাকত তবে হয়তো থেকে যেতেন। তিনি একথাও বিশ্বাস করেন, আজকের এই স্টাইল আর চিত্র হয়তো জন্ম নিত না ভারতে থেকে গেলে।
’৬৭-৬৮ সালের ছবিগুলো দেখে পরে মনে হয়েছে, এগুলো তাঁর নিজস্ব নয়। আবিষ্কার আর চর্চার ধারাবাহিকতায় ক্রমাগত নিজেকে বদলিয়েছেন, বিভিন্ন নিরীক্ষা করেছেন।
ভ্রমণ অভিজ্ঞতায় পুরী, পুরুলিয়া, রাজস্থান পরে ইতালি, মিশরে দেখার অভিজ্ঞতা শিল্পবোধকে ক্রমাগত পরিণত, পরিশীলিত করেছে। নৈকট্য ও দূরত্ব – পরস্পর জানার অভিজ্ঞতা থেকে খুঁজে পেয়েছেন নিজস্বতার দিকচিহ্ন। মিশরীয় পুরোহিতরা প্রাচীনকালে চিত্রাক্ষর দিয়ে তাঁদের ভাব প্রকাশ করতেন। শক্তি তাঁর চিত্রে নিজেকে নিবেদন করেন বিভিন্ন প্রতীক, চিত্রকল্প ব্যবহার করে। রং, রেখা, রূপকে এক ভিন্ন অধাত্ম্য তাতে জড়িয়ে থাকে।
শক্তি বর্মণের চিত্রের মনস্তাত্ত্বিক পর্দা সরালে অনেকেই তাতে ইয়ং বা ফ্রয়েডীয় তত্ত্বের ছায়া পান। মানুষের স্বপ্ন আর বাস্তবের মধ্যে থাকে এক অন্তহীন শূন্যতা। তবে তাঁর ছবিতে শূন্যতার হাহাকার, আক্ষেপ নেই। কিন্তু শক্তি এই দুজগতের অর্থাৎ বাস্তবজীবন এবং কল্পনার জীবনের মধ্যকার ফাঁকটুকু ভরে দিয়েছেন স্মৃতির সংরাগে।
শক্তি বর্মণের চিত্রকর্ম বিষয়ে লিখতে গিয়ে রবীন্দ্রনাথের কাছে ফিরে যেতে হয়। কবি তাঁর ছবি সম্পর্কে লিখেছিলেন – যখন ছবি আঁকায় আমার মন টানল, তখন দৃষ্টির মহাযাত্রার মধ্যে মন স্থান পেল। গাছপালা, জীবজন্তু সকলই আপন আপন রূপ নিয়ে চারিদিকে প্রত্যক্ষ হয়ে উঠতে লাগল। তখন রেখায়, রঙে সৃষ্টি করতে লাগল যা প্রকাশ হয়ে উঠেছে। তাছাড়া অন্য কোনো ব্যাখ্যার দরকার নেই।
ব্যাকরণকে অশুদ্ধ করে, বর্ণে বা বিন্যাসে কোনো মনান্তর না ঘটিয়ে জীবনের সমস্ত দৈন্যতা পাশে রেখে সৌন্দর্যের দিকে চোখ রাখেন শিল্পী। দরবারির দরদি আলাপে আবিষ্ট শ্রোতার মতো স্বপ্নের অলিগলি দিয়ে ঘুরে বেড়ান তন্ময় এক মানুষ – তিনি শিল্পী শক্তি বর্মণ।
রেখা, রেখার রং, রঙের প্রলেপ, পুতুল, দেবীসদৃশ নারী, শিশু, প্রকৃতি, প্রাণী, পাখির শরীর বর্ণ-বর্ণান্তে গড়েন ফ্রিজশটের মতো। নিজস্ব রেখার ছন্দ এবং ফর্মের একান্ত ভারতীয় প্রয়োগরীতি এবং তা শক্তির নিজস্ব শিল্পশৈলী। অঙ্কনরীতিতে আপাত ন্যাচারালিস্ট, রিয়েলিজম থেকে পৌঁছে যান সুররিয়ালিজমে। তবে তাঁর ক্যানভাসের শৃঙ্খল স্থিতিমনের অবচেতন স্তরের প্রকাশ। আর তিনি সুররিয়ালিস্টদের মতো নৈরাজ্যবাদীও নন। আবার আধুনিকতার ছাপ দেওয়া দুর্বোধ্য কিছু নেই। স্বপ্নের এলোমেলো ভাবটাও সচেতন কাজ।
মানুষ তার অভিজ্ঞতার বৃত্ত থেকে চ্যুত হতে পারে না। শক্তির সৃষ্টির পুরোটাই নিজস্ব অর্জনের বয়ান। প্যারিসে পড়ার সময় ঘুরেছেন ইউরোপ, মিশর। দেখেছেন গ্রিস, ইতালি, স্পেন। উদ্বেল হয়েছেন মিশরীয় এবং এত্র“স্কান আর্টের আভিজাত্যে।
আর স্বদেশে অজন্তার গুহাচিত্র, ইলোরার ভাস্কর্যের অনপনেয় ছাপ রয়ে গেছে তাঁর চৈতন্যভূমিতে। তাই মন্দির, ম্যুরাল, মিনিয়েচারের মতো তাঁর কাজে নানা অনুষঙ্গের মেলামেশা, নানা উপকরণের উপস্থিতি। শাঁখ, ঝিনুক, মানুষের বর্ণিল দেহ, বর্তুল স্তনের নারী, বাগান, বৃক্ষপত্রের সঙ্গে আছে স্থাপত্যের যাবতীয় খুঁটিনাটি। মিনিয়েচারের শৈলীতে বর্ডার দেওয়া – এসবই ভারতীয় ঐতিহ্যের রেশ। বিষয়ের প্রয়োজনে রং প্রয়োগ বদলেছে। একসময়ের সবুজ, নীল, হলুদের স্থান করে নিয়েছে গোলাপি, কমলা। মনে হতে পারে ঘুরেফিরে আসা বিষয়, বিষয়ের অভিনবত্ব নেই। তার প্রতিটি ছবিতে প্রতীকের চিত্রগুরুত্ব সমমান সম্পন্ন।
ইউরোপীয়, ভারতীয় উপাদানের প্রভাব ছাড়াও রয়েছে মিশরীয় উপকরণ। এই বিচিত্র দৃষ্টিভঙ্গি তাঁর চিত্রের কোনো কোনো অংশ ভিজ্যুয়াল কোটেশন হিসেবে নতুনতর ব্যাখ্যা দেয়। ক্যানভাসে নগ্ন নারী, নানা ভঙ্গিমায় দাঁড়ানো নারী দেখে মনে হতেই পারে, মন্দিরগাত্র থেকে তাদের জন্ম। আর এই চিত্রাবলি যেন ফ্রেমের ভেতর ফ্রেম। ভারতীয় মিনিয়েচার ছবির প্রবল সাযুজ্য তাতে। তারুণ্যের বোনারের অনুরাগী শক্তি বলেন – ফরাসি শিল্পী বোনারের রং ব্যবহার তাঁকে পারসিয়ান আর ভারতীয় মিনিয়েচার চিত্রের কথা মনে করিয়ে দেয়।
শিল্পীর চিত্রকর্মেও দুই ধারার দর্শনের ছায়া পড়েছে। তিনি ভাবনায়, স্বভাবে ভারতীয়, আবার উপস্থাপনের ধরনে কখনো বা তাতে ইউরোপীয় শিল্পীর প্রভাবও থাকে। প্রবলভাবে ন্যারেটিভ ছবিগুলোতে শাগালের স্বপ্নময়তার সঙ্গে শক্তির স্মৃতি-শ্র“তি-পুরাণ মিশে যায়।
তাঁর কাজে তমসার ছায়া নেই। মাতিস যেমন বলেছিলেন – ছবিতে তিনি হতাশা বা আতঙ্কের অবতারণা করতে চান না। আশির দশকে কাজে যে-পরিবর্তন তাকে বলেন – ‘ধারার মধ্যে প্রবাহের মধ্যে পরিবর্তন।’ খ্রিষ্টান মিথলজি এসেছে নানাভাবে – নুহের নৌকা, আদম-ইভ, জ্ঞানবৃক্ষ। শিল্পী একসময় আঁকতেন কাল্পনিক সব চরিত্র, যারা সময় ও স্থানের ঊর্ধ্বে। উৎস ছিল শৈশবের স্মৃতি, রামায়ণের গল্প, উপকথা।
বাল্য-কৈশোরে দেখা নাটক, সার্কাস – স্বপ্নকল্পনায় বিস্ময়াবিষ্ট পরিবেশগত যাবতীয় অনুভূতিমালা। পরে শিল্পীর ক্যানভাসে মূর্ত হলো পুত্র, কন্যা, নাতি, স্ত্রী – অর্থাৎ পরিবার হয়ে উঠল সৃজনের বিষয়। অভিজ্ঞতা আর বোধের সরণি ধরেই ক্রমাগত ছবির বিষয় বদলেছে।
এই পরিবর্তন বা দিক বদল আরোপিত নয়। সময় ও মেজাজের প্রয়োজনে স্বতঃস্ফূর্ত তাঁর আবির্ভাব। শিল্পীসত্তার অলক্ষে রূপান্তরটা ঘটে শৈলীতে, প্রেক্ষাপটেও। অতীতের সঙ্গে আধুনিকতাকে বা বর্তমানকে জুড়ে দেওয়ার চমৎকার শক্তি রয়েছে তাঁর। অবনীন্দ্রনাথ তাঁর আরব্যরজনী চিত্রমালায় আরব্যরজনীর সময়কালকে উড়িয়ে নিয়ে এসেছিলেন জোড়াসাঁকোয়। ঠিক তেমনিভাবেই শক্তির চেতনার রঙে দৃশ্যজগৎ রঞ্জিত এবং রূপান্তরিত হয় ছবিতে।
পুরাণের উপাখ্যানের সঙ্গে উপস্থাপন করেন স্মৃতি, রূপকথা, মানুষের জীবন – সব মিলিয়ে স্বপ্নমায়ার এক ভুবন। তিনি এসব সচেতনভাবেই আনেন। কল্পমায়ার নন্দনকানন, মধ্যযুগের বর্ণিল পোশাকের নর-নারী, মানুষ ও জন্তুর মাঝামাঝি প্রাণী – বিচিত্র চরিত্রের সমাবেশ ঘটে শিল্পীর ভাবনার চিত্রনাট্যে, সৃষ্টির মঞ্চে। প্রাচ্য আর প্রতীচ্যের সমন্বয়ে যে নতুন চিত্রভাষা চর্চা করেন তাতে নিরাভরণ নারী, প্রসাধনরতা, জিপসি মেয়ে, মোমের মতো মসৃণ দেবশিশু, মাখন কেটে বার করা লাবণ্যময়ী কিশোরী, সাপ, নৌকা, ময়ূর, পাখি, বৃক্ষ, শূন্যে দুর্গাভাসমান, শিব, নৃত্যরত গণেশ, চশমাপরা পুরুষ, নগ্ন ফরাসি নারী – অনুষঙ্গগুলো ভিন্ন ভিন্ন ভাব ও মাত্রায় অর্থপূর্ণ।
বিশুদ্ধ সৌন্দর্যের পূজারি। তিনি মনে করেন জীবনটা সুন্দর আর সেই সুন্দর ছবিটা তিনি আঁকেন। বিম্বনির্ভর ছবিতে কখনো মানুষ, কখনো প্রাণী, পশু, লতাগুল্ম সহাবস্থানে স্বপ্নমায়া-ভ্রমের ভুবন তৈরি করেন। বাস্তব ও স্বপ্ন, অতীত ও বর্তমান এখানে একাকার হয়ে মূর্ত হয় অপার আনন্দের ভুবন। ছবিতে তিনি প্রাণীর অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের সাযুজ্য বদলে দেন। আকারকে নিয়ন্ত্রণ করেন। তার রঙের প্যালেটও নিয়ন্ত্রিত। কমলা, গোলাপি, পান্না সবুজ, হলদে বাদামি বর্ণে পুরাণের ধর্ম উপাখ্যানের সঙ্গে জারিত স্মৃতি, রূপকথা, মানুষের জীবন। মূলত শিল্পী পারিপার্শ্বিক জীবনে যা দেখেন, দেখতে পান বা যা প্রত্যাশা করেন তাকেই কল্পনার মোড়ক খুলে উন্মোচন করেন। প্রাচ্য ও প্রতীচ্যের প্রতি অগাধ শ্রদ্ধায় তাঁর শৈলীতে দুই পরম্পরার সম্মিলন ঘটেছে। হারলেকুইন, ক্লাউন, আদম-ইভ, নেপোলিয়নের টুপি, কার্নিভাল, গথিক গির্জা, জ্ঞানবৃক্ষ – তাঁর ছবিতে পুনরাবৃত্তি মূলত রেকারেন্ট মোটিফ, যার উৎস ইউরোপের ভূখণ্ড। অন্যদিকে গণেশ, দুর্গা, শিব, লক্ষ্মী, শাঁখ, পাখি, শকুন্তলা, ঝিনুক দেব-দেবী – সবই বাংলার লৌকিক ঐতিহ্যের উত্তরাধিকারী।
তাঁর মনোভূমিতে কল্পনার স্রোত। বাস্তব ও স্বপ্ন, অতীত ও বর্তমান, এমনকি ভবিষ্যৎকে সঙ্গে নিয়ে ক্যানভাসে সৃষ্টি করেন আনন্দনিকেতন। যেমন ময়ূরের শরীরে ছোট ছেলের মুখ – এসব নিছক মজার জন্য নয়। এ প্রসঙ্গে তিনি বলেন – এই যে আমরা একটা এপোক বা সময় পার করছি, অনেক শতাব্দীর পর এই সময়টা রূপকথার জগৎ হয়ে যাবে। কিন্তু এখন যেটা করছি সেটা রূপকথা নয়, রিয়েলিটি। এই যে লোকটা জন্তুর দেহ, মানুষের মাথা, এটা লিজেন্ডারি ফিগার। এটা হলো পঁ (pan) গ্রিক ফিগার। সমুদ্রের ধারে ঘুরে বেড়াত। স্নানরতা সুন্দরী মেয়েদের দেখে মুগ্ধ হতো। তাদের মধ্যে একজনের প্রেমে পড়ে। সুন্দরীরা তার প্রেমে আগ্রহী ছিল না। তারপর সে দেবতার করুণা প্রার্থনা করে। সমুদ্রের ধারের গাছের ডাল কেটে বাঁশি বানায়। দেবতার আশীর্বাদে তাঁর বাঁশির মোহন সুরে মুগ্ধ হয় সুন্দরী।
এই ফিগারটা ইচ্ছাকৃতভাবে রেখেছি টু ক্রিয়েট অ্যা এসথেটিক পার্ট ফর দি বেনিফিট অব দি এসথেটিক পাস্ট (to create a esthetic part for the benefit of the esthetic past) )। এটা রিয়েল না আন-রিয়েল যাই হোক না কেন। আদম-ইভ বা আমার মেয়ে, নাতি এখন বেশি করে আসছে বিষয় হিসেবে। বাস্তবের রুক্ষতা-কর্কশ ভাবটা আমার আসে না।
শক্তি বর্মণের পা এখন প্রৌঢ়ত্ব ছাড়িয়ে গেছে। পঁচাত্তর বছর বয়স। বলিরেখাহীন কপাল, শ্মশ্র“মণ্ডিত অবয়বে হাসির কোমল মাধুর্য। কথা বলেন গুছিয়ে। এক কথায় বয়সী যুবক। যার দেহ আর মুখাবয়বে প্রবহমান সময় আর সুস্থির পরিণতির ছাপ। শক্তি ভাগ্যবান। স্ত্রী মাইতে দেলতেই, একমাত্র কন্যা মায়া বর্মণও চিত্রশিল্পী। একই পরিবারে তিনজন ছবি আঁকেন।
শৈশবের বিদ্যাকুট গ্রাম, ডিব্রুগড়, কলকাতার স্মৃতি নিয়ে সৃষ্টির মধ্যে ডুবে থাকেন। শিল্পীর কোনো ভূগোল নেই। দেশ থেকে দূরে ভিন্ন সংস্কৃতির মাঝে আত্ম-সংকট বা বিচ্ছিন্নতাবোধ তাড়া করে না। তিনি যে পাখি আঁকেন তা কি শিল্পীর অভিবাসিত জীবনের চিত্রকল্প? শক্তি বর্মণ বলেন – পাখিটা হলো মুক্তি, স্বাধীনতা। আমাদের মনটা অনেক সময় পাখির মতো ঘুরে বেড়ায়। পাখিটা হলো শান্তি এবং বিশুদ্ধতার প্রতীক।
এই রচনা লেখার প্রয়োজনে শিল্পীর সঙ্গে দুদিন দীর্ঘ সময় কথা বলেছি। শৈশব, যৌবন, শিল্পচর্চা, শিল্পভাবনা, মনস্তত্ত্ব, সমাজ – সবকিছু নিয়েই আলোচনা হয়েছিল। সেই সমস্ত আলোচনার নির্বাচিত অংশ তুলে ধরছি।
প্রশ্ন : এই বয়সে পৌঁছে মনে হয় আরো কিছু করার ছিল?
শক্তি : শোনো, এত কাজ করলাম, কিন্তু সবসময় মনে হয় আমি যেন কিছু একটা করতে চাই, যেটা করতে পারছি না। এটা মডেস্টি নয়। আমি যখন ট্রাভেল করি তখনো স্কেচ করি। ঘোরাঘুরি করি, মাথার মধ্যে একটা জিনিস থাকে – কাজ, ছবি আঁকা। যখন যেখানে গেছি, খাজুরাহোতে গেছি, স্কেচ করেছি। এগুলো আমাকে সাহায্য করেছে। সবসময় মনে হয় কোথায় আরো যেন করার আছে।
প্রশ্ন : একটা অতৃপ্তি সবসময়?
শক্তি : হ্যাঁ, আমি সুখী যে, আমি এ-সমস্ত কাজ করতে পেরেছি। এ পর্যন্ত আসতে পেরেছি আমার শিল্পকর্ম দিয়ে। আর যে-সমস্ত কাজ করেছি, তা দেখে আমার অতৃপ্তি হয় না। আমার মনে হয়, আমি আমার শ্রেষ্ঠ মানে ডান মাই বেস্ট। তবে আরো কিছু করার যে-অনুভূতি এটা আমার সবসময়ের। এটা আমার কিউরিসিটি, কৌতূহল। এখনো খোঁজাখুঁজি। ফ্লব্যেয়র ‘মাদাম বোভারি’ প্রসঙ্গে বলেছেন – তিনি একই উপন্যাস লিখছেন। কিন্তু তিনি তো একই নভেল লেখেন না। রাফায়েল রাফায়েলই করছে। লিওনার্দো দ্য ভিঞ্চি ভিঞ্চিই করছে। কিন্তু ভিঞ্চির অনেক রকম কিউরিসিটি ছিল। অন্য জিনিসও করেছেন। পরিবর্তনটা আমি দুজন শিল্পীর মধ্যে দেখি। পিকাসো আর গয়া। গয়ার ছবি যদি দেখো, দেখবে ট্রিমেনডাস – তরুণ বয়সে, মধ্য বয়সে আর শেষ বয়সে। শেষ বয়সে যে মেন্টাল ডিস্টারবেন্স তা সরাসরি রিফ্লেকটেড। নেপোলিয়ন যখন আক্রমণ করল সে-সময়টার ভায়োলেন্স বেরিয়ে এসেছে। এই যে পরিবর্তন এটা কিন্তু সব শিল্পীর মধ্যে দেখা যায় না। পিকাসোর মধ্যে দেখবে সবসময় একটা পরিবর্তন। কিন্তু তা নয় যে, তিনি উদ্বিগ্ন বা সচেতন ছিলেন। নিজের থেকে হয়েছে। চেষ্টা করতে হয়নি, আপনি হয়েছে। আমাদের অনেক চেষ্টা করতে হয়। আমার মনে হয় কাজ না করলে … আমি ফাঁকি দিইনি। আমি পরিশ্রম করেছি। তবে ভাবি, করার আকাক্সক্ষাটা না থাকলে করতে পারতাম না। একটা ছবির শেষে নতুন কিছু করার তৃষ্ণা আমার আগের মতোই আছে। তবে আগে হয়তো যথেষ্ট জ্ঞান, অভিজ্ঞতা ছিল না। যেটা সময়ের সঙ্গে পূর্ণ হয়েছে। অনেক লোকের সঙ্গে থাকা, আমার ছেলেমেয়ে, স্ত্রী, নাতি-নাতনি – এই সব। এসবও তো অভিজ্ঞতা। তাতে ভাবনা-টাবনাগুলো অন্যরকম হয়। সেটাও তো কাজে সাহায্য করে।
প্যারিসের পম্পিডু সেন্টারে ‘পারি, দিল্লি, বম্বে’ শিরোনামে প্রদর্শনী নিয়ে কথা হলো। বললেন – পম্পিডু সেন্টারের মতো এত বড় স্থানে মডার্ন আর্ট নিয়ে প্রদর্শনী করতে পারে। কিন্তু পম্পিডুর লক্ষ্য এদিকে নেই। তাদের লক্ষ্য মাস্টার পেইন্টার বা কনটেমপোরারি আর্ট। বেকন, লুসিয়ান ফ্রয়েড অথবা অ্যান্ডি ওয়ারহল। ইনস্টলেশন বা কনসেপচুয়াল আর্ট নিয়ে এ ধরনের প্রদর্শনী আগে হয়েছে। আমি গর্বিত এ কারণে যে, সুবোধ গুপ্তারা প্রদর্শনীতে সব ধরনের জিনিস উপস্থিত করেছিল, যাতে লোকেরা প্রদর্শনী দেখতে যায়। এর আগে প্যারিসে ভারতীয় নির্বাচিত কয়েকজনের চিত্র-প্রদর্শনী হয়েছে। তাই ‘পারি, দিল্লি, বম্বে’ প্রদর্শনী আমার মনে হয় – আমি গর্বিত। These group has taken us a little further in the sense. মনে করো, অনিল কাপুর পৃথিবী বিখ্যাত। কিন্তু আমি তাঁর কাজ অ্যাপ্রিশিয়েট করি না। বোর্জাটে তাঁর কাজটি দেখছি। প্রদর্শনীতে বই ছিল, কতগুলো কাগজে বড় বড় কথা লেখা ছিল প্রদর্শনীর কনসেপ্ট সম্পর্কে। তিনি অনেক প্রশংসা পেয়েছেন। কিন্তু আমি আমার সময় নষ্ট করতে চাইনি। চেষ্টা করেছি কাজটি অ্যাপ্রিশিয়েট করতে। প্রদর্শনীতে আমি অন্য শিল্পকর্ম দেখেছি। কী বলব, কাজটা ছিল …
প্রশ্ন : আপনার কি মনে হয় না এখন কনসেপচুয়াল আর্ট বা ইনস্টলেশনের নামে যা হয় তা আসলে পারফর্মিং আর্ট?
শক্তি : পারফর্মিং…
প্রশ্ন : সাজিয়ে রাখলেন, তুলে ফেললেন।
শক্তি : হ্যাঁ তাই। হয়ে গেল। ওই যে বললাম, বন্দুকটা যখন গয়া আঁকছে … এটা এখনো দেখে আমরা মুগ্ধ হই। আমাদের লোমকূপ কেঁপে ওঠে। আর আসল কতগুলো বন্দুক রেখে শিল্প তৈরি করা। আমি মহৎ কোনো সৃষ্টি তাতে দেখি না।
প্রশ্ন : আপনার ছবিতে অস্ত্র?
শক্তি : (হাসলেন) আচ্ছা, আমার ছবিতে বন্দুক, এটা সময়ের রিফ্লেকশন। আমার অন্য ছবিতেও আছে। এটা ‘লাভ অ্যান্ড ভায়োলেন্স’। এই পিরিয়ড আমার ভালো লাগে। ভায়োলেন্স এবং লাভ একসঙ্গে বাস করছে। মনে করো, যখন ইরাকে ঘটনা ঘটছে। বহুলোক মারা যাচ্ছে। সাদ্দাম যা মেরেছে তার চেয়েও বেশি তো যুদ্ধে মারল আমেরিকানরা। অনেক বেশি ভায়োলেন্স, অনেক বেশি নিষ্ঠুরতা। তখন মনে হতো এতকিছুর পরও তো সেখানে মানুষ জন্ম নিচ্ছে। মানুষ প্রেম করছে। প্রেম-ভালোবাসা ছাড়া মানুষ বাঁচতে পারে না।
প্রশ্ন : আপনার একটা চিত্রকর্মে দেখছি মুখটা গান্ধীর মতো, আবার ক্ষাণিকটা বুদ্ধের মতো।
শক্তি : গান্ধীর এ ছবিটা বুদ্ধের মতোও মনে হচ্ছে। গান্ধীজির একটা ফটোগ্রাফ দেখেছিলাম। তারপর মনে হলো পেইন্টিং করব। যখন আঁকা শুরু করলাম মনে হলো গান্ধীজির যে আদর্শ সেটা কি এখনো আছে? তখনই আমার মনে হয় গান্ধীজির আদর্শটা… ইট ডিড নট কন্টিনিউ। ভায়োলেন্স তো সর্বত্র। এটা এক ধরনের ‘লস্ট অব ড্রিম’।
প্রশ্ন : দেবীর মাথায় মুকুট দিয়েছেন? ‘লস্ট অব ড্রিম…
শক্তি : লস্ট ড্রিম। তার মানে এখানে যে দেবী দুর্গাও অসুরকে মারতে যাচ্ছে।
প্রশ্ন : সবার মধ্যে অসহিষ্ণুতা।
শক্তি : আসলে গান্ধীজির প্রতিকৃতিতে আমি কিছু করতে চাচ্ছিলাম – হোয়্যার ইট সে মোর। এখন সন্ত্রাস, ভায়োলেন্স সব আছে। কিছু ছবিতে গান্ধীজির আইডিয়া। তিনিটি ধর্ম – মসজিদ, মন্দির, গির্জা। আর সঙ্গে তাঁর আদর্শ লোকেরা। কিছু ভায়োলেন্স আছেই।
প্রশ্ন : আপনি যখন প্যারিসে এসেছিলেন আর কোনো ভারতীয় শিল্পী ছিলেন?
শক্তি : হ্যাঁ, রাজা প্রথম এসেছিলেন। তাঁরও আগে এসেছিলেন নীরদ মজুমদার। আমি যে বছর প্যারিসে আসি তিনি সে বছরই চলে যান দেশে। তারপর পরিতোষদা ছিলেন। পরিতোষদা পরে অনেকবার এসেছেন।
প্রশ্ন : অরুণ বসু ছিলেন?
শক্তি : অরুণ বসু আমার সঙ্গেই পড়ত। খুবই ট্যালেন্টেড ছিল অরুণ। আমার ফরাসি স্ত্রী। মেলামেশাটা বেশি ফরাসিদের সঙ্গে ছিল। ফলে আমার একটু পরিচিত লোকজন ছিল। আমার এখনো মনে আছে অরুণ সাঁ মিশেলের রাস্তায় ঘুরছিল। দেখা হতে বলল, শক্তি, আমার থাকার জায়গা দরকার। ড. ব্যার্নাজি বলে এক ভদ্রলোক চলে যাচ্ছিলেন অন্য জায়গায়। আমি তাদের স্থানটা অরুণের জন্য ঠিক করে দিই।
প্রশ্ন : বই পড়ার সময় হয় এখন?
শক্তি : পড়তে ভালো লাগে। কিন্তু বই পড়ার সময় পাই না। কারণ কাজ। সেজন্য আফসোস হয়। আগে অনেক কবিতা মনে ছিল। আস্তে আস্তে সব ভুলে গেছি। রবিঠাকুরের সোনার তরী, দেবতার গ্রাস … সূর্য গেল অস্তাচলে আর উঠিল না।
প্রশ্ন : গীতাঞ্জলি সিরিজের সময় পড়েছিলেন?
শক্তি : হ্যাঁ, তখন খুব মুখস্থ ছিল। মধুসূদনও – এতক্ষণে অরিন্দম কহিল … ভুলে গেছি। এখন এসবের জন্য দুঃখ হয়। হয়েছে কি জানো, প্রথম যখন আসি মনে হলো ফরাসি দেশের শিল্প, সাহিত্য – এইগুলো নিয়েই থাকব। সেজন্য দেশের সঙ্গে যোগাযোগ কয়েক বছর ছিল না। মানে সরাসরি শিল্প-সাহিত্যের সঙ্গে। আমার কয়েকজন শিল্পী বন্ধু বা আধুনিক সাহিত্যিক যারা সুনীল, শক্তি এদের সঙ্গে যোগাযোগ ছিল না। পরে অনেক শিল্পী দেশ থেকে এলে আমার বাড়িতে থাকত। শুভাপ্রসন্ন এসেছিল। ওর একটা জেনারেল কালচার আছে। বলেছে – শক্তিদা, দেশ পত্রিকায় কিছু ধারাবাহিক বের হচ্ছে। সুনীল গাঙ্গুলীর বাবু পিরিয়ডের সময় নিয়ে লেখা পড়ে আপনার খুব ভালো লাগবে। তখন থেকে আমি কিছু পেলে পড়া শুরু করি। দেশের গ্রাহক হয়েছি পরে। এখন দেশ নিয়মিত পাই। কিন্তু সব বিষয় পড়তে পারি না। কারণ সময়। সকালে বা ঘুমাবার আগে পড়ি।
প্রশ্ন : তারপরও আপনার বাংলা অনেক ভালো। বাড়িতে তো সবাই ফরাসি।
শক্তি : বাংলাটা বলি, কারণ বাঙালি বন্ধু ছিল। আর আমার স্ত্রী বাংলা লিখতে আরম্ভ করেছিল। আমার মেয়েও একটু বাংলা বলে। ছেলেও। যখন কলকাতায় গেছি তখন ওরা বাংলা ভাষায় কথা বলতে বেশি আগ্রহী ছিল। আমার ছেলের বাচ্চারা, বউমা বাংলা শিখতে চায়। কাজেই প্রত্যেক রবিবার যেয়ে ওদের শেখাই বর্ণপরিচয়।
বোদলেয়ার, ভিক্টর হুগো পড়ে আনন্দ পাই। কবিতা তো বড় নয়, সুবিধা। আর আমার গ্রিক মিথলজি পড়তে ভালো লাগে। আমাদের মিথলজি রামায়ণ, মহাভারত পড়তে খুব ভালো লাগত। আমাকে অনুপ্রাণিত করে। যেমন গান-বাজনা তুমি হয়তো করো না। কিন্তু তোমাকে অনুপ্রাণিত করবে। আমার দুর্গার ছবি দেখো। কয়েকটি করেছি। সব ধরনের মিথলজিকাল বিষয় তাকে ঘিরে। আগে শুধু গ্রিক মিথলজি নিয়ে কাজ করেছি। একবার দেশ পত্রিকা পুজো সংখ্যার প্রচ্ছদ করতে বলল। সেই প্রথম দুর্গা করলাম। কিন্তু ঠিক প্রথাগত দুর্গা নয়। দুর্গা দশভুজা। তাতে ফুল আছে। গণেশ নাচছে। লক্ষ্মী শূন্য স্পেসে তাকিয়ে। কারণ লক্ষ্মী হলো আমাদের অর্থনীতি। শূন্য স্পেস মানে অর্থনৈতিক অবস্থা। সরস্বতীও নাচছে। কার্তিক ঘুমাছে। পরে দুর্গাকে করেছি নোয়ার আর্কের সঙ্গে। সেখানে পাখি, সব ধরনের প্রাণী ছিল। দুটো কালচারাল ভিশন – যাতে অনেকটা মিল আছে। দুর্গা অপশক্তিকে হত্যা করছে, অন্যদিকে নোয়ার আর্ক নতুন প্রজন্মকে রিনিউ করছে।
শক্তি বর্মণ লেখেন ভালো। তবে লেখেন কম। সে প্রসঙ্গে বললেন – : এক ধরনের শিল্পী আছেন মাঝে মাঝে রবিবার ছবি আঁকে। তাদের বলে সানডে পেইন্টার। আমিও সেরকম। লিখতে ইচ্ছে হলে লিখি। একবার একটা লেখা দেশ পত্রিকায় পাঠালাম। যদি ছাপা হয় খুশি হব, না প্রকাশিত হলে অসন্তুষ্ট হব না, একটু মন খারাপ হবে। তারপর ইমিডিয়েটলি একটা চিঠি পেলাম অরূপ সরকারের যে, লেখাটা পরের সংখ্যায় ছাপাচ্ছে। একবার চণ্ডীগড়ে লেকচার দিতে নিমন্ত্রণ করেছিল। আমি যেভাবে কথা বলি তেমনভাবেই বলেছি। শিল্পীরা তো বলে না, কাজ করে। তবে যাঁদের অভ্যাস আছে খুব ভালো বলেন। যেমন পরিতোষদা খুব ভালো বলতেন।
প্রশ্ন : লিখতেনও খুব সুন্দর।
শক্তি : হ্যাঁ, লিখতেন সুন্দর। কিন্তু আমার সে-ক্ষমতা নেই। যাই হোক, নিজের অভিজ্ঞতার কথা বলছি। কলকাতার আর্ট কলেজে মাস্টারমশাই মনীন্দ্রবাবু। এককালে খুব নাম ছিল। শ্রীলংকার কলম্বোর এক আর্ট কলেজের প্রিন্সিপাল ছিলেন। তিনি একটু পড়াশোনা বেশি করতেন। ভালো থিওরিটিশিয়ান, আবার একটু পাগলাটে ছিলেন। নিজে নিজেই কথা বলতেন। মনীন্দ্রবাবু ক্লাসে আমাদের পাতা আঁকতে দিতেন। কিন্তু পাতা আঁকতে কত আর ভালো লাগে। তো বললাম – স্যার, কী করে আর্টিস্ট হব? কী করতে হবে? শুনে বললেন – শোনো, মাইকেল অ্যাঞ্জেলো তোমাকে কিছু বোঝাতে পারবে না। আমি কী বোঝাব? তখন প্রথম বর্ষের ছাত্র আমি। স্যার খাতা নিয়ে একটা পিরামিডের মতো করলেন। পিরামিডিক্যাল কম্পোজিশন মানে কি জানো? মানুষ যখন ছবি আঁকে কম্পোজিশনটা পিরামিডের মতো হয়। তখন কিছু বুঝতে পারিনি। কিছু পরে আমি নিজেই করেছি। আমার ছবির কম্পোজিশনে কিছু পিরামিডের একটা ব্যাপার আছে। কতগুলো ছবিতে বিষয় ক্রমশ ওপরে উঠে গেছে। লেকচারে আমি বললাম, মনীন্দ্রবাবু ভেবেছিলেন কিছুই শেখাননি। কিন্তু আমার অবচেতনে তাঁর শিক্ষা রয়ে গেছে। সেটা এখনো আমি রিপিট করছি।
প্রশ্ন : লন্ডনের পিকাডেলি গ্যালারির পর ইউরোপের কোনো গ্যালারিতে প্রদর্শনী করেছেন?
শক্তি : নিউইয়র্কের এক গ্যালারি আমার ছবি দেখেছিল সাঁল দ্য লা জোন প্যান্তঁরে। এরা এসে ছবি কিনেছিল বাড়ি থেকে, বিভিন্ন সাঁলোতে ছবি বিক্রি হয়েছে। তবে প্রথম প্রফেশনাল গ্যালারি হলো ইতালির। মিলানের ‘গ্যালারি সাজিতানিওস’। গ্যালারিটা এখন নেই। স্প্যানিশ এক বন্ধুর মাধ্যমে যোগাযোগ হয়েছিল। পাঁচ বছর ওদের সঙ্গে কাজ করেছি। তার আগে পার্টিকুলার কোনো গ্যালারি ছিল না। প্যারিসেও একটা গ্যালারি ছিল রু বোনাপার্টে। গ্যালারিটা এখনো আছে। কেবল মালিক মারা গেছেন। ওরা পিকাসোর গ্রাফিক্স নিয়ে কাজ করত। আমার কাজও ওরা রেখেছে গ্যালারিতে বছর পাঁচেক। কোনো চুক্তি না, বিক্রি হলে অর্থটা দিত। … আমার এখানকার প্রতিষ্ঠা, স্বীকৃতি তা তো অনেক বছরের শ্রম। বহু লোক, অনেক গ্যালারি আমার ছবি সংগ্রহে রাখছে। আজ আমি যেটুকু যোগ্যতার অধিকারী, তার শিকড় ভারতের ঐতিহ্য।
প্রশ্ন : হুসেন সম্পর্কে কী ভাবেন?
শক্তি : হুসেনের অবদান, কন্ট্রিবিউশন টু ইন্ডিয়ান আর্ট ইজ গ্রেট। তিনি না থাকলে এখন আমরা যে সহজ, নির্বিঘেœ এসব করি … শিল্পকে উনি লোকের কাছে নিয়ে গেছেন। আর্টকে নিয়ে গেছেন মানুষের কাছে, এলিটের কাছে নয়। যেমন পিকাসো সবার কাছে। হুসেনের কন্ট্রিবিউশনটাও এত বড়। হ্যাঁ, দু-একটা ছবি এঁকেছেন। যারা কুসংস্কারে আচ্ছন্ন, তাদের আপত্তিকর মনে হয়েছে। একটা ছোট অংশের লোক তারা। এখন দেখবে আর্ট প্রমোট করার নামে একশ্রেণির লোক তাদের পারসোনাল ইন্টারেস্টকে কাজে লাগাচ্ছে। সমাজকে ছাড়া শিল্প হতে পারে না। আমাদের সমাজ এমন হয়ে গেছে ফুল অব ভায়োলেন্স … না, আমি সমাজের সমালোচনা করব না। কারণ আমিও সমাজের একজন। কিন্তু এ ধরনের ব্যাপার খুব সংক্রামক। মানুষ খুব সহজে প্রভাবিত হয়, যখন দেখে কিছু না করে সফলতা। শুধু নামই নয়, অর্থনৈতিক অর্জনও। তখন যারা রিয়েল পেইন্টার, পরিশ্রম করছে, তারা নিরাশ হয়। এখন যে কনসেপচুয়াল আর্ট দেখতে পাচ্ছ, ইম্প্রেশনিস্ট বা মাইকেল অ্যাঞ্জেলো, গয়া, রেমব্রান্ট দেখলে তুমি আনন্দ পাবে, সুখী হবে, কষ্ট পাবে। একটা প্রতিক্রিয়া হবে। আমার মনে হয় না তথাকথিত শিল্পী বা ভাস্কররা কনসেপচুয়াল বলে যা করে তাতে কোনো ইমোশন থাকে। অনেক পেইন্টার মিনিয়েচার করে, নিজেরা করে না। অন্যকে দিয়ে করায়। ক্রাফটম্যানরা ওদের জন্য কাজ করে। আমি জানি, আমি দেখেছি। কিছু শিল্পীর আইডিয়া গো থ্রো উইথ হিজ ফিজিকাল ইফোর্ট। তারা অনেক ভালো কথা বলে। প্রচুর তত্ত্ব, লিটারেচার থাকে। তবে এ-জাতীয় ক্ষেত্রে দুঃখজনক যে, রাষ্ট্রও তাদের সহযোগিতা করে। ভারতে প্রকৃত সংগ্রাহকরা রিয়েল পেইন্টারের কাছেই যায়। তবে কিছু অংশ কালেক্টরস তাদের নিজের স্বার্থে, অর্থনৈতিক ইন্টারেস্টে এ-জাতীয় শিল্পকে স্পন্সর করে। তবে আর্ট হলো সাইক্লিক। এটা হবেই। তুমি তাকে থামাতে পারবে না। আর কী বলব …
প্রশ্ন : নদীর স্রোতের মতো। পরিশ্র“ত জল প্রবাহিত হয় কিন্তু জঞ্জাল, আবর্জনা পড়ে থাকে।
শক্তি : হ্যাঁ, আমি তা-ই বলতে চাচ্ছি।
আমাদের আলোচনার মাঝে স্ত্রী মাইতে এসে জানালেন : বাংলাদেশের মানুষ হয়তো এখন ভুলে গেছে বিদ্যাকুট গ্রাম কোথায়। কিন্তু দক্ষিণ-পশ্চিম ফ্রান্সের সবাই জানেন যে একজন মানুষ বাংলাদেশের বিদ্যাকুট নামের গ্রামে বেড়ে উঠেছেন। মাইতের পরিবারের সবাই শক্তি বর্মণকে ডাকেন ‘জমিদার অব বিদ্যাকুট।’ শক্তি বর্মণ শুনেছেন, গ্রামটি আর নেই।
প্রশ্ন : নদীর ভাঙন?
শক্তি : না। সব ঘরবাড়ি ভেঙে শস্যক্ষেত্র হয়েছে। খবরটা বিশ-পঁচিশ বছর আগে শুনি।
প্রশ্ন : কিন্তু বিদ্যাকুট নামটা তো থাকবে। গ্রাম দেখার ইচ্ছে হয় না?
শক্তি : ভয় পাই। লোকে মেরে ফেলবে সে-ভয় নয়। কারণ শৈশবের যে-গ্রামে বাস করেছি, স্মৃতি – সেটা তো পাব না। সেই কষ্টের ভয়।
প্রশ্ন : আশা ভঙ্গের।
শক্তি : হ্যাঁ।
- ঠিকানা
- সপ্তম বর্ষ । দ্বিতীয় সংখ্যা । আশ্বিন ১৪২৫ । October 2018
- পুরানো সংখ্যা
- সপ্তম বর্ষ । প্রথম সংখ্যা । পৌষ ১৪২৪ । December 2017
- ষষ্ঠ বর্ষ । দ্বিতীয় সংখ্যা । বৈশাখ ১৪২৩ । May 2017
- ষষ্ঠ বর্ষ । প্রথম সংখ্যা । কার্তিক ১৪২৩ । November 2016
- পঞ্চম বর্ষ । দ্বিতীয় সংখ্যা । বৈশাখ ১৪২৩ । May 2016
- পঞ্চম বর্ষ । প্রথম সংখ্যা । অগ্রহায়ন ১৪২২ । November 2015
- চতুর্থ বর্ষ । দ্বিতীয় সংখ্যা । আষাঢ় ১৪২২ । June 2015
- তৃতীয় বর্ষ । চতুর্থ সংখ্যা । কার্তিক১৪২১ । November 2014
- তৃতীয় বর্ষ । তৃতীয় সংখ্যা । আষাড় ১৪২১ । July 2014
- তৃতীয় বর্ষ । দ্বিতীয় সংখ্যা । ফাল্গুন ১৪২০ । February 2014
- তৃতীয় বর্ষ । প্রথম সংখ্যা । কার্তিক ১৪২০ । Novembeer 2013
- দ্বিতীয় বর্ষ । চতুর্থ সংখ্যা । শ্রাবণ ১৪২০ । July 2013
- দ্বিতীয় বর্ষ । তৃতীয় সংখ্যা । বৈশাখ ১৪২০ । April 2013
- দ্বিতীয় বর্ষ । দ্বিতীয় সংখ্যা । পৌষ ১৪১৯ । January 2013
- দ্বিতীয় বর্ষ । প্রথম সংখ্যা । আশ্বিন ১৪১৯ । September 2012
- প্রথম বর্ষ । চতুর্থ সংখ্যা । জ্যৈষ্ঠ ১৪১৯ । May 2012
- প্রথম বর্ষ । তৃতীয় সংখ্যা । ফাল্গুন ১৪১৮ । February 2012
- প্রথম বর্ষ । দ্বিতীয় সংখ্যা । অগ্রহায়ন ১৪১৮ । November 2011
- প্রথম বর্ষ । প্রথম সংখ্যা। ভাদ্র ১৪১৮ । August 2011