logo

স্বপ্নের নাম কেমোমা

মাহফুজা ইয়াসমীন
স্বপ্ন ছিল কলকাতাবাসীর, অবশেষে সেই স্বপ্নের দ্বার উন্মোচিত হলো। জনতা দেখল তাদের মনের মধ্যে ধারণ করা আকাক্সক্ষার বহিঃপ্রকাশ। আর এই স্বপ্ন-আকাক্সক্ষার নাম ‘কলকাতা মিউজিয়াম অফ মডার্ন আর্ট’, সংক্ষেপে ‘কেমোমা’। ১৫ জুলাই কলকাতার মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের উপস্থিতিতে উন্মোচন করা হয় কেমোমার চূড়ান্ত নকশা। এ সময় আরো উপস্থিত ছিলেন কেমোমার ম্যানেজিং ট্রাস্টি রাখী সরকার এবং প্রথিতযশা শিল্পী যোগেন চৌধুরী।
কেমোমার ধারণাটা অবশ্য আজকের নয়, সেই নব্বইয়ের দশকে প্রথম কলকাতায় একটি আধুনিক গ্যালারি স্থাপনের প্রয়োজনীয়তা অনুভূত হয় ব্যাপকভাবে। ১৯৯৭ সালে শিল্পী পাবলো পিকাসোর কিছু ছবি আনা হয়েছিল কলকাতায়; কিন্তু আন্তর্জাতিক মানের গ্যালারির অভাবে সে-সময় ওই ছবিগুলোর প্রদর্শনী করা সম্ভব হয়নি। এতে কলকাতাবাসী বঞ্চিত হয়েছে অসাধারণ কিছু কাজ একেবারে সামনে থেকে প্রত্যক্ষ করার সুযোগ থেকে। সেই থেকেই দানা বাঁধতে শুরু করেছিল চিন্তাটা। এই চিন্তায় রসদ জুগিয়েছেন সরকার, ব্যবসায়ী এবং সমাজের গণ্যমান্য ব্যক্তিবর্গ।
কেমন হবে কেমোমা? যে-স্থাপত্য ঘিরে এত স্বপ্ন, এত আকাক্সক্ষা, সেই স্থাপত্যের নকশা কেমন হবে? এটা জানতে যে সবাই উৎসুক থাকবেন তা বলাই বাহুল্য। আলো, হাওয়া, ঐতিহ্য এবং আধুনিকতার মিশেলে নির্মিত হবে কেমোমা। শুধু ইটের পর ইট গেঁথে নয়, সঙ্গে মনন আর ঐতিহ্যের অপূর্ব সমন্বয়ে নির্মিত হবে এই আধুনিক চিত্রশালা। রাজারহাটে দশ একর ভূমির ওপর দশতলা ভবন নির্মিত হবে, যাতে থাকবে চুয়াল্লিশটি গ্যালারি। কোনো গ্যালারি উনিশ শতক থেকে আজকের ভারতীয় চিত্রকলা, কোনোটি ইউরোপ, আমেরিকা, চীন বা জাপানের শিল্পের জন্য নির্ধারিত থাকবে। গ্যালারিগুলো প্রথম, তৃতীয়, পঞ্চম ইত্যাদি বেজোড় তলে। এরই মধ্যে ছবি রেস্টোরেশনের উইং, কোথাও লেকচার থিয়েটার, লাইব্রেরি; একটা বাধাহীন খোলামেলা পরিবেশ, শিল্প ও শিল্পীর জন্য যা সত্যি অত্যাবশ্যক বিষয় হিসেবে বিবেচিত। যে-কোনো তলে দাঁড়ালে পুরো স্থাপত্যকে এক লহমায় ঠাহর করা সম্ভব হবে। কেমোমা নির্মাণের দায়িত্ব নিয়েছে সুইজারল্যান্ডের নির্মাণ-সংস্থা হারজগ অ্যান্ড ডি মিউরোঁ, যাদের রয়েছে লন্ডনের টেট মডার্ন গ্যালারি বা বেইজিংয়ের বার্ডস নেস্ট অলিম্পিক স্টেডিয়ামের মতো স্থাপত্যকলা নির্মাণের অনন্য কৃতি।
এ বছরই নির্মাণ শুরু হবে কেমোমার, শেষ হবে ২০১৪ সালে। কয়েক বছর ধরে ১৪টি ওয়ার্কশপ পেরিয়ে অবশেষে কেমোমার নকশা চূড়ান্ত করা হয়। পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের উপস্থিতিতে টাউন হলে এই আধুনিক চিত্রশালা সম্পর্কিত নানা তথ্য ভিডিও প্রেজেন্টেশনের মাধ্যমে সবার সামনে তুলে ধরা হয়।
বিশ্বে স্থাপত্যকলার অসংখ্য নিদর্শন আমাদের চোখে পড়ে – প্রাচীন, মধ্যযুগীয় থেকে একেবারে হাল আমলের নির্মাণ-কৌশলে আমাদের দৃষ্টি জুড়ায়। কিন্তু এটা সবার মনে সব সময়ই দাগ কাটে যে, শুধু ইটের ওপর ইট বসিয়ে দিলেই কোনো যুগান্তকারী স্থাপত্য দাঁড়ায় না, যা দাঁড়ায় তা হলো গৃহস্থালি-মননের বহিঃপ্রকাশ, যা আজ কলকাতাসহ বিশ্বের সব শহরেরই অ্যাপার্টমেন্ট বাসাগুলোর বৈশিষ্ট্য। স্থাপত্যও যে সুন্দরের অনেকটা জুড়ে থাকে সে-কথার প্রমাণ হিসেবে আমাদের সামনে ভেসে ওঠে নতুন দিল্লি তৈরির সময়কার ছবি, যখন কলকাতার ভাইসরয় তাঁর প্রাসাদ নির্মাণের জন্য ডেকে এনেছিলেন স্থপতি এডুইন লুটিয়েন্সকে। আবার স্বাধীন ভারতে চণ্ডীগড় তৈরির জন্য জওয়াহেরলাল নেহরু ডেকেছিলেন ফরাসি স্থপতি লে করবুসিয়েরকে। আলো-আঁধারির জাদুকর লুই আই কানের তত্ত্বাবধানে নির্মাণ হয়েছিল আইআইএম আমদাবাদ। এক্ষেত্রে করবুসিয়েরের একটি মন্তব্য প্রণিধানযোগ্য – ‘আলোয় যে আকার এবং আয়তন দেখা যায়, তা নিয়ে মেধাবী খেলার নামই স্থাপত্য।’
বিংশ শতাব্দীতে সারাবিশ্বে স্থাপত্য ক্ষেত্রে প্রভূত পরিবর্তন সাধিত হলেও কলকাতায় তার ছাপ তেমনভাবে পড়েনি। ব্রিটিশ-শাসন শেষে দেশভাগের চাপে উদ্ভূত উদ্বাস্তুতায় দিশেহারা এই শহরের স্থাপত্য নিয়ে কেউ কখনো ভাবারই অবকাশ পায়নি। বাঁচতে হবে, বাঁচাতে হবে, নিশ্চিত করতে হবে মাথা গোঁজার ঠাঁই – এ ধারণা থেকে নগর-কলতাকায় গড়ে ওঠে অসংখ্য ইমারত; চোখে যা জ্বালা ধরিয়ে দেয় – এ যেন ‘ইটের পর ইট, মাঝে মানুষকীট’। এমনই এক রুদ্ধশ্বাস অবস্থায় কেমোমা যেন একচিলতে দখিনা হাওয়া, মুক্ত নিশ্বাসের সুখ নেওয়ার আনন্দ।
আধুনিক স্থাপত্য-নকশায় নির্মিতব্য কেমোমায় সিঁড়ি ভেঙে উঠতে উঠতে দেখা যাবে দূরে শিল্পীদের বাড়িগুলো। দেশ-বিদেশের শিল্পীরা এসে এখানে থাকবেন, করবেন ওয়ার্কশপ। একটু দূরে নিচে তাকালে দেখা যাবে ৫০০ আসনের অডিটোরিয়াম। থাকবে বিশাল অ্যাম্ফিথিয়েটার। ধারণক্ষমতা প্রায় দেড় হাজার। শুধু চিত্রকলা, ভাস্কর্য আর ইন্সটলেশনই প্রদর্শিত হবে না এখানে, একই সঙ্গে সমান গুরুত্ব পাবে ফটোগ্রাফি, নাচ-গান-বাজনা। ভারতের আর কোনো গ্যালারিতে এত বিপুলভাবে বিভিন্ন শিল্পমাধ্যমের পারস্পরিক যোগাযোগ ঘটে না।
কেমোমা ভারতের শিল্প-ইতিহাসে এক যুগান্তকারী পদক্ষেপ বলেই বিবেচিত। তাই রাজ্য সরকারও এই কর্মযজ্ঞে নিজেকে জড়িত করেছে একেবারে শেকড়-পর্যায় থেকে। এই ‘শিল্পমেলা’য়
আসা-যাওয়া আরো সহজতর করার জন্য মুখ্যমন্ত্রী নকশা উদ্বোধনের দিন ঘোষণা দিয়েছেন, ‘একটা মেট্রো স্টেশন হবে কেমোমার কাছে। এটা আগেই পরিকল্পনা করা হয়েছিল।’ সরকার এবং ব্যক্তিগত উদ্যোগে কেমোমা গড়ে উঠছে, রয়েছে সুপরিকল্পনা। ৪১০ কোটি টাকার প্রকল্পে সরকার এবং জনসাধারণের অংশীদারিত্ব নিশ্চিত করা হচ্ছে। কেমোমার ট্রাস্টি রাখী বলেন, ‘সরকারি ভিত্তি আর বেসরকারি পেশাদারি নৈপুণ্য, এই দুয়ের মিলমিশেই গড়ে উঠবে কেমোমা।’ একই বাসনা যেন সেদিন সেখানে উপস্থিত সবার চোখে ফুটে উঠেছিল।
কেমোমার জন্য যে-দরদ আর হৃদয়-উছলানো আবেগ তৈরি হয়েছে তা সত্যিই অভূতপূর্ব। একটি পরিপূর্ণ শিল্পপীঠ হবে কলকাতায়, এ যে কত বড় একটি ব্যাপার তা অনুভব করলে হৃদয়ের একেবারে মধ্যখানে একটি আলোকরশ্মি প্রবলভাবে তার অস্তিত্ব জানান দেয়। এ সম্পর্কে বরেণ্য শিল্পী যোগেন চৌধুরী উচ্চারণ করেন, ‘এই প্রকল্প শেষ হলে দেখবেন, শিল্প সম্পর্কে কলকাতা তো বটেই, গোটা দেশের ধারণাই পুরো বদলে যাবে।’  তিনি আরো যোগ করেন, ‘এর পরে আমরা বলতে পারব, আন্তর্জাতিক মানের শিল্পী শুধু নয়, শিল্প-সংগ্রহশালাও আমাদের আছে।’ কী অপার স্বপ্ন আর সম্ভাবনার কথা ধ্বনিত হলো অনুষ্ঠানজুড়ে। সবাই মনে মনে উচ্চারণ করল, হ্যাঁ, কলকাতাকে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে নিয়ে যাওয়ার সূচনা হয়েছে। কেমোমা সেই বদলে যাওয়ার সময়ের স্মারক হয়ে থাকবে।

Leave a Reply