গাজী মাহতাব হাসান
একটা ব্র্যান্ড ভ্যালু গিয়াসউদ্দীন সেলিমের আগে থেকেই ছিল – সেটা নিঃসন্দেহে তাঁর প্রথম ছবি মনপুরার অভূতপূর্ব সাফল্য। বাংলাদেশের চলচ্চিত্রের কালপ্রবাহে বেদের মেয়ে জোছনার পর আর কোনো ছবি এতটা জনপ্রিয় ও ব্যবসাসফল হয়নি।
কী ছিল মনপুরায়? গ্রামীণ চক্রামেত্মর শিকার হয়ে সোনাইয়ের দ্বীপান্তর – গ্রামীণ পটভূমিকায় নিটোল প্রেমের গল্প, যার পরিণতি ছিল গ্রিক ট্র্যাজেডির নিয়তি। যাদের শেকড় এখনো গ্রামে গ্রোথিত, তারাসহ সব শ্রেণির দর্শকের কাছে ছবিটি ছিল উপভোগ্য। গানগুলো খেয়াল করে দেখলে দেখা যাবে তা চিরায়ত বৈষ্ণব পদাবলির অনুরূপ, ভারতীয় নাট্যশাস্ত্রে উলিস্নখিত সব রসের (প্রেমরস, বিরহরস ইত্যাদি) আধার।
গিয়াসউদ্দীন সেলিমের স্বতন্ত্র গল্প বলার সক্রিয়তায়, তার সঙ্গে সিনেমাটোগ্রাফার খসরুর ভিস্যুয়াল স্টোরিটেলিং, জুয়েলের সম্পাদনার মুনশিয়ানায় মনপুরা একটি সাধারণ গ্রাম্য গল্প হতে অসাধারণ চলচ্চিত্রে উত্তীর্ণ হয়। বাণিজ্যিক কাঠামোর মধ্যে থেকেও তিনি বাজার উপযোগী পরিশীলিত ছবি বানিয়েছেন। যদিও কোন ধরনের বিষয়বস্ত্ত বাজারে গ্রহণযোগ্য হবে সে প্রশ্ন থেকেই যাচ্ছে (সে প্রসঙ্গে পরে আসছি)।
মনপুরার মতো সুপারহিট ছবির পর অন্য কেউ হয়তো পরের ছবি বানাবার জন্য এক বছরও অপেক্ষা করতে চাইতেন না। কিন্তু গিয়াসউদ্দীন সেলিম তাঁর দ্বিতীয় সিনেমা নিয়ে দর্শকের কাছে ফিরে আসতে নয় বছর সময় নিয়েছেন। এই নয় বছরে সেলিম নিজেকে ঋদ্ধ করেছেন। গিয়াসউদ্দীন সেলিমের অভিষেক হয়েছিল টেলিভিশন নাটকের চিত্রনাট্যকার হিসেবে, চিত্রনাট্য রচনায় হাত পাকিয়ে তিনি পরিচালনা করতে শুরু করেন। একাধিক নতুন ও চ্যালেঞ্জিং বিষয়ে শিল্পসম্মত নাটক ও টেলিফিল্ম বানিয়ে তিনি নিজেকে তৈরি করেছেন। নানারকম বিষয়বস্ত্ত নিয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করেছেন। সেই অভিজ্ঞতার আলোকে তিনি মনপুরা করার আগে সোচ্চার প্রচারণা করেছিলেন – ছবির গানগুলো জনপ্রিয়তা পেয়েছিল, মুক্তি পাওয়ার আগেই ছবির মিডিয়া কাভারেজ ছিল ব্যাপক। কিন্তু স্বপ্নজালের প্রচারণা ছিল মস্নান। ছবির প্রযোজনা সংস্থা ‘বেঙ্গল ক্রিয়েটিভে’র মাধ্যমে কয়েকটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে ছবির নায়িকা, নায়ক ও কলাকুশলী নিয়ে যে প্রচার অভিযান ছিল তাও তেমন সাড়া জাগাতে পারেনি। কেননা বিশ্ববিদ্যালয়পড়ুয়া ছাত্রছাত্রীর মধ্যে সেলিমের জনপ্রিয়তা মোস্তফা সরয়ার ফারুকী বা অমিতাভ রেজার চেয়ে কম। এই বিবেচনা ধর্তব্যের মধ্যে আনা উচিত ছিল যে, সেলিমের ছবির বিষয়বস্ত্ত প্রেমবিষয়ক হলেও তার সামাজিক বাস্তবতা এদের (বিশ্ববিদ্যালয়পড়ুয়া ছেলেমেয়েদের) আকৃষ্ট করে না। অনন্ত জলিলের ছবিও তারা যেভাবে হাসিঠাট্টার ও মেধাহীন বোকামির জন্য গ্রহণ করতে পারে – সেলিমের ছবিতে তা নেই। স্বপ্নজাল ছবির নায়িকা ডানাকাটা পরির আকস্মিক পরিবর্তন (Transformation), সুঅভিনয়কে উপজীব্য করে প্রচারণা চালানো যেত দেশজুড়ে। প্রচারণায় ছবির গান নিয়ে কোনোরকম উন্মাদনা সৃষ্টি থেকে বিরত থাকার কারণও বোধগম্য নয়। ছবির ট্রেলার দেখে অনুভব করা গিয়েছিল অন্য সমাজবাস্তবতার এটি একটি প্রেমের ছবি। মনপুরা সিক্যুয়েল বা পিক্যুয়েল নয়। মনপুরাকে মাথায় রেখে যারা স্বপ্নজাল দেখতে চেয়েছিল তারা আগে থেকেই সন্দিহান ছিল। যদিও গিয়াসউদ্দীন সেলিম আগেই বলেছেন, স্বপ্নজাল তাঁর পরিণত সময়ের ছবি। গল্প নির্মাণের ধরন কোনোভাবেই মনপুরার নয়। পরিচালকের এ বক্তব্যও ততটা প্রচার পায়নি।
ছবির প্রথম কয়েক মিনিটের মধ্যে পরিণত পরিচালকের হাতের কাজ টের পাওয়া গেল; তারপর ধীরে ধীরে চাঁদপুর, কলকাতা ও আগরতলার খ- খ- গল্প সুচিস্তিতভাবে সময়ের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ হয়ে ওঠে।
গত ৭ এপ্রিল স্বপ্নজাল মুক্তি পেল মাত্র বিশটি সিনেমা হলে। একই দিনে অন্য একটি ছবি মুক্তি পেয়েছে সত্তরটি হলে। এর কারণ কি কেবল নতুন প্রযোজনা সংস্থার ছবি বলে? আর্ট হাউস ছবির তকমা সেলিম লাগাননি কখনো যে, বাণিজ্যিক ছবির কর্ণধাররা যাঁরা হলগুলোর খবরদারি করেন তাঁরা এই ছবিকে দূরে রাখবেন। এসব হল মালিক তো পরিবেশক সংস্থার পকেট ভারী করেছেন মনপুরা প্রদর্শন করে। এঁরা তো স্বপ্নজাল প্রদর্শনের ব্যাপারে আরো একটু উদারতা দেখাতে পারতেন। যাই হোক, ৭ এপ্রিল মুক্তির দুই সপ্তাহ পর প্রথম দফায় এই বিশ হল থেকে ছবিটি নামিয়ে ফেলা হলো; যদিও চট্টগ্রামসহ কয়েকটি জেলায় ছবিটি মুক্তি পাচ্ছে।
বিজ্ঞাপনের চমক, মন ভোলানো চটক, মনোযোগ আকর্ষণের কায়দা (থাকলেও তা ছিল পরিমিত) – এসব গিমিক না থাকার কারণেই কি স্বপ্নজাল যে পরিমাণ দর্শক দেখবে আশা করা গিয়েছিল, তা আর হলো না? তবে কি মফস্বল শহরের অসম বর্ণের (মূলত হিন্দু-মুসলমান) যুবক-যুবতীর মিষ্টি প্রেম, পরিবারের কর্তাদের ল্যান্ডফোনে আড়িপাতা – এসব স্মৃতিকাতরতায় আচ্ছন্নতা আর নেই? বাংলাদেশের ছবির দর্শকদের গড়পড়তা হিসাবে এরা হয়তো বিপন্নপ্রায় সংবেদনশীল প্রাণী। এই সংবেদনশীলতার বাজার নেই। কারণ তাদের তুলনায় অন্য ধরনের দর্শক যারা অন্য দেশের অ্যাকশন ছবির আদলে পুলিশি সন্ত্রাস, ক্রিমিনাল গংয়ের শক্তির লড়াই, স্নায়ুযুদ্ধ বা জেলের অন্তর-বাহিরের প্যাচাল দেখতে ভালোবাসে তাদের সংখ্যা ব্যাপক। আইটেম সং না থাকায়, উসকানি না দেওয়ায় যদি দর্শক হলে না যায় তবে সে ব্যর্থতা আমাদের সামগ্রিক – নির্মাতার নয় নিশ্চয়ই। এটা গণরুচির অবক্ষয়।
অপ্রাসঙ্গিক কোনো প্রসঙ্গের চর্চা নেই, সহজ গল্প বলার স্টাইলেই স্বপ্নজালের কাহিনি এগিয়েছে, ঘটনার জট পাকিয়েছে এবং জট খুলে গিয়েছে। শুভ্রার বাবা হিরণ সাহার নিখোঁজ হওয়া, আয়নাল গাজীর চক্রান্ত, হিরণ সাহার মৃত্যুর রহস্য উদ্ঘাটন, বাস্ত্তভিটা ছাড়া হওয়া এবং পুনরায় বাস্ত্তভিটায় ফিরে আসা। অপু-শুভ্রার বিচ্ছিন্নতায় আপনি ইমোশনাল হবেন। কিন্তু ইমোশনফুল হবেন না।
অধিকাংশ বাংলাদেশি ছবিতে দেখা যায় প্রেম দেখাতে গিয়ে সমাজ, সংসার, পেশা, শ্রেণি, অবস্থান – সবকিছু গৌণ হয়ে পড়ে; সমাজ ও বাস্তবতাবিবর্জিত প্রেম কোনোরকম আবেদনই সৃষ্টি করতে পারে না। কিন্তু স্বপ্নজাল পুরোপুরি ব্যতিক্রম। স্বপ্নজাল কোনো জটিল মনস্তাত্ত্বিক সামাজিক রাজনৈতিক আখ্যানের বুদ্ধিবৃত্তিক পর্যালোচনা নয়। নববইয়ের দশকের প্রথম দিকে তিন ইলিশ মাছ আড়তদার ব্যবসায়ীর মধ্যে ক্ষমতার দ্বন্দ্ব এবং আয়নাল গাজীর ক্রমান্বয়ে সংখ্যালঘু হিন্দু আড়তদারের স্থাবর-অস্থাবর সম্পত্তি দখলের চক্রান্তকে ঘিরে আবর্তিত হয় এই ছবির কাহিনি। মেঘনা ও ডাকাতিয়া নদীর ঢেউ লাগে শৈশবে ঘনিষ্ঠ সম্প্রদায় ভুলে বড় হওয়া দুই যুবক-যুবতীর প্রাণে – তাদের অবাধ প্রেমের আখ্যানে।
স্বপ্নজাল ছবির বড় শক্তি অভিনয়। প্রতিটা চরিত্র তার সেরা অভিনয় দেওয়ার চেষ্টা করেছে। এখানে নবাগত ইয়াশ রোহান থেকে শুরু করে বাণিজ্যিক ছবির সিলছাপ্পর মারা নায়িকা পরীমণি কিংবা জাতীয় ভিলেন মিশা সওদাগরকে সম্পূর্ণ ভিন্ন ভূমিকায় দেখা গেল। পরীমণি নিজের সর্বোচ্চ দিয়েছেন শুভ্রা হওয়ার জন্য। স্বপ্নজালে সে ‘ডানাকাটা পরি’ ছিল না, ছিল সাদামাটা মফস্বল শহরের মিষ্টি মেয়ে, ভালোবাসার মানুষের জন্য যে জাতপাত-ধর্মের ভেদ ভুলতে চায়। কখনো প্রতিবাদী হয়ে ওঠে, সমাজ-সংসারের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করতে চায় কিংবা আবার বাস্তবতার কাছে হার মানতে বাধ্য হয়। সবকিছুই সে ফুটিয়ে তুলেছে অত্যন্ত দক্ষ অভিনেত্রীর মতো। কোনো স্টারডমের ভাবনা না রেখে কেন্দ্রীয় চরিত্রে নবাগত ইয়াশ রোহানের অভিষেক এই ছবিতে। কিন্তু কোনোরকম ত্রম্নটি ধরা যায়নি তার ডায়ালগ ও এক্সপ্রেশনে, বাড়তি আতিশয্য চোখে পড়েনি, জড়তা ছিল না অভিনয়ে। অপুর বাবার চরিত্রে শহীদুল আলম সাচ্চু। আশির দশকে ব্যাপারী ব্যবসায়ীরা যে-রকম ব্যাগ ব্যবহার করতেন, সে-রকম ব্যাগ ব্যবহার, নির্দিষ্ট ম্যানারিজম, দায়িত্বশীল কিন্তু কট্টর নয় – এরকম পিতার চরিত্রে চমৎকার অভিনয় করেছেন। খলচরিত্রে ফজলুর রহমান বাবু কর্তৃক শুভ্রাদের সম্পত্তি জবরদখল, শুভ্রার বাবাকে হত্যা, শুভ্রাদের পরিবারকে দেশ ত্যাগে বাধ্য করা, সম্প্রতি এদেশে ধর্মীয় মৌলবাদের উত্থান, সংখ্যালঘু নির্যাতনের কারণ চিত্রায়ণে বাস্তবতার বহিঃপ্রকাশ ঘটে। তবে তা কোনোভাবেই Larger than life মনে হয়নি। কেননা বাবুর পাপবোধ আছে, সময় সময় তা দেখা যায়। ছবিতে আয়নাল গাজীর (ফজলুর রহমান বাবু) অপকর্ম দেখে রাগ হচ্ছিল, কিন্তু পরক্ষণেই তার সংলাপে হেসে পড়ছিল দর্শক – চরিত্র ও সংলাপের এই অদ্ভুত ট্রান্সফরমেশন ধারাবাহিকভাবে করে যাওয়া কেবলমাত্র ফজলুর রহমান বাবুর পক্ষেই সম্ভব। একজন অভিনেতা ভালো অভিনয় করলে তাঁর সহযোগী অভিনেতারাও যে ভালো অভিনয় করেন সেটা দেখা গেল। বাবুর সঙ্গে ইরেশ যাকেরও যথেষ্ট ভালো অভিনয় করেছেন।
গ্রেপ্তার হওয়ার পর শারীরিকভাবে ভঙ্গুর – আশপাশে তার কোনো সমর্থক না থাকা সত্ত্বেও ভি সাইন (জয়সূচক) প্রদর্শন বর্তমান সময়ে অসৎ রাজনীতিবিদদের অহেতুক আস্ফালনকে স্যাটায়ার করে। যদিও বাবুর এই ক্যারিশম্যটিক অভিনয় সিনেমার ফোকাসকে নষ্ট করেছে কি না সেই প্রশ্ন উঠবে স্বাভাবিকভাবেই।
অপু-শুভ্রার প্রেম নিয়ে উদ্ভূত পরিস্থিতিতে তাদের বাবা-মাদের স্বাভাবিক থাকতে দেখা যায়। এরা কোনো নিষ্ঠুর আচরণ করে না। যদিও শেষ পর্যায়ে ধর্মীয় অনুশাসনের কাছে তাদের হার মানতে হয়েছে। এই চরিত্রগুলো রূপায়ণে শহীদুল আলম সাচ্চু (অপুর বাবা), ফারহানা মিঠু (অপুর মা) ও শিল্পী সরকার অপু (শুভ্রার মা) যথেষ্ট ভালো অভিনয় করেছেন। অন্য অভিনেতারাও নিজ নিজ চরিত্র অনুযায়ী মানিয়ে গিয়েছেন।
মেঘনা ও ডাকাতিয়া নদীর মিলনস্থল ও কলকাতার ট্রাম-ট্যাক্সি বাঙালি থিয়েটার নববইয়ের দশকের শেষে নতুন শতাব্দীর শুরুতে যেমনটি ছিল তা উপস্থিত হয়েছে স্বপ্নজাল ছবিতে। তবে থিয়েটারের নায়িকা হতে হলে তাকে রক্তকরবীর নন্দিনীই হতে হয় – এই আদিখ্যেতা মোটেই ভালো লাগে না। কলকাতার অংশে কলকাতার শিল্পীদের ব্যবহার করায় কলকাতার শিল্পীরা স্ব-স্ব ক্ষেত্রে মুনশিয়ানা দেখিয়েছেন। যদিও কলকাতায় শুভ্রার স্বাবলম্বী হওয়া খুব বেশি তাড়াতাড়ি হয়েছে। মধ্য বয়সের সমস্যাসংকুল বিশ্বম্ভরের উদ্দেশ্য বুঝতে পেরেও শুভ্রা যতটা স্বাভাবিকভাবে তা মোকাবেলা করে সেটা নিঃসন্দেহে পরিস্থিতির শিকার তরুণীর বাস্তবতাকে মেনে নিয়ে পরিণত হয়ে ওঠার চমৎকার উদাহরণ। নাটকের পরিচালক (রজত গাঙ্গুলী) সংলাপ প্রক্ষক্ষপণে নায়িকার বাঙ্গাল উচ্চারণকে ঠাট্টা করা ঘটি ও বাঙ্গালের সাংস্কৃতিক পার্থক্য স্পষ্টতর করেছে।
স্বপ্নজাল ছবির সংলাপ ছিল সাবলীল, কিছুটা আবেগকে আধিক্য দিয়ে। চরিত্রের মনোজগতের টানাপড়েন, ঈর্ষা, ক্ষমতা, লোভ, প্রেম যা কিছু নিয়ে ছবির নির্যাস তৈরি হয়েছে – তার সঙ্গে সংগতি রেখে সংলাপ রচনাকে যথাযথ মনে হয়েছে। নদীর পাড়ে শুভ্রার বিদায় সংলাপ –
‘আমার মনটাকে তোমার কাছে রেখে গেলাম
মনটাকে মোর বসতে দিও
মুড়ি মুড়কি খেতে দিও
জলের গস্নাস দেয়ার ছলে একটু শুধু ছুঁয়ে দিও।’
…এই ছড়া ভালো লেগেছে, কিন্তু খাপছাড়া লাগেনি। কারণ সাধারণ এক মফস্বল শহরের মেয়ের সংবেদনশীলতা বিবেচনা করে এই সংলাপ বিশ্বাসযোগ্য মনে হয়। চিঠির আদান-প্রদান, চাঁদপুর ও কলকাতায় ডাকপিয়নের চিঠি পৌঁছানো চলচ্চিত্রের গতিকে হয়তো মন্থর করেছে; কিন্তু চাঁদপুরের ডাকপিয়নের সঙ্গে অপুর যে একটা আত্মিক সম্পর্ক গড়ে ওঠে তা ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র মুহূর্ত দিয়ে উপস্থাপন খুব হৃদয়গ্রাহী। শুভ্রার সংলাপটি মনে করতে পারি আমরা –
‘ডাকপিয়ন কাকুকে চিঠির ব্যান্ডেল হাতে দেবদূতের মতো লাগে।’
অপু ও শুভ্রার প্রেমের পরিণতিতে ধর্ম যে বাধা সৃষ্টি করবে তা আঁচ করা গিয়েছিল ছবির মাঝ পর্যায় থেকেই। তবে শেষাংশে ধর্মগুরুর ক্ষমতা প্রদর্শন কিছুটা আরোপিতই মনে হয়েছে।
সম্প্রতি দেখা আয়নাবাজির পর স্বপ্নজাল ছবির সিনেমাটোগ্রাফি দর্শকের ভালো লেগেছে। গল্পের অভিব্যক্তি, চরিত্রকে সঠিক অ্যাংগেলে, সঠিক লেন্সে পরিমিতি বজায় রেখে সঠিক শটটি নিয়েছেন সিনেমাটোগ্রাফার কামরুল হাসান খসরু। শিকার ও শিকারিকে ধীরে ধীরে ক্লোজ থেকে মিড, মিড থেকে মিড লং এবং লংয়ে ঠেলে দিয়ে সরাসরি হত্যার দৃশ্য না দেখিয়ে আবহ তৈরি করেছেন। ভাবতে অবাক লাগে, আকিরা কুরোসোওয়ার ছবির লেন্সিং টেকনিক আমাদের ছেলেরা সিনেমায় কীভাবে ব্যবহার করছে! অপুর মৃত্যুর পর পাখির পালকের হাইস্পিড শটটি কতটা নিখুঁত! গল্পের বয়ানকে এক অন্যমাত্রায় নিয়ে গেছে খসরুর ক্যামেরা। ডে লাইট আর কৃত্রিম (Indoor) লাইট সবখানেই যৌক্তিক মনে হয়েছে। লাইট সোর্স, আলোর পরিমাণ, প্রক্ষক্ষপণ, সাবজেক্ট-অবজেক্টের ব্যবধান, আলো দিয়ে ফ্রেমে লেয়ার তৈরি ছিল যুক্তিযুক্ত।
যদিও সেটের কিছু দুর্বলতা দু-এক জায়গায় বেশ স্পষ্টভাবে ধরা পড়েছে। যেখানে বাবু, ইরেশ ও তাদের প্রমোদ বালিকা মদ খাচ্ছিল। নতুন কাঁচা বাঁশ দিয়ে সেট তৈরি করার ফলে তা ক্যামেরায় স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। যে-কোনো সেট শুটিংয়ের উপযোগী করার আগে Weathering করা দরকার।
চরিত্র অনুযায়ী কস্টিউম ও মেকআপ ঠিকই ছিল। পরীমণি ও অন্যদের খুবই ন্যাচারাল মনে হয়েছে কোনোরকম মেকআপ ছাড়াই। মেকআপ ভালো হয়েছে আয়নাল গাজীর (ফজলুর রহমান বাবু) – তার চরিত্রের সময়, মানসিক-শারীরিক অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে অবয়ব পরিবর্তনের জন্য দর্শকের কাছে প্রশংসনীয় হয়েছে।
ফলি সাউন্ড, ব্যাকগ্রাউন্ড স্কোর, গান – সবকিছু উতরে গেছে। সাউন্ড ডিজাইন যথেষ্ট যত্নসহকারে করা হয়েছে। আশপাশের অ্যামবিয়েন্সকে সংযুক্ত করে নদীর বাতাস, রাতের নিস্তব্ধতা, চিরায়ত কলকাতার কোলাহল, আয়নাল গাজীর বমি করার লাউড ফলি সাউন্ড একদম ভালো লাগেনি। আয়নাল গাজীর প্রাণবন্ত অভিনয়, অভিব্যক্তিই যথেষ্ট ছিল। সাউন্ড বাড়িয়ে বাজারের সস্তা কমেডির মতো দৃশ্যটি করার দরকার ছিল না। দর্শক হাসানোর অভিপ্রায়ে এটা করা। কিন্তু দর্শক হাসানোর যথেষ্ট উপাদান ছবিতে ছিল। এটা বরং সিনেমার জন্য ক্ষতিকর হয়েছে।
কিছু আবহসংগীত পরিচিত বিদেশি চলচ্চিত্রের অনুরূপ না হলেই পারত। অনায়াসেই সেখানে চলচ্চিত্রের সংগীত নির্মাণের জন্য Motif, Leit Motif তৈরি করা যেত। গল্পের প্রয়োজনে আবহ সৃষ্টিতে তিনটি গান ব্যবহৃত হয়েছে। আছে একটি রবীন্দ্রসংগীত। তবে দুটি গানে ত্বরিত চিত্র সম্পাদনা হয়েছে। চিত্র সম্পাদনায় আরো যত্নবান হওয়া উচিত ছিল।