র বি উ ল হু সা ই ন
জাহা মোহাম্মদ হাদিদ যিনি জাহা হাদিদ নামে বিশ্বের এই সাম্প্রতিককালের স্থপতি-তারকা (স্টার আর্কিটেক্ট) গোষ্ঠীর একমাত্র নারী স্থপতি, ইসলাম ধর্মাবলম্বী এবং প্রিত্জ্কার আর্কিটেক্ট ২০০৪-এ পুরস্কারপ্রাপ্ত স্থাপত্যশিল্পী হিসেবে তাঁর বিস্ময়কর সৃজনশীলতার আলো ছড়িয়েছেন।
জন্ম ইরাকের বাগদাদে ১৯৫০ সালের ৩১ অক্টোবরে। জাতীয়তা আরবীয়, নাগরিকত্ব ইরাকি-ব্রিটিশ। লেখাপড়া প্রথমে সুইজারল্যান্ডের বোর্ডিং স্কুলে, পরে বৈরুতের আমেরিকান ইউনিভার্সিটিতে গণিতশাস্ত্রে। তার পরে পিতামাতাসহ ইরাকে সাদ্দাম হোসেনের রাজনৈতিক ডামাডোলের কারণে বিলেতে বসবাস করতে এসে স্থাপত্যশিল্পে লন্ডনের বিখ্যাত প্রাচীনতম ভিন্নধর্মী স্থাপত্য বিদ্যায়তন আর্কিটেক্চারাল অ্যাসোসিয়েশন স্কুল অব আর্কিটেক্চারে (এ অ্যান্ড এ) পড়াশোনা করে নিজেকে স্থপতি হিসেবে গড়ে তোলেন।
স্থাপত্যচর্চায় অসামান্য অবদানের জন্য হাদিদ ২০১০ এবং ২০১১ সালে দুবার স্টারলিং পুরস্কারে ভূষিত হন। পরের বছর
২০১২-তে তিনি ডেইম কমান্ডার অব দি অর্ডার অব দি ব্রিটিশ এম্পায়ার (ডিবিই) পুরস্কারে সম্মানিত হন এবং নিজের কৃতকর্মে অনন্যতার স্বাক্ষর রাখার জন্য রয়াল ইনস্টিটিউট অব ব্রিটিশ আর্কিটেক্টস্ (রিবা) স্বর্ণপদক লাভ করেন। ডিবিই পুরস্কারটি হাদিদ স্থাপত্যশিল্পে নিদর্শন রাখার জন্য তাঁর জন্মদিন উপলক্ষে লাভ করেছিলেন। এর আগে ২০০২-এ কমান্ডার অব দি অর্ডার অব দি ব্রিটিশ এম্পায়ারও নির্বাচিত হয়েছিলেন। ২০১৫ সালে তিনি ব্রিটিশ-মুসলিম পুরস্কার পেয়েছিলেন বিজ্ঞান ও প্রকৌশলে সার্বিক অবদান রাখার জন্য।
এরকম একজন অসামান্য শিল্পী ও স্রষ্টা, যাঁর অভূতপূর্ব সাড়া-জাগানিয়া আবির্ভাব, বহুদিন পর স্থাপত্য-জগতে দেখা গেল নারী বা পুরুষ যে-কোনো বলয়ে, তিনি হঠাৎ করে মাত্র ৬৫ বছর বয়সে যুক্তরাষ্ট্রের ফ্লোরিডার মিয়ামিতে এ-বছরের ৩১ মার্চ ব্রংকাইটিস চিকিৎসা করাতে এসে অভাবিতভাবে সবাইকে শোকের সাগরে ডুবিয়ে হৃৎযন্ত্রের ক্রিয়া বন্ধ হয়ে চিরবিদায় নিলেন। তাঁর জীবন দিয়ে সেই আপ্তবাক্যটির পুনঃপ্রতিষ্ঠা করলেন Ñ এলেন, দেখলেন এবং সবকিছু জয় করে চলে গেলেন। তাঁকে বলা হতো বক্ররেখার মহারানি Ñ কুইন অব কার্ভ। মহাকবি গ্যেটের কথায়, স্থাপত্য হচ্ছে জমাটবাঁধা সংগীত লহরি আর সংগীত তার বিপরীতে তরল স্থাপত্য। জাহা হাদিদের স্থাপত্য-নিদর্শন দেখলে মনে হয়, স্থাপত্যের কাঠিন্য ও পাথর বা বরফ-জমা দৃঢ় অবস্থানকে তিনি জলের তরল সরলতা অথবা সরল তরলতায় নৃত্যের ছন্দে রূপায়িত করেছেন। বলা যায়, তাঁর আগে এযাবৎকালে কোনো স্থপতি এমন শৈল্পিক আঙ্গিকে স্থাপত্যশিল্পকে বাস্তবে রূপ দিতে পারেননি। নারীদের মধ্যে তো অসামান্য ও অনন্য বটেই, পুরুষদের ভেতরেও সবসহ সর্ব স্থপতির সীমা বা পরিধি ধরলেও এ-কথা নির্দ্বিধায় ঘোষণা করা যায়। যদিও তিনি বলেছেন, আরব দেশে জন্ম নেওয়া একজন নারী হয়ে স্থাপত্যশিল্পের চর্চা করা সহজ নয়।
হাদিদের স্থাপত্যকর্মে কয়েকটি বৈশিষ্ট্য প্রণিধানযোগ্য। হাদিদ আরব বিশ্ব থেকে উঠে আসা হয়তো প্রথম আধুনিক ও সমসাময়িক কোনো স্থাপত্যশিল্পী এবং স্থাপত্যবিদ, যিনি আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে স্থাপত্যকলায় সবিশেষ অবদান রেখেছেন।
সাধারণত আরবীয় রীতি অনুসারে কোনো জীব বা প্রাণীর আকৃতি বা গঠন বা চেহারা ধর্মীয় আচার-বিরুদ্ধ হওয়াতে নকশার আঁকাআঁকিতে তুলে আনা বা প্রকাশের প্রচলন নেই। যদিও সময়ের সঙ্গে তা পরিবর্তিত হচ্ছে। তাই সেখানে সবকিছু হতে হয় স্বাভাবিক বা অস্বাভাবিক জ্যামিতিক প্রকরণে। হাদিদের স্থাপত্যকাজে সেরকম আরবি বর্ণমালার ক্যালিগ্রাফি বা হস্তলিপির ছন্দোবদ্ধতা ও সাবলীল প্রবহমান সৌন্দর্য এবং বিমূর্ততার খোঁজ পাওয়া যায়। সেই অনুসারে আরবীয় সংস্কৃতির বহু চিত্রকলার সৃষ্টি হয়েছে, যা বিশ্বের চিত্রশিল্পে এক অনন্য অধ্যায় ও সংযোজন;
কিন্তু স্থাপত্যে তেমনটি দেখা যায়নি। হাদিদের স্থাপত্যকর্মের দ্বারা সে-অভাব পূরণ হয়েছে। বলা যায়, যা অভূতপূর্ব ও অনবদ্য।
হাদিদ বলেছেন, যারা জীবনকে সহজভাবে নিয়ে থাকে, তাদের জন্য স্থাপত্যপেশা উপযুক্ত নয়। তিনি স্থাপত্যবিদ্যার শিক্ষক, পেশাচর্চাকারী ও স্থাপত্যতাত্ত্বিক ছিলেন। প্রথম দিককার
স্থপতি-জীবনে বহু আন্তর্জাতিক স্থাপত্য প্রতিযোগিতায় ব্যতিক্রমী গতিময় স্থাপনা সৃষ্টির জন্য পুরস্কৃত হয়ে বিশ্বখ্যাত হয়েছিলেন, অথচ কোনো প্রকল্প তখন পর্যন্ত বাস্তবায়িত হতে পারেনি। তাঁর স্থাপত্যশিল্পসৃষ্টি ১৯৯০ সাল থেকে কম্পিউটার বা বৈদ্যুতিন প্রযুক্তিগত রীতি-কৌশল ব্যবহারের উজ্জ্বল ফসল এবং মাধ্যাকর্ষণ শক্তির বিপরীতে চলমান ও ভূমির ওপর ভাসমান এবং উত্থিত বলে মনে হয়ে থাকে। এই বিবেচনায় তিনি সমকালীন বলিষ্ঠ একটি স্থাপত্য প্রযুক্তিগত ধারার স্রষ্টা, এরকম অভিহিত করা যায়।
হাদিদ যখন লন্ডনের রেডফোর্ড স্কয়ারে আর্কিটেক্চারাল অ্যাসোসিয়েশন স্কুল অব আর্কিটেক্চারে ১৯৭২ সালে স্থাপত্যবিদ্যা শিক্ষা শুরু করেন, তখন দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরে
বড়-বড় নির্মাণ-প্রকল্পে আধুনিক স্থাপত্যরীতি সার্বিকভাবে অনুসরিত হওয়ায় তা কিছু-কিছু ক্ষেত্রে অকার্যকর প্রমাণিত হয় এবং সে-কারণে আধুনিক স্থাপত্য বাস্তবায়িত না হয়ে বাধার সম্মুখীন হতে থাকে। এই পরিস্থিতিতে বলা হচ্ছিল, আধুনিকতা এখন মৃত। এখান থেকে কোথায় গন্তব্য তার কোনো নিশ্চয়তা নেই। এসব বলা ও জানা সত্ত্বেও হাদিদ দৃঢ় মনোবল আর আত্মপ্রত্যয়ে স্থাপত্যশিক্ষা গ্রহণে এগিয়ে গিয়ে সেটা সম্পন্ন করে সফলতা লাভ করেছেন। এই মানসিক শক্তি তখন আর কারো মনে এত প্রবলভাবে দেখতে পাওয়া যায়নি, সেই দিক থেকে তিনি লক্ষ্যভেদী ও অজেয়।
হাদিদের স্থাপত্যপেশাচর্চায় রক্ষণশীল স্থপতিদের দ্বারা বাধা, বিরোধিতা ও অসহযোগিতা লক্ষ করা যেতে থাকে। কিন্তু এসব সত্ত্বেও তিনি তাঁর কাজ দৃঢ় সংকল্পে সমাধা করে সবাইকে বিমোহিত করে তোলেন এবং এ-কারণে তিনি নবীন সৃষ্টিশীল স্থপতিদের কাছে একটি প্রতীক হিসেবে পরিগণিত হন, যা তাঁর আগে কেউ হতে পারেননি। হাদিদের দৃঢ় মনোবল ও ইচ্ছাশক্তি অসাধারণ ছিল। তিনি বলতেন, তাঁর নাম হাদিদ এবং এই আরবি নামের অর্থ হচ্ছে লোহা, ভাঙবে তবু বাঁকা হবে না।
হাদিদের বিচিত্র ও বৈচিত্র্যধর্মী সৃষ্টিশীলতার স্ফুরণ ছোটবেলা থেকেই লক্ষ করা যায়। তাঁর বসবাসের পরিবেশ তাঁর ওপর গভীরভাবে প্রভাব বিস্তার করে এসেছে। সবসময় ব্যতিক্রমধর্মী কিছু দেখলে বা জানলে বা শুনলে সেগুলো নিয়ে হাদিদের মনে বিভিন্ন প্রশ্ন জাগত এবং তার উত্তর ও সমাধান পাওয়ার চেষ্টা করে যেতেন। সেই সময়ে অনেক কিছুর মধ্যে তিনটি জিনিসের কথা বলে গেছেন, যেগুলো তাঁকে নিরন্তর অনুপ্রেরণা জুগিয়ে গেছে। হাদিদের ঘরের একটি অপ্রতিসম বা বিপরীত প্রতিসাম্য বা অসামঞ্জস্য ধরনের আয়না ছিল, যার ওপরে যে-কোনো প্রতিচ্ছবি বিমূর্ত ও ভাঙাচোরা হয়ে দেখা যেত, সেটা তাঁকে ভাবিয়েছে। তাঁর ঘরের আসবাবপত্র, চেয়ার, টেবিল, সোফা সব কৌণিক আঙ্গিকের ছিল যা অন্য ঘরগুলোর আসবাব থেকে ভিন্ন Ñ এগুলোও তাঁকে নতুন করে প্রশ্নবিদ্ধ করেছিল। আর তাঁর ঘরের মেঝে কারুকার্যময় একটি পারস্যদেশীয় রঙিন আরবীয় নকশাপূর্ণ জ্যামিতিনির্ভর শিল্পশৈলীর কার্পেটে ঢাকা থাকত, যেটি আগামী স্থাপত্যশিল্পচর্চাতে তাঁকে প্রভূতভাবে অনুপ্রেরণা দিয়ে নতুন ও ব্যতিক্রমধর্মী কিছু সৃষ্টি করতে উদ্বুদ্ধ করেছিল।
উনিশ শতকের শেষ থেকে শিল্প-ভাস্কর্য-স্থাপত্য জগতে ঘটে যায় বিভিন্ন শিল্প-আন্দোলন, যা বিংশ শতাব্দী পর্যন্ত ক্রমান্তর হয়েছিল। যেমন রাশিয়ার কনস্ট্রাকটিভিজম বা নির্মাণবাদ, সুপ্রিম্যাটিজম বা সর্বোৎকৃষ্টবাদ, পরবর্তী সময়ে প্যারামেটিক বা স্থিতিমাপকবাদ মতবাদ, আর্কিটেক্টনিক বা স্থাপত্যলব্ধবিদ্যা নিয়ন্ত্রণবাদ, অ্যাসিম্প্টোট বা বিকেন্দ্রিক বক্ররৈখিকতাবাদ স্থাপত্য ইত্যাদি আঁভা গার্দ বা অগ্রসর চিন্তা ও সাম্প্রতিকতায় উন্নীত হয়েছিল, সেই ভাবধারা নিয়ে হাদিদ নতুন এক গতিময় গড়নে স্থাপত্যসৃষ্টির পথিকৃৎ হয়ে দেখা দিয়েছেন, যা বিস্ময়কর ও উজ্জ্বল সৃষ্টিশীলতার পরিচয় বহন করে। তিনি বরাবরই বিমূর্ততার মধ্যে সৌন্দর্যখনি আবিষ্কার করতে সচেষ্ট ছিলেন এবং তাই বলেন, বিমূর্ততা সবকিছুকে মুক্ত করে নতুন পথের সন্ধান দেয় ও এভাবে তা উদ্ভাবনার শক্তিকে বাড়িয়ে তুলতে সাহায্য করে। আর্কিটেক্টনিক পদ্ধতিতে তিনি অনেক চিত্রকলায় রৈখিক, বক্ররেখা ও পরিসর বিভাজনে গঠনমূলক বর্ণগুলো ব্যবহার দ্বারা গঠনাত্মক গতিশীল স্থাপত্যলব্ধবিদ্যা নিয়ন্ত্রণে পরিবেশনা ও উপস্থাপনা করেছেন এবং এক্ষেত্রে স্থাপত্য, ভাস্কর্য ও শিল্পকলাকে পরস্পরের শৈল্পিক পরিপূরক হিসেবে স্থাপত্যে প্রথমবারের মতো একীভূত করার লক্ষ্যে সফলতা পেয়েছেন।
হাদিদ ব্যক্তিগত জীবনে চঞ্চল, অস্থির, সর্বদা ধূমপায়ী (পরে অবশ্য ত্যাগ করেছিলেন), রাতের পর রাত জেগে তাঁর স্থাপত্যশিল্প সৃষ্টির সমাধান খুঁজে পাওয়ার নিরন্তর প্রচেষ্টাকারী কনস্ট্রাক্টিভিজম ও আর্কিটেকটনিক চিত্র শিল্পশৈলী অনুসারে একজন চিত্রশিল্পী, গায়ক, অভ্যন্তরীণ সাজসজ্জার নকশাবিদ, পোশাক-পাদুকা-গহনা নকশাকারসহ আসবাবপত্র-নাট্যমঞ্চ-স্থাপনা-অনুষ্ঠান পরিকল্পক ছিলেন এবং সর্বত্র নির্মাণবাদ শিল্পশৈলী অনুসারে নতুন-নতুন সৃষ্টি উপহার দিয়ে ব্যবহারকারীদের চমৎকৃত করে তুলতে পেরেছিলেন। এসব নিমগ্নতায় তাই তিনি একজন গভীর ইচ্ছাশক্তিসহ
স্থপতি-ব্যক্তিত্বসম্পন্ন ও আত্মসম্মানী শিল্পী-মানুষ হিসেবে সবার কাছে পরিচিত হয়েছিলেন। যখন তিনি স্থপতি হিসেবে সনদপ্রাপ্ত হলেন এ অ্যান্ড এ স্কুল থেকে ১৯৭৭-এ, তাঁর শিক্ষক রেম কুলহাস তাঁর ফার্মে কাজ করতে বলেন। তখন হাদিদ বলেন, তিনি একজন পার্টনার বা অংশীদার হিসেবে যোগ দিতে পারেন। উত্তর আসে হ্যাঁ, তবে অধীনস্থ হিসেবে। হাদিদ তখন বলেন, না, তা তিনি হতে পারবেন না নিজের স্বাধীনতা বিসর্জন দিয়ে। তারপরও বছরখানেক কুলহাস, যিনি ডেলিরিয়াস বা বিকারগ্রস্ত নিউইয়র্ক নামক বইটির জন্য স্বনামখ্যাত, তাঁর আপিসে ছিলেন। হাদিদের স্থাপত্যকর্মে কুলহাসের সবসময় উৎসাহ ছিল। তিনি হাদিদ-সৃষ্ট ক্লাসের শেষবর্ষের স্থাপত্য-সন্দর্ভ সম্বন্ধে উক্তি করেছেন এমন যে, হাদিদ এক তুলনাহীন ঘূর্ণায়মান নক্ষত্র। তাঁর নিজের কক্ষপথে সে সর্বদা পরিভ্রমণরত। ২০২২ সালে কাতারে যে ওয়ার্ল্ড কাপ ফুটবল খেলা হবে তার স্টেডিয়াম হাদিদের নকশায় এবং সেটা নির্মাণকালে এক দুর্ঘটনায় বেশ কয়েকজন বিদেশি নির্মাণশ্রমিক মারা যান। কিন্তু হাদিদকে তার জন্য অপরাধী করে বিবিসি রেডিও কর্তৃপক্ষ এক সাক্ষাৎকারে তাঁকে বারবার জিজ্ঞাসা করে উত্ত্যক্ত করে তোলে। তিনি বলেন, নির্মাণ করা স্থপতির দায়িত্ব নয়। স্থপতির দায়িত্ব নকশা করা। কর্তৃপক্ষকে এ-সম্বন্ধে সজাগ হতে হবে। তারপরও তাঁকে বিরক্ত করা শুরু করে হাদিদের জাপান স্টেডিয়াম সম্বন্ধে, তখন তিনি তার প্রতিবাদে সঙ্গে-সঙ্গে সাক্ষাৎ চলাকালীন স্টুডিও ত্যাগ করে চলে আসেন। এমনই তাঁর আত্মসম্মানবোধ ও ব্যক্তিত্ব ছিল।
কনস্ট্রাকটিভিজম বা গঠনবাদ একটি দার্শনিক মতবাদ, যেটি জাঁ পিয়াগেট ব্যাখ্যা করেছেন এমন, যেখানে মানুষ তাদের অভিজ্ঞতা ও আদর্শের মিথস্ক্রিয়ায় একটি অর্থ সৃষ্টি করেন। এই মতবাদ শিল্পের বিমূর্ততা গঠনে বর্ণ ও আকারের অন্তর্নিহিত অর্থ ফুটিয়ে তুলতে সাহায্য করে নতুন আঙ্গিক এবং চিন্তাধারায়। রাশিয়ার বিপ্লবোত্তর গঠনবাদের সেই সময়েই কাজিমির
মেলভিচ-উদ্ভাবিত সুপ্রিম্যাটিজম বা সর্বোৎকৃষ্টবাদ শিল্পধারা দেখা দেয়, যে-মতবাদ দ্বারা হাদিদ প্রভূতভাবে প্রভাবান্বিত হন।
উত্তর-বিপ্লবকালের নির্মাণবাদ এবং জড়বাদের বিপরীতে সর্বোৎকৃষ্টবাদের অবস্থান। মেলভিচ বলেছেন, সৃজনশীল শিল্পে বিশুদ্ধ অনুভূতির সূচনাই সর্বোৎকৃষ্টবাদ। এতে দৃশ্যগত বস্তুগুলোর কোনো অর্থ নেই, মর্মার্থ হচ্ছে অনুভবতা, যা পরিস্থিতি ও পরিবেশবহির্ভূত। এই মতবাদ মানবিক দর্শনকে গ্রহণ করে না, যা মানুষকে ব্রহ্মা-ের কেন্দ্রে স্থাপন করে। বরং এটি মানুষ ও শিল্পী দুজনকেই মৌলিক সৃজনশক্তিসম্পন্ন সহায়ক হতে অনুপ্রাণিত করে, যা পৃথিবীর একমাত্র বাস্তবতা স্বয়ম্ভু এবং নির্বস্তুক। ভবিষ্যৎ ব্রহ্মা- গঠিত হবে এমন যেখানে আকার বা আকৃতি, বস্তু, স্বাচ্ছন্দ্য ও সুযোগ-সুবিধা বড় হয়ে দেখা দেবে না।
মেলভিচের ওপর রাশিয়ার রহস্যবাদী এক দার্শনিক অউস্পেনস্কির প্রভাব ছিল, যিনি চতুর্মাত্রা বা চতুর্থ পথের কথা বলেছেন, যা মানুষের সাধারণ ত্রিমাত্রার বোধানুভবকে অতিক্রম করে যায়। মেলভিচের ১৯১৫ সালের কৃষ্ণবৃত্ত বা ব্ল্যাক সার্কল,
১৯১৬-১৭ সালের সুপ্রিম্যাটিজম এরকম বিশুদ্ধ বোধের চিত্রকলা যেগুলো হাদিদের স্থাপত্যশিল্প রচনায় প্রভাব ফেলেছে।
এই পথের পথিক-শিল্পী মেলভিচ অনুসারী লাচ্ছিজকি সুপ্রিম্যাটিজম মতবাদকে এমন গঠনে রূপান্তরিত করে তোলেন, যেখানে বা যে কেন্দ্রে একজন স্রষ্টা চিত্রশিল্পকে স্থাপত্যশিল্পে পরিবর্তন করেন, যেটাকে ‘প্রাউন’ বলে অভিহিত করা হয় এবং ওই নামে ১৯২৫ সালের এক চিত্রশিল্প থেকে তা শুরু হয়। হাদিদের সৃষ্টিশীলতা সেই আঁভা গার্দ বা সময় থেকে অগ্রসরিত সময়ে, যেটি রাশিয়ায় শিল্পবিপ্লব হিসেবে দেখা দিয়েছিল। তাঁর চিত্রকলা ও স্থাপত্যে এটি প্রভাব বিস্তার করেছিল। আরো লক্ষ করা যায়, মেলভিচের সঙ্গে নাওম গ্যাবো, এন্তোয়েন প্রেভসনার ক্যান্ডিনস্কির চিত্ররচনা আর স্থাপত্যে অ্যান্টোনিও গাউদি, স্পেনের স্থপতি যিনি অন্যতম প্যারামেট্রিক নকশার পথিকৃৎ, ব্রাজিলের অস্কার নেইমার, পোল্যান্ড-আমেরিকার সংগীতজ্ঞ-স্থপতি লাইবসকাইন্ড, আমেরিকার ফ্রাঙ্ক গেহরি প্রমুখের প্রভাব এবং সবকিছুর ধারাবাহিকতা ও ক্রমান্তরে স্থাপত্য-জগতে সাম্প্রতিক আধুনিক ও উত্তরাধুনিকতায় হাদিদ একটি স্বতন্ত্র নিজস্ব হাদিদি ধারা সৃষ্টি করতে সমর্থ হয়েছেন।
সুবিখ্যাত কালজয়ী যে-কোনো স্থপতির মতো হাদিদ মনেপ্রাণে নতুন-নতুন গঠন, আকার বা গড়ন সৃষ্টি করেছেন স্থাপত্যে, শুধু অধিবিদ্যক ধারণা নিয়ে নয়। জাদুর বাক্স হিসেবে পরিচিত সাম্প্রতিক কম্পিউটার বা বৈদ্যুতিন যন্ত্রের অসম্ভব ও অভাবিত সাহায্য এবং তার মেধাবী অংশীদার প্যাট্রিক শুমাচার, যিনি প্যারামেট্রিক বা স্থিতিমাপক ধ্রুবকবাদ শব্দটির প্রবর্তক ও সেই কৃতিত্বের অধিকারী, সবসময় হাদিদকে তাঁর জটিল-প্রবহমান আকারের স্থাপত্যসৃষ্টিতে অকুণ্ঠ সহযোগিতা দিয়ে এসেছেন। হাদিদের স্থাপত্য সমুদ্রের ঢেউয়ের মতো যেন, কোনো কঠিন পদার্থ ছাড়া তরলীকৃত গঠনে বাস্তবায়িত। এসব শুরু হয়েছে এক বিচ্ছেদক শক্তিময় রেখা ও সমভূমির বিস্ফোরণ প্রক্রিয়ায়, যা প্রযুক্তিগতভাবে বাস্তবায়নযোগ্য নয় বলে মনে হলেও তার গতিময়তার রূপ সম্ভব হয়েছে ডিজিটাল প্রযুক্তিতে।
জাহা হাদিদ সর্বপ্রথম স্থাপত্য-জগতে ধ্রুবতারার মতো আবির্ভূত হন ১৯৮৩ সালে এক আন্তর্জাতিক স্থাপত্য প্রতিযোগিতায় শ্রেষ্ঠ নির্বাচিত হয়ে হংকংয়ের এক স্পোর্টস ক্লাবের নকশা করে। তা ছিল পাহাড়ের ওপর এক ভগ্ন মৃৎপাত্রের টুকরাকৃতি আকর্ষণীয় আকার, যদিও তা কোনোদিন নির্মিত হয়নি। এরকম বহু গুরুত্বপূর্ণ স্থাপত্য নকশার বাস্তব রূপ Ñ যে নদী মরুপথে হারাল ধারার মতো শুধু কাগজের ওপর নকশায় বিদ্যমান, তা হাদিদের জীবনে অনেক ঘটে গেছে। অবশ্য তেমনটি প্রত্যেক স্থপতির জীবনেই ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে থাকে। যুক্তরাজ্যের ওয়েলসের কার্দিফে এক অপেরা হাউসের স্থাপত্য প্রতিযোগিতায় সেরকম ১৯৯৫ সালে ঘটেছিল, হাদিদের নকশায় দুবারে নির্বাচিত শ্রেষ্ঠ নকশাটি কর্তৃপক্ষ গ্রহণ না করে ফিরিয়ে দিয়েছিল, যা দিয়ে তাঁকে পেশাগতভাবে অসম্মান করা হয়, এমন মনে করে তিনি তীব্র প্রতিবাদমুখর হয়ে লড়াই চালিয়ে যান, যা স্থাপত্য-জগতে সম্মানীয় ও স্মরণীয় হয়ে আছে।
১৯৯৪ সালে যখন হাদিদের ভিটরা ফায়ার হাউস জার্মানির উইয়িল অ্যাম-রেইনে বাঁকানো সমতলীয় ক্ষুরধারী গঠন ও আয়োজনে বাস্তবায়িত হলো তখন আর তাঁকে আটকানো গেল না। একের পর এক অভূতপূর্ব, অনুপম, বিচিত্র ও বৈচিত্র্যময় গঠনে সারাবিশ্বকে চমৎকৃত করে তুললেন তিনি।
১৯৮০ সাল থেকে লন্ডনে স্থাপত্যপেশা কারকেনওয়েল অঞ্চলে শুরু করেন। পরবর্তী সময়ে সেই আপিসে বিভিন্ন স্থাপত্য-প্রকল্পের কাজ করার জন্য প্রায় ৪০০ স্থপতি ও কর্মীবাহিনী নিয়োজিত হয়েছিল। হাদিদের মেধা চিত্রকলা, বিশেষ করে আর্কিটেক্টনিক ধারায় বিকশিত হতে দেখা যায় এবং সেই সুবাদে ১৯৮৮ সালে বিনির্মাণ আঙ্গিকে নিউইয়র্কের মিউজিয়াম অব মডার্ন আর্ট, মোমাতে ফিলিপ জনসন ও মার্ক উইগলির বাছাইয়ে খুব চমৎকারভাবে স্থাপত্যকলাকেন্দ্রিক ড্রইং প্রদর্শন করেন, যা সবার দৃষ্টিতে নতুন ও অভিনব হিসেবে দেখা দেয়।
শিক্ষক হিসেবে হাদিদের প্রভূত অবদান রয়েছে। পুরোপুরি স্থাপত্যপেশায় ব্যস্ত হওয়ার আগে ১৯৮০-এর মাঝামাঝি সময় থেকে হার্ভার্ড গ্র্যাজুয়েট স্কুল অব ডিজাইন, আর্কিটেক্চারাল অ্যাসোসিয়েশন স্কুল অব আর্কিটেক্চার, ১৯৯০-এ ইলিনয় ইউনিভার্সিটিতে শিকাগোর স্থাপত্যবিদ্যা শিক্ষালয়, হামবুর্গে এইচএফবিকে, ওহাইও স্টেট বিশ্ববিদ্যালয়ের নোলটন স্থাপত্য স্কুল, কলাম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের মাস্টার্স স্টুডিও, ইয়েল স্কুল অব আর্কিটেক্চারে ভিজিটিং প্রফেসর এবং ২০০০-এ ভিয়েনার ইউনিভার্সিটি অব অ্যাপ্লায়েড আর্টসের ইনস্টিটিউট অব আর্কিটেক্চারে অতিথি অধ্যাপক হিসেবে সময় দিয়েছেন। এছাড়া আমেরিকান অ্যাকাডেমি অব আর্টস অ্যান্ড লেটার্সের অনারারি মেম্বার ও আমেরিকান ইনস্টিটিউট অব আর্কিটেক্টসের অনারারি ফেলোসহ দি আর্কিটেক্চার ফাউন্ডেশনের একজন ট্রাস্টি ছিলেন। এরকম বর্ণাঢ্য জীবনের অন্যতম কৃতিত্ব বহনকারী ছিলেন তিনি।
হাদিদকৃত অসংখ্য স্থাপত্য-প্রকল্পের মধ্যে উল্লেখযোগ্য ২০১৩ সালের চীনের চাংশা মেইশিহু ইন্টারন্যাশনাল কালচারাল সেন্টার, চীনের বেইজিংয়ে গ্যালাক্সি সোহো, ২০১২-এ আজারবাইজানের বাকুতে হায়দার আলিয়েভ সেন্টার, অস্ট্রিয়ার ইনসব্রুক শহরে নর্দপার্ক রেলওয়ে স্টেশন, হংকংয়ের ইনোভেশন টাওয়ার, ১৯৯৭ সালে কাতারের দোহাতে মিউজিয়াম অব ইসলামিক আর্টস, ১৯৯৭ সালে ম্যাক্সি/ন্যাশনাল মিউজিয়াম অব কনটেম্পোরারি আর্টস যেটি ইতালির রোমে হয়েছে। এছাড়া ১৯৯১-এ দি হেগ, নেদারল্যান্ডসে দি হেগ ভিলাজ, ১৯৯৫-এ ইংল্যান্ডের বার্মিংহামে ব্লুপ্রিস্ট ভিলা, ১৯৯৯-এ জার্মানির ওলফসবার্গে ফায়েনো সায়েন্স সেন্টার Ñ এরকম সব প্রকল্পে তাঁর সৃষ্টিশীলতার উজ্জ্বল স্ফুরণ দেখা যায়।
হাদিদ তাঁর কাজের মধ্য দিয়ে শহরের সামাজিক জীবনে পুনর্নগরায়ণ এবং তার স্ফুরণ স্থাপত্য ব্যবহার দ্বারা প্রকাশিত হবে এটাই বিবেচ্য, ব্যক্তিগত শৈল্পিক প্রকাশ বা নিজস্ব ইচ্ছার প্রদর্শন নয়। এটাই একবিংশ শতাব্দীর প্রধানতম বৈশিষ্ট্য। ভবন এবং তাঁর কর্মসূচি ও উদ্দেশ্য একে অপরকে ঋদ্ধ করে সবকিছু নিয়ে গড়ে উঠতে সাহায্য করবে, এটার জন্য দরকার স্থানিক জটিল যৌগিকতা এবং উন্মুক্ততা। তিনি এই বলে শেষ করেছেন যে, তাঁর সব প্রকল্প বেসরকারি বা সরকারি যা-ই হোক, এভাবে এটি সংযুক্তিকরণ প্রক্রিয়াজাত জীবনবোধ বৃদ্ধি ও নিরাপত্তার
উজ্জীবন-প্রত্যাশী এবং তার সহায়ক শক্তি হিসেবে সৃষ্টি করার চেষ্টায় নির্মিত।
তাঁকে বলা হয়েছিল, কেন তিনি লন্ডনের নাগরিকত্ব নিয়ে স্থায়ী উদ্বাস্তু হয়ে বাস করছেন? উত্তরে হাদিদ বলেন, লন্ডন বসবাসের জন্য খুব প্রয়োজনীয় একটি নগর। বিশেষ করে স্থাপত্যের বাস্তব নির্মিতি, আনুষঙ্গিক কাঠামো বিষয়ে লন্ডনের নির্মাণ বা পুরকৌশলীগণ অতি উত্তম এবং তাঁর আপাত জটিল স্থাপত্য নকশার বাস্তব রূপ তাঁরাই সহজে সম্পাদন করেন।
হাদিদের স্থাপত্যকর্মকে তাঁর অনুরাগীরা ফ্যান্টাসম্যাগোরিক্যাল (Phantasmagorical), বিহিমোথস (Behemoths) এবং লিভাইঅ্যাথনস (Leviathans) হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন। তাঁর স্থাপত্যসৃষ্টি রহস্যময় মঙ্গলগ্রহজাত জীবনের চেয়ে বড় এরকম প্রবচনের। সেই সৃষ্টি পদার্থবিদ্যার সূত্র এবং মানুষের সীমানার বাইরে নিয়ে যাওয়ার প্রশ্নকে লঙ্ঘন করে তোলে।
জাহা হাদিদের কতগুলো বিখ্যাত স্থাপত্য-প্রকল্প সম্বন্ধে আলোচনা করা যায়, সংক্ষেপে, তাঁর কাজ বুঝতে। চাংশা মেইশিহু ইন্টারন্যাশনাল কালচারাল সেন্টার, যেটি চীনে চাংশা নগরীর মেইক্সি হ্রদের পাশে বিশাল এক ফুলের মতো মনোমুগ্ধকর পাপড়ি মেলে বহুধাবিস্তৃত। ২০১৩ সাল থেকে এটি একটি গ্র্যান্ড থিয়েটার আর্ট মিউজিয়াম ও একটি বহুরকম ব্যবহারের জন্য মিলনায়তন নিয়ে স্থাপিত। সম্পূর্ণ সাইট জুড়ে ভবনের বহুরৈখিক বক্রতা নিয়ে কেন্দ্র থেকে ব্যাসার্ধের দূরত্ব বিভিন্ন হওয়ায় পরিধির সর্পিলতা ও গতিময়তায় সব একীভূত গঠনে নির্মিত, যা দর্শক ও ব্যবহারকারীদের চমৎকৃত এবং আকৃষ্ট করে তুলতে সাহায্য করে। গ্যালাক্সি সোহো চীনের বেজিংয়ে স্থাপিত এক বিশাল মল বা বিপণিবিতান, যা পূর্ণাকার দৃষ্টিবিভ্রমকারী সর্বদা পরিবর্তিত গতিময় চিত্রানুপাতে নির্মিত স্থাপনা, যেটি পাঁচটি গোলাকার ভবন একাঙ্গীভূত হয়ে সবুজ নিসর্গের মধ্যে এক সাংস্কৃতিক বলয় সৃষ্টি করেছে। সচরাচর যেমন সব শপিংমল আমরা দেখতে অভ্যস্ত, তার চেয়ে অভিনব ও নতুন উপভোগ্য অভিজ্ঞতার সন্ধান পাওয়া যায় এই নির্মিতিতে। আজারবাইজানের বাকুতে হায়দার আলিয়েভ সেন্টার একটি মিলনায়তন, গ্যালারি হল এবং একটি জাদুঘর নিয়ে ২০১২ সালে উদ্বোধিত হয় এই সংস্কৃতি-ভবন। অনুরাগীরা এই স্থাপনাকে বরফাচ্ছাদিত অশ্বারোহীদের শোভাযাত্রাসদৃশ মিছিল, যেখানে ধারালো কৌণিকতার বদলে সবকিছু ছন্দায়িত ঢেউয়ে প্রকাশিত, এমন আখ্যায়িত করেছেন। অগ্রসরিত কম্পিউটার প্রযুক্তির ব্যবহারে এই প্রকল্পে বিশাল মুক্ত অভ্যন্তরীণ পরিসর সৃষ্টির জন্য কংক্রিট কাঠামো ও স্টিল বা ধাতুযোগে স্পেস ফ্রেম সহকারে বাঁকানো বুট কলাম এবং ডাভটেল বা পায়রার পুচ্ছ-পালকের মতো সূচালো বিস্তারে ক্যান্টিলেভার বিম বা কড়িকাঠ যোগ করে বাইরের প্রবহমানতাকে কাঠামোগত সমাধানে যুক্ত করা হয়েছে। বাইরের প্রসারিত ও বহুকেন্দ্রিক পারস্পেকটিভ বা পরিপ্রেক্ষিতে রচিত বহমান আচ্ছাদন গ্লাস ফাইবার রিইনফোর্সড কংক্রিট (জিএফআরসি) এবং গ্লাসফাইবার রিইনফোর্সড পলিয়েস্টার (জিএফআরপি) নির্মাণ-উপাদান দিয়ে নির্মিত। এই ভবনের স্থাপত্য আয়োজনে ভবনের তল বা স্তর যদি সংগীত হয়, তাহলে প্যানেল বা পাটাতনের জোড়গুলো হবে সংগীতের দোলা, যেগুলো ভবনের কাঠামো থেকে সমতলের নিসর্গ রচনাতেও প্রবাহিত হয়েছে অপূর্ব লালিত্যে। অস্ট্রিয়ার কুয়াশাঢাকা পর্বতবাহিত ইনসব্রুক শহরের চারটি রেলস্টেশনকে একটি ছাউনিতে নিয়ে নর্থপার্ক রেলওয়ে স্টেশন ব্যাঙের ছাতাসদৃশ খিলান আবৃত হয়েছে, যা সবাইকে আশ্চর্যান্বিত করে তোলে। তাঁবুর মতো বাঁকানো আচ্ছাদনে আলগাভাবে ঝুলন্ত স্থাপনাটি চতুর্দিকের ভবনগুলোর মধ্যে ব্যতিক্রমী হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। হংকংয়ের ইনোভেশন টাওয়ার জাহা হাদিদের তরল আঙ্গিক নির্মিতি থেকে আরো কয়েক ধাপ এগিয়ে একটি নির্জনতার দুর্গকে বাস্তবায়িত করার চেয়ে কোনো অংশে কম নয়। আগামদৃষ্টিসম্পন্ন ভবিষ্যৎমুখী জ্যামিতিনির্ভর কৌণিক বক্রতা নিয়ে আঁভা গার্দ ভাবনাযুক্ত ভবনটি বিস্ময় সৃষ্টিকারী চমকে নির্মিত হয়েছে। শূন্যে ঝুলন্ত সর্পিল আঁকাবাঁকা শরীরের অংশের মতো হাদিদের নকশাকৃত ভবনগুলো সবাইকে বিস্মিত করে তোলে। জাহা হাদিদের আর একটি প্রকল্প বিশেষভাবে উল্লেখ করার দাবি রাখে, সেটা হচ্ছে কম্বোডিয়ার নমপেনে বোয়াং ত্রাবেক উচ্চ বিদ্যালয় চত্বরে নির্মিত সøুক রিথ ইনস্টিটিউট, যেটি দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার সর্ববৃহৎ গণহত্যা স্মৃতিরক্ষাকারী ভবন, যেখানে গণহত্যাবিষয়ক দলিল, স্মৃতিচিহ্ন, দ্রব্যাদি, বস্তুসামগ্রী রাখার ব্যবস্থা বিদ্যমান। এই ইনস্টিটিউটটি মানবাধিকার রক্ষণ ও গবেষণাকর্মী ইয়ুক ছ্যাং, যিনি খেমাররুজ আমলের গণহত্যা সম্বন্ধে, সেই অমানবিক অত্যাচার, হত্যা, ধর্ষণ, নিপীড়নের প্রতিফলন, অপনোদন ও পুনরায় সমন্বয়সাধন করার মধ্য দিয়ে ভবিষ্যৎমুখী শিক্ষা ও গবেষণা করার উদ্দেশ্যে ভুক্তভোগী নিবেদিতপ্রাণ, তিনিই এটির প্রতিষ্ঠাতা। ইনস্টিটিউটটি পাঁচটি কাঠের কাঠামোর স্থাপনা নিয়ে গঠিত; নিচতলায় যেগুলো পৃথক কিন্তু ওপর থেকে যেগুলো যুক্ত হয়ে বিরাজ করছে। তিন থেকে আটতলা উঁচু স্থাপনায় গণহত্যাবিষয়ক বিশাল সংগ্রহ নিয়ে পাঠাগার, গণহত্যা ও মানবাধিকার সম্বন্ধে পড়াশোনা করার জন্য একটি স্নাতকোত্তর বিদ্যালয়, একটি গবেষণাকেন্দ্র, একটি আর্কাইভ, একটি মিডিয়া কেন্দ্র এবং ইনস্টিটিউট ও সারা অঞ্চলের জন্য একটি মিলনায়তন Ñ এসব সুবিধা রাখা হয়েছে। এই নির্মাণাধীন ভবনের উন্মুক্ত জায়গায় একটি নিসর্গরচনায় পার্ক, সবুজ বৃক্ষ, ফুল, ফল, ঘাস, ফোয়ারা, ভাস্কর্য উদ্যান দিয়ে নাগরিকদের ইতিহাস সংস্কৃতি ও সামাজিক দায়িত্ব এবং তা রক্ষার উদ্দেশ্যে সচেতনতা সৃষ্টির চেষ্টা করা হয়েছে। কম্বোডিয়ার দারুশিল্পের উন্নত ও পরিশীলিত সৃষ্টিশৈলী ব্যবহারের উদ্যোগকে উৎসাহিত এবং ঐতিহ্যপূর্ণ সংস্থাপনে ভবনটিতে দেশের জলবায়ু, বৃষ্টি, রোদ, বন্যা Ñ এসব নিয়ে চিন্তা করা হয়েছে। সৌরশক্তি, জলশক্তি ও বায়ুশক্তির ব্যবহার নিশ্চিত করে ভবনটির আবরণ ও গঠনে দৈশিক ঐতিহ্যের ছাপ, নকশা এবং আকারের রূপ দেওয়া হয়েছে, যা স্থাপত্যশিল্পে খুবই গুরুত্ববহনকারী ও প্রশংসনীয় দেশজ এবং প্রাকৃতিক শক্তির ব্যবহার সম্বন্ধীয় প্রগতিশীল একটি উদ্যোগ বলে চিহ্নিত। এই পরিপ্রেক্ষিতে মনে হয়, আমাদের দেশেও সেরকমভাবে মুক্তিযুদ্ধ ও গণহত্যাবিষয়ক কার্যকরী শিক্ষায়তন, পাঠাগার, জাদুঘর ও গবেষণাকেন্দ্র নিয়ে একটি ইনস্টিটিউট স্থাপন করা যেতে পারে।
বিশেষজ্ঞরা বলেছেন, হাদিদ ভবিষ্যতের চেহারা তাঁর নকশাকৃত ভবনের মধ্য দিয়ে দেখার ক্ষমতা বিরলসংখ্যক ব্যক্তির মধ্যে একজন। আরো বলা হয়েছে, পৃথিবীতে একেবারে নতুন কিছু সৃষ্টি করা কঠিন, এর মধ্যে যতটা নতুন করা সম্ভব ততটাই হাদিদ করে দেখাতে সমর্থ হয়েছেন। আরো উল্লেখ্য, সৃষ্টিশীল স্থপতিদের কাছে একটি শিক্ষণীয় উদাহরণ হিসেবে এমন প্রমাণ করেছেন একটি গ্রহণযোগ্য আদর্শিক সূত্রের মতো যে, নিজের চিন্তাভাবনা নিয়ে স্বাধীনভাবে কিছু তৈরি করতে গেলে তাঁকে একটি নিজস্ব কার্যালয় স্থাপন করে তাঁর অনুসারী সহযোগীদের নিয়ে এগোতে হবে। এই কার্যপদ্ধতিতে অন্য পেশা বা ব্যক্তির অযৌক্তিক বিরূপ অশালীন হীনম্মন্যতাসুলভ আমলাতান্ত্রিক সমালোচনা বা অসহযোগিতা তাঁর সৃষ্টকর্ম পদ্ধতির স্বাভাবিক বিকাশ ও রূপায়ণে বাধার সৃষ্টি করে বেড়ে উঠতে দেয় না, যা খুব ক্ষতির কারণ হয়ে দেখা দেয় এবং এটা স্থাপত্যপেশায় কখনো গ্রহণীয় হতে পারে না। তাই দেখা যায়, হাদিদ একজন আরবীয় অভিবাসী বা প্রবাসী নারী স্থপতি হয়ে এক বিশাল সংকল্প ও দৃঢ় মনোবল নিয়ে একাকী নিজের মতো একটি স্বাধীন অফিস স্থাপন করে তাঁর নিজস্ব সহকর্মীদের সঙ্গে নিয়ে অসীম সাহসিকতা, ব্যক্তিত্ব এবং স্থির লক্ষ্যে স্থাপত্যকর্মের অভিনব রহস্যময়, অসৃষ্টপূর্ব সৃষ্টিশীলতার অতল সৌন্দর্যগুহায় ঝাঁপিয়ে পড়লেন। হাদিদের স্থাপত্যকীর্তি একটির সঙ্গে আরেকটির ভিন্নতায় নির্মিত এবং ভাস্কর্যশিল্পের সঙ্গে তার মিল খুঁজে পাওয়া যায়। এ অ্যান্ড এ স্কুলে তাঁর শিক্ষক ছিলেন রেম কুলহাস, বার্নার্ড শুমি, লিও ক্রিয়ার প্রমুখ বিখ্যাত স্থপতিবিদ বিশেষজ্ঞ। বলা হয়ে থাকে, সেই শিক্ষকই শ্রেষ্ঠ ও উঁচুমানের, যিনি ছাত্রকে সর্বদা অনুপ্রেরণা জুগিয়ে নিরন্তর উৎসাহ দিয়ে থাকেন। কুলহাস তেমনি ছিলেন। তবে লিও অন্যরকমের যিনি মনে করতেন, নতুন যা তা সব আগেই করা হয়ে গেছে। তার চেয়ে অভিনব আর করা যায় না তাই নতুন সৃষ্টির চেষ্টা সময়ের অপচেষ্টা। এসবের মধ্য দিয়ে হাদিদের নতুনত্ব সৃষ্টির যাত্রা শুরু হয় এবং তা আন্তর্জাতিক স্থাপত্য প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণের মাধ্যমে। ১৯৭৭ সালে পড়াশোনা শেষ করে হাদিদ মেলভিচের ইউক্লিডীয় জ্যামিতির বিপরীতে সুপ্রিম্যাটিজম আর্কিটেক্টনিক রীতি অনুযায়ী ১৪ তলা একটি হোটেলের নকশা করে পুরস্কৃত হন, যদিও তা কোনোদিন নির্মিত হয়নি। তবে তা স্থাপত্যজগতে আলোড়ন সৃষ্টি করে। তখন থেকেই হাদিদের পথচলা শুরু হয়ে আর থেমে থাকেনি। তাঁর জীবনের প্রথম প্রধান প্রকল্প সিনসিনাটির সেন্টার ফর কনটেম্পোরারি আর্ট ১৯৯৭-এ শুরু হয় এবং শেষ হয়নি। তেমনি ১৯৮৩ সালে হংকংয়ে পিক প্রজেক্টের বেলায় প্রতিযোগিতায় প্রথম পুরস্কার পেয়েও আলোর মুখ দেখেনি। ২০১২ সালে টোকিওতে জাতীয় অলিম্পিক স্টেডিয়াম, যেটা ২০২০ সালের গ্রীষ্মকালীন অলিম্পিকের জন্য নির্মিত হওয়ার কথা, তার প্রাক্কলন ব্যয় বেড়ে যাওয়ায় হাদিদকে বদলিয়ে অন্য কাউকে জাপানের প্রধানমন্ত্রী দ্বারা নির্দেশিত হয়ে দেওয়া হয়। এরকম বহু নাটকীয় স্থাপত্য-ঘটনায় হাদিদের সৃষ্টিশীল জীবন ভরপুর। তাঁর কাজ পৃথিবীজুড়ে আরম্ভ হয়েছিল, যেমন Ñ যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, জার্মানি, আজারবাইজান, অস্ট্রিয়া, অস্ট্রেলিয়া, স্পেন, ডেনমার্ক, সিঙ্গাপুর, লেবানন, স্কটল্যান্ড, ফ্রান্স, চীন, কম্বোডিয়া, ইরাক, বেলজিয়াম, ইতালি, সাইপ্রাস, মেক্সিকো, রাশিয়া, রোমানিয়া, তাইওয়ান, কাতার Ñ এসব দেশে। তাঁর কাজের বহু সমালোচনা পাওয়া যায়, যেমন Ñ ভীষণ ব্যয়সাপেক্ষ, জটিল, শূন্য কলসের মতো সবকিছুকে গ্রাস করে ফেলে, রাশিয়ার একনায়কত্ববাদ অনুসারে তৈরি আলিয়েভ কেন্দ্র ইত্যাদি। তাঁর ভবন মানুষকে ভীত, সংশয়ী ও বিহ্বল করে তোলে, এই অনুযোগের উত্তরে হাদিদ বলেছেন Ñ হ্যাঁ, তাই মানুষ যা দেখে অভিভূত হয়, যেমন পাহাড়-পর্বত, নিসর্গ বা পার্কে গিয়ে যা দেখে তিনি সেরকমটিই চান। ৫৪ তলা অফিস ভবন অস্ট্রেলিয়ার মেলবোর্নে হাদিদ কতগুলো ফুলের টব একটির পর একটি সাজিয়ে, রোমানিয়ার ডেরোবান্টি টাওয়ার এক বিশাল আলম্ব লোহার খাঁচা, কোনোটা দ-ায়মান নারীর বাঁকানো দেহবল্লরীর মতো নানা ভঙ্গিতে ভবনের রূপ দিয়েছেন অভিনবতায় যেন পোশাক পরানো। তাই দেখা যায়, পোশাক বা সংগীতজগতের বা আসবাবপত্র গহনা যে-কোনো শিল্পের সঙ্গে হাদিদের সমন্বয় করতে। পোশাকশিল্পে কার্ল লাগার ফেল্ডের সঙ্গে তিনি জড়িত ছিলেন, তেমনি তাঁকে গায়িকা লেডি গাগার মতো স্থাপত্যের লেডি গাগা বলেও অভিহিত করা হয়। সবকিছু নিয়ে জাহা হাদিদ অনন্য ও অনুপম। তিনি বদ্ধ
স্থাপত্য-জ্যামিতিকে মুক্ত করে টুকরো করে সচল তরলতায় রূপ দিতে পেরেছিলেন, যা ঝঞ্ঝাময় আধুনিক নাগরিকজীবনের প্রতিভূ। হাদিদের কাজের শৈলীটা কী Ñ এমন প্রশ্ন করলে তিনি বলেন, শৈলীটা হলো কাজের মধ্য দিয়ে সৌন্দর্যের চূড়ান্ত পর্যায় বা
উৎকর্ষ খুঁজে পাওয়ার প্রক্রিয়া, ব্যক্তিগত ঐকান্তিকতা ও
গবেষণা-অনুসন্ধিৎসাই মূল বিবেচ্য বিষয় আর নিজের কাজে মনোযোগী এবং লক্ষ্যভেদী হতে হবে।
হাদিদ সারাজীবন ধরে একটি সরলরেখাকে ধরতে চেয়েছেন, কীভাবে সেটা একটি ভবনের মধ্যে চালিত হয়ে আলো আর আঁধারের সঙ্গে মিশে লক্ষ্য, উদ্দেশ্য ও দিক বদলায়। মাত্র ৬৫ বছরের জীবনের জীবনশিল্পীর প্রতি গভীর শ্রদ্ধার্ঘ্য।
সূত্র : আর্কিটেক্চারাল রেকর্ড, মে ২০১৬। এনসাইক্লোপিডিয়া উইকিপিডিয়া ও বিভিন্ন পত্রপত্রিকা।