logo

স্থপতি মাজহারুল ইসলাম : সৃষ্টি ও দেশাত্মবোধের সম্মিলন

শা মী ম  আ মি নু র  র হ মা ন

১৯৮০ সালের প্রথম দিকের কোনো একদিন হঠাৎ করেই নামটি শুনেছি। উচ্চ মাধ্যমিক পাস করে স্থাপত্যে ভর্তি হওয়ার আশায় বুয়েটে গিয়েছি। স্থাপত্য ফ্যাকাল্টির নিচতলার খোলা পাকা জায়গাটিতে বসে আলাপ করছিলাম কোনো জ্যেষ্ঠ স্থাপত্যের ছাত্রের সঙ্গে। পরামর্শ চাইছিলাম তাঁর কাছে ভর্তি-সংক্রান্ত বিষয়ে। নানা কথার ফাঁকে বললেন, আমি যেন এদেশে কাজ করেছেন এমন কয়েকজন স্থপতি ও তাঁদের স্থাপত্যকর্মের কয়েকটি উদাহরণ জেনে নিই। উদাহরণস্বরূপ দুজন স্থপতি ও তাঁদের কাজের কথা আমাকে বললেন। একজন হচ্ছেন স্থপতি মাজহারুল ইসলাম ও তাঁর স্থাপত্যকর্ম আর্ট কলেজ এবং লুই আই কান যিনি আমাদের সংসদ ভবনের নকশা করেছেন। এঁদের কারো নাম এর আগে আমার জানা ছিল না। আগে জানার তেমন সুযোগ ছিল না বললেই চলে। এর পর স্থাপত্যে ভর্তি হয়েছি। ছাত্র অবস্থায় তাঁদের স্থাপত্যকর্ম নিয়ে আমাদের প্রিয় শিক্ষক সামসুল ওয়ারেসের কাছে জেনেছি। সামসুল ওয়ারেসের ক্লাস ছিল আমাদের সবার প্রিয়। স্থাপত্য পরিকল্পনার বিভিন্ন দিক, দর্শন, মুখ্য নিয়মনীতি, ডিজাইন থিওরি বিষয়ে তাঁর শেখানো বিষয়গুলো আজো পেশাজীবনে নানাভাবে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে প্রয়োগ করি। প্রথম ও তৃতীয় বর্ষে তিনি বাংলাদেশের আধুনিক স্থাপত্যের বিবিধ দিক তুলে ধরতে স্থপতি মাজহারুল ইসলাম ও স্থপতি লুই আই কানের কথা বারবার বলতেন। আমরা তাঁর কথা মুগ্ধ হয়ে শুনতাম। এসব কথা আমাদের প্রেরণা জোগাতো। বুয়েটের স্থাপত্য ভবনের নিচতলার খোলা জায়গাটুকু ও চারুকলার ভেতরের খোলা অঙ্গনটুকু আমাদের কেন ভালো লাগতো তার একটি তাত্ত্বিক ব্যাখ্যা খুঁজে নিলাম তারই পাঠ থেকে। বুঝতে পেরেছিলাম আমাদের অবচেতন মনে এই ভালো লাগার পেছনে আছে স্থপতির সুচিন্তিত, শৈল্পিক এবং সৃষ্টিশীল স্থাপত্য নির্মাণের প্রয়াস। আছে প্রকৃতির সঙ্গে জড় স্থাপত্যের সংমিলনে যেন প্রাণের সঞ্চার ঘটানোর প্রচেষ্টা। সেই প্রচেষ্টায় স্বাভাবিকভাবেই আমরা হয়েছিলাম একীভূত বা ব্যবহারকারী হিসেবে পুরো সৃষ্টির অংশভুক্ত। ছাত্রাবস্থায় বুঝে নেওয়া ছিল একরকম। আর আজ দীর্ঘ স্থাপত্যচর্চার প্রক্রিয়ার মধ্যে দিয়ে যে উপলব্ধি, তাতে এই মহান স্থাপত্যকর্মের তাৎপর্য আরো ব্যাপক হয়ে ধরা দেয়। তাকে ইতিহাস, সমাজ, দেশ – এসব থেকে আলাদা করে শুধুমাত্র একটি স্থাপত্যকর্ম হিসেবে দেখতে পারি না। তখন মনে হয়, মহৎ সৃষ্টির পরেও আছে তার ব্যাপক অদৃশ্য প্রভাব, যা সুদূরপ্রসারী। স্থাপত্য পাঠ শুরু করতে যে স্থপতি মাজহারুল ইসলামকে জানতাম সে-জানার সঙ্গে আজ দীর্ঘ প্রক্রিয়ার মধ্যে তাঁকে খুঁজে দেখার উপলব্ধির বড় ব্যবধান। স্থপতি মাজহারুল ইসলাম এখন জীবনসায়াহ্নে। তাঁর আবির্ভাবে স্থাপত্যশিল্প ও শিল্পের অঙ্গনে যে সুদূরপ্রসারী প্রভাব পড়েছিল সেই অধ্যায়টুকু বুঝে নিলে তাঁর মহৎ শিল্পীসত্তার একটা পরিচয় পাওয়া যাবে বলে আমার বিশ্বাস। তাঁর শিল্পীসত্তাকে খুঁজতে হলে বাংলাদেশের আধুনিক স্থাপত্যের ইতিহাসটা জানা যেন জরুরি। সে সময়ের কথা কিছুটা তুলে ধরছি।
১৯৪৭ সালে ভারত ভাগের পর আমরা পাকিস্তান পেলাম। এদেশের বাঙালিরা নতুন করে যে স্বপ্ন দেখা শুরু করলো তা শুরুতেই হোঁচট খেল। পাকিস্তানের সংখ্যাগরিষ্ঠ হয়েও আমাদের রাষ্ট্রভাষা বাংলা নয়, হবে উর্দু। আমাদের সমৃদ্ধ জাতিসত্তায় শুরুতেই আঘাত হানা হলো। পূর্ব পাকিস্তানিরা দেখলো, ব্রিটিশদের কাছ থেকে মুক্ত হয়েও আমরা পশ্চিম পাকিস্তানের মুসলিম শাসকদের অধীন একটি প্রদেশ মাত্র। বাঙালির মনে অসন্তোষের যে দানা বাঁধতে থাকলো তা দ্রুত প্রত্যেক বাঙালির মনে বাঙালি জাতীয়তাবাদের সত্তাকে আরো জাগ্রত করেছিল। আর তার মহৎ ও রূদ্র বহিঃপ্রকাশ ঘটলো ’৫২-র ভাষা-আন্দোলনের মধ্যে দিয়ে। আমরা নানাভাবে বঞ্চিত হতে থাকলাম। শিল্প-সংস্কৃতির সর্বক্ষেত্রে এক ষড়যন্ত্র। আরবি হরফে বাংলা লেখানোর চেষ্টা, রবীন্দ্রসংগীত গাইতে না দেওয়া, এমন নানাবিধ কর্মধারায় সমৃদ্ধ বাংলা সংস্কৃতিকে দাবিয়ে রাখার চেষ্টা। কিন্তু বাঙালিরা তা মুখ বুজে মেনে নেয়নি, রাজনৈতিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সকল ক্ষেত্র থেকে এসেছিল প্রতিঘাত, প্রতিবাদ ও বাংলা সংস্কৃতির মূলধারা থেকেই শিল্প সৃষ্টির মাধ্যমে সেসব প্রতিবাদকে আরো এগিয়ে নেওয়া। অন্যান্য শিল্পের তুলনায় স্থাপত্যচর্চার ক্ষেত্রটি ছিল সবচেয়ে নাজুক। পাকিস্তান হওয়ার পর থেকেই পশ্চিম পাকিস্তানে নানা সময়ে রাজধানী পরিবর্তন হতে থাকলো। পরিবর্তনের সঙ্গে একেকটি শহরকে ধরে ধরে তারা আধুনিক শহরে রূপান্তরিত করতে লাগলো। অর্থনীতির বড় অঙ্কের অংশটির জোগান হতে থাকলো এদেশেরই পাট, চা, চামড়া রপ্তানির টাকা দিয়ে। আর তখনো ঢাকা একটি মফস্বল শহর। স্বভাবে তখনো গ্রামীণ ঢাকায় স্থাপত্যচর্চা বা ভবন নির্মাণে কোনোভাবেই যেমন  দেশজ কোনো রীতি অনুসরণ করা হয়নি তেমনি সে-সময়ের আধুনিক স্থাপত্যের আন্তর্জাতিক স্টাইলটিও প্রতিফলিত হয়নি। এর বড় কারণ সে-সময়ে এদেশে ছিল না কোনো প্রশিক্ষিত স্থপতি বা স্থাপত্য শিক্ষার ব্যবস্থা। পাকিস্তান সৃষ্টির পর প্রথম থেকেই পূর্ব পাকিস্তানে বিল্ডিং নির্মাণ কর্মকাণ্ডে যারা ব্যাপ্ত ছিল তাদের প্রায় অনেকেই ছিল কলকাতা-বম্বের টেকনিক্যাল স্কুলের ট্রেনিংপ্রাপ্ত সার্ভেয়র, ড্রাফটসমান বা ট্রেনিংপ্রাপ্ত ডিপ্লোমা প্রকৌশলী। স্থানীয়ভাবে প্রশিক্ষিত স্থপতি না থাকায় পাকিস্তান আমলের প্রথম দিকেই দুজন ব্রিটিশ স্থপতি ১৯৪৮ সালেই পূর্ব পাকিস্তানের (যোগাযোগ, বিল্ডিং ও সেচ) C B & I দফতরে যোগদান করলেন। একজন রোনাল্ড ম্যাককনেল ও অন্যজন এডওয়ার্ড হিকস। এডওয়ার্ড হিকস ব্যস্ত ছিলেন মূলত ঢাকা মাস্টার-প্ল্যান নিয়ে। আর ম্যাককনেল ব্যস্ত হলেন ঢাকায় নানা সরকারি-বেসরকারি বা বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের ভবনের নকশা প্রণয়নে। এডওয়ার্ড হিকস ঢাকার মাস্টার-প্ল্যানের পাশাপাশি বিভিন্ন ভবনেরও নকশা প্রণয়ন করেছিলেন। ১৯৫৯ সালে ঢাকা ছেড়ে যাওয়ার আগে তিনি আজিমপুর হাউজিং, হোটেল শাহবাগ (বর্তমান বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের পুরনো ভবন), নিউমার্কেট, রাজারবাগ পুলিশ ব্যারাকের নকশা প্রণয়ন করেছিলেন। ডিপ্লোমাধারী ম্যাককনেল এডওয়ার্ড হিকসের প্রস্থানের পর ক্রমান্বয়ে সিনিয়র অ্যাসিস্ট্যান্ট আর্কিটেক্ট থেকে সরকারের চিফ আর্কিটেক্টও হয়েছিলেন এবং ১৯৭১ সালের নভেম্বর পর্যন্ত কর্মরত ছিলেন। তিনি সচিবালয়, ভিকারুননিসা নূন স্কুল, হলি ফ্যামিলি হাসপাতালেরও ডিজাইন করেছিলেন। এসব ভবনের নকশা প্রণয়নে লম্বা করিডোর দিয়ে রুমের পর রুম সংস্থান করা হয়েছিল। ব্যবহারিক প্রয়োজন বা চাহিদা মেটানোই ছিল নকশার প্রধান কাজ। স্থানীয় জলবায়ু, নির্মাণসামগ্রী, সংস্কৃতির কোনো ছাপ তাতে ফুটে ওঠেনি। উঠে আসেনি তাতে স্থাপত্যশৈলীর কোনো যুক্তিগ্রাহ্য প্রয়োগ। দেশজ ইটের তৈরি ভবনকে প্লাস্টার দিয়ে ঢেকে দিয়ে তাতে করা হয়েছিল নানা প্রকট রঙের ব্যবহার। পাকিস্তান সৃষ্টির পর পর ঢাকায় অফিস, আদালত, সরকারি আবাসন নির্মাণের প্রয়োজন দেখা দেয়। প্রশিক্ষিত স্থপতি এবং দক্ষ জনবলের অভাব, এমন সুযোগ কাজে লাগিয়ে রাতারাতি অর্থের পাহাড় গড়তে পশ্চিম পাকিস্তান থেকে কিছু ডিপ্লোমাধারী প্রকৌশলী, ড্রাফটসম্যান, চতুর ব্যবসায়ী দ্রুত পূর্ব পাকিস্তানে খুলে বসলো নানা উপদেষ্টা ফার্ম। প্রশাসন ও শাসকদের তুষ্টি সাধন করতে তাদের ফরমায়েশ মতো গড়ে তুললো অতীতমুখী ইসলামিক স্থাপত্যের নামে অন্ধ অনুকরণ ও বিক্ষিপ্ত কিছু তথাকথিত ইসলামিক উপাদানের সংযোজনে স্থান-কালের সঙ্গে সম্পর্কহীন কিছু ইমারত। আবার এমন কিছু ভবন তারা তৈরি করলো যা নিছক পশ্চিম দুনিয়ার বিভিন্ন ভবনের বিভিন্ন অংশবিশেষ জুড়ে দিয়ে নির্মিত তা সহজেই বোধগম্য।
এই সকল ভবনকে আকর্ষণীয় করতে আমজনতার রুচিকে তৃপ্তি দিতে তারা সংযোজন করেছিল নানা ব্যয়বহুল নির্মাণ, চোখ ঝলসাতে ভবনের বাহির ও ভেতরের দেয়ালে করা হয়েছে ব্যয়বহুল নির্মাণসামগ্রীর অবিবেচিত ব্যবহার। বাংলাদেশের নিজস্ব ঐতিহ্য, এদেশের জলবায়ু, নির্মাণ উপকরণ প্রভৃতিকে তাদের সৃষ্টিতে কখনো ঠাঁই দেওয়া হয়নি। সে যোগ্যতাই তাদের ছিল না। ঢাকা ও বাংলাদেশের সর্বত্র শত শত ভবনের নকশা করেছিল এই সব ফার্ম, যা আধুনিক স্থাপত্যের মানদণ্ডে
ইট-কংক্রিটের জঞ্জাল ছাড়া কিছুই নয়। দুর্ভাগ্যজনক হলেও এটাই সত্য, সে-সময়ের ব্রিটিশ সরকারি স্থপতি বা পরের দিকের এই সকল ফার্মের কোনো কাজই সে-সময়ের প্রচলিত আধুনিক স্থাপত্যের আন্তর্জাতিক ধারার কোনো ছাপ বা চর্চার প্রয়াস এ-সকল বিল্ডিংয়ে প্রতিফলিত হয়নি। যদিও ইউরোপের সর্বত্র বিশের দশকেই আধুনিক স্থাপত্যের আন্তর্জাতিক রীতির চর্চা শুরু হয়েছিল, কিন্তু পূর্ব পাকিস্তানে পঞ্চাশের দশকের মধ্যবর্তী সময় পর্যন্ত এর কোনো ছাপ এদেশের মাটিতে পড়েনি। বিক্ষিপ্ত, ঐতিহ্যহীন, স্থান-কালবিচ্যুত স্থাপত্যচর্চার এমন আকাল এর মধ্যেই, চরম খরায় যেমন অপেক্ষমাণ ধরণী এক পশলা বৃষ্টিতে প্রাণ পায় তেমনি স্থাপত্যচর্চার ঘোর অন্ধকারাচ্ছন্ন অঙ্গনে এক ঝলক আলো হয়ে আবির্ভূত হলেন স্থপতি মাজহারুল ইসলাম।
দেশে ও বিদেশে প্রশিক্ষিত ডিগ্রিধারী আধুনিক ধারায় শিক্ষিত এই স্থপতি তাঁর প্রথম সৃষ্টিতেই সূচনা করলেন আমাদের স্থাপত্য ইতিহাসে এক নতুন অধ্যায়। পঞ্চাশের দশকের মাঝামাঝি বর্তমান চারুকলা ইনস্টিটিউট ভবন এবং পাবলিক লাইব্রেরির (বর্তমানে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় গ্রন্থাগার) স্থাপত্য নকশা প্রণয়নের মধ্যে দিয়ে এদেশে আধুনিক ধারার প্রবর্তন তিনিই এককভাবে  করেছিলেন। তিনি যথার্থভাবেই পশ্চিমা ধারণার আধুনিক স্থাপত্যের সঙ্গে এ অঞ্চলের জনগণের আকাক্সক্ষা, এদেশীয় পরিচিত নির্মাণ উপকরণ, আমাদের অতি চেনা উঠান, বারান্দা ইত্যাদির সঙ্গে যে সৃষ্টিশীল সমন্বয় করেছিলেন তার উজ্জ্বল উদাহরণ এই চারুকলা ভবন। চারুকলা প্রাঙ্গণের মধ্যে লন যেন ভবনের সঙ্গে সাধারণভাবেই মিশে গিয়ে ভবনেরই একটি অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ হয়ে দাঁড়ায়। করিডোরে আলো-ছায়া, কাঠের লুভার, লাল ইটের ব্যবহার একেবারেই যেন দেশজ। নকশা প্রণয়নের আগে তিনি এই স্থানের প্রতিটি গাছ, পুকুর চিহ্নিত করে তা তাঁর সৃষ্টিতে সমন্বয় করেছিলেন। পুরো স্থাপনায় পুকুর, গাছ, উঠোন, ভবন পরস্পরের সঙ্গে অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িত। ভূমির স্বরূপ, জলবায়ু, সংস্কৃতি, সমাজদর্শন তাঁর আধুনিক স্থাপত্যে যুক্ত হয়ে তা করেছে অনন্যসাধারণ, দেশজ – একই সঙ্গে আন্তর্জাতিক।
তাঁর এই পরিকল্পিত সৃষ্টির পরবর্তী সুদূরপ্রসারী প্রভাব আজো আমরা উপলব্ধি করতে পারি, যখন দেখি বাঙালি সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডের অনেক কিছুই এই ভবনকে ঘিরে। একুশ, বাংলা নববর্ষে এই বিদ্যাপীঠের ভূমিকা আমাদের অজানা নয়। পুরো স্থাপনার পরিকল্পিত সৃষ্টি করা পরিবেশটাই যে এর জন্য অনেকখানি দায়ী তা অস্বীকার করি কীভাবে?
শুধু নিজেকে নিয়ে মগ্ন ছিলেন না তিনি। এই দুর্ভাগা দেশে মানুষ নতুন সৃষ্টিধর্মী মহৎ স্থাপত্যের সঙ্গে পরিচিত হবে, নতুন ধারায় স্থাপত্যচর্চা শুরু হবে এদেশে – এ-ভাবনা থেকেই তিনি নিজে উদ্যোগ নিয়ে বিদেশি অনেক স্বনামধন্য স্থপতিকে এদেশে কাজ করার জন্য আমন্ত্রণ জানিয়েছিলেন। তাঁর পথ অনুসরণ করে পরের দিকে অনেক ফার্ম ও বিদেশি কিছু স্থপতিকে এদেশে নিয়ে আসে। মাজহারুল ইসলাম ঢাকায় আমন্ত্রণ জানিয়ে নিয়ে আসেন বিশ্বখ্যাত স্থপতি পল রুডলফকে কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের ডিজাইন করার জন্য। মাজহারুল ইসলাম বাংলাদেশের পাঁচটি পলিটেকনিক ইনস্টিটিউটের নকশা প্রণয়ন করেছিলেন মিলিতভাবে মার্কিন স্থপতি স্টানলি টাইগারম্যানের সঙ্গে। স্থপতি রবার্ট বুই ও ড্যানিয়েল ডানহাম কমলাপুর রেলস্টেশনের ডিজাইন করেছিলেন। বরার্ট বুইয়ের ময়মনসিংহ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের হোস্টেল ও ক্লাব হাউস, বুয়েটের তিনটি ছাত্রাবাস, সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং বিল্ডিং, জিমনেসিয়াম ভবন, নটর ডেম কলেজের ব্রাদার্স হোস্টেল, সেন্ট জোসেফ স্কুল তাঁর উল্লেখযোগ্য কাজ। স্থপতি কনস্টানটাইন ডক্সিএডিস ডিজাইন করেছিলেন কুমিল্লার বিখ্যাত বার্ড কমপ্লেক্স, ঢাকার হোম ইকোনমিকস কলেজ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের টিএসসি কমপ্লেক্স; যা আধুনিক স্থাপত্য সৃষ্টিতে আমাদের জলবায়ুর বিবেচনায় এক নতুন সম্ভাব্য পথ দেখিয়েছিল। বুয়েটের স্থাপত্য ভবনটির নকশা করেছিলেন স্থপতি ভ্রুম্যান। স্থপতি মাজহারুল ইসলাম বিশ্বাস করতেন, আধুনিক ধারায় এদেশে স্থাপত্যচর্চার প্রসার ঘটাতে হলে চাই এদেশের মাটিতেই আধুনিক স্থাপত্যের কিছু উৎকৃষ্ট উদাহরণ। আর তাই এই সকল উৎকৃষ্ট উদাহরণ পরবর্তী সময়ে এদেশের স্থপতিদের করেছিল অনুপ্রাণিত। এটাই এখন প্রতিষ্ঠিত সত্য যে, আধুনিক স্থাপত্যের আন্তর্জাতিক রীতির এদেশীয় উৎকৃষ্ট স্থাপত্য সৃষ্টি খুঁজতে হলে মাজহারুল ইসলামসহ ওই সকল বিদেশি স্থপতির কাজের দিকেই দৃষ্টি দিতে হবে।
এই মহান স্থপতি আরেকটি মহৎ কাজ করেছিলেন এদেশের মানুষের জন্য। সেটি উল্লেখ করবার আগে প্রবাসে থাকাকালীন বর্তমান লেখকের একটি ঘটনা উল্লেখ করতে চাই। ২০০৪-এর শেষ দিকে কানাডার অটোয়ায় অবস্থিত বাইটাউন থিয়েটারের স্থপতি লুই আই কানের ওপর নির্মিত চলচ্চিত্র মাই আর্কিটেক্ট দেখছিলাম। সঙ্গে ছিল আমার এক সহপাঠী বন্ধু ব্রান্ডন। হলভর্তি দর্শক। চলচ্চিত্রটি নিয়ে তখন পত্রপত্রিকায় লেখালেখি চলছিল। আমাদের সংসদ ভবনের স্থপতি লুই আই কানের ছেলের করা চলচ্চিত্রে প্রয়াত বাবাকে নিয়ে তার একটি জিজ্ঞাসা, তাঁর সৃষ্টিকে বুঝতে চাওয়া নিয়েই চলচ্চিত্রটি। তাঁর প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে তিনি বিভিন্ন দেশে বিভিন্ন মানুষ যাঁরা লুই আই কানকে জানতেন তাঁদের সঙ্গে কথা বলেছেন। ঘুরে দেখেছেন লুই আই কানের করা স্থাপত্যকর্ম। এই স্থপতির সর্ববৃহৎ ও সর্বশ্রেষ্ঠ কাজটি দেখতে শেষে ঢাকায় এসেছিলেন। আর এখানেই তিনি খুঁজে পেয়েছিলেন তাঁর সম্ভাব্য উত্তরটি। চলচ্চিত্রে শেষ পর্যায়ে বাংলাদেশের মানুষের সঙ্গে কথা বলছিলেন। বলছিলেন আমার প্রিয় শিক্ষক স্থপতি সামসুল ওয়ারেসের সঙ্গে। এই সংসদ ভবনেরই ভেতরে দাঁড়িয়ে সামসুল ওয়ারেস দিয়েছিলেন লুই আই কানের পুত্রের খুঁজে ফেরা প্রশ্নের সম্ভাব্য উত্তরটি। হলভর্তি দর্শক দেখলো বিশ্বের বিখ্যাত স্থপতির শ্রেষ্ঠ কাজটি বাংলাদেশেই। কাজটির বিশালতা ও ব্যাপকতা কিছুটা হলেও অনুধাবন করলো সেদেশের দর্শকরা। নানা জনে স্থানে ঘুরে এই দেশের মানুষের কাছেই তিনি পেলেন উত্তর। আমি বাংলাদেশের মানুষ, তাই ব্রান্ডন আমার পিঠ চাপড়ে দিলেন। হলের দর্শকরা মন্ত্রমুগ্ধের মতো চলচ্চিত্রটি উপভোগ করেছিল। হল থেকে বেরিয়ে বাড়ি ফেরার পথে ভাবছিলাম, স্থপতি লুই আই কান আমাদের দেশের স্থপতি নন। তবুও এই বিখ্যাত মানুষটির শ্রেষ্ঠ কাজটি আমাদের দেশে বলে আমি গর্ববোধ করছি। আজ এই গর্ববোধের পেছনে নেপথ্যে যে মহান মানুষটির এক বড় ত্যাগ রয়েছে তাঁর কথা স্মরণ করতেই শ্রদ্ধায় আনত হই। তিনি মাজহারুল ইসলাম। ১৯৬১ সালে তৎকালীন পাকিস্তান সরকার ঢাকায় একটি ‘দ্বিতীয় রাজধানী কমপ্লেক্স’ নির্মাণের পরিকল্পনা গ্রহণ করে। কেন্দ্রীয় পূর্তমন্ত্রী স্থপতি মাজহারুল ইসলামকে এই দায়িত্ব অর্পণ করলেন। তিনি সে-সময়ে বিদেশি দুজন স্থপতি নিয়ে চিন্তাভাবনা শুরু করলেন। কাজ শুরুর প্রথম দিকে তাঁর মনে হলো এমন একটি বৃহৎ ‘প্রজেক্টের ডিজাইন ও বাস্তবায়নে বিশ্বের একেবারে প্রথম সারির কোনো স্থপতিকে জড়াতে পারলে এদেশে আধুনিক স্থাপত্যের এক বিরাট দ্বার উন্মোচিত হবে।’ এই সময় ফ্রান্সের বিখ্যাত স্থপতি লি কর্ব্যুসিয়ার ভারতের পাঞ্জাবের নতুন রাজধানী শহর চণ্ডীগড় নির্মাণ করছিলেন। তিনি দ্রুত বিষয়টি নিয়ে পূর্তমন্ত্রীর সঙ্গে আলাপ করে তাঁকে রাজি করালেন এবং বিশ্বের সে-সময়ের বিখ্যাত তিনজন স্থপতির সঙ্গে ক্রমান্বয়ে যোগাযোগ করলেন। কর্ব্যুসিয়ার রাজি হলেন না। আলভার আলতো তখন বেশ বৃদ্ধ। তাই তাঁর পক্ষেও আসা সম্ভব হলো না। এলেন লুই আই কান। কান কাজটি অত্যন্ত গুরুত্বের সঙ্গে নিলেন আর আধুনিক স্থাপত্যের শ্রেষ্ঠতম কাজের একটি আমাদের উপহার দিলেন। নিজ দেশের সংসদ ভবন বা দ্বিতীয় রাজধানীর স্থাপত্য পরিকল্পনা ও ডিজাইন করার সুযোগ বিশ্বের কজন স্থপতির ভাগ্যে লেখা থাকে? কোন স্থপতি এমন দুর্লভ সুযোগ হাতছাড়া করেন যখন এমন একটি কাজের জন্য স্মরণীয় হয়ে থাকা সম্ভব! স্থপতি মাজহারুল ইসলাম পেরেছিলেন। পেরেছিলেন দেশপ্রেমের জন্য। দেশের প্রতি, দেশের মানুষের প্রতি ভালোবাসার অমোঘ টানে বিরল সম্মানপ্রাপ্তি ঠেলে দিয়ে নেপথ্যে থেকে এক মহান সৃষ্টির ক্ষেত্র তৈরি করেছিলেন। তাই তো বিশ্বের শ্রেষ্ঠ স্থাপত্যকর্মের একটি বাংলাদেশে হওয়ায় আমরা গর্বিত।
আমার এ লেখা এই মহান স্থপতির সৃষ্টির চুলচেরা তাত্ত্বিক বিশ্লেষণে নিবেদিত নয়। সে কাজ শিল্পতাত্ত্বিকের। এক শিল্পীর নিখাদ বাঙালি ও দেশপ্রেমিক সত্তাটিকে ফিরে দেখা। তাঁর ঐতিহ্য, দেশপ্রেমের ছায়া যে কতটা ব্যাপক ও বিস্তৃত তা উপলব্ধির জন্য তাঁর কাজের শুরু থেকে আজকের দিনটি পর্যন্ত এ সময়টুকুর প্রয়োজন ছিল।
বাংলা নববর্ষ বা একুশের সমাগমে চারুকলা অনুষদের (আর্ট কলেজ) খোলা চত্বরে অন্তত একবার বসে যাই। এবারেও নববর্ষের উৎসবে এসেছিলাম। সেই উৎসবে নানা ঐতিহ্যময় বাহারি পোশাকে ও সাজে তরুণ-তরুণীদের ছুটে চলা, সংস্কৃতিপ্রেমিক আমজনতা, শিল্পী, নানা পেশার মানুষের আগমনে সৃষ্ট গুঞ্জন, করিডোরে বা চত্বরের গাছের ছায়ায় বসে শিশুদের ছবি আঁকা, তাদের কোলাহল, পাখির ডাক – সব মিলিয়ে যে ঐকতানের সৃষ্টি, তাতে সেই মহান দেশপ্রেমিক স্থপতির বিমূর্ত ইচ্ছার প্রতিধ্বনি শুনতে পাই। ভাবি, এই পথিকৃৎ স্থপতির কাছে আমাদের যত ঋণ তা শোধবার নয়।

 

Leave a Reply