logo

সোমনাথ হোরের শিল্পযাত্রা ও আজকের দৃশ্যকলার অভিমুখ

আ বু ল  ম ন সু র
আজকের বাণিজ্য-শাসিত দৃশ্যকলার পরিমণ্ডলে বসবাস করে সোমনাথ হোর নামের শিল্পীটি আমাদের কাছে কিছুটা অপরিজ্ঞাত থাকতে পারেন। ব্রিটিশ-শাসিত চট্টগ্রামে ১৯২৯ সালে জন্ম নেওয়া মানুষটি যখন ২০০৬ সালে ভারতের শান্তিনিকেতনে মৃত্যুবরণ করেন তখন সংবাদটি বাংলাদেশে শুধু নয়, খোদ ভারতেও তেমন গুরুত্ব পায়নি। এটি অপ্রত্যাশিত ছিল না, কারণ কলাজগতের আলোঝলমল পাদপ্রদীপের শিখা থেকে দূরেই থাকতে চেয়েছেন তিনি। আর নিজেও হয়তো তাঁর মৃত্যু নিয়ে কোলাহল চাননি।
সোমনাথ হোর আমাদের মূলধারা-দৃশ্যকলার সমকালীন প্রবণতার সামনে একটি বিরাট প্রশ্নচিহ্ন হয়ে বিরাজ করেন। আমাদের মতো তৃতীয় বিশ্বের দারিদ্র্য, বঞ্চনা, নিপীড়ন-লাঞ্ছিত পটভূমিতে একজন সৃজনকর্মীর সৃষ্টি কী উদ্দেশ্য সাধনে সৃজিত হবে? সে কি শুধুমাত্র ব্যক্তিগত উপার্জনের উপায় হিসেবে চর্চিত হবে, নাকি সমাজের প্রতি দায়বোধ, প্রতিকারের অঙ্গীকার হয়ে ভূমিকা পালন করবে। সেটি প্রতীয়মান হবে কিসে, শুধু নিছক সৃজনকর্মে কিছু প্রতিবাদী বক্তব্য উপস্থাপনেই, নাকি শিল্পচর্যার সঙ্গে জীবনচর্যার সম্মেলক যাপনচিত্রের মধ্য দিয়ে তার হয়ে-ওঠা সার্বিক এক কণ্ঠস্বরে – এমন প্রশ্নের সহজ উত্তর নেই।
সোমনাথ ব্যতিক্রম বিবিধার্থে। তাঁর শিল্পী হয়ে-ওঠাও প্রচলিত পথ ধরে নয়। প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার সুযোগ পাওয়ার আগেই রেখাচিত্র ও কাঠখোদাই চিত্রের নিয়মিত চর্চা তাঁকে করতে হয়েছে, শিল্পসৃষ্টির তাগিদে নয়, রাজনৈতিক প্রচারণার প্রয়োজন মেটাতে। এ ক্ষেত্রে তাঁর শিক্ষাগুরু ছিলেন চিত্তপ্রসাদ ভট্টাচার্য, যিনি নিজেও ছিলেন স্বশিক্ষিত। ফলে প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার প্রথানুগত্য তাঁর ওপর চেপে বসেনি সত্য, তবে অন্যদিকে রাজনৈতিক আনুগত্যের চাহিদামাফিক শিল্পসৃষ্টির তাগিদ তাঁকে বেঁধেছিল বইকি। অতি অল্প বয়সে মার্কসবাদে দীক্ষা ও ভারতীয় কমিউনিস্ট পার্টির সংস্রব তাঁর জীবনদৃষ্টির সুরটি বেঁধে দিয়েছিল। ১৯৪৩-এর মন্বন্তর তাঁর রাজনৈতিক বিশ্বাসকে এমন একটি দৃঢ় ভিত্তির ওপর দাঁড় করিয়ে দিয়েছিল, যেটি জীবনের দীর্ঘ পথ-পরিক্রমায় প্রবল ঝড়-ঝাপটায়ও কখনো টলেনি। এই পথ-পরিক্রমায় দলীয় রাজনীতির সঙ্গে শিল্পসৃজনের এক দ্বান্দ্বিক বোঝাপড়া তাঁকে করে নিতে হয়েছে। এই বোঝাপড়া চলেছে দীর্ঘ সময় ধরে। অবশেষে তিনি দলের সদস্যপদ নবায়ন না করার সিদ্ধান্ত নিয়ে সক্রিয় রাজনীতির ক্ষেত্র থেকে সরে আসেন বটে, কিন্তু একচুলও সরেননি তাঁর রাজনৈতিক বিশ্বাস থেকে। তাঁর বাকি জীবনের সকল শিল্পকর্ম, চিত্র, রেখাঙ্কন, ছাপাই ছবি, ভাস্কর্য – সকলেরই শিকড় উত্থিত হয়েছে তাঁর তেতাল্লিশের অভিজ্ঞতাকে জড়িয়ে, সকলের ভেতর দিয়েই তাঁর জানাবার কথা একটিই – বঞ্চনায়-নিপীড়নে-আঘাতে ক্ষত-লাঞ্ছিত শীর্ণকায় শরীরের নির্মাণের ভেতর দিয়ে তাঁর ব্যক্তিগত প্রতিবাদ।
অসম্পূর্ণ হলেও প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা থেকেও তিনি পেয়েছিলেন তাঁর প্রেরণার রসদ। এর অন্যতম ছিল শিক্ষক জয়নুল আবেদিনের সাহচর্য। ততদিনে মন্বন্তরের নিষ্ঠুর ছোবলে কলকাতার ফুটপাথে মৃতপ্রায় মানুষের অসাধারণ রেখাচিত্র এঁকে জয়নুল ভারত-খ্যাত শিল্পী। জয়নুলের ক্ষিপ্র ও সবল, অথচ অমোঘ ও সংযত রেখায় আঁকা মন্বন্তরের চিত্রমালার মধ্যে সোমনাথ পেয়ে গেলেন তাঁর ইচ্ছার পরিপূরক রসদ। চিত্তপ্রসাদ ও জয়নুল, মন্বন্তরের দুই শ্রেষ্ঠ রূপকার, তাঁর জীবনে যেন কাকতালীয়ভাবে যুক্ত হয়ে শিল্প ও রাজনীতির সমীকরণের এক ভবিতব্য নির্মাণের সহায়ক হয়ে উঠলেন। ছাত্র অবস্থায় রাজনীতির সঙ্গে প্রত্যক্ষ সংযোগ তাঁর শিক্ষানবিশিকে ব্যাহত করেছিল, পাশাপাশি শিক্ষক জয়নুল আবেদিনের সংসর্গে যেমন তাঁর রেখাচিত্রাঙ্কন পারদর্শিতায় গুণান্বিত হয়ে উঠছিল তেমনি আরেক শিক্ষক সফীউদ্দিন আহমেদের সাহচর্যে তাঁর কাঠখোদাই চিত্ররচন হয়ে উঠতে পেরেছিল কৃৎ-দক্ষতায় উৎকর্ষমণ্ডিত।
তেতাল্লিশের মন্বন্তরের কিছু রেখাচিত্রে, যা কমিউনিস্ট পার্টির পত্রিকা পিপল্স ওয়ার ও জনযুদ্ধে প্রকাশিত হয়, রেখার মুনশিয়ানা ও প্রায়োগিক দক্ষতার ঘাটতি উভয়ই প্রতীয়মান। সে-তুলনায় আর্ট স্কুলের ছাত্র থাকাকালীন আঁকা তেভাগার কৃষক ও চা-বাগানের শ্রমিকের অবয়বে অধিক পারদর্শিতার ছাপ দেখতে পাই। তবে এসব প্রাথমিক নিদর্শন মোটেও গুরুত্বহীন নয় এ জন্য যে, এর মধ্যেই বিধৃত রয়েছে সোমনাথের শিল্প-প্রবণতার মূল নির্যাসটি। ১৯৮৯ সালে তেভাগার ডায়েরি আর চা-বাগিচার কড়চা বই দুটির ইংরেজি অনুবাদ প্রকাশের কালে শিল্পী তাই যথার্থভাবেই বলেছিলেন, ‘এসব কাজে তেমন কিছু শিল্পগত নিপুণতা না থাকলেও আজো এ-ড্রয়িংগুলি আমার অত্যন্ত প্রিয়।’ চল্লিশ ও পঞ্চাশের দশকে সোমনাথ ছিলেন পার্টির একনিষ্ঠ কর্মী, শিল্পকর্মে রাজনৈতিক আদর্শকে রূপদানই শিল্পীর কর্তব্য – এ-সম্পর্কে তাঁর মনে কোনো বিভ্রান্তি ছিল না। যেহেতু ছাপাই ছবির মাধ্যমে অনেক বেশি দর্শকের কাছে পৌঁছনো যায়, সে-কারণে চীনা কাঠখোদাই চিত্র ছিল তাঁর সামনে আদর্শ চিত্ররচনের নমুনা। এর উদাহরণ দেখি ‘লং লিভ কমরেড স্ট্যালিন’ জাতীয় প্রচারধর্মী ছাপাই কাজে। কিছু পরে অবশ্য জার্মান সমাজতন্ত্রী শিল্পী ক্যাথে কোলৎভিজের ছাপাই ছবির সঙ্গে তাঁর পরিচয় ঘটে এবং কোলৎভিজের কাজ তাঁকে আরো গভীরভাবে প্রাণিত করেছিল।
ক্যাথে কোলৎভিজের কাজ দেখেই সম্ভবত সোমনাথ প্রথম অনুভব করেছিলেন রাজনৈতিক বিশ্বাস থেকে বিচ্যুত না হয়েও শিল্পকর্মে ব্যক্তিক সৃজনশীলতা ও নান্দনিক উৎকর্ষের প্রকাশ ঘটানো যেতে পারে। ফলে চীনা ছাপাই ছবির প্রভাব প্রবল হয়েও তাঁর শিল্পীজীবনে ক্ষণস্থায়ী হয়েছিল, আর কোলৎভিজের অভিজ্ঞতা ধীরে হলেও স্থায়ী প্রেরণা হিসেবে বজায় ছিল। সৃজনশীলতার গভীরতর স্তরের মধ্যে ক্রমশ নিবিষ্টতা বাড়তে থাকলে সোমনাথের উপলব্ধিতে এটিও ক্রমশ প্রতীয়মান হয়ে উঠছিল যে, সমাজতান্ত্রিক আদর্শের বৃহৎ দৃশ্যপট আর সমাজতান্ত্রিক পার্টির নিয়মবদ্ধ জগৎ এক নয়। পার্টির ছক-কাটা নির্দেশ আর শিল্পের সৃজনশীল অনুসন্ধানের আকুতিকে একসঙ্গে মেলানো ক্রমশই তাঁর জন্য দুরূহ হয়ে উঠছিল। শেষ পর্যন্ত ১৯৫৮ সালে দিল্লি পলিটেকনিকের প্রিন্টমেকিং বিভাগের দায়িত্ব নিয়ে কলকাতা ছেড়ে গেলেন এবং পার্টির সদস্যপদ আর নবায়ন করলেন না। তার মানে অবশ্য এ নয় যে, সমাজতন্ত্রের প্রতি তাঁর আস্থায় কিছু কমতি ঘটেছিল। বরং রাজনৈতিক বিশ্বাসের প্রতি তাঁর অঙ্গীকার তিনি শুধু তাঁর শিল্পকর্মেই চিরকাল বহাল রাখেননি, তাঁর জীবনচর্যায়ও তার প্রতিফলন ঘটিয়েছেন সর্বাংশে। তবে এটি ঠিক যে দিল্লি-পর্ব থেকেই সোমনাথ শিল্পের বিষয়ের চেয়েও প্রকরণের, বিশেষ করে এচিং, ড্রাই পয়েন্ট ও নবলব্ধ একই প্লেটে রঙিন ইনতাগ্লিও প্রভৃতি ছাপাই ছবির নানা মাধ্যমের প্রতি আগ্রহী হয়ে ওঠেন। ছাপাই ছবির অন্যতম শিল্পী হিসেবে তাঁর পরিচিতিও এ সময় গড়ে ওঠে।
সোমনাথের ব্যতিক্রমী ব্যক্তিত্বের পরিচয়টি আরো স্পষ্ট হয়ে ওঠে যখন দেখি দিল্লিতে শিল্পী হিসেবে তাঁর প্রতিষ্ঠা ও সাফল্য মধ্যগগনে, তখনই হঠাৎ সব ছেড়ে তিনি কলকাতায় বেকার জীবনে ফিরবার মতো ঝুঁকিপূর্ণ সিদ্ধান্ত নিচ্ছেন। ওই সময় দিল্লির দৃশ্যকলাজগতে যিনি পেশাগত ও অর্থনৈতিক সাফল্যে সামনের সারিতে, ১৯৬০ থেকে ১৯৬৩-র মধ্যে তিনবার ললিতকলা আকাদেমির পুরস্কারে সম্মানিত হবার বিরল সাফল্যে উদ্ভাসিত, দিল্লির সারস্বত সমাজে বন্ধুবেষ্টিত তখনই এমন সিদ্ধান্ত হয়তো শুধুমাত্র সোমনাথের মতো বিবেক-আক্রান্ত মানুষের পক্ষেই সম্ভব। সাফল্যের উজ্জ্বলতার মধ্যেও তাঁর দম বন্ধ হয়ে আসছিল, কারণ তিনি উপলব্ধি করতে পারছিলেন শিল্পী হিসেবে সমাজের ও মানুষের প্রতি দায় থেকে তিনি সরে আসছিলেন।
অতএব ১৯৬৪-তে কলকাতার অনিশ্চিত জীবনে ফেরা। তাঁর কলকাতা ফেরার সঙ্গে ষাটের দশক থেকে পশ্চিমবঙ্গে বাম রাজনীতির উত্থানের আর ১৯৬৭ সালে বাম শক্তির ক্ষমতায় আসীন হওয়ার ঘটনার মধ্যে ইতিবাচক কোনো যোগসূত্র হয়তো ভাবা যেতে পারে। তবে বাস্তবতা এমনটিই যে, ’৬৭-পরবর্তী কলকাতায় বাম রাজনীতির খণ্ডায়ন ও ক্রমবর্ধমান পারস্পরিক হিংসা, হানাহানি ও রক্তপাতে সোমনাথ বরং বিমর্ষ, বিভ্রান্ত ও বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছিলেন। তাঁরই কমরেডরা যখন একদিকে শ্রেণিশত্র“ খতমের সহিংস রাজনীতি ও অন্যদিকে তা দমনের নিষ্ঠুর প্রয়োগে পরস্পরের বিরুদ্ধে নির্বিচার হত্যার প্রতিযোগিতায় মেতে উঠলেন তখন সোমনাথ একেবারেই বিপন্ন ও অসহায় বোধ করলেন। কোনো পক্ষই আর তাঁর কাছে সমর্থনযোগ্য রইল না, তাঁর সহানুভূতি টিকে রইল দলমত নির্বিশেষে আক্রান্ত-বিক্ষত মানুষের পক্ষে। তারাই রইল তাঁর রাজনৈতিক বিবেচনার জগতে আর তাঁর সমস্ত শিল্পসৃষ্টির একমাত্র উপজীব্য হয়ে।
এইভাবে সোমনাথ হোর রাজনৈতিক সচেতনতা ও সৃজনশীল সৃষ্টিকর্মের মধ্যে টানাপড়েনকে যখন মেলাবার দ্বন্দ্বে ভুগছিলেন তখন পুরনো বন্ধু দিনকর কৌশিকের কলাভবনে শিক্ষকতায় যোগদানের আহ্বান তাঁর জন্য এ-বিহ্বলতা থেকে উত্তরণের একটি পথ হিসেবে দেখা দিয়েছিল। ১৯৬৬ সালে নন্দলাল বসুর মৃত্যুর পর দিনকর কৌশিক তখন বিশ্বভারতীর কলাভবনের অধ্যক্ষের দায়িত্ব নিয়েছেন। কিছুটা দোদুল্যমানতার পর ১৯৬৯ সালে সোমনাথ কলাভবনের প্রিন্টমেকিং বিভাগের দায়িত্ব নিয়ে শান্তিনিকেতনে চলে আসেন। রবীন্দ্রনাথ ও নন্দলাল তখন পরলোকগত হলেও তাঁদের ব্যক্তিত্বের ছটা কাছ থেকে অনুভব করলেন। তবে বিনোদবিহারী ও রামকিঙ্করকে একেবারে স্বচক্ষে দেখে আরো বিশদভাবে বুঝতে শিখলেন সৃজনশীল মানুষ নিজের অবস্থানটি প্রান্তিকতায় রেখেও কীভাবে সামাজিক দায়বদ্ধতাকে পূরণ করতে পারেন। শিখলেন সমাজের সাময়িক ঘটনাপ্রবাহ ও অস্থিরতার মাঝেও কীভাবে নৈর্ব্যক্তিক অবস্থানে থেকেও শিল্পী নিজ ভূমিকায় স্থিত থাকতে পারেন। শিখলেন নিজকে কেমন করে একই সঙ্গে উত্তীর্ণ করা যায় নির্মোহ ও নিরাসক্তির উচ্চতর বোধে, অথচ সৃজনকর্মে থাকা যায় নিগৃহীত-নিম্নবর্গীয় মানুষের সহমর্মী। বোধের এই উত্তরণ সোমনাথের জন্য নিয়ে এলো মানসিক স্থিতি ও সৃজনকর্মের ব্যাপক উদ্যম। আমরা দেখি দিল্লিতে ছাপাই ছবির ক্ষেত্রে তাঁর যে-বিকাশ ঘটেছিল শান্তিনিকেতনে এসে তার আরো উত্তরণ ঘটল রঙিন লিথোগ্রাফ নিয়ে নিরীক্ষায়, কাগজের পুরু মণ্ডে চাপ প্রয়োগের মাধ্যমে সাদার ওপর সাদা রিলিফধর্মী ছাপ-ছবি নির্মাণের নিজস্ব আঙ্গিকের উদ্ভাবনে এবং সবশেষে সত্তরের দশকের মাঝামাঝি থেকে সবকিছুকে ছাপিয়ে আত্মপ্রকাশ করল ভাস্কর সোমনাথ হোর – যা তাঁর জন্য রচনা করল আরেকটি একক পরিচয়। এখানেও তিনি পরিচয় রাখলেন নিজ স্বাতন্ত্র্যের, ভাস্কর্যের আঙ্গিক ও প্রকরণে একেবারেই স্বকীয় একটি ধারার প্রবর্তন করে।
এসব অভিজ্ঞতা ও নিরীক্ষার ভেতর দিয়ে সোমনাথের শিল্পদৃষ্টি ক্রমশ পরিপুষ্টি ও তার পরিণত রূপটি অর্জন করছিল। সমাজতন্ত্রী রাজনৈতিক দীক্ষায় শ্রেণিচিহ্নিত বৈষম্যবিরোধী শিল্পের সংকীর্ণ গণ্ডির মধ্যে তাঁর শিল্প নির্মাণের যাত্রা সূচিত হয়েছিল, নানান চড়াই-উতরাই পেরিয়ে পরিণত বয়সে তাঁর সহানুভূতি আর সেখানে নির্দিষ্ট রইল না, হয়ে উঠল সর্বমানবের যাবতীয় দুর্দশার সমব্যথী। তাঁর ছবি একটি পর্বে বিমূর্ততার অভিমুখী হয়ে উঠেছিল বলা চলে, তবে সেসবই শেষ পর্যন্ত আঘাত ও বেদনার আর্তির সংবেদকেই প্রকাশ করে। তাঁর এ-পর্বের কাজগুলির শিরোনাম ‘উন্ডস’ বা ক্ষত, যা বিমূর্ত চিহ্নমাত্র হয়ে আঘাত ও যন্ত্রণার অনুভূতিকে একটি সর্বব্যাপ্ত চরিত্র দান করে। এর আগে ও পরে সোমনাথের বিষয় মূলত মানবশরীর, এ ছাড়া কখনো কুকুর, ছাগল বা অন্য প্রাণীর অবয়ব। যন্ত্রণার অভিব্যক্তির মধ্যে বিশেষায়ণের চিহ্ন মুছে সামগ্রিকতায় উপস্থাপনের পথে যাত্রাটি যেন তাঁর নিজ সময়কালের প্রতিকারহীন বিয়োগান্ত প্রেক্ষাপটের প্রতিরূপ। আশা যেখানে প্রায় তিরোহিত, হতাশা হয়ে উঠছে সর্বব্যাপ্ত সেখানে ক্ষত ও লাঞ্ছনার ক্রমাগত রূপায়ণ হয়ে উঠতে পারত গতানুগতিকতা ও ভাবালুতায় আক্রান্ত। সোমনাথ মানবশরীর-রূপের অফুরন্ত ও ক্রমিক বিবর্ধন ও বৈচিত্র্যের প্রকাশময়তায় সে-সকল আশঙ্কাকে অতিক্রম করে যান। কী রেখাঙ্কনে, কি ছাপাই ছবিতে, কি ভাস্কর্যে তাঁর সৃজন-উদ্ভাবন ক্ষমতা আকর্ষিত করে নতুন থেকে নতুনতর সম্মোহনে। শেষ বয়সে, যখন ভাস্কর্য বা ছাপাই ছবি করবার শারীরিক সামর্থ্য লোপ পেয়েছে, রেখাচিত্রে অক্ষুণ্ন দেখতে পাই সৃষ্টিশীলতার একই উৎসারণ।
যেমনটি এ-আলোচনার সূচনাপর্বে ব্যক্ত হয়েছিল তার সূত্র ধরে আবারো ফিরে আসা যায় সে-প্রশ্নটিতে – শিল্পী তাঁর সৃজনকর্মে পরিপার্শ্ব বা প্রেক্ষাপটের প্রতি কোনো দায় বহন করেন কি না। বিশেষ করে আমাদের মতো দেশে যেখানে বৈষম্য-নির্যাতন-লাঞ্ছনা সমাজের অভ্যন্তরে নির্মাণ করেছে গভীর ক্ষতচিহ্ন, সেখানে প্রতিকারের দায় কি সমাজের সংবেদনশীল অগ্রসর অংশের ওপরে কিছুটা বর্তায়? শিল্পীর হাতে প্রতিকারের আয়ুধ নেই, তবে রয়েছে প্রতিবাদের ভাষা। শিল্পীর বোধ কি সেটুকু নিয়ে লড়ে যাওয়াকে কর্তব্যজ্ঞান করে? অন্যের কোনো উদাহরণের অপেক্ষা না করে সোমনাথ এ-কর্তব্যটিই জীবনভর পালন করেছেন। তাঁর শিল্পসত্তা ও মানবসত্তার এটিই একমাত্র অনুধ্যান। মৃত্যুর কিছু আগেও তাই এ শিল্পীর কাছে সবচেয়ে গুরুতর প্রশ্ন – ‘পৃথিবীতে একজন মানুষও কেন না খেয়ে থাকবে? সোমনাথের বিষয় তাই জীবনভর একই থেকে যায়। অন্যদিকে শিল্পীর সৃজনশীল প্রবহমানতারও এক উদাহরণ নির্মাণ করে যান তিনি, ফলে বিষয়ের পৌনঃপুনিকতা তাঁর শিল্পে পুনরাবর্তনের একঘেয়েমি তৈরি করে না, বরং উপস্থাপনের বিভিন্নতায় বিষয়ের যাথার্থ্যকে নানান বৈচিত্র্যে প্রতিষ্ঠা দান করে।
সোমনাথ হোর তাঁর সৃজনকর্মের সামগ্রিক সম্ভারে দেশকালের প্রেক্ষাপটে জীবনচর্যা ও শিল্পচর্যার এক প্রাসঙ্গিক উদাহরণ নির্মাণ করেন। তিনি এও প্রমাণ করেন যে, কেবলমাত্র বিষয়ের বৈচিত্র্যে বা মাহাত্ম্যে শিল্প কাল-অতিক্রমী হয়ে ওঠে না, হয়ে ওঠে তার প্রাসঙ্গিকতায় আর শিল্পভাষার স্বাতন্ত্র্যে ও অনন্যতায়। এক্ষেত্রে সোমনাথ হোর উপমহাদেশীয় চারুশিল্পজগতে ব্যতিক্রম শুধু নন, একক ও প্রাতিস্বিক এক কণ্ঠ।

Leave a Reply