দ্রা বি ড় সৈ ক ত
চারুশিল্পী ও শিল্পানুরাগীদের জন্য ‘জাতীয় চারুকলা প্রদর্শনী’ একটি উৎসাহ-উদ্দীপনা ও উৎসাহের উপলক্ষ, দর্শক-শিল্পীদের বুঝে নেওয়ার সুযোগ হয় আমাদের জাতীয় চিত্রকলার গতিবিধি। সেই হিসেবে এবারের প্রদর্শনী একটি স্পষ্ট ইঙ্গিত দেয় শিল্পের চলন-প্রক্রিয়ার, দীর্ঘকাল চর্চিত ও চর্বিত বিমূর্তায়নের ঘোর থেকে বাংলাদেশের চারুশিল্প কি কিছুটা আড়মোড়া ভেঙে উঠে দাঁড়ানোর চেষ্টা করছে? অথবা পাশ্চাত্যের অন্ধ অনুকরণের মোহে কনসেপচুয়াল অভিধার মোড়কে শিল্প শিল্প খেলা থেকে কি সমসাময়িক শিল্পীরা মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছেন? কনসেপচুয়াল শিল্প অথবা ইনস্টলেশনের জয়জয়কারের সময়ে বহুল উচ্চারিত বাহানার নাম পোস্টমডার্নিটি; পোস্টমডার্নিটির অন্যতম অনুষঙ্গ যে স্থানিকতা তার কী হবে? শিল্পের স্থানিক অবয়বের বিষয়ে বোধবুদ্ধির পূর্ণতা ছাড়া পোস্টমডার্ন শিল্প রচনা সম্ভব নয় বোধ হয়। সেই দিক থেকে আমাদের জাতীয় চারুকলা প্রদর্শনী সঠিক পথেই আছে বলা যায়। শিল্পের কারিগরি দিক মক্স না থাকায় যাঁরা কনসেপচুয়াল আর্ট অথবা স্থাপনাশিল্পের অনায়াসলব্ধ খ্যাতির দিকে ঊর্ধ্বশ্বাস ছুটে বেড়ান তাঁদের জন্য এ-প্রদর্শনী একধরনের সংকেত বহন করে।
আমাদের চিত্রকলার স্থানীয় কিংবা আন্তর্জাতিক চরিত্র নিয়ে বিতর্ক বেশ পুরনো, দেশীয় চরিত্রের সুনির্দিষ্ট অবয়ব যেহেতু নির্ণীত নয়, অথবা আদৌ দেশীয় চরিত্র বলে গাঠনিক কোনো প্রকাশ সম্ভব কি না তাও ভেবে দেখার বিষয়, এই আপাত অসুবিধাটি আমাদের চারুকলায় সুবিধায় রূপান্তরিত হয়েছে; এখানে ভাবগত ঐক্যের জমিন প্রস্ত্তত থাকায় আমরা সহজেই স্থানিকতাকে চিনে নিতে পারি। জাতীয় চারুকলা প্রদর্শনীতে সেই ভাবের জায়গাটি ধরে নিতে সাধারণ দর্শকের অসুবিধা হয় না। আটপৌরে জীবনের ক্ষোভ-বিক্ষোভ স্বপ্ন আর স্বপ্নভঙ্গের স্বরলিপিগুলো আলাদা করে বুঝে নেওয়া যায়।
প্রদর্শনীতে পুরস্কারপ্রাপ্ত কাজগুলো অন্যদের থেকে বেশি গুরুত্ব দাবি করে, পুরস্কারের ধর্মই এমন, যদিও পুরস্কারের বাইরে রয়ে গেছে অনেক গুরুত্বপূর্ণ কাজ। যেমন সৈয়দ ফিদা হুসেনের ‘সেলফ কোয়েস্ট অ্যান্ড প্যানোরমা ওয়ার্ল্ড-১’, সুশান্ত কুমার অধিকারীর ‘প্রক্রিয়া এবং প্রতিক্রিয়া-১’ অথবা আবুল হোসেন ঢালীর ‘চারণভূমি-২১’-সহ বেশকিছু ভালো শিল্পকর্ম। বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমী পুরস্কার পেয়েছে মো. মাঈনউদ্দীনের ‘মোনাজাত’ শীর্ষক শিল্পকর্ম, যা অ্যাকাডেমিক গন্ডি ছাড়িয়ে বেরোতে পারেনি। তবে মাধ্যম ব্যবহারের দক্ষতায় উতরে যাওয়া, মোনাজাতরত বৃদ্ধের অভিব্যক্তির সঙ্গে পশ্চাৎপটে ব্যবহৃত দৈনিক পত্রিকার আধো আধো টেক্সটগুলো বিভ্রম তৈরি করে। বেঙ্গল ফাউন্ডেশন পুরস্কারপ্রাপ্ত গুলশান হোসেনের কাজ ‘অগ্নিদগ্ধ নারী পোশাক শিল্প শ্রমিকদের অনন্ত যাত্রা’ একটা শোকাবহ পরিবেশ তৈরি করলেও স্থাপনার সঙ্গে ব্যবহৃত পেইন্টিংয়ে শিথিলতার ছাপ থাকায় তা মর্মস্পর্শী হয়ে উঠতে পারেনি। সোসাইটি ফর প্রমোশন অফ বাংলাদেশ আর্ট পুরস্কারপ্রাপ্ত শিল্পী রুহুল করিম রুমীর ‘সন্দেহজনক প্রতিকৃতি-৩’ শিরোনামের মিশ্র মাধ্যম শিল্পকর্মে অ্যাকাডেমিক দক্ষতাই সবকিছু ছাপিয়ে চোখে পড়ে। তাছাড়া এবি ব্যাংক পুরস্কারপ্রাপ্ত রাসেল কান্তি দাশের ‘পরিস্থিতি-৮’, বেগম আজিজুন্নেসা চারুকলা পুরস্কারপ্রাপ্ত জাহিদা আখতারের ‘ভবঘুরে-১’, দীপা হক পুরস্কারপ্রাপ্ত আনিসুজ্জামান মামুনের ‘রিয়ালিটি শো-২০১৩-০১’, বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমী সম্মান পুরস্কারপ্রাপ্ত মনজুরুল লভির ‘সেভ দ্য চিলড্রেন-১’ বিষয়বস্ত্তর নিরিখে নতুনত্বের দাবি জোরালো নয়। বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমী সম্মান পুরস্কারপ্রাপ্ত মো. হাসান মোর্শেদের ‘আমার বয়স ৪২ বছর’ কাজটি হৃদয়গ্রাহী। মোহাম্মদ হাসানুর রহমানের বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমী সম্মান পুরস্কারপ্রাপ্ত ‘সিগনেচার’ একটি আলাদাভাবে উল্লেখযোগ্য কাজ। সাম্প্রতিক ঘটনাকে শিল্পে উত্তীর্ণ করায় পারঙ্গম এই শিল্পী কাজ করেছেন পোশাক শিল্পে ঘটে যাওয়া দুর্ঘটনাকে উপজীব্য করে।
শিল্পীর নিজস্ব ভাষা স্টাইল বা শৈলী বিষয়ে আমাদের আলাদা যত্ন নেওয়া বা বিষয়টি মনোযোগের কেন্দ্রবিন্দুতে চলে আসায় আখেরে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে শিল্প ও শিল্পী দুই পক্ষই। মরিয়া হয়ে আইডেন্টিটি তৈরির প্রবণতা শিল্প থেকে প্রাণভোমরাকে তাড়িয়ে দিয়ে সেখানে স্থান করে দিয়েছে ব্যক্তি শিল্পীর মৃত খোলসকে। ভাষা তৈরির নামে অথবা নিজস্ব স্টাইলের ধোয়ায় অনেকেই শিল্পী হয়ে উঠেছেন। তাঁরা বর্ণমালা শিখে বিন্যাস করেন, কোনো অর্থপূর্ণ শব্দ গঠনের তাগাদা ভেতরে বহন করেন না। আশার কথা হলো, বিশতম জাতীয় চারুকলা প্রদর্শনী এমত ধারাকে সাধ্যমতো খারিজ করে দিয়েছে। সমাজে বসবাসকারী শিল্পীর কাজে সামাজিক বিবিধ উত্তাপের অাঁচ পাওয়া যাবে এটাই তো স্বাভাবিকতা, সেই স্বাভাবিকতার বিষয়াবলি প্রদর্শনীতে আছে বেশ ভালোভাবেই। মান বিষয়ে কিছু প্রশ্ন এবং প্রত্যাশায় অতৃপ্তি রয়েই গেল।
বিশতম জাতীয় চারুকলা প্রদর্শনী ২০১৩-তে অংশগ্রহণকারী শিল্পীর সংখ্যা ২৫৫। এত বিপুলসংখ্যক বাংলাদেশি শিল্পীর কাজ একসঙ্গে দেখার সুযোগ তৈরি হয় দুই বছর পর পর। কিন্তু শিল্পকলা একাডেমীর বিশাল আয়োজনের সঙ্গে প্রচারণা পদ্ধতি একেবারেই বেমানান। দর্শক সমাগম না হলে এত বড় আয়োজন অর্থবহ হয়ে উঠবে না। নিজস্ব আঙিনায় শিল্পের এই সুবিশাল আয়োজনকে বদ্ধ করে রাখা অর্থ ও শিল্পের বিরাট অপচয় ছাড়া অন্যকিছু নয়। প্রচারণা বিষয়ে আরো মনোযোগ দর্শক, শিল্পী ও শিল্পকলা একাডেমী সবার জন্যই অর্থবহ হয়ে ওঠার কথা। ভবিষ্যতে এ বিষয়ে সংশ্লিষ্ট মহলের আরো সতর্ক থাকবেন বলেই আশা করি। ২২ জুন থেকে শুরু হয়ে প্রদর্শনী চলে ১২ জুলাই পর্যন্ত।n