মোস্তফা জামান
সুলতানের ব্যক্তিসত্তা ও শিল্পসত্তার যে মাত্রাটি সবার আগে স্মরণীয় তা জীবন ও সময়ের পাঠ সংক্রান্ত। শাহাবুদ্দীন আহমেদ দৌলতপুর বি. এল. কলেজের ছাত্র থাকাকালীন সময়ের যে বক্তৃতার স্মৃতি উল্লেখ করেছেন তার ‘আমার স্মৃতিতে সুলতান’ নামক প্রবন্ধে, তাতে ১৯৫৪ সনে সদ্য দেশে ফেরা সুলতানের মনোকাঠামো স্পষ্ট ধরা দেয়। শাহাবুদ্দীন আমাদের হদিস দেন : ‘জগৎ ও দর্শন নিয়ে আলোচনা শুরু করলেন। কৌতূহলী ছাত্রদের প্রশ্নের জবাব দিতে লাগলেন। আর বারবার বলতে লাগলেন – শূন্যে ফিরত যেতে হবে – শূন্যে ফিরে যেতে হবে। শূন্য থেকে সব কিছুর উদ্ভব।’
সুলতানের বক্তৃতা ও ভাব বিনিময়ের পর শাহাবুদ্দীন, যিনি তখন বিজ্ঞান বিভাগের দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্র, অনুমান করেছেন : লোকটি সাধারণ পাগল নয় – অসাধারণ পাগল। এই পাগল শিল্পী এস. এম. সুলতান যার আদি নাম লাল মিয়া – এই নাম পিতৃপ্রদত্ত। ওপরের ঘটনার সূত্র ধরে আমরা সুলতান বিষয়ে কিছু প্রাথমিক সিদ্ধামেত্ম পৌঁছতে পারি : আধুনিকতা-পরবর্তী একরৈখিক চিন্তার তুলনায় প্রাচীন ভাবুকদের সার্কুলার জগৎবীক্ষণ তাঁর কাছে জরুরি মনে হতো। এই স্মৃতিচারণে আরো যে বিষয়টি উঠে আসে তা হলো শিল্পীর চিত্রশিল্প ভিন্ন আরো আরো শাখায় অনায়াস যাতায়াতের প্রবৃত্তি। সুলতানকে কদমগাছের তলায় বাঁশি বাজাতে দেখা, তাঁর শূন্যবিষয়ক দার্শনিকতার খোঁজ পাওয়া, গান গাইতে গাইতে নৃত্যের নৈর্ব্যক্তিকতায় নিজেকে সঁপে দেওয়া – এসবের মধ্যে দিয়ে এক ‘সম্পূর্ণ’ ব্যক্তিত্বের হদিস মেলে। যুবক সুলতানের এই সম্পূর্ণতার মধ্যে দিয়ে শিল্প ও সমাজের এক নববন্ধন আবিষ্কার করা যায়। যদিও ছবি বা চিত্রের চরিত্রে এই সমাজবিষয়ক মর্ম ফলতে এই শিল্পীর জীবনের বেশ কিছু বছর গত হয়। সুলতানের কাজে কৃষিসমাজের ‘সহজ’ ও ‘সাহসী’ জীবনের যে চিত্র উঠে আসে তা স্বাধীনতা-উত্তরকালে প্রথম আপন ‘চরিত্র’ লাভ করে।
সামাজিক গণমাধ্যমে যে ভিডিও চিত্রটি এখন ভাইরাল অবস্থায় সুলভ, তা-তে শিল্পী ১৯৭১ সালের নয় মাসব্যাপী যুদ্ধের মধ্যে দিয়ে কালেকটিভ নিশ্চেতনায় যে পরিবর্তন লক্ষণীয় হয়ে ওঠে শিল্পীকে সেই বিষয়ে ব্যাখ্যা করতে দেখা যায়। স্বাধীনতা-পরবর্তী বিশাল পরিসরে আঁকা গ্রামীণ জীবনচিত্র, কৃষকের বিদ্রোহ, কৃষি জমিনির্ভর জনগোষ্ঠীর ভূমির দখল নেওয়া, প্রকৃতিতে প্রাকৃত জীবন – এসবই তাঁর মনোজগতের পরিবর্তনের ফল হিসেবে গণ্য করা চলে।
বহু বছর পরে যখন এসব ভিশনারি চিত্রের জেল্লা বাস্তবে কমে এসেছে, ইমেজের শক্তির পেছনে যে মনোকাঠামো জারি ছিল তা বোঝা আরো সহজ হয়ে উঠেছে। এখানে প্রণিধানযোগ্য যে, সুলতান তাঁর স্বভাবসুলভ জীবনযাপনের অংশ হিসেবে যে দেশজ উপায়ে ক্যানভাসে প্রলেপ তৈরি করেছেন, তা তাঁর ক্যানভাসগুলোর সুরক্ষা নিশ্চিত করেনি। সত্তরের দশকে আঁকা দশ-বারো ফুট দীর্ঘ ভারতীয় ক্লাসিক দেয়াল চিত্রসুলভ কাজগুলোর রং ফিকে হয়ে এসেছে, আভা হারিয়ে গেছে। যারা এসব ছবি প্রথম থেকে দেখে আসছেন, তাদের কাছে উজ্জ্বলতা আজ শুধু স্মৃতি। তবে এর ফলে তাঁর অঙ্কন ও ফর্মের মর্ম উদ্ধারে কোনো ব্যত্যয় ঘটে না। সত্তরের শুরুর দিকে আঁকা এসব কাজ সুলতানের সুলতানীয় ধারার সূচনা হিসেবে গণ্য করা যেতে পারে। সুলতানীয় ধারা বলতে এখানে গ্রামীণ ঘটনা বৃহৎ জানালার আদলে আঁকা দৃশ্যের মধ্যে ফুটিয়ে তোলার মুনশিয়ানাকে নির্দেশ করা হচ্ছে। এরই বিকশিত রূপ দেখা যায় আশির দশকের কৃষকের অভ্যুত্থান, জমিতে কাজ করা ইত্যাকার ছবিতে। যেসব ছবির চিত্রকল্প ব্যক্তি শিল্পীর নিরীক্ষা নির্ভর না, ফর্মের অভিনবত্ব দেখানো কৌশল নির্ভর না। এমনকি বাস্তব জীবনের প্রতিচ্ছবিও না। যা কাল্পনিক – যাতে সমাজ-মানস জাহের থাকে – এমন চিত্র শুধুমাত্র ‘আধুনিক’ নাম ধারণ করে তুষ্ট হয় না। আবার তা অনাধুনিকও নয় – কারণ চিত্রভাষা, ভাষ্য, ভাব হিসেবে এর শক্তি সমাজের সূত্রে পাওয়া। এই শক্তির উৎপাদক সমাজ, ব্যক্তি শিল্পী এর মধ্যস্থতা করেন মাত্র। এমন ভাবনার প্রেক্ষিতে সুলতানকে প্রাক-আধুনিক যুগের শিল্পী বলেও ঠাহর হতে পারে।
জার্মান শিল্পবেত্তা হ্যান্স বেল্টিং তাঁর ‘এন এন থ্রপলজি অব ইমেজ’ পুস্তকে শরীর যা সমাজের একক – তার মধ্যে দিয়ে দৃশ্য নির্মাণের প্রথার কথা বলেছেন। তাঁর মতে, শরীর যদি ইমেজ বা চিত্র উৎপাদনের লোকাস বা স্থান হয় – তার মধ্যে দিয়ে ইমেজ শুধু ইমেজ হিসেবে হাজির হয় না। ওটি সামাজিক প্রক্রিয়ার সূত্রে গোষ্ঠীর কল্পদ্রম্নমের ফল হিসেবে জায়মান থাকে। যদিও বর্তমানবিশ্বে জীবন্ত সূত্র যে মানব শরীর তা থেকে যোজন দূরের ভার্চুয়াল সূত্র থেকে ইমেজ বা চিত্রবস্ত্ত নির্মিত হচ্ছে। ডেস্কটপ কম্পিউটার, কিংবা ডিজিটাল ক্যামেরার মধ্যস্থতা শরীরকে প্রামিত্মকতায় ঠেলে দিচ্ছে। সুলতানে দুই ধরনের প্রামিত্মকতারই সুরাহা মেলে। প্রথম প্রামিত্মকতা ইমেজ তৈরিতে শরীরের চেয়ে স্বয়ংক্রিয় মেশিনের গুরুত্ব বেড়ে যাওয়ার মধ্যে চিহ্নিত। দ্বিতীয় প্রামিত্মকতা কৃষিভিত্তিক সমাজের কৃষক, কৃষিভিত্তিক জীবনের মর্ম শহরের পুঁজিভিত্তিক নব আচার-আচরণের মধ্যে গৌণ হয়ে যাওয়ার মধ্যে নিহিত।
ইমেজ বা চিত্রের যে নব্য সূতিকাগার ও স্টোর হাউস তা সত্য জগতের মধ্যে আর নেই। যন্ত্রের মধ্যস্থতায় তা এখন ইলেকট্রনিক ভার্চুয়াল বা স্বয়ংক্রিয় স্থানিকতায় থিতু। এই পরিপ্রেক্ষিতে সুলতানের কাজ আরো বেশি তাৎপর্যপূর্ণ হয়ে উঠেছে। যে অশরীরী যৌথ চেতনা আজ সাইবার স্পেসে জায়মান, তার বিপরীতে সুলতানের কাজ শরীরী ও শিল্পজ স্থানিকতার ধারণায় স্থির। এই অটলতা শিল্পীর একনাগাড়ে বহুবিধ স্থানিকতায় গমনের সূত্রেও ব্যাখ্যা করা চলে। যে শরীর তিনি প্রতীক হিসেবে হাজির করেন তা তাঁর বাসভূমির বাস্তব মানুষের সঙ্গে যেমন সম্পর্কিত তেমন ইউরোপীয় রেনেসাঁসের প্রথম ম্যানারিস্ট শিল্পী মাইকেল এনজেলোর ধর্মীয় পটভূমির এপিকধর্মী চিত্রের কাছেও ঋণী। এই অর্থে শিল্পী সুলতান হাইব্রিড শিল্পভাষার অন্যতম দেশজ প্রতিভূ। দৃষ্টির একত্বসন্ধানী প্রক্রিয়ায় তিনি বহুত্ববাদী অনুসন্ধান জারি রেখেছিলেন – যা আধুনিক শিল্পীর সমন্বয়বাদিতা থেকে কিছুটা পৃথক। সুলতান যে মোক্ষ অর্জনের পথ তৈয়ার করে নিতে ব্রতী হয়েছিলেন তা আধুনিক শিল্পীর বাসনা থেকে আলাদা। তিনি সম্যক জ্ঞানের অন্বেষী এক বহুমাত্রিক মানুষ ছিলেন। যিনি জীবনের একটি সময় শাড়ি পরে নারীভাব ধারণ করে আঁড় বাঁশি বাজিয়ে শরীরে অবস্থিত বহুবিধ মাত্রাকে উদযাপন করতেন। এই স্বভাব তাঁর অন্তর্গত – আরোপিত নয়। কলার সঙ্গে কলার সম্পর্ক, স্থানের সঙ্গে স্থানের, কিংবা কালের সঙ্গে কালের ও সর্বোপরি দেহের সঙ্গে ভাবের সম্পর্ক সম্পর্কে তার ধারণা ছিল ত্রিলোক-সন্ধানী ঋষির মতো। বিষ্ণুধর্মোত্তর গ্রন্থের যেমন সন্ন্যাসী মর্কন্দ রাজা বজ্রের মূর্তি নির্মাণের বাসনার কথা শুনে নৃত্যকলা, সংগীত ও কবিতা সম্পর্কে জ্ঞান লাভের পর এমন নির্মাণ সম্ভব বলে দাবি করলেন, শিল্পী সুলতানও অবগত ছিলেন এমন সম্পর্ক সূত্রের কথা। শিল্পবিষয়ক আলোচনামত্ত হয়ে হামেশাই তিনি রেখা-ছন্দ-রং বিষয়ে ব্যাখ্যা দিতে গিয়ে নিজেই নাচতে শুরু করতেন। রফিকুল আলমের ‘সুলতানের স্মৃতি’ প্রবন্ধে উপরোক্ত সম্পর্কসূত্রের উল্লেখ করেছেন, যদিও তা মূল কাহিনি থেকে কিঞ্চিৎ আলাদা। এছাড়া সন্ন্যাসীর নামের হদিস তিনি দেননি। তবু, তার স্মৃতিচারণের মধ্যে দিয়ে সুলতানের তৈরি হওয়ার একটা সংক্ষক্ষপিত চিত্র ফোটে। রফিকুল আলমের ১৯৯৫-তে লেখা পদে তিরিশ বছর আগে পেনসিলে আঁকা একটি স্কেচের উল্লেখ পাওয়া যায়। আরো আরো ছবির শক্তিশালী নমুনার কথাও মেলে। তাঁর মতে : সুলতানের যৌবন বয়সে আঁকা ছবিগুলোর অধিকাংশই হারিয়ে গেছে…তাঁর গ্রামে বসবাসের কারণে সাধারণ মুদির দোকানদার, চায়ের বা ময়রার দোকানে বসে আঁকা স্কেচগুলোর হদিস আজকে পাওয়া সত্যিই মুশকিল। অনুধাবন করা যায় যে, সুলতান শিল্পী হিসেবে নিজেকে গড়ে তুলতে যেমন ‘দিবা দৃষ্টি’ খোলা রেখেছিলেন তেমন অঞ্চলের অভ্যাসও গড়ে তুলেছিলেন। একই লেখায় ‘গ্রাম বাংলার মোহ’ ত্যাগ করতে না পারার উল্লেখ দেখে সিদ্ধান্ত নেওয়া চলে যে, আপামর জনগোষ্ঠীর সঙ্গে একাত্ম জীবনবোধ ও অটল আত্মশক্তির সমন্বয়ে গড়ে ওঠা জীবনের এই উনব্যাখ্যা পাশ কাটিয়ে আমাদের সুলতানের তথা লাল মিয়ার আত্মীয়তার নেটওয়ার্ক চিহ্নিত করা বাঞ্চনীয়। সাধারণের সঙ্গে তাঁর অটুট সম্পর্ক ছিল; প্রাণিকুলের সঙ্গেও তাঁর আত্মীয়তা স্মরণযোগ্য। এই নানাবিধ সম্পর্কের সূত্রেই মূলত ভিশনারি শিল্পী হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেন।
এই ভিন্নমাত্রিক ব্যক্তিত্বের হাতে যা মধ্যস্থতার যে শিল্পভাষার জন্ম শুধু বায়োগ্রাফির সূত্রে তার তাৎপর্য বর্ণনা যথেষ্ট নয়। অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুরের বাগেশ্বরী বক্তৃতায় যে প্রকারভেদের প্রচার দেখা যায়, সুলতান সে-ই মাপকাঠির ঊর্ধ্বের শিল্পী। চিত্রী ও চিত্রবেত্তা নিজে ধ্যানী পুরুষ ছিলেন বটে, তথাপি আধুনিক জ্ঞানের আওতায় তিনি কৃতীর দেশ বিভাজন করেছেন। তাঁর ধারণা মতে, ইতিহাস ঘটনামূলক, ডাক্তার কায়ামূলক, আর শিল্পী মায়ামূলক। এই তিনই একত্রে শিল্পী সুলতানের কর্মে বিরাজ করে। তাঁর ছবি ঘটনামূলক, যদিও তা ইতিহাসের দর্পণ না। কারণ তা এক ভবিষ্যৎ জগতের ইশারা মতোন। কোনো গুহ্য সত্য নয়, বরং সম্ভাবনার ক্ষেত্র হিসেবে তাঁর পাত্রপাত্রীগণ সুঠামদেহী এবং প্রকৃতির কোলে লালিত। তাঁর কায়াপন্থার যে মাত্রাটি তিনি অর্জন করতে চান, সেই সূত্রে তার মানব অবয়ব বাস্তবের অধিক, অর্থাৎ প্রতীকায়িত। প্রতীক নির্মাণের মধ্যে দিয়ে মায়ামূলক আচরণের শুরু। অর্থাৎ কায়ার সূত্রে উৎপাদিত চিত্র যখন কোনো নির্দিষ্ট ভাব প্রকাশ করতে উদ্যোগী। যে বস্ত্তগত বা অঙ্কন প্রক্রিয়া ভাব তৈরিতে সহায়ক হয় তা শুধু ‘বর্তমানতা’ নির্ভর নয়। যদিও সব ইমেজই নিজেকে একটি নির্দিষ্ট সময়ে, নির্দিষ্ট কোনো দর্শকের সামনে উপস্থিত হয়, তবু শুধু উপস্থিতির মধ্যে সে সীমাবদ্ধ নয়। বিশেষ করে সুলতানের চিত্রকল্প অতীত, বর্তমান ও ভবিষ্যৎ – এই তিনের মাত্রা একত্রে হাজির করেন। ভাবি সমাজের যে ভিশন বা স্বপ্ন শিল্পী ক্যানভাসে তুলে ধরেন, তার সূত্রে তিনি নব ভাব প্রকাশ করেন। অর্থাৎ গল্প, তার নিমিত্তে ব্যবহৃত কায়া এবং দুয়ের সমন্বয়ে গড়া ভাব, এই তিনে সুলতানের জগৎ গঠিত – যা চিত্রজ কিন্তু যা আলোচনা দাবি করে, চিন্তার উদ্রেগ করে।
সুলতানের ছবি সুনির্দিষ্ট কিছু চিন্তার বিসত্মার ঘটায়। তার পেছনে একপ্রস্থ কারণ জড়িত। উদাহরণ দিতে গিয়ে শিল্পবেত্তা বোরহানউদ্দিন খান জাহাঙ্গীরের সমাজপাঠ নির্ভরতত্ত্বে চোখ রাখা জরুরি। তিনি সুলতানের কৃষককে ‘আধুনিক ঐতিহ্যের অংশ’ বলে চিহ্নিত করেছেন। তাঁর ব্যাখ্যা যুতসই পাঠ উদ্ধার করে যখন তিনি এঁদের ‘ঐতিহ্যের অবদমিত অংশ এবং অবদমিত অংশের উপস্থিতি’ হিসেবে চিহ্নিত করেন। জনগোষ্ঠীর গরিষ্ঠ অংশের মধ্যে সমাজ পরিবর্তনের সম্ভাবনা একটি সামগ্রিক ভিশনের মধ্যে দিয়ে হাজির করেছেন সুলতান। যে ‘শৈল্পিক, সামাজিক এবং অসিত্মত্বিক স্বীকৃতি আদায়’ করে নেওয়ার কথা বোরহানউদ্দিন বলেছেন – এর মধ্যে দিয়ে সুলতান নিম্নবর্গের বাস্তবতা তুলে ধরে জনসমক্ষে তাদের উপস্থিতির প্রচলিত ধারণা বদলে দিয়েছেন। বোরহানউদ্দিনের মতে, কৃষককে তিনি ‘সমাজ বাস্তবতা এবং সমাজ কল্পনার এক সক্রিয় উপাদানে পরিণত’ করেছেন। সুলতানের এই মতো উপস্থাপনা বিঔপনিবেশিক তর্কের বা চৈতন্যের সূচনা করে। বোরহানউদ্দিন এই সূত্রে মাইকেলের ‘বুড়ো শালিকের ঘাড়ে রো’, বঙ্কিমের ‘কৃষক’, দীনবন্ধুর ‘নীল দর্পণ’, মীর মশাররফের ‘জমিদার দর্পণ’ এবং ‘গাজি মিয়ার বসত্মানী’ উদাহরণ হাজির করে ঔপনিবেশিক সভ্যতার ধারণায় প্রামিত্মকতায় পর্যবশিত কৃষক সমাজকে নাগরিক মানসে ফিরিয়ে আনার ট্র্যাডিশন চিহ্নিত করেছেন।
জীবনযাপনের ব্যতিক্রমী মাত্রার কারণে অনেকেই সুলতানের জগৎকে ‘বোহেমিয়া’ শব্দ দিয়ে ব্যাখ্যাও করার চেষ্টা করেছেন। এর বিপরীতে বোরহানউদ্দিন খান জাহাঙ্গীরের অ্যান্টিথিসিসটি লাগসই। তিনি গ্রামীণ ‘স্বাভাবিকতা, সরলতা, স্বতঃস্ফূর্ততার’ বিপরীতে জীবনযাপনের ‘বুদ্ধিবাদী পদ্ধতি’র উল্লেখ করে ব্যাখ্যা করেন যে, বুদ্ধির জোরে সংখ্যালঘিষ্ঠের সংস্কৃতি ‘প্রবল হয়েছে’, যা ধনতন্ত্র উদ্ভূত। তাঁর মতে, ‘দেশজ বুর্জোয়ারা ব্রিটিশ বুর্জোয়াদের নির্মিত নান্দনিক ভুবনে প্রবেশ করেছে, নির্মাণ করেছে বোহেমিয়া’, যা ‘ঔপনিবেশিক ধনতন্ত্রের নান্দনিক ভুবন’ এবং যার ‘প্রধান উপাদান নিসর্গ। এই নিসর্গ বানানো, কৃত্রিম এবং ব্রিটিশ বোহেমিয়ার অনুসরণে নির্মিত। সেজন্যে এর মধ্যে সুস্থ স্বাভাবিক প্যাস্টরালিজম নেই, বাস্তব গ্রামবাংলার প্রকৃতি নেই’। তাঁর ব্যাখ্যায়, ‘এভাবে প্রকৃতি ও নিসর্গের মধ্যে দূরত্ব তৈরি রয়েছে, নিসর্গ হয়ে উঠেছে আকুতি, ইচ্ছাপূরণ, বাস্তববর্জিত ‘সুন্দর’।’ এর পরের সিদ্ধান্তটিতে সত্য প্রকট : ‘এই সুন্দরই নিসর্গের মাধ্যমে শহরের জাতীয় সাংস্কৃতিক উপাদানে পর্যবশিত হয়েছে। নিসর্গের এই মতাদর্শিক নির্মিতির মধ্যে দিয়ে ঔপনিবেশিক আধুনিকতা গ্রামবাংলাকে নির্বাসিত করেছে। সুলতান এই মতাদর্শ চ্যালেঞ্জ করেছেন এবং নিসর্গের বিপরীতে প্রকৃতির দিকে হাত বাড়িয়েছেন।’
শুধু বুর্জোয়া সমাজ নয়, প্রাকধনতান্ত্রিক বিশ্বেও সভ্যতার যে আলামতগুলোকে আমরা সাংস্কৃতিক তুরীয় প্রকাশ বা অর্জন বলে মেনে নিই তার মাঝে বৃহত্তর জনগোষ্ঠীর স্থান হয়নি। গ্রিক সভ্যতায় জনগণের রুচিকে ‘ভালগার’ বলে বাতিল করে দেওয়া হয়েছে। যে সভ্যতায় ক্রীতদাসের ভূমিকা গৌণ করে দেখার কোনো সুযোগ নেই, সে-ই একই সভ্যতার জ্ঞানের ভিন্ন ধারায়ও দাসবৃত্তি নিয়ে আলাপচারিতাও লক্ষণীয় নয়। উনিশ শতকের ঔপনিবেশিক কলকাতায় ইবি হ্যাভেল, অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর এবং তাদের ভাবশিষ্য শ্যামাচারণ শ্রিমানী ‘আর্য’ সংস্কৃতির সন্ধান করতে মোগল দরবারি শিল্প থেকে শুরু করে আরো আরো রাজদরবারের দ্বারস্থ হয়েছেন। নিম্নবর্গের জনগোষ্ঠীর উচ্চ মার্গের সঙ্গে পেরে ওঠেনি – তারা যদি আদিতে অস্পৃশ্যতার মধ্যে দিয়ে নির্বাসিত হয়েছেন, আধুনিক সমাজে, পাশ্চাত্য জ্ঞানকা–র আওতায়, তারা শ্রেণির দৌরাত্ম্যে অদৃশ্য হয়ে গেছেন। ফলে যে দৃশ্যমানতা তথা উপস্থিতির মধ্যে দিয়ে সুলতান তাঁর ভিশন বা কল্পদৃষ্টি গড়ে তোলেন তা রাজনৈতিক। এ রাজনীতি কেবল আপন-পর বিভাজন দিয়ে বিচার করলে সমূহ বিপদের সম্ভাবনা রয়ে যায়। বলাবাহুল্য, শিল্পীর আশির দশকে আঁকা ‘দখল’ শিরোনামের বিখ্যাত চিত্রে কৃষক দলের জাগরণের যে দৃশ্য চাক্ষুষ হয় তা একপক্ষীয় জাগরণ নয়। এখানে লক্ষণীয় বিষয় হলো শত্রুর অনুপস্থিতি। এটি ভ্রম নয়, শিল্পী নিজে এর ব্যাখ্যা দিয়েছেন। শত্রুপক্ষের অনুপস্থিতি সুলতানের লক্ষ্য ছিল। তাঁর সরল উক্তিতে তিনি ‘সংঘাতের’ শিল্পী নন, ভায়োলেন্স দেখানো তাঁর লক্ষ্য নয়। তবে সংঘাতে অনিবার্যতা সম্পর্কে তিনি যে জানতেন, তার বেশ কিছু চিত্রে ঢাল-তলোয়ার, টেঁটা-বর্শা নিয়ে যুদ্ধের দৃশ্য নির্মাণে তা অনুভব করা যায়। মানব অবয়ব সমূহের বিবর্তিত রূপও এই সংঘাতপূর্ণ মুহূর্তে ভিন্ন এক মাত্রা যোগ করে। যা প্রত্যক্ষ হয়ে ওঠে তা সমাজ পুনর্গঠনের বাসনা। তাঁর ‘প্রথম রোপণে’র (১৯৭৬) পেশিবহুল মানব ও পাশ্চাত্য ধর্মীয় চিত্র থেকে ধার করা দুই নারী ফেরেশতা – এই ভাব-কল্পনার মধ্যে নবজীবনের যে খোঁজ শিল্পী দেন, তারই বিসত্মারিত প্রসত্মাব বিপস্নব বা জাগরণের সুরত ধারণ করে তাঁর প্যানারামিক যুদ্ধের ছবিগুলোতে। এসব ছবির আদ্যকথা যদি হয় ‘পুনরুজ্জীবন’ তারই ছায়ার শিল্পী মালিক-শ্রমিক, আশরাফ-আতরাফ বা নির্দিষ্ট করে বললে, জমিদার-রায়ত, কিংবা সরকার-প্রজার বিভাজন থেকে মুক্তির পথ খোঁজেন। এখানে ‘মালিকানার’ প্রশ্নটি বড় হয়ে ওঠে – বিশেষ মনোযোগ দাবি করে।
বোরহানউদ্দিন যে ‘সামাজিকতা বদলে’ দেওয়ার কথা বলেন, সুলতান, আবেদিন এবং কামরুলের সূত্রে, মূলত তা দৃষ্টি বদল মাত্র। সমাজ বদলের প্রাথমিক পর্যায়ে সামাজিক-সাংস্কৃতিক দুনিয়ায় নবদৃষ্টি ও সৃষ্টির মধ্যে দিয়ে যে জাগরণ সম্ভবপর হয়, সুলতান তার মধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ একটি বিষয়ের অবতারণা করেন। বোরহানউদ্দিন সুলতানবিষয়ক ভাবনার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ যে প্রশ্নটি যোগ করেন তা হলো ল্যান্ডস্কেপে বা দৃশ্য ‘মালিকানা’র প্রশ্ন উত্থাপন সংক্রান্ত। এই অঞ্চলে দৃশ্যশিল্পের ধারা অনেকাংশেই এক মাত্রিক এবং শুধুমাত্র চোখের আরাম সৃষ্টির উদ্দেশ্যে শিক্ষিত শিল্পীর হাতে অতিচর্চিত একটি ঘরান। সুলতান তথা লাল মিয়ার সেই নান্দনিকতার পরিসরে সমাজতাত্ত্বিক একটি বিষয়ের অনুপ্রবেশের সূত্রে নতুন সামাজিক যা সামষ্টিক দৃষ্টির সম্ভাবনা চাড়িয়ে দেন। ফলে পিস্নবিয়ান বা সাধারণের নিমিত্তে শিল্পী সামাজিক ডিসকোর্স তৈরি করেন যা সমাজকে শ্রেণি, ধর্ম, বর্ণ ও ভাষা নিরপেক্ষ এক অখ- শর্তসাপেক্ষে দেখতে শেখায়। এই শর্ত মিথ, কাল্ট বা সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের মধ্যে নির্দিষ্ট নয়, এর গভীর থেকেও সৃষ্টি হয়নি। বরং মানুষ-সমাজ এই দ্বিমাত্রিক অথচ ডায়নামিক সম্পর্কের মধ্যে চিহ্নিত করা যায়। স্থিতিস্থাপকতার (ইলাস্টিসিটি) সূত্রে মানুষ ও সমাজ উভয়ই ব্যাপকতাপূর্ণ। সমাজ যেমন প্রচলিত মূল্যবোধের মধ্যে দিয়ে বিকশিত হয় না, তেমন ক্ষমতাকাঠামোর মেকি নৈয়ায়িক মাপকাঠির মধ্যে মানুষের চরিতার্থতা অসম্ভব। সভ্যতা নামের যে তকমাটি প্রাক-আধুনিক ও আধুনিক যুগে বস্ত্তগত উন্নয়ন নির্দেশ করে, এর বাইরে গিয়ে মানুষকে তাই সত্য সন্ধান করতে হয়। সুলতান এমন সত্যসন্ধানী পুরুষ, যিনি কেন্দ্র থেকে স্বেচ্ছায় প্রামেত্ম সরে গিয়ে কেন্দ্রের ধারণাকে প্রশ্নবিদ্ধ করেছেন। আবুল মনসুর যখন বয়ান করেন যে সুলতান ‘কর্মিষ্ঠ ভূমিসম্পৃক্ত আদি মানবের একটি প্রতীক অর্জন’ করতে সরব হয়েছেন, তখন মাইকেল এনজেলোর সৃষ্টিতত্ত্ব ও নানান মিথিক ঘটনার মধ্যে দিয়ে মানবের যে অবিনশ্বর চৈতন্য লক্ষণীয় হয়ে ওঠে, তার দেশজ একটি চরিত্র যেন ফুটে ওঠে। ‘ভূমিপুত্রের স্বদেশি চিরায়ত রূপ’ হিসেবে মানবগোষ্ঠীকে চিহ্নিত করা চলে।
সুলতানের ভূমিপুত্ররা প্রাকৃত চরিত্রের, তারা প্রকৃতির কোলে ‘সহজ’ জীবনযাপনের ছক খুঁজে পেয়েছেন। তারা সম্ভাবনাময় – এ কারণে পেশিবহুল। নারী ও পুরুষ উভয় শ্রেণির সৌন্দর্যের নিরিখে পরিবর্ধিত কিন্তু পরিশীলিত নয়। কোনো নিরাসক্ত বা নৈর্ব্যক্তিক দৃষ্টি দিয়ে এদের সৃষ্টি সম্ভব হতো না। রূপ ও রূপকের মধ্যবর্তী অঞ্চল থেকে এই যে চিরায়তের ধারণার মধ্যে দিয়ে এদের জন্ম, এদের শুধু শিল্পকলার ইতিহাসের নিমিত্তে দেখার অবকাশ নেই। যুগ ও হুজুগ – দুই ত্যাগ করে এক অখ- দৃষ্টির সূত্রেই শিল্পী এদের ভবিষ্যৎ সমাজের সৃষ্টিশীল প্রতিনিধি হিসেবে দেখতে পেরেছেন।
সুলতান শিল্পজগতের মহাজন – তাঁর ছবি রচনা করার পাশাপাশি চিন্তার প্রক্রিয়া সব জারি ছিল। নিজেকে ব্যাখ্যা করতে গিয়ে শাহাদুজ্জামানের সঙ্গে এক সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন, ‘হ্যঁা, আমার ছবির ব্যাপার হচ্ছে সিম্বল অব এনার্জি। এই যে মাসলটা, এটা যুদ্ধের কাজে ব্যবহৃত হচ্ছে, সয়েলের সঙ্গে যুদ্ধ। শ্রমটাই হলো বেসিস। আর আমাদের এই অঞ্চল হাজার বছর ধরে এই কৃষকের শ্রমের ওপর দাঁড়িয়ে আছে। অথচ সেই কৃষকদের হাজার বছর ধরে মারা হয়েছে। ব্রিটিশ, পাকিসত্মান, এখনো।’ সমাজের যে মূল কর্মতৎপরতা – সুলতান তা চিহ্নিত করেছেন। তাঁর এই চিহ্নিতকরণের প্রক্রিয়ার পেছনের কিছু আলাপ রয়েছে। যৌবনের সুলতানের এমন কিছু সুনির্দিষ্ট অভিজ্ঞতা অর্জন করার সুযোগ হয়েছে পরবর্তী সময়ে যা তাঁর মূলধন হিসেবে কাজ করেছে। তাঁর আপন বয়ানের সূত্রে আমরা জানতে পারি যে, শিল্পীর কলকাতার ছাত্রজীবন শুরু হয়েছে তৎকালীন সময়ের বিখ্যাত চিত্রসমালোচক শাহেদ সুহরোয়ার্দীর ছত্রছায়ায়। তাঁরই মধ্যস্থতায় তিনি কলকাতার শিল্প-শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ভর্তি হতে পেরেছেন। সুলতানের ভাষায় যিনি ছিলেন ‘হাইলি কোয়ালিফাইড এক মানুষ’, তাঁর বাড়িতেই সুলতান সন্তানের মতো আদর পেয়ে শিক্ষাজীবন শুরু করেন। সুহরোয়ার্দীর ‘প্রকা- লাইব্রেরিটাতে’ শিল্পের ইতিহাস, ওয়ার্ল্ড মাস্টার পেইন্টারদের ছবি আর ডিসকোর্সের বইয়ে চোখ রাখার সুযোগ পান। এই হলো তাঁর শিল্পের তরিকায় প্রবেশের প্রথম ভিত্তি।
সমাজমুখিনতার পাঠ তিনি গ্রহণ করেন খাকসার আন্দোলন নামে একটি ‘সেবামূলক সংগঠনের’ সঙ্গে যুক্ত হওয়ার নিমিত্তে। ‘খেদমতে খালেক’ নামে এই আন্দোলনের ‘ইসলামি সেবা সৈনিক’ হিসেবে সেবা প্রদানের মধ্যে দিয়ে তিনি সর্বভারতীয় সমাজের সঙ্গে সম্পৃক্ত হন। এনায়েতুল্লা মাশরেকি ছিলেন এই আন্দোলনের প্রবক্তা, যার সঙ্গে ওঠা-বসা ও আলাপচারিতার মধ্যে দিয়ে সুলতান উপকৃত হয়েছেন।
ইকবাল ও নজরুলভক্ত এই শিল্পী এই দুই কবির কাজ থেকেও অনুপ্রেরণা পেয়েছেন সংখ্যাগরিষ্ঠ কর্মঠ জনতার নতুন রূপ উন্মোচনে। সুলতানিয়ে জমুরিয়েত বা ক্যাপিটালিস্ট সমাজকে ধ্বংসের যে ডাক ইকবালে তিনি চিহ্নিত করেছেন তারই সূত্র ধরে পতিত পাবনের অপর সহায় নজরুলের ওপর তাঁর বিশেষ মনোযোগ লক্ষ্য করা যায়।
যে শিল্পী মেহনত নিয়ে বিশেষ ভাবিত, তিনি মানবতত্ত্ব ও ধর্মতত্ত্ব বিষয়ে আগ্রহী ছিলেন। মানব নামের রহস্য উদ্ঘাটনে তাঁর নানামুখী তৎপরতার কথা অনেকেই উল্লেখ করেছেন। সুলতান তাঁর অঞ্চলের এক শৈবপন্থী সন্ন্যাসীর সঙ্গে মিশেছেন এবং সূর্যধ্যানও করেছেন বলে উল্লেখ পাওয়া যায়। রবীন্দ্রনাথ প্রসঙ্গে তিনি যথাযথ নিয়মেই কবির নিয়ত ব্যবহৃত ধারণা সীমার মাঝে আসীন, কিংবা যুদ্ধের মধ্যে বৃহতের খোঁজ যে সুফি চিন্তার প্রভাবে মিলেছে সে খোঁজ রাখতেন। আবার ঐতিহাসিক পরম্পরার হদিস নিতে ঐতিহ্যিক বিষয়েও তাঁর চিন্তাভাবনা ছিল, এমনটা শাহাদুজ্জামানের সাক্ষাৎকারেই পাওয়া যায়। গৌড়ের ইতিহাসে তিনি ‘বাঙালি ক্যারেক্টারটা’ পাওয়া যায় বলে দাবি করেন। হিন্দু-মুসলমান উভয়ের বৈষ্ণব পদাবলী লিখবার যে যৌথ সংস্কৃতি, তার মধ্যে দিয়েই তিনি আঞ্চলিক চরিত্রের খোঁজ দেন তাঁর পাঠকদের।
জাতি, ভেদাভেদ, ধর্ম, ঈশ্বর – এমন বহুমাত্রিক বিষয়ের ওপর আলোচনায় নানান বিক্ষক্ষপ্ত আলাপচারিতার মধ্যে সুলতানের সদা সজাগ এক মনের সন্ধান মেলে।
আইডেন্টিটি নিয়ে কথার একপর্যায়ে তিনি বাঙালি শিল্পীর রং কেন বাদামি হতে বাধ্য তার ব্যাখ্যা জীবন ও বাস্তবতার সূত্রেই ঘুরপাক খায়। তবে পটুয়া লাইন ব্যবহার নিয়ে তাঁর ভাষ্য গুরুত্বপূর্ণ। সুলতান বলছেন : ‘বাঙালি ঐ পটুয়া লাইনে এ কাজ করলেই শুধু হবে না। পটুয়া লাইনে ক্যারেক্টারটা ধরে নতুন করে ভাবা যেতে পারে।’ এবং সব শেষে যে মন্তব্য দিয়ে আইডেন্টিটির বিষয়ক আলাপে ছেদ টানেন তা ভাবনার উদ্রেগ করে – পেইন্টিংয়ে আসলে বেঙ্গল স্কুল বলে কিছু নেই।
কোনো সিদ্ধান্ত স্বতঃসিদ্ধ নয়। তবু সুলতানের মন্তব্য চিন্তার যে নতুনতর ধরন সামনে হাজির করে তা কেবল কৌতূহল জাগার নয়; বরং নতুন ভাব ও জ্ঞান উৎপাদনে সহায়ক হয় বললে বাড়িয়ে বলা হয় না।
যখন তাঁর দূরবর্তী মানুষেরা তাঁকে আউটসাইডার বলে ঠাওরেছেন, তখন এই সপ্রতিভ ব্যক্তিত্ব তাদের ভুল ভাঙিয়ে দিয়েছেন। তিনি তাঁর নিকটজনের কাছে, গ্রামবাসীর কাছে অত্যন্ত শ্রদ্ধেও অথচ স্বাভাবিক এক মানুষ হিসেবে পরিচিত ছিলেন। সুলতানের ব্যক্তিত্ব মূলত পারফর্মেটিভ ব্যক্তিত্ব – অর্থাৎ ক্রিয়া-বিক্রিয়ার অধীন স্বতঃস্ফূর্ত ব্যক্তিত্ব। গান গাইতে গাইতে নাচের ঘোরে চলে যাওয়া, নারীভাব ধারণা করতে শাড়ি পরা, বাঁশি বাজিয়ে রাধা-কৃষ্ণের প্রেমের ভাব স্মরণে নেওয়া – এসবই শরীরযোগে ভাব উৎপাদনের পদ্ধতি বিশেষ।
পারফর্মেটিভ হওয়ার কারণে শিল্পী সুলতান তথা লাল মিয়া শিল্পবস্ত্ত ও শিল্পের জগৎ উভয়কে দ্বৈপায়নতা থেকে রেহাই দিয়েছেন। শিল্প ও শিল্পীর জগৎ যখন বহিঃজগৎ থেকে সম্পর্কহীন দ্বীপ হিসেবে প্রবর্তিত হয় – পুঁজিবাদের আওতায় অত্যন্ত প্রকট চরিত্র ধারণ করেছে – অমন দ্বৈপায়নতা থেকে সুলতান মুক্ত ছিলেন। বোহেমিয়া নির্মাণের যে বাসনা ইউরোপে সৃষ্টিশীল মানুষের জগৎকে সাধারণের দুনিয়া থেকে আলাদা করার উদ্যোগ বলে ধরা যায়, তেমনটা সুলতানের তরিকা নয়। তিনি শিল্প ও জীবন এই দুইয়ে সুরাহা করেছেন সন্ন্যাসভাব দিয়ে নয়, কর্মভাব দিয়ে। এ কারণে ‘একাডেমিক প্রসেসটা’ তাঁর ‘কাজে খুব লেনদি মনে হচ্ছিল’। কলেজের ছয় বছরের কোর্সে হঠাৎ তিনি ইতি টেনে দেন তিন সাল পরেই। তাঁর দুনিয়া দেখতে বেরিয়ে পড়ার মধ্যে সাধকের আকুতি ছিল, কিন্তু জীবনের মূলস্রোত থেকে বাইরে যাওয়ার ইচ্ছা ছিল না। শিল্পকর্ম অন্যান্য কর্মের পাশে তাই অনায়াসে জায়গা করে নেয়। জীবনের অখ-তার প্রশ্নটি তাই তাঁর ঘুরে বেড়ানো ও পারফর্মেটিভ ব্যক্তিত্বের মধ্যে থেকে সূচনা হয়েছে বলে ধারণা করা যায়।
বাজারে যে সুলতানের ছবি সহজলভ্য হয়ে উঠেছে – সেসব ড্রইং অনেকাংশে শিল্পীর শেষ জীবনের ম্রিয়মাণ ধারার ফসল। এসব ছবিতে চোখ রেখে সুলতানের ছবি ও তাৎপর্য বিষয়ে মীমাংসা হবে না, তার আদ্যশক্তিতে বলীয়ান প্রটাগনিস্টরা পুনরাবৃত্তির কারণে হারিয়ে গেছে বললে সত্যের অপলাপ হয় না। এর ওপর আবার নকলের বোঝা শিল্পীর সঙ্গে বোঝাপড়ার সুযোগ বারবার নষ্ট করে চলেছে। শিল্পী সুলতান, কামরুল ও জয়নুলের চাহিদা বেড়েছে, সঙ্গে বেড়েছে নকলকারের তৎপরতা। তবে খোদ বা আসল সুলতান কিংবা নকল সুলতান – এই দুয়ের কোনো সুরাহায় না গিয়ে, তাঁর মানব অবয়ব, নতুন সমাজ নির্মাণের বাসনা, শরীর ও ক্রিয়াশীল জনগোষ্ঠীর নিরিখে তাঁর মূল্যায়ন সম্ভব।
সুলতান ছিলেন অমত্মঃকালীন সময়ের নির্মাতা – অর্থাৎ টেলিওলজিকাল চিন্তক। তিনি সভ্যতা পরিণতি মালিকানার বিনাশে এবং মানুষে একত্বে দেখতে পেয়েছিলেন। তাঁর শক্তি এই ভিশনের নিরিখে তাঁর অসংখ্য ছবিতে অক্ষরের মতোই স্পষ্ট।