হা স না ত আ ব দু ল হা ই
প্রাচ্য ছবির প্রাণ হলো রেখা। রেনেসাঁ ও তারই ধারাবাহী পাশ্চাত্য ছবিতে রেখা বলতে কিছু নেই; আলোছায়াই তার প্রাণ।
নন্দলাল বসু
-দৃষ্টি ও সৃষ্টি
শিল্পের শুরুতেই অত্যাবশ্যকীয় উপাদান হিসেবে থাকে ড্রয়িং। এর অবর্তমানে কোনো কিছুই হয় না।
জর্জিও ভাসারি
-লাইভস্ অব আর্টিস্টস
এক
দুটি উক্তিতে আপাতদৃষ্টিতে সামঞ্জস্য নেই, বরং বিরোধের আভাস রয়েছে। কিন্তু আলোছায়া দিয়েও ড্রয়িং আঁকা যায়, একথা যখন তাঁর বইতে নন্দলাল উলেস্নখ করেন তখন তাঁর উক্তি আর ভাসারির মমত্মব্য পরস্পরবিরোধী মনে হয় না। সব শিল্পের পেছনেই রয়েছে ড্রয়িং, এই ধ্রম্নব সত্য কোনো শিল্পী কিংবা সমালোচকই অস্বীকার করেন না। রেখার সাহায্যে প্রধানত ড্রয়িং আঁকা হয় বলেই তাঁর বিকল্প মাধ্যমগুলি অপ্রধান হয়ে যায় না। কিন্তু ড্রয়িংয়ে রেখার ব্যবহারই সবচেয়ে বেশি। বলা হয়, রেখাই ছবি আঁকার ব্যাকরণ।
ড্রয়িং বলতেই সাধারণত বোঝায় কাগজে বা ক্যানভাসে রেখা টানা। এমনভাবে রেখা আঁকা যার ফলে একটা ঘের, ইংরেজিতে যাকে বলে আউটলাইন, তৈরি হয় এবং পরিণতিতে দেখা যায় একটা দৃশ্য বা নকশার রূপের প্রতিকৃতি। একে আকারও বলা যায়। শিল্প সম্বন্ধে পেস্নটো যা-ই বলে থাকুন না কেন, বাসত্মব জগতের অনুকরণস্পৃহাই একজন ব্যক্তিকে শিল্পী হওয়ার আগেই রেখার সাহায্যে ড্রয়িং এঁকে রূপ সৃষ্টিতে উদ্বুদ্ধ করে। আলোছায়ার সাহায্যে যে ড্রয়িং, সেই কৌশল আয়ত্তে আনার জন্য স্বতঃস্ফূর্ততা নয়, অর্জ্জিত জ্ঞানের প্রয়োজন, যা সাধারণ মানুষের না থাকলেও শিল্পীর থাকে। কিন্তু শিল্পী ড্রয়িং করার জন্য রেখারই ব্যবহার করেন সবচেয়ে বেশি, কেননা এটি সহজ এবং স্বতঃস্ফূর্ত। তবে এই মাধ্যমে সফল ড্রয়িং আঁকার জন্য শিল্পীর প্রয়োজন দৃশ্যমান রূপ বা বস্ত্তর আকার সম্বন্ধে স্পষ্ট ধারণা এবং রেখা আঁকার জন্য হাতের কুশলী ব্যবহার। এই দুটি দক্ষতা জন্মসূত্রে লাভ করেন কেউ কেউ। অন্যরা এবং জন্মগত সূত্রে প্রতিভাবান ব্যক্তিরাও প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার মাধ্যমে এ দুটি বিষয়ে বিশেষ জ্ঞান অর্জন করে থাকেন। এমন গুণী ব্যক্তি যখন প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা লাভ করেন তাঁর জন্মগত সূত্রে প্রাপ্ত ড্রয়িং আঁকার দক্ষতা আরো বৃদ্ধি পায়। শিল্পী এস এম সুলতানের ড্রয়িং নিয়ে আলোচনায় এই ভূমিকা বেশ প্রাসঙ্গিক।
সুলতান তাঁর বিশাল আকারের তৈলচিত্রে সুস্বাস্থ্যের অধিকারী, পেশিবহুল নর-নারী ও শিশুর ছবি এঁকে বিশেষত্ব এবং খ্যাতি অর্জন করেছেন। তাঁর শিল্পচর্চার এসব সৃষ্টিই সবচেয়ে বেশি আলোচিত। সে তুলনায় তাঁর আঁকা রেখাভিত্তিক ড্রয়িং তেমন পরিচিতি পায়নি, খ্যাতিও নয়। তাঁর স্বল্প যে কয়েকটি প্রদর্শনী হয়েছে সেখানে কখনো কিছু ড্রয়িং স্থান পেলেও তা যেন দেয়ালে শূন্যস্থান পূরণের জন্য, শিল্প-সৌকর্যের কারণে নয়। এর কারণ তাঁর আঁকা ড্রয়িংয়ের স্বল্পতা বলা যাবে না, কেননা তিনি কিশোর বয়স থেকে আমৃত্যু প্রচুর ড্রয়িং করেছেন। ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা এবং অবহেলায় নষ্ট হয়ে যাওয়ার জন্যই সুলতানের ড্রয়িং নিয়ে আলোচনা প্রায় হয়ইনি; মূল্যায়ন তো নয়ই। ২০১৩ সালে বেঙ্গল গ্যালারিতে অধ্যাপক আবুল কাশেম জোয়ারদারের ব্যক্তিগত সংগ্রহে রাখা আশিটি ড্রয়িংয়ের প্রদর্শনীই ছিল সুলতানের আঁকা ড্রয়িংয়ের সঙ্গে শিল্পপিপাসু ও সুলতানপ্রেমিকদের প্রথম বিশদ পরিচয়। কিন্তু এসব ড্রয়িং কেবল একটা বিশেষ সময়ের হওয়ার জন্য তাঁর ব্যবহৃত এই মাধ্যম সম্বন্ধে সম্পূর্ণ ধারণা পাওয়া যায় না। তবে ড্রয়িং যে তাঁর প্রিয় মাধ্যম ছিল তা এই প্রদর্শনী থেকে বেশ বোঝা যায়। তাঁর শিল্পী-মানস সম্বন্ধে সামগ্রিকভাবে ধারণা পেতে হলে ড্রয়িংয়ের আলোচনার বেশ প্রয়োজন।
প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষালাভের আগেই সুলতানের শিল্পকলা চর্চায় হাতেখড়ি ড্রয়িং দিয়ে। এই সূচনা ছিল বেশ অপ্রচলিত পদ্ধতির অনুসরণ। তাঁর বাবা মেসের আলী নড়াইলের জমিদার ডিএল রায়ের প্রধান রাজমিস্ত্রি হিসেবে জমিদারবাড়ির অলিন্দ, প্রবেশপথ, রেলিং এবং ছাদের দেয়ালে অনেক নকশা যোগ করে অলংকৃত করেছিলেন। এইসব নকশা দেখে অনুকরণ করে কিশোর বয়সেই সুলতান মাটিতে কাঠি দিয়ে ড্রয়িং করতেন। এর মধ্যে মূর্ত এবং বিমূর্ত দুই ধরনের কাজই ছিল। জমিদার ডিএল রায় তাঁর পারদর্শিতার কথা শুনে বাড়িতে ডেকে নিয়ে নিজের প্রতিকৃতি এঁকে দিতে বলেন। আঁকার পর তিনি চমৎকৃত হন এবং তাঁকে স্কুলে ভর্তি করিয়ে দেন। সুলতানের জবানিতে জানা যায়, সে সময় জমিদারবাড়ির বসবার ঘরের দেয়ালে গিয়োত্তো, মিলে এইসব ইউরোপীয় শিল্পীর ছবির বাঁধানো রিপ্রডাকশন দেখে তিনি বেশ অনুপ্রাণিত হন। সেসব ছবি অবশ্য ড্রয়িং ছিল না; কিন্তু ড্রয়িংয়ের ওপর ভিত্তি করেই আঁকা হয়েছিল। জমিদার ডিএল রায়ের ছেলে অরুণ রায়ের ছবি আঁকার শখ ছিল। সুলতান তাঁর নির্দেশনায় বিভিন্ন প্রাণীর ড্রয়িং করতে থাকেন, কেননা স্কুলে ছবি আঁকার প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা ছিল না। স্কুলে পঞ্চম শ্রেণিতে পড়ার সময় দশ বছর বয়সে তাঁকে একজন গুরুত্বপূর্ণ অতিথির প্রতিকৃতি আঁকার কথা বলা হলো। অতিথি ছিলেন স্যার আশুতোষ মুখার্জ্জীর ছেলে শ্যামপ্রসাদ মুখার্জ্জী। সুলতানের আঁকা নিজের পোর্ট্রেট পেয়ে তিনি এতই মুগ্ধ হন যে এটি কলকাতায় নিয়ে নিজ বাড়ির বসার ঘরের দেয়ালে টাঙিয়ে রাখেন। তাঁর মতে, এটিই ছিল সবচেয়ে সুন্দর প্রতিকৃতি। সুলতানের তখনো কোনো প্রাতিষ্ঠানিক প্রশিক্ষণের সুযোগ হয়নি। তাঁর সৃজনশীল প্রতিভা ছিল নিঃসন্দেহে ঈশ্বর প্রদত্ত।
স্কুলে ষষ্ঠ শ্রেণিতে ওঠার পর সুলতানের কলকাতায় আর্ট স্কুলে ভর্তি হয়ে চিত্রকলা বিষয়ে শিক্ষা লাভের বাসনা প্রবল হয়ে উঠল। কলকাতায় গিয়ে জমিদার ডিএল রায়কে তাঁর ইচ্ছার কথা জানানোর পর তিনি বললেন, স্কুল পরীক্ষা এন্ট্রান্স পাশ না করলে কাউকে আর্ট স্কুলে ভর্তি করা হয় না। প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা লাভের জন্য তাঁর বাসনা অপূর্ণই থেকে যেত যদি না জমিদার ডিএল রায়ের সুপারিশে খ্যাতিমান শিল্পরসিক এবং শিক্ষাবিদ সাহেদ সোহরাওয়ার্দী তাঁর পৃষ্ঠপোষক হয়ে আর্ট স্কুলের পরিচালনা পর্ষদকে ভর্তি পরীক্ষায় অংশগ্রহণের সুযোগ দেওয়ার জন্য বলতেন। অন্যান্য ছাত্রছাত্রীর সঙ্গে সুলতানও ভর্তি পরীক্ষায় অংশ নিলেন। পরীক্ষায় বিষয় ছিল ভেনাস ডি মিলোর মূর্তি দেখে নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে ড্রয়িং আঁকা। পরীক্ষায় সব প্রতিযোগীর মধ্যে সুলতান প্রথম হয়ে আর্ট স্কুলের প্রথম বর্ষে ভর্তির সুযোগ পেয়ে যান। তখন পর্যমত্ম তাঁর নাম ছিল লাল মিয়া। সাহেদ সোহরাওয়ার্দী পছন্দ করে শেখ মোহাম্মদ সুলতান নাম দিয়ে বললেন, একজন শিল্পীর নাম এমনই হওয়া উচিত। নাম পরিবর্তনের সঙ্গে সুলতানের জীবনের নতুন অধ্যায় শুরু হলো। সাহেদ সোহরাওয়ার্দীর স্নেহপুষ্ট হয়ে তিনি তাঁর বাড়িতে থেকেই পড়াশোনা করতে থাকলেন।
আর্ট স্কুলে অধ্যক্ষ ছিলেন মুকুল দে, যিনি পরবর্তী সময়ে কবিগুরু রবীন্দ্রনাথের সচিব হয়েছিলেন। তাঁর স্ত্রী বীণাপাণি ছিলেন সুলতানের সহপাঠিনী। মুকুল দে সুলতানের ড্রয়িং করার কুশলতা দেখে বীণাপাণিকে সঙ্গে নিয়ে আউটডোর ড্রয়িংয়ের নির্দেশ দিলেন। সুলতান ধূপখোলায় ট্যানারির শ্রমিকরা যখন কাজের অবসরে বাইরে বেরিয়ে এসে নানা কাজে লিপ্ত হয় সেসব মুহূর্তের ছবি ড্রয়িংয়ে ধারণ করলেন। অল্প সময়েই তাঁর আঁকা ড্রয়িংগুলি সম্পূর্ণ হয়ে যেত; কিন্তু বীণাপাণি তা পারতেন না। মুকুল দে দেখে সুলতানের প্রশংসা করতেন আর স্ত্রী বীণাপাণিকে তাঁর মতো আঁকার জন্য বলতেন। এ থেকে বোঝা যায়, আর্ট স্কুলের শিক্ষা শুরু হতে না হতেই সুলতান ড্রয়িংয়ের জন্য খ্যাতি অর্জন করেন। তিনি যে ড্রয়িংয়ে বিশেষভাবে পারদর্শী সে কথা অবশ্য স্কুলে ভর্তি পরীক্ষার সময়ই প্রমাণ করেছিলেন।
ড্রয়িংসহ সব বিষয়েই প্রথম হয়ে সুলতান প্রথম থেকে দ্বিতীয় বর্ষে উত্তীর্ণ হন। ততদিনে শিল্পচর্চার ‘ব্যাকরণ’ ড্রয়িং সম্পর্কে তিনি সিদ্ধহসত্ম হয়েছেন। একই কৃতিত্বের সঙ্গে তৃতীয় বর্ষে উত্তীর্ণ হওয়ার পর প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার প্রতি তাঁর আকর্ষণ কমে গেল। তিনি শুনতে পেলেন বোহেমীয় জীবনের ডাক, যা শিল্পীদের জন্য ভবিতব্যই বলা যায়। এই ট্র্যাডিশন ছাড়াও তাঁর ভেতর কাজ করছিল স্বভাবসুলভ চঞ্চলতা আর কোথাও কোনোদিন বাঁধা পড়ে না থাকার প্ররোচনা। তিনি ট্রেনে ভারতবর্ষের বিভিন্ন অঞ্চল বেড়াতে যাবার অভিলাষ প্রকাশ করলেন তাঁর অভিভাবক সাহেদ সোহরাওয়ার্দীর কাছে।
তিনি ততদিনে কাছ থেকে পর্যবেক্ষণ করে সুলতানের মতিগতি বুঝে গিয়েছেন। রবীন্দ্রনাথের গল্প ‘অতিথি’র নায়কের মতো এই তরুণকে যে শেকল দিয়ে বেঁধে রাখা যাবে না এটা উপলব্ধি করে তিনি অনুমতি দিলেন। শুধু বললেন, সুলতান যেন স্কুল থেকে সিকিউরিটি হিসেবে জমা দেওয়া টাকা তুলে না নেন। একথা বলার পেছনে তাঁর আশা ছিল যে হয়তো অদূর ভবিষ্যতে সুলতান কলকাতা ফিরে আসবেন এবং আবার স্কুলে পড়াশোনা করে শিক্ষা সমাপ্ত করবেন। ট্রেনে ভ্রমণের খরচ হিসাবে তিনি সুলতানকে কিছু টাকা দিলেন, যা ছিল সামান্যই। এর পেছনেও উদ্দেশ্য ছিল একই : সুলতান টাকা শেষ হয়ে গেলে তাড়াতাড়ি কলকাতা ফিরে আসবেন। কিন্তু সোহরাওয়ার্দী সুলতানের অফুরমত্ম পুঁজির কথা জানতে পারেননি; ড্রয়িং করে অর্থ উপার্জন!
সুলতান একটা ব্যাগে কিছু কাপড়, আর ড্রয়িংয়ের কাগজ-পেন্সিল নিয়ে বেরিয়ে পড়লেন ট্রেনযোগে ভারত ভ্রমণে। শীঘ্রই সাহেদ সোহরাওয়ার্দীর দেওয়া টাকা শেষ হয়ে গেল। তখন থাকা এবং খাওয়ার খরচ মেটানোর জন্য তিনি স্টেশনে যাত্রীদের প্রতিকৃতি আঁকতে শুরু করলেন। কখনো অনুমতি নিয়ে, কখনো যাত্রীর অজামেত্মই। এইসব যাত্রীর মধ্যে ছিল ইংরেজ গোরা সৈন্য। তখন দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ চলছে। গোরা সৈন্যরা ট্রেনযোগে স্থান থেকে স্থানামত্মরে যাচ্ছে। তাদের পকেটে বেতনের টাকা অথচ খরচের তেমন জায়গা নেই। তারা তাদের পোর্ট্রেট দেখে খুশি হয়ে মুঠো ভরে টাকা দিলো সুলতানকে। কেউ দশ, কেউ বিশ, কেউবা পঁচিশ-ত্রিশ, অথবা পঞ্চাশ। ভিক্ষা নয়, পরিশ্রম করেই স্টেশনে স্টেশনে অর্থ উপার্জন করলেন সুলতান। চাহিদা মিটিয়েও তাঁর কাছে উদ্বৃত্ত থাকত। তিনি স্টেশনে থেমে থেমে সামনে অগ্রসর হলেন। এই সময় পোর্ট্রেট ড্রয়িংয়ে আরো পারদর্শী হয়ে উঠলেন। অল্প সময়ে দক্ষ হাতে এঁকে গেলেন একের পর এক পোর্ট্রেট। এর সবই ছিল কাগজের ওপর পেন্সিলের রেখা টেনে আঁকা। না দেখলেও বোঝা যায় সেই সব রেখা ছিল সূক্ষ্ম এবং দীর্ঘ, সময়ের সংক্ষিপ্ততার জন্য। স্টেশনে ট্রেন বেশিক্ষণ থামছে না, সেই সময়ের ভেতর একজন না, একাধিক ব্যক্তির পোর্ট্রেট আঁকতে গেলে রেখার ব্যবহারে মিতব্যয়ী হওয়ার বিকল্প ছিল না। এমন পরিস্থিতিতে ড্রয়িং করা ছিল একটা চ্যালেঞ্জ। সুলতান সেই চ্যালেঞ্জ গ্রহণ করেছিলেন অবলীলায়।
আগ্রা স্টেশনে পৌঁছে সুলতান যথারীতি ড্রয়িং করছেন। এক ভদ্রলোক দেখে কাছে বসে নিজের পরিচয় দিয়ে বললেন, মর্গে শব ব্যবচ্ছেদের ডাক্তার হিসেবে তাঁর একজন সহকারী প্রয়োজন, যে ব্যবচ্ছেদ হয়ে যাবার পর কাটা-ছেঁড়া শবের অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের স্কেচ করবে। এর বিনিময়ে তিনি সহকারীকে কিছু টাকা দেবেন এবং নিজের বাড়িতে থাকার ব্যবস্থা করবেন। সুলতান ভাবলেন মানুষের শরীরের এনাটমি নিয়ে কাজ করলে তাঁর ফিগারেটিভ ড্রয়িং আরো নিখুঁত হতে পারবে। তিনি ডাক্তারের প্রসত্মাবে রাজি হয়ে দয়ালবাগে তাঁর বাড়িতে উঠলেন। মর্গে ব্যবচ্ছেদ হয়ে যাওয়া শবের অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের ড্রয়িং করতে গিয়ে তিনি যেমন নতুন অভিজ্ঞতা সঞ্চয় করলেন, একই সঙ্গে একের পর এক মৃতদেহ দেখে তাঁর মধ্যে জেগে উঠল বিবমিষা। কিছুদিন ডাক্তারের সঙ্গে কাজ করার পর বিদায় নিয়ে পৌঁছলেন লক্ষক্ষনŠ। সেখানে সংগীত শেখার বিখ্যাত প্রতিষ্ঠান মরিস কলেজের কথা তাঁর জানা ছিল, কেননা কলকাতায় যাবার পর উচ্চাঙ্গসংগীতের প্রতি তাঁর আগ্রহ জন্মেছে। মরিস কলেজের অধ্যক্ষের কাছে গিয়ে গান শেখার ইচ্ছা প্রকাশ করলেন তিনি। অধ্যক্ষ বিয়াস জানালেন কোনো অসুবিধা নেই। ডিএল রায় আসছেন, এখানেই তাঁর গান শুনতে পারবেন তিনি। অধ্যক্ষ বিয়াস কলেজের হোস্টেলেই তাঁর থাকার ব্যবস্থা করে দিলেন। সুলতান রাতে গান শেখেন আর দিনের বেলা কাগজ-পেন্সিল নিয়ে লক্ষক্ষন শহরের পুরনো প্রাসাদ এবং অন্যান্য সৌধের ড্রয়িং করেন। হয়তো তাঁর ইচ্ছা ছিল ছবিগুলি নওয়াববাড়ির লোকজন দেখে পছন্দ করে কিনতে পারে। এই উদ্দেশ্য ছাড়া কেনই বা তিনি পুরনো প্রাসাদ আর সৌধের স্কেচ করবেন?
নওয়াববাড়ির লোকদের নজরে পড়লেন তিনি ঠিকই, তবে তারা ছবি কেনার কথা না বলে নওয়াবের মেয়ের ছবি আঁকা শেখার কথা জানাল; সুলতান কি তাকে ছবি আঁকা শেখাতে পারবেন? সুলতান রাজি হয়ে গেলেন। টাকা না দিলেও থাকা-খাওয়ার ব্যবস্থা তো হয়ে যাবে, ভাবলেন তিনি। ক’দিন পরই মরিস কলেজের হোস্টেল ছেড়ে এসে উঠলেন আমিনাবাদ নওয়াববাড়ির অতিথিশালায়। তাঁর ছাত্রী শুধু নওয়াবজাদি না, আরো দুজন মহিলা, নওয়াব পরিবারের দুই শরিকের পুত্রবধূ দুজন। এদের একজন ছিল ফরাসি। বেশ
আদরে-যত্নে থাকলেন সুলতান, মনোযোগ দিয়ে ছবি আঁকা শেখালেন তিন ছাত্রীদের। ছবি আঁকার জন্য তারা কিনে আনল দামি কাগজ, রঙিন পেন্সিল, দামি কলম আর কালি। এতদিন শুধু কাগজের ওপর পেন্সিল দিয়ে এঁকেছেন তিনি, এখন কলম আর রঙিন কালির ব্যবহারও করতে পারলেন। সময়ের অভাবে দ্রম্নত হাতে অল্প কয়েকটি রেখার সাহায্যে নয়, বেশ সময় নিয়ে বিশদভাবে আঁকলেন নওয়াববাড়ির সদস্যদের পোর্ট্রেট। ছাত্রীদের শেখাতে গিয়ে প্রথমে কাগজ-পেন্সিল ব্যবহার করলেও পরে যে অন্যান্য উপকরণ দিয়ে ছবি আঁকতে শিখিয়েছেন এটা অনুমান করা যায়। এই পর্বে সুলতানের ড্রয়িং আঁকা সুস্থিরতার জন্য ভিন্ন রূপ পেল। জাপানি ড্রয়িং সম্পর্কে চিত্র সমালোচক শোভন সোম লিখেছেন : ‘জাপানি চিত্রের রেখা অস্থির, উত্তেজক, আকস্মিক এবং মচমচে।’ আমিনাবাদ নওয়াববাড়িতে সুলতান যেসব ড্রয়িং এঁকেছেন সেসবের ভেতর এই বৈশিষ্ট্যগুলি ছিল না, একথা বলা যায়। এসব ড্রয়িংয়ে স্থূলতা থেকে সূক্ষ্মতা, কর্কশ থেকে কোমলতা, শুষ্কতা থেকে আর্দ্রতায় এবং গাঢ় থেকে হালকা বৈশিষ্ট্য থাকা স্বাভাবিক এবং খুব সম্ভবত ছিল। এই পর্বকে আমরা সুলতানের ড্রয়িং আঁকার নতুন অধ্যায় বলতে পারি।
ছয় মাস থাকার পর সুলতান নওয়াববাড়ি থেকে বিদায় নিতে চাইলেন। কিন্তু ছাত্রী তিনজন তো বটেই অন্য সদস্যরাও তাঁকে ছাড়তে চায় না। ততদিনে তাঁর সারল্য আর ব্যবহারের মাধুর্য তাদেরকে মুগ্ধ করে ফেলেছে। অনেক বলার পর সুলতান অব্যাহতি পেলেন, নওয়াববাড়ি তাঁকে অনিচ্ছা সত্ত্বেও যেতে দিলো। সুলতান আবার ভবঘুরে জীবনে ফিরে গেলেন। এবার প্রথম গমত্মব্য হলো সিমলা। সেখানে পৌঁছে দেখলেন শহরের বাড়িঘর সবই পাহাড়ের চূড়ায়। শহরের কেন্দ্রে গিয়ে এক ফটোগ্রাফির দোকান দেখে সুলতান তাঁর আঁকা কিছু ড্রয়িং সেখানে রেখে বিক্রির প্রসত্মাব দিলেন। দোকানের মালিক রাজি হয়ে গেলেন। সুলতান প্রত্যেকদিনই সেখানে গিয়ে খবর নেন কটা ছবি বিক্রি হলো, কিন্তু মালিকের উত্তরে হতাশই হলেন। ক’দিন পর মালিক জানাল এক বিদেশিনী ছবি দেখে তাঁর সঙ্গে দেখা করতে চেয়েছেন। মিসেস স্মিথ নামে সেই বিদেশিনীর সঙ্গে দেখা করতে তাঁর হোটেলে যাওয়ার পর তিনি জানালেন যে সুলতানের ছবি তাঁর পছন্দ হয়েছে, তবে আরো ছবি আঁকতে হবে; ড্রয়িং, জলরং। তিনি সব ছবি দিয়ে একটা প্রদর্শনীর ব্যবস্থা করবেন। প্রদর্শনীতে বিক্রি ছবির মূল্যের বিশ পারসেন্ট রাখবেন তিনি ইংল্যান্ডে তাঁর পরিচালিত এতিমখানার জন্য। সুলতান রাজি হয়ে গেলেন। আরো ছবি আঁকার জন্য মিসেস স্মিথ তাঁকে কাগজ, রং, পেন্সিল, কলম, ব্রাশ কিনে দিলেন। এই প্রথম তিনি ড্রয়িংয়ের পাশাপাশি জলরঙে ছবি আঁকলেন। ল্যান্ডস্কেপ, হিলস্কেপের জলরং আর মানুষের পোর্ট্রেট দিয়ে প্রদর্শনী হলো। শর্ত অনুযায়ী মিসেস স্মিথ সুলতানকে বিক্রির শতকরা আশি ভাগ দিয়ে নিজে বিশ ভাগ রাখলেন। দেখা গেল বিক্রির মধ্যে জলরঙে আঁকা ল্যান্ডস্কেপ, হিলস্কেপই বেশি বিক্রি হয়েছে। এটাই স্বাভাবিক। নিজের প্রতিকৃতি না হলে ড্রয়িং কিনতে চায় খুব কম লোকই। আর ঘর সাজানোর জন্য ড্রয়িংয়ের তুলনায় জলরংঙের ছবিই বেশি উপযোগী। সুলতান তখন পর্যমত্ম তৈলচিত্র আঁকা শুরু করেননি। এর কারণ শুধু অনভিজ্ঞতা নয়, ভ্রাম্যমাণ জীবনে স্বল্পকালীন সময়ে এবং প্রবাসকালে ধীরে সুস্থে তৈলচিত্র আঁকা প্রায় অসম্ভব। এজন্য সুলতান ড্রয়িং আর জলরঙের মধ্যেই তাঁর প্রদর্শনী সীমাবদ্ধ রেখেছিলেন।
সিমলায় প্রদর্শনী উদ্বোধন করেছিলেন কাপুরথালার মহারাজা। তিনি সুলতানের ছবি দেখে মুগ্ধ হয়ে তাঁর প্রতিকৃতি আঁকার জন্য জলন্ধরে আমন্ত্রণ জানালেন। সুলতান সম্মত হয়ে জলন্ধরে গিয়ে মহারাজার অতিথি হলেন। কিন্তু মহারাজা এতই ব্যসত্ম থাকেন যে, তাঁর পোর্ট্রেট আঁকা আর হয় না। অপেক্ষা করতে করতে সুলতান আকরাম খাঁ নামে এক দোকানের মালিকের মাধ্যমে পরিচিত হলেন জলন্ধরের কাছে তালবন্দের জমিদার আমির হাবিবুলস্নাহ খানের সঙ্গে। সুলতানের ব্যবহার ও কথাবার্তায় মুগ্ধ হয়ে আমির হাবিবুলস্নাহ খান তাঁকে তালবন্দে তাঁর জমিদারবাড়ি নিয়ে গেলেন। সেখানে নিজের প্রতিকৃতি আঁকতে বললেন এবং সেটা হয়ে যাবার পর তিনি আরাম কেদারায় শুয়ে থাকেন আর সুলতানকে কথা বলে যেতে বলেন। সুলতান বুঝলেন মনের মতো কথা বলার সঙ্গীর অভাবেই তাঁকে নিয়ে আসা। কিছুদিন এইভাবে কাটাবেন সিদ্ধামত্ম নিয়ে তিনি হাবিবুলস্নাহ খানকে গল্প শোনান; যখন তিনি ঘুমিয়ে পড়েন সেই সময় পশুপাখির ড্রয়িং করেন। সেসব ড্রয়িং হাবিবুলস্নাহ খানের তিন অবিবাহিতা বোনের দৃষ্টিতে পড়ার পর তারা সুলতানের কাছে ছবি আঁকা শিখতে চায়। এমন ছাত্রীদের ছবি আঁকা শেখানো মানেই ড্রয়িং করা। সুলতান তিন বোনকে খুব যত্নের সঙ্গে ড্রয়িং করা শেখালেন। হরিণ, পাখি, মহিষ, এসব বিষয়ই বেশি। পোর্ট্রেট আঁকা শিখতে সময় নেয়, দক্ষতাও বেশ প্রয়োজন। সুলতান এ কারণে সেদিকে গেলেন না। তিন বোনের পোর্ট্রেট করে দেওয়াতেই তারা খুশি। তাঁর আত্মজীবনীভিত্তিক উপন্যাস লেখার সময় সুলতান আমাকে বলেছিলেন, সব মেয়েরাই ছবি আঁকা শিখতে চায়। এর মাধ্যমে তারা নিজেদের একটা পরিচিতি পায়। যারা অমত্মঃপুরবাসিনী তাদের জন্য এই প্রয়োজন আরো বেশি।
আমির হাবিবুলস্নাহর আতিথেয়তায় ছয় মাস কাটালেন সুলতান। এই সময়ে তাঁকে গল্প শোনালেন, তাঁর বোনদের পোর্ট্রেট আঁকলেন, তাদেরকে ড্রয়িং করতে শেখালেন। ড্রয়িং তাঁর ভবঘুরে জীবনের খরচ মেটানোর উপায় হয়ে থাকল। এই ছয় মাসের মধ্যে দ্বিতীয় মহাযুদ্ধ শেষ হলো। এর পরপরই তিনি নড়াইলে তাঁর বাবার মৃত্যুর খবর শুনলেন। নড়াইলে যাওয়ার জন্য বিদায় নিলেন তিনি। মাঝপথে থামলেন কয়েক দিনের জন্য লাহোরে খাকসার আন্দোলনের নেতা আলস্নামা মাশরেকীর সঙ্গে দেখা করার জন্য। খাকসার বাহিনীর কথা তিনি কলকাতা থাকতেই শুনেছিলেন। তাদের জনসেবার আদর্শ তাঁকে আকর্ষণ করেছিল।
নড়াইলে ফিরলেন তিনি খাকসার বাহিনীর আলখালস্না পরে, বেলচা হাতে। কৃষকদের সংগঠিত করলেন খাকসার বাহিনীর আদর্শে। তখন বামপন্থী কৃষক আন্দোলনের নেতারা এসে তাঁকে দলে যোগ দিতে বললেন। তিনি রাজি হয়ে আন্ডারগ্রাউন্ডে বাস করতে থাকলেন। এসময় কৃষকদের সঙ্গে তাঁর পরিচয় নিবিড় হয় এবং তাদের জীবনের দুঃখকষ্ট তিনি মর্মে মর্মে অনুভব করেন। পুলিশের তাড়া খেয়ে তিনি তিনজন সঙ্গী নিয়ে জলন্ধরে আমির হাবিবুলস্নাহ খানের জমিদারিতে ফিরে এলেন। তিনি তাঁকে দেখে খুব খুশি হলেন। তাঁর অভাবে তিনি খুবই নিঃসঙ্গ হয়ে পড়েছিলেন। আবার শুরু হলো গল্প শোনানো, ড্রয়িং করা আর তাঁর বোনদের ড্রয়িং শেখানো।
কয়েক মাস পর সুলতান আমির হাবিবুলস্নাহকে বললেন তিনি মুসৌরি যাবেন। তিনি জলধর সেনের বই পড়ে জেনেছেন সেখানে নীল আকাশে তাসের ঘর দেখা যায়। শুনে হাসলেন হাবিবুলস্নাহ খান। হাসি থামিয়ে বললেন, আকাশে শহর? কাউকে বলো না, পাগল ঠাউরাবে। সুলতানের উৎসাহ দেখে শেষ পর্যমত্ম তাঁকে যেতে দিলেন হাবিবুলস্নাহ খান। দেরাদুন যাওয়ার ট্রেনে উঠিয়ে দেবার পর বললেন সুলতান যেন তাড়াতাড়ি ফিরে আসেন। তাঁর কথা বলার লোক নেই। যে তিনজনকে নড়াইল থেকে সঙ্গে নিয়ে এসেছিলেন সুলতান তারা অনেক আগেই চলে গিয়েছে।
দেরাদুনে এসে পুরি নামে এক শিল্পীর স্টুডিওতে তাঁর ছবি রাখতে দিলেন। পরদিন যাত্রা করলেন মুসৌরি। তাঁর পকেটে তখন মাত্র চার আনা পয়সা। যেতে যেতে পথ আর শেষ হয় না। বিশ্রামের জন্য সুলতান যাত্রাবিরতি করে এক জায়গায় বসে পড়লেন। তাকিয়ে দেখেন তিন দিকে তিন শহর। দেরাদুন পেছনে ফেলে এসেছেন। দূরে, বাঁয়ে মুসৌরি, ডানে হরিদ্বার। তিনি বসে বসে দেরাদুন আর হরিদ্বার শহরের স্কেচ করলেন। পাখির দৃষ্টিতে দেখার মতো ব্যবহার করলেন হায়ার পার্সপেকটিভ। এই আঙ্গিক পরবর্তীতে তাঁর প্রায় তৈলচিত্রেই থাকত। ড্রয়িং আঁকতে গিয়ে সুলতান তৈলচিত্রের বিষয় এবং বিশেষ করে আঙ্গিকের নতুন কৌশল খুঁজে পেলেন। তৈলচিত্রের খসড়া নকশা হিসেবে এবং পার্সপেকটিভের ব্যবহার, এই দুই দিকেই ড্রয়িং এবং অন্য অভিজ্ঞতা সুলতানের শিল্পসৃষ্টিতে সাহায্য করেছে।
দূরত্বের জন্য সুলতানের পায়ে হেঁটে মুসৌরি যাওয়া হলো না। দূর থেকেই মুসৌরি শহর দেখে তিনি ড্রয়িং করলেন কয়েকটা। জলধর সেনের বর্ণনায় তাসের দেশ দেখা হয়ে গেল তাঁর। কীভাবে দেখলেন তাঁর জীবনী উপন্যাস লেখার সময় তিনি ব্যাখ্যা করেছেন। তাসের ঘর মানে আলোর মেঘ আর আলোর খেলা। আলো যখন ওপরে পড়ে তখন কিউব হয়ে যায়। নিচে পড়লে সার্কল হয়, যেমন জঙ্গলে। জলধর সেন ওভাবেই তাসের শহর দেখেছিলেন আকাশে। সুলতানের এই ব্যাখ্যায় তাঁর ছবি আঁকার একটা ইঙ্গিত পাওয়া যায়। এখানেও পার্সপেকটিভ নিয়ে নতুন ধারণা। প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা তিনি শেষ করেননি, কিন্তু প্রকৃতির কাছ থেকে পাঠ তাঁর শিল্পীসত্তাকে সমৃদ্ধ, অভিজ্ঞ করে তুলছিল।
দেরাদুনে ফিরে পুরির স্টুডিওতে এক সপ্তাহ থাকলেন সুলতান। পুরি তাঁকে ছবি আঁকা নিয়ে অনেক কিছু বললেন। ছবি এঁকে এঁকে দেখালেন। তাঁকেও আঁকতে বললেন। বেশির ভাগই ড্রয়িং। সীমিত সময়ে এছাড়া আর কোন মাধ্যমই বা ব্যবহার করবেন? সুলতান আবিষ্কার করলেন এক স্থানে দীর্ঘদিন থেকে ড্রয়িং করার মধ্যে যে চরিত্র থাকে, স্বল্পকালীন অবস্থানে সেই চরিত্র কিছুটা বদলে যায়। রেখায় থাকে দ্রম্নতগতি, সূক্ষ্মতা আর ইঙ্গিতময়তা। এর ফলে ড্রয়িং হয়ে যায় অর্দ্ধ মূর্ত অথবা বিমূর্ত। একধরনের অতিলৌকিকতার আবহ আচ্ছন্ন করে রাখে তাঁর স্বল্পকালীন প্রবাসে আঁকা ড্রয়িংকে।
দেরাদুন থেকে উত্তর-পশ্চিম সীমামেত্ম করদ রাজ্য অম্বের পথে রওনা হলেন সুলতান। হাবিবুলস্নাহ খানের শ্বশুর সালেহ মোহাম্মদ খান সেই করদ রাজ্যের প্রধানমন্ত্রী। সালেহ মোহাম্মদ খানের বাড়ি ক’দিন থাকার পর নওয়াব সাহেব তাঁর ছবি আঁকার খবর পেয়ে প্রাসাদে নিয়ে গেলেন। তাঁকে দিয়ে সব মন্ত্রীর পোর্ট্রেট আঁকালেন। তাঁর স্ত্রী অন্দরমহলে ডেকে নিজের ছবি আঁকালেন। শেরগড়ে তাঁদের গ্রীষ্ম আবাসে নিয়ে ছেলে সাঈদকে ছবি আঁকা শেখাতে বললেন। তারপর বললেন তিনি নিজেও শিখবেন। রাজকবির মতো সুলতান হয়ে গেলেন রাজশিল্পী। ড্রয়িংএ পারদর্শিতা তাঁকে সেই ভূমিকা দান করল। আরো একবার সুলতান ড্রয়িংএর কাছে ঋণী হয়ে থাকলেন। অনুমান করা যায়, অন্যান্য অভিজাত পরিবারে ড্রয়িং শেখানোর মতো এখানেও উপকরণের কোনো অভাব ছিল না। ফলে সুলতান ড্রয়িংএর নানা দিক নিয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষার সুযোগ পেলেন, একথা বলা যায়।
মা আর ছেলে সুলতানকে নানা অজুহাতে ধরে রাখেন। কিন্তু সুলতানকে যে ‘বিপুল সুদূর’ ডাকছে। তিনি অনেক চেষ্টায় বিদায় নিয়ে কাশ্মীরে যাত্রা করলেন। কাশ্মীরে শ্রীনগর পৌঁছে উপত্যকার সৌন্দর্য দেখে চোখের পলক পড়ে না সুলতানের। এই স্থানকে ভূস্বর্গ কেন বলে তার চাক্ষুষ প্রমাণ পেলেন তিনি। উচ্ছ্বসিত মনে এক হোটেলে উঠলেন। মনে হলো, এমন সুন্দর জায়গায় অনেকদিন থাকতে হবে তাঁকে। উপত্যকা, ডাল হ্রদ, কাশ্মীরী মেয়েদের সৌন্দর্য এইসবকে বিষয় করে অনেক ছবি আঁকা যাবে। তবে এখানকার আকাশে, প্রকৃতিতে, মানুষের চেহারায় যে রং তা ধরে রাখতে হলে ব্যবহার করতে হবে জলরং। এই প্রথম ভ্রাম্যমাণ জীবনে ড্রয়িংএর তুলনায় জলরং প্রধান হয়ে গেল তাঁর কাছে। কিন্তু কাশ্মীরের আকাশে, মাটিতে সূর্যের আলোর মসৃণতা, মৃদু আভায় তাঁর জলরংএ ইমপ্রেশনিস্টদের ছবির মতো অস্পষ্টতা নিয়ে এলো। জীবনের শেষ পর্যমত্ম সুলতানের জলরংএ এই প্রভাব অক্ষুণ্ণ ছিল। তাঁর জলরংএ উজ্জ্বলতা নেই, ছবি প্রাণবমত্ম নয়, আকার অস্পষ্ট। বিস্ময়ের ব্যাপার কাশ্মীরিদের নিয়ে যেসব ড্রয়িং তিনি আমার উপন্যাসের জন্য এঁকেছেন সেখানে কোনো অস্পষ্টতা নেই, ঋজুতা এবং তীব্রতাই যার প্রধান বৈশিষ্ট্য। বিভিন্ন মাধ্যমের জন্য একই দৃশ্য যে ভিন্নরূপ বহন করে কাশ্মীরের দৃশ্য নিয়ে আঁকা ড্রয়িং সে কথা বলে।
শ্রীনগরে এলিজাবেথ নামে এক ইংরেজ মহিলা শিল্পীর সঙ্গে যোগ দিয়ে সুলতান প্রায় এক বছর ছবি এঁকে কাটালেন। এই সময় ট্যুরিস্টরা তাঁর জলরংএর ছবিই বেশি কিনেছে, এটা অনুমান করা যায়, কেননা কাশ্মীরের প্রকৃতি ড্রয়িংএ ধরা দেয় না। শ্রীনগরে যে এক বছর ছিলেন তখন দুজনে মিলে কেন যে একটা প্রদর্শনী করলেন না, একথা সুলতানকে জিজ্ঞাসা করা হয়নি। একটা কারণ হয়তো এই যে, শ্রীনগরে এলিজাবেথের নিজেরই ছিল স্টুডিও, সেখান থেকে ক্রেতারা ছবি কিনে নিয়ে যেত।
কাশ্মীরে হঠাৎ পাকিসত্মান-ভারত যুদ্ধ শুরু হয়ে গেলে হোটেলে তাঁর কাপড়-চোপড়, ছবির স্টক সব ফেলে এক ট্রাকে উঠে সুলতান এসে উপস্থিত হলেন শিয়ালকোট। সেখান থেকে লাহোরে এসে উঠলেন ওয়াইডাবিস্নউসিয়ের হোস্টেলে। দেখা পেলেন পাকিসত্মানের নামকরা চিত্রসমালোচক এস আমজাদ আলির। তাঁর পরামর্শে একটা প্রদর্শনীর জন্য ছবি আঁকলেন সুলতান। স্মৃতি থেকে আঁকলেন মুসৌরি, সিমলা, কাশ্মীরের ছবি। বেশিরভাগই জলরং। এর মধ্যে কিছু ছাত্রছাত্রী জুটে গেল। বলা বাহুল্য, ড্রয়িং আঁকা শেখানো দিয়েই তাদের শিক্ষানবিশি শুরু হলো। প্রদর্শনী সফল হয়েছিল, বেশ ক্রেতা এসেছিল বাঙালি শিল্পীর নাম শুনে কৌতূহল নিয়ে। প্রদর্শনী শেষে শামিম নামে এক পাঞ্জাবি মহিলা এসে তাঁর বাড়িতে নিয়ে গেলেন থাকার জন্য। সুলতানের ছবি তাঁর পছন্দ হয়েছে। এখন তাঁর কাছ থেকে ছবি আঁকা শিখতে চান। তাহলে তাঁর অন্য ছাত্র-ছাত্রীর কী হবে? শামিম বললেন, তারা এখানে আসতে পারে। ড্রয়িংএ পারদর্শিতা সুলতানকে আবার নতুন আশ্রয়ের ঠিকানা দিলো।
লাহোরে থাকতে অন্য এক নেশায় জড়িয়ে পড়লেন সুলতান, যার প্রভাব তাঁর জীবনে হয়েছে বহুমুখী এবং সুদূরপ্রসারী। তিনি হাফিজউদ্দিন নামে এক যন্ত্রবাদকের সংস্পর্শে এসে চরস নামে মাদক সেবন শুরু করলেন। এই মাদকের মাদকতা তাঁকে এমনভাবে আচ্ছন্ন করে রাখল যে তিনি কিছুতেই এর হাত থেকে মুক্তি পেলেন না। মৃত্যুর কয়েক বছর আগে যখন মুক্তি পেলেন তখন অনেক দেরি হয়ে গিয়েছে। নেশা তাঁর ব্যক্তিজীবনে যেমন নতুন মাত্রা যোগ করেছে, তেমনি ছবি আঁকাতেও প্রভাব ফেলেছে। যখন নেশার ঘোরে থেকে ছবি এঁকেছেন তার চরিত্র এবং ধরন হয়েছে একরকম, যার সঙ্গে স্বাভাবিক অবস্থায় আঁকা ছবির পার্থক্য বেশ শনাক্ত করা যায়। পঞ্চাশের দশকে তাঁর নেশাগ্রসত্মতা ছিল চরম অবস্থায়। তখন তিনি বড় কোনো কাজ প্রায় করেননি। কিন্তু ড্রয়িং করেছেন প্রচুর। আবুল হাসনাত রোডে আফজাল করিম নামে এক বিদগ্ধ শিল্পমনস্ক ভদ্রলোকের বাসায় ছয় মাস থাকার সময় প্রায় আটশো ড্রয়িং করেছিলেন। এর মধ্যে বেশ কটি তাঁর ভাই আলী করিম আমাকে উপহার দিয়েছিলেন। এর আগে নড়াইলে এবং যশোরে থাকার সময় তিনি এঁকেছেন কয়েকশ ড্রয়িং, যার মধ্যে আশিটি অধ্যাপক আবুল কাশেমের কাছে ছিল এবং ২০১৩ সালে বেঙ্গল গ্যালারিতে প্রদর্শিত হয়েছিল। পিকাসোর বস্নু পিরিয়ডের মতো পঞ্চাশের দশকের এইসব ড্রয়িংএ সুলতানের মানসজগৎ এবং সৃজনশীলতায় মাদক নেশা যে প্রভাব রেখেছিল তার কিছু ইঙ্গিত পাওয়া যায়। এই বিষয় নিয়ে ব্যাখ্যা পরবর্তী সময়ে হবে, যখন তাঁর ড্রয়িংএর মূল্যায়ন করার প্রয়াস পাব। এখন আমরা তাঁর ব্যক্তিজীবন এবং শিল্পীজীবনের অংশ হিসেবে ড্রয়িংএর চর্চা প্রসঙ্গে ফিরে যাব।
লাহোর থেকে করাচি গিয়ে থিতু হলেন সুলতান। সেখানেও ওয়াইডাবিস্নউসিতে প্রদর্শনী হলো তাঁর ছবির। সুলতান তখন তৈলচিত্র আঁকা শুরু করেছেন। ছবির বিষয় ছিল বাংলাদেশের গ্রাম আর কাশ্মীরের নিসর্গের দৃশ্য। করাচি তখন পাকিসত্মানের রাজধানী। মন্ত্রী, বড় বড় শিল্পপতি সবাই থাকেন সেখানে। ছবি বিক্রির জন্য বড় বড় শিল্পীরাও করাচি বাস করছেন, এক চুঘতাই ছাড়া। কিছুদিন পর এক প্রতিযোগিতায় প্রথম হয়ে সুলতান শুভেচ্ছা সফরে আমেরিকা গেলেন। সেখানে জাতিসংঘের পক্ষ থেকে একটা প্রতিযোগিতার আয়োজন করা হলো পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের নিমন্ত্রিত শিল্পীদের মধ্যে। বিষয় : ঘূর্ণায়মান এক নগ্নিকা মডেলের ড্রয়িং। সুলতান প্রথম হয়ে প্রমাণ করলেন ড্রয়িংএ তাঁর সমকক্ষ কেউ নেই। পুরস্কার হিসেবে পেলেন এক বোতল শ্যাম্পেন আর সেইসঙ্গে মডেলের একটি চুম্বন।
আমেরিকা থেকে ফেরার পথে লন্ডনে যাত্রাবিরতি করে খান আতাউর রহমান আর ফজলে লোহানীর সঙ্গে থাকলেন তিনি। ছবি আঁকলেন, বাংলাদেশের গ্রামের ছবি, লাহোরের গ্রামের ছবি, কাশ্মীরের ছবি। প্রায়ই তেলরং, কিছু জলরং। ড্রয়িং আর আঁকেনইনি ওই সময়। হ্যাম্পস্টিডে ভিক্টোরিয়া এম্বব্যাঙ্কমেন্টে তাঁর ছবি প্রদর্শিত হতো। প্রদর্শনী দেখে এক ইংরেজ ভদ্রলোক বললেন, দুটি ছবি তিনি লেইস্টার গ্যালারিতে দেখাতে চান। ১৯৫০ সালে লেইস্টার গ্যালারিতে পিকাসো, মাতিস, ডাফি, পল ক্লি আর দালির ছবির পাশাপাশি সুলতানের ছবিও দেখানো হলো। ‘স্টুডিও’ নামে এক পত্রিকায় সুলতানের ওপর একটা রিভিউ বেরিয়েছিল তারপর।
আবার করাচি ফিরে এলেন সুলতান। তখন তিনি অল পাকিসত্মান সেলিব্রিটি। তিনি যেখানে থাকেন, ক্যাসিনো হোটেল হয়ে উঠলো শিল্পী, সাহিত্যিক আর বুদ্ধিজীবীদের আড্ডার প্রাণকেন্দ্র। স্থায়ী আয়ের একটা পথ বার করলেন সুলতান। বিদেশি দূতাবাসের অনেক মহিলা ছবি আঁকা শিখতে চায়। যথারীতি ড্রয়িং দিয়েই তাদের শিল্প শিক্ষার শুরু হলো। ড্রয়িং সুলতানের হাতের পাঁচ হয়েই থাকে, ব্রেড অ্যান্ড বাটার। তারপর একদিন জমজমাট আসরেও বৈরাগ্য এসে যায়। সুলতান শুনতে পান পূর্ব পাকিসত্মানের আর নড়াইলের মাটির টান। সব আকর্ষণ, খ্যাতি, বিত্ত উপভোগের সুযোগ ত্যাগ করে তিনি চলে আসেন ঢাকা। সেখনে তাঁকে সমাদরে গ্রহণ করা হয় না। স্বীকৃতি দেওয়ার কথা মুখেই আনে না কেউ। তাঁর অপরাধ তিনি প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা শেষ করেননি। তাঁর অপরাধ তিনি নেশাগ্রসত্ম। তাঁর অপরাধ তিনি বোহেমিয়ান জীবন যাপন করেন।
অভিমান নিয়ে নড়াইল চলে গেলেন। শেকড়ের সন্ধানে মনোযোগ দিলেন। শিশুদের শিল্পশিক্ষায় শিক্ষিত করার চেষ্টা করলেন। চেচুড়ি পুরুলিয়ায় গিয়ে জঙ্গল কেটে পরিষ্কার করে ছেলেমেয়েদের আর্ট স্কুল প্রতিষ্ঠার জন্য গ্রামের মানুষকে নিয়ে কাজ করলেন। স্কুল হলো ঠিকই কিন্তু আর্ট স্কুল নয়। কী করতেন তিনি ওই সময় যখন জঙ্গল পরিষ্কারে ব্যসত্ম থাকতেন না? গ্রামের লোক উত্তরে বলেছে তিনি কাগজ-কলম নিয়ে বসে যেতেন ড্রয়িং করতে। স্বাস্থ্যবান সাহসী আদিম সব মানুষের ছবি আঁকতেন। বলতেন, এই হলো আমাদের পূর্বপুরুষ। এইসব ছবির প্রায় সবই হারিয়ে গিয়েছে। দোকানের বেড়ার দেয়াল থেকে উদ্ধার করে একটা ড্রয়িং উপহার দিয়েছিল গ্রামের মানুষ। ছেঁড়া, রং চটে যাওয়া। কিন্তু তার মধ্যেই আদিম মানুষগুলির সাহসী এবং বেপরোয়া ভঙ্গি পষ্টভাবে দেখা যায়।
দুই
আর্ট সমালোচক আর জি কলিংউড প্রতিনিধিত্ব এবং অনুকরণের মধ্যে পার্থক্য করেছেন। তাঁর মতে, প্রাকৃতিক বস্ত্তর ছবি আঁকা হলে তা হয় সেই বস্ত্তর প্রতিনিধিত্বকারী (রিপ্রেজেন্টেটিভ)। প্রাকৃতিক বিষয়ের মধ্যে প্রাণীও রয়েছে। যখন আর্ট অন্য একটি চিত্রকর্মের অনুকরণ করে তা হয় অনুকরণবাদ (ইমিটেটিভ)। পেস্নটোর শিষ্য এরিস্টটল যে সব আর্টকে প্রতিনিধিত্বকারী বলে ভেবেছেন তিনি তার উলেস্নখ করেছেন। রেনেসাঁ যুগে এবং সপ্তদশ শতাব্দীতে এ ধরনের মতবাদ প্রচলিত ছিল। কলিংউড মনে করেছেন, আর্ট এবং প্রতিনিধিত্বশীলতা পরস্পরবিরোধী নয়। অর্থাৎ প্রকৃতির বস্ত্ত ও তাদের রূপের অনুকরণ যেমন আর্ট হতে পারে, প্রতিনিধিত্বশীলতাও হতে পারে।
ড্রয়িংএর কৌশলই হলো অনুকরণ। যে ড্রয়িংএ বিষয়ের মত হুবহু অনুকরণ দেখা যায় সেটি সফলতায় উত্তীর্ণ, এটা মেনে নেওয়া হয়। আগেই বলা হয়েছে, মানুষের অনুকরণস্পৃহা থেকেই ড্রয়িংএর সূত্রপাত। এর এমন দৃষ্টামত্ম দেখা গিয়েছে পাহাড়ে গুহার দেয়ালে যেখানে আজ থেকে চলিস্নশ হাজার বছর আগে আদিম মানুষ পশু ও মানুষের ছবি এঁকেছে। অনুকরণস্পৃহা সবার থাকলেও অনুকরণ ক্ষমতার অধিকারী সবাই হয় না। প্রশিক্ষণ নিয়েও এই ঘাটতি পুরোপুরি পূরণ করা যায় না।
আর্টের প্রশিক্ষণার্থী হবার আগেই সুলতানের অনুকরণস্পৃহা ছিল। সেইসঙ্গে ছিল অনুকরণক্ষমতা। এর ভিত্তিতে তিনি নড়াইলে কিশোর বয়সেই নকশা এঁকেছেন, বিখ্যাত কিছু ব্যক্তির প্রতিকৃতি এঁকেছেন। এইসব কাজে প্রতিনিধিত্বশীলতা লক্ষ্য ছিল না, ছিল হুবহু অনুকরণ। অনুকরণ করতে গিয়ে তিনি ব্যবহার করেছেন রেখা স্পষ্ট করে, কখনো সোজা, কখনো বাঁকিয়ে। রেখা দিয়েই তিনি সম্পূর্ণ করেছেন ড্রয়িংএর আউটলাইন বা ঘের, ঘেরের ভেতরের রূপ সৃষ্টির জন্যও ব্যবহৃত হয়েছে নানা দৈর্ঘ্যের রেখা। অনুকরণভিত্তিক তাঁর সেই সময়ের ড্রয়িং ছিল সম্পূর্ণ অর্থাৎ যে রূপ বা প্রতিকৃতি আঁকতে চেয়েছেন সেখানে স্পেস ফাঁকা রাখেননি, অস্পষ্টতার সাহায্য নেননি। কলকাতার আর্ট স্কুলে ভর্তি পরীক্ষায় যে ড্রয়িং করেন সেখানেও ছিল নিখাদ নৈপুণ্য, অনুকরণবাদ। অধ্যক্ষ মুকুল দের নির্দেশে যখন ধূপখোলায় গিয়ে ট্যানারি শ্রমিকদের শরীরের বিভিন্ন ভঙ্গির স্কেচ করেছেন সেখানে সম্ভবত অনুকরণ এবং প্রতিনিধিত্বশীলতা উভয় আঙ্গিকই ছিল। সীমিত সময়ে দূর থেকে অত বড় ফ্রেমের দৃশ্য দেখে নিয়ে হুবহু অনুকরণ করা কঠিন ছিল। যত প্রতিভাবানই হোক তার পক্ষে সেই কঠিন কাজ করা সম্ভব ছিল না। আমরা সেই সব ড্রয়িং না দেখেও বলতে পারি সেগুলি অনুকরণ এবং প্রতিনিধিত্বশীল, দুই বৈশিষ্ট্যেই ম–ত ছিল। তাঁর ড্রয়িং বাসত্মবের হুবহু অনুকরণ না হয়ে, হয়েছিল প্রতিনিধিত্বশীল। অর্থাৎ বাসত্মবের অনুষঙ্গে ইঙ্গিতময়তা যুক্ত হয়েছিল। তখন পেন্সিল বা কলম যা-ই ব্যবহার করে থাকেন সে সব দ্রম্নত হাতে পরিচালিত হয়েছে। দ্রম্নতগতির কারণে রেখাগুলি হয়েছে সূক্ষ্ম এবং নাতিদীর্ঘ। এর ফলে স্পেসে কিছু ফিগার স্পষ্ট, কিছু অস্পষ্ট হয়ে দেখা দিয়েছে।
সুলতানের ড্রয়িংএর পরবর্তী পর্ব শুরু হয় তিনি যখন ট্রেনযোগে ভারত ভ্রমণে বেরিয়ে স্টেশনে স্টেশনে যাত্রীদের পোর্ট্রেট এঁকেছেন। এগুলি ক্রেতার কাছে বিশ্বাসযোগ্য হবার জন্য বাসত্মবের অনুকরণ হতে হয়েছে। ফটোগ্রাফির মতোই প্রতিকৃতিগুলি হতে হয়েছে বাসত্মবসম্মত। এখানেও সময়ের অভাব ছিল, কেননা যাত্রীরা কিছুক্ষণের জন্য স্টেশনে নেমেছে। দ্রম্নত হাতে প্রধানত দীর্ঘ রেখা ব্যবহার করে তিনি বাসত্মবের অনুকরণ করেছেন। খুব সম্ভবত স্টেশনে পোর্ট্রেট আঁকার জন্য পেন্সিলই ব্যবহার করেছেন তিনি, যা দ্রম্নতগতিতে আঁকতে সাহায্য করেছে। যেহেতু পোর্ট্রেট মুখাবয়বের, সে কারণে সূক্ষ্ম রেখাই ব্যবহার করেছেন বেশি। মুখের কোনো অংশ, যেমন গলা, হাইলাইট করার জন্য কখনো হয়তো সাহায্য নিয়েছেন পেন্সিলে আঁকা আলো-ছায়ার।
আগ্রায় ডাক্তারের সহকারী হিসেবে ব্যবচ্ছেদ করা শবদেহের ড্রয়িং করতে গিয়ে অনুকরণের আঙ্গিক ব্যবহার করেছেন সুলতান, একথা সেই সব ছবি না দেখেও বলা যায়। যেহেতু সম্পূর্ণ শরীর নয়, শরীরের খ–ত অংশ এঁকেছেন, সেজন্য সূক্ষ্ম রেখায় মিতব্যয়ী ব্যবহারেই স্পষ্ট করে তুলেছেন বাসত্মবরূপ। হয়তো এসব ড্রয়িং করতে গিয়ে পেন্সিলের পাশাপাশি কলমেরও ব্যবহার করেছেন, কেননা কালি-কলম পেতে তখন অসুবিধা হয়নি। শরীরের কোন অংশের ড্রয়িং কালি-কলমে করলে স্পষ্ট হবে, এই বিবেচনার ভিত্তিতে তিনি হয়তো পেন্সিল আর কলমের ব্যবহারের উপযোগিতা বিচার করেছেন। এসব ড্রয়িং মানুষের শরীরের এনাটমি সম্বন্ধে তাঁর জ্ঞান বৃদ্ধি করেছিল, আমরা সে কথা জেনেছি।
লক্ষণ শহরে প্রথমে তিনি প্রাসাদ ও সৌধের ড্রয়িং করেন। খরচের কথা ভেবে এবং সময়ের সাশ্রয় করার জন্য এইসব ড্রয়িং তিনি পেন্সিল দিয়েই এঁকেছেন, এমন অনুমান ভুল হবে না। যখন লক্ষক্ষন- শহরেই নওয়াববাড়িতে গিয়ে অতিথি হিসেবে থেকে তাঁকে নওয়াব এবং তাঁর দুই নিকট-আত্মীয়ার পোর্ট্রেট আঁকতে হলো এবং তারপর তাদেরকে ছবি আঁকা শেখাতে হলো সে সময় উপকরণের অভাব তাঁর হয়নি। পেন্সিল-কাগজ, কালি-কলম-কাগজ এবং হয়তো জলরংও ব্যবহারের জন্য পেয়েছেন। তবে যে উপকরণই ব্যবহার করে থাকুন দুই মাসের শিক্ষকতার সময় অনুকরণের ভিত্তিতেই ড্রয়িং আঁকতে শিখিয়েছিলেন তাঁর তিন ছাত্রীকে। প্রতিনিধিত্বশীলভাবে অস্পষ্টতার সাহায্য নিয়ে যে ড্রয়িং আঁকা তা জনপ্রিয় ছিল না এবং সময়সাপেক্ষও বটে। এই দুই কারণে তিনি প্রতিনিধিত্বশীল ড্রয়িংএর কৌশল নিয়ে সময় ব্যয় করেননি। ফটোগ্রাফির মতো বাসত্মবের প্রতিফলনই তাঁর ছাত্রীদের আকর্ষণ করেছিল বেশি, একথা বলা যায়। যেহেতু আউটডোরে যাওয়ার প্রশ্নই ছিল না, সে কারণে ছাত্রীদের নিয়ে প্রাসাদ কিংবা প্রাকৃতিক দৃশ্য অথবা শহরের দৃশ্য আঁকার কথা মনে হয়নি তাঁর, এমন অনুমান করা যায়।
সিমলা শহরে ইংরেজ মহিলার আমন্ত্রণে তাঁর একক প্রদর্শনীর জন্য যেসব ছবি তিনি আঁকলেন তার অধিকাংশই ছিল ড্রয়িং আর কিছু জলরং। অল্প সময়ের প্রস্ত্ততিতে ড্রয়িং যে প্রাধান্য পেয়েছিল তা ভাবতে কষ্ট হয় না। তবে ড্রয়িংএর বিষয় ছিল বিভিন্ন : মানুষের মুখ কিংবা দেহের ছবি, শহরের পথ-ঘাট, দোকানপাটের ছবি, পাহাড়ের নিসর্গের ছবি। বিষয়ের বিবেচনায় সূক্ষ্ম এবং মোটা দুই দাগের রেখাই তাঁকে ব্যবহার করতে হয়েছে। পাহাড়ের নিসর্গের এবং শহরের বিভিন্ন দৃশ্যের ড্রয়িংগুলি নিশ্চয়ই ছিল স্কেচধর্মী কেননা ওইসব বিষয়ের সঙ্গে ড্রয়িংএর এই কৌশলই সামঞ্জস্যময়। পোর্ট্রেটের ড্রয়িংএ অনুকরণশক্তি মহারাজাকে মুগ্ধ করেছিল যার জন্য তিনি সুলতানকে জলন্ধরে তার অতিথি করে নিয়ে যান।
জলন্ধরে মহারাজার পোর্ট্রেট আঁকা না হলেও সেখানে সুলতানের দেখা হলো হাবিবুলস্নাহ খান নামে এক জমিদারের সঙ্গে, সে কথা আগে বলা হয়েছে। তিনি তাঁকে নিজ জমিদারিতে নিয়ে অতিথি হিসেবে রেখে প্রথমে নিজের এবং তারপর তিন বোনের পোর্ট্রেট আঁকালেন। পরে তিন বোন তাঁর কাছে ছবি আঁকা শিখতে শুরু করে এক এক করে। এই পর্বে ড্রয়িং আঁকাই ছিল প্রধান এবং সবই বাসত্মবভিত্তিক অর্থাৎ বাসত্মবের অনুকরণ। তিনি যখন-যেখানেই স্বল্পকালীন শিক্ষক হয়েছেন অনুকরণভিত্তিক ড্রয়িং বেছে নিয়েছেন, কেননা এটাই শিল্পশিক্ষার প্রথম পাঠ। তবে হাবিবুলস্নাহ খানের বাড়িতে ছবি আঁকা শেখানোর জন্য তিনি যে পেয়েছিলেন
পেন্সিল-কাগজ ছাড়াও অন্যান্য উপকরণ, সে সম্বন্ধে সন্দেহ নেই। তখন যেসব ড্রয়িং করে দেখিয়েছেন সেখানে রেখার ব্যবহারে বৈচিত্র্য থাকাটাই স্বাভাবিক। মোটা রেখার সঙ্গে থেকেছে সূক্ষ্ম রেখার সাবলীল টান, মন্থরগতির রেখার পাশাপাশি দেখা গিয়েছে দ্রম্নতগতিতে আঁকা সর্পিল রেখা।
মুসৌরি শহরে যাওয়ার পথে সুলতান ড্রয়িং আঁকার নতুন পর্বে প্রবেশ করলেন। পাহাড় আর নদী পরিবেষ্টিত হরিদ্বার শহরের ড্রয়িং করলেন স্কেচের আকারে। পেন্সিল ব্যবহার করে সৃষ্টি করলেন আলো-ছায়া। পাখীর দৃষ্টিতে দেখা দূরের শহর দেরাদুন আঁকতে গিয়ে বাসত্মবের অনুকরণ নয়, প্রতিনিধিত্বশীলতার সাহায্য নিলেন। দূর থেকে দেখা দৃশ্যের হুবহু অনুকরণ সম্ভব ছিল না, আভাস এবং ইঙ্গিতের আশ্রয় নিতে হয়েছে তাঁকে। মোটা নয় সূক্ষ্ম রেখাই প্রাধান্য পেয়েছে এখানে, একথা বিষয়ের কথা ভেবে বলা যায়। পেন্সিল দিয়ে আঁকলেও রেখাগুলিকে হতে হয়েছে তীক্ষন এবং স্পষ্ট, যার অভাবে দূরকে কাছে আনা সম্ভব ছিল না।
উত্তর-পশ্চিম প্রদেশের আম্ব করদরাজ্যে গিয়ে নওয়াবের অতিথি হয়ে তাঁর এবং মন্ত্রিপরিষদের সব সদস্যের পোর্টেট আঁকা এবং তারপর অন্দরমহলে গিয়ে মহিলাদের ছবি আঁকায় আগের শিক্ষকতার পুনরাবৃত্তি ছিল। এখানে তাঁর ড্রয়িং করা এবং শেখানোর ভেতর কোনো নতুনত্ব ছিল না। বাসত্মবের হুবহু অনুকরণই প্রধান হয়ে থেকেছে।
কাশ্মীরের শ্রীনগরে গিয়ে সেখানকার নয়নাভিরাম নিসর্গ দৃশ্য দেখে তিনি ড্রয়িং এবং জলরং, দুই আঙ্গিকই ব্যবহার করলেন। ড্রয়িংএ প্রধান হয়ে থাকল অনুকরণবাদ আর জলরংএ প্রাধান্য পেল প্রতিনিধিত্বশীলতা। শ্রীনগরে ড্রয়িং নিয়ে নতুন কোনো পরীক্ষা-নিরীক্ষা করা হলো না।
দেশভাগের পর লাহোরে আকস্মিকভাবে উপস্থিত হয়ে সুলতান তাঁর শিল্পীজীবনের বড় পর্বে প্রবেশ করলেন। এখানেই আয়োজিত হলো তাঁর প্রথম একক প্রদর্শনী; সেখানে উপস্থিত ছিলেন সমঝদার অনেক দর্শক ছাড়াও পাকিসত্মানের খ্যাতনামা শিল্পীরা। এই প্রদর্শনীতে প্রায় সব আঙ্গিকের ছবি ছিল; কিন্তু ড্রয়িংই আকর্ষণ করল ছাত্রছাত্রীদের, যারা তাঁর কাছে ছবি আঁকা শিখতে এলো। তাদেরকে তিনি অনুকরণভিত্তিক ড্রয়িং করতে শেখালেন, কেননা একাডেমিক পদ্ধতিতে সেটাই প্রথাসিদ্ধ। যখন করাচি গিয়ে থিতু হয়ে দ্বিতীয় একক প্রদর্শনী করলেন সেখানেও ড্রয়িং ছিল এবং সে সব অনেকের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছিল। ড্রয়িং তাঁর এত প্রিয় ছিল এবং এই আঙ্গিকে তাঁর পারদর্শিতা ছিল এতই উলেস্নখযোগ্য যে, ড্রয়িং ছাড়া তাঁর কোনো প্রদর্শনীই অনুষ্ঠিত হয়নি। এমন ঘটনা খুব কম প্রতিষ্ঠিত শিল্পীদের ক্ষেত্রেই হয়ে থাকে। ড্রয়িংকে পরিণত বয়সের শিল্পীর প্রিয় আঙ্গিক হিসেবে ধরা হয় না। সুলতান এই ট্র্যাডিশন ভেঙেছিলেন।
সুলতান করাচি থেকে ঢাকায় ফিরলেন দীর্ঘদিন পর। এর মধ্যে ঘুরেছেন আমেরিকা এবং লন্ডন। আমেরিকায় পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের শিল্পীদের সঙ্গে প্রতিযোগিতায় ড্রয়িং এঁকে প্রথম হয়েছিলেন অনুকরণ ক্ষমতার জন্যই। খুব দ্রম্নত হাতে আঁকা নগ্নিকা মডেলের স্কেচে সূক্ষ্ম রেখার টানের সঙ্গে ছিল গতিময়তা। কেবল প্রতিযোগিতায় প্রথম হওয়ার জন্য নয়, আঁকার ভঙ্গিতে স্বতঃস্ফূর্ততার জন্যই ছবিটি প্রশংসিত হয়েছিল। ড্রয়িংএর ধ্রম্নপদী বর্ণনার সঙ্গে তিনি যোগ করেছিলেন আধুনিকতা, যা তাঁর আয়ত্তে এসেছিল স্বতঃস্ফূর্তভাবেই।
সুলতান নিজের জবানিতেই বলেছেন লাহোরে থাকতে তিনি এক সংগীতশিল্পীর সংস্পর্শে এসে মাদকাসক্ত হয়ে যান। মাদকসেবন তাঁর শরীরের ওপর যেমন প্রভাব ফেলেছে, ছবি আঁকার ওপরও। করাচি থেকে পঞ্চাশের দশকের শুরুতে ইস্ট পাকিসত্মানে ফিরে নড়াইলে এবং ঢাকায় তিনি অজস্র ড্রয়িং এঁকেছেন। এসবের অধিকাংশে বাসত্মবের হুবহু অনুকরণের পরিবর্তে দেখা যায় প্রতিনিধিত্বশীলতার বৈশিষ্ট্য। অর্থাৎ আভাসে-ইঙ্গিতে, কখনো প্রায় বিমূর্ত ভঙ্গিতে রূপের সৃষ্টি। এই স্টাইলে তিনি করাচি থাকার সময় ড্রয়িং আঁকেননি, কেননা প্রদর্শনীর জন্য তাঁকে বেশিরভাগ তৈলচিত্রই আঁকতে হয়েছে। যখন প্রবাসী বিদেশিনীদের ছবি আঁকা শিখিয়েছেন সে সময় একাডেমিক পদ্ধতিরই অনুসরণ করে বাসত্মবের অনুকরণের ওপর জোর দিয়েছেন।
সুলতান কৈশোর থেকেই ছিলেন ভাবুক স্বভাবের, দৈনন্দিন জীবনের সঙ্গে আপস করার পাশাপাশি মননের দিক দিয়ে এবং কল্পনায় তিনি উঠতে পেরেছিলেন বাসত্মবতার ঊর্ধ্বে। এভাবে তিনি হয়ে গিয়েছিলেন দুই ভুবনের বাসিন্দা। পার্থিব জগতের দাবি মিটিয়ে তিনি বিচরণ করেছেন মন্ময় জগতে, যার প্রভাব পড়েছে তাঁর শিল্পকর্মে। মাদকের প্রভাব তাঁকে নিয়ে গিয়েছে মন্ময় জগতের গভীরে। সেই জগতের অনুভূতি ভিন্ন, সেখানে বাসত্মবকে স্বীকৃতি দেয়ার পরও কল্পনার শক্তি হয় প্রবল। পঞ্চাশের দশকে তিনি নড়াইল, যশোর এবং ঢাকায় অজস্র ড্রয়িং করেছেন। দুই ভুবনের বাসিন্দা হিসেবে যখন যেখানে অবস্থান করেছেন সেখানকার পরিবেশ সৃজনশীলতার ওপর প্রভাব ফেলেছে। স্বাভাবিক অবস্থা থেকে আঁকা ড্রয়িংগুলিতে অনুকরণক্ষমতার প্রকাশ ঘটেছে, যার জন্য সেগুলি বাসত্মবতার অনেক কাছাকাছি। যেমন, বেঙ্গল গ্যালারিতে প্রদর্শনীতে ছবিগুলির মধ্যে নৃত্যের ভঙ্গিতে আঁকা নারীর অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ এবং বেশভুষা বেশ বাসত্মবসম্মত। চারকোল দিয়ে আঁকা রেখা যে ছন্দময়তার সৃষ্টি করেছে তা জীবনসংলগ্ন। একই কথা বলা যায় ড্রয়িংএ আঁকা প্রস্ফুটিত ফুল এবং লতা-পাতা সম্বন্ধে। এখানেও কল্পনার ভূমিকা স্বল্পই। রেখার মিতব্যয়ী ব্যবহারে অবশ্য স্বকীয়তা রয়েছে। পঞ্চাশের দশকেই ব্রাশ দিয়ে কালো রং ব্যবহার করে আঁকা আমার সংগ্রহের অন্যতম ড্রয়িংএ যে কিশোরী আর পোষা প্রাণীর ছবি সেখানেও বাসত্মবতার প্রভাব স্পষ্ট। আমার সংগ্রহে আরেকটি ড্রয়িং ‘বাজার থেকে ফেরা’ ছবিতে পুরুষের ফিগার স্পষ্টতই অনুকরণভিত্তিক। এসবের পাশাপাশি বেঙ্গল গ্যালারিতে প্রদর্শিত ড্রয়িংএ প্রকৃতির ছবি অস্পষ্ট এবং অসম্পূর্ণ। একই কথা বলা যায় অন্য ড্রয়িং সম্বন্ধে। এমন আরো দৃষ্টামত্ম দিয়ে দেখানো যায় যে, তিনি যখন মন্ময় জগতের গভীরে তখনকার আঁকা ড্রয়িংগুলির বৈশিষ্ট্য আভাসে-ইঙ্গিতে প্রতিনিধিত্বশীলতার। আবার যখন পার্থিব জগতে ফিরে এসেছেন অনুকরণবাদ প্রাধান্য পেয়েছে তাঁর ড্রয়িংএ। একই শিল্পীর আঁকা সম্পূর্ণ দুই চরিত্রের ড্রয়িংএর ব্যাখ্যা এভাবে দিলেই যুক্তিসংগত মনে হয়।
মন্ময় এবং পার্থিব জগতের অভিজ্ঞতা শিল্পী হিসেবে সুলতানকে বৈচিত্র্যের অধিকারী করেছে। শুধু তাই নয়, অনুকরণভিত্তিক ড্রয়িংএর পাশাপাশি প্রতিনিধিত্বশীল ড্রয়িং এঁকে এই মাধ্যমের শিল্প-সম্ভাবনার প্রতি দৃষ্টি আকর্ষণ করেছেন। দুই ভুবনের বাসিনদা হয়ে দ্বান্দ্বিক অভিজ্ঞতার অধিকারী হবার জন্য তাঁর মতো যে সব শিল্পীকে একই ধরনের জীবনচর্চা করতে হবে, তা নয়। সচেষ্ট হয়েও একজন তন্ময় হয়ে মন্ময় জগতে প্রবেশ করতে পারেন। সে সাধনা অনেকের পক্ষেই সম্ভব। এখানে যা মনে রাখার তা হলো, বাসত্মবের হুবহু অনুকরণের ঊর্দ্ধে উঠে কল্পনার সাহায্যে প্রকৃতি ও প্রাণীর প্রতিনিধিত্বশীল ছবি আঁকতে হলে পার্থিব জগতের নিয়ম-শৃঙ্খলা অতিক্রম করে যেতে হবে। সুলতানের দুই শ্রেণির ড্রয়িং থেকে এই উপসংহারে আসা যায় সহজেই। এটা বেশ বিস্ময়কর যে, তাঁর মতো অনুকরণভিত্তিক এবং প্রতিনিধিত্বশীল, এই দুই শ্রেণির ড্রয়িং এই উপমহাদেশে আর কোনো প্রতিষ্ঠিত শিল্পী আঁকেননি।
সুলতানের দুই শ্রেণির ছবিতেই কিছু সাধারণ মিল রয়েছে। এসব ড্রয়িংএর পটভূমি গ্রাম, আর ফিগারগুলি অধিকাংশই নারীর। প্রকৃতির দৃশ্যে রয়েছে শামত্ম সমাহিত ভাব আর মানুষের দেহের ভঙ্গি প্রায় ক্ষেত্রেই ছন্দময়, লীলায়িত অথবা প্রাণশক্তিতে উলস্নসিত। সুলতানের ড্রয়িং জীবনের জয়গান আর প্রকৃতির প্রতি প্রসন্নতায় সমৃদ্ধ।
তিন
রেখাই ড্রয়িংএর প্রাণ এবং প্রধান সম্বল। এই রেখা আঁকতে গিয়ে শিল্পী ব্যবহার করেন পেন্সিল-কাগজ, কালি-কলম ও কাগজ, তুলি-রং এবং কাগজ অথবা ক্যানভাস, চারকোল (কাঠ-কয়লা)-কাগজ, চক এবং প্যাস্টেল। এসব উপকরণের রয়েছে নিজস্ব শক্তির জায়গা এবং সেইসঙ্গে দুর্বলতাও। যে বিষয়ের ড্রয়িং করা হবে তার চরিত্র ও বৈশিষ্ট্য মনে রেখে শিল্পী উপকরণ বেছে নেন। যখন আর্থিক সামর্থ্য থাকে না অথবা নেহায়েত চর্চার জন্যই ড্রয়িং করা সেই সময় পেন্সিল অথবা চারকোলই বেশি ব্যবহৃত হয়। অবশ্য কিছু বিষয় আছে, যেখানে কোনো একটি উপকরণই সবচেয়ে উপযোগী। যেমন, পোর্ট্রেটে পেন্সিল আর কাগজ।
সুলতান ড্রয়িং আঁকার জন্য ব্যবহার করেছেন পেন্সিল-কাগজ, চারকোল-কাগজ, কালি-কলম ও কাগজ এবং ব্রাশ ও রং। সবক্ষেত্রেই তিনি কাগজ ব্যবহার করেছেন, যদিও তাঁর তৈলচিত্রের নকশা এঁকেছেন ক্যানভাসের ওপর। তাঁর ব্যবহৃত সব উপকরণের মধ্যে পেন্সিল-কাগজ, চারকোল-কাগজ আর কালি-কলম-কাগজে আঁকা ড্রয়িংই দেখতে পাওয়া গিয়েছে বেশি। অন্য উপকরণের সাহায্যে আঁকা ড্রয়িং খুব একটা দেখা যায়নি।
সাধারণত অনুকরণভিত্তিক ড্রয়িংএর জন্য সুলতান ব্যবহার করেছেন পেন্সিল-কাগজ, কালি-কলম-কাগজ। কখনো বা ব্রাশ আর রং। অনুকরণভিত্তিক এবং প্রতিনিধিত্বশীল (অর্ধবিমূর্ত) উভয় শ্রেণির ড্রয়িংএ ব্যবহৃত হয়েছে চারকোল। তাঁর যেসব ড্রয়িং দেখতে পাওয়া গিয়েছে তার মধ্যে চারকোলে আঁকা অবশ্যই বেশি। চারকোল কেবল সহজলভ্য না, এর ব্যবহারে বহুমুখীনতা রয়েছে, যার জন্য বিভিন্ন ইফেক্ট সৃষ্টি করা সম্ভব। এর দ্বারা পেন্সিল অথবা কলমের মতো সূক্ষ্ম রেখা যেমন টানা যায়, ঘষে নেওয়ার পর স্পেসে মৃদু ধূসর ভাবও সৃষ্টি করা যায়। মোটা দাগের রেখা তো সৃষ্টি করা যায়ই। নারীদেহের ছন্দময়, লীলায়িত ভঙ্গি আঁকার জন্য সুলতান প্রধানত চারকোলই ব্যবহার করেছেন। অর্ধবিমূর্ত কিংবা প্রায়-বিমূর্ত ড্রয়িং আঁকার জন্য চারকোলই হয়েছে প্রধান সম্বল। চারকোল দিয়ে বেশ কিছু ড্রয়িংএ তিনি আলো-ছায়া সৃষ্টি করেছেন। পুরুষ দেহের শক্তি এবং দ্রম্নতগতি দেখানোর জন্যও চারকোল তাঁর কাছে উপযোগী মনে হয়েছে। চারকোলের আর একটি বৈশিষ্ট্য তাঁকে আকর্ষণ করেছে : কয়েকটি সংক্ষিপ্ত রেখা টেনেই তিনি বিষয়কে উপস্থিত করতে পেরেছেন। পেন্সিল কিংবা কলম দিয়ে এই ইঙ্গিতময়তা, যা তাঁর প্রতিনিধিত্বশীল শ্রেণির ড্রয়িংএর বৈশিষ্ট্য, তা সৃষ্টি করা যেত না। ব্রাশে আর কালো রংএ আঁকা একটা ড্রয়িংএর দৃষ্টামত্মই আমার কাছে আছে, যা নিখুঁত বলা যাবে না। এটা দেখে বলা যায় যে ব্রাশ আর রংএ আঁকা ড্রয়িংএ গতি নেই, থাকলেও তা অবদমিত। এই সীমাবদ্ধতার ক্ষতিপূরণ হয়ে যায় ব্রাশে আঁকা ড্রয়িংএর ওজনের (Mass) গুণে। সুলতান ব্রাশ ও রং ব্যবহার করে ড্রয়িং করেছেন খুব কম। এর একটা কারণ হয়তো এই যে যখন ড্রয়িং করার ইচ্ছা হঠাৎ করে হয়েছে সে সময় হাতের কাছে এই উপকরণ পাননি। অন্য কারণ হতে পারে এই মাধ্যমের ওপর তাঁর নিয়ন্ত্রণ অন্যান্য মাধ্যমের মতো অটুট ছিল না। নিয়মিত অভ্যাসে তিনি যে এই সীমাবদ্ধতা কাটিয়ে উঠতে পারতেন সে বিষয়ে সন্দেহ নেই। n
তথ্যসূত্র
১. হাসনাত আবদুল হাই, সুলতান (উপন্যাস) ১৯৯১
২. R.G. Collingwood, The Principles of Art, 1938
৩. নন্দলাল বসু, দৃষ্টি ও সৃষ্টি, ১৯০৭
৪. শোভন সোম, চিত্রভাবন, ১৯৮৬
৫. Paul J. Sachs, Great Drawings, 1951
৬. Dale G. Cleaver, Art : An Introduction, 1966