logo

সুরের ‘কমল’

অভীক চট্টোপাধ্যায়

‘গজল’ হলো মূলত প্রেমসংগীত। বাংলা গানে প্রথম উচ্চমার্গের গজল উপহার দেন অতুলপ্রসাদ সেন। সৃষ্টিগত দিক থেকে এক অতুলনীয় বাংলা গজলের ধারার জন্ম দিয়েছিলেন এই সংগীতমনীষী। তাঁর গভীর সংগীতবোধ, ধর্মচেতনা ও জীবনবোধ গজল গানগুলিকে দিয়েছিল গজলের রূপ-রস-গন্ধের আবহে নির্মিত এক ভারতীয় ঘরানার সংগীতের স্বাদ। গজলের জন্ম ইসলামি সংস্কৃতির হাত ধরে এবং জন্মস্থান সেই মধ্যপ্রাচ্য। এই আরবি-ফারসি-উর্দু গজলের

অন্তর থেকে নির্গত হয় তীব্র হাহাকার তোলা শূন্য হৃদয় থেকে উৎসারিত এক রক্তাক্ত প্রেম। এই প্রেমের ধরনের সঙ্গে আমাদের এই উপমহাদেশের বৈষ্ণব ঘরানার প্রেমের রূপের যেন একটু প্রভেদ আছে। এই হৃদয়বিদারক তীব্র বিরহকাতর প্রেমের অহরহ প্রকাশ ঘটেছে উর্দু শায়েরি-গজলের মারফত। কাজী নজরুল ইসলামই সেই মানুষ, যিনি প্রথম বাংলা গানে উর্দু গজলের সরাসরি প্রভাবান্বিত গজলের আমগনি করেছিলেন। আসলে, প্রেমকে সংগীত বা সুরের মাধ্যমে নিয়ে বয়ে চলাটা চিরকালই মানুষের কাছে অন্যতম শ্রেষ্ঠ পথ বলে বিবেচিত হয়েছে। হয়তো, ভালোবাসার সঙ্গে কান্নার যে অঙ্গাঙ্গি সম্পর্ক, তা মূলত সুরেই প্রকাশিত হতে চায় বলেই বোধহয়। জ্যো স্নয় ভেসে যাওয়া প্রেমময় বৃন্দাবন খোঁজে বাঁশির সুর, তার পরিবেশজাত ভালোবাসার আবেশকে আকাশে-বাতাসে ছড়িয়ে দিতে, যা, রাধাকৃষ্ণের প্রেমাকুতির বার্তাকে বহন করে। অন্যদিকে, প্রেমের তাজমহল আহ্বান জানায়, রবাব বা সরোদের মূর্ছনাকে, তার ভালোবাসাজনিত ক্রন্দনকে মেলে ধরার জন্য। এর উলটোটি ঘটলে, কারোর মনই সম্ভবত তাতে সায় দেবে না। আবার, ‘কেন’ জিজ্ঞেস করলে, এর ব্যাখ্যা দেওয়াও বেশ মুশকিল। এ এমন এক অন্তর-উৎসারিত বিচারবোধ, যা বোঝানো যায় না। এখান থেকে কিন্তু, পরিষ্কার হয়, সংগীতের হাত ধরে ভালোবাসা কীভাবে বিচরণ করে এবং দুই ঘরানাজাত প্রেমের ধরনের সূক্ষ্ম পার্থক্য কীভাবে বাদ্যযন্ত্র নির্বাচনকেও চিহ্নিত করে দিচ্ছে। পূর্বোল্লিখিত, দ্বিতীয় সাংগীতিক ঘরানাটিকে বাংলা গানে প্রবেশ করিয়েছিলেন মূলত কাজী নজরুল এবং অতুলপ্রসাদ সেনের তৈরি বাংলা গজলের সঙ্গে তাঁর সৃষ্ট গজলের আবেদনের ক্ষেত্রে এই ঘরানাজনিত বৈশিষ্ট্যের প্রভেদটিই চোখে পড়ে। যাই হোক, ১৯২৮ সালে প্রায় ‘ধূমকেতু’র (কাজী নজরুল-সম্পাদিত পত্রিকা) মতোই বাংলা গানের জগতে আবির্ভূত হয়েছিলেন কাজী সাহেব। তাঁর রচনা, সুরবোধ, সংস্কৃতি ইত্যাদির প্রভাবে অচিরেই গড়ে উঠল এক সাংগীতিক গোষ্ঠী, যা এর আগে একমাত্র রবীন্দ্রনাথকে ঘিরেই গড়ে উঠতে দেখা গিয়েছিল। নজরুলের দ্বারা প্রভাবান্বিত শিল্পীকুলের মধ্যে প্রথম সারির সংগীতব্যক্তিত্ব হিসেবে উত্থান ঘটেছিল কমল দাশগুপ্তের। কমল দাশগুপ্তকে অবশ্য কখনই সম্পূর্ণভাবে নজরুল অনুসারী বলা চলে না, এতই তাঁর সাংগীতিক বৈচিত্র্য নানা বর্ণে রাঙানো ছিল। তবু একথা অনস্বীকার্য, সুরসাধক কমল দাশগুপ্তর সংগীতের যে পথ ধরে গমন চলেছিল, তা অনেকাংশেই সুগম হয়েছিল নজরুল-সান্নিধ্যে। প্রথমেই উল্লিখিত গজলজাত প্রেমের ধরনকে মূলত অন্তরে আশ্রয় করে, কমল দাশগুপ্তসহ অনেক সুরকার-গীতিকার ও কণ্ঠশিল্পীরা দেখা দিলেন। যাঁদের মাথার ওপরে ছিলেন কাজী নজরুল। তখন রেকর্ড-বেতার-সবাক চলচ্চিত্রের পরপর আবির্ভাবের কারণে, সংগীতের সৃষ্টির জগতে শ্রেণিবিভাজন ঘটে গিয়েছিল – গীতিকার-সুরকার-গায়ক বা গায়িকা, এই বিন্যাসে। এই সুরকারের দায়িত্ব সেই বিশ-একুশ বছর বয়স থেকেই পুরোপুরিভাবে নিয়ে, অচিরেই বাংলা গানের অন্যতম স্তম্ভস্বরূপ সংগীত পরিচালকের মর্যাদা আদায় করে নিয়েছিলেন কমল দাশগুপ্ত। যদিও প্রথমদিকে মূলত নিজের গাওয়া অনেকগুলি রেকর্ডের গানের বাণীর গীতিকার ছিলেন কমলবাবু নিজেই। তবে একথা হলফ করেই বলা যায়, কমল দাশগুপ্তের সাংগীতিক সত্তার সমগ্র অংশ ছিল সুরসৃষ্টির নেশায় মগ্ন। সেখানে গীতিকার বা গায়কসত্তা সেভাবে কখনো প্রাধান্য পায়নি। তাঁর নিজস্ব এক সুর-স্বপ্ন ছিল। উপযুক্ত গীতিকবিতা এবং সুযোগ্য কণ্ঠের মাধ্যমে তাঁর সুরের রেশ চারদিকে ছড়িয়ে পড়–ক, এই-ই ছিল কমল দাশগুপ্তের সাংগীতিক বাসনা। এই কারণে দেখা যায়, বেশিরভাগ ক্ষেত্রে, কমলবাবু বেছে নিয়েছিলেন তৎকালীন যুগের উঠতি প্রতিভাবান তরুণ গায়কা-গায়িকাদের। এঁদের মধ্যে যূথিকা রায়, জগন্ময় মিত্র, সত্য চৌধুরী, পদ্মরানী চট্টোপাধ্যায়, পারুল সেন, গৌরীকেদার ভট্টাচার্য প্রমুখ উল্লেখযোগ্য। চলচ্চিত্রের ক্ষেত্রে, কমল দাশগুপ্তের সুরের গান যাঁদের কণ্ঠে গীত হয়ে কালজয়ী হয়ে আছে, তাঁদের মধ্যে উজ্জ্বলতম দুজন হলেন কানন দেবী ও রবীন মজুমদার।

কমল দাশগুপ্তদের দেশ ছিল বাংলাদেশের যশোর জেলার কালিয়াবেন্দা গ্রামে। কিন্তু তিনি ১৯১২ সালের ২৮ জুলাই জন্মেছিলেন পশ্চিমবঙ্গের কুচবিহারে। পিতামহ কামিনীরঞ্জন ও বাবা তারাপ্রসন্ন দুজনেই ছিলেন ধ্র“পদ গানের শিল্পী। কাকা কিরণপ্রসন্ন ছিলেন বিভিন্ন তালবাদ্যে দক্ষ বাজিয়ে। ফলে, জন্মগত সাংগীতিক আবহাওয়াটা পরিবারেই পেয়েছিলেন কমলবাবু। কিন্তু খুব অল্প বয়সেই বাবার মৃত্যু হওয়ায়, সংগীতের তালিম এঁদের কারো কাছ থেকেই জোটেনি। বেশ কিছুটা বয়সে বড় বড়দাই ছিলেন প্রথম সংগীতগুরু। বড়দা বিমল দাশগুপ্ত ছিলেন নানা গুণে গুণান্বিত Ñ ম্যাজিশিয়ান, মিউজিশিয়ান ও কমেডিয়ান। এর সঙ্গে, খেলাধুলায়ও পটু। কমল দাশগুপ্ত প্রথমদিকে নিজেও খেলাধুলার চর্চা করেছিলেন। কিন্তু ঠিকঠাকভাবে, বিমলবাবু তাঁর ভাইকে শিখিয়েছিলেন গান। রক্তে তো সংগীত ছিলই। শুধু দ্বার খোলার অপেক্ষা। সেই কাজটাই নিপুণভাবে করেছিলেন বিমল দাশগুপ্ত। এছাড়া কমলবাবুদের এক বোনও পরবর্তীকালে অসামান্য কণ্ঠশিল্পী হিসেবে বাংলা গানের জগতে নিজের পরিচয় রেখেছিলেন – তিনি সুধীরা দাশগুপ্ত (সেনগুপ্ত)। এই শিল্পীর অকালপ্রয়াণ, আরো অনেককিছু পাওয়া থেকে বঞ্চিত করেছিল বাংলা গানের জগৎকে। আর ছোট ভাই সুবল দাশগুপ্ত। প্রথমে দক্ষ তবলচি হিসেবে সংগীতের আঙিনায় প্রবেশ করে পরবর্তীকালে সংগীতপরিচালক হিসেবে নিজেকে কোন স্তরে নিয়ে গিয়েছিলেন, তা সুবল দাশগুপ্ত সুরারোপিত কিছু চিরসবুজ বাংলা গানের উদাহরণ দিলেই স্পষ্ট হবে – ‘যদি ভুলে যাও মোরে…’ (ধনঞ্জয়), ‘নাইবা ঘুমালে প্রিয়…’ (সায়গল), ‘সাতটি বছর আগে ও পরে’ এবং ‘চিঠি’ (জগন্ময়)। আর কিছু বলবার দরকার আছে কি? সুতরাং দেখা যাচ্ছে, কমল দাশগুপ্তরা ভাইবোন মিলে বাংলা গানের ভাণ্ডারকে কতখানি শস্য-শ্যামলা করে তুলেছিলেন।

বড়দা ছাড়াও দিলীপকুমার রায়, জমীরুদ্দিন খাঁ, রামকৃষ্ণ মিশ্র, কৃষ্ণচন্দ্র দে প্রমুখ মহীরুহের কাছে বিভিন্ন সময়ে নেওয়া সংগীতশিক্ষা কমল দাশগুপ্তের সাংগীতিক ভিত্তিটাকে অসম্ভব শক্তপোক্ত করেছিল। এর সঙ্গে জন্মগত সংগীতবোধ মিশে যে সুরময় চেতনা জন্ম নিল, তাতেই সমৃদ্ধ হলো বাংলা গানের জগৎ। খুঁজে পেল এক নতুন দিশা। এ রচনার শুরুতেই যে উর্দু গজলের আবেদনের কথা এবং তার প্রভাব বাংলা গানের ওপর মূলত নজরুলের হাত ধরে কীভাবে এলো তার কথা বলা হয়েছে, এর মানে এই নয় যে, এর প্রভাবে নজরুলসহ অন্যান্য গীতিকার-সুরকারেরা সব গজলধর্মী গান তৈরি করতে লাগলেন। আসলে, ইসলামি সংস্কৃতি থেকে উদ্ভূত গজলের প্রেমের প্রকাশের ধরনের একটা ছাপ দেখা গেল সব ধরনের বাংলা গানের মধ্যে। যেহেতু সমস্ত বাংলা গানের মধ্যে প্রেমের গানের আধিক্যই বেশি, তাই এই দিকটিই সিংহভাগজুড়ে প্রতিফলিত হলো। একদিকে বৈষ্ণব ঘরানাজাত প্রেম, অন্যদিকে শায়েরি-গজলনির্গত ভালোবাসার রকম – এই দুই ধরনের প্রেমের গানে সেজে উঠল বাংলা গান। প্রধানত এই দ্বিতীয় ঘরানার প্রধান সুরকার হিসেবে উজ্জ্বল হয়ে উঠেছিলেন কমল দাশগুপ্ত। এছাড়া শৈলেশ দত্তগুপ্ত, ধীরেন দাশ, নিতাই ঘটক, সুবল দাশগুপ্ত, চিত্তরায় প্রমুখ সংগীতপরিচালক হিসেবে একই ধরনের ছাপ রাখলেন তাঁদের সুরে। অন্যদিকে কমল দাশগুপ্তের সমসাময়িক হিসেবে সমবয়সী গীতিকার প্রণব রায় যেন একে অপরের পরিপূরক হিসেবে আবির্ভূত হলেন। কিছু পরে এলেন মোহিনী চৌধুরী। এঁদের পূর্বসূরি গীতিকার হিসেবে অজয় ভট্টাচার্য ছিলেন এক অন্য উচ্চতার কবি ও গীতিকার। তাঁর রচনা, মূলত রবীন্দ্র-অনুসারী পঙ্কজ মল্লিক-রাইচাঁদ বড়ালের সুরেই সংগীতে পরিণত হয়েছে বেশি। পরবর্তীকালে শচীন দেববর্মনের সুরেও সংগীতময় হয়েছে অজয় ভট্টাচার্যের রচনা। এছাড়া সেই সময় গীতিকার হিসেবে হেমেন্দ্রকুমার রায়, সৌরীন্দ্রমোহন মুখোপাধ্যায়, বাণীকুমার প্রমুখ ছিলেন উল্লেখযোগ্য। শৈলেন রায়, সুবোধ পুরকায়স্থর মতো গীতিকারের অনেক রচনা সুরারোপিত হয়েছে কমল দাশগুপ্তের দ্বারা। পঙ্কজ মল্লিক ও রাইচাঁদ বড়াল – এই দুই উজ্জ্বল সংগীত পরিচালক (পঙ্কজবাবু কণ্ঠশিল্পীও বটে) মূলত তাঁদের সৃষ্ট সংগীতে আলোকিত করে রেখেছিলেন সদ্যোজাত ‘কলকাতা বেতার’ ও সবাক চলচ্চিত্রের জগৎকে। পঙ্কজবাবু পথপ্রদর্শক হলেন, যথাযথভাবে সাধারণের মধ্যে রবীন্দ্রনাথের গানের বিস্তার ঘটানোর ব্যাপারেও। কারণ অমূল্য ঐশ্বর্যের মতো রবীন্দ্রগান রেকর্ডে যেভাবে বেশিরভাগ কণ্ঠশিল্পী মারফত গীত হচ্ছিল, তাতে তার মূল্যের মর্যাদাহানি ঘটছিল। উচ্চাঙ্গসংগীত দ্বারা আচ্ছাদিত শিল্পীকুল সব গানের মতো এই গানেও প্রয়োগ করছিলেন

খেয়াল-ঠুংরির কালোয়াতি ঢং। শান্তিনিকেতনের অন্দরে একমাত্র বাণী-সুরের মেলবন্ধের যথার্থ মূল্য প্রদানসহ ভাবনির্ভর রবীন্দ্রসংগীতের চর্চা হচ্ছিল। পঙ্কজবাবু সেই ত্রিশের দশকে প্রথম সাধারণ মানুষকে দেখানোর চেষ্টা করলেন, এ গানের আসল মাহাত্ম্য কী? আর একজন ‘সুরসাগর’ হিমাংশুকুমার দত্ত। এই ক্ষণজন্মা প্রতিভাধর, তাঁর সুরকার্যে এমন এক নিজস্ব বিশিষ্টতা আনলেন যে, আজো তাঁকে বাংলা গানের জগতে এক আলাদা কক্ষে রাখতে হয়েছে। সহজ-সাধারণ গানের বাণীতে এমন এক অসামান্য ভাঙাচোরা রূপ তাঁর সুরারোপে তিনি এনেছেন যে, এ-গানকে যখন-তখন গেয়ে ওঠা দুষ্কর এবং মাথায় তুলে রাখা ছাড়া গতি থাকে না। এছাড়া মাত্র ছত্রিশ বছর বয়সে লোকান্তরিত হওয়ার কারণে হিমাংশু দত্ত বেশি কাজও করতে পারেননি। এতক্ষণের উল্লিখিত এত উজ্জ্বল সাংগীতিক ব্যক্তিত্বদের মাঝে কমল দাশগুপ্তর স্থান কোথায়? তিনি বাংলা গানের কোন অংশে আলো ফেললেন? এবার তাই দেখা যাক। এটা বোঝার জন্য সমসাময়িক সাংগীতিক প্রেক্ষাপটকে একটু বুঝে নেওয়ার চেষ্টা হলো।

কমল দাশগুপ্তের বড়দা বিমলবাবু তখন গ্রামোফোন কোম্পানির ‘টুইন’ রেকর্ড বিভাগের সংগীতশিক্ষক। কমলবাবু অত্যন্ত অল্প বয়স থেকেই তাঁর সহকারী। বিমলবাবুকে গানের পাশাপাশি সারা ভারতে ঘুরে ম্যাজিক দেখাতে হতো। এর ফলে কিছুদিন পরে গ্রামোফোন কোম্পানির দায়িত্ব তাঁকে ছাড়তেই হলো। এরপর নানা টানাপড়েনের পর যুবক কমল দাশগুপ্ত তাঁর স্থলাভিষিক্ত হলেন। এ ব্যাপারে তৎকালীন গ্রামোফোন কোম্পানির ‘রিটেলার’ পদের দায়িত্বে থাকা কাজী নজরুল ও ‘টুইন’ বিভাগের কর্তা ওয়াহেদ সাহেবের (মুন্সীজি) মুখ্য ভূমিকা ছিল। কিছুদিন পরে ‘টুইন’-এর সঙ্গে ‘এইচএমভি’ বিভাগের দায়িত্বও মূলত তাঁদেরই চেষ্টায় পেলেন কমল দাশগুপ্ত। এখানে বলা দরকার, কাজী নজরুলের সঙ্গে বোধহয় কমল দাশগুপ্তের এক পূর্বনির্ধারিত অলিখিত সুরের বন্ধন ছিল। বহুদিন আগে, সেই বিশের দশকে যখন রমা থিয়েটারে (পূর্ণ সিনেমা) দেশবন্ধুর সংবর্ধনায় দিলীপকুমার রায়ের দলে গান গাইতে গিয়েছিলেন কমলবাবু, সেই প্রথম কাজী সাহেবকে সেখানে দেখেছিলেন তিনি। দেখেই সে-চেহারাটা মনের মধ্যে গেঁথে গিয়েছিল। আবার গ্রামোফোন কোম্পানিতে এসে সেই নজরুলের সমর্থন তাঁর দিকেই গেল। আসলে কোনোকিছু সৃষ্টি হতে গেলে বোধহয় অনেককিছুর মিলনের একটা পথের দরকার হয়, তবেই তা সম্ভব হয়। যুগের পর যুগ ধরে গোটা দুনিয়াজুড়ে এরকম অব্যাখ্যায়িত মিলনের ধারা দেখা গেছে, সে-পথ দিয়ে কোনো চিন্তা-উদ্যম সৃষ্টিতে পরিণত হয়েছে।

যাই হোক, ১৯৩৪ সালে পুজো উপলক্ষে প্রকাশিত রেকর্ডের মধ্যে চারটির দায়িত্ব পেলেন বাইশ বছর বয়সী কমলবাবু। শিল্পীরা হলেন – কমলা ঝরিয়া, মানিকমালা, হরিমতী এবং শেষের জন তখনো নির্ধারিত হননি। কমলা ঝরিয়া এক উঠতি সুরকারের সুরে গান করতে রাজি হলেন না। মানিকমালা ও হরিমতীর রেকর্ড দুটি ১৯৩৪-এর সেপ্টেম্বরে প্রকাশিত হয়ে গেল। গান লিখলেন কমলবাবুর সমবয়সী অন্তরঙ্গ বন্ধু তেইশ বছরের প্রতিভাবান গীতিকার প্রণব রায়। কিন্তু প্রথমেই যা বলেছি, কমল দাশগুপ্তের অন্তরে থাকা নির্দিষ্ট সুর-স্বপ্নের বাস্তবায়ন তখনো ঘটল না। কী সেই সুরের প্রকৃতি? তখন বাংলা গানের জগতে যত কণ্ঠশিল্পী রাজত্ব করছেন, তাঁরা প্রত্যেকে উচ্চাঙ্গসংগীতে তালিমপ্রাপ্ত একেকজন উচ্চমানের খেয়াল-ঠুংরিতে পারদর্শী শিল্পী। শুধু তাই নয়, সেই সময় সংগীতশিক্ষা ও সংগীত পরিবেশন – সমস্ত বিষয়ের মাপকাঠিই ছিল হিন্দুস্তানি সংগীত। ফলে বাংলা গানে অবাধে এই গায়নরীতির প্রয়োগ করতেন এই কণ্ঠশিল্পীরা। এতে তাঁদের উচ্চমানের গায়নক্ষমতার প্রকাশ ঘটলেও, বাংলা ভাষার মাধুর্য তাতে মার খেত এবং বাণী অপ্রধান হয়ে, গান হয়ে পড়ত সুরের কায়দানির্ভর। ভাবধর্মিতার কোনো প্রকাশই ঘটত না। রবীন্দ্রনাথই প্রথম এ-ব্যাপারে আলোকপাত করেছিলেন এবং মেলে ধরেছিলেন তাঁর স্বর্গশোভাস্বরূপ সংগীতের ভাণ্ডার। কিন্তু আগেই বলেছি, রবীন্দ্রসংগীত তখনো তার আসল রূপ মেলে ধরতে পারেনি। কিন্তু সাধারণ মানুষ সম্ভবত চাইছিলেন সহজ-সরল কথায়-সুরে গান। এ বিষয়ে আঁচ পাওয়া গিয়েছিল ১৯৩২ সালে। তখন সবে পাঁচ বছর হলো কলকাতায় বেতারের আগমন ঘটেছে। সাধারণ মানুষ আলোড়িত, এই গণমাধ্যমকে ঘিরে। যথারীতি, গানের প্রাধান্যই বেশি থাকত বেতারানুষ্ঠান নির্মাণে। সেই সময়, বেতার কর্তৃপক্ষ চিঠি মারফত শ্রোতাদের কাছ থেকে ভোট নিয়েছিলেন যে, উচ্চাঙ্গসংগীতনির্ভর নাকি তুলনামূলকভাবে একটু লঘু ধরনের বাংলা গান – কোনটি তাদের বেশি শুনতে ইচ্ছে করে? সাধারণ বাংলা গান ভোটে জিতে গিয়েছিল। ঠিক এই মনোভাবটাই যথাযথভাবে অনুভব করতে পেরেছিলেন কমল দাশগুপ্ত। সেই যে আগে লিখেছিলাম, চতুর্থ রেকর্ডের শিল্পী তখনো ঠিক হয়নি, অবশেষে পাওয়া গেল। বাতিল রেকর্ডের স্তূপ ঘেঁটে যূথিকা রায় নামে একটি চোদ্দ বছরের মেয়ের কণ্ঠে তাঁর কাক্সিক্ষত আবেদনটি পেয়ে গেলেন কমল দাশগুপ্ত। ১৯৩৪ সালের নভেম্বর মাসে প্রকাশিত হলো প্রণব রায়ের কথায়, কমল দাশগুপ্তের সুরে ও যূথিকা রায়ের কণ্ঠে – ‘আমি ভোরের যূথিকা…’ (ভৈরবী) ও ‘সাঁঝের তারকা আমি পথ হারায়ে এসেছি ভুলে…’ (ইমনকল্যাণ)। আজো চিরনবীন এই গান। কিন্তু সেদিন গ্রামোফোন কোম্পানির রেকর্ডের অনুমোদন বোর্ডে থাকা কোম্পানির ডিলাররা রেকর্ডটি শুনে বলেছিলেন – ‘এ আবার কী গান। না রবীন্দ্রসংগীত, না আবৃত্তি, না অর্কেস্ট্রা সংবলিত। এ রেকর্ড চলবে না।’ আসলে, তৎকালীন প্রচলিত কালোয়াতি প্রদর্শনের পরিবর্তে মেলোডিকে আশ্রয় করে, মিষ্টি ভাব প্রদান করে সহজভাবে গাওয়া গান সম্ভবত তাঁদের কাছে নতুন ঠেকেছিল। তাতেই সম্ভবত উপরোক্ত আচরণ তাঁরা দেখিয়েছিলেন। কিন্তু তাঁরা জানতেন না, কীভাবে তাঁদের আশঙ্কা মিথ্যা প্রমাণিত হতে যাচ্ছে। যাই হোক, শেষ পর্যন্ত কাজী নজরুলের হস্তক্ষেপে রেকর্ডটি বাজারে বেরোলো এবং কিছুদিন পরেই সব রেকর্ডের বিক্রিকে ছাপিয়ে গেল এই রেকর্ড। কাজী নজরুল ওই আপত্তি তোলা ডিলারদের এই রেকর্ডটি নিতে বাধ্য করে, কমল দাশগুপ্তকে বলেছিলেন, ‘তোর অনেক ঝামেলা সহ্য করতে হবে। তবে শেষ পর্যন্ত তুই থাকবি, ওরা চলে যাবে।’ কি অমোঘ উক্তি, ভাবা যায়! এই রেকর্ডটির গান দুটিসহ পরবর্তীকালে কমল দাশগুপ্ত বাংলা গানকে যা দিলেন, তা কি নতুন করে বলবার দরকার পড়ে? এরপর, একের পর এক অবিস্মরণীয় গান গড়ে উঠতে লাগল – যূথিকা রায়ের ‘চরণ ফেলিও ধীরে ধীরে প্রিয়… (প্রণব রায়), ‘মনে পড়ে আজ সে কোন জনম …’ (কাজী নজরুল), ‘ওরে নীল যমুনার জল…’ (কাজী নজরুল), ‘জানি বাহিরে আমার…’ (প্রণব রায়), ‘এমনই বরষা ছিল সেদিন…’ (প্রণব রায়), ‘শতেক বরষ পরে…’ (মোহিনী চৌধুরী), জগন্ময় মিত্রের গাওয়া, ‘আমি দুরন্ত বৈশাখী ঝড়…’ (মোহিনী চৌধুরী), ‘ভালোবাসা মোরে ভিখারী করেছে…’ (মোহিনী চৌধুরী), ‘তুমি কি এখন দেখিছ স্বপন…’ (প্রণব রায়), ‘গভীর নিশীথে ঘুম ভেঙে যায়…’ (কাজী নজরুলের লেখা, এ-গানটি এর আগে কমলবাবু নিজেও রেকর্ডে গেয়েছিলেন), সত্য চৌধুরীর কণ্ঠে, ‘পৃথিবী আমারে চায়…’ (মোহিনী চৌধুরী), ‘যেথা গান থেমে যায়….’ (প্রণব রায়), তালাত মাহমুদের (তপন কুমার), ‘দুটি পাখি দুটি তীরে…’ (গিরিণ চক্রবর্তী), গৌরীকেদার ভট্টাচার্যের, ‘নিও নাগো অপরাধ…’ (শৈলেন রায়) – এরকম অজস্র ননফিল্ম আধুনিক গানে যে মিষ্টি সহজ-সরল মনকাড়া সুরে প্রেমময় আবেদন রাখলেন কমল দাশগুপ্ত, তাতে বাঙালি শ্রোতাকুল মেতে উঠল এবং আজো এসব গান অক্ষয়-অমর। মানদাসুন্দরী দাসী বা কে. মল্লিকের মতো ওস্তাদি ঘরানার কণ্ঠশিল্পীদের সম্পূর্ণ কালোয়াতি ঢঙে গান গাইয়ে, কমল দাশগুপ্ত প্রমাণ করলেন, তিনি শিল্পী অনুযায়ী গান তৈরিতে সমর্থ। এছাড়া, চলচ্চিত্র জগতে? সেখানে দেখালেন ছবির সিচুয়েশনের দাবি অনুযায়ী কীভাবে সুরকে খাপ খাওয়াতে হয়। কানন দেবীর কণ্ঠে শেষ উত্তর ছবিতে, ‘আমি বনফুল গো…’ (প্রণব রায়), ‘তুফান মেল…’ (শৈলেন রায়), যোগাযোগ ছবিতে ‘যদি ভালো না লাগে…’ (প্রেমেন্দ্র মিত্র), একই ছবিতে রবীন মজুমদারের গাওয়া, ‘এই জীবনের যত মধুর ভুলগুলি…’ (প্রেমেন্দ্র মিত্র), ‘নাবিক আমার …’ (প্রেমেন্দ্র মিত্র) বা রবীন মজুমদারেরই গরমিল ছবিতে, ‘এই কি গো শেষ দান…’ (প্রণব রায়) – এসব কি আদৌ ভোলা সম্ভব? এছাড়া যূথিকা রায়কে দিয়ে ভজন, তামিল গান, গীত, তাছাড়া জগমোহন (জগন্ময় মিত্র), হেমন্তকুমার (হেমন্ত মুখোপাধ্যায়) প্রমুখ শিল্পীকে দিয়ে বাংলা ভাষার বাইরে অন্যান্য ভাষায়ও অজস্র অসামান্য গান তৈরি করেছেন কমল দাশগুপ্ত। এছাড়া অন্য অনেক কণ্ঠশিল্পী এই তালিকাবদ্ধ হতে পারেন। সর্বোপরি, বেশকিছু হিন্দি চলচ্চিত্রে কমলবাবুর সফল সুরারোপের কথা তো কখনই ভোলা যাবে না। তাঁর উদ্যোগে ও কর্মে গ্রামোফোন কোম্পানির হিন্দি বিভাগ ফুলে-ফলে সমৃদ্ধ হয়ে উঠেছিল। তাহলে, সংগীতজগতে কমল দাশগুপ্তকে কোন স্থানে বসানো যায় বা এই জগতে তাঁর অধিকৃত অঞ্চল কোনটি, সে-বিষয়ে একটু নজর দেওয়ার চেষ্টা করা যাক।

‘আধুনিক বাংলা গান’ বলতে আমরা যা বুঝি, সেই ধরনের গানের যথাযথ স্পর্শ প্রথম পাওয়ার ব্যাপারে ১৯৩৪ সালে যূথিকা রায়ের গাওয়া, ‘আমি ভোরের যূথিকা…’ রেকর্ডের ক্ষেত্রে কমল দাশগুপ্তর সুরভাবনা এবং গায়কী নির্ধারণ যে অন্যতম প্রধান ভূমিকা পালন করেছিল, একথা বলাই যায়। তারপর কয়েক দশকজুড়ে বহু গীতিকার-সুরকার, গায়ক-গায়িকারা উপহার দিয়ে গেছেন অজস্র ‘আধুনিক বাংলা গান’, যা নিত্যজীবনের সঙ্গী করে রেখেছিল বাঙালি শ্রোতাকুল এবং এসব গান আজো রীতিমতো সজীব। কমলবাবুরা সেই আমলে প্রথম সহজ কথায় ও সুরে মেলোডিপ্রধান গান তৈরি করে খুব সহজেই শ্রোতাদের অন্তর জয় করেছিলেন। সে-বিষয়টির ওপর গায়কীর ক্ষেত্রে, কমল দাশগুপ্তর মতো চিন্তাধারার সুরকার ও ট্রেনাররা সবচেয়ে বেশি জোর দিলেন, তা হলো, সংগীত পরিবেশনের সময় নাটক তৈরি করা। এটা পরিষ্কারভাবে বোঝার জন্য, দেখা যাক বাংলা সংস্কৃতির প্রাণপুরুষ রবীন্দ্রনাথ তাঁর ‘বিশ্ববিদ্যালয়ে সংগীত শিক্ষা’ প্রবন্ধের এক জায়গায় কী লিখেছেন – ‘ওস্তাদীর চেয়ে বড়ো একটা জিনিস আছে, সেটা হচ্ছে দরদ। সেটা বাইরের জিনিস নয়, ভেতরের জিনিস। বাইরের জিনিসের পরিমাপ আছে, আদর্শে ধরে সেটা সম্বন্ধে দাঁড়িপাল্লার বিচার চলে। তার চেয়ে বড়ো যেটা সেটাকে কোনো বাইরের আদর্শে মাপা চলে না, সেটা হল ‘সহৃদয় হৃদয় বেদ্য’।… সুতরাং বোঝাই যাচ্ছে রবীন্দ্রনাথ তাঁর নিজসৃষ্ট সংগীতের মাধ্যমে কোনদিকে দৃষ্টি আকর্ষণ করেছিলেন এবং কমল দাশগুপ্তদের মতো সংগীতব্যক্তিত্বদের ভাবনা রবীন্দ্র-অনুসারীই ছিল। রবীন্দ্রনাথ তো বলেই দিয়েছেন এবং তা অত্যন্ত স্বাভাবিকও বটে যে, দরদ ও হৃদয়ের সম্পর্ক অঙ্গাঙ্গি। তাঁর বক্তব্য থেকে আরো একটা জিনিস স্পষ্ট যে, গানের বহিরাবরণের চুলচেরা বিচার কখনো হৃদয়ানুভূতিকে প্রাধান্য দেয় না। এইখান থেকেই আসে, গান গাইবার সময় তাতে যথাযথ নাটক প্রয়োগের বিষয়টি। গানের কথা ও সুর যখন কণ্ঠশিল্পীর কাছে সম্পূর্ণরূপে আপন হয়ে উঠবে, তখনই তা প্রাণ পাবে। এ যেন অনেকটা দেবতার মূর্তি গড়ার সময় চক্ষুদানের মাধ্যমে তাকে জীবন্ত করে তোলার মতো। যখনই সংগীত পরিবেশনের সময় কণ্ঠশিল্পী তাঁর নিজসৃষ্ট গানের মতো করে গানটিকে ভাবতে পারেন, তখনই বাণী-সুরের নাটকীয়তা তাঁর অন্তরে যে-ছবি তৈরি করে, সেই নাটকীয়তা আসে শিল্পীর কণ্ঠে এবং এর ফলেই ঝরে পড়ে ভাবের পরিপূর্ণ দরদ। ফলে, আনন্দের গানে শ্রোতারা উদ্বেল হন আবার দুঃখের গানে তাঁদের চোখে আসে জল। এক্ষেত্রে আবার শ্রোতাদের নিজেদের মতো করে গানগুলিকে চিনতে পারা চলতে থাকে এবং এভাবেই শিল্পী-শ্রোতার মধ্যে একভাবে পরিপূর্ণ অনুভবের বন্ধন তৈরি হয়। ওস্তাদি গানের চঞ্চলতা এই ভাবতন্ময়তা প্রদানের ক্ষেত্রে, বোধহয় একটু বাধাস্বরূপ হয়, বিশেষ করে, তা যখন হয় এক মিষ্টি, নরম, রসেভরা বাংলা ভাষার গান। সুতরাং একথা বলাই যায়, রবীন্দ্রনাথের সাংগীতিক ভাবধারা থেকে যে ‘আধুনিক বাংলা গান’ জন্ম নিল, সে বিষয়ে কমল দাশগুপ্ত কিছুটা অনন্যতা তো দাবি করতেই পারেন। রবীন্দ্র-পরবর্তী দ্বিজেন্দ্রলাল-রজনীকান্ত-অতুলপ্রসাদ এবং নজরুল প্রমুখ সংগীতমনীষীও একই ভাবধারার দৃষ্টান্ত তুলে ধরেছিলেন, তাঁদের কালজয়ী সংগীতনির্মাণের বৈশিষ্ট্যে। প্রখ্যাত দিলীপকুমার রায়ও একটি ঘরানার সৃষ্টি করেছিলেন, কিন্তু তা ছিল এতটাই নিজস্ব বৈশিষ্ট্যনির্ভর, যার বেশিরভাগ গানই দিলীপকুমারের নিজকণ্ঠেরই উপযোগী হিসেবে বেশি পরিগণিত হওয়ার যোগ্য। রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে উল্লিখিত তিন সংগীতকারের সঙ্গে কাজী সাহেবের গানকেও ভাবধর্মী গানের ধারার শামিল করাতে, অনেক পাঠকেরই ভুরু কুঁচকাতে পারে। কারণ, অনেকদিনই নজরুলগীতির একধরনের গায়নরীতির প্রভাবে সবার মধ্যে একটা বদ্ধমূল ধারণা জন্মে গেছে, এই গান গাইতে গেলে, খুব সুরের কারুকার্য দেখিয়ে একটি উচ্চাঙ্গসংগীত পরিবেশনের আবহ তৈরি করতে হবে। এ বিষয়ে খতিয়ে ভাবতে গেলে, দেখতে হবে, কাজী নজরুল ও কমল দাশগুপ্তর সাংগীতিক বন্ধনগত বৈশিষ্ট্যের দিকে।

১৯২৮ সালে কে. মল্লিকের গাওয়া দুটি গানের একটি রেকর্ড অসম্ভব জনপ্রিয়তা পাওয়ায়, তৎকালীন গ্রামোফোন কোম্পানির ট্রেনার ধীরেন্দ্রনাথ দাশ খোঁজ লাগিয়ে অবশেষে গান দুটির সৃষ্টিকর্তা কাজী নজরুল ইসলামকে আবিষ্কার করে তাঁকে কোম্পানিতে ধরে নিয়ে আসেন। এইভাবেই বাংলা গানের জগতে প্রবেশ ঘটে কাজী সাহেবের। মজার কথা, এর তিন বছর আগে, অর্থাৎ ১৯২৫ সালে পুজো উপলক্ষে হরেন্দ্রনাথ  দত্তের গাওয়া রেকর্ডের একটি গান ছিল নজরুলের ‘জাতের নামে বজ্জাতি সব…’। অথচ, গানটির মূল কারিগরের খোঁজ তখন পড়েনি। প্রসঙ্গত, সেই সময়ে রেকর্ডে গানের গীতিকার-সুরকারের নাম থাকত না। যাই হোক, এইভাবে নজরুলের আগমন ঘটার পর, তাঁর প্রাণখোলা উচ্ছ্বাসে ভরা হো-হো হাসিতে স্বভাব এবং এক অন্যরকম, সাংগীতিক চেতনা – সব মিলিয়ে অনেক সংগীতব্যক্তিত্ব তাঁর আকর্ষণে আকর্ষিত হলেন, যা আগেই বলেছি। এঁদের মধ্যে কমল দাশগুপ্ত ছিলেন প্রথম সারিতে। নজরুলের একটা প্রবণতা ছিল, মুহুর্মুহু গান রচনা করার। যখন লিখতে আরম্ভ করতেন, একটানা লিখেই যেতেন এবং যে-কোনো পরিবেশে বা অবস্থায় তিনি গান লেখা শুরু করে দিতেন। ফলে, এত অজস্র গান, নিজে ছাড়াও যাঁদের ভরসা করতেন, সেরকম কিছু মানুষকে গানে সুর করতে দিতেন। এ বিষয়ে সম্ভবত তাঁর সেরা ভরসাস্থল ছিলেন কমল দাশগুপ্ত। কাজী সাহেব তাঁর প্রিয় ‘কুট্টুর’ (কমল দাশগুপ্তর ডাকনাম) কাছে মুঠো মুঠো গান ফেলে দিয়ে তাতে সুর করতে বলতেন। এ কারণেই বোধহয়, অন্যদের মধ্যে কমলবাবুই সর্বাধিক (প্রায় চারশো)

নজরুল-রচনায় সুরারোপ করেন। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে, কমল দাশগুপ্তর সুরারোপের বৈশিষ্ট্যটি লক্ষ করলে দেখা যায়, তা মেলোডিনির্ভর সহজ-সরল-মিষ্টি সুরে আবদ্ধ। বাণী যা দাবি করছে, সুর যেন সেই দাবিই মেটাচ্ছে। কাজী নজরুল অল্প কিছুদিনের জন্য জমীরুদ্দিন খাঁ সাহেবের কাছে তালিম নিয়েছিলেন, আর পূর্বেই উল্লিখিত যে, কমল দাশগুপ্ত রীতিমতো নাড়া বেঁধে খাঁ সাহেবের কাছে সংগীতশিক্ষা নিয়েছিলেন। কিন্তু, নজরুলের নিজের সুরারোপের মধ্যে একটু উচ্চাঙ্গসংগীত-ঘেঁষা প্রবণতা থাকলেও, কমলবাবু কিন্তু অতদিন শেখা মূলত ঠুংরির প্রয়োগ নজরুলসহ অন্য গীতিকারদের গানে যেভাবে করেছেন তার মিষ্টতা ওভাবে ভরপুর হয়ে শ্রোতাদের অন্তর ছুঁয়েছে। এ বিষয়ে দৃষ্টান্ত দেওয়া যাক। এ থেকে নজরুল-কমল একে অপরে তাঁদের অন্তরে হয়ে চলা সাংগীতিক ক্রিয়াকলাপের আঁচ কীভাবে অনুভব করতেন, তা কিছুটা পরিষ্কার হবে। ১৯৪১ সালের ঘটনা। তখন কমলবাবু প্রায়ই কাজী সাহেবকে বলতেন, তিনি গান লেখা শুরু করে কেন কবিতা লেখাটা প্রায় ছেড়েই দিলেন। সময়াভাবের অজুহাত দেখাতেন নজরুল। অবশেষে একদিন একটা দীর্ঘ কবিতা লিখে নিয়ে এসে কমল দাশগুপ্তকে দিলেন। কমলবাবু চুপিচুপি কবিতাটি একজায়গায় লিখে নিয়ে মূল পাণ্ডুলিপিটি কাজী সাহেবকে ফিরিয়ে দিলেন। এই কবিতাটিই পরে, নতুন চাঁদ কাব্যগ্রন্থে ‘চিরজনমের প্রিয়া’ নামে প্রকাশিত হয়। যাই হোক, কমল দাশগুপ্ত এই দীর্ঘ কবিতাটি থেকে চার-ছয় লাইন তুলে তুলে চারখানি গান তৈরি করলেন এবং নজরুলকে দেখিয়ে বললেন, গানগুলি তাঁরই (কমলবাবুর) এক বন্ধুর লেখা। কাজী সাহেব দেখে তো সেই গীতিকারের ব্যাপারে প্রশংসায় পঞ্চমুখ। যখন কমল দাশগুপ্ত আসল সত্যটি প্রকাশ করলেন, তখন নজরুল প্রথমে বিশ্বাস করতেই চাননি। পরে অবশ্য মানলেন। গান হিসেবে মুখড়ায় ফিরে আসার জন্য, কিছু শব্দ কমল দাশগুপ্তকে ঢোকাতে হয়েছিল এবং তা কবিতাংশগুলিকে আদর্শ গানে রূপান্তরিত হতে নিশ্চয়ই সাহায্য করেছিল। প্রতিটি গান সুরসহ শোনার পর কাজী নজরুল চারটি গানকেই অনুমোদন করেন এবং এইভাবে কমল দাশগুপ্তই এক অর্থে চারটি নজরুলগীতির জন্ম দিয়ে দেন। এ থেকে পরিষ্কার হয়, নজরুল-কমলের সাংগীতিক তালমিল কী পর্যায়ের ছিল। এই চারটির মধ্যে একটি অন্যতম জনপ্রিয় নজরুলগীতি হলো, ‘আরো কতদিন বাকি…’, যা ১৯৪১ সালের জুন মাসে রেকর্ডে কমল দাশগুপ্তর সংগীত পরিচালনায় গেয়েছিলেন অকালপ্রয়াত এক প্রতিভাময়ী শিল্পী মীনা বন্দ্যোপাধ্যায়। এই সমস্ত তথ্য আমরা পাই প্রখ্যাত নজরুলগীতি গবেষক আসাদুল হকের লেখা নজরুল-সংগীতের রূপকার গ্রন্থে। কমল দাশগুপ্ত ভাবকে আশ্রয় করে, সহজভাবে গান গাওয়ার ধারা প্রণয়নে যে কতখানি আগ্রহী ছিলেন, তা তাঁর সুরে নজরুলের লেখা শ্রীমতী ইন্দুবালার রেকর্ডে গাওয়া, ‘সাঁঝের পাখিরা ফিরিল কুলায়…’ (এপ্রিল, ১৯৪০) গানটির গায়কীতে স্পষ্ট হয়। সবারই জানা, ইন্দুবালা দেবী ছিলেন সেই সময়ের ডাকসাইটে কণ্ঠশিল্পী, যাঁর কণ্ঠস্বরে অহরহ খেলত খেয়াল-ঠুংরির মুড়কি – গিটকিরি-তানকারির কারুকার্য। তাঁর বেশিরভাগ গান শুনলেই যে কেউ তা বুঝতে পারবেন। কিন্তু উপরোক্ত গানটিতে তুলনামূলকভাবে কালোয়াতির প্রবণতা অনেক কম এবং গানটির বাণী ও পূরবী রাগনির্ভর অসামান্য সুরপ্রয়োগের মাধ্যমে যে বিষাদময়তা ঝরে পড়ছে, সেই ভাবকে প্রাধান্য দেওয়ার দিকে ঝোঁক বেশি। এর পাশাপাশি অন্যান্য রেকর্ডে কিন্তু ইন্দুবালা দেবীর এই ধরনের গায়নরীতি প্রায় শোনা যায় না। বোঝাই যাচ্ছে, কমল দাশগুপ্ত তাঁর নিজস্ব সংগীতভাবনার দ্বারা অন্তত এই রেকর্ডের ক্ষেত্রে, ইন্দুবালা দেবীর মতো তৎকালীন দাপুটে শিল্পীকেও প্রভাবিত করতে পেরেছিলেন। অবশ্য, কমল দাশগুপ্তর দাপটও সে-সময়ে কিছু কম ছিল না। প্রসঙ্গত, এই রেকর্ডটির আরেক পিঠে, কবি কুমুদরঞ্জন মল্লিকের লেখা, ‘ও তার অধরে নেমেছে…’ গীতিকবিতাটি কমল দাশগুপ্তর সুরে গেয়েছিলেন ইন্দুবালা দেবী। একইভাবে বলা যায়, নজরুল রচিত অত্যন্ত জনপ্রিয়, ‘মোর না মিটিতে আশা, ভাঙিল খেলা…’ গানটি নিয়েও। এই গানটিতে কাজী নজরুল ও কমল দাশগুপ্ত দুজনেই দুটি ভিন্ন সুরারোপ করেন। কাজী নজরুলের এই গানটির বাণী প্রথম প্রকাশিত হয় বুলবুল গীতিগ্রন্থের দ্বিতীয় সংখ্যায় এবং নজরুলের করা সুরের স্বরলিপিটি, যেটি করেছিলেন জগৎ ঘটক মশাই, তা প্রকাশিত হয় ১৩৪৫ সালের ২৬ বর্ষ প্রথম খণ্ড, ৫ম সংখ্যা ভারতবর্ষ পত্রিকায় (নজরুল-সংগীতের রূপকার, আসাদুল হক)। অন্যদিকে, কমল দাশগুপ্তকৃত সুরারোপে একই গান শোনা যায় শান্তা আপ্তের কণ্ঠে একটি রেকর্ডে, যা প্রকাশিত হয় ১৯৪১ সালের এপ্রিল মাসে। কাজী নজরুলের সুরে নির্মিত গানটি একটু জটিল ছিল। তিনি টিমেতেতালা তালে আবদ্ধ করেছিলেন গানটিকে। কমল দাশগুপ্তর সুরটি ছিল যথারীতি সহজ-সরল এক মনকাড়া পথগামী। গানটির বাণী থেকে যে-বিষাদময়তা বেরিয়ে আসছে, সাধারণ দাদরা তালে বেঁধে এবং শান্তা আপ্তেকে দিয়ে এক হৃদয়ধর্মী গায়কীকে আশ্রয় করে পরিবেশন করিয়ে শ্রোতাদের সদর্থেই যেন এক বিষন্নতার জগতে নিয়ে গিয়ে ফেলেন কমল দাশগুপ্ত। প্রসঙ্গত, কাজী নজরুলের করা সুরারোপটির কোনো রেকর্ড হয়নি এবং আজো আমরা এই, ‘মোর না মিটিতে আশা…’ গানটির যে-সুরটি শুনি, তা ওই কমলবাবুর করা সুরারোপটিই। এ থেকে অনুমান করা যেতেই পারে, কাজী নজরুল নিজের সুরটিকে প্রাধান্য না দিয়ে কমলবাবুরটিকেই পছন্দ করেন এবং জনসমক্ষে প্রকাশিত হতে দেন। এখান থেকে যে-বিষয়টি অভিনব ঠেকে, তাহলে কি কিছু কিছু গানের ক্ষেত্রে তার সংগীতময় রূপটি নিজ অপেক্ষা কমল দাশগুপ্তের মাধ্যমে আরো স্পষ্ট দেখতে পেতেন কাজী সাহেব? কেন জানি না, তেমনই যেন মনে হয়। একই সঙ্গে এও মনে হয়, নিজে একজন আদ্যোপান্ত প্রেমে আচ্ছাদিত ও ক্ষতবিক্ষত সংগীতহৃদয়ের ধারক হওয়ার ফলেই সম্ভবত শ্রোতাহৃদয়ের নরম আকুতির সঙ্গে খুব সহজেই সুরবন্ধনে নিজেকে যুক্ত করতে পেরেছিলেন এই মহান সুরকার কমল দাশগুপ্ত। শুধু সুরের কায়দা দেখানো নয়, বাংলার মতো একটি রসসিক্ত আবেগপূর্ণ ভাষার গানে হৃদয়ানুভূতির আশ্রয়ে সংগীতকে কণ্ঠ মারফত নিবেদন করলে, তবেই তা যথাযথভাবে অন্তরগ্রাহী হয়ে ওঠে, তাঁর নানা সুর নির্মাণ ও গায়কী নির্ধারণের মধ্য দিয়ে বারবার তা দেখিয়েছেন কমল দাশগুপ্ত। অথচ পরবর্তীকালে, পুনরায়, অতিরিক্ত কালোয়াতি প্রদর্শনের পাল্লায় পড়ে নজরুলগীতি তার ভাবধর্মিতার বৈশিষ্ট্য হারাল এবং তার প্রভাব আজো অব্যাহত। একটা ধারণা যেন দৃঢ়ভাবে চারদিকে ছেয়ে গেছে, নজরুলগীতি গাইতে গেলে, উচ্চাঙ্গসংগীত-ঘেঁষা সুরের কারুকার্য প্রদর্শনের ক্ষমতা থাকা চাই। একথা অনস্বীকার্য, গান শেখার প্রাথমিক সোপান হচ্ছে উচ্চাঙ্গসংগীতশিক্ষা। না হলে, প্রাথমিক বনেদটা গড়ে ওঠে না। কিন্তু তার মানে এই নয়, যে-কোনো ধরনের গানে, তার পূর্ণমাত্রায় প্রয়োগ করতে হবে। সুতরাং একথা বলাই যায়, নজরুলগীতি শেখা বা গাওয়ার ব্যাপকতা ইদানীংকালে কিছুটা হলেও স্তিমিত হওয়ার অন্যতম প্রধান কারণ হিসেবে উপরোক্ত নজরুলগীতি সংক্রান্ত বক্তব্যের বিষয়টিকে ধরা যেতে পারে (একথা শুধুমাত্র কলকাতা ও পশ্চিমবঙ্গের ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য)। এই ধারণা থেকে বেরিয়ে এসে নজরুলগীতিকে আবার একটু বেশি হারে চর্চার দিকে নিয়ে যাওয়ার ক্ষেত্রে, এ-বছর জন্মশতবর্ষে উপনীত হওয়া নজরুল সম্পৃক্ত সুরসাধক কমল দাশগুপ্তের সাংগীতিক ধ্যানধারণার দিকে নজর দেওয়া আশু জরুরি। শুধু কমলবাবুই নয়, তাঁর সমসাময়িক অনেক প্রণম্য সংগীতব্যক্তিত্ব নজরুল বাণীতে সুরারোপ করার সময় একই রকম সহজ-মিষ্টি-আর্তিময় মেলোডিনির্ভর সুরের আশ্রয় নিয়েছেন। কিছু নমুনা পেশ করলে নিশ্চয়ই তা অপ্রাসঙ্গিক হবে না – ‘নয়নভরা জল গো তোমার…’ (সুরকার : চিত্ত রায়), ‘আমায় নহে গো…’ (সুরকার : শৈলেশ দত্তগুপ্ত), ‘তোমারি আঁখির মতো …’ (সুরকার : নিতাই ঘটক), ‘নিশি পবন, নিশি পবন, ফুলের দেশে যাও…’ (সুরকার : গিরিণ চক্রবর্তী), ‘সন্ধ্যা নেমেছে আমার বিজন ঘরে…’ (সুরকার : সুবল দাশগুপ্ত) ইত্যাদি। এর পাশাপাশি কমল দাশগুপ্ত-সুরারোপিত আরো কিছু (পূর্বোল্লিখিত বাদে) নজরুল-গীতিকবিতার উদাহরণ দিলে, সাংগীতিক ধারণাগত সাযুজ্যের বৈশিষ্ট্যটি স্পষ্ট হয় –  ‘স্বপ্নে দেখি একটি নতুন ঘর…’, ‘আধখানি চাঁদ হাসিছে আকাশে…’, ‘জানি জানি প্রিয়…’, ‘যবে তুলসীতলায় প্রিয়, সন্ধ্যাবেলায়…’, ‘তোমার হাতে সোনার রাখী…’, ‘প্রজাপতি, প্রজাপতি, কোথায় পেলে ভাই…’ ইত্যাদি। গানের ধরন অনুযায়ী উপযুক্ত শিল্পীদের দিয়ে গাইয়ে, গানগুলিকে অমর করেছেন কমল দাশগুপ্ত। ১৯৩৪ সালের জানুয়ারি মাসে প্রকাশিত একটি রেকর্ডে নিজের সুরে কাজী নজরুলের লেখা দুটি গান গেয়েছিলেন স্বয়ং কমল দাশগুপ্ত। গান দুটি হলো – ‘চলরে চপল তরুণদল…’ এবং ‘শঙ্কাশূন্য লক্ষ কণ্ঠে…’। অবশ্য এছাড়া আরো বহু কাজী নজরুল রচিত গীতিকবিতা নিজের সুরে রেকর্ডে গেয়েছেন কমলবাবু, কিন্তু, পূর্বোক্ত গান দুটি বিশেষ উল্লেখের দাবি রাখে। কেন? এ-বিষয়ে বিস্তারিত লিখেছেন, বিশিষ্ট সংগীত প্রাবন্ধিক কল্যাণবন্ধু ভট্টাচার্য তাঁর ‘সুরকার কমল দাশগুপ্ত’ নিবন্ধে। বিষয়ের সারমর্ম হলো, সেই সময়ে ইংল্যান্ড থেকে London Philmonic Orchestra-র একটি রেকর্ড এদেশে আসে। বেহালার সঙ্গে অন্যান্য যন্ত্রবাদনের মিশ্রণে একটি orchestra -র রেকর্ড। গ্রামোফোন কোম্পানি সারা ভারতে বিভিন্ন সংগীতপরিচালকের কাছে রেকর্ডটি পাঠিয়ে অনুরোধ করেছিলেন, যদি এই ছন্দের মাপে কোনো ভারতীয় ভাষার গান তৈরি করা যায়। কলকাতায় ভার পড়ল কমল দাশগুপ্তের ওপর। তিনি দুমাস অক্লান্ত পরিশ্রম করে, ওই জটিল ছন্দ ও স্ক্যানিং অনুযায়ী একটি মেলোডিনির্ভর সুরচলনকে নির্মাণ করলেন। এরপর কাজী নজরুলকে দিয়ে ওই সুরচলনের মিটার অনুযায়ী বাণী লেখালেন এবং সৃষ্টি হয়ে গেল উপরোক্ত গান দুটি। প্রসঙ্গত, ভারতের অন্য সমস্ত জায়গা থেকে সুরকারেরা তাঁদের অসামর্থ্যরে কথা জানিয়ে রেকর্ডটি ফেরত পাঠিয়েছিলেন। এ থেকে যা প্রমাণিত হয়, তা সবিস্তারে লেখার প্রয়োজন পড়ে না। একটি কথা উজ্জ্বল হয়ে ওঠে যে, কমল দাশগুপ্ত সময়ের থেকে অনেক এগিয়ে থাকা একজন সাংগীতিক প্রতিভাধর ছিলেন। কিন্তু আজো এই বিরাট সৃষ্টিকর্তার যথাযথ মূল্যায়ন হয়নি। কারণ, বিশেষ করে আজকের সময়ে সংগীততাত্ত্বিক মহলের একটা বড় অংশ আধুনিক বাংলা গানের বিষয়টিকে বিশেষ আমল দিতে চান না। রবীন্দ্রনাথের গানের পাশে এগুলো কিছুই না, এরকম একটি ধারণার সংস্কৃতি যেন ছেয়ে গেছে কিছু শ্রেণির পণ্ডিতবর্গের মধ্যে এবং এর সঙ্গে, এ-প্রশ্নও তাঁরা তোলেন, ‘রবীন্দ্রসংগীত’ কি ‘আধুনিক বাংলা গান’নয়? ব্যক্তিগতভাবে মনে হয়, এসব চিন্তাধারার মধ্যে একটু অসারতা আছে। প্রথমত, রবীন্দ্রসংগীত অবশ্যই আধুনিক বাংলা গানের ধারার প্রথম সোপান। কিন্তু আধুনিক বাংলা গান বললে কিন্তু সাধারণভাবে কেউই রবীন্দ্রসংগীতের কথা ভাবেন না। তাছাড়া রবীন্দ্রসংগীতকে শ্রোতারা তো হৃদয়ের সর্বোচ্চ আসনে বসিয়ে পুজো করেন, বলা যায়। তাঁদের মনে ‘রবীন্দ্রসংগীত’ ও ‘আধুনিক বাংলা গান’ দুধরনের গানের গ্রহণীয়তা যদি পৃথক আবেগ ও মেধার পথ ধরে আসে, তাতে অসুবিধাটা কোথায়? সবচেয়ে বড় কথা এই সমস্ত যুক্তিধর্মী মন্তব্য, সাধারণ মানুষের মধ্যে সেভাবে কোনো প্রভাব ফেলে বলে মনে হয় না। তা আপন নিয়মেই প্রবহমান থাকে। কমল দাশগুপ্তর মতো সুরকারেরা বা তৎকালীন স্মরণীয় গীতিকার ও গায়ক-গায়িকারা তো মূলত রবীন্দ্রনাথের দরদধর্মী গানের ধারণার ওপর দাঁড়িয়েই গান তৈরির কাজ করেছিলেন। উপরন্তু বাংলা গানে প্রথম যে সার্থক ‘সঞ্চারী’র প্রবর্তন ঘটিয়েছিলেন রবীন্দ্রনাথ, সেই ধারার তো ব্যাপকহারে প্রভাব পড়েছিল এই আধুনিক ও ছায়াছবির বাংলা গানে। কয়েক দশক ধরে অজস্র গীতিকার সঞ্চারীর প্রয়োগ করে চললেন তাঁদের গানে এবং সেই অনুযায়ী সুরও করলেন সুরকারেরা। হ্যাঁ, অবশ্যই রবীন্দ্রসংগীতসহ বিভিন্ন ধারার বাংলা গানের এই বাংলা গানের জগতে অবস্থানগত তারতম্য থাকতেই পারে এবং সেটাই তো স্বাভাবিক। কারণ, দাঁড়িপাল্লা দিয়ে গান ধরে ধরে এইভাবে ওজন মাপতে গেলে তো গানটা ঠিকঠাকভাবে হৃদয় দিয়ে শোনাই হয়ে উঠবে না, তাই না? আর, রবীন্দ্রসংগীতের মতো গান অহরহ সৃষ্টি হলে কি খুব ভালো হতো? না, এই গানের সৃষ্টিকর্তার ভাষাতেই তা অনেকের ভিড়ে হয়ে পড়ত মাঝারি। আসলে, একটি বৃক্ষের সম্পূর্ণ রূপ যেমন শুধুমাত্র তার প্রধান গুঁড়িটি নয়, তার থেকে বেরোনো, নানা সরু-মোটা শাখা-প্রশাখা মিলিয়েই তবে সে সম্পূর্ণ একটি গাছ, ঠিক তেমনি, দশক থেকে দশকে গড়ে ওঠা নানা বৈচিত্র্যের সাংগীতিক ধারার সমন্বয়েই বাংলা গানের জগৎ। শ্রোতাকুলের ওপর তার প্রত্যেকটির নিজ নিজ বৈশিষ্ট্য অনুযায়ী প্রভাব আছে। কেউ অস্বীকার করলেও আছে, না করলেও আছে।

সেই ত্রিশের দশকে একবার কণ্ঠশিল্পী যূথিকা রায়কে কমল দাশগুপ্ত বলেছিলেন, সে-সমস্ত গান তখন প্রচলিত ও জনপ্রিয় ছিল, যেহেতু তার প্রায় সবটাই উচ্চাঙ্গসংগীতের আদলে নির্মিত। ফলে, এইসব গান সংগীত সমঝদার শ্রোতাদের মধ্যেই মূলত সীমাবদ্ধ রয়েছে, কিন্তু তিনি (কমলবাবু) যে মিষ্টিসুরের মেলোডিপ্রধান গান তৈরির কথা ভেবেছেন, তাঁর দৃঢ় বিশ্বাস তা হবে আপামর সংগীতপ্রেমী সাধারণ শ্রোতার মন-প্রাণকাড়া গান। কমল দাশগুপ্তর স্বপ্ন অক্ষরে অক্ষরে যে ফলে গিয়েছিল, তা কি আর নতুন করে বলার দরকার হয়? পরবর্তী কয়েক দশক ধরে বাঙালি শ্রোতা তো এই গানগুলিকে বুকে আঁকড়ে রইল এবং এখনো এই ধরনের বাংলা আধুনিক গানের দৃষ্টিভঙ্গিকে আশ্রয় করে তো অনেক গানই তৈরি হচ্ছে। দীর্ঘদিন ধরে গ্রামোফোন রেকর্ড, পাড়ার জলসা, রেডিওর ‘অনুরোধের আসর’ বা ‘ছায়াছবির গান’ ইত্যাদি আরো অনেক কিছু যা ‘বঙ্গজীবনের অঙ্গ’ ছিল, তার মূল উপজীব্য ছিল এই ‘আধুনিক বাংলা গান’। আজো, বিশেষ করে চল্লিশোর্ধ্ব বাঙালি শ্রোতার কাছে এই গানগুলি অনেক স্মৃতিকে এনে মনে জড়ো করায়। একেকটা গান জীবনের কোনো এক বিশেষ অধ্যায়ের ক্ষণ-পল-মুহূর্ত ইত্যাদিকে তার সঙ্গে টেনে এনে আমাদের সামনে যেন দাঁড় করায়। এই গানগুলিকে ঘিরে এই অনুভূতিপ্রবণতার ঐতিহ্য ছিল, আছে ও থাকবে এবং এখানেই যে-কোনো যুগে কমল দাশগুপ্তদের মতো চিরপ্রণম্য সংগীতব্যক্তিত্বরা প্রাসঙ্গিক হয়ে থাকেন। কিন্তু যিনি বাংলা গানের জগতে এত বড় জায়গায় অবস্থান করছেন, সেই কমলবাবুর শেষ জীবনটা মোটেই সুখকর হলো না।

একসময়ে দুহাতে রোজগার করেছেন কমল দাশগুপ্ত। যেদিকে তাকাচ্ছেন, সোনা ফলিয়ে দিচ্ছেন। চল্লিশের দশকের শেষের দিকে হঠাৎ ব্যাংক ফেল করে গিয়ে তাঁর যাবতীয় অর্থসঞ্চয় জলাঞ্জলি গেল এবং এক লহমায় কপর্দকশূন্য হয়ে গেলেন। এর মধ্যে, ধরেছেন ভয়াবহ মরফিনের নেশা। তাঁর পেটে একটা তীব্র যন্ত্রণা হতো, তা উপশম করতে ডাক্তার মরফিন ইঞ্জেকশন দিতেন। সেই থেকে নেশা হয়ে গিয়েছিল। চরম অর্থাভাব আরম্ভ হলো। কাজও কমে গেল অনেক। তখন মূলত বেতার ও কিছু চলচ্চিত্রে কাজ করছেন, আর গান শেখাচ্ছেন ছাত্রছাত্রীদের। পঞ্চাশের দশকে বিয়ে করলেন, গানের ছাত্রী ও পরবর্তীকালের প্রখ্যাত গায়িকা ফিরোজা বেগমকে। সংসার পাতলেন কলকাতায়। সন্তানাদিও হলো। কিন্তু দারিদ্র্য ঘুচল না। ১৯৫৮ সালে, শ্বশুরবাড়ির জায়গা পূর্ব পাকিস্তানে (বর্তমান বাংলাদেশ) সপরিবারে চলে এলেন কমল দাশগুপ্ত। তারপর, বারকয়েক কলকাতায় এসেছেন। তাঁর সুরারোপিত শেষ ছবি বধূবরণ (১৯৬৭)-এর কাজ বাংলাদেশ থেকে এখানে এসেই করে গিয়েছিলেন। শেষ এলেন ১৯৭২-৭৩ সালে ‘বঙ্গ-সংস্কৃতি সম্মেলনে’ যোগ দিতে কলকাতায়। স্ত্রী ফিরোজা বেগমের সঙ্গে দ্বৈত কণ্ঠে রবীন্দ্র-সদন মঞ্চে শেষবারের মতো কমল দাশগুপ্ত শুনিয়েছিলেন, ‘মোরা একই বৃন্তে— দুটি কুসুম, হিন্দু-মুসলমান…’। অবশেষে, ১৯৭৪ সালের ২০ জুলাই বাংলাদেশেই, বেঁচে থাকার মতো দুরূহ কাজটি থেকে অব্যাহতি নিয়ে ইহলোক থেকে সুরলোকে পাড়ি দিলেন এই কিংবদন্তি সংগীতমনীষী। কিন্তু বাঙালি হিসেবে আমরা তাঁর কী মূল্যায়ন করলাম? এ বছর তাঁর জন্মশতবর্ষ। বছর ঘুরতে চলল, সেভাবে কিছুই তো চোখে পড়ছে না। কমল দাশগুপ্তর বাংলা গানের জগতে যা অবদান এবং সেই পরিপ্রেক্ষিতে বর্তমানের বাঙালি হিসেবে তাঁকে স্মরণে রাখার যা বহর, দুটোকে এক করলে, আমরা যে সত্যিই এক ‘আত্মবিস্মৃত’ জাতিতে পরিণত হয়েছি, সে-ব্যাপারে আর কোনো সন্দেহ থাকে কি?

 

তথ্যসূত্র :

১.       ‘বিশ্ববিদ্যালয়ে সঙ্গীতশিক্ষা’ (‘সঙ্গীত’ প্রবন্ধমালার অন্তর্গত), রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর (রবীন্দ্র-রচনাবলী জন্মশতবার্ষিকী সংস্করণ)।

২.       ‘কাজীদাকে যেমন পেয়েছি’, কমল দাশগুপ্ত (কল্যাণী

কাজী-সম্পাদিত ‘শতবিভায় নজরুল’ গ্রন্থ, ‘সাহিত্যম’, মহালয়া ১৪০৫)।

৩.      ‘সুরকার কমল দাশগুপ্ত’, কল্যাণবন্ধু ভট্টাচার্য (সঞ্জীবকুমার

বসু-সম্পাদিত সাহিত্য ও সংস্কৃতি পত্রিকা, কার্তিক-পৌষ ১৩৮৩।

৪.       নজরুল-সংগীতের রূপকার, আসাদুল হক (নজরুল ইনস্টিটিউট, ঢাকা, জুলাই ১৯৯০)।

৫.      আদি গ্রামোফোন রেকর্ডে ধারণকৃত নজরুল-সঙ্গীতের বাণী

(বিভিন্ন খণ্ডের সম্পাদনায় যথাক্রমে আসাদুল হক, সুধীন দাশ, রসীদুন নবী ও ব্রহ্মমোহন ঠাকুর) – প্রথম থেকে পঞ্চম খণ্ড নজরুল ইনস্টিটিউট, ঢাকা, ফেব্রুয়ারি ১৯৮৯, জানুয়ারি ১৯৯০, জুন ১৯৯৪, জুন ১৯৯৫, সেপ্টেম্বর ১৯৯৫)।

৬.      ‘কমল দাশগুপ্ত স্মরণে’, অরুণ সেন (বেতার জগৎ : ১৬-৩০ সেপ্টেম্বর, ১৯৭৪)।

এছাড়া প্রখ্যাত কণ্ঠশিল্পী যূথিকা রায়ের সঙ্গে ব্যক্তিগত আলাপচারিতার মাধ্যমে প্রাপ্ত তথ্য।

Leave a Reply