logo

সুদীপের চাকা একটা ঘোরে ফেলে দিয়েছে

অ লো ক  ব সু

নাটক রচনার ক্ষেত্রে সেলিম আল দীন বরাবরই ছিলেন নিরীক্ষাধর্মী ও বৈচিত্র্যপিয়াসী। গত শতকের নববইয়ের দশকের একেবারে শুরুতে চাকা নাটক রচনার মধ্য দিয়ে তিনি এক নতুন ধারার নাট্যরচনা শুরু করেছিলেন। নতুন ধারার এই রচনারীতির নাম দিলেন কথানাট্য। এই ধারায় তিনি পরপর লিখলেন চাকা, যৈবতী কন্যার মন ও হরগজ। শুরুর কথানাট্য চাকা সম্পর্কে সৈয়দ শামসুল হক তাঁর বিমুগ্ধতার কথা জানিয়েছিলেন গ্রন্থের শেষ প্রচ্ছদে। কথানাট্য পাঠে যেমন রয়েছে নাটক পাঠের আনন্দ, তেমনি উপন্যাস ও কবিতা পাঠের স্বাদ। দ্বৈতাদ্বৈতবাদী শিল্প সৃষ্টি সেলিম আল দীনের কৃতিত্বের পরিচয় পাঠক-দর্শক পরিপূর্ণভাবে অনুভব করতে শুরু করেন তাঁর প্রথম কথানাট্য চাকার মাধ্যমে।

আজ থেকে প্রায় একুশ-বাইশ বছর আগে সেলিম আল দীনের এ নাটকটি মঞ্চে উপস্থাপন করেছিল ঢাকা থিয়েটার। নির্দেশনা দিয়েছিলেন সৈয়দ জামিল আহমেদ। ঢাকা থিয়েটার প্রযোজিত চাকা নাটকটি তখন দারুণভাবে আলোড়িত করেছিল দর্শকদের। শুধু যে নতুন রীতির রচনার কারণে চাকা আলোচনার কেন্দ্রে ছিল তা নয়, প্রযোজনার অভিনবত্বেও দর্শক ছিল বিমুগ্ধ।

মহিলা সমিতি মিলনায়তনের চিরপরিচিত রূপ পালটে দিয়ে সৈয়দ জামিল আহমেদ এক ধুন্ধুমার কান্ড ঘটিয়েছিলেন। এতদিন যেখানে দর্শকের আসন ছিল, সেখানে তৈরি হলো নাটকের মঞ্চ (মঞ্চ বললে ভুল হবে, বলা উচিত অভিনয় স্পেস)। আর যেখানে হতো অভিনয় সেই মঞ্চের ওপর বসানো হলো দর্শকদের। মিলনায়তনের মেঝেতে খড়কুটো বিছিয়ে তৈরি করা হলো উত্তরবঙ্গের রুক্ষ প্রান্তর। কারণ এ গল্পের ঘটনাস্থলের ইঙ্গিত সে-রকমই। হাসপাতাল থেকে একটি লাশ পৌঁছে দেওয়ার দায়িত্ব দেওয়া হয় গরুর গাড়ির এক গাড়োয়ানকে। ভুল ঠিকানার কারণে গাড়োয়ান লাশ নিয়ে ছুটে চলে গ্রাম থেকে গ্রামান্তরে। কিন্তু কোনো গ্রামের লোকই নিজেদের গ্রামের কারো লাশ হিসেবে তা শনাক্ত করে না। গল্পের শববাহী চাকা এগিয়ে চলে মাঠের পর মাঠ ছাড়িয়ে নানা প্রান্তরে। স্বজনহীন লাশ চলতে চলতে একসময় বাহের গাড়োয়ান, পৌঢ় ও শুকুরচান, ধরমরাজদের পরম আত্মীয় হয়ে ওঠে। অনামা লাশটিকে যে কেউ চিনতে পারল না, সেই কষ্ট নিবারিত হয় শববাহক ক্ষেতমজুরদের কর্তৃক জানাজা ও কবরদানের মাধ্যমে।

১৯৮৬-৮৭ সালের গণঅভ্যুত্থান আকস্মিকভাবে স্তব্ধ হলে অন্য সবার মতো সেলিম আল দীনও বিচলিত হয়েছিলেন। রাজনৈতিক দলের বাদানুবাদে শহীদেরা নাম-পরিচয়হীন দিগন্তের দিকে ভেসে যায়। এ রকম বেদনা রয়েছে চাকা নাটকের মূলে। সেলিম আল দীন স্বীকার করেছেন সে-কথা। তিনি আরো বলেছেন, ‘চাকা রূপক সাংকেতিক নাটক নয় – নিরবলম্ব বাস্তবতাও যে এর লক্ষ্য ছিল তা বলা যায় না। গল্পটি যেভাবে বলতে ভালো লেগেছে সেভাবেই বলা। আমার অন্যসব নাটকের মতো এ নাটকেও পুরাণ আছে। অথচ নিশ্চিত যে অনামা মৃত্যুকে আমি পৌরাণিকতার ছলে ব্যাখ্যা করেছি। চাকার গল্পটি গল্পই। নাটকটি কেউ যদি ঘটে গেছে এমন একটা ঘটনার ব্যাখ্যা বলেও মনে করেন আপত্তি করব না।’

চাকা নাটকের কাহিনি বলার ক্ষেত্রে দুর্দান্ত নিরীক্ষা করেছিলেন সৈয়দ জামিল আহমেদ। ঢাকার নাটকের দর্শকের কাছে সে স্মৃতি এখনো জ্বলজ্বল করে। সেই প্রযোজনার প্রায় একুশ-বাইশ বছর পরে ঢাকার দর্শকরা আরো একবার বিস্মিত হলো আরো একটি চাকা প্রযোজনা দেখে। এবারের চাকার কারিগর সৈয়দ জামিল আহমেদেরই সুযোগ্য ছাত্র এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের নাট্যকলা বিভাগের তরুণ শিক্ষক সুদীপ চক্রবর্তী। সুদীপের কাজ বরাবরই দর্শকদের প্রশংসা অর্জন করে। যখন জানা গেল সুদীপ চাকা নাটকটি তাঁর বিভাগের ছাত্রছাত্রীদের নিয়ে নির্মাণ করতে যাচ্ছেন তখন অনেক দর্শকের মাঝেই এক ধরনের উত্তেজনা ও শঙ্কা কাজ করছিল। কিন্তু গত ১৭ আগস্ট সন্ধ্যায় সেলিম আল দীন উৎসবে বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমীর মূল মিলনায়তনে চাকা নাটকের উদ্বোধনী মঞ্চায়নের মধ্য দিয়ে দর্শকদের শঙ্কা উধাও হয়ে যায়। বয়সস্বল্পতার কারণে কুশীলবদের, সম্ভবত নির্দেশক সুদীপ চক্রবর্তীরও সৈয়দ জামিল আহমেদের চাকা দেখার সৌভাগ্য হয়নি। সেই চাকা দেখা থাকলে হয়তো প্রভাবিত হয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা থাকত, নয়তো সেই ডিজাইন থেকে সচেতনভাবে দূরে থাকতে গিয়ে অন্যকিছু হতে পারত। সুদীপের চাকায় সেসব কিছুই হয়নি। তিনি যা নির্মাণ করেছেন তাতে নিশ্চিতভাবে রয়েছে স্বাতন্ত্র্য। রয়েছে তাঁর মেধার ছাপ আর সেলিম আল দীনের রচনার বিশ্বস্ত মঞ্চানুগ প্রয়োগ। চাকা নাটকের আখ্যানে রয়েছে গরুর গাড়িতে করে ভুল ঠিকানায় একটি লাশের এগিয়ে চলা। সুদীপ চক্রবর্তী চমৎকারভাবে চক্রাকার একটি স্পেসের ব্যবহার করেছেন চাকা নাটকের অভিনয়ের জন্য। কাহিনি যেন এগিয়ে চলে চাকার পরিভ্রমণের সঙ্গে। চাকা কথানাট্যের এক নির্মেদ মঞ্চরূপ উপহার দিলেন সুদীপ চক্রবর্তী। পুঙ্খানুপুঙ্খ নাট্যঘটনা, ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া ও মিথস্ক্রিয়ায় অভিনয়শিল্পীরা দর্শকদের সামনে উপস্থাপন করেন এক অসাধারণ প্রযোজনা। চাকা নাটকে এক অনামা শব যেমন ঘটনার কেন্দ্রবিন্দুতে অবস্থান নিয়ে এগিয়ে চলে নানা প্রান্তরে, তেমনি চলনে কুকুর, মাছি, মৌমাছিসহ আরো অনেক কিছুই অনুবর্তী চরিত্রের অংশ হয়ে যায়। এ নাটকে অভিনয় করেছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের নাট্যকলা বিভাগের স্নাতকোত্তর পর্বের শিক্ষার্থীরা। টোটাল টিমওয়ার্ক দেখলে বিস্ময়ে অভিভূত না হয়ে পারা যায় না। নির্দেশক যেন নিপুণ হাতে সেলাই করেছেন এক অনন্যসাধারণ নকশিকাঁথা। যেখানে রঙের আধিক্য কিংবা ঘাটতি নেই। নেই ফোঁড়ের কোনো তারতম্য কিংবা ত্রুটিবিচ্যুতি।

এ প্রযোজনায় যাঁরা অভিনয় করেছেন তাঁরা সকলেই চমৎকার অভিনয় করেছেন। তবে পৌঢ়ের চরিত্রে নুসরাত শারমিন, বাহের গাড়োয়ানের চরিত্রে মাহ্জাবীন ইসলাম এবং ধরমরাজ চরিত্রে খান মোঃ রফিকুল ইসলাম অসাধারণ অভিনয় করেছেন। কথকত্রয় মেহেদী তানজীর, সৈয়দা ইফাত আরা ও লাবনী আকতারও চমৎকার করেছেন। সবার নাম উল্লেখ করা সম্ভব নয়, তবে এ নাটকের সকল কুশীলবই ধন্যবাদ ও প্রশংসা পাওয়ার মতো কাজ দেখিয়েছেন দর্শকদের। এ নাটকের মঞ্চ পরিকল্পনা নিরাভরণ অথচ বুদ্ধিদীপ্ত ও মার্জিত। আলোক পরিকল্পনাও চমৎকার। মঞ্চ ও আলোক পরিকল্পনার ক্ষেত্রে সুদীপ চক্রবর্তী তাঁর মেধার দ্যুতি ছড়াতে সমর্থ হয়েছেন। পোশাক পরিকল্পনা, রূপসজ্জা ও সংগীত পরিকল্পনায় ছিলেন যথাক্রমে ওয়াহিদা মল্লিক জলি, রহমত আলী ও নীলা সাহা। তাঁরাও স্ব স্ব ক্ষেত্রে নিজেদের সাফল্য দেখাতে সমর্থ হয়েছেন। ইংরেজিতে এ টু জেড বলে যে ব্যাপারটি আছে এ নাটকের ক্ষেত্রে তা সফলভাবে উপস্থাপিত হয়েছে। দুজন নির্দেশকের কাজের মাঝে তুলনা করা চলে না। দুটি কাজই চমৎকার। তারপরও মনের মাঝে দুটি ভিন্ন ধরনের অনুভূতি তৈরি হয় দুটি প্রযোজনার ক্ষেত্রে। সৈয়দ জামিল আহমেদের চাকা আমাদের অভিভূত করেছিল। আর সুদীপের চাকা আমাদের বিস্মিত করেছে, একটা ঘোরে ফেলে দিয়েছে। এই ঘোর থেকে সুদীপই হয়তো আবার টেনে নিয়ে দর্শকদের পৌঁছে দেবেন নতুন আরেক বিস্ময়ের জগতে, নতুন কোনো ঘোরে। সুদীপ তেমনই পটীয়ান নির্দেশক।