হা স না ত আ ব দু ল হা ই
সিনেমার লিখিত ভাষা আছে, ব্যতিক্রমী কেউ কেউ এই ভাষা পরিহার করলেও অধিকাংশ চিত্রনির্মাতা এর ব্যবহার করে থাকেন। কেউ ব্যবহার করুন আর নাই করুন, লিখিত ভাষা নিয়েই চলচ্চিত্র নির্মাণের যাত্রা শুরু করতে হয়। এই লিখিত ভাষার দুটি রূপ আছে, একটিতে রয়েছে কাহিনি ও দৃশ্য বর্ণনা, যেমন গল্প বা উপন্যাসে। দ্বিতীয়টিতে থাকে কাহিনিকে চিত্রায়িত করার জন্য ধারাবাহিক নির্দেশিকা। এই দ্বিতীয়টিকেই বলা হয় সিনেমার লিখিত ভাষা; বাংলায় চিত্র-নাট্য এবং ইংরেজিতে ফিল্ম-স্ক্রিপ্ট। গল্প বা উপন্যাস ছাড়াও অবশ্য অন্য রচনার ভিত্তিতে চিত্র-নাট্য লেখা হতে পারে যেমন, নাটক। বলা বাহুল্য, নাটকের যে মঞ্চভিত্তিক সীমাবদ্ধতা সিনেমার জন্য তৈরি চিত্র-নাট্যে তার বেশ পরিবর্তন ঘটে, বিশেষ করে বহির্দৃশ্যের সংযোজনে।
ইংরেজি ফিল্ম-স্ক্রিপ্টের তুলনায় বাংলা চিত্র-নাট্য শব্দটি বেশ বিশদ এবং স্বয়ংব্যাখ্যিক। এই শব্দের প্রথমটি (চিত্র) দ্বারা বোঝানো হয়েছে সিনেমায় ইমেজের প্রাধান্য। কিন্তু শুধু চিত্র বা রূপ অর্থাৎ ইমেজ থাকলেই সিনেমা তৈরি সম্পূর্ণ হবে না, এর জন্য প্রয়োজন নাটকীয় উপাদান, যেমন সংলাপ, শব্দ, আলোকসম্পাত, গতিময়তা, মঞ্চসজ্জা, দৃষ্টিকোণ ইত্যাদি। এই সব উপাদান বোঝানোর জন্যই ‘চিত্রের’ পরে যুক্ত হয়েছে ‘নাট্য’ কথাটি। শুধু ‘নাট্য’ বললে বিষয়টির অর্থ ভিন্ন হতো, নাটকের চরিত্র পেয়ে যেত। কিন্তু যখন চিত্রের বা ইমেজের সঙ্গে যুক্ত হয় তখন কেবল চিত্র বা ইমেজ নয়, কিংবা নাটকীয় উপাদানও নয়, সার্বিকভাবে চলচ্চিত্রের রূপটি স্পষ্ট হয়ে ওঠে। এভাবেই চিত্র-নাট্য সিনেমার নিজের ভাষা, লিখিত ভাষা হয়েছে।
ইংরেজি ফিল্ম-স্ক্রিপ্টে চিত্র-নাট্যের মতো স্বয়ংব্যাখ্যিক প্রাঞ্জলতা নেই। তবে তার আভাস রয়েছে। ইংরেজি ফিল্ম বলতে সার্বিকভাবে নির্মিত সিনেমা বোঝানো যায়, আবার এর অন্তর্গত অংশগুলির ওপরও দৃষ্টি দেওয়া হয়। এই শব্দটিতে চলচ্চিত্রের অন্তর্গত সব উপাদানই উপস্থিত, কিন্তু অনড়-অচল অবস্থায়। তাদের মধ্যে প্রাণ সঞ্চারের পর অর্থবহ করে যে নির্দেশিকা তাকেই বলা হয়েছে ‘স্ক্রিপ্ট’ বা ‘রচনা’। সম্পূর্ণ ফিল্মকে ধারণ করে তার নির্মাণে ধাপে ধাপে অগ্রসর হওয়ার জন্য নির্দেশিকা থাকে স্ক্রিপ্টে। শুধু স্ক্রিপ্ট বলা হলে অনেক কিছু বোঝানো হতো, যেমন কবিতার, গল্পের কিংবা উপন্যাসের খসড়া। ‘ফিল্মে’র সঙ্গে যুক্ত হয়ে ‘স্ক্রিপ্টে’র অর্থ ব্যাপক থেকে বিশেষে সীমাবদ্ধ হয়েছে এবং এর উদ্দেশ্য স্পষ্ট হয়ে দাঁড়িয়েছে। এই দিক দিয়ে বাংলা চিত্র-নাট্য আর ইংরেজি ফিল্ম-স্ক্রিপ্টে খুব একটা তফাৎ নেই।
চিত্র-নাট্য লেখা বিভিন্ন ব্যক্তির দ্বারা হতে পারে। গল্পকার বা ঔপন্যাসিক নিজেরাই চিত্র-নাট্য লিখে সাহায্য করেন চিত্রনির্মাতাকে। এর ফলে শুধু চিত্রনির্মাতার কাজ সহজ হয় না, লেখকের লেখার মূল বৈশিষ্ট্যও অক্ষুণœ থাকার সুযোগ থাকে। চিত্র-নাট্য লেখার জন্য পেশাদার লেখক থাকেন, তাঁরাও এই দায়িত্ব পালন করেন, অবশ্যই পারিশ্রমিকের বিনিময়ে। হলিউডের বড় বড় স্টুডিও পেশাদার চিত্র-নাট্যকারদের দিয়েই চিত্র-নাট্য লিখিয়ে থাকে। আবার পরিচালকদের মধ্যে কেউ কেউ নিজেরাই চিত্র-নাট্য রচনা করেন বা করতেন। যেমন – সত্যজিৎ রায়, মৃণাল সেন, জহির রায়হান, ফ্রেদারিকো ফেলেনি, রবার্ট অল্টম্যান, ত্র“ফো, ইঙ্গেমার বার্গম্যান, বুন্যুয়েল প্রমুখ। অতঁর পরিচালকদের ক্ষেত্রেই এই বিষয়টি বিশেষ করে এবং বেশিরভাগ দেখা যায়। পরিচালকদের কেউ কেউ চিত্র-নাট্য এমন বিশদভাবে লেখেন বা আঁকেন যে ক্যামেরাম্যান বা অভিনেতা-অভিনেত্রীদের বিশেষ কিছু করতে হয় না, কেবল চিত্র-নাট্য অনুসরণ ছাড়া। সত্যজিৎ রায়, আইজেনস্টাইন এই শ্রেণির পরিচালক-চিত্র-নাট্যকার ছিলেন। তাঁরা কিছুই অন্যের কল্পনার ওপর ছেড়ে দিতেন না। তাঁদের উদ্দেশ্য ও লক্ষ্য নিয়েই তাঁরা লিখতেন চিত্র-নাট্য এবং সেই জন্য নির্বাচিত বিষয় আর চিত্রায়িত সিনেমার মধ্যে কোনো তফাৎ থাকতো না তাঁদের ক্ষেত্রে। আবার কোনো কোনো পরিচালক আছেন বা ছিলেন যাঁরা আদপেই চিত্র-নাট্যের সাহায্য নিতে আগ্রহী ছিলেন না বা নন। কেন্দ্রীয় বিষয়ের বিবর্তনে এবং চরিত্রগুলির স্বতঃস্ফূর্ত আচরণে সিনেমার চিত্রায়ণ নিজের গতিতেই অগ্রসর হবে, এই হলো তাঁদের বিশ্বাস। এখানে সিনেমাকে চিত্র-নাট্যের শৃঙ্খলে বেঁধে রাখা হয় না, তাকে মুক্ত করে দিয়ে কাহিনির পরিণতি মনে রেখে অগ্রসর হতে দেওয়া হয়। এমন পরিচালকের সংখ্যা অবশ্য খুব বেশি নয়। আভাঁ গার্দ-শ্রেণির সিনেমা পরিচালকরা এভাবেই তাঁদের চিত্র নির্মাণ করেছেন অধিকাংশ ক্ষেত্রে। বলা বাহুল্য, এমনভাবে তৈরি ছবিতে সবারই অংশগ্রহণ থাকে, পরিচালক মহামহিম কর্তৃপক্ষের সার্বভৌম ভূমিকা পালন করেন না।
চিত্র-নাট্যকে সিনেমার নান্দনিকতা সৃষ্টিতে কোন অর্থে প্রাসঙ্গিক, গুরুত্বপূর্ণ অথবা কার্যকর বলে মনে করা যায়? এ প্রশ্ন নিয়ে এখন অগ্রসর হওয়া যেতে পারে। চিত্র-নাট্য যাঁরাই লিখুন, যেভাবেই লিখুন (আংশিক, সম্পূর্ণ অথবা ইঙ্গিতসর্বস্ব) তাঁদেরকে সিনেমার নান্দনিকতার কথা মনে রাখতে হবে। যাঁরা নির্জলা বাণিজ্যিক ছবি তৈরি করেন তাঁদের কাছে
চিত্র-নাট্যের এই দায়বদ্ধতা অতটা প্রবল বা প্রত্যক্ষ নয়। বিনোদনমূলক সিনেমায় চিত্র-নাট্য বাণিজ্যিক ফর্মুলা অনুসারেই রচিত হবে, এটাই স্বাভাবিক। তবু এখানে কতগুলি ন্যূনতম শর্ত মেনে চলার দায়িত্ব আরোপিত হতে পারে। যেমন, বিনোদনমূলক সিনেমার চিত্র-নাট্যে ভায়োলেন্স, যৌন আবেদনময় দৃশ্য এবং সামাজিক মূল্যবোধের অবক্ষয় ঘটে এমন ধ্যান-ধারণা প্রাধান্য দেওয়া হলে বাণিজ্যিক সিনেমা শুধু নিম্ন রুচির নয়, সমাজের জন্য হবে চরম ক্ষতিকর। বাণিজ্যিক সিনেমার
চিত্র-নাট্য রচনাতেও তাই একটা সীমারেখা নির্দিষ্ট করে দেওয়া উচিত। এর ফলে বাণিজ্যিক সিনেমা শিল্পের দিক দিয়ে নান্দনিকতা গুণসম্পন্ন না হলেও রুচিশীল ও বাস্তবানুগ হওয়ার সুযোগ পাবে এবং সেই কারণে সমর্থনযোগ্য হবে। এই সব ছবি দেখে যারা অভ্যস্ত হবে সেই সব দর্শক হয়তো একদিন নান্দনিক গুণসম্পন্ন ছবি বলতে যা বোঝানো হচ্ছে তার প্রতি আগ্রহী না হলেও অন্তত কৌতূহলী হবে। নির্মিত সিনেমা দেখার আগেই সেন্সর বোর্ড চিত্র-নাট্য পরীক্ষা করে দেখতে চাইলে চিত্র-নাট্যের শিল্পগুণ এবং রুচিবোধ এবং বাস্তবানুগতা সম্পর্কে অবহিত হয়ে প্রয়োজনীয় নির্দেশ দিতে পারবে। অবশ্য চিত্রনির্মাতারা যে সংশোধিত চিত্র-নাট্য অনুযায়ী সিনেমা তৈরি করবেন তার কোনো নিশ্চয়তা নেই। এর জন্য প্রয়োজন হবে সিনেমা হলে আকস্মিক পরিদর্শন এবং শর্তাবলি লঙ্ঘনের জন্য জরিমানা আদায়। সেন্সর বোর্ড যেন অযৌক্তিকভাবে তার ক্ষমতা ব্যবহার না করে সেদিকেও দৃষ্টি রাখতে হবে।
বাণিজ্যিক সিনেমার প্রযোজক ও পরিচালকরা বলতে পারেন যৌনাবেদনময় নাচ-গানের দৃশ্য ও ভায়োলেন্স দেখিয়েও দর্শকদের বর্তমানে সিনেমা হলে টেনে আনা যাচ্ছে না, কেননা সমস্ত দেশে ছয়লাপ হয়ে যাওয়া ডিভিডির কল্যাণে এখন সব ধরনের সিনেমাই দেখার সুযোগ হয়েছে। এই সমস্যা নান্দনিক গুণসম্পন্ন সিনেমা তৈরির ক্ষেত্রে তো বটেই, ন্যূনতম রুচিসম্পন্ন বাণিজ্যিক ধারার সিনেমা তৈরির ক্ষেত্রে প্রকট সমস্যা হয়ে দেখা দিয়েছে, এ কথা স্বীকার না করে উপায় নেই। সুলভে ডিভিডি এবং পাইরেটেড ফিল্মের সহজলভ্যতার ফলে শহরের অলিতে-গলিতে তো বটেই, গ্রামে-গঞ্জেও এখন রুচিহীন সিনেমা দেখা যাচ্ছে। আইন করে, আকস্মিক পরিদর্শনের মাধ্যমে কদর্য সিনেমার এই আগ্রাসন বন্ধ করা সম্ভব হবে না। এর জন্য সেন্সর বোর্ডকে রুচিসম্পন্ন নাচ-গান এবং খুনোখুনি ব্যতিরেকে পুরনো দিনের মতো হাত-পা ব্যবহার করে মারপিটের দৃশ্যের অনুমোদন দিতে হতে পারে। কুংফু বা জুজ্যুৎসু ব্যবহার রক্তাক্ত ভায়োলেন্সের বিকল্প হতে পারে।
এই লেখার উদ্দেশ্য ব্যাপকভাবে সকল শ্রেণির সিনেমায় নান্দনিক গুণ অর্জন নয়, ধ্র“পদী ধরনের সিনেমায় এর চর্চা নিয়মিতকরণের জন্য আবেদন ও প্রস্তাব রাখা। আগেই বলা হয়েছে, নান্দনিক গুণসম্পন্ন ধ্র“পদী শ্রেণির সিনেমা সবাই দেখবে না, বিদগ্ধ রুচির সিনেমাভক্তদের জন্যই এ সব তৈরি করতে হবে। বিদগ্ধ রুচির সিনেমা দর্শকরাও যে নান্দনিকতা গুণসম্পন্ন সিনেমা দেখতে পাচ্ছেন না সেই কারণেই বিষয়টির অবতারণা এবং আলোচনা করা হয়েছে। কোনো শিল্পই যেমন তার শেকড় বা শাখা-প্রশাখা থেকে বিচ্ছিন্ন নয় কিংবা তেমন থেকে স্বস্তির নিশ্বাস ফেলতে পারে না সেই যুক্তিতে নান্দনিক গুণসম্পন্ন সিনেমার আলোচনার পাশাপাশি অন্য ধারার সিনেমারও উল্লেখ করতে হলো। তা না হলে বর্ণবাদের মতো সিনেমা শুধু দ্বিধাবিভক্ত নয়, তিনটি শ্রেণিতে বিভক্ত হয়ে পড়বে (বলা যায় এখনই হয়ে পড়েছে) : (ক) নান্দনিকতা গুণসম্পন্ন সিনেমা, (খ) নান্দনিকতা গুণসম্পন্ন নয় কিন্তু মোটামুটি রুচিশীল সুস্থ মূল্যবোধসম্পন্ন সিনেমা, (গ) রুচিহীন বাণিজ্যিক সিনেমা। নান্দনিকতা গুণসম্পন্ন সিনেমা অবশ্যই তার নিজ ক্ষেত্রের কথা বেশি করে ভাববে এবং তার চর্চা করবে। কিন্তু সেই সঙ্গে তাকে অন্য ধারার সিনেমার কথাও মনে রাখতে হবে এবং তাদের উৎকর্ষ সাধনের জন্য কিছুটা হলেও ভাবতে হবে।
এই অধ্যায়ের মূল আলোচনার বিষয় থেকে বেশ কিছুটা সরে আসার পর এখন তার প্রতি দৃষ্টিপাত এবং সে সম্বন্ধে আলোচনা করা যায়। স্মরণ করিয়ে দেওয়া যায় যে, আমাদের উদ্দেশ্য সিনেমার নান্দনিকতা এবং এই অধ্যায়ে সেই প্রসঙ্গে চিত্র-নাট্যের ভূমিকা ও করণীয় সম্পর্কে আলোচনা।
অতি উৎসাহীদের কথা বাদ দেওয়া হলে পূর্ণাঙ্গ চিত্র-নাট্য দর্শক পড়ে না। অবশ্য চিত্র-নাট্যকে এখন সাহিত্যের অন্যতম শাখা হিসেবে মর্যাদা দেওয়া হচ্ছে; অন্তত ফিল্ম স্টাডিজে। পূর্ণাঙ্গ চিত্র-নাট্য পরিচালক প্রথম থেকে শেষ পর্যন্ত পড়েন, তাঁকে পড়তে হয়। চিত্র-নাট্য তাঁকে সিনেমা নির্মাণে সাহায্য করে যেমন একজন স্থপতিকে ভবন নির্মাণে সাহায্য করে ব্লু প্রিন্ট। ব্লু প্রিন্টের মতোই চিত্র-নাট্যের বিভিন্ন অংশ সিনেমা তৈরির সঙ্গে জড়িত প্রত্যেককেই কম-বেশি পড়তে হয় এবং মনে রাখতে হয়। পরিচালকের জন্য চিত্র-নাট্য একটি সম্পূর্ণ নির্দেশিকা আর সিনেমার অন্যান্য কুশীলবের (অভিনেতা, ক্যামেরাম্যান, লাইটম্যান প্রমুখ) জন্য একে বলা যায় আংশিক নির্দেশনা। এই সব আংশিক নির্দেশনার ভিত্তিতেই সম্পূর্ণ হয় পূর্ণাঙ্গ নির্দেশনা এবং তার অনুসরণে নির্মিত হয় সম্পূর্ণ সিনেমা। একজন পরিচালক যখন নান্দনিক গুণসম্পন্ন সিনেমা তৈরি করতে চান তখন তাঁকে সেই বৈশিষ্ট্য অক্ষুণœ রাখার জন্য অনুকূল ও সহায়তাকারী নির্দেশনাই রাখতে হবে চিত্র-নাট্যে। এটা করতে হবে খুব সচেতনভাবেই, কারো কল্পনার ওপর নির্ভরশীল হয়ে নয়। এ ক্ষেত্রে অতঁর সিনেমা পরিচালক আর নান্দনিকতা গুণসম্পন্ন চলচ্চিত্র নির্মাতা প্রায় সমার্থক। এর অর্থ এই নয় যে সিনেমা তৈরিতে যারা অংশ নিচ্ছে তারা যন্ত্রচালিতের মতো চিত্র-নাট্যের নির্দেশনা অনুযায়ী কাজ করে যাবে, নিজের উদ্যোগ বা কল্পনা ব্যবহার একেবারেই করবে না। যেমন, চিত্র-নাট্যে লেখা থাকতে পারে ‘ভোরের আলো ফুটে উঠেছে’। ভোরের আলোর নানা মাত্রা আছে : খুব হালকা, ধূসর অথবা আবছা সাদা। এর মধ্যে ক্যামেরাম্যান বা লাইটম্যান কোন মাত্রাটি বেছে নেবে? পরিচালকের নির্দেশনা ছাড়াই তারা আলোর এই মাত্রা বেছে নিতে পারে কয়েকটি বিষয়ের ওপর নির্ভর করে। যেমন, কোথায় ভোর হচ্ছে, কোন ঘটনার পর ভোর হচ্ছে, কে বা কারা এই ভোরের আলো দেখছে। আবার চিত্র-নাট্যে যে কাহিনি বা ঘটনা ভোরের আলো ফোটার আগে বর্ণিত হয়েছে তার ভিত্তিতে আলোর মাত্রা নির্ধারিত হতে পারে। অথবা একটি চরিত্রকে বিষণ্ন মনে জানালার ধারে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখানো যেতে পারে কোনো দৃশ্যে। বিষণ্নতারও নানা গভীরতা আছে। চরিত্রটি কোন ধরনের গভীরতা বেছে নেবে? এই সিদ্ধান্ত সে বিষণ্ন হওয়ার আগের মুহূর্তে যে ঘটনা ঘটেছে, যে মুহূর্তে তার সেই ঘটনার অভিজ্ঞতা হয়েছে, তার সঙ্গে অন্য যে চরিত্রের ভাবের আদান-প্রদান হয়েছে, স্থান এবং কাল ইত্যাদির ভিত্তিতে চরিত্রটির বিষণ্নতার মাত্রা নির্ধারিত হতে পারে। এই সিদ্ধান্ত চরিত্রটি নিজেই নিতে সমর্থ, পরিচালকের ইঙ্গিত বা নির্দেশনা ছাড়াই। তবে পরিশ্রমী পরিচালক নিজে না দিয়ে তৃপ্তি পাবেন না।
ওপরে নির্বাক অভিব্যক্তির দুটি দৃষ্টান্ত দেওয়া হলো। এরপর সবাক দৃশ্যের কথা বলা যায়। ধরা যাক নায়ক-নায়িকার মধ্যে মনোমালিন্য হয়েছে কোনো কিছু নিয়ে। এর আগে ও পরে তাদের মধ্যে সংলাপ হয়েছে। এই সংলাপ বিশদ হলে নাটকের মতো শোনাবে, অপরদিকে স্বল্প ও সীমিত হলে নান্দনিকতার শর্ত পূরণ করবে। চিত্র-নাট্যে এই সংলাপ সংক্ষিপ্তভাবে নির্দিষ্ট করে দেওয়া যেতে পারে। অথবা আভা গাঁর্দ সিনেমা হলে নায়ক-নায়িকা সেই পরিস্থিতিতে সংক্ষেপে যা বলা সংগত পরিচালক তাই বলার জন্য নির্দেশ/উপদেশ দিতে পারেন। মুখের যত কথা নির্বাক হয়ে মুখের অভিব্যক্তি দিয়েই ব্যক্ত করা যাবে নান্দনিকতার শর্ত সেই পরিমাণে পূরণ হবে।
চিত্র-নাট্যে কেবল সংলাপ, আলোকসম্পাত বা মুখের অভিব্যক্তি সম্পর্কে উল্লেখ থাকে না। কোন দৃশ্যের জন্য কোন ফ্রেম ব্যবহার করা হবে, ক্যামেরার শট কখন লং হবে আর কখন মিডল হবে ক্লোজ-আপ অথবা ক্যামেরা প্যান করবে দৃশ্যটিকে এক পাশ থেকে অন্য পাশে ধারণ করার জন্য এই সবের ওপরও ছবির নান্দনিক গুণ নির্ভর করে। ক্যামেরা ওপর থেকে অ্যাঙ্গেল করে শট নেবে না নিচে থেকে অথবা সমান্তরাল হয়ে এর ওপরও ছবির উৎকর্ষ নির্ভর করে। এই উৎকর্ষ কেবল নতুনত্ব বা চমক সৃষ্টির জন্য না, বিষয়কে প্রাণবন্ত ও অর্থময় করে তোলার জন্যও সহায়ক। নান্দনিক গুণসম্পন্ন সিনেমা তৈরিতে চরিত্রের মুখের অভিব্যক্তির পরই গুরুত্বে প্রধান ক্যামেরার এই সব কাজ। অবশ্য মুখের অভিব্যক্তি কিংবা কোনো দৃশ্যও ক্যামেরাই ধারণ করে বলে সেসব তার সৃষ্টি। সেই জন্য নান্দনিক গুণের বিচারে ক্যামেরা ওয়ার্কের বিশদ আলোচনা প্রাসঙ্গিক। এটা অন্য অধ্যায়ে করা হবে।
সিনেমা কোনো ভাষা নয়, যেমন ভাষা বাংলা, ফরাসি কিংবা ইংরেজি। কিন্তু ভাষা না হলেও এর নিগূঢ় রহস্য সহজেই ধরা পড়ে না। যে যত বেশি সিনেমার ভাষা উপলব্ধি করতে পারে তার কাছে এর অর্থ ততই বেশি প্রাঞ্জল। আবার যেখানে একাধিক অর্থ নিহিত রয়েছে কোনো দৃশ্যে সেই সব ক্ষেত্রে সিনেমার প্রধান বাহন সচল ক্যামেরার কৌশলগত ব্যবহার সম্বন্ধে জ্ঞান বা পরিচিতি বেশ সহায়ক হয়। সিনেমাকে যদি তুলনা করা হয় ভাষার সঙ্গে, ক্যামেরা হবে তার লেখনী বা কলম এবং তার সৃষ্ট দৃশ্যাবলি হবে (শট) তার বর্ণমালা।
ক্যামেরার ব্যবহারই চলচ্চিত্র নির্মাণে প্রধান কৌশল বা উপকরণ হওয়ার জন্য এর প্রতি গুরুত্ব দিতে হয় সবচেয়ে বেশি। সিনেমার কাহিনি বর্ণনায় যে দুটি উপায় রয়েছে তার মধ্যে ক্যামেরায় ধারণকৃত ইমেজ একটি এবং দ্বিতীয়টি হলো সাউন্ড ট্রাকে গৃহীত শব্দ। প্রথম পর্বে সাউন্ড ছিল না তখন শুধু ক্যামেরা দিয়েই ছবি তৈরি হয়েছে, প্রয়োজনে লিখিত টাইটেল ব্যবহার করে। সেই সময় চরিত্রের মুখের অভিব্যক্তি ছিল ভাব প্রকাশের এবং বক্তব্য রাখার প্রধান উপায়। সাউন্ড আবিষ্কারের ফলে সেই সীমাবদ্ধতা চলে গেলেও সিনেমার নান্দনিকতা নির্ধারণে ও প্রকাশে ইমেজের ভূমিকাই প্রধান হয়ে থাকলো, কেননা সেটিই তার মৌলিক ভাষা। এই রচনার আলোচনায় এ কথাই বার বার জোর দিয়ে বলা হয়েছে। সুতরাং চিত্র-নাট্য রচনা করতে গিয়ে শব্দ, আলোকসম্পাত, মঞ্চসজ্জা, পোশাক, লোকেশন ইত্যাদির ওপর স্থান দিতে হবে ইমেজকে, যা ক্যামেরা ধারণ করে। ক্যামেরাকে মনে করতে হবে যে এখনো যেন নির্বাক যুগের মতো প্রকাশের অর্থাৎ ন্যারেটিভের দায়িত্ব তার ওপরেই রয়েছে। মঞ্চসজ্জা, বহির্দৃশ্য, চরিত্রের পোশাক, সংলাপ, আলোকসম্পাত, রঙের ব্যবহার – এই সব উপকরণের ব্যবহার এমনভাবে করার উল্লেখ থাকতে হবে চিত্র-নাট্যে যেন ভাব প্রকাশে কিংবা বক্তব্য পরিবেশনায় ইমেজ সৃষ্টিই প্রাধান্য পায় সবার ওপর। সিনেমায় নান্দনিকতা অর্জনের বা সেই গুণ যুক্ত করার জন্য এটা অপরিহার্য।
ইমেজ বলতে শুধু চরিত্রের মুখচ্ছবি নয়, জড়বস্তুর রূপও সেখানে অন্তর্ভুক্ত। যেমন, একটি বিশেষ অনুভূতি প্রকাশের জন্য উপযোগী একটি মঞ্চসজ্জাই থাকতে পারে অথবা চরিত্রের পোশাক। একই কথা বলা চলে বহির্দৃশ্যের নির্বাচনে। যে-কোনো লোকেশনে একটি ভাব প্রকাশের বা বক্তব্য রাখার প্রয়োজন পূরণ করা যায় না। চিত্র-নাট্য লিখতে গিয়ে এ কথা মনে রাখতে হবে। নান্দনিকতার দৃষ্টিকোণ থেকে লোকেশন নির্বাচন হতে হবে কাহিনি বর্ণনার সম্পূরক। আবহসংগীত কিংবা শব্দ যেন কাহিনি বর্ণনার মূল চরিত্রকে ব্যাহত না করে চিত্র-নাট্যকারকে সেদিকেও দৃষ্টি দিতে হবে। রঙের অপ্রয়োজনীয় ব্যবহারে যেন ভাবগম্ভীর অথবা করুণ অভিব্যক্তি প্রকাশের অন্তরায় না হয়, তা নিশ্চিত করাও গুরুত্বপূর্ণ।
নান্দনিকতা সৃষ্টি বা সংযোজনের জন্য চিত্র-নাট্য রচনাকে গতানুগতিক কাহিনি বর্ণনার পথ পরিহার করতে হবে। এইখানে সত্যজিৎ রায়ের কথা স্মরণযোগ্য : ‘হঠাৎ শুনলে মনে হবে যে চিত্র-নাট্যকারের কাজ বুঝি আরো সহজ (সাহিত্যিকের তুলনায়)। কারণ তার হাতে হাতিয়ারের সংখ্যা আরো বেশি কিন্তু আসলে তা নয়, কারণ ছবির ভাষা সব সময় কবির ভাষার মতো স্পষ্ট নয়।’ তিনি অবশ্য সনাতনী দৃষ্টিভঙ্গি থেকেই চিত্র-নাট্য রচনার বিষয়টিকে দেখেছেন এবং তার সপক্ষে এইভাবে বক্তব্য রেখেছেন : ‘কতগুলো ব্যাপার আছে যেখানে
চিত্র-নাট্যকার সংলাপের সাহায্য নিতে বাধ্য। যেমন, সময়, বিশেষ করে ছবির শুরুতে তাকে কিছু জরুরি তথ্য পরিবেশন করতে হয় যার অধিকাংশ সংলাপ ছাড়া সম্ভব নয়।’ এর পর তিনি দৃষ্টান্ত হিসেবে অ্যান্টনিয়নির লা ভেঞ্চুরা ছবির প্রারম্ভিক দৃশ্য ও সংলাপের উদ্ধৃতি দিয়ে লিখেছেন : ‘যে গল্পের প্রধান বিষয়বস্তু হচ্ছে অনেকগুলো মানুষের পরস্পরের সম্পর্ক, সেখানে এই জাতীয় একটা ইনট্রোডাক্শন এবং সেখানে কথার মধ্যে নানান তথ্যের পরিবেশন – এটা করতেই হবে। এছাড়া চিত্র-নাট্যকারের অন্য রাস্তা নেই। কিন্তু এই তথ্য পরিবেশনের মধ্যে আর্ট আছে, যেটা চিত্র-নাট্যকারের আয়ত্তে না থাকলে ছবির গোড়াপত্তন কখনো সুষ্ঠু বা সাবলীলভাবে হতে পারবে না।’ এ কথার মধ্য দিয়ে তিনি চিত্র-নাট্য রচনার সনাতন রীতি অর্থাৎ ইমেজের পাশাপাশি সংলাপ ব্যবহারের অনিবার্যতা স্বীকার করলেও এটি যে মোটা দাগে অতিরঞ্জিতভাবে করা যাবে না, শিল্পিতভাবেই নিষ্পত্তি করতে হবে, তার ওপর জোর দিয়েছেন। আর যে কাহিনির বিষয়বস্তু ‘অনেকগুলো মানুষের পরস্পরের সম্পর্ক’ভিত্তিক নয় সেখানে যে চিত্র-নাট্যকার আরো পরীক্ষাধর্মী ও আধুনিক হবেন তারও ইঙ্গিত রয়েছে এখানে। সংলাপনির্ভর সিনেমা তৈরির ধারায় অন্তর্ভুক্ত হলেও সত্যজিৎ রায় ইমেজের গুরুত্বের কথা ভোলেননি। এর অজস্র দৃষ্টান্ত রয়েছে পথের পাঁচালীতে এবং পরবর্তী সময়ে তৈরি অরণ্যের দিন রাত্রি ছবিতে। এরপর তিনি আরো স্পষ্ট করে বলেছেন : ‘ইমেজও ধ্বনি। ইমেজ এখানে শুধু ছবিই নয়, বাক্সময় ছবি। অর্থাৎ ছবির ছবিত্যেই ছবির শেষ নয়, শুরুও নয়, যেমন শুরুরও শেষ পেইন্টিংয়ে। এখানে মুখ্য হলো ছবির অর্থ। এক একটি ছবি এক একটি বাক্য। সব ছবি মিলিয়ে পুরো বক্তব্য। চলচ্চিত্রের নির্বাক যুগেও ছবি অর্থ বহন করেছে।’ এরপরই তিনি দিয়েছেন তাঁর চরম এবং চূড়ান্ত রায় : ‘এর (সিনেমা) ভাষা সংলাপ নিরপেক্ষ।’ স্পষ্ট করে না বললেও শেষ পর্যন্ত সনাতনী ইমেজ-নির্ভর সিনেমার নান্দনিকতার প্রতি সত্যজিতের দুর্বলতা প্রকাশ পেয়েছে।
সিনেমার বিশুদ্ধবাদীদের কাছে ইমেজের যে প্রতিপক্ষ হয়ে দাঁড়িয়েছে সাউন্ড, সে সম্পর্কেও তাঁর মতামত স্পষ্ট : ‘আর ধ্বনি? ধ্বনি ইমেজেরই পরিপূরক। এক ছাড়া অন্যের অস্তিত্ব নেই। চোখ-কান দুইই সজাগ না রাখলে চলচ্চিত্রের ভাষা বোঝা যায় না। যদি কোনো দৃশ্যে ধ্বনি না থাকে, তবে সে না-থাকাটাই ব্যঞ্জক হয়ে ওঠে। নৈঃশব্দ্যই তার বক্তব্য হয়ে দাঁড়ায়।’ এখানে ইমেজের গুরুত্ব ও তাৎপর্য নিয়ে তাঁর অবস্থান আরো স্পষ্ট। তিনি ধ্বনিকে ইমেজের পরিপূরক বলে তার সহায়তাকারী ভূমিকা স্পষ্ট করেছেন। আবার ধ্বনি না থাকাটাও যে ব্যঞ্জক হয়ে উঠতে পারে সেই সম্ভাবনার উল্লেখও করেছেন। এই সব উক্তি তিনি করেছেন ‘চলচ্চিত্র রচনা : আঙ্গিক, ভাষা ও ভঙ্গি’ প্রবন্ধে অর্থাৎ চিত্র-নাট্য নিয়ে লিখতে গিয়ে। (সূত্র : সত্যজিৎ রায়, বিষয় চলচ্চিত্র, কলকাতা, ১৯৯৭)
চলচ্চিত্র নিয়ে অনেক কাজ করেছেন এমন একজন বাঙালি লেখক প্রাথমিক চিত্র-নাট্য ও চূড়ান্ত চিত্র-নাট্যের ভেতর পার্থক্য করে দেখিয়েছেন : ‘প্রাথমিক চিত্র-নাট্য ঠিক করে দিচ্ছে কি কি দেখানো হবে, আর চূড়ান্ত চিত্র-নাট্যকে ভাবতে হচ্ছে কেমনভাবে দেখানো হবে, না হবে না। প্রথমটি তার মধ্যে সাহিত্যের বিষয় আর দ্বিতীয়টির ক্ষেত্রে ব্যবহার করতে হয় চলচ্চিত্রের ভাষা।’ চিত্র-ভাষাকে চিত্র-নাট্যের ভাষা বলতে গিয়ে সাহিত্যের ভাষার যে প্রাধান্য তার গুরুত্ব কমিয়েছেন তিনি, স্পষ্ট করে না বললেও পরে তিনি বিষয়টির আরো স্পষ্টীকরণ করেছেন এই বলে যে, ‘বিশেষ কোনো চিত্রপ্রতিমা বা চলচ্চিত্রসম্মত টেকনিক বা চিত্র ভাষার সমৃদ্ধ প্রয়োগ অনেক ব্যঞ্জনাময় করে ফুটিয়ে তুলতে পারে কোনো বিশেষ পরিস্থিতি বা বিশেষ মুহূর্তের মানসিকতা।’ এখানে তিনি সিনেমার নান্দনিক সৃষ্টির সম্ভাবনাময় চলচ্চিত্রের ভাষার প্রতি প্রাধান্য দিয়েছেন, যদিও সম্পূর্ণ দ্ব্যর্থহীনভাবে নয়। (ধীমান দাশগুপ্ত, চিত্র-নাট্যের উপাদান ও রীতি, চিত্র-নাট্য রচনা ও বিশ্লেষণ, কলকাতা, ১৯৮৩)।
আধুনিককালে অনেক চলচ্চিত্র নির্মাতা সিনেমা তৈরির আগে চিত্র-নাট্য তৈরি করেন না, কিংবা করেননি। আবার কেউ কেউ খুব সংক্ষিপ্ত আকারে এই কাজটি করেছেন। এর দ্বারা তাঁরা ইমেজ-নির্ভর ছবির প্রতি গুরুত্ব আরোপ করেছেন। কাহিনি বর্ণনায় চরিত্র বা দৃশ্যের কোন অভিব্যক্তি মোক্ষম, তাঁরা সিনেমা তৈরি করার সময়ই তা ভেবে নিয়েছেন। এঁদের সিনেমা নান্দনিকতার গুণে সমৃদ্ধ, কিংবা বলা যায় বৈশিষ্ট্যমণ্ডিত। এঁদের সংখ্যা কম। অধিকাংশ চলচ্চিত্র নির্মাতাই চিত্র-নাট্যের ব্যবহার করেন। তাতে সমালোচনা করার কিছু নেই, এতে সিনেমারও ক্ষতির কারণ হয় না যতক্ষণ পর্যন্ত সিনেমার মৌলিক ভাষা অর্থাৎ সচল ইমেজকে অন্যান্য উপভাষা (সংলাপ, সংগীত, শব্দ) দ্বারা দ্বিতীয় শ্রেণির ভূমিকায় পর্যবসিত করা না হয়।
ভবিষ্যতে চিত্র-নাট্য রচনা গতানুগতিক অর্থাৎ সনাতন পদ্ধতিতেই চলবে, এটা ধরে নেওয়া যায়। কিন্তু এই সব সিনেমা নির্মাতা যদি সিনেমার মৌলিক ভাষায় (সচল দৃশ্যকল্প প্রাধান্য দিয়ে) চিত্র-নাট্য রচনা করেন বা অন্যকে দিয়ে করান (আংশিক, খণ্ডিত অথবা এক্সটেম্পর পদ্ধতি, যাই হোক না কেন) তাহলে সিনেমার নান্দনিকতার যেসব শর্তের উল্লেখ করা হয়েছে বা হবে তার জন্য দুশ্চিন্তার কারণ থাকবে না।
সাধারণভাবে বলতে গেলে চিত্র-নাট্যের রূপরেখা একই, সেখানে একই বিষয় অন্তর্ভুক্ত থাকে। একটি সিনেমা তৈরি করতে হলে কী, কখন, কোন ক্রম অনুসারে কাজ করতে হবে এবং কে কী করবে এসবের নির্দেশনা দেওয়াই চিত্র-নাট্যের ভূমিকা। এই দিক দিয়ে বাণিজ্যিক আর নান্দনিক গুণসম্পন্ন সিনেমার কোনো তফাৎ নেই। পার্থক্য আসে ইমেজের ভূমিকা ও গুরুত্ব নিয়ে। যেহেতু এই আলোচনায় বলা হয়েছে যে সিনেমার মৌলিক ভাষা সচল দৃশ্যকল্প বা মুভিং ইমেজ সেই জন্য চিত্র-নাট্যে যেসব নির্দেশনা থাকবে তা এ ধরনের সিনেমা নির্মাণে অনুকূল ও উপযোগী কি না সেই বিষয়টি গভীরভাবে বিবেচনা করতে হবে। সব পরিচালক ও প্রযোজক এই বিষয়ের প্রতি গুরুত্ব দেবেন এটা আশা করা যায় না। কিন্তু যাঁরা নান্দনিক ধারার সিনেমা তৈরি করবেন তাঁদের পক্ষে এই বিষয়টি ভুলে গেলে চলবে না। শুধু মনে রাখা নয়, সিনেমা নির্মাণের প্রতি ধাপে একে স্মরণ করে কার্যক্রম গ্রহণ করতে হবে।
নান্দনিক সিনেমার নির্মাতা তাঁর সিনেমার জন্য লেখা চিত্র-নাট্য খুব সংক্ষিপ্ত রাখতে পারেন, বাকিটা তিনি শুটিং, এডিটিংয়ের সময় পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে বলে দিতে পারেন সংশ্লিষ্ট সবাইকে। এটা সময় ও পরিশ্রম সাপেক্ষ এবং তাৎক্ষণিকভাবে অনেক সময় সবকিছু মনে নাও থাকতে পারে। সেই জন্য সবচেয়ে সন্তোষজনক পন্থা হলো চিত্র-নাট্যটি নান্দনিক সিনেমা তৈরির উপযোগী করে লেখা বা লিখিয়ে নেওয়া, যা পড়ে
অভিনেতা-অভিনেত্রী, ক্যামেরাম্যান, আলোকসম্পাতকারী সবাই জানতে পারবে তাদের কখন কী করণীয়। এর পরও পরিচালকের দায়িত্ব থেকে যাবে, কেননা চিত্র-নাট্য যত বিশদই হোক সবার পক্ষে তার নির্যাস বুঝে ওঠা সম্ভব হবে না। তারা তার আক্ষরিক অর্থ গ্রহণ করবে কিন্তু বিষয়ের ভাব ধরতে পারবে না।
যেখানে গল্প বা উপন্যাস থেকে চিত্র-নাট্য লেখা হয় সেই ক্ষেত্রে পরিচালকের ভূমিকা আরো বেশি থাকে, কেননা তিনি কাহিনি ও চরিত্রগুলিকে নিজের চিন্তা ও ধারণা অনুযায়ী নির্ধারিত করেন। কাহিনি ও চরিত্রের মূল কাঠামো ঠিকই থাকে কিন্তু এর ব্যাখ্যা দেন তিনি তাঁর উপলব্ধির ভিত্তিতে, যার জন্য লেখকের ও পরিচালকের তৈরি সিনেমা সবসময় এক হয় না। ঋতুপর্ণ ঘোষ রবীন্দ্রনাথের চোখের বালির যে চিত্রায়ণ করেছেন কারো কারো কাছে তা মনঃপূত হয়নি। ঋতুপর্ণ রবীন্দ্রনাথের বা পাঠকের দৃষ্টিতে নয়, নিজের উপলব্ধির ভিত্তিতে ছবিটি তৈরি করেছেন। বুন্যুয়েলের ডায়েরি অফ এ চেম্বারমেইড ছবিটি অক্টাভ মিরাবুঁর লেখা এবং এর প্রথম চলচ্চিত্রায়ণ করেন জাঁ রেনোয়াঁ ১৯৪৫ সালে। বুন্যুয়েল যখন ১৯৬৫ সালে একই বই অবলম্বন করে সিনেমা তৈরি করেন সেখানে বইয়ের লেখা তো বটেই, জাঁ রেনোয়াঁর তৈরি সিনেমার সঙ্গেও বেশ পার্থক্য দেখা যায়। যেমন, বৃদ্ধ চরিত্রের জুতোর প্রতি তীব্র আকর্ষণ, মৃত মেয়েটির শরীরের ওপর দিয়ে শামুকের হেঁটে যাওয়া, এই সব দৃশ্য মূল বই কিংবা রেনোয়াঁর সিনেমায় ছিল না। বুন্যুয়েল তাঁর নিজের ব্যাখ্যা অনুযায়ী এসব দৃশ্য যোগ করেছেন। ব্যাখ্যা দেওয়ার সঙ্গে পরিচালকের সৃজনশীল দৃষ্টিভঙ্গির সম্পর্ক রয়েছে। সুতরাং নান্দনিক গুণসম্পন্ন ছবির চিত্র-নাট্য থেকে শুরু করে তাকে ভিত্তি হিসেবে নিয়ে যে সিনেমা নির্মিত হবে তার পেছনে পরিচালকের সৃজনশীল মনের প্রক্রিয়াই প্রধান ভূমিকা পালন করে থাকে। বর্তমান যুগে যেখানে ডিজিটাল প্রযুক্তিতে স্পেশাল ইফেক্টের ছড়াছড়ি আর বহুল ব্যবহার সেই সময় সনাতন সৃজনশীলতার পরিচয় পাওয়া যায় এমন চিত্র-নাট্য লেখক ও পরিচালকের সংখ্যা যে কম হবে তা বলাই বাহুল্য। তা হোক। তাঁরা যেন তিরোহিত না হন, এটাই হবে বিশুদ্ধ সিনেমা শিল্পের প্রতি অনুরক্ত ভক্তদের কামনা ও প্রার্থনা।
নান্দনিক গুণসম্পন্ন সিনেমাকে বলা যায় অর্ধবিমূর্ত চরিত্রের যার বিমূর্ততা পাঠক/দর্শককেই উপলব্ধি করে নিতে হয় তার জ্ঞান, বুদ্ধি, মনন এবং সৃজনশীল মন দিয়ে। বিমূর্ত/অর্ধবিমূর্ততার সঙ্গে নান্দনিকতার সম্পর্ক আছে বলে এর একটা তাত্ত্বিক বা ধারণাগত ব্যাখ্যা দেওয়া যেতে পারে যা চিত্র-নাট্য লেখায় সহায়ক হবে। খ্রিস্টপূর্ব চতুর্থ শতাব্দীতে সিনেমার প্রথম তাত্ত্বিক ধারণাটি পাওয়া গিয়েছে অ্যারিস্টটলের পোয়েটিক্স গ্রন্থে। বইটিতে যে ধারণা দেওয়া হয়েছে তার ভিত্তিতে শিল্পের মধ্যে (সব ধরনের) বিমূর্ততার মাত্রা সম্বন্ধে মত খুঁজে পাওয়া যায়। অ্যারিস্টটলের মতে শিল্প হলো অনুকরণের প্রকৃষ্ট দৃষ্টান্ত (প্লেটোর মতো অনুকরণের অনুকরণ নয়)। বাস্তবের এই অনুকরণ একটি মাধ্যমের ওপর নির্ভর করে (যেমন, চিত্রকলা, ভাস্কর্য, স্থাপত্য ইত্যাদি) এবং মাধ্যমটি যেভাবে ব্যবহৃত হয় সেই পদ্ধতি এবং পন্থার ওপর। শিল্প যত অনুকরণপ্রিয় হবে ততই এর মধ্যে মূর্ততার গুণ থাকবে। অবশ্য কোনো অবস্থাতেই শিল্প সম্পূর্ণভাবে বাস্তবকে অনুকরণ করবে না।
অ্যারিস্টটেলীয় ধারণা অনুযায়ী মূর্ততা থেকে বিমূর্ততার দিকে শিল্পকর্মগুলিকে তাদের বৈশিষ্ট্য অনুযায়ী শ্রেণিভুক্ত করলে যে বিন্যাস পাওয়া যাবে তার ছক হবে নিচের মতো :
শিল্প হিসেবে পরিগণিত না হলেও ডিজাইন (আসবাব, পোশাক, তৈজসপত্র ইত্যাদি) সারণী-‘ক’-এর বাঁদিকে অবস্থিত। এগুলি বিমূর্ত নয়। এর ডানে রয়েছে স্থাপত্য, ভাস্কর্য, চিত্রকলা, ড্রইং এবং নকশা যা ‘চিত্রময়তার’ বা পিকটোরিয়ালের শ্রেণিভুক্ত এবং সেই হিসেবে সম্পূর্ণ বিমূর্ত নয়, তবে বিমূর্ততার কিছু বৈশিষ্ট্য থাকতে পারে। নাটক ন্যারেটিভ এবং চিত্রময়তা, এই দুইয়ের মধ্যেই পড়ে। গল্প, উপন্যাস এবং প্রবন্ধ বর্ণনা বা ন্যারেটিভের শ্রেণিতে পড়ে যেখানে বিমূর্ততার স্থান রয়েছে। কবিতা মূর্ত এবং বিমূর্ত ন্যারেটিভ, দুইই। সবশেষে ডানে দেখানো হয়েছে সংগীত যার সবটাই বিমূর্ত। নন্দনবিদ ওয়াল্টার প্যাটার অনেক আগেই বলেছিলেন : সব শিল্পই সংগীতের মতো বিমূর্ত হতে চায়।’ যাই হোক, এই সারণীতে ফিল্ম এবং ফটোগ্রাফিকে কোথায় স্থান দেওয়া যেতে পারে, এই প্রশ্ন এখন প্রাসঙ্গিক। এরা শিল্পের এই প্রাচীন শ্রেণিবিন্যাসের পুরো অংশ জুড়েই রয়েছে (ফটোগ্রাফিকে ছবির অর্থাৎ চিত্রময়তার শ্রেণিতে স্থান দিয়ে দুই দিকেই সম্প্রসারিত করা যায়)। ফিল্ম প্রাকটিক্যাল থেকে শুরু করে সংগীতের শ্রেণিতে পৌঁছাতে পারে অর্থাৎ তার মূর্ত এবং বিমূর্ত উভয় বৈশিষ্ট্যই রয়েছে। নাটকের মতো মনে করা হলেও সিনেমা ‘ছবির’ মতো শিল্প যার জন্য মিউজিয়াম আর গ্যালারিতে পুরনো সিনেমা সংরক্ষণ করা হয়। সিনেমার বর্ণনাকারী শক্তিও নাটকের চেয়ে বেশি। সাউন্ডের সঙ্গে যুক্ত হয়ে এবং সুসংগঠিত ছন্দের জন্য একে সংগীতের শ্রেণিতেও ফেলা যায়।
বিমূর্ততার মাপকাঠি দ্বারা শিল্পভিত্তিক সব অভিজ্ঞতাকে বিন্যস্ত করা যায় কিন্তু একে কোনো তত্ত্ব বলা যাবে না, এটি বিধানও নয়। যা স্মরণীয় এবং উল্লেখযোগ্য তা হলো বিমূর্ততার যে বিভিন্ন মাত্রা এই ছক দ্বারা সাজানো হয়েছে (সারণী-‘ক’) এর ভিত্তিতে বিভিন্ন শিল্পকে মূর্ত থেকে বিমূর্ত শ্রেণিতে অন্তর্ভুক্ত করা যেতে পারে। চিত্র-নাট্যের পরিপ্রেক্ষিতে তথা নান্দনিক সিনেমার প্রসঙ্গে এখানে যা স্পষ্ট হয়েছে তা হলো সিনেমা মূর্ত-বিমূর্ত উভয় বৈশিষ্ট্যই ধারণ করতে পারে (তার বিশাল বিস্তার দ্বারা) এবং চিত্র-নাট্যও সেইভাবে উভয় শ্রেণিভুক্ত করে লেখা যায়।
শিল্পকে দ্বিতীয় এবং আধুনিক যে শ্রেণিকরণের মাধ্যমে দেখানো হয়েছে সেখানে, শিল্পী এবং দর্শকের মধ্যকার সম্পর্কের ওপরই জোর দেওয়া হয়েছে বেশি। শৈল্পিক অভিজ্ঞতার এই ত্রিভুজে শিল্প বা ইমেজ থেকে দর্শকের দৃষ্টি সরিয়ে এনে যোগাযোগের মাধ্যমের প্রতি নিবদ্ধ করা হয়েছে। দর্শক এবং শিল্পীর সম্পর্ককে শিল্পী যতটুকু প্রভাবান্বিত করে বিমূর্ততাকে ততটুকুই গুরুত্ব দেওয়া হয়। সৃষ্ট শিল্প নয়, যোগাযোগের মাধ্যমই এখানে প্রাধান্য পায়। এই দৃষ্টিতে দেখলে শিল্পের সঙ্গে যোগাযোগের পদ্ধতি বা মাধ্যম সারণী-‘খ’-এর মতো দেখাবে। উল্লম্ব রেখা শিল্পের অভিজ্ঞতার প্রতিনিধিত্ব করে আর আনুভূমিক রেখা শিল্পকে বর্ণনা করে এবং পরিবেশনার ভূমিকার প্রতি দৃষ্টি আকর্ষণ করে। ছবির প্রতিনিধিত্ব এবং ছবির নমুনা, যা আনুভূমিক অক্ষরেখার ওপরে অবস্থিত, সেসব অধিকার করে স্থান (স্পেস), সময় নয়। সাহিত্য, নৃত্য, সংগীত এবং ফিল্ম রেকর্ডস সময়ের সঙ্গে যুক্ত, স্থানের সঙ্গে নয়। শিল্পে যে বিমূর্ততা বিদ্যমান সারণী-‘ক’ তার মাত্রা সম্বন্ধে পরিচয় দেয় এবং তার পরিচায়ক হয়। শিল্প এবং তার বিষয়বস্তুর মধ্যে যে প্রকৃত সম্পর্ক তার ব্যাখ্যা করে সারণী-‘ক’। কিন্তু সারণী-‘খ’ শিল্পচর্চার যে সমস্ত বিভিন্ন দিক রয়েছে শিল্পীর কাছে তার সরল ব্যাখ্যা দেয় মাত্র। এই সংক্ষিপ্ত ব্যাখ্যা প্রদানের ফলে নান্দনিক ছবির জন্য চিত্র-নাট্য রচনায় সারণী-‘ক’ তুলনামূলকভাবে অনেক বেশি সহায়ক।
অনেকের মতে বাংলা, ইংরেজি অথবা ফরাসির মতো সিনেমার কোনো নির্দিষ্ট ভাষা না থাকার জন্য এর কোনো ব্যাকরণ নেই (এই ব্যাখ্যা এই আলোচনায় মানা হয়নি। প্রথম থেকেই বলা হয়েছে সিনেমার নিজের ভাষা আছে, তা হলো সচল দৃশ্যকল্প।)। এর ফলে সুবিধা যেমন আছে, অসুবিধাও দেখা দিয়েছে বলে তাঁরা মনে করেন। সুবিধা হলো, ইচ্ছেমতো এই ভাষা নিজের প্রয়োজন অনুযায়ী তৈরি করে ব্যবহার করা যায়, যেমন বেশির ভাগ পরিচালক সিনেমার মৌলিক ভাষার কথা না ভেবে সিনেমা তৈরি করতে পারেন যা ব্যাকরণের উদ্ধৃতি দিয়ে ভ্রান্ত বলে কেউ জোর দিয়ে বলতে পারবে না; তারা কেবল অসন্তুষ্টি প্রকাশ করতে পারবে অথবা অতৃপ্ত থাকবে। অসুবিধা হলো, একই মানদণ্ডে সিনেমাকে বিচার বা তার মূল্যায়ন করা সম্ভম হয় না। যেমন, বিনোদন যাদের কাছে গুরুত্বপূর্ণ তারা এ ধরনের সিনেমাকেই পছন্দ করবে এবং সেই কারণে এ ধরনের সিনেমাই বেশি তৈরি হবে। আর এ ধরনের সিনেমা তৈরি তুলনামূলকভাবে সহজ হওয়ায় অধিকাংশ নির্মাতাই এদিকে ঝুঁকবেন। বাণিজ্যিক সফলতা যেহেতু বিনোদনের জন্য নিশ্চিত করা যায় সেই কারণেও এই ধরনের সিনেমা বেশি তৈরি হবে। সাহিত্যের সঙ্গে তুলনা করলে দেখা যাবে ধ্র“পদী ধরনের সাহিত্য গুণসম্পন্ন সাহিত্য সৃষ্টিকে যেমন উঁচু মানসম্পন্ন ও কালজয়ী বলে মনে করা হয় সিনেমার ক্ষেত্রে তেমন ভেদরেখা টানা সম্ভব হয় না। বিনোদনের ছবি, যেমন মাই ফেয়ার লেডি, সাউন্ড অফ মিউজিক, দ্য কিং অ্যান্ড আই ইত্যাদি কেবল বিনোদনের জন্য হলেও কালজয়ী হয়ে গিয়েছে। অপরদিকে হ্যামলেট, ওয়ার অ্যান্ড পিস, ড. জিভাগো, ওয়ান হান্ড্রেড ইয়ার্স সলিচুড, ম্যাজিক মাউন্টেন, কালিন্দী, লালসালু যেমন ধ্র“পদী উপন্যাস অন্য শ্রেণির সাহিত্য সৃষ্টি সেই পর্যায়ে পড়ে না। সাহিত্যে ব্যাকরণ থাকা সত্ত্বেও এমন হয়েছে এবং হচ্ছে। সুতরাং ব্যাকরণ না থাকার জন্য যে সিনেমা খেয়াল-খুশি মতো তৈরি হচ্ছে তা নয়, পরিচালকের ইচ্ছা, প্রবণতা ও সৃজনশীল ক্ষমতার মাত্রাও এখানে ভূমিকা রাখে।
সিনেমার কোনো নির্দিষ্ট ভাষা না থাকলেও (অবশ্য সচল দৃশ্যকল্পকে আমরা সিনেমার নিজস্ব ভাষা বলতে চাই) এটি ভাষার মতো, কেননা এর দ্বারা বক্তব্য এবং অনুভূতি প্রকাশ করা যায়। সম্প্রতিকালে সিনেমার ভাষাতাত্ত্বিক (লিঙ্গুয়িস্টিক) চরিত্র সম্বন্ধে বেশ লেখালেখি হয়েছে। তবে সম্পূর্ণ অর্থে ভাষা না হওয়ায় সিনেমার ভাষার সঙ্গে ভাষায় ব্যবহৃত ধারণার হুবহু প্রয়োগ করা সমীচীন হবে বলে অনেকে মনে করেন না। সিনেমার ভাষাকে ফিল্ম স্টাডিজে প্রথম দিকে মুখের ভাষার সঙ্গে তুলনা করা হয়েছে। কিন্তু বিশ শতকে পঞ্চাশ ও ষষ্ঠ দশকের পর থেকে লিখিত/দৃশ্যমান চিহ্ন (সাইন) এবং এর মুখের ভাষা, উভয়ের ব্যবহারই করা হয়েছে সিনেমায়। সেমিওলজি নামে পরিচিত ভাষাতত্ত্বের একটি বিশেষ শাখার স্বীকৃতি ও চর্চার পর এই বিশ্লেষণ জনপ্রিয় হয়েছে। সেমিওলজি (চিহ্নের) পঠন-পাঠন বিশ্লেষণের ভিত্তিতে সেমিওলজিকে অনেকে লিখিত ও মুখের ভাষার মতো প্রকাশ মাধ্যম বলে বিবেচনা করে। আর এভাবেই সিনেমাকে একটি ভাষা হিসেবে বিচার করার সুযোগ এসেছে বলে মনে করা হয়। চিহ্নের (সাইন) যে পদ্ধতি বা ব্যাখ্যা তার ভেতর সব ধরনের ভাষাই অন্তর্ভুক্ত বলে ধরে নেওয়া হয়েছে যেমন, লিখিত, দৃশ্যমান এবং মুখে বলা কথা। অবশ্য ক্রিশ্চিয়ান মেৎজের মতো তাত্ত্বিক বলেছেন, সিনেমা একটা ভাষা হলেও একে ভাষা পদ্ধতি বলা যাবে না যেমন ভাষা পদ্ধতি হলো ইংরেজি অথবা ফরাসি। তাঁর মতে, সিনেমা বোধগম্য বলেই এর ভাষা সম্বন্ধে একটা ধারণা সহজেই অর্জন করা যায়। তাঁর বিখ্যাত উক্তি : ‘কাহিনি বর্ণনা করতে পারে বলেই সিনেমা ভাষা হয়ে গিয়েছে।’ (ক্রিশ্চিয়ান মেৎজ, ফিল্ম ল্যাঙ্গুয়েজ, পৃ. ৪৭)
সেমিওলজির প্রথম প্রবক্তা সস্যুরের মতে, একটি ধারণজ্ঞাপক চিহ্নের দুটি দিক আছে। প্রথম হলো, দ্যোতনাকারী (সিগনিফায়ার); দ্বিতীয় হলো, দ্যোতক (সিগনিফায়েড)। প্রচলিত ভাষায় শব্দ (ওয়ার্ড) এই অর্থে দ্যোতনাকারী কিন্তু এর দ্বারা যা বোঝানো হয় তার অর্থ ভিন্ন, সেটি দ্যোতক। সাহিত্যে শব্দ এবং অর্থ বহনকারী দ্যোতকের মধ্যকার সম্পর্কই ভাষাকে তাৎপর্যপূর্ণ করে এবং সৌন্দর্য ও গুরুত্ব দেয়। কিন্তু সিনেমায় দ্যোতনাকারী ও দ্যোতক প্রায় একই : দৃশ্যমান বস্তু বা চরিত্রই সংক্ষেপে বলা বা দেখানো চিহ্ন ছাড়া কিছু নয়। সংক্ষেপে বলার অর্থ হলো কোনো কিছুর ইমেজ তাৎক্ষণিকভাবে সেই বস্তুটিকে/চরিত্রকে চিনিয়ে দেয় সিনেমায়। কিন্তু সাহিত্যে ‘বই’ বলা হলে সঙ্গে সঙ্গে সেই বস্তুটি সম্পর্কে ধারণা হয় না যদি না আগের অভিজ্ঞতা থাকে। সংক্ষেপে বুঝিয়ে দেয় বলেই অর্থাৎ দৃষ্টির সামনে এনে, সিনেমার ভাষা কঠিন। মেৎজের ভাষায়, সিনেমার ব্যাখ্যা করা বেশ জটিল, কেননা এটা সহজেই বোঝা যায়। চোখের দৃষ্টি দিয়েই বই দেখা আর সিনেমা তৈরি করাও সিনেমার ভাষার সংক্ষিপ্ততার জন্য কঠিন হয়। সিনেমায় গোলাপ ফুল দেখালে সবার কাছে তা গোলাপই মনে হবে, অন্য কোনো ফুল নয়; কিন্তু ‘গোলাপ’ (রোজ) লেখা হলে তার বিভিন্ন অর্থ সামনে এসে যায় যেমন, গোলাপী, কোনো কিছুর সারি, মানুষের ওঠা (রাইজ) ইত্যাদি। লিখিত ভাষায় দ্যোতনাকারী এবং দ্যোতকের মধ্যে অনেক তারতম্য বা রকমফের রয়েছে এবং এটাই তার ক্ষমতা ও শক্তির উৎস। কিন্তু এটা আপাত সীমাবদ্ধতার মতো হয়ে পরিচালককে সীমাহীন সুযোগ দেয় দ্যোতককে বেছে নেওয়ার জন্য, তিনি অনেক গোলাপের মধ্যে একটিরই ছবি তুলতে পারেন (লাল, গোলাপী, কালো) কিন্তু লেখার ‘গোলাপ’ নির্দিষ্ট হতে হয়। অনেকগুলি গোলাপের মধ্যে একটি গোলাপকে বেছে নেওয়ার যে সুযোগ তার ফলে চিত্রনির্মাতা বিশেষ অভিব্যক্তি প্রকাশের জন্য নির্দিষ্টভাবে একটি গোলাপ নির্বাচন করতে পারেন। সেমিওলজির এই ব্যাখ্যার ভিত্তিতে সিনেমার মৌলিক ভাষা অর্থাৎ দৃশ্যকল্প বা মুভিং ইমেজকে প্রাধান্য দেওয়া সম্ভব হয়। সিনেমার নান্দনিকতার বিচারে সেমিওলজি তাঁর জটিলতা সত্ত্বেও সহায়কী ভূমিকা পালন করে।
প্রথম দিকে ফিল্মের ভাষা এবং লিখিত/মুখের ভাষার তুলনায় ক্যামেরার শটকে মনে করা হতো লিখিত/মুখের শব্দের মতো। কয়েকটি শট নিয়ে যে দৃশ্য তাকে মনে করা হতো বাক্য। এই ধারণা অনুযায়ী কয়েকটি বাক্য নিয়ে তৈরি হতো সিকোয়েন্স আর কয়েকটি সিকোয়েন্স নিয়ে রচিত হয় অনুচ্ছেদ। ক্রম অনুযায়ী এই বিশ্লেষণ সঠিক হলেও ফিল্মের ভাষা ব্যবহারের ক্ষেত্রে এটি সঠিক হয় না। যেমন, লিখিত ভাষায় শব্দ (ওয়ার্ড) যেমন অর্থ বহনকারী, ফিল্মের একটি শট তেমন অর্থবহ অবশ্যই না। সুতরাং শট, সিন (দৃশ্য) অথবা সিকোয়েন্সের ক্রমিক বিন্যাসে ফিল্মের অর্থ ব্যক্ত হতে পারে না, যেমন হয় লিখিত/মুখের ভাষায়, শব্দ, বাক্য, অনুচ্ছেদ দ্বারা। সাহিত্যের বা মুখের ভাষার মতো সিনেমার ভাষার অর্থ বিভিন্ন অংশে বিভক্ত করা যায় না; এই অর্থ শট, সিন এবং সিকোয়েন্স সবকিছুর সমাহারে ফিল্মে বিষয়ের অর্থ নিরবচ্ছিন্নভাবে ব্যক্ত করা সম্ভব হয় না। নান্দনিকতা সৃষ্টির দৃষ্টিকোণ থেকে পৃথকভাবে শট, সিন এবং সিকোয়েন্সের প্রতি দৃষ্টি দিলে যথেষ্ট বলে মনে হতে পারে কিন্তু যেহেতু নান্দনিকতা সকল কার্যক্রমের সামষ্টিক ফলাফল সেই জন্য সামগ্রিকভাবেও সিনেমা তৈরির যে প্রক্রিয়া একটি সামষ্টিক দ্যোতনা সৃষ্টি করে তার প্রতি সজাগ থাকতে হবে। এর ব্যত্যয় হলে দ্যোতনা সৃষ্টিকারী উপাদানগুলি পৃথকভাবে হয়তো নান্দনিকতার বৈশিষ্টমণ্ডিত হবে কিন্তু সার্বিকভাবে যে দ্যোতনার সৃষ্টি হবে সেখানে কিছু ঘাটতি থেকে যেতে পারে। সিনেমার নান্দনিকতা সৃষ্টিতে সেমিওলজি বা সেমিওটিকস এইভাবে একটি নতুন শর্ত যুক্ত করে এর ব্যাপ্তি বৃদ্ধি করেছে। এর অর্থ হলো, সিনেমার নান্দনিকতা সৃষ্টি একটি সামগ্রিক ব্যাপার, একে খণ্ডে খণ্ডে দেখালে তা
সন্তোষজনকভাবে উদ্দেশ্য পূরণ করতে পারবে না।
নান্দনিকতা সৃষ্টির জন্য চরিত্রের মনস্তাত্ত্বিক বিশ্লেষণের গুরুত্ব অনেক দিন থেকেই স্বীকৃত। চরিত্রের মানসিক চিন্তা-ভাবনা ভাষাতে যেমন প্রকাশ করা যায়, তার ভাব-ভঙ্গিতেও অভিব্যক্তি পেতে পারে। সিনেমার মৌলিক ভাষা যে ‘সচল দৃশ্যকল্প’ এ কথা মনে রেখে মানুষ জগতে চরিত্রের
ক্রিয়া-প্রক্রিয়াকে মুখের বা দেহের নির্বাক অভিব্যক্তির মধ্যে রাখাই সমীচীন। এতে মুখের কথার চেয়ে মনের চিন্তার প্রকাশ আরো গভীর এবং শিল্পিত হবে। মানসিক চিন্তা-ভাবনার সঙ্গে মুখের ভাব-ভঙ্গি, পোশাক-পরিচ্ছদ, মঞ্চসজ্জা, রঙের ব্যবহার, শব্দ এবং বহির্দৃশ্যের শট বেছে নিয়ে সার্বিকভাবে নান্দনিকতার প্রভাব ফুটে উঠবে। অবচেতনের চিন্তা স্রোত ইমেজের সাহায্যে যতটা, চরিত্রের মুখের কথায় তেমন হতে পারে না। একটা বিশেষ ঘটনা কিংবা চরিত্রের পারস্পরিক সম্পর্কের পরিপ্রেক্ষিতে কোন ধরনের ইমেজ সেই ঘটনা বা অনুভূতির প্রকাশে বেশি সফল এ কথা ভাবলে সচল দৃশ্যকল্পের ওপর গুরুত্বই প্রাধান্য পাবে। চিত্র-নাট্যে মনস্তত্ত্বের ভূমিকার কথা মনে রেখে এই প্রসঙ্গে নির্দেশনা থাকা প্রয়োজন। পরিচালক অভিনেতা-অভিনেত্রী, ক্যামেরাম্যানকে প্রথম থেকেই এ বিষয়ে সতর্ক করে দিতে পারেন এবং অবহিত রাখতে পারেন। অভিনেতা-অভিনেত্রীকেও চরিত্রের বিশেষ মুহূর্তের অনুভূতির কথা মনে রেখে সবাক অথবা নির্বাক হতে হবে এবং এদের মাত্রা সম্বন্ধে সচেতন থাকতে হবে। ক্যামেরাম্যান যখন কোনো দৃশ্যের বা চরিত্রের মুখের শট নেবে তখন তাকেও মনস্তত্ত্বের বিষয়টি মনে রাখতে হবে, কেননা, মুখের অভিব্যক্তি এবং দৃশ্যের ছবি চরিত্রের মনের ভেতরকার চিন্তা-ভাবনারই প্রতিফলন করে। একই কথা প্রযোজ্য লাইটম্যান ও সাউন্ড রেকর্ডার সম্বন্ধে। মনস্তাত্ত্বিক বিশ্লেষণকে চরিত্রের মনের কথা হিসেবে বিবেচনা করে নান্দনিকতার প্রসঙ্গে এর পৃথক ও বিশদ আলোচনা করা হবে।
উপসংহার
চিত্র-নাট্য রচনা একই সঙ্গে সহজ এবং কঠিন। সনাতন পদ্ধতিতে গতানুগতিকভাবে লেখা হলে চিত্র-নাট্য হবে বিশদ এবং সেখানে বিমূর্ত
চিন্তা-ভাবনার কোনো ভূমিকা থাকবে না। কিন্তু এমন চিত্র-নাট্য নান্দনিক গুণসম্পন্ন সিনেমা তৈরির জন্য উপযোগী হবে না। নান্দনিক গুণসম্পন্ন সিনেমার জন্য যে চিত্র-নাট্য রচনা করা হবে সেটি সংক্ষিপ্ত হতে পারে অথবা পূর্ণাঙ্গ এবং বিশদ। যেভাবেই রচনা করা হোক না কেন নান্দনিকতা গুণসম্পন্ন সিনেমার জন্য তৈরি চিত্র-নাট্যকে অবশ্যই হতে হবে এমন বৈশিষ্ট্যের এবং চরিত্রের যা সিনেমার মৌলিক ভাষা সচল দৃশ্যকল্পকে প্রাধান্য দেবে।
সংক্ষেপে অথবা বিশদভাবে যে পদ্ধতিতেই নান্দনিকতা গুণসম্পন্ন সিনেমা তৈরির জন্য চিত্র-নাট্য তৈরি করা হোক না কেন, অভিনেতা, অভিনেত্রী, ক্যামেরাম্যান, লাইটম্যান, সাউন্ড রেকর্ডার প্রমুখ অংশগ্রহণকারীকে বিমূর্ত প্রকাশ সম্বন্ধে পরিচালককে বিশদভাবে ব্যাখ্যা করে বোঝাতে হবে। হয়তো পৌনঃপুনিকভাবেই করতে হবে এই কাজ, কেননা, সিনেমার কুশীলব এবং অন্যরা নান্দনিকতা সৃষ্টির যে শর্ত ও উপায় সে সম্বন্ধে খুব সচেতন হয়ে কাজ করবে সে সম্বন্ধে নিশ্চিত হওয়া যাবে না। কেননা, তারা এ ধরনের ছবি তৈরিতে সবসময় অংশগ্রহণ করে না। ব্যতিক্রম বলেই নান্দনিক সিনেমার পরিচালকের দায়িত্ব অন্য পরিচালকের তুলনায় বেশি। চিত্র-নাট্য তাকে সাহায্য করতে পারে, তার দায়িত্বভার লাঘবে সহায়ক হয় কিন্তু বিশেষভাবে সচেতন থাকার দায়িত্ব থেকে তাকে কোনো কিছুই মুক্তি দিতে পারে না। এমন সিনেমার পরিচালককে তাই পরিশ্রম করতে হবে প্রথম থেকে শেষ পর্যন্ত। এর জন্য শুধু তার নিজের ধারণা থাকলেই যথেষ্ট হবে না, প্রয়োজন হবে প্রচুর ধৈর্যের এবং অন্যের প্রতি সহানুভূতির।
ওপরের বক্তব্যের বিপরীতে কেউ কেউ বলে থাকেন যে অভিনেতা-অভিনেত্রী অথবা ক্যামেরাম্যানকে সবকিছু তোতা পাখির মতো শেখানোর প্রয়োজন নেই। তাদের করণীয় কাজ তাদের ওপর ছেড়ে দেওয়াই ভালো। এর ফল সন্তোষজনক হতে পারে যেমন হয়েছিল জন ক্যাসাভেটের তৈরি ছবি শ্যাডোজে আবার চিত্র-নাট্যের ঘেরাটোপ থেকে মুক্তি দিলে যে অভিনেতা প্রমুখ অংশগ্রহণকারী যে ভালো ফল দিতে পারে তার উৎকৃষ্ট দৃষ্টান্ত অ্যালে রেঁনের তৈরি লাস্ট ইয়ার ইন ম্যারিয়েনবাদ এবং মাইকেল অ্যাঞ্জেলো অ্যান্টোনিয়নির লা ভেঞ্চুরা সিনেমা। এসব আর্ট ফিল্ম ছিল বলেই পরিচালক এমন স্বাধীনতা নিতে পেরেছিলেন।