logo

সালভাদোর দালির ফ্যান্টাসির জগৎ

অভিতাভ মৈত্র 

মুখ চাই, মুখ

১৯০৪ সাল তাঁর জন্মের তিন বছর আগে মরে যাওয়া তাঁর ভাইয়ের নাম ছিল ‘সালভাদোর’। সাত বছর বয়সে সেই শিশুটি মেনেঞ্জাইটিসে মারা যায়। সান্তবনাহীন শোকে ভেঙে পড়ে শিশুটির মা-বাবা। তিন বছর পরে যখন আর একটি পুত্র সন্তান জন্মায়, সেই মরে যাওয়া শিশুটির নামে নবজাতকের নাম দেওয়া হয় ‘সালভাদোর’। সারাজীবন দালি সেই না-দেখা ভাইকে খুঁজে বেড়িয়েছেন নিজের মধ্যে। – ‘আমি আর আমার ভাই ছিলাম জলের দুটি ফোঁটার মতো, যাদের কিছুতেই আলাদা করে চেনা যায় না, শনাক্ত করা যায় না। কিন্তু আমাদের প্রতিবিম্ব আলাদাভাবে চেনা যেত। আমার ভাইয়ের মুখের গড়নও ছিল আমার মতো – প্রতিভার নির্ভুল ছাপ ছিল দুটো মুখেই। মুখ দেখেই বোঝা যেত সে ভয়ংকর অকালপক্ব একটি ছেলে। কিন্তু চোখের সুদূর বিষণ্ণতা থেকে তার অদম্য মেধা আর জাগ্রত মনের স্পষ্ট ধারণা পাওয়া যেত সহজেই। আর আমি ছিলাম অপেক্ষাকৃত কম বুদ্ধিমান। কিন্তু আমি ছিলাম প্রতিচ্ছবি দিয়ে ঠাসা এক জাদুঘরের মতো, সব স্মৃতি সমানভাবে উজ্জ্বল হয়ে আছে যেখানে। ধাত্রী ক্রোড়েই আমি উত্তেজক স্বর্গগুলো ঠিকভাবে চিনেছিলাম। অসীমকে আমি আনতে চেয়েছিলাম আমার নাগালে।’

মৃত ভাইয়ের ছায়া সালভাদোর দালি সারাজীবন কইন করেছিলেন নিজের মধ্যে। ছায়ার নিয়ন্ত্রণ থেকে মুক্ত করতে চেয়েছেন নিজেকে। ছায়াটিকে শিক্ষা দিতেই যেন খামখেয়ালি, উদ্ভট অযৌক্তিক আচরণ করতেন ছায়াটির হাত থেকে যাতে নিষ্কৃতি পান তিনি।

তিন বছর বয়সে রাঁধুনি হতে চেয়েছিলেন। যখন ছয় বছর বয়সে তিনি চেয়েছিলেন নেপোলিয়ান হতে। সেই থেকে তাঁর উচ্চাকাঙক্ষার উড়ান শুরু। নিজের শরীরের বিভিন্ন প্রত্যঙ্গে তিনি খুঁজে পেয়েছিলেন স্বর্গ, আর কোমল, পিচ্ছিল উষ্ণ নরক এমনকি নরকের রং পর্যন্ত। এই সময়েই পাত্র ছাড়াই দুটো ডিমের সিদ্ধ হওয়ার দৃষ্টিভ্রম মাঝেমাঝেই ফিরে আসত তাঁর কল্পনায়। এই দৃশ্যেই তিনি খুঁজে পেয়েছিলেন তাঁর জন্মের আগের অবস্থা। দালি তাঁর নিজের শৈশব এবং সেই সময়ের খামখেয়ালি অতর্কিত প্রতিক্রিয়ার নানা কথা অকপটে নিজেই বলেছেন। পাঁচ বছর বয়সে তাঁর থেকে কমবয়সী একটি ছেলের সঙ্গে বেড়াচ্ছিলেন। ছেলেটি ছিল ট্রাইসাইকেলে আর দালি ঠেলছিলেন সেটা। একটা রেলিংহীন সাঁকো পার হওয়ার সময় কেউ তাঁদের লক্ষ্য করছে কিনা সেটা একঝলক দেখে নিয়ে এক ধাক্কায় সাঁকো থেকে ফেলে দিলেন ছেলেটিকে। তারপর দৌড়ে বাড়ি ফিরলেন খবরটা দিতে। পনেরো ফিট নিচে পাথরের ওপর পড়ে থাকল ছেলেটি। আর সারা বিকেল রকিং চেয়ারে বসে দালি দেখলেন আহত শিশুটির ঘর থেকে মাঝেমাঝেই রক্তমাখা বেসিন, গজ, তুলো বাইরে আনা হচ্ছে।

যখন তাঁর বছর ছয় বয়স, এক বিখ্যাত ধূমকেতু দেখা গেল আকাশে। সবাই বেরিয়ে গেল ধূমকেতু দেখতে। দৌড় লাগালেন দালিও। যদিও তিনি খুব ভয় পেয়েছিলেন সেই ধূমকেতুর লেজ পৃথিবীতে নামতে পারে জেনে। দ্বিধা নিয়ে থামলেন একটু। দেখলেন তাঁর ছোট বোন হামাগুড়ি দিয়ে নিজের মনে চৌকাঠ ডিঙোচ্ছে। বোনের মাথায় জোরে একটা লাথি মেরে আনন্দে বিহবল হয়ে দৌড়লেন বাইরে। আবার যখন সেই বোনের কান বেঁধানোর জন্য বাড়িতে ডাক্তার এসেছে, ছেলেমানুষ দালির মনে হলো ব্যাপারটা নিষ্ঠুর, অমানবিক। একটা তোষক পেটার ছড়ি এনে সপাং করে মারলেন ডাক্তারের মুখে। চশমা ভেঙে গেল, ছোট লাগল মুখে। বুড়ো ডাক্তারটি কেঁদে ফেললেন। পরবর্তী সময়ে দালি মাঝেমাঝেই চাইবেন অসুস্থ হয়ে পড়তে, যাতে সেই ডাক্তারকে ডাকা হয় আর দালি তাঁকে দেখতে দেখতে সেই কান্নার স্মৃতি মনে করতে পারেন।

একবার একটা আহত বাদুড় বাড়িতে এনে পরিত্যক্ত স্নানঘরে লুকিয়ে রাখলেন সেটাকে। পরদিন সকালে গিয়ে দেখলেন যন্ত্রণায় কাঁপতে থাকা বাদুড়টির, মুমূর্ষু শরীরে উন্মত্তের মতো দংশন করছে মাংসাশী পিঁপড়ের দল। এক অদ্ভুত আবেগে দালি তুলে নিলেন বাদুড়টিকে এবং কামড়াতে থাকলেন যতক্ষণ পর্যন্ত না সে মরে যায়। যখন স্কুলে ভর্তি হলেন, সহপাঠীরা ভয় পেত তাঁকে, এড়িয়ে যেত। তাদের মনোযোগ পাওয়ার জন্য উঁচু সিঁড়ি থেকে মাঝেমাঝেই বিপজ্জনকভাবে লাফ দিতেন। রক্তাক্ত যন্ত্রণা ছাপিয়ে তাঁর মুখে তখন ফুটে উঠত প্রসন্ন আত্মগর্বিত হাসি। তিনি পেরেছেন বন্ধুদের চমকে দিতে, ভয় পাইয়ে দিতে। একবার এক সহপাঠীর বেহালা ভেঙে টুকরো টুকরো করে দিলেন স্রেফ এটুকু বোঝাতে যে, সংগীতের থেকে চিত্রাঙ্কন অনেক বেশি প্রয়োজনীয় এবং উৎকৃষ্ট মাধ্যম।

ছয় বছর বয়সে রীতিমতো ছবি আঁকা শুরু করলেন দালি। নিখুঁত উনিশ শতকের প্রচলিত ধারা মেনে আঁকা হয়েছে প্রতিভা স্পর্শিত দুটি ছবি – Portrait of Helen of troy এবং Joseph Greeting his Brethrew. তিনতলার একটা পরিত্যক্ত স্নানঘর হলো তাঁর স্টুডিও। গ্রীষ্মকালে গরম থেকে বাঁচতে একটা বাথটাব জলে ভর্তি করে খালি গায়ে বসে ঘণ্টার পর ঘণ্টা ছবি আঁকতেন। পরিত্যক্ত টুপিগুলো আর সব দেয়াল ভর্তি করে দিতেন দালি ছবি এঁকে। এই নির্জনতা এই একাকিত্ব ছিল তাঁর কাছে একরকমের আশ্রয়। কেউ আসবে না সেখানে তাঁর উদ্দাম উন্মাদ কল্পনাকে বিব্রত করতে। এই অবিশ্বাস্য অমানবিক কল্পনাশক্তি সারাজীবন নিয়তির মতো চালিয়ে নিয়ে গেছে তাঁকে।

 

‘যখন আমি ছবি আঁকি, গর্জন করে সমুদ্র। আর সব কিছু সেই জলোচ্ছ্বাস ভেসে যায়।’

 

১৯০৪ সালের ১১ মে সকাল ৮টা ৪৫ এ যখন সালভাদের দালি জন্মান তাঁর বাবা যিনি ছিলেন ফিগেরার এক লব্ধপ্রতিষ্ঠ নোটারি, নিশ্চিতভাবেই জানতেন না তাঁর ছেলেটি কী অপরিসীম প্রতিভা নিয়ে জন্মেছে। জানতেন না চিত্রশিল্পের জগতে কী অবিশ্বাস্য অবদান অফুরন্তভাবে রেখে যাবে সে। যখন ছয় বছরে পড়েছে সে প্রথাগত শিক্ষা ছাড়াই ছবি আঁকার যাবতীয় পদ্ধতি তাঁর আয়ত্তে। ছেলের এই বিশেষ ক্ষমতা দেখে তাঁর বাবা তাঁকে পাঠালেন বন্ধু শিল্পী রামন পিশোৎ-এর কাছে। পিশোৎ নিজে ছিলেন খ্যাতিমান শিল্পী। যে ঘরে দালিকে থাকতে দেওয়া হলো তার সব দেয়ালজুড়ে ছিল পিশোৎ-এর আঁকা বর্ণময় অনেক ইমপ্রেশনিস্ট ছবি। ছবিগুলো যেন দৃষ্টির এক মহাভোজ, এক visual cocktail হয়ে এলো দালির কাছে। প্রথাবহির্ভূত যে দৃষ্টিবঙ্গি এতদিন খুঁজছিলেন তিনি, এসব ছবির মধ্যে তার একটা দিক-নির্দেশ পেলেন। একটা বড়সড় ঘর পিশোৎ দালিকে স্টুডিওর জন্য ছেড়ে দিলেন। পিশোৎ-এর দেখার চোখ এবং উজ্জ্বল জীবন্ত রঙে স্নাত ঝকঝকে ছবি যেন বিস্ফোরণ ঘটিয়ে দিল দালির মধ্যে। প্রথাসিদ্ধ প্রেক্ষিত প্রথাসিদ্ধ রং থেকে যেন মুক্তি পেল ছবি নিয়ে তাঁর এতদিনের ধারণা। আর এক ঘোরের মধ্যে তাঁর স্বপ্নের ছবি আঁকতে শুরু করলেন তিনি। ছবি আসতে লাগল স্রোতের মতো। এভাবে একবার ক্যানভাস শেষ হয়ে যেতে দালি পুরনো ঘুণধরা একটা দরজাকেই করে নিলেন ক্যানভাস, আর চেরিফলের একটা স্থির চিত্র আঁকতে শুরু করলেন তার ওপর। মডেল হিসেবে সামনে থাকল বড়সড় একটা চেরির গুচ্ছ। গাঢ় লাল, ভার্মিলিয়ন আর সাদা রঙের সরাসরি প্রয়োগ করে ছবিটিকে আঁকতে যেন তীব্র আক্রমণ করলেন দরজাটিকে। রঙের ঘনত্ব যেন স্পর্শযোগ্য করে তুলল চেরিগুলোকে। আঁকতে আঁকতেই দালি খেয়াল করলেন দূরে একটা যন্ত্র চলার শব্দের সঙ্গে তাল রেখেই আঁকছিলেন এতক্ষণ তিনি, যার ফলে তাড়াতাড়ি শেষ হয়ে গেছে ছবি। এবার দালি দেখলেন চেরিগুলোর বৃন্ত আঁকার উত্তেজনায় তিনি ভুলে গেছেন। দ্রম্নত কিছু চেরি চিবিয়ে সেই বৃন্ত আঠা দিয়ে তিনি জুড়ে দিলেন ছবিতে। তারপর চেরি ফলের সত্মূপ থেকে কিছু কীট তুলে নিয়ে আঠা দিয়ে একইভাবে আটকে দিলেন। ফলে বাস্তবতা আরো জোরালোভাবে প্রতিষ্ঠিত হলো। পিশোৎ ঘরে ঢুকে মন দিয়ে ছবিটি দেখে নিজের মনে বলে উঠলেন, ‘দুর্দান্ত প্রতিভা। অসাধারণ শিল্পী হবে এ।’ ভুল করেননি পিশোৎ।

ফুল তোলার জন্য মই আনতে গিয়ে পিশোৎ-এর বাড়ির এক কোণে পুরনো জিনিসপত্রে ঠাসা ঘুরে তিনি খুঁজে পেয়েছিলেন নাটকের কাজে লাগে এমন বড়সড় একটা মুকুট আর ক্রাচ। স্টুডিওতে নিয়ে এলেন সে দুটো। মাথায় মুকুট পরে ক্রাচ নিয়ে তিনি জানালায় দাঁড়ালেন আহত রাজার মতো। নিচে কাজে ব্যস্ত পরিচারিকা তার সুগঠিত স্তন যেন অগ্নিসংযোগ করল তাঁর কল্পনায়। ক্রাচের দুটো মাথা দিয়ে স্তন দুটিকে ছোঁয়ার আকাঙক্ষা এত তীব্র হয়ে উঠল যে, সামনে বাতাবিলেবু গাছের দুটো পুষ্ট বাতাবিকে তিনি চেপে ধরলেন সেই ক্রাচ দিয়ে। চাপে ফুটো হয়ে লেবু থেকে গাঢ় রস নেমে এলো ক্রাচ থেকে তাঁর হাতে। মহিলার স্তনের প্রতীক ছাড়িয়ে দালির চোখে সেই লেবু তখন হয়ে উঠেছে মৃত ফুলে ওঠা দুটো শজারু। পরে তাঁর ছবিতে বারবার ফিরে আসবে এই ক্রাচের ফেটিশ, বিভিন্নভাবে। এ সময়েই দালি আকৃষ্ট হচ্ছেন রেনেসাঁস যুগের বিখ্যাত ছবি থেকে আলো এবং ছায়াপাতের কৌশল ও রহস্য আবিষ্কার করতে। দর্শনশাস্ত্রে আকৃষ্ট হলেন এই সময়ে। নিৎসের Thus spake Zarathrusta, ভলত্যারের Philosophical Dictionary মন দিয়ে পড়লেন। এরপর যথাক্রমে স্পিনোজা আর দেকার্ত। পরবর্তীতে তাঁর বিভিন্ন ধরনের উদ্ভাবনে এই আত্মশিক্ষা সাহায্য করেছে তাঁকে। কান্ট ছিলেন তাঁর সব থেকে প্রিয়। একটি শব্দও না বুঝে বারবার পড়তেন কান্ট। ‘এত গুরুত্বপূর্ণ আর অর্থহীন বই আর একটিও লেখা হয়নি’ – বলেছিলেন একবার সপ্রশংসভাবে।

প্রথাগত পড়াশোনা চলছিল খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে। নাক দিয়ে রক্তপাত আর বুকে ব্যথায় অজুহাতে স্কুলে যাওয়া প্রায় ছেড়ে দিলেন। ছুটি পড়লে উন্মাদের মতো ছুটতেন ভূমধ্যসাগরের উপকূলে কাদাকেস গ্রামে। ধর্মীয় নিষ্ঠায় তিনি যেন আরাধনা করতেন জনশূন্য সমুদ্রতীর আর অদ্ভুত রঙের পাথরগুলোকে। এই সমুদ্রতীর এই অদ্ভুত রঙের পাথর তাঁর ছবিতে ফিরে আসবে মাঝেমাঝেই। সতেরো বছর বয়সে বাবা-মার অনুমতি পেয়ে ভর্তি হলেন মাদ্রিদের School of Fine Art-এ। নিজের ক্ষমতায় পূর্ণ আস্থাবান এবং অত্যন্ত মেধাবী আর শান্ত ছাত্র হিসেবে প্রশংসা পাচ্ছেন সবার। দুটি প্রতিযোগিতায় প্রথম স্থান অধিকার করে আরো বেড়ে গেল আত্মবিশ্বাস। সবেমাত্র পরিচিত হচ্ছেন কিউবিজমের সঙ্গে। বিখ্যাত কিউবিস্ট শিল্পী হুয়ান গ্রিস তাঁর অন্তর্দৃষ্টি খুলে দিলেন। পুরনো নানারকম ছবিকে কিউবিজমের ধরনে এঁকে প্রস্ত্তত করছেন নিজেকে। ইমপ্রেশনিজমের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করেছেন, ইমপ্রেশনিজমের বর্ণবহুল প্যালেট সরিয়ে কাজ করছেন সাদা, কালো, বার্নট সায়না আর অলিভ গ্রিন রঙে। প্যালেট থেকে অন্তর্হিত রং তিনি ফিরিয়ে আনলেন পোশাকে। ছোট ঝুলের তাপ্পি দেওয়া ট্রাউজার। রংচঙে মোজা। বিরাট কালো টুপির নিচে লম্বা চুল ঝুলছে। নেভানো পাইপ দাঁতে চেপে ধরা। এই পোশাক যেন তাঁর অবজ্ঞা আর প্রচলিত শিক্ষার বিরুদ্ধে হতাশার প্রকাশ। তাঁর অনুসন্ধিৎসু প্রশ্নগুলো ধাক্কা খেত অনির্দিষ্ট নিষ্প্রভ উত্তরে। তিনি খুঁজছিলেন উৎকর্ষের চূড়ান্ত বিন্দু, শ্রমলব্ধ প্রজ্ঞা। আর পাচ্ছিলেন চিন্তাহীন অলসতা, ‘যেমন খুশি সাজো’ জাতীয় মেধাবর্জিত স্বাধীনতা। বিরক্তিতে একদিন ভাস্কর্য শেখানোর ফাঁকা ঘরে ঢুকে বেসিনে এক বসত্মা পস্নাস্টার ঢেলে কল খুলে দিলেন। দুশ সাদা পস্নাস্টার গোলা জলস্রোত গোটা ঘর ভাসিয়ে পাহাড়ি ঝর্নার মতো সিঁড়ি পস্নাবিত করে প্রধান ফটক অবধি পৌঁছে গেল। তাঁর ধ্বংস সাধনের বিপুলতায় ভয় পেয়ে লুকিয়ে সেই পিচ্ছিল জলাভূমি পার হয়ে গেলেন কোনোমতে। ধরা পড়লেন না। আর দ্রম্নত জমাট হয়ে যাওয়ার ক্ষমতার জন্য সারাটা রাসত্মা ধন্যবাদ দিয়েছিলেন পস্নাস্টারকে!

 

উড়তে শেখার দিনগুলো

‘শৃঙ্খলার ভেতর দিয়েই বিভ্রামিত্মকে সৃষ্টি করতে হবে। সৃজনশীলতার মুক্তি আসে এভাবেই। যা কিছু পরস্পরবিরোধী তাই জীবনকে চালিত করে’

 

১৯২২ সাল। স্কুল থেকে এক বছরের জন্য বিতাড়িত দালি তখন আচ্ছন্ন হয়ে আছেন ফ্রয়েডে। ফ্রয়েডের The Interpreation of Dreams পড়ার পর শুরু করলেন ফ্রয়েডের মতো করে নিজের মনোবিশেস্নষণ যা তাঁর কাছে ছিল যন্ত্রণাদায়ক। প্রচুর চিন্তা ও স্বনির্যাতন করেও তিনি সিদ্ধান্ত নিতে পারছেন না তিনি স্বাভাবিক না প্যারানোইয়াক। কল্পনায় তাঁর দীর্ঘ আলাপ চলে ফ্রয়েডের সঙ্গে। একদিন দেখলেন ফ্রয়েড ঝুলছেন তাঁর জানলার পর্দা আঁকড়ে ধরে। আরেকদিন হোটেলে শামুক খেতে খেতে আনন্দে চিৎকার করে উঠলেন ‘ফ্রয়েডের মাথার খুলি আসলে শামুকের মতো পাকানো।’ তিনি আরো আবিষ্কার করলেন রাফায়েলের খুলি আসলে পাথরের গায়ের শিরার মতন যার ভেতরে মণিরত্ন সাজানো। আবার লিওনার্দো দ্য ভিঞ্চির খুলি শক্ত বাদামের মতো, শাঁসে পৌঁছতে হলে যা ভাঙতে হয়। খুলি নিয়ে তাঁর অদ্ভুত আসক্তি পরবর্তী জীবনে বারবার আসবে ছবিতে।

লন্ডনে দেখা হলো ফ্রয়েডের সঙ্গে। কথাবার্তা বিশেষ হলো না। কিন্তু পরস্পরকে তাঁরা যেন চোখ দিয়ে শুষে নিচ্ছিলেন। মসিত্মষ্ক বিকৃতি নিয়ে তাঁর লেখা বড় আর গুরুগম্ভীর একটা ছাপানো প্রবন্ধ নিয়ে গেছিলেন। বারবার সেটা দেখতে বললেন ফ্রয়েডকে। ফ্রয়েড শুধু চুপচাপ তাকিয়ে আছেন তাঁর দিকে। ছুঁয়েও দেখলেন না লেখাটা। পরে ফ্রয়েড বলেছিলেন, ‘এমন গোঁয়ার এমন উন্মাদ স্প্যানিয়ার্ড তিনি আর দেখেননি। কিন্তু ছবি আঁকার ক্ষেত্রে ছেলেটি জিনিয়াস।’

স্কুল থেকে এক বছরের জন্য বের করে দেওয়ার পর উগ্র নৈরাজ্যবাদী কথাবার্তার জন্য তাঁকে এক মাসের জন্য কারাবাস করতে হয়। কোনো অভিযোগ না থাকায় এক মাস পর ছাড়া পেয়ে দালি আবার ফিরে গেলেন কাদাকেস গ্রামের শান্ত নির্জনতায়। সমস্ত শরীর মন একাগ্র করে এই এক বছর তিনি শুধু ছবি আঁকা ও দার্শনিক গবেষণায় ডুবে থাকলেন। এই সময় তার জীবনযাপন ছিল সুশৃঙ্খল এবং কর্মময়। ‘সেই দিনগুলোয় আমি ছিলাম এক দৈত্য, চোখ হাত আর মসিত্মষ্ক ছাড়া আর কিছু যার শরীরে নেই।’ এই কাদাকেস অঞ্চলের স্মৃতি পরবর্তী সময়ে বারবার ফিরে আসবে তাঁর ছবিতে।

নিজের জীবনে বিশৃঙ্খলা, অনিয়ন্ত্রিত আবেগের কাছে দালি ছিলেন অসহায়। কাদাকেসের স্থির আত্মস্থ প্রকৃতির মধ্যে শুশ্রূষা খুঁজে পেতেন তিনি। কিছুটা এজন্যই বিমূর্ততাকে সহ্য করতে পারতেন না। তাঁর মানসিক গঠন ও শিল্পভাবনাও ছিল বিমূর্ততার ঠিক বিপরীত মেরুতে। বরং অন্তর্নিহিত নিয়ন্ত্রণ ও নতুন দৃষ্টিকোণে ফর্মের উত্তেজনা খুঁজে পেয়েছিলেন। ১৯২৬ সালে আঁকা Figure between the Rocks এ কয়েকটি পাথরের ওপর হাত-পা টান করে শায়িত নারীমূর্তির ছবিটি তাঁর কিউবিজমের ঝোঁক চিনিয়ে দেয়। কিউবিজমের ধ্রম্নপদী গঠনে তিনি যেন প্রয়োজনীয় আশ্বাস খুঁজে পেলেন। তাঁর আভ্যন্তরীণ বিশৃঙ্খলাকে শমিত করায় একটি পথ যেন খুঁজে পেলেন। কিউবিজম তাঁকে সন্ধান দিল উজ্জ্বল সম্মোহক এক নতুন দিগন্তরেখার। মুগ্ধ বিস্ময় নিয়ে ১৯২৭ সালে পারিতে তিনি দেখা করতে গেলেন পিকাসোর সঙ্গে। পিকাসোকে বললেন, ‘লুভ্রতে যাওয়ার আগে আমি আপনার সঙ্গেই দেখা করতে এসেছি।’ ‘তুমি কোনো ভুল করোনি।’ পিকাসো উত্তর দিলেন। একটি ছোটখাটো কাজ দালি দেখতে দিলেন পিকাসোকে। অনেকক্ষণ ধরে ছবিটি দেখলেন পিকাসো। কোনো মন্তব্য করলেন না। পিকাসো এরপর নিঃশব্দে উঠে স্টুডিও থেকে নিজের অনেক ছবি নিয়ে নিঃশব্দে রাখলেন দালির সামনে। তারপর নিঃশব্দে দুঘণ্টা ধরে দালি পিকাসোর ছবি দেখলেন, বুঝলেন, বিশেস্নষণ করলেন মনে মনে। ফিরে আসার সময় দুজনে দুজনের দিকে আরেকবার নিঃশব্দে কয়েক মুহূর্ত তাকালেন। সেই দৃষ্টি দেখে দালির মনে হলো পিকাসো যেন জানতে চাইছেন ‘বঝেছো?’ দৃষ্টি দিয়ে দালি উত্তর দিলেন ‘বুঝলাম।’

ছবির জগতে নানা ধ্যান-ধারণা, তত্ত্ব ও নিরীক্ষায় ব্যস্ত ছিলেন দালি এই সময়। কিউবিজমের পাশাপাশি ইতালিয়ান ফিউচারিজমেও আগ্রহী হলেন। বিশেষ করে বস্ত্তর গতিময়তাকে ছবিতে আনার যে চেষ্টা ফিউচারিজম করছিল দালি আকৃষ্ট হয়েছিলেন তার দিকে। ১৯২৪ সালে তাঁর আগ্রহের অভিমুখ ঘুরে গেল Scuola Metafisica (Metaphysical School) এর অতীন্দ্রিয় অলোকদৃষ্টির দিকে। বরং বলা ভালো এই ধারণায় প্রবর্তক ইতালিয়ান শিল্পী জর্জো দে কিরিকোর (১৮৮৮-১৯৭৮) চিত্র দেখে। প্রতিটি বস্ত্তর জন্য আছে দুটি দৃষ্টিকোণ। একটি সাধারণ যা সকলেই দেখতে পায়, আর অন্যটি অপ্রাকৃত বা পরাবাস্তব। এই দ্বিতীয়টি তাঁর চোখেই ধরা পড়ে বস্ত্তর অতীন্দ্রিয় সত্তাকে যিনি অনুভব করতে পারেন। চোখে যেমন দেখা যায়, কোনো বস্ত্ত তার চেয়ে অনেক বেশি প্রকাশ করে সেখানে। একজন mystic বা অতীন্দ্রিয় ভাবুক কিরিকো ছিলেন বিষাদময় সন্ধানী। তাঁর ছবির আবহ যেন অতল বিষাদ আর দুঃস্বপ্নের অতি সংকীর্ণ পরিসীমায় যেন শূন্যের মধ্যে সাজানো হয়েছে ইতালির শহরের বড় বড় প্রাসাদ, রাসত্মা। এক নিষ্প্রাণ, দয়ামায়াশূন্য আলোয় স্নান করছে দৃশ্যটি। একটি চিত্রে ফিরিকো দেবীমূর্তির মাথার পাশে স্বপ্ন দৃশ্যের মতো রেখেছিলেন এক জোড়া লাল দসত্মানা – স্থহল বৈপরীত্যকে, নিরর্থকতাকে এভাবেই মেলাবার চেষ্টা করেছিলেন কিরিকো। নিৎশে এবং শোপেনহাওয়ারের দর্শনের গভীর প্রভাব ছিল তাঁর ওপর। তিনি বিশ্বাস করতেন জীবনের অর্থহীনতাকে শিল্পকলায় প্রকাশ করার জন্য প্রতিটি বস্ত্তর মধ্যে কাল্পনিক সংযোগগুলো ছিন্ন করে তার একক অবিঘ্নিত ভাসমান অসিত্মত্বকে প্রতিষ্ঠিত করতে হবে। তাঁর প্রহেলিকাময় অস্বসিত্মজনক স্বপ্ন-প্রতীকগুলোতে শোপেনহাওয়ারের Essays on Apparitions ভারি ছায়াপাত ঘটেছে। কিরিকো তাঁর ছবি সম্পর্কে একবার বলেছিলেন – আর কাকেই বা ভালোবাসব প্রহেলিকা ছাড়া? (Et quid amoto achigma est?)। কিরিকোর ছবি সরাসরি নস্যাৎ করেছিল কিউবিজম এবং কিউচারিজম আন্দোলনকে এবং সেই শূন্যবেদীতে বসিয়েছিল স্বপ্ন অন্তর্জগতের উদ্ভাসনকে। দালি এবং পারিতে কিছু শিল্পী তাঁর প্রবল মৌলিকতাকে চিনতে দেরি করলেন না। দালিকে বিশেষভাবে আকৃষ্ট করল কিরিকোর ছবির দৃশ্য গভীরতা আর ছায়া ফেলার রহস্য।

 

বুনুয়েল, গালা, এলুয়ার, পরাবাস্তববাদ

তাঁর ছবি ঝাঁকিয়ে দিচ্ছে মানুষের কল্পনাশক্তিকে, রীতিমতো আলোড়ন ফেলে দিয়েছেন তিনি, পিকাসো এবং ফ্রয়েড তাঁকে গুরুত্ব দিচ্ছেন, দাদাবাদ তখন নির্বাপিত প্রায়, এরকম সময় বুনুয়েল, পল এলুয়ার, গালা আর সস্ত্রীক শিল্পী রেনে মাগ্রিত কাদাকেসে দেখা করতে এলেন দালির সঙ্গে। এর মধ্যে ১৯২৪ সালে বেরিয়ে গেছে আঁদ্রে ব্রেতঁর প্রথম পরাবাস্তববাদী ইশতাহার। যার ভিত্তি সাইকিক অটোমেটিজম। কথায় ভাষায়, সাহিত্যে এবং অন্যান্য শিল্প মাধ্যমে যেখানে চিন্তন প্রক্রিয়াই হয়ে উঠবে সবকিছু। স্বপ্নই যেখানে সর্বাত্মক এবং যুক্তিবিশেস্নষণ গৌণ। এ যাবৎ সবরকম মানসিক সংগঠন প্রক্রিয়াকে সম্পূর্ণ ধ্বংস করে পরাবাস্তববাদ খুঁজছে জীবনের প্রধান প্রশ্নগুলোর উত্তর।

কিন্তু ছবির জগতে কীভাবে একে প্রতিষ্ঠিত করা সম্ভব এ বিষয়ে স্পষ্ট কোনো ধারণা করতে পারেননি তাঁরা। ১৯২৫ সালে পিয়ের নেভিল সরাসরি বলেই দিলেন যে ছবিতে পরাবাস্তববাদ আনা অসম্ভব। ব্রেতঁ জানালেন স্বপ্ন প্রতীকের মাধ্যমে শিল্পীরা অন্যান্য মাধ্যমগুলোর সঙ্গে ছন্দময় সংহতি রচনা করতে পারেন। ব্রেতঁ চিত্রশিল্পী ছিলেন না। তাঁর নির্দেশ মেনে স্বপ্ন-সম্ভব ছবি আঁকার মতো তৈরি শিল্পীও হাজির হননি প্রদীপের দৈত্যের মতো। একজনই আদর্শ ছিলেন সুররিয়ালিস্তদের সামনে – সালভাদর দালি। বুনুয়েল, এলুয়ার, মাগ্রিত এবং গালার সঙ্গে প্রথম দেখা হওয়ার সময় দালির পাগলামি যখন তখন অট্টহাসিতে ফেটে পড়া একধরনের বিতৃষ্ণা আনল তাঁদের মধ্যে। দালির ছবির চৌম্বকশক্তি তাঁদের আকর্ষণ করলেও কিছু কিছু বিষয় দুর্বোধ্য লেগেছিল তাঁদের। গালাকে দেখার পর তীব্র প্রেমে ভেসে গেলেন দালি। গালাকে প্রেমের প্রসত্মাব দেওয়ার আগে নিজেকে দর্শনীয় করতে চেয়ে দালি এই কাজগুলো করলেন – (১) নিজের শ্রেষ্ঠ শার্ট এমনভাবে ছেঁটে ফেললেন যাতে নাভি দেখা যায় (২) শার্টের কলার ও কাঁধের অংশ ছিঁড়ে ফেললেন (৩) ট্রাউজার পরলেন উল্টে নিয়ে (৪) ক্ষুর ঘষে বাহুমূল ও হাঁটু থেকে পায়ের পাতা পর্যন্ত রক্তাক্ত করে জামাকাপড়ে দেওয়ার নীল ভালো করে লাগালেন জায়গাগুলোয়। রাসত্মায় নেমে জানালায় গালাকে দেখে মনে হলো এই বিয়ের পোশাকে চমৎকার মানিয়েছে তাঁকে। দৌড়ে ঢুকলেন গালার ঘরে আর গালার পায়ে আছড়ে পড়ে ভয়ংকর অট্টহাসিতে ফেটে পড়লেন। ঘৃণা ও বিবমিষার প্রাথমিক ধাক্কা কাটিয়ে গালা একরকমভাবে স্বীকৃতি দিয়েছিলেন দালিকে।

আর একবার ন্যুইয়র্কে তাঁর ছবির প্রদর্শনীর বিরাট সাফল্যের পর গোটা আমেরিকা যখন দালিকে একমাত্র সুররিয়ালিস্ত শিল্পী বলে একবাক্যে স্বীকৃতি দিচ্ছে, অন্য সুররিয়ালিস্ত শিল্পীরা ব্রেতঁর বাড়িতে ভৎর্সনার জন্য ডেকে পাঠালেন তাঁকে। অনেকগুলো শার্ট পরপর গায়ে চাপিয়ে মুখে থার্মোমিটার গুঁজে দালি ঢুকলেন। যত চড়তে থাকল ঝগড়ার পারদ ততই বাড়তে থাকল থার্মোমিটারে তাঁর জ্বর দেখার ঝোঁক। শেষে সব জামা একের পর এক খুলে খালি গায়ে তিনি শুয়ে পড়লেন ব্রেতঁর পায়ের কাছে।

বুনুয়েলের সঙ্গে তাঁর সংযোগ বেশ ফলপ্রসূ হয়েছিল। বুনুয়েলের ‘দি আন্দালুসিয়ান ডগ’ শুরু হয়েছিল একটি মেয়ের, খোলা চোখের ওপর ক্ষুর চালানোর কঙ্কাল কাঁপিয়ে দেওয়া দৃশ্যটি ছিল দালির ভাবনা। প্রদর্শনীর সময় ভয়ে শিউরে উঠেছিলেন সব দর্শক।

 

নমনীয় ঘড়ি ও অন্যান্য

১৯২৯ সালে আঁকা Illumined Pleasures ছিল কিরিকোর প্রতি তাঁর শ্রদ্ধার্ঘ্য। ছবির মধ্যে এখানে অন্য ছবি এসেছে কিরিকোর ধরনে। কমপক্ষে তিনটি আলাদা আলাদা ছবি সাজিয়ে উদ্দীপ্ত রঙে ছবিটি এঁকেছেন দালি। মাঝেমাঝে দক্ষ হাতে কোলাজ এমনভাবে মিশিয়ে দিয়েছেন ছবিতে যে আঠা দিয়ে জুড়ে দেওয়া অংশগুলোকে আর আলাদা করে চেনার উপায় নেই। ছবির মাঝবরাবর একটু নিচের দিকে একজন পুরুষ গলা টিপে ধরেছে কোনো মহিলাকে, যিনি দুহাত তুলে ভীত চিৎকার করছেন। একজনের ডানহাতে রক্তমাখা ছুরি ধরা। মাটির ওপর সেই ছুরিসমেত হাতের দীর্ঘ ছায়া। ছবির ডানদিকে একজন ম্যাজিক বাক্সের গোল জানালা দিয়ে উৎসুক আগ্রহে কিছু দেখছে। পিঠের ওপর বড় বড় পিঁপড়ে ঘুরছে, তবু সে বোড়ে ফেলছে না তাদের। ছবিটির ভূমি যেন দিগন্তবিসত্মৃত কার্ডবোর্ড, যার তিন টুকরোয় আঁকা তিনটে ছবি যেন অনুভূমিকভাবে কার্ডবোর্ড থেকে কেটে আলাদা হয়ে উঠে আসছে। যেখানে কার্ডবোর্ড থেকে কেটে আলাদা হয়ে উঠে আসছে। যেখানে কার্ডবোর্ড কাটা হয়েছে সেসব জায়গায় অতল কোনো খাদ। ওপরে বিভ্রম, মুগ্ধতা। কিন্তু তার নিচে অতল শূন্যতা ছাড়া কিছু নেই। রঙের ব্যবহার এমন যে স্বপ্ন দৃশ্যের এক আবহ তৈরি হয়। এই সময় বিছানার পায়ের দিকে তাঁর অসমাপ্ত ছবিটি ইজেলের ওপর রেখে ঘুমিয়ে পড়া পর্যন্ত গভীর মনঃসংযোগে তাকিয়ে থাকতেন তার দিকে, যাতে স্বপ্নে তিনি ছবিটিকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার মতো কোনো উপাদান পেয়ে যাবেন।

এই সময়েই (১৯৩১) দালি এঁকেছিলেন তাঁর বিখ্যাত ছবি ‘The Persistence of Memory’। গাঢ় খয়েরি ভূমির ওপর পড়ে আছে মেয়েদের পুরো হাতা বস্নাউজ যার গলা আর পিঠের অংশে একটা নমনীয় ঘড়ি আটকে আছে। বাঁদিকে একটা উঁচু বাক্সে শিথিলভাবে যেন গলে নেমে আসছে একটা ঘড়ি। আর একটা ঘড়ি ঢেকে দিয়েছে পিঁপড়ের দল। সেই বাক্সের ওপরেই রাখা হাড়ের মতো শুকনো আর পাতাশূন্য জলপাই গাছে একইরকম নমনীয় একটা ঘড়ি দুভাঁজ হয়ে ঝুলছে। দূরে উজ্জ্বল নীল আর হলুদ রঙে আঁকা আকাশ, সমুদ্র। ডানদিকে কর্কশ শক্ত পাথরের বিসত্মৃতি। স্তব্ধ, শান্ত, নিস্পন্দ, বাতাসহীন একটা পৃথিবী যেখানে সময়ের কণ্ঠস্বর শোনা যায় না কখনো।

‘In conquest of the Irrational’ এ নিজের ছবির প্রসঙ্গে দালি একবার বলেছিলেন, ‘ছবি আঁকার মুহূর্তে আমার ছবি আমি বুঝতে পারি না বলে আমার ছবি কিছু বলে না এমন নয়। বরং তাদের অর্থ এতদূর গভীর, যে কেজো দৈনন্দিনের ভাষায় তার বিশেস্নষণ করা যাবে না।’ The Persistence of Memory ছবিটি নিয়ে তিনি বলেছিলেন যে মুখের ভেতর ক্যামেমবার্ট চিজের বিশেষ ধরনের কোমল স্বাদও অনুভূতি এই ছবিতে ধরার চেষ্টা করেছেন তিনি। শব্দ নিয়ে অদ্ভুত এক খেলাও এখানে খেলেছেন দালি। ফরাসিতে ঘড়িকে বলা হয় montre। শব্দটির আর একটি অর্থ ‘দেখানো’। শিশু দালি যখন অসুস্থ হয়ে ডাক্তারের কাছে যেতেন ডাক্তার তাঁকে বলতেন ‘montrer sa Lange’ অর্থাৎ ‘জিভ দেখাও’। পরে ‘সময়’ এবং ‘জিভ’ তাঁর চেতনায় প্রায় সমার্থক হয়ে যায়। এই ছবির নমনীয় ঘড়িগুলো দালির সেই ছোটবেলার বের করা জিভের অনুষঙ্গ নিয়ে এসেছে। স্থান ও কাল তাঁর পরবর্তী অনেক ছবিতে একইভাবে নমনীয় ঘড়ি হয়ে এসেছে। ছবির মুহূর্তটি দালি এভাবে লিখেছিলেন তাঁর নোটবুকে –

একদিন সন্ধ্যায় অত্যন্ত ক্লান্ত ছিলুম, আর মাথাব্যথা করছিল সামান্য, যা সচরাচর আমার হয় না। বন্ধুবান্ধবের সঙ্গে একটা ফিল্ম দেখতে যাওয়ার কথা ছিল। শেষ মুহূর্তে সিদ্ধান্ত নিলুম যে যাব না। গালা ওদের সঙ্গে যাক, আমি বাসায় থেকে একটু বিশ্রাম নেব। খাওয়া-দাওয়ার শেষে আমরা যৎসামান্য মদ খেয়েছিলুম, বেশ কড়া। আর সবাই চলে যাওয়ার পর খাবার টেবিলের ধারে বসে আমি মশগুল হয়ে পড়েছিলুম অতিনমনীয়তা বিষয়ক দার্শনিক চিন্তায়, যা আমার কল্পনায় প্রতীকায়িত হচ্ছিল পনির-মাখনে। উঠে স্টুডিয়োয় গেলুম, আলো জ্বালালুম, দেখার জন্যে যে-ছবিটা তখন আঁকছিলুম তা কোন পর্যায়ে। এটা আমার অভ্যাস। ছবিটা পোর্ট লিগাতের কাছাকাছি এক ভূদৃশ্যের, যেখানকার পাথরগুলো একরকম স্বচ্ছ আর দুঃখী গোধূলি দ্বারা আলোকিত। সামনের দিকে ডাল ছাঁটা একটি অলিভ গাছ, পাতাহীন। আমি জানতুম যে ছবিটার ভূদৃশ্যে যে-আবহ গড়ে তুলেছিল তা রূপায়িত করতে চলেছে কোনো নতুন দৃষ্টিভঙ্গির পৃষ্টভূমি, কোনো বিস্ময়কর চিত্রকল্প, কিন্তু আমি ঘুণাক্ষরেও আঁচ করতে পারিনি যে তা ঠিক কী?

আলো নেভাবার জন্যে হাত বাড়িয়েই ছিলুম, কিন্তু সেই মুহূর্তে চোখের সামনে সমাধান ভেসে উঠল। দুটি নরম কোমল নমনীয় ঘড়ি দেখতে পেলুম, আর একটি ঝোলানো রয়েছে অলিভ গাছের ডালে। মাথাব্যথা যদিও হয়ে উঠেছিল অসহ্য, আমি সযত্নে প্যালেট সাজিয়ে আঁকতে আরম্ভ করলুম। দুঘণ্টা পরে গালা যখন ফিরে এলো সিনেমা দেখে তখন ছবিটা (যা পরে আমার বিখ্যাত ছবিগুলোর অন্যতম হয়েছিল) আঁকা সম্পূর্ণ হয়ে গিয়েছিল। আমি ওকে চোখ বন্ধ করে বসিয়ে দিলুম ছবিটার সামনে : ‘‘এক, দুই, তিন। এবার চোখ খোলো!’’ আমি খুঁটিয়ে পরখ করলাম গালার মুখম-ল, আর তাতে দেখলুম স্তম্ভিত বিস্ময়ের নির্ভুল বিস্ফার। আমি আমার চিত্রকল্পের কার্যকুশলতা সম্পর্কে নিশ্চিত হলুম, কেননা কোনো প্রহেলিকার বিশ্বাসযোগ্যতা সম্পর্কে কখনো ভুল করে না গালা। আমি ওকে জিগ্যেস করলুম, ‘‘তোমার কি মনে হয় যে তিন বছরের মধ্যে তুমি এই ছবিটা ভুলে যাবে?’’

‘‘একবার যে এই ছবিটা দেখবে সে জীবনে ভুলবে না।’’

সময় সাক্ষী, গালা ভুল বলেননি।

 

মানুষখেকো মানুষ

Autumn Cannibalism ছবিতে গল্পে ছড়িয়ে পড়তে থাকা দুজন মানুষ একটা দেরাজযুক্ত বাক্সের ওপর একে অপরকে জড়িয়ে ধরে আছে ঘনিষ্ঠভাবে। দুজনের হাতেই কাঁটাচামচ আর ছুরি। তারা খুব যত্ন করে তৃপ্তির সঙ্গে পরস্পরকে খেয়ে ফেলছে। যেন আর কিছু দেওয়ার বা পাওয়ার নেই কারো। যাপনের অসহ গস্নানি থেকে মুক্তির এই একমাত্র পথ। এই ছবির পটভূমি বিশৃঙ্খল, কর্কশ। এখানে স্বপ্নের সেই শান্ত দূরত্ব নেই।

ছবি আঁকার সঙ্গে বারবার দালি তুলনা করেছেন রন্ধনশৈলীর। মুহূর্তের স্বয়ংক্রিয় সিদ্ধামেত্ম যেমন রান্নার সময় কিছু যোগ করতে হয়, ছবির ক্ষেত্রে রং মেশানোর ব্যাপারটা একইরকম – নানা প্রসঙ্গে দালি বারবার এমন বলেছেন। এছাড়া তাঁর আরেক আকর্ষণ ছিল আসবাব। বিভিন্নরকম পরাবাস্তব আসবাবপত্রের পরিকল্পনা ছিল তাঁর। মানুষের শরীরে তিনি আবিষ্কার করেছিলেন শ্রেষ্ঠ স্বর্গীয় আসবাবের সমস্ত উপাদান এবং তাঁর প্যারানোইয়াক মানসিকতায় আসবাব এবং মৃত্যু যেন পরস্পরের নিয়ন্ত্রক। মানুষের শরীরে তিনি কল্পনা করেছেন দেরাজের সারি যার মধ্যে মৃত্যু অপেক্ষা করছে। Island of the Dead ছবিতে একটা বড় খাটের মতো কোনো কিছুর ওপর হাড়সমেত একটা অনেক পুরনো রোস্ট। আর একটি ছোট বাক্সের ওপর পুরনো, ফাটা, রংজ্বলা একটা চায়ের কাপ থেকে আকাশে উঠে যাচ্ছে ধাতব রড। বিচ্ছিন্ন বিকেলের শান্ত, নির্বাক আকাশ। ছবিটির মধ্যে একধরনের চাপা অনুপস্থিতি আছে এবং সেই নিয়ন্ত্রণ করছে ছবির সবকিছু। এরকমই আর একটি ছবি Nostalgia of the cannibal এক শান্ত অবসানের মতো আকাশ। নিচে সবুজ দিগন্তছোঁয়া মাটি। হালকা নীল একটা কাঠের টেবিলে ছটা দোয়াত। প্রতি দোয়াতের পাশে একটি ভাজা ডিম রাখা। ছটা দোয়াতেই কলম রাখা আছে। শুধু একটা কলম আটকে আছে ভাজা ডিমের ওপর।

ডিম ছিল তাঁর ফেটিশ, তাঁর দৃষ্টিবিভ্রমের এক চিরন্তন উপাদান। ফ্রাইংপ্যান ছাড়া দুটো ডিম শূন্যে ভাজা হচ্ছে – মাতৃগর্ভেই তিনি নাকি এই দৃশ্য দেখেছিলেন। জন্মের প্রতীক হিসেবে ডিম তাঁর অবচেতনায় আর স্বপ্নে বারবার এসেছে। বন্ধ চোখে হাতের চাপ দিয়ে তিনি ডিমের আকার নিখুঁতভাবে তুলে আনতে পারেন – দাবি করতেন তিনি। ১৯৩২ সালে আঁকা ‘Fried Eggs without a plate’ ছবিতে শূন্য থেকে একটা ভাজা নরম ডিম অদৃশ্য সুতোয় একটা ফ্রাইংপ্যানের ওপরে ঝুলছে। আবার ordinary French Loaf with tow fried eggs এ সাদা কাপড়ে মুখঢাকা একটি কাটাছেঁড়া মৃতদেহের মতো রুটির ওপর ভাজা ডিমের হলুদ কুসুম ছড়িয়ে পড়ছে। আবার Geophysical child wathcing the birth of the new man ছবিটিতে প্রায় স্বচ্ছ, পাতলা পর্দার মতো ডিমের আস্তরণ ছিন্ন করে একটি মানব শিশুর বাঁ হাত আর কাঁধ বেরিয়ে এসেছে বাইরে। ডিমের ভেতরে তার টানটান হয়ে থাকা পা আর মাথার আভাস। প্রাণপণে যেন সে বেরিয়ে আসতে চাইছে বাইরে। একটি ব্রোঞ্জ রঙের আফ্রিকান নারী তার ভীত শিশুটিকে এই ভূমিষ্ঠ হওয়ার মুহূর্তটি দেখাচ্ছে। ডিম ফেটে বেরিয়ে আসছে তাজা ঘন রক্তের ধারা। শুধু ছবিতেই নয়, রুটি আর ডিম তাঁর চিন্তা জগতেও রীতিমতো আলোড়ন তুলেছিল। তাঁর সারাক্ষণের সঙ্গী ছিল ‘নোটবই’ যেখানে তাঁর ভাবনাচিন্তা তিনি লিখে রাখতেন। ‘নোটবই’য়ে দালির রুটি আর ডিম বিষয়ে নানা অবিশ্বাস্য এবং মৌলিক আবিষ্কারের কথা আছে। দুটি উদ্ধৃতি দেওয়া হলো পরপর।

‘‘নভেম্বরের সকালে আকাশে যখন ঝকঝকে সূর্য, আমি বগলদাবায় পাউরুটি নিয়ে চলে যেতুম নিউইয়র্ক শহরের কেন্দ্রে। একদিন একটা দোকানে ঢুকে ডিমসেদ্ধর সঙ্গে আবার বিরাট পাউরুটি থেকে এক টুকরো খেয়ে বোকা বানালুম প্রত্যক্ষদর্শী প্রশ্নকর্তাদের। ভীরু হাসি আর কাঁধ নাচিয়ে প্রশ্নগুলোর জবাব দিলুম।

‘‘একদিন বগলে রুটি নিয়ে এভাবেই হাঁটছিলুম। একেবারে শুকিয়ে গিয়েছিল রুটিটা আর ঝরে পড়ার উপক্রম হচ্ছিল। শেষে দু-আধখানা হয়ে গেল। ভাবলুম এবার এটা থেকে নিষ্কৃতি পাওয়া দরকার। দুপুর বারোটা। ওয়ালডর্ফ অ্যাসটরিয়া হোটেলের সামনে দিয়ে হাঁটছিলুম। রাসত্মা পার হতে যাব, ব্যাস পড়ে গেলুম পা পিছলে। রুটির টুকরো দুটো জোরে আছাড় খেয়ে ছিটকে এদিক-ওদিক হয়ে গেল। একজন পুলিশ এসে টেনে তুলল আমায়। কয়েক পা এগিয়ে, পেছন ফিরে দেখি রুটির টুকরো দুটো উধাও, বেমালুম গায়েব। কে যে কীভাবে হাতিয়ে নিলে তা এক রহস্য।

‘‘অভিজ্ঞতাটি আমার কাছে একটি উদ্ভাবনার প্রস্থানবিন্দু এবং আমি তা আমার গবেষণাপত্র ‘অদৃশ্য রুটি’তে লিখে জমা দিয়েছিলুম সরবন বিশ্ববিদ্যালয়ে। এই গবেষণাপত্রে আমি ব্যাখ্যা করেছিলুম কিছু কিছু জিনিসপত্রের আচমকা অদৃশ্য হওয়ার ক্ষমতা, এক জাতীয় নেগেটিভ সম্মোহন, প্রকৃত হ্যালুসিনেশানের তুলনায় যা বারংবার ঘটে, কিন্তু তাদের স্মৃতি বিলোপকারী বৈশিষ্ট্যের জন্যে টের পাওয়া যায় না সহজে। যে জিনিসটির দিকে একজন তাকায় তা সে তখনই দেখতে পায় না, এবং প্রক্রিয়াটি মোটেই ফালতু নয়, তা মূলত একটি হ্যালুসিনেশানের ঘটনা। এই ধরনের হ্যালুসিনেশান জাগিয়ে তোলার ক্ষমতা, নিজের ইচ্ছে অনুযায়ী, বস্ত্তকে বাস্তব জগতের মাঝেই অদৃশ্য হওয়ার সম্ভাবনা সৃষ্টি করে দেয়, তা মগজ বিকারজনিত জাদুর কার্যকরী উপায়। আমাদের মনে পড়ে যে অধিকাংশ উদ্ভাবনার উপাদানটি অনৈচ্ছিক।’’

‘‘সেদ্ধ ডিমের টেবিল ব্যাপারটা অসম্ভব ছিল না। যে কেউ তা বানাতে চাইলে আমি রেসিপি বলে দিতে পারি। প্রথমে সেলুলয়েড দিয়ে টেবিলের ছাঁচ বানাতে হবে, যেমনটা ঢালাই করার জন্যে বানাতে হয়। ছাঁচের মধ্যে পস্নাস্টার ঢালার বদলে তার ভেতর সাদা ডিম ঢালতে হবে। তারপর পুরোটা চোবাতে হবে বাথটাবের গরম জলে। সাদা ডিমটা যেই কঠিন হওয়া আরম্ভ হবে তখন একটা নলের সাহায্যে ঢালতে হবে হলদে কুসুম। পুরো জিনিসটা কঠিন হয়ে গেলে, সেলুলয়েডের ছাঁচটা ভেঙে ফেলতে হবে আর তার গায়ে মাখাতে হবে গুঁড়ো-করা ডিমের খোসার ময়দা, কোনওরকম গঁদ বা চটচটে জিনিসের সাহায্যে। গুঁড়ো ঝামাপাথর দিয়ে তার গা পালিশ করা যেতে পারে, যাতে তা প্রকৃত ডিমের মতন দেখায়। ঠিক এই প্রক্রিয়াতেই গড়া যায় প্রমাণমাপের ভেনাস অব মিলো। তাহলে আপনি ভেনাসের ডিমের খোসা ভাঙতে পারবেন আর ভেতরে পাবেন ডিমের সাদা নরম মাংস এবং আরো ভেতরে পাবেন ডিমের হলদে কুসুম। পিপাসা ধরে রাখতে পারে এমন একজন বিকৃতকামের শিকার মানুষের আনন্দদায়ক পিপাসার কথা ভেবে দেখুন একবার যার মনে এই ডিমের ভেনাস খাবার ইচ্ছে আছে। গ্রীষ্মকালীন তীব্র বেদনায় সে ভেনাসের বুক তুলে নেবে রূপোর নীল চামচ দিয়ে। বেরিয়ে আসবে হলুদ কুসুম, যা সূর্যাসেত্মর আলোয় মনে হবে তৃষ্ণার আগুনের হলুদ এবং লাল রং!’’

১৯৩৩ সালে দালি আঁকলেন The Enigma of William Tell। ঘন অন্ধকারে বাদামি-নীলচে একটা ছোট্ট বেদির সামনে বাঁ হাঁটু ভাঁজ করে মুখে একধরনের প্রলুব্ধ করা হাসি ঝুলিয়ে বসে আছে একজন টুপিপরা কেতাদুরস্ত মানুষ। বাঁ পায়ের পাতা আর ডান দিকের হাঁটুতে ভর দিয়ে সে বসে। ওপরের পোশাক কেতাদুরস্ত কিন্তু কোমরের নিচে কোনো পোশাক নেই। তাঁর ডানদিকের হিপ অবিশ্বাস্য দীর্ঘ। ক্রাচে ভর দিয়ে তাঁকে কোনোমতে শূন্যে আটকে রাখার চেষ্টা হয়েছে। হিপের মাঝবরাবর মাংসের এক টুকরো খ- দৃষ্টি আকর্ষণের জন্য রাখা। মানুষটির মুখ লেনিনের মতো। লেনিনের নগ্ন পশ্চাৎ নিয়ে এই হেঁয়ালির জন্য প্রতিক্রিয়াশীল তকমা পান দালি। আদ্রেঁ ব্রতঁ এবং পরাবাস্তববাদীদের সঙ্গে তাঁর সম্পর্ক স্যাঁতসেঁতে চকোলেট হয়ে দাঁড়ায়।

উইলিয়াম টেলের কাহিনি নানাভাবে এসেছে দালির ছবিতে। দালি সাধারণভাবে সুন্দর সম্পর্কে ছিলেন তাঁর বাবার সঙ্গে। কিন্তু বাবার সর্বগ্রাসী কর্তৃত্বের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করতেন ছেলেবেলা থেকেই। একসময় তিনি বুঝতে পারেন বাবার কাছে তিনি ঘৃণার পাত্র ছাড়া আর কিছু নন। ছোটবেলায় স্বপ্নে দালি দেখতেন তাঁর বাবার সামনে তিনি দাঁড়িয়ে আছেন কাঁধের ওপর কাঁচা মাংস নিয়ে। যাতে ক্রুদ্ধ পিতা তাঁকে হত্যা না করেন। পরিবর্তে সেই কাঁচা মাংস গ্রহণ করেন। তাঁর নোটবইয়ে তিনি সবিসত্মারে তাঁর এই অনুভূতির কথা লিখেছিলেন –

‘‘পারি ফিরে দুহপ্তার মতন সংসার খরচ। আমি যেহেতু বাড়ি থেকে বিতাড়িত হয়েছিলুম, পারিবারিক নির্যাতন ছাড়া কিছুই পাইনি। সম্ভব হলে পোর্ট লিগাতে আমার বসবাস অসম্ভব করে তুলতেন বাবা। আমার নৈকট্য ছিল তাঁর পক্ষে অপমানজনক। তারপর থেকে আমি মাথার ওপর উইলিয়াম টেলের আপেল নিয়ে বেড়িয়েছি, যা আসলে আবেগতাড়িত নরমাংসভোজনের প্রতীক। পৈতৃক প্রতিশোধের তীর মেরে প্রায়শ্চিত্তমূলক বলিদান দাবি করে। পিতা কর্তৃক সন্তানকে বলি দেওয়ার চিরন্তত্মন কাহিনী। শনি নিজের দাঁত দিয়ে চিবিয়ে খাচ্ছে নিজের ছেলেদের। পরম পিতা ঈশ্বর বলি দিচ্ছেন যিশু খ্রিষ্টকে। আইজাককে পুড়িয়ে মারছেন আব্রাহাম। গুজমান এল বুয়েনো নিজের ছোরা তুলে দিচ্ছেন ছেলের হাতে। এবং ছেলের মাথার ওপর রাখা আপেল লক্ষ্য করে তীর ছুঁড়ছেন উইলিয়াম টেল।

‘‘গোর্ট লিগাতে গুছিয়ে বসার পরই আমি গালার একটা পোরট্রেট আঁকলুম, দুই কাঁধে কাঁচামাংস রাখা। এর মর্মার্থ, পরবর্তীকালে আমি বুঝেছি, ওকে খেয়ে ফেলার বদলে, আমি একজোড়া কাঁচামাংসের টুকরো খেতে চেয়েছি। মাংসগুলো হল আসলে ব্যর্থ বলিদান প্রক্রিয়ার প্রায়শ্চিত্তের শিকার – আব্রাহামের ভেড়ার মতন, এবং উইলিয়াম টেলের আপেলের মতন। ভেড়া এবং আপেল, শনির সন্তান ও যিশু খ্রিষ্টের ক্রসবিদ্ধ হওয়ার মতন, কাঁচামাংস ছিল – নরমাংসভোজী বলিদানের প্রধান শর্ত। একই মেজাজে আমার আট বছর বয়েসে একটা ছবি এঁকেছিলুম, মাথার ওপর বসানো একটা কাঁচামাংসের খ-। আমি এভাবে আমার বাবাকে প্রলোভন দেখাচ্ছিলুম যাতে আমায় না খেয়ে মাংসপি-টা খান।’’

বস্ত্ত বা মানুষের গলে যাওয়া শরীর, অতিকৃত খুলি, ক্রাচ, জুতো – এসব তাঁর ছবিতে ফেটিশ হিসেবে বারবার এসেছে। Average Atmospherocephalic Bureauerat in the Act of Milking a cranial Harp ছবিতে একজন সাদা চুলের মানুষ ক্রাচের ওপরে রাখা বিকৃত করোটির মতো Harp থেকে দুগ্ধ দোহনে ব্যস্ত। Skull with its Lyrical Appendage Leaning on a Night Table ছবিতে শূন্যে একটা গ্র্যান্ড পিয়ানো গলে একটা খুলির সঙ্গে মিশে যাচ্ছে। পিয়ানোর রিডগুলো যেন করোটির দাঁত। আবার Three young women with Heads of Flowers Finding the skin of a grand Piano ছবিতে পুষ্পস্তবকের মতো মাথাঅলা তিনটি মেয়ে নির্জন সমুদ্র তীরে সাপের খোলসের মতো একটা পিয়ানোর খোলস খুঁজে পাচ্ছে। The Burning Giraffe ছবিতে নীল পটভূমিতে সমুদ্রতীরে দূরে একটা জিরাফ পুড়ছে। শরীরের নানা জায়গায় ক্রাচ আর দেরাজ লাগানো একটি অগ্নিময় মাথাঅলা নারীর পেছনে একইভাবে ক্রাচ লাগানো একটি মেয়ে মাথায় আগুন নিয়ে দাঁড়িয়ে। চুপচাপ পুড়ে যাচ্ছে দুজনেই। Mae west’s Face which can be used as a surreal Apartment ছবিতে মে ওয়েস্টের মুখ একই সঙ্গে হয়ে যাচ্ছে একটা চমৎকার পর্দা ও চিত্রশোভিত বসার ঘর।

 

মাল্টিপল ইমেজ

শীর্ণ হাতের তিন আঙুল একটি ফল ধরে আছে – আপাতভাবে এরকম মনে হয় প্রথমে। কিন্তু যত নিবিড় হবে দেখা ছবিটি অবিশ্বাস্যভাবে বদলে যাবে জলের ধারে বাঁ হাঁটুতে মাথা গুঁজে বসে থাকা একটি বিষণ্ণ মানুষের মূর্তিতে। দৃশ্যের মধ্যে নানারকম দৃশ্য এনে দৃষ্টিভ্রম সৃষ্টি করা দালির একটি প্রিয় খেলা। Apparition of Face and Fruit Dish on a Beach ছবিটি দেখতে বসে প্রথমে মনে হতে পারে সাদা কাপড়ে ঢাকা টেবিলে লম্বা গলার একটি ফলপাত্রের ওপরে রাখা নানারকমের ফল। দৃশ্যটির মধ্যে অদৃশ্য একটি প্রতীক্ষার গল্প বলা আছে যেন। দেখতে দেখতেই মনে হবে ফলের পাত্রের মধ্যে নারী মুখের একটা স্পষ্ট আদর আর পাত্র উপচেপড়া ফলের জায়গায় একটা কুকুর দাঁড়িয়ে। Outskirt of a Paranoiac Critical Town ছবিটিতে একটি শহরের প্রবেশ পথ, সেই শহরের অনেক ভেতরে এক ঘণ্টা ঘরের প্রতিচ্ছবির মতো। আর প্রবেশ পথের সামনে ছুটে যাওয়া কিশোরীটির প্রতিরূপ যেন সেই ঘণ্টা ঘরের ঘণ্টা। একইভাবে Slave Market with Invisible Bust of Vottaire ছবিটিতে সাদা-কালো পোশাক পরা দুজন ব্যবসায়ীর শরীর আর পশ্চাৎপটের আকাশ নিখুঁতভাবে ভলত্যেয়ের মুখ হয়ে ওঠে। The Phantom Cart ছবিটি একটি অত্যাশ্চর্য কবিতা যেন। ধুধু প্রান্তরের সুদূরে একটি ঘোড়ার গাড়ি এগিয়ে যাচ্ছে দিগমেত্মর দিকে, যেখানে জনবসতি আছে বলে মনে হয়। শেষ বিকেলের দীর্ঘ আলোয় ঘোড়ার গাড়ি আর তার টুপি পরা চালকের ছায়া পড়েছে মাটিতে। কিছুক্ষণ চোখ অন্যদিকে ফিরিয়ে আবার ছবিটি দেখলে মনে হবে ঘোড়ার গাড়িটির যাত্রা শেষ হয়েছে। যাকে চালক বলে মনে হয়েছিল তা আসলে দূর শহরের কোনো গম্বুজ। যেন একই সঙ্গে চালক চালিয়ে নিয়ে যাচ্ছে গাড়িটিকে আবার সেই সঙ্গেই সে গাড়িতে নেই।

The Sleep ছবিটি একটি প্রহেলিকার মতো। যেন বিসত্মীর্ণ মাঠে নানা আকারের ক্রাচে টাঙিয়ে রাখা রোদে শুকোতে দেওয়া কাপড়ের মতো একটি মুখ। ঘুমে চোখ বুজে আছে; ঠোঁট শিথিল। মুখটির মধ্যে গভীরতম ঘুম থমথম করছে। ঘুমকে কীভাবে ভাবতেন দারি, নোটবইয়ে তার বিবরণ পড়া যাক এবার –

‘‘আমি প্রায়ই ভাবি যে ঘুমের দানবটা একটা ভীষণ ভারি মাথার মতন, দেহটা সরু সুতোর মতন, যা বাস্তবের আঁকশিতে ঝোলানো, যে কারণে ঘুমন্ত অবস্থায় আমরা ঝুলে থাকি। অনেক সময়ে আঁকশিগুলো সরে যায় আর আমরা পড়ে যাই। ঘুমোবার সময়ে আচমকা শূন্যে অধঃপতনের অভিজ্ঞতা আছে নিশ্চয়ই পাঠকদের, যা থেকে চমকে জেগে উঠি, ভয়ে ধড়ফড় করতে থাকে বুক। এ হলো জন্মাবার নির্মম স্মৃতি, বিতাড়িত হয়ে বাইরে অধঃপতনের মুহূর্ত।

ফ্রয়েডকে ধন্যবাদ, উড়ালের যাবতীয় প্রাসঙ্গিকতায় আছে যৌনতার বৈশিষ্ট্য, বিশেষ করে তার উৎসে। উড়ন্ত স্বপ্নের তুলনায় আর কোনও ব্যাপারে স্বর্গীয় গুরুত্বে স্বচ্ছতা নেই। এটা হল আকাশকে জয় করার ভ্রামিত্মময় মুখোশ। ওই প্রাকস্বপ্নে পাওয়া যাবে আজকের যুগের প্যারাশুট লাফ, যেন আকাশ থেকে ঝরে পড়ছে নবজাতকের দল, যারা নিজেদের জন্মের আতঙ্ক কাটিয়ে উঠতে পারেনি, বেবাক ঝাঁপিয়ে পড়তে চায় শূন্যে, আবার যে কোনও উপায়ে জন্মাবার অভিলাষে, সিল্কের পস্ন্যাসেন্টায় ঝুলতে থাকে মায়ের মতন প্যারাশুটে।’’

 

 

নার্সিসাস : দালির ছবি

১৯৩৮ সালে, সিগমুন্ড ফ্রয়েডের মৃত্যুর আগের বছর, জুলাইয়ে দালি লন্ডনে তাঁর সঙ্গে দেখা করতে যান ‘মেটামরফোসিস অফ নার্সিসাস’ ছবিটি নিয়ে। এই বিষয়টি নিয়ে পরদিন সেত্মফান ৎজোয়েইগকে ফ্রয়েড লিখলেন : ‘এতদিন পর্যন্ত আমি বিশ্বাস করতাম যে আমাকে যারা প্রায় তাদের ধর্মগুরু হিসেবে দেখে, সেই স্যুররিয়ালিস্টরা ১০০ শতাংশ পাগল (অথবা অ্যালকোহলের মাত্রার মতো ৯৫ শতাংশ, বলা যায়)। কিন্তু এই তীব্র জ্বলজ্বলে চোখের তরুণ স্পেনীয় তার অসাধারণ শিল্প-দক্ষতার জন্য বিশেষরকম গুরুত্ব দাবি করে। আসলে এই ছবিটির সৃষ্টিকে যদি বিশেস্নষণ করে ব্যাখ্যা করা যায়, সেটা যথেষ্ট কৌতুহলোদ্দীপক হবে।’ এই চিঠি ফ্রয়েড যখন লিখছেন তখন তাঁর বয়স বিরাশি বছর। বিস্ময় লাগে যে, অত বয়সেও কত সজীব আর জাগ্রত ছিল তাঁর মাথা আর কত সূক্ষ্ম ছিল রসবোধ (অ্যালকোহলের শতাংশের প্রসঙ্গে প্রায় ফিচেলের মতো আনা হয়েছে যেখানে)।

একটি স্থির বস্ত্ত কীভাবে একই সঙ্গে অসংখ্য বস্ত্তর প্রতিরূপ হয়ে আসতে পারে তাঁর নানা ছবিতে সেই বিভ্রম সারাজীবন ছড়িয়ে রেখেছেন দালি। দিগন্তরেখার দিকে বিকেলের আলো মেখে এগিয়ে যাওয়া ছোট্ট একটা ঘোড়ার গাড়ির কোচোয়ান একই সঙ্গে হয়ে ওঠে ঝাপসা আলোয় কোনো গির্জার চূড়া। যা ঘোড়ার চলমান পা, সেই পা যেন একই সঙ্গে মেঠো পথের রেখা মনে হয় (দ্য ফ্যান্টম কার্ট)। দুজন সাদা-কালো পোশাকের দাস ব্যবসায়ী পেছনের শূন্যতাকে জড়িয়ে নিয়ে হয়ে ওঠে ভলতেয়ারের প্রবীণ মুখচ্ছবি (সেস্নভ মার্কেট উইদ ইনভিজিবল বাস্ট অফ ভলতেয়ার)। একজন অর্ধশায়িত নারী একই সঙ্গে হয়ে ওঠে ঘোড়া এবং সিংহ। Double image এর এমন নিখুঁত বিভ্রম তাঁর সারাজীবনের অসংখ্য কাজে ছড়িয়ে দিয়েছেন দালি একজন গবেষকের মতো নিষ্ঠায়। আমার ব্যক্তিগত অনুভূতি এরকম : সমস্ত শিল্পীরাই সাধারণভাবে তাঁর ছবির মূল প্রতিমা বা প্রধান কাঠামোর ওপর মনঃসংযোগ এবং যত্নকে নিবদ্ধ রাখেন। এমন কোনো বাহুল্য তিনি রাখবেন না যা ছবির মূল জায়গা থেকে দর্শকের দৃষ্টিকে সরিয়ে দেয় এবং ছবির কেন্দ্রাবিঘ শক্তিকে টলিয়ে দেয়। দর্শকের জন্য তিনি হয়ে ওঠেন একজন সার্থক নির্দেশক, যিনি দর্শকের ফোকাস ঠিক করে দিচ্ছেন, তাঁর ছবির রসগ্রহণে তিনি যাতে বিভ্রান্ত না হয়ে পড়েন। দালি যেন ঠিক এর বিপরীত। তিনি যেন বড়সড় এক মেলায় নামিয়ে দিচ্ছেন আমাদের, আর নিজের মতো করে খুঁজে নিতে বলছেন যা দেখার। আসিত্মনের নিচে লুকোনো তাঁর তাস – ‘double image’ এবং ‘optical illusion’.

দালির optical illusion এর পেছনে আছে একটি সাধারণ ধারণা – কোনো দৃশ্যবস্ত্তর দিকে সম্পূর্ণ স্থির দৃষ্টিতে দীর্ঘক্ষণ তাকিয়ে থাকলে – যখন চোখের তারা একটুও নড়বে না এবং চোখের পাতাও পড়বে না – দৃশ্যটি যেন অন্তর্হিত হয়ে যায়। দেয়ালে জলের দাগের নকশাকে যখন আমরা ড্রাগনের অগ্নিস্রাবী মুখ হয়ে উঠতে দেখি – তখন সেই বিভ্রম জন্মায় এই স্থির দৃষ্টি থেকেই। রেটিনায় স্থির হয়ে থাকা কোনো বস্ত্তকে আমাদের চোখের স্নায়ুপুঞ্জ অগ্রাহ্য করে। রেটিনা অথবা বস্ত্তটির মধ্যে ন্যূনতম একটা অস্থিরতা দরকার বস্ত্তটিকে দৃষ্টিগোচর করার জন্য। যখন কোনো বস্ত্তর ওপর আমাদের চোখ আটকে যায়, তখন বহিঃসীমার বস্ত্তদের সাধারণভাবে আর দেখতে পাই না আমরা। আবার সেই বস্ত্তটির রেটিনাল ইমেজ যখন গভীর মনোযোগের কারণে পুরোপুরি স্থির হয়ে যায, তখনো সেই বস্ত্তটি একইভাবে অন্তর্হিত হয়।

‘মেটামরফোসিস অফ নার্সিসাস’ ছবিটিতে দালি ওভিদের কাহিনির ছায়ায় নার্সিসাসের রূপান্তর দেখিয়েছেন – রং আর প্রতীকের বিভিন্ন স্তরের মধ্যদিয়ে যে রূপান্তরে পৌঁছতে হয়। ছবিটির বাঁদিকে হাঁটুতে মাথা গুঁজে বসে থাকা একজন মানুষের অতিকৃত শরীর। হলুদ রঙের শরীরটিতে প্রাণের আভাস নেই যেন। মুখ নেই। এমনকি তার বিখ্যাত রূপের চিহ্নমাত্রও এই নার্সিসাসে নেই। স্থির জলের ওপর সে ঝুঁকে। জলে তার শরীরের অংশ প্রতিফলিত। মাথার কয়েকগাছি চুল পেছনের জ্বলন্ত আগুনে মিশে যাচ্ছে। বাসনার রক্তিম আগুন থেকে এখন মুক্ত সে, কিন্তু পশ্চাৎপটের সেই আগুন তাকে জলের সামনে থেকে সরে যেতে দিচ্ছে না। কালো আর লাল রঙে আঁকা বড় একটা পাহাড়। ছবিটির এই অংশে গাঢ় লাল, কালো আর হলুদ রং ব্যবহার করা হয়েছে। ছবির ডানদিকের অংশটি তুলনায় অনেক বেশি জটিল। নানারকম প্রতীক আর প্রতিমার চাপ এই অংশে। প্রতীকী অর্থে যা আসে না, যা অপরিকল্পিত এবং প্রেরণানির্ভর এমন একটি বিন্দুও কখনো আঁকেন না দালি। সবকিছুই সেখানে সুগ্রথিত পরিকল্পনার অংশ হিসেবে আসে। ছবির ডান অংশে বাঁ দিকের সেই হলুদ মানুষটি যেন মায়াবীর মতো জাদুবলে একই ভঙ্গিতে বসে থাকা একটি হাড়ের মানুষ হয়ে গেছে। স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকলে হাড়ের মানুষটি পিছিয়ে যায় আর সামনে আসে হাড়ের একটি হাত। সেই হাত ডিম ধরে আছে। ডিমের ফাটা খোলা থেকে সাদা একটি ফুল বেরিয়ে আসছে। হাতের পেছনে খানিকটা দূরে একটি নির্বাপিত অগ্নিকু-। হালকা ধোঁয়া উঠছে। পাথর হয়ে যাওয়া ফাটলযুক্ত বুড়ো আঙুল বেয়ে পিঁপড়ের সারি উঠে আসছে ফাটা ডিমের দিকে। হাতটির অদূরে মাংসের টুকরোর ওপর ঝুঁকে পড়েছে একটা কুকুর। কুকুরটাও যেন পাথর হয়ে উঠছে নার্সিসাসের মতো। সম্ভবত সে-ও মাংসের টুকরোর ওপর অনন্তকাল ঝুঁকে থাকবে একইভাবে, নার্সিসাস যেভাবে ঝুঁকে আছে তার প্রতিরূপের দিকে। নীল এবং ধূসর রং ব্যবহার হয়েছে এখানে, পরিব্যাপ্ত বিষণ্ণতা আর মৃত্যুর আভাস দিতে। অনেক দূরে মেটে হলুদ রঙের পাথুরে রাসত্মায় বিলাপরত নগ্ন নারীদের একটি দল। তারা বিলাপ করছে নার্সিসাসের প্রত্যাখ্যানের জন্য। হালকা হলুদ এবং লাল রং এখানে জীবনের সাধারণ গতিকে প্রকাশ করছে। এবং হয়তো ক্ষতিকেও। গোটা ছবিটার মধ্যে এই নারীরাই শুধু যূথবদ্ধ, যে যূথবদ্ধতা তাদের যন্ত্রণা ও শোককে সহনীয় করে তোলে। তাদের আশা ফুরোয়নি, তাই তারা মুখ তুলে থাকতে পারে। কিন্তু একা নার্সিসাস, একা কুকুরটি, আর ছবির ডানদিকে দাবার ছকের ওপর উঁচু বেদিতে রাজার মতো ঔদ্ধত্য এবং তাচ্ছিল্য নিয়ে নারীদের থেকে মুখ ফিরিয়ে দাঁড়িয়ে থাকা নগ্ন তরুণ – নার্সিসাসের আরো একটি রূপান্তর হয়তো যে – এরা প্রত্যেকেই নিজেকে নিয়ে চ্যুত, বিচ্ছিন্ন, উদ্ধারহীন, নিচুমুখ, একা। দাবার ছকের ওপর দাঁড়িয়ে থাকা নার্সিসাসের মাথার ওপরে পাহাড়ের চূড়ায় প্রায় অদৃশ্য সাদা পাথরের আরেক নার্সিসাস – জলের ধারে মাথা গুঁজে বসে থাকা মানুষটির একটি হুবহু মূর্তি যেন নার্সিসাসের চূড়ান্ত পরিণতির আগাম ঘোষণার মতো। ছবিটির সামনের অংশ হাঁটুতে মুখ গুঁজে বসে থাকা হলুদ নার্সিসাস সামনের স্থির জল আর পেছনের পাথরের দেয়ালে যেন দ-প্রাপ্ত বন্দি। স্তব্ধ জল আর ঘিরে থাকা পাথরও বিষণ্ণ আর একা – নার্সিসাসের মতো। নার্সিসাসের অভিশাপের অংশভাক যেন তারাও।

পাথরের যে আঙুল ডিম তুলে ধরেছে তা মৃত ইকোর হাত আর সেই ডিম যেন নার্সিসাসের অবশেষ। ডিম ফাটিয়ে জেগে উঠছে যে ফুল, তাকে যত্নে ধরে আছে সেই হাত। যেন দেখছে, আশা খুঁজে নিচ্ছে বিবর্ণ আশাহীন সেই ফুলের মধ্যে। ইকোর পাথরের আঙুলে পিঁপড়ের সারি যেন বলছে সৌন্দর্য চিরজীবী নয়। তারও অবসান আছে। যেমন আমাদের সমস্ত বাসনারও আছে স্থির নিরঞ্জন – যেখানে বাসনাময় হলুদ নার্সিসাস আর ইকোর পাথরের হাত মিশে যায়। আর আলাদা করা যায় না তাদের।

দালি একবার বলেছিলেন, ‘তোমাকে বিভ্রামিত্ম সৃষ্টি করতে হবে, পরিকল্পিতভাবে। সৃজনশীলতাকে এভাবেই মুক্ত করা যায়।’ দালির এই ছবি তারই প্রমাণ যেন। ছবিতে স্পষ্ট দুটি অংশ – একদিকে হাঁটুমুড়ে নতমুখে বসে থাকা নার্সিসাস আর অন্যদিকে ইকোর পাথরের হাতে ডিম। এবার একটু দূরে থেকে স্থির চোখে একাগ্রমনে ছবিটির দিকে তাকিয়ে থাকলে হলুদ নার্সিসাস আমাদের চিন্তার বাইর চলে যায় আর আমরা দেখি পাশাপাশি হলুদ আর ধূসর রঙের দুটি হাতে গোল দুটি বস্ত্ত ধরা আছে। একেই বলা যায় নার্সিসাসের রূপান্তরের চূড়ান্ত মুহূর্ত। আমাদের দৃষ্টি-রূপান্তরের হাত ধরে রূপান্তরিত হচ্ছে নার্সিসাস।

 

নার্সিসাস : দালির কবিতা

 

ঝকঝকে আকাশে, ছুটে যাওয়া কালো মেঘের ফাঁকে,

অদৃশ্য দাঁড়িপাল্লা দুলে যাচ্ছে বসমেত্মর।

উঁচু পাহাড়ের চূড়ায় বরফের দেবতা –

উদভ্রান্ত প্রতিচ্ছবির ওপর ঝুঁকে পড়ছে তার ঝকঝকে মুখ

যেন বাসনায় গলে নেমে আসছে তরল বরফ

আর স্খলনের গুমরে ওঠা শব্দে নিঃশেষ করে দিচ্ছে নিজেকে

অথবা শীতের ওড়না যেন সরে যাচ্ছে জল-আয়না থেকে

আর বিদ্যুৎ চমকের মতো প্রথম সে আবিষ্কার করছে নিজের মুখ।

 

তার দেবত্ব হারিয়েছে বলে

আদিগন্ত মালভূমি যেন শোকে চূর্ণ করে দিচ্ছে নিজেকে

আর ফিরে যাচ্ছে নিস্তব্ধ নিঃসঙ্গ মরচে ধরা আকরিক জীবনে

যেন সেই ভারে দেবতার ভূমি উঠে আসছে ওপরে

আর্টেজিয় ঝর্নার মতো ঘাস হাত বাড়িয়ে দিচ্ছে আকাশে

আর জেগে উঠছে দৃঢ় কোমল শক্তফুলের বলস্নম হাতে যোদ্ধারা

যখন জন্ম নিচ্ছে নার্সিসাস।

 

কামপ্রবণ নারী পুরুষরা ততক্ষণে

কামনার চিরাচরিত মুদ্রা ফুটিয়ে তুলেছে শরীরে

আর বুঁদ হয়ে আছে কূল ছাপানো এই জাগরণ নিয়ে।

সবাই জড়ো হচ্ছে একে একে –

উগ্র তৈলাক্ত মধুর হিন্দু

চওড়া পিঠে সূর্যের আলো নিয়ে বসে থাকা কাতাপলানিয়ান

মাথায় সৌরকণার মাংস আর মেঘলা হাঁটুর ভাঁজে

গণিতের অস্পষ্টতা নিয়ে সোনালি চুলের মাংসভুক জার্মান

আর উন্মুখ ক্ষরণ গ্রন্থি ও জলপাই রঙের বিষণ্ণতা নিয়ে

ইংরেজ রাশিয়ান সুইডিশ আমেরিকান

আর শ্যামবর্ণ দীর্ঘ আন্দালুসিয় মেয়েরা।

 

ওদিকে দূরে গড়িয়ে নামছে দিনাবসানের ছায়া

আর জলের ধারে এক নগ্ন তরুণ শরীর কেঁপে উঠছে ঠা-ায়।

অস্পষ্ট জলের আয়নায় ঝুঁকে পড়ে নার্সিসাস

আর বাসনার কোমলস্পর্শে তার সাদা শরীর

কঠিন হয়ে ওঠে ধীরে ধীরে আর

নিজের মাংসের ফুল ও বালুকণায় তার সময় চলে যায়।

দুরন্ত এক ঘূর্ণি তার অসিত্মত্ব নিঃশেষে মুছে দেয়, তখন

অনেক নিচে তার নিজেরই ছায়া গান গাইছে অবসানের

আর অসংখ্য প্রতিফলনের ভিড়ে নার্সিসাস হারিয়ে ফেলেছে তার শরীর

বালি-কাচের মতো যা আর ফিরবে না কোনদিন।

 

হাজার ছায়ার ভিড়ে নার্সিসাস, তুমি

হারিয়ে ফেলেছো তোমার বিভ্রান্ত শরীর

আর ভালবাসার হলুদ মৃত্যু নিয়ে তুমি

ভেঙে পড়ছো পোখরাজ রঙের ঢালের ওপর

দ্যাখো, কালো পাথরের ঢাল বেয়ে, বুনো গন্ধের স্রোত ভেঙে

রাত্রির অনুজ্জ্বল হাঁ-মুখে নেমে যাচ্ছে

তোমার হেরে যাওয়া সাদা শরীর।

সেই হাঁ-মুখের এক প্রামেত্ম ভোরের প্রথম রূপোলি-লাল রেখা

আর শিরামুখ ফেটে সারা আকাশ যেন হয়ে উঠছে

এক রক্তস্নাত জেটি।

স্বর্গীয় সম্মোহ আর প্রতিসাম্যের ঘুমে ডুবে আছে তোমার মাথা

চামড়ার কাগজের মতো শুকনো যার শাঁস

আর বীজ থেকে শস্যের মতো এগিয়ে আসছে তোমার রূপান্তর।

তোমার মাথা থেকে জলে খসে পড়লো বীজ –

ক্লামিত্মর ঘুম মানুষকে পৌঁছে দেয় শস্যের জীবনে

আর বাসনার মোহাবরণে সেখানে পৌঁছয় দেবতারা।

এতো স্থির তুমি নার্সিসাস, যে মনে হয় জেগে নেই তুমি।

হারকিউলিসের মতো যদি কর্কশ ও বাদামি হতে

লোকে হয়তো বলতো: বিরাট ওক গাছের গুঁড়ির মতো ঘুমোচ্ছে সে।

কিন্তু বয়ঃসন্ধির গন্ধমাখা তোমার মুখ ঠিক ফুলের মতো নরম।

 

এখন এগিয়ে আসছে এক মহা-রহস্য, মহান এক বিবর্তন

নিজের প্রতিচ্ছবিতে মগ্ন স্থির নার্সিসাস যখন

মাংসাশী লতার ধীরে গ্রাসে অদৃশ্য হয়ে যাচ্ছে

শুধু তার সাদা ডিমের মতো মাথা ফুটে আছে বিভ্রম জাগিয়ে।

আবার গুটিপোকার নরম অন্তর্জীবনের মতো হয়ে উঠছে তার মাথা

জলের আঙুল তুলে ধরেছে তাকে

চেতনাহীন হাত

ভয়ংকর হাত

বর্জ্য খেয়ে বেড়ে ওঠা হাত

তার প্রতিফলিত মরণশীল হাত –

যখন চিড় ধরবে খুলিতে আর ভেঙে ফেটে পড়বে মাথা

তখন সে হয়ে উঠবে ফুল

গালা – আমার নার্সিসাস

 

‘মেটামরফোসিস অফ নার্সিসাস’ আঁকার পরে দালি এই দীর্ঘ কবিতাটি লেখেন, সেই একই বিষয়ে। হয়তো দালি ভেবেছিলেন এই কবিতা তাঁর ছবির নানা স্তর, আর বিভিন্ন প্রতীকের সমাবেশ দর্শককে বিসত্মারে ছবিটি গ্রহণ করতে সাহায্য করবে। ১৯৩৭ সালে Editions Surrealistes এ কবিতাটি প্রকাশিত হয়। এডোয়ার্ড জেমস ইংরেজিতে অনুবাদ করেন। নিউইয়র্কের জুলিয়েন লেভি গ্যালারি প্রকাশ করে সেই অনুবাদ। বাংলায় এই তর্জমা সেই ইংরেজি অনুবাদের অনুসরণে।

অগ্নিসূক্তের মতো দালির এই কবিতা। এখানে ছবিটির বিশেস্নষণ, ভাবসম্প্রসারণ প্যারাফ্রেজ কিছু মাত্র নেই। নিজের জোরে সে দাঁড়িয়ে আছে ওক গাছের মতো সুবিশাল, বিস্ময়কর, একা। প্রতীকে, রঙের স্রোতে ছবিকে ভাসিয়ে দিয়েছেন তিনি। কিন্তু রং যা ছুঁতে পারে না সেই অন্তর্গত বোধ রৌদ্রে খরশান তরবারির মতো ঝকঝক করে ওঠে তাঁর কবিতায়। ‘When his white torso folded forward fixes itself, frozen/ in the silvered and hypnotic curve of his desire/ when the time passes/ on the clock of the flowers of the sand of his own flesh/ Narcissus looses his being in the cosmic vertigo’। কোনোভাবেই ‘When time passes/on the clock of the flowers of the sand of his own flesh’ রঙের ভাষায় বলা যেত না। কবিতার শেষ দিকে যেখানে স্থির নার্সিসাস মাংসাশী গুল্মের ধীর জারণ-প্রক্রিয়ায় অদৃশ্য হয়ে যাচ্ছে আর তার দৃষ্টি ভ্রমকারী সাদামাথা গুটিপোকার অন্তর্জীবন নিয়ে ‘held up by the tips of water’s fingers/ at the tip of the fingers of the insensate hand/ of the terrible hand/ of the excrement eating hand/ of the mortal hand / of his own reflection’ সেখানে বারবার নতুন বিশেষণে সমৃদ্ধ হয়ে ‘হাত’ ফিরে এসেছে। এই হাত অনন্ত সময়ের। শব্দটি বারবার ফিরে আসায় যে অভিঘাত – একমাত্র কবিতাই সৃষ্টি করতে পারে সেটা।

 

শেষ কথাটি

ক্যাথারিন হিউম-এর ফ্যান্টাসি অ্যান্ড মিমেসিস গ্রন্থে তাও যুগের একজন চৈনিক দ্রষ্টার কথা লিখেছিলেন যিনি একদিন স্বপ্নে নিজেকে প্রজাপতি হিসেবে দেখার পর থেকেই বুঝতে পারছিলেন না যে তিনি নিজেই আসলে প্রজাপতি কিনা যে দার্শনিকের স্বপ্ন দেখছে। দালির ছবির জগৎ একই রকম রহস্য ফ্যান্টাসি আর বিভ্রমের। যেখানে সর্বাংশে নিমজ্জনের পর ভেসে থাকে সেই আদি অকৃত্রিম আর মৌল প্রশ্নটি – নিজেকে নিয়ে।

Leave a Reply