logo

সালভাদর দালি খণ্ডচিত্রে আত্মপরিচয়

ভাষান্তর : হা সা ন  ফে র দৌ স

প্রথম অধ্যায়

আমি কী খাই তা জানি, কিন্তু কী করি, তা আমার জানা নেই।

সৌভাগ্যবশত, আমি সেইরকম একজন মানুষ নই, যার মুখ খুললেই দেখা যাবে দাঁতে লেগে আছে শাকপাতার টুকরো। না, আমি যে অন্যের চেয়ে বেশি ভালো করে দাঁত মাজি, তা নয়।  আসল কারণ হলো আমি আদৌ শাকজাতীয় খাবার খাই না। অন্য সকল খাদ্যদ্রব্যের মতো পাতাশাকের ক্ষেত্রেও আমি সবিশেষ নৈতিক ও নান্দনিক গুরুত্ব আরোপ করে থাকি। তাছাড়া আমি কী খাই না খাই, সে ব্যাপারে কঠোর নজরদারির জন্য তো বিরক্তি নামক প্রহরী সতত প্রহরাময়।

বস্ত্তত আমি কেবল সেসব দ্রব্য ভক্ষণ করি যাদের সুনির্দিষ্ট আকার রয়েছে, যে আকার প্রচলিত বুদ্ধিমত্তা দ্বারা নির্ধারণ সম্ভব।  শাকপাতা জাতীয় খাদ্য আমার অপছন্দ, কারণ শাকের কোনো আকার নেই।

এ-ব্যাপারে আমি সুনিশ্চিত – এবং সেকথা উঁচু গলায় বলতে আমার কোনো দ্বিধা নেই – শাকের ভেতর খাদ্য গুণাগুণসম্পন্ন একমাত্র বস্ত্ত যা আছে তা হলো বালু।

শাকের ঠিক বিপরীত হলো খোলা বা শক্ত খোসা। সব  ধরনের খোলাযুক্ত খাদ্য, বিশেষত ছোট শামুক, আমার বিশেষ প্রিয়। এই খোলা, যা বর্ম ভিন্ন অন্য কিছু নয়, তা এই অতীব মৌলিক ও ধীমান ধারণার প্রকাশ যে হাড়গোড় দেহের ভেতরে নয়, বাহিরে থাকা উচিত। খোলাযুক্ত প্রাণীর কথা ধরুন। এরা নিজের দেহজ অস্ত্রবলে বহির্গত সকল দুষ্টতা প্রতিহত করতে সমর্থ। এই খোলস যেন পোক্ত ও নিবিড় এক জলযান, যা সে জলযানের ভেতরের যাত্রীকে – সর্বশক্তিমান রাজকীয় আগ্রাসন, অর্থাৎ প্রবল আহারেচ্ছা, ভিন্ন – সকল বহিঃআক্রমণ থেকে রক্ষায় সমর্থ। ভাবুন তো, কী চমৎকার একটা ব্যাপার যখন আমরা ক্ষুদ্র কোনো পক্ষীর খুলি ভাঙি। (মানুষের ভেতরে যে মানুষখেকো সত্তা রয়েছে, পাখির খুলি ভাঙার ভেতর দিয়ে সেই দেবদূতকে জাগিয়ে তোলা হয়। দেল্লা পোরতা তাঁর ন্যাচারাল ম্যাজিক গ্রন্থে টার্কি হত্যা না করে তা কী করে রান্না সম্ভব তার রন্ধনপ্রণালি দিয়ে গেছেন, যেখানে বলা আছে কীভাবে সেই টার্কি একই সঙ্গে রন্ধনকৃত অবস্থায় ও তাজা ভক্ষণ সম্ভব।) বলুন, মগজজাতীয় খাদ্য এছাড়া আর কীভাবে ভক্ষণ সম্ভব? খুদে পাখিরা অনেকটা খুদে কাঁকড়ার মতো। তাদের বর্ম নিজেদের চামড়ার সঙ্গে যুক্ত। কথা প্রসঙ্গে বলছি, পাওলো উসেলো বর্মের ছবি অাঁকতেন, যা দেখে মনে হতো খুদে অরতোলান পাখি, আর তা এমন আশ্চর্য দক্ষতা ও জাদুময়তা দিয়ে তিনি অাঁকতেন যে মনে হতো তিনি নিজেও যেন সত্যি সত্যি এক পাখি। তার নামও করা হয়েছিল পাখির নামানুসারে।

আমি বরাবর বলেছি, মানবদেহের সবচেয়ে দার্শনিক অঙ্গ হলো তার চোয়াল। ভাবুন তো, আপনি ধীরে ধীরে এক হাড়খন্ডকে চিবিয়ে তার শেষ রসটুকু আপনার শক্ত দাঁতের ফাঁকে চূড়ান্ত আলিঙ্গনে আবদ্ধ করছেন, আর তা আপনাকে এই বিশ্বাসে উদ্বুদ্ধ করাচ্ছে যে, পুরো পরিস্থিতি আপনার পূর্ণ নিয়ন্ত্রণে। এর চেয়ে গভীরতর দার্শনিক মুহূর্ত আর কী হতে পারে? এই তো সেই মুহূর্ত, যখন সত্যের প্রকৃত স্বাদ আপনি অনুভব করছেন, নির্মোক ও নম্র সে সত্য, যা আপনার দুই দাঁতের ফাঁকে অবস্থান করছে।

আত্মসম্মানবোধসম্পন্ন যে-কোনো খাদ্যদ্রব্য একবার তার নিজস্ব আকার অক্ষুণ্ণ রাখতে সমর্থ হলে তাতে আর এমন কিছুই অবশিষ্ট থাকে না যা কি না পিচ্ছিল, আঠাল, কম্পমান, অস্বচ্ছ বা অপমানজনক। হতে পারে সে খাদ্যদ্রব্য কোনো মীন অক্ষির আঠাল লবণ-স্বাদ, কোনো পক্ষীর গুরুমস্তিষ্কের পিচ্ছিল অস্থিমজ্জা, অথবা কোনো চমৎকার শুক্তি বা শামুক (আমি সব সময়েই সুপের বাটিতে পরিবেশনকৃত স্পষ্ট আকারবিহীন শুক্তি খেতে আপত্তি করে থাকি, এমনকি সে যদি একদম টাটকা ও পৃথিবীর সেরা শুক্তি হয়, তবুও)। প্রশ্ন উঠতে পারে, আমি কি ক্যামেমবেয়ার পনির খেতে ভালোবাসি? সে পনির তো নিজের আকার অক্ষুণ্ণ রাখতে সমর্থ নয়। বস্ত্তত ক্যামেমবেয়ার পনির আমার পছন্দ, কারণ সে মোটেই আকারহীন নয়। এই পনির যখন পরিপক্ব, অর্থাৎ সে গলতে শুরু করে, তার আকার দাঁড়ায় ঠিক আমার প্রিয় নরম হাতঘড়ির মতো। যেহেতু এই পনির তার মৌল সত্তার কৃত্রিম ভাব-সম্প্রসারণ, অতএব – তা যতই অসম্মানজনক হোক না কেন – নিজের এই অবস্থার জন্য তাকে পুরোপুরি দায়ী করা যায় না। তদুপরি আমি একথাও যোগ করতে চাই, কেউ যদি পালংশাকের আকারে ক্যামেমবেয়ার পনির তৈরি করতে চায়, তাহলে সে পনিরও আমি ছুঁয়ে দেখব না।

উডকক পক্ষী, তা যদি বেশ দামি ব্রান্ডিতে ভিজিয়ে চমৎকার ভাজাপোড়ার পর নিজের গাদে সাজিয়ে সাচ্চা ফরাসি রেস্তোরাঁর ঐতিহ্যে পরিবেশিত হয়, আমার কাছে তা খাদ্য হিসেবে এই বিশেষ শাখার সেরা সভ্য নিদর্শন হিসেবেই বিবেচিত হবে। এই পাখির কোমল দৈহিক গঠনতন্ত্র, বলতে পারেন, তখন ঠিক যেন রাফায়েলের করা চিত্রকর্মের ন্যায় নিখুঁত সংগতিসম্পন্ন।

সোজা কথায়, আমি যা বলতে চাই তা হলো, কী খেতে চাই, সে ব্যাপারটা আমার নিশ্চিতভাবে জানা আছে। আমার চারপাশের মানুষকে যখন প্রয়োজনের সুনির্দিষ্টতা ছাড়া যা খুশি খেতে দেখি, তখন বিস্মিত না হয়ে পারি না।

নিজের ইন্দ্রিয়ের কাছে আমি কী চাই সেকথা যদিও আমি নিশ্চিতভাবে জানি, কিন্তু নিজের অনুভূতি – যা কি না সাবানের বুদ্বুদের মতো কোমল ও ভঙ্গুর – তার কাছ থেকে কী চাই আমি তা জানি, সেকথা বলা যাবে না। আমার চরিত্রের যে অতিনাটকীয় ও অস্বাভাবিক দিকগুলি আছে, বিশেষত তার চূড়ান্ত ফলাফল, সে বিষয়ে আমার নিজেরই কোনো আগাম ধারণা থাকে না। সত্যি বলতে কি, অধিকাংশ ক্ষেত্রে আমি নিজেই তার বিস্ময়াহত দর্শক। দেখা যায়, সেসব ঘটনার চরম পরিণতি অতি ওজনবিশিষ্ট, চূড়ান্ত ও ভয়াবহ পরিণামবাহী ধাতব বলের আকার নিয়েছে। আমার অনুভূতিসমূহ, যা শতসহস্র বহুবর্ণিল বুদ্বুদের মতো, তা যখন নিজের ক্ষণস্থায়ী জীবন থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে অলৌকিকভাবে পৃথিবী – অর্থাৎ বাস্তব জগৎ – স্পর্শ করে ও অর্থপূর্ণ বৈশিষ্ট্য অর্জন করে, তা যেন নিজের স্বচ্ছ ও অশরীরী অস্তিত্ব পরিবর্তন করে বোমার মতো এক ছায়াময়, ধাতব ও ভয়ংকর বস্ত্ততে পরিণত হয়। এই গ্রন্থে পর্যায়ক্রমে যেসব ঘটনা বিবৃত হবে তা থেকে আমার এই কথার প্রমাণ মিলবে। এ ঘটনাসমূহ, যা পরিবেশিত হবে কোনো রাখঢাক ছাড়া ও বস্ত্তনিষ্ঠভাবে, তার ভেতর দিয়েই প্রকাশিত হবে আমার প্রকৃত আত্মপরিচয়। এই নিশ্চয়তা আমি দিচ্ছি। অনেকের কাছেই এইসব ঘটনা অপরিজ্ঞাত গোপন তথ্যের মতো মনে হবে। এই গ্রন্থে আমার লক্ষ্যই হবে, সেই সব গোপনীয়তা আমার নিজের হাতে হত্যা করা।

 

আমার পাঁচ বছর বয়সের কথা বলছি, সময়টা বসন্তকাল, বারসেলোনার কাছে কামব্রিল নামক এক গ্রামে আমার থেকেও ছোট এক বালকের সঙ্গে গ্রামের পথে হাঁটছিলাম। লালচুলো বালকটির সঙ্গে স্বল্পসময় আগেই পরিচিত হয়েছি। আমি হাঁটাপথে, ছেলেটি তিন-চাকার সাইকেলে। আমি পেছন থেকে ঠেলে তাকে চলতে সাহায্য করছিলাম।

আমরা একটা সেতুর কাছে পৌঁছলাম, সে সেতুর কোনো বেড়া বা রেলিং ছিল না। হঠাৎ আমার মাথায় একটা বুদ্ধি আসল – যেমন করে অধিকাংশ আইডিয়া আমার মাথায় আসে – আমি করলাম কি, ছেলেটাকে পেছনে থেকে দিলাম এক ধাক্কা। ফিট পনেরো নিচে পাথরের ওপর সে থুবড়ি খেয়ে পড়ল। তারপর আমি দ্রুত বাসায় পা চালালাম সে ঘটনা সবিস্তারে ঘোষণার জন্য।

সারাদিন পর সে ছেলের রক্তমাখা জামা জলঘরে নিয়ে ধোয়া হলো। ছেলেটির মাথায় বেজায় চোট লেগেছিল, কম করে হলেও এক সপ্তাহ তাকে বিছানায় কাটাতে হবে। এই নিয়ে যে শোরগোল শুরু হলো তা দেখে আমার ভীষণ মজা লাগছিল। বৈঠকখানার দোল খাওয়া চেয়ারে বসে আমি চেরি খেতে বসলাম। কুশিকাঁটার লেস লাগানো সে চেয়ার। গরম কমানোর জন্য পর্দা নামানো ছিল, ফলে চারদিক অন্ধকার। অন্ধকার ফুঁড়ে সে লেসের ওপর সূর্যের আভা ঠিকরে পড়ছিল কাঠের চেয়ারের গিঁটে, তাতে মনে হচ্ছিল কারো কানের পেছন দিকটা টকটকে লাল হয়ে উঠেছে। ঘটনাটায় আমার যে বিন্দুমাত্র কোনো অনুশোচনা হয়েছিল, মনে হয় না। সেদিন সন্ধ্যায় হাঁটতে গিয়ে আমি প্রতিটি ঘাসপাতা দেখে বেশ আনন্দ পেয়েছিলাম।

 

তখন আমার বয়স ছয়। বসার ঘরে গাদাখানেক লোক। সবাই বলাবলি করছিল সেদিন রাতে আকাশে মেঘ না থাকলে একটা ধূমকেতু দেখা যাবে। কেউ একজন বললেন, ধূমকেতুর লেজটা খসে পড়তে পারে, আর তার ফলে পুরো দুনিয়া ধ্বংস হয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। সবাই ব্যাপারটা কৌতুকের সঙ্গে গ্রহণ করেছিল, কিন্তু আমি ব্যাপারটা গুরুত্বের সঙ্গে নিয়েছিলাম। কিছুটা সাহস সঞ্চার করে আমি দিলাম ছুট বারান্দার দিকে। হঠাৎ নজরে পড়ল আমার তিন বছর বয়সী বোন হামাগুড়ি দিয়ে একটা দরজা পেরোচ্ছে। আমি হঠাৎ পেছন থেকে তার মাথায় কশে দিলাম এক লাথি, যেন ওর মাথাটা একটা ফুটবল। ঘটনাটা বর্বর হলে কী হবে, আমার কিন্তু ভীষণ মজা লাগছিল। আমার বাবা ছিলেন ঠিক পেছনে, তিনি আমাকে পাকড়াও করে তার অফিসঘরে রাত্রের আহারের আগ পর্যন্ত আটকে রাখলেন।

ধূমকেতু না দেখতে পারার এই ব্যাপারটা আমার মনে গেঁথে ছিল। আমি রাগে বেহুঁশ হয়ে এমন চিৎকার শুরু করলাম যে আমার গলা ভেঙে যায়। এতে আমার বাবা-মাকে ভীষণ ঘাবড়ে গেছে দেখতে পেয়ে যে শিক্ষা হলো তা পরবর্তী সময়ে আমি যথাযথ ব্যবহারে সিদ্ধহস্ত হয়ে উঠি। আরেকবার আমার মাছের কাঁটা খেতে গিয়ে শ্বাসরোধ হবার জোগাড়, তা দেখে আমার বাবা ভীতসন্ত্রস্ত হয়ে দুই হাতে মাথা ঢেকে ঘর ছেড়ে বেরিয়ে যান। শুধু বাবার ওই প্রতিক্রিয়া দেখার জন্য এর পরে আরো কয়েকবার আমি শ্বাসরোধ হবার অভিনয় করেছি। বলাই বাহুল্য, আমার নিজের প্রতি অতিরিক্ত মনোযোগ পাওয়ার জন্যই এই কাজ করা।

এই সময়ে একদিন আমার বোনের কান ফুটো করার জন্য ডাক্তার বাসায় এলেন। বোনের প্রতি আমার মনোভাব ছিল বিকারগ্রস্ত স্নেহের, লাথি মারার ঘটনার পর থেকে তা উত্তরোত্তর বেড়েই চলছিল। কান ফুটো করার ব্যাপারটি আমার কাছে অত্যন্ত বর্বর একটা ব্যাপার মনে হওয়ায় তা যে-কোনো মূল্যে ঠেকানোর সিদ্ধান্ত নিলাম। ডাক্তার তাঁর চেয়ারে বসে নিজের চশমা জোড়া ঠিক করে বোনের কান ফুটো করতে উদ্যত হলেন। ঠিক সেই সময় তোশক পেটানোর মুগুরখানা নিয়ে আমি সে ঘরে ঢুকে ডাক্তারকে পেছন থেকে এমন এক বাড়ি বসালাম যে তার চশমা ভেঙে চৌচির। বুড়ো ভদ্রলোক ব্যথায় কুঁকড়ে উঠলেন। বাবা ছুটে এসে তাঁকে ধরায় ধপাস করে মাটিতে পড়া থেকে তিনি রক্ষা পেলেন। ভয়তাড়িত গলায় প্রায় কাঁদো কাঁদো হয়ে বাবা বললেন, ‘ছেলেটাকে আমি এত আদর করি, আর সেই কি না এমন একটা কাজ করবে, আমি ভাবতেও পারিনি।’ সেদিনের পর থেকে ওই বুড়ো ডাক্তার, যার আমি কান্না ছুটিয়ে ছেড়েছিলাম, শুধু তাঁর ভয়তাড়িত মুখখানি দেখার জন্য যখন-তখন অসুখের ভান করতাম।

 

আবার ক্যামব্রিলে ফিরে যাই, যখন আমার বয়স পাঁচ। বয়স্ক তিন সুন্দরী রমণীর সঙ্গে আমি হাঁটছিলাম। তাদের মধ্যে একজন ছিল অপূর্ব সুন্দরী। আমার হাত ধরে সে হাঁটছিল, তার মাথায় ছিল ঝুল বসানো টুপি, তাতে মেয়েটিকে অপরূপ লাগছিল। প্রায় জনশূন্য একটি স্থানে পৌঁছানোর পর তারা নিজেদের মধ্যে কিচিরমিচির করে কী সব বলাবলি শুরু করল। আমাকে অন্য কোথাও গিয়ে খেলতে বলায় আমার ভীষণ হিংসে হলো। আমি সরে গেলাম বটে, কিন্তু উদ্দেশ্য ছিল কাছাকাছি এক জায়গা থেকে তারা কী বলছে তা আড়ি পেতে শোনা। দেখলাম তারা বিচিত্র দেহভঙ্গি করছে। সবার মাঝখানে ছিল সবচেয়ে সুন্দরী মেয়েটি, বাকি দুজন সামান্য দূর থেকে তাকে ঘনিষ্ঠভাবে অবলোকন করছিল। গর্বভরে মেয়েটি তার মাথাটি নতমুখী করে, মাজায় হাত রেখে পা জোড়া খুব শক্ত করে বিছাল, তারপর নিজের ঘাগরা উঁচু করে ধরল। নড়াচড়াবিহীন মেয়েটির ভাব দেখে মনে হচ্ছিল দারুণ কিছু একটা ঘটার অপেক্ষায় আছে সে। আধমিনিট ধরে চারদিকে সুনসান নীরবতা, তারপর হঠাৎ দেখি তরল মতো কিছু একটা ছিটকে পড়ল মাটিতে, আর তার পায়ের কাছে ফেনা মতো কিছু একটা জমাট বাঁধল। শুকনো মাটি সে ফেনার কিছুটা শুষে নিল, বাকিটা তার জুতোর ওপর দ্রুত ফেনা পাকিয়ে তুলল। মেয়েটি পা দিয়ে তা ঢাকার চেষ্টা করলেও পারছিল না, উলটো দুই জুতোতেই সে ফেনা ছড়িয়ে পড়ল।

নিজের কাজ নিয়ে টুপি পরা মেয়েটি এতটা ব্যস্ত ছিল যে তার পক্ষে দেখা সম্ভব হয়নি যে আমি ওর দিকে হাঁ করে তাকিয়ে আছি। কিন্তু চোখ ওপরে তুলতেই আমার সঙ্গে চোখাচোখি হলো। আমি দেখলাম তার চোখে কৌতুকের হাসি, কী ঘটছে তা বুঝতে পেরে আমার হৃৎকম্প শুরু হলো। প্রায় একই সময়ে আরো দুই তরল ধারা মাটিতে আছড়ে পড়ল। আমি বড় বড় চোখ করে মেয়েগুলোর দিকে তাকিয়ে থাকলাম। আমার রক্তচাপ একবার বাড়ছিল, একবার কমছিল, সঙ্গে সঙ্গে একধরনের ভীতিও আমাকে পেয়ে বসে। আকাশে সূর্যের শেষ আভা মিলাচ্ছিল, আর মাটিতে তিন তরল ধারা যেন সদ্য ফোটা পোখরাজ মণি জলপ্রপাতের জলদ ধ্বনিসহ ফেটে পড়ছিল।

রাত ঘনিয়ে আসছিল। ফেরার পথে তিন মেয়ের একজনকেও আমি নিজের হাত ধরতে না দিয়ে তাদের পিছু পিছু হাঁটছিলাম। মন আমার একদিকে উৎফুল্ল, অন্যদিকে আমি রাগে ফুঁসছি। পথ থেকে আমি একটা জোনাক পোকা কুড়িয়ে নিয়েছিলাম, তা আমার হাতে মুঠিতে বাঁধা ছিল। মাঝে মাঝে সাবধান হয়ে সামান্য মুঠি খুলে দেখছিলাম তার আলো এখনো আছে কি না। এমন শক্ত করে আমার মুঠি বাঁধা ছিল যে তা একদম ঘেমে উঠছিল। জোনাকিটা যাতে ঘামে নেয়ে না ওঠে সেজন্য আমি মাঝেমধ্যে তাকে এক হাত থেকে অন্য হাতে চালান করছিলাম। হাত ফস্কে বার কয়েক সে পড়েও গেল। আমাকে হাঁটাপথে চাঁদের আলোয় তাকে খুঁজে নিতে হচ্ছিল। ধুলোবালুর ওপর চাঁদের আলো হালকা নীল একটা আভা ছড়িয়ে দিয়েছিল। একবার একফোঁটা ঘাম আমার হাত বেয়ে মাটিতে পড়ে খুদে এক ফুটো তৈরি হলো। সে ফুটো দেখে আমার গা শির শির করে উঠল। খুব ভয় পেয়ে আমি জোনাক পোকাটা মাটি থেকে তুলে নিয়ে মেয়ে তিনটি – তারা তখন কিছুটা এগিয়ে গেছে – তাদের দিকে দৌড় লাগালাম। ঝুল টুপি পরা মেয়েটি কপট আগ্রহে আমার দিকে হাত বাড়িয়ে দিলো। আমি সে হাত না ধরে তার গা ঘেঁষে হাঁটতে লাগলাম।

বাড়ির কাছে আসতেই বছর বিশেকের এক চাচাতো ভাইয়ের দেখা পেলাম। তার এক কাঁধে ছিল ছোট একটা বন্দুক, হাতে ধরা ছিল আমাদের দেখানোর জন্য একটা কিছু জিনিস। কাছে আসতে নজরে পড়ল, সদ্য গুলি করা একটা বাদুড়ের কান ধরে সে দাঁড়িয়ে। বাদুড়টা আমি চাই তা টের পেয়ে একটা টিনের বাটিতে রেখে ওটা সে আমায় উপহার দিলো। আমি তখন এক দৌড়ে ছুটে গেলাম আমার প্রিয় কাপড় ধোবার ঘরে। সেখানে একটি কাচের পাত্রে পুদিনা পাতার ওপর গোটাকয় লেডিবাগ পোকা আমি জমিয়ে রেখেছিলাম। টিনের পাত্রের ভেতর বাদুড়টির পাশে জোনাক পোকাটি সযত্নে নামিয়ে রাখলাম। বাদুড়টি একদম নড়াচড়া করছিল না। রাতের খাবারের আগে ঘণ্টাখানেক আমি সেখানে কাটালাম, যেন একটা স্বপ্নের ঘোরের মধ্যে ছিলাম। মনে আছে, আমি জোরে জোরে বাদুড়টির সঙ্গে কথা বলছিলাম, বারবার তার লোমশ কপালে চুমু খাচ্ছিলাম, যেন সেই মুহূর্তে এর চেয়ে অধিক প্রিয় আমার কাছে আর কিছুই ছিল না।

পরদিন সকালে ঘটল এক ভয়াবহ কান্ড। কাপড়-ধোয়া ঘরে গিয়ে দেখি কাচের সেই পাত্র উলটে পড়ে আছে। জোনাক পোকা উধাও, বাদুড়টি যদিও আছে, কিন্তু তাকে ঘিরে কিলবিল করছে পিঁপড়ার সারি, তার দাঁত কপাটি লাগার জোগাড়। বুড়ি মহিলাদের মতো তার দাঁত বেরিয়ে আছে। এমন সময় কয়েক হাত দূর দিয়ে যেতে দেখলাম সেই ঝুল টুপি পরা মেয়েটিকে। বাগানের দরজা খোলার জন্য খানিকক্ষণের জন্য সে থামল। বিন্দুমাত্র বিলম্ব না করে আমি গায়ের সকল শক্তি দিয়ে এক টুকরো পাথর নিয়ে সাঁই করে তার দিকে ছুড়ে মারলাম। সামান্যর জন্য সে পাথর লক্ষ্যভেদে ব্যর্থ হলো। মেয়েটি মাতৃসুলভ ঔৎসুক্য নিয়ে আমার দিকে তাকাল। আমার সারা শরীরে কাঁপন ছুটল, যেন কী এক গভীর লজ্জা আমাকে গ্রাস করল।

হঠাৎ আমি এক অদ্ভুত কান্ড করলাম। তড়িৎ গতিতে পিঁপড়াতে কিলবিল করা বাদুড়টি তুলে গভীর মমতায় মুখের কাছে তুলে নিলাম।  চুমু করার বদলে – যা করার ইচ্ছা আমার ছিল – আমি বাদুড়টাকে এক কামড় বসালাম, তাতে মনে হলো সে যেন দুটুকরো হয়ে গেছে। ঘেন্নায় বাদুড়টা ছুড়ে ফেলে দিলাম ছুট।  কাপড়-ধোয়া ঘরে পরিষ্কার পানিতে তখন ছায়া দেওয়ার জন্য যে ডুমুর গাছ ছিল, তা থেকে খসে পড়া থোকা থোকা পাকা ডুমুর ভাসছিল। আমার দুচোখ জলে ভরে উঠল। পানিতে ভাসমান কালো কালো ফুল-পাতার পাশে বাদুড়টিকে তখন আর আলাদা করে চেনা যাচ্ছিল না। ওই কাপড়-ধোয়া ঘরে আমি এরপর আর কক্ষনো যাইনি। কালো কোনো ফুটকি, এমনকি স্থাপনাশিল্প (ইনস্টলেশন) দেখলে এখনও আমার স্নানপাত্রের জলে ডুমুর ও বাদুড়ের কথা মনে পড়ে।

 

তখন আমার বয়স ১৬। ফিগেরাতে মারিস্ট ব্রাদার্স (ক্যাথলিক) স্কুলের ছাত্র। আমাদের স্কুলঘর থেকে খেলার ঘরে যেতে হলে খাড়া এক পাথরের সিঁড়ি ডিঙিয়ে যেতে হতো। একদিন কোনো কারণ ছাড়াই আমার ইচ্ছে হলো সে সিঁড়ি থেকে লাফিয়ে নামব। সব ঠিকঠাক, কিন্তু শেষ মুহূর্তে ভয় পেয়ে বসল। কিন্তু পরদিন নিজেকে আর সামলে রাখতে পারলাম না। সবাই মিলে নিচে নামছি, হঠাৎ আমি শূন্যে লাফিয়ে পড়ে গড়াতে গড়াতে একদম  মাটিতে। আমার সারা শরীর রক্তাক্ত হয়ে গেল, কিন্তু তা সত্ত্বেও এমন আশ্চর্য এক তৃপ্তি বোধ হচ্ছিল যে সব ব্যথা আমি ভুলে গেলাম। বয়োজ্যেষ্ঠ ছাত্র ও স্কুলের শিক্ষকদের মধ্যে এ নিয়ে তুলকালাম কান্ড। কেউ কেউ আমার মাথায় ভেজা রুমাল দিয়ে জলপট্টি দেওয়া শুরু করল।

এই সময়টা আমি ছিলাম বেজায় ভীরু। আমার দিকে সামান্য মনোযোগ দেওয়া হলে চোখ-কান লাল হয়ে উঠত। অধিকাংশ সময়ই আমি হয় লুকিয়ে, নয় একা একা থাকতাম। (সেদিন স্কুলে) আমার চারদিকে এত লোকজন দেখে আমার ভিরমি যাবার জোগাড়। চারদিন পর আমি আবার সেই একই কান্ড করলাম, তবে এবার  সিঁড়ির একদম ওপর থেকে, আর ঘটনাটা ঘটালাম ক্লাসের দ্বিতীয় ছুটির ঘণ্টার সময়, যখন স্কুলমাঠে ছাত্রদের ভিড় সবচেয়ে বেশি। ব্রাদার সুপিরিওর – অর্থাৎ আমাদের পাদ্রি শিক্ষক – খেলার মাঠে না আসা পর্যন্ত আমি অপেক্ষা করেছিলাম। এবার আমার পতনের প্রতিক্রিয়া হলো আগের চেয়েও তীব্র। মাটিতে পড়ার আগে আমি এমন এক তীব্র চিৎকার করলাম যে সবাইকে তা সচকিত করে তুলল। আমার আনন্দের মাত্রা ছিল বর্ণনাতীত, সেই তুলনায় ব্যথা সামান্যই। এ ঘটনার ফলে আমি আরো উৎসাহ বোধ করলাম এবং মাঝেমধ্যেই ইচছা করে লাফিয়ে পড়তাম।  যখনই আমি লাফ দিতে উদ্যত হতাম, সবাই একেবারে হুমড়ি খেয়ে পড়ত। সবার প্রশ্ন : ও লাফ দেবে, না দেবে না?  সবার যখন এত আগ্রহ, তখন নীরবে এ কাজটি করায় কোনো উৎসাহ আমার ছিল না।

এক বৃষ্টিভেজা অক্টোবর সন্ধ্যার কথা আমার বেশ মনে পড়ে।  আমি সবেমাত্র সিঁড়ি দিয়ে নিচতলায় গড়িয়ে পড়া শুরু করেছি।  খেলার মাঠে তখন কেমন অদ্ভুত এক মৌতাত – মাটির ভেজা গন্ধ, তার সঙ্গে গোলাপের সুবাস, আকাশে গনগনে সূর্য, তার নিচে চিতার মতো ছোপ ছোপ ও পালতোলা জাহাজের আকারে মেঘের দল। আমি যেন কোনো দেবতা, এমন একটা ভাব করে মুখখানা ঊর্ধ্বে তুলে, সিঁড়ি বেয়ে লাফিয়ে পড়লাম। খেলার মাঠ, যা একমুহূর্ত আগেও ছিল হৈ-হুল্লোড়ে ভরা, তা হঠাৎ একদম স্তব্ধ। মাইরি বলছি, সেই সময় কোনো দেবতার সঙ্গেও নিজের স্থানবদলে আমি প্রস্ত্তত ছিলাম না।

 

তখন আমার বয়স ২১, মাদ্রিদে চারুকলা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র। সবাই যা করে ঠিক তার উলটো করার এক উদগ্র বাসনা আমাকে খুব দ্রুত শিল্পী মহলে কুখ্যাত করে তোলে। একবার ক্লাসে প্রফেসর নির্দেশ দিয়েছিলেন এক মডেলকে সামনে রেখে গথিক কায়দায় মা মেরির ছবি অাঁকার। ক্লাস ছেড়ে যাবার আগে তিনি বলে গেলেন, ঠিক যেমন যেমন দেখছি, ঠিক তেমন তেমন অাঁকতে হবে। আমি মহা উৎসাহে এক জোড়া দাঁড়িপাল্লা অাঁকা শুরু করলাম। এক ছবির ক্যাটালগে আমি সেই দাঁড়িপাল্লার ছবি দেখেছিলাম। এতে সবাই ভাবল আমি নির্ঘাত পাগল হয়ে গেছি। সপ্তাহান্তে কাজের অগ্রগতি তদারকিতে এসে শিক্ষক সব ছাত্রকে নিয়ে আমার ছবির সামনে বরফ চোখে তাকালেন। আমি সাহস সঞ্চয় করে বললাম, ‘আপনারা হয়তো মা মেরিকে দেখছেন, আমি কিন্তু দেখছি একজোড়া দাঁড়িপাল্লা।’

(এই ঘটনার কথা স্মরণ করতে যেয়ে আমার এখন মনে হচ্ছে, রাশিচক্রে মা মেরি ও দাঁড়িপাল্লার একটি স্বভাবজ যোগসূত্র প্রকাশিত হয়। হতে পারে এই প্রকাশ শুধুমাত্র চিন্তাগত সাযুজ্য। এখন স্মৃতিতে যেভাবে ধরা পড়ে তাতে মনে হয় মা মেরি এক স্বর্গীয় স্থানে দাঁড়িয়ে ছিলেন। অর্থাৎ এই আসন্ন অতীন্দ্রিয় অভিজ্ঞতা ছিল বড়জোর একটি সম্ভাবনা বা সম্ভাবনার প্রতীক্ষা। আর সেটাই ছিল শিল্পকলায় ভবিষ্যৎ ‘দালিবাদের’ প্রথম উপলব্ধি, উদ্দিষ্ট ইমেজের আকস্মিক অনুধাবনের ভেতর দিয়ে যার প্রকাশ। ভৌতিক হওয়া সত্ত্বেও তার ভেতর রয়েছে ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য বস্ত্তর সকল গুণাগুণ।)

 

তখনো আর্ট স্কুলের ছাত্র। একবার আমাদের এক চিত্র প্রতিযোগিতায় অংশ নিতে বলা হলো। আমি বাজি ধরে বললাম, ক্যানভাসে একবারও ব্রাশ না বুলিয়ে আমি এই প্রতিযোগিতায় জয়ী হব।  হয়েওছিলাম। এক মিটার দূর থেকে ক্যানভাসে রং ছুড়ে দিয়ে আমি নিখুঁত এক ‘পোয়াতিলিস্তে’ চিত্রকর্ম নির্মাণে সমর্থ হয়েছিলাম।

 

পরের বছর শিল্পকলার ইতিহাসের পরীক্ষা।

যতটা সম্ভব ভালো করার ইচ্ছা ছিল। সেজন্য প্রস্ত্ততিও ছিল। পরীক্ষক কমিটির তিন সদস্যের দিকে আমি অগ্রসর হলাম। তাঁরা লটারিতে আমার জন্য পরীক্ষার প্রশ্নসমূহ নির্ধারণ করলেন। ভাগ্য ভালো, যে বিষয়টি আমার কাম্য ছিল, লটারিতে সেটাই উঠল।  হঠাৎ কী হলো, এক প্রচন্ড আলস্যভাব আমাকে গ্রাস করল, আমি উঠে দাঁড়িয়ে ঘোষণা করলাম, ‘দুঃখিত, কিন্তু  এখানে উপস্থিত তিনজন অধ্যাপকের চেয়ে নিজেকে অধিক যোগ্য মনে করি। অতএব, এই কমিটি দ্বারা পরীক্ষিত হতে আমি অস্বীকার করছি।’

এই ঘটনার পর শৃঙ্খলা কমিটির সামনে আমাকে হাজির করা হয় এবং স্কুল থেকে বহিষ্কারের সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। সেই ছিল আমার শেষ স্কুলে যাওয়া।

 

আমার একুশ বছর বয়সের ঘটনা, সময়টা গ্রীষ্মকাল, তখন আমি কাদাকে (আমার ভবিষ্যৎ স্ত্রী) গালাকে পটানোর চেষ্টায় ব্যস্ত। একদিন সমুদ্রপারে সবান্ধব আমরা দুপুরের আহার সারছিলাম। সেখানে ছিল আস্ত মৌচাকসহ এক আঙুরের ঝোপ। মৌমাছির শব্দে কান ঝালাপালা হবার জোগাড়। সে সময় আমি প্রেমে হাবুডুবু খাচ্ছি, যদিও সে প্রেমের যাতনায় আমার গলা জড়িয়ে ছিল উদ্বেগের মণিমাণিক্যখচিত খাঁটি সোনার এক অক্টোপাস। আমি সবেমাত্র স্থানীয় সুরাসহ চারখানা পোড়ানো চিংড়ি সাবাড় করেছি। নামিদামি না হলে কী হবে, ভূমধ্যসাগরীয় সে সুরা ছিল এক চমৎকার ফুলের তোড়ার মতো, যাতে লুকানো থাকে কণ্টকাকীর্ণ অশ্রুরেখা।

আহার শেষ করতে বিলম্ব হচ্ছিল, যদিও সূর্য তখন প্রায় ডুবুডুবু। আমি খালি পায়ে ছিলাম। আমাদের দলের একটি মেয়ে, যে বেশকিছু সময় ধরে আমার পিছু নিয়েছিল, প্রায় চেঁচিয়ে বলছিল, আমার পা জোড়া কী সুন্দর! কথাটা খুবই সত্য ছিল, কিন্তু তা নিয়ে এমন ঘটা করে বলায় মেয়েটাকে আমার মনে হচ্ছিল নির্বোধ। আমার হাঁটুর ওপর মাথা কাত করে বসেছিল মেয়েটি।  একসময় কাঁপা কাঁপা হাতের এক আঙুল দিয়ে আমার পায়ে বিলি কাটতে শুরু করল সে। হঠাৎ নিজেকে গালা ভেবে প্রচন্ড ঈর্ষায় আমি লাফিয়ে উঠলাম। আমি সব শক্তি দিয়ে মেয়েটিকে ধাক্কা দিয়ে ফেলে পা দিয়ে এমনভাবে মাড়িয়ে দিলাম যে ও একেবারে রক্তাক্ত হয়ে উঠল। লোকজন ত্রস্ত হয়ে আমার কাছ থেকে মেয়েটিকে সরিয়ে নিল।

 

আমি যেন নিষ্ঠুর এক খামখেয়ালিপনায় লিপ্ত হতে নিয়তি দ্বারা আদিষ্ট ছিলাম। তখন আমার বয়স ৩৩। একদিন প্যারিসে অতি দক্ষ এক মনোবিশারদের টেলিফোন পেলাম। লা মিনাতুর  পত্রিকায় ‘পারাওনিক কার্যকলাপের অন্তস্থ প্রক্রিয়া’ – এই বিষয়ে আমার লেখা একটি নিবন্ধ তিনি সদ্য পাঠ শেষ করেছেন।  আমার বৈজ্ঞানিক ধীমত্তায় তিনি বিস্ময় প্রকাশ করলেন, অথচ বিষয়টি নিয়ে অধিকাংশের তখনো নানা বিভ্রান্তি ছিল। এ নিয়ে আমার সঙ্গে কথা বলতে তিনি আগ্রহ প্রকাশ করলেন। সেদিন বিকেলে আমার র্যু গগেতের স্টুডিওতে সাক্ষাতে আমরা সম্মত হলাম। কী নিয়ে কথা হবে তার একটা আগাম ছকও আমি করে নিলাম। পরাবাস্তববাদী মহলে আমার বন্ধুবান্ধবের কাছেও আমার ধারণাগুলি পাগলামো ভাবা হতো, যদিও তারা স্বীকার করতে বাধ্য হতো সেসব ধারণায় প্রখর বুদ্ধিমত্তার ছাপ রয়েছে। বৈজ্ঞানিক মহল অবশেষে আমাকে স্বীকৃতি দিচ্ছে জানতে পেয়ে আমি স্বভাবতই তুষ্ট হলাম। সেহেতু আমি দৃঢ়প্রতিজ্ঞ ছিলাম এই মনোবিশারদের সঙ্গে প্রথম সাক্ষাৎকারে সবকিছুই যেন একদম স্বাভাবিক ও গুরুগম্ভীর থাকে। তাঁর জন্য অপেক্ষারত অবস্থায় আমি ভিকম্তে দে নোয়াইয়ের যে পোর্ট্রেটটি নিয়ে কাজ করছিলাম, তার কথা ভাবতে থাকলাম। ছবিটি সরাসরি তামার ওপর অাঁকা হচ্ছিল। অতি প্রচ্ছন্ন রঙে মোড়া প্লেটটিতে আলোর প্রতিফলন তির্যকভাবে পড়ায় ভালোভাবে তা দেখতে কষ্ট হচ্ছিল। আমি আগেই লক্ষ করেছিলাম, আলোর প্রতিফলন যেখানে সবচেয়ে তীব্র, সেখানে দেখা আমার জন্য সবচেয়ে সহজতম ছিল। আমি করলাম কি, আধ ইঞ্চি পরিমাণ এক টুকরো কাগজ নিয়ে নিজের নাকে গুঁজে দিলাম। এর ফলে যে প্রতিফলন সৃষ্টি হলো তাতে ছবিটির যে অংশ নিয়ে কাজ করছিলাম, তা চালিয়ে যাওয়া আমার পক্ষে অনেক সহজ হয়ে এলো।

ছ’টার সময় – আমাদের পূর্বনির্ধারিত সাক্ষাতের মুহূর্তে – দরজায় ঘণ্টা বেজে উঠল।  আমি তামার প্লেটটি সরিয়ে রাখলাম, ঘরে ঢুকলেন জ্যাক লাকঁ। সময় ব্যয় না করে আমরা বৈজ্ঞানিক বিষয় নিয়ে আলোচনা শুরু করলাম। আমি বিস্মিত হলাম একথা জেনে যে, আমাদের উভয়ের বৈজ্ঞানিক তত্ত্বের প্রতি সে সময় প্রচলিত কনস্টিটিউশনালিস্ট থিয়োরিবিদদের বিরোধিতা প্রায় অভিন্ন। ঘণ্টা দুয়েক দ্বান্দ্বিক তর্ক-বিতর্কে আমাদের সময় কাটল। মাঝেমধ্যে আমাদের দেখা হবে এই প্রতিশ্রুতিতে আমাদের আলোচনা ভাঙল। লাকঁ চলে যাবার পর আমি পায়চারি করে ভাবতে লাগলাম কোথায় কোথায় আমাদের মতের অমিল রয়েছে, যদিও তার সংখ্যা খুব অল্প ছিল, কিন্তু তাদের তাৎপর্য সামান্য ছিল না। তবে তরুণ মনোবিশারদ যে রকম উদ্বেগজনকভাবে আমার মুখমন্ডল নিরীক্ষণ করছিলেন, তা ভেবে আমি বেশি ফাঁপরে পড়ে গেলাম। যেন এক অজ্ঞাত জীবাণুবাহী স্মিত হাসির কণা তাঁর দৃষ্টি ভেদ করে প্রকাশিত হচ্ছিল। আমি ভেবে পাচ্ছিলাম না, আমার চিত্তে যে ভাবনা-চিন্তার ঢেউ উথাল-পাতাল ঢেউ তুলছিল, আমার মুখমন্ডলে তার সংক্ষুব্ধ প্রকাশই কি তাঁকে আকৃষ্ট করছিল?

এই ধাঁধার উত্তর আমি পেলাম হাত ধুতে যাবার পর (বস্ত্তত সকল জটিল প্রশ্নের উত্তর পাবার এটিই প্রকৃষ্ট সময়)। উত্তরটা জুটল আয়নায় নিজের চেহারা দেখে। নাসিকা-রন্ধ্র থেকে সাদা কাগজ-টুকরো সরাতে আমি ভুলে গিয়েছিলাম। দুঘণ্টা ধরে নানা জটিল বিষয়ে আমরা বাদানুবাদ করে গেছি, কিন্তু আমার নাসিকার ওই আবরণটি আমি সরাতে ভুলে গিয়েছিলাম। অতি ‘সিনিক’ ছাড়া আর কার পক্ষে এ নিয়ে একটি কথা না বলে এত দীর্ঘ সময় বাদানুবাদ করা সম্ভব?

 

১০

তখন আমার একুশ বছর বয়স, ফিগেরাসে পিত্রালয়ে থাকি। স্টুডিওতে একটি বড় আকারের কিউবিস্ট ছবি নিয়ে আমি খুব তন্ময় হয়ে কাজ করছিলাম। আমার ড্রেসিং গাউনের ফিতা হারিয়ে গিয়েছিল, ফলে সে অবস্থায় কাজ করতে বিভ্রাট ঘটছিল। হাতের কাছে ছিল একটি বিদ্যুতের তার, আমি সেটাই আমার কোমরে জুড়ে নিলাম। তারের শেষ প্রান্তে ছিল একটি প্রদীপ। খোঁজাখুঁজিতে অতিরিক্ত সময় ব্যয়ের বদলে সে প্রদীপকে বগলস বানিয়ে কাজ করতে থাকলাম।

মনোযোগ দিয়ে কাজ করছি, এমন সময় আমার বোন এসে জানাল আমার সঙ্গে সাক্ষাতের জন্য কয়েকজন অতিথি বৈঠকখানায় অপেক্ষা করছেন। আমি এমন একসময়ের কথা বলছি যখন ছবির জন্য নয়, বরং একের পর এক নাটকীয় ঘটনায় কাতালনে আমার দুর্নাম রটে গিয়েছিল। কিঞ্চিৎ বিরক্ত হয়ে কাজ ফেলে আমি বৈঠকখানায় এলাম।  আমার বাবা-মা সেখানে ছিলেন, তাঁরা যে রং-কালিমাখা আমার ড্রেসিং গাউন দেখে বিরক্ত হয়েছেন, তা আমি বুঝতে পারলাম। কিন্তু তখনো বুঝিনি আমার নিতম্ব বরাবর ওই প্রদীপখানাও ঝুলছে। সবিনয়ে নিজের পরিচয় দেবার পর সেই প্রদীপের ওপরেই আমি বসে পড়লাম। অমনি কাচের বাল্ব একেবারে বোমা ফাটানো শব্দে ভেঙে পড়ল।

একেবারে সাদামাটা একটা ঘটনা, অথচ দেখুন আমার বেলায় তা কেমন নাটকীয় ও হিংস্র আকার নিল। এসব ঘটনা যেন আমার ক্ষেত্রে ঘটার জন্য মুখিয়ে থাকে!

 

১১

১৯২৮ সালে আমার নিজের শহর ফিগেরাসে আমি আধুনিক চিত্রকলা বিষয়ে একটি ভাষণ দিচ্ছিলাম। শহরের মেয়র সে অনুষ্ঠানের সভাপতি, অনেক গণ্যমান্য ব্যক্তি সেখানে উপস্থিত। বেশ ভিড় হয়েছিল বক্তৃতা শুনতে। লক্ষ করছিলাম, লোকজন কিছুটা বিস্ময়মিশ্রিত আগ্রহে বক্তৃতা শুনছে। আমার সব কথা – বিশেষত শেষ বাক্য – তারা বুঝেছে, তা মনে না হওয়ায় আমি গলা ফাটিয়ে বললাম, ‘ভদ্রমহোদয় ও ভদ্রমহিলাগণ, আমার বক্তৃতা এখানেই শেষ।’

ঠিক তখন, মেয়র ভদ্রলোক, যাকে শহরের মানুষ সত্যি খুব ভালোবাসত, আমার পায়ের কাছে মৃত অবস্থায় হুমড়ি খেয়ে পড়লেন।  এতে কী কান্ড হলো আমি বুঝিয়ে বলতে পারব না। কোনো কোনো পত্রিকা রস করে লিখল, আমার ভাষণের গভীরতার ভার সইতে না পেরে মেয়র সাহেব মারা গেছেন। অথচ ব্যাপারটা ছিল হৃদপীড়াজনিত কারণে আকস্মিক মৃত্যু। সৌভাগ্যক্রমে, ঘটনাটা ঘটে ঠিক আমার বক্তৃতা শেষ হতে না হতেই!

 

১২

১৯৩৭ সালে বারসেলোনায় ‘শয্যাপাশে টেবিলের পরাবাস্তববাদী ও প্রপঞ্চক রহস্য’ – এই বিষয়ে যেদিন আমার বক্তৃতা হবার কথা, ঠিক সেদিনই শহরে এক এনারকিস্ট বিদ্রোহ ছড়িয়ে পড়ে। যেসব লোক আমার বক্তৃতা শুনতে এসেছিলেন, তাঁরা অনুষ্ঠান ভবনে আটকে পড়েন, কারণ গুলিগোলার ফলে তার লোহার মূল ফটক বন্ধ করে দেওয়া হয়। সেসময় আইবেরিয়া এনারকিস্ট ফেডারেশনের সদস্যদের ফোটানো বোমার মুহুর্মুহু শব্দ আমাদের কানে আসছিল।

 

১৩

ইতালিতে আমার প্রথম ভ্রমণ সূত্রে যেবার আমি তুরিন এসে পৌঁছই, সেদিন রাস্তা দিয়ে প্রদক্ষিণ করছিল এক মশাল মিছিল। ঠিক সেদিনই আবিসিনিয়ার বিরুদ্ধে (ইতালি) যুদ্ধ ঘোষণা করে।

 

১৪

বারসেলোনায় আরেক বক্তৃতা। যে নাট্যালয়ে আমার বক্তৃতা করার কথা, সেখানে সেদিন সকালে আগুন ধরে যায়। সে আগুন চট করে নিভিয়ে ফেলা হয় বটে, কিন্তু এর ফলে সেদিনের সান্ধ্য ভাষণের আশু গুরুত্ব বহুলাংশে বেড়ে যায়।

১৫

সেই বারসেলোনায় আরেক ভাষণ। এক ডাক্তার সেদিন কী এক ক্রোধের বশবর্তী হয়ে আমাকে খুন করতে উদ্যত হয়। কয়েকজন লোক মিলে তাকে শান্ত করে হল থেকে বের করে নিয়ে আসে।

 

১৬

১৯৩১ সালে প্যারিসে বুনুয়েল পরিচালিত LAge dOr (লা’জ দো’অর বা সোনালি কাল) ছবি, যাতে আমি বুনুয়েলের সঙ্গে সহযোগিতা করেছিলাম, তাতে প্রদর্শনীর পর একটি ফরাসি যুব সংগঠনের সদস্যরা পর্দায় কালো কালি ছুড়ে মারে, শূন্যে গুলি ছোড়ে, সাধারণ দর্শকদের আক্রমণ করে ক্ষতাক্ত করে ফেলে এবং থিয়েটার হলের লবিতে যে পরাবাস্তববাদী চিত্রকলার প্রদর্শনী চলছিল তা নষ্ট করে। এটা ছিল প্যারিসে সেই সময়ের সবচেয়ে বড় পরাবাস্তব প্রদর্শনী। এ ঘটনা নিয়ে পরে আমি বিস্তারিত লিখব।

 

১৭

আবার ছয় বছর বয়সে ফিরে যাই। সে সময় আমি বাবা-মায়ের সঙ্গে বারসেলোনায় যাচ্ছি। পথে এল এমপালমে স্টেশনে এক লম্বা বিরতি।  আমরা রেলগাড়ি থেকে বেরিয়ে আসি। বাবা বললেন, ‘ওই দেখো, ওখানে ভাজা রুটি বিক্রি হচ্ছে। দেখি তুমি কেমন চালাক-চতুর হয়েছ। যাও তো, আমার জন্য শুধু রুটি কিনে আনো। দেখো, তাতে যেন ডিম ভরা না থাকে, আমি শুধু রুটি চাই।’

আমি দৌড়ে রুটি কিনে এনে বাবাকে দিলাম, কিন্তু বাবার মুখ গোমড়া হয়ে গেল। ‘এর ভেতরে যে ডিম ছিল, সেটা কই?’

‘কেন, তুমি তো বললে শুধু রুটি চাও, ডিম চাও না।’

‘তো, ডিম গেল কোথায়?’

‘আমি মাটিতে ফেলে দিয়েছি।’

 

১৮

১৯৩৬-এর প্যারিস। স্ক্রেকোয়েরের কাছে ৭ র্যু বেকেরেলে আমার অ্যাপার্টমেন্টের ঘটনা। পরের দিন গালার একটা অপারেশন হবার কথা। প্রস্ত্ততি হিসেবে রাতে তাকে হাসপাতালে যেতে হয়েছিল। বেশ জটিল ছিল অপারেশন, কিন্তু গালার তা নিয়ে কোনো ভ্রূক্ষেপ নেই। আমরা দুজন সারা বিকেল দুটি পরাবাস্তব দ্রব্য বানাতে ব্যস্ত থাকলাম। মানুষ হিসেবে গালা হাসিখুশি প্রকৃতির, কারপাচিও১০-এর মূর্তিগুলির মতো কিছুটা বাঁকানো ও গতিময়। হাজারো রকম টুকরো জিনিসপত্র সে গোছাচ্ছিল, পরে বোঝা গেল অপারেশনের কথা মাথায় রেখে দ্রব্যগুলো সে সংগ্রহ  করেছিল। যে দ্রব্যটি বানানোর কথা, তার জৈবিক চরিত্র ছিল খুবই স্পষ্ট : জীবদেহের ঝিল্লি, অস্ত্রোপচারের যন্ত্রপাতি, বাটি বোঝাই আটা, যার কাজ হবে এক জোড়া নারীর স্তনের ওপর যাতে চাপ না পড়ে তার জন্য ‘শক-অ্যাবজরভার’ হিসেবে কাজ করা। স্তন-যুগলের বোঁটায় গুঁড়ি গুঁড়ি হয়ে লেগে ছিল মোরগের পালক। উদ্দেশ্য : আটার ওপর ঝাড়ু বোলালে যাতে স্তন-যুগলে বড় কোনো আঘাত না লাগে, তা নিশ্চিত করা।

অন্যদিকে আমি এমন একটা জিনিস বানাবার চেষ্টা করছিলাম যার নাম দিয়েছিলাম ‘মন্ত্রাবিষ্ট ঘড়ি’। আড়ম্বরপূর্ণ বেদির ওপর বিশাল এক ফরাসি রুটি বসিয়েছিলাম। সে রুটির পেছনে আমি জুড়ে দিয়েছিলাম কয়েকটা কালির দোয়াত, যা ভরা ছিল পেলিকান কলমের কালিতে। এর ফলে সব মিলে (দর্শকের মনে) কী প্রতিক্রিয়া হয় তা দেখতে আমি খুবই উদগ্রীব ছিলাম। রাত্রের মধ্যে গালা তার ‘জিনিসটা’ বানিয়ে শেষ করলে আমরা ঠিক করলাম হাসপাতালে যাবার আগে তা অাঁদ্রে ব্রেতো১১কে দেখাব (সে সময় এইসব জিনিস বানানো সুররিয়ালিস্টদের একটা বাতিকে দাঁড়িয়েছিল)। আমরা খুব সাবধানে (গালার বানানো) জিনিসটা ট্যাক্সিতে তুললাম, কিন্তু তুলতে না তুলতেই সে জিনিস টুকরো টুকরো হয়ে সেই ট্যাক্সির ভেতর ছড়িয়ে পড়ল। সবচেয়ে ভয়ের কথা হলো, দুই বাটি বোঝাই আটাও ছড়িয়ে-ছিটিয়ে একসা। তার সঙ্গে আমরাও। আটা ঝেড়ে তোলার চেষ্টা করে ব্যর্থ হলাম, সব ততক্ষণে ধুলাবালুতে নোংরা হয়ে গেছে। ট্যাক্সি ড্রাইভার মাঝমধ্যে পেছনে ফিরে বিস্ময় ও সহানুভূতির চোখে তাকাচ্ছিল। আমরা পথে এক মুদির দোকানে থামলাম পাউন্ড দুয়েক আটা ফের কেনার জন্য।

এইসব করতে যেয়ে আমরা হাসপাতালের কথা ভুলে বসে আছি। ভীষণ দেরি করে পৌঁছান হলো সেখানে। যে নার্স আমাদের সঙ্গে দেখা করতে বেরিয়ে এলেন তাঁর চেহারা দেখে বুঝলাম, মে মাসের সান্ধ্য আলোতে আমাদের নির্ঘাত ভুতুড়ে দেখাচ্ছিল।  আমরা, বিশেষত আমি, চারদিকে ধুলো ছিটিয়ে আটা ঝেড়ে ফেলতে চেষ্টা করছিলাম।  সত্যি তো, সাধারণ এক ট্যাক্সি থেকে এক স্বামী যদি তার অসুস্থ স্ত্রীকে গুরুত্বপূর্ণ অস্ত্রোপচারের জন্য সারা পোশাক বোঝাই আটা নিয়ে হাসপাতালে ঢোকেন আর পুরো ব্যাপারটা এক মজার ব্যাপার বলে ভাবেন, তাহলে সে নার্সের কী ভাবা উচিত? সেই হাসপাতালের নার্সেরা, যাঁরা আমাদের এই কান্ড-কারখানার সাক্ষী, তাঁদের কাছে আমাদের পোশাক ও ব্যবহার নিশ্চয় এখনো রহস্যময় রয়ে গেছে। তাঁদের কেউ যদি ঘটনাক্রমে এই বাক্যগুলি পড়ার সুযোগ পায়, তাহলে যদি-বা সে রহস্যের খোলাসা হয়!

গালাকে হাসপাতালে রেখে আমি ঘরে ফিরে এলাম। আসার পথে আমি বারবার – অনেকটা বেখেয়ালে – জামায় আটকে থাকা বেয়াড়া কিছু আটা ঝাড়ছিলাম। ঘরে ফিরে আমি বেজায় খিদে নিয়ে শামুক ও ভাজা মুরগির মাংস দিয়ে আহার সারলাম।  সেদিন বিকেলে যে জিনিসটা বানাতে বসেছিলাম, তিন কাপ কফি খেয়ে আবার তা নিয়ে পড়লাম। বস্ত্ততপক্ষে নির্মাণের এই মুহূর্তটি আমি খুব সাগ্রহে অপেক্ষা করছিলাম, গালাকে হাসপাতালে আনা-নেওয়ায় যে কালক্ষেপণ হলো তাতে বস্ত্তটি বানানোর ব্যাপারের আগ্রহ কেবল বৃদ্ধি পেয়েছিল। পরদিন সকাল দশটায় আমার স্ত্রীর অস্ত্রোপচার, অথচ পুরো ব্যাপারটাই আমি ভুলে বসে আছি! চেষ্টা করেও এ নিয়ে বিন্দুমাত্র উদ্বেগের সঞ্চার হলো না। যে মানুষটাকে আমি ভালোবাসি বলে বিশ্বাস করি, তার প্রতি এই মনোভাবের গভীর দার্শনিক ও নৈতিক তাৎপর্য রয়েছে, সে কথা আমার কাছে প্রতীয়মান হলেও তা নিয়ে ভাববার মতো সময় তখন আমার ছিল না।

সত্যি বলতে কি, জিনিসটা বানানোর ব্যাপারে আমি খুবই উদ্দীপ্ত ছিলাম, যেমন কোনো সুরকার তাঁর গানের সৃষ্টি নিয়ে উদ্দীপ্ত হন। নতুন নতুন ভাবনা আমার মনের মধ্যে জাগ্রত হচ্ছিল। রুটিখন্ডের সঙ্গে আমি যুক্ত করলাম ষাটটি কালির দোয়াত, তাতে জলরঙের কলম, যেগুলো আমি সেই রুটির নিচে ষাট টুকরো দড়ি দিয়ে বেঁধে দিলাম। রাস্তা থেকে উড়ে আসা গরম হাওয়ায় ছবিগুলো এপার-ওপার দোল খাচ্ছিল। আমার বানানো এই ‘অ্যাবসার্ড’ কিন্তু অতিবাস্তব বস্ত্তটি নিয়ে আমি সত্যি খুব সন্তুষ্ট ছিলাম। সেই খুশ মন নিয়ে রাত দুটোর দিকে আমি ঘুমুতে গেলাম। যেন নিষ্পাপ এক দেবদূত, এমন বোধ নিয়ে আমি অঘোরে ঘুম দিলাম। সকাল সাতটায় উঠলাম ভয়ানক মন্দ অনুভূতি নিয়ে। এমন প্রবল মনস্তাপ আমি আগে কখনো বোধ করিনি।

খুব শ্লথগতিতে – যেন হাজার দুয়েক বছর সময় ধরে – আমি দম আটকানো কম্বলখানা ছুড়ে ফেলে দিলাম। আমার মনে একটা গ্লানির ভাব খচখচ করছিল, সভ্যতার গোড়া থেকে মানুষের মনে নৈতিকতার প্রভাবে যে গ্লানিবোধের সৃষ্টি হয়, অনেকটা সে রকম।  দিনের আলো খোঁচাচ্ছিল আকাশকে, আমার চোখের পাতা ঠুকরে দিচ্ছিল পাখি, যাদের চিৎকার আমার চোখের পাতা খুবলে দিচ্ছিল, আমার শ্রবণ রুদ্ধ করে দিচ্ছিল, বসন্তকালের  সদ্য ফোটা পুষ্পমালা আমার বুকের ওপর বোঝা হয়ে বসছিল।

গালা, গালাচকা, গালুচকিনেতা! ফোঁটা ফোঁটা অশ্রুবিন্দু আমার চোখের পাতায় ভিড় জমাল। গোড়ার দিকে কিছুটা বিব্রতভাবে, কিন্তু ক্রমশ শিশু প্রসবের পর্যায়ক্রমিক মোচড় ও আর্তনাদসহ, যেন অনবরত এক প্রবাহের মতো গরম অশ্রুজল আমার চোখে এসে ভিড় জমাল। বেদনার রত্নখচিত রথে বসে আমার প্রিয়ে, তার জন্য এই অশ্রু। জলের তোড় একবার হ্রাস পায়, কিন্তু ফের সে চাড়া দিয়ে ওঠে, আমি দেখতে পাই গালাকে।  গালা কাদাকের এক জলপাই গাছে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে, আমাকে ডাকছে। গালা কেইপ ক্রেয়াসের সমুদ্রতটে শেষ গ্রীষ্মে মিকা নুড়ি কুড়াচ্ছে। গালা সাঁতার কেটে দূরে কোথাও সরে যাচ্ছে, আমি কেবল তার মুখের হাসিটুকু  চিনতে পারি। এইসব দৃশ্যের প্রতিটি আমার মনে জাগ্রত হয়ে অশ্রুর বন্যা হয়ে ঝরছিল, এক এক ফোঁটা হয়ে সে ফেটে বেরোচ্ছিল, অম্ল ও রোষপূর্ণ স্মৃতির বাতাবি স্বাদে।

উন্মাদের মতো আমি ছুটলাম হাসপাতালে, সেখানে সার্জনের জামা আমি এমনভাবে খামচে ধরলাম যে সে ডাক্তার যেন কোনো উন্মাদ রোগীর মুখোমুখি, এমন অভিনিবেশ নিয়ে আমাকে দেখলেন। এরপর সপ্তাহখানেক আমি অশ্রুজলে ভেসেছি, আমার নিকটাত্মীয় ও অস্তিত্ববাদী বন্ধুরা তা দেখে ভীষণ অবাক হয়েছিল। তারপর একদিন এক রোববারে গালা বিপদমুক্ত হলো, আর মৃত্যুভয় গুটি গুটি পায়ে পিছু হটল। গালুচকা হাসছিল, আমি তার হাত নিয়ে নিজের গালে ঘষলাম, তারপর মনে মনে বললাম, ‘এতকিছুর পর, আমি তোমাকে খুন করতে পারতাম।’

 

১৯

ভিয়েনায় আমার তিনটে সফরই ছিল ফলাফলবিহীন, অনুজ্জ্বল তিন ফোঁটা জলের মতো। তিনবারই একই কাজ করেছি আমি : প্রতিদিন সকালে ভেরমিয়ারে গেছি জেরনিনের চিত্র-সংগ্রহ দেখতে, আর বিকেলে ফ্রয়েড১২-এর কাছে যাবার পরিকল্পনা করেও যেতে পারিনি, কারণ প্রতিবারই তিনি স্বাস্থ্যগত কারণে শহরের বাইরে ছিলেন।

মনে পড়ে, কিঞ্চিৎ বিষণ্ণ মনে অস্ট্রিয়ার সাবেক রাজধানীর পথে কতদিন অনির্দিষ্টভাবে বিকেলে হেঁটেছি। এক প্রাচীন দ্রষ্টব্য স্থান থেকে অন্য দ্রষ্টব্য স্থানে যাবার ফাঁকে যে চকোলেট কেক চেখে দেখেছি, তার তিক্ত স্বাদ মুখে লেগে থাকত, মুখ্যত যে সাক্ষাৎকারের প্রতীক্ষায় ছিলাম, অথচ বাস্তবায়িত হচ্ছিল না, সে কথা ভেবে। সন্ধ্যায় আমি ফ্রয়েডের সঙ্গে লম্বা কাল্পনিক আলাপচারিতায় মত্ত হতাম। (এই কাল্পনিক আলাপচারিতার সূত্রে) একদিন তিনি আমার সঙ্গে বাড়ি পর্যন্ত এসেছিলেন, আমার সঙ্গে থেকেও গিয়েছিলেন, এমনকি হোটেল সাচারে সারারাত আমার ঘরের পর্দা ধরে দাঁড়িয়েও ছিলেন।

ফ্রয়েডের সঙ্গে সাক্ষাতের এই ব্যর্থ চেষ্টার বছর কয়েক পর আমি ফ্রান্সের সেন অঞ্চলে কোথায় কী খাবার পাওয়া যায় তা চেখে দেখার লক্ষ্যে এক ভ্রমণে বেরোই। প্রথম যে স্থানে ডেরা বাঁধি, সেখানে আমার প্রিয় শামুক দিয়ে আহার শুরু করি। সঙ্গীদের সঙ্গে আড্ডার একপর্যায়ে আলোচনা কেন্দ্রীভূত হলো এডগার এলেন পোকে নিয়ে। শামুক ভক্ষণের সঙ্গে আলাপের জন্য এর চেয়ে উত্তম বিষয় আর হয় না। গ্রিসের রাজকুমারী মারি বোনাপারতের সদ্য প্রকাশিত একটি বই নিয়ে কথা উঠল, যার কেন্দ্রীয় বিষয় ছিল পোর মনস্তাত্ত্বিক বিশ্লেষণ। আমাদের টেবিলের পাশে এক ভদ্রলোক পত্রিকা পড়ছিলেন, তার প্রথম পাতায় একটি খবর দেখে আমি দ্রুত সে পত্রিকার একটি সংখ্যা চেয়ে নিলাম। দেখলাম, পত্রিকা লিখেছে, নির্বাসিত অধ্যাপক ফ্রয়েড সদ্য প্যারিসে এসে পৌঁছেছেন। এই খবরের তাৎপর্য পুরোপুরি হৃদয়ঙ্গম করার আগেই আমি রীতিমতো চেঁচিয়ে উঠলাম। আমি ফ্রয়েডের দেহসংক্রান্ত গোপনীয়তা উদ্ধার করতে পেরেছি! আর তা হলো : ফ্রয়েডের মাথার খুলি আসলে একটি শামুক! তাঁর মগজ সর্পিল, সুই জাতীয় কিছু দিয়ে খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে তা বের করতে হয়। বছরখানেক পর আমি যখন মুখোমুখি বসে তাঁর পোর্ট্রেট অাঁকি এই আবিষ্কার তখন খুব কাজে দিয়েছিল।

রাফায়েল১৩-এর মাথার খুলি ঠিক উলটো। তা অষ্টভুজ, বাঁকানো মণিরত্নের মতো, যেন পাথরে লুকানো তার শিরা-উপশিরা। অন্যদিকে লিওনার্দোর১৪ মগজ হচ্ছে অনেকটা বাদামের মতো, যা আমরা টস টস করে ভেঙে চিবুই। অন্য কথায়, স্বাভাবিক মগজ।

শেষমেশ ঠিক হলো, ফ্রয়েডের সঙ্গে আমার দেখা হবে লন্ডনে। আমার সঙ্গে ছিলেন লেখক স্তেফান জভিগ ও কবি এডওয়ার্ড জেমস। প্রবীণ অধ্যাপকের বাড়ির আঙিনা পেরোবার সময় আমার নজরে এলো দেয়ালে রাখা একখানা সাইকেল, তার যাত্রী আসনে রবারের গরম এক পানির বোতল। দেখে মনে হলো তাতে পানি বোঝাই। আর বোতলের ঠিক পেছনে গুটি গুটি করে হাঁটছে একটি শামুক। ফ্রয়েডের বাড়ির আঙিনায় এইসব দ্রব্যের উপস্থিতি আমার কাছে তাজ্জব লাগছিল।

কথা আমরা খুব কমই বললাম, তবে দুজনে দুজনের চোখ দিয়ে একে অপরকে গিলে খেলাম। আমার ছবির বাইরে ফ্রয়েড আমার সম্বন্ধে কিছুই জানতেন না (আমার ছবির তিনি ভক্ত ছিলেন)। হঠাৎ ইচ্ছা হলো  তাঁর সামনে ‘বিশ্বজনীন বুদ্ধিমত্তার’ এক প্রবক্তা সাজি (অর্থাৎ পন্ডিতি করি)। পরে অবশ্য জেনেছি এর ফলে যে প্রতিক্রিয়া হয় তা ছিল আমার প্রত্যাশার ঠিক বিপরীত।

বিদায় নেওয়ার আগে ভাবলাম, প্যারানয়া বা মস্তিষ্কবিকৃতিবিষয়ক আমার প্রকাশিত একটি প্রবন্ধ তাঁকে দিই। যে ম্যাগাজিনে লেখাটি ছাপা হয়েছিল, পাতা বের করে তাঁকে সবিনয় অনুরোধ জানালাম সময় পেলে তিনি যেন তা পড়ে দেখেন। পত্রিকাটির দিকে কণামাত্র ভ্রূক্ষেপ না করে ফ্রয়েড আমার দিকে একদৃষ্টে তাকিয়ে থাকলেন। তিনি আগ্রহী হবেন এই ভেবে আমি বললাম, লেখাটি কোনো পরাবাস্তববাদী চালাকি নয়, বরং অতি উচ্চাশাপূর্ণ একটি বৈজ্ঞানিক নিবন্ধ। লেখাটির নাম পুনরাবৃত্তি করে আঙুল দিয়ে তা দেখিয়েও দিলাম। সম্পূর্ণ অমনোযোগী ফ্রয়েডের সামনে আমার গলা ক্রমশ উচ্চকণ্ঠ হয়ে আসছিল। তারপর, আমার দিকে তাঁর তীক্ষ্ণ অভিনিবেশ পরিবর্তন না করে স্তেফান জিভিগের দিকে তাকিয়ে ফ্রয়েড মন্তব্য করলেন, ‘আমি এর আগে এ রকম একজন আপাদমস্তক হিস্পানীয়কে দেখিনি। আস্ত পাগল!’ n

পাদটীকা

১.  গিয়ামবাতিস্তা দেলা পোরতা (১৫৩৫-১৬১৫) ইতালীয় অঙ্কবিশারদ, ভাষাবিজ্ঞানী ও নাট্যকার।  তাঁর প্রকাশিত বিখ্যাত গ্রন্থ ম্যাগি নাতুরালে (ন্যাচারাল ম্যাজিক)-এ তিনি দর্শন, জ্যোতির্বিদ্যা ও বিজ্ঞানের নানা বিষয়ে আলোকপাত করেন।

২.  পাওলো উত্তেলো (১৩৯৭-১৪৭৫) বিখ্যাত ইতালীয় চিত্রকর।  ছবির জন্য যতটা নয়, তার চেয়ে বেশি ছবি নিয়ে পাগলামির জন্য তিনি বিখ্যাত। ক্লাসিক্যাল কায়দা বাদ দিয়ে পুরনো গথিক কায়দায় ছবি আঁকতেন, খুব নজর দিতেন রঙের ব্যবহার ও নকশার বহুবর্ণিলতায়। অঙ্কবিদ হিসেবেও তাঁর খ্যাতি ছিল। সর্বাধিক খ্যাত চিত্রকর্মের নাম ‘দি ব্যাটেল অব সান রমানো’।

৩.  চড়ুই-জাতীয় পাখি।

৪.  ফ্রান্সের নর্মান্ডি অঞ্চলের এই শহরের নামানুসারে প্রস্ত্তত পনির তার নিজস্ব স্বাদের জন্য জগদ্বিখ্যাত।

৫.  শুধুমাত্র ডট বা ফোঁটা দিয়ে ছবি আঁকার বিশেষ রীতি ত্রোয়াতিলিজম নামে পরিচিত। ফরাসি চিত্রকর জর্জ সুরাত ও পল সিনাক এই ধারার চিত্রকলার জন্য সুপরিচিত।

৬.  গালা, সালভাদর দালির স্ত্রী (১৮৯৪-১৯৮২)। রুশ বংশোদ্ভূত ইলেইন ইভানোভনা দিয়াকোনভার জন্ম রাশিয়ার কাজান অঞ্চলে।  ১৯১৬ সালে সুইজারল্যান্ডে চিকিৎসা গ্রহণের সময় ফরাসি কবি পল এলুয়ারের সঙ্গে পরিচয় ও প্রেম। ১৯১৭ সালে প্যারিসে তাঁদের বিয়ে হয়। এলুয়ার ও গালা ফরাসি পরাবাস্তববাদী আন্দোলনের সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে জড়িত ছিলেন। সালভাদর দালি এই ধারার চিত্রকলার প্রধান মুখপাত্র। ১৯২৯ সালে স্পেন ভ্রমণের সময় এলুয়ার ও গালা দালির সঙ্গে পরিচিত হন। গালা ও দালির আজীবন স্থায়ী এক প্রেমের সেই সূচনা। ১৯৩৪ সালে তাঁরা আনুষ্ঠানিকভাবে বিয়ে করেন। শুরু থেকেই গালা দালির ছবি কেনাবেচার সকল ব্যবসায়িক দিক নিজ দায়িত্বে গ্রহণ করেন। দালি গালাকে নিজের আরাধ্য দেবী হিসেবে উপস্থিত করলেও তাঁরা উভয়েই বহুগামী হিসেবে পরিচিত ছিলেন। কাতালনের গিরনাতে দালির কেনা ‘পুবল দুর্গে’ ৯৬ বছর বয়সে গালার মৃত্যু হয়। সে দুর্গ এখন দালি-গালা মিউজিয়াম নামে পরিচিত।

৭.  মিনাতুর – এই নামে পরাবাস্তববাদীদের সাময়িকীটি প্রকাশিত হয় ১৯৩৩-৩৯ সালে, অাঁদ্রে ব্রেতো ও  পিয়ের মাবিয়েরের সম্পাদনায়। সালভাদর দালি এই পত্রিকার নিয়মিত লেখক ছিলেন।

৮.  মারি-লরে নোয়াই ও তাঁর স্বামী ভিকম্টেস দে নোয়াই বিশ শতকের গোড়ার দিকে ফরাসি ও আন্তর্জাতিক আধুনিক শিল্পকলার অন্যতম প্রধান সমর্থক। বুনুয়েল ও দালির নির্মিত চলচ্চিত্র লা’জ দো’অর (১৯৩০) তাঁরা প্রযোজনা করেছিলেন।

৯.  জ্যাক লাকঁ (১৯০১-৮১) বিখ্যাত ফরাসি মনোবিশারদ। উত্তর-আধুনিক শিল্প-সাহিত্য ও নারীবাদী গবেষণায় তাঁর রচনার প্রভাব লক্ষণীয়।

১০.     ভিত্তরে কারপাচিও (১৪৬০-১৫২৫) ইতালীয় রেনেসাঁসের অন্যতম প্রধান প্রবক্তা।

১১. অাঁদ্রে ব্রেতো (১৮৯৬-১৯৬৬) বিখ্যাত ফরাসি লেখক ও কবি।  তিনি সর্বাধিক পরিচিত পরাবাস্তববাদী আন্দোলনের প্রধান সংগঠক হিসেবে। এই আন্দোলনের ইশতেহারটি তাঁরই লেখা।

১২.     সিগমুন্ড ফ্রয়েড (১৮৫৬-১৯৩৯) বিখ্যাত অস্ট্রীয় মনোবিশারদ। মনোবিশ্লেষণ, মানসিক চিকিৎসার এই শাখাটির তিনি প্রবর্তক বলে ধরা হয়। মানুষের ব্যবহারে যৌন চেতনার ভূমিকা বিষয়ে তাঁর গবেষণা পরাবাস্তববাদী শিল্পীদের প্রবলভাবে প্রভাবিত করে। ফ্রয়েডের মৃত্যুর পর তাঁর কোনো কোনো অনুসারী মনোবিশ্লেষণ পদ্ধতির নির্ভুলতা নিয়ে প্রশ্ন তোলেন।

১৩.     রাফায়েল (১৪৮৩-১৫২০) বিখ্যাত ইতালীয় চিত্রকর ও স্থপতি। মাইকেলএঞ্জেলো, লিওনার্দো দা ভিঞ্চি ও রাফায়েলকে ইতালীয় রেনেসাঁসের তিন প্রধান প্রতিনিধি হিসেবে বিবেচনা করা হয়। রাফায়েলের অাঁকা অনেক দেয়ালচিত্র বা ফ্রেস্কো রোমের ভ্যাটিকান গির্জায় এখনো শোভা পাচ্ছে।

১৪. লিওনার্দো দা ভিঞ্চি (১৪৫২-১৫১৯) বিখ্যাত ইতালীয় চিত্রকর, ভাস্কর ও বিজ্ঞানী। বিশ্বের শ্রেষ্ঠ বিজ্ঞানী-চিত্রকর হিসেবে তিনি স্বীকৃত। ‘মোনালিসা’ ও ‘লাস্ট সাপার’ তাঁর সর্বাধিক পরিচিত ছবি।

 

(সালভাদর দালির আত্মজীবনী দি সিক্রেট লাইফ অব সালভাদর দালি, ডোভার পাবলিকেশান্স, নিউইয়র্ক ১৯৯৩ অবলম্বনে)

Leave a Reply