logo

সালভাদর দালি খন্ডচিত্রে আত্মপরিচয়

ভাষান্তর : হা সা ন  ফে র দৌ স

পঞ্চম অধ্যায়

শৈশবস্মৃতি

আমি আমার চোখ বন্ধ করি ও মনোযোগ নিবিষ্ট করি দূরের সেই সব স্মৃতির প্রতি, যা স্বতঃস্ফূর্তভাবে প্রকাশিত হয় এবং যা সর্বাধিক উজ্জ্বল। আর সেই সবই হলো আমার শৈশবের প্রকৃত স্মৃতি। আমার নজরে আসে দুটি সাইপ্রেস গাছ, বেশ বড়, গাছদুটি দৈর্ঘ্যে প্রায় সমান। বাঁদিকেরটি সামান্য খাটো, তার মাথাটা অপর গাছ, যেটা একদম খাড়া, তার দিকে কিছুটা নুয়ে পড়া। ফিগেরাসের খ্রিশ্চান ব্রাদার্স স্কুলের ১ নম্বর কক্ষের জানালা দিয়ে আমি গাছদুটির দিকে তাকিয়ে থাকি। সিনর ত্রেইতের বিদ্যালয়ে আমার লেখাপড়ার বেজায় ক্ষতি হয়েছে, এই ধারণার ভিত্তিতে আমাকে শিক্ষালাভে এখানে পাঠানো হয়। এই জানালা, যা আমার দৃষ্টিপথে ‘ফ্রেম’-এর কাজ করত, তা খোলা হতো শুধু বিকেলবেলায়, আর তখন থেকে বাকি পুরো সময়  আমি ব্যয় করতাম জানালা দিয়ে ওই দুই গাছে দিনের আলোর রং কীভাবে বদলায় তা পর্যবেক্ষণ করতে। আমাদের স্কুলভবনে সে আলোর ছায়া পড়ত, যা ক্রমশ দীর্ঘ হয়ে উঠত। ঠিক সূর্য ডোবার আগে ডানদিকের সাইপ্রেসের আগায় সূর্যের আলো ঠিকরে পড়ত, তার রং হতো ঘন লাল, দেখে মনে হতো কেউ বুঝি তাকে রক্তিম মদিরায় চুবিয়ে এনেছে। আর বাঁদিকের সাইপ্রেসটি, যা ততক্ষণে ছায়ায় ঢেকে গেছে, মনে হতো ঘন কৃষ্ণবর্ণের। আর তখনই গির্জার ঘণ্টা বেজে উঠত। তখন আমরা দাঁড়িয়ে দুই হাত মুড়ে ধর্মস্তোত্র পাঠ করতাম।

গাছদুটি দেখে আমি ক্লাসের একঘেয়েমি কাটাতে চেষ্টা করতাম। সিনর ত্রেইতের ক্লাসে সুবিধা ছিল তিনি ঘুমোতেন, তার ফলে আমি যা খুশি করতে পারতাম। কিন্তু এই স্কুলের ব্রাদাররা আমার মনোযোগ আকর্ষণের জন্য যত রকম নির্মম পদ্ধতি আছে, তার সবই অনুসরণ করতেন। তার ফল অবশ্য হতো উলটো, আমার বহির্বিশ্বকে সম্পূর্ণ উবে দেওয়ার ক্ষমতা তা আরো বহুগুণে বাড়িয়ে দিত। আমি কারো সঙ্গে কথা বলতাম না, কাউকে স্পর্শ করতে দিতাম না, আমার মস্তিষ্কের ভেতর তখন কী চলছে, সে-কথা কাউকে বিন্দুবিসর্গ বুঝতে দিতাম না। সিনর ত্রেইতের ক্লাসে যে সুখকল্পনা শুরু হয়েছিল, এখানে তা যেন দ্বিগুণ তীব্রতায় শুরু হলো। এই সুখকল্পনা এখন বিপদগ্রস্ত, সে-কথা টের পেয়ে আমি যেন তাকে আরো গভীরভাবে অাঁকড়ে ধরলাম।

সন্ধ্যার গির্জা ঘণ্টার পর সাইপ্রেস গাছ দুটো অন্ধকারে ডুবে যেত। কিন্তু অাঁধারে ডুবে গেলেও তাদের রেখা আমার মনে ধরা থাকত, আমি ফিরে ফিরে তাদের দিকে তাকাতাম, যদিও তাদের আর দেখা যেত না। গির্জার ঘণ্টাধ্বনির সঙ্গে সঙ্গে করিডরে ও ক্লাসে আলো জ্বলে উঠত। দরজার কাচের ভেতর দিয়ে নজরে আসত করিডরের দেয়ালে সাজানো তৈলচিত্রগুলো। আমার ক্লাস থেকে ভালোভাবে দেখা যেত দুটি তৈলচিত্র, তার একটি ছিল এক শেয়ালের, যার মুখে ধরা মৃত হাঁস, কোনো গুহা থেকে সে মাথা বের করছে। অন্যটি ছিল মিলের আঞ্জেলাস১-এর একটি অনুলিপি।  ছবি দুটো আমার মনে এক বিচিত্র উদ্বেগের সৃষ্টি করত, অনেক দিন পরেও সে অনুভূতি রয়ে গিয়েছিল। ওই ছবি দেখে মনে হতো কেউ বুঝি আমাকে পাহারা দিচ্ছে, সে বোধ থেকে এক ধরনের গোপন ও শুদ্ধ আনন্দ আমি অনুভব করতাম, যা ছিল ধবল কোনো ছুরির মতো, যা অপরাধী হলেও সূর্যালোকে জ্বলজ্বল করত।

ক্লাস কখন শেষ হবে, তার জন্য যখন আমি অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করতাম, আর এই পুরোটা সময় পাঁচটি অতি অনুগত ও বিশ্বস্ত রক্ষী আমাকে পাহারা দিয়ে রাখত। আমার বাঁয়ে বাইরের সাইপ্রেস গাছদুটি, ডানে আঞ্জেলাসের দুই ছায়া, আর সামনে যিশু খ্রিষ্টের প্রতীকে ঈশ্বর – শিক্ষকের টেবিলের পেছনে কাঠের ক্রুশে যা ঝোলানো থাকত। যিশুর দুই পায়ে দুটি গভীর ক্ষতচিহ্ন, অ্যানামেলে অাঁকা সে ক্ষত ভেদ করে দেখা যেত হাড়। যিশুর পা ছিল ছেলেদের দৈনিক হাতের ছোঁয়ায় বিবর্ণ, নোংরা। নিয়ম ছিল প্রতিদিন ক্লাস থেকে বিদায় নেওয়ার আগে শিক্ষকের লোমশ হাত চুম্বনের পর এবং বুকে ক্রুশচিহ্ন অাঁকা শেষ হলে আমাদের যিশুর ক্ষতাক্ত পদযুগল হাত দিয়ে ছুঁতে হতো।

আমি যে একদৃষ্টে বাইরে তাকিয়ে থাকি, স্কুলের ব্রাদারদের তা নজর এড়ায়নি। স্কুলে আমি ছিলাম একমাত্র ছাত্র, যার ওপর জানালাখানির এমন নিরঙ্কুশ প্রভাব ছিল। সে কারণে তারা আমার বসার স্থান বদল করে দিলেন, ফলে সাইপ্রেস দুটি আমার দৃষ্টি সীমানার বাইরে চলে গেল। তাতে কি, আমি তবুও নাছোড়বান্দার মতো তাদের দিকে তাকিয়ে থাকতাম, ঠিক যেখানে গাছদুটি ছিল তার অবস্থান মনের মধ্যে গেঁথে নিতাম। ইচ্ছাশক্তির প্রাবল্যে আমি যেন দেয়াল ভেদ করে দেখতে সক্ষম হতাম, আমার কল্পনার চোখে তাবৎ কিছুই পুনর্গঠিত হতো। কখন কোন প্রহর, তা ঠাহরের জন্য আমাকে নির্ভর করতে হতো ক্লাসের অভ্যন্তরে তখন কী ঘটে চলেছে, তার ওপর। যেমন, এখন প্রশ্নোত্তর পালা, তার মানে ছায়া এখন ডানদিকের সাইপ্রেসের ওপর স্থির হয়েছে, সে গাছের গায়ে জ্বলে যাওয়া যে ফোকর রয়েছে, ছায়া সেইতক পৌঁছেছে, সেই ফোকর থেকে বেরিয়ে এসেছে শুকনো একটা ডাল, আর সেই ডালের ওপর রয়েছে সাদা এক টুকরো কাপড়। আমি ঠিক দেখতে পেতাম পিরেনিস পাহাড়ের রং, যা এখন নিশ্চয় বেগুনি, আর এখন – যেমন আমি দিন কয়েক আগে দেখেছিলাম – বহু দূরের গ্রাম, ভিলা বেরত্রান – এর এক একটা জানালা দিয়ে ঠিকরে বেরোচ্ছে আলো। আর এইভাবে নিকষ কালো অন্ধকারেও ঠিকরে উঠত হিরের দ্যুতির মতো হঠাৎ আলোর ঝলকানি। আম্পারদানের সমতল ভূমি, যা পরবর্তীকালে আমার শিল্প ও দর্শন ভাবনাকে নির্মাণ করবে, তাকে দেখতে না দেওয়ার এ ছিল এক মোক্ষম জবাব।

ব্রাদারদের পক্ষে বুঝতে দেরি হলো না আমাকে জানালার দৃষ্টি সীমানার বাইরে নিয়ে যাওয়ায় খুব একটা লাভ হয়নি। বরং ঘটল ঠিক উলটো। তারা আমার এই একাগ্র ব্যক্তিগত আনন্দকে রীতিমতো ঘৃণা করা শুরু করল।

একদিন রাতে খেতে বসে আমার স্কুলের রিপোর্ট কার্ড পড়তে গিয়ে আমার বাবা রীতিমতো আতঙ্কগ্রস্ত হয়ে পড়লেন। রিপোর্টে আমার সুশীল স্বভাব ও শৃঙ্খলাবোধের কথা উল্লেখ করা হলো। বলা হলো হৈচৈ এড়িয়ে চলা আমার স্বভাব। চকোলেটের কাগজে মোড়া কোনো ছবি দেখে আমি হয়তো মশগুল হয়ে যাই (কোন ছবিটির কথা বলা হলো তা বোঝা আমার জন্য কঠিন ছিল না)। কিন্তু এরপর মন্তব্য হিসেবে জুড়ে দেওয়া হলো যে, আমি এমন একধরনের মানসিক আলসেমিতে এতটা ডুবে আছি যে আমার পক্ষে লেখাপড়ায় আদৌ কোনো অগ্রগতি অর্জন সম্ভব নয়। মনে আছে সে-কথা শুনে মা বেজায় কেঁদেছিলেন। সত্যি কথা হলো, পুরো একটা বছর কাটানোর পরেও আমি অন্য ছাত্রদের তুলনায় প্রায় কিছুই শিখিনি। অন্যরা যেখানে তরতর করে সামনে এগোচ্ছিল, আমি সেখানে একই ক্লাসে পড়ে ছিলাম। আমি ইচ্ছা করেই বারবার ভুল করতাম, জানা জিনিসও ভাব করতাম জানি না।

একদিন এক টুকরো চকচকে কাগজের এক নোটবুক পাওয়ার পর আমি হঠাৎ করেই যেন যথাযথভাবে লেখার আনন্দ আবিষ্কার করলাম। দুরুদুরু বক্ষে, বলপয়েন্ট কলমের আগা বার কয়েক নিজের জিহবায় ভিজিয়ে এমন চমৎকার করে হাতের লেখা শেষ করলাম যে আমি সেবার হাতের লেখার প্রতিযোগিতায় সেরা হলাম এবং আমার হাতের লেখা কাচের ফ্রেমে বাঁধিয়ে রাখা হলো।

আমার হস্তাক্ষরের এই জাদুকরী পরিবর্তন আমাকে ‘অতীন্দ্রিয়তা ও অনুকরণ প্রবণতার’ পথে অগ্রসর হতে অনুপ্রাণিত করল। এই দুই পদ্ধতি ছিল ‘সামাজিক যোগাযোগে’ আমার অনুসৃত দুই পদ্ধতি। ক্লাসে কোনো পাঠ বিষয়ে প্রশ্ন করা হলে আমি হাতে ধরা খাতা বা বই, যা বিগত ঘণ্টাখানেক প্রবল অভিনিবেশে পাঠের ভান করছিলাম, তা ছুড়ে ফেলে এমন একটা ভঙ্গি করতাম যে পুরো ব্যাপারটা আমার নখদর্পণে রয়েছে। আমি বেঞ্চের ওপর উঠে দাঁড়াতাম, আবার চট করে নেমে পড়তাম, যেন কী এক ভয় আমাকে গ্রাস করেছে, আর দুই হাত দিয়ে নিজেকে অজ্ঞাত সেই ভীতি থেকে আগলাবার চেষ্টা করতাম। তারপর ভীতসন্ত্রস্ত হয়ে ডেস্কে বসে পড়তাম, আমার দুই হাত দিয়ে ঢাকা থাকত আমার মাথা। এই মূকাভিনয়ের ফলে বিস্মিত ব্রাদার – আমি অসুস্থ বোধ করছি এই ধারণা থেকে – আমাকে বাগানে কিছু সময় হেঁটে আসার অনুমতি দিতেন। ক্লাসে ফিরে এলে আমাকে সুগন্ধযুক্ত এক ভেষজ চায়ের পানীয় পান করতে দেওয়া হতো। আমার বাবা-মাকে আমার এই দৃষ্টিবিভ্রমের কথা নিশ্চয় জানানো হয়েছিল, তাদের অনুরোধেই স্কুলে আমার প্রতি মনোযোগ আরো কয়েকগুণ বেড়ে গেল। ফলে, ক্রমান্বয়ে স্কুলে আমার অবস্থা অন্য সবার চেয়ে আরো বেশি আলাদা হয়ে এমন অবস্থায় পৌঁছাল যে, শিক্ষককুল আমাকে বিদ্যাদানের সকল চেষ্টা থেকে বিরত থাকা শুরু করলেন।

আমাকে অসুস্থ বিবেচনা করে প্রায়ই ডাক্তারের কাছে নিয়ে যাওয়া হতো। এ ছিল সেই ডাক্তার, আমার বোনকে কান ফুটো করার সময় একবার যার চশমার কাচ আমি ভেঙে দিয়েছিলাম। এদিকে বার কয়েক সিঁড়ি ধরে ওঠানামা করার ফলে আমার মাথা ঘুরছে। নাক দিয়ে রক্ত পড়া ও কণ্ঠনালির প্রদাহের সমস্যায়ও আমি ভুগতাম। প্রতিবারই ঘটত একই ঘটনা : একদিনের জ্বর, সাতদিন নিরাময়ের জন্য ছুটি। এই সময়ে আমি আমার ঘরেই বিভিন্ন প্রাকৃতিক ক্রিয়া-কর্ম সারতাম। ঘরের দুর্গন্ধ দূর করতে আমার ঘরে পাঠিয়ে দেওয়া হতো বেগুনি রঙের আর্মেনীয় কাগজে মোড়া এক ধরনের আগরবাতি। কখনো আর্মেনীয় কাগজ না পাওয়া গেলে চিনি পোড়ানোর ব্যবস্থা হতো, যা কিনা ছিল আরো সুস্বাদু। সত্যি বলতে কি, প্রদাহ ব্যাপারটা আমার ভালোই লাগত। এই রোগের আগমন আমি আগ্রহ নিয়ে অপেক্ষা করতাম। লুসিয়া, আমার পুরনো দাইমা, সে-সময় আমার সঙ্গে সঙ্গে থাকত। দাদিমাও তাঁর উল বুনুনির কাজ নিয়ে আমার ঘরে জানালার কাছে বসতেন। আমার মা-ও কখনো কখনো তাঁর বান্ধবীদের নিয়ে এসে বসতেন। আমি এক কান দিয়ে লুসিয়ার বলা গল্প শুনতাম, অন্য কান দিয়ে শোনার চেষ্টা করতাম বড়দের গালগপ্প। আর কখনো যদি জ্বর বেড়ে যেত, তাহলে মাথাটা ঝিমঝিম করত, তখন বাস্তব-অবাস্তবের ভেদরেখা দূর হতো, আর আমি দেখতে পেতাম সাদা পোশাক পরা এক দেবদূতকে, লুসিয়া যাকে পরিচয় করাত ঘুমের দেবতা হিসেবে।

লুসিয়া ও আমার দাদিমা আমার জানা মতে সবচেয়ে  পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন দুজন মানুষ, তাদের শুভ্র চুল ও নাজুক কিন্তু কুঁচকে আসা চামড়া আমার চোখে ছিল অপূর্ব সুন্দর। লুসিয়া দেখতে বড়সড় আকারের ছিল, অনেকটা পোপের মতো। আর দাদিমা ছিল ছোটখাটো, অনেকটা এক কাটিম সাদা সুতোর মতো। এঁদের দেখেই বার্ধক্য ব্যাপারটা আমার কাছে দারুণ মনে হতো!

বস্ত্তত, আমি হলাম অ্যান্টি-ফাউস্টের জীবন্ত অবতার, তার পুনঃপ্রকাশ। শৈশবে আমি বৃদ্ধদের সৌম্য দর্শনে এতটা মুগ্ধ ছিলাম যে, অনতিবিলম্বে বৃদ্ধ হয়ে গেলে নিজের দেহ আমি অনায়াসে দান করতে প্রস্ত্তত ছিলাম। হ্যাঁ, আমিই ছিলাম অ্যান্টি-ফাউস্ট। সেই লোক – অর্থাৎ ফাউস্ট বস্ত্তত ছিল নেহাতই হতভাগা। বার্ধক্যের বিপুল জ্ঞান অর্জন সত্ত্বেও সে নিজের আত্মা শয়তানের কাছে বিক্রি করেছিল শুধু তার দেহের অবচেতন যৌবন ফিরে পাবার জন্য। বার্ধক্যে আমার কোনো আপত্তি ছিল না, যদি আত্মার ধীশক্তি, তার বুদ্ধিমত্তা, আমি সংরক্ষণে সক্ষম হতাম। শৈশবে আমি মসৃণ ত্বকের এক জানোয়ার ছিলাম, তাকে ঘৃণা করতাম, সম্ভব হলে তাকে দু-পায়ে মাড়িয়ে শেষ করে দিতাম। আমার কাছে বাসনা ও বিজ্ঞান এই দুইয়ের মধ্যে কোনো প্রভেদ ছিল না। আমি এ-ও জানতাম, দেহের ভঙ্গুরতার ভেতর দিয়েই অর্জিত হয় পুনরুত্থানের অভিজ্ঞান।

মানছি, গণিতশাস্ত্র বা গণনাবিদ্যায় আমি কখনো পারঙ্গম ছিলাম না, সে বিদ্যা অর্জনে আমি বরাবরই পিছিয়ে ছিলাম। কিন্তু নয় বছর বয়সেই আমি, এই সালভাদর দালি, মিমেসিস বা অনুকরণ তত্ত্ব কেবল আবিষ্কারই করি তা নয়, সে তত্ত্বের পূর্ণাঙ্গ ব্যাখ্যাতেও পারঙ্গম হয়ে উঠি।

কাদাকেসে সে বছর আমার নজরে আসে এক ধরনের গুল্ম, সমুদ্রতীর বরাবর এগুলো বিপুল সংখ্যায় দেখা যেত। কাছ থেকে দেখলে নজরে আসত এই গুল্মগুলো খুব সরু এক ডালের ওপর ভর দিয়ে টিকে আছে। তারা এমনই ভঙ্গুর, যেন সামান্য বাতাসেই নেতিয়ে পড়বে। একদিন আমি লক্ষ করি, সে গাছের গোটাকয় পাতা বাকি গাছের সমর্থন ছাড়া নিজেরা একাই দুলছে। এমনকি আমার এমনও বোধ হলো যে তারা হাঁটছে! আমি সে গাছের কিছু পোকা-পাতা আলাদা করে রাখলাম অবসরমতো নিকট থেকে পর্যবেক্ষণের জন্য। পেছন থেকে দেখলে এই পাতাগুলিকে গাছের অন্য পাতার থেকে ভিন্ন কিছু মনে হতো না, কিন্তু তাদের উলটে ধরলে মনে হতো কোনো গুবরেপোকা, তবে তাদের পা-গুলি খুবই ভঙ্গুর, আর স্বাভাবিক অবস্থায় চোখে দেখা যেত না। সত্যি বলতে কি, এই পোকা-পাতা আবিষ্কারের পর আমার মনে হলো প্রকৃতির এক জাদুকরী গোপন তথ্য আবিষ্কার করেছি। (ভলতেয়ারের অদৃশ্য প্রতিচ্ছবি পোকা-পাতার এই মিমেসিসের সঙ্গে তুলনীয়, গঠন [ফিগার] ও পশ্চাদ্ভূমির [ব্যাকগ্রাউন্ড] মধ্যে সাদৃশ্য ও বিভ্রান্তির দরুন যা দৃষ্টির বাইরেই রয়ে যায়।) আমার মনে বিন্দুমাত্র সন্দেহ ছিল না, মিমেসিসের এই রোমহর্ষক আবিষ্কার আমার চিত্রকর্মে অনেকে যে অদৃশ্য ও ভ্রান্তিমূলক প্রচ্ছায়া আবিষ্কার করেন তার প্রভাবেরই ফল। নিজের এই গর্বিত আবিষ্কার আমি নিজের চিত্রকলার অলৌকিক বৈশিষ্ট্য নির্মাণে ব্যবহার করেছি। তখন থেকে এই দাবি করা শুরু করলাম যে, ব্যক্তিগত অলৌকিক ক্ষমতাবলে আমি জড়বস্ত্তকে জীববস্ত্ততে পরিণত করার ক্ষমতা অর্জন করেছি। সে গাছের গোছা গোছা পাতা থেকে গোটা কয়েক ছিঁড়ে আমি হাতসাফাইয়ের মাধ্যমে তাদের স্থলে পোকা-পাতা বদলে রাখতাম, তারপর খাবার টেবিলের মাঝখানে এক টুকরো গোলাকার প্রস্তরখন্ড, যার জাদুকরী ক্ষমতা আছে বলে আমি দাবি করতাম, তা দিয়ে বারবার আঘাত করতাম এইজন্য যে, এর ফলে সে পাতায় জীবন জেগে উঠবে।

প্রথম প্রথম সবাই ভাবত আমার দ্রুত হাতচালনার জন্যই পাতাগুলো নড়ছে। কিছুক্ষণ পর আমি হাত নাড়ানো ক্রমশ কমিয়ে দিতাম, কিন্তু তারপরও পাতাগুলো থিরথির করে নড়ত, কোনো বাইরের প্রভাব ছাড়াই নিজস্ব শক্তিতে তারা গতি সঞ্চারে সক্ষম হতো। পাতাগুলো সত্যি সত্যি হাঁটতে পারে দেখে লোকজন সবিস্ময়ে চিৎকার করে উঠত। আমি এই এক্সপেরিমেন্ট নানা সময় – বিশেষ করে জেলেদের কাছে – করে দেখাতাম। এই গাছ এবং এর পোকা বিষয়ে অনেকেই জানত, কাদাকেসে এ গাছের তো আর অভাব ছিল না, কিন্তু তার পাতা যে এভাবে হাঁটতে পারে, একথা তাদের অজ্ঞাত ছিল। অনেক পরে, ১৯১৪ সালে প্রথম মহাযুদ্ধ শুরুর সময়, কাদাকেসের সমুদ্রসীমায় আমার নজরে আসে ‘ক্যামুফ্ল্যাজ’ বা ছদ্মবেশে থাকা যুদ্ধজাহাজ। তখন আমার নোটবুকে আমি লিখেছিলাম, পাতা-পোকা, যার নাম আমি দিয়েছিলাম ‘মরো দ্য কঁ’ (কাতালোনীয় ভাষায় এই শব্দটি খুব অশ্লীল, অন্য ভাষায় তা অনুবাদও অসম্ভব। নারীদেহের যৌনাঙ্গের প্রতি ইঙ্গিত করে জেলে ও কৃষকেরা শব্দটি ব্যবহার করত কাউকে অতি ধূর্ত এই কথা বলে নিন্দা করতে) তার এক ব্যাখ্যা আবিষ্কারে সক্ষম হলাম। আমার গাছ-পোকাকে কেন, কার হাত থেকে রক্ষা পেতে এমন ছদ্মবেশ নিতে হয়েছিল?

শৈশবে ছদ্মবেশ ধারণ ছিল আমার এক গভীর আগ্রহের বিষয়। একবার যেমন রাশিয়ার কথা ভেবে তুষারপাত দর্শনের প্রবল ইচ্ছা জেগেছিল, ঠিক সেই রকম হঠাৎ আমি বার্সেলোনায় এক পিতৃব্যের কাছ থেকে এক উপহার পেলাম, যাতে ছদ্মবেশ ধারণের নানা উপকরণ ছিল।

উপহার পাওয়ার দিন সন্ধ্যায় আমি সাজভূষা পরে আয়নায় নিজেকে দেখলাম। মাথায় মুকুট, আমার স্কন্ধাবৃত জোববা; কিন্তু শরীরের বাকি অংশ সম্পূর্ণ উদাম। আমি তখন নিজের শিশ্ন চেপে ধরে দুই পায়ের মাঝখানে রেখে তা দৃষ্টির বাইরে নিয়ে গেলাম, দেখে যেন মনে হয় আমি একটি বালিকা। ততদিনে তিনটি জিনিসের প্রতি আমার আসক্তি গড়ে উঠেছে : দুর্বলতা, বার্ধক্য ও বিলাসিতা।

এ সময় প্রায়ই আমার মা আমাকে জিজ্ঞেস করতেন, খোকা, তোর কী চাই, কোন জিনিসটা তোর প্রয়োজন? আমি জানতাম কোনটা আমার চাই। আমি চাইতাম বাড়ির ছাদে রাখা দুটি কাপড়ধোয়া ঘর, যা ততদিনে কাপড়ধোয়ার বদলে স্টোর রুম হিসেবেই ব্যবহৃত হতো। সে ঘর থেকে অনায়াসে চত্বরে নেমে আসা যেত। একদিন সে ঘরকে আমার স্টুডিও হিসেবে ব্যবহারের অনুমতি দেওয়া হলো। দেখলাম, গৃহপরিচারিকা এক এক করে সে ঘরের সব জিনিস সরিয়ে অন্যত্র নিয়ে যাচ্ছে। খুবই ছোট ছিল কক্ষটি, এত ছোট যে কাপড় ধোয়ার পাকা থালা বা ট্রে বাদ দিলে সে ঘরে অবশিষ্ট কোনো জায়গাই থাকত না। কিন্তু সে ক্ষুদ্র কক্ষই পূর্ববর্ণিত মাতৃগর্ভের স্মৃতির আনন্দ আমাকে স্মরণ করিয়ে দিল।

আমি ঘরটা মনের মতো করে সাজালাম। নিজের কেদারাখানি রাখলাম সেই পাকা ট্রের ওপর। উল্লম্ব কাঠের বোর্ডটি রাখলাম আড়াআড়ি করে, যা সে ট্রের অর্ধেক জুড়ে থাকত। এই ছিল আমার স্টুডিও। কোনো কোনো খুব গরমের দিনে আমি উদাম হয়ে বসতাম, পানির কল ছেড়ে সেই ট্রেতে পানি বোঝাই করে নিতাম। সূর্যের তাপে সে পানি থাকত ঈষদুষ্ণ। অনেকটা মোজার্টের বাথটাবের মতোই। সেই ছোট ঘরের দেয়ালজুড়ে থাকত বিভিন্ন বস্ত্তর ওপর আমার অঙ্কিত চিত্রাবলি। বেশির ভাগই ছিল আমার ফুফুর গম মাড়াইয়ের দোকান থেকে চুরি করা কাগজের বাক্স, তার ওপর অাঁকা ছবি। সেই শানবাঁধানো ট্রের ওপর আমি দুটি তৈলচিত্র এঁকেছিলাম। তার একটি ছিল জোসেফ (ইউসুফ) (মিসরে) তার ভাইদের সঙ্গে মিলিত হচ্ছে, যার পুরোটাই ছিল আমার কল্পনাপ্রসূত। অন্যটি ছিল ইলিয়াদের সংক্ষিপ্ত গল্পের এক বইয়ের ভেতর অাঁকা ট্রয়ের হেলেনের একটি ছবি থেকে অনুপ্রাণিত। সে ছবির শিরোনাম দিয়েছিলাম, স্মৃতি-ভারাক্রান্ত হেলেনের নিদ্রাতুর হৃদয়। এই ছবির এক কোনায় আমি অতি উচ্চ এক দুর্গ অাঁকলাম, যার শীর্ষে ছিল এক খুদে মানুষের ছবি। নির্ঘাত সে মানুষটি ছিলাম আমি। অন্য যেসব ছবি আমি এখানে অাঁকি তার মধ্যে অনেকগুলি ছিল ১৯২৯ সালে প্যারিসে যেসব পরাবাস্তব ছবি অাঁকি, তার প্রথম সংস্করণ। এই সময়ে আমি কাদামাটি দিয়ে ‘ভেনাস অব মিলো’ শিল্পকর্মের একটি কপি বানানো শেষ করি। ভাস্কর্য নির্মাণে যে গভীর যৌন আনন্দ আছে, এ ছিল তার প্রথম অভিজ্ঞতা। (আমার স্ত্রীর নাম হওয়ার কথা ছিল হেলেন)।

এই কাপড় ধোয়ার কক্ষে আমি একেক করে বাবার কাছ থেকে পাওয়া ছোট ছোট ছবির নানা বই, যা বাবা আমাকে সেসবের অর্থ না বোঝার আগেই উপহার হিসেবে দিয়েছিলেন, এনে সাজালাম। আমার জীবনে এইসব ছবির বইয়ের প্রভাব ছিল প্রবল। এইসব বই থেকে আমি শিল্পের ইতিহাসের সেরা চিত্রকর্মের সঙ্গে পরিচিত হই। সবচেয়ে বেশি আমাকে যা আকৃষ্ট করত তা হলো নগ্ন নারীদেহের ছবি। তার মধ্যে সবচেয়ে প্রিয় ছিল ইনগ্রের ‘গোলডেন এজ’ ছবিটি। আমার চোখে বিশ্বের সবচেয়ে সুন্দর এই ছবিতে অঙ্কিত নগ্ন বালিকাটির প্রেমে পড়ে যাই আমি। সে বালিকা ছিল এই ছবিতে এক ঝর্নার প্রতীক।

এখানে সেই লন্ড্রি ঘরের সব কথা বলা যাবে না। একটা জিনিস ঠিক, আর তা হলো ঠাট্টা দিয়ে হুল ফোটানোর ব্যাপারটা আমি এখানেই শিখেছিলাম। চোখের কোনা নাচিয়ে ও সামান্য বিদ্রূপের হাসি ধরে রাখার ব্যাপারটা আমি এখানেই প্রথম পরীক্ষা করা শুরু করি। এখানেই আমি – কিছুটা অস্পষ্ট হলেও – বুঝতে শিখি যে আমি কত বড় জিনিয়াস। দালি, তুমি তো এখন নির্ঘাত জানো, একবার যদি জিনিয়াসের ভূমিকার অভিনয় শিখে যাও, একদিন তুমি জিনিয়াস হয়ে উঠবে।

আমাদের বাসায় কেউ বেড়াতে এলেই জিজ্ঞেস করত, সালভাদর কোথায়? বাবা-মা জবাবে বলতেন, ও তো ওপরে। ছাদের কাপড়ধোয়া ঘরে ও নাকি ছবি অাঁকার স্টুডিও বানিয়েছে। সেখানেই সে ঘণ্টার পর ঘণ্টা কাটায়।

‘ওপরে!’ কী চমৎকার একটা কথা। আমার সারাটা জীবন পরিচালিত হয়েছে এই দুই পরস্পরবিরোধী কথা – ওপর ও নিচ – তা দ্বারা। সারা জীবন, সেই শৈশব থেকে সচেতন থেকেছি শীর্ষে ওঠার। এখন যখন ঠিক সেখানেই আমার অবস্থান, এখান থেকে আমি আর নড়ছি না। n

 

পাদটীকা

১.      অ্যাঞ্জেলাস : ফরাসি চিত্রকর জঁ ফ্রাসোয়াঁ মিলের অাঁকা  তৈলচিত্র। দিনশেষে গির্জাধ্বনি শোনার সঙ্গে সঙ্গে মাথা নুইয়ে প্রার্থনা করছে দুই কৃষক, এই ছবিতে সেই মুহূর্তের বাস্তবধর্মী প্রকাশ রয়েছে।

২.       ফ্রান্স ও স্পেনের সীমান্ত বরাবর পর্বতমালা।

৩.      হোমারের লেখা বিখ্যাত গ্রিক কাব্য।

৪.      প্রাচীন গ্রিসে নির্মিত সর্বাপেক্ষা খ্যাত একটি ভাস্কর্যের নাম। খ্রিষ্টপূর্ব
১০০-১৩০ বছরে নির্মিত এই ভাস্কর্যের বিষয় গ্রিক আফ্রোদিত।

৫.      ইয়ানুগুস্ত দমিনিক ইনগ্রে (১৭৮০-১৮১৬) বিখ্যাত ফরাসি নিওক্লাসিক্যাল চিত্রকর। তার অাঁকা ‘গোলডেন এজ’ ছবিটি মাতিসসহ অনেক আধুনিক চিত্রকরকে প্রবল প্রভাবিত করে।

 

(দ্য সিক্রেট লাইফ অব সালভাদর দালি, ইংরেজি অনুবাদ : হাকন এম শেভালিয়ে অবলম্বনে)

Leave a Reply