logo

সমাজ ও চলচ্চিত্র আলমগীর কবিরের সমকালীন প্রাসঙ্গিকতা

মা হ মু দু ল  হো সে ন

 

আলমগীর কবির মারা গিয়েছিলেন ১৯৮৯ সালের ২০ জানুয়ারি। সে বছরই, ডিসেম্বর মাসে, ঋত্বিক চলচ্চিত্র সংসদের সংকলন মন্তাজের দ্বিতীয় সংখ্যায় একটি ক্রোড়পত্র প্রকাশিত হয়েছিল তাঁকে স্মরণ করে। তাঁর জীবন ও কর্ম নিয়ে বেশ কয়েকটি লেখার ভেতর আমি একটি লেখা লিখেছিলাম ‘আলমগীর কবিরের ছবিতে সমাজ চেতনা’ শিরোনামে। পঁচিশ বছর পর চলচ্চিত্রকার মোরশেদুল ইসলাম ফোন করে অনুরোধ করলেন আলমগীর কবিরকে নিয়ে একটি লেখা তৈরি করার জন্যে১। বললেন, আলমগীর কবিরের চলচ্চিত্র-ভাবনা ও তাঁর সামাজিক প্রাসঙ্গিকতা যেন গুরুত্ব পায় লেখাটিতে। চমকে উঠেছিলাম! এটি কী কাকতালীয় ব্যাপার যে, সেই তখন, যখন তাঁর আকস্মিক অপঘাত মৃত্যুর অবাস্তবতা, শোক আমাদের আচ্ছন্ন করে রেখেছে, যখন সকল কিছুর ওপর রেগে থাকা তরুণ বয়স আমাদের, আর সে রাগে শিল্পময়তার বাতাস দিতেন আলমগীর কবির, তখন তাঁর চলচ্চিত্র নিয়ে লিখতে গিয়ে সমাজচেতনাই সবচেয়ে প্রাসঙ্গিক মনে হয়েছিল, আর এতকাল পরে, এই প্রৌঢ়ত্বে উপনীত মোরশেদ ভাই ও আমরা, আমাদের প্রজন্ম, যাঁরা ইতিমধ্যে চলচ্চিত্রের কাছে যথেষ্ট জব্দ হয়েছি অথবা চলচ্চিত্রকেই করেছি খানিকটা জব্দ, তাঁরা, আলমগীর কবিরের চলচ্চিত্র ও চলচ্চিত্র-ভাবনাকে সামাজিক প্রাসঙ্গিকতার দৃষ্টিকোণ থেকে দেখতে আগ্রহী হই? পরে ভেবে দেখেছি, কাকতালীয় নয় আদৌ ব্যাপারটি। আলমগীর কবিরকে যাঁরা দেখেছেন তাঁদের পক্ষে তাঁকে একজন ভীষণরকম সমাজপরায়ণ মানুষ ছাড়া অন্য কোনোজন হিসেবে ভেবে ওঠা মুশকিল। যে জীবন তিনি যাপন করেছেন, যে শিক্ষা তিনি আয়ত্ত করেছেন, যে শিল্প তিনি নির্মাণ করেছেন, যে সংগঠন তিনি গড়েছেন সে-সব কিছুতে সবকিছু ছাপিয়ে বড় হয়ে উঠেছে সমাজ, রাষ্ট্র, মানুষ। ১৯৬৯-এ প্রকাশিত তাঁর গ্রন্থ দ্য সিনেমা ইন পাকিস্তান এবং ১৯৭৯-এ প্রকাশিত ফিল্ম ইন বাংলাদেশ এই অঞ্চলের এবং পরে বাংলাদেশের চলচ্চিত্রকে পাঠ করার চেষ্টা করেছে সামাজিক দৃষ্টিকোণ থেকে। শিল্প হিসেবে চলচ্চিত্রের বিকাশের ইতিহাস, ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক আমলে ভারতীয় উপমহাদেশে চলচ্চিত্রের অবস্থা, বাঙালি-মুসলমানের পশ্চাৎপদ অবস্থা – এইসব অধ্যায় চলচ্চিত্রের ইতিহাসকে পাঠ করার একটি সামাজিক কাঠামো নির্মাণ করে দেয়। এরপর যখন তিনি পঞ্চাশ, ষাট ও সত্তরের দশকের নির্মিত চলচ্চিত্রগুলোকে বিশ্লেষণ করেছেন, ইন্ডাস্ট্রি অর্থে শিল্প হিসেবে একে বিবেচনা করেছেন, উর্দু ও বাংলা ছবির প্রসঙ্গ টেনেছেন, সেন্সর প্রথা নিয়ে কথা বলেছেন, মুক্তিযুদ্ধের সময় জহির রায়হানের নেতৃত্বে চলচ্চিত্রকর্মীদের চলচ্চিত্র-ভাবনার কথা বলেছেন,
চলচ্চিত্র-সমালোচকের যোগ্যতার মাপকাঠি নির্মাণ করেছেন তখন সমাজ হয়ে উঠেছে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। আলমগীর কবির চলচ্চিত্র-সমালোচকের এক নম্বর যোগ্যতা হিসেবে শনাক্ত করেছেন Social consciousness-কে। লিখেছেন, ‘The aim of every art is to contribute directly or indirectly to social development and also to act as a catalyst in the process of social evolution. A critic must be fully aware of the needs of his society at a given moment and of the kind of inspiration that is required to fulfill his responsibilities toward his fellow beings. In other words, socio-political consciousness is an indispensible quality in a critic.’ তাহলে এটাই স্বাভাবিক যে, আলমগীর কবিরকে তাঁর মৃত্যুর পঁচিশ বছর পর আমরা সমাজ ও চলচ্চিত্রের পরিপ্রেক্ষিত থেকে পুনঃপাঠ করতে চাইব। কিন্তু একটি অস্বস্তি আমাকে ঘিরে থাকে। আমি ভাবি, ভেবে দেখতে চাই, সমকালে আলমগীর কবির প্রাসঙ্গিক কি না। মানুষ হিসেবে তো আলমগীর কবিরের পরিণতি এই যে, তিনি একটি নির্দিষ্ট সময়কালে জীবিত ছিলেন এবং তাঁর কাজগুলো করেছিলেন। সেকালের মানুষেরা, তাঁর মিত্র ও শত্রুরা, নিশ্চিতভাবেই সমাজের প্রতি তাঁর গভীর দায়বোধকে স্বীকার করবেন। এমনকি, তাঁর কালের পরের মানুষেরা, যাঁরাই আজ সংখ্যাগরিষ্ঠ, তাঁরাও আলমগীর কবিরের নিজের কালে তাঁর সমাজপরায়ণতাকে মেনে নেবেন যদি তাঁরা দেখেন তাঁর চলচ্চিত্র, পাঠ করেন তাঁর চলচ্চিত্র বিষয়ে লেখাগুলো এবং জানেন তাঁর সংগঠন গড়ার ইতিহাস। এভাবে আলমগীর কবিরকে তাঁর সমকালের একজন সমাজসচেতন চলচ্চিত্র-ব্যক্তিত্ব হিসেবে মর্যাদার আসনে বসিয়ে ইতিহাসের একটি ধূসর অধ্যায়ে পরিণত করা যায়। সেটি করতে কুণ্ঠিত বোধ করি, যেন বঞ্চিত হবে এভাবে সমকাল – যখন সমাজ ও চলচ্চিত্র প্রসঙ্গে প্রয়োজন উজ্জীবনী ভাবনা, উদ্যোগ এবং ইতিহাসের পথনির্দেশ। কিন্তু এটি আমার ভাবনামাত্র, সিদ্ধান্ত নয় এখনো। আলমগীর কবির, তাঁর কর্ম ও ভাবনা নিয়ে, সমকালের সমাজ ও চলচ্চিত্র স্পেকট্রামে প্রাসঙ্গিক কি না – এই তাহলে আমাদের বিবেচ্য।

 

দুই

নাট্যজন আলী যাকের আলমগীর কবিরের ঘনিষ্ঠ ছিলেন। সে ঘনিষ্ঠতা মুক্তিযুদ্ধের সময় স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের কর্মোদ্যোগের সময় বেড়েছিল। আলমগীর কবিরের স্মৃতিচারণা করতে গিয়ে আলী যাকের লিখছেন, ‘আমরা এমন একটি প্রজন্মের মানুষ যারা কেবলমাত্র ‘আইকন’ দ্বারা প্রভাবিত হওয়া থেকে প্রায় বিদ্রোহ করে বেরিয়ে এসেছি। … আমরা আসলে বড় হয়েছি এমন একটা সময়ে যখন ক্রোধই ছিল তারুণ্যের প্রধান বৈশিষ্ট্য অথবা এক এবং অদ্বিতীয় প্রতীক। ভাষা, দেশ এইসব ছিল হৃদয়ের মধ্যিখানে সযত্নে লালিত।… কবির ভাই, আলমগীর কবির বোধহয় আমাদের তারুণ্যের সময়ের প্রথম মানুষ যিনি যুক্তিহীন, বুদ্ধিহীন কথা শুনলে যেমন প্রচন্ড ক্ষুব্ধ হতেন, তেমনি একজন পাকা পশ্চিমার মতো অন্যের যুক্তি সকল আগ্রহ নিয়ে শুনতেন।’ এই লেখাতেই আলী যাকের তাঁদের সময়কার তারুণ্যের সঙ্গে বর্তমান সময়ের তারুণ্যের পার্থক্য নিয়েও বলেছেন। বলেছেন এখনকার তারুণ্যের আপাত বিদ্রোহের সঙ্গে ভীষণরকম প্রতিষ্ঠানমুখীনতার কথা। আসলে সমাজ পরিবর্তিত হয়েছে। বিদ্রোহ, প্রতিষ্ঠানবিরোধিতা, নিরীক্ষা এসব শব্দকে অনেক ক্ষেত্রেই প্রতিস্থাপন করেছে স্থিতাবস্থা, ক্যারিয়ার গড়া অথবা রক্ষণশীলতার মতো শব্দ। কিন্তু এ কথাও সত্য যে, তাঁদের প্রজন্মেও তাঁরাই সম্ভবত সংখ্যাগরিষ্ঠ ছিলেন না। কিন্তু লঘিষ্ঠতার ভেতর থেকেই তাঁরা প্রভাবিত করতে পারতেন গরিষ্ঠদের, অন্তত কখনো কখনো। এখনো লঘিষ্ঠ সংখ্যায় আছেন সেরকমই তরুণেরা যাঁরা নতুনের, সৃজনের, দ্রোহের আগুনে জ্বলছেন; কিন্তু তাঁদের গরিষ্ঠদের প্রভাবিত করার সক্ষমতা কমে এসেছে। এর কারণ অনেক। বিশ্ব রাজনীতি, প্রযুক্তি, পণ্যপরায়ণতা – এ সবকিছুই প্রতিষ্ঠান ও রক্ষণশীলতাকে অনেক বেশি শক্তিমান করে তুলছে; আর নানারকম কৌশলে ক্রমাগত বিভ্রান্ত করছে তারুণ্যকে বিশ্বাস বনাম যুক্তি, কৌশল বনাম আত্মসমর্পণ ইত্যাদি ক্ষেত্রে। কমসংখ্যক সেই তারুণ্যই আমাদের আগ্রহের বিষয়; তাদের ভেতর যারা চলচ্চিত্রকর্মে নিযুক্ত তাদের প্রচেষ্টায়, সংগ্রামে আলমগীর কবিরের প্রাসঙ্গিকতাকে পরখ করে দেখতে চাই।

 

তিন

পঁচিশ বছর আগেরকার যে লেখার কথা দিয়ে শুরু করেছিলাম, সে লেখায় আলমগীর কবিরের সাতটি ছবি – ধীরে বহে মেঘনা, সূর্যকন্যা, সীমানা পেরিয়ে, রূপালী সৈকতে, মোহনা এবং মণিকাঞ্চনকে বিবেচনার জন্যে এসব ছবির ভেতর থেকেই পাঁচটি উপাত্ত বেছে নেওয়া গিয়েছিল। এই উপাত্তগুলি ছিল ক. তাঁর  ছবির আঙ্গিক ও শিল্পরূপ, খ. তাঁর সৃষ্ট সামাজিক আবহ ও তার যৌক্তিকতা, গ. কবিরের মধ্যবিত্তরা, ঘ. নারীমুক্তি, অসাম্প্রদায়িকতা, আন্তর্জাতিকতা, মানবতাবাদ, প্রকৃতি প্রভৃতি প্রসঙ্গ, ঙ. চলচ্চিত্রে উপস্থাপিত সমস্যাবলির সামাজিক স্তরে গ্রহণযোগ্যতা। ওই লেখায় এইসব উপাত্ত ধরে সবকটি ছবির যে বিস্তারিত বিশ্লেষণ করার চেষ্টা আছে তার পুনরাবৃত্তি এখানে সম্ভবও নয়, সংগত বা প্রাসঙ্গিকও নয়। আর লেখাটি আলমগীর কবিরের প্রায় সমকালেরই হওয়াতে সেখানে সময়-নির্দিষ্ট পর্যবেক্ষণও আছে। কিন্তু আমরা তাঁর চলচ্চিত্র-চিন্তার সমকালীন প্রাসঙ্গিকতাকে বিবেচনায় নিতে সে লেখা থেকে সাহায্য নিতে পারি নিশ্চয়ই।

তাঁর ছবির আঙ্গিকের বিবেচনায় আমরা দেখছি যে, ধীরে বহে মেঘনায় তিনি একরৈখিক বর্ণনাধর্মিতাকে বর্জন করেছেন আর কাহিনিচিত্রের মধ্যেই ব্যবহার করেছেন প্রামাণ্য ফুটেজ। মন্তব্য করেছি সেখানে, ‘৭১-এর বাংলাদেশকে উপস্থাপনায় – অসহযোগ আন্দোলন, যুদ্ধের প্রস্ত্ততি, গণহত্যা, মুক্তিবাহিনীর বীরত্বপূর্ণ সংগ্রাম এবং বিজয় – কবির মূল আখ্যান থেকে স্বচ্ছন্দে চলে গেছেন প্রামাণ্যচিত্রে। Internal Flash Bank-এর যথাযথ ব্যবহারে ভেঙেছেন তিনি বর্ণনাধর্মিতার একঘেয়েমি; Mise-en-scene-এর সুপরিকল্পিত ব্যবহারে তাঁর লেন্স কাজ করেছে ধনাত্মক অনুঘটকের। তাহলে দুটি বিষয় লক্ষণীয় হয়ে উঠেছে। এক. প্রচলিত সিনেমার যে প্রতিক্রিয়াশীল আঙ্গিক তাকে ভেঙে ফেলেছেন কবির। দুই. যে ফর্মে তিনি ছবি নির্মাণ শুরু করলেন তা সমকালীন রাজনৈতিক ও প্রতিবাদী চলচ্চিত্রনির্মাতাদের কাছে গ্রহণযোগ্য চলচ্চিত্র-ভাষা।’ সূর্যকন্যায় সময় উপাদানটিকে আলমগীর কবির ব্যবহার করেছেন একটি মুক্ত উপাদানের মতো। এই ছবিতে তিনি অ্যানিমেশন ব্যবহার করে সভ্যতার ইতিহাসে নারী-পুরুষ সম্পর্ককে বর্ণনা করতে চেয়েছেন। এই বর্ণনার যথার্থতা নিয়ে প্রশ্ন উঠতেই পারে, কিন্তু আঙ্গিকের দিক থেকে কাজটি অভিনব, নিরীক্ষাধর্মী। সীমানা পেরিয়ের আঙ্গিক নিয়ে বলা গিয়েছিল, ‘ছবির নির্মিতিতে একটি কাব্যিক ছন্দময়তা আছে, ডিটেলের কাজে, স্পেসের ব্যবহারে, নিসর্গের উন্মোচনে এক ধরনের আবিষ্টতা আছে, যা ভবিষ্যৎমুখী শিল্পকর্মের অনিবার্য বৈশিষ্ট্য হতে পারে। এছাড়া লক্ষণীয় যে, প্রকৃতিকে এমনভাবে চিত্রায়িত করতে পেরেছেন কবির যে, প্রকৃতিকে ছবির থিমের অবিচ্ছেদ্য অংশ বলে মনে হয়েছে।’ রূপালী সৈকতে চলচ্চিত্রে ফিকশন এবং প্রামাণ্যচিত্রের এক দেয়াল-ভাঙা আঙ্গিককে গ্রহণ করেন আলমগীর কবির। লক্ষ করি যে, ষাটের দশকের স্বদেশ এবং আন্তর্জাতিক রাজনীতিকে একটি কাহিনিচিত্রের অক্ষের মধ্যে ধরে রাখতে সচেষ্ট নির্মাতা। প্রামাণ্যচিত্র, ফটোগ্রাফ এবং সত্য ঘটনার পুনর্নির্মাণ – এসবই তিনি ব্যবহার করেছেন কাহিনিচিত্রের চলচ্চিত্রায়ণের পাশাপাশি। তারপর সম্পাদনার টেবিলে নির্মাণ করেছেন এক নতুন চলচ্চিত্র – এদেশের পরিপ্রেক্ষিতে তো বটেই। লিখেছিলাম, ‘ষাটের দশকের শেষার্ধের সামাজিক, রাজনৈতিক, জাতীয় ও আন্তর্জাতিক বাস্তবতার ভেতর তাঁর ছবির চরিত্ররা প্রতিষ্ঠিত হয়। তথাকথিত কাহিনীর চেয়ে অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে পুরো পরিমন্ডল। আইয়ুবী শোষণ, অরাজকতা, মধ্যবিত্তের বিদ্রোহ, বাম আন্দোলনের অনিশ্চিত গতি-প্রকৃতি, সমকালীন ভিয়েতনাম, প্যালেস্টাইন, দক্ষিণ আফ্রিকা – এসব প্রসঙ্গ মিলে নির্মাণ করে এ ছবির মোটিফ। প্রামাণ্যচিত্র, স্টিল, সত্য ঘটনার পুনর্নির্মিতি (ড. মাহমুদ, ড. শেলী এপিসোড) এবং থেকে থেকে ফিচারে ফিরে গিয়ে যেন কেবল সূত্রগুলোকে গেঁথে নেওয়া।’ মোহনা প্রসঙ্গে লিখেছিলাম, ‘সমকালীন বিশ্বখ্যাত গ্রিক চলচ্চিত্রকার কস্তা গাভরাসের জেড, মিসিং অথবা আরো প্রবলভাবে মনে পড়ে ভারতের শ্যাম বেনেগালের মন্থন ছবির কথা মোহনা দেখতে বসে। …মনে রাখা দরকার চলচ্চিত্র আঙ্গিকের এইসব নিরীক্ষা প্রতিবাদী চলচ্চিত্র আন্দোলনের সাথে গভীরভাবে সম্পর্কিত।’ স্বল্পদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র মণিকাঞ্চনের আঙ্গিক নিয়ে তখন মন্তব্য, ‘মণিকাঞ্চনের আঙ্গিক যেন একাধারে প্রতিনিধিত্ব করে এদেশে বিকাশমান স্বল্পদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র আন্দোলনের এবং এইসব তরুণ নির্মাতার জন্যে রেখে যায় পথনির্দেশ। অাঁটোসাঁটো কাঠামো, তীক্ষ্ণ, প্রায়-বিস্ফোরণোন্মুখ আবহ, দ্রুতগতি, স্বল্প বাজেটের কর্ম-পদ্ধতি – এ সবকিছুই তাঁর ছাত্রদের জন্যে পথনির্দেশ, উৎস প্রেরণার।’ আঙ্গিক বিবেচনার উপসংহারে মন্তব্য করা গিয়েছিল, ‘…প্রতিবাদী আঙ্গিককে ব্যবহার করতে সচেষ্ট হয়েছেন, …চলচ্চিত্র শিল্পরূপের আরো যে-সব নিরীক্ষা করতে চেয়েছেন তাদের প্রধান লক্ষ হচ্ছে চলচ্চিত্রকে প্রগতির সপক্ষে কার্যকরভাবে ব্যবহার এবং প্রতিবাদী ও প্রগতিশীল বিষয়বস্ত্তকে যথাযোগ্য বাহনে প্রতিষ্ঠিত করা।’ সে-সময়ে লিখেছিলাম, আলমগীর কবির রূপালী সৈকতে, মোহনা বা কিছু অংশে ধীরে বহে মেঘনায় ডিরেক্ট সিনেমার আঙ্গিক ব্যবহার করেছিলেন। সম্প্রতি শ্রদ্ধেয় চলচ্চিত্রকার মানজারেহাসীন মুরাদ এই বক্তব্যের যথার্থতা নিয়ে সংশয় প্রকাশ করেছেন। ষাটের দশকের সিনেমা ভেরিতে এবং ডিরেক্ট সিনেমা প্রামাণ্যচিত্রের আন্দোলন হিসেবে বাস্তবের এক ধরনের নির্মোহ ধারণের কথা বলেছিল। এই ধারার নির্মাতারা সিনেমার মিথ্যে বলার ক্ষমতাকে পরিহার করতে নানাভাবে সচেষ্ট হয়েছিলেন এবং বাস্তবতা ও সিনেমার সম্পর্ককে নানাভাবে পরীক্ষা করে দেখতে চেয়েছিলেন। নিঃসন্দেহে আলমগীর কবির যেসব ছবি নির্মাণ করেছেন সেগুলিতে ডিরেক্ট সিনেমার আঙ্গিক তিনি ব্যবহার করেছেন এমন বলার সুযোগ নেই। বরং রূপালী সৈকতে অনেক বেশি ডকুফিকশনের আঙ্গিকের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ। কিন্তু আলমগীর কবির নিজে ডিরেক্ট সিনেমা বিষয়ে খুবই আগ্রহী ছিলেন এবং নিজের সিনেমা সম্পর্কে কথনে ডিরেক্ট সিনেমার আঙ্গিক ব্যবহারের কথা উল্লেখ করেছেন। বিশেষ করে বাস্তবতার প্রতি তাঁর যে দায় এবং সে দায় মোচনে কাহিনিচিত্রের অক্ষের মধ্যে প্রামাণ্য ফুটেজ ব্যবহার, সত্য ঘটনার পুনর্নির্মাণ, অথবা মোহনায় সত্য ঘটনাকে উপজীব্য করেই সাজানো কাহিনিচিত্র – এগুলিকে তিনি ডিরেক্ট সিনেমার সমান্তরাল কাজ ভাবতেন বোধ করি। চলচ্চিত্রের আঙ্গিক নিয়ে আজ যাঁরা নতুন করে ভাবছেন আলমগীর কবিরের এসব ছবি তাঁদের জন্যে উজ্জীবক হিসেবে কাজ করতে পারে। আলমগীর কবির শিল্প হিসেবে সিনেমার চরিত্রকে আত্মস্থ করেছিলেন গভীরভাবে। তিনি লিখেছেন, ‘In the cinema, the performance is recorded on a film, from film it is projected on to a screen, from screen it reaches the retina of the eye of the beholder. So, the cinema is an art of Terenary Transport.’ তিন স্তরের এই শিল্প-প্রকাশের সম্ভাবনা ও সীমাবদ্ধতাকে যথাযথভাবে বুঝতে হবে চলচ্চিত্রনির্মাতাকে এবং তারপর তাঁকে ব্যবহার করতে হবে নিজের অভিব্যক্তি নির্মাণের কাজে – এই ছিল তাঁর যুক্তি। এই যুক্তি আজো কি সমানভাবেই প্রাসঙ্গিক নয়?

আলমগীর কবির তাঁর চলচ্চিত্রে যথাযথ সামাজিক আবহ নির্মাণে কতখানি সাফল্য অর্জন করেছিলেন? আজকের চলচ্চিত্রনির্মাতা, যাঁরা তাঁদের চলচ্চিত্রে সামাজিক আবহ নির্মাণের দায় বোধ করেন তাঁরা এই প্রশ্ন করতেই পারেন। পঁচিশ বছর আগেকার সে লেখার অনুসরণে এ-প্রশ্নের উত্তর খোঁজা যেতে পারে। ধীরে বহে মেঘনা ১৯৭১-এর জাতীয় মুক্তিযুদ্ধের পরের সময়কার মধ্যবিত্ত সমাজের আবহকে নির্মাণ করতে সচেষ্ট হয়েছিল। লিখেছি, ‘মুক্তিযুদ্ধের বিরাট, বিশাল পরিমন্ডল রয়ে গেছে নেপথ্যে, নিবিড়ভাবে উঠে এসেছে নাগরিক মধ্যবিত্তদের যুদ্ধের জীবন, আত্মত্যাগ এবং সদ্য স্বাধীন দেশে তাদের যাপিত দিনরাত্রি।… ইতিহাসের সেই কালান্তরের ক্ষণে ভারত আর বাংলাদেশের মানুষের মধ্যে ব্যক্তিগত এবং সামাজিক স্তরে যে যোগাযোগ, বোঝাপড়ার সুযোগ সৃষ্টি হয়ে গিয়েছিল প্রায় এক প্রজন্মের স্তব্ধতা এবং অর্থহীন বৈরিতার পর – সেই মানবিক বিকাশের সম্ভাবনাকে চিহ্নিত করতে চেয়েছিলেন কবির এই ছবিতে।’ অন্যদিকে সূর্যকন্যায়, ‘শিল্পী লেনিন চৌধুরীকে ঘিরে আছে একটি নিম্নমধ্যবিত্ত সামাজিক পরিমন্ডল। তবে এ পরিমন্ডল কেবল চলচ্চিত্রের নেপথ্যের দৃশ্যপট সৃষ্টি করে। যা গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে তা হচ্ছে লেনিন চৌধুরীর স্বপ্ন আর সৃষ্টির জগৎ। … বিশেষ কোনো সমাজ বা সময়ে নয়, একটি চিরকালীন আবহের মধ্যে নারীমুক্তি প্রসঙ্গটি বিস্তার লাভ করে। বস্ত্তত, এ ছবিতে এই ঐতিহাসিক সমস্যাটিকে নিয়ে কাজ করার কারণে এবং সমস্যাটির এই অভিনব ট্রিটমেন্টের কারণে বাস্তব সামাজিক পরিমন্ডল অত্যন্ত গৌণ বিষয় হয়ে পড়ে।’

‘সীমানা পেরিয়েতে একটি নতুন সামাজিক আবহ সৃষ্টি করতে চেয়েছেন কবির। এই সামাজিক আবহের উপাদান হিসেবে তিনি গ্রহণ করেছেন সমাজের উচ্চবিত্ত শ্রেণির একটি চরিত্র (টিনা) আর নিম্নবিত্ত শ্রেণির একটি চরিত্রকে (কালু)। এই দুই চরিত্র তাদের মূল্যবোধ, জীবনদর্শন, অভিজ্ঞতা আর সাংস্কৃতিক সম্পন্নতাকে মূলধন করে একটি নতুন সমাজের ভিত্তি স্থাপন করে।… কবির তাঁর ছবিতে যে নিরীক্ষাটি করতে চেয়েছেন (দুটো বিপরীত শ্রেণির মানুষের ব্যক্তিগত স্তরে সম্পর্ক স্থাপন) তার জন্য বিশ্বাসযোগ্য সামাজিক আবহ তিনি সৃষ্টি করতে পেরেছেন।’

‘রূপালী সৈকতের মূল সাফল্যই হচ্ছে বাস্তব সামাজিক আবহ সৃষ্টি করতে পারার সাফল্য। বিশেষত কিছুটা আত্মজৈবনিক হওয়ায় ষাটের সেই উত্তপ্ত শেষভাগ অত্যন্ত নিবিড়ভাবে উপস্থাপিত হয়েছে ছবিতে।’

‘মোহনার প্রাথমিক কাঠামোটি আলমগীর কবির সংগ্রহ করেছেন ডা. জাফরউল্লাহ চৌধুরীরর গণস্বাস্থ্য প্রকল্পের অভিজ্ঞতা থেকে। নিজেই জানিয়েছেন তিনি সে কথা। সামাজিক শ্রেণিবিন্যাসটিকে এবং স্বার্থচেতনাকে সাফল্যের সাথে চিহ্নিত করা হয়েছে ছবিতে। তবে সমকালীন গ্রামীণ সমাজের যে জটিল ও বহুধাগামী সমস্যাবলি তার অখন্ড এবং সূত্রায়িত চিত্র উপস্থাপিত করতে পারেন নি কবির মোহনায়।’

 

আলমগীর কবিরের চলচ্চিত্রে সামাজিক আবহ নির্মাণের সাফল্যের এসব বিশ্লেষণ অন্তত আমাদের কয়েকটি বিষয়গত ধারণার মুখোমুখি করে। প্রথমত, তাঁর চলচ্চিত্রের বিষয় সমাজ এবং সামাজিক মানুষ। চলচ্চিত্রকে তিনি মূলত সামাজিক ন্যায্যতা সৃষ্টির লক্ষ্যে নিবেদিত একটি শিল্প হিসেবে পেতে চেয়েছেন। এ জন্যে যে সততা প্রয়োজন সেই সততার প্রেরণাই তাঁর চলচ্চিত্রে সামাজিক আবহ নির্মাণের বিষয়টিকে গুরুত্বপূর্ণ করে তুলেছে। দ্বিতীয়ত, যখন তিনি নিরীক্ষা করেছেন, তখনো তাঁর দায়বদ্ধতা কিন্তু সামাজিক শ্রেয়বোধের কাছেই। সূর্যকন্যার নারীবাদী চেতনার অভিনব নিরীক্ষা অথবা সীমানা পেরিয়ের নতুন সমাজের প্রোটোটাইপ গড়ার নিরীক্ষা এই বক্তব্যকে সমর্থন করবে। তৃতীয়ত, আলমগীর কবির যেসব অন্যায্য প্রতিষ্ঠান, অসাম্য এবং সামাজিক ঋণাত্মকতাকে মোকাবিলা করতে চেয়েছেন তাঁর চলচ্চিত্রে, তারা নানা মাত্রায় ও রূপে এখনো বিদ্যমান। তিনি যেসব মানবিক সম্পর্ক গড়ার প্রস্তাব করতে চেয়েছেন, তারা নতুন পরিপ্রেক্ষিতে আজো প্রাসঙ্গিক। সামাজিক চলচ্চিত্রকার আলমগীর কবিরের পাঠ এবং বিশ্লেষণ আজকের নতুন চলচ্চিত্রকার এবং চলচ্চিত্রপ্রেমীর শিল্প-উদ্যম ও চেতনাকে সমৃদ্ধ করতে পারে – এই উপসংহার গড়া যেতে পারে বোধহয়।

 

চার

প্রায় দেড় দশকের ডিপ্রেশনের পর বিশ্বের দেশে দেশে এখন জেগে উঠেছে নতুন সাম্যবাদ। নব্য রক্ষণশীলতার বিরুদ্ধে আর কেউ নয়, সাম্যবাদই নতুন বাস্তবতায় এবং আঙ্গিকে বিশ্ব মানবতার মুক্তির পথ দেখাচ্ছে। একই সঙ্গে অসাম্প্রদায়িকতা, মানবতাবাদ, নারীবাদ আজকের প্রগতিশীলতার আইকনসমূহ। আজকের সমাজসচেতন শিল্পে এসবই আরাধ্য। আলমগীর কবিরের সামাজিক চলচ্চিত্রে এসব বিষয়ই প্রধান হয়ে এসেছিল। ‘ধীরে বহে মেঘনায় আমরা শুনি সুমিত আর হাসুর অপূর্ণ প্রেমের কাহিনী। ধর্মের সীমানা পার হয়ে তাদের এই ভালোবাসা বহমান হয়েছিল। অন্যদিকে রূপালী সৈকতের লেনিন, আনোয়ারের মতো চরিত্ররা নিজেদেরকে সমকালীন ভিয়েতনাম, দক্ষিণ আফ্রিকা, প্যালেস্টাইন আর কিউবার সংগ্রামী জনতার অবিচ্ছেদ্য অংশ বলে জানে, প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে জড়িয়ে পড়ে বিশ্বব্যাপী মানুষের মুক্তির সংগ্রামে। এভাবেই রূপালী সৈকতে হয়ে ওঠে বিংশ শতাব্দীর মানুষের মুক্তির চেতনায় সম্পর্কিত খন্ড দলিল।’ সূর্যকন্যায় আলমগীর কবির নারীমুক্তির বিষয়টি নিয়ে কাজ করতে চেয়েছেন। রোমান্টিকতার বেনো জলে বিষয়টি খানিক গুলিয়ে গেলেও অন্তত প্রসঙ্গটি উপস্থাপিত হয়েছে। অ্যানিমেশন পর্বটি অন্তত এ বিষয়টি প্রতিষ্ঠিত করে যে, প্রাকৃতিকভাবেই বা সভ্যতার শুরু থেকেই পুরুষ নারীর চেয়ে উচ্চ স্তরের এবং যোগ্যতর – এই সংস্কার সঠিক নয়।

আলমগীর কবিরের ছবিগুলি জুড়ে আছে মধ্যবিত্ত চরিত্ররা। এ প্রসঙ্গে তিনি বলছেন, ‘১৯৪৮ সাল থেকে বাংলাদেশের স্বাধীনতাসহ সার্বিক মুক্তি আন্দোলনে মধ্যবিত্ত শ্রেণি-উদ্ভূত প্রগতিশীল কর্মীদের ভূমিকা ছিল নেতৃস্থানীয়। আপামর জনসাধারণ সেই নেতৃত্ব সবিশ্বাসে মেনে নিয়েছিল বলেই একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ সফল হয়েছিল। চলতিকালের রাজনৈতিক সংকট নিরসনেও অনুরূপ নেতৃত্বের প্রয়োজন রয়েছে বলে আমার বিশ্বাস। গ্রামবাংলার সার্বিক অর্থনৈতিক মুক্তি ও তদ্দুশ্যে সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গিতে প্রয়োজনীয় পরিবর্তন আনয়নে এমন নেতৃত্বেরও ভূমিকা আছে, কিন্তু সীমিত। এই গ্রুপটিকে সত্যিকার অর্থে উচ্চশিক্ষিত করতে জাতি প্রচুর কষ্টার্জিত সম্পদ বিনিয়োগ করেছে। সে কারণেই এই নেতৃত্ব তাদের কাছে জাতির পাওনা, কিন্তু তা কেবল সামাজিক বিবর্তনের Catalytic agent হিসেবে।’ তাঁর ইতিহাসের পাঠের সঙ্গে খুব বেশি দ্বিমত প্রকাশের সম্ভবত সুযোগ নেই। আজকের সমাজ ও চলচ্চিত্র-চিন্তায় মধ্যবিত্ত কতখানি গুরুত্বপূর্ণ অথবা কাকে বলব মধ্যবিত্ত – এসব আলোচনা অন্তত আজকের বিষয় নয়। কিন্তু মধ্যবিত্তদের ঘিরে আলমগীর কবিরের নির্মিত সামাজিক ইমেজ সমকালের পাঠে বাতিল হয়ে যায় না। কারণ আলমগীর কবিরের মধ্যবিত্ত চরিত্ররা তাঁর প্রতিপাদ্য প্রতিষ্ঠার অনুঘটক, নিজেরাই প্রতিপাদ্য নয়। আজ যাঁরা সামাজিক ন্যায্যতা নির্মাণের লক্ষ্যে চলচ্চিত্র নির্মাণ করবেন, তাঁদের জন্যে এরকম অনুঘটক চরিত্ররা উদাহরণ হিসেবে প্রেরণামূলক হওয়ার কথা।

 

পাঁচ

আজকের সমাজ ও চলচ্চিত্রের মধ্যকার সম্পর্ক এবং আলমগীর কবিরের কালে সমাজ ও চলচ্চিত্রের মধ্যকার সম্পর্ক এক নয়। গত এক দশকের কিছু বেশি সময়ে প্রযুক্তির হাত ধরে চলচ্চিত্র, আরো ভেঙে বললে চলমান ছবি ও সমাজের সম্পর্কের ক্ষেত্রে একটি বিপ্লবী পরিবর্তন ঘটে গেছে। স্যাটেলাইট টেলিভিশন, ইন্টারনেট এবং মোবাইল ফোন চলমান ছবির নির্মাণ, বিতরণ ও ভোগের সম্ভাবনাকে এমন এক স্তরে নিয়ে গেছে যাকে যে-কোনো অর্থেই এ বিষয়ে প্যারাডাইম শিফটে বলা শনাক্ত করা যেতে পারে। কাজেই এখনকার ভিজ্যুয়ালি অবসেসড, ডিজিটাল সমাজের সকল চাহিদা-মেটানো চিন্তা এবং শিল্পদর্শন আলমগীর কবির সরবরাহ করে গেছেন এমন রূপকথা আমরা বলতে চাই না। সিনেমার ভবিষ্যৎ নিয়েও অনেকে সন্দেহ প্রকাশ করছেন; চলমান ছবির সংস্কৃতিতে প্রচলিত সিনেমার ধারণা ক্রমশ প্রান্তিক হয়ে পড়বে – এমন মত শোনা যাচ্ছ। কিন্তু চলমান দৃশ্যমানতা সমাজে মত নির্মাণে ও প্রচারে, যৌথতার বোধ নির্মাণে প্রতিদিন আরো গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠছে। এই গোটা দৃশ্যমানতার পরিমন্ডলকেই আমরা চলচ্চিত্র বলে বিবেচনা করি না কেন? এভাবে ভাবলে শেষ পর্যন্ত মানুষ ও সমাজ বিষয়ে যে চলচ্চিত্র-চিন্তা গুরুত্বপূর্ণ, আলমগীর কবিরের কাছে তার পাঠের জন্যে আমাদের বারবার ফিরে যেতে হয়। এরকম কিছু বিষয়ের অবতারণা করা যাক।

ডিজিটাল প্রযুক্তি চলচ্চিত্রকে গণতন্ত্রায়িত করেছে। এখন এটা বাস্তব যে, একজন ব্যক্তিমানুষের একক প্রচেষ্টায় একটি চলচ্চিত্র নির্মিত হতে পারে। চলচ্চিত্র এখন রহস্য-ঘেরা, অল্প কয়েকজনের কুক্ষিগত এক জাদুর শিল্প নয়। আলমগীর কবির জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত চলচ্চিত্রের বিরহস্যীকরণের জন্যে কাজ করেছেন। ফিল্ম আর্কাইভের ফিল্ম অ্যাপ্রিসিয়েশন কোর্সে, চলচ্চিত্রসংসদগুলির সেমিনারে, ওয়ার্কশপে, অ্যাপ্রিসিয়েশন কোর্সে, নিমকোর চলচ্চিত্রনির্মাণ কর্মশালায়, চলচ্চিত্র বিষয়ে তাঁর অবিরাম লেখায় তিনি এ-কাজটি করতে চেয়েছেন। চলচ্চিত্র-সমালোচকদের তিনি উপদেশ দিয়েছেন চলচ্চিত্রের সকল প্রযুক্তিগত দিকের সঙ্গে পরিচিত হতে, এমনকি ক্যামেরা ভাড়া করে, ফিল্ম স্টক কিনে শুট করে প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা অর্জনের জন্যে। চলচ্চিত্রসংসদকর্মীদের নিজের হাতে ফিল্ম প্রজেক্টর চালাতে শিখিয়েছেন। জীবনের শেষ বক্তৃতায় বলেছেন, ‘এখন শহরে তো বটেই, প্রতি গ্রামে গ্রামে গিয়ে ছবি দেখাতে হবে। সম্ভব হলে গ্রামে গ্রামে ফিল্ম সোসাইটি তৈরি করতে হবে।… মুক্ত দৈর্ঘ্যের ছবি নির্মাণ করতে হবে। এর অর্থ হলো ছবি কতটুকু সময়ের হবে তা নির্ধারণ করবে নির্মাতা। প্রতিটি শিল্পেই ক্রিয়েটারের স্বাধীনতা আছে। ফিল্মে কেন থাকবে না?’ চলচ্চিত্রকে সকলের মাধ্যম করে তোলার স্বপ্ন আলমগীর দেখেছিলেন এবং তাঁর কালের বাস্তবতার ভেতরে সে লক্ষ্যে কাজ করেছিলেন আজীবন।

ফিল্ম ইন বাংলাদেশ গ্রন্থে আলমগীর কবির মুক্তিযুদ্ধকালে জহির রায়হানের নেতৃত্বে একদল চলচ্চিত্রকারের জাতীয় চলচ্চিত্র পরিকল্পনার তৈরির কথা লিখেছেন। এই পরিকল্পনায় আলমগীর কবির যে যুক্ত ছিলেন তা আমরা অনুমান করতে পারি। কারণ মুক্তিযুদ্ধকালে আলমগীর কবির ছিলেন জহির রায়হানের ঘনিষ্ঠ সহচর। জহির রায়হানের স্টপ জেনোসাইড ছবিতে তিনি ধারাবর্ণনার কাজ করেছেন। নিজে নির্মাণ করেছেন দ্য লিবারেশন ফাইটার্স। যে পরিকল্পনার কথা বলেছেন আলমগীর কবির তাতে মুক্তিযুদ্ধ-উত্তর বাংলাদেশে চলচ্চিত্রশিল্পকে সম্পূর্ণ জাতীয়করণের প্রস্তাব করা হয়েছিল। চলচ্চিত্রনির্মাণের সিদ্ধান্ত কেন্দ্রীয়ভাবে গ্রহণ করা, অভিজ্ঞ এবং নতুন মেধাবী নির্মাতাদের দিয়ে ছবি নির্মাণ করানো এবং তাদের সরকারি বেতনের আওতায় রাখা, চলচ্চিত্র বিতরণ ও প্রদর্শনব্যবস্থাকে সম্পূর্ণ জাতীয়করণ করা এসবই ছিল এই র‌্যাডিক্যাল পরিকল্পনার অংশ। আজকের এই মুক্তবাজার অর্থনীতির কালে এমন রাষ্ট্রায়ত্ত চলচ্চিত্রশিল্পের কথা শুনলে অনেকেই অাঁতকে উঠবেন। কিন্তু এর উল্টো দিকটির দিকেও আমরা নজর দিতে পারি। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর ঔপনিবেশিক শাসনমুক্ত হয়ে যেসব নতুন জাতি-রাষ্ট্রসমূহের উদ্ভব হয়েছে সেসব রাষ্ট্রে তখনই শিল্পসফল চলচ্চিত্র নির্মিত হয়েছে যখন প্রত্যক্ষ সরকারি পৃষ্ঠপোষকতা পাওয়া গেছে। চলচ্চিত্রকে এসব দেশে যখন জাতিসত্তা নির্মাণের কাজের অংশ হিসেবে বিবেচনা করা হয়েছে তখনই ‘জাতীয় চলচ্চিত্র’ বলে এক ধরনের চলচ্চিত্র নির্মিত হয়েছে। এসব ছবি বাণিজ্যিক ছবির আবশ্যিক বিষয়-ভাবনাকে অতিক্রম করে সমাজ ও শিল্পের দাবিকে মেটাতে অধিকতর মনোযোগী হয়েছে। জাতিসত্তার ভিজ্যুয়াল আইকনগুলি নির্মিত হয়েছে। প্রতিবেশী দেশ ভারতের এনএফডিসি এবং পরে এফএফসির প্রযোজিত চলচ্চিত্রগুলি এর শ্রেষ্ঠ উদাহরণ। যে প্রস্তাবনার কথা প্রকাশ করেছেন আলমগীর কবির তা অন্তত কয়েক বছরের জন্যে আংশিক বাস্তবায়িত হলেও বাংলাদেশে জাতীয় চলচ্চিত্রের একটি বলিষ্ঠ ধারা হয়তো দাঁড়িয়ে যেতে পারত। কিন্তু এ তো কেবল একটি প্রাকল্পিক বিবেচনাই, বাস্তবে এমন কিছুই ঘটেনি। কিন্তু এই কি সত্য নয় যে, আজো যাঁরা সিরিয়াস চলচ্চিত্রের কথা ভাবেন তাঁদের চিন্তায় সরকারি পৃষ্ঠপোষকতা একটি বড় জায়গা জুড়ে থাকে। কেবল নির্মাণ সহায়তাতেই নয়, বিতরণে এবং প্রদর্শনেও এই সহযোগিতা প্রয়োজন – মানবেন সকলেই। আমি ভাবতে চাই আলমগীর কবির এদেশের জন্মলগ্নেই এমন এক চলচ্চিত্র পরিকল্পনায় সংশ্লিষ্ট হয়েছিলেন, যা আজো প্রাসঙ্গিক।

আলমগীর কবির একজন ব্যক্তিশিল্পী ছিলেন। তিনি কোনো শিল্পীগোষ্ঠীর অন্তর্ভুক্ত ছিলেন না, তাঁর কালে এরকম কোনো সংগঠনও সম্ভবত চলচ্চিত্রকারদের ছিল না। জানা মতে, তিনি সরাসরি কোনো রাজনৈতিক দলের সদস্য ছিলেন না। কিন্তু তাঁর চলচ্চিত্রে, তাঁর লেখায় রাজনীতি-সচেতনতার ছাপ প্রবল। আলমগীর কবিরের রাজনৈতিক শত্রু/মিত্র চেনা কঠিন নয়। ষাটের দশকে তিনি গ্রেপ্তার হয়েছিলেন এবং প্রায় ছয় মাস জেল খেটেছিলেন। এর সম্ভাব্য কারণ হচ্ছে, লন্ডনে আইয়ুব খানকে কালো পতাকা দেখানো। মুক্তিযুদ্ধের সময় দেশ তাঁর মতো একজন মানুষের কাছে যা আশা করতে পারে তা কড়ায়গন্ডায় মিটিয়েছেন তিনি। স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের ইংরেজি বিভাগের দায়িত্ব নিয়েছেন, ক্যামেরা হাতে ছুটে গেছেন রণাঙ্গনে। নির্মাণ করেছেন মুক্তিযুদ্ধের প্রামাণ্যচিত্র। মুক্তিযুদ্ধের পর যখন চলচ্চিত্র-সাংবাদিক থেকে চলচ্চিত্রনির্মাতা হয়ে গেলেন আলমগীর কবির তখন রাজনৈতিক বিশ্বাস তাঁর শিল্পের অন্তরকে নির্মাণ করেছে। আর যে লেখার কাজ কখনই থামেনি, যে কথন চলেছে আমৃত্যু তাতে আলমগীর কবির যতখানি চলচ্চিত্রের মানুষ ততখানিই এক রাজনৈতিক মানুষ। এই জীবনদর্শন বা শিল্পদর্শন কি কিছু শেখায় আমাদের? আমরা দ্রুত হতাশ হই, সিনিক্যাল হয়ে পড়ি, সৎ সংগঠনের অভাবে নিজেদের ভীষণ প্রতিকূলের যাত্রী ভাবি। নিজেদের প্রকাশকে কোন পাত্রে রাখা যাবে, কে ধারণ করবে আমার রাজনৈতিক শিল্পকে তা ভেবে উষ্মাও প্রকাশ করি। আলমগীর কবিরের উজান বাওয়া, অফুরান প্রাণশক্তি এবং নিজের বিশ্বাসে প্রবল আস্থা আমাদের এ বিষয়ে নতুন করে ভাবতে অনুপ্রাণিত করতে পারে।

আলমগীর কবির প্রতিষ্ঠানবিরোধিতার প্রতীক হয়ে উঠেছিলেন। ষাটের দশকের মাঝামাঝি ইংল্যান্ড থেকে ফিরে তিনি লিখেছিলেন, ‘আমি জোর গলায় বলব আমার পিতা-মাতা, আমার শিক্ষক, আমার গুরুজনেরা আমাকে ভুল জিনিস শিখতে সাহায্য করেছিলেন, বাজে বই পড়তে উৎসাহ দিয়েছিলেন এবং ভুল পথে পরিচালিত করতে উদ্যোগী হয়েছিলেন।’ বিদ্রোহী আলমগীর কবির কিন্তু সমাজকে ত্যাগ করেননি, বিবরমুখী হয়ে পড়েননি। বরং তিনি যা বিশ্বাস করেন তাকে প্রকাশ করতে ব্যাপক কর্মযজ্ঞে মেতে উঠেছিলেন। ষাটের দশকে তাঁর চলচ্চিত্র-সমালোচনা যেমন ছিল নতুন ধরনের, তেমনি ছিল প্রবলরকম আক্রমণাত্মক। উদাহরণ দেওয়া যেতে পারে, ‘Sentiments of all kinds used to reign supreme in the Bengali Cinema’s ‘realism’ from pre-independence days. A lot of tears, exaggerated and sentimentalised depiction of the plight of the lower middle-class that appeared more like a complaint than a social protest; simple, adolscent romance between handsome boys and beautiful girls, etc. were the typical ingradients that Dacca film-makers of the early period easily inherited and assimilted.’ এহেন আলমগীর কবিরের শত্রুর অভাব ছিল না। ১৯৮৮ সালে যখন বাংলাদেশ শর্ট ফিল্ম ফোরামের উদ্যোগে প্রথম আন্তর্জাতিক স্বল্পদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র উৎসব আয়োজিত হয় তখন তিনি এই উৎসব কমিটির চেয়ারম্যান হতে প্রথমে রাজি হননি।  তাঁর যুক্তি ছিল ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রিতে তাঁর  শত্রুর অভাব নেই। তিনি থাকলে আয়োজনটি সফল হবে না। পরে অবশ্য তিনি চেয়ারম্যান হয়েছিলেন। আলমগীর কবিরের প্রতিষ্ঠানবিরোধিতা ছিল নিরন্তর যুদ্ধের ব্যাপার। সত্তরের দশকে ধীরে বহে মেঘনা, সূর্যকন্যা, সীমানা পেরিয়ে, রূপালী সৈকতের মতো চলচ্চিত্র নির্মাণ এবং প্রদর্শন যে কী দুরূহ কর্ম ছিল তা বলার অপেক্ষা রাখে না। আর আলমগীর কবির ৩৫ মিমি ফিল্মেই ছবি করেছেন, এফডিসির সকল সুবিধা এবং অসুবিধার ভেতর দিয়ে গেছেন এবং তাঁর ছবি ঢাকাসহ সারাদেশের প্রেক্ষাগৃহগুলিতেই প্রদর্শিত হয়েছে। তাঁকে বলতে শুনেছি, ‘আমি শত্রু লাইনের এপারে এবং ওপারে দুই দিকেই কাজ করি!’ শিল্পসম্মত এবং সৎ চলচ্চিত্র আজো পৃথিবীর আরো বহু স্থানের মতো আমাদের দেশে প্রতিষ্ঠানবিরোধী এক কর্মযজ্ঞই। আলমগীর কবিরের কর্মকৌশল এবং প্রাণশক্তি তাহলে হতে পারে এরকম উদ্যোগের অনুপ্রেরণা।

আজকের স্বাধীন চলচ্চিত্রনির্মাণে প্রামাণ্যচিত্র অনেক বড় একটা জায়গা করে নিয়েছে। বিশেষ করে ডিজিটাল যন্ত্রপাতি যে হালকা চলচ্চিত্রনির্মাণ আবহ তৈরি করে দিয়েছে তার সুযোগ নিয়ে অনেক নতুন নির্মাতা চলচ্চিত্রের এই দিকটির প্রতি আগ্রহী হয়ে উঠেছেন। আলমগীর কবির ছিলেন প্রামাণ্যচিত্রের এক একনিষ্ঠ প্রবক্তা। সত্তরের দশকের শেষভাগ থেকে চলচ্চিত্রসংসদসমূহের কর্মশালায়, সেমিনারে প্রামাণ্যচিত্রের সম্ভাবনা এবং উত্তেজনাকর দিক নিয়ে বলতে শুনেছি। এখন দেখছি তিনি লিখেছিলেন, ‘Since the day I had become conscious of the cinema as an art medium with ability to move beyond the limits of mere sensuous delight I had become particularly conscious of the art of documentary… Despite all the great creations in the realm of feature film production, the essence of true cinema perhaps continues to remain hidden within the documentary cinema.’ এসব উচ্চারণ আজকের প্রামাণ্যচিত্রনির্মাতাদের প্রেরণার কারণ হতে পারে নিশ্চয়ই। আবার এই আলমগীর কবিরই এর পরপরই বলেছেন যে, চলচ্চিত্র যেভাবে এগিয়ে চলেছে তাতে নিকট ভবিষ্যতেই প্রামাণ্যচিত্র এবং কাহিনিচিত্রের অনির্দিষ্টভাবে তৈরি বিভাজন ভেঙে পড়বে। এ হচ্ছে চলচ্চিত্রে নিরীক্ষা-প্রেমিক আলমগীর কবিরের উচ্চারণ! এসবই আজকের এই ভিজ্যুয়াল প্যারাডাইম শিফটের কালে আমাদের কাছে দারুণ উত্তেজনাকর এবং প্রাসঙ্গিক মনে হতে পারে।

নাট্যজন আলী যাকেরের একটি স্মৃতিচারণার কথা বলেছিলাম এই লেখার শুরুর দিকে। স্মৃতিচারণাটির শেষের দিকে আলী যাকের আলমগীর কবিরকে চলচ্চিত্র আন্দোলনের ‘প্রাইম মুভার’ বলে আখ্যায়িত করেছেন। আলী যাকের আলমগীর কবিরের নেতৃত্বে নতুন প্রজন্মের চলচ্চিত্র চর্চার নানা উদ্যোগের কথা বলতে চেয়েছেন আসলে। বাংলাদেশে আশির দশকে যে বিকল্প ধারার চলচ্চিত্র আন্দোলনের সূত্রপাত হয় আলমগীর কবির সেই কর্মোদ্যোগের প্রধানতম অনুপ্রেরণা। আর এ প্রেরণা তো কেবল তাত্ত্বিক নয়। শারীরিক দৌড়ঝাঁপ, আমলাতান্ত্রিক জটিলতার বিরুদ্ধে যুদ্ধে নামা, তহবিল সংগ্রহ – সবকিছুতেই আলমগীর কবির যুক্ত হয়েছিলেন নিবিড়ভাবে। এ সময়ে সংসদ-আন্দোলনের কার্যক্রমেও তাঁকে অনেক বেশি করে পাওয়া গিয়েছিল। আর এ সবকিছুর আগে সেই ’৮১ সালেই ফিল্ম আর্কাইভের ফিল্ম অ্যাপ্রিসিয়েশন কোর্স চালু করায় তিনি ছিলেন প্রধান উদ্যোক্তা। এভাবেই আলমগীর কবির সৎ চলচ্চিত্র-আন্দোলনের প্রাইম মুভার। সৎ চলচ্চিত্রের আন্দোলন সামগ্রিক চলচ্চিত্র চর্চারই অংশ এবং আজ, সিকি শতাব্দী পরও সমানভাবে গুরুত্বপূর্ণ।

আসলে আলমগীর কবিরকে নতুন প্রজন্মের ভালো করে জানা প্রয়োজন। কথাটি বলেই দ্রুত জানাই, আলমগীর কবির মহামানব ছিলেন না। তাঁর ত্রুটির কোনো অভাব ছিল না। তাঁর চলচ্চিত্রে, তাঁর লেখায়ও সীমাবদ্ধতা প্রচুর। কিন্তু আলমগীর কবির চলচ্চিত্রশিক্ষায় শিক্ষিত মানুষ ছিলেন, তাঁর চিন্তায় আধুনিকতা ছিল, যুক্তি ছিল। তিনি ন্যায্য সমাজের কথা ভাবতেন, বলতেন। তিনি চলচ্চিত্র নির্মাণ করতেন, কারণ চলচ্চিত্রকে ন্যায্য সমাজ নির্মাণের অনুঘটক এক শিল্পমাধ্যম বলে জানতেন। আলমগীর কবির নিজের জানাকে অন্যের মধ্যে ছড়িয়ে দিতে চাইতেন, তাঁর কর্মে কোনো ক্লান্তি ছিল না। তিনি চলচ্চিত্রবিষয়ক নানা অ্যাডভেঞ্চার নিয়ে উত্তেজিত থাকতেন এবং সেই উত্তেজনা সবার মধ্যে সঞ্চারিত করতে চাইতেন। আলমগীর কবিরের ছবি দেখে, তাঁর লেখা পাঠ করে, তাঁর সম্পর্কে নির্ভরযোগ্য সূত্র থেকে শুনে আজকের এবং আগামী দিনের চলচ্চিত্রপ্রেমিকরা ভালো ছবি বানাতে, দেখতে এবং ভালো ছবির জন্যে লড়তে প্রেরণা পাবেন – এই দৃঢ় বিশ্বাস জ্ঞাপন করছি। আজ থেকে তিরিশ বছরেরও আগে তিনি লিখেছেন, ‘It is too late to put the blame on our colonial past or cultural subjugation by the majority community of this sub-continent. Because we know now that given the right conditions and dedications from adherents of the art even the most exploited nation could achieve true cinema with marked national character.’  আমাদের এই নির্মিতি আজো সম্পন্ন হয়নি, কিন্তু নিঃসন্দেহে আজ এ লক্ষ্যে কর্মীর অভাব নেই। আশা করা যেতে পারে আলমগীর কবিরের চলচ্চিত্র ও সমাজচিন্তা তাদের সফল হতে পথনির্দেশ দেবে। n

 

তথ্যসূত্র

১.  দ্য সিনেমা ইন পাকিস্তান : আলমগীর কবির, প্রকাশক : সন্ধানী প্রকাশনী, ১৯৬৯

২.  ফিল্ম ইন বাংলাদেশ : আলমগীর কবির, প্রকাশক : বাংলা একাডেমি, ১৯৭৯

৩. মন্তাজ, দ্বিতীয় সংখ্যা : প্রকাশক ঋত্বিক চলচ্চিত্র সংসদ, ১৯৮৯

৪.  চলচ্চিত্রাচার্য আলমগীর কবির : সম্পাদনা : মুনিরা মোরশেদ মুন্নী, প্রকাশক : সোনারং সাহিত্য সংস্কৃতিপত্র, ২০০৬

 

 

এই নিবন্ধটি প্রাথমিকভাবে আলমগীর কবিরের পঁচিশতম মৃত্যুবার্ষিকী উপলক্ষে আয়োজিত অনুষ্ঠানমালায় পঠিত হয়।

Leave a Reply