logo

সত্যজিৎ রায়ের একাধিক ছবিতে তাঁর ক্যামেরা কথা বলেছে

সৌ মে ন্দু   রা য়

তাহলে সেই গল্প দিয়েই শুরু করা যাক। গল্প? গল্প তো নয়, সত্যি ঘটনা। রূপকথার মতো পরিবেশ। তখনো বিদ্যুৎ এসে পৌঁছয়নি সেখানে। জায়গাটা এমনিতেই বেশ চুপচাপ। এখানে সূর্যও যেন তাড়াতাড়ি ডুবে যায়। ঝুপ করে সন্ধ্যা নেমে এলো। চারদিক আরো নিঝুম। বাড়িতে আলো বলতে কেবলই লণ্ঠন। আর, বাড়ি বড় হলে যা হয়, লোকেরা এঘরে ওঘরে ছড়িয়ে। বিছানায় ফোল্ডিং মশারির নিচে আমাকে শুইয়ে রাখা হয়েছে। নেহাতই শিশু তখন আমি। মাত্র মাস কয়েক বয়স। আমাকে দেখাশোনার জন্য একজন দাইমাকে রাখা হয়েছিল। হঠাৎ তিনি ঘরে ঢুকে দেখেন এক মারাত্মক কা-। একটা সাপ। নিকষ কালো বিষাক্ত একটা সাপ। বিছানায়, ফণা তুলে সে যেন প্রস্ত্তত। আমি তো ঘুমোচ্ছি। আর জেগে থাকলেও আমি কি বুঝতাম যে ওটা কী? দাইমা আঁতকে উঠলেন। চিৎকার করে উঠলেন। মুহূর্তে বাড়ির সকলে ওই ঘরে জড়ো হয়ে গেল। সাপটাকে বোধ হয় মেরেই ফেলা হয়েছিল। সেদিন মৃত্যুই এসেছিল, চলে গেল। সকলের মুখেই তখন আমাকে ফিরে পাওয়ার আনন্দ। দাইমা আমাকে কোলে তুলে নিলেন, মাকে বললেন, ‘একদিন তুমহারা এ বেটা রাজা হোগা!’

রাজা হওয়া বা না হওয়াটা কোনো কথা নয়। রাজা হতেও কখনো চাইনি। দাইমার কথাটা আমার কাছে এক বিরাট আশীর্বাদ। কিন্তু জীবনটা শুরু হয়ে গেল।

আমার জন্ম উত্তর কলকাতায়, গ্রে স্ট্রিটে। কলকাতা আমার বড় প্রিয় শহর। কিন্তু জীবনের প্রথম দশ বছর এই শহরের সঙ্গে তেমন ঘন হতে পারিনি। মাঝে মাঝে এসেছি, থেকেওছি – চলে যেতে হয়েছে। আমার বাবা কনককুমার রায় বাইরে কাজ করতেন, মধ্যপ্রদেশে। এখন ওই অঞ্চল ছত্তিশগড় নামে পরিচিত। মধ্যপ্রদেশের ধরমজয়গড়ে আমার জীবনের ওই দশ বছর কেটেছে। ১৯৩২ সালের ৭ ফেব্রুয়ারি আমার জন্ম। জন্মানোর কয়েক মাসের মধ্যেই আমাকে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল ধরমজয়গড়ে। তখন তো ব্রিটিশ আমল। ধরমজয়গড় ছিল নেটিভ রাজ্য। বাবা ছিলেন সেখানকার রাজবাড়ির এক উচ্চপদস্থ কর্মচারী। ব্রিটিশদের সঙ্গে রাজবাড়ির সম্পর্ক, লেনদেন, আইনি খুঁটিনাটি – সমস্ত কিছু বাবাকেই সামলাতে হতো। বাবার ওপর ছিল রাজবাড়ির অগাধ ভরসা।

আমাদের সবকিছু আমাদের হাতে থাকে না। নিয়তিই আমাদের ঠিকানা বলে দেয়। যতদূর মনে পড়ে ১৯২৫-২৬ সালে বাবাকে কলকাতা ছেড়ে ধরমজয়গড়ে চলে আসতে হয়েছিল। বাবা ছিলেন ইতিহাসের ছাত্র। বিশ্ব ইতিহাসে কত বড় বড় চরিত্র, কত ঘটনা, কত পালাবদল, গল্পগাথা – এসবই ছিল বাবার ভাবনার জগৎ। এদিকে আমাদের যৌথ পরিবারে জ্যাঠা-কাকারা প্রায় সকলেই উকিল, ব্যারিস্টার, ডাক্তার। একরকম জোর করেই বাবাকে ওকালতি পড়তে বাধ্য করা হলো। বাবার মন কিন্তু পড়ে ছিল ইতিহাসেই। ফলে ওকালতিতে তিনি ডানা মেলতে পারলেন না। আমার সেজ জ্যাঠামশায় বিমল রায় ছিলেন সেই সময় বিহারের নামকরা সিভিল সার্জন। তাঁর সঙ্গে সেখানকার বহু বিশিষ্ট মানুষের আলাপ ছিল। ধরমজয়গড় তখন সদ্য হারিয়েছে তার প্রিয় রাজাকে। অথচ এত বড় এস্টেট একা রাজমাতা কীভাবে সামলাবেন? তাছাড়া মাথার ওপর দোর্দ- প্রতাপ ব্রিটিশ সরকার, তাদের সামলানোর জন্যও রাজবাড়ির দরকার ছিল একজন নির্ভরযোগ্য লোকের। জ্যাঠামশায়ের সঙ্গে রাজমাতার দাদা সিরাজিকাকার ভীষণ বন্ধুত্ব ছিল। জ্যাঠামশায়ের কাছে তিনি এমন লোকের সন্ধান করেছিলেন, যিনি রাজপরিবারের সেই গুরুদায়িত্ব নিজ যোগ্যতায় সামলাতে পারবেন। তখন জ্যাঠামশায় বাবাকে সেখানে পাঠালেন।

তখন ধরমজয়গড়ের চারদিকে কেবলই জঙ্গল। সন্ধ্যা নামতে না নামতেই রাস্তা দিয়েও হিংস্র জন্তুদের যাতায়াত। সে সময় ওই এলাকায় বাঘও ছিল প্রচুর। একে ওরকম একটা পরিবেশ, মানুষজনের সংখ্যাও খুব কম, যাঁরা রয়েছেন তাঁরাও কেউ কলকাতার আদব-কায়দা শেখা নয়, নিতান্তই হাটুরে মানুষ, ভালো করে কথাও বলতে পারতেন না তাঁরা। প্রিয় শহর, প্রিয় ভাষাকে ছেড়ে তবু বাবা কী এক আকর্ষণে যেন এখানেই থেকে যাবেন স্থির করলেন। না, শুধু উপার্জনের জন্যই নয়; রাজবাড়ির সকলের, বিশেষ করে রাজমাতার ভালোবাসায়, আন্তরিকতায় বাবা ক্রমশই জড়িয়ে পড়লেন।

আমরা চার ভাই। তিন বোন। রাজমাতা ছিলেন আমাদের পিসিমা। আমি ছিলাম ভাইদের মধ্যে সব থেকে ছোট। এমনকি একজন বাদে বোনেরাও ছিল আমার থেকে বয়সে অনেক বড়। মধ্যপ্রদেশে তো তেমন ভালো স্কুল ছিল না। দাদা-দিদিরা একটু বড় হতেই পড়াশোনার জন্য তাদের পাঠিয়ে দেওয়া হতো কলকাতায়। দেশপ্রিয় পার্কের কাছে, ওই এখন যেটা প্রিয়া সিনেমা হল, তার উলটো দিকে ১৪৮ নম্বর রাসবিহারী অ্যাভিনিউতে আমার সেজ জ্যাঠামশাই একটা বাড়ি তৈরি করেছিলেন। যৌথ পরিবারের আনন্দ নিয়ে, জ্যাঠা-কাকা-দাদা-দিদি-ভাইবোন – সকলেই ওখানে থাকত। স্বাভাবিকভাবে, আমার দাদা-দিদিরাও সেই বাড়িতেই থাকত। আমি আর বোন তখন নেহাতই ছোট। পড়াশোনাও শুরু হয়নি। ধরমজয়গড়ে মা-বাবার সঙ্গেই থাকতাম। ম্যাট্রিক পাশ করে মেজদিও চলে এসেছিল এখানে। অর্থাৎ মা, বাবা, মেজদি, আমি আর আমার বোন – এই নিয়েই ছিল মধ্যপ্রদেশে আমাদের ছোট সংসার। সেখানে আনন্দের অভাব ছিল না। কিন্তু আনন্দ যে কী বিরাট হতে পারে তা বুঝতাম যখন মাঝে মাঝে কলকাতার বাড়িতে আসতাম। যৌথ পরিবারে উৎসব-অনুষ্ঠান লেগে থাকত হামেশাই, সেই উপলক্ষে কলকাতায় আসা হতো আমাদের।

দাইমার কথা মনে পড়ে – ‘একদিন তুমহারা এ বেটা রাজা হোগা!’ সত্যি সত্যি রাজা হওয়ার বাসনা কোনোদিন মনে না এলেও ছোটবেলায় আমি বহুবার মিথ্যে মিথ্যে রাজা হয়েছি। আর রাজা হলে তার তো থাকবেই একটা বিশাল রাজবাড়ি। সেখানে দরবার বসবে। সেই দরবারে বসে রাজা তার প্রজাদের আদেশ-হুকুম করবে। দশেরার দিন রাজবাড়ির দরবার হল খোলা হতো পরিষ্কার করার জন্য। রাজবাড়িতে বাবার জন্য ছিল আলাদা সম্মান আর আমাদের জন্য ছিল নিবিড় ভালোবাসা। রাজমাতাকে কোনোদিন রাজমাতা মনে হয়নি, পিসির স্নেহ-আদরে বড় হয়েছি তাঁর কাছে। আমার ছোট বোনকে উনি নিজের মেয়েই ভাবতেন। বোন সারাদিন ওই বাড়িতে রাজমাতার কাছেই থাকত। সারাদিন ওখানেই ঘুমোত, খেত। শুধু রাতেরবেলা বাবা-মার কাছে চলে আসত। রাজবাড়ির হেঁসেল থেকে প্রত্যহই আসত সুস্বাদু খাবারদাবার। রাজমাতার শাশুড়ি জানতেন আমি শাক খেতে খুব ভালোবাসি। প্রতিদিন শাক রান্না করে উনি আমাদের বাড়িতে পাঠিয়ে দিতেন। ভাতের পাতে একটু শাক আজো আমার ভালো লাগে। যাই হোক, দশেরার কথায় ফিরে আসি। ওই বিশাল দরবার হলে ছিল হাতির দাঁতের ফ্রেম করা একটা সিংহাসন, রাজার সিংহাসন। রাজবাড়ির সদস্য হওয়ার ফলে ওই বাড়ির পরিচারক-পরিচারিকারাও আমাকে খুব যত্ন-আত্তি করত। আমি, আমার ছোট বোন আর ওই পরিচারক-পরিচারিকাদের ছেলেমেয়েরা সেদিন একসঙ্গে দরবার হলে প্রবেশ করতাম। শুরু হতো ছোটদের রাজত্ব। বলা বাহুল্য, আমিই ছিলাম সেই রাজ্যের রাজা। সিংহাসনে বসতে দরবার চালু হতো। প্রজারা নিচে পেতে রাখা কার্পেটে বসত। প্রজাদের আদেশ করতাম। বিধান দিতাম। তারা পালন করত – এ যে স্বয়ং রাজার আজ্ঞা। বছরের ওই একটি দিনেই দরবার হলটি খোলা হতো। বছরের ওই একটি দিনেই বসত ছোটদের রাজ্যপাট।

দশেরা ছিল ধরমজয়গড়ের একটি বিশেষ উৎসব। সেদিন বিরাট প্রসেশন বেরোত। সবার আগে থাকত রাজবাড়ির হাতি মঙ্গল সিং। মঙ্গল সিংয়ের ছিল বিশাল বড় দুটো দাঁত। ওই দাঁতের ওপর তুলে হাতির পিঠের হাওদায় আমাকে আর বোনকে বসিয়ে দিত মাহুত। প্রসেশন শুরু হতো। হাতির পিঠে চড়ে সারা শহর ঘুরতাম সেদিন। ঘোরা শেষ হলে আবার আমাদের নামিয়ে দেওয়া হতো বাড়িতে। মঙ্গল সিংয়ের পছন্দের মেনু ছিল কলা আর আখের গুড়। মা তাকে খেতে দিত।

ধরমজয়গড়ের গল্পের ঝোপঝাড় যেন শেষই হতে চায় না। রাজমাতার দত্তক সন্তান যুবরাজ চন্দ্রচূড়ের সঙ্গে কতবার শিকারে গিয়েছি। যুবরাজ বেরোতেন হরিণ শিকারে। হরিণের চামড়া, শিং – সে তো প্রচুর ছিল আমাদের বাড়িতে। এমনকি বাঘের কিংবা চিতার চামড়াও ছিল। আর তখন তো ইলেকট্রিক ছিল না, টানা পাখার হাওয়া খেলত ঘরে। আমি কিন্তু ছোটবেলায় খুব একটা দুষ্ট ছিলাম না। এঘর ওঘর ওই পাখার হাওয়ার মতো একা একাই ঘুরে বেড়াতাম। বাবা কখন কাজে বেরিয়ে গেছেন। মা ব্যস্ত সংসার নিয়ে। আর বোনও তো নেই, পিসিমার কাছে চলে গেছে। বাড়ির খুব কাছেপিঠেই ছিল বেশ কয়েকটা মন্দির। কী করব – সেখানেও চলে যেতাম। চোখ মেলতেই গাছগাছালিতে ভরা একটা সবুজ পাহাড়। পাশ দিয়ে বয়ে গেছে আমারই মতো শান্ত এঁরু নদী। নদী কি কিছু খোঁজে? আমিই বা কী খুঁজছি? খুব বেশি জল ছিল না নদীটির। স্থানীয় লোকজন ওই হাঁটুজলে দাঁড়িয়ে মাছ ধরত গামছা পেতে। দেখতাম। ওই বিশাল একা বাড়িতে আমার সঙ্গী ছিল দুজন। দুই সারমেয়। বিদেশি। জ্যাক আর জেনি। সারা বাড়ি জুড়ে এরা ছুটে বেড়াত। বাগানে চলে যেত। আগেই বলেছি, ধরমজয়গড় ছিল নানান হিংস্র শ্বাপদে ভরা। একদিন হায়না এসে তুলে নিয়ে গেল জেনিকে। স্বজন হারানোর ব্যথা এই প্রথম অনুভব করলাম।

বাংলার বাইরে থেকেছি। কিন্তু বাংলা সংস্কৃতির থেকে কখনো বিচ্ছিন্ন হইনি। সেটা হতে দেননি বাবা। তিনি ছিলেন অত্যন্ত রুচিশীল। বাড়িতে থাকলে বাবা বই পড়েই সময় কাটাতেন। চাইতেন আমাদের মধ্যেও বই পড়ার নেশা জেগে উঠুক। নিজের এবং আমাদের জন্য কলকাতা থেকে নিয়মিত বই আনাতেন। ধরমজয়গড়ের সঙ্গীহীন দিনগুলোয় আমার সঙ্গী ছিল মৌচাক, শিশুসাথী পত্রিকা, ঠাকুরমার ঝুলির মতো অজস্র বইপত্র। গল্প শোনার জন্য অক্ষরজ্ঞানের প্রয়োজন কী? মেজদি তো ছিলই। সে-ই কথকঠাকুরের ভূমিকা নিত। গল্পগুলো পাঠ করে শোনাত আমাকে আর বোনকে। ওই এলাকায় এমনিতেই বাঙালির সংখ্যা হাতে গোনা। তারই মধ্যে বাবা আমাদের পড়ানোর জন্য এক বাঙালি মাস্টারকে নিয়ে এলেন। তিনি পড়াতেন ভালো। কিন্তু পড়াশোনায় আমার তেমন মতিগতি ছিল না। পড়াশোনার ব্যাপারে সেই গল্পটা মনে পড়ে গেল। তখন বর্ণপরিচয়ের দ্বিতীয় ভাগ পড়ছি। কলকাতা থেকে বড় দিদি এসেছে বাড়িতে। আমাকে আর বোনকে পড়াতে বসেছে। দ্বিতীয় ভাগের বানান ঠিকমতো পড়তে পারছি না। খুব জোরে আমার কান মলে দিয়ে দিদি মাকে বলল – ছেলেকে কলকাতায় পাঠাও, নাহলে পড়াশোনা কিচ্ছু হবে না। খুব রাগ হলো। দিদি আমার কান মলল কেন? এর একটা জবাব দিতেই হবে। মাকে বললাম, ‘আচ্ছা মা, বিয়ে করে মেয়েরা কোথায় থাকে?’ আচমকা আমার মুখে এরকম একটা কথা শুনে মা যথেষ্ট অবাক, বললেন, ‘কেন? শ্বশুরবাড়ি -।’ মার কাছে অভিযোগ জানালাম, ‘আমার দিদি কেন এখানে?’ ভাবলাম কথাটা বলে আচ্ছা একটা জবাব দেওয়া গেল দিদিকে। দেখলাম, সবার মতো দিদিও ওই কথায় খুব মজা গেল। সকলেই ওই কথায় খুব হাসছে। বড়দির সঙ্গে আমার বয়সের অনেক তফাত। আমার প্রতি তার ওরকম অভিভাবকসুলভ আচরণ তো থাকবেই। আবার এই বড়দিই একদিন আমাকে ক্যামেরা কিনে দিয়েছিল। সেটাই জীবনে পাওয়া আমার প্রথম ক্যামেরা।

কিন্তু বড়দি তো আর সবসময় ধরমজয়গড়ে থাকত না। মা-ই আমাকে বড় করে তুলেছে। এক অর্থে আমি ছিলাম মা-ন্যাওটা। যত রাজ্যের আবদার তার কাছেই। বাবা একাদশী করত। দেখাদেখি বললাম, মা আমিও তোমার সঙ্গে একাদশী করব। বরং বাবার সঙ্গে একটু দূরত্ব ছিল। কাছে যেতে ভয় পেতাম। অন্যদিকে বড়দিকে বেশ সাহসী মনে হয়। দেখতাম বাবার সঙ্গে কী সহজেই সে মিশে যেতে পারত।

ধরমজয়গড়ের পরিবেশ আমার সঙ্গে প্রকৃতির সম্পর্ক গড়ে তুলেছিল। প্রকৃতিকে ভালোবাসার নেপথ্যে ছিল বাবারও মস্ত ভূমিকা। বাবা এমনিতে খুব রাশভারী। কিন্তু ভেতরে ভেতরে তিনি ছিলেন একদম অন্য রকম। সেটা বাড়ির সামনে ওই ছড়ানো বাগানটি দেখলেই বোঝা যেত। ফুলের রঙে, গন্ধে বাতাসেরও মন ভালো হয়ে যেত। কী যত্ন করে ফুলগাছ লাগাতেন বাবা, কত রকমের! রজনীগন্ধা, জুঁই, স্থলপদ্ম ছাড়াও ফুটত বিভিন্ন ঋতুর ফুল। বিদেশি ফুলও লাগানো হতো। বাবার প্রিয় হর্টিকালচার দেখতে শুধু ধরমজয়গড়ের মানুষই নয়, ইংরেজরাও হাজির হতো সেই বাগানে। কলকাতার গ্লোব নার্সারি থেকে নিয়মিত চারা আনা হতো। ফুলের মন বুঝত বাবা। ফুলেরাও তার সঙ্গে কথা বলত। বাড়ির সামনের দিকে ছিল যেমন ওই ফুলের বাগান, তেমনি পেছন দিকে ছিল সবজির বাগান। কত রকমের পাখিও আসত সেখানে!

মানুষের তৈরি বাগানে কোথাও একটা পরিকল্পনা থাকে। কিন্তু প্রকৃতি নিজের হাতে যে বাগান তৈরি করে, তাতে কোনো পরিকল্পনা থাকে না। আপন মনে সে বেড়ে ওঠে। গরু চড়াত যেসব রাখাল, তাদের সঙ্গে কতদিন মাঠের পর মাঠ চষে বেরিয়েছি। পরিচিত কারো হয়তো মোষ রয়েছে। সেই মোষের পিঠে চড়ে ধরমজয়গড়ের মাঠ, জঙ্গল পেরোনোর সে কী রোমাঞ্চ। হাটে যাওয়ার আনন্দও কি কম? নিতান্ত গেঁয়ো হাট। একদিকে পাঁঠা বিক্রি হচ্ছে, অন্যদিকে কাঠের হাতা-খুন্তি-হাঁড়ি-কলসির মতো নিত্যকার জিনিসপত্তর। সেসব কিনতেই মানুষের আসা-যাওয়া – কোনো আড়ম্বর নেই, জৌলুস নেই কিন্তু সারল্য আছে। স্থানীয় বাজার-হাটে মাছ বিক্রি হতো না। পাওয়াই যেত না। মাংস বলতে সবসময়ের জন্য মুরগি। আমাদের বাড়িতে মুরগি রাখার জন্য একটা আলাদা মাটির ঘরই ছিল। পাঁঠার প্রেস্টিজ অবশ্যই বেশি। তার দেখা সপ্তাহান্তে ওই একবারই মিলত। কিন্তু সে মাংস যে কী স্বাদের ভাবলে আজো জিভে জল চলে আসে।

যৌথ পরিবারে থাকার আনন্দ যে কী, ধরমজয়গড়ে তা টের পেতাম কেবল পুজোর সময়ই। কলকাতার বাড়ি থেকে দাদা, দিদি, খুড়তুতো ভাইবোনেরা – সকলে মিলে চলে আসত ছুটি কাটাতে। হাসিখুশি গন্ধে ভরে উঠত সারাবাড়ি। বিজয়া দশমীর দিন ওখানকার কিছু বাঙালি আর আমাদের নিয়ে বাবা প্রতিবছর সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের আয়োজন করত। সেখানে নাটক, গান-বাজনা হতো। একবার বিসর্জন নাটকে ‘ধ্রম্নব’র পার্ট পেলাম। ধ্রম্নবর মৃত্যুদৃশ্যে আমার ছোট বোনের সে কী কান্না। তার কেবলই মনে হতে থাকল ছোড়দা মরে গেছে। কে ওকে বোঝাবে সেটা ছিল নিতান্তই নাটক।

এইসব নাটক তো কেবলই প্রাণের খুশিতে করা হতো। তাই তাকে ঘিরে সবসময়ই কিছু না কিছু মজার ঘটনা ঘটে যেত। আলিবাবা নাটকে পিসতুতো দাদা সেজেছে ‘মর্জিনা’। কিন্তু সবাইকে অবাক করে দিয়ে স্টেজে ও বলে গেল ‘আবদুলস্না’র ডায়লগ। দাদা আসলে ভুলেই মেরে দিয়েছে যে নাটকে ও একটি মেয়ের ভূমিকায় অভিনয় করছে। পুজোর কটা দিন বাড়িজুড়ে যে হট্টমেলা চলত, সবাই আবার কলকাতায় ফিরে যেতে সারাবাড়িটা যেন খাঁ খাঁ করত। আনন্দের এত কাছেই যে বিষাদ কেন বসে থাকে – কিছুতেই মেনে নিতে পারতাম না। আর সে বয়সটা ছিল এমনই, যে বয়সে সকলেই কেবল আনন্দকে খোঁজে। আমার পরবর্তী আনন্দের দিন ছিল কালীপুজো।

বাড়ি থেকে পাঁচ মাইল দূরে আমরিটিকরা বলে একটা জায়গা ছিল। ওখানকার কালীমন্দিরকে স্থানীয় লোকজন জাগ্রত মানত। বাবার সঙ্গে আমি আর ছোট বোন হাতির পিঠে চেপে সেখানে যেতাম। ছোট্ট একটা নদী পার হয়ে সেই জায়গায় যেতে হতো। আমরা হাতির পিঠেই বসে থাকতাম। যাওয়া-আসার এই পথটাই ছিল খুব আনন্দের। আমরিটিকরার কালীমন্দিরে গিয়ে দেখি পুজোর বিপুল আয়োজন। মারাত্মক ভিড়। ওইদিন সেখানে ৪৯টি পাঁঠা বলি হতো। এছাড়া ছোট-বড় মোষও বলি হতো। বয়ে যেতে রক্তগঙ্গা। এত লাল দেখে চোখ ঝলসে উঠত। আনন্দের এত কাছেই যে বিষাদ কেন বসে থাকে মুহূর্তেই মন ভারী হয়ে যেত। দরিদ্র আদিবাসীদের উলস্নাস যদিও থামার নয়। ওই পশুরক্ত ছিল তাদের প্রিয় খাদ্য। রক্ত জমাট বাঁধলে তাকে বরফির মতো কেটে, রান্না করে খেত তারা। তখন আমার চোখে যা ছিল কেবলই নিষ্ঠুর দৃশ্য, আজ বুঝি তা আসলে ওই দরিদ্র মানুষের চরম অসহায়তা।

১৯৩২ সালে এসেছিলাম ধরমজয়গড়ে। দেখতে দেখতে কীভাবে যেন দশটা বছর কেটে গেল। দাদা-দিদিদের যে কারণে কলকাতায় পাঠানো হয়েছিল, শুনলাম আমাকেও নাকি সেজন্যই কলকাতায় যেতে হবে। কলকাতা! মুহূর্তে আলোর ঝিলিক খেলে গেল মনে। পরমুহূর্তেই মন খারাপ – মাকে ছেড়ে এতদূরে থাকব কীভাবে?

 

দুই

স্বপ্নের শহর। অদ্ভুত রং তার। কোথাও কোনো তাড়া নেই। রাস্তাঘাট ফাঁকা ফাঁকা। হঠাৎ একটা ট্রাম চলে গেল। ঘণ্টি বাজিয়ে। গাড়ি বলতে ওই দু-একটা বাস। একটা পরিষ্কার শহর বলতে যা বোঝায়, কলকাতা তখন ঠিক সেরকম। পাশের পায়ে চলা পথ ধরে কতদূর যেন চলে যাওয়া যায়।

মেজদাই বলেছিলেন – সিনেমা দেখাতে নিয়ে যাবেন। সিনেমা! তাকে শুনেছি, দেখিনি কখনো। আমি যে সেই সুদূর মধ্যপ্রদেশের তস্য গ্রাম ধরমজয়গড়ের অনাড়ম্বর পরিবেশ থেকে আসা এক নিতান্ত বালক, মুহূর্তে ভুলে গেলাম। শহরের হাওয়া এসে গায়ে লাগল। মেজদা আর তাঁর বন্ধু অমিয়দার সঙ্গে পৌঁছলাম এলিট সিনেমা হলে। প্রথমবারের মতো দেখছি এসপ্লানেড। প্রথমবারের মতো দেখছি কোনো সিনেমা হল। একেবারে এক নতুন জগতের সঙ্গে দেখা হলো যেন। তখন Gold Rush চলছে, চ্যাপলিনের। সত্যি কথা বলতে কি সিনেমাটা দেখে মজা লেগেছিল, কিন্তু বুঝিনি কিছু। কিন্তু ওই যে পর্দা সরে গেল। একটা অদ্ভুত আলো। অন্ধকার একটা বড় ঘর। কত লোক সেখানে বসে। এসব দেখেই আমি অবাক হয়ে গেলাম। কই, ধরমজয়গড়ে তো এরকম ম্যাজিক নেই। সিনেমা ভেঙে যাওয়ার পর মেজদারা আমাকে একটা রেস্টুরেন্টে নিয়ে গেলেন। রেস্টুরেন্টই বা কী? ধরমজয়গড়ের সেই গ্রামীণ হাট, বাজার – সেখানে আলাদা করে কোনো খাবারের দোকানই ছিল না, রেস্তোরাঁ তো দূরের কথা। রেস্টুরেন্টের নাম কী মেজদা? মেজদা জানালেন, অনাদি কেবিন। সেখানে কী খাব? বাড়ির রান্নার আঙিনা পার করে এই প্রথম বাইরের দোকানের কোনো খাবার – মোগলাই পরোটার সঙ্গে পরিচিত হলাম। বলতে কোনো দ্বিধা নেই, চ্যাপলিনের (Gold Rash)-এর থেকে অনাদি কেবিনের সেই মোগলাই পরোটা অনেক বেশি আকর্ষণীয় লেগেছিল। ফেরার পথে মেজদা ও অমিয়দা আমাকে নিয়ে হাঁটতে থাকলেন, যাতে কলকাতা শহরটাকে আমি একটু দেখতে দেখতে যেতে পারি। সে যাত্রাপথ আমার ভেতরে কী যে মায়া ছড়িয়েছিল! ফিরপোর পরিচয় আজ আর কারোকে দিতে হবে না। কিন্তু আমার কাছে তো সেদিন সবই প্রথম, সবই নতুন। ফিরপোর পাশ দিয়ে যেতে যেতে অমিয়দা বললেন – সাহেব ছাড়া এখানে কেউ অ্যালাও নয়, বুঝেছিস? কিছু বুঝি, কিছু বুঝি না, আবছা-আবছা সবই শুনে যাই। টাইগার হলের পাশ দিয়ে আমরা হেঁটে গেলাম। আরো একটা সিনেমা হল। সেখানেই বা কোন সিনেমা চলছে? কিছুটা দূরেই নিউমার্কেট। বাজার এরকম হয় বুঝি! ঘুরে ঘুরে দেখলাম। এই শহরকে দেখার যেন কোনো শেষ নেই।

ধরমজয়গড়ে থাকার সময় মাঝে মাঝেই আসা হতো কলকাতায়। কলকাতায় বড় পরিবারে বিয়ে, উৎসব, অনুষ্ঠান লেগেই থাকত। সে কারণেই মা-বাবার সঙ্গে কলকাতায় আসা। যে কলকাতার কথা এতক্ষণ বললাম, সে কলকাতাকে আমার ওরকম ঘুরতে আসার সময়ই দেখা। কিন্তু পড়াশোনার কারণে এবার যখন পাকাপাকিভাবে কলকাতায় চলে আসতে হলো, সেই স্বপ্নের শহর কলকাতাকে কীভাবে পেলাম?

তখন যুদ্ধের সময়। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ। ঝলমলে কলকাতার মুখ গোমড়া। ভার-ভার। প্রতিটি বাড়ির আলোর রং কালো। নিরাপত্তার কারণে বালবের গায়ে ঠুলি পরিয়ে রাখা হয়েছিল। জানালা দিয়ে ঘরের ভেতরকার আলো যাতে বাইরে বের হয়ে না আসে, সেজন্য জানালাগুলো কাগজে ঢেকে তার ওপর ক্রস করে আঠা দিয়ে আটকে দেওয়া হতো। অসময়ে কারো বেরোনো চলবে না। সময়ে বেরোলেও আতঙ্ক পিছু ছাড়ার নয়। দেশপ্রিয় পার্কে আমাদের বাড়ির পাশ দিয়েই বড় রাস্তা, সেখানে মানুষ কই? চারিদিকে সেনাবাহিনীর গাড়ি, বুটের শব্দে সবাই তটস্থ। আমাদের পাশের বাড়িতেই ছিল সেনাবাহিনীর আস্তানা। কখনো সেখানে একসঙ্গে ব্রিটিশ সেনারা থাকত, কখনো আমেরিকানরা। ব্রিটিশ সেনাদের শিক্ষাদীক্ষা ছিল, সভ্যতা-সংস্কৃতি ছিল। তারা সকলের সঙ্গে খুব ভদ্র ব্যবহার করত। আমাদের বাড়ির লোকজন যাঁরা ইংরেজি বলতে পারতেন, তাদের সঙ্গে কত গল্প করত। ছোটদের উপহার দিত চকোলেট। আমেরিকানরা ছিল এর ঠিক উলটো। সভ্যতার কোনো বালাই ছিল না। উলঙ্গ হয়ে ঘরময় ঘুরে বেড়াত। স্বাভাবিক কারণেই, ওরা এলে আমাদের বাড়ির একদিককার জানালা সম্পূর্ণ বন্ধ করে রাখতে হতো। সাদা আমেরিকানরাই ছিল এতটা রুচিহীন, বেপরোয়া। নিগ্রোদের তো মানুষই মনে হতো না।

মার কাছ থেকে এতদূরে যখন ট্রেনে করে আসছি, ভাবছি, তাও তো অন্য কোথাও নয়, যাচ্ছি আমার স্বপ্নের শহরে। এই শহরের মধ্যে ঢুকে আমার সেই স্বপ্ন মুহূর্তে চুরমার হয়ে গেল। তখন মনকে সান্তবনা দেওয়ার কিছুমাত্র উপায় আর নেই। সময়টা তখন ছিন্ন-বিচ্ছিন্ন হয়ে আছে। সবকিছু বুঝতে পারতাম না। আঁচের তাপ তো টের পেতাম। ’৪৩-এর ভয়াবহ দুর্ভিক্ষ বিভীষিকার মতো। চারিদিকে রোল উঠছে – মা, ভাত দাও, ফেন দাও – গোটা কলকাতা তখন ক্ষুধার্ত। ব্রিটিশ রেশনে হয়তো কিছু চাল আসত, সে চাল ছিল অখাদ্য, কাঁকরে ভর্তি। চারিদিকে লঙ্গরখানা খোলা হচ্ছে। সেখানে স্বেচ্ছাসেবকের কাজ করেছিলাম আমি। মানুষের এই অসহায়তাকে এত কম বয়সে প্রত্যক্ষ করলে, বয়স আপনিই বেড়ে যায়। অস্থিরতার মানচিত্রও শেষ হতে চায় না। এসে পড়ল রায়ট। নৃত্যপর আগুনের শিখা। এই ‘আলস্নাহু আকবর’ বলে একদল ছুটে গেল তো পরমুহূর্তেই ‘জয় মহাদেব’ উলস্নাস ধ্বনি। লেক মার্কেটের দুটো দোকানে আগুন ধরিয়ে দেওয়া হলো। অভিযোগ, ওই দোকান দুটো ছিল মুসলমানের। দেশপ্রিয় পার্কে একটা লোককে শুয়ে থাকতে দেখে শিউরে উঠলাম – তার গলা কাটা! ধরমজয়গড়ের শান্ত নিবিড় প্রকৃতি থেকে এ কোন ঘোলাটে শহরে এসে পড়লাম! মা, তুমি কোথায়? একটা গোটা কালো মেঘ বৃষ্টি হয়ে ভেঙে পড়ল শহরটার মাথায়। ধীরে ধীরে আকাশ পরিষ্কার হতে শুরু করল। রোদ ঝলমলে আগস্ট। রাত বাড়তেই ঘরে ঘরে শাঁখ বেজে উঠল। কটা বাজে এখন? রাত বারোটা। অর্থাৎ একটা নতুন দিন। জন্ম নিল আরেক নতুন ভারতবর্ষ। এইমাত্র স্বাধীন হলো সে।

সকালে ছোটদের জন্য ছিল ট্রামে করে ফ্রি রাইডিংয়ের ব্যবস্থা। বালিগঞ্জ থেকে রাজভবন অবধি। ভাবা যায় – এই ভবন ছিল এতকাল ব্রিটিশদের রাজবাড়ি। এখন এই ভবনের ওপর কেবল আমাদের অধিকার। এতকাল দূর থেকে সম্ভ্রমে দেখে গেছি সেই প্রাসাদ। সেদিন ভেতরের একটা অংশে আমাদের ঘুরিয়ে দেখানো হলো। অধিকারের আনন্দ ছোটদের মধ্যেও যেন ছড়িয়ে গেল!

 

তিন

কলকাতায় এসে ভর্তি হলাম তীর্থপতি ইনস্টিটিউশনে। আমাদের বাড়ির পাশেই ছিল সেই স্কুল। সেখান থেকেই আমার ম্যাট্রিক পাশ। তবে কলকাতায় আসার পর, মাঝের এক বছর আবার ছেদ পড়েছিল এই শহরের সঙ্গে আমার সম্পর্কের। আমার সেজ জ্যাঠামশায় বিমল রায় এমনিতে রাশভারী হলেও আসলে ছিলেন খুব দিলদরিয়া মানুষ। তিনি পরিবার নিয়ে ভাগলপুরেই থাকতেন। কী কারণে যেন, মাঝে কলকাতায় এসেছিলেন। স্থির করলেন, আমাকে ভাগলপুরে নিয়ে যাবেন। সেজ জ্যাঠামশায়ের ছেলে আমার থেকে মাত্র এক বছরের বড়। আমি গেলে ওরও একজন সঙ্গী হবে, ভেবে, জ্যাঠামশায় আমাকে নিয়ে গেলেন। সেটা ছিল ১৯৪৫ সাল। ভাগলপুরের দুর্গাচরণ হাই স্কুলে আমাকে ভর্তি করা হলো। আমি তখন ক্লাস সেভেনে। ভাগলপুরের দিনগুলোকে এখন আর আমার তেমনভাবে মনে পড়ে না। তবে সেখানেও খুব ভালো ছিলাম। জ্যাঠামশায়দের বাংলোটা ছিল খুব বড়। খোলামেলা একটা বাগানও ছিল সেখানে। পরবর্তী সময়ে কাজের সূত্রে জেনেছি, পরিচালক তপন সিংহেরও স্কুল ছিল ওই দুর্গাচরণ হাই স্কুল। যাই হোক, জ্যাঠামশায়ের ছিল বদলির চাকরি। ভাগলপুর থেকে তিনি আমাদের নিয়ে পাটনায় চলে গেলেন। কিন্তু সেখানে গিয়ে জ্যাঠামশায় খুবই অসুস্থ হয়ে পড়লেন। সবাইকে নিয়ে কলকাতায় ফিরে আসা ছাড়া জ্যাঠামশায়ের কোনো উপায় ছিল না। আমি যথারীতি আবার এক বছর পর ভর্তি হয়ে গেলাম তীর্থপতি ইনস্টিটিউশনে।

মা-বাবার সঙ্গে ধরমজয়গড়ে থাকাটা একরকম, কিন্তু একান্নবর্তী পরিবারে নিয়মরীতিগুলো যেন কিছুটা আলাদা, লক্ষ করলাম। সেটা রোজকার খাবারের মেনুতে চোখ রাখলেই বোঝা যাবে। বড়দের জন্য চেয়ার-টেবিলের ব্যবস্থা থাকলেও ছোটরা মেঝেতে বসেই খেতাম। মা-বাবার সঙ্গে যখন থাকতাম তখন কবে কী রান্না হবে সে বিষয়ে কোনো চার্ট মানা হতো না, প্রয়োজনও ছিল না। কিন্তু এ বাড়িতে সবকিছুই নিয়মে বাঁধা। মাসে কেবল একদিনই মাংস আসত। মাংস বলতে পাঁঠার। কলকাতায় মুরগির মাংসের তখনো অত চল ছিল না। তবে ডিম হবে সপ্তাহে দুদিন। একেকজনের জন্য বরাদ্দ ছিল আধখানা করে। আর বাড়িতে বসে কাবাব-বিরিয়ানি খাবারও কোনো চল সে সময়ে ছিল না। বলা যায়, ওসব ব্যঞ্জনের কোনো প্রবেশাধিকারই ছিল না বাড়িতে। দুবেলাই ভাত খেতাম, পরিমাণমতো। স্কুল থেকে ফেরার পর খুব খিদে পেত। খাবার থাকত রুটি, ছোলার ডাল আর দুধ। এসবে আমি বেশ মানিয়ে নিয়েছিলাম। কেবল একটা ব্যাপারেই মনে মনে ছিল নীরব আপত্তি। ম্যাট্রিক পাশ না করলে এ বাড়িতে তার লুচি খাওয়ার অনুমতি নেই। কেন, বা কে এই কঠিন আইন বলবৎ করেছিলেন আমি জানি না। ফলে লুচি ব্যাপারটাকে আমার বিরাট পুরস্কারের মতো মনে হতো। আমার পড়াশোনায় এমনিই খুব একটা মতিগতি ছিল না। তাই লুচির প্রতি আমার তাড়নাও ছিল একটু বেশি। আর থাকবে নাই বা কেন? ছোটবেলায়, ধরমজয়গড়ে লুচি মোটেই আমার কাছে দুর্লভ ছিল না। আমি লুচি খেতে ভালোবাসতাম বলে মা খাঁটি গাওয়া ঘিয়ে সেই লুচি ভেজে দিতেন। মার কাছে আমার আবদারের শেষ ছিল না। একবার মা লুচি ভাজছেন আর সেই ভাজা লুচি সকলকে দিচ্ছেন। আমি মাকে গিয়ে বললাম, মা, আমাকে যে লুচি দেবে, সেগুলো ভাজার আগে প্রতিবার তুমি কড়া-তে নতুন করে ঘি দেবে। পুরনো ঘিয়ের ভাজা লুচি আমি খেতে পারব না। শুনে মা তো হেসে কুটোপুটি। বললেন, ‘তুই কি রাজার ছেলে?’ আর কলকাতায় এসে আমার কী হাল হলো!

আসলে, সে যুগে ছোটদের বেশ কড়া অনুশাসনের মধ্যে রাখা হতো। তখন এসবের বাইরে কখন বেরিয়ে আসতে পারব এই ভেবে বড় হওয়ার প্রবল ইচ্ছে জেগে উঠলেও বড় হয়ে দেখেছি, এসব নিয়ম না থাকলে আবার সঠিকভাবে বড় হওয়াও যেত না। রাত সাড়ে
নটা-দশটার মধ্যে আমাদের শুয়ে পড়তে হতো। সকাল হতো ছটা-সাড়ে ছটা নাগাদ, চা আর দুটো বিস্কুট হাতে ধরিয়ে আমাদের জাগিয়ে দেওয়া হতো। যদিও এইসব অনুশাসনের ফাঁকফোকর দিয়ে আমরা ছোটরা প্রচুর আনন্দ কুড়িয়ে নিতাম।

ধরমজয়গড়ের সেই ছোট্ট নিঃসঙ্গ বালক এখানে এসে অনেক দোসর পেয়ে গেল। দাদারা তো ছিলেনই, এছাড়া জ্যাঠা-কাকা-পিসিদের ছেলেপুলে মিলে আমরা চার ভাই ছিলাম একেবারে পিঠাপিঠি। চার ভাই বলতে? গদাই, শম্ভু, বুদ্ধু এবং আমি। ফোর মাস্কেটিয়ার্স এই দলটির সর্দার ছিল গদাই। তার যে কত কীর্তি, বলে শেষ করা যাবে না। মেজদির বিয়ের সময় এধার-ওধার থেকে টাকা-পয়সা সরিয়ে গদাইয়ের নেতৃত্বে আমরা চললাম ‘পূর্ণ’ সিনেমা হলে, জীবনে প্রথম অ্যাডাল্ট ছবি দেখতে! তখন রবীন মজুমদারের গরমিল সিনেমাটা চলছিল। সিনেমা দেখার পরেও অ্যাকাউন্টে কিছু পয়সা বেঁচে ছিল। যা দিয়ে খাওয়া-দাওয়াও চলল। আমি যে-কোনো অ্যাডভেঞ্চারে যতটা উৎসাহ নিয়ে শামিল হতাম, ভেতরে ভেতরে ছিলাম ঠিক ততটাই ভিতু। সবসময়ই মনে হতো, এই রে, কোনো গরমিল হয়ে যাবে না তো! বাড়ির লোক জেনে যাবে না তো! গদাই ওসব তোয়াক্কাই করত না। ও বিশ্বাসই করত না যেমন কাজ, তার তেমন কর্মফল। ফলে ওর মধ্যে বেশ একটা নেতৃত্ব দেওয়ার প্রতিভা খুঁজে পেয়ে আমরাও ওর দলে নাম লেখাতাম। কিন্তু সবসময়ই যে নেতা ম্যাচ জিতিয়ে দেবে, তা তো হয় না। কখনো কখনো জেতা ম্যাচও হেরে আসতে হয়।

ছোট কাকা ছিলেন চেইন স্মোকার। বাবা আর নতুন কাকা যদিও ছিলেন নস্যি অনুরাগী। আমাদের কাছে নস্যির কোনো আকর্ষণ ছিল না। এমনকি বাড়ির ওই কড়া অনুশাসন পার হয়ে যে একটু ধোঁয়া ছাড়ব, তেমন উদ্যমও প্রবল ভয়ের কারণে ছিল না। কিন্তু গদাই এক্ষেত্রেও অকুতোভয়, সে একদিন শোর তুলল, ‘চল, আমরা সিগারেট খাই।’ যথারীতি আমি খুব উৎসাহ বোধ করলাম এই প্রস্তাবে, যদিও মনে মনে ভাবলাম, গদাইটা কি পাগল হয়ে গেছে? ওর কি কোনো ভয় নেই? মেপল ব্র্যান্ডের খানতিনেক সিগারেট কিনে ফেলল গদাই। অতঃপর চারজনে মিলে ভাগাভাগি করে সুখটান। সুখ বেশিক্ষণ আর কপালে সইল না। বাড়ির পরিচারক-পরিচারিকার বাথরুমে সমবেত সেই ধূম্রপান টের পেয়ে যান কাকা। বড়দের মৃদু ও প্রবল ভৎর্সনার মধ্যে দিয়ে আমরা তিনজন কোনোক্রমে রেহাই পেয়ে গেলেও মূল আসামি গদাইকে যথেষ্টই শাস্তি পেতে হয়েছিল, অন্তত ওর গায়ের দু-একটা কালশিটে ছোপ সেকথাই বলছিল।

আসলে, পেছন দিকে ফিরে, আজ, যখন ওই চারটে ছেলেকে দেখি, ওদের কারোরই কোনো দোষ খুঁজে পাই না। কী অসম্ভব সরল আর উদ্যমে ভরা ছিল সেসব দিন। স্কুল, স্কুলের পরীক্ষা, রেজাল্ট খারাপ ফলে মন আরো খারাপ – না, মন খারাপের কোনো সুযোগই ছিল না। বাড়িতে এত এত লোক, দুদিন ছাড়া ছাড়া কারো হয়তো বিয়ে, সেজন্য আরো সবার এ বাড়িতে এসে যাওয়া – সে এক বড় রাজকীয়, ধুমধামের স্বর্গ ছিল আমাদের বাড়ি। এখানে থাকলে কারো মন খারাপ হয়? হতে পারে? বাড়ির সামনেই ছিল দেশপ্রিয় পার্ক। স্কুল থেকে ফিরে প্রথমে হুড়মুড় করে খাওয়া-দাওয়া, তারপর একছুটে সেই পার্কে। ক্রিকেট, ফুটবল সবই খেলতাম কিন্তু কোনো খেলাতেই আমি খুব পারদর্শী ছিলাম না। কিন্তু ওই যে, সবার সঙ্গে থাকা, সঙ্গে চলা, এতেই আমার আনন্দ। বড় হয়ে ক্যামেরার পেছনে দাঁড়িয়ে লেন্সে চোখ রাখতে ওই আনন্দে রাঙা ছেলেটিকে বহুবার দেখতে পেয়েছি। সে সকলের সঙ্গে থাকায় এত আনন্দ পেয়েছিল বলেই না আজ সিনেমা নামক এক কালেক্টিভ আর্টে সকলের সঙ্গে কাজ করে, কাজ করার সেই আনন্দটাকে উপভোগ করতে পেরেছে!

সেই সময় ক্লাব ক্রিকেটের খুব চল ছিল। নতুন কাকা আমাদের খেলাধুলোয় উৎসাহ দিতেন। ব্যাট উইকেট বল – এসব কিনেও দিতেন। আমরা খেলতাম। আর এই খেলাচ্ছলেই কখন যে আমাদের মধ্যে উঁকি মারছে বয়ঃসন্ধি, তা বুঝতেও পারতাম না আর বুঝতে পারলেও আমি এতটাই স্বভাবলাজুক ছিলাম যে, সে সময়ে খুব অপ্রস্ত্তত হয়ে যেতাম। আমাদের বাড়িতে খুড়তুতো, জ্যাঠতুতো বোনেদের বন্ধুরাও আসত। তখন সকলেরই ফ্রক পরার বয়স। এদের মধ্যে দুজন আসত, তাদের নাম বলছি না, তারা ছিল দুই বোন। গদাই তো বড় বোনের প্রতি পাগল। বড় বোনও। কিন্তু তখনকার দিনে প্রেমালাপ চিঠি চালাচালির গ– পেরিয়ে খুব দূর একটা যেতে স্পর্ধা পেত না। আর ছোট বোন চিঠি লিখত আমাদের আরেক ভাই শম্ভুকে। কিন্তু ভাগলপুর থেকে আমি আবার কলকাতায় এসে পড়ায় শম্ভুর কপাল পুড়ল। একদিন ভাইয়েরা সকলে মিলে বারান্দায় আড্ডা মারছি, হঠাৎ দেখি শম্ভুর সেই পত্রপ্রেমিকা শম্ভুর দিকে তার চিঠিটা না ছুড়ে আমার দিকে ছুড়ে মুহূর্তে কোথায় মিলিয়ে গেল। আমি তো ওরকম চিঠি পেয়ে ভয়ে কাঁপছি, যাকে বলে দুর্নিবার ভয়। গদাই অভয় দিলো – ‘ও কিছু না, খোল, চিঠিটা খোল, পড় – দ্যাখ, কী লিখেছে!’ কী আবার লিখবে? প্রেমের চিঠি যা হতো আর কি – ‘তোমাকে আমার…’ বলা ভালো, জীবনে সেটাই ছিল আমার পাওয়া প্রথম ও শেষ প্রেমের চিঠি। ওই দুই বোন তো এরপর হাওয়ায় মিলিয়ে যেতে পারে না। আমাদের বাড়িতে ওদের যাতায়াতও ছিল। কিন্তু ছোট বোনকে আসতে দেখলে সে ঘটনার পর থেকে আমিই হাওয়া হয়ে যেতাম। কিন্তু গদাইকে রুখবে কে? ওর অত আমার মতো
হাওয়া-বাতাস হয়ে যাওয়ার সাধ ছিল না। বরং স্বাধীনতার পর যে বাড়িটায় আগে ব্রিটিশ ও আমেরিকান সেনারা থাকত, সেখানে নতুন একটি পরিবার এলে, আমাদের জানালার মুখোমুখি ওবাড়ির জানালা খুলতেই ‘তৃষ্ণা’ নামের একটি মেয়েকে দেখতে পেতাম, যেরকম দেখা যায় এবাড়ি ওবাড়ি মুখোমুখি থাকলে। তৃষ্ণা জানালার সামনে এলেই গদাই গায়ক হয়ে উঠত, কী পরম নিবিড়তায় ও গেয়ে উঠত ‘চক্ষে আমার তৃষ্ণা’। কিছুক্ষণ পরেই ওবাড়ির তরফে দড়াম করে একটা শব্দ – তৃষ্ণা জানালা ভেজিয়ে দিয়েছে।

গদাইয়ের সেই প্রতিভাকে তৃষ্ণা বোঝেনি। গদাই নিজেও ওর প্রতিভা সম্বন্ধে ছিল উদাসীন। কোথাও না শিখেও গদাই কী অসম্ভব ভালো পিয়ানো বাজাতে পারত। সেতারের হাতটাও ছিল খুব মিষ্টি। বাঁশি শুনিয়ে ও শ্রোতার মনকে দূরে কোথাও নিয়ে যেতে পারত। এসব গুণ ফেলে রেখে, বড় চাকরি, বউ, ছেলেমেয়েকে ফেলে রেখে, স্রেফ অত্যধিক নেশা-ভান করে বড় অসময়ে গদাই কোথায় চলে গেল? ও আর কোনোদিন ফিরে আসবে না। আমার স্মৃতিচিত্রগুলো মনের ভেতরে কোনো গোপন স্টুডিয়োতে আজো জমা পড়ে আছে। মাঝে মাঝে সেই স্টুডিয়োয় ঢুকি। ফিল্মের রাশ (Rush) ঘাঁটতে ঘাঁটতে এভাবেই দু-এক টুকরো গদাইকেও পেয়ে যাই। ক্যামেরা জলে ভরে ওঠে।

ক্যামেরা।

ক্যামেরাই আমার চিরবন্ধু।

এতসব পারিপার্শ্বিক ঘটনার মধ্যে দিয়ে সে কীভাবে আমায় হাতছানি দিলো? স্মৃতিচিত্রগুলো আরো একবার নেড়েচেড়ে দেখা যাক –

 

চার

আমাদের পরিবারে ছবি তোলার একটা রেওয়াজ ছিল। তখন কারো হাতে ক্যামেরা থাকা মানে সে অন্য সকলের থেকে আলাদা। দাদারা সকলেই ছিলেন অ্যামেচার ফটোগ্রাফার। জ্যাঠতুতো দাদার যেমন একটা ক্যামেরা ছিল, তেমনই আমার দাদারও একটা ক্যামেরা ছিল। ওদের দেখে আমিও বেশ ক্যামেরার লোভে পড়ে গেলাম। মনে হতো, আমারও যদি ওই যন্ত্রটা থাকত, তবে আমিও ছবি তুলতাম। কত মুহূর্ত আমাদের মধ্যে আসে আর চলে যায়। তেমনই, কত কত মুহূর্তের মধ্যে আমরাও আসি আর চলে যাই। ভাবতে অবাক লাগত, কেবলমাত্র একটি সুইচ টিপলেই সেই মুহূর্তটা আর আমার কাছ থেকে সরে যেতে পারছে না, চলে যেতে পারছে না, সে অবিকল রয়ে যাচ্ছে আমারই কাছে, আমারই সঙ্গে। ক্যামেরাকে না ভালোবেসে উপায় কী! কিন্তু তখন একটা ক্যামেরা জোগাড় করা মুখের কথা ছিল না। তখন তো আর এরকম যুগ নয় যে মোবাইল কিনলেই ক্যামেরা ফ্রি! ক্যামেরা পাওয়া যে কত বড় ব্যাপার সেটা বোঝা গেল যখন আমার বড়দি নমিতা বলল, ‘আগে ম্যাট্রিকটা পাশ কর, তবে মিলবে ক্যামেরা, আমি কিনে দেব।’ বুঝলাম, ম্যাট্রিক পরীক্ষাটা একটা সীমান্তরেখার মতো, যেটা পার না হলে আমি লুচি বা ক্যামেরা, কিছুই পাব না। আচ্ছা গেঁরোয় পড়া গেল। দাদারা সকলেই পড়াশোনায় ভালো। আমি প্রত্যেকবারই পরীক্ষায় ওই লাল কালির গা ঘেঁষে ঠিক পাশ করে যাই। ম্যাট্রিকটাও উতরে গেলাম। দিদি কথা রেখেছিল। লুচির ব্যাপারেও নিষেধাজ্ঞা উঠে গেল। ম্যাট্রিকের ওই সীমানা পার হয়ে আমি তখন এসে পড়লাম যেন এক নতুন দেশে – ক্যামেরার দেশ, ছবির সে দেশ!

তবে এরও আগের কিছু ঘটনা রয়েছে। তখন আমি তীর্থপতিতে ক্লাস এইটের ছাত্র। ক্লাসে অসিত রাহা নামে নতুন একটা ছেলে ভর্তি হলো। আমি যেরকম স্বভাব-প্রকৃতির, তাতে নতুন কারো সঙ্গে ভাব জমতে বেশ সময় লেগে যায়। কিন্তু অসিতের সঙ্গে আমার অচিরেই বন্ধুত্ব তৈরি হয়ে গেল। ওই সময় অসিতের কাছে একটা ভালো ক্যামেরা ছিল। থার্টি ফাইভ মিলিমিটার। এছাড়া লেক মার্কেটে অসিতের দাদার ফটোগ্রাফির একটা স্টুডিয়োও ছিল। অসিতকে ধরলাম – ‘তুই আমাকে ছবি তোলা শেখাবি?’ ছবি তোলার প্রাথমিক দিনগুলো আমি ওর কাছ থেকেই শিখতে শুরু করলাম। তখন শনি-রবিবার করে অসিতের ক্যামেরা নিয়ে দুজনে বেরিয়ে পড়তাম। শহর কলকাতার এদিক-ওদিক গিয়ে ছবি তুলতাম। তারপর ওর দাদার স্টুডিয়োর ডার্করুমে প্রবেশ করে ছবিগুলোকে এনলার্জ করতাম। ক্রমে, ছবি তোলার ব্যাপারে আমার আগ্রহ বাড়তে থাকল।

অসিত ছিল আমার কলেজেরও সতীর্থ। ওর মধ্যে একরকম রসবোধ আমি টের পেয়েছি। আমাদেরই পরিচিত একজন, চা-বাগানে কাজ করতেন, তিনি কলকাতা ছেড়ে চলে যাবেন বলে মা আমাকে বললেন, ‘যা, ওঁর বাড়ি থেকে কিছু দরকারি জিনিসপত্তর তুই নিয়ে আয়।’ ভদ্রলোক থাকতেন চৌরঙ্গি স্কয়ারে। কলেজে উঠে গেলেও আমার অধিকাংশ ঘোরাঘুরি, আড্ডার কেন্দ্র ছিল দক্ষিণ কলকাতাই। এসপ্লানেড চত্বরটা খুব ভালো করে চিনতাম না। একা না গিয়ে অসিতকেই সঙ্গী করে রওনা দিলাম। কিন্তু এসপ্লানেডের ঠিক কোন এলাকায় ওই চৌরঙ্গি প্লেস, সেটা চিনব কী করে! মাঝে মাঝে এলিট বা লাইটহাউসে সিনেমা দেখতে এসেছি, নিউমার্কেটেও এসেছি বেশ কয়েকবার, কিন্তু এর বেশি জ্ঞান ওই অঞ্চল সম্পর্কে আমার বা অসিতের, কারোরই ছিল না। রাস্তার একটি লোককে জিজ্ঞেস করলাম। তিনি আমাদের দুজনকে কিছুক্ষণ মাপলেন, জিজ্ঞেস করলেন, ‘আপনারা নতুন এস্ছেন কলকাতায়?’ আমি একটা ফিরিস্তি দিতে যাচ্ছিলাম, অসিত চট করে আমাকে অবাক করে জবাব দিলো, ‘হ্যাঁ, এই প্রথম।’ লোকটা তখন বেশ বিজ্ঞের মতো ‘হু’ বলে আমাদের অনুসরণ করতে বললেন। অসিত মুচকি হেসে আমাকে বলল – ‘চল’। আমরা, কলকাতার দুই নতুন অতিথি (!) সেই গাইডকে ফলো করে হাঁটতে থাকলাম। গাইড রাস্তার দুপাশের যত উল্লেখযোগ্য জায়গা, তার বর্ণনা দিতে দিতে যাচ্ছিলেন। আমরা সব শুনছি, জানছি। অসিতের মুখ দেখে মনে হলো, ও সত্যি কলকাতায় নতুন এসেছে। লোকটা আমাদের নিউমার্কেট চেনাতেও নিয়ে গেলেন। তারপর হাত তুলে ‘ওই ওদিকটায় গেলেই চৌরঙ্গি প্লেস পাবেন’ বলে চলেও গেলেন। এমন মহানুভব গাইড আমি জীবনে দুটি লাভ করিনি। অসিত হেসে কুটোপুটি। শেষ পর্যন্ত প্যারাডাইস সিনেমার কাছে আবিষ্কার করা গেল চৌরঙ্গি প্লেসকে।

মজার সঙ্গে আলাপ করার এরকমই সহজাত দক্ষতা ছিল অসিতের। স্রে্রফ মজা, আনন্দ পাবে বলে মাঝে মাঝে এমন কা- বাধিয়ে বসত ও যে, আমি যথেষ্ট অস্বস্তিতেও পড়ে যেতাম। আমিনিয়ায় চপ খেতে ঢুকেছি দুজনে। চপের স্বাদ যত ভালো, ততই কম ছিল আমাদের রেস্ত। কিন্তু অসিত শূন্য পকেটকে গুরুত্ব দেওয়ার বান্দা নয়। তার সাহস অদম্য। নির্বিকারভাবে মাথার একটা চুল ছিঁড়ে, অর্ধেক খাওয়া চপের মধ্যে সেটাকে রেখে দোকানে অভিযোগ জানাল। মুহূর্তে আরেকটা চপ ওর প্লেটে হাজির হলো।

যাই হোক, অসিতের কিছু আত্মীয় কাজ করতেন নিউ থিয়েটার্স স্টুডিয়োয়। সেই সুবাদে দু-একটা ছবির শুটিং দেখার সুযোগ হয়েছিল আমাদের। দেখেছিলাম মহাপ্রস্থানের পথে ছবির শুটিং। সিনেমাকে এতদিন দেখেছি বাইরে থেকে। সেই প্রথম আমরা দেখলাম ছায়াছবির রান্নাঘরটিকে। সেখানে ঢুকে অবাক হওয়া ছাড়া আমাদের উপায় ছিল না। বাইরে দুরন্ত গরম। কিন্তু সেটে তৈরি করা হয়েছে একটা পাহাড়। এখানেই শেষ নয়। পাহাড়ে বরফও পড়ছে! এ কীভাবে সম্ভব? এ তো ম্যাজিক, স্টুডিয়োয় ঢুকলেই আমি কেমন একটা ঘোরের জগতে চলে যেতাম। পরে জেনেছি, ওপর থেকে লাক্স ডিটারজেন্ট পাউডার ফেলে ওই বরফ কুচি দেখানো হয়েছিল। এই যে, বাস্তব থেকে সরে এসে বাস্তবকেই দেখানো হচ্ছে, এর মধ্যেকার এক রহস্যময় ছন্দ, সৃষ্টির আনন্দ, এসবই আক্রান্ত করল আমাকে। স্টিল ফটোগ্রাফি চর্চা করছি কিন্তু মুভি ক্যামেরার প্রতি কখন যেন সন্তর্পণে আগ্রহ তৈরি হয়ে গেল, টের পেলাম না। কিন্তু ভেতর থেকে কেউ যেন বলছে আমাকে, জীবনে যদি কিছু করতে পারিস, তবে ওই ক্যামেরাকেই সঙ্গী করে নিতে হবে। ওই অস্থির মুহূর্তগুলো জীবনে না এলে, আর যা-ই হোক, ক্যামেরার পেছনে আমার দাঁড়ানো হতো না, সিনেমার সঙ্গেও কোনো গাঁটছড়া তৈরি হতো না। এদিকে কিছুদিনের মধ্যেই অসিত চলে গেল বিদেশে। যদিও মুভি ক্যামেরায় কাজ শেখার ব্যাপারটা আমার মাথাছাড়া হলো না।

তখনকার দিনে চলচ্চিত্রকে কেউই ভালো চোখে দেখতেন না। তার ওপর, সিনেমার কাজকর্মের সঙ্গে যুক্ত এরকম কারো সঙ্গে আমার চেনাজানাও ছিল না। মাকে মাঝে মাঝেই বলতাম, ‘পড়াশোনা করতে ভালো লাগছে না, আমি ক্যামেরার কাজ শিখব।’ মা আঁতকে উঠতেন – ‘তুই পাগল হয়েছিস নাকি? তোর বাবা-কাকারা কেউই রাজি হবেন না। আর আমরা এই সিনেমাজগতের কারোকে চিনিও না যে, তোর জন্য বলব!’

কী করব! কূলকিনারা কিছুই খুঁজে পাচ্ছি না। এদিকে অসিতও নেই এখানে। ওকেও ওর স্বপ্ন ফেলে রেখে পাড়ি দিতে হয়েছে বিদেশে। মাকেও অভিযোগ করার কিছু নেই। জীবন যে পরিস্থিতির কাছে কত অসহায়, তা প্রথম টের পেলাম। কিন্তু সৌভাগ্যের ব্যাপার এই, আমাদের পরিবার ছিল যৌথ। সেখানে অনেক মানুষেরই আসা-যাওয়া লেগে থাকত। খুড়তুতো দিদির বিয়ে উপলক্ষে তার শ্বশুরবাড়ি থেকে এক ভদ্রলোক কাকার সঙ্গে দেখা করতে এলেন। জানলাম, তিনি একজন চিত্রপরিচালক, নাম হিরণ্ময় সেন। মাকে জোর করলাম, ‘এই একটা সুযোগ এসেছে, দ্যাখো – যদি ওঁকে বলে কিছু একটা হয়।’ বাবা-কাকাদের পছন্দের সীমারেখা পেরোতে মা প্রথমে রাজি হননি, কিন্তু প্রিয় ছেলের প্রস্তাবই বা ফেলে দেবেন কীভাবে? ভদ্রলোক সেদিন চলে গেলেও ইতিমধ্যে আরো দু-তিনবার তিনি আমাদের বাড়িতে এলেন। বারবার জোর করায় এক প্রকার বাধ্য হয়েই মা হিরণ্ময় সেনকে বললেন, ‘আমার ছোট ছেলে ক্যামেরার কাজ শিখতে চায়। আপনি কি কোনো ব্যবস্থা করতে পারেন?’ হিরণ্ময়বাবু জানালেন, ‘আমি তো কিছু করতে পারব না, তবে আমার ক্যামেরাম্যান রামানন্দ সেনগুপ্ত যদি রাজি হন, তাহলে ঠিক আছে।’

হিরণ্ময়বাবুর কাছে আমি কৃতজ্ঞ। তিনি কথা রেখেছিলেন। আমি কোন বাড়ির ছেলে, রামানন্দবাবু তাঁর কাছ থেকে খোঁজ নিয়েছিলেন। রামানন্দবাবুর সঙ্গে আবার আমার জ্যাঠতুতো দাদার ক্ষীণ একটা পরিচয় ছিল।

১৯৫৪ সাল। আমি রামানন্দ সেনগুপ্তর সঙ্গে দেখা করলাম। কথা হলো। শেষে, তিনি আমাকে নিতে রাজি হয়ে গেলেন।

জুট টেকনোলজি পড়ার কথা ছিল আমার। বাবা-কাকারা চেয়েছিলেন সেরকমই। একটা সুস্থির চাকরি, সেটাই তো ভবিষ্যৎ। কী এক অদম্য টানে যে সেই ভবিষ্যৎ অস্বীকার করেছিলাম – ভাগ্যিস করেছিলাম!

 

পাঁচ

লাল খেরোখাতায় মন দিয়ে মানিকদা কী সব যেন লিখে যাচ্ছেন। আরেকজন বড় বড় চুল, রোগা-পাতলা, একটু শর্ট হাইট মানুষ, পাজামা-পাঞ্জাবি পরা, ব্রাশ নিয়ে একমনে কী যেন একটা রং করেই যাচ্ছেন। আমি সম্ভ্রমের চোখে সবকিছু দেখে যাচ্ছি। তখন কারোকেই চিনি না। কী রং করছিলেন তিনি? আজ আর স্পষ্ট করে মনে নেই। কিন্তু কাজের প্রতি কী তাঁর একাগ্রতা! মানিকদা তাঁকে বলছেন : ‘বংশী, ওটা আসবে না, ছাড়ো।’ উত্তরে তিনি বলছেন : ‘তুমি থামো তো মানিক, আমাকে কাজ করতে দাও।’ গোটা সেটে এরকমভাবে সত্যজিৎ রায়ের সঙ্গে কথা বলতে পারতেন কেবল একজনই। তিনি বংশী চন্দ্রগুপ্ত। যে কাজ তাঁর মাথায় চাপবে, তা তিনি সম্পূর্ণ না করা পর্যন্ত থামবেন না। আর যা করবেন, তা এতটাই নিখুঁত হবে যে, সেই কাজ অন্য কারো পক্ষে আর করা সম্ভব নয়। ওই পথের পাঁচালীর দরজাটার কথাই যদি ভাবি – সে তো বংশীদারই তৈরি। দরজাটি ছিল পাইন কাঠের। বংশীদা সেই দরজাকে রোদে পুড়িয়ে পুড়িয়ে, তারপর ব্রাশ করে সেটের পরিবেশের সঙ্গে মানানসই করে গড়ে নিলেন। দরজাটিকে একটা ভাঙাচোরা আদল দেওয়ার জন্য দরজার নিচের অংশ বেশি করে পুড়িয়ে খসিয়ে দিয়েছিলেন। একটু পুরনো লাগবে দেখতে – সেরকম করার জন্য তিনি দরজাটিকে কস্টিক সোডা দিয়ে বিস্নচ করে দিলেন।

পেছনে ফিরে তাকালে সেইসব দিনের কথাই কেবল মনে পড়ে। ক্রমে ক্যামেরা কেয়ারটেকারের ভূমিকাও পালটালো আমার। ক্যামেরা সংরক্ষণের দায়িত্ব ছেড়ে আমি হয়ে উঠলাম সহকারী ক্যামেরাম্যান। কার? বিখ্যাত সিনেমাটোগ্রাফার সুব্রত মিত্রর। আর তখন থেকেই খুব কাছের করে পেয়ে গেলাম সিনেমাজগতের তিন কিংবদন্তি ব্যক্তিত্বকে – সত্যজিৎ রায়, সুব্রত মিত্র এবং শিল্পনির্দেশক বংশী চন্দ্রগুপ্তকে।

কিন্তু সমস্ত শুরুরই এক শুরুর কথা থাকে। সেই কথাতেই আগে ফেরা যাক।

তখনকার টালিগঞ্জ স্টুডিয়োপাড়ার সঙ্গে আজকের দিনের স্টুডিয়োপাড়ার কোনো মিল নেই। সে তখন সবেমাত্র তার ডালপালা মেলছে। সরু একটা রাস্তা ধরে পৌঁছলাম সেখানে। জীবনে প্রথমবার। ঢোকার মুখে দরোয়ান আটকে দিলো, ‘কী চাই?’ রামানন্দবাবু দুটোর সময় আমাকে আসতে বলেছেন, জানাতে দরোয়ান আমাকে অফিসে গিয়ে বসার অনুমতি দিলো। অফিসে ‘বাবু’ নামের একটি ছোট ছেলে বসে আছে। বুঝলাম বাবু টেলিফোন অপারেটরের কাজ করে। সে জানাল, ‘রামানন্দবাবু এখনো আসেননি, এলে খবর দিচ্ছি।’

ঘণ্টাখানেক বসে আছি। সম্পূর্ণ অপরিচিত একটা জায়গা। অপরিচিত জগৎ। কী করব বুঝে উঠতে পারছি না। ইতিমধ্যে বেশ একটা মজার ঘটনা ঘটল। আমার পকেটে তখন বাড়ি ফেরার পয়সাটুকুই সম্বল। বাবু স্বাভাবিক ভদ্রতায় জিজ্ঞেস করল, ‘চা খাবেন?’

আমি আঁতকে উঠলাম, ‘না-না, আমার পয়সা নেই। আপনি খান।’ বাবু তখন আশ্বস্ত করল, ‘পয়সা দিতে হবে না। আপনি খান।’ যথাসময়ে রামানন্দবাবু এসে পড়েছেন। ডাক পড়ল। স্টুডিয়োয় তখন আরো অনেকেই বসে। স্টুডিয়োর ম্যানেজমেন্টের তরফে ছিলেন সত্যেন চ্যাটার্জি ও দুর্গাদাস মিত্র। ইন্টারভিউ বোর্ডের সামনে এসে বেশ নার্ভাস হয়ে গিয়েছিলাম। ক্যামেরা নিয়ে কাজ করব – সেখানেও এরকম ইন্টারভিউ দিয়ে ঢুকতে হবে। ভেবেছিলাম, এরপর একের পর এক প্রশ্নবাণ ছুটে আসবে। দেখলাম, প্রশ্নকর্তারা খুব আন্তরিক। পরিবারের কথা, কত অব্দি পড়াশোনা – আমার কাছ থেকে এসবই জানলেন তাঁরা। শেষে, রামানন্দবাবুও আমাকে জিজ্ঞেস করলেন, ‘তোমার বাড়িতে কে কে আছেন?’ আমি জানালাম। তাঁর পরবর্তী প্রশ্ন : ‘তোমার ইনকামের ওপর কি তোমার বাবা-মা নির্ভরশীল?’ জানালাম, ‘না’। রামানন্দবাবুর তাৎক্ষণিক জবাব, ‘ঠিক আছে। তাহলে এসো।’ তিনি দীনেন গুপ্তকে ডেকে পাঠালেন, আমাকে দেখিয়ে তাঁকে জানালেন, ‘এই ছেলেটি কাল থেকে আসবে।’ দীনেন গুপ্ত তখনো পরিচালক হননি। তখনো তিনি ক্যামেরার কাজই করতেন। তিনি ছিলেন টেকনিশিয়ান ক্যামেরা ডিপার্টমেন্টের হেড। বাবা-মা আমার পয়সার ওপর নির্ভরশীল নয় জেনে রামানন্দবাবু কি কিঞ্চিৎ খুশি হয়েছিলেন? কেন? এই প্রশ্ন সেদিন আমার মনে জেগেছিল। পরবর্তী সময়ে জিজ্ঞেস করতে রামদা জানিয়েছিলেন, ‘আসলে এমন তো হতেই পারে, সারাজীবন হয়তো তুমি অ্যাসিস্ট্যান্টই রয়ে গেলে – এ লাইনে তো কোনো নিশ্চয়তা নেই। তখন হয়তো ফ্রাস্ট্রেটেড হয়ে সিনেমা লাইনটাই ছেড়ে দিলে। পরিবার নির্ভরশীল হলে এরকম বিপদ তোমার আসতেই পারত।’ সেদিন, ইন্টারভিউতে কিন্তু আমি ছবি তুলি কি না কিংবা সিনেমা দেখি নাকি – এরকম কোনো প্রশ্নই করা হয়নি।

শুরু হয়ে গেল ইন্ডাস্ট্রিতে আমার নিয়মিত যাতায়াত। রোজ সকাল সাড়ে দশটায় চলে যেতাম। কিন্তু তখন তো আমি একেবারেই আনকোরা। কিছুই জানি না। প্রথম তিন মাস আমাকে অবজারভার হয়েই থাকতে হয়েছিল। এর জন্য কোনো মাইনেপত্র পেতাম না। বাবা-মা বাইরে থাকেন, দাদা-দিদিরাও কোনোদিন আমাকে টাকা-পয়সার ব্যাপারে চাপ দেননি। উলটো তাঁরা উৎসাহ দিয়েছেন ‘তুই তোর মতো কাজ কর’ বলে। রামানন্দবাবুর সেই প্রশ্ন অভ্রান্ত হয়ে দেখা দিলো আমার জীবনে। এদিকে পকেট ফাঁকা। খিদে পেলেও নিজে থেকে কিছু কিনে খাওয়ার উপায় নেই। বিকেলের দিকে স্টুডিয়োর পক্ষ থেকে সামান্য কিছু খাওয়ানোর ব্যবস্থা ছিল। দীনেনদাই একদিন জিজ্ঞেস করলেন আমাকে, ‘তোমার নিশ্চয় খিদে পেয়েছে? কিছু খাও -’ স্টুডিয়োর অন্য কর্মীদের মতো আমার জন্যও বিকেলবেলায় বরাদ্দ হলো টোস্ট, আলুর দম আর চা। ক্রমে দীনেনদার সঙ্গে আমার ঘনিষ্ঠতা বাড়ল। কাজে যুক্ত হওয়ার প্রথম দিনই তিনি আমাকে বলেছিলেন, ‘মন দিয়ে কাজ দেখে যাও। কোনো কথা বোলো না। কিছু জিজ্ঞাসা তৈরি হলে পরে আমাকে বোলো। আমি বুঝিয়ে দেব।’ কিন্তু দীনেনদা সারাক্ষণের ব্যস্ত মানুষ। এক জায়গায় কাজ গুছিয়ে আরেকটি কাজে ব্যস্ত হয়ে পড়তেন। তাছাড়া, প্রথম ওই তিন-চার মাস আমার মনে কোনো প্রশ্নও তৈরি হয়নি। আমি কেবলই কাজ দেখে গিয়েছি অন্যের। কোনটা কী, সেটুকুই জেনেছি কেবল। ক্যামেরাকে বলা যায় ছুঁয়েও দেখিনি।

দীনেনদাই আমাকে ক্যামেরার কাছে নিয়ে এলেন। এতদিন স্থিরচিত্র তুলেছি। এবার চলমান চিত্র তৈরির সেই যন্ত্র, মিচেল ক্যামেরার সামনে এসে দাঁড়ালাম। ইউনিটে একজন কুলি ছিলেন, যিনি ক্যামেরা বয়ে নিয়ে যেতেন। ভদ্রলোক অতীব সদাশয়। তিনি প্রথম আমাকে শেখালেন কীভাবে ক্যামেরা ফিট করতে হয়। আর দীনেনদার কাছেই আমি প্রথম শিখেছি কীভাবে ফিল্ম লোড করতে হয়, ক্যামেরার লেন্সকে কীভাবে অ্যাডজাস্ট করতে হয়, এইসব। কিন্তু এর মানে এই নয় যে, তক্ষুনি আমি সিনেমাটোগ্রাফার হয়ে গেলাম। সে পথ অনেক দূর। পেরোতে ধৈর্য এবং নিয়তি, দুটোই লাগে।

টেকনিশিয়ান স্টুডিয়োটি লিজে চলত। জমি একজনের। স্টুডিয়োকে লিজে চালাতেন আরেকজন, তিনিই মালিক। মালিকের সঙ্গে ম্যানেজমেন্টের কী একটা কারণে যেন ঝামেলা লেগে গেল। ইলেকট্রিসিটি সাপ্লাই বন্ধ করে দেওয়া হলো। ফলে স্টুডিয়োর কাজও বন্ধ হয়ে গেল। আমি যদিও প্রত্যেকদিন সেখানে চলে যেতাম অন্য কর্মীদের মতো। বিশাল ওই অন্ধকার স্টুডিয়োর দিকে তাকালে নিজের অন্ধকার ভবিষ্যৎটিকে দেখতে পেয়ে ভয়ে প্রমাদ গুনতাম। ক্যামেরার কাজ কিছুই শিখিনি তখনো। ক্যামেরা সংরক্ষক বা কেয়ারটেকারের ভূমিকা পালন করে গেছি শুধু। এরকম কেয়ারটেকার তো ইন্ডাস্ট্রিতে কত লোকই আছেন। আমাকে কে কাজে নেবেন? নিয়তির কথা বলছিলাম না, শুনতে পেলাম, একটি ছবি শুটিংয়ের কাজ চলতে চলতেই টাকার অভাবে বছর দুই আগে বন্ধ হয়ে গিয়েছিল, সেটি আবার চালু হবে। যিনি পরিচালক, শুনলাম ওই প্রথম পর্বের শুটিং তিনি অত্যন্ত আর্থিক প্রতিকূলতার মধ্যে দিয়ে করেছেন। শুটিংয়ের খরচ জোগানের জন্য তাঁকে নাকি স্ত্রীর সমস্ত গহনাও বেচে দিতে হয়েছে। শেষে, পশ্চিমবঙ্গের তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী বিধান রায়ের আর্থিক আনুকূল্যে আবার চালু হতে চলেছে সেই ছবির শুটিং। ছবির নাম? পথের পাঁচালী।

সত্যজিৎ রায় আমাদের স্টুডিয়ো থেকে মিচেল ক্যামেরা ভাড়া নিয়ে শুটিং করতেন। প্রথম প্রথম দীনেন গুপ্ত সেই ক্যামেরার সঙ্গে যেতেন। দীনেনদার ডাকনাম ছিল ‘খোকাবাবু’। স্টুডিয়ো বন্ধ হয়ে যাওয়ার পর আমি তো বেকার। এদিকে কাজ দেখার, কাজ শেখার জন্য মনে ছিল অদম্য উৎসাহ। এতদিন ইনডোরেই শুটিং দেখেছি। তখনকার দিনে অবশ্য আউটডোরে শুটিং বেশি হতো না। শুনলাম পথের পাঁচালীর কাজ হচ্ছে আউটডোরেই। পয়সা পাওয়া-না পাওয়াকে গুলি মারো, কাজটা তো শেখা যাবে – ভেবে দীনেনদাকে বললাম, ‘খোকাবাবু, পথের পাঁচালীর আউটডোর শুটিং হচ্ছে, আপনি যদি রাজি থাকেন, সেখানে আমি যেতে পারি।’ আমি এমনিতে লাজুক প্রকৃতির এবং কথা কম বলা ছেলে হলেও আমার মধ্যে যে কাজ শেখার যথেষ্ট আগ্রহ রয়েছে এই ব্যাপারটা রামানন্দবাবু এবং দীনেনদা বুঝতে পেরেছিলেন। এজন্য আমি ওঁদের কাছে চিরকৃতজ্ঞ। দীনেনদা বললেন, ‘তুই যাবি? ঠিক আছে, আমি অনিলের সঙ্গে কথা বলে দেখছি।’ অনিল চৌধুরী ছিলেন সত্যজিৎ রায়ের টিমের প্রোডাকশন কন্ট্রোলার। অচিরে তাঁর সম্মতিও মিলল। পরের দিন থেকে ক্যামেরা সংরক্ষক হিসেবে দীনেনদার সঙ্গে আমিও যেতে থাকলাম পথের পাঁচালীর শুটিংয়ে।

দীনেনদা সম্পর্কে আরো একটা কথা বলা দরকার। তাঁকে এখন আমরা চিনি একজন বড় পরিচালক হিসেবে। কিন্তু দীনেনদা ছিলেন মূলত ক্যামেরাম্যান। অত্যন্ত দক্ষ, উঁচুদরের একজন ক্যামেরাম্যান। কিন্তু ওই যা হয়, পরে সিনেমা করার ডাক পেয়ে পরিচালনার নেশাতেই বুঁদ হয়ে রইলেন। অত বড় একজন সিনেমাটোগ্রাফারের কয়েকটি মাত্র ছবির ক্যামেরার কাজ দেখেই আমাদের সন্তুষ্ট থাকতে হলো। তিনি যে খারাপ সিনেমা বানিয়েছেন তা বলছি না, বরং বলছি – তাঁর স্বক্ষেত্র ছিল ক্যামেরাই। যাই হোক, পথের পাঁচালীর ওই শুটিং চলাকালীন দীনেনদা অন্য একটি সিনেমায় স্বাধীন ক্যামেরাম্যান হিসেবে কাজ করার ডাক পেলেন এবং চলেও গেলেন। স্বাভাবিকভাবেই, ক্যামেরা সংরক্ষকের দায়িত্বটা তখন আমার একার কাঁধেই এসে পড়ল। এভাবেই নিয়মিত শুটিংয়ে যেতে যেতে আমি সত্যজিৎ রায়ের টিমের সঙ্গে যুক্ত হয়ে গেলাম।

পথের পাঁচালীর টিমে কাজ করছি সত্য, কিন্তু তখন তো আমি একদম নতুন, ছাত্রই বলা ভালো, এবং কখনোই নিজেকে খুব ভালো ছাত্র হিসেবে দাবি করার স্পর্ধা আমার নেই, তাই ওই সিনেমা যে বিশ্ব চলচ্চিত্রের জন্য কী কী গহনা রেখে যাচ্ছে, কাজ করার সময় এবং শুটিং শেষ হয়ে যাওয়ার পরেও আমি বহুদিন বুঝিনি। মানিকদাকে দেখে গেছি, ওঁর উপস্থিতিই একরকম সম্ভ্রম জাগাত, সন্দেহ নেই। কিন্তু তিনি যে এত এত বড়মাপের পরিচালক, সেটাও অনুমান করার শিক্ষা ও বয়স কোনোটাই তখন আমার মধ্যে ছিল না, থাকার কথাও নয়। মানিকদা অবশ্য সেটের সকলের সঙ্গেই খুব স্বাভাবিকভাবেই মেলামেশা করতেন, যাকে যা বলার, তা বলতেন। সবার দিকেই তাঁর ছিল সমান নজর। তখনো সত্যজিৎ রায় আমার কাছে ‘মানিকদা’ হননি, তাঁকে আমি ‘সত্যজিৎবাবু’ বলেই ডাকতাম সেসময়। পরিচয়ের প্রথম দিকে একদিন তাঁকে জানালাম, ‘সত্যজিৎবাবু, আমি ক্যামেরার সঙ্গে এসেছি। ক্যামেরাটা লাগানো হয়ে গেছে। আর কী কী করতে হবে বলুন।’ উনি তখন স্ক্রিপ্টের শর্ট ডিভিশন করছিলেন, আমার দিকে তাকিয়ে আন্তরিকভাবে জানতে চাইলেন, ‘আপনি খেয়েছেন?’ জলখাবার খেয়ে নিয়েছি, জানাতে তিনি বললেন, ‘ঠিক আছে, আমি আসছি।’ এই প্রথম তাঁর সঙ্গে আমার বাক্যবিনিময়। এভাবেই ধীরে ধীরে কাজের সূত্রে আমার সঙ্গে মানিকদা, সুব্রতদা এবং বংশীদার ঘনিষ্ঠতা বেড়ে গেল। এই প্রথম পথের পাঁচালীতে ঢুকে আমি একটা বিরাট ওপেনিং পেলাম। কী সেটা – একটা বিরাট পরিবারের মতো আবহাওয়ায় থাকা, সেখানে কাজ করা। লক্ষ করলাম, সত্যজিৎবাবুকে সকলেই ‘মানিকদা’ বলে ডাকেন। আমার কাছেও তিনি কখন যে ‘মানিকদা’ হয়ে গেলেন, তা আর মনে নেই।

 

ছয়

পথের পাঁচালী নিয়ে সিনেমাপ্রেমী মানুষ, সমালোচকদের মধ্যে যে পরিমাণ আলোচনা, তর্ক-বিতর্ক হয়েছে, তা বাংলা কেন ভারতীয় আর কোনো সিনেমা নিয়েই হয়নি। বিদেশেও লক্ষ করেছি, ভারতের সিনেমা নিয়ে কথাবার্তা শুরু হলেই উঠে এসেছে পথের পাঁচালীর নাম। তাত্ত্বিক, আলোচকরা এর মধ্যে অনেক জটিলতা, রহস্যের খোঁজ করে গেছেন এতদিন। জানি, সেই অনুসন্ধান থামার সম্ভাবনাও যথেষ্ট কম। কিন্তু এসবে নয়, আমি অবাক হই যা ভেবে তা হলো, তিনজন মহান শিল্পী এই সিনেমাটির প্রাণকেন্দ্র এবং এই ত্রয়ী বলা ভালো পুরো সিনেমাটি করে গিয়েছেন একরকম না-জানা থেকে। হ্যাঁ, এটাই সত্যি, পথের পাঁচালী ছিল মানিকদার করা প্রথম ছবি। এর আগে তিনি কোনো সিনেমাই পরিচালনা করেননি। আর সুব্রত মিত্রর কথা কী বলব! তিনি আমার থেকে মাত্র বছর দুয়েকের বড়। পথের পাঁচালীতে সিনেমাটোগ্রাফার হিসেবে কাজ করার সময় তাঁর বয়স কত আর – বড়জোর চবিবশ কি পঁচিশ। আরো যেটা বিস্ময়, মানিকদার মতো সুব্রতদারও ওই সিনেমাই ছিল ছায়াছবির দুনিয়ায় প্রথম কাজ। এর আগে তিনি স্টিল ক্যামেরায় ছবি তুলেছেন সত্য কিন্তু মুভি ক্যামেরা, তাও আবার মিচেল ক্যামেরা, যাকে নিয়ে কাজ করতে গেলে যথেষ্ট প্রশিক্ষণ প্রয়োজন – সুব্রতদা সেসব কিছু না জেনেই ওরকম একটা ইতিহাস তৈরি করতে পারলেন! হয়তো একটু-আধটু পড়াশোনা করে থাকতে পারেন তিনি ওই ক্যামেরা, তার কার্যকারিতা সম্পর্কে। কিন্তু এটুকু প্রশিক্ষণ তো যাকে বলে একেবারেই প্রাথমিক স্তরের। কোনো পূর্ব অভিজ্ঞতা, কোনো উপযুক্ত প্রশিক্ষণ ছাড়াই স্রেফ প্রতিভা এবং কল্পনার সমন্বয়ে বলা যায় সুব্রতদা এক প্রকার ঝাঁপ দিয়েছিলেন ওই না-জানা জগতে।

বংশীদা অবশ্য তখন দু-একটা কাজ করে ফেলেছেন। সেদিক থেকে ভেবে দেখলে তিনি সত্যজিৎ রায় কিংবা সুব্রত মিত্রর তুলনায় সামান্য অভিজ্ঞ। কিন্তু পথের পাঁচালীর মতো সিনেমার সাপেক্ষি সেই অতীত অভিজ্ঞতা আর কতটুকু! না-জানার সমুদ্রে তাঁকেও ঝাঁপিয়ে পড়তে হয়েছিল বই কি! আমি মনেপ্রাণে বিশ্বাস করি, এই তিন বিরাট মাপের প্রতিভা একত্র হয়েছিলেন বলেই সম্ভব হয়েছিল পথের পাঁচালীর মতো একটা সিনেমার হয়ে ওঠা।

আর একটা কথা, মানিকদা, সুব্রতদা এবং বংশীদা – এঁদের তিনজনের অসম্ভব বোঝাপড়া ছিল। কে কার থেকে কী চাইছেন, কতটুকু চাইছেন – এটা কারোর অজানা ছিল না। আর যেটা ছিল, সকলকে একই চোখে দেখার মানসিকতা। পথের পাঁচালীর আগে অন্যান্য সিনেমার সেটে আমি লক্ষ করেছি, পরিচালক কিংবা সিনিয়র টেকনিশিয়ান কিংবা আর্টিস্টদের সঙ্গে জুনিয়র টেকনিশিয়ানদের একটা দূরত্ব থাকত। কে ছোট কে বড় এসবের বিচার থাকত। জুনিয়র টেকনিশিয়ানরা কাজ করত সম্ভ্রমের মধ্য দিয়ে। কিন্তু আগেই বলেছি, পথের পাঁচালীর সেটে উঁচু-নিচুর ব্যাপার ছিল না। সকলেই এখানে সমান। খোলামেলা পরিবেশ। একেবারে পরিবারের মতো। ফলে সকলের মধ্যেই কাজের ব্যাপারে আন্তরিকতা, ভালোবাসার কোনো অভাব ছিল না।

এতদিন আমরা কী জেনে এসেছিলাম – আউটডোরে রোদ ছাড়া ভালো শুটিং হয় না। কিন্তু পথের পাঁচালী হলো সেই অভিজ্ঞান, আমরা দেখলাম, আমরা জানতে পারলাম, মেঘলা দিনেও শুটিং করা যায়, বৃষ্টিতেও শুটিং হয়, এমনকি বিকেলের আলোতেও শুটিং সম্ভব। কীভাবে? যদি সবকিছু ঠিকঠাক থাকে – এই সবকিছু হলো ক্যামেরা, এক্সপোজার এরকম কয়েকটা টেকনিক্যাল ব্যাপারস্যাপার। কিন্তু আবার বলছি – টেকনিককে অস্বীকার না করেও, শিল্পের ক্ষেত্রে প্রতিভার আগে কোনো কিছুই নেই। এক্ষেত্রে আবার আমি বাধ্য হলাম সুব্রত মিত্রর কথায় ফিরে আসতে। সেসময় নিমাই ঘোষ (পড়ুন, ফটোগ্রাফার নন) নামে একজন ক্যামেরাম্যান ছিলেন। প্রথমদিকে ঠিক ছিল তিনিই ক্যামেরাটা দেখবেন। আর তাঁকে অ্যাসিস্ট করবেন সুব্রতদা। কিন্তু তিনি অন্য একটি কাজ পেয়ে চলে গেলেন মাদ্রাজে। মানিকদা যখন সুব্রতদাকে বললেন, ‘সুব্রত, তুমিই এবার ক্যামেরাটা দ্যাখো’ – শুনে আঁতকে ওঠা ছাড়া সুব্রতদার আর কী করার থাকতে পারে? ‘না-না, আমি পারব না’ – সুব্রতদার ওই কথাতেও টলে যাননি মানিকদা, তিনি সঠিক লোকটিকেই চিনেছিলেন। উলটে, ‘কেন পারবে না – তুমি তো ফটোগ্রাফি করেছ, তুমি অবশ্যই পারবে’ বলে, সুব্রতদাকে বিরাট মনের জোর দিয়েছিলেন মানিকদা। পথের পাঁচালীর আগে অবশ্য রেঁনোয়ার সেই বিখ্যাত রিভার ছবিতে অবজারভারের ভূমিকায় কাজ করেছিলেন সুব্রতদা। কী জানি, মানিকদার দেওয়া ওই মনের জোরের সঙ্গে রিভার ছবিতে কাজ করার অভিজ্ঞতাটাও হয়তো সুব্রতদাকে শক্তি জুগিয়েছিল।

আর আমার কী ভূমিকা ছিল পথের পাঁচালীতে! ট্রলি করতাম, ট্রলি পাততাম, রিফ্লেক্টর ঠিক করে দিতাম – এসবই। তবে সবচেয়ে বেশি যে-কাজটা করে গেছি তা হলো সবকিছু পর্যবেক্ষণ করা, দেখা। দেখেছি, সুব্রতদা কত রিস্ক নিয়ে একের পর এক দৃশ্য শুট করে গেছেন। তখন তো মনিটর ছিল না যে কোনো শট ওকে হওয়ার পর সেটা কেমন হলো দেখে নেওয়া যাবে। সবকিছুই অনুমানের ওপর দাঁড়িয়ে। তখন, সে মুহূর্তে সুব্রতদার ওই কাজ নিয়ে মনে মনে প্রচুর প্রশ্ন জাগত কিন্তু করার সাহস ও সুযোগ, কোনোটাই হয়নি। পরবর্তীকালে অবশ্য সবটুকুই জেনেছি তাঁর থেকে। বলা যায়, ক্যামেরার যতটুকু আমার শিক্ষা তা সবই সুব্রতদার কাছ থেকেই শিখেছি। আমি ভাগ্যবান যে তাঁর মতো একজন গুরুকে পেয়েছিলাম কাজ করতে আমার প্রায় প্রথম থেকেই।

শেখানোর ব্যাপারে সুব্রতদারও কোনো কৃপণতা ছিল না। খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে সব প্রশ্নেরই উত্তর দিতেন তিনি। কীভাবে এক্সপোজার ঠিক করতে হয়, কীভাবে শট নেওয়া উচিত, ক্যামেরা কীভাবে, কোন মুহূর্তে কতটা প্যান করা জরুরি কিংবা ট্রলিতে কাজ করার পদ্ধতি – এসবই পথের পাঁচালীর মুহূর্তে সুব্রতদার কাজ দেখে আমি শিখে নেওয়ার চেষ্টা করে যেতাম। টেকনিকের এরকম খুঁটিনাটি ব্যাপারগুলো ঠিকমতো জানার জন্য একটা ছোট্ট খাতায় সেসব লিখেও রাখতাম। খাতাটা যদিও আজ আর নেই, কোথায় হারিয়ে গিয়েছে!

 

সাত

লোকেশন বোড়াল। সেখানে পথের পাঁচালীর টিমের বেশ কয়েকজন টানা তিনদিন শুধু চাতকের মতো অপেক্ষায় রয়েছি, কখন বৃষ্টি নামবে। মানিকদা তখন সেখানে ছিলেন না। তখনো উনি চাকরি করতেন বলে শনি ও রবিবার ছাড়া স্পটে উপস্থিত থাকার সুযোগ পেতেন না। তবে ওঁর অ্যাসিস্ট্যান্ট শান্তি চ্যাটার্জি এবং সুব্রতদাকে বলে গিয়েছিলেন কী কী করতে হবে। সেই মতো আমরা, যারা টেকনিশিয়ান, রয়ে গেছিলাম ওই দুজনের সঙ্গে বোড়ালেই আর অপেক্ষা করছি বৃষ্টি নামার। প্রথমদিন কেটে গেল, বৃষ্টির দেখা নেই। দ্বিতীয়দিন কেটে গেল, তার পরেও আকাশ শূন্য। বোড়াল তখন যথেষ্ট অজ। হাতের সামনে পাওয়ার মতো কোনো কিছুই নেই। হঠাৎ অসময়ে খিদে পেলে একে তাকে বলে ওই মসলা মুড়িটুকুই যা মিলত হয়তো। কিন্তু আমরা সকলে অধীর আগ্রহে, উৎসাহে অপেক্ষা করছি কখন মুষলধারে বৃষ্টি পড়বে। এখনকার দিনে বৃষ্টির সিনগুলো ইনডোরেই শুট করা যায়। তখন প্রকৃতি ছাড়া কাউকে ভরসা করার উপায় নেই। কিন্তু প্রকৃতিকেই বা ভরসা করি কীভাবে? দুটো দিন স্রেফ বসে বসেই কেটে গেল। তিনদিনে পড়তেই আমাদের সকলের মনে আশার সঞ্চার – আকাশে জমাট কালো মেঘ, নির্ঘাত বৃষ্টি হবে, মুষলধারে। এবং হলোও। দুর্গা ভিজল। পুকুরপাড়ে। মাথার সমস্ত চুল সামনের দিকে এনে, নিচু হয়ে সেই চরকির মতো ওর ঘোরার দৃশ্যটা মনে পড়ছে? আর অদূরে দাঁড়িয়ে কাঁপছে অপু। সেই বৃষ্টিতে না ভিজলে দুর্গা জ্বরে ভুগত না। সেই বৃষ্টির অপেক্ষায়, আজ ভাবতে অবাক লাগে, কয়েকজন (বোধ হয়) পাগল লোক, পড়ে রয়েছি বোড়ালে। কিন্তু কারো মধ্যেই বিরক্তির লেশমাত্র নেই। পথের পাঁচালী যে ভবিষ্যতে একটা কাল্ট ফিল্ম হয়ে উঠবে এমন আশাও তখন আমরা কেউ করিনি। কিন্তু কাজের প্রতি ভালোবাসা, সর্বোপরি সৃষ্টির আনন্দ – এসবই ছিল সকলের অনুপ্রেরণা।

সৃষ্টির আনন্দ কীরকম তা উদাহরণ দিয়েই বলা যাক। ওই, জলে ভিজে দুর্গার জ্বর এলো। অসুস্থ দুর্গা জানালার ধারে বসে আছে আর জানালা দিয়ে ক্যামেরা দেখাচ্ছে যে চিনিবাশ কাকা হেঁটে হেঁটে চলে যাচ্ছে। তারপর ক্যামেরা প্যান করে দুর্গার মুখের ওপর পড়ে। ওই দৃশ্যে এক্সপোজারের নানারকম ভেরিয়েশন ছিল। বাইরের সঙ্গে ভিতরঘরের আলোর তফাত ঠিকমতো মিলিয়ে দেওয়ার প্রয়োজনে সুব্রতদা মানিকদাকে বলেছিলেন যদি ব্যাটারি অপারেটর লাইটের কোনো ব্যবস্থা করা যায়! মানিকদা দুটো পুলিশ সার্চলাইট জোগাড় করে আনলেন, সেটা দিয়েই সুব্রতদা আলোর ওই ব্যালান্স তৈরি করেছিলেন। এভাবেও যে ভাবতে পারা যায়, মানিকদা, সুব্রতদাদের না দেখলে কোনোদিন জানতেই পারতাম না।

শুটিং শেষ হওয়ার পর শুরু হলো এডিটিংয়ের কাজ। মানিকদার আরেক সারথি দুলাল দত্ত এই এডিটিংয়ের দায়িত্বে ছিলেন। আমি ল্যাবরেটরিতে রোজ যেতাম ছবির Rush দেখতে। এই যাওয়াটা আমার কাজের আওতায় পড়ত না। কিন্তু যেতাম, কাজ শেখার তাগিদেই যেতাম। মানিকদার নজর চারিদিকে। তিনি কোনোদিন আমাকে আসতে বারণ করেননি। মনে আছে, এই সময়ে হ্যারিসন বলে এক ভদ্রলোক এসেছিলেন। মানিকদা তাঁকে পথের পাঁচালীর রাফ কাট দেখিয়েছিলেন। হ্যারিসন তা দেখে অত্যন্ত আপস্নুত, মানিকদাকে জানিয়েছিলেন, ‘ছবিটা ঠিকমতো শেষ করুন, আমি মিউজিয়াম অফ মডার্ন আর্ট গ্যালারিতে সেটা দেখানোর ব্যবস্থা করে দেব।’ ছবিটি সম্পূর্ণ করার একটা ডেডলাইনও ছিল। প্রায় চোদ্দোটি দিন-রাত্রি অক্লান্ত পরিশ্রম করে দুলাল দত্ত কাজটি শেষের পথে নিয়ে এলেন। যথাসময়ে মিউজিয়াম অফ মডার্ন আর্ট গ্যালারিতে দেখানো হলো পথের পাঁচালী। শুনলাম সকলেই যথেষ্ট প্রশংসা করেছেন। কিন্তু সেখানে তো আমাদের যাওয়ার কোনো উপায় নেই। অপেক্ষায় থাকলাম পথের পাঁচালী কলকাতার হলগুলোয় কবে মুক্তি পাবে।

১৯৫৫ সালের ২৬ আগস্ট। রাসবিহারীর বসুশ্রী হলে রিলিজ হলো পথের পাঁচালী। এই দিনটি আমার জীবনে একটি অবিস্মরণীয় দিন। জীবনে এই প্রথম একটি ছবির সঙ্গে এভাবে জড়িয়ে পড়ার সুযোগ, তার ওপর কাজ করতে করতে মনেও হচ্ছিল, বোধ হয় আর পাঁচটা ছবির থেকে পথের পাঁচালী একটু অন্যরকমের ছবি। ফলে আবেগ একটা ছিলই। সকাল সাড়ে দশটা নাগাদ বসুশ্রীর টিকিট কাউন্টারে গিয়ে দেখি সেখানে আমি ছাড়া আর কেউই আসেননি। এটাই স্বাভাবিক, শো শুরু হতে এখনো অনেক সময় বাকি। যদিও টিকিট কাউন্টারের লোকটির থেকে একটাও টিকিট বিক্রি হয়নি জেনে একটু খটকা লাগল। যাই হোক, তিনটে থেকে শো শুরু হবে। যথাসময়ে আবার পৌঁছলাম। মানিকদা আসেননি। ছবির টেকনিশিয়ানরা বসে পড়েছেন। ছবি শুরু হলো। নিচের তলায় কোনো দর্শকই নেই। প্রায় খালি বলা যায়। ওপরে কয়েকজন মাত্র উপস্থিত। জীবনে এই প্রথম নিজের পছন্দের একটি কাজের সঙ্গে যুক্ত থেকে যখন দেখলাম ছবিটি দেখার কোনো দর্শকই নেই, মনে মনে কিছুটা হলেও মুষড়ে ছিলাম। ছবিটি শেষ হতে ওই মুষ্টিমেয় দর্শকের অভিব্যক্তিতে দেখলাম কোনো প্রতিক্রিয়াই নেই। যে যার মতো চুপচাপ, কথা না বলে হল থেকে বেরিয়ে আসছেন।

পরের শো শুরু হলো ছটায়। মানিকদা এলেন। হলে আগের শোয়ের থেকে অপেক্ষাকৃত বেশি ভিড়। শো শেষ হলে দেখলাম অনেকেই চোখ মুছতে মুছতে হল থেকে বেরোচ্ছেন। মানিকদার সঙ্গে যাঁরা আলাপিত বা পরিচিত, তাঁদের দেখলাম ছবিটি ভালো হয়েছে জানিয়ে মানিকদাকে অভিনন্দন করতে। আর তার পর? বাকি সবটুকুই একটা ইতিহাস। পথের পাঁচালী ভারতীয় চলচ্চিত্রে এক নবজাগরণ। রেস্তোরাঁ, কফি হাউসে, সবখানেই তখন একটাই আলোচনা – সত্যজিৎবাবুর ছবি পথের পাঁচালী। কলেজ স্ট্রিট থেকে পরিচালক তরুণ মজুমদারের (তখন তিনি ছাত্র) নেতৃত্বে একটি মিছিল বেরোল, যার স্লোগান ছিল পথের পাঁচালী দেখুন। কানে কানে ছবিটির প্রচার হয়ে গেল দ্রম্নত।

পথের পাঁচালী বসুশ্রীতে চলেছিল চার সপ্তাহ। কিন্তু দর্শকের আবদারে আজ তাকে রিলিজ করা হলো ইন্দিরায়। ইন্দিরায় পথের পাঁচালী চলেছিল টানা চোদ্দো সপ্তাহ। তখনকার দিনে এতগুলো সপ্তাহ ধরে কোনো সিনেমা রাজত্ব করছে, ব্যাপারটা সহজ কথা ছিল না। স্বাভাবিকভাবে আমরা যারা যুক্ত ছিলাম এই ছবির সঙ্গে, আনন্দের অংশীদার হলাম। আমার পরিবারেও দেখলাম সকলেই বলাবলি করছেন – সিনেমা তাহলে এরকমও হয়! আমারও গর্ব হলো খুব; সামান্য হলেও যুক্ত ছিলাম তো পথের পাঁচালীর সঙ্গে।

 

আট

সুব্রত মিত্রর কথা লিখেছি। এবার আরেকজনের কথা বলতেই হবে। আমার আরেক শিক্ষাগুরু – বংশী চন্দ্রগুপ্ত – বংশীদা। বংশীদাকে কাছে পেয়ে কত কিছু যে শিখেছি। হাতে ধরে বুঝিয়ে দিয়েছেন সবকিছু। ওঁকে দেখে মনের ভেতর কখনোই ভয় তৈরি হতো না। উনি ছিলেন এতটাই খোলামেলা মানুষ। আরেকটা সুবিধা আমার হয়েছিল, আমার বাড়ি ছিল লেক প্লেসে। আর বংশীদা থাকতেন আমার বাড়ির খুব কাছে, সদানন্দ রোডে।

অনেকেই বংশী চন্দ্রগুপ্তকে ভাবতেন বাঙালি। তাঁর ওই ‘গুপ্ত’ পদবিটির কারণে। বংশীদা ছিলেন পাঞ্জাবি। পদবিটিও গুপ্ত নয়, ‘গুপ্তা’। তিনি বড় হয়েছিলেন কাশ্মীরে। কলকাতায় তাঁকে নিয়ে আসার ক্ষেত্রে সুবো ঠাকুরের বড় ভূমিকা ছিল। বংশীদা কলকাতায় ছবি আঁকা শিখতেন। এমনকি একসময় কিছু বড়লোক বাড়ির ছেলেমেয়েদের আঁকাও শেখাতেন। সদানন্দ রোডের যে বাড়িতে উনি থাকতেন, তার একটি ঘরে ছিলেন নৃত্যশিল্পী অনাদিপ্রসাদ। দুজনে একসঙ্গেই খাওয়া-দাওয়া করতেন, সাদার্ন মার্কেটের ‘বিহার’ হোটেলে। কিন্তু দীর্ঘদিন ধরে বাইরের খাবার খেলে যা হয়,
তেল-মসলার ঝাঁজ সহ্য করতে না পেরে বংশীদার শরীর খারাপ হয়ে গেল। বাইরের খাবার খাওয়া তখন সম্পূর্ণ বন্ধ।

ততদিনে কাজের সূত্রে বংশীদার সঙ্গে আমার আলাপ ঘনিষ্ঠতায় পরিণত হয়েছে। মাঝে মাঝেই চলে যেতাম ওঁর বাড়ি। উনি তো অকৃতদার, পরিবারও থাকে বাইরে, ওই বাড়িতে বসে একা একাই কাজ করে যেতেন। কখনো স্কেচ করতেন, কখনো বা পস্ন্যানিং। আর আমি বসে বসে একমনে সেই কাজ দেখে যেতাম। প্রচুর প্রশ্ন জমা হতো ভেতরে, বংশীদাকে নিঃসংকোচে জিজ্ঞেস করতাম। বংশীদা খুঁটিনাটি ব্যাপারগুলো খুব সহজ করে বুঝিয়ে দিতেন। ওঁর শরীর খারাপ নিয়ে স্বাভাবিক কারণেই আমি খুব চিন্তায় পড়ে গেলাম। মাকে বললাম সেই কথা। মা তখন বংশীদার খাবারও তৈরি করে দিতেন রোজ। সেই থেকে মা দুবেলা নিয়মিত খাবার পাঠাতেন। কখনো সকালের দিকে বংশীদা কাজের কারণে বাইরে থাকলে খাবারটা হয়তো গেল না, কিন্তু রাতে অবশ্যই যেত।

আর কোনো আর্ট ডিরেক্টরকে আমি দেখিনি, যিনি ক্যামেরাটাকে বংশীদার থেকে ভালো বুঝেছেন। এই গুণ ওঁর কাজেও খুব সাহায্য করেছিল। ক্যামেরাম্যানের সুবিধে-অসুবিধে বংশীদা খুব ভালো বুঝতেন। একটা সেট আমি করে দিলাম কিন্তু তাতে শুটিং করতে গিয়ে ক্যামেরাম্যান সমস্যায় পড়ছেন, এরকম কাজ বংশীদা করতেন না। যখন সেট তৈরি হতো, উনি আমাকে ডেকে বলতেন, ‘দ্যাখো, এইভাবে এইভাবে করছি, তোমার কোনো সমস্যা নেই তো, তোমার যদি কিছু জিজ্ঞাস্য থাকে তো বলো -’ আমি বসে বসে ওঁর সেট করা দেখতাম। গুপি গায়েন বাঘা বায়েনের সেই সেটের কথা আমার আজো মনে পড়ে। এত বড় ক্যানভাসে এর আগে আমি কোনোদিন কাজই করিনি। কিন্তু বংশীদাকে দেখলাম সাবলীল। কী চাইছেন মানিকদা, বুঝে নিয়ে এমন সেট উনি তৈরি করলেন যা দেখে বিস্মিত হওয়া ছাড়া আমার আর কোনো উপায় রইল না।

ফিল্ম সোসাইটি মুভমেন্টের সময় থেকেই মানিকদার সঙ্গে বংশীদার সম্পর্ক। দুজনের সেই সম্পর্ক ছিল খুবই মধুর। বংশীদাকে আমরা বাঙালি করে নিয়েছি বটে, তবে বাংলাটা উনি একটু অন্যভাবে বলতেন। যেমন, একদিন মানিকদাকে জিজ্ঞেস করলেন, ‘মানিক, কুলাঙ্গিটাতে কী রাখব বলো তো?’ শুনে মানিকদা খুব মজা পেলেন, বললেন, ‘বংশী, তুমি বাংলাটা আর শিখলে না। ওটাকে কুলাঙ্গি নয়, কুলুঙ্গি বলে।’ একমাত্র বংশীদাকেই দেখেছি মানিকদার সামনে সিগারেট ধরাতে। একটা মজার ঘটনাও মনে পড়ে যাচ্ছে এই সূত্রে।

১৯৭১ সাল। আমরা সবাই সিকিমে। তখন মানিকদা সিকিম নিয়ে তথ্যচিত্রটি প্রস্ত্তত করছেন। বংশীদা শুধু ধূমপানই করতেন না, সুরাপানেও তাঁর আসক্তি ছিল। কিন্তু মানিকদার সে অভ্যেস ছিল না। আমরা সকলে উঠেছিলাম ওখানকার ‘গ্রিন হোটেলে’। আর মানিকদা ছিলেন স্টেট গেস্ট হিসেবে রাজার বাড়িতে। সেখানে এলাহি ব্যাপার। বংশীদা করতেন কী – ওই রাজবাড়িতে চলে যেতেন। গিয়ে মানিকদার ঘরে সাজিয়ে রাখা দামি দামি বিদেশি স্কচ, হুইস্কির বোতল নিয়ে হোটেলে চলে আসতেন।

কিন্তু কাজের সময় বংশীদা একদম আলাদা মানুষ। মাঝে, বংশীদা চলে গেলেন মুম্বই। সেখানে তাঁর নিজের একটা ফ্ল্যাটও ছিল। যদিও সদানন্দ রোডের বাড়িটি উনি কখনোই ছাড়েননি। প্রচুর হিন্দি ছবিতে উনি কাজ করেছিলেন সেই সময়। তবে মূলধারার ছবি নয়, ওর বরাবরই আগ্রহ ছিল অন্য ধরনের ছবি করার দিকে। অরুণ কউল, বাসু ভট্টাচার্য এবং বাসু চ্যাটার্জির মতো পরিচালকদের সঙ্গে উনি একাধিক কাজ করেছেন।

মানিকদা বছরে ওই একটা ছবিই করতেন। তাতে রোজগারের ক্ষেত্রে সমস্যা দেখা দিচ্ছিল। আমাদের তবু বাবা-দাদারা ছিলেন। কিন্তু বংশীদা তো একা মানুষ। মুম্বই না গিয়ে তাঁর উপায় কী? যদিও মানিকদা যখনই ডেকেছেন, উনি এসে তাঁর সঙ্গে কাজ করে গেছেন। যেমন, সতরঞ্চ কি খিলাড়ির সময়ের কথাই বলা যায়। কী অসাধারণ সেট! সেই প্লাস্টারের কাজ আজো মনে পড়ে। মুম্বই থেকে লোক আনালেন বংশীদা। টানা দুমাসে তাঁর সেট তৈরি হলো। সেই ঘর, আমজাদ খানের দরবার হল আজো চোখের সামনে ভাসে। মানিকদা উর্দু খুব ভালো জানতেন না। কিন্তু সতরঞ্চ কি খিলাড়ির ক্ষেত্রে উর্দু ভাষাটা না জানা থাকলে চলবে না, বুঝতে পেরেছিলেন। সেক্ষেত্রে বংশীদা তাঁকে খুবই সাহায্য করেছিলেন। উর্দু অনুবাদের জন্য শয়ের জাভেদ সিদ্দিকি এবং এম এস সত্তুর স্ত্রীর সঙ্গে মানিকদার যোগাযোগ করিয়ে দিয়েছিলেন বংশীদা। মুম্বইয়ে কোনো কাজে বা অকাজে গেলে আমি বংশীদার ফ্ল্যাটেই থাকতাম। থাকা, খাওয়া-দাওয়া, আড্ডার কোনো অভাব হতো না।

দীর্ঘদিন ধরেই বংশীদা ডায়াবেটিসে ভুগছিলেন। সেটাই তাঁর মৃত্যুর কারণ হয়ে দাঁড়াল। যতদূর মনে পড়ছে, আশি ছোঁয়ার আগেই তিনি আমাদের ছেড়ে চলে গেলেন। বংশীদার মৃত্যু হয়েছিল আমেরিকায়। সেসময় সত্যজিৎ রায়ও ছিলেন সেই দেশে। বিদেশে যাওয়ার আগে কিছুদিনের জন্য সদানন্দ রোডের বাড়িতে এসেছিলেন বংশীদা। তখনই আমার সঙ্গে তাঁর শেষ দেখা। বংশীদার চলে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে আমিও হারালাম আমার এক প্রিয় অভিভাবককে।

অনুলেখক : সৌরভ দে ও দেবজ্যোতি মুখোপাধ্যায়

Leave a Reply