সৌ মি ত্র ব সু
১৯২৬ খ্রিষ্টাব্দে জন্ম, সেই সূত্রে এই দুহাজার ষোলোয় নব্বই বছর বয়েস হলো কুমার রায়ের। শম্ভু মিত্র তৃপ্তি মিত্রের পর বহুরূপীর হাল ধরেছিলেন এই মানুষটি। নির্দেশনার কাজ করেছেন, অতুলনীয় সব অভিনয় করেছেন, সংগঠন চালিয়েছেন, আভিজাত্যময় বহুরূপী পত্রিকা চালিয়েছেন দীর্ঘদিন ধরে। ছিলেন নাট্য অকাদেমি এবং মিনার্ভা রেপার্টরি থিয়েটারের সভাপতি, নাটকের মানুষজন তাঁকে দেখতেন খানিকটা অভিভাবকের মতো। বহুরূপীর সঙ্গে আমার প্রথম যোগাযোগ যাঁদের মাঝখানে রেখে, তাঁদের মধ্যে অন্যতম হলেন কুমার রায়, যদিও তাঁকে আমি অন্য লোক বলে ভুল করেছিলাম। ঘটনাটা বলি। তখন ক্লাস এইটে পড়ি। রেডিওতে নাটক শুনে শম্ভু মিত্রের ভক্ত হয়ে গেছি, কাগজে বিজ্ঞাপন দেখলাম, অ্যাকাডেমি মঞ্চে বহুরূপীর বাকি ইতিহাস হবে, নির্দেশক শম্ভু মিত্র। ঠাকুমার কাছ থেকে এক টাকা ম্যানেজ করে চলে গেলাম, নাটক দেখলাম এই নিশ্চিন্ততা নিয়ে যে, প্রধান চরিত্রে অভিনয় করছেন শম্ভু মিত্র। পরে সে ভুল ভেঙেছিল, যখন বেশ পাঁড় নাটক দেখিয়ে হয়ে উঠেছি। বহুরূপীতে শম্ভু মিত্রের কোনো নতুন প্রযোজনায় কাজ করার সুযোগ আমি পাইনি, তৃপ্তি মিত্রের বেলায় অল্প পেয়েছি, কিন্তু পরিণত বয়েসের কুমার রায়ের গৌরবোজ্জ্বল নির্দেশনা পর্বে আমি অনেকটাই থাকতে পেরেছি তাঁর সঙ্গে, এ কথা বেশ অহংকারের সঙ্গে বলতে পারি।
কিন্তু উলটোদিকে কয়েকটা কথা বলবার আছে। তাঁর নির্দেশিত সব ক’টি নাটকে আমি অভিনয় করিনি, অভিনেতা হিসেবে যেসব অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে নির্দেশককে চিনতে পারা যায়, অনেক নাটকেই তার সুযোগ হয়ে ওঠেনি। সেসব নাটক দেখেছি বাইরে থেকে, দর্শক হিসেবে। যেহেতু সমালোচক হিসেবে দেখা হয়নি, তাই প্রযোজনার খুঁটিনাটি মাথায় রাখিনি এতদিন ধরে। এ কথাও স্বীকার করি, বেশ কিছু প্রযোজনা নিয়ে আপত্তি ছিল আমার, ছিল সমালোচনা, সে কাজগুলোর বিষয়ে ভাবিওনি তেমন করে। কুমার রায় মানুষটিকে নিয়ে সমস্যা হলো, তাঁর যাবতীয় ভাবনার কেন্দ্রেই ছিল বহুরূপী, দলের যা হবে হোক বলে স্বার্থপরের মতো নিজেকে সরিয়ে নেবার কথা ভাবেননি কখনো, বহুরূপীকে বাঁচিয়ে রাখবার দায় নিয়ে তাঁকে পরের পর প্রযোজনা করে যেতে হয়েছে, সেসব কাজে ক্লান্তি বা নিরুপায়তার ছাপও পড়েছে শেষের দিকে। একথা তখনো মনে হতো, আজো মনে হয়, তরুণদের হাতে দলকে আর একটু ছাড়তে পারলে হয়তো ভালো হতো Ñ তাঁর পক্ষে এবং বহুরূপীর পক্ষে, কিন্তু সে ভরসা তিনি করে উঠতে পারেননি।
যাক, ভালোমন্দ নিয়ে কথা বলার দায় আমার নয়, আমি শুধু তাঁর সঙ্গে থাকার অভিজ্ঞতা নিয়ে দু-চার কথা বলতে বসেছি। যেহেতু স্মৃতিনির্ভর, তাই একটু এলোমেলো হয়ে পড়তে পারে এই লেখা। স্বভাবতই প্রথমদিকের কাজ সম্পর্কে বেশি কথা জমে আছে মনের মধ্যে Ñ বহুরূপীর ভয়ানক সংকটের মধ্যে যেভাবে হাল ধরে তাকে তুফান পার করে দিয়েছিলেন কুমার রায়, তার বিস্ময় এতদিন পরেও ভুলে যাওয়া শক্ত।
যে-কথা কখনো বলা হয়নি তাই দিয়েই শুরু করি। পাঠক কি একটু চমকে যাবেন, যদি বলি, কুমার রায়ের নির্দেশনায় আমার প্রথম অভিনয় রবীন্দ্রনাথের চার অধ্যায় নাটকে? চার অধ্যায় শম্ভু মিত্রের বিখ্যাত প্রযোজনা, বহুরূপীর প্রথম রবীন্দ্রনাটক। সাতের দশকের মাঝামাঝি পর্বে, আকাশবাণী থেকে বহুরূপীকে আহ্বান করা হয় চার অধ্যায় রেকর্ড করার জন্যে। মঞ্চে সূত্রধারের চরিত্রে অভিনয় করতেন কুমার রায়, রেডিওতে অভিনয়ের জন্যে কিন্তু শম্ভু মিত্র তৈরি হতে বললেন কন্যা শাঁওলীকে। খুবই আহত হয়েছিলেন কুমার রায়, অসম্মানিত বললেই ঠিক ঠিক বলা হয়। এর পরেই, অন্ধ্রের ঝড়ে দুর্গত মানুষদের সাহায্য করবার জন্যে একটি নাট্যোৎসব হয়, তাতে বহুরূপী প্রযোজনা করবে চার অধ্যায়। সে প্রযোজনায় কুমার রায় সূত্রধারের চরিত্রে অভিনয় করতে অস্বীকার করলেন, অভিনয় করতে বলা হলো আমাকে। ‘এই পার্টটা আমি করতে পারি না প্রমাণ হয়ে গেছে, তবু শম্ভুদা বলে দিয়েছেন বলে আমি তোমাকে দেখিয়ে দিচ্ছি Ñ’ একথা বলে আমাকে অভিনয় বুঝিয়ে দিয়েছিলেন কুমার রায়, তাঁর সেই আহত কণ্ঠস্বর এখনো আমার কানে বাজে। বলা যেতে পারে, সেই আমার তাঁর তত্ত্বাবধানে প্রথম অভিনয়।
এই ঘটনাটা দিয়ে শুরু করা ভুল হলো কি না জানি না। পাঠক যদি ভেবে বসেন কুমার রায় তীব্র প্রতিবাদী মানুষ ছিলেন, তাহলে একেবারেই ভুল ভাবা হবে। সত্যি বলতে কী, প্রকাশ্যে গুরু শম্ভু মিত্রের বিরুদ্ধে ওই একবারই ক্ষোভ প্রকাশ করতে দেখেছিলাম তাঁকে, আর কখনো নয়। মনে পড়ে, কোনো কোনো ঘটনার সূত্রে কম বয়সের উত্তেজনায় কখনো তাঁর কাছে গিয়ে বলেছি, এটা কেন হলো, এমনটা কী করে মেনে নিয়েছেন আপনারা, কুমার রায় শান্ত স্থৈর্যে সিগারেটে টান দিয়ে বলেছেন, এটাই আমাদের সবাইকার ঠিক পথ বলে মনে হয়েছিল। তিনি সেসব কথা নিয়ে কখনো সরব হননি, আমিও হব না, আশা করি মানুষটিকে যাঁরা সম্মান করতেন শত প্ররোচনাতেও তাঁরা কেউ যাবেন না কাদা ঘাঁটতে। যাক গে। একটা ঘটনার কথা মনে পড়ছে, আমার, স্মৃতির ঘরে হিরে দিয়ে বাঁধিয়ে রাখা সেই ঘটনা। দত্তাপহারক ঈশ্বর আমাকে দুর্মর স্মৃতিশক্তি দিয়েছিলেন, তার সুবাদে যে-কোনো নাটকের যে-কোনো চরিত্রই প্রায় পলকে আমার মুখস্থ হয়ে যেত কম বয়সে। যদি আর একবার নাটকের সব ক’টি চরিত্র ঠিক তেমনি করে মুখস্থ ছিল। ’৭৬ কি ’৭৭ সালে, শান্তি দাসের অপারগতার কারণে যদি আর একবার নাটকের রতিকান্ত আমাকে করতে হয়, যতদূর মনে পড়ছে এক সন্ধের মহলায়। একটু দেরি করে মহলায় আসা তৃপ্তি মিত্রকে আমার পক্ষে অনর্গল বুঝিয়ে চলেছেন কুমার রায়, তৃপ্তি মিত্র কিছুতেই মানবেন না, আমার মতো বাচ্চা ছেলেকে দিয়ে গীতা চক্রবর্তী বা শাঁওলী মিত্রদের সঙ্গে প্রেমের অভিনয় করানো অসম্ভব বলে মনে হচ্ছে তাঁর। কুমার রায়ের সেই ব্যাকুল সওয়াল স্পষ্ট মনে পড়ে। সেই অভিনয়ের পরেই তৃপ্তি মিত্র আমাকে তুই সম্বোধন শুরু করলেন, বড়দের নজরে পড়লাম বলা যায়।
১৯৭৯ সালে প্রযোজিত হলো মৃচ্ছকটিক। একথা ভাবলে বিস্ময়ই লাগে যে, মৃচ্ছকটিক করবার আগে প্রায় ঠিক করে ফেলা হয়েছিল বহুরূপী বন্ধ করে দেওয়া হবে, অন্তত সেই কথা বলেই এ নাটক পড়া শুরু করেছিলেন তিনি। আমরা বহুরূপী বন্ধই করে দেব, কিন্তু তার আগে একটা শেষ চেষ্টা করে দেখা যাক। আর শেষ চেষ্টাটা সবসময় বড় কাজ দিয়ে করাই ভালো Ñ তাঁর কণ্ঠস্বর এখনো স্পষ্ট হয়ে কানে বাজে। মৃচ্ছকটিক যে অপরিমেয় জনপ্রিয়তা পেয়েছিল তার একটি বড় কারণ নিশ্চয় এই যে, এ নাটকের ঘরানা বহুরূপীর পূর্ববর্তীদের থেকে একেবারে আলাদা। এখানে নাট্যশাস্ত্র, ভারতীয় থিয়েটারের ইতিহাস বিষয়ে পুঁথিগত জ্ঞানের সঙ্গে আধুনিক মনন আর বুদ্ধির যে মিশেল ঘটতে পেরেছিল, তা বাংলা থিয়েটারে বিস্ফোরণের মতো ফেটে পড়ল।
নিজেকে খুব সৌভাগ্যবান মনে হয়, একটা গোটা গরমের ছুটি এই মৃচ্ছকটিক নিয়ে আমি আর রমাপ্রসাদ বণিক কাটিয়েছি কুমার রায়ের রাইফেল রেঞ্জের ছোট্ট বসবার ঘরে, নাটকের সম্পাদনার কাজ করার জন্য। কেমন করে বাদ দিতে হয় লিখিত পাঠকে, লেখায় যার নাগাল পাওয়া যায় না, থিয়েটারের নিজস্ব ভাষায় কেমন করে আয়ত্ত করতে হয় তাকে, তার একটি অনুপুঙ্খময় কর্মশালা ছিল সেটি। এমন নয় যে, কুমার রায় নিজেই যা করবার করছেন আমরা শুধু দর্শক হয়ে বসে আছি আর হুকুম তামিল করছি। প্রশ্ন করছেন আমাদের, মতামত জানতে চাইছেন, আর ফাঁকে ফাঁকে জানাচ্ছেন সংস্কৃত নাটকের প্রযোজনা বা অভিনয়রীতি নিয়ে বিবিধ তথ্য। সেসব বিদ্যে এখনো অধ্যাপনা করতে গিয়ে কাজে লাগে। ওই সময় নান্দীকার তৈরি করছিল মুদ্রারাক্ষস, তাদের কারুর কোনো একটা লেখায় ছিল জাদুঘরে গিয়ে প্রচুর মূর্তি স্কেচ করে আনার কথা। প্রবল উৎসাহে কুমার রায়কে বললাম, আমরাও ওরকম স্কেচ করে আনতে পারি না? কুমার রায় এক ফুঁয়ে উড়িয়ে দিলেন সে উৎসাহ, বললেন, মিউজিয়ামে গিয়ে কী হবে, মিউজিয়াম তো আমার ঘরে। বলে দেখালেন মোটা মোটা সব অ্যালবাম। কথাটা খুব মিথ্যে ছিল না। মঞ্চটা যেভাবে সাজিয়েছিলেন তিনি, মত্তবারণীর ধারণাকে যেভাবে আধুনিক একটা অবয়ব দিয়েছিলেন, পোশাকে যেভাবে এনেছিলেন প্রাচীন অভিজাত শালীনতার প্রকার, তার যোগফল তো এই দাঁড়ায়, মিউজিয়াম তাঁর ঘরের মধ্যেই।
কেমন হবে এ নাটকের অভিনয়রীতি? ধ্রুপদী অভিনয়রীতির প্রথম পাঠ আমার কুমার রায়ের কাছেই। নিজেকে কোনো চরিত্রের মধ্যে আশিরনখর ডুবিয়ে না দিয়ে তাকে ভেতরে নিয়ে যাওয়া আর বাইরে থেকে দেখার খেলা প্রথম খেলবার সুযোগ মিলেছিল মৃচ্ছকটিক নাটকেই, ফলে ব্রেখটের গালিলেও করতে তেমন কোনো নতুন চমকের মুখে পড়তে হয়নি। তাঁকে সাহায্য করেছিল অবশ্য বহুরূপীর বেশ কিছু কম বয়সী ছেলেমেয়ের দাঁতচাপা জেদ, বহুরূপীকে বার করে আনতেই হবে অনিবার্য পতন থেকে, সর্বস্ব দিয়ে লড়ে যেতে হবে তার জন্যে।
এই জেদটা আমাদের মনে সঞ্চারিত করে দিতে পেরেছিলেন কুমার রায়, একথা বিশেষ করে বলবার।
মৃচ্ছকটিক বা গালিলেওর তুলনায় রাজদর্শন অন্য জাতের নাটক। দিল্লি বা মুম্বাইয়ে অভিনয় করতে যাওয়ার সময় কোনো একটা পত্রিকার পুজো সংখ্যায় আমরা সবাই কাড়াকাড়ি করে পড়েছিলাম রাজদর্শন, পুজোর পরেই এ নাটকের কাজ শুরু হবে, একথাটা তখন চাউর হয়ে গিয়েছিল আমাদের মধ্যে। পড়ে বেশ হতাশ লেগেছিল, এই নাটক করবে বহুরূপী? এটা ঠিক, পুজো সংখ্যায় একটু তাড়াহুড়ো করেই হয়তো দেওয়া হয়েছিল নাটকটা, আলগা ছিল জোড়গুলো, সবটা মিলিয়ে অভিঘাত তৈরি হয়ে ওঠেনি। বহুরূপীর মঞ্চে রাজদর্শনের যে রূপ দেখা গেছে, আমার ধারণা তার অনেকটাই কুমার রায়ের পরামর্শমতো তৈরি। কমেডি কী করে তৈরি করতে হয়, মূল মজাদার সুরকে এতটুকু টাল না খাইয়ে কেমন করে তার মধ্যে চোরাগোপ্তা মিশিয়ে দিতে হয় সিরিয়াস সব কথা, তা প্রায় শেখা যায় রাজদর্শন দেখে। মঞ্চে, পোশাকে, আলোয়, অভিনয়ে ঝলমল করত এ-নাটক। এই সূত্রে একটা অভিযোগের কথা বলি। আমার বিবেচনায়, কুমার রায়ের মূল ক্ষেত্র ছিল কমেডি Ñ অভিনয়ে এবং প্রযোজনায়। মানুষটি বাইরের থেকে যতই গম্ভীর এবং পরিশীলিত হোন না কেন, ভেতরে ভেতরে একটা মাটো রসিকতার ধরন ছিল তাঁর, সেটা বেরিয়েও আসত নানা পথে। মাটো কথাটা এসেছে মাটি থেকে, ভুলেও কেউ ভাববেন না তার স্বভাবে কোনো গ্রাম্যতা ছির। কিন্তু একধরনের গ্রামীণ সরলতা ছিল স্বভাবের মধ্যে, অন্তত রাজদর্শনের প্রযোজনায় সেই সরলতাকে তিনি সঞ্চারিত করে দিতে পেরেছিলেন। দুঃখ হয়, এই ধরনে খুব বেশি গেলেন না তিনি, রাজদর্শনের পর একেবারেই অন্যরকম নাটক মিস্টার কাকাতুয়া, কিংবা কিনু কাহারের থেটার বাদ দিলে কমেডির দিকে মন দিলেন না। তার বদলে যে নাটকগুলো করলেন, তারা নাটক হিসেবেও যে সবসময় খুব ভালো এমন নয়, আর যে অভিনয়-পদ্ধতি অনুসরণ করা হচ্ছিল, তাও ধীরে ধীরে পুরনো হয়ে যাচ্ছে তখন।
আজকে বেশ আফসোসই হয় একথা ভেবে যে, মিস্টার কাকাতুয়া নাটকে অভিনয়ের সুযোগ ছেড়ে দিয়েছিলাম আমি, মাত্রই একটা-দুটো অভিনয়ের পর জোর করে সরে এসেছিলাম। নাটকটা পছন্দ হয়নি, মনে হয়েছিল, এ-নাটক ব্যক্তির পালিয়ে যাওয়ার কথা বলে। গালিলেওতে যে কথাগুলো বলা হয়েছিল, মানুষের যে-কোনো উদ্ভাবনকে যদি বহু মানুষের মধ্যে ছড়িয়ে না দেওয়া হয় তাহলে তা শাসকদলের অস্ত্রে পরিণত হবে, তার ঠিক বিপরীত প্রান্তে এ নাটকের অভিমুখ। তখন বয়েস কম, নাটকের বক্তব্য বিষয়ে অনেক রকম ছেলেমানুষি একগুঁয়েপনা তো ছিলই। আজকে নিশ্চয় এ নাটক নিয়ে অনেকগুলো ইতিবাচক কথা বলতে ইচ্ছে করবে। তাছাড়াও, মুখে ছাড়ব ছাড়ব করছি, কিন্তু আসলে ছাড়ব না পার্টটা, এমন কথাও বলেছিল সমবয়সী কোনো এক সদস্যা, সে এখন রাজনীতির মঞ্চে নামকরা মানুষ, নামটা না বলাই উচিত হবে। জেদ চেপে গিয়েছিল সে-কথা শুনেও। কাকাতুয়া রাজদর্শনের থেকে একেবারে বিপরীত গোত্রের কমেডি। রাজদর্শনে যতটা হাত-পা ছড়ানোর সুযোগ আছে, সম্ভাব্যতার ঘেরাটোপকে পার হয়ে যাওয়ার স্বাধীনতা কাকাতুয়ায় তা ছিল না। কিন্তু ড্রইংরুম প্লের আওতায় থেকেও কেমন করে মজা তৈরি করতে হয়, তার প্রকৃষ্ট উদাহরণ হয়ে থাকবে এ প্রযোজনা।
আরো অনেক নাটকের কথা মনে পড়ে টুকরো টুকরো করে। আগুনের পাখি, যাকে আমি তাঁর সেরা কাজ বলব, কেমন করে মূল পাঠের মধ্যে ভাঙচুর করতে হয় তার অজস্র্র্র উদাহরণ তৈরি করেছিলেন তিনি, আজ যখন সুমন কৌশিক ব্রাত্যরা মূল পাঠকে ভেঙে ফেলে ভেতরের নির্যাসকে বার করে আনার খেলায় মাতেন, তখন বুঝতে পারি, সময়ের তুলনায় কতটাই না আধুনিক ভাবনায় তৈরি হয়েছিল আগুনের পাখি। শিশিরকুমার দাশের শ্যামা নাটকে একটি চরিত্রকে দু’তিনটি রূপে ভেঙে অভিনয় করাবার একটা পরিকল্পনা করেছিলেন। খুব সফল হয়নি সে পরিকল্পনা, কিন্তু এই অন্যরকম করে ভাবার সাহস তাঁর ধাতকে চিনিয়ে দেয়।
গল্প গুটিয়ে এবার বরং কাজের কথায় আসি। যদি নির্দেশক হিসেবে কুমার রায়কে আমি কী চোখে দেখি তা জিজ্ঞেস করা হয় তবে বলব, পারি না পারি, তাঁর কাছ থেকে অনেকগুলো বিষয় শিখেছি। প্রথম, বিচিত্র রকম বিষয় এবং ফর্ম নিয়ে নাটক করা। শম্ভু মিত্র তৃপ্তি মিত্রদের কথা মনে রেখেই বলছি, এত বৈচিত্র্য তাঁদের কাজেও পাওয়া যাবে না। দ্বিতীয়ত, নির্দেশক হিসেবে নিজের একটা ভাষা তৈরি করতে পেরেছিলেন কুমার রায়, তাঁর সম্পন্ন পূর্বসূরিদের থেকে আলাদা একটা ভাষা, যা বিপদের দিনে বহুরূপীকে বাঁচিয়ে দিয়েছিল। তিন, বিশেষ করে কমেডি অভিনয়ে নিজের এবং তার অনুগামীদের মধ্যে একটা ঝরঝরে আধুনিক অভিনয়-পদ্ধতি তৈরি হয়ে উঠতে পেরেছিল নিশ্চিতভাবে তাঁর অনুমোদনক্রমে। এটা বহুরূপীর পক্ষে খুবই কল্যাণকর হয়েছে। আপত্তির কথা একটাই, বড় বেশি চাপ নিয়েছেন, যা শরীর এবং সৃজন ক্ষমতা সবসময় সহ্য করতে পারেনি। পরের দিকে তারাপদ মুখোপাধ্যায় আসেন নির্দেশনার দায়িত্বে, আসে তুলিকা দাস, দেবেশ রায়চৌধুরীও কয়েকটি প্রযোজনা করেছে, বিশেষ করে বহুরূপীর প্রযোজনায় নতুন ভাবনা ঢুকে পড়ছে, একথা ভেবে আমরা সবাই খুব খুশি হয়েছিলাম।
আমার নির্দেশিত চারটি নাটক দেখেছিলেন তিনি। তিনটি মন্তব্যের কথা মনে পড়ছে। বিজড়িত বলে একটি নাটক দেখেছিলেন দুবার, দ্বিতীয়বারের অভিনয়টা খুব খারাপ হয়েছিল, কিন্তু কুমার রায়ের মনে হয়েছিল, কোথাও কিচ্ছু নষ্ট হয়নি। মঞ্চে চরিত্রদের দিয়ে যে ত্রিভুজ তৈরি করা হচ্ছে বারবার তার কথা বলেছিলেন আলাদা করে। মুড়কির হাঁড়ি দেখে বলেছিলেন, ‘দেখিস, পপুলার নাটক করতে গিয়ে যেন পপুলিস্ট করে ফেলিস নি।’ গহ্বর ভালো লেগেছিল, ছাপতেও চেয়েছিলেন বহুরূপীতে, কিন্তু সুতপনের চরিত্রটা নিয়ে একটু সংশয়ের কথা বলেছিলেন। আর দেখেছিলেন টুনটুনি লো। বললেন, ‘বাচ্চাদের নাটকটা তুই খুব ভালো ট্যাকল করিস তো!’ পরের দিকে আর কিছু দেখাতে পারিনি, শরীর দিত না তখন।
ভালো খারাপ যা-ই করি, বেশ কটা প্রযোজনা করা হয়ে গেল। নির্দেশক হিসেবে আমার ভাষার সঙ্গে কুমার রায়ের প্রভেদ বিস্তর, ভাবনা চিন্তা রুচি পছন্দের ক্ষেত্রেও। তবু একথা ভুলব কেমন করে, লিখিত পাঠ থেকে মঞ্চের রূপে নাটককে নিয়ে আসার প্রাথমিক শিক্ষা আমার তাঁর কাছ থেকেই পাওয়া। আজো তো কোথাও কোথাও সমস্যার মুখে দাঁড়িয়ে যেন দেখতে পাই মানুষটিকে, ভেতর থেকে ধাক্কা মেরে দেখিয়ে দেন মঞ্চে ছবি তৈরি করার হদিস, একা একা ভাবতে বসে মনে হয় পোশাক বা মঞ্চ কেমন হবে তাই নিয়ে একটু কথা বলে নিতে পারলে ভালো হতো।