logo

সংগীত, সংগীতজ্ঞ ও শ্রোতা

আলীম-উর-রহমান খান

এই লেখাটির জন্ম একামত্মভাবে লেখকের নিজস্ব প্রণোদনা থেকেই। এটি সেই প্রণোদনা, যার সৃষ্টি বেঙ্গল ও আইটিসির যৌথভাবে আয়োজিত সংগীত সম্মেলন দ্বারা। এই লেখকের সুযোগ ঘটেছে ১৯৫২ সালের পর থেকে কলকাতা ও ঢাকায় আয়োজিত অনেক সংগীত সম্মেলনে শ্রোতা হিসেবে উপস্থিত থাকার; তা সত্ত্বেও এমন বড় অথচ অনুচ্চকিত, এমন ভালোভাবে সংগঠিত ও সুন্দরভাবে পরিচালিত সংগীত সম্মেলনে আগে আর কখনো উপস্থিত থাকার সুযোগ লেখকের হয়নি। সর্বোপরি, এই অনুষ্ঠান আয়োজিত হয়েছে ঢাকায়, যেখানে তা সম্ভব বলে আশা করা যায়নি, কিন্তু সত্যিই তা ঘটেছে।
অভিজ্ঞতার, এমনকি তা যদি আত্মিকও হয়, একটি নিজস্ব প্রকৃতি ও উদ্দেশ্য থাকে। অভিজ্ঞতা অবশ্যই, ভবিষ্যৎ প্রজন্ম কর্তৃক ব্যবহারের জন্য, লিপিবদ্ধ ও সংরক্ষিত হওয়া উচিত; তবে এর মধ্যে বাছাই করে নিতে হবে – কোনটি সংরক্ষণ করতে হবে এবং কোনটি পরিত্যাগ করতে হবে। এই রচনার যিনি লেখক তাঁর রয়েছে বিগত শতাব্দের কিছু কিংবদমিত্মসম সংগীতশিল্পীর গান ও বাদন শোনার প্রায় ৬৫ বছরের সচেতন অভিজ্ঞতা। এই লেখাটির জন্ম সেসব গায়ন-বাদন অনুষ্ঠান এবং সংশিস্নষ্ট আলোচনার অভিজ্ঞতা ও জ্ঞানের অংশ হিসেবে।
এখানে লেখক যেসব কিংবদমিত্মসম সংগীতশিল্পীর সংস্পর্শে আসার ও বহুবার তাঁদের পরিবেশিত সংগীত শোনার সৌভাগ্য অর্জন করেছেন, কেবল তথ্য হিসেবে তাঁদের কিছু কথা উলেস্নখ করা নিশ্চয় অপ্রাসঙ্গিক হবে না।
শুরম্নতেই বলতে হয় ওসত্মাদ বড়ে গোলাম আলী খাঁ ও ওসত্মাদ বিলায়েত খাঁর কথা। এই লেখক তাঁদের দুজনের খুব কাছে যাওয়ার সুযোগ পেয়েছিলেন। এঁদের সঙ্গে যোগ হতে পারে ওসত্মাদ নিসার হোসেন খাঁ, আসাদ আলী খাঁ (গায়ক) ও আমানত আলী খাঁর নাম। আরো সৌভাগ্য হয়েছিল ওসত্মাদ আলাউদ্দিন খাঁ, ওঙ্কারনাথ ঠাকুর, হাফিয আলী খাঁ, বিসমিলস্নাহ্ খাঁ, লতাফত হোসেন খাঁ, কেশরবাই কেরকার, হীরাবাই বরোদেকার, বিনায়ক রাও পট্টবর্ধন, ডিভি পলুশকর ও তাঁদের প্রায় কাছাকাছি পর্যায়ের অনেক সংগীতসাধকের পরিবেশনা বহুবার শোনার এবং এঁদের সঙ্গে আরো নাম যোগ করা যায়। কেবল এক বা একাধিকবার তাঁদের পরিবেশনা শোনার অভিজ্ঞতাকেও মূল্যবান অভিজ্ঞতা রূপে বিবেচনা করা যায়। এছাড়া রয়েছেন আরো অনেকে, যাঁরা বিগত ত্রিশ বছরে ঢাকায় এসেছেন। যন্ত্রসংগীতে লেখকের শিক্ষা সূচনা হয় বিলায়েত খাঁ, রবিশঙ্কর ও আলী আকবর খাঁর কাছে। তবলায় তালিম নিয়েছেন যেসব কিংবদমিত্ম শিল্পীর কাছে তাঁরা হলেন – আহমদজান থিরাকুরা, কামিত্ম মহারাজ, আনোখি লাল, কিষেন মহারাজ, শামত্মা প্রসাদ, কেরামত উলস্নাহ খাঁ ও তাঁদের মতো গুণীজনের কাছে। সংগীতের দিক বিবেচনায় এটি লেখকের সৌভাগ্য। এই লেখায় উলিস্নখিত গুণীজনদের পরিবেশনা শোনার ও তাঁদের সঙ্গে কিছু কিছু আলোচনার প্রভাব পড়েছে নিঃসন্দেহে।
আমাদের উচ্চাঙ্গসংগীত ও উত্তর ভারতের উচ্চাঙ্গসংগীত অভিন্ন। আমরা একই ঐতিহ্যের অংশীদার এবং আমাদের সংগীতের উদ্ভব একই মূল থেকে আর প্রকাশের ধরনও অভিন্ন। এই পদ্ধতির ভিত্তি হচ্ছে রাগ-রাগিণীর মাধ্যমে সংগীতের পরিবেশনা। এই রাগগুলো হচ্ছে আবার শব্দ, নৈঃশব্দ্য ও লয়ের ব্যবহারের মাধ্যমে সৃষ্ট বাহ্য আকৃতিমূলক চিত্র। প্রতিটি রাগই স্পষ্টভাবে শনাক্তযোগ্য ও সুসামঞ্জস্যপূর্ণ একক সত্তা। প্রতিটি রাগই একটি প্রতীকী রূপ তথা বাহ্য আকৃতিমূলক রূপ বা প্যাটার্ন তুলে ধরে। আমাদের সংস্কৃতিতে আমাদের শেখানো হয় নয়টি স্থায়ী রস ও তেত্রিশটি অস্থায়ী রস সম্পর্কে, যার মাধ্যমে একজন শিল্পী, সংগীতশিল্পী বা নৃত্যশিল্পী বাহ্য আকৃতিমূলক চিত্র উপস্থাপন করতে পারেন। আমি অবশ্যই নিশ্চিত যে, ওপরে বর্ণিত রসগুলো ছাড়া আরো রস আছে, তবে বাসত্মব কারণে এগুলোর মধ্যেই রস সীমিত ও শ্রেণিবিভক্ত করা হয়েছে। এতদসত্ত্বেও, আমাদের বক্তব্য উপস্থাপনের জন্য এগুলোই যথেষ্ট।
একজন সংগীতশিল্পীর কাজ হচ্ছে শ্রোতার সামনে একটি রাগ উপস্থাপন করা। সুষ্ঠুভাবে উপস্থাপিত একটি রাগ শ্রোতার ‘হৃদয়ে’ রঞ্জকতা সৃষ্টি করতে পারে। রঞ্জকতা শব্দটির অর্থ হচ্ছে, কিছুটা শিথিল অর্থে, ‘পরম সুখানুভূতিসহ হৃদয়কে আলোকিত করা।’
রাগকে তুলনা করা যেতে পারে একটি চিত্রকর্মের সঙ্গে, যে চিত্রের রয়েছে একটি মূল ভাব; এতে রং ব্যবহার করা হয় চিত্রটিতে একটি ‘মেজাজ’ ফুটিয়ে তোলার জন্য। সংগীতের ক্ষেত্রে, রঙের পরিবর্তে সাংগীতিক নোটগুলো ব্যবহার করা হয় সেই একই উদ্দেশ্যে। এর মধ্যে যে একমাত্র পার্থক্য রয়েছে তা হলো – চিত্রকর্ম স্থবির, কিন্তু রাগের সংগীত গতিময়। ফলে সংগীতে আরো অনেক সম্ভাবনার সুযোগ থেকে যায়।
এ লেখাটির উদ্দেশ্য হলো – এমন অল্প কিছু বিষয় বিশেষভাবে তুলে ধরা, যেগুলো শিল্পীরা ও শ্রোতারা প্রায়শ এড়িয়ে যান। এর মধ্যে কিছু বিষয়ের উলেস্নখ করা হয়েছে শিল্পীদের দৃষ্টি আকর্ষণের জন্য। সেই বিষয়গুলো সংগীতের রস আরো গভীরভাবে আস্বাদনের ব্যাপারে শ্রোতাদেরও সাহায্য করতে পারে। একজন ভালো শ্রোতার অবশ্যই বিষয় সম্পর্কে কিছু প্রত্যক্ষ জ্ঞান ও উপযুক্ত পরিমাণ তাত্ত্বিক জ্ঞান থাকা উচিত। এ রচনাটির লেখক নিজে তাঁর বয়সকালে কণ্ঠসংগীত ও যন্ত্রসংগীত এই উভয় বিষয়েই প্রখ্যাত ওসত্মাদদের কাছে হাতে-কলমে কিছু প্রশিক্ষণ গ্রহণ করেছিলেন এবং সংগীত বিষয়ে কিছু পাঠ ও চিমত্মাও তাঁর অধিগত হয়েছিল। দুর্ভাগ্যবশত সংগীতের ইতিহাস এবং রাগাদির বাহ্য আকৃতিগত কাঠামো ঐতিহাসিক বিবেচনার দিক থেকে অত্যমত্ম অপরিণত রয়ে গেছে, তবে এর ফলে বর্তমান সংগীত এবং/অথবা বর্তমান রূপের যা আছে সেই রাগগুলোর তেমন কোনো পরিবর্তন ঘটেনি।
আগেকার যুগের রাগগুলোর প্যাটার্ন বা রূপাদর্শ সম্পর্কে যখন ঐতিহাসিক বিবরণ বা তুলনা উপস্থাপন করা হয়, তখন একটি বড় ধরনের বিভ্রামিত্ম থেকে যায়। একটি রাগের মূল রূপ, এর নামকরণ-পদ্ধতি ও সংশিস্নষ্ট অন্যান্য বহু বিষয়ে অনেক বিভ্রামিত্ম রয়েছে। এসব বিষয়ে যেসব যুক্তি তুলে ধরা হয় তার মধ্যে অধিকাংশই অগ্রহণযোগ্য বলে মনে হয়, যেহেতু এগুলোর কোনো হুবহু লিপিবদ্ধ বিবরণ নেই। নোট বসানোর অবস্থান ছিল ভিন্ন, নামগুলো ছিল ভিন্ন এবং চলন বা সঞ্চালন ছিল ভিন্ন; তাহলে আর কী রইল?
রাগগুলো বর্তমানে যেভাবে পরিবেশন করা হয় সেভাবেই গ্রহণ করে সেগুলো নিয়ে কাজ করাই সবচেয়ে ভালো। এটিই সমেত্মাষজনক উপায়। একই রাগের বহু প্যাটার্ন বা রূপ থাকতে পারে; সেগুলো ভিন্ন ভিন্ন সরগমে প্রায়শ ভিন্ন ভিন্ন রাগ বলে মনে হয়। কিন্তু এগুলোর একটিই নাম। দৃষ্টামত্ম হিসেবে বসমত্ম রাগের কথা বলা যায়। তিন মেলে এর পাঁচটি রূপ রয়েছে। কোনটি শুদ্ধ বসমত্ম? সম্ভবত একটি, সম্ভবত সবগুলোই। সবচেয়ে জনপ্রিয় সেটিই, যা সাধারণত গাওয়া বা বাজানো হয়। সেটি হচ্ছে পূরবী মেল।  অন্যগুলো ভুল নয়, ভিন্ন। সম্ভবত সেগুলোর ভিন্ন ভিন্ন নাম থাকা উচিত ছিল।
মওলানা রম্নমি এক জায়গায় বলেছেন যে, সৃষ্টিকর্তার ভাষা হচ্ছে নীরবতা এবং অন্য সবকিছুই হচ্ছে এর দুর্বল অনুবাদ বা রূপামত্মর মাত্র। এ কথাটিকে যদি মূলকথা হিসেবে গ্রহণ করা হয় তাহলে ‘অনাহত নাদ’ হচ্ছে প্রথম সংগীত।
অনাহত নাদ হচ্ছে নীরবতা বা নৈঃশব্দ্য। প্রথমে এই নৈঃশব্দ্য শ্রবণের কাজটি শিখতে হয়; এর প্রতি মনোযোগী হও এবং নিজেকে নৈঃশব্দ্যের মধ্যে নিমজ্জিত করতে শেখো। এটি সংগীত পরিবেশনকারী এবং শ্রোতা উভয়ের ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য, তবে বেশি প্রযোজ্য সংগীত পরিবেশনকারীর ক্ষেত্রে। এটি হতে পারে একজন সংগীতজ্ঞ হওয়ার পথে প্রথম পদক্ষেপ এবং কিছুটা একজন ভালো শ্রোতা হওয়ার পথেও।
এখানে প্রধানত সংগীতজ্ঞদের জন্য একটি উপমা তুলে ধরা হলো। এই লেখকের মতে, একটি অদৃশ্য জগতে রাগ-রাগিণীর বাসত্মব অসিত্মত্ব রয়েছে।
একজন সংগীতশিল্পীকে প্রথমে সে জগতে এদের দেখতে হবে, এবং এরপর, অন্যভাবে বলতে গেলে, এদের ‘জানতে হবে’ এবং চিনতে শিখতে হবে। এরপরই তিনি এদের সেই অদৃশ্য জগৎ থেকে বের করে এনে এদের রূপের ওপর মনোনিবেশ করতে এবং তাঁর শ্রোতারা এই স্পর্শনীয় জগতে এদের যেভাবে জানে ও চিনতে পারে সেভাবে উপস্থাপন করতে সমর্থ হবেন। এ কাজে তাঁর সহায় হবে সংগীতের নোট ও লয়গুলো ব্যবহার করতে পারার সামর্থ্য, যা তিনি তাঁর সংগীত অনুশীলনকালে শিখবেন বলে আশা করা হয়। সহজ ভাষায় বলতে গেলে, তিনি সুর ও তাল উভয়ই ব্যবহার করবেন।
রাগসমূহের মূল বিষয়গুলো অল্প কয়েকদিনের মধ্যে অনুধাবন করতে পারা গেলেও, একজন যথার্থ শিক্ষাগুরম্নর নির্দেশনায় শেখা এই কৌশল প্রয়োগ করার জন্য বহু বছর ধরে সাধনার প্রয়োজন হয়। একজন যথার্থ নির্দেশক ও সংগীতগুরম্ন কদাচিৎ খুঁজে পাওয়া যায়, বিশেষত আজকাল। তবে এসব কাজ করা হয়েছে এরূপ ধরে নিয়েও জিজ্ঞেস করা যায় – যে সংগীত পরিবেশনকারী এখন একজন সংগীতশিল্পী হয়ে উঠছেন তাঁর পরবর্তী কাজ কী?
একজন শিল্পীর প্রশিক্ষণ-কর্মসূচির মধ্যে দুটি অংশ রয়েছে; এ দুটি অংশই গুরম্নত্বপূর্ণ, কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত অত্যমত্ম বেশি গুরম্নত্ব দেওয়া হয় বাইরের বিষয়টির ওপর এবং খুব সামান্য দেওয়া হয় ভেতরের মূল বিষয় বা আত্মার ওপর। আত্মাহীন দেহ কোনো কাজে আসে না; আবার দেহ ব্যতীত আত্মার ধারণা সম্ভব নয়। এখানে দেহের কাজ হচ্ছে জানানো বা যোগাযোগ করা। স্পষ্টভাবে ও যথাযথভাবে যোগাযোগ করা। বাহ্য প্রশিক্ষণ প্রধানত এজন্যই প্রয়োজন।
বাহ্য প্রশিক্ষণের মধ্যে থাকে সাধারণ একটি নোট শুদ্ধভাবে প্রয়োগ করার ও লয় আয়ত্ত করার সক্ষমতা। সংগীতের ভাষায় সুর ও লয়ের ওপর নিয়ন্ত্রণ। শিক্ষার্থী শিল্পীকে রাগসমূহ ও সেসব রাগের গঠন (composition) সম্পর্কে কিছু ধারণা দেওয়া হয়। পরবর্তী ধাপ হচ্ছে নোটগুলোর মধ্যকার বিসত্মারের (space) ব্যবহার এবং এই বিসত্মার প্রয়োগের বিভিন্ন কৌশল শেখা। সংগীতের ভাষায় গমক ও মিড় শেখা। যে বিষয়টি নিয়ে বেশি বলা হয় সেই তান শেখা অবশ্যই প্রকৃতপক্ষে গৌণ, অমত্মত এই লেখকের মতে। অবশ্য এক্ষেত্রে কিছু ব্যতিক্রম আছে; তবে সেগুলো বিরল ও গুরম্নত্বপূর্ণ। এ সময়ে তালও শেখানো হয়। এসব শেখার জন্য বছরের পর বছর ধরে অনুশীলনের প্রয়োজন হয়। এ সময় অন্যান্য বিষয় শেখানোর পাশাপাশি অলংকরণের অন্যান্য পদ্ধতিও শিক্ষা দেওয়া হয়। তবে বিবেচনার বিষয় হচ্ছে – শেষ পর্যমত্ম এসব অনুশীলন থেকে কী পাওয়া যায়, চূড়ামত্ম লক্ষ্য কী? এটা কী শুধু কোনো ধারণক্ষমতা; সেই ধারণক্ষমতা যা নোটগুলো শুদ্ধভাবে বের করে আনতে ও সেগুলোকে নির্দিষ্ট লয়ে ধরে রাখতে এবং প্রশিক্ষণ অনুযায়ী কেবল একটি গান গাইতে পারা? এসব প্রয়াসের মাধ্যমে একজন ছাত্র/ছাত্রী যা শেখে, বিভিন্ন যন্ত্র ব্যবহার ও সেগুলো ফলপ্রসূভাবে বাজাতে শেখে – তার মধ্যে সংগীত কোথায়? প্রশ্ন হলো, এর উদ্দেশ্য কী?
কৌশলগুলো আয়ত্ত হওয়ার পরই একজন সংগীত শিক্ষার্থী সংগীতের দরজায় গিয়ে পৌঁছে। এটিই লক্ষ্য। লক্ষ্য হচ্ছে সংগীত সৃষ্টি, যা মানুষের বুদ্ধিকে অতিক্রম করে ‘হৃদয়ের’ গভীরে গিয়ে পৌঁছা উচিত। এটি করা হয় শুদ্ধভাবে রাগ উপস্থাপনের মধ্য দিয়ে। রাগ পদ্ধতি আমাদের সংগীতজগতের মূলসত্মম্ভ। পাঠক ইতোমধ্যেই জেনেছেন – রাগ কী; এ নিয়ে আর বিসত্মারিত কিছু বলার প্রয়োজন নেই।
উপমার বিষয়টিতে ফিরে গিয়ে বিবেচনা করা যায় যে, সংগীতের সেই অদৃশ্য জগতে প্রতিটি রাগেরই একটি সুস্পষ্ট বাহ্যিক অবয়ব আছে। অদৃশ্য জগতে রাগগুলোর অবস্থান ব্যক্তিগত অসিত্মত্বের মতো। শিল্পীকে বাসত্মব পৃথিবীতে একটি রাগকে আহবান জানাতে হয় এর অদৃশ্য বাহ্যিক অবয়বেই। শিল্পীর দায়িত্ব হচ্ছে একে দৃশ্যমান করে তোলা। শিল্পীকে রাগ জানতে হয় সুস্পষ্টভাবে ও সম্পূর্ণভাবে, অমত্মত তাঁর পক্ষে যতটা সম্ভব। কেবল তখনই তিনি তাঁর হাতিয়ারগুলো (কণ্ঠ ও যন্ত্রাদি) ব্যবহার করে তাঁর শ্রোতাদের এর অসিত্মত্ব সম্পর্কে সচেতন এবং সংগীত সম্পর্কে ইমাম গাজ্জালি যা বলেছেন অর্থাৎ ‘কানের প্রবেশপথ’ দিয়ে এর বাহ্যিক অবয়ব দেখতে সক্ষম করে তুলতে পারেন।
শিল্পী যখন রাগের ওপর মনোযোগ নিবদ্ধ করেন, তখন সেটি শিল্পীর ‘হৃদয়ে’ একটি বাসত্মবরূপ পরিগ্রহ করে। এ সময়ে শিল্পীর উচিত প্রশামত্ম মেজাজে থেকে রাগকে এর রূপ গঠন করতে দেওয়া। এটি শিল্পীর হৃদয়ে নেমে আসবে এর অদৃশ্য রূপ নিয়েই। শিল্পীকে স্পষ্টভাবে তা ইন্দ্রিয় দ্বারা উপলব্ধি করতে হবে এবং এরপর ধীরে ধীরে তাঁর হাতিয়ারগুলোর সাহায্যে অর্থাৎ সুর ও লয়ের সাহায্যে দৃশ্যমান করে তুলতে হবে। সুর ও লয় অদৃশ্য রূপটিকে দৃশ্যমান পোশাক পরাবে; অলংকরণ আসবে এরপর। এ পর্যায়ে একজন শিল্পী প্রায়ই একটি ভুল করে ফেলেন। আনন্দের আতিশয্যে তিনি রাগটিকে অলংকৃত করেন এবং এর ফলে রাগটি অলংকরণের আড়ালে চলে যায়। এ কথাটি বলা হলো সতর্কবাণী হিসেবে।
এই উপমাটি গ্রহণ করা সম্ভব হলে, এরপর আরো সূক্ষ্ম কিছু বিষয় চলে আসে। সেগুলো বিবেচনা করা হলে কাজে আসতে পারে।
প্রথম বিষয়টি হলো, কীভাবে রাগটি জানা যাবে ও তা চিহ্নিত করা যাবে। এখানেই একজন ভালো গুরম্নর কাছে প্রশিক্ষণ নেওয়ার বিষয়টি আসে। ‘পরম্পরা’র যুগে গুরম্নর সার্বক্ষণিক উপস্থিতির ফলে শিষ্য সার্বক্ষণিকভাবে তাঁর নির্দেশনা পেয়ে থাকতেন। এ ছিল আত্মা থেকে আত্মায় জ্ঞান ও প্রত্যক্ষ জ্ঞানশক্তির আদান-প্রদান। বর্তমান যুগে সিডি, ইউটিউব, বই ও ব্যক্তিগত চিমত্মাভাবনাকে এ কাজের অংশবিশেষ সম্পন্ন করতে হবে।
ভবিষ্যতে যিনি শিল্পী হতে চান তাঁর উচিত হবে নিজেকে সাংস্কৃতিকভাবে শিক্ষিত করে তোলা। এ বিষয়ের ওপর সুনির্দিষ্টভাবে লিখিত বই নেই। তবে আশা করা যায়, অদূর ভবিষ্যতে বাংলাদেশে বেঙ্গল ফাউন্ডেশন এবং ভারতে আইটিসির মতো প্রতিষ্ঠান ও বিষয়ে মনোযোগ দেবে এবং যা করা প্রয়োজন তা করবে। এছাড়া বিশেষভাবে শ্রোতাদের জন্যও ‘কীভাবে শুনবেন’ জাতীয় বই প্রকাশ করা প্রয়োজন।
এখানে আরো কিছু বলার আছে। আমাদের উচ্চাঙ্গসংগীত কিছুটা আমাদের সার্বিক সংস্কৃতির সংশেস্নষের একটি শীর্ষবিন্দুর মতো। এর মধ্যে সমাজের সর্বপ্রকার সাংস্কৃতিক সূক্ষ্ম পার্থক্যের রূপটিও প্রকাশ পায়। এটি সেই সমাজ, যা অনেক পুরনো এবং হাজার বছর ধরে টিকে আছে। ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র ভিন্নতার মধ্যেই এই সমাজের সাংস্কৃতিক দিকটি যথেষ্ট সমৃদ্ধ; তার সবকিছু আজকের দৃষ্টিতে গ্রহণযোগ্য হোক বা না হোক। সব ক্ষুদ্র পার্থক্য আমাদের শিল্পগুলোতে একীভূত ও চিত্রিত হয়েছে; আমাদের উচ্চাঙ্গসংগীতের ক্ষেত্রে এই একই ঘটনা ঘটেছে। অনুভূতিগুলোকে তাদের নিরেট রূপ থেকে বের করে আনা হয়েছে এবং অত্যমত্ম পরিশীলিত ও সূক্ষ্ম উপায়ে সেগুলোর বৈশিষ্ট্যসূচক রূপ নির্দিষ্ট করা হয়েছে। রাগসমূহ এরই ফলশ্রম্নতি। আমরা জানি, রাগ হচ্ছে বাহ্য আকৃতিমূলক একটি গঠন, যা এমনভাবে নির্মিত হয় যাতে তা আলাদাভাবে চিহ্নিত করা যেতে পারে এবং একই সঙ্গে এতে থাকবে বিভিন্ন পরিমাণে সব ধরনের ভাব বা মেজাজ। উপস্থিত শ্রোতারা যাতে রস গ্রহণ করতে পারেন সেভাবে এসব বিষয় তুলে ধরাই একজন শিল্পীর প্রধান লক্ষ্য। এ-ও সত্য যে, যা উপস্থাপন করা হয় তা গ্রহণ অনেকটা নির্ভর করে শ্রোতার গ্রহণক্ষমতার ওপর। একটি রাগের মূল উদ্দেশ্য হলো, সাংগীতিক ধ্বনির মাধ্যমে একটি বাহ্য অবয়বমূলক চিত্র রচনা করা এবং তা মোটেই সবিরাম নীরবতার ব্যবহার দ্বারা নয়। অবশ্যই রাগের কাজ হচ্ছে শ্রোতার মধ্যে ‘রঞ্জকতা’ সৃষ্টি করা।
সব মিলিয়ে বলা যায়, শিল্পীর কাজ হচ্ছে শ্রোতার কাছে একটি রাগ উপস্থাপন করা। এই রাগ নিজেই শিল্পীর রাগের নিজস্ব ব্যাখ্যা বহন করবে। এ কাজের জন্য প্রথমে শিল্পীকে তাঁর মনোযোগ কিছুক্ষণ কেন্দ্রীভূত করতে হবে, যাতে তিনি রাগ যে ‘জগতে’ রয়েছে সেখানে পৌঁছতে পারেন। রাগকে খুঁজে নিন এর সমসত্ম সৌন্দর্যসহ। এরপর একে হৃদয়ে মিশে যেতে দিন। এটি তখনো অদৃশ্যই থাকবে। এখন শিল্পী সুর ও লয়-সহযোগে প্রাপ্ত তাঁর প্রশিক্ষণের সাহায্যে একটি রূপ প্রদান করবেন, অবশ্য এর সঙ্গে রাগ সম্পর্কে তাঁর জ্ঞানও থাকতে হবে। শিল্পীকেই বুঝতে হবে তাঁর শ্রোতারা কতখানি গ্রহণ করতে পারবেন এবং পরম পারদর্শিতা অবশ্যই এর ওপর চেপে বসবে না অথবা তাঁর শ্রোতাদের জন্য অতিরিক্ত বোঝা হয়ে দাঁড়াবে না।
এ কাজটি একটু কঠিন, কিন্তু অসম্ভব কিছু নয়। এর জন্য কিছুটা অভিজ্ঞতাও প্রয়োজন। এতসব সত্ত্বেও, কিছু বড় ও গুণী শিল্পী তাঁদের অসাধারণ পারদর্শিতা ও মৌলিকতার মাধ্যমে তাঁদের দর্শক-শ্রোতাদের বিমোহিত করতে পারেন।
এর মধ্যে একটি অসুবিধা অবশ্য প্রায়শই দেখা দেয়। একে বলা যেতে পারে ‘প্রতিস্থাপন প্রপঞ্চ’। এটি হচ্ছে, শিল্পীর কাছে রাগের সৌন্দর্য বিসত্মারের আর কিছু যদি না থাকে, তাহলে তিনি নানা খুঁটিনাটি বিষয়ের মধ্যে আশ্রয় গ্রহণ করেন। এগুলো হচ্ছে অনেক শোরগোল এবং ক্ষমতা ও কৌশলাদি প্রদর্শন। এটি প্রায়শ ঘটতে দেখা যায়। সব শিল্পীরই এটি মনে রাখা ও এড়িয়ে যাওয়া উচিত। এক ঘণ্টার শোরগোলমূলক সংগীত উপস্থাপনের চেয়ে আধঘণ্টার কোমল ও ধীরলয়ের আলাপ অনেক ভালো।
ওপরে যেমন বলা হয়েছে, এই সংগীতের উদ্দেশ্য হচ্ছে বাংলায় যাকে ‘রঞ্জকতা’ বলে তা সৃষ্টি করা। মোটামুটি অনুবাদে বলা যায়, এর অর্থ বোঝায় ‘রঞ্জন’ বা রঙিন করা, অর্থাৎ শ্রোতার হৃদয়কে বা অমত্মর্গত অসিত্মত্বকে রাঙিয়ে তোলা। এই রঞ্জন অবশ্যই সুন্দর হতে হবে এবং অবশ্যই আনন্দ দেবে ও ওপরে যা বলা হয়েছে সেরূপ সৌন্দর্যপ্রবণতার প্রতি মনকে টেনে নিয়ে যাবে। অর্থাৎ পরম সুখানুভূতি সৃষ্টি করবে। তবে শ্রোতাকেও অবশ্যই তাঁর নিজের মধ্যে এই সুন্দর ও আনন্দময় পরম সুখানুভূতি ধারণের জন্য নিজেকে তৈরি করতে হবে। এর জন্য প্রয়োজন সংগীত শ্রবণ, প্রশিক্ষণ ও অনুশীলন।
বড় দাগে বিবেচনা করলে, শ্রোতাদের মধ্যে অমত্মত তিনটি দল রয়েছে। এক দল আসেন সংগীত শুনতে ও উপভোগ করতে; আরেক দল আসেন তাঁরা যা শুনবেন তা থেকে কিছু শিখতে এবং সর্বশেষ দলটি হচ্ছেন সমালোচক। প্রত্যেকটি উদ্দেশ্যই ভিন্ন। এ রচনাটি লেখা হয়েছে তাঁদের জন্য, যাঁরা আসেন উপভোগ করতে ও সংগীতকে নিজের মধ্যে একাত্ম করতে।
এ ধরনের প্রভাবশীল শ্রোতার প্রতি আমার প্রথম পরামর্শ হচ্ছে – নিজেকে শূন্য করার সামর্থ্য অর্জন করম্নন। এরপর নৈঃশব্দ্যকে শোনার দিকে নিজেকে নিয়ে যান। যদি কেউ ‘নৈঃশব্দ্য’ শুনতে পারেন তাহলে তিনি, আগে যেমন বলা হয়েছে, সংগীত শ্রবণের প্রথম বাধাটি অতিক্রম করতে পেরেছেন।
এরপর অবশ্য তানপুরার শব্দকে নিজের মধ্যে প্রবেশ করতে দিতে হবে। এর মধ্যে সংগীত পরিবেশনকারী জেগে-থাকা নৈঃশব্দ্যের সঙ্গে নিজে আত্মস্থ হবেন এবং যে রাগ তিনি শোনাতে যাচ্ছেন সে রাগে নিজের মনোযোগ নিবদ্ধ করবেন ও এই মানসিক অবস্থার মধ্যে নিজেকে নিয়ে যাবেন। আমি মনে করি, প্রথম ধ্বনিটি যখন ভেসে আসে, সেটি কণ্ঠের হোক বা কোনো সংগীতযন্ত্রের হোক – সেই মুহূর্তটি এক স্বর্গীয় মুহূর্ত।
ইমাম গাজ্জালি (ইতঃপূর্বে তাঁর কথা বলা হয়েছে) তাঁর সংগীত সম্পর্কে লিখতে গিয়ে তাঁর ইমাহিয়া উলম-উদ-দীন গ্রন্থে বলেছেন যে, একজন মানুষের হৃদয় হচ্ছে বহু মণি-রত্নে পরিপূর্ণ একটি গুহার মতো। সেখানে আছে হীরা, পদ্মরাগ-মণি ও পান্না; আরো আছে গারনেট, অ্যামিথিস্ট ইত্যাদির মতো কম মূল্যবান রত্ন-পাথর এবং বাজে পাথর ও টুকরো টুকরো আলগা পাথর। রত্নাদি সংগ্রহের জন্য এই গুহায় প্রবেশ করতে হলে সংগীতের সহায়তা নিতে হয় এবং যেতে হয় কর্ণদ্বারের মধ্য দিয়ে, কিন্তু সেখানে যা নেই সংগীত তা বের করে নিয়ে আসতে পারে না। এ কথাটি অত্যমত্ম ঠিক। বিশেষভাবে এই সংগীতের রসাস্বাদন উন্নত করতে হলে শ্রোতাকেও তাঁর নিজেকে উন্নত করতে হবে।
আগে যা উলেস্নখ করা হয়েছে সে বিষয়টি আবার স্মরণ করে বলতে চাই, আমাদের সংস্কৃতির শিল্পদর্শন নয়টি স্থায়ী ভাব ও তেত্রিশটি অস্থায়ী ভাবকে স্বীকৃতি দেয়। অস্থায়ী ভাবগুলো নিরমত্মর স্থায়ী ভাবগুলোর দিকে এগিয়ে যেতে থাকে। এসব ভাবকে বিভিন্ন পরিমাণে মেশানোও যেতে পারে। সুর ও লয় এবং রাগ পরিবেশনের নির্দিষ্ট কিছু নিয়ম ব্যবহারের মাধ্যমে উচ্চাঙ্গসংগীত ভাবগুলোর একটি ধ্বনিচিত্র তৈরি করে এবং আগে যা বলা হয়েছে তদ্রূপ সাংগীতিক কাঠামো থিম বা মূল বিষয় পরিবর্তন ছাড়াই, যা চিত্রকলার ক্ষেত্রে ঘটে না, গতিময় থাকে। শ্রোতা যদি তৈরি থাকেন, তাহলে সংগীত তাঁকে জানা ও অজানা উভয় অঞ্চলেই নিয়ে যেতে পারে। শ্রোতার জন্য, তাঁর নিজের মধ্যে এসব অনির্ণীত অঞ্চল আবিষ্কার এই সংগীত শ্রবণের একটি প্রধান অর্জন হতে পারে, তবে শ্রোতাকে অবশ্যই বাইরে নিষ্ক্রিয় থেকে ভেতরে সক্রিয়ভাবে নিজের ভূমিকা পালন করতে হয়।
সবশেষে, সুস্পষ্টভাবে অনুধাবন করা উচিত – এই সংগীত আমোদ-প্রমোদ বা চিত্তবিনোদনের জন্য নয়। সেসবের জন্য অন্যান্য ধরনের সংগীত রয়েছে এবং সমাজে সেগুলোর প্রচলনও রয়েছে। এই সংগীত পবিত্র সংগীত। সেজন্য শিল্পী ও শ্রোতা উভয়েরই এর প্রতি শ্রদ্ধা পোষণ করা উচিত। যথাযথভাবে এই সংগীতের কাছে পৌঁছা গেলে এটি সন্তুষ্টি ও আনন্দের অজ্ঞাতপূর্ব উচ্চতার দ্বার উন্মুক্ত করে দিতে পারে। অসীমের কাছাকাছি পৌঁছার জন্য মানুষ যা কিছু সৃষ্টি করেছে এই সংগীত সম্ভবত তার নিকটতম এক উপায়। 

ইংরেজি থেকে অনুবাদ : সুব্রত বড়ুয়া

Leave a Reply