আ বু ল ম ন সু র
এই সর্বগ্রাসী বিশ্বায়ন ও তথ্য-প্রবাহের অপ্রতিরোধ্যতার সময়কালে শিল্পকর্মে নির্দিষ্ট গ–র অবয়ব প্রমাণের আর কোনো অর্থময়তা রয়েছে কি না সে প্রশ্ন উঠতে শুরম্ন করেছে। সাম্প্রতিক কয়েক দশকে, বিশেষ করে পশ্চিমে, দৃশ্যকলাজগতের ব্যাপক ভাঙচুর, রূপনির্মাণের খোলনলচেসুদ্ধ বদলে যাওয়া আর আমাদের শিল্পে এর ব্যাপক অভিঘাত এ যুক্তিকে পুষ্টি জুগিয়েছে। তা সত্ত্বেও নানা ঘাত-প্রতিঘাতের মধ্য দিয়ে অগ্রসর হতে হতে সম্ভবত এ উপলব্ধিও হারিয়ে যায়নি যে, ইতিহাসের গুরম্নভার পুরোপুরি বিসর্জন দেওয়া সম্ভব নয় এবং একে উপেক্ষা করে শিল্পের জগৎসভায় নিজের স্বতন্ত্র আসন অর্জন করা যাবে না।
প্রযুক্তির অভাবনীয় অগ্রগতির সর্বব্যাপ্ত অভিঘাত আমাদের জীবনচর্যা শুধু নয়, মনন ও কল্পনার জগতেও বিসত্মৃত হয়েছে। বলা যেতে পারে, প্রযুক্তি আজ আমাদের দেহ ও মন উভয়ের নিয়ন্ত্রণ প্রায় নিয়ে নিয়েছে আর ঘটিয়েছে এমন এক বিশ্বায়নে আসক্তি, যা আমাদের শেষ পর্যমত্ম কোথায় পৌঁছে দেবে তা আমরা জানি না। এমন পরিস্থিতিতে দৃশ্যকলার জগৎ হয়ে উঠেছে টালমাটাল, সংশয় ও দোলাচলে দিশাহীন। প্রথাগত চিত্রভাস্কর্যের পাশাপাশি চর্চিত হচ্ছে ইনস্টলেশন, পারফরম্যান্স, ফটোগ্রাফ, ভিডিও, সাইট-স্পেসিফিক আর্ট ইত্যাকার নানাবিধ নব্যধারার শিল্পরূপ। তবে সেসব শুধুই পশ্চিমের অনুকরণ, অনুসরণ বা অনুরণন হয়েই ফুরিয়ে যাচ্ছে কি না সে প্রশ্নও গুরম্নত্বপূর্ণই থাকছে। অন্যদিকে সমকাল ও স্থানিক বৈশিষ্ট্যের মেলবন্ধন একবিংশ শতকের পটভূমিতে কোন রসায়নে সম্ভবপর সেটিও এক জটিল প্রশ্ন হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। দৃশ্যকলার জগতে যে বিপুল সংকটের মুখোমুখি আমরা আজ দাঁড়িয়েছি সেটি থেকে উত্তরণের পথ খুঁজতে গিয়ে আমরা সে মানুষটির দিকে মুখ ফেরাতে পারি, যিনি এ চ্যালেঞ্জের এমন একটি প্রত্যুত্তর নির্মাণ করেছেন যা একদিকে সারল্যপূর্ণ ও স্বতঃস্ফূর্ত, অন্যদিকে সমকালের জটিলতাকে ধারণেও সক্ষম ও সম্ভাবনায় ব্যাপ্ত। তাঁর মৃত্যু উপমহাদেশের দৃশ্যকলাজগতে এক নক্ষত্রপতন। বিগত ২৯ জুন বিরানববই বছর বয়সে প্রয়াত হয়েছেন তিনি – কল্পতি গণপতি সুব্রহ্মণ্যন্।
সমকালের জটিল ও বিক্ষত পরিপ্রেক্ষিকে স্থানিক পটভূমিতে উপস্থাপনের কাজটি সম্ভব করেছেন তিনি, মোটাদাগে বলতে গেলে, মূলত বাঙালির লোককলা ও আখ্যানকে উপজীব্য করে নিজস্ব শিল্পভাষায় পরিবেশন, চিত্রভাস্কর্যের মতো উচ্চশিল্পের সঙ্গে নিম্নবর্গীয় লোক ও কারম্নকলার এক স্বাতন্ত্র্যম–ত মিশ্রণ ঘটিয়ে আর চিত্রভাস্কর্যের জগৎকে প্রাত্যহিক জীবনের অনুষঙ্গী হিসেবে গড়ে তোলার মাধ্যমে। পাশাপাশি ছিল তাঁর গভীর পঠন-পাঠন ও যুক্তিশীল লেখনী, যা দৃশ্যকলার একটি সমকালীন বিকল্প ভাষ্য নির্মাণের কাজটি অবিরাম করে গেছে। কে জি সুব্রহ্মণ্যন্ নামে অধিক পরিচিত এ শিল্পী নিজে বাঙালি নন, জন্মসূত্রে কেরলের অধিবাসী। তবে শামিত্মনিকেতনের কলাভবনে অধ্যয়ন তাঁর শিল্পীজীবনকে গভীরভাবে প্রভাবিত করেছিল, বলা যায় এর রেশ সারাজীবনই তাঁর ভেতর প্রবাহিত হয়েছে। রবীন্দ্রনাথ শামিত্মনিকেতনে বিশ্বভারতী শিক্ষালয়টি প্রতিষ্ঠা করেছিলেন মূলত এ আদর্শে যে, এর মধ্য দিয়ে সর্বভারত ও বিশ্বের শিক্ষার্থীদের মধ্যে জ্ঞান ও সংস্কৃতির আদান-প্রদানের মাধ্যমে এক বৈশ্বিক সহমর্মিতা গড়ে উঠবে। আর চিত্রভাস্কর্য ধর্ম-পুরাণের জগৎ ছেড়ে হয়ে উঠবে প্রাত্যহিক জীবনের নৈমিত্তিক দিনযাপনের প্রতিলিপি।
মাস্টারমশাই নন্দলাল বসু আর শিক্ষক বিনোদবিহারী মুখোপাধ্যায় কে জি সুব্রহ্মণ্যন্কে গভীরভাবে আনেদালিত করেছিলেন। তবে গান্ধিবাদী আন্দোলনে জেলখাটা আর মাদ্রাজ প্রেসিডেন্সি কলেজে অর্থনীতি পড়া, প্রচুর পড়াশোনা করা সুব্রহ্মণ্যন্ একটু পরিণত ও ভিন্ন ধাঁচের ভাবনাচিমত্মা নিয়েই কলাভবনে এসেছিলেন। হয়তো শামিত্মনিকেতনের সমন্বয়বাদী আবহ তাঁকে শিল্পের এক সামগ্রিক চরিত্র ও ভূমিকা বিষয়ে ভাবতে আগ্রহী করে তোলে। নন্দলাল ও বিনোদবিহারীর ভিত্তিচিত্রে আগ্রহ ও অনুশীলন এবং কারম্নকলার বিকাশ সাধনে শ্রীনিকেতনকে ঘিরে নন্দলালের শ্রম ও উদ্যম এসব বিষয়ে তাঁর ঔৎসুক্য উসকে দেয়। এ সময় নিশ্চয় তিনি যামিনী রায়ের প্রয়াসকে আগ্রহের সঙ্গে লক্ষ করেছেন। নন্দলাল ও যামিনী রায় প্রায় সমসাময়িক, ওই সময়ে সর্বভারতীয় দৃশ্যকলাজগতে দুজনই খ্যাতির শীর্ষে। সুব্রহ্মণ্যন্ তাঁদের পার্থক্য বোঝার চেষ্টা করেছেন। যামিনী রায় সম্পূর্ণ একক প্রয়াসে আধুনিক ভারতশিল্পের জন্য একটি একেবারে নতুন পথের সন্ধান দিলেন, লোককলাকে এনে দাঁড় করালেন আধুনিককালের শিল্প রচনার উৎস হিসেবে। কিন্তু তিনি ব্যর্থ হয়েছেন লোকশিল্পের শক্তি ও স্বতঃস্ফূর্ততার কোনো রূপামত্মর ঘটিয়ে তাকে সমকালীন জীবনের ভাষ্য হিসেবে উপস্থাপন করতে। সুব্রহ্মণ্যন্ এটি সঠিক উপলব্ধি করেছিলেন যে, লোকশিল্পের অমত্মর্নিহিত প্রাণশক্তির তুলনায় যামিনী রায়ের ছবি নিষ্প্রাণ। তিনি একে বলেছেন মৃত রেশমগুটির মতো, মনোরম কিন্তু পুতুলের মতো আড়ষ্ট।
অন্যদিকে রক্ষণশীল মানসিকতা সত্ত্বেও নন্দলালের মধ্যে তিনি দেখতে পেয়েছেন শিল্পকে তার সমগ্রতায় ধারণের ও জীবনযাপনের অংশ হিসেবে দেখার দৃষ্টি, যা তিনি প্রতিটি ছাত্রের মধ্যে বপন করার জন্য নিরলস কাজ করে যেতেন। নন্দলালের সৃষ্ট শিল্প দ্বারা সুব্রহ্মণ্যন্ তেমন প্রভাবিত হননি, হয়েছেন তাঁর প্রজ্ঞাপ্রসূত শিল্পদৃষ্টির দ্বারা। কলাভবনে যে শিক্ষকটি সুব্রহ্মণ্যনের ওপর সত্যকার ছায়া বিসত্মার করেছিলেন তিনি হলেন বিনোদবিহারী মুখোপাধ্যায়। বিনোদবিহারীর মধ্যে তিনি দেখেছিলেন সৃষ্টির কৃৎকৌশলের সঙ্গে বুদ্ধিবৃত্তিক ভাবনার প্রয়োগ। একভাবে বলা যায়, সুব্রহ্মণ্যন্ হলেন কলাভবন থেকে আধুনিক ভারতশিল্পের যে ধারাটি নন্দলাল-বিনোদবিহারী-রামকিঙ্করের মাধ্যমে সূচিত হয়েছিল তার উত্তর-প্রজন্মের অন্যতম প্রতিনিধি এবং বিশেষ করে বিনোদবিহারীর পূর্ব-পশ্চিম সমন্বয়বাদী প্রয়াসের সফলতম উত্তরাধিকারী। তার পরও সুব্রহ্মণ্যন্ নিজের জন্য বেছে নিয়েছেন যে পথটি, বলা যায়, সেটি ক্রমশই সরে গেছে তাঁর পূর্বসূরিদের থেকে। তিনি ক্রমশ আগ্রহী হয়ে উঠেছেন লোককলার বিবিধ ধরনে, গ্রামীণ কারম্নকলার নির্মাণকৌশলে, বিশেষ করে বয়নশিল্প আর মৃৎ-পুতুলের অনায়াস নান্দনিক অভিব্যক্তিতে। আবার তাঁর মধ্যে রয়েও গেছে কলাভবনের রেশ – শিল্পকে সামগ্রিকতায় ও জীবনমুখী উপযোগিতায় ধারণের আকাঙক্ষায় আর চিত্রপটে পরিপার্শেবর জগৎ ও আখ্যানধর্মিতার চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যে। এভাবে কে জি সুব্রহ্মণ্যন্ ক্রমে সর্বভারতীয় দৃশ্যকলা জগতে নেতৃস্থানীয় একজন হয়ে উঠেছেন, একই সঙ্গে রয়ে গেছেন একেবারেই স্বতন্ত্র একজন। এ স্বাতন্ত্র্য পরিস্ফুট তাঁর শিল্পকর্মে যেমন, তেমনি তাঁর লেখনীতে। অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর ও বিনোদবিহারী মুখোপাধ্যায়ের পর সমগ্র ভারতবর্ষে আঁকা ও লেখা – উভয় ক্ষেত্রে এমন উচ্চমানের নৈপুণ্য আর কেউ দেখাতে পেরেছেন বলে আমাদের জানা নেই।
সুব্রহ্মণ্যনের অভিযাত্রা বিভিন্ন সত্মর অতিক্রম করে ক্রমশ বিকশিত হয়েছে। ১৯৪৪ সালে শামিত্মনিকেতনের কলাভবনে এসে ১৯৪৮ পর্যমত্ম তিনি এখানে অধ্যয়ন করেছেন। রবীন্দ্রনাথ পরলোকগত হলেও নন্দলাল-বিনোদবিহারী-রামকিঙ্করের মধ্যে তাঁর উদ্দীপনা তখনো বেঁচে ছিল। ফলে কলাভবনের আবহ তাঁকে ক্রমশ রূপামত্মরিত করে শিল্পের একজন সাধকে। শিক্ষকতাকেই মূল পেশা হিসেবে বেছে নিলেও সুব্রহ্মণ্যন্ পাশাপাশি দৃশ্যকলার অন্য নানা অভিব্যক্তি বিষয়ে তাঁর আগ্রহকে সমন্বিত করে তুলতে থাকেন। এসবের অন্যতম হলো আমরা যাকে ‘মাইনর আর্টস’ নামকরণ করেছি – গ্রামীণ ও আদিম জীবন থেকে উৎসারিত জীবন-সম্পৃক্ত শিল্প ও কারম্নকলা। শিক্ষকতা-জীবনে বিভিন্ন পর্বে তিনি গুজরাটের বরোদায় অবস্থিত এমএস বিশ্ববিদ্যালয়ের চারম্নকলা অনুষদ ও শামিত্মনিকেতনের কলাভবনে অতিবাহিত করেছেন। ১৯৮০ সালে তিনি বরোদা ছেড়ে তাঁর শিল্পশিক্ষার পীঠস্থান কলাভবনে স্থায়ীভাবে ফিরে যাওয়ার সিদ্ধামত্ম নেন এবং ১৯৮৯ পর্যমত্ম ওখানে শিক্ষকতা করে অবসরগ্রহণ করেন। ওই বছরই তাঁকে বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয় প্রফেসর এমেরিটাস নিযুক্ত করে। তা সত্ত্বেও ২০০৪ সালে সুব্রহ্মণ্যন্ আবার বরোদা ফিরে আসেন এবং মৃত্যু পর্যমত্ম ওখানেই বাস করেন। শিক্ষকতাকে পেশা হিসেবে নিলেও লোককলা ও কারম্নশিল্প বিষয়ে তাঁর আগ্রহ ও বিসত্মৃত জ্ঞানের কারণে বিভিন্ন সময় ভারত সরকারের নানা প্রতিষ্ঠানে উপদেষ্টা, ফেলো বা সদস্য হিসেবে তাঁকে দায়িত্ব পালন করতে হয়েছে, কখনো কখনো এ ধরনের আমত্মর্জাতিক সংস্থায়ও যুক্ত হয়েছেন তিনি।
রবীন্দ্রনাথ সম্পর্কে তাঁর আগ্রহ ও পঠন-পাঠন ব্যাপক, দৃশ্যকলার শিক্ষার্থী হিসেবে কলাভবনেই তাঁর শিল্পসত্তার বিকাশ এবং শেষজীবন শামিত্মনিকেতনেই অতিবাহিত করার সংকল্প, – এসব সত্ত্বেও আশি বছর বয়সে আবার বরোদায় ফিরে যাওয়ার সিদ্ধামত্ম এ দুটি প্রতিষ্ঠানকে নিয়ে তাঁর মানসিক দোলাচলের পরিচয়। এমনটি ভাবা হয় যে, পঞ্চাশের দশকে শামিত্মনিকেতনের পড়তি অবস্থার প্রেক্ষাপটে বরোদার উত্থান ঘটে এবং এ রসায়নে বিশেষ অবদান রেখেছেন বরোদার কিছু শিক্ষক, যাঁরা হয় শামিত্মনিকেতনে প্রশিক্ষিত অথবা অন্যভাবে এর সংস্পর্শে এসেছিলেন। শামিত্মনিকেতনের সঙ্গে বরোদার সংযোগের সূচনা ১৯৩০ সালে কীর্তিমন্দিরে রবীন্দ্রনাথের বক্তৃতার মাধ্যমে – যার শিরোনাম ছিল ‘ম্যান দ্য আর্টিস্ট’। তবে কলাভবনের শিল্পধারার সঙ্গে বরোদার সত্যিকার পরিচয়টি ঘটে কীর্তিমন্দিরেই নন্দলাল বসুর মন্দিরের চার দেয়ালজুড়ে করা ভিত্তিচিত্রগুলোর মাধ্যমে। নন্দলাল এই ভিত্তিচিত্রগুলো রচনা করেছেন ১৯৩৯ থেকে ১৯৪৬ সাল সময়কালে, এটি তাঁর জীবনের অন্যতম শিল্পকর্মও বটে। বরোদার শিল্প শিক্ষালয়টিকে কেন্দ্র করে আখ্যানমূলক শিল্পরচনার যে একটি নব্যধারার স্ফুরণ ঘটে তার অন্যতম কা-ারি হিসেবে তিনজন শিক্ষকের নাম উলেস্নখ করা চলে। তাঁরা হলেন এন এস বেন্দ্রে, শঙ্খ চৌধুরী ও কে জি সুব্রহ্মণ্যন্। এঁদের মধ্যে শঙখ চৌধুরী ও কে জি সুব্রহ্মণ্যন্ সরাসরি শামিত্মনিকেতন কলাভবনেরই জাতক। বেন্দ্রে ১৯৪৫ সালে কিছুদিন অতিথি অধ্যাপক হিসেবে শামিত্মনিকেতনে ছিলেন এবং কলাভবনের শিল্পীদের গভীর অমত্মর্দৃষ্টি ও শিল্পকে জীবনঘনিষ্ঠ করার ভাবনা তাঁকে আকৃষ্ট করেছিল। বেন্দ্রের এই মুগ্ধতা এবং শঙ্খ চৌধুরী ও সুব্রহ্মণ্যনের শামিত্মনিকেতনের পশ্চাদ্ভূমি বরোদায় শামিত্মনিকেতনের কলাভবনের বর্ণনাত্মক শিল্পধারার একটি নবতর বিকাশ ঘটায়, যা নিজেকে রূপামত্মরিত করে নেয় সমকালের আর্তি ও জটিলতার প্রেক্ষাপটে। শিল্পের তাত্ত্বিক পঠন-পাঠনকেও নতুন গুরম্নত্বে সাজানো হয়। ফলে সমকালীন ভারতীয় শিল্পের জগতে বরোদা-প্রশিক্ষিত অনেক শিল্পীই গুরম্নত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছেন। সুব্রহ্মণ্যনের শামিত্মনিকেতনে থাকার আগ্রহের বিপরীতে এর ক্ষয়িষ্ণু আবহ, অন্যদিকে বরোদার নবীন উদ্দীপনাময় পরিবেশ – তাঁর সিদ্ধামেত্ম টানাপড়েন সৃষ্টি করতেই পারে।
শিক্ষকতাকেই পেশা হিসেবে নিয়ে কর্মজীবন সূচিত করলেও এটি লক্ষ করা যায় যে, গতানুগতিক শিক্ষকতা তাঁর অভীপ্সা নয়, শিক্ষক-ছাত্রের সম্পর্ককে শামিত্মনিকেতনের আদলে আরো আদান-প্রদানমুখী করে তোলার বিভিন্ন উদ্যোগ তিনি গ্রহণ করছেন। ভিত্তিচিত্রের প্রচলন, শিক্ষক-ছাত্রের অংশগ্রহণে গ্রামীণ মেলার ধরনে বিবিধ শিল্পসম্মত বস্ত্ত নির্মাণ করে কলা-মেলা, শিল্প-সফর ইত্যাকার নানা কর্মকা–র মাধ্যমে ছাত্রদের দেশজ শিল্পের প্রাণের সঙ্গে পরিচয় ঘটানোর চেষ্টা করেছেন। পাশাপাশি নিজের স্বতন্ত্র শিল্পশৈলী নির্মাণের পথে প্রথমত তাঁর দৃষ্টি পশ্চিমের দিকে। তিনি কিউবিজম-উত্তর ধারার প্রয়াসগুলো পর্যবেক্ষণ করেন এবং ক্রমশ সেসবে নানা বিচ্যুতি ঘটিয়ে নিজস্ব রূপকল্পের দিকে এগোতে থাকেন। দৃশ্যকলার নানা প্রকাশমাধ্যমও তাঁকে আকৃষ্ট করে, ছাপচিত্র ছাড়াও বিশেষ করে মাটির ভাস্কর্য নির্মাণকলা তাঁকে বিশেষভাবে আকৃষ্ট করে। এর মাধ্যমে গ্রামীণ কুমোরের গড়া মূর্তি ও পুতুল, নানা মাধ্যমে তৈরি ব্যবহার্য বস্ত্তর সহজ নান্দনিকতা তাঁর দৃষ্টিতে গেঁথে যায়, তাঁর শিল্পরচনার অন্যতম একটি প্রকাশ হয়ে ওঠে মৃৎফলক বা মাটির রিলিফকাজ, যা বাংলার ঐতিহ্যিক শিল্পের অন্যতম উদাহরণও বটে। লোকশিল্পের – বিশেষ করে পটচিত্র ও লক্ষ্মীর সরা, মাটির পুতুল ও খেলনা, দেবীর প্রতিমারূপ আর কারম্নশিল্পের সমৃদ্ধ জগৎ হয়ে উঠতে থাকে তাঁর নিজ সৃজনজগতেরও অন্যতম প্রেরণাস্থল। একজন লোকশিল্পীর মতো সৃজনকর্মকে একটি আনন্দময় খেলার মতো অবিরাম সচল রেখে তিনি শিল্পের নানা মাধ্যম ও উপকরণে সৃজনশীলতার স্বকীয় শৈলী গড়ে তুলেছেন। তাঁর কাজের মধ্য দিয়ে ভারতের সমকালীন শিল্পের একটি স্বতন্ত্র ধারা নির্মিত হয়েছে, যার আপাত সারল্যের আড়ালে বহুমাত্রিক জটিল জীবনের প্রতিভাস বিম্বিত হয়ে ওঠে।
কে জি সুব্রহ্মণ্যন্ পশ্চিমের আঙ্গিকবাদী ধারার অনুসারীদের বিরম্নদ্ধে বিকল্প ভারতীয় এক আধুনিকতার সন্ধান করেছেন, যা অবনীন্দ্রনাথ-নন্দলাল ও শামিত্মনিকেতনের ধারা বয়ে বিনোদবিহারী-রামকিঙ্করের মধ্যে প্রতিভাত হতে শুরম্ন করেছিল। এর সঙ্গে তিনি সমন্বিত করেছেন লোকজ শিল্প ও কারম্নকলার ব্যবহারিক মূল্য, আর তিনি চেয়েছেন শিল্প হবে দৈনন্দিন জীবনের মধ্যে ক্রিয়াশীল ও প্রাসঙ্গিক। তাঁর অন্বেষা ছিল শিল্পের ব্যক্তিক অভিব্যক্তির এমন একটি প্রকাশ, যা সমাজের বহুমাত্রিক বিন্যাসের সঙ্গে আদান-প্রদান করতে সক্ষম। তাঁর প্রধান চারটি গ্রন্থে – মুভিং ফোকাস (১৯৭৮), দ্য লিভিং ট্র্যাডিশন (১৯৮৭), দ্য ক্রিয়েটিভ সার্কিট (১৯৯২) ও দ্য ম্যাজিক অব মেকিং (২০০৭) – বলা যায় পশ্চিম-অনুসৃত আধুনিকতাপন্থী মতের বিরম্নদ্ধে তিনি একধরনের লড়াই জারি রেখেছেন।
এভাবে পশ্চিম আর একেবারে স্থানিক লোকঐতিহ্যের সমন্বয়ে কে জি সুব্রহ্মণ্যন্ গড়ে নিতে থাকেন নিজের জন্য সমকালের এক স্বতন্ত্র রূপবন্ধ, যা যামিনী রায় ও অন্যদের উপরতল-স্পর্শী লোকপ্রভাব থেকে একেবারেই ভিন্ন। তাঁর চেয়ে সামান্য বয়োজ্যেষ্ঠ কামরম্নল হাসানের মধ্যে যে সম্ভাবনা পরিস্ফুট হয়ে উঠছিল, মৃত্যু এসে যবনিকা টেনে যার সমাপ্তি রচনা করল, হয়তো তার পূর্ণতার রূপ দেখি সুব্রহ্মণ্যনের মধ্যে। সুব্রহ্মণ্যন্ লোককলা আর কারম্নশিল্পের সরলতা, পরিহাস ও রঙ্গব্যঙ্গপ্রিয়তাকেও নিয়ে আসেন তাঁর মৃৎফলকে, তেলরংচিত্রে, গস্নাস পেইন্টিংয়ে। শামিত্মনিকেতনের আখ্যানধর্মী বিন্যাসে তিনি যুক্ত করেন লোককলার সহজিয়া উপস্থাপন আর নিজস্ব নির্মাণের পরিপক্বতা। সমকালের শিল্পে লোককলার প্রয়োগে সুব্রহ্মণ্যনের বৈশিষ্ট্য দৃশ্যমান তাঁর রূপনির্মাণের স্বতন্ত্রতায়। ভারতীয় ধর্ম ও পুরাণের পাত্র-পাত্রীরা তাঁর চিত্রকর্মে প্রাত্যহিক জীবনের অংশ হয়ে যায়, ভালো-মন্দ বা হাস্যরসের আখ্যানেও আমরা তাদের দেখি স্পন্দমান জীবনের অংশ হিসেবে। এভাবে যা বিধৃত হয় তাঁর নানাবিধ শৈল্পিক ক্রিয়াকলাপে তার সমন্বিত চেহারাটি হয়ে ওঠে সমকালের কিন্তু ভারতীয় এক কল্পকথার জগৎ, যা আবার একামত্মভাবে কে জি সুব্রহ্মণ্যনেরও একামত্ম স্বতন্ত্র শিল্পজগৎ।
শামিত্মনিকেতনের কলাভবন সুব্রহ্মণ্যনের শিল্পীসত্তার আদল নির্মাণে ভূমিকা রেখেছে আর বরোদার চারম্নকলা অনুষদের বৈশিষ্ট্য নির্মাণে অন্যতম পথনির্দেশক কে জি সুব্রহ্মণ্যন্। তবে শেষ পর্যমত্ম সুব্রহ্মণ্যন্ এসবকে ছাপিয়ে হয়ে উঠেছেন নিজ স্বকীয়তায় দীপ্র এক কলাকার, সমকালের শিল্পধারায় এক স্বতন্ত্র কণ্ঠ।