logo

শিল্প ও বাস্তব

আবদুল হাই 

\এক\

 

বাস্তবতা সকল শিল্পকর্মের বিষয়। শিল্পকর্মের দায়িত্ব ও ভূমিকা বাস্তবের রূপের প্রতিফলন। এ নিয়ে শিল্পের ইতিহাসে বিশেষ কোনো মতানৈক্য দেখা দেয় নি। এমনকি বিমূর্ত ধারার ছবির ক্ষেত্রেও এই ধারণা কাজ করেছে, কেননা বিমূর্ততার যে ফর্ম বা রূপ তার পেছনেও রয়েছে বাস্তব অর্থাৎ প্রকৃতি, মানুষ ও মানুষের পরিপার্শ্বের ফর্ম। যেমন, রেখা, বৃত্ত, আয়তক্ষেত্র, শূন্য ইত্যাদি এবং প্রকৃতিতে দৃশ্যমান বিভিন্ন রং যা শিল্পীর চেতনায় প্রভাব ফেলেছে। এখানে বলা নিষ্প্রয়োজন যে, সাহিত্যেও বাস্তবতার ভূমিকা প্রাধান্য পেয়েছে, যেহেতু সাহিত্যের বিষয়ও মানুষ ও প্রকৃতি এবং প্রকৃতি ও মানুষ, এই দুইয়ের দ্বান্দ্বিক সম্পর্কের ভিত্তিতে মানুষের যাপিত জীবন। শিল্প ও সাহিত্যে বাস্তবতা প্রধান হলেও দুটি ক্ষেত্রে এর তাত্ত্বিক এবং দার্শনিক ব্যাখ্যায় পার্থক্য রয়েছে যার জন্য শিল্পের ইতিহাস এবং সাহিত্যের ইতিহাস সমার্থক বা সমান্তরাল নয়, যদিও কখনো কখনো একটি অন্যটিকে প্রভাবান্বিত করেছে। যেমন, স্যুররিয়েলিজম বা পরাবাস্তববাদ নামে পরিচিত বাস্তবের একটি ব্যাখ্যা এবং শিল্পে ও সাহিত্যে তার ব্যবহার। অপরদিকে, অন্তত একটি ক্ষেত্রে ছবি এবং লেখায় ব্যবহৃত বর্ণমালা এক হয়েছে বলে দেখা যায়। এর উদাহরণ, প্রাচীন মিশরে হাইরোগিস্নফিক্স নামে পরিচিতি প্রতিকৃতির সমষ্টি (পিক্টোগ্রাম) নিয়ে তৈরি বর্ণমালা। চীন এবং জাপানের বর্ণমালাও পিক্টোগ্রামের ভিত্তিতে তৈরি যার জন্য ছবির রেখাই যে ভাষায় সংকেত বা চিহ্নের মতো ব্যবহৃত হচ্ছে, এ কথা বলা যায়। ভাষাবিজ্ঞানে সেমিওটিক থিয়োরি সে কথাই বলে। বর্তমান ডিজিটাল যুগে ই-মেইল বা টেক্সট মেসেজে শব্দ দিয়ে তৈরি বাক্যের শেষে যোগ করা হচ্ছে বিভিন্ন অভিব্যক্তি নিয়ে ছোট আকারে মানুষের মুখের ছবি যা জাপানে প্রথম শুরু হওয়ার জন্য নামকরণ হয়েছে ‘ই-মোজো’। হাইরোগিস্নফিক্সের ছবির মাধ্যমে যেমন বক্তব্য প্রকাশ করা হয়েছে লিখিতভাবে ভাষা ব্যবহার করে, ভাষা দিয়েও ছবির বর্ণনা বা ব্যাখ্যা করা হয়েছে এবং হচ্ছে। অবশ্য কেবল ভাষার সাহায্যে শিল্পকর্ম তৈরি করা যায় না, কেননা ভাষার বর্ণমালা রেখায় তৈরি হলেও পূর্ণাঙ্গ ভিস্যুয়াল ইমেজ বা দৃশ্যকল্প নয়। ‘গোয়ের্নিকা’ ছবির মাধ্যমে পিকাসো স্পেনের গৃহযুদ্ধের একটি ভয়াবহ হত্যাযজ্ঞের দৃশ্য এঁকেছেন। ভাষা ব্যবহার করে এই ধ্বংস ও মৃত্যুর ভয়াবহতা বর্ণনা করা যেত কিন্তু শিল্পকর্মের মতো প্রত্যক্ষভাবে প্রকাশ করা সম্ভব হতো না। কিছু বিষয় আছে যা ছবির সাহায্যে যেমন তাৎক্ষণিকভাবে সরাসরি উপস্থাপিত করা যায় এবং তার ফলশ্রম্নতিতে দর্শকের মনে তীব্র প্রতিক্রিয়ার সঞ্চার হয়, ভাষার বর্ণনায় সেই ক্ষমতা নেই। এর কারণ, ছবির আবেদন প্রধানত এবং প্রথমত ইন্দ্রিয়ের কাছে, ভাষার আবেদন শ্রোতা/পাঠকের মননের ওপর নির্ভরশীল। ছবিও মননের কাছে আবেদন রাখে তবে তা কার্যকর হয় ইন্দ্রিয়ভিত্তিক প্রাথমিক অভিজ্ঞতা অর্জন এবং তার প্রতিক্রিয়ার পরবর্তী পর্যায়ে। ছবির দৃশ্য মননের কাছে তাৎক্ষণিকভাবে পৌঁছায় না।

 

\দুই\

এই লেখা শিল্প বিষয়ে, যার জন্য সাহিত্যের প্রসঙ্গ তখনি আসবে যখন তার প্রয়োজন হবে অথবা তার উল্লেখে প্রাসঙ্গিকতা থাকবে। শিল্প ও বাস্তবের সম্পর্ক নিয়ে আলোচনায় যাওয়ার আগে এই শব্দ দুটির ব্যাখ্যা দেওয়া হলে সুবিধাজনক হবে, কেননা অধিকাংশ শব্দেরই একাধিক অর্থ আছে যার জন্য একটি শব্দ কোন অর্থে ব্যবহৃত হচ্ছে তা নির্দিষ্ট করে দেওয়া প্রয়োজন। ‘শিল্প’ বলতে এখানে বোঝানো হয়েছে ভিস্যুয়াল আর্ট বা দৃশ্যশিল্প এবং পস্নাস্টিক আর্ট। পস্নাস্টিক আর্ট বলতে সাধারণত ভাস্কর্য বোঝানো হলেও ভিস্যুয়াল আর্টের (যেমন, চিত্রকলা) ক্ষেত্রেও এর প্রয়োগ করা হয়, কেননা এটি একটি বৈশিষ্ট্য (ত্রিমাত্রিকতা) যা ভিস্যুয়াল আর্টেও দেখা যায়। কারুশিল্প, যা দৈনন্দিন জীবনে ব্যবহৃত হয় এবং পরিবর্তনশীল পদ্ধতির পরিবর্তে ঐতিহ্যের পরম্পরায় লোকায়ত শৈলীর অনুসরণে তৈরি, সেসব সৃষ্টি ‘শিল্পে’র অন্তর্ভুক্ত বলে মনে করা হয় না। চারুশিল্পের (ভিস্যুয়াল আর্ট) বিবর্তনে কারুশিল্পের (ক্র্যাফট) ভূমিকা অথবা প্রভাব প্রয়োজনে যথাস্থানে উল্লেখ করা হবে। যদিও পেস্নটো এবং অ্যারিস্টটল কারুশিল্পকে শিল্প বলে গণ্য করেছেন, বিংশ শতাব্দীতে শিল্প-সমালোচক এবং ঐতিহাসিক কলিংউড কারুশিল্পকে শিল্পের সমতুল্য বলে মনে করেন নি (১৯৩৮)। তাঁর মতো আরো অনেকে একই মত পোষণ করেন। শিল্পের অর্থ কী, সংক্ষিপ্ত বর্ণনায় তার ব্যাখ্যা দেওয়া হলে সবকিছু বলা হয় না। বর্ণনায় ব্যাখ্যা একটা সাধারণ পরিচিতি দেয় মাত্র, সংজ্ঞা দেওয়া হলে সাধারণ পরিচিতি সুনির্দিষ্ট হয়ে ওঠে। শিল্পের সংজ্ঞা বিভিন্ন শিল্প-সমালোচক এবং তাত্ত্বিক নিজের উপলব্ধি ও অভিজ্ঞতার ভিত্তিতে দিয়েছেন যার জন্য এখানে মিল যেমন রয়েছে, বিভিন্নতাও দেখা যায়। কয়েকজনের দেওয়া সংজ্ঞা একসঙ্গে বিবেচনা করা হলে শিল্পের পরিচিতি ‘সুনির্দিষ্ট’ হওয়ার সুযোগ থাকে। অনেক সংজ্ঞার মধ্যে কয়েকজনের দেওয়া সংজ্ঞা নিচে বর্ণনা করা হলো।

প্রথম সংজ্ঞাটি ক্লাইভ বেলের (১৯১৪) যা তিনি তাঁর লেখা আর্ট বইতে দিয়েছেন। তিনি বলেছেন, সব শিল্পেরই একটি সাধারণ বৈশিষ্ট্য রয়েছে যার অবর্তমানে সেটি শিল্প হিসেবে বিবেচিত হতে পারে না। এই সাধারণ বৈশিষ্ট্য হলো ‘তাৎপর্যপূর্ণ রূপ’ (সিগনিফিকেন্ট ফর্ম)। তাঁর সংজ্ঞা অনুযায়ী ‘তাৎপর্যপূর্ণ রূপ’টি সৃষ্টি হয় যখন রেখা এবং রঙের মিশ্রণ এমনভাবে ঘটে যা নান্দনিক অনুভূতির সঞ্চার করে (১৯১৪)। এই ‘তাৎপর্যপূর্ণ রূপ’ বা ‘সিগনিফিকেন্ট ফর্ম’কে তিনি কেবল শিল্পীর সৃষ্টিতে নয়, প্রকৃতির মধ্যেও দেখা যায়, এ কথা বলেছেন। তাঁর এই উক্তি মূল্যবান এই জন্য যে, বাস্তবের (প্রকৃতির) রূপই শিল্পের রূপ সৃষ্টি করে বা করতে ভূমিকা রাখে, এখানে তার স্বীকৃতি রয়েছে। এর ভিত্তিতে এই উপসংহারে আসা যায় যে, তিনি শিল্পকে প্রকৃতির (বাস্তবের) অনুকরণ বা প্রতিফলন বলে মনে করেছেন যদিও এই তত্ত্ব তাঁর সংজ্ঞার অন্তর্ভুক্ত নয়। ক্লাইভ বেলের বই আর্ট প্রকাশিত হওয়ার সতেরো বছর পর, ১৯৩১ সালে শিল্প-সমালোচক হার্বার্ট রিড তাঁর মিনিং অফ আর্ট বইতে শিল্পের যে সংজ্ঞা দিয়েছেন তা হলো কোনো বস্ত্তর আকার (শেপ), উপরিতল (সারফেস) এবং পরিমাণ বা ভরের (ম্যাস) মাত্রা এমনভাবে সাজানো যা আনন্দদায়ক অনুভূতির সঞ্চার করে (১৯৩১)। ক্লাইভ বেল এবং হার্বার্ট রিডের সংজ্ঞার মধ্যে এত মিল যে, হার্বার্ট রিড তাঁর পূর্বসূরির বই পড়ার পর নিজের সংজ্ঞা নিরূপণ করেছিলেন কিনা সেই প্রশ্ন দেখা দেয়। কিন্তু তাঁর বইতে কোথাও ক্লাইভ বেলের দেওয়া সংজ্ঞার উল্লেখ নেই। তাঁর মতো একজন বিজ্ঞ গবেষক এবং শিল্প বিশেষজ্ঞ অন্যের অনুকরণ করেছেন অথবা অন্যের দেওয়া সংজ্ঞার পুনরাবৃত্তি করেছেন, এ কথা না বলে ‘গ্রেট মেন থিংক অ্যালাইক’, এমন মনে করা যায়। একটি বিষয় একইভাবে প্রতিভাত হলে দুজন কেন, অনেকেই একই সিদ্ধামেত্ম পৌঁছাতে পারেন। এই যুক্তির প্রমাণ পাওয়া যায় ১৯৯৮ সালে লেখা শিল্প-সমালোচক জুলিয়ান বেল যখন তাঁর হোয়াট ইজ পেইন্টিং? বইতে লেখেন, ‘শিল্পীরা প্রকৃতিতে যা কিছু তাৎপর্যপূর্ণ ও অর্থময় এবং সুন্দর, তারই অনুকরণ করেন, তখন শিল্পের সংজ্ঞা সম্বন্ধে ধারণা যে অনেক তাত্ত্বিক/সমালোচকের কাছেই এক মনে হয়েছে, এই উপলব্ধিও দৃঢ় হয়।’ জুলিয়ান বেল এই সংজ্ঞা দেওয়ার পর উল্লেখ করেছেন যে, ইউরোপের একাডেমিতে শিল্পে বাস্তব অনুকরণের যে সূত্র সেখানে হয়েছে প্রকৃতি থেকে দৃশ্য নির্বাচনের (প্রয়োজনে একটি দৃশ্যের সঙ্গে অন্য একটি দৃশ্যের অংশ যোগ করে) ওপর জোর দেওয়া হয়েছে। তাঁর এই মন্তব্যে শিল্পে বাস্তবতার প্রতিফলন বা রূপায়ণ যে ক্লাসিক্যাল পর্ব থেকে উত্তর-রেনেসাঁ পর্ব (তখনই অধিকাংশ একাডেমি প্রতিষ্ঠিত হয়) পর্যন্ত অনুকরণবাদের (ইমিটেশন থিয়োরি) ওপর নির্ভর করেছে এর উল্লেখ রয়েছে এবং সেই সঙ্গে ‘দৃশ্য নির্বাচন’ ও ‘একাধিক দৃশ্যের সংযোজন’-এর কথা যোগ করে বাস্তবের হুবহু অনুকরণের পরিবর্তে সৃজনশীলভাবে করা হয়েছে, সেই বিষয়টির প্রতিও দৃষ্টি আকর্ষণ করা হয়েছে। তিনজনের সংজ্ঞাতেই ‘তাৎপর্যপূর্ণ রূপ’ সৃষ্টি, যা আনন্দদায়ক, তার ওপর জোর দেওয়া হয়েছে। হার্বার্ট রিড অন্য দুজনের মতো প্রকৃতি (বাস্তবতা) থেকে রূপ গ্রহণ করার কথা না বললেও এই বিষয়টি তাঁর সংজ্ঞায় সুপ্ত রয়েছে, কেননা তিনি বস্ত্তর আকার, উপরিতল এবং ভরের কথা বলেছেন, যেসবের উৎসব বাস্তবেই। তিনজনই ‘সিগনিফিকেন্ট ফর্মে’র (হার্বার্ট রিড এ কথাটি স্পষ্টভাবে না বলে পরোক্ষে ‘সাজানো’ বলেছেন) এবং তার দ্বারা সৌন্দর্য সৃষ্টির উল্লেখ করেছেন। ‘তাৎপর্যপূর্ণ রূপ’ সৃষ্টির ফলে আনন্দ অনুভূত হয়, এই নান্দনিক বৈশিষ্ট্যের কথা ক্লাইভ বেল এবং হার্বার্ট রিড স্পষ্ট করে বললেও, জুলিয়ান বেল বলেন নি। কিন্তু শিল্প প্রকৃতির তাৎপর্যপূর্ণ দৃশ্য অনুকরণ করে, এ কথা বলার মধ্যেও নান্দনিক উদ্দেশ্য নিহিত, এমন অনুমান করা যায়। তিনটি সংজ্ঞায় যে বৈশিষ্ট্যগুলি সাধারণ বলে দেখা যায় তা হলো : (ক) তাৎপর্যপূর্ণ রূপ সৃষ্টি (খ) বাস্তব (প্রকৃতি) থেকে নেওয়া হলেও তার হুবহু অনুকরণ নয়, নির্বাচন কিংবা সংগঠনের (অ্যারেঞ্জমেন্ট) মাধ্যমে সাজানো এবং (গ) আনন্দদায়ক অনুভূতি সৃষ্টি। জুলিয়ান বেল আনন্দদায়ক হওয়ার কথা ব্যবহার করেন নি, কিন্তু ‘প্রকৃতিতে যা কিছু সুন্দর’ এই কথা বলেছেন যার মধ্যে নান্দনিকতার প্রসঙ্গ এসে গিয়েছে। এঁদের তিনজনের সংজ্ঞায় ‘সুন্দরে’র ভূমিকার প্রতি যে ভিন্নমত দেওয়া হয়েছে তার ব্যাখ্যা দেওয়া প্রয়োজন, কেননা ইন্দ্রিয়ভিত্তিক সৌন্দর্যজ্ঞান আর মননভিত্তিক সৌন্দর্যজ্ঞান এক নয়, যে পার্থক্যের কথা এঁরা কেউ উল্লেখ করেন নি। মননভিত্তিক সৌন্দর্যজ্ঞান যা ‘অসুন্দর’ তার মধ্যেও সৌন্দর্য উপলব্ধি করতে পারে।

ওপরের তিনজনের সংজ্ঞায় শিল্পের ‘রূপ’ বা ‘ফর্ম’ই প্রাধান্য পেয়েছে। এই ‘ফর্মালিস্ট’ সংজ্ঞা (যা ফর্মভিত্তিক) অনেকের কাছে গ্রহণযোগ্য মনে হয় নি। তাঁরা শিল্পকে দেখেছেন শিল্পীর অনুভূতি প্রকাশের মাধ্যম হিসেবে অথবা অনুভূতির বাহন হিসেবে। শিল্পের ‘প্রকাশবাদী’ সংজ্ঞা যাঁরা দিয়েছেন তাঁদের মধ্যে রয়েছেন লিও টলস্টয় (১৮৯৮) এবং জন হসপার্স (১৯৬৭)। ‘হোয়াট ইজ আর্ট’ প্রবন্ধে টলস্টয় বলেছেন, ‘যদি দর্শকরা শিল্পীর অনুভূতি দ্বারা আলোড়িত হয় তাহলে তার সৃষ্টিকে শিল্প বলা যাবে।’ তিনি এরপর শিল্পে অনুভূতি প্রকাশের পদ্ধতি সম্বন্ধে বলেছেন : ‘শিল্পীর যে অভিজ্ঞতা হয়েছে নিজের মধ্যে সেটি পুনর্বার জাগ্রত করতে পারলে এবং জাগ্রত করে রেখা, শব্দ, অথবা কথার সাহায্যে প্রকাশ করে অন্যের মধ্যে একই অনুভূতির সঞ্চার করাই হলো শিল্প।’ তিনি আরো বলেছেন : ‘শিল্প হলো মানুষের সেই সৃষ্টি যার দ্বারা সচেতনভাবে নিজের অনুভূতিকে শিল্পের উপকরণের সাহায্যে অন্যের মধ্যে সঞ্চার করা যায়।’

জন হসপার্স একজন নন্দনতাত্ত্বিক-দার্শনিক এবং শিল্প-সমালোচক। তিনিও শিল্পের সংজ্ঞায় ‘প্রকাশবাদী’ তত্ত্বকে (এক্সপ্রেসনিস্ট থিয়োরি) প্রাধান্য দিয়েছেন, তবে এ ক্ষেত্রে তাঁর সঙ্গে টলস্টয়ের দেওয়া ব্যাখ্যার পার্থক্য রয়েছে। তাঁর মতে, শিল্প ‘রূপ’ (ফর্ম) সৃষ্টি করে, এ বিষয়ে সন্দেহ নেই এবং সেই ‘রূপ’ সৃষ্টিতে শিল্পের (ফর্মালিস্ট আর্ট) নিয়ম-রীতির অনুসরণ অবশ্যই করতে হবে কিন্তু তাহলেই তাকে শিল্প বলা যাবে না। যে ‘রূপ’ সৃষ্টি হয়েছে তার মাধ্যমে নির্দিষ্ট কোনো মানবিক অনুভূতি প্রকাশ করতে হবে। তিনি স্বাধীনভাবে ‘আবেগ’ আর ‘অনুভূতি’র মধ্যে পার্থক্য করেছেন। আবেগ প্রকাশ করা হয় সরব হয়ে, অনুভূতির প্রকাশের জন্য ভাষার বা ব্যাখ্যার প্রয়োজন নেই। ‘যে শিল্পকর্মের ভেতরই অনুভূতি নিহিত এবং সেটি তার অন্তর্গত বৈশিষ্ট্য, সেই শিল্পকর্মই প্রকাশবাদী।’ তিনি এই প্রসঙ্গে টলস্টয়, বেনেদিতো ক্রোচে এবং আর জি কলিংউডের কথা উল্লেখ করে বলেছেন যে, তাঁরাও শিল্পকর্মকে প্রকাশবাদী হতে হবে মনে করেছেন কিন্তু তাঁরা চেয়েছেন শিল্পী সৃষ্টির সময় যে আবেগ (টলস্টয়ের মতে অভিজ্ঞতার অনুভূতি) অনুভব করেন তার প্রকাশই শিল্প। কিন্তু হসপার্স ‘আবেগ’ প্রকাশ করাকে নয়, শিল্পকর্মের ফর্মের ভেতরই ‘অনুভূতি’ (আবেগ নয়) সৃষ্টি করাকে শিল্প বলে মনে করেছেন। এই আলোচনা থেকে দেখা যায় যে, শিল্পের প্রকাশবাদী যে তত্ত্ব সেখানে তাত্ত্বিকদের মধ্যে মৌলিক মতপার্থক্য রয়েছে। শিল্পে বাস্তবতার প্রতিফলন প্রসঙ্গে হসপার্সের মতই গ্রহণ করা যায়।

আরো অনেকের সংজ্ঞা দেওয়া যেতে পারে কিন্তু তার ফলে আলোচনা দীর্ঘ হবে এবং বিভ্রামিত্মরও সৃষ্টি হতে পারে। ওপরে যেসব সংজ্ঞা দেওয়া হলো তার ভিত্তিতে সংক্ষেপে এখন বলা যায় যে, শিল্প হলো তাৎপর্যময় রূপ সৃষ্টি যার অন্তর্নিহিত অনুভূতি (একে ব্যাপক অর্থে সৌন্দর্যবোধও মনে করা যায় যেখানে সুন্দর ও অসুন্দর, দুই-ই আছে) দর্শককে আনন্দ দেয়। এই সংজ্ঞায় শিল্পে বাস্তবের প্রতিফলন সম্পর্কে প্রত্যক্ষভাবে কিছু বলা হয় নি কিন্তু তাৎপর্যময় রূপ সৃষ্টির জন্য যে বাস্তবের ব্যবহার প্রয়োজন, এই বিষয়টির প্রতি ইঙ্গিত দেওয়া হয়েছে। বাস্তবের ব্যবহার অনুকরণের অথবা অন্য কোনো পদ্ধতির মাধ্যমে করা হবে কিনা, সেই বিষয়টি অবশ্য উহ্য রয়েছে। পরবর্তীতে শিল্পে বাস্তবের প্রতিফলন নিয়ে বিশদ আলোচনা হবে।

শিরোনামের দ্বিতীয় শব্দ ‘বাস্তবের’ সাধারণ জ্ঞানভিত্তিক সংজ্ঞা হলো যার অভিজ্ঞতা পঞ্চেন্দ্রিয়ের সাহায্যে অর্জন করা যায়। এর মধ্যে রয়েছে দৃশ্য, বর্ণ, শব্দ, ঘ্রাণ ও স্পর্শ। দৃশ্য ও বর্ণ চোখ দিয়েই দেখা যায়, যার জন্য সহজেই ভিস্যুয়াল আর্ট বাস্তবের এই দুটি ‘রূপ’কে (দৃশ্য ও বর্ণ) প্রতিফলন করে। স্পর্শের অভিজ্ঞতা হতে পারে পস্নাস্টিক আর্টের (মূলত ভাস্কর্য) মাধ্যমে, ফলে ইন্দ্রিয়ভিত্তিক বাস্তবের এই তৃতীয় রূপটিও শিল্পে প্রতিফলিত করা যায়। শিল্পের ইতিহাসে দীর্ঘকাল ঘ্রাণ ও শব্দ শিল্পকর্মে প্রতিফলিত করা যেত না। এখন ইনস্টলেশন আর্টে গন্ধ সৃষ্টি করা যায় সহজেই (লোবান জ্বালিয়ে, সুগন্ধী কিছু ব্যবহার করে) যার জন্য ইন্দ্রিয়জ বাস্তবতার এই চতুর্থ রূপটিও শিল্পকর্মে প্রতিফলিত হয়েছে। মাল্টিমিডিয়া আর্টের মাধ্যমে টেলিভিশনের ব্যবহার ‘শব্দ’কেও শিল্পের অন্তর্ভুক্ত করতে পেরেছে খুব সফলভাবে। সুতরাং বর্তমানে শিল্পে ইন্দ্রিয়ভিত্তিক বাস্তবতার পাঁচটি রূপই প্রতিফলিত হচ্ছে অথবা হতে পারছে।

বিজ্ঞানের আবিষ্কার মানুষের জীবন ও প্রকৃতিকে যতটা প্রভাবান্বিত শুধু নয়, পরিবর্তিত করেছে জ্ঞানের অন্য কোনো শাখা সেভাবে পারে নি। এসব আবিষ্কার সৃষ্টি করেছে নতুন বাস্তবতা যার কিছু পঞ্চেন্দ্রিয় দ্বারা অভিজ্ঞতায় আসে, এবং কিছু আবিষ্কার পঞ্চেন্দ্রিয়ের সাহায্যে সরাসরি অভিজ্ঞতায় না এলেও বিজ্ঞানের ব্যাখ্যার মাধ্যমে জানা যায়। যেমন, বিগ ব্যাং থিয়োরির ভিত্তিতে মহাবিশ্বের সৃষ্টির ইমেজ অথবা সৌরজগতের কিংবা নীহারিকাপঞ্জির ইমেজ। বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির সৃষ্টি বিভিন্ন মেশিন, যন্ত্রপাতি, যানবাহন ও অন্যান্য বস্ত্তর অভিজ্ঞতা পঞ্চেন্দ্রিয়ের সাহায্যেই অর্জিত হতে পারে। ইন্দ্রিয়ের সাহায্যে অথবা ইন্দ্রিয়ের বাইরের বৈজ্ঞানিক বাস্তবতাও এখন শিল্পের বিষয় হয়েছে। এর ফলে সাধারণ জ্ঞানভিত্তিক ইন্দ্রিয়জ বাস্তবতার সংজ্ঞা ও ব্যাখ্যার বিসত্মৃতি ঘটেছে। আবার প্রযুক্তিভিত্তিক অনেক ব্যবহার্য বস্ত্তও ইনস্টলেশন আর্টের আকারে শিল্পকর্ম হিসেবে স্বীকৃতি পেয়েছে। যেমন, মার্শাল দুশাম্পের ‘ফাউন্টেন’ নামের ইনস্টলেশন যা আসলে একটি চিনেমাটির তৈরি ইউরিনাল।

পঞ্চেন্দ্রিয়ভিত্তিক বাস্তবের বাইরে রয়েছে দর্শনভিত্তিক বাস্তব যা যুক্তি দিয়ে ব্যাখ্যা করা হয়। এই বাস্তবের দৃশ্য, বর্ণ, শব্দ, ঘ্রাণ বা স্পর্শের কোনো বৈশিষ্ট্য নেই যা বিজ্ঞানভিত্তিক বাস্তবতার অনেক ‘রূপে’র মধ্যে রয়েছে। এই কারণে দর্শন বাস্তবতা নিয়ে দীর্ঘদিন আলোচনা করে এলেও সাধারণত দার্শনিক বাস্তবতার শিল্পরূপ দেওয়া সম্ভব হয় নি। কিন্তু যেসব ধর্ম বা ধর্মীয় আচার দার্শনিক পদ্ধতির অনুসরণ করেছে সে ক্ষেত্রে ধর্মীয় দর্শন শিল্পের বিষয় হয়েছে। যেমন, সুফি দর্শন, জৈন-বৌদ্ধ দর্শন এবং তান্ত্রিক দর্শন ধ্যানের (মেডিটেশনের) মাধ্যমে বিমূর্ত রূপের (ফর্মের) কল্পনা করেছে। যেমন, বৃত্ত, রেখা, বিন্দু ও অন্যান্য চিহ্ন। এইসব দার্শনিক ‘বাস্তবতা’ শিল্পের বিষয় হয়েছে। ধর্মীয়/আধ্যাত্মিক দর্শনের এইসব ফর্ম এককভাবে অথবা মোটিফ হিসেবে শিল্পকর্মের বিষয় অথবা বিষয়ের অংশ হয়েছে।

প্রাচীনকাল থেকেই প্রকৃতি ও মহাবিশ্বের পেছনে দৈবশক্তির উপস্থিতির কথা কল্পনা করা হয়েছে এবং সেইসব দৈবশক্তি বিমূর্ত রূপ থেকে ধীরে ধীরে মূর্ত আকার ধারণ করেছে যার মধ্যে রয়েছে মানুষ-সদৃশ্য জীব, জীব-জন্তু এবং পাখির দেহের বৈশিষ্ট্যপূর্ণ রূপ (ফর্ম)। মিথলজির এইসব ‘রূপ’ এককভাবে অথবা প্রকৃতি সংলগ্ন হয়ে অবাস্তবের প্রতিনিধিত্ব করলেও শিল্পের বিষয় বলে গণ্য হয়েছে।

 

\চার\

শিল্প ও সাহিত্যের বিষয় বাস্তবতার প্রতিফলন। যখন শিল্প ও সাহিত্যকে বিমূর্ত বা প্রতীকীরূপে দেখা হয় তখনো তাদের বাস্তবের সঙ্গে সম্পর্ক উপেক্ষা করা হয় না। প্রত্যক্ষভাবে না হলেও শিল্প ও সাহিত্যে বাস্তব উপস্থিত থাকে। বাস্তবতার অভাবে সাহিত্য হবে হয় রূপকতা অথবা কল্পবিজ্ঞান। একইভাবে শিল্পে বাস্তবতাকে বর্জন করার চেষ্টা করা হলে সেই সৃষ্টি শিল্পকর্ম না হয়ে হবে অর্থহীন আঁকিবুকি (ডুডলস্) বা হোলি খেলার মতো রঙের যথেচ্ছ এবং উদ্দেশ্যবিহীন ব্যবহার। যত সামান্যভাবেই হোক, শিল্প ও সাহিত্যে বাস্তবের ভূমিকা তাদের সঙ্গে জীবন ও জগতের সম্পর্ক স্থাপিত করে। যে শিল্প বা সাহিত্য বাস্তবতাবর্জিত সেইসব জীবনযাপনের সঙ্গে সম্পর্কহীন এবং সেই কারণে মানুষের জীবন অপ্রয়োজনীয় ও অর্থহীন। কোনো যুগেই শিল্প ও সাহিত্য বাস্তব থেকে সম্পূর্ণ মুখ ফিরিয়ে নেয় নি, কেননা তাহলে শিল্পের উৎস ও ভিত্তিকেই অস্বীকার করা হয়।

শিল্পে ও সাহিত্যে বাস্তবের ভূমিকা কম হবে, না বেশি হবে, এই নিয়ে বিতর্ক হতে পারে। এর চেয়েও গুরুত্বপূর্ণ হলো শিল্প ও সাহিত্যে বাস্তবের প্রতিফলন কোন পদ্ধতিতে এবং কী মাত্রায় হবে, সেই বিষয়। বাস্তবের প্রতিফলন পদ্ধতি ও প্রক্রিয়াকে কেন্দ্র করে শিল্পে যে পরিবর্তন এসেছে তাকে রক্ষণশীল ভাষায় ‘বিবর্তন’ বলা যায়। অপরদিকে প্রগতিশীলদের দৃষ্টিতে এই পরিবর্তন বিপস্নবের সমতুল্য। যে অভিধাতেই উল্লেখ করা হোক, শিল্পে বাস্তবের প্রতিফলন পদ্ধতি নিয়ে বিভিন্ন সময়কালে গড়ে উঠেছে ভিন্ন ভিন্ন নামের শিল্প আন্দোলন; সেইসবের কোনোটি হয়েছে ক্ষণস্থায়ী, কোনোটির স্থায়িত্ব মধ্য মেয়াদের কিন্তু কোনোটি দীর্ঘস্থায়ী হয়েছে এমন বলার উপায় নেই। শিল্পে বাস্তবের প্রতিফলনের ভিন্নতা এসেছে শিল্পীর দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তনের ফলে, যার পেছনে কাজ করেছে আর্থ-সামাজিক-রাজনৈতিক পরিবর্তন অর্থাৎ সংস্কৃতির পরিবর্তন। শিল্পে বাস্তবের প্রতিফলনে শিল্পচর্চার অভিজ্ঞতা, নতুন শিল্প উপকরণের লভ্যতা এবং নতুন মাধ্যমও ভূমিকা রেখেছে উল্লেখযোগ্যভাবে।

শিল্পের ইতিহাসে সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য হলো বাস্তবের প্রতিফলনে তার পদ্ধতি ও রীতিনীতি এবং আদর্শ ও লক্ষ্যের বিবর্তন। এই অর্থে শিল্পে বাস্তবের প্রতিফলনের ইতিহাসই হলো শিল্পের ইতিহাস। যখন এই নিয়মিত পরিবর্তন বন্ধ হয়ে যাবে শিল্প সৃষ্টি হবে অনড়, অচল, বরফ-জমাট স্থির। তাকে বলা যাবে ‘এন্ড অফ আর্ট’। কেউ কেউ এমন ভবিষ্যদ্বাণী করেছেন (ডান্টো, ১৯৬৪)। কিন্তু শিল্পের ইতিহাসে ক্রমাগত বাঁকবদল তাঁদের মত সমর্থন করে না। এই লেখায় শিল্পে পরিবর্তনশীল পদ্ধতি ও শৈলী যার সাহায্যে বাস্তব প্রতিফলিত হয়েছে এবং হচ্ছে, সেইসবই প্রধান আলোচ্য বিষয়। সংক্ষেপে বলতে গেলে, এখানে শিল্পে বাস্তবের প্রতিফলন নিয়ে যতটা নয় তার চেয়ে বেশি প্রতিফলনের উপায় ও পদ্ধতির বর্ণনা এবং ব্যাখ্যার ওপর বেশি গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে।

 

\পাঁচ\

সমালোচকদের মধ্যে শিল্পে বাস্তবতার প্রতিফলন নিয়ে যে আলোচনা এবং বিতর্ক সেটি প্রাচীনকাল থেকেই চলে আসছে। এই প্রসঙ্গে যে ধারণা দীর্ঘদিনের এবং সুপরিচিত তা হলো, শিল্পকর্ম বাস্তবতার অনুকরণ। মানুষ শিল্প সৃষ্টি করেছে তার অনুকরণ ক্ষমতার জন্য। এই ক্ষমতা তার সহজাত প্রবৃত্তি। অনুকরণের মতো সৃজনশীলতাও যে মানুষের সহজাত প্রবৃত্তি এর উল্লেখ কেউ করেন নি। একই কারণে শিল্প সৃষ্টিতে এই সহজাত প্রবৃত্তির ভূমিকার কথাও উহ্য থেকে গিয়েছে। প্রচলিত ধারণা অনুযায়ী যাদের মধ্যে অনুকরণ ক্ষমতা বেশি ছিল এবং এখনো আছে তারা শিল্পী হিসেবে অন্যের তুলনায় দক্ষতার নিরিখে এগিয়ে থেকেছে এবং সফল শিল্পী হিসেবে পরিচিতি পেয়েছে। প্রাচীনকাল থেকে আধুনিক শিল্পের আগে পর্যন্ত এই ধারণা শিল্প সমালোচনায় ব্যবহৃত হয়েছে। যদিও অনুকরণ ক্ষমতার সঙ্গে সৃজন ক্ষমতা প্রাচীনকাল থেকেই ব্যবহার হয়েছে, শেষেরটি শিল্পের আলোচনায় এসেছে অনেক পরে। এই সৃজন ক্ষমতার ব্যবহার করা হয়েছে বাস্তবের প্রতিফলনে আইডিয়ালাইজেশন, স্টাইলাইজেশন এবং অ্যাবস্ট্র্যাকশনের শৈলী ব্যবহারের জন্য, কিন্তু এর প্রত্যেকটি পদ্ধতির পেছনেই ন্যূনতম মাত্রায় হলেও অনুকরণ পদ্ধতি থেকেছে এবং এখনো তা অক্ষুণ্ণ।

প্রচলিত ধারণার ভিত্তিতে শিল্প-ইতিহাসে দীর্ঘকাল প্রধান বিষয় ছিল, বাস্তবের হুবহু অনুকরণ করা হয়েছে, না ত্রুটিপূর্ণভাবে অনুকরণ করা হয়েছে? এই প্রশ্ন। এর মধ্যে সৃজনশীলতার বিষয়টি পরোক্ষেও আসে নি। প্রথমে অনেকে মনে করেছেন যে, শিল্প অনুকরণ দিয়ে শুরু হয়েছে প্রাগৈতিহাসিক যুগে এবং তারপর ক্রমে ধারাবাহিকভাবে সৃজনশীলতার সাহায্যে অগ্রসর হয়েছে, কখনো অনুকরণকে ন্যূনতম পর্যায়ে রেখে বা একেবারে ত্যাগ করে। কিন্তু যখন অনেক দৃষ্টান্ত দেখা গেল যে, প্রাগৈতিহাসিক যুগেই মানুষ একই সঙ্গে অনুকরণভিত্তিক এবং সৃজনশীল শিল্প সৃষ্টি করেছে তখন তর্ক শুরু হয়ে গেল। সেই প্রসঙ্গে পরে আসা যাবে। এই পর্যায়ে যা মনে রাখা গুরুত্বপূর্ণ তা হলো, শিল্পের ইতিহাস সরল রেখায় অগ্রসর হয় নি, প্রথম থেকেই শিল্পের জগৎ ছিল বিচিত্র এবং একাধিক বৈশিষ্ট্যপূর্ণ। এই বৈচিত্র্যের মধ্যে যা অনুসন্ধানের বিষয় (বর্তমান লেখার দৃষ্টিকোণ থেকে) তা হলো বাস্তবতার সঙ্গে শিল্পের সম্পর্ক। কখন, কীভাবে এবং কী উদ্দেশ্যে শিল্পে বাস্তবতার প্রতিফলন ঘটেছে, এই ব্যাখ্যা শিল্পের অগ্রগতির ইতিহাসও বটে। অনুকরণ গুরুত্বে হ্রাস পেয়েছে মনে করা হলেও শিল্প বাস্তবতা থেকে সরে এসেছে কিংবা তার প্রতিফলনে আগ্রহ নেই, এ কথা বলারও উপায় নেই, কেননা বাস্তবতা কেবল অনুকরণের মাধ্যমে না, সৃজনশীলতার সাহায্যেও প্রতিফলিত হয়েছে এবং হচ্ছে। শিল্পের উৎসই হলো বাস্তব, যেভাবেই সে বাস্তবের সংজ্ঞা বা ব্যাখ্যা দেওয়া হোক না কেন। আর সেই বাস্তবের প্রতিফলন শিল্পে প্রথম থেকেই ঘটেছে, অনুকরণ এবং সৃজনশীলতা উভয়ের সাহায্যে। শুধু অনুকরণের মাধ্যমে যেমন শিল্প সৃষ্টি করা হয় নি, একইভাবে কেবল সৃজনশীলতা দ্বারা শিল্পের ব্যাখ্যা করা যায় না। কম্পিউটারের সৃষ্ট শিল্পেও রয়েছে বাস্তবের প্রতিফলন, কেননা কম্পিউটারের আর্টিফিশিয়াল ইন্টালিজেন্স বাস্তবের অনুকরণ করে মানুষের মসিত্মষ্কের বিকল্প হতে চায়। কম্পিউটারও অনুকরণ এবং সৃজনশীলতা, উভয়েরই ব্যবহার করে। গ্যারি ক্যাসপারোভ যখন আইবিএম-এর ‘বস্নু টুথ’ নামক কম্পিউটারের সঙ্গে দাবা খেলায় হেরে যান তখন এই সত্য প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। শিল্পে বাস্তবতার প্রতিফলনের বিষয়টি বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির অগ্রগতির সঙ্গে সঙ্গে আরো জটিল হচ্ছে এবং সেই সঙ্গে শিল্পীর জন্য চ্যালেঞ্জিংও বটে।

শিল্প সৃষ্টিতে অনুকরণবাদের গুরুত্ব হ্রাস পেয়েছে ক্রমান্বয়ে, সেই সঙ্গে বৃদ্ধি পেয়েছে সৃজনশীলতা। কিন্তু অনুকরণ একেবারে বিদায় নিয়ে যায় নি, কেননা বাস্তবের প্রতিফলনে তার সহায়তার বিশেষ প্রয়োজন। আগেই বলা হয়েছে বাস্তবই শিল্পের বিষয়। শিল্পে সেই বাস্তবের প্রতিফলন নিয়ে দেখা দিয়েছে তর্ক-বিতর্ক প্রাচীনকাল থেকেই, এরও উল্লেখ করা হয়েছে। এই তর্ক-বিতর্ক জন্ম দিয়েছে বিভিন্ন তত্ত্বের এবং শুরু হয়েছে বিভিন্ন আন্দোলন যেসবের আয়ু দীর্ঘস্থায়ী হয় নি। এর কারণ কি এই যে, শিল্পে বাস্তবের প্রতিফলন নিয়ে বিভিন্ন যুগের শিল্পীরা অতৃপ্তিতে থেকেছেন, বিশেষ করে পুরনো এবং প্রচলিত ধারার শিল্প নিয়ে? নতুন ধারার শিল্প আন্দোলনও যে দীর্ঘস্থায়ী হয় নি বা হতে পারছে না তার অন্যতম প্রধান কারণ শিল্পে বাস্তবের প্রতিফলন নিয়ে শিল্পীর মনে দ্বিধা-দ্বন্দ্ব, অতৃপ্তি এবং সংশয়। বাস্তবের সংজ্ঞা পরিবর্তিত হয়ে এবং শিল্পের মাধ্যমগুলিতে বিশাল পরিবর্তন এসে শিল্পে বাস্তবের প্রতিফলন এক জটিল বিষয় হয়ে গিয়েছে। বাস্তবকে ভিন্নভাবে শিল্পে প্রতিফলিত করার তাড়না এবং প্রেরণা, দুই-ই শিল্পীদের উদ্বুদ্ধ করেছে যার ফলে শিল্পচর্চা এক স্থানে স্থির হয়ে থাকে নি দীর্ঘদিন। জীবনযাপন যত বদলাচ্ছে বাস্তবের ধারণাও বদলে যাচ্ছে যার প্রভাব পড়ছে শিল্পের ওপর। শিল্পের এই অস্থির, চঞ্চল এবং ক্রমাগত বাঁকবদলের যাত্রা ও পুনরাবৃত্তির প্রবণতা শুরু হয়েছে নিওলিথিক যুগ থেকে অর্থাৎ গুহাবাসী মানুষ যখন সমতলে এসে কৃষিনির্ভর জীবনযাপন শুরু করে। প্যালিওলিথিক কিংবা নিওলিথিক যুগের মানুষেরা যারা শিল্প সৃষ্টি করেছে, তারা তাদের সৃষ্টিকে ‘শিল্প’ বলে মনে করে নি, কেননা নান্দনিক অর্থে শিল্প বলতে যা বোঝায় তার চর্চা শুরু হয় নি সেই সুদূর অতীতে। দেয়ালচিত্রের মতো শিল্প ছিল তাদের দৈনন্দিন জীবনযাপনের অংশ এবং অন্যান্য কাজের মতো আরো একটি কাজ যা পরস্পর সংযুক্ত। প্রাগৈতিহাসিক যুগের শিল্প এবং তার সঙ্গে বাস্তবতার সম্পর্ক নিয়ে আলোচনার যে সূত্রপাত হয়েছে তা এখনো অব্যাহত। শিল্পে বাস্তবের প্রতিফলনের সেই তাত্ত্বিক-দার্শনিক আলোচনা সমকালে হয় নি, হয়েছে অনেক পরে প্রত্নতাত্ত্বিকদের অনুসন্ধানের ভিত্তিতে, যে প্রসঙ্গ নিয়ে পরে আলোচনা হবে। শিল্পে বাস্তবের প্রতিফলনের সেই তাত্ত্বিক-দার্শনিক আলোচনা দিয়েই শুরু করা যায় শিল্প ইতিহাসের বিভিন্ন পর্বে এর প্রাসঙ্গিকতা। দেখা যাবে অধিকাংশ ক্ষেত্রে শিল্পচর্চা হয়েছে আগে, এবং পরবর্তীতে তার ওপর তাত্ত্বিক-দার্শনিক আলোচনা হয়েছে। শিল্পচর্চা এবং শিল্প আন্দোলনের সঙ্গে সঙ্গে তার ওপর তাত্ত্বিক-দার্শনিক আলোচনা হয়েছে এমন দৃষ্টান্ত বিরল। জীবনে অনেক কিছুর মতো ঘটে যাওয়ার পরই ঘটনার বিশেস্নষণ হয়েছে শিল্পেও। এই আলোচনা দ্বারা শিল্পচর্চা প্রভাবান্বিত হয়েছে, এমন বলা যাবে না। তবে তার ব্যাখ্যা করা হয়েছে, যদিও সেখানে মতানৈক্য ছিল এবং এখনো আছে। সেইসব আলোচনায় যাওয়া এখন প্রাসঙ্গিক হবে।

 

\ছয়\

প্রাগৈতিহাসিক যুগ (প্যালিওলিথিক বা পুরাতন প্রস্তর যুগের শেষ পর্ব) থেকে আদিম মানুষ তাদের আবাসস্থান গুহার দেয়ালে শিকারি মানুষ ও পশুর ছবি এঁকেছে যার বেশ কিছু দৃষ্টান্ত পাওয়া গিয়েছে ইউরোপে ও আফ্রিকায়। এইসব দেয়ালচিত্র পরবর্তীতে ‘শিল্প’ হিসেবে স্বীকৃত হলেও প্রাচীনকালে গুহাবাসী মানুষ জীবনযাপনের ব্যবহারিক প্রয়োজনেই এইসব ছবি এঁকেছে। এর পেছনে সৌন্দর্য সৃষ্টি করে বিনোদন লাভের কোনো উদ্দেশ্য তাদের ছিল না। তারা চেয়েছিল শিকারে সফল হওয়ার জন্য ম্যাজিকের ক্ষমতা লাভ করতে।

প্রাগৈতিহাসিক যুগের মানুষ ছবি এঁকেছে, কিছু ভাস্কর্য সৃষ্টি করেছে তার অনুকরণ ক্ষমতা এবং সৃজনশীলতার জন্য। আগেই বলা হয়েছে, অনুকরণ মানুষের সহজাত প্রবৃত্তি। সেই সঙ্গে যোগ করা হয়েছে তার সৃজনশীলতার দক্ষতা। এখনো এই দুটি সহজাত প্রবৃত্তি রয়েছে মানুষের মধ্যে যা শিশুদের ছবি আঁকা দেখে বোঝা যায়। প্রাগৈতিহাসিক যুগে সব মানুষের মধ্যেই অনুকরণ ও সৃজনশীলতার সহজাত প্রবৃত্তি থাকলেও সেই ক্ষমতা সকলের মধ্যে একই মাত্রায় ছিল না, যেমন এখনো নেই। শুধু যাদের অনুকরণ এবং সৃজনশীলতার ক্ষমতা উন্নত পর্যায়ের ছিল তারাই ‘শিল্পী’ হতে পেরেছে। তাদের এই সহজাত প্রবৃত্তিভিত্তিক ক্ষমতা প্রশিক্ষণের ফলে বৃদ্ধি পায় নি, চর্চার ধারাবাহিকতায় হয়তো হয়েছে। বর্তমানে প্রশিক্ষণ এবং চর্চা, উভয়েই সহজাত দুটি প্রবৃত্তিকে জাগ্রত রেখে ক্ষমতা বৃদ্ধি করেছে এবং তার ফলে শিল্পে নতুন মাত্রা সংযোজন সহজ হয়েছে।

ওল্ড টেস্টামেন্টের বাইবেলে অনুকরণের ভিত্তিতে প্রতিকৃতি (ইমেজ) সৃষ্টি নিষিদ্ধ করা হয়েছিল। তখনকার ধর্মবিশ্বাস অনুযায়ী প্রতিকৃতি সৃষ্টির ক্ষমতা একমাত্র ঈশ্বরের। মানুষ প্রতিকৃতি সৃষ্টি করলে ঈশ্বরের সৃষ্টি ক্ষমতাকে অস্বীকার করা হয়। ওল্ড টেস্টামেন্টের টেন কমান্ডমেন্টে অনুকরণের ভিত্তিতে প্রতিকৃতি সৃষ্টির ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হয় যেন পৌত্তলিকতার প্রতি মানুষের আকর্ষণ দেখা না দেয়। যুক্তি দেওয়া হয় যে, মানুষ অনুকরণের ভিত্তিতে যা সৃষ্টি করে তা মূল বিষয়ের বিকল্প ছাড়া আর কিছু নয়। কিন্তু এই বিকল্পই দর্শককে আকৃষ্ট করে, মূল ইমেজ, যা অদৃশ্য, তা উপেক্ষা করতে উৎসাহিত করতে পারে। এর ফলে মূল বিষয় নয় (ইমেজ) যে, তার বিকল্প রূপ সৃষ্টি করেছে তার ক্ষমতারই প্রশংসা করা হয়। এতে সাধারণ মানুষের নৈতিক চরিত্র নষ্ট হয় এবং সত্যের অপলাপ ঘটে। খ্রিষ্টপূর্ব চতুর্থ শতাব্দীতে প্রাচীন গ্রিসে দার্শনিক পেস্নটোর শিল্পসংক্রান্ত চিন্তায় একই ধারণা ব্যক্ত হয়েছে। তাঁর রিপাবলিক গ্রন্থের দশম অধ্যায়ে পেস্নটো লিখেছেন, শিল্পীরা তাদের শিল্পকর্ম দিয়ে মানুষকে বিভ্রান্ত করে, কেননা যে প্রতিকৃতি তারা আঁকে তা মূল বিষয়ের যথার্থ প্রতিফলন করে না। তার মতে, ‘ফর্ম’ বা ‘রূপ’ ঈশ্বরপ্রদত্ত ‘আইডিয়া’র সৃষ্টি। মানুষ যা কিছু দেখে তার পেছনে রয়েছে ঈশ্বরের আইডিয়াপ্রসূত ফর্ম। শিল্পীরা এই আইডিয়া সম্পর্কে কিছুই জানে না যার জন্য এর ভিত্তিতে সৃষ্ট ফর্ম সম্বন্ধেও তারা অজ্ঞ। সুতরাং শিল্পে প্রতিকৃতির নামে তারা যা সৃষ্টি করে তা ‘অনুকরণের অনুকরণ’ এবং সেই কারণে প্রকৃত সত্য থেকে দুই ধাপ দূরে।

পেস্নটোর রিপাবলিক গ্রন্থে (দশম অধ্যায়ে) সক্রেটিসের সঙ্গে একটি সংলাপের প্রসঙ্গে লেখা হয়েছে যে, সক্রেটিস একজন কারুশিল্পীর সংজ্ঞা দিতে গিয়ে বলেছিলেন, সে অন্য কারুশিল্পীরা যা পারে সেসব হুবহু অনুকরণ করার ক্ষমতা রাখে। এছাড়াও সে প্রকৃতি, গাছ-পালা, জীব-জন্তু, এমনকি নিজের প্রতিকৃতিও তৈরি করতে সমর্থ। তিনি এ কথাও বলেন যে, কারুশিল্পী স্বর্গে-মর্তে-নরকে যা কিছু আছে সবই সৃষ্টি করতে পারে। সংলাপে অংশগ্রহণকারী (পেস্নটো কিনা জানা যায় না) যখন স্বর্গ এবং নরকের প্রসঙ্গে সংশয় প্রকাশ করে তখন সক্রেটিস তাকে বলেন, যে কোনো ব্যক্তিই তার বর্ণিত কারুশিল্পী হতে পারে যদি সে তার সঙ্গে একটি দর্পণ নিয়ে ঘোরে যেখানে তার চারপাশের সব কিছুই প্রতিফলিত হবে। এই ‘চারপাশে’র মধ্যে স্বর্গ এবং নরক কীভাবে অন্তর্ভুক্ত হতে পারে, সেই ব্যাখ্যা তিনি দেন নি। তিনি এরপর বলেন যে, শিল্পীরা এই ধরনেরই অনুকারক কারুশিল্পী। এই ব্যাখ্যা অনুযায়ী দর্পণে প্রতিফলিত ছবি ‘চারপাশে’র বস্ত্ত বা বিষয়ের সদৃশ হয়। অর্থাৎ শিল্পকর্মের প্রতিকৃতি অনুকরণের প্রক্রিয়ায় সৃষ্টি হয়। অনুকরণের গ্রিক প্রতিশব্দ ‘মাইমেসিস’ কথাটি সক্রেটিস ব্যবহার করেছেন বলে অনুমান করা হয় যার জন্য পরবর্তীতে গ্রিক দার্শনিক যারা অনুকরণভিত্তিক শিল্পের আলোচনা-সমালোচনা করেছেন তাঁরা ‘মাইমেসিস’ কথাটিই ব্যবহার করেছেন। যেমন, পেস্নটো তাঁর শিক্ষক সক্রেটিসের অনুসরণে প্রতিকৃতি (ইমেজ) সৃষ্টির প্রক্রিয়াকে ‘মাইমেসিস’ বলে আখ্যায়িত করেছেন। তাঁর শিষ্য অ্যারিস্টটলও পরবর্তীতে মাইমেসিস কথাটি ব্যবহার করেছেন। মাইমেসিসের ইংরেজি প্রতিশব্দ ‘ইমিটেশন’ (বাংলায় অনুকরণ) নয়, এ কথা পরবর্তীতে দার্শনিক-সমালোচকরা উল্লেখ করেছেন যার আলোচনা পরে হবে, কেননা শিল্পের ইমিটেশন থিয়োরি মাইমেসিস থেকে এসেছে কিনা তা জানা গুরুত্বপূর্ণ। ‘মাইমেসিস’ গ্রিক ভাষায় একটি বিশেষ্য পদ যা ‘মাইমেইসমাই’ ক্রিয়াপদ থেকে এসেছে। মাইমেইসমাই-এর অর্থ হলো অনুকরণ করা (মাইম)। নকলের এই সৃষ্টি দৃষ্টি আকর্ষণের উদ্দেশ্যে করা হয় বলে পেস্নটোর কাছে নিন্দনীয় মনে হয়েছে কেননা একে বাস্তবের তুচ্ছের তুচ্ছ অনুকরণের বেশি কিছু বলা যায় না। সেই জন্য তিনি বাস্তবের এই অনুকরণকে সত্য থেকে (বাস্তব থেকে) দুই ধাপ দূরে বলে সমালোচনা করেছেন। এই প্রসঙ্গে তিনি গুহায় বসে কয়েকজন মানুষ দেয়ালে বাইরের যে ছায়া দেখতে পায় তাকেই বাস্তব বলে মনে করে, এই দৃষ্টান্ত দেন। পরে সেই মানুষগুলিকে গুহার বাইরে এনে দৃশ্যমান প্রকৃতিকে দেখানো হলে তারা বাস্তবের রূপ দেখতে পায়। কিন্তু প্রকৃতির এই বাস্তবও ঈশ্বরের যে ‘আইডিয়া’ থেকে ‘ফর্ম’ বা রূপ হিসেবে সৃষ্টি হয়েছে তার থেকে পৃথক। শিল্পী কিংবা গুহাবাসী মানুষদের কেউই এই ‘আইডিয়া’ এবং তার ভিত্তিতে সৃষ্ট ‘ফর্ম’ (বাস্তব) সম্বন্ধে জানতে পারে না। ফলে শিল্পীর আঁকা বাস্তবের প্রতিকৃতি দেখে তারা প্রকৃত বাস্তব থেকে দুই ধাপ দূরে থেকে যায়। শিল্পীরা অনুকরণের মাধ্যমে তাদের শিল্পকর্মে এই ভ্রম সৃষ্টি বা মিথ্যা প্রচার করে বলে পেস্নটো তাদেরকে আদর্শ রাষ্ট্র থেকে নির্বাসিত করার পক্ষে মত দেন।

শিল্প সম্পর্কে সক্রেটিস প্রকৃতই কিছু বলেছিলেন কিনা এ বিষয়ে সন্দেহ রয়েছে, কেননা তিনি কিছুই লিখে যান নি, তাঁর সব দার্শনিক মতামতই সংলাপের আকারে দেওয়া যা পরবর্তীতে পেস্নটো তাঁর বইগুলিতে অন্তর্ভুক্ত করেছিলেন। শিল্প সম্পর্কে পেস্নটোর মতামত প্রধানত পাওয়া যায় রিপাবলিক গ্রন্থের দশম অধ্যায়ে। কিন্তু শিল্প সম্বন্ধে তাঁর আলোচনা কখনোই মুখ্য হয়ে ওঠে নি। রাষ্ট্র এবং নৈতিকতার প্রসঙ্গক্রমে এসেছে শিল্পসংক্রান্ত আলোচনা। কিন্তু এর প্রভাব হয়েছে সুদূরপ্রসারী। শিল্প ও বাস্তবতার ওপর আলোচনার সূত্রপাত হয় তার লেখা থেকেই। এখানে বলা প্রাসঙ্গিক পেস্নটোর শিল্পসংক্রান্ত সংক্ষিপ্ত আলোচনার দুটি দিক আছে। একদিকে রয়েছে, শিল্পের ‘মেটাফিজিকাল’ (আধিবিদ্যক) সংজ্ঞা, অপরদিকে সামাজিক জীবনে ও রাষ্ট্রীয় ক্ষেত্রে শিল্পের প্রয়োজনীয়তা ও তার প্রভাব নিয়ে আলোচনা। শিল্প বাস্তব থেকে ‘দুই ধাপ দূরে’, এই মতপ্রকাশের পেছনে তাঁর আধিবিদ্যক জ্ঞান ও দৃষ্টিভঙ্গি কাজ করেছে। তাঁর মতে যথার্থ জ্ঞান যুক্তিভিত্তিক। তাঁর পূর্বসূরি ‘সোফিস্ট’ নামে পরিচিত দার্শনিক-শিক্ষকরা (যাঁদের সঙ্গে সক্রেটিস মাঝেমাঝে সংলাপে যোগ দিয়েছেন এবং কখনো একমত, কখনো দ্বিমত পোষণ করেছেন) মনে করতেন, ইন্দ্রিয়ভিত্তিক জ্ঞানই সত্য এবং জ্ঞানের মাপকাঠি হলো স্বয়ং মানুষ (ম্যান ইজ দি মেজার অফ অল থিংস)। পেস্নটো সোফিস্টদের মত খ-ন করে দেখালেন যে, প্রত্যক্ষ (ইন্দ্রিয়নির্ভর) অভিজ্ঞতা কেবল ‘বিশেষে’র (পার্টিকুলার) জ্ঞান দেয়। এই কারণে প্রত্যক্ষ জ্ঞান ব্যক্তিভেদে ও সময়ভেদে ভিন্ন হয়। সুতরাং ইন্দ্রিয়জ প্রত্যক্ষ জ্ঞান সর্বজনগ্রাহ্য তো নয়ই, চিরায়তও নয়। শাশ্বত সত্যের সন্ধান ইন্দ্রিয়ভিত্তিক অভিজ্ঞতা দিতে পারে না। তার ভিত্তি বুদ্ধিবৃত্তিক এবং সেই জ্ঞান সর্বজনগ্রাহ্য হওয়ার ক্ষমতা রাখে। বুদ্ধিবৃত্তিক জ্ঞান ‘বিশেষ’ (পার্টিকুলার) নয়, ‘সাধারণ’ (জেনারেল) লক্ষণাক্রান্ত। বুদ্ধিগ্রাহ্য যে জগৎ তা ইন্দ্রিয়াতীত এবং অপরিবর্তনশীল। যা নিয়ত পরিবর্তনশীল (ইন্দ্রিয় জগৎ) তা প্রকৃত জগৎ নয়। এর ঊর্ধ্বে যে জগৎ বা বাস্তব আছে পেস্নটো তাকেই বললেন ‘আইডিয়া’র জগৎ, যা ইন্দ্রিয়াতীত। তিনি ‘আইডিয়া’ বলতে মানসিক ধারণা নয়, সত্তাবান, অবিনশ্বর ও ‘সাধারণে’র কথা বলেছেন। ইন্দ্রিয়ের মাধ্যমে মানসিক ধারণা হতে পারে কিন্তু পেস্নটো যে ‘আইডিয়া’র উল্লেখ করেছেন তার সম্বন্ধে জ্ঞান লাভ করা যায় না। সুতরাং পেস্নটোর অধিবিদ্যায় ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য এবং ইন্দ্রিয়াতীত, উভয় জগৎই স্বীকৃত হলেও প্রথমটির মাধ্যমে সত্য বা জ্ঞানার্জনের সীমাবদ্ধতা সম্বন্ধে তিনি সচেতন ও সতর্ক করে দেন। এই দুই জগতের মধ্যে সম্পর্কের কথা বলতে গিয়েই তিনি ‘মাইমেসিস’ কথাটি ব্যবহার করেছেন। তাঁর মতে, ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য যে জগৎ, যাকে ‘প্রকৃতি’র বাস্তব বলে চিহ্নিত বা মনে করা হয় তাই-ই হচ্ছে প্রকৃত জগৎ বা ‘আইডিয়া’র জগতের অনুকরণ।

দর্শনে পেস্নটোর এই আধিবিদ্যক ব্যাখ্যা বুঝতে পারলে শিল্পকর্মকে কেন তিনি অনুকরণের অনুকরণ বলেছেন, তা বুঝতে পারা যায়। এই ব্যাখ্যার ভিত্তিতে তিনি শিল্প যে সত্য নয়, প্রকৃত বাস্তবের প্রতিফলন নয়, বাস্তবের ‘অনুকরণের অনুকরণ’ এবং সেই কারণে তা ব্যক্তির চেতনা ক্ষমতার জন্য ক্ষতিকারক বলে মনে করেছেন। শিল্প (কবিতাও) এজন্যই জ্ঞানার্জনের সহায়ক নয় বলে তিনি মতপ্রকাশ করেছেন। ইন্দ্রিয়লব্ধ বলে এই বাস্তবতার জ্ঞান বা অভিজ্ঞতা মানুষের মনের লঘু আবেগকে উদ্দীপিত করে। এই কারণে শিল্প আদর্শ নৈতিক জীবনের পক্ষে ক্ষতিকারক। একই কারণে শিল্পকর্ম আদর্শ ধর্ম-জীবনের অনুকূল নয় এবং আদর্শ প্রজাতন্ত্রের নাগরিকদের সত্য সম্বন্ধে যে জ্ঞান থাকা প্রয়োজন তা দিতে অক্ষম।

পেস্নটোর শিল্পকর্ম সম্বন্ধে, বিশেষ করে শিল্পে বাস্তবের প্রতিফলন সম্বন্ধে মতামতের আলোচনা শেষ করার আগে বলা প্রয়োজন যে, রিপাবলিকের পর তিনি তাইমেউস নামক সংলাপ গ্রন্থে (তার সব বই-ই সংলাপের আকারে লেখা) স্বীকার করেছেন যে, ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য বস্ত্ত বা বিষয়ের অনুকরণ যত আদর্শের (প্রকৃত বাস্তবের) কাছাকাছি হওয়ার চেষ্টা করে ততই তা বিশ্বাসযোগ্য হয়ে ওঠে। সুতরাং পেস্নটো অনুকরণ প্রক্রিয়াকে সত্যের অনুসন্ধানে (বাস্তবের প্রতিফলনে) একেবারেই অকার্যকর বা ব্যর্থ অথবা সেই উদ্দেশ্য সাধনের সম্ভাবনা তার মধ্যে নেই, এ কথা শেষ পর্যন্ত বলেন নি। তাঁর বাস্তবের অনুকরণকেন্দ্রিক সমালোচনা এত গুরুত্ব ও মনোযোগ পেয়েছে যে, অনুকরণের প্রতি এই শর্তাধীন স্বীকৃতি তাঁর মতামতের আলোচনায় প্রায় স্থানই পায় না।

শিল্প-ঐতিহাসিকদের মতে, প্রায় দুই হাজার বছর পর্যন্ত (খ্রিষ্টপূর্ব চতুর্থ শতাব্দী থেকে ঊনবিংশ শতাব্দীর প্রারম্ভ) পাশ্চাত্যের শিল্প-ঐতিহ্যে ‘মাইমেসিস’ বা অনুকরণবাদ মূলনীতি (প্রিন্সিপাল) হিসেবে কাজ করেছে। এর জন্য পেস্নটোর শিষ্য অ্যারিস্টটলের ভূমিকা ছিল প্রধান। দৃশ্যমান ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য জগৎ উপেক্ষা করার পরিবর্তে অ্যারিস্টটল শিল্পে এর প্রতিফলন প্রচেষ্টার গ্রহণযোগ্য ব্যাখ্যা দেওয়ার চেষ্টা করেন। এই প্রচেষ্টায় ‘মাইমেসিসে’র ধারণাকে তিনি বেশ কার্যকর বলে মনে করেন। তিনি শব্দটি চিত্রকলা, ভাস্কর্য, কবিতা, নাটক এবং সংগীতে যা সৃষ্টি করা হয় তার ব্যাখ্যায় প্রয়োগ করেন। ‘মাইমেসিসে’র প্রক্রিয়ায় মানুষ (শিল্পী) অন্যের প্রতিকৃতি বা বস্ত্তর রূপ পুনঃসৃষ্টি করে যেন সেইসবের উপলব্ধি সহজ হয়। প্রাথমিক পর্বের উপলব্ধি ‘মাইমেসিসে’র মাধ্যমেই সম্ভব হয় বলে তিনি মনে করেন। শিল্পকর্মসহ অনুকরণভিত্তিক সব সৃষ্টি দৃশ্যমান জগতের দিকে মনের সব জানালা খুলে দেয় যার ফলে আবেগ ও অনুভূতি পরিশ্রম্নত এবং বিশুদ্ধ হওয়ার সুযোগ পায়। তাঁর মতে, অনুকরণ এক ধরনের খেলাও বটে কিন্তু মোটেও উদ্দেশ্যবিহীন নয়। জ্ঞান ও অনুভূতির মধ্যে যে বিরোধ, যুক্তি ও বিশ্বাসের মধ্যে যে পার্থক্য, সেইসব বিবেচনায় এনে অ্যারিস্টটল জ্ঞান ও যুক্তির সমর্থন করেন। তিনি বিশ্বাস করেন যে, অনুকরণভিত্তিক প্রতিকৃতি বা ইমেজ এই লক্ষ্যে পৌঁছাতে সাহায্য করে। এজন্য মানুষ অনুকরণভিত্তিক ইমেজ বা প্রতিকৃতি সৃষ্টি করে এবং তা তাদের কাছে গ্রহণযোগ্য মনে হয়। এই কারণে শিল্পকলা, সাহিত্য, সংগীত ইত্যাদি ক্ষেত্রে মাইমেসিসের ধারণা অ্যারিস্টটলের কাছে যৌক্তিক বলে মনে হয়েছে।

ঊনবিংশ শতাব্দীর শুরুতে মডার্ন আর্টের আবির্ভাবের পূর্ব পর্যন্ত আর্ট এস্টাবলিশমেন্ট (একাডেমিসহ) স্বীকার করেছে যে, শিল্পীরা বাস্তবতা সম্বন্ধে ধারণা দেওয়ার জন্যই বস্ত্ত বা বিষয়ের প্রতিকৃতি সৃষ্টি করেছে। অ্যারিস্টটলের শিল্পকর্ম ব্যাখ্যা এবং সেখানে বাস্তবতার প্রতিফলনে ‘মাইমেসিসে’র ভূমিকা সম্বন্ধে তাঁর মতো দীর্ঘকাল পাশ্চাত্যের শিল্পকলার ইতিহাসে গ্রহণযোগ্য হয়ে থেকেছে। মডার্ন আর্ট আবির্ভাবের পর বিভিন্ন শিল্প আন্দোলনের ফলে অনুকরণবাদ যে সম্পূর্ণভাবে ত্যাগ বা বর্জন করা হয়েছে, এ কথা বলার উপায় নেই। গুরুত্বে হ্রাস পেলেও অনুকরণবাদ শিল্পে বাস্তবের প্রতিফলনে তার অবদান রেখেছে এবং ভবিষ্যতেও রাখবে, এ বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই। প্রশিক্ষণের সময় এখনো প্রত্যেক ছাত্রছাত্রীকে যে মডেল দেখে অনুকরণ করে ড্রইং আঁকতে হয় তার মাধ্যমেই অনুকরণের দক্ষতা অর্জনের স্বীকৃতি রয়েছে।

অনেকের মতে, পেস্নটো ও অ্যারিস্টটলের মধ্যে শিল্পকর্মে অনুকরণ নিয়ে যে মতপার্থক্য তার মূলে ছিল ‘আইডিয়া’র স্বরূপ ব্যাখ্যা। ‘আইডিয়া’র প্রসঙ্গে ‘সাধারণে’র (জেনারেল) ও ‘বিশেষ’-এর (পার্টিকুলার) সম্পর্ক নিয়ে দুজনের মধ্যে যে মতপার্থক্য দেখা দিয়েছিল তাই-ই উভয়ের শিল্প চিন্তাকে প্রভাবান্বিত করেছিল বলে অনেকের ধারণা। অর্থাৎ আধিবিদ্যক দর্শনের প্রয়োগই ছিল দুজনের মধ্যে শিল্পসংক্রান্ত চিন্তার দূরত্বের কারণ। অ্যারিস্টটল শিল্পকে বাস্তবের অনুকরণ মনে করলেও ‘সাধারণ’ (জেনারেল) ‘বিশেষ’ (পার্টিকুলার) নিরপেক্ষ হয়ে পৃথক অসিত্মত্ব নিয়ে থাকতে পারে না, এই ধারণা পোষণ করেছেন। এজন্য তিনি শিল্প কখনোই ‘বিশেষ’ বর্জিত হতে পারে বলে মনে করেন নি। আর এই কারণেই শিল্পের সংজ্ঞা দিতে গিয়ে বলেছেন, শিল্প ‘বিশেষ’-এর মাধ্যমেই ‘সাধারণ’কে অনুকরণ করে। ন্যায়শাস্ত্রের (লজিক) প্রবর্তক অ্যারিস্টটল নৈয়ায়িকের মতো বুদ্ধি প্রয়োগ করে শিল্পের যে সংজ্ঞা তৈরি করেছিলেন পরবর্তীকালে বেনেদিতো ক্রোচে তার প্রশংসা করেছিলেন (১৯৫৩) এবং বলেছিলেন যে, অ্যারিস্টটলই প্রথম যুক্তির ভিত্তিতে শিল্পের সংজ্ঞা নিরূপণের চেষ্টা করেন। অ্যারিস্টটল শিল্পকে দেখেছেন একদিকে দর্শন-বিজ্ঞানের বিশুদ্ধ ‘সাধারণ’, অন্যদিকে ইতিহাসের ‘সাধারণ’-এর মাঝখানে অবস্থিত যা ‘বিশেষ’-এর মাধ্যমে ‘সাধারণ’ হয়। এইভাবে শিল্পের সংজ্ঞা নিরূপণ করে অ্যারিস্টটল বলেছেন, শিল্প বাস্তব (সত্য) থেকে দুই কি তিন ধাপ দূরে নয়। তাঁর ব্যাখ্যায় শিল্পের জগৎ মিথ্যার (অনুকরণের জন্য) জগৎ নয়, বাস্তবেরই জগৎ। শিল্পকর্ম এই ব্যাখ্যায় ‘আইডিয়া’ বা সত্যকেই প্রকাশ করে বলে উপসংহারে এসেছেন তিনি। তিনি এও বলেছেন, শিল্প মানুষের সত্যবোধকে জাগ্রত করে, অন্যদিকে ক্ষতিকর আবেগকে মন থেকে দূর করে। এইভাবে তিনি পেস্নটোর শিল্প সম্বন্ধে দ্বিতীয় আপত্তির উত্তর দিয়েছেন।

পেস্নটো-অ্যারিস্টটলের শিল্প সম্বন্ধে ধারণাকে সমন্বিত করে এইভাবে সংক্ষিপ্ত বর্ণনা দেওয়া যায় : শিল্প যে ‘রূপ’-এর অনুকরণ, এ বিষয়ে দুজনই একমত। কিন্তু পেস্নটোর কাছে শিল্পের রূপ ‘বিশেষ’-এর অনুকরণ, অপরদিকে অ্যারিস্টটল মনে করেছেন শিল্পের রূপ ‘সাধারণ’-এর অনুকরণ। গুরুর মতে, শিল্পীর দৃষ্টি ‘বিশেষ’-এর জগতের দিকে নিবদ্ধ। শিষ্যের মতে, শিল্পীর দৃষ্টি ‘বিশেষ’-এর জগৎ অতিক্রম করে ‘সাধারণ’-এর জগতে প্রসারিত। গুরুর মতে, শিল্প মিথ্যার জগৎ, সত্য (বাস্তব) থেকে দুই কি তিন ধাপ দূরে অবস্থিত। শিষ্যের মতে, শিল্প বাস্তবের অনুকরণ হলেও সেই বাস্তব মিথ্যা নয়। দুজনের মধ্যে মতভেদ এখানে অনুকরণ নিয়ে নয়, যার অনুকরণ করা হচ্ছে (বাস্তব) তা সত্য না মিথ্যা, এই প্রশ্ন নিয়ে। গুরুর মতে, শিল্প মনের নিম্নতর আবেগকে পুষ্ট করে, শিষ্য বলেন, শিল্প আবেগকে শোধন করে মনকে শান্ত ও সংযত হতে সাহায্য করে। এই সার-সংক্ষিপ্তিতে যা গুরুত্বপূর্ণ তা হলো পেস্নটো এবং অ্যারিস্টটল, গুরু-শিষ্য দুজনই অনুকরণবাদে বিশ্বাস করেছেন, কিন্তু কিসের অনুকরণ হচ্ছে, সত্য, না মিথ্যা (প্রকৃত বাস্তব না অলীক বাস্তব), এই নিয়ে মতপার্থক্য প্রকাশ করেছেন। পেস্নটোর অনুকরণ সংক্রান্ত ধারণা এতই চরম যে, তা গ্রহণযোগ্য হয় নি, যদিও দার্শনিক বিতর্কের বিষয় হওয়ার মতো যুক্তিপূর্ণ। অপরদিকে অ্যারিস্টটলের অনুকরণের ব্যাখ্যা শিল্প-সমালোচক ও দার্শনিকদের কাছে গ্রহণযোগ্য মনে হয়েছে।

 

\সাত\

এতক্ষণ গ্রিক শব্দ ‘মাইমেসিসে’র ইংরেজি প্রতিশব্দ হিসেবে ‘ইমিটেশন’ এবং বাংলায় ‘অনুকরণ’ শব্দ দুটি ব্যবহার করা হয়েছে। এখন এই গ্রিক শব্দটির বুৎপত্তিগত যে ব্যাখ্যা ও সে সম্বন্ধে যে বিভিন্ন মত এবং সেইসব মত সমন্বয়ের জন্য যে চেষ্টা করা হয়েছে তার প্রতি দৃষ্টি দেওয়া যায়। বিশ শতকের দার্শনিক হ্যান্স-জর্জ গ্যাডামার ‘মাইমেসিসে’র অর্থ ইংরেজিতে ‘ইমিটেশন’ করা হলে তা যথার্থ হবে কিনা সে বিষয়ে সন্দেহ প্রকাশ করেছেন (১৯৭৫)। ‘মাইমেসিসে’র প্রতিশব্দ হিসেবে ‘ইমিটেশন’ ব্যবহার করা হলে গ্রিক শব্দটির অর্থ সংকীর্ণ হয়ে যায় বলে তিনি মনে করেন। তাঁর মতে, ‘মাইমেসিস’ শব্দটি যা অনুপস্থিত তার উপস্থিতি সম্বন্ধে ধারণা দেয় এবং একই সঙ্গে অনুকরণের অর্থও বহন করে যা পেস্নটোর অনুকরণবাদের প্রতি সমর্থন জানায়। তাছাড়া ‘মাইমেসিস’ গ্রিক শব্দটির কাছাকাছি আরো তিনটি শব্দ আছে যেগুলির অর্থ ‘মাইমেসিসে’র প্রতিশব্দ কেবল ‘অনুকরণ’ বলা হলে বিভ্রামিত্মর সৃষ্টি করতে পারে। মাইমেসিসের সমগোত্রীয় এই তিনটি গ্রিক শব্দ হলো : মেথেস্কিস (অংশগ্রহণ), হোমায়ওসিস (সাদৃশ্য) এবং প্যারাপেস্নসিয়া (প্রতিকৃতি)। ‘মাইমেসিসে’র প্রায় সমার্থক এই তিনটি শব্দ থাকার জন্য গ্রিক শব্দটির ইংরেজি প্রতিশব্দ ‘ইমিটেশন’ করা হলে তা হবে ভ্রান্ত, কেননা কোনো ইংরেজি শব্দই মাইমেসিসের মতো ‘মুক্ত’ (সমার্থক হওয়া সত্ত্বেও একাধিক ব্যঞ্জনাবিশিষ্ট) স্বাধীন শব্দ নেই।

‘রিপ্রেজেন্টেশন’ শব্দটি মাইমেসিসের মতো ব্যাপক ও বিশদ অর্থ বহন করে ব্যবহৃত হতে পারে বলে শিল্প-ঐতিহাসিক বিয়ার্ডসলে মতপ্রকাশ করেছেন (১৯৬৬)। কিন্তু তিনি বিতর্ক এড়ানোর জন্য সক্রেটিস এবং পেস্নটোর ব্যবহৃত ‘মাইমেসিসে’র ইংরেজি প্রতিশব্দ হিসেবে ‘ইমিটেশন’ও ব্যবহার করা যায় বলে মনে করেছেন, কিন্তু এমনভাবে যেন এটি ‘রিপ্রেজেন্টেশনে’র মতো একাধিক অর্থ বহন করতে পারে। এই যুক্তির ভিত্তিতে বিয়ার্ডসলে বলেছেন যে, সমস্ত শ্রেণির শিল্পেই (কারু ও চারুশিল্প) ‘রিপ্রেজেন্টেশন’ শব্দটি প্রয়োগ করা যায়। এরপর বিয়ার্ডসলে রিপাবলিক গ্রন্থে পেস্নটো ‘ফর্ম’ শব্দটি যে অর্থে ব্যবহার করেছেন তার উল্লেখ করেছেন। পেস্নটো বিছানা বা খাট (বেড) ‘ফর্মে’র উদাহরণ হিসেবে বর্ণনা করে বলেছেন, এই ফর্ম স্বর্গীয় (ঈশ্বরের) ক্ষমতার প্রকাশ। বিয়ার্ডসলে এরপর প্রশ্ন তুলেছেন, যদি এই ফর্ম (খাট/বেড) ঈশ্বরের সৃষ্ট ফর্মই হয়ে থাকে তাহলে এর মডেল বা সুপার মডেলটি কোথায়? এইভাবে তিনি পেস্নটোর দেওয়া অনুকরণের ব্যাখ্যার মূল ভিত্তি সম্বন্ধে সংশয় প্রকাশ করে ইমিটেশনকে একাধিক অর্থবহ হওয়ার শর্তে ‘রিপ্রেজেন্টেশনে’র সমার্থক হিসেবে ব্যবহারের পক্ষে মত দিয়েছেন।

জুলিয়ান বেলও ‘রিপ্রেজেন্টেশন’ ইংরেজি শব্দটির যে সাধারণ অর্থ রয়েছে (নির্দিষ্টের বিপরীতে) তার উল্লেখ করে বলেছেন যে, এর দ্বারা কেবল ‘পিক্টোরিয়াল রিপ্রেজেন্টেশন’ (দৃশ্যকল্পভিত্তিক প্রতিফলন) বোঝানো হয় না, ‘সিম্বলিক রিপ্রেজেন্টেশন’ও (প্রতীকী প্রতিফলন) এর সাধারণ অর্থের মধ্যে অন্তর্ভুক্ত। যেমন, একটি ছবি প্রকৃতির কোনো দৃশ্যকে রিপ্রেজেন্ট করে পিক্টোরিয়াল রিপ্রেজেন্টেশন হিসেবে, আবার ছবির ভেতর কোনো মোটিফ অন্য কোনো অর্থের বা বাস্তবতার প্রতীক হিসেবে কাজ করে সিম্বলিক রিপ্রেজেন্টেশন হতে পারে। সুতরাং রিপ্রেজেন্টেশন বলতে কেবল ইমিটেশন বোঝায় না, এর দ্বারা ইমিটেশনের অতিরিক্ত কিছু বোঝানো হয়। এইভাবে ব্যাখ্যা করে জুলিয়ান বেলও শর্তাধীনে ‘রিপ্রেজেন্টেশন’ শব্দটি মাইমেসিসের প্রতিশব্দ হিসেবে ব্যবহার করা যায় বলে মনে করেছেন (১৯৯৮)। যেহেতু বর্তমানে ইমিটেশন বাস্তবের হুবহু অনুকরণ নয় বলে মনে করা হয় অর্থাৎ ‘নির্বাচিত অনুকরণ’ (সৃজনশীলও বলা যায়) সেজন্য এই আধুনিক অর্থ যুক্ত করে তিনি ইমিটেশন শব্দটিও ব্যবহার করা যায় বলে মনে করেছেন। ভিন্নভাবে বিয়ার্ডসলে এবং জুলিয়ান বেল মাইমেসিসের প্রতিশব্দ হিসেবে ‘রিপ্রেজেন্টেশন’ এবং ‘ইমিটেশন’ ব্যবহার করা যায়, এই একই উপসংহারে এসেছেন।

অনুকরণ বা ইমিটেশনের স্থানে রিপ্রেজেন্টেশনের প্রসঙ্গ প্রথম দেখা যায় ষষ্ঠদশ এবং সপ্তদশ শতাব্দীতে। দুটি শব্দকে সেই সময় সমতুল্য বলে মনে করা হয়েছে যদিও পদ্ধতি ও চর্চার দিক দিয়ে ‘রিপ্রেজেন্টেশনে’র অর্থ ছিল ‘ইমিটেশনে’র তুলনায় অগ্রগামী। প্রথমদিকে রিপ্রেজেন্টেশন বলতে অবশ্য বুঝিয়েছে একজন ব্যক্তি দ্বারা অন্য একজন ব্যক্তির প্রতিনিধিত্ব করার বিষয়। কিন্তু প্রতিনিধিত্বকারী যার প্রতিনিধিত্ব করছে তার অনুকরণ করে না, এখানে বিষয় বা বস্ত্তর মধ্যে সাদৃশ্য স্থাপনের প্রশ্ন নেই, রয়েছে পারস্পরিক সম্মতির ভিত্তিতে ক্ষমতার (প্রতিনিধিত্ব করার) ব্যবহার। ছবির ক্ষেত্রে এসে রিপ্রেজেন্টেশন ভিন্ন অর্থ বহন করেছে। সপ্তদশ শতাব্দীতে থমাস হবস্ তাঁর লেভিয়াথান বইতে যেসব দেবদেবীর উপাসনার জন্য মূর্তি বা প্রতিকৃতির ব্যবহার করা হতো তাদের মধ্যে সাদৃশ্যের অভাবের উল্লেখ করে বলেছেন, এইসব ত্রুটিপূর্ণ মূর্তি বা প্রতিকৃতি মূল বিষয় (দেবদেবী) বা বস্ত্ত রিপ্রেজেন্টেশন করার জন্য যথেষ্ট ছিল না। এর ভিত্তিতে তিনি বলেন যে, প্রতিকৃতি বা মূর্তি হলো বাস্তবে দৃশ্যমান বস্ত্তর সঙ্গে সাদৃশ্যপূর্ণ (রিজেমবেস্নন্স) শিল্প সৃষ্টি অথবা তার প্রতিনিধিত্বমূলক। কারো প্রতিনিধিত্ব করার বিষয়টি যেমন ‘রিপ্রেজেন্টেশন’ শব্দটির অন্তর্গত, প্রতিকৃতি বা মূর্তির প্রতিনিধিত্ব করার ক্ষেত্রেও রিপ্রেজেন্টেশনের গ্রহণযোগ্যতা মানুষের পারস্পরিক সম্মতির ভিত্তিতে নিশ্চিত হয়ে থাকে। এই সম্মতির পেছনে রয়েছে প্রচলিত আচার-ব্যবহার, রীতিনীতি (কনভেনশন), হবস্ এর উল্লেখ করেছেন (১৬৫১)। সপ্তদশ শতকে হবস্ বিষয় (বাস্তব) ও তার ইমেজের সম্পর্ক নিয়ে (সর্বজনগ্রাহ্য রিপ্রেজেন্টেশন) যে ব্যাখ্যা দিয়েছেন সেটি ঊনবিংশ ও বিংশ শতাব্দীতে শিল্প ইতিহাসে আলোচনায় স্থান পেয়েছে। বিষয় ও তার ইমেজের মধ্যে সাদৃশ্য নয়, সাদৃশ্য বিষয়ে দর্শকের ঐকমত্যই রিপ্রেজেন্টেশনকে গ্রহণযোগ্য করেছে। এই আলোচনার ভিত্তিতে শিল্পের দৃষ্টিকোণ থেকে রিপ্রেজেন্টেশনকে বাস্তবের অনুকরণ মনে না করে গ্রহণ করা হয়েছে মূল বিষয়ের সদৃশ্য প্রতিকৃতি বা মূর্তি হিসেবে যার পেছনে দর্শকের সম্মতি রয়েছে। শিল্পে বাস্তবতার প্রতিফলন হিসেবে এইভাবেও রিপ্রেজেন্টেশন এসেছে বলে জুলিয়ান বেলের ধারণা।

অনুকরণ দিয়ে শিল্প সমালোচনার যে শুরু ‘রিপ্রেজেন্টেশন’ শব্দটি ও তার একাধিক ব্যাখ্যা দিয়ে সেই আলোচনার সমাপ্তি হয়ে যায় নি। ‘রিপ্রেজেন্টেশন’ নিয়ে আরো দার্শনিক ও তাত্ত্বিক আলোচনা হয়েছে যার কিছু দৃষ্টান্ত দেওয়া প্রয়োজন। অনুকরণ বা ইমিটেশনের স্থানে রিপ্রেজেন্টেশনের প্রসঙ্গ ইউরোপে প্রথম দেখা দেয় ষষ্ঠদশ ও সপ্তদশ শতাব্দীতে, যার উল্লেখ করা হয়েছে। তখন তার অর্থ করা হয় বাস্তবের ‘বিকল্প’। একই সময়ে থমাস হবস্ তাঁর লেভিয়াথান বইতে রিপ্রেজেন্টেশনের আরো বিশদ ও ব্যাপক ব্যাখ্যা দেন যে সম্বন্ধে ইতিপূর্বে কিছু আলোচনা হয়েছে। তিনি রিপ্রেজেন্টেশনকে মাইমেসিস বা ইমিটেশনের সমার্থক মনে না করে দুটি ভিন্ন ব্যাখ্যা দেন। প্রথম ব্যাখ্যা অনুযায়ী ‘রিপ্রেজেন্টেশন’ শব্দটি একজন ব্যক্তিসম্মত হয়ে অন্য একজনের সম্মতির ভিত্তিতে এবং তার দ্বারা ক্ষমতাপ্রাপ্ত হয়ে তাকে প্রতিনিধিত্ব করেন। যেমন, একজন আইনজীবী তাঁর মক্কেলের প্রতিনিধিত্ব করে থাকেন। এখানে পারস্পরিক সম্মতি ছাড়াও একপক্ষ কর্তৃক অন্যপক্ষকে ক্ষমতা প্রদানের বিষয় রয়েছে। শিল্পকর্মের ক্ষেত্রে রিপ্রেজেন্টেশনের অর্থ কী তার ব্যাখ্যায় হবস্ বলেছেন, এখানে শিল্পকর্মের গ্রহণযোগ্যতা সম্বন্ধে শিল্পী ও দর্শকের মধ্যে সমঝোতা বা ঐকমত্য প্রতিষ্ঠিত হতে হবে যার ফলে যে মূর্তি বা প্রতিকৃতি তৈরি হয়েছে তা বিষয়ের (দেবদেবীর) কল্পিত রূপের সদৃশ্য না হলেও উপাসনার যোগ্য বলে মনে করা হবে। হবস্ একটি দৃষ্টান্ত দিয়ে বলেছেন যে, শিল্পী যদি একটি পাথরখ-কে নেপচুন দেবতার মূর্তি বলে ঘোষণা করে এবং উপাসকরা তাই সত্য বলে মনে করে তাহলে যে সমঝোতার সৃষ্টি হয়ে তার ভিত্তিতেই প্রস্তরখ-টি দেবতা নেপচুনের রিপ্রেজেন্টেশন করতে পারবে। দুইপক্ষের এই সমঝোতার পেছনে থাকে সমাজের বা গোষ্ঠীর সদস্যদের অনুসৃত সামাজিক-ধর্মীয় আচার, রীতি এবং প্রথা যার ভিত্তিতে শিল্পীর সৃষ্টি মূর্তি বা প্রতিকৃতিকে মূল বিষয়ের সদৃশ (রিজেমবেস্নন্স) বা প্রতিনিধিত্বকারী (রিপ্রেজেন্টেশন) বলে মনে করা হয়। জুলিয়ান বেলের মতে, এই ব্যাখ্যায় প্রকারন্তরে শিল্পের দৃষ্টিকোণ থেকে রিপ্রেজেন্টেশনকে অনুকরণ মনে না করে বাস্তবের (বিকল্প) মনে করা হয়েছে। অর্থাৎ তিনি বলতে চেয়েছেন এই ব্যাখ্যা দ্বারা রিপ্রেজেন্টেশন শব্দটির বিশেষ অর্থ যোগ করা হলো। শিল্পী ও দর্শক যদি যা শিল্পীর হাতে সৃষ্ট হয়েছে তা বাস্তবের সদৃশ বা বিকল্প, এই বিশ্বাস পোষণ করে তাহলে রিপ্রেজেন্টেশনের মাধ্যমে সেই প্রক্রিয়া সংঘটিত হয়েছে মনে করা যায়। জুলিয়ান বেলের মতে, বিংশ শতাব্দীতে শিল্পকে এইভাবে বাস্তবের অনুকরণ মনে না করে শিল্পীর সৃজনশীল সৃষ্টি হিসেবে গ্রহণ করা হয়েছে। অর্থাৎ রিপ্রেজেন্টেশনে অনুকরণ থাকলেও সৃজনশীলতাই প্রধান বলে তিনি মনে করেছেন। তাঁর এই ব্যাখ্যায় অনুকরণই যে সৃজনশীলতার ভিত্তি বা সম্পূরক তার সরাসরি স্বীকৃতি নেই। সেজন্য বেলের দেওয়া রিপ্রেজেন্টেশনের এই সংকীর্ণ ব্যাখ্যা গ্রহণ না করে শব্দটির অর্থ ‘সৃজনশীল অনুকরণ’ মনে করাই বেশি সমেত্মাষজনক বলে মনে হয়। এতে করে ‘রিপ্রেজেন্টেশন’ কথাটির মধ্যে ন্যূনতমভাবে হলেও অনুকরণ রয়েছে বলে স্বীকার করা হয়। এটা মনে করা কেন গুরুত্বপূর্ণ? এর উত্তর নিচের আলোচনায় পাওয়া যাবে।

প্রাগৈতিহাসিক যুগের শিল্পকর্ম দেখে প্রথম দর্শনে সেইসব অনুকরণভিত্তিক এবং অনুকরণ মানুষের সহজাত প্রবৃত্তি এই উপসংহারে আসা হয়েছে। পরে দেয়ালচিত্রে এবং অন্যত্র সৃজনশীল শিল্পকর্ম দেখে প্রাগৈতিহাসিক মানুষের মধ্যে যে সৃজনশীলতাও সহজাত প্রবৃত্তি ছিল, তার প্রমাণ পাওয়া গিয়েছে যদিও অনুকরণের ওপরই জোর দেওয়া হয়েছে বেশি, কেননা পশুশিকার ও আত্মরক্ষার জন্য তৈরি হাতিয়ার নির্মাণে (পাথর বা গাছের ডাল কেটে) গুহাবাসী মানুষ একে অন্যের অনুকরণ করেছে, এই তথ্য প্রত্নতাত্ত্বিকদের (নৃ-তাত্ত্বিক গবেষণা শুরু হয়েছে অনেক পরে কেননা এই ডিসিপিস্নন গড়ে উঠতে সময় নিয়েছে) কাছে বেশি গুরুত্ব পেয়েছে। সৃজনশীল অনুকরণের মাধ্যমে শিল্পকর্ম আবিষ্কারের পর সৃজনশীলতাও যে মানুষের সহজাত প্রবৃত্তি, এটা মেনে নিতে সময় নিয়েছে। এই ক্ষেত্রে ব্যাখ্যা ও বিশেস্নষণ দিয়ে পরবর্তীতে শিল্প-ঐতিহাসিকরা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখলেও সৃজনশীলতাকে সহজাত প্রবৃত্তি, এ কথা সরাসরি কেউ বলেন নি, এমনকি মনসত্মাত্ত্বিকরাও নন। শিল্পের ব্যাখ্যায় এই প্রতিষ্ঠিত সত্য উহ্য থাকা একটা বড় ত্রুটি। শিল্পে প্রাগৈতিহাসিক যুগ থেকে অনুকরণ ও সৃজনশীলতা, উভয়ের ভিত্তিতে শিল্প সৃষ্টি করা হয়েছে, এ কথা স্বীকার করা হলে শিল্পে অনুকরণবাদের একচেটিয়া ভূমিকার স্থানে সৃজনশীলতারও ভূমিকা স্বীকার করা হয়। এই ব্যাখ্যার ভিত্তিতে ইমিটেশন থিয়োরি দিয়ে নয়, এমন একটি শব্দের ব্যবহার বা প্রয়োগ করা সমীচীন যা দুটি বৈশিষ্ট্যকেই ধারণ করে। ‘রিপ্রেজেন্টেশন’ নিয়ে এতক্ষণ যে আলোচনা হয়েছে তার ভিত্তিতে মনে করা যায় যে, এর দ্বারা অনুকরণ ও সৃজনশীলতা, উভয় অর্থই ব্যাখ্যা করা সম্ভব।

শিল্পে বাস্তবের প্রতিফলনের ব্যাখ্যায় ‘রিপ্রেজেন্টেশন’ বহুল আলোচিত হলেও এ বিষয়ে ঐকমত্য প্রতিষ্ঠিত হয়েছে, এ কথা বলা যায় না। তবে এই কথাটি যে, গ্রিক শব্দ ‘মাইমেসিসে’র মতো একাধিক অর্থ বহন করে সেই স্বীকৃতি পাওয়া গিয়েছে। এখন আরো কিছু দার্শনিক, শিল্প-ঐতিহাসিকের মতামত বিশেস্নষণ করে রিপ্রেজেন্টেশনের পক্ষে-বিপক্ষে দেওয়া ব্যাখ্যার পর্যালোচনা করা যেতে পারে।

‘রিপ্রেজেন্টেশন’কে যদি অনুকরণ বা এর সমার্থক বলে মনে করা হয় (যেমন, ‘মাইমেসিস’কে করা হয়েছে বলে গ্যাডামার মনে করেছেন) তাহলে এর বিরুদ্ধে প্রথম সমালোচনা হবে যে বস্ত্তর হুবহু অনুকরণ আক্ষরিক অর্থে অসম্ভব। এই প্রসঙ্গে শিল্প-ঐতিহাসিক গমব্রিখ বলেছেন, শিল্পী আরাম করে বসে স্বচ্ছন্দে যা দেখতে পান তা-ই এঁকে বা পেইন্ট করে দেখাতে পারেন না। তাদেরকে দৃশ্যমান বস্ত্ত বা বিষয়ের (মানুষ, জীব-জন্তু, প্রাকৃতিক দৃশ্য) একটা ব্যাখ্যা বা অর্থ আবিষ্কারের প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে অগ্রসর হতে হয়। তিনি এই প্রক্রিয়ার নাম দিয়েছেন ‘স্কিমা’ (প্রকল্প/নকশা) ও ‘কারেকশন’ (সংশোধন)। যে বস্ত্তর প্রতিকৃতি তৈরি হচ্ছে শিল্পে তার বিশেষ বৈশিষ্ট্যগুলির সঙ্গে ছবি আঁকার রীতিনীতি ও পদ্ধতি (কনভেনশন) যুক্ত করার কাজ দিয়ে শুরু হয় শিল্প সৃষ্টি প্রক্রিয়া। এটি বেশ সময়সাপেক্ষ, কেননা এর পেছনে কাজ করে শিল্পে ব্যবহৃত শৈলীর দীর্ঘ ইতিহাস। ষষ্ঠদশ শতাব্দীতে একজন শিল্পী কোনো ব্যক্তির প্রতিকৃতি যেভাবে এঁকেছিলেন বিংশ শতাব্দীর শিল্পী সেইভাবে আঁকেন না, কেননা শিল্পে শৈলীর বিবর্তন হয়েছে যদিও মানুষের চেহারায় কোনো পরিবর্তন আসে নি (১৯৮৩)। গমব্রিখ এইভাবে তাঁর আর্ট অ্যান্ড ইল্যুশন বইতে ছবি ব্যাখ্যার প্রচলিত এবং প্রতীকী পদ্ধতির বিশদ ব্যাখ্যা দিয়েছেন যা শিল্পের ইতিহাসে গুরুত্বপূর্ণ হিসেবে বিবেচিত। যেমন, শিল্পীদের শিক্ষাসূচিতে ফিগারকে প্রচলিত পদ্ধতিতে যেভাবে দেখানো হয় তার বর্ণনা ও দৃষ্টান্ত (১৯৬০)। গুডম্যান ইমিটেশন থিয়োরি সম্বন্ধে প্রায় একই কিন্তু আরো জোরালো সমালোচনা করে বলেছেন, কোনো একটি বস্ত্ত বা বিষয় দেখতে যেমন ঠিক সেইভাবে অনুকরণ (কপি) করা সম্ভব না, কেননা সেই বস্ত্ত বা বিষয়টি নানা উপাদানের সমষ্টি যার জন্য তার প্রতিকৃতি (ইমেজ) বিভিন্ন হতে পারে। যেমন, একজন মানুষের (বিষয়) জৈবিক (বায়োলজিকাল) সত্তা আছে, সে অনেক ‘সেল’ (কোষ) দিয়ে তৈরি, তার ভেতর অসংখ্য অনুকণা আছে, সে বুদ্ধিমান, নির্বোধ অথবা ভাঁড় এবং অনেক কিছু হতে পারে। যেহেতু এ মানুষটির একক এবং অভিন্ন কোনো সত্তা বা পরিচিতি নেই সেজন্য তার অনুকরণভিত্তিক প্রতিকৃতি আঁকা সম্ভব না (১৯৭২)। তৃতীয় একটি মত অনুযায়ী, (এটি আগেই উল্লেখ করা হয়েছে) বাস্তবের তুলনায় অনুকরণভিত্তিক প্রতিফলন অর্থহীন, কেননা বাস্তবের হুবহু অনুকরণ সম্ভব না। সেজন্য একজন শিল্পী যদি বাস্তবের অনুকরণভিত্তিক প্রতিফলন করে তাহলে তা শুধু ‘কপি’ করা হবে না, ত্রুটিপূর্ণও বলতে হবে। এইসব সমালোচনার ভিত্তিতে আধুনিককালেও অনেকে মনে করেন যে, শিল্পের কাজ অনুকরণ নয়, বস্ত্তর আদর্শ রূপের সৃষ্টি।

রেনেসাঁ যুগের নিও-পেস্নটোনিস্ট শিল্পী-সমালোচকদের অভিমত ছিল যে, শিল্পকর্মে যদি কোনো বস্ত্ত বাস্তবে যেমন দেখায় তেমনভাবে না এঁকে আদর্শরূপে এঁকে দেখানো হয় তাহলে সেই সৃষ্টি, ‘রিপ্রেজেন্টেটিভ আর্ট’, বাস্তব থেকে দূরে নয় বরং উচ্চপর্যায়ের বাস্তবের কাছে পৌঁছাতে পারবে। উল্লেখযোগ্য যে, এখানে তাঁরা ‘রিপ্রেজেন্টেটিভ আর্ট’ কথাটি ব্যবহার করেছেন, কিন্তু সীমিত অর্থে। দার্শনিক হেগেল একই মত পোষণ করেছেন। তাঁর কাছে ইন্দ্রিয়জ অভিজ্ঞতা শিল্পে আত্মার স্বরূপের প্রতিনিধিত্ব করে। তিনি আরো বলেন, এই প্রক্রিয়ায় শিল্প তার নিজস্ব উপকরণের ভিত্তিতে চারুশিল্প (ফাইন আর্টস) এমনভাবে সৃষ্টি করতে পারে যা ক্ষণস্থায়ী, ইন্দ্রিয়জ এবং বাইরের জগতের (বাস্তবের) সঙ্গে মধ্যস্থতার সম্পর্ক তৈরি সম্ভব করে তোলে (১৮৩৮/১৯৭৫)।

শিল্প-সমালোচক কেনেথ ক্লার্কও একই প্রসঙ্গে বলেছেন : বাইরের জগতের সৌন্দর্যের সন্ধানে আমাদের সহজাত বাসনা হলো নিখুঁত শিল্প সৃষ্টি করা যা অনুকরণের ভিত্তিতে করা সম্ভব নয় (১৯৫৬)। এই প্রসঙ্গে তিনি বলেছেন, অনেক শিল্পীর কাজ বাস্তবের আদর্শ রূপের সৃষ্টি করেছে। যেমন, রাফায়েলের ছবি বাইরের জগতের হুবহু অনুকরণ নয়, সেইসব সচেতনভাবে সাজানো (কম্পোজ)। তাঁর সৃষ্টি ‘ম্যাডোনা’র মুখচ্ছবি বাস্তবের মডেলের তুলনায় আদর্শায়িত সৌন্দর্যকে ধারণ করেছে।

ইমিটেশনের থিয়োরির সমালোচনা করলেও এর স্থানে বা বিপরীতে ‘রিপ্রেজেন্টেশন’ কথাটির ব্যবহার ওপরে উলিস্নখিত কেউ করেন নি। ‘রিপ্রেজেন্টেটিভ আর্ট’ কথাটি রেনেসাঁ যুগে নিও-পেস্নটোনিস্টরা করলেও তার প্রয়োগ ছিল সীমিত ক্ষেত্রে, ‘অদর্শায়িত শিল্প’ সম্পর্কে। রিপ্রেজেন্টেশন বলতে অনেকে যা মনে করেছেন তার মাধ্যমে বাস্তবের আদর্শায়িত (আইডিয়ালাইজড্) প্রতিফলন কীভাবে হতে পারে তার ব্যাখ্যা দেওয়া হলে রিপ্রেজেন্টেশনের একটা সংজ্ঞা পাওয়া যেত। এটা না করে শিল্প সমালোচনায় দীর্ঘ সময় ধরে বাস্তবের আদর্শায়িত রূপায়ণ রিপ্রেজেন্টেশনের মাধ্যমে কীভাবে করা যেতে পারে, সেই বিষয়টিকে সমস্যা হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। কারো মতে, বাস্তবের আদর্শায়িত প্রতিফলনকে রিপ্রেজেন্টেশনাল শিল্পীরা গ্রহণ করে কীভাবে অগ্রসর হবেন সেই বিবেচনা শিল্প সমালোচনায় আসা উচিত। এখানে রিপ্রেজেন্টেশনাল শিল্পী বলতে কাদের বোঝানো হয়েছে তার ব্যাখ্যা নেই। রিপ্রেজেন্টেশনের পূর্ণাঙ্গ এবং সমেত্মাষজনক তত্ত্বের ইঙ্গিত বা আভাস এইসব আলোচনায় পাওয়া যায় না।

ওপরের আলোচনা ছাড়াও শিল্পে বাস্তবের প্রতিফলন প্রসঙ্গে যে আধিবিদ্যক ধারণার ওপর অনুকরণ ও আদর্শায়িত রূপের অসিত্মত্ব নির্ভরশীল সে সম্পর্কেও সংশয় প্রকাশ করা হয়েছে, যা পরোক্ষে অনুকরণবাদেরই সমালোচনা। অধিবিদ্যায় অনুকরণ এবং আদর্শায়ন বিষয়েও ওপরে যে কথা বলা হয়েছে তা নির্ভর করে বাস্তবতা এবং পৃথিবীর অসিত্মত্ব সম্পর্কে ধারণার পার্থক্যের ওপর। এইসব সমালোচকের মধ্যে দার্শনিক ডিউঈ, হেইডেগার, শিল্প-ঐতিহাসিক গমব্রিখ, শিল্প-সমালোচক এবং অন্যদের মতে অনুকৃত অথবা আদর্শায়িত হওয়ার জন্য পৃথিবী নিশ্চুপ হয়ে বসে নেই। তাঁদের ধারণায় পৃথিবী নিজের অসিত্মত্ব দিয়েই আংশিকভাবে নিজেকে প্রকাশ কিংবা ব্যাখ্যা করেছে অর্থাৎ পৃথিবীর (বাস্তবের) ব্যাখ্যার জন্য শিল্পকর্মের মাধ্যমে অনুকৃত বা আদর্শায়িত হওয়ার প্রয়োজন নেই (ডিউঈ ১৯৩৪, হেইডেগার ১৯৫০, গমব্রিখ ১৯৮৩, গ্যাডামার ১৯৬০)। ডিউঈ আরো স্পষ্ট করে বলেছেন : যেসব বস্ত্ত নির্মীয়মাণ, ভাষাহীন, অসমাপ্ত, নিয়ন্ত্রিত এবং যাদের প্রতিহত করা হয়েছে শিল্প তাদেরই অর্থ ব্যাখ্যা করে অনুকরণ বা অদর্শায়নের নতুন অভিজ্ঞতা সৃষ্টির মাধ্যমে। অর্থাৎ অনুকৃত শিল্প বা আদর্শায়িত রূপায়ণের দ্বারা পৃথিবীর বাস্তবতার ব্যাখ্যার প্রয়োজন পড়ে না। ডিউঈ এবং অন্যান্য যাঁদের নাম উল্লেখ করা হয়েছে, তাঁদের মন্তব্যে শিল্পে অনুকরণবাদের সমালোচনা থাকলেও আদর্শায়নের বিরুদ্ধে কোনো বিরূপ মন্তব্য নেই, কেবল যে আধিবিদ্যক দর্শনের ওপর ভিত্তি করে এই ধরনের শিল্প সৃষ্টি করা হয় তার সমালোচনা রয়েছে।

শিল্পের ব্যাখ্যায় (বাস্তবের প্রতিফলন বিষয়ে) আধিবিদ্যক দর্শনে শর্তাধীন সমর্থনও হেইডেগার এবং গ্যাডামার মানতে রাজি নন। হেইডেগারের মতে, শিল্পকর্ম একটা বাস্তবের সৃষ্টি করে এবং তা স্থায়ী করে রাখতে চায়। অর্থাৎ অনুকরণকেই প্রকৃত সত্য বলে প্রতিষ্ঠিত করতে আগ্রহী। গ্যাডামার বিদ্রূপের সঙ্গে বলেন, ‘শিল্প সৃষ্টিতে মূল বিষয় (বাস্তব) ও প্রতিকৃতির মাধ্যমে অসিত্মত্বভিত্তিক যে সম্পর্ক তা সম্পূর্ণ উল্টে দেওয়া হয়। অর্থাৎ বাস্তব প্রতিকৃতির প্রতিফলনের ভূমিকা নেয় যা অর্থহীন এবং অপ্রয়োজনীয়। জীবন শিল্পের অনুকরণ করে, এ কথা বলাই যেন শিল্পের উদ্দেশ্য।’ গ্যাডামারের এই উক্তিতে ‘রিপ্রেজেন্টেশন’ তত্ত্বের পূর্বাভাস রয়েছে কিন্তু তার বিশদ ব্যাখ্যা নেই। গুডম্যান ‘রিপ্রেজেন্টেশন’ তত্ত্বের একটা মোটামুটি ব্যাখ্যা দিয়েছেন। তিনি বলেছেন, ‘ভাষায় লেখা অনুচ্ছেদ যেভাবে বাস্তবের বর্ণনা করে, সেইভাবে ছবি যখন বস্ত্তকে রিপ্রেজেন্ট করে তখন তা সেই বস্ত্তর ব্যাখ্যা দেয় এবং বর্ণনা করে।’ অর্থাৎ ব্যাখ্যা দেওয়া ও বর্ণনা করা রিপ্রেজেন্টেশনের ভূমিকা। তাঁর মত অনুযায়ী একটি ছবির সঙ্গে তার বিষয়ের সম্পর্ক একটি নাম এবং যার নামকরণ করা হয় তাদের মতো এক না হলেও কোনো কোনো ক্ষেত্রে তারা মিলে যায়। অন্যভাবে বলতে গেলে এই সম্পর্ক একটি বিষয়ের বর্ণনা ও যা বর্ণনার বিষয়, তাদের সম্পর্কের সদৃশ। গুডম্যান এই মত প্রকাশ করে ছবি ও ভাষায় বর্ণনার এবং শিল্প জগতের পদ্ধতি ও ভাষার প্রকাশধর্মিতার (আর্টিকুলেশন ভিউ) যে চরিত্র বা ভূমিকা, তার স্বপক্ষে অবস্থান নিয়েছেন। কিন্তু এর (প্রকাশধর্মিতার) পাশাপাশি ছবির রিপ্রেজেন্টেশনের যে নির্দেশনামূলক বা ব্যাখ্যামূলক (ডিনোটেশন ভিউ) পরিচিতি সেটিও স্বীকার করে নেন। এর ফলে ছবির প্রতিনিধিত্বমূলকতা (পিক্টোরিয়াল রিপ্রেজেন্টেশন) ভূমিকার সঙ্গে ভাষার নির্দেশনা বা ব্যাখ্যামূলক (ডিনোটেশন) ভূমিকার মধ্যে সম্পর্ক স্থাপিত হতে পারে। এই আলোচনা থেকে বোঝা যায়, গুডম্যান রিপ্রেজেন্টেশনের যে নির্দেশনাসূচক বা ব্যাখ্যামূলক (ডিনোটেশন) সংজ্ঞা তার শক্ত সমর্থক। এই ‘ডিনোটেশন ভিউ’ রিপ্রেজেন্টেশনের মধ্যে প্রকাশ (অনুকরণের ভিত্তিতে) এবং সৃজনশীল ব্যাখ্যা, উভয় বৈশিষ্ট্য আছে বলে প্রকারান্তরে ব্যক্ত করা হয়েছে। এই ব্যাখ্যায় পরোক্ষে হলেও ‘রিপ্রেজেন্টেশনে’র সমেত্মাষজনক অর্থ পাওয়া যায় কিন্তু ‘ডিনোটেশন ভিউ’কেই গুরুত্ব দেওয়ার জন্য কথাটি শিল্পে বাস্তবতার প্রতিফলন প্রক্রিয়ার নামকরণে অধিকতর প্রযোজ্য, এর স্বীকৃতি পায় না।

নির্দেশনা বা ব্যাখ্যামূলক (ডিনোটেশন ভিউ) মতের একটি বহুল স্বীকৃত অর্থ হলো, যে বস্ত্তকে প্রকাশ করা হচ্ছে তার সঙ্গে প্রকাশ প্রক্রিয়ার যে সম্পর্ক সেটি প্রচলিত প্রতীক চিহ্ন পদ্ধতির সাহায্যে মধ্যস্থতা করে থাকে। এজন্য প্রকাশ প্রক্রিয়া এবং যে বস্ত্তকে প্রকাশ করা হচ্ছে তাদের অন্তর্গত বা স্বাভাবিক সম্পর্কের উল্লেখ বা ব্যাখ্যা এখানে অবান্তর।

শিল্পী ছবি আঁকার প্রচলিত ‘ভাষা’র শব্দভা-ার নিয়ে কাজ করেন, যাঁরা ওইসব ছবির ব্যাখ্যা দেন তাঁদেরকে সেই শব্দভা-ারের সঙ্গে পরিচিত এবং সে বিষয়ে অভিজ্ঞ হতে হবে। এ সত্ত্বেও গুডম্যানের রিপ্রেজেন্টেশন থিয়োরিতে (যা ডিনোটেশন এবং আর্টিকুলেশন ভিউয়ের সমন্বিত ব্যাখ্যা) প্রকাশ পদ্ধতি বা ব্যাখ্যা প্রদানকারী পদ্ধতিতে ছবি এবং ভাষার মধ্যে যেসব পার্থক্য তার জন্য এই থিয়োরির ব্যবহারযোগ্যতা বেশ সীমিত। যেমন, ভাষা পদ্ধতিতে যেসব প্রতীকী উপকরণ রয়েছে (শব্দ) সেইসব পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে জানা প্রয়োজন। অপরদিকে পিক্টোরিয়াল সিস্টেম (চিত্রভিত্তিক পদ্ধতি) একবারেই সহজে আয়ত্তে আনা যায়। এইভাবে একটি ছবিকে ব্যাখ্যা করার যে ক্ষমতা অর্জিত হয় তা অন্য ছবির ব্যাখ্যাতেও প্রযোজ্য। গুডম্যানের দৃষ্টিতে ‘ডেপিকশন’ (বর্ণনা/ব্যাখ্যা) একটি প্রতীকী পদ্ধতি নয়। রিপ্রেজেন্টেশনের জন্য ডিনোটেশন (নির্দেশনা) থিয়োরি ও আর্টিকুলেশন থিয়োরি ব্যবহার করা হলে তা শুধু ফলপ্রসূ নয়, সফল হতে পারবে বলে তাঁর ধারণা।

ফ্লিন্ট শিয়ার নামে শিল্প-সমালোচক রিপ্রেজেন্টেশন তত্ত্বের আলোচনায় যা বলেছেন তা পূর্ববর্তী দার্শনিক-তাত্ত্বিকদের আলোচনা থেকে পৃথক শুধু নয়, বেশ বিপরীতে। তাঁর মতে, শিল্প জগতের একটা বৈশিষ্ট্য হলো যখন কেউ এর অন্তর্গত কোনো অংশের (ছবির) ব্যাখ্যায় সমর্থ হয় তখন তার এই যোগ্যতা অন্য অংশের (ছবি) ক্ষেত্রেও প্রয়োগ করা সম্ভব হয়। শুধু প্রয়োজন যে বস্ত্তর প্রতিকৃতি সৃষ্টি করা হয়েছে তা শনাক্ত করার ক্ষমতা (১৯৮৬)। শিল্প জগতের এই বৈশিষ্ট্যকে শিয়ার বর্ণনা করেছেন ‘স্বাভাবিক উৎপাদন ক্ষমতা’ (শনাক্তকরণমূলক) বলে। যেমন, কেউ যদি রহিম দেখতে কেমন তা জানে তাহলে তার ফটোগ্রাফ ব্যাখ্যা করার ক্ষমতা থাকলে রহিমের ফটোগ্রাফ দেখলেই বলতে পারবে সেটি রহিমের। এর ভিত্তিতে তিনি বলেন যে, ছবি দেখে ব্যাখ্যা করার অভিজ্ঞতার মতোই এটি একই শ্রেণির দক্ষতা। ভাষার ক্ষেত্রে এমন দৃষ্টান্ত নেই। যেমন, ‘বিড়াল’ বললে এবং তা চিনলে অন্য বিড়াল দেখে শনাক্ত করা যায়, কুকুরকে নয়। এই যুক্তি ব্যবহার করে শিয়ার বলতে চান যে, এই অভিজ্ঞতা বা দৃষ্টান্ত রিপ্রেজেন্টেশন থিয়োরিতে অনুকরণ নির্ভরতার প্রাধান্যের কথা বলে। ফটোগ্রাফ এবং ফটোগ্রাফের প্রতিকৃতি, তাদের মধ্যে সাধারণ যে প্রকৃতি বা বৈশিষ্ট্য এবং যার ভিত্তিতে একটি অন্যটির প্রতিনিধিত্ব করে তার পেছনে কাজ করে দুটি শনাক্তকরণের একই যোগ্যতা।

আলোচনার ভিত্তিতে এই শিয়ার বলেন, ছবি দেখে ছবি শনাক্তকরণের যোগ্যতা দ্বারা রিপ্রেজেন্টেশনের অনুকরণবাদের প্রতি নির্ভরশীলতার ওপরই আলোকপাত করা হয়। অর্থাৎ রিপ্রেজেন্টেশনে অনুকরণই প্রধান ভূমিকা পালন করে। রহিমের চেহারা স্মৃতিতে রেখে তার ফটোগ্রাফে সেই চেহারার সাদৃশ্য দেখে তাকে শনাক্ত করা মানেই অনুকরণের ক্ষমতা ব্যবহার করা। এই যুক্তি ব্যবহার করে শিয়ার পূর্বোক্ত দার্শনিক-সমালোচকরা ইমিটেশন থিয়োরির বিরুদ্ধে যেভাবে বক্তব্য রেখেছেন তিনি তা করেন নি। বরং তাঁরা যা বলেন নি তিনি তা বলেছেন অর্থাৎ রিপ্রেজেন্টেশনের কথা বলেছেন শর্তাধীনে, বাস্তবের প্রতিফলনের উপায় বা পদ্ধতি হিসেবে রিপ্রেজেন্টেশন অনুকরণের ব্যবহার করে, এর উল্লেখ করে। তিনি যদি রিপ্রেজেন্টেশনে অনুকরণের ভূমিকার কথা না বলতেন তাহলে তাঁর ব্যাখ্যায় শিল্পে বাস্তবতার প্রতিফলনে ‘রিপ্রেজেন্টেশন’ শব্দটির ব্যবহার প্রাধান্য পেত অনুকরণের স্বীকৃতি ছাড়াই। তাঁর আগে যেসব দার্শনিক-সমালোচকের মতামত আলোচিত হয়েছে সেখানে ইমিটেশনের বিপক্ষেই মতামত ব্যক্ত করা হয়েছে বেশি কিন্তু এর বিকল্প হিসেবে কোন তত্ত্ব বা শব্দটি যথাযথভাবে শিল্প সৃষ্টির ব্যাখ্যা করতে সক্ষম তার সুস্পষ্ট উল্লেখ নেই। পেস্নটো এবং অ্যারিস্টটলও শিল্পে সৃজনশীলতার ভূমিকার একেবারেই উল্লেখ করেন নি, এ বিষয়টিও বিস্ময়কর, কেননা প্রাচীন গ্রিসেও শিল্প সৃষ্টিতে কেবল অনুকরণ নয়, সৃজনশীলতার সাহায্যও নেওয়া হয়েছে। তারা কেউ এমন কোনো বা তার প্রতিশব্দ ব্যবহার করেন নি যার মধ্যে দুটি পদ্ধতিরই স্বীকৃতি রয়েছে।

এই লেখার প্রধান উদ্দেশ্য রিপ্রেজেন্টেশনের দ্ব্যর্থবোধক অর্থকে (অনুকরণ এবং সৃজনশীলতার সংমিশ্রণ) বাস্তবের প্রতিফলন হিসেবে গ্রহণ করা যেখানে অনুকরণের তারতম্য থাকতে পারে কিন্তু একেবারে প্রত্যাখ্যাত হয় না বা অনুপস্থিত থাকে না। প্রাগৈতিহাসিক যুগের শিল্পের আলোচনার সময় রিপ্রেজেন্টেশনের এই বিশদ সংজ্ঞার বিষয়ে দৃষ্টান্তসহ আলোচনা হবে। রিপ্রেজেন্টেশনের এই সংজ্ঞায় হেগেলের দ্বিপাক্ষিক (শিল্পী ও দর্শকের মধ্যে) সম্মতির প্রয়োজন নেই, এ ক্ষেত্রে শিল্পীর সিদ্ধান্তই (ছবি সম্পর্কে) চূড়ান্ত মনে করা হবে, কেননা শিল্পীই অনুকরণ ও সৃজনশীলতার অনুপাত নির্ধারণ করে বাস্তবের প্রতিফলন করে। এখানে তাঁর শিল্পচেতনা, শিল্পজ্ঞান এবং শিল্পচর্চার অভিজ্ঞতা প্রধান ভূমিকা রাখে।

 

\আট\

বাস্তবের সঙ্গে শিল্পকর্মের ব্যাখ্যা প্রাচীন গ্রিসে পেস্নটো এবং অ্যারিস্টটলের সময় থেকে শুরু হয়েছে মনে করা হলেও শিল্প ও বাস্তবের সম্পর্ক স্থাপিত হয়েছে প্রাগৈতিহাসিক যুগে (একে প্যালিওলিথিক বা পুরাতন প্রস্তর যুগের শেষ পর্ব বলা হয়) যখন মানুষ গুহাবাসী ছিল এবং প্রধানত পশু শিকার করে জীবন ধারণ করত। এর সময়কাল ৮০ হাজার থেকে ১৪ হাজার বছর বলে হিসাব করা হয়েছে। এই যুগের শুরু হয়েছিল খ্রিষ্টপূর্ব ৫০ হাজার বছরে এবং সমাপ্তি ঘটে খ্রিষ্টপূর্ব ১৫ হাজার বছরে। প্রত্নতাত্ত্বিকরা যখন আদিম গুহাবাসী মানুষের ইতিহাস জানার জন্য, বিশেষ করে তাদের ব্যবহৃত বিভিন্ন বস্ত্ত সম্বন্ধে কৌতূহলী হলেন এবং সরেজমিনে গবেষণা শুরু করলেন তখন অন্যান্য বস্ত্তর মধ্যে আবিষ্কৃত হলো প্যালিওলিথিক যুগের গুহাবাসী মানুষের ব্যবহৃত বিভিন্ন হাতিয়ারের সঙ্গে শিল্পকর্মের দৃষ্টান্ত। এই শিল্পকর্ম ছিল দুই ধরনের। প্রথম শ্রেণিতে ছিল দৈনন্দিন জীবনে ব্যবহৃত বিভিন্ন ধরনের হাতিয়ার (পশু শিকার ও আত্মরক্ষার জন্য) যেসব প্রস্তরখ- এবং গাছের ডালপালা ভেঙে বা কেটে সূচালো করে শিকারের উপযুক্তভাবে তৈরি করা হতো। প্রায় সব আদিম মানুষই (নরনারী নির্বিশেষে) এই কাজে দক্ষ ছিল, কেননা এর ওপর নির্ভর করত তাদের জীবনযাপন এবং জীবনরক্ষা। প্রথম পর্বে বিভিন্ন শ্রেণির হাতিয়ার সৃজনশীলতার ভিত্তিতে তৈরির পর সেইসব অনুকরণের মাধ্যমেই তৈরি করা হয়েছে। প্রথম পর্বে আদিম মানুষকে সৃজনশীল হয়ে হাতিয়ার উদ্ভাবন করতে হয়েছে এবং পরবর্তীতে সেইসব অনুকরণের মাধ্যমে ব্যাপকভাবে তৈরি হয়েছে, এই সময় বিভাজন প্রত্নতাত্ত্বিক কিংবা অন্য কেউ পরবর্তীতে স্পষ্ট করে উল্লেখ করেন নি। প্রাথমিক পর্বে সৃজনশীলতার ব্যবহার করা হলেও হাতিয়ার পর্যাপ্ত সংখ্যায় নির্মাণের জন্য অনুকরণই প্রধান হওয়ায় একে পরবর্তীতে কেউ কেউ কারুশিল্পের সঙ্গে তুলনা করেছেন। সক্রেটিস এই অর্থেই শিল্পকে কারুশিল্প বলেছিলেন। কারুশিল্পে যে অনুকরণ করা হয়েছে তার পেছনে কাজ করেছে মানুষের সহজাত প্রবৃত্তিও। কোনো শ্রেণির প্রথম হাতিয়ারটি যখন উদ্ভাবিত হয় তখন তার পেছনে ভূমিকা রেখেছে যে সৃজনশীলতা সেটিও অনুকরণের মতো মানুষের সহজাত প্রবৃত্তি, কেননা কোনো প্রশিক্ষণ বা পূর্ব অভিজ্ঞতা ছাড়াই আদিম মানুষ হাতিয়ার তৈরির এই সূচনা করেছে এবং এটিও অনুকরণের মতোই সহজাত প্রবৃত্তি না বলে উপায় থাকে না। অনুকরণের জন্য প্রয়োজন হয়েছে মনন ও বুদ্ধির, সৃজনশীলতার পেছনে কাজ করেছে কল্পনা এবং উদ্ভাবনের আগ্রহ। দুটি প্রবৃত্তিই মানুষের দৈনন্দিন জীবনের প্রয়োজন মিটিয়েছে, তবে ভিন্ন ভিন্নভাবে এবং অনুপাতে। অনুকরণে বাস্তব প্রতিফলিত হয়েছে আর সৃজনশীলতায় বাস্তবকে নতুন রূপ দেওয়া হয়েছে (যেমন, পাথর ভেঙে হাতিয়ার তৈরি)। প্রাগৈতিহাসিক যুগেই অনুকরণ এবং সৃজনশীলতা পাশাপাশি থেকে মানুষের জীবনযাপনে সহায়ক হয়েছে এবং সেই সঙ্গে বাস্তবের প্রতিফলন ঘটিয়েছে।

প্রাগৈতিহাসিক যুগের প্যালিওলিথিক পর্বে (খ্রিঃপূঃ ৫০,০০০ থেকে খ্রিঃপূঃ ১৫,০০০) হাতিয়ারের মতো কারুশিল্পের অন্য এক ধরনের শিল্প আবিষ্কৃত হয়েছে গুহাবাসী মানুষের আবাসস্থান গুহার অভ্যন্তরে। দেয়ালে রং দিয়ে আঁকা বড় আকারের পশু শিকারের চিত্র আবিষ্কৃত হয়েছে ইউরোপে এবং আফ্রিকায় আজ থেকে প্রায় চলিস্নশ বছর আগে। এইসব দেয়ালচিত্রের উদ্দেশ্যও ছিল হাতিয়ারের মতো পশু শিকারের জন্য ব্যবহার, তবে ভিন্নভাবে। পশু শিকারের সময় নয়, ঠিক তার আগে আঁকা হয়েছে এইসব দেয়ালচিত্র যেখানে শিকারি মানুষকে হাতিয়ার হাতে এবং শিকারের পশুকে হাতিয়ারবিদ্ধ অবস্থায় দেখানো হয়েছে। স্পেনের আলতামিরা নামক স্থানের গুহায় এবং ফ্রান্সের ল্যাসকোঁ অঞ্চলের গুহার দেয়ালে এই ধরনের আঁকা চিত্রে প্রায় একই ধরনের দৃশ্য দেখা যায়। কেউ কেউ যদিও মনে করেছেন অলংকরণের জন্য এদের সৃষ্টি, সেই ধারণা সঠিক নয় এই কারণে যে, আদিম মানুষের গুহা অলংকরণের সময় ছিল না। তাদের একমাত্র কাজই ছিল পশু শিকার করে জীবন ধারণ করা। তারা যতটুকু অবসর পেয়েছে সে সময় তাদের কেউ কেউ সৃজনশীল হয়ে হাড়ের ওপর বিমূর্ত আঁকিবুকি এঁকেছে, পাথরের খ- দিয়ে মালা তৈরি করেছে, অথবা গায়ে ভেষজ রং লাগিয়ে সেজেছে। বিনোদনের জন্য এর বেশি কিছু করার সময় তারা পায় নি এবং তেমন দৃষ্টান্তও পাওয়া যায় নি। তাছাড়া দেয়ালচিত্র দেখে নান্দনিক আনন্দ পাওয়ার জন্য যে উন্নত মনন ও মানসিকতার প্রয়োজন অষ্টপ্রহর বেঁচে থাকার সংগ্রামে ব্যস্ত মানুষের মধ্যে তা ছিল বলে মনে করা হলে বাড়িয়ে বলা হবে। প্রাগৈতিহাসিক যুগে (প্যালিওলিথিক পর্বে) সব গুহাতেই দেয়ালচিত্রে পশু শিকারের দৃশ্য দেখানো হয়েছে কিনা তা বলার উপায় নেই। তবে ইউরোপ, আফ্রিকা এবং ইন্দোনেশিয়ার গুহায় প্যালিওলিথিক যুগের মানুষের আঁকা দেয়ালচিত্র দেখে মনে হয় এটি বেশ ব্যাপক এবং ভৌগোলিকভাবে বিসত্মৃতই ছিল যার পেছনে কাজ করেছে আদিম মানুষের এক মহাদেশ থেকে অন্য মহাদেশে মাইগ্রেশন এবং পশু শিকারের ওপর নির্ভরশীলতা।

পশু শিকারের সঙ্গে দেয়ালচিত্রের যে সম্পর্ক সে বিষয়ে কোনো সন্দেহ প্রকাশ করা না হলেও প্রকৃত উদ্দেশ্য সম্পর্কে সত্য উদ্ঘাটিত করতে সময় নিয়েছে। প্রত্নতাত্ত্বিক এবং নৃ-তাত্ত্বিক বিশেষজ্ঞরা গবেষণা করে উপসংহারে এসেছেন যে, পশু শিকারের আগে শিকারি মানুষ ম্যাজিকের ক্ষমতা অর্জনের উদ্দেশ্যে এইসব দৃশ্য এঁকেছে। শিকারের দৃশ্য এঁকে শিকারি মানুষ পশুর তুলনায় অধিকতর শক্তির অধিকারী হতে পারে ম্যাজিক ক্ষমতা অর্জন করে, এই বিশ্বাস থেকে দেয়ালচিত্রের সৃষ্টি হয়েছে বলে মনে করা হয়। শুধু তাই নয়, শিকারের দৃশ্যে যেসব পশু দেখানো হয়েছে সেগুলি অস্ত্রবিদ্ধ অথবা অস্ত্র দ্বারা পরাস্ত, এমন অবস্থায় দেখিয়ে সেইসব খাদ্য হিসেবে গুহায় নিয়ে আসা হয়েছে, এই ধারণাও দেওয়া হয়েছে দেয়ালে আঁকা দৃশ্যের মাধ্যমে। গর্ডন চাইল্ডের মতে, ‘উইশ অ্যান্ড উইশ ফুলফিলমেন্ট’ উভয়ই থাকত দেয়ালচিত্রে শিকারের দৃশ্যে (১৯৩৬)।

পশু শিকারের উদ্দেশ্যে গুহাবাসী আদিম মানুষ যেসব পশু ও শিকারির প্রতিকৃতি আঁকত সেগুলি বাস্তবের অনুকরণ ছিল, না তার আলংকারিক (অর্নামেন্টাল) অথবা জ্যামিতিক (জিওমেট্রিক) প্রতিফলন ছিল, এই প্রশ্ন নিয়ে প্রত্নতাত্ত্বিক ও নৃ-তাত্ত্বিকদের মধ্যে, এমনকি শিল্প-ঐতিহাসিকদের মধ্যেও মতানৈক্য দেখা দেয়। কেউ কেউ মনে করেছেন, দেয়ালচিত্রের মানুষ ও পশুকে বাস্তবের অনুকরণে আঁকা হতো না, তাদের চারিত্রিক বা শৈল্পিক বৈশিষ্ট্য ছিল আইডিয়ালাইজড্ বা আদর্শায়িত অথবা স্টাইলাইজড যেখানে কল্পনার ভিত্তিতে আদর্শরূপে কিংবা জ্যামিতিক অলংকরণে শিল্প সৃষ্টি করা হয়েছে। বেশ কয়েকজন জার্মান প্রত্নতত্ত্ববিদ রক্ষণশীল একাডেমেশিয়ান হিসেবে শিল্প সৃষ্টির সূচনার সঙ্গে জ্যামিতিক অলংকরণ এবং কারিগরি কার্যক্রমের (টেকনিকাল ফাংশনালিজম) সম্পর্ক প্রতিষ্ঠিত করতে চেয়েছেন। তাঁদের কেউ কেউ পরবর্তীকালে শিল্পে ও বাস্তববাদিতার (ন্যাচারালিজম) প্রাধান্য মেনে নিলেও শর্তাধীনে এই স্বীকৃতি দেন যার ভিত্তিতে আদিম প্রকৃতিবাদী (প্রিমিটিভ ন্যাচারালিজম) শিল্পকর্মের নিদর্শনেও আর্কাইক আর্টের (ক্লাসিকাল পর্বের আগের প্রাচীন শিল্পে) স্টাইলিস্টিক বা শৈলীগত বৈশিষ্ট্য রয়েছে বলে তাঁরা দাবি করেন। যেমন, মূর্তি বা প্রতিকৃতির সম্মুখভাগ প্রদর্শন, পরিপ্রেক্ষিতের অভাব, স্পেসের অনুপস্থিতি, দলগতভাবে মানুষকে না দেখানোর পরিবর্তে পৃথকভাবে দেখানো এবং ছবির উপকরণগুলির (অংশ) ভেতর ঐক্য সৃষ্টি। এসবই জ্যামিতিক অলংকরণবিশিষ্ট হওয়ার দৃষ্টান্ত যা আদিম শিল্পে (আর্কাইক আর্ট) ছিল এবং গুহার দেয়ালচিত্রে দেখা যায় (আর্নল্ড হাউজারের দি সোসাল হিস্ট্রি অফ আর্ট, ১৯৫৭ বইতে উলিস্নখিত)। গডফ্রিড সেম্পার নামে একজন জার্মান প্রত্নতত্ত্ববিদের মতে, শিল্প যেসব উপকরণ থেকে তৈরি হয় তার গুণগত বৈশিষ্ট্য নির্ধারণ করে দিয়েছে আদিম শিল্প। অলংকরণের ফর্ম এবং যে পদ্ধতিতে এই উপকরণ ব্যবহার করা হয় সেইসবও অলংকরণের ফর্ম সৃষ্টি করে। অর্থাৎ তাঁর মতে, আদিম শিল্পীর কাজে আলংকারিক ফর্ম (বাস্তবের বিপরীতে) না থাকার উপায় ছিল না। এই ফর্ম ছিল স্বাভাবিক এবং স্বতঃস্ফূর্ত, ন্যাচারালিস্টিক নয় (১৮৬০)। এর উত্তরে আলোয়াস রিগেল নামে আর একজন জার্মান প্রত্নতত্ত্ববিদ বলেছেন যে, ‘সব শিল্প, এমনকি আলংকারিক শিল্পের প্রকৃতিবাদী (অনুকরণভিত্তিক) উৎস রয়েছে এবং জ্যামিতিক অলংকরণবিশিষ্ট আর্টকে কোনোভাবেই শিল্পের ইতিহাসের সূচনা পর্ব হিসেবে বিবেচনা করা যায় না।’ তাঁর মতে, জ্যামিতিক আলংকারিক শিল্প, যা বাস্তবের অনুকরণ নয় তার আবির্ভাব হয়েছে শিল্প সৃষ্টি শুরু হওয়ার অনেক পরে (১৮৯৩)। এর উত্তরে ব্রিটিশ প্রত্নতাত্ত্বিক গর্ডন চাইল্ড দ্ব্যর্থহীনভাবে বলেছেন, যে ন্যাচারালিস্টিক আর্ট অর্থাৎ অনুকরণভিত্তিক বাস্তববাদী শিল্পই প্রথমে সৃষ্টি করা হয়েছে এবং এই শিল্পে আর্কাইক আর্টের (অলংকরণবহুল প্রাচীন শিল্পের) কোনো প্রবণতাই দেখা যায় না। তাঁর মতে, প্রাগৈতিহাসিক যুগের (প্যালিওলিথিক পর্বের) শিল্পীর সৃষ্টি ছিল চরমভাবেই বাস্তববাদী এবং প্রাণবন্ত (১৯৩৬)।

আর্নল্ড হাউজার প্রাগৈতিহাসিক যুগের (প্যালিওলিথিক পর্বের) দেয়ালচিত্র সম্বন্ধে বলতে গিয়ে মন্তব্য করেছেন : ‘এই শিল্পের ন্যাচারালিজমের সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য দিক হলো এটি যে, শুধু প্রিমিটিভ আর্টের (আর্কাইক আর্ট) জ্যামিতিক স্টাইলের চেয়েও পুরনো তাই নয়, এর মাধ্যমে শিল্পচর্চা ঐতিহাসিকভাবে যেসব পর্বের ভেতর দিয়ে গিয়েছে সেইসবের পরিচয় পাওয়া যায়।’ তিনি এরপর বলেছেন, ‘এই প্রাগৈতিহাসিক শিল্প সরলরৈখিকভাবে (ধারাবাহিকতার সঙ্গে) বাস্তবের প্রতি বিশ্বস্ত থেকে ক্রমান্বয়ে আরো সূক্ষ্ম ধারণাভিত্তিক (ইম্প্রেশনিস্টিক) আঙ্গিকের দিকে অগ্রসর হয়েছে। প্রাগৈতিহাসিক শিল্পের যে বাস্তববাদিতা (ন্যাচারালিজম) তা এক স্থানে স্থির হয়ে থাকে নি, বরং জীবন্ত এবং গতিশীল ফর্মের আকার গ্রহণ করেছে যার ফলে বাস্তবের প্রতিফলন ঘটেছে বিচিত্র প্রকাশভঙ্গির মাধ্যমে। এই লক্ষ্য অর্জিত হয়েছে কখনো স্বল্পমাত্রায় দক্ষতার সঙ্গে, কখনো উচ্চমাত্রার দক্ষতার ব্যবহারে। অনুকরণের সহজাত প্রবৃত্তির সাহায্যে বাস্তবের প্রতিফলন ধীরে ধীরে পেছনে থেকে গিয়েছে কিন্তু সঙ্গে সঙ্গেই কঠোর, শৃঙ্খলাবদ্ধ পদ্ধতির আধুনিক শিল্প সৃষ্টি হয় নি।’

হাউজার বিস্ময় প্রকাশ করেছেন যে, ঐতিহাসিক যুগের শিল্প আর শিশুদের আঁকা ছবি কিংবা সম্প্রতি আবিষ্কৃত হয়েছে যেসব আদিম জনগোষ্ঠীর শিল্পকর্ম তাদের মধ্যে কোনো মিল নেই, তারা শৈলীগতভাবে সমান্তরালভাবে অগ্রসর হয়েছে, এমন কথাও বলা যাবে না। তিনি এই প্রসঙ্গে বলেছেন, শিশুদের কিংবা সম্প্রতিকালের আদিম জনগোষ্ঠীর ড্রইং এবং শিল্পকর্ম যুক্তিভিত্তিক, ধারণা বা অনুভূতিনির্ভর নয়। এইসব শিল্পকর্মে শিশু বা আদিমগোষ্ঠীর নরনারী যা জানে তাই প্রকাশ করেছে, তারা চোখে যা দেখে সেইসবের প্রতিফলন নেই। তারা একটা বস্ত্তর বানানো বা কৃত্রিম ছবি তৈরি করে, দেখতে জীবন্ত মনে হয়, এমন কিছুর নয়। শিশু বা সম্প্রতিকালের আদিম শিল্পীরা বিষয়ের (মানুষ, জন্তু, পাখি) সম্মুখভাগের দৃশ্যের সঙ্গে পাশের দৃশ্য যোগ করে অথবা ওপর থেকে (এরিয়াল পার্সপেক্টিভ) বিষয়কে দেখায় এবং বিষয় সম্বন্ধে যা জানার তার কিছুই বাদ দেয় না। কিন্তু প্রাগৈতিহাসিক যুগের (প্যালিওলিথিক পর্বের) শিল্পীদের বাস্তববাদী শিল্পকর্মের অদ্ভুত দিক হলো তারা বিষয়ের ভিস্যুয়াল ধারণা দেয় এমন সরাসরি, সামনে আর পাশের দিক যুক্ত করে নয় এবং কোনো যুক্তিভিত্তিক নিয়ম-কানুন বা শৈলী ছাড়াই, যে এর সঙ্গে তুলনা করার জন্য ঊনবিংশ শতাব্দীর ইম্প্রেশনিজমের ধারার কথা ভাবতে হয়। প্রাগৈতিহাসিক শিল্পে গতির ধারণা পাওয়া যায় যার সঙ্গে তুলনীয় আধুনিক ফটোগ্রাফি অথবা ঊনবিংশ শতাব্দীর ফরাসি শিল্পী তুলোঁ লত্রাক এবং দেগাসের ছবি। যারা ইম্প্রেশনিজমের ছবি দেখে নি তাদের কাছে প্রাগৈতিহাসিক এইসব ছবি দুর্বলভাবে আঁকা এবং দুর্বোধ্য মনে হবে। প্রাগৈতিহাসিক ছবির অগ্রসর চরিত্রের সঙ্গে অন্য যে ধারণা পাওয়া যায়, তা হলো শিল্পীদের খোলা এবং ‘অশিক্ষিত’ চোখেও বস্ত্তর ওপর রঙের নানা গভীরতা ধরা পড়ার বিষয়। প্যালিওলিথিক যুগের পর নিওলিথিক যুগে (নতুন প্রস্তর যুগ, যা শুরু হয় খ্রিঃপূঃ ১৫,০০০ থেকে খ্রিঃপূঃ ৫,০০০ পর্যন্ত) এসে তখনকার শিল্পীদের অনুভূতির প্রত্যক্ষতার স্থান নিয়ে নেয় ধারণাগত অভিজ্ঞতার (কনসেপচুয়ালিজম) অনমনীয়তা এবং স্থির থাকার প্রবণতা যার ফলে গতিশীলতার প্রকাশ বেশ চাপা পড়ে যায়। নিওলিথিক যুগের শিল্পীদের পাশাপাশি গুহাবাসী প্যালিওলিথিক আদিম মানুষের জীবনযাপনও বেশ কিছুকাল অব্যাহত থাকে এবং সেই পর্বের শিল্পীরা আগের মতোই যা দেখে তা-ই এঁকে যায়, কিন্তু একটি নির্দিষ্ট মুহূর্তে তারা বস্ত্তর বা বিষয়ের যা দেখে তার বেশি কিছু আঁকতে পারে না। শিশু বা সাম্প্রতিক আদিম মানুষেরা একটি ছবির যে বিভিন্ন দিক দেখতে পায় এবং তার কম্পোজিশনে যে যুক্তিনির্ভর শৃঙ্খলা থাকে অথবা শৈলীগত বৈশিষ্ট্য, সেইসব কিছুই প্যালিওলিথিক শিল্পীর কাজে চোখে পড়ে না। প্রোফাইলের ছায়া (সিল্যুট) দেখে মুখের প্রতিচ্ছবি আঁকার টেকনিকও প্রাগৈতিহাসিক শিল্পীর অজানা ছিল এবং মুখে চোখ আঁকার ব্যাপারেও তারা আনাড়ি ছিল। দৃশ্যগত ধারণার যে ঐক্য আধুনিক শিল্পে দেখা যায় প্যালিওলিথিক যুগের শিল্পীদের সেই দক্ষতা অর্জনের জন্য অপেক্ষা করতে হয় প্রায় এক শতাব্দী। কিন্তু তাদের ছবি আঁকার পদ্ধতির উন্নতি হলেও তার আমূল পরিবর্তন হয় না। দৃশ্য এবং অদৃশ্যের মধ্যে যে পার্থক্য তা প্যালিওলিথিক যুগের শিল্পে অনুপস্থিত থেকেই যায়।

আর্নল্ড হাউজারের আলোচনায় একদিকে যেমন গুহাবাসী প্যালিওলিথিক শিল্পীদের শিল্পকর্মের প্রশংসা পাওয়া যায়, সেই সঙ্গে এর বিরূপ সমালোচনা বেশ অবাক করার মতো। এই বিরূপ সমালোচনা পড়ে মনে হয় যে, তিনি সেই শিল্পীদের ছবি আঁকার মূল কারণ বিস্মৃত হয়েছিলেন। তারা ছবি এঁকেছে পশু শিকারের জন্য ম্যাজিকের ক্ষমতা লাভের উদ্দেশ্যে। এই উদ্দেশ্য পূরণে মানুষ ও পশুর ছবি যেভাবে আঁকা প্রয়োজন তারা তা-ই করেছে। আধুনিক যুগের শিশু এবং আদিম মানুষদের ছবি আঁকার উদ্দেশ্য ভিন্ন। তারা ছবি এঁকেছে জানার অভিজ্ঞতা এবং ধারণার ভিত্তিতে, শুধু দেখার ওপর নির্ভর করে নয়। দেখার অভিজ্ঞতা গুহাবাসী শিল্পীদের ছবিতে অসম্পূর্ণতা সত্ত্বেও বাস্তবের প্রতিফলন ঘটাতে পেরেছে। তারা রঙের ব্যবহারে তারতম্য করে পশুর শরীরের ভর (ম্যাস) প্রতিফলিত করেছে যা তাদের অনুকরণের ভিত্তিতে বাস্তববাদিতার দৃষ্টান্ত। পশুর প্রতিকৃতিতে গতিশীলতার আভাস সৃষ্টি করে তারা বাস্তবের প্রতিফলন করেছে অনুকরণের ভিত্তিতে। আর্নল্ড হাউজার নিজেই স্বীকার করেছেন যে, দেয়ালচিত্রে পশু শিকারের ছবি ছিল একই সঙ্গে বিষয়ের প্রতিফলন এবং বিষয়। অর্থাৎ গর্ডন চাইল্ড যেমন বলেছেন ‘উইশ অ্যান্ড উইশ ফুলফিলমেন্ট’। হাউজার আরো স্বীকার করেছেন যে, প্যালিওলিথিক শিল্পী যখন পাথরে কোনো পশুর ছবি এঁকেছে, তখন সেটি প্রকৃতই একটি পশুর ছবি হয়েছে। প্রাগৈতিহাসিক (প্যালিওলিথিক) শিল্পীর কাছে কল্পনা এবং ছবির জগৎ, শিল্পের বিষয় এবং তার অনুকরণ বাস্তব থেকে পৃথক কিছু ছিল না। এইসব ছিল পরস্পরের পরিপূরক এবং বিশেষ একটি জগৎ। হাউজার এও বলেছেন, শিল্প দৈনন্দিন বাস্তবতারই সম্প্রসারণ এই ধারণা পরবর্তীতে শিল্পকে বাস্তবের বিপরীত বলে ভাবার পরও অপসৃত হয় নি। অর্থাৎ আধুনিক শিল্পের আবির্ভাবের পর শিল্পে বাস্তবতার প্রতিফলনের ধারণা মিথ্যা বা অপ্রয়োজনীয় বলে ভাবে নি কেউ। এই প্রসঙ্গে তিনি পিগম্যালিয়নের উপকথার উল্লেখ করেছেন। পিগম্যালিয়নের কাহিনির মতোই প্যালিওলিথিক যুগের শিল্পকর্মে শিল্প এবং বাস্তবতার মধ্যে কোনো সীমানা ছিল না, দুটির ছিল একই জগৎ এবং শিল্পের ভূমিকা ছিল জীবনযাপনে সহায়ক হওয়া।

প্রাগৈতিহাসিক যুগের দেয়ালচিত্রে বাস্তবতার প্রতিফলন সম্বন্ধে হাউজারের মনে কোনো সন্দেহ নেই। এই শিল্প ম্যাজিকের ক্ষমতা লাভের জন্য সৃষ্ট হয়েছে বলে বাস্তবের প্রতিফলন হতে হয়েছে। যে প্রতিকৃতির সঙ্গে বিষয়ের (মানুষ ও পশু) কোনো সাদৃশ্য নেই তা শুধু ত্রুটিপূর্ণ নয়, তা ম্যাজিকের প্রসঙ্গে অপ্রয়োজনীয়ও। যে রিপ্রেজেন্টেশনের উদ্দেশ্যে মডেলের (বিষয়ের সদৃশ্য হওয়া) তা বাস্তববাদী না হয়ে উপায় নেই। প্রতিফলনের প্রতিশব্দ হিসেবে এখানে ‘রিপ্রেজেন্টেশন’ কথাটি ব্যবহৃত হয়েছে, এটা লক্ষণীয়। হাউজার এখানে ‘অনুকরণ’ বলেন নি, অবশ্য অনুকরণের বিকল্প হিসেবে যে ‘রিপ্রেজেন্টেশন’ ব্যবহার করা যায় এ কথাও তিনি বলেন নি। হয়তো এজন্য যে, এই প্রসঙ্গ অনেক পরে এসেছে শিল্পের তাত্ত্বিক-দার্শনিক আলোচনায়।

হাউজারের মতে, শিল্পে ন্যাচারালিস্টিক/বাস্তববাদী যে ধারা সেটি কয়েক হাজার বছর পর্যন্ত প্রচলিত ছিল। অর্থাৎ প্যালিওলিথিক যুগের (পুরাতন প্রস্তর যুগ) শেষে শুরু হয়ে নিওলিথিক বা নব্য প্রস্তর যুগের সূচনা পর্ব পর্যন্ত। তাঁর মতে, নিওলিথিক যুগে প্যালিওলিথিক যুগের শিল্পের যে উত্তরণ, এটাই ছিল শিল্পের ইতিহাসে প্রথম শৈলীগত পরিবর্তন। নিওলিথিক যুগে বাস্তবের প্রতিফলনের পরিবর্তে নকশাভিত্তিক ছবি এবং বিভিন্ন চিহ্নের ব্যবহার শুরু হয় যার দ্বারা বিষয়ের প্রতিফলন বা পুনঃসৃষ্টি না করে তার প্রতি ইঙ্গিত দেওয়া হয়। যেমন, মিশরের বর্ণমালা হাইরোগিস্নফস্। শিল্প তখন প্রকৃত জীবনযাপনের অভিজ্ঞতার বাস্তব দৃশ্যের পরিবর্তে বিষয়ের অন্তর্নিহিত ধারণা এবং তাৎপর্য ধারণ করার ভূমিকা নেয়। বিষয়ের প্রতিকৃতি না এঁকে সৃষ্টি করা হয় প্রতীক। নিওলিথিক যুগের শিল্পে মানুষের দেখানো হয় দুটি কি তিনটি সরল জ্যামিতিক নকশা দ্বারা। যেমন, মূল শরীরের জন্য একটি উলম্ব রেখা এবং বাহু ও পায়ের প্রতীক হিসেবে দুটি অর্ধবৃত্ত, যার একটি ঊর্ধ্বমুখী এবং অপরটি নিম্নাভিমুখী।

নিওলিথিক যুগের শিল্পে পরিবর্তনের বড় কারণ হিসেবে হাউজার উল্লেখ করেছেন আর্থ-সামাজিক পরিবেশের পরিবর্তনের কথা। এই যুগে মানুষ পশু শিকার ও ফলমূল আহরণ বাদ দিয়ে সমতলে এসে কৃষিকে জীবিকা নির্বাহের উপায় হিসেবে গ্রহণ করে (গর্ডন চাইল্ড অবশ্য বলেছেন, নিওলিথিক যুগেও পাশাপাশি প্যালিওলিথিক যুগের মানুষের মতো গুহাবাসী পশু শিকারিদের বসবাস ছিল)। নিওলিথিক যুগে নতুন সংস্কৃতির (কৃষিকেন্দ্রিক) সূচনার পর অন্য বড় যে পরিবর্তন এলো তা হলো ধর্মীয় আচার অনুষ্ঠান পালন ও দৈবশক্তির বিভিন্ন প্রতীকের উপাসনা। এই উপাসনার বিষয় ছিল মানুষের আত্মা, বিভিন্ন অদৃশ্য শক্তি, মৃতদের প্রতি শ্রদ্ধাজ্ঞাপন ও অ্যানিমিজিম বা সামগ্রিকভাবে প্রকৃতির উপাসনা। ধর্মীয় বিশ্বাস ও উপাসনার অনুষঙ্গ হিসেবে প্রয়োজন হলো মূর্তির, পবিত্র প্রতীকী বস্ত্তর, সমাধিস্থানে স্মৃতিসৌধ নির্মাণ ও তার ভেতর মূর্তি এবং চিত্রাবলি আঁকা। এর ফলে পবিত্র বিষয়ের শিল্প (স্যাক্রেড আর্ট) এবং দৈনন্দিন কাজে ব্যবহারের জন্য শিল্পের মধ্যে পার্থক্য করা হলো। মূর্তি এবং সমাধিসৌধের ভেতর চিত্রকর্মের পাশাপাশি মৃৎপাত্রের গায়ে প্রতিকৃতি আঁকার প্রচলন হলো। কৃষিকাজে ব্যবহৃত নানা যন্ত্রপাতি যেমন, লাঙল, কাসেত্মর বাট ইত্যাদিতেও অলংকরণ দেখা গেল যা ক্রমে কারুশিল্পের জন্ম দিল। গার্হস্থ্য জীবনে ব্যবহৃত মৃৎপাত্রের গায়ে অলংকরণমূলক ছবি আঁকার মধ্যেও শিল্প সৃষ্টিই প্রধান ছিল। এই শিল্পে অনুকরণের তুলনায় সৃজনশীলতার ব্যবহার হয়েছে বেশি। প্যালিওলিথিক যুগের মানুষের কাছে ইহকালের জীবনই ছিল মুখ্য, নিওলিথিক যুগে পরকাল হয়ে গেল প্রধান। এজন্যই প্যালিওলিথিক যুগের শিল্পে ইহজীবনের চিত্র আঁকা হয়েছে যা ছিল বাস্তবের প্রতিফলন (যেমন, পশু শিকার) আর নিওলিথিক যুগের শিল্পের বৈশিষ্ট্য হলো আদর্শায়িত (আইডিয়ালাইজড্) এবং সৃজনশীল (স্টাইলাইজড্) মূর্তি ও প্রতিকৃতি যা ছিল সাধারণ বাস্তবের বিপরীতে পরলোকের রহস্যময় জগতের প্রতীক। এটাই ছিল শিল্পে বুদ্ধিবৃত্তিভিত্তিক এবং যুক্তিপূর্ণ শিল্পচর্চার সূচনা। বাস্তবের চিত্র এবং ফর্মের স্থান অধিকার করল প্রতীক এবং চিহ্ন। সরাসরি প্রকাশের স্থানে এলো চিন্তা-ভাবনাপ্রসূত ব্যাখ্যা। এই সঙ্গে এলো অতিরঞ্জন ও বাস্তবের বিকৃতিকরণ। শিল্পকর্ম আর নির্দিষ্ট বিষয় বা বস্ত্তর রিপ্রেজেন্টেশন (হাউজার আবার এ কথাটি ব্যবহার করেছেন কোনো ব্যাখ্যা ছাড়াই) না হয়ে হলো একটি ধারণার প্রতিফলন, কেবল স্মৃতিচারণার জন্য নয়, ভবিষ্যৎ দর্শনের বিষয় হিসেবেও। অর্থাৎ অনুভবভিত্তিক এবং যুক্তিহীন বিষয়ের স্থান অধিকার করল শিল্পীর কল্পনার ধারণাগত প্রসঙ্গসমূহ এবং অনুভব-নিরপেক্ষ বিষয়। এভাবে প্রতিকৃতির পরিবর্তে চিত্রভিত্তিক চিহ্নমূলক ভাষার প্রবর্তন হলো। চিত্রময় প্রাচুর্যের স্থানে এলো প্রতিকৃতিহীন বিমূর্ত শিল্প। জীবিকা নির্বাহের উপায়ের জন্য ম্যাজিকের পরিবর্তে বিভিন্ন প্রাকৃতিক এবং অদৃশ্য শক্তির উপাসনার ফলে নিওলিথিক যুগের শিল্পে এলো বিশাল পরিবর্তন।

হেনরি ব্রেউইল ব্যাখ্যা করেছেন কীভাবে প্যালিওলিথিক যুগের শেষে বাস্তববাদী শিল্প ধীরে ধীরে নিওলিথিক যুগের জ্যামিতিক ফর্মের দিকে অগ্রসর হয়েছে। তাঁর মতে, এই পরিবর্তন এসেছে বিমূর্ততার (অপরিকল্পিত অর্থে) চর্চায়। জ্যামিতিক ফর্মের অনুষঙ্গ হিসেবে স্টাইলাইজেশনও এসেছে কিন্তু এর উৎস ছিল প্যালিওলিথিক যুগের বাস্তববাদিতায়। শিল্পে যে বিমূর্ততা প্রকাশ হয় তার মধ্যে জ্যামিতিক নকশার উপস্থিতি বেশ স্পষ্ট। এই নতুন শিল্পশৈলীর ধারা দুইদিকে অগ্রসর হয়। প্রথমত এর মাধ্যমে সহজবোধ্য যোগাযোগ এবং প্রকাশ পদ্ধতির সন্ধান করা হয়। দ্বিতীয়ত এই নতুন শৈলী প্যালিওলিথিক যুগের শেষ পর্বে তিন শ্রেণির ‘পিক্টোরিয়াল রিপ্রেজেন্টেশন’ (হাউজারের ভাষায়) এর উদ্ভব হয় : (ক) অনুকরণভিত্তিক (খ) তথ্যপ্রকাশভিত্তিক এবং (গ) অলংকরণমূলক। এই তিন শ্রেণির সমার্থক হলো : (১) বাস্তববাদিতা (২) প্রতিকৃতিভিত্তিক চিহ্ন (৩) বিমূর্ততা। এইসব শৈলী মধ্য প্যালিওলিথিক যুগের শিল্পেও দেখা গিয়েছে কিন্তু নিওলিথিক যুগে জীবনযাপনের নতুন সংস্কৃতির আবির্ভাব (কৃষিনির্ভর জীবনযাপন) এই শ্রেণিবিভাগকে আরো স্পষ্ট করে তোলে এবং শেষের দুটি শৈলী প্রাধান্য পায়।

মানুষের জীবনযাপনে পরিবর্তন এসেছে ধীরে, তার সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে শিল্পে বাস্তবতাবাদ থেকে জ্যামিতিক নকশা আঁকা কিংবা বিমূর্ত শৈলী বিবর্তিত হয়েছে ধাপে ধাপে। গর্ডন চাইল্ডের মতে, নিওলিথিক যুগের কৃষিজীবী মানুষের পাশাপাশি প্যালিওলিথিক যুগের আদিম মানুষেরাও কিছু সংখ্যায় গুহায় থেকে আগের মতো পশু শিকার করে জীবিকা নির্বাহ করেছে অনেক বছর যার জন্য তাদের অনুসৃত বাস্তববাদী শৈলী অব্যাহত থেকেছে। প্যালিওলিথিক যুগের গুহায় দেয়ালচিত্রের কাছে স্কেচ, খসড়া এবং ড্রইং পাওয়া গিয়েছে যার ভিত্তিতে এম সি বার্কিট মনে করেন যে, ধীরে হলেও আদিম শিল্পীদের মধ্যে পেশাদারি মানসিকতা ও অভ্যাস গড়ে উঠেছিল (১৯৩১)।

নিওলিথিক যুগে যে জ্যামিতিক অলংকরণমূলক এবং রীতিসিদ্ধ (ফর্মালিস্টিক) শিল্পশৈলীর আবির্ভাব হয় (প্যালিওলিথিক যুগেও এ ধরনের শৈলীতে ছবি আঁকা হয়েছে, এই দৃষ্টান্ত রয়েছে) তা দীর্ঘকাল স্থায়ী হয়েছিল যার সঙ্গে তুলনীয় আর কোনো শৈলীর উল্লেখ করা যায় না। অন্তত রীতিনির্ভর, শৃঙ্খলাবদ্ধ শৈলীর ক্ষেত্রে এ কথা বলা যায়। পরবর্তীতে ক্রিট এবং মাইসেনীয় সভ্যতার সময়ের শিল্পের কথা বাদ দিলে নিওলিথিক যুগের এই শৈলী ব্রোঞ্জ ও লৌহ যুগের পুরো সময় এবং প্রাচীন এশীয় সভ্যতার সময়কার ও প্রাচীন গ্রিস সভ্যতার শিল্পের ওপর প্রভাব বিসত্মার করেছিল যা হিসাব করলে খ্রিষ্টপূর্ব পাঁচ হাজার থেকে খ্রিষ্টপূর্ব পাঁচশো শতাব্দী পর্যন্ত অব্যাহত ছিল। নিওলিথিক যুগের এই শিল্পশৈলীর সঙ্গে পরবর্তীকালে যে জ্যামিতিক অলংকরণ ও ক্লাসিক্যাল যুগের শৈলী তার তুলনা করলে দেখা যাবে শেষোক্ত শ্রেণির শৈলী ছিল স্বল্পস্থায়ী। নিওলিথিক এই বিমূর্ত ধারার শৈলীর দীর্ঘস্থায়িত্ব হওয়ার পেছনের কারণ ব্যাখ্যা করতে গিয়ে হাউজার বলেছেন যে, নিওলিথিক যুগের সমাজ-ব্যবস্থার বিশেষ চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য এবং আঞ্চলিক পার্থক্য সত্ত্বেও ঐতিহ্যের প্রতি গুরুত্ব দেওয়া হয়েছিল। নিওলিথিক যুগে যে সংঘবদ্ধ জীবন এবং ঐতিহ্যের অনুসরণ তার ভিত্তিতে সংস্কৃতির প্রতিটি ক্ষেত্রে স্থায়িত্বের প্রতি গুরুত্ব দেওয়ায় শিল্পের শৈলীও স্থায়ী হয়েছে। গর্ডন চাইল্ডও এই মত সমর্থন করে বলেছেন যে, নাগরিক জীবনের তুলনায় গ্রামীণ কৃষি-সংস্কৃতিনির্ভর জীবনে পরিবর্তন হয়েছে ধীরে যার জন্য গ্রামীণ শিল্প (যার মধ্যে ছিল জ্যামিতিক অলংকরণ) সংরক্ষণ সহজ হয়েছিল। তিনি এ কথাও বলেছেন যে, আধুনিক জীবনে গ্রামীণ শিল্পের সঙ্গে প্রাগৈতিহাসিক যুগের (নিওলিথিক যুগে) জ্যামিতিক অনুকরণমূলক শিল্পের মিল দেখা যায়। শিল্পের শৈলীর পরিবর্তনে শুধু নয়, তার স্থায়িত্বের পেছনে প্রধান কারণ হিসেবে গ্রামীণ সংস্কৃতির ঐতিহ্য-নির্ভরতা ও রক্ষণশীলতার প্রতি এই গুরুত্ব আরোপ শিল্প ইতিহাসের ব্যাখ্যায় একটি নতুন অধ্যায় রচিত করেছে যার উল্লেখ করার কৃতিত্ব হাউজার, গর্ডন চাইল্ড প্রমুখ প্রত্নতাত্ত্বিকরা দাবি করতে পারেন। সামাজিক-অর্থনৈতিক সংস্কৃতির ব্যাখ্যা অনুযায়ী শিল্পে বাস্তববাদী শৈলী হলো ব্যক্তিকেন্দ্রিক এবং অবিন্যস্ত সমাজের (প্যালিওলিথিক যুগের প্রতি ইঙ্গিত) প্রতিফলন, যেখানে ঐতিহ্যের ভূমিকা নেই, দৃঢ়ভাবে প্রতিষ্ঠিত কোনো নীতি বা পদ্ধতি অনুসরণের বাধ্যবাধকতাও নেই এবং ধর্মের ভূমিকা অনুপস্থিত। অপরদিকে জ্যামিতিক অলংকরণভিত্তিক শৈলীর সম্পর্ক ছিল স্থায়ী সামাজিক-অর্থনৈতিক প্রতিষ্ঠান বা পদ্ধতি এবং ধর্মীয় আচার-আচরণের ওপর নির্ভরশীল। নিওলিথিক যুগের শিল্পচর্চায় সামাজিক-অর্থনৈতিক কাঠামো ও পদ্ধতির উল্লেখ করে প্রত্নতাত্ত্বিক এবং শিল্প-ঐতিহাসিকরা বলেছেন, জ্যামিতিক অলংকরণভিত্তিক, সেক্যুলার, বিমূর্ত ধারার শৈলীর চর্চা প্রথমে হয়েছে ধর্মীয় উপাসনা ও মৃতদের স্মৃতিসৌধ ব্যবহারের জন্য। পবিত্র শিল্প (স্যাক্রেড আর্ট) নগরের রাজন্যবর্গ ও ধর্মীয় পুরোহিতদের নির্দেশনায় হয়েছে বলে এরা যে মতপ্রকাশ করেন শিল্পে বাস্তবতার প্রতিফলনের ক্ষেত্রে তার অর্থ দাঁড়ায়, বাস্তবের প্রতিফলন নিওলিথিক যুগে নাগরিক শিল্পীরা যে মাত্রায় করেছে গ্রামীণ শিল্পীরা তেমন করে নি, বরং উল্টোটাই করেছে। গ্রামের রক্ষণশীল সমাজে সেক্যুলার আদর্শ, ধর্মীয় প্রভাবের অভাব, এই বিষয়গুলি গ্রামীণ মানুষের রক্ষণশীলতার সঙ্গে পরস্পরবিরোধী। এমন ধারণা করার পেছনের কারণ সম্পর্কে প্রত্নতাত্ত্বিক বিশেষজ্ঞ যাদের নাম উল্লেখ করা হয়েছে তারা কোনো ব্যাখ্যা দেন নি। কেবল হাউজার উপসংহারে বলেছেন, কোনো বিশেষ সময়ে বিভিন্ন শিল্পশৈলীর সঙ্গে সেই সময়ের সমাজের বিন্যাসের সম্পর্ক বেশ সহজেই স্থাপন করা যায়। তাঁর এই মন্তব্য কিছুটা বিভ্রামিত্মকর, কেননা তাই যদি হবে তাহলে ধর্মের ব্যাপারে যে রক্ষণশীলতা সেই বিষয়ে গ্রাম এবং নগরের মধ্যে পার্থক্য থাকার যুক্তি পাওয়া যায় না। অভিজ্ঞতায় বলে গ্রামের মানুষেরাই ধর্মের ব্যাপারে বেশি রক্ষণশীল। তাহলে কি বিশ্বাস করতে হবে যে, নিওলিথিক যুগে ধর্ম নাগরিক জীবনে যেমন প্রধান ভূমিকা পালন করেছে গ্রামে তেমন নয়? এর অনুষঙ্গ হিসেবে আসে এই অনুমান যে, ধর্মকে রাজন্যবর্গ, শাসকশ্রেণি এবং পুরোহিতরা নিজেদের মধ্যেই সীমাবদ্ধ রেখেছিল যার জন্য ধর্ম ছিল নাগরিক সংস্কৃতির অঙ্গ। প্রকৃতপক্ষে প্যালিওলিথিক যুগে ধর্মবিশ্বাসের অভাবের স্থানে বিভিন্ন অদৃশ্য শক্তির উপাসনা ও তা কেন্দ্র করে বাস্তববাদী প্রতিকৃতি আঁকা এবং মূর্তি তৈরি শুরু হয়েছে নিওলিথিক যুগের শেষে যখন ব্যবসাকেন্দ্রে শহরের প্রতিষ্ঠা হয়। সেখানে ধনী ও প্রভাবশালী ব্যক্তিরা অন্য অধিবাসীদের শাসন করার ব্যবস্থা গ্রহণ করে। পরবর্তীতে কৃষি সংস্কৃতি আরো উন্নত হয়ে মেসোলিথিক যুগের (খ্রিঃপূঃ ৫,০০০ থেকে খ্রিঃপূঃ ৬০০) সূচনা করে। এর পরবর্তী পর্বেই সংস্কৃতির আরো উন্নতির ফলে নগরের বিসত্মৃতি ঘটে এবং নগরকেন্দ্রিক সভ্যতার সূচনা হয়। নগরে শাসকশ্রেণি একসময় নিজেদেরকে ঐশী ক্ষমতাসম্পন্ন রাজবংশ হিসেবে দাবি করে। তাদের সমর্থন জানায় পুরোহিত শ্রেণি যারা গ্রামে নয়, নগরেই ধর্মীয় আচার-অনুষ্ঠান সীমাবদ্ধ রাখে, কেননা সেখানেই শুধু সংখ্যাগরিষ্ঠ জনসাধারণ নয়, ধনীশ্রেণি বাস করতে থাকে। গ্রামের মানুষ নিওলিথিক যুগের আগে যেমন শেষের পর্বেও সেক্যুলার থেকে যায় দীর্ঘকাল যার ফলে তাদের শিল্পচর্চা হয় নগরের তুলনায় ভিন্ন। যেমন মৃৎপাত্রে জ্যামিতিক অলংকরণ ও নকশা। তবে নিওলিথিক যুগেও যারা গুহায় বাস করেছে তারা দেয়ালচিত্রে বাস্তববাদী জীবনের (কৃষিকাজ, পশুপালন) ছবি এঁকেছে। মৃৎপাত্রে অলংকরণ এবং দেয়ালচিত্র ছাড়াও নিওলিথিক যুগে মাতৃকা মূর্তির ভাস্কর্য পাওয়া গিয়েছে যা প্যালিওলিথিক যুগের ‘ভেনাস অফ টানটান’-এর মতোই অর্ধবিমূর্ত। নগরকেন্দ্রিক সভ্যতায় উপাসনার জন্য তৈরি মূর্তি এবং রাজা ও রাজন্যবর্গের মূর্তিতে যে মূর্ত শৈলী এসেছিল ভবিষ্যতে তার আভাস পাওয়া যায় মেসোলিথিক যুগেই। নিওলিথিক যুগে গ্রাম এবং ছড়ানো-ছিটানো ব্যবসাকেন্দ্রিক শহরের মধ্যে পার্থক্য ছিল কম। কিন্তু ধনী ব্যবসায়ীদের পৃষ্ঠপোষকতায় প্রতিকৃতি ও মূর্তি তৈরির শৈলী ক্রমেই বাস্তববাদী হয়ে উঠেছিল। ধর্মের প্রচার ও চর্চা নিওলিথিক যুগে ব্যাপক ছিল না, বিশেষ করে গ্রামে যার জন্য সেখানকার জীবন ছিল অনেকটাই সেক্যুলার। এই ব্যাখ্যা মেনে নেওয়া হলে হাউজার ও গর্ডন চাইল্ড ধর্ম বিষয়ে নগর ও গ্রামের মধ্যে যে বিভাজন করেছেন এবং তার ভিত্তিতে শিল্পচর্চার প্রকৃতি, বিশেষ করে শৈলী সম্বন্ধে যা বলেছেন তা মেনে নেওয়া যায়।

 

\নয়\

প্যালিওলিথিক যুগে আদিম মানুষের শিল্প বাস্তববাদী ছিল এবং নিওলিথিক যুগে এসে শিল্প প্রতীকী এবং জ্যামিতিক নকশাভিত্তিক হয়ে যায়, হাউজারের এই মত পুরোপরি গ্রহণ করা যায় না, যদিও তার সমাজতাত্ত্বিক বিশেস্নষণ ও ব্যাখ্যা শিল্প বিবর্তনের ইতিহাসে খুবই গুরুত্বপূর্ণ। এটা মেনে নিলে স্বীকার করতে হবে প্যালিওলিথিক যুগে শিল্পীরা অনুকরণের ওপর নির্ভর করেছে যার জন্য তাদের শিল্প বাস্তববাদী হয়েছে আর নিওলিথিক যুগের শিল্পে প্রতীকী এবং জ্যামিতিক বিন্যাসের ব্যবহার হয়েছে সৃজনশীলতার জন্য। প্রাগৈতিহাসিক যুগে (প্যালিওলিথিক ও নিওলিথিক) শিল্পের আঙ্গিকের মধ্যে এমন স্পষ্ট এবং সুনির্দিষ্ট বিভাজন ছিল না। প্যালিওলিথিক যুগের দেয়ালচিত্রেও দেখা যায় পশুর প্রতিকৃতি বাস্তববাদী হলেও মানুষের প্রতিকৃতি অনেকটা প্রতীকী ছিল, জ্যামিতিক নকশার মতো। যেমন, শিকারি মানুষের শরীর এবং হাত-পা মাংস ও পেশিসহ না দেখিয়ে আঁকা হয়েছে রেখার সাহায্যে। এখানে অনুকরণ ও সৃজনশীলতা, উভয় আঙ্গিকই পাশাপাশি ব্যবহার করা হয়েছে। প্যালিওলিথিক যুগে পাথরে যে আঁকিবুকি দেখতে পাওয়া গিয়েছে সেগুলিও রেখাপ্রধান, বিমূর্ত। প্যালিওলিথিক যুগের মধ্যবর্তী পর্বের আগে ‘ভেনাস অফ টান টান’ নামে যে প্রস্তরখ– তৈরি ভাস্কর্য পাওয়া গিয়েছে তার শৈলী বাস্তববাদী নয়, অর্ধবিমূর্ত। অপরদিকে নিওলিথিক যুগে মাতৃকা মূর্তির যে নকশা পাওয়া গিয়েছে সেগুলি ‘ভেনাস অফ টান টান’-এর মতো হলেও অর্ধবিমূর্ত নয়, অনেকাংশে মূর্ত। এর কারণ এমন মূর্তির চাহিদাই ছিল ছোট ছোট শহরের ধনীদের কাছে। মধ্য প্যালিওলিথিক যুগে আফ্রিকার বিলজিংস্টেভেন নামক স্থানে পাথরে যে আঁকা-বাঁকা দাগ দেখতে পাওয়া গিয়েছে প্রত্নতাত্ত্বিকরা সেইসবকে ‘চেতনার পরিবর্তিত অবস্থার’ প্রতীক বলে ব্যাখ্যা করেছেন অথবা নেহায়েতই সরল অঙ্কন (ডুডলিং)। প্যালিওলিথিক যুগের গুহায় দেয়ালচিত্রে অর্ধেক মানুষ এবং অর্ধেক জন্তুর শরীর নিয়ে আঁকা প্রতিকৃতিও পাওয়া গিয়েছে যার ভূমিকা ‘সামানিস্টিক’ (ঐশী ক্ষমতাপ্রাপ্ত ব্যক্তির দ্বারা রোগশোক দূর করার আচার-অনুষ্ঠান) চর্চার অংশ বলে মনে করা হয়েছে (ডেভিড লুই উইলিয়ামস্-উইকিপিডিয়া)। কোনো কোনো প্রত্নতাত্ত্বিকের মতে, গুহাচিত্রে মানুষ ও পশুর প্রতিকৃতির তুলনায় প্রতীকী মূর্তিসহ চিত্রের সংখ্যা বেশি। প্রত্নতাত্ত্বিকদের মতে, এইসব বিশিষ্ট প্রতীকী দেয়ালচিত্র গুহাবাসী বিভিন্ন গোত্রের প্রতিনিধিত্ব করত (উইকিপিডিয়া)। অর্থাৎ দেয়ালচিত্র কেবল পশু শিকারের উদ্দেশ্যে আঁকা হয় নি। সত্য হলেও, এ ছিল ব্যতিক্রমী, কেননা এ ধরনের কম শিল্পই আবিষ্কৃত হয়েছে। বাস্তবের প্রতিফলনই (অনুকরণ ও সৃজনশীলতাভিত্তিক) ছিল দেয়ালচিত্রের প্রধান ভূমিকা যার কেন্দ্রে ছিল পশু শিকার। প্যালিওলিথিক ও নিওলিথিক যুগের শিল্পে বাস্তবের প্রতিফলনে অনুকরণ এবং সৃজনশীলতার প্রাধান্য নির্ধারিত হয়েছে : (ক) প্রয়োজনের (খ) চাহিদার (গ) উপকরণের লভ্যতার এবং (ঘ) শিল্পীর নিজস্ব শিল্প-চেতনার ভিত্তিতে। পরবর্তীকালের (সাম্প্রতিককাল পর্যন্ত) শিল্পচর্চার ক্ষেত্রেও এই সিদ্ধামেত্ম আসা যায়।

নিওলিথিক যুগের অবসানের পরেই (খ্রিঃপূঃ ৫০০) ঐতিহাসিক পর্বের সূচনা হয় নি। তার আগে ছিল প্রায়-ইতিহাস বা প্রোটো-হিস্ট্রি বলে একটি পর্ব যার সময়কাল, আগেই বলা হয়েছে, ছিল খ্রিঃপূঃ ৫,০০০ থেকে খ্রিঃপূঃ ৬০০ পর্যন্ত। এই পর্বে মানুষ শহরে স্থায়ী বাসস্থান গড়ে তোলে এবং দৈনন্দিন জীবনের ব্যবহারে তামা ও ব্রোঞ্জ ধাতু ব্যবহার শুরু করে। এইভাবে প্রাগৈতিহাসিক যুগের মানুষ প্রস্তর যুগ থেকে বেরিয়ে এসে সভ্যতার দ্বারপ্রামেত্ম পৌঁছায়। প্রায়-ইতিহাস পর্ব নির্ধারিত হয়েছে যখন লিখন পদ্ধতি উদ্ভাবন বা তার পাঠোদ্ধার সম্ভব হয় নি, এই গবেষণার ভিত্তিতে। তাম্র ও ব্রোঞ্জ যুগের মানুষের ধাতুবিদ্যা এবং ব্যবহার সম্বন্ধে জ্ঞান ও অভিজ্ঞতা বৃদ্ধি পায় যার দৃষ্টান্ত দেখা যায় নিত্যব্যবহার্য বস্ত্তর নির্মাণে। শিল্প ও ভাস্কর্য কর্মেও নতুন উপকরণের লভ্যতার জন্য দেখা দেয় আকার এবং প্রকারে অগ্রগতি। তাম্র যুগের একটি পশুর ভাস্কর্যে দেখা যায়, অনুকরণ এবং সৃজনশীলতা, উভয়ের প্রভাব। তবে অনুকরণের তুলনায় বেশি মাত্রায় সৃজনশীলতার ব্যবহারই বাস্তবের প্রতিনিধিত্ব করা হয়েছে এই কাজটিতে। এমন শৈলী হয়তো ক্রেতা বা পৃষ্ঠপোষকের চাহিদার অথবা ভাস্করের নিজস্ব শিল্প চেতনার জন্যই অনুসরণ করা হয়েছে।

ভূমিকাতেই বলা হয়েছে, এই লেখার প্রধান বিষয় শিল্পে বাস্তবের প্রতিফলন এবং তার পদ্ধতি ও প্রক্রিয়া। প্রাচীন এবং সাম্প্রতিক তাত্ত্বিক-দার্শনিক আলোচনা এবং শিল্প-ইতিহাসের দৃষ্টামেত্মর আলোকে এই উপসংহারে আসা যায় যে, শিল্পকর্ম মানুষের দুটি সহজাত প্রবৃত্তির ফল : অনুকরণ ও সৃজনশীলতা। এই দুটি প্রবণতা প্রাগৈতিহাসিক যুগের মানুষের মধ্যে ছিল এবং তা অক্ষুণ্ণ থেকেছে সেই যুগ অবসানের পরও। অনুকরণের ভিত্তিতে শিল্পে বাস্তবতার বৈশিষ্ট্য এসেছে, সৃজনশীলতা সেই বাস্তবতাকে রূপান্তরিত করেছে। এই দুটি প্রক্রিয়ার ব্যবহার একই সময়ে দেখা গিয়েছে যদিও অনুপাতের দিক দিয়ে পদ্ধতি দুটির ব্যবহারে তারতম্য ঘটেছে বিভিন্ন সময়ে। আর্থ-সামাজিক কারণে এবং শিল্পকর্মে আন্দোলনের বিবর্তনের জন্য এই দুটি পদ্ধতির ব্যবহারে পার্থক্য দেখা গিয়েছে, এটা মেনে নিলেও শিল্পীর সিদ্ধান্ত এবং বিশেষ সময়ে শিল্পকর্মের উদ্দেশ্য ও শিল্পকর্মে অনুকরণপ্রধান, না সৃজনশীলতার প্রাধান্য বেশি হবে, তা নির্ধারিত করেছে। শিল্পে বাস্তবতার প্রতিফলনে অনুকরণ ও সৃজনশীলতা উভয় প্রবণতাই শিল্প পদ্ধতির চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য নির্ধারণে ভূমিকা রেখেছে।

শিল্পে বাস্তবতার প্রতিফলনের বিষয়টি ইংরেজি যে শব্দ সবচেয়ে সমেত্মাষজনকভাবে ব্যাখ্যা করে তা যে ‘রিপ্রেজেন্টেশন’, পূর্ববর্তী আলোচনার ভিত্তিতে সেই বিষয়টি প্রতিষ্ঠিত হয়েছে বলে মনে করা যায়। ইংরেজি এই শব্দে অনুকরণ ও সৃজনশীলতা, উভয় পদ্ধতি অন্তর্ভুক্ত এই উপসংহারে অবশ্য কেউ আসেন নি। এই লেখায় আলোচনার মাধ্যমে উপসংহারটি গ্রহণ করা হয়েছে। ‘রিপ্রেজেন্টেশনে’র বাংলা প্রতিশব্দ হিসেবে প্রতিফলন ব্যবহার না করে ‘প্রতিনিধিত্ব’ কথাটি ব্যবহার বেশি যৌক্তিক বলে মনে হয়, এই উপসংহারও একই সঙ্গে এসে যায়। অনুকরণ ও সৃজনশীলতার যে প্রক্রিয়ায় বাস্তবের প্রতিনিধিত্ব হয় তার বৈজ্ঞানিক ও মনসত্মাত্ত্বিক দিক রয়েছে যা উল্লেখ করা না হলে বিষয়টি সম্বন্ধে ব্যাখ্যা সম্পূর্ণ হবে না। দার্শনিক দেকার্তে বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে দেখিয়েছেন, কোনো বিষয় চোখের দৃষ্টিতে যেভাবে ধরা পড়ে তা নির্ধারণ করে দৃষ্টিশক্তি, আলো এবং দূরত্ব। এদের সাহায্যে কোনো বিষয় বা বস্ত্তর প্রকৃত দৃশ্যকল্প (অ্যাকচুয়াল ইমেজ) সৃষ্টি হয়। এই ইমেজ নিউরো-ট্রান্সমিটারের সাহায্যে মসিত্মষ্কে পৌঁছায় এবং সেখানে মেন্টাল ইমেজ তৈরি করে জ্ঞান, দক্ষতা ও অভিজ্ঞতার ভিত্তিতে (দেকার্তে অবশ্য এই বিশদ ব্যাখ্যা দেন নি)। তিনি বলেছেন, শিল্পী এই ‘মেন্টাল ইমেজে’র ভিত্তিতে বাস্তবের প্রতিফলন করে (১৬৪১)। এখানে যোগ করা প্রয়োজন, মেন্টাল ইমেজ তৈরি হওয়ার পরই শিল্পী ছবি আঁকেন না, সৃজনশীলতা তখন সক্রিয় হয় এবং অনুকরণের সঙ্গে যুক্ত হয়ে (অনুপাতের তারতম্যসহ) বাস্তবের প্রতিনিধিত্বকারী হিসেবে শিল্প সৃষ্টি করে। এই প্রতিনিধিত্বে অনুকরণ ও সৃজনশীলতা, উভয়েই ভূমিকা পালন করে (ক্ষেত্রবিশেষে অনুপাতের তারতম্যসহ) যার জন্য দুটিকে সমন্বিত করে প্রতিনিধিত্বের প্রক্রিয়ার এই নাম ‘রিপ্রেজেন্টেশন’ দেওয়ার যথেষ্ট যৌক্তিকতা রয়েছে। ‘রিপ্রেজেন্টেশন’ কথাটি বহুল ব্যবহৃত এবং অনেক বিশেষজ্ঞ এ নিয়ে তাঁদের মতামত দিয়েছেন (যদিও তাঁদের কেউই কথাটিতে অনুকরণ ও সৃজনশীলতা অন্তর্ভুক্ত, এ কথা স্পষ্ট করে বলেন নি। বরং অধিকাংশ আলোচকই ‘রিপ্রেজেন্টেশন’কে অনুকরণের বিপরীত অর্থে ব্যবহার করার কথা বলেছেন)। শিল্পে বাস্তবতার প্রতিফলনে (যার যথার্থ বাংলা প্রতিশব্দ ‘প্রতিনিধিত্ব’ বলা হয়েছে) এই কথাটির (‘রিপ্রেজেন্টেশন’) ব্যবহার করার সময় অনুকরণ এবং সৃজনশীলতা, উভয় পদ্ধতি/প্রক্রিয়াই অন্তর্ভুক্ত করতে হবে, এই লেখায় সেই মত ব্যক্ত করা হয়েছে, এর উল্লেখ আবার করা হলে পুনরুক্তি হতে পারে, কিন্তু স্পষ্টীকরণ ও গুরুত্ব আরোপের জন্য এর প্রয়োজন রয়েছে। শিল্প ইতিহাসের বিভিন্ন পর্বের ব্যাখ্যার জন্য এর প্রয়োগযোগ্যতা কথাটি ব্যবহারের যৌক্তিকতা প্রমাণ করবে।

 

 

 

গ্রন্থসূচি :

১। আর জি কলিংউড, দি প্রিন্সিপালস অফ আর্ট, ১৯৩৮

২। ক্লাইভ বেল, আর্ট, ১৯১৪

৩। হার্বার্ট রিড, দি মিনিং অফ আর্ট, ১৯৩১

৪। জুলিয়ান বেল, হোয়াট ইজ পেইন্টিং?, ১৯৯৮

৫। লিও টলস্টয়, হোয়াট ইজ আর্ট, ১৮৯৮

৬। জন হসপার্স, ‘আর্ট অ্যাজ এক্সপ্রেসশন’, দি এনসাইক্লোপিডিয়া অফ ফিলসফি, ১৯৬৭

৭। পেস্নটো (ক) দি রিপাবলিক, (খ) তাইমেউস

৮। অ্যারিস্টটল, পেয়েটিকস্

৯। আর্থার ডান্টো, আর্ট ওয়ার্ল্ড, ১৯৬৪

১০। বেনেদিতো ক্রোচে, এসথেটিক, ১৯৫৩

১১। হ্যান্স-জর্জ গ্যাডামার, ট্রুথ অ্যান্ড মেথার্ড, ১৯৭৫ (নিউইয়র্ক)

১২। এম সি বিয়ার্ডসলে, এসথেটিকস্, ফ্রম ক্লাসিক্যাল টু দি প্রেজেন্ট-এ শর্ট হিস্ট্রি, ১৯৬৬

১৩। থমাস হবস্, লেভিয়াথান, ১৬৫১

১৪। ই এইচ গমব্রিখ, ‘সিইং আর্ট অ্যান্ড সিইং পেইন্টিং’, আর্ট অ্যান্ড ইল্যুশন, ১৯৮৩

১৫। নেলশন গুডম্যান, সেভেন স্ট্রিকচারর্স অন সিমিলারিটি প্রবলেমস্ অ্যান্ড প্রজেক্টস্, ১৯৭২

১৬। জি ডাবিস্নউ হেগেল, এসথেটিকস্ ১৮৩৮ (বার্লিন), ১৯৭৫ (অক্সফোর্ড)

১৭। কেনেথ ক্লার্ক, দ্য ন্যুড, ১৯৫৬

১৮। জন ডিউঈ, আর্ট অ্যাজ এক্সপেরিয়েন্স, ১৯৩৪

১৯। মার্টিন হেইডেগার, দি অরিজিন অফ দি ওয়ার্ক অফ আর্ট, ১৯৫০ (ফ্রাঙ্কফুর্ট), ১৯৭১ (নিউইয়র্ক)

২০। ফ্লিন্ট শিয়ার, ডিপার ইন টু পিকচার্স, ১৮৯৬

২১। আর্নল্ড হাউজার, দি সোসাল হিস্ট্রি অফ আর্ট, ১৯৫৭

২২। গর্ডন চাইল্ড, ম্যান মেকস্ হিমসেলফ্, ১৯৩৬

২৩। হার্বার্ট রিড, আর্ট অ্যান্ড সোসাইটি, ১৯৩৬

২৪। আলোয়াস রিগেল, স্টিলফ্রাগেন, ১৮৯৩

২৫। গডফ্রিড সেম্পার, ১৮৬০ (আর্নল্ড হাউজারের বই থেকে উদ্ধৃত)

২৬। হেনরি ব্রেউইল, (ক) স্টাইলাইজেশন, ১৯০৬ (খ) কেভস্ অফ আলতামিরা, ১৯০৬

২৭। ডেভিড লুই উইলিয়ামস্ (উইকিপিডিয়া)

২৮। রেনেঁ দেকার্তে, মেডিটেশন অন ফাস্ট ফিলসফি, ১৬৪১

Leave a Reply