হাসনাত আবদুল হাই
কৃষি আবিষ্কারের মধ্য দিয়ে প্যালিওলিথিক যুগের গুহাবাসী মানুষ নিওলিথিক যুগে প্রবেশের পর জীবনযাপনের সংস্কৃতিতে (নৃতাত্ত্বিক অর্থে) ক্রমান্বয়ে বিপুল পরিবর্তন ঘটতে থাকে। এর পেছনে কাজ করে প্রযুক্তির নিত্যনতুন উদ্ভাবন ও দ্রুত উন্নতি। কৃষি উৎপাদন বৃদ্ধি পাওয়ার পর ব্যবসা-বাণিজ্যের প্রসার ঘটে এবং বাজারকেন্দ্রিক ছোট শহরগুলি জনসংখ্যা বৃদ্ধির ফলে আকারে বড় হয়। শান্তি-শৃঙ্খলা রক্ষার জন্য উদ্ভব হয় শাসক শ্রেণির। তাদের অধীনে কর্মরত থাকে রাজস্ব আদায়ের যেসব আমলা এবং শান্তিরক্ষী সশস্ত্র বাহিনী, তারা শাসক শ্রেণির কাছে শহরে থাকে। ব্যবসায়ী এবং অন্যান্য পেশাজীবী মানুষও বাস করে শহরে। শাসক এবং অভিজাত শ্রেণির সেবার জন্য তাদের অধীনে কাজ করে যুদ্ধবন্দি দাস। গ্রামে বাস করে কৃষক, কারুশিল্পী এবং ভূমিদাস। কৃষি সংস্কৃতির সূচনার পর অদৃশ্য শক্তির ওপর বিশ্বাস ও বিভিন্ন কুসংস্কার দূর হয়ে তার স্থানে প্রচলিত হয় প্রাকৃতিক শক্তির প্রতীক, বিভিন্ন দেবদেবীর উপাসনাভিত্তিক ধর্মবিশ্বাস। শাসকদের সমর্থন এবং পৃষ্ঠপোষকতা লাভের জন্য উপাসনার মন্দির নির্মিত হয় প্রধানত শহরে এবং সেখানে দায়িত্ব পালন করে পুরোহিত শ্রেণি। উপাসনার জন্য নির্মিত হয় দেবদেবীর মূর্তি এবং মন্দিরের দেয়ালে আঁকা হয় তাদের প্রতিকৃতি। ক্রমে শাসক, পুরোহিত এবং ধনীদের মূর্তি ও প্রতিকৃতি তৈরিও শুরু হয় গৃহাভ্যন্তরে সাজসজ্জার উদ্দেশ্যে এবং তাদের ক্ষমতার প্রতীক হিসেবে। দেবদেবীর মূর্তি কল্পনার ভিত্তিতে তৈরি হলেও একই দেবতা বা দেবীর মূর্তি নির্মাণে ক্রমে অভিন্নতা দেখা দেয়। এইসব মূর্তি নির্মাণ হয়ে যায় পৌনঃপুনিক। অপরদিকে শাসক, ধনী শ্রেণি এবং পুরোহিতদের মূর্তি বা প্রতিকৃতি তৈরি করতে গিয়ে শিল্পীকে অনুসরণ করতে হয় বাস্তবের অনুকরণ অর্থাৎ বিষয়ের যথাযথ প্রতিফলন। তবে সেই বাস্তব প্রতিফলনে যে কিছুটা সৃজনশীলতার ব্যবহার করে বিষয়কে সৌন্দর্যমন্ডিত করা হয় তা সহজেই অনুমেয়। কৃষি সম্পদ থেকে আহৃত রাজস্ব দিয়ে এইসব ভাস্কর্য ও প্রতিকৃতি তৈরির খরচ নির্বাহ করা হয়। বলা বাহুল্য, প্রথম পর্বে এইসব ক্ষেত্রে কর্মকা- এবং তার জন্য খরচ সীমিতই থাকে।
গ্রামাঞ্চলে প্রধানত বাস করে কৃষক ও মৎস্যজীবী। তাদের সঙ্গে থাকে কারুশিল্পী, যারা তৈরি করে বিভিন্ন আকারের মৃৎপাত্র এবং গৃহস্থালি কাজে প্রয়োজনীয় বিভিন্ন বস্তু, যা স্থানীয় চাহিদা মেটানো ছাড়াও শহরের মানুষের কাছে বিক্রি করা হয়। এইসব মৃৎপাত্রের গায়ে মৃৎশিল্পীরা অলংকরণের জন্য আঁকে জ্যামিতিক নকশা, যার সঙ্গে বাস্তবের সম্পর্ক থাকে না। এখানে প্রধানত কাজ করে কারুশিল্পীর সৃজনশীলতা। সভ্যতার উষালগ্নে এভাবেই শিল্পকর্মের সূচনা হয়। অবশ্য এর আগে প্যালিওলিথিক যুগে গুহাবাসী মানুষ গুহার দেয়ালে ম্যাজিক ক্ষমতা লাভের উদ্দেশ্যে পশু শিকারের ছবি এঁকেছে, যা মানুষের শিল্পকর্মের প্রথম নিদর্শন। গমব্রিখের মতো শিল্প-ঐতিহাসিক অবশ্য দেয়ালচিত্র শিল্প হিসেবে বিবেচনা করেননি (গমব্রিখ, দি স্টোরি অফ আর্ট, ১৯৫০)।
ক্রমাগত সমৃদ্ধির জন্য শহরগুলির মধ্যে একটি বৃহৎ আকার ধারণ করে এবং শাসক শ্রেণির উদ্যোগে পরিণত হয় নগরে। ছোট শহরের সংস্কৃতি এইভাবে উন্নত হয়ে, সৃষ্টি করে নগরসভ্যতা। তখন রাষ্ট্রের বা রাজ্যের প্রতিষ্ঠা হয়, যার শাসনভার গ্রহণ করেন প্রধান শাসক কিংবা রাজা। শাসক বা অভিজাত শ্রেণির মধ্য থেকেই আবির্ভূত হয় রাজবংশ। সমাজে শ্রেণিবিন্যাস আরো সুনির্দিষ্ট হয়ে ওঠে। রাজা বা প্রধান শাসকের নিচে থাকে অমাত্যবর্গ, পুরোহিত, ধনী অভিজাত শ্রেণি, আমলা, শান্তি-শৃঙ্খলার দায়িত্বপ্রাপ্ত সশস্ত্র বাহিনী, লিপিকর, ব্যবসায়ী, শিল্পী, কৃষক, কারুশিল্পী, ভূমিদাস ও যুদ্ধবন্দি দাস। সমাজে বিভিন্ন শ্রেণির মানুষের অবস্থান মাঝে মাঝে পরিবর্তিত হয়, ধনসম্পদ ও ক্ষমতা বণ্টনের ভিত্তিতে। নগরসভ্যতায় সামাজিক শ্রেণিবিন্যাস ছিল জঙ্গম।
প্রায় ক্ষেত্রেই উর্বর জমিতে কৃষিকাজের সুবিধার জন্য এবং যাতায়াত ব্যবস্থা সুগম হওয়ার কারণে নগর গড়ে ওঠে নদীতীরবর্তী অঞ্চলে। ইতিহাসবেত্তা গর্ডন চাইল্ড নিওলিথিক যুগে কৃষি সংস্কৃতি শুরু হওয়ার পাঁচ বছরের মধ্যে এই বিশাল পরিবর্তনকে আখ্যায়িত করেছেন ‘বৈপ্লবিক’ বলে (গর্ডন চাইল্ড, ম্যান মেকস্ হিমসেলফ্, ১৯৩৬)। নগরায়ণের মাধ্যমে জীবনযাত্রার পদ্ধতি ও মান নতুন পর্যায়ে পৌঁছানোর জন্য একে বলা হয়েছে নগরসভ্যতা। এইভাবে নগরায়ণ ও সভ্যতা হয়ে গিয়েছে সমার্থক।
প্রাচীন মিশর
নগরসভ্যতার মধ্যে প্রাচীনতম হলো নীল নদের তীরে মিশর দেশ। সকল প্রাচীন সভ্যতার মধ্যে মিশরের সময়কাল ছিল দীর্ঘতম, প্রায় সাড়ে চার হাজার বছর। তার ঐশ্বর্য, জাঁকজমক এবং বিভিন্ন ক্ষেত্রে উৎকর্ষ অর্জনও ছিল সবচেয়ে বেশি। খ্রিষ্টপূর্ব ৫০০০ থেকে ৫২৫ অব্দ পর্যন্ত প্রাচীন মিশরীয় সভ্যতার সময়কালে সেখানে রাজত্ব করে তিনটি রাজ্যের (প্রাচীন, মধ্যম ও নতুন) একত্রিশটি রাজবংশ। রাজ্যগুলির সময়ে যেমন আর্থসামাজিক-রাজনৈতিক পরিবর্তন ঘটে, একইভাবে সমসাময়িক রাজবংশগুলির শাসনকালে বিশেষ বিশেষ ক্ষেত্রে নিজস্ব কিছু বৈশিষ্ট্য দেখা দেয়। যেমন, দেবদেবীর উপাসনার ক্ষেত্রে অথবা সামাজিক শ্রেণিগুলির ক্ষমতা ও অবস্থানের উত্থান-পতনে। পুরোহিত শ্রেণির সঙ্গে ধর্মের ক্ষেত্রে প্রভাব নিয়ে রাজার (ফারাও নামে পরিচিত) দ্বন্দ্ব দেখা দেয় মাঝে মাঝে, কখনো পুরোহিত শ্রেণির ক্ষমতা বৃদ্ধি পায়, যখন তারা ধর্মের নামে ব্যবসা শুরু এবং কুসংস্কারের প্রচলন করে। শান্তি ও যুদ্ধের ভিত্তিতেও তিনটি রাজ্যের (কিংডম) সময়কালে পার্থক্য দেখা যায়। প্রথম রাজ্য শান্তিপূর্ণ নীতি অনুসরণ করেছে, মধ্যরাজ্যের সময় মিশর বিদেশিদের দ্বারা অধিকৃত হয় এবং তাদের প্রভাবে স্বৈরতান্ত্রিক ও সাম্রাজ্যবাদী চেতনা লাভ করে। নতুন রাজ্যের সময় ফারাওগণ শক্তিশালী সেনাবাহিনী গড়ে তুলে বিদেশিদের বিতাড়িত করেন। মিশর তখন সাম্রাজ্যবাদী শক্তিতে পরিণত হয়। এই সময় থেকে মিশর সাম্রাজ্যের পরিচিতি লাভ করে। যুদ্ধ জয়ের পর বিদেশ থেকে ধন-রতœ লুণ্ঠন করে এনে নগরসভ্যতার উন্নতির জন্য ব্যয় করা হয়। বাকি অংশ যায় ফারাও ও অভিজাত শ্রেণির বিলাসব্যসনে। উভয়ভাবেই মিশরের স্থাপত্য, ভাস্কর্য ও চিত্রকলার উন্নতি ত্বরান্বিত হয়।
বিখ্যাত ফারাওদের মধ্যে সর্বশেষ ছিলেন তৃতীয় রামেসেস। নতুন রাজ্যের সময় খ্রিষ্টপূর্ব বারো শতকের মাঝামাঝি থেকে পরবর্তী ফারাওদের শাসনকালে সাম্রাজ্যের শক্তি দুর্বল হয়ে পড়ে এবং নগরসভ্যতার কাঠামো ভেঙে যায়। মিশরীয়দের উদ্ভাবনী শক্তির স্থান অধিকার করে জাদুবিদ্যা ও বিভিন্ন কুসংস্কার। ধর্মীয় আচার-অনুষ্ঠান জনজীবনকে আচ্ছন্ন করে ফেলে। ধর্মের ক্ষেত্রে ক্ষমতা চলে যায় পুরোহিত শ্রেণির হাতে, যারা তার অপব্যবহার করতে শুরু করে। বিদেশিদের আক্রমণ অব্যাহত থাকে। অবশেষে খ্রিষ্টপূর্ব ৫২৫ অব্দে মিশর পারসীয়দের অধিকারে চলে যায়। প্রাচীন মিশরীয় সভ্যতার এইভাবে সমাপ্তি ঘটে।
প্রাচীন মিশরীয় সভ্যতার প্রধান বৈশিষ্ট্য ছিল সুনির্দিষ্ট ধর্মবিশ্বাস, যেখানে দৈবশক্তির অধিকারী হিসেবে বিভিন্ন প্রাকৃতিক বস্তু বা দৃশ্যের উপাসনা করা হয়। সূর্য, পাতাল, নদী, বজ্র ইত্যাদি ছিল এইসব দেবদেবীর অন্তর্ভুক্ত। বিভিন্ন রাজ্যের সময় এদের নাম এবং ক্ষমতা ও প্রভাবের পরিবর্তন ঘটেছে। একজন শিল্প-ঐতিহাসিকের বইতে বলা হয়েছে, সমস্ত মিশরীয় সভ্যতার ওপর প্রভাব রেখেছিল এক বিশদ ও জটিল ধর্মবিশ্বাস, যা ইহকালের তুলনায় পরকালের প্রতি বেশি গুরুত্ব আরোপ করেছিল (ডেল জি ক্লিভার, আর্ট-অ্যান ইন্ট্রোডাকশন, ১৯৬১)। তাঁর মতে, প্রাচীন মিশরের প্রায় সব ভাস্কর্য, চিত্রকলা ও স্থাপত্য ছিল প্রাকৃতিক শক্তির উদ্দেশে নিবেদিত ধর্মীয়
আচার-অনুষ্ঠানভিত্তিক এবং মৃতদের সমাধিসৌধকেন্দ্রিক। ধর্মবিশ্বাস ব্যাপক ও গভীর হওয়ার জন্যই প্রাচীন মিশরের শিল্পকর্মে ছিল বিশালতা, বৈচিত্র্য ও অগণিত সংখ্যা। তিনি মিশরের ধর্মে বিভিন্ন ধরনের দেবদেবীর উপাসনার উল্লেখ করে বলেছেন, এদের প্রতিনিধিত্ব হয়েছে পুরুষ ও নারীর রূপে এবং কখনো মানুষ ও জন্তুর সমন্বিত অবয়বের ভিত্তিতে। যেমন-স্ফিংকস, যার মাথা ছিল রাজার এবং নিচের অংশ ছিল সিংহের দেহের মতো। দেবদেবীর মধ্যে ছিল ওসিরিস, যাকে পাতালের অধিকর্তা মনে করা হতো এবং প্রায়ই মমির (ঔষধি বস্ত্র দ্বারা আবৃত মৃতদেহ) আকারে দেখানো হতো। ভাস্কর ও শিল্পী তারা এই দুই ভূমিকায় রূপ সৃষ্টি করেছে মূর্তি নির্মাণে এবং প্রতিকৃতি এঁকে। এনুবিস নামে দেবতা ছিল শেয়ালের মতো দেখতে, যে মৃতদেহ সংরক্ষণের জন্য মমির গায়ের ঔষধি বস্ত্র তৈরি করা ও তা মৃতদেহে পরানোর ক্ষমতাপ্রাপ্ত ছিল। নাট ছিল মানুষের অবয়বে আকাশ পরিভ্রমণকারী দেবী। হাথোর ছিল ভালোবাসা ও আনন্দের দেবী, যার মাথায় শোভা পেত গরুর শিং। সবচেয়ে শক্তিশালী ছিল সূর্যদেবতা ‘রে’ বা ‘রা’। সূর্যদেবতা রে দিনে তার রথে আকাশ পরিভ্রমণ শেষে সন্ধ্যার পর পাতাল পরিভ্রমণে যেত। হোরুস নামের দেবতাও সূর্যদেবতার প্রতিনিধিত্ব করত এবং দেখতে ছিল ঈগল পাখির মতো। এইসব দেবদেবী সময়ে সময়ে তাদের নাম পরিবর্তন করত (ফারাওয়ের সম্মতি নিয়ে পুরোহিতরাই করত) এবং একে অন্যের রূপ পরিগ্রহ করত। কখনো সূর্যদেবতার স্থানে পাতালের দেবতা ওসিরিস সবচেয়ে ক্ষমতাধর হয়েছে। যেমন মধ্যরাজ্যের সময়। রূপে ও ক্ষমতায় এইসব পরিবর্তন ভাস্কর্য ও চিত্রকলায় প্রতিকৃতি তৈরির ওপর প্রভাব ফেলেছে। ভাস্কর ও শিল্পীদের জানতে হতো কোন সময়ে কোন দেবতা বা দেবী সবার ওপর, কেননা ভাস্কর্যে, বিশেষ করে রিলিফ ভাস্কর্যে এবং প্রতিকৃতি আঁকার সময় তাকে যথাস্থানে রাখা অত্যাবশ্যকীয় ছিল। ফারাওকেও মনে করা হতো দেবতা হিসেবে অথবা দৈবশক্তির অধিকারী রূপে। দৈবশক্তির প্রতিনিধি হিসেবে ফারাও প্রধান পুরোহিতের ভূমিকা পালন করতেন। স্বভাবতই এ নিয়ে তাদের মধ্যে ক্ষমতার দ্বন্দ্ব ছিল।
রাষ্ট্রশক্তি ও ধর্মের নিকট সম্পর্কের জন্য স্থাপত্য, ভাস্কর্য ও চিত্রকলার উন্নয়নে ফারাও যেমন সক্রিয় পৃষ্ঠপোষকতা দান করেছেন, পুরোহিতের ভূমিকাও ছিল উল্লেখযোগ্য, বিশেষ করে মন্দির এবং দেবদেবীর মূর্তি নির্মাণ ও প্রতিকৃতি তৈরিতে। ফারাওয়ের কাছ থেকে আসত মন্দির ও সমাধিসৌধ নির্মাণ এবং ভাস্কর্য ও চিত্রকলা তৈরির জন্য প্রয়োজনীয় অর্থ। পুরোহিত ও তার সহকর্মীরা এইসব ভবন নির্মাণে এবং শিল্প সৃষ্টিতে তদারকি করত ও সেসব তাদের তত্ত্বাবধানে রাখত। প্রধান পুরোহিতের বাসগৃহের পাশেই ছিল শিল্পী ও ভাস্করের কারখানা, যেখানে তারা শুধু ভাস্কর্য তৈরি আর প্রতিকৃতি আঁকত না, নবীন শিক্ষানবিশিদের প্রশিক্ষণও দেওয়া হতো। গমব্রিখ তাঁর বইতে উল্লেখ করেছেন, এইসব অভিজ্ঞ ভাস্কর ও শিল্পীদের কাছে গ্রিস দেশ থেকেও শিক্ষার্থীরা প্রশিক্ষণের জন্য আসত (গমব্রিখ, প্রাগুক্ত)।
নিওলিথিক যুগেই নীল নদের তীরবর্তী অঞ্চলে নতুন ধর্মবিশ্বাস প্রচলিত হলেও গ্রামাঞ্চলে মন্দির নির্মাণ ও দেবদেবীর মূর্তি তৈরি করে ভেতরে স্থাপন শুরু হয়নি। এর কারণ ছিল হয়তো এই যে, পুরোহিত শ্রেণি শহরেই থাকত, কেননা সেখানেই শাসক শ্রেণির বাস, যাদের পৃষ্ঠপোষকতা তাদের জন্য প্রয়োজনীয় ছিল। নিওলিথিক যুগের ছোট ছোট শহরে ছোট আকারের মন্দির নির্মাণ ও দেবদেবীর মূর্তি তৈরি শুরু হলেও সেসব ছিল সংখ্যায় অল্প। নগরসভ্যতা প্রতিষ্ঠার পর ফারাও রাজধানী নগরে বসবাস শুরু করলে ধর্মের আচার-অনুষ্ঠান এবং দেবদেবীর উপাসনা বিস্তৃতি লাভ করে। এইসবের পেছনে থাকে রাজ্যের (ফারাওয়ের) সমর্থন। পুরোহিত শ্রেণি নগরে এসে ধর্মীয় কাজকর্মের তদারকি ও পরিচালনার মাধ্যমে জনগণকে উদ্বুদ্ধ করে। ফারাও যেহেতু দৈবশক্তির অধিকারী সেজন্য তার পৃষ্ঠপোষকতায় বৃহৎ আকারের অনেক মন্দির নির্মিত হয়, তার ভেতরে স্থাপিত হয় দেবদেবীর মূর্তি এবং মন্দিরের সামনে পথের দুপাশে স্থাপিত হয় ফারাওয়ের মুখ ও সিংহের শরীর সমন্বয়ে তৈরি অতিকায় স্ফিংকসের ভাস্কর্য। মৃত ফারাও ও পুরোহিতসহ অন্যান্য অভিজাত শ্রেণির জন্য নগরের উপকণ্ঠে নির্মিত হয় সুউচ্চ সমাধিসৌধ, যা পরিচিত হয় পিরামিড নামে। এর ভেতর সংরক্ষিত হয় মমির আকারে মৃতের দেহ, তার ওপর তৈরি হয় অবয়ব ও মুখের অনুকরণে ভাস্কর্য এবং প্রতিকৃতি। পিরামিডের ভেতর মৃতের মূর্তি স্থাপন এবং দেয়ালে ইহকালে তার জীবন বর্ণনাকারী দৃশ্যাবলিও আঁকা হয় বিশদভাবে। এইসব কাজের তদারকিতে পুরোহিতের ভূমিকা হয় অগ্রগণ্য।
প্রাচীন মিশরীয় সভ্যতায় গ্রামাঞ্চলে এই ধর্মবিশ্বাস প্রচলিত থাকলেও মন্দির নির্মিত হয়েছে কম, সেইসঙ্গে দেবদেবীর মূর্তির সংখ্যাও ছিল সীমিত। নগরে যেমন পাথর দিয়ে প্রাসাদ, মন্দির, সমাধিসৌধ এবং পুরোহিত ও অভিজাতদের বাসগৃহ তৈরি হয়েছে গ্রামে সেই ধরনের স্থাপত্য ছিল না। পাথরের অভাবে অস্থায়ী ও দুর্বল প্রকৃতির মন্দির এবং ভবনে মূর্তি ও প্রতিকৃতি থাকলেও সেসব সংরক্ষিত হয়নি। তবে গ্রামে অনেক কারুশিল্পী বাস করত। তাদের তৈরি মৃৎপাত্র এবং দৈনন্দিন কাজে ব্যবহৃত অন্যান্য বস্তুর ভগ্নাবশেষ আবিষ্কৃত হয়েছে। এইসবের গায়ে মৃৎশিল্পীরা শখ করে জ্যামিতিক নকশা এঁকেছে; কোনো ধর্মীয় মোটিফ সেখানে নেই। এই সৃজনশীল শিল্প ছিল একান্তভাবেই সেক্যুলার। একই দেশে নগরে নির্দিষ্ট ধর্মের প্রবল প্রতাপ ও শিল্পকর্মে তার প্রভাব এবং পাশাপাশি গ্রামাঞ্চলে তার অনুপস্থিতি না হলেও তার অনুসরণে মন্দির নির্মাণ ও দেবদেবীর মূর্তি তৈরিতে এত পিছিয়ে থাকার কারণ হয়তো এই যে, পৃষ্ঠপোষকতার অভাবে এইসব হয়নি। মন্দির নির্মাণ, মূর্তি ও প্রতিকৃতি তৈরি সবই ছিল ব্যয়বহুল, যার জন্য ভাস্কর ও শিল্পীদের পৃষ্ঠপোষকতার ওপর নির্ভর করতে হয়েছে। পৃষ্ঠপোষকের অভাবে তারা গ্রামে বসবাস করে এইসব ব্যয়বহুল ও সময়সাপেক্ষ শিল্পকর্মে নিয়োজিত থাকতে পারেনি। এইভাবে মিশরের নগরসভ্যতায় শিল্পকলার উৎকর্ষ ও প্রসার লাভ করেছে নগরেই, একথা বলা যায়।
নগরে মন্দিরের ভেতর দেবদেবীর মূর্তি ছাড়াও প্রধান স্থানে ক্ষমতাসীন ফারাওয়ের মূর্তি নির্মাণ ও স্থাপিত হয়েছে। এইসব মূর্তি অধিকাংশ ক্ষেত্রেই ছিল আদর্শায়িত, বাস্তবের অনুকরণ নয়। আদর্শায়িত মূর্তি নির্মাণের নির্দেশ এসেছে কর্তৃপক্ষের কাছ থেকে যেন মূর্তির সৌন্দর্য দেখে প্রজা-দর্শকরা মুগ্ধ হয় এবং শ্রদ্ধাবনত হয়ে প্রণতি জানায়। আগেই বলা হয়েছে, ফারাওয়ের মুখ এবং সিংহের শরীরের নিম্নাংশ নিয়ে বিশাল আকারের ভাস্কর্য তৈরি করা হয়েছে শৌর্যবীর্যের নিদর্শন হিসেবে। এইসব ভাস্কর্য বা স্ফিংকস স্থাপিত হয়েছে সমাধিসৌধের (পিরামিড) কাছে অথবা প্রধান মন্দিরের সম্মুখভাগে পথের দুপাশে। ধর্মভীরু প্রজাদের মনে উপাসনায় যাওয়ার পূর্বমুহূর্তে ফারাওয়ের প্রতি ভক্তি এবং শ্রদ্ধাজ্ঞাপন ছিল এইসব ভাস্কর্য স্থাপনের প্রধান উদ্দেশ্য। ফারাওয়ের প্রাসাদে এবং পুরোহিত ও অভিজাত শ্রেণির বাসভবনেও নিজেদের যে মূর্তি স্থাপন করা হয়েছে সেসবের প্রকৃতিও ছিল আদর্শায়িত অর্থাৎ বাস্তবানুগ না করে চেহারা সুন্দর করে দেখানো। বাস্তবের সঙ্গে অবশ্য কিছু সাদৃশ্য থাকত যেন মূর্তির বিষয় শনাক্ত করা যায়। এইভাবে সৃজনশীলতার পাশাপাশি অনুকরণও তার স্থান করে নিয়েছিল।
সমাধিসৌধ অর্থাৎ পিরামিডের ভেতর ফারাও, রানি, পুরোহিত, রাজন্যবর্গ ও অভিজাত শ্রেণির মমির ওপর যে বাস রিলিফ বা খোদাই করা ভাস্কর্য তৈরি করা এবং পাশে স্তম্ভের ওপর মুখের মূর্তি স্থাপিত হতো সেসব ছিল মৃত ব্যক্তির চেহারার হুবহু অনুকরণে। এখানে আদর্শায়ন স্থান পায়নি। এর প্রথম কারণ, দেখার জন্য সেখানে জনসাধারণের প্রবেশাধিকার ছিল না। তার চেয়েও বড় কারণ ছিল, মৃতের প্রকৃত চেহারার সঙ্গে সাদৃশ্য না থাকলে তার দ্বৈতসত্তা বা যমজ ‘কা’ মৃতকে (‘বা’) শনাক্ত করতে না পেরে তাকে নিয়ে পরলোক যাত্রা করতে পারবে না, এই বিশ্বাস। জীবদ্দশায় না হলেও মৃত্যুর পর সমাধিসৌধে ধর্মবিশ্বাস ভাস্কর্যে (চিত্রকলাতেও) বাস্তবের অনুকরণের ভিত্তি হিসেবে কাজ করেছে। মিশরের শিল্পকলার সঙ্গে বাস্তবের সম্পর্ক স্থাপনের ক্ষেত্রে এইভাবে দুটি বিপরীতধর্মী আদর্শ কাজ করেছে। পিরামিডের ভেতরে ফারাও বা তার রানির মূর্তি কতটা বাস্তবানুগভাবে তৈরি হয়েছে তার একটা নিদর্শন দেখা যায় ফারাও ম্যানকুরে ও তার রানির দ-ায়মান ভাস্কর্যে, যা পিরামিডের ভেতর ছিল। এই ভাস্কর্যে বাস্তবের আদলে দেখা যায়, মুখের অভিব্যক্তিসহ। ফারাওয়ের দাঁড়ানোর ভঙ্গিতে রয়েছে সচেতনভাবে বলিষ্ঠতা প্রদর্শন, যা বাস্তবসম্মত। কিন্তু তার দাড়ি ও শিরসজ্জায় দেখা যায় আদর্শায়িত রূপ। রানির মূর্তি বাস্তবানুগ হলেও তারও সাজসজ্জায় বাহুল্য এবং মুখে প্রসাধনীর আভাস রয়েছে। তবে সব মিলিয়ে বাস্তবের অনুকরণই প্রাধান্য পেয়েছে। এই ভাস্কর্যটি আরো একটি কারণে বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। এখানে মিশরের শিল্পরীতির সাধারণ নিয়ম ও পদ্ধতির (ফ্রন্টালিটি) অনুসরণ করে মুখের প্রোফাইল, সামনাসামনি দেখা বুকের দৃশ্য এবং চোখ জোড়া আঁকা হয় নি। ফ্রন্টালিটি বা সমুখ থেকে দৃশ্যমান শরীরের বিশেষ অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের প্রতিকৃতি দেখানোর যে স্টাইলাইজ রীতি তা এখানে নেই। শুধু এই মূর্তি দুটিতে নয়, দ-ায়মান কোনো মূর্তির ভাস্কর্যেই ফ্রন্টালিটির নিয়ম ব্যবহার করা হয়নি। এর কারণ দ-ায়মান ভাস্কর্যে ত্রিমাত্রিক ভাব ফুটিয়ে তোলা যায় অনায়াসে। সমাধিসৌধে ভাস্কর্যে যে বাস্তবানুগতা এসেছে শুধু ধর্মীয় কারণে নয়, ত্রিমাত্রিকতার সুবিধার জন্যও।
মন্দির, সমাধিসৌধ, প্রাসাদ ও বাসভবন ছাড়াও মূর্তি স্থাপিত হয়েছে নগরীর বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ স্থানে, উদ্যানে ও সরোবরের পাশে। এদের অধিকাংশই ছিল ফারাওয়ের। দেবদেবীর মূর্তি মন্দিরের বাইরে সাধারণত স্থাপিত হতো না তবে ফারাও ও তার পরিবারের দৃশ্য নিয়ে তৈরি বা রিলিফ অর্থাৎ খোদাই করা ভাস্কর্যে সূর্যদেবতার প্রতিকৃতি প্রায়ই দেখানো হতো। আগেই বলা হয়েছে, দেবদেবীর মূর্তি ছিল কাল্পনিক। কিন্তু এসবের জন্য মডেল ব্যবহার করা হতো, যা তৈরির জন্য নির্দেশ দিত প্রধান পুরোহিত। ভাস্কররা কেন্দ্রীয়ভাবে অনুমোদিত নকশার আদলে দেবদেবীর মূর্তি নির্মাণ করত তার উল্লেখ করেছেন গমব্রিখ (গমব্রিখ, প্রাগুক্ত)। ফারাও ও অন্যদের মূর্তি নির্মাণের ক্ষেত্রে একইভাবে মডেল বা মুখোশ ব্যবহার করা হতো। দেয়ালে প্রতিকৃতি নির্মাণেও শিল্পীরা ব্যবহার করত নির্ধারিত পদ্ধতি ও নীতি। দেয়ালে প্রথমে সরলরেখা দিয়ে নকশা দিয়ে তার ভেতর আঁকা হতো ফারাও ও অন্যদের প্রতিকৃতি। গমব্রিখ এই শৃঙ্খলা ও নির্ধারিত পদ্ধতির উল্লেখ করে বলেছেন, মিশরের ভাস্কর্য ও চিত্রকলা তৈরির সবচেয়ে প্রধান বৈশিষ্ট্য ছিল শিল্পীরা যেন একই আদর্শ অনুসরণ করে তা নিশ্চিত করা। তাঁর মতে, নির্ধারিত রীতি-পদ্ধতির অনুসরণের ফলে তিন হাজার বছর ধরে মিশরীয় ভাস্কর্যে ও চিত্রকলায় একই শৈলী দেখা যায়। সেখানে কোনো পরিবর্তন আসে নি (গমব্রিখ, প্রাগুক্ত)।
আগেই বলা হয়েছে, ফারাও বা অভিজাত শ্রেণির সদস্যদের জীবদ্দশার মূর্তি নির্মাণে আদর্শায়িত রূপের অনুসরণ করার নির্দেশ ছিল শিল্পীদের ওপর। এর কারণও ব্যাখ্যা করা হয়েছে। এখানে প্রাচীন রাজ্যের চতুর্থ রাজবংশের সময়ে একটি মুখের মূর্তির উল্লেখ করা যায়, যেখানে জ্যামিতিক সারল্য এবং বাস্তবের সংমিশ্রণ রয়েছে। মূর্তিটি মানুষের মুখের আদর্শায়িত রূপের প্রতিফলন, যেখানে শান্ত-সমাহিত ভাব এবং আভিজাত্যবোধ রয়েছে। বার্লিন মিউজিয়ামে রানি নেফারতিতির কাঁধসহ মুখের মূর্তিতে তার বাস্তব চেহারার ওপর যে প্রলেপ পড়েছে প্রসাধনের তা বেশ বোঝা যায়। তার গলা দেখা যায় অস্বাভাবিকভাবে দীর্ঘ ও বাঁকানো, যা প্রকৃতই ছিল কিনা তা জানার উপায় নেই। রানির মুখের প্রসন্ন ও প্রত্যয়ী দৃষ্টিতে যে রাজকীয় আভিজাত্য ও গরিমা পরিস্ফুট সেসব একজন রানির জন্য যথাযথ ও স্বাভাবিক। রানি নেফারতিতির মুখের মূর্তি আগে উল্লিখিত যুবকের মূর্তির তুলনায় অনেক বাস্তব, যদি না দীর্ঘ কণ্ঠটি সৌন্দর্যবর্ধনের জন্য তৈরি করা হয়ে থাকে।
সব ফারাওই তাদের মূর্তি নির্মাণে আদর্শায়িত রূপ অনুসরণের পক্ষে ছিলেন না এবং তেমন নির্দেশও দেন নি। এমন একজন ফারাও ছিলেন নতুন রাজ্যের অষ্টাদশ রাজবংশের চতুর্থ আমেনোফিস। তাঁকে গমব্রিখ বলেছেন নন্দনতত্ত্বের বিষয়ে ‘হেরেটিক’ অর্থাৎ অবিশ্বাসী। তিনি একাধিক দেব-দেবতার স্থানে কেবল আটেন দেবতাকে স্বীকার করেছেন, যে অনেকটা সূর্যদেবতার প্রতীক, কেননা ওপর থেকে সূর্যের রশ্মি বিকিরণ করত এই দেবতা। এই দেবতার সঙ্গে মিল রেখে ফারাও আমেনোফিস নিজের নামকরণ করেন আখনাটেন। তিনি তার এবং পরিবারের যে ভাস্কর্য তৈরি করার নির্দেশ দেন তার মধ্যে রাজকীয় গাম্ভীর্য কিংবা আনুষ্ঠানিকতার কোনো বৈশিষ্ট্য ছিল না। বাস রিলিফে বা খোদাই করা ভাস্কর্যে প্রতিফলিত তার পারিবারিক জীবনের দৃশ্য শুধু বাস্তবানুগ নয়, আটপৌরেও বটে। এর আগে আর কোনো ফারাওয়ের পারিবারিক জীবনের এমন নিরাভরণ দৃশ্য ভাস্কর্যে মূর্ত হয় নি। তিনি নিজের মুখের যে খোদাই করা ভাস্কর্য তৈরি করতে বলেন সেখানে তার চেহারার সব ত্রুটি প্রতিফলিত করা হয়েছে বিশ্বস্তভাবে। যেমন, মোটা দুই ঠোঁট, ঝুলে পড়া চিবুক, চুপসে যাওয়া গাল, ছোট আকারের কান, কপালের সঙ্গে একই রেখায় প্রসারিত নাক এবং ছোট আকারের চোখ। বলতে গেলে কদর্যরূপেই তাকে দেখানো হয়েছে এই ভাস্কর্যে। এখানে বাস্তবের প্রতিফলন হয়েছে শতভাগ। তাঁর উত্তরসূরি ফারাও টোটেনখামেনের সময়েও এই বাস্তবানুগ শৈলী অক্ষুণœ ছিল। একটি কাঠের ওপর আঁকা প্রতিকৃতিতে তাঁকে তাঁর স্ত্রীর সঙ্গে যে ভঙ্গিতে দেখা যায় সেখানেও আটপৌরে ভাব স্পষ্ট, রাজকীয় গাম্ভীর্য বা গরিমা প্রকাশের কোনো প্রয়াস নেই। মিশরের ভাস্কর্য ও চিত্রকলায় (চিত্রকলার প্রসঙ্গ পরে আসবে) এই পরিবর্তন এসেছিল ক্রিট সভ্যতার সময়ে সৃষ্ট চিত্রকর্মে অনুসৃত আদর্শের প্রভাবে। কিন্তু এই পরিবর্তন দীর্ঘস্থায়ী হয়নি। টোটেনখামেনের রাজত্বকালেই শিল্পকর্মে পুরনো আদর্শ প্রত্যাবর্তন শুরু করে। তাঁর রাজত্বের হাজার বছর আগে যে শৈলী ছিল সেটি ব্যবহৃত হয় এবং আরো এক হাজার বছর পর্যন্ত সেটি অব্যাহত থাকে। মিশরের শিল্পকর্মে নতুন বিষয় এসেছে, নতুন সৃষ্টিও হয়েছে কিন্তু গমব্রিখের ভাষায় শিল্পের অর্জনে নতুন কিছুই যোগ করা হয় নি।
ভাস্কর্যের ক্ষেত্রে তিনটি রাজ্যের সময় কী কী প্রধান বৈশিষ্ট্য লক্ষ্য করা যায়, তা সংক্ষেপে উল্লেখ করে মিশরীয় ভাস্কর্যের আলোচনা শেষ করা যায়। প্রাচীন মিশরের ভাস্কর্যের একটি বৈশিষ্ট্য হলো তাদের বিশাল আকার। শিল্প ঐতিহাসিক ডেল ক্লিভারের ভাষায় : মিশরের ভাস্কর্যে কলোসাসের মতো বড় থেকে শুরু করে স্বর্ণকারের ক্ষুদ্র ও সূক্ষ্ম কাজ ছিল। সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য ভাস্কর্যগুলি ছিল সমাধিসৌধ এবং মন্দিরের জন্য তৈরি। বড় আকারের মূর্তির জন্য ব্যবহার করা হতো পাথর। আর ছোট কাজের জন্য সোনা, রুপা, এনামেল অথবা অন্যান্য মূল্যবান পাথর। প্রাচীন রাজ্যে রিলিফে উৎকীর্ণ ভাস্কর্য অল্প খোদাই করা থেকে উঁচু করে তোলা পর্যন্ত ছিল। মিশরের ইতিহাসে মানবদেহকে যেভাবে দেখানোর রীতি ছিল সেইভাবে মূর্তি খোদাই করা হতো যেখানে চোখ আর বুক দেখা যেত সামনাসামনি। পশ্চাৎদেশ এবং পায়ের প্রতিফলনও হতো প্রোফাইলে। এই রীতির নাম ছিল ‘ফ্রন্টালিটি’, যা আগেই উল্লেখ করা হয়েছে। এর উদ্দেশ্য ছিল পারসপেক্টিভের সমস্যা এড়ানো। শিল্পী/ভাস্কর ধাপে ধাপে এই কাজ করলেও ভাস্কর্যে কোনো গতিশীলতা সৃষ্টি হয়নি। গতিশীলতা দেখাতে হলে সময়ের পরিবর্তন দেখাতে হয় আর ভরের (ম্যাস) জন্য প্রয়োজন স্পেস বা জমির। প্রাচীন রাজ্যের রিলিফ ভাস্কর্যে এই দুটির কোনোটিই ছিল না। ভাস্কর্যে মূর্তির তীক্ষè প্রান্তদেশ এবং কৌণিক অঙ্গভঙ্গির ফলে গতিশীলতার কোনো আভাসই পাওয়া যায়নি। ফিগারের প্রায় সমতলসদৃশ আকারগুলি পরস্পর সন্নিবেশিত হওয়ায় জমিকে অগভীর মনে হলেও বিশাল আকারের অবয়ব এবং গভীরতার মায়া অথবা আভাস সৃষ্টি হয়নি। এর ফলে রিলিফ ভাস্কর্যগুলি দেয়ালের ভর বা ম্যাসকে দুর্বল বা গৌণ করতে পারেনি। প্রাচীন রাজ্যে যেসব দ-ায়মান ভাস্কর্য দেখা যায় সেখানে দেয়ালের সঙ্গে কোনো সম্পর্ক নেই, সেসব স্বাধীনভাবেই দাঁড়িয়ে। বড়জোর সমর্থনের জন্য পেছনে লম্বা একটি পাথরের খ- ব্যবহার করা হয়েছে। অধিকাংশ মিশরীয় দ-ায়মান ভাস্কর্যই যা পাথর কেটে তৈরি করা হয়েছে সেগুলি চারদিকের আভাস অক্ষুণœ রেখেছে। দেহের অ্যানাটমিকে এক ধরনের সরলীকরণ দেখা যায়, যা প্রায় জ্যামিতিক চরিত্রের। ফলে ফিগারগুলি মিশরের স্থাপত্যের মতো ঋজু, সবল, দৃঢ় এবং স্থায়ী দেখায়। মূর্তিগুলির মুখে ব্যক্তিত্বের ছাপ থাকলেও সেসব শারীরিকভাবে গতিহীন এবং অনড়। প্রাচীন রাজ্যে অবশ্য বিভিন্ন অঞ্চলের ভাস্কর্য একইরকম সাধারণ ফর্মের ছিল না। উপাসনার দেবতা অথবা সমাধিসৌধে মৃতের সেবার জন্য ভৃত্যের মূর্তির মধ্যে পার্থক্য ছিল। ভৃত্য এবং তার মতো সাধারণ মানুষের মূর্তি ছিল হুবহু বাস্তবের অনুকরণ। মৃত ব্যক্তির সমাধিতে তার মূর্তির ভাস্কর্যে সামান্যভাবে হলেও সৃজনশীলতার ব্যবহার করা হয়েছে।
মধ্যরাজ্যে (খ্রিষ্টপূর্ব ২১৩৪-১৭৮৬ অব্দ পর্যন্ত) সমাধিসৌধের এবং মন্দিরের আকার ছোট ছিল। কোথাও কোথাও মন্দির ও সমাধিসৌধ পরস্পর সংলগ্ন ছিল। সম্পদের অপ্রতুলতার জন্য এমন হয়েছিল বলে ধারণা করা যায়। এই রাজ্যের সময় পাতাল দেবতা ওসিরিস প্রাধান্য পাওয়ার ফলে মন্দিরে পরলোকের তুলনায় পাতালের ওপর জোর দেওয়া হয় বেশি, যার জন্য সমাধিসৌধের আকার হ্রাস পায়। মধ্যরাজ্যের অনেক ভাস্কর্য বিদেশি আক্রমণকারী হিকসসদের হাতে অথবা নতুন রাজ্যের (খ্রিষ্টপূর্ব ১৫৭০-৩০ অব্দ পর্যন্ত) সময়ে বিধ্বস্ত হয়। যা অবশিষ্ট থাকে সেসব সাদামাটা সাধারণ ধরনের থেকে সূক্ষ্ম শৈলীবিশিষ্ট। বর্ধমান মধ্যবিত্ত শ্রেণির পৃষ্ঠপোষকতা এবং সম্পদের বিস্তৃত বণ্টনের ফলে অনেক ভাস্কর্য তৈরি হয়, যার ফলে গুণগত উৎকর্ষের দিকে মনোযোগের অভাব থাকে। খোদাই করা ভাস্কর্যের ব্যবহার করা হয় বেশি, যা দেয়ালে শোভাবর্ধন করে। শৈলীর দিক দিয়ে এসবের সঙ্গে প্রাচীন রাজ্যের মিল ছিল, যদিও দেহের ভঙ্গি ছিল বেশ সচেতন, স্বতঃস্ফূর্ত নয়। দ-ায়মান মূর্তি নির্মাণে প্রাচীন রাজ্যের তুলনায় এই সময় আরো সরল শৈলী ব্যবহার করা হয়। ফিগারগুলি হয় খুব মসৃণ ও কৃশ অথবা খসখসে এবং ভারী ও স্তূপীকৃত। অনেক উপবিষ্ট মূর্তির হাত রাখা হয় জড়ো করা পায়ের হাঁটুর ওপরে। এ ধরনের ভাস্কর্যে পাথরের ওপরে মূর্তির মাথা খোদাই করে নিচের অংশে প্রায় কোনো কাজ না করে কেবল হাঁটুর ওপরে হাত রাখা দেখানো হয়েছে। ফলে যে পাথরের খ-টি উপবিষ্ট ভাস্কর্যের জন্য ব্যবহার করা হয়েছে সেটি নিচের দিকে অটুটই রয়েছে বলে মনে হয়। ডেল ক্লিভারের মতে, (ডেল ক্লিভার, প্রাগুক্ত) মধ্যরাজ্যের ভাস্কর্যে ফিগারের মুখে ক্লান্তি এবং সন্দিগ্ধতার অভিব্যক্তিই প্রধান বৈশিষ্ট্য ছিল, যার প্রতিফলন পাওয়া যায় মধ্যরাজ্যের সাহিত্য ও দর্শনে। অভিব্যক্তির এই বাস্তবানুগ প্রতিফলনের সঙ্গে ফিগারের সরলতার বৈপরীত্য ছিল। এখানে সৃজনশীলতা ও অনুকরণ, উভয়ের সংমিশ্রণ ঘটেছে।
নতুন রাজ্যে নীল নদের পশ্চিম পাশে রাজা ও রানির উপত্যকা নামে পরিচিত স্থানে পাহাড়ের ভেতর সমাধিসৌধে ফারাও ও তাদের রানির মমি সংরক্ষিত হয়েছিল। সমতলে বা উপত্যকায় পৃথক সমাধিসৌধ এই সময় নির্মিত হয়নি। নগরের কাছে ছিল উপাসনার জন্য বড় আকারের মন্দির এবং মৃতের মমি তৈরির স্থান। একাধিক দেবতার নামে এসব মন্দির তৈরি হয়েছে। পাহাড়ের ভেতর পাথর কেটে সমাধিসৌধের ভাস্কর্য নির্মাণ করেছে শিল্পীরা আর মন্দিরে স্থাপিত হয়েছে উপাসনার জন্য তৈরি দেবদেবীর মূর্তি। এই রাজ্যের সময় খোদাই করা ভাস্কর্যের সংখ্যা ছিল অনেক। এই পর্বের ভাস্কর্যে মধ্যরাজ্যের শৈলী অক্ষুণœ ছিল কিন্তু সাম্রাজ্যের বিস্তৃতির ফলে অন্যান্য দেশের ভাস্কর্য সম্বন্ধে অবহিত হয়ে মিশরের ভাস্কররা প্রচলিত ফর্ম কিছুটা সংশোধিত করে। এর ফলে বিভিন্ন গোত্রের ও জাতিসত্তার শারীরিক বৈশিষ্ট্যের প্রতিনিধিত্ব করা হয়। এইভাবে ভাস্কর্যে বাস্তবতার অনুকরণ গুরুত্ব পায়। ফারাও আখেনাটনের রাজত্বে ভাস্কর্যের ভঙ্গিতে দৈনন্দিন জীবনের অনানুষ্ঠানিকতা এবং কাজকর্ম করার ভঙ্গি ধারণ করে শৈলী। বয়স এবং শরীরের নমনীয়তা প্রদর্শনের পাশাপাশি পোশাকের জটিলতা ও অলংকরণের বাহুল্যও স্থান পায়। ফারাওয়ের মোটা ঠোঁট, স্থূল চিবুক, লম্বা কান এবং চুপসানো পেট, সবই স্থান পায় ভাস্কর্যে। ক্যারিকেচারের মতো দেখালেও ভাস্কর্যে এটাই হয়ে দাঁড়ায় প্রচলিত আদর্শ। ফারাও ছাড়া অন্যদের ভাস্কর্যেও একই আদর্শ অনুসরণ করা হয়। পুরনো শৈলী পুরোপুরি পরিত্যক্ত হয় না কিন্তু সংশোধিত হয় উল্লেখযোগ্যভাবে। আখেনাটনের মৃত্যুর পর পুরনো শৈলী ফিরে এলেও হুবহু আগের রূপে আসে না। ভাস্কর্যের কন্টুর বা সীমানা হয় মসৃণ এবং নরম।
ওপরের আলোচনায় দেখা যায়, বিভিন্ন কারণে তিন রাজ্যের সময়ে (প্রাচীন, মধ্য ও নতুন) ভাস্কর্যের শৈলীতে কিছু পার্থক্য দেখা গিয়েছে। বাস্তবতা ও সৃজনশীলতার সংমিশ্রণের মাত্রায় তারতম্য ঘটেছে। প্রাচীন মিশরের ভাস্কর্যের বিশেষ বৈশিষ্ট্য ছিল এসবের বিশাল আকার, বিশেষ করে দ-ায়মান মূর্তিগুলির। বিশাল আকারের জন্য ভাস্কর্যগুলি অবাস্তব মনে হয় না, কেননা দেহের অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের মধ্যে সম্পর্ক রাখা হয় আনুপাতিক হারে। ফলে বিশাল মূর্তিটি হয় সামঞ্জস্যময়। লুক্সরে পাহাড়ের ভেতর অবস্থিত মন্দিরের সম্মুখভাগে দুই পাশে খোদাই করা ফারাও দ্বিতীয় রামেসিসের উপবিষ্ট বিশাল দুই মূর্তি এই একই পদ্ধতি ও রীতিতে তৈরি। আকারে বড় হলেও এখানে অবাস্তবতার আভাস নেই। তুলনায় রানি হাটসেপুটুটের ভাস্কর্যে দেখা যায় তিনি জোড়া করা পায়ের দুহাঁটুর ওপর হাত রেখে আসনে উপবিষ্ট কিন্তু তার দেহের নিচের অংশে পোশাক থাকলেও উপরিভাগ নগ্ন। দেহের প্রতিনিধিত্বে ভাস্কর্যটি বাস্তব কিন্তু রানির মর্যাদার সঙ্গে সংগতিবিহীন। এখানে বাস্তব ও সৃজনশীলতার যে মিশ্রণ দেখা যায় তা বেশ অস্বাভাবিক।
পুরোহিত বা অভিজাত শ্রেণির ব্যক্তির ভাস্কর্যে বাস্তবের হুবহু অনুকরণ করা হয়নি। জীবিত অবস্থায় নিখুঁতভাবে নির্মাণের যে রীতি প্রযোজ্য ছিল ফারাওদের ক্ষেত্রে তা এইসব শ্রেণির সদস্যদের মূর্তি নির্মাণেও ব্যবহার করা হয়েছে। তবে সাধারণ শ্রেণির মানুষের মূর্তি নির্মাণে আদর্শায়িত রূপ প্রতিফলনের বাধ্যবাধকতা ছিল না কোনো রাজ্যের সময়েই। বরং উঁচু ও নিচু শ্রেণির পার্থক্য দেখানোর জন্য সাধারণ মানুষের মূর্তিকে আদর্শায়িত না করে বাস্তবানুগ করা হয়েছে। এর নিদর্শন পাওয়া যায় প্যারিসের ল্যুভর মিউজিয়ামে সংরক্ষিত দুটি ভাস্কর্য দেখে। প্রথম ভাস্কর্যটিতে দেখা যায় সাক্কারার এক সম্ভ্রান্ত পুঁথিলেখক হাঁটু মুড়ে যোগাভ্যাসের মতো মেঝেতে উপবিষ্ট। তার দুই হাত পুঁথির ওপর রাখা। তিনি তাকিয়ে আছেন সামনে যেন কাউকে দেখছেন। তার কোমর থেকে ঊর্ধ্বাঙ্গ সম্পূর্ণ অনাবৃত। এটি বাস্তবের হুবহু অনুকরণ, এখানে সৃজনশীলতার প্রভাব নেই। দ্বিতীয় ভাস্কর্যটি এক পদস্থ কর্মচারীর। তিনি লাঠি হাতে দ-ায়মান খুব স্বাভাবিক ভঙ্গিতে। তারও ঊর্ধ্বাঙ্গ অনাবৃত। তার দাঁড়াবার ভঙ্গি এবং দৃষ্টিতে বাস্তবের অনুকরণ স্পষ্ট। দেখা যাচ্ছে জীবিত ব্যক্তির মূর্তি তৈরির ক্ষেত্রে দুধরনের রীতি ও পদ্ধতি ছিল প্রাচীন মিশরে। ফারাও, প্রধান পুরোহিত এবং রাজন্যবর্গ ও অভিজাত শ্রেণির সদস্য ছাড়া সাধারণ মানুষের মূর্তি তৈরিতে বাস্তবতার হুবহু অনুকরণ স্বীকৃত ছিল। সমাজে শ্রেণিবিন্যাস ভাস্কর্যে (চিত্রকলাতেও) যে পার্থক্য মেনে নিয়ে শিল্প সৃষ্টি করেছে তার প্রমাণ পাওয়া যায়। পুঁথিলেখক এবং রাজকর্মচারী শ্রেণিবিন্যাসে বেশ নিচে, তাদের ভাস্কর্য তৈরির প্রয়োজন কেন হলো, সেই ভাস্কর্যের ব্যয় কে বহন করল, তার ব্যাখ্যা পাওয়া যায় না। তবে সহজে অনুমান করা যায়, সাধারণ মানুষ নিজেদের মূর্তি তৈরির কথা ভাবতে পারেনি অর্থ ব্যয়ের কথা ভেবে। কোনো ভাস্কর নিজের সন্তুষ্টির জন্য এদের ভাস্কর্য তৈরি করে বাস্তববাদিতার প্রতি তার অনুরক্তির প্রকাশ করতে চেয়ে থাকতে পারে।
অশোক মিত্র তাঁর ইউরোপের ভাস্কর্য বইতে লিখেছেন, মিশরীয়রা তিন হাজার বছর ধরে ভালো ভালো মূর্তি তৈরি করেছে যার মধ্যে খোদাই করা, সামান্য উৎকীর্ণ, মাঝারি উৎকীর্ণ এবং পূর্ণ উৎকীর্ণ মূর্তি রয়েছে। সম্পূর্ণ সুডৌল মূর্তিগুলি প্রায় অতিকায় এবং চারদিক থেকেই দেখা যায়। তাঁর মতে, শুরু থেকে খ্রিষ্টপূর্ব ১৮০০ যেসব মূর্তি নির্মিত হয়েছে তার মতো বলিষ্ঠ, প্রাণবন্ত, স্টাইলাইজড, স্পন্দনময় শরীরের মূর্তি পরে অনেক কম হয়েছে। অর্থাৎ প্রাচীন ও মধ্যবর্তী রাজ্যে মূর্তিগুলি ছিল বাস্তবের অনুকরণ ও সৃজনশীলতার সংমিশ্রণ। পরবর্তীকালের (নতুন রাজ্য) মূর্তিগুলি তাঁর কাছে মনে হয়েছে বড় বেশি সাজানো ও নিটোল। অর্থাৎ এসবের মধ্যে সৃজনশীলতার মাত্রা বেশি। তাঁর এই পর্যবেক্ষণ সঠিক হলেও অসম্পূর্ণ এজন্য যে জীবিত ও মৃতদের মূর্তিতে বাস্তবের প্রতিফলন হয়েছে ভিন্নভাবে, যার কারণ আগেই উল্লেখ করা হয়েছে। ধর্মবিশ্বাস মৃতদের মূর্তিতে বাস্তবের অনুকরণের প্রতি যেমন গুরুত্ব দিয়েছে, রাজকীয় ক্ষমতা কিংবা আভিজাত্যের গৌরব মূর্তি নির্মাণে আদর্শায়িত রূপের প্রতি একই প্রাধান্য দিয়েছে। কেবল রাজা আমেনহোটেপ, যিনি একেশ্বরবাদ প্রচলন করেন, তাঁর সময় তৈরি (তাঁর নির্দেশেও বটে) উৎকীর্ণ মূর্তিতে বাস্তবতার প্রতিফলন দেখা যায়। এই বৈশিষ্ট্য একমাত্র তাঁর রাজত্বের সময়েই ছিল, পরবর্তীতে আবার আগের রীতি-পদ্ধতি অনুযায়ী মূর্তি (প্রতিকৃতি) তৈরি হয়েছে, যার উল্লেখ করা হয়েছে আগেই। শেষ পর্বের ভাস্কর্য সম্বন্ধে অশোক মিত্রের যে নেতিবাচক মত বা বক্তব্য তা সম্পূর্ণ গ্রহণযোগ্য নয়। প্রাচীন শৈলীর প্রভাব মেনে নিলেও শেষ পর্যন্ত মিশরের ভাস্কর্য বাস্তবতা ও সৃজনশীলতার ব্যবহারে তার নিজস্বতা অক্ষুণœ রাখে।
স্থাপত্যের তুলনায় চিত্রকলায় প্রাচীন মিশরের শিল্পীদের নৈপুণ্য দেখা যায় আরো বেশি মাত্রায়। গমব্রিখ এই জন্য প্রাচীন মিশরের চিত্রকলাকে আধুনিক চিত্রকলার সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত বলে মনে করেছেন (গমব্রিখ, প্রাগুক্ত)। যদিও তাঁর এ বক্তব্যে প্যালিওলিথিক যুগের গুহাবাসী মানুষের তৈরি দেয়ালচিত্রের প্রতি অস্বীকৃতি প্রচ্ছন্ন কিন্তু মিশরের চিত্রকলার সমৃদ্ধ ঐতিহ্য এবং তার অভিনবত্বে মুগ্ধ হয়ে তিনি উচ্ছ্বসিত হলে সমালোচনার কিছু নেই।
মিশরের চিত্রকলায় ‘ফ্রন্টালিটি’ রীতি ও পদ্ধতির ব্যবহার করা হয়েছে সবচেয়ে বেশি এবং সর্বত্র। ভাস্কর্যে এই রীতির ব্যবহার হয়েছে কেবল রিলিফ বা খোদাই করা মূর্তির ক্ষেত্রে। ফ্রন্টালিটি পদ্ধতি ব্যবহার করে মিশরের চিত্রশিল্পী পারসপেক্টিভের সমস্যার সমাধান করতে চেয়েছে। একই সঙ্গে দেহের যেসব অংশ গুরুত্বপূর্ণ – চোখ, বুক, পায়ের ভেতরের দিক, পশ্চাৎদেশ এইসব প্রোফাইলে না দেখিয়ে সামনাসামনি দেখার উপায় তারা বের করেছে। শিল্পকর্মে, বিশেষ করে চিত্রকলায় এটি অভিনব এক পদ্ধতি, যা দক্ষ এবং অভিজ্ঞ শিল্পীর মস্তিষ্কপ্রসূত উদ্ভাবন ছাড়া অন্য কিছু দ্বারা ব্যাখ্যা করা যায় না।
ফ্রন্টালিটির নীতি ও পদ্ধতি স্টাইলাইজড শৈলীর সৃষ্টি করলেও ডিটেইলসের ব্যবহারে, রঙের বিন্যাসে এবং কম্পোজিশনে দূরত্ব ঘুচিয়ে দিয়ে (নিচ থেকে ওপরে দূরত্ব অনুযায়ী দৃশ্য সাজিয়ে) মিশরের চিত্রকলা বাস্তবের অনুকরণে বিকল্প পদ্ধতির সাহায্য নিয়েছে। বাস্তবের স্বার্থেই স্টাইলাইজেশনের ব্যবহার করা হয়েছে। ফ্রন্টালিটির মতো রীতি ও পদ্ধতির উদ্ভাবন করা হয়েছে একই উদ্দেশ্যে।
ফারাওয়ের প্রাসাদ, পুরোহিত ও অভিজাত শ্রেণির বাসভবনে দেয়ালে চিত্র আঁকা হলেও সেসব ধ্বংসপ্রাপ্ত হওয়ায় আবিষ্কৃত হয়নি। মিশরের চিত্রকলার প্রায় সব নিদর্শনই পিরামিডের অভ্যন্তরে দেয়ালচিত্রে দেখা যায়। আবহাওয়া এবং জনসমাগম থেকে মুক্ত থাকার জন্য এসব সংরক্ষিত হয়েছে কোনো অবনতি বা ক্ষতি ছাড়াই। পিরামিড মৃতের পরলোক জীবনের জন্য তৈরি হলেও তার দেয়ালে যেসব চিত্র আঁকা হয়েছে সেখানে বিধৃত ইহকালের জীবনের বিভিন্ন দৃশ্য। মৃত ব্যক্তি তার জীবদ্দশায় যেসব কাজ করত, তার যে পারিবারিক ও কর্মজীবন ছিল এবং বিনোদনের জন্য সে পরিবারসহ কর্মচারীদের নিয়ে পশু কিংবা মৎস্য শিকারের মতো যেসব ক্রিয়ায় লিপ্ত হতো সেসবের দৃশ্য প্রতিফলিত হয়েছে দেয়ালচিত্রে। এদিক দিয়ে দেয়ালচিত্রের দৃশ্য বাস্তবানুগ, যদিও তার উপস্থাপনায় সৃজনশীলতার ব্যবহার করা হয়েছে। ফ্রন্টালিটির সূত্রের ব্যবহার ছাড়াও দেয়ালচিত্রের আর একটি প্রধান বৈশিষ্ট্য হাইরোগ্লিফিক বা মিশরীয় বর্ণমালার ব্যবহার, যার দ্বারা দেয়ালে বিভিন্ন দৃশ্যের সম্পর্কে মন্তব্য করে বা বক্তব্য রেখে ব্যাখ্যা দেওয়ার ভঙ্গিতে বর্ণনা করা হয়েছে। চিত্রকলার ইতিহাসে এই প্রথম ভিস্যুয়াল দৃশ্যকল্পের সঙ্গে বর্ণমালার ব্যবহার দেখা যায়। লিখিত বর্ণনা চিত্রকলায় দৃশ্যকল্পের সম্পূরক হয়েছে। বর্ণমালার বিশেষ রূপের (ফর্ম) জন্য এর ব্যবহার অলংকরণেরও কাজ করেছে বলা যায়।
গমব্রিখ মিশরের দেয়ালচিত্র সম্বন্ধে বলেছেন, শিল্পীরা এখানে বাস্তবের প্রতিফলনে যে রীতি অনুসরণ করেছে তা বর্তমান কালের তুলনায় এতই পৃথক যে দেখে বিভ্রান্ত হতে হয় (গমব্রিখ, প্রাগুক্ত)। এই উক্তি তিনি নেতিবাচক অর্থে করেননি, প্রশংসার জন্যই করেছেন। তিনি দেয়ালচিত্র দেখার পর এই সিদ্ধান্তে এসেছেন যে, শিল্পীদের উদ্দেশ্য ছিল সৌন্দর্য সৃষ্টি নয়, পূর্ণতা সৃষ্টির জন্য বাস্তবের অনুকরণ। একটি নির্দিষ্ট দৃষ্টিকোণ থেকে কোনো দৃশ্যের যে অংশ দেখা যায় তার প্রতিফলন নয়, বাস্তবে যা যা আছে সেই দৃশ্যের অভ্যন্তরে তা একটি দৃষ্টিকোণ থেকে শিল্পীর দৃষ্টিগোচরে আসুক বা না আসুক, দেয়ালচিত্রে সবকিছু অন্তর্ভুক্ত করার ছিল তার উদ্দেশ্য। এর জন্য শিল্পীকে কল্পনা করতে হয়েছে যে সে দৃশ্যটিকে বিভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে দেখছে এবং তার সার্বিক রূপ উপলব্ধি করতে পারছে। কল্পনা করছে কিন্তু প্রকৃতপক্ষে তাকে নির্ভর করতে হচ্ছে স্মৃতির ওপর, বিভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে একটি দৃশ্যকে দেখার স্মৃতি। এভাবে বাস্তবের পুরনো অভিজ্ঞতা স্মৃতির আকারে দেখা দিয়ে চিত্রকলায় প্রতিফলিত হয়েছে। এই পদ্ধতির সঙ্গে তুলনা করা যায় ম্যাপ প্রস্তুতকারকের কাজের। কোনো স্থানের কন্টুরসহ (ভূ-প্রকৃতি) ম্যাপ আঁকতে গিয়ে এমন পদ্ধতিই ব্যবহার করা হয়। এই পদ্ধতির দৃষ্টান্ত হিসেবে গমব্রিখ উল্লেখ করেছেন থিবসের এক সমাধিসৌধের ভেতরে ‘নেবানুনের উদ্যান’ (১৪১০ খ্রিষ্টপূর্ব অব্দ) শীর্ষক দেয়ালচিত্রের। শিল্পী এখানে উদ্যানের মধ্যবর্তী পুকুরকে এঁকেছে এমনভাবে যে মনে হয় ওপর থেকে দেখা। কিন্তু পুকুরে ভাসতে থাকা হাঁস, ভেতরে মাছ, ভেতর থেকে ওপরে উঠে আসা জলজ উদ্ভিদ ইত্যাদি আঁকা হয়েছে এমনভাবে, যেন সামনে থেকে দেখা। পুকুরের তিনদিকে দাঁড়ানো ডালপালা আঁকা হয়েছে আনুভূমিক ভঙ্গিতে এবং একপাশে কাত করে রেখে। এইভাবে পুকুর, তার ভেতরকার এবং পার্শ্ববর্তী দৃশ্য একসঙ্গে দেখাতে চেয়েছে শিল্পী, যেন ছবিটি পূর্ণতা পায়। একজন ম্যাপমেকার এই পদ্ধতিতে কাজ করে থাকে। ম্যাপ তৈরির কৌশল জানা না থাকলেও মিশরের শিল্পী ব্যবহার করেছে কার্টোগ্রাফিক পদ্ধতি। সৌন্দর্যসৃষ্টি তার উদ্দেশ্য ছিল না, কিন্তু শিল্পনৈপুণ্যে সেটিও নিশ্চিত হয়ে গিয়েছে। বাস্তবে যেভাবে একটি দৃশ্য আংশিকভাবে দেখা যায় সেভাবে না দেখিয়ে শিল্পী দেখিয়েছে পূর্ণাঙ্গভাবে। এজন্য ছবিটি অবাস্তব হয়েও বাস্তব। বাস্তবের অনুকরণের সঙ্গে এখানে মিশেছে স্মৃতিনির্ভর সৃজনশীলতা।
মিশরের চিত্রশিল্পীরা দেয়ালচিত্রে একই পদ্ধতির ব্যবহার করেনি একমাত্র ফ্রন্টালিটির সূত্র ছাড়া। এই সূত্র কেবল মানবদেহের ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য। চিত্রে অন্যান্য যে বিষয় – গাছপালা, ফুল, মাছ, প্রাণী এবং দৈনন্দিন জীবনের বিভিন্ন কর্মকা- – এইসবের প্রতিফলনে কম্পোজিশন সাহায্য করেছে। ফ্রন্টালিটির চেয়েও বেশি গুরুত্বপূর্ণ হয়েছে কম্পোজিশনের ব্যবহার। এক্ষেত্রে মিশরীয় শিল্পীদের নৈপুণ্য বিস্ময়কর।
মধ্যরাজ্যের খুনুমহোটেপ নামে এক উচ্চপদস্থ রাজকর্মচারীর সমাধির দেয়ালচিত্রে (খ্রি.পূ. ১৯০০ অব্দ) তাকে দেখানো হয়েছে স্ত্রী, পুত্র, রক্ষিতা, প্রহরী এবং পরিচালকসহ জেলেদের নিয়ে নৌকায় মাছ ও পাখি ধরার দৃশ্যে। ছবিটি ওপরে নিচে তিন অংশে বিভক্ত। মাঝখানে দরজার দুই পার্শ্বে ও ওপরে হাইরোগ্লিফিকে তার জীবন সম্বন্ধে বিশেষ করে তিনি দিনে কখন কী খাবেন সেই বর্ণনা করা হয়েছে। মৃতদেহের জন্য আঁকা বলেই তার খাদ্যাভ্যাস সম্বন্ধে এই বর্ণনা। ছবিতে রাজকর্মচারী এবং তার স্ত্রীর মুখ আঁকতে গিয়ে ফ্রন্টালিটির ব্যবহার করা হলেও প্রহরী ও জেলেদের ক্ষেত্রে করা হয় নি, কেননা নিম্নশ্রেণির মানুষদের প্রতিকৃতি প্রোফাইলে দেখানোই নিয়ম ছিল। ফ্রন্টালিটি ছিল ফারাও, রানি, রাজপরিবারের সদস্য এবং অভিজাত শ্রেণির চিত্র আঁকার জন্য নির্দিষ্ট। শ্রেণিভেদে ফিগারের চিত্রকলার (ভাস্কর্যেও) পদ্ধতিতে তারতম্য করেছিল মিশর সভ্যতা। কিন্তু উদ্দেশ্য ভিন্ন হলেও এই পদ্ধতি পরবর্তী চিহ্নিত হয়েছে অভিনব শিল্পনৈপুণ্য হিসেবে। দেয়ালচিত্রটিতে আরো যা লক্ষণীয় তা হলো, জেলেদের মাথার ওপরে পানির উচ্চতা, যেন তারা নিমজ্জিত অবস্থায় মাছ ধরছে। আসলে মায়া সৃষ্টি করে শিল্পী জেলেদের মাছ শিকারের দৃশ্য এঁকেছে। একইভাবে খুনুমহোটেপের বুকের সমান উচ্চতায় দেখানো হয়েছে বর্শাবিদ্ধ দুটি মাছ। পানির উচ্চতা এখানে আরো ওপরে উঠে মাছ দুটিকে পানির ভেতর দেখিয়েছে। শিল্পী বাস্তব অবস্থা দেখাতে গিয়ে সৃজনশীলভাবে পানি ইত্যাদির অবস্থানে পরিবর্তন এনেছে, যা প্রকৃতপক্ষে বাস্তবের বিপরীত। দেয়ালচিত্রের মাঝখানে দেখানো হয়েছে সমাধির প্রধান দরোজা, তার দুই পাশে উপবিষ্ট দুই প্রহরী। জলাশয়ে শিকারের সঙ্গে সমাধির অভ্যন্তরের এই দৃশ্য সংযোজন অবাস্তব হলেও এবং একই দৃষ্টিকোণ থেকে দেখা না গেলেও একটি সামগ্রিক দৃশ্যের উপস্থাপনা হয়েছে, যাকে গমব্রিখ বলেছেন ‘পূর্ণতা’। রাজকর্মচারীর মাছ শিকারের দৃশ্য দেখাতে গিয়ে বিভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে দেখা দৃশ্যাবলির এক মোজাইক সৃষ্টি করা হয়েছে। গমব্রিখ যদিও বলেছেন, সৌন্দর্য সৃষ্টি নয়, পূর্ণতা নিশ্চিতকরণ ছিল শিল্পীর উদ্দেশ্য, প্রকৃতপক্ষে সৌন্দর্যও সৃষ্টি হয়েছে এই ছবিতে। বাস্তবতাকে ভেঙেচুরে সৃজনশীলতার সাহায্যে প্রতিফলিত করা হয়েছে বাস্তবকে দেয়ালচিত্রে এমনভাবে যে রাজকর্মচারীর জীবনে অভিজ্ঞতা পারিপার্শ্বসহ দর্শকের সামনে উপস্থিত। বাস্তবই ছবিটির বিষয় ও উদ্দেশ্য, যদিও উপস্থাপনে বাস্তবতাকে ম্যানিপুলেট করা হয়েছে। গমব্রিখ বলেছেন, এ ধরনের ছবি দেখে তার অবাস্তবতা নিয়ে আমরা ভাবি না, অবাক হই ছবিতে ডিটেইলসের ব্যবহার দেখে এবং প্রাসঙ্গিকতার ভিত্তিতে বিভিন্ন দৃশ্যের সমন্বিত উপস্থাপনায়।
মিশরীয় শিল্পীদের বিভিন্ন দৃষ্টিকোণ সমন্বিত করে একটি পূর্ণাঙ্গ ছবি আঁকার আরো একটি নিদর্শন হিসেবে উল্লেখ করা যায় প্রথম রাজ্যের সময়ে আঁকা (খ্রি.পূ. ২১০০) ভা-ারে শস্য নেওয়ার দৃশ্য। এই ম্যুরাল গ্যাবেলেইন নামক স্থানে ইটির সমাধির দেয়ালে আবিষ্কৃত হয়। ছবিটিতে ওপরে নিচে দুটি স্তর লেভেল রয়েছে, ওপরের স্তরে দূরে অবস্থিত গরু মাঠে চরছে আর নিচের স্তরে দেখানো হয়েছে শস্যের বোঝা মাথায় নিয়ে সিঁড়ি দিয়ে ওপরে উঠছে তিনজন শ্রমিক, তাদের পেছনে ভারবাহী গরু শস্য টেনে নিয়ে যাচ্ছে এবং তার পেছনে আরো একজন শ্রমিককে দেখা যাচ্ছে শস্য নিয়ে যেতে। বাঁদিকে উল্লম্ব রেখা ব্যবহার করে স্পেসের ভেতর গভীরতা সৃষ্টি করা হয়েছে, যা পারসপেক্টিভের বিকল্প হিসেবে কাজ করছে। মানুষগুলির দেহ ও ভঙ্গি এবং ওপরের স্তরে গরুগুলির অবস্থান খুবই বাস্তবসম্মত, যদিও ওপর নিচে, দুই স্তরে নিকট ও দূরের দৃশ্য একই সমতলে দেখানোর মধ্যে অবাস্তবতা রয়েছে। এই পদ্ধতিতে বাস্তবতার অনুকরণ ও সৃজনশীলতার ব্যবহার, দুই-ই দেখা যায় যা মিশরের শিল্পকলার বৈশিষ্ট্য হিসেবে চিহ্নিত। উল্লেখ্য যে, সাধারণ শ্রেণি হওয়ার জন্য শ্রমিকদের শরীর ও মুখ আঁকার সময় ফ্রন্টালিটির ব্যবহার করা হয়নি। পূর্বে বর্ণিত ছবির জেলেদের মতো তাদেরকে প্রোফাইলেই দেখানো হয়েছে। বিশেষ করে তাদের চোখ। ছবিটির আর একটি উল্লেখযোগ্য দিক হলো ছকের সাহায্যে আঁকা হলেও দৃশ্যের মধ্যে গতিশীলতার পরিচয় পাওয়া যায়। এই বৈশিষ্ট্য মিশরের ভাস্কর্যে তেমন পরিলক্ষিত হয় না।
সেনেফারের সমাধির ভেতরকার দেয়ালে ও ছাদে আঁকা ছবিতে (খ্রি.পূ. ১৪৩০) একটি ব্যতিক্রমী দৃশ্য দেখা যায়। এই চিত্রটি আঙ্গিকের দিক দিয়ে বেশ অগ্রগামী। এখানে শুধু ঘরের সিলিংয়ে আঙুরগাছের লতাপাতা এঁকে অলংকৃত করা হয়নি, সামনে পেছনে দুটি ভিন্ন দৃশ্য এঁকে মাঝখানে সচিত্র দেয়াল দিয়ে বিভক্ত করে পারসপেক্টিভের ব্যবহার করা হয়েছে। দূরত্ব বোঝানোর জন্য কাছে এবং দূরের দৃশ্য ওপরে আর নিচে আঁকা হয় নি। নিঃসন্দেহে মিশরের চিত্রকলা তৈরিতে এটি অগ্রগতির লক্ষণ। প্রকৃতপক্ষে এই ছবিতে তিনটি ভিন্ন দৃশ্য রয়েছে, যা পরস্পর বিচ্ছিন্ন হলেও সম্পর্কযুক্ত, কেননা ফিগারগুলি একই কর্মকা-ে অংশ নিচ্ছে নিজ নিজ ভূমিকায় থেকে। দেহের ও মুখের প্রতিকৃতিতে, বসা ও দাঁড়াবার ভঙ্গিতে এবং মুখের অভিব্যক্তিতে ছবিটি বাস্তবের অনুকরণই করেছে বেশি, যদিও সৃজনশীলতাও তার ভূমিকা রেখেছে। এই ছবিতেও স্পেসের কোনো অংশ শূন্য রাখা হয় নি, রং ও রেখায় ছবিটি পরিপূর্ণ।
‘আকাসিয়া গাছে পাখি’ শীর্ষক ছবিতে (খ্রি.পূ. ১৯০০) খুনুমহোটেপের পাখি শিকারের একটি দৃশ্য দেখানো হয়েছে। এটি তার পূর্বে উল্লিখিত শিকার দৃশ্যের অংশ। বিষয় সম্বন্ধে ব্যাখ্যা বা বর্ণনা দিলেও ছবিটি এমন স্বয়ংব্যাখ্যিক যে, শুধু এর পূর্ণাঙ্গতাই মনোযোগ আকর্ষণ করে। রেখায় রঙের ব্যবহারে এবং কম্পোজিশনে ছবিটি এতই নিখুঁত ও পরিপাটি করে সাজানো যে, না বলা হলে আধুনিক শিল্পীর কাজ বলেই মনে করবে দর্শক। গমব্রিখ এই ছবিটি সম্বন্ধে বলেছেন, কেবল জ্ঞান বা অভিজ্ঞতা নয়, প্যাটার্ন আবিষ্কারের দৃষ্টিক্ষমতার অধিকারী হওয়ার জন্যই শিল্পী এমন ছবি আঁকতে পেরেছেন। এইসব ছবি দেখেই গমব্রিখ তাঁর বইয়ের প্রথমেই মন্তব্য করেছেন যে, পাশ্চাত্যের শিল্প ঐতিহ্যের সঙ্গে সম্পর্ক রয়েছে প্রাচীন মিশরের শিল্পকলার (গমব্রিখ, প্রাগুক্ত)। অর্থাৎ তিনি প্রাচীন মিশরের শিল্পকলাকে আধুনিক শিল্পের পথিকৃৎ মনে করেছেন।
আর্নল্ড হাউজারের মতে, প্রাচীন মিশরের শিল্পে নিওলিথিক যুগের স্টাইলাইজড শৈলীর প্রভাব ছিল। এজন্য তারা বাস্তবের হুবহু অনুকরণ করেনি (আর্নল্ড হাউজার : দি সোশ্যাল হিস্ট্রি অফ আর্ট, ১৯৫৭)। কিন্তু নিওলিথিক যুগের কোনো দেয়ালচিত্রের নিদর্শন পাওয়া যায়নি, কেননা তারা হয় মাটির কিংবা বাঁশের বেড়ার ঘরে বাস করত। নিদর্শনের অভাবে হাউজারের এই মতের পক্ষে কিংবা বিপক্ষে কিছু বলার উপায় নেই। অবশ্য নিওলিথিক যুগে গ্রামবাসী কারুশিল্পীদের তৈরি মৃৎপাত্রের গায়ে জ্যামিতিক নকশা দেখতে পাওয়া গিয়েছে। এখানে বাস্তবের অনুকরণ নেই কিন্তু এসব অলংকরণকে চিত্রকলা না বলে নকশাই বলতে হয়। প্রাগৈতিহাসিক চিত্রকলার নিদর্শনের জন্য আমাদের যেতে হয় আরো আগে, প্যালিওলিথিক যুগে, যখন পশুশিকারি মানুষ গুহার দেয়ালে শিকারের রঙিন ছবি এঁকেছে। সেইসব ছবি ছিল স্টাইলাইজড এবং বাস্তবের সংমিশ্রণ। হাউজারের বক্তব্য মেনে নিলে বলতে হয় যে নিওলিথিক নয়, প্যালিওলিথিক যুগের শিল্প ঐতিহ্য মিশরের শিল্পীদের ওপর প্রভাব ফেলেছে। কিন্তু মিশরের শিল্পীরা গুহাচিত্র দেখেছে বলে মনে হয় না, সুতরাং স্টাইলাইজেশন মানুষের মধ্যে যারা শিল্পী তাদের অনুকরণ প্রবৃত্তির মতোই একটি সহজাত প্রবৃত্তি বলা ছাড়া উপায় থাকে না। আর একটি ব্যাখ্যা হতে পারে যে, প্যালিওলিথিক যুগের শিল্পীরা নিওলিথিক যুগে তাদের শিল্প ঐতিহ্য পরিচিতি করায় বংশপরম্পরায় যদিও আগের মতো তার চর্চা হয়নি কৃষিজীবী মানুষের ব্যবহারিক জীবনে। বংশপরম্পরার সূত্র ধরে নিওলিথিক যুগ থেকে প্যালিওলিথিক যুগের স্টাইলাইজেশন শৈলী প্রাচীন মিশরের শিল্পীদের অবগতিতে এসেছে, এই উপসংহারেও আসা যায়।
প্রাচীন মিশরের চিত্রকলার বিশ্লেষণে হাউজারের সবচেয়ে বড় অবদান ‘ফ্রন্টালিটি’ সূত্রের ব্যাখ্যা প্রদান। এই সূত্র অবশ্য তিনি নিজে আবিষ্কার করেননি। এই প্রসঙ্গে তিনি উল্লেখ করেছেন জার্মান দুই প্রতœতাত্ত্বিকের, জুলিয়াস ল্যাঙ্গে ও এডলফ এরম্যান, যাঁরা প্রথম এই সূত্রটি আবিষ্কার করেন। এই দুই প্রতœতাত্ত্বিক মিশরের চিত্রকলায় (এবং রিলিফ ভাস্কর্যে) ফ্রন্টালিটির ব্যবহার ব্যাখ্যা করতে গিয়ে বলেছেন যে, মিশরের শিল্পীরা ছবিতে ফিগারের মুখ প্রোফাইলে দেখালেও চোখ এবং বুকের সমুখভাগ পুরোপুরি দেখিয়ে আঁকত, যেন দর্শকের মনে হয় তারা সামনাসামনি থেকে দেখছে। এই সামনাসামনি দেখার মধ্যে পায়ের গোড়ালি, পায়ের ভেতরের অংশও অন্তর্ভুক্ত ছিল। এই পদ্ধতি ফারাও ও অভিজাত শ্রেণির মধ্যে ব্যবহার করা হতো, সাধারণ শ্রেণির মানুষের ছবিতে তাদের দেহের সবকিছু দেখানো হতো প্রোফাইলে। এই স্টাইলাইজেশন, যার জন্য ব্যবহৃত হয়েছে ফ্রন্টালিটির সূত্র এ কি শুধুই শ্রেণি-পার্থক্য বোঝানোর জন্য না অন্য কোনো উদ্দেশ্যে, এর উত্তর হাউজার কিংবা জার্মান দুই প্রতœতাত্ত্বিক দেননি। যেহেতু শিল্পীরা নিজের ইচ্ছায় কিংবা শখ করে নয়, উচ্চতর কর্তৃপক্ষের এবং তাদের মনিবদের নির্দেশে ছবি এঁকেছে সেজন্য মনে করা যেতে পারে যে, শ্রেণি-পার্থক্য নির্দিষ্ট করার উদ্দেশ্যেই এই আঙ্গিকের বা সূত্রের উদ্ভাবন। সমকালীন উদ্দেশ্য যাই হোক না কেন, শিল্পীরা ফ্রন্টালিটির সূত্র আবিষ্কার ও ব্যবহার করে শিল্পচর্চায় একটি উল্লেখযোগ্য আঙ্গিকের সংযোজন করেছেন।
প্রাচীন মিশরের চিত্রকলা (এবং উৎকীর্ণ ভাস্কর্য) সম্বন্ধে দ্বিতীয় যে প্রশ্ন উত্তরের অপেক্ষায় রয়েছে তা হলো সব ছবিতেই উপবিষ্ট হোক কিংবা দ-ায়মান, ফিগারগুলি কেন প্রোফাইলের ভঙ্গিতে আঁকা হয়েছে? ফারাও ও অভিজাতদের চেতানো বুক এবং সামনাসামনি চোখ ও পায়ের গোড়ালি আঁকা হলেও ফিগারের মূল ভঙ্গি আঁকা হয়েছে প্রোফাইলেই। এমন নয় যে মিশরের শিল্পীরা বিষয়ের পুরো শরীরই সামনাসামনি করে এঁকে দেখতে পারত না। তাহলে প্রোফাইলের প্রতি এই অনুরক্তি বা আকর্ষণ কেন? একটা ব্যাখ্যা হতে পারে প্রাচীন মিশরের প্রায় ছবিতেই ফিগারগুলিকে গতিশীল অবস্থায় দেখানো হয়েছে অথবা পরস্পরের সঙ্গে সংলাপরত। এজন্য প্রোফাইলের ভঙ্গি উপযুক্ত মনে হয়েছে। এটা মেনে নিলেও প্রশ্ন থাকে যে, উপবিষ্ট অবস্থায় ফিগারকে প্রোফাইলে দেখানোর প্রয়োজন হয়েছে কেন? ভাস্কর্যে এই প্রয়োজন দেখা দেয়নি, যার জন্য অনেক ভাস্কর্যের ফিগার দ-ায়মান বা উপবিষ্ট যাই হোক না কেন, তাদেরকে শুধু সামনাসামনি নয়, চারিদিক থেকেই দেখা যায়। অবশ্য খোদাই করা ভাস্কর্যে প্রোফাইলের ব্যবহার করা হয়েছে। চিত্রকলায় ফিগারকে প্রোফাইলে দেখানো বিষয়টি রহস্যাবৃতই থেকে যায়। শেষ পর্যন্ত গতিশীলতা সৃষ্টিতে এবং সংলাপরত ভঙ্গি দেখাতে সহায়ক বলেই প্রোফাইলের ব্যবহার করেছে মিশরের চিত্রশিল্পীরা, এই উপসংহারে আসতে হয়।
গমব্রিখ প্রাচীন মিশরের স্থাপত্য, ভাস্কর্য এবং চিত্রকলা সম্বন্ধে বলতে গিয়ে মন্তব্য করেছেন যে, এইসব শিল্পকর্ম যেন একই নিয়ম বা নির্দেশিকা অনুসরণ করেছে যার ভিত্তিতে গড়ে উঠেছে শৈলী। এই শৈলী কী, তার ব্যাখ্যা দেওয়া কঠিন বলে তিনি মন্তব্য করার পর যোগ করেছেন সকল মিশরীয় শিল্পকে যে নিয়ম বা অনুশাসন নিয়ন্ত্রিত করেছে তার ভিত্তিতে প্রতিটি শিল্পকর্মে উদ্ভাসিত হয়েছে দুটি বৈশিষ্ট্য : [ক] সুষমাম-িত ভঙ্গি এবং [খ] বাহুল্যবর্জিত সমন্বিত রূপ। প্রাচীন মিশরের চিত্রকলা ব্যাখ্যায় ও উপভোগে অন্যান্য মতামতের সঙ্গে এই দুটি বিষয়ও গ্রহণ করা যেতে পারে। কিন্তু এর পাশাপাশি মনে রাখতে হবে আর এক শিল্প ঐতিহাসিকের মন্তব্য যে, মিশরীয় চিত্রকলায় যা দৃশ্যমান তা স্বয়ংব্যাখ্যিক নয় সব ক্ষেত্রে। দৃশ্যে যে ঘটনা বিবৃত হচ্ছে বলে মনে হয়, তার পেছনে থাকতে পারে নিগূঢ় কোনো রহস্য অথবা কঠিন সত্য (ইয়ান জাজেক, দি ইলাসট্রেটেড স্টোরি অফ আর্ট, ২০১৩)। মিশরের শিল্প ধর্মের প্রণোদনায় ও প্রয়োজনে তৈরি হয়েছিল বলে এই দার্শনিক/আধ্যাত্মিক ব্যাখ্যাও মনে রাখা প্রয়োজন।
মেসোপটেমিয়া
খ্রিষ্টপূর্ব ৫০০০ অব্দে টাইগ্রিস ও ইউফ্রেতিস নদীর মধ্যবর্তী অঞ্চলে একটি সভ্যতা গড়ে ওঠে। এটি মিশরের সভ্যতার সমকালীন ছিল কিন্তু তার মতো দীর্ঘস্থায়ী কিংবা উন্নত ছিল না। সুমেরিয়া, আক্কাদিয়া, ব্যাবিলন এবং ক্যালডিও সভ্যতার সমন্বয়ে গড়ে ওঠে মেসোপটেমীয় সভ্যতা। মেসোপটেমিয়ার নিম্নাঞ্চলে খ্রিষ্টপূর্ব ৪০০০ অব্দের শেষদিকে কয়েকটি নগর গড়ে ওঠে। এর মধ্যে ছিল উর, ইউরুখ, লাগাসা, উম্মা ইত্যাদি নামের জনপদ। মিশরের সভ্যতার ভিত্তি ছিল কৃষি উৎপাদন। তুলনায় মেসোপটেমিয়ার সমৃদ্ধির পেছনে ছিল ব্যবসা ও বাণিজ্য, শিল্প এবং অর্থনৈতিক লেনদেনের কার্যক্রম। বিভিন্ন জাতিসত্তার সমন্বয়ে গঠিত মেসোপটেমিয়া সভ্যতায় বিভিন্ন অঞ্চলের জনগণের চিন্তা, দর্শন, রাষ্ট্র পরিচালনা, প্রশাসন এবং ধর্মীয় বিশ্বাসে বেশ পার্থক্য ছিল। প্রতিবেশী রাষ্ট্রের আক্রমণের ফলে প্রতিআক্রমণের যে ধারাবাহিকতা দেখা দেয় তার জন্য প্রশাসন ছিল কঠোর এবং রাষ্ট্রের নিয়ন্ত্রণ ব্যাপক। জ্ঞান-বিজ্ঞানের চর্চায় মেসোপটেমিয়া সভ্যতার মানুষ ছিল তুলনামূলকভাবে অনগ্রসর যদিও রাষ্ট্র আইন প্রণয়নে ও আইনের শাসন প্রতিষ্ঠায় সফলতা অর্জন করে। মিশরের সভ্যতার সঙ্গে মেসোপটেমিয়া সভ্যতার সবচেয়ে বড় পার্থক্য ছিল ধর্মবিশ্বাসে। মিশরের জনগণের এবং রাজশক্তির পরকালে বিশ্বাসভিত্তিক ধর্মের স্থানে মেসোপটেমিয়ায় পালিত ধর্মে ইহকালের জীবনযাপনই ছিল প্রধান। চিত্রকলার দৃৃষ্টিকোণ থেকে ধর্ম মেসোপটেমিয়ায় কোনো ভূমিকা পালন করেনি তবে স্থাপত্যে এবং ভাস্কর্যে রাষ্ট্রের ভূমিকা ছিল প্রধান। মেসোপটেমিয়া সভ্যতায় চিত্রকলার চর্চা প্রায় ছিলই না।
মেসোপটেমিয়ায় মিশরের মতো পাথর ছিল না, যার জন্য বিপুল সংখ্যায় ভাস্কর্য তৈরি হয়নি। কিন্তু গমব্রিখের মতে, মেসোপটেমিয়ায় পরলোকে বিশ্বাস না থাকার জন্য মূর্তি ও দেয়ালচিত্র তৈরি জনপ্রিয় ছিল না। রাজাদের সমাধিতে তাদের গৃহস্থালির ব্যবহৃত সমস্ত বস্তু রাখা হতো এবং সেইসঙ্গে কয়েকজন জীবিত দাস। উর-এ একটি সমাধিতে বাদ্যযন্ত্রের গায়ে মানুষ ও জীবজন্তুর নিখুঁত ছবি আঁকা দেখতে পাওয়া যায় কিন্তু এর পেছনে কোনো ধর্মীয় উদ্দেশ্য ছিল না। অলংকরণের জন্য ছোট আকারের এই চিত্রকলার নিদর্শন দেখে শিল্পচর্চা সীমিত হলেও যে ছিল তার প্রমাণ পাওয়া যায়। বাদ্যযন্ত্রের ছবিতে বাস্তবের অনুসরণ ছিল অলংকরণের চেয়ে বেশি। ছবিটির অন্য বৈশিষ্ট্য ছিল সামঞ্জস্যময়তা এবং সূক্ষ্মতা। সমাধির দেয়ালে চিত্র কিংবা ভেতরে মূর্তি নির্মাণ করে স্থাপন করার রীতি না থাকলেও শিল্পীদের, বিশেষ করে ভাস্কর্যদের রাজাদের গৌরব সংরক্ষণ ও প্রচারের জন্য স্মৃতিসৌধে মূর্তি খোদাই করতে হয়েছে। যুদ্ধে বিজয়ের পর রাজারা ভাস্করদের স্মৃতিসৌধ নির্মাণ করে তার গায়ে যুদ্ধের দৃশ্য এবং বিজয়ীবেশে রাজাকে দেখানোর নির্দেশ দিতেন। এইসব ভাস্কর্য ছিল পাথরের উঁচু স্তম্ভে অর্ধ উৎকীর্ণ। যুদ্ধ জয়ের দৃশ্য নিয়ে স্মৃতিসৌধে ভাস্কর্য তৈরি করে পরাজিত জাতিকে তাদের ওপর বিজয়ী রাজার উচ্চতর ক্ষমতা ঘোষণা করা হতো যেন তাদের বংশধর কিংবা অন্য কোনো জাতি যুদ্ধের দুঃসাহস না দেখায়। ২২৭০ খ্রিষ্টপূর্ব অব্দে সুমায় প্রাপ্ত পাথরে উৎকীর্ণ ভাস্কর্যে রাজা নারাসসিমকে যুদ্ধে বিজয়ের পর শত্রুকে পদদলিত করে হত্যা করতে দেখা যায়। পরাজিতদের অনেককে দেখানো হয়েছে ক্ষমা প্রার্থনার ভঙ্গিতে। সম্ভবত পাথরের খ-টির আকারের জন্য রাজাসহ অন্য মূর্তিগুলি উৎকীর্ণ করা হয়েছে ওপর থেকে নিচে, সমান্তরালভাবে নয়। এতে করে পারসপেক্টিভের ধারণা পাওয়া যায় না, বরং বাস্তবের অনুকরণের সঙ্গে সৃজনশীলতার সংমিশ্রণ লক্ষ্য করা যায়।
পরবর্তী যেসব পাথরে উৎকীর্ণ ভাস্কর্য দেখা যায় সেখানে যুদ্ধের বিশদ দৃশ্য রয়েছে, কেবল বিজয়ের নয়। এর ফলে এসব ঐতিহাসিক দলিল হয়ে গিয়েছে। আসেরিয়ার রাজা দ্বিতীয় অসুর নাসিপালের সময়ে (খ্রিষ্টপূর্ব নবম শতাব্দী) একটি ভাস্কর্যে উৎকীর্ণ দৃশ্যে যুদ্ধ পরিচালনার বিভিন্ন দিক দেখানো হয়েছে। একটি দুর্গ অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে আক্রমণ করা হচ্ছে, শত্রুবাহিনী নিহত হয়ে ভূমিতে নিপতিত হচ্ছে এবং মিনারের ওপর এক রমণী শোকার্ত হয়ে কাঁদছে, এইসব দৃশ্য দেখানো হয়েছে। বাস্তবানুগ এই ভাস্কর্যে মিশরীয়দের পদ্ধতির আভাস পাওয়া যায় কিন্তু অতটা নিখুঁত বা রীতিবদ্ধ নয়। কুসংস্কারের জন্য নিহত এবং আহতদের মধ্যে আক্রমণকারী কোনো আসেরীয় সৈন্যকে দেখানো হয়নি, যা বাস্তবের ব্যত্যয়। রাজা এবং জাতির গৌরব ও ক্ষমতা প্রচার যেখানে প্রধান উদ্দেশ্য সেখানে এটাই স্বাভাবিক। খোদাই করা ভাস্কর্যের অন্য একটি বিষয় ছিল শিকারের দৃশ্য। আসেরিয়ার ভাস্কররা সবচেয়ে বেশি উৎকর্ষ দেখিয়েছে জন্তুর প্রতিকৃতি তৈরিতে। মিশরীয় ভাস্কর্যের তুলনায় এসব জন্তুর মূর্তি অনেক বেশি জীবন্ত এবং শক্তিশালী। যুদ্ধের দৃশ্যের মতো শিকারের দৃশ্যেও রাজা এবং তার অনুচরদের দেখানো হয়েছে পেশিবহুল শক্তিশালী হিসেবে। অশোক মিত্র বলেছেন, আসেরিয়ানরা হয়তো ভাবত সৌন্দর্য মানেই বিশাল পেশি। যাদের খুব শক্ত পেশি তারাই সুন্দর। তাদের এই সৌন্দর্যজ্ঞান কতটা নিজেদের চিন্তাপ্রসূত, কতটা কর্তৃপক্ষের নির্দেশে তা অবশ্য জানা যায়নি। তবে এই স্টাইলাইজেশন ভাস্কর্যে বাস্তবের হুবহু হতে দেয়নি। আসেরীয় শিল্পচর্চায় মিশরীয় এবং পারসীয় শিল্পের প্রভাব ছিল। চুনাপাথরে তৈরি আসেরীয় ভাস্কর্যগুলি কালো, সাদা, নীল, লাল, সবুজ রঙের ছিল। সম্রাট অসুর নাসিপালের সময়ের কয়েকটি রঙিন স্মৃতিস্তম্ভ পাওয়া গিয়েছে। এই সময়ের ভাস্কর্যের নিদর্শনের মধ্যে বিশাল সিংহের মূর্তি, ডানাযুক্ত মানুষের মাথাসহ বানরের মূর্তি এবং সম্রাটের দুটি মূর্তি পাওয়া গিয়েছে। সম্রাট পানসানেসেরের সমাধিফলক ও তার প্রাসাদ তোরণে ব্রোঞ্জের কারুকাজ, তৃতীয় তিগলাত গিনেজার ও দ্বিতীয় সারসনের সময়ে নির্মিত ডানাযুক্ত মানুষের মাথা ও ষাঁড়ের মূর্তি তাদের ভাস্কর্যে ও শিল্পে দক্ষতার পরিচয় দেয়। পশুপাখির ভাস্কর্য তৈরিতে আসেরীয়রা বিশেষ দক্ষতা অর্জন করে, এ কথা আগেই বলা হয়েছে। একটি খোদাই করা আসেরীয় ভাস্কর্যে রাজাকে অনুচরসহ ঘোড়ায় চরে তীর ছুড়তে দেখা যায়। এটা যুদ্ধের কিংবা শিকারের দৃশ্য হতে পারে। পাথরে খোদাই হলেও উড়ন্ত ঘোড়া এবং ফিগারের ভঙ্গির জন্য গতিশীলতার সৃষ্টি হয়েছে। এমন গতিশীলতা মিশরের ভাস্কর্যে দেখা যায় নি। আসেরীয় শিল্প খ্রিষ্টপূর্ব অষ্টম কি নবম শতাব্দীর সময় বাস্তবতার প্রতিফলনের প্রতি গুরুত্ব দেয়। অসুরবাণীপালের সময় যুদ্ধে এবং শিকারে জন্তুদের যে উৎকীর্ণ ফিগার সেগুলি প্রাণবন্ত এবং বাস্তবানুগ কিন্তু মানুষের ফিগার ২০০০ বছর আগের মতোই আড়ষ্ট এবং সাজ-সজ্জায় আনুষ্ঠানিক রূপে দেখানো হয়েছে। শৈলীর এই দ্বৈত বৈশিষ্ট্য আখেনাটোনের সময় মিশরে যেমন ছিল তেমনই মনে হয়। প্যালিওলিথিক যুগের দেয়ালচিত্রে মানুষ ও জন্তুর প্রতিকৃতিতেও একই বৈষম্য ছিল। অর্থাৎ পশুকে অনেক বেশি বাস্তবানুগ করে দেখানো হয়েছে এবং শিকারি মানুষকে স্টাইলাইজড রূপে দেখানো হয়েছে। হাউজার বলেছেন, প্যালিওলিথিক যুগে পশুর ছবি বাস্তবানুগ হয়েছে শিকারি মানুষ সবসময় তাদের নিয়েই চিন্তা-কল্পনা করত এবং অনুসরণে ব্যস্ত থাকত। পরবর্তীকালে যে একই প্রবণতা রয়ে যায় তার কারণ পশুকে স্টাইলাইজড রূপে দেখানোর উপযুক্ত মনে হয়নি শিল্পীর কাছে (আর্নল্ড হাউজার, প্রাগুক্ত)। এটা একটা ব্যাখ্যা বটে, তবে খুব সন্তোষজনক নয়। শিল্পে বিষয়বস্তুতে যা কিছু আছে সবই সমান গুরুত্বপূর্ণ এবং একইভাবে প্রতিফলিত করার ইচ্ছা থাকাই স্বাভাবিক। প্যালিওলিথিক যুগে পশুর ছবি আঁকা ছিল শিল্পীর প্রধান উদ্দিষ্ট, কেননা তা ম্যাজিক ক্ষমতা অর্জন করে শিকার করা যেত। সুতরাং তার সম্পূর্ণ অবয়ব সৃষ্টি শিল্পীর উদ্দেশ্য। পরবর্তীকালে শিকারের বস্তু নয় বলে ছবিতে পশুর প্রতিকৃতি গৌণ হয়ে যাবে, এটা কোনো যুক্তি হতে পারে না। এর পেছনে নিশ্চয়ই কর্তৃপক্ষের নির্দেশনা ভূমিকা পালন করেছে।
খ্রিষ্টপূর্ব ৬১২ অব্দের মধ্যে আসেরীয় রাজ্য ধ্বংসপ্রাপ্ত হয়। তার স্থানে প্রতিষ্ঠিত হয় চারটি রাজ্য। ক্যালডীয় সভ্যতা এদের একটি। ব্যাবিলনকে কেন্দ্র করে এর উত্থান হয় বলে একে ব্যাবিলনীয় সভ্যতাও বলা হয়। সম্রাট নেবুচাদনেজার খ্রিষ্টপূর্ব ৬৬৪ অব্দে ক্ষমতায় আসীন হন। তার সময়ে চিত্রশিল্পের কিছুটা বিকাশ ঘটে ব্যাবিলনে। মুখ্যত পশুচিত্র অঙ্কনের নিদর্শন পাওয়া যায়, তবে মানুষের ছবি আঁকার প্রতি আগ্রহ ছিল না। মনে হয় ব্যাবিলনীয়রা মানুষের ছবি আঁকার বিরুদ্ধেই ছিল। কিন্তু স্থাপত্যে তারা বিশেষ দক্ষতা দেখিয়েছে। তাদের নগর নির্মাণ এবং নগরের দেয়ালে শূন্য উদ্যান তৈরি পৃথিবীতে সপ্তম আশ্চর্যের অন্তর্ভুক্ত হয়। সুমেরীয়দের মতো তারা জিগুরাত নামে ধর্মমন্দির নির্মাণ করে, যা দেখতে পিরামিডের মতো। ধাপে ধাপে ওপরে উঠে যাওয়ার পর ওপরে যে বিশাল কক্ষ, সেটি ছিল প্রধান দেবতার। তার দেয়ালে অলংকরণ ছিল মোজাইকের ধরনে।
ব্যাবিলনীয় সভ্যতার প্রধান অবদান তার আইন সংকলন যা সম্রাট হাম্বুরাবির সময় প্রণীত হয়। কালো এক প্রস্তরখ-ে নির্মিত স্মৃতিস্তম্ভে এই আইনের সব অনুশাসন বিশদভাবে উৎকীর্ণ করে ভাস্কর। আট ফুট উঁচু এই স্মৃতিস্তম্ভের ওপর রয়েছে একটি ভাস্কর্য। ন্যায়বিচারের দেবতা সূর্যদেব হাম্বুরাবিকে তাঁর আইন লিপিবদ্ধ করার নির্দেশ দিচ্ছেন অথবা সম্রাট সূর্যদেবতাকে তার আইনগ্রন্থ প্রদান করছেন, এমন উপলব্ধি হয় ভাস্কর্যটি দেখলে। উপবিষ্ট এবং দ-ায়মান মূর্তি দুটি প্রোফাইলে হলেও তাদের বুক সামনাসামনি দেখানো হয়েছে, যা থেকে বোঝা যায় যে ফ্রন্টালিটির সূত্র মিশর থেকে ব্যাবিলনে এসেছে এবং ভাস্কর ও শিল্পীরা তার ব্যবহার করেছে। ফিগার দুটি আকারে বিশাল নয় এবং কোনো স্টাইলাইজেশন নেই। সব মিলিয়ে বাস্তবের অনুকরণ প্রাধান্য পেয়েছে, কেবল প্রোফাইলের সংমিশ্রণ ছাড়া।
ব্যাবিলনীয়দের শিল্প সম্পর্কে মন্তব্য করতে গিয়ে হাউজার বলেছেন যে, উন্নত এবং প্রগতিশীল নগরীর অর্থনীতির তুলনায় আড়ষ্ট এবং রীতিবদ্ধ (ফরমাল) ব্যাবিলনীয় শিল্পকর্ম দেখে কৃষি সংস্কৃতির সঙ্গে জ্যামিতিক শৈলীর এবং নিয়ন্ত্রণহীন স্বতঃস্ফূর্ত ও স্বাভাবিক (বাস্তবানুগ) শিল্পের সঙ্গে উন্নত নগরজীবনের সম্পর্ক প্রসঙ্গে যে ব্যাখ্যা দেওয়া হয় তার যথার্থতা নিয়ে প্রশ্ন ওঠে। এর কারণ হিসেবে তিনি বলেছেন, ব্যাবিলনে স্বৈরাচারীর কঠোর শাসন নগরীর উন্মুক্ত ও স্বাধীন চেতনাকে অবদমিত করে রেখেছিল। রাজদরবারের পৃষ্ঠপোষকতাই একমাত্র উৎস ছিল, যার জন্য গ্রামাঞ্চলে কোনো শিল্পচর্চা হয়নি এবং বিশেষ শৈলীর আবির্ভাবও দেখা যায়নি। আর একটি পার্থক্য হলো মিশরের তুলনায় আসেরিয়া এবং ব্যাবিলনের শিল্পে সৃজনশীলতার প্রভাব ছিল আরো বেশি। ভাস্কর্যে মানুষের ফিগার কেবল ফ্রন্টালিটির নির্দিষ্ট রীতি অনুযায়ী তৈরি হয়নি। মুখের বিশেষ অংশ নাক, ঠোঁট এবং চোখ দুটিকে বড় করে আঁকা হয়েছে। অন্যদিকে মুখের কম গুরুত্বপূর্ণ অংশ যেমন চিবুক, কপাল দেখানো হয়েছে ছোট আকারে। এই বাস্তবতাবিরোধী রীতির প্রকৃষ্ট দৃষ্টান্ত দেখা যায় আসেরীয় ভাস্কর্যে। যেমন দ্বাররক্ষী, পাখাবিশিষ্ট সিংহ এবং ষাঁড়ের মূর্তিতে। মিশরের কোনো শিল্পকর্মে বাস্তবের বিপরীতে স্টাইলাইজেশনকে এত বেশি গুরুত্ব দেওয়া হয়নি। পাশ থেকে দেখলে মানুষের ফিগারে চারটি গতিশীল এবং সামনে থেকে দেখলে দুটি স্থির, মোট পাঁচটি পা দেখা যায়। যার অর্থ হলো একটি নয়, দুটি জন্তুর দেহ নিয়ে মূর্তিটি তৈরি। বাস্তবতার বিরোধী এই শৈলীর পেছনে যে সচেতন উদ্দেশ্য ছিল তা হলো দর্শক যেদিক থেকেই দেখুক যেন ফিগারের নিখুঁত এবং সম্পূর্ণ অবয়ব দেখতে পায়। মেসোপটেমীয় সভ্যতার অন্তর্গত সুমেরীয় সভ্যতার উত্থানকাল খ্রিষ্টপূর্ব ৩৯০০ অব্দ এবং ৩০০০ অব্দ অর্থাৎ এর সময়কাল প্রায় ৯০০ বছর। পশ্চিম এশিয়ার জাতিগোষ্ঠীর মধ্যে নিওলিথিক পর্ব থেকে উন্নত হয়ে প্রথম সভ্যতায় পদার্পণ করে সুমেরীয় অঞ্চলের অধিবাসীরা। একটি আইনসম্মত উপায়ে সুমেরীয় নগররাষ্ট্র পরিচালিত হয়। সুমেরে প্রাপ্ত পৃথিবীর প্রাচীনতম মহাকাব্য গিলগামেশ থেকে এই রাজ্যের সরকারব্যবস্থা, আধ্যাত্মিক জীবন এবং সমাজবিন্যাস সম্বন্ধে জানা যায়। রাজা ছিলেন প্রধানত একজন সমরনায়ক। মন্দির-নিয়ন্ত্রিত শহরগুলি প্রদেশের মর্যাদা পায়। মন্দিরগুলি রাষ্ট্রের শক্তির প্রতীক ছিল, যার জন্য এই রাজ্যে ধর্মের প্রাধান্য উপলব্ধি করা যায়। কয়েকটি শহরকে কেন্দ্র করে সুমেরীয়দের রাজনৈতিক শক্তির বিকাশ ঘটে। নগরীর চারিদিক উন্মুক্ত থাকায় বাইরে থেকে শত্রুদের আক্রমণে সুমেরীয় রাজ্যের উত্থান ও পতন ঘটেছে কয়েকবার।
সুমেরীয়দের জীবনযাত্রায় ধর্মের অবস্থান ছিল গুরুত্বপূর্ণ। এই ধর্ম ছিল বহু দেবদেবীনির্ভর। খনন করে অনেক দেবদেবীর বিভিন্ন উচ্চতার মূর্তি পাওয়া গিয়েছে, যা থেকে তাদের আপেক্ষিক ক্ষমতার পরিচয় পাওয়া যায়। মূর্তিগুলি পুতুলের মতো মনে হলেও বেশ বাস্তবানুগ, মানুষের প্রতিকৃতির অনুরূপ। দেবদেবী বলে মূর্তিতে কোনো বাহুল্যের সংযোজন করা হয়নি। প্রত্যেকের ভঙ্গিতেই রয়েছে বিনীতভাব। ক্ষমতার প্রতাপ নয়, ক্ষমা এবং ভালোবাসার আশ্বাস রয়েছে সেই ভঙ্গিতে। দেবদেবীকে এইভাবে মানবিক গুণে গুণান্বিত করা হয়েছে।
কিংবদন্তির রাজা গিলগামেশকে কেন্দ্র করে প্রাচীন সুমেরে রচিত হয়েছিল বিখ্যাত গিলগামেশ মহাকাব্য। এটা পুরাকাহিনিনির্ভর হলেও প্রাচীন রাজাদের সঙ্গে দেবদেবীর সম্পর্ক বর্ণিত হয়েছে। এছাড়া রয়েছে রাষ্ট্র ও সমাজ সম্বন্ধে অনেক তথ্য। গিলগামেশের রিলিফ ভাস্কর্যে তাকে পশু হাতে দ-ায়মান দেখা যায়। রিলিফে হলেও ভাস্কর্যের মূর্তিটি প্রোফাইলে নয়, সামনাসামনি তাকিয়ে থাকার ভঙ্গিতে। এখানে ফ্রন্টালিটির ব্যবহার নেই। গিলগামেশের দাঁড়ানোর ভঙ্গিতে আড়ষ্টতা নেই, আর চাঞ্চল্যও প্রকাশ পায়নি। আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে দাঁড়িয়ে তিনি যেন ধৈর্যের সঙ্গে কিছুর প্রতীক্ষা করছেন।
হাউজার মেসোপটেমিয়ার শিল্প সম্পর্কে বলেছেন, নগরকেন্দ্রিক সভ্যতায় গতিশীল এবং পরিবর্তনমুখী অর্থনীতির পরিবেশে অনিয়ন্ত্রিত বাস্তবানুগ চলিষ্ণু নাগরিক অর্থনীতির প্রতিভূ হিসেবে বাস্তববাদী শিল্প আর কৃষি সংস্কৃতির সঙ্গে সামঞ্জস্যময় যে কঠোর জ্যামিতিক শিল্প শৈলী সম্পর্কে সাধারণ ধারণা সেটি মেসোপটেমিয়ার ব্যাবিলনের শিল্পের ক্ষেত্রে দেখা যায় না। তিনি মনে করেছেন যে শাসকের স্বৈরাচার এবং ধর্মীয় জীবনের জন্য ব্যাবিলনে নাগরিক সংস্কৃতির স্বাধীন স্বতঃস্ফূর্ত বিকাশ ব্যাহত হয়েছিল, যার জন্য সেখানকার শিল্প নিওলিথিক সংস্কৃতির মতোই কঠোর শৃঙ্খলাবদ্ধ ছিল। ব্যাবিলনে কেবল রাজদরবারে আর মন্দিরে শিল্পচর্চা প্রচলিত ছিল, ফলে ব্যক্তিবাদী ও বাস্তবানুগ শিল্পচর্চা নিরুৎসাহিত হয়েছে। একই কারণে গ্রামাঞ্চলে লোকশিল্পের বিকাশ হয়নি। ব্যাবিলনের শিল্প ছিল এত উপেক্ষিত যে, কোনো শিল্পকর্মের পেছনে শিল্পীর নাম জানা যায় না। হাম্বুরাবির আইন নির্দেশক প্রস্তরখ-ে স্থপতি এবং ভাস্করের নামের পাশে মুচি এবং কামারের নাম ছিল একই শ্রেণিতে। তিনি আরো বলেছেন, মেসোপটেমিয়ার আসেরিয়ান স্থাপত্য-ভাস্কর্যে অবাস্তব ফ্রন্টালিটি সূত্রের ব্যবহার দেখা যায়, যার দৃষ্টান্ত দ্বাররক্ষীর মূর্তিতে এবং ডানাযুক্ত সিংহ ও ষাঁড়ের ভাস্কর্যে। মিশরের শিল্পকর্মে এমন স্টাইলাইজেশন ছিল না। অনেক পরে অষ্টম ও সপ্তম খ্রিষ্টপূর্ব অব্দে আসেরিয়ান ভাস্কর্যে কিছুটা বাস্তবতা দেখা যায়। অসুরবাণীপালের যুদ্ধ ও শিকারের রিলিফ ভাস্কর্যে জন্তুর মূর্তি দেখা যায় জীবন্ত ও বাস্তবরূপে কিন্তু মানুষের ফিগার স্টাইলাইজড এবং আড়ষ্ট, দুই হাজার বছর আগে যেমন ছিল। হাউজার মনে করেন, দ্বৈত শৈলীর এই সহাবস্থান প্যালিওলিথিক যুগ থেকে চলে এসেছে, যখন পশুকে জীবন্ত এবং মানুষকে স্টাইলাইজড দেখানো হয় দেয়ালচিত্রে, কেননা তখন পশু ছিল শিল্পীর কাছে গুরুত্বপূর্ণ। পরবর্তীকালে কৃষি সংস্কৃতিতে এবং সভ্যতার যুগে পশুর গুরুত্ব হ্রাস পেলেও তাদের মূর্তি স্টাইলাইজড করা হয়নি অপ্রয়োজনীয় এবং অপ্রাসঙ্গিক মনে করে (হাউজার, প্রাগুক্ত)।