শ রী ফ আ তি ক – উ জ – জা মা ন
শিল্পকলায় নগ্নতা প্রসঙ্গে মানুষের অনুভূতি মিশ্র হলেও তার ইতিহাস অতি প্রাচীন। একেবারে সূচনালগ্ন থেকেই নগ্নতা শিল্পের অবিচ্ছেদ্য অংশ এবং তা বিষয়, গড়ন, উদ্দেশ্য ও ঐতিহাসিক প্রসঙ্গসূত্র – এই চারটি বৈশিষ্ট্যকেই গুরুত্বের সঙ্গে ধারণ করেছে। নগ্নতা আজ শিল্প ও সংস্কৃতির গুরম্নত্বপূর্ণ এক প্রতীক হিসেবে প্রতিষ্ঠিত। কিন্তু দর্শকদের দৃষ্টিকোণ থেকে বিষয়টি কেমন? তাঁরা কি চিত্রকলার নগ্নতাকে স্বাগত জানিয়েছেন? দর্শকদের একটি বড় অংশ কি এখনো নগ্নচিত্রের দিকে কপট গাম্ভীর্য, অস্বসিত্ম বা চরম বিরক্তি নিয়ে তাকায় না? কিংবা চপলমতি তরুণের চোখে দুষ্টুমি লক্ষ করা যায় না? এই মিশ্র প্রতিক্রিয়ার সবটা সত্য না হলেও সেই কারণেই নগ্ন শিল্প প্রকৃত অর্থে শিল্প কি না তা নিয়েও কম বিতর্ক হয়নি। তবে নগ্নতা বা যৌনতা যেহেতু জীবনের বড় একটি প্রসঙ্গ তাকে শিল্প থেকে বাদ দেওয়া সম্ভব ছিল না, কিন্তু তার জনপ্রদর্শনী যুক্তিসংগত কি না তা নিয়েও অনেক কথা হয়েছে, হয়তো অনেক কথা বাকি আছে। আর তাই নগ্নতা শিল্পের বিরাট এক অংশ জুড়ে থাকায় তাকে বাদ রেখে শিল্পের আলোচনা অসম্পূর্ণ।
সাধারণত শিল্পে নগ্নতার সূচনাকাল হিসেবে ধ্রম্নপদী গ্রিক যুগকে (ষষ্ঠ-পঞ্চম খ্রিষ্টপূর্ব) ধরা হয়ে থাকে যখন বীর যোদ্ধাদের চিত্রায়ণ বা ভাস্কর্য নির্মাণ শুরম্ন হয়। সম্ভবত এই সময়ই নাদুসনুদুস ভেনাসের ছোট প্রতিমূর্তি নির্মাণ শুরম্ন হয়েছিল। প্রাচীনকালে তাকে উর্বরতার প্রতীক হিসেবে ধরা হতো। খ্রিষ্টপূর্ব প্রথম শতকে ভারতের বিভিন্ন মন্দিরে অজস্র কামনা জাগানো নগ্ন নারীমূর্তির ভাস্কর্য ও রিলিফ নির্মিত হয়েছে, যার পৌরাণিক ও ধর্মীয় প্রসঙ্গসূত্র রয়েছে। সেইসব দেবীর অনেককেই উর্বরতার প্রতীক হিসেবে পুজো করা হতো। গ্রিক শিল্পের নগ্ন পুরম্নষের ধারাবাহিকতায় সামগ্রিক শিল্পকলায় নগ্নতা আজ বিশেষভাবে চর্চিত ও আলোচিত এক প্রসঙ্গ। গ্রিক শিল্পে দেবতা ও দেবতাতুল্য পৌরাণিক বীরের নগ্নদেহ দর্শকদের মনে বিস্ময় ও ব্রীড়া – দুই-ই জাগিয়েছিল। শিল্পের বিবর্তনের সঙ্গে নগ্নতা উপস্থাপনের ধরন যেমন পালটে গেছে তেমনি তার নৈতিক, নান্দনিক, দার্শনিক, ধর্মীয় ও সামাজিক ব্যাখ্যার ভিন্নতাও বিষয়টিকে বিশেষ মাত্রা দান করেছে।
ঐতিহাসিকভাবে, কিছু ব্যতিক্রম বাদে, নগ্নতা একেবারেই পাশ্চাত্যের সৃষ্টি। নগ্ন নারী ও নগ্ন পুরম্নষের নির্মাণ হয়েছে সবসময়ই ভিন্ন উদ্দেশ্য মাথায় রেখে। গ্রিক শিল্পে দেবতা ও অলিম্পিক ক্রীড়ার বীরদের আদর্শায়িত নগ্ন-নির্মাণ অতি স্বাভাবিক এক বিষয় ছিল। এর সঙ্গে যৌনতার বিব্রতকর প্রসঙ্গও বড় হয়ে দেখা দিয়েছিল। গ্রিকরা মনুষ্য দেহের সৌন্দর্যের নিরিখে সবকিছুর সৌন্দর্য মূল্যায়ন করত। তাই মনুষ্য দেহের আদর্শায়িত চিত্র বা ভাস্কর্য নির্মাণ করত। মানুষ দেখতে কেমন তা নয়, বরং মানুষের দেখতে কেমন হওয়া উচিত সেই দৃষ্টিভঙ্গি থেকে তার চিত্রায়ণ হওয়া প্রয়োজন বলে তারা মনে করত। কিন্তু তারা নগ্ন কেন? কাপড়ে ঢেকে শরীরের শতভাগ সৌন্দর্য প্রদর্শন সম্ভব নয় বলেই নগ্নতার চিত্রায়ণে তারা এত সাবলীল। খ্রিষ্টপূর্ব চতুর্থ শতকে প্রাক্সিটেলস ও অন্য ভাস্কররা নগ্নিকা, বিশেষ করে প্রেমের দেবী আফ্রোদিতির নগ্ন ভাস্কর্য নির্মাণ শুরম্ন করেন, কিন্তু একই সময়ে নগ্নিকা চিত্রায়ণ শিষ্টাচারবিরোধী বিবেচনা করা হতো – যা স্ববিরোধী এক সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গি। কিন্তু সময়ের সঙ্গে সঙ্গে বিষয়টা যথেষ্ট পালটে গেছে। এখন তো নগ্ন পুরম্নষের চিত্রায়ণ কদাচিৎ হয়ে থাকে। মধ্যযুগে তেমন কোনো নগ্ন চিত্র দেখা যায় না। এই সময়ের চিত্রীরা অতিমাত্রায় প্রতীকী চিত্রকর্ম নির্মাণে সচেষ্ট ছিলেন, যার লক্ষ্য ছিল খ্রিষ্টধর্ম বা ঈশ্বরের গুণগান। ম্যাডোনা ও তার শিশু এবং বিভিন্ন সমত্ম আইকন বা প্রতিমা হিসেবে চিত্রিত হতেন। মাতা মেরি পবিত্র ও অলৌকিক হিসেবে চিত্রিত হয়েছেন। আর এগুলো সময়কে অতিক্রম করেছে বলে মনে করা হয়। তবে কিছু নগ্নতার চিত্রায়ণ মধ্যযুগেও হয়েছে, যার মূলে ছিল খ্রিষ্ট বিশ্বাস। রোমান সাম্রাজ্যের পতন, গ্রিক ও লাতিন গির্জার বিভাজন এবং খ্রিষ্টপূর্ব ও নব্য-খ্রিষ্ট সংস্কৃতির মধ্যে বিভেদরেখার প্রভাব শিল্পের ওপর পড়েছিল। খ্রিষ্টধর্মের শুরম্নতে শুদ্ধতা ও কৌমার্যব্রতকে বিশেষ মূল্য দেওয়া হতো। গ্রিক ও রোমানদের মতো কামজ আদর্শ প্রচার গির্জার জন্য খুব প্রয়োজনীয় ছিল না। এমনকি নগ্ন খেলোয়াড় ও অপরাপর মনুষ্য দেহের মূল্য নিরূপণে নতুন দৃষ্টিভঙ্গি লক্ষ করা গেল। অ্যাডাম ও ঈভের নগ্ন চিত্রায়ণ কামোদ্দীপনার চেয়ে বেশি করে লজ্জা ও অসহায়ত্ব তুলে ধরে। প্রতিমায়ন (Iconography) ছিল প্রতীকী ও অবাসত্মব এবং পৌত্তলিকতার বিরম্নদ্ধে এক প্রতিক্রিয়া। কিন্তু পরিহাস হলো, খ্রিষ্টধর্মাবলম্বীরা এই প্রতিমাগুলোকেই পুজো করতে শুরম্ন করল।
খ্রিষ্টধর্মের উত্থানের পর সাময়িক সময়ের জন্য নতুন বৈশিষ্ট্যের নগ্ন শরীর চিত্রায়ণে ভাটা পড়ে। শুধুমাত্র কয়েক শতক ধরে প্রচলিত নগ্নদেহের নির্মাণ চলতে থাকে। ধর্মীয় চিত্রকলায় কিংবা ভাস্কর্যে অ্যাডাম ও ঈভের চিত্রায়ণও নগ্ন, তবে কখনো কখনো সামান্য বস্ত্রখ–র মাধ্যমে শরীরের বিশেষ স্থানসমূহ আবৃত রাখার শৈল্পিক কলাকৌশলও লক্ষ করা গেছে। এই শ্রেণির চিত্রে নগ্নতাকে লজ্জার মনে করা হলেও পতিত শয়তানের নগ্ন চিত্র হাসির উদ্রেক করে।
এরপর তেরো শতকের ইতালিতে নগ্নতা নতুনভাবে ফিরে এলো এবং তা চিত্রায়ণের ক্ষেত্রে আভিজাত্য ও সৌন্দর্যকে কামজ আকাঙক্ষার ওপরে স্থান দেওয়া হলো। একসময় তা চিত্রকলার প্রধান বিষয়বস্ত্ত হয়ে উঠল। তেরো শতকে শিল্পী নিকোলো পিসানো ও চোদ্দ শতকে জত্তো ধ্রম্নপদী যুগের নগ্নতা সম্পর্কে বিশেষ আগ্রহ দেখালেন। যেহেতু তখন মডেল পাওয়া যেত না, তাই Korai অর্থাৎ নারী চিত্রায়ণে পুরুষদের শরীরকে আদর্শ ধরে কিছু বৈশিষ্ট্য বদলে নেওয়া হতো বলে কথিত আছে। ষোলো ও সতেরো শতকের চিত্রকলায় সবচেয়ে পরিচিত নগ্ন বিষয়বস্ত্তরূপে আমরা ভেনাস বা আফ্রোদিতিসহ অপরাপর গ্রিক ও রোমান দেব-দেবীদের দেখতে পাই। কিন্তু প্রাচীন রোম বা গ্রিসে তাঁরা ধর্মীয় গাম্ভীর্যে পূজিত হতেন। রেনেসাঁ যুগে এসে সেই ধারায় যতি পড়ল, কারণ তখন লোকে তাদের অসিত্মত্বই বিশ্বাস করত না। কিন্তু সেই পৌত্তলিক দেব-দেবী বাসত্মব ধারণার প্রতীক হয়ে উঠে শিল্পের মাধ্যমে মানুষের সামনে আসতে থাকলেন। যেমন, মারস (Mars) হলেন রণদেবতা, আর ভেনাস হলেন সৌন্দর্য ও ভালোবাসার প্রতীক। ধ্রম্নপদী ভেনাস সম্মানের সঙ্গে পূজিত হতেন। তিনি নিজে বাসত্মব না হলেও যে ভালোবাসা ও সৌন্দর্যের প্রতীক হয়ে উঠেছিলেন তা ছিল বাসত্মব।
ষোলো শতকে লিওনার্দো দ্য ভিঞ্চির মতো শিল্পীরা শারীরবিদ্যা সম্পর্কে বিশেষভাবে আগ্রহী হয়ে ওঠেন। তারপরেও ধর্মীয়, পৌরাণিক, ঐতিহাসিক কাহিনির বীরত্ব ও সদ্গুণসম্পন্ন আদর্শায়িত নগ্নদেহ নির্মাণে বৈশিষ্ট্যের অনুসন্ধান চলল। মাইকেল অ্যানজেলোর ভাস্কর্য ও চিত্রকলার নগ্নদেহে প্রাকৃতিক বৈশিষ্ট্যের চেয়ে আদর্শায়িত বৈশিষ্ট্যই বেশি লক্ষ করা যায় এবং নারীদেহ নির্মাণে পুরম্নষের আদল বদলে নিয়েছেন বলেই সকলে নিশ্চিত হন। আবার টিশিয়ান প্রকৃত বৈশিষ্ট্যে নগ্নিকা চিত্রায়ণের মধ্য দিয়ে ষোলো শতকের দৃষ্টিভঙ্গি তুলে ধরেছেন। এই সময় ইতালিতে প্রথম শিল্প শিক্ষায়তন প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে শিল্পশিক্ষা দেওয়া শুরম্ন হয়। সেখানে নারী মডেল ব্যবহৃত হতো কি না সে সম্পর্কে কোনো বস্ত্তনিষ্ঠ তথ্য পাওয়া যায় না। কিন্তু তাদের ছবির নারীরা যথেষ্ট কামোদ্দীপক এবং টিশিয়ানের নগ্নিকারা আদর্শায়িত হলেও কাম-জাগানিয়া।
সতেরো শতকে স্বাভাবিক বৈশিষ্ট্যের নগ্নিকার রূপায়ণ শুরম্ন হলো, বিশেষ করে ব্যারোক চিত্রকলায়। ক্যারাভাজ্জিয়োর ছবিতে নগ্ন পুরম্নষেরা অনেক বেশি ইন্দ্রিয়সুখাসক্ত হিসেবে চিত্রিত। এই সময়ে নগ্নিকা চিত্রায়ণের পুরোগামী শিল্পী ছিলেন রম্নবেন্স। তিনি নিজে ইতালীয় রেনেসাঁর প্রশংসায় পঞ্চমুখ হলেও তাঁর নগ্নিকারা অনেক বেশি বাসত্মবানুগ এবং আকাঙক্ষা-জাগানিয়া। শিল্পের নগ্নতা সম্পর্কিত দৃষ্টিভঙ্গি ও বিশ্বাস সময়ের সঙ্গে সঙ্গে পালটে গেছে। আঠারো শতকের দিকে স্পেনের শিল্পী ফ্রান্সিসকো গয়া একজন নারীর দুটি ছবি এঁকেছিলেন : একটি আবৃত, আরেকটি অনাবৃত। দুটি ছবিতেই তাকে একটি বিছানায় অর্ধশায়িত অবস্থায় দেখা যাচ্ছে, যা ষোলো শতকের দেবীচিত্রের কথা মনে করিয়ে দেয়। কিন্তু এই নারী দেবী নয়, মানবী – আবৃত ও অনাবৃত। সম্ভবত গয়া বলতে চেয়েছেন যে দেবী ভেনাস মৃত, যা অবশিষ্ট আছে তা শুধু মানবী। আঠারো শতকেই রোকোকো শিল্পীরা হালকা পারিপার্শ্বিকতার মাঝে নগ্ন নারীমূর্তি অাঁকতে শুরম্ন করলেন। তার মধ্যে অনেক অভিজাত ব্যক্তির রক্ষিতার ছবি ছিল বলে সমালোচকরা শনাক্ত করেছেন। এর মাধ্যমে তাঁরা প্রমাণ করার চেষ্টা করেছেন যে এই শিল্পীরা নারী মডেল ব্যবহার করতেন। উনিশ শতকে ব্রিটেনের ছোট ছোট শিল্পশিক্ষা প্রতিষ্ঠানে নগ্নিকারা মডেল হিসেবে ব্যবহৃত হতেন। এই চর্চা সেখানে নগ্নিকাদের জনপ্রিয়তা অনেক বাড়িয়ে দেয়। ঐতিহাসিক ছবিতে নগ্ন পুরম্নষের সর্বজনীন জনপ্রিয়তা ছিল। ব্রিটেনেও সেই আদলে বীরদের নগ্নরূপে চিত্রায়ণ শুরম্ন হলো। গেভিন হ্যামিলটনের Death of Patroclus এই ধরনের একটি চিত্রকর্ম। উনিশ শতকে ফ্রান্সেও নগ্নিকার চিত্রায়ণ প্রাধান্য পেতে থাকে। শিক্ষায়তনিক চিত্রকলা ও ভাস্কর্য ছিল প্রতিবাদী কাজ। গুসত্মাভ কুরবের গুরম্ননিতম্বিনী নারীরা আদর্শায়িত নগ্নিকা দেখার দর্শকরম্নচির প্রতি চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দেয়। কুরবে প্রথাগত বিষয়কে এড়িয়ে সম্পূর্ণ নতুন দৃষ্টিকোণ থেকে নগ্নতাকে দেখতে চাইলেন। যে বিষয় ইতিহাস, বাইবেল ও পুরাণকে অমত্মর্ভুক্ত করেছিল কুরবে তাকে বাদ দিয়ে চারপাশে যা দেখলেন তাই অাঁকলেন সম্পূর্ণ নিজস্ব ভাবনার আলোকে। ‘আমি দেব-দেবী দেখিনি, তাই অাঁকতে পারি না,’ তিনি বলতেন। তাঁর ছবি সেই সত্য বলত, যা আমরা শুধুমাত্র দেখতে ও অনুভব করতে পারি। এদুয়ার্দ মানে কুরবের ভাবনাকে আরো খানিকটা এগিয়ে নিয়ে গেছেন। তাঁর দুটি ছবির কথা সমালোচকরা খুব উলেস্নখ করেন : Luncheon on the Grass ও Olympia। প্রথম ছবিতে দেখা যাচ্ছে, দুজন ধোপদুরসত্ম পুরম্নষ পিকনিক-মুডে বসে আছেন আর পাশে একজন নারী নগ্নাবস্থায় উপবিষ্ট এবং একটু দূরে আরেকজন প্রায় নগ্ন হয়ে স্নান করছেন। ছবিটির এই উপস্থাপনা বেশ হাস্যকর। অনুমান করা যায়, ১৫০ বছর আগে মানুষ এই ছবি দেখে কতখানি ধাক্কা খেয়েছিল। কিন্তু এখানে যে বিষয়টি গুরম্নত্বপূর্ণ তা হলো, শিল্পীরা প্রাচীন ভাবনা খারিজ করে নতুন ভাবনাকে সামনে নিয়ে এসেছিলেন।
৯৫০ থেকে ১০৫০ খ্রিষ্টাব্দের মধ্যে ভারতের মধ্যপ্রদেশের খাজুরাহে চান্দেলা রাজাদের দ্বারা প্রায় ৮৫টি মন্দির নির্মিত হয়েছিল। একই সময় ধর্মীয় ও দার্শনিক ভাবনাসমূহ বিকশিত হয়েছিল। যেমন, ভামানা মন্দিরগাত্রে নারী-পুরম্নষ, অর্ধমানব-অর্ধপ্রাণী, নরাত্ম-আরোপিত দেব-দেবীদের ভাস্কর্য থাকলেও প্রথম দেখাতেই তাদের নগ্নতার রূপটি চোখে পড়বে। এছাড়া অন্যান্য মন্দিরে মৈথুনের দৃশ্য রয়েছে। এই কামজ ভাস্কর্য ও ধর্মীয় কাঠামো পারস্পরিক বিরম্নদ্ধ-বৈশিষ্ট্যম–ত। এইসব পৌরাণিক দেব-দেবী একাধারে ধর্মীয় ও ধর্মনিরপেক্ষ। উর্বরতা, সমৃদ্ধি, সৌভাগ্যের প্রতীক এইসব নারীদেহ সবার কাছেই সমানভাবে গ্রহণযোগ্য। মন্দিরগাত্রের দেব-দেবী শিব ও শক্তির প্রতীক। এইসব মন্দিরের কামোদ্দীপক শিল্প মূলত দেবী জগদাম্বীর সঙ্গে সম্পৃক্ত। দেবাঙ্গনা, মৈথুনের নানা ভঙ্গি, অজস্র নগ্নদেহের কারণে জগদাম্বী মন্দিরকে কামসূত্র মন্দিরও বলে। এই মন্দিরগুলোতে নারীত্বের উদ্যাপন হয় বলে ধারণা প্রচলিত রয়েছে, কারণ সেখানে প্রচুর অলংকার পরিহিত পীনোন্নত পয়োধর ও গুরম্ননিতম্বের নারীর ভাস্কর্য রয়েছে, যাদের অপ্সরা বলা হয়। এরা প্রেমের প্রতীক হিসেবে সাধারণের প্রশংসাধন্য। এই ধারণা প্রভাবশালী ধর্মীয় গ্রন্থ বিরাট সম্হিতা ও শিল্পশাস্ত্র সমর্থিত। বিরাট সম্হিতায় উলেস্নখ রয়েছে যে মৈথুন ও কামজ চিত্র বা ভাস্কর্য মন্দিরগাত্রের দরজায় থাকাটা সৌভাগ্যের প্রতীক।
জাপানি শিল্পঐতিহ্যে শুঙ্গা (Shunga) একধরনের কামনা উদ্রেককারী শিল্পের নাম। বেশিরভাগ শুঙ্গা হলো ukiyo-e ধরনের, যা কাঠখোদাইয়ের মাধ্যমে করা হয়। ukiyo-e-এর উলেস্নখ কেনেথ ক্লার্কের The Nude গ্রন্থে রয়েছে। শুঙ্গা শব্দের অর্থ ‘বসমেত্মর চিত্রাবলি’ এবং সেখানে ‘বসমত্ম’ সঙ্গমের সমার্থক শব্দ হিসেবে বহুল ব্যবহৃত। জাপানের প্রায় সব শিল্পীই শিল্পজীবনের কোনো এক পর্যায়ে শুঙ্গার চর্চা করে থাকেন। শুঙ্গার উৎপত্তি হিসেবে চোদ্দ শতকে বহুল প্রচলিত চীনা চিকিৎসা পুসিত্মকার অলংকরণকে ধরা হয়ে থাকে। তাং যুগের চিত্রী ঝউ ফ্যাং (Zhou Fang) ছিলেন কামোদ্দীপক চিত্রকলায় সিদ্ধহসত্ম। তিনি ও অন্য চিত্রীরা অাঁকার সময় নারীদের যৌনাঙ্গ বড় করে অাঁকতেন এবং সম্ভবত ওষুধগুলো যৌনশক্তিবর্ধন সম্পর্কিত। জাপানি শুঙ্গা অভিজাত শ্রেণির মধ্যে সীমিত ছিল। স্ক্রলের মাধ্যমে প্রাসাদ ও মঠের যৌন-কেলেঙ্কারি তুলে ধরা হতো। চরিত্ররা ছিলেন অমাত্য ও ভিক্ষু। শুঙ্গার নারী-পুরম্নষদের অবাসত্মব যৌনভঙ্গিমায় ও বৃহৎ যৌনাঙ্গসহ চিত্রিত দেখা যায়। সুনির্দিষ্ট যৌন বিষয়কে বড় করে দেখানো, শৈল্পিক আকর্ষণ ও মনসত্মাত্ত্বিক প্রভাব এর ব্যাখ্যায় অমত্মর্ভুক্ত। যৌনাঙ্গগুলোকে ‘দ্বিতীয় মুখ’ হিসেবে ব্যাখ্যা করা হয়েছে, যা প্রতিদিনকার চেহারার পেছনে লুকানো আদিম অনুভূতির প্রকাশক। সব শুঙ্গা চরিত্রই পোশাকে আবৃত, যার কারণ একেবারে উদোম শরীর জাপানি সমাজে খুব কামোদ্দীপক হিসেবে বিবেচিত ছিল না। লোকে শৌচাগারে নারীদের নগ্ন হয়ে স্নান করার দৃশ্য বরং বেশি পছন্দ করত। কায়োনাগার সেই রকম একটি চিত্র রয়েছে। পোশাকের উদ্দেশ্যও রয়েছে। শুঙ্গায় অংশ নেওয়া অভিজাত অমাত্যদের সহজে চেনার জন্য তাদের বৈশিষ্ট্যম–ত পোশাকে অাঁকা হতো। শুধুমাত্র যৌনাঙ্গগুলো উন্মুক্ত করে দেখানো হতো দর্শকের মনোযোগ কাড়ার জন্য।
আধুনিক শিল্পীরা চিমত্মার যে স্বাধীনতা নিয়েছেন সেখানে ইতিহাস, বাইবেল বা পুরাণ ছিল না আবার ছিলও। যেমন, পিটার ব্রম্নকসের মতে, পল গগ্যাঁ ঈভকে আদর্শ ধরে তাহিতির নগ্নিকা এঁকেছেন অর্থাৎ নতুন রূপে প্রাচীন সৌন্দর্যের পুনর্জাগরণ ঘটাতে চেয়েছেন। শিল্প ইতিহাসে ঈভের নগ্নতা পাপ, লজ্জা, ভালো-মন্দের জ্ঞানের নিরিখে উপস্থাপিত। গগ্যাঁর আকাঙক্ষা ছিল কোনো প্রকার লজ্জা বা অস্বসিত্মর ধারণা ছাড়াই নগ্নতার রূপটি তুলে ধরা। তিনি বাইবেলের ‘পতন’-এর ধারণা এবং পাপের সঙ্গে নগ্নতার যোগসূত্রকে খারিজ করে দিয়েছেন। তিনি রম্নশোর Noble savage-এর ধারণা দ্বারা অনুপ্রাণিত হয়েছিলেন। আধুনিক চিত্রীদের মধ্যে পাবলো পিকাসো গগ্যাঁর নগ্নিকা চিত্রায়ণের পথ ধরে আরো এক ধাপ এগিয়ে গেলেন। তাঁর কাজ প্রকৃত অর্থেই সৃষ্টিশীলতার ভিন্নমাত্রিক উদাহরণ। কোনো শিল্পীই তাঁর মতো করে শিল্পকে সাহসিকতার সঙ্গে নির্মাণ করতে পারেননি। কিন্তু রক্ষণশীল সমালোচকরা তাঁকে সেই সম্মান বা কৃতিত্ব দিতে চাননি। তাঁর বস্নু পিরিয়ডের ছবি দেখলে বোঝা যায় যে তিনি ধ্রম্নপদী কলাকৌশল ও শারীরবিদ্যা সম্পর্কে যথেষ্ট দক্ষ ছিলেন। তাঁর ছবিটি চমৎকার আবেগের বহিঃপ্রকাশ। যাহোক পিকাসো দ্রম্নত পথ পরিবর্তন করেন। গগ্যাঁ রূপায়ণধর্মী কাজ করে গেলেও পিকাসোর কিছু কিছু ছবি ‘androgynous’ বৈশিষ্ট্যের, যেখানে নারী-পুরম্নষের পার্থক্যগুলো ঠিক বোঝা যায় না। তিনি শরীরের গড়ন ভেঙে বিমূর্তায়নের মধ্য দিয়ে একটি মৌলিক প্রশ্নের উত্তর খুঁজেছেন, ‘বাসত্মব প্রকৃত অর্থে কী?’ তাঁর বিখ্যাত ঘনকবাদী কাজ Les Demoiselles d’Avignon-এ দেখা যায় তিনজন গণিকা। তাদের মুখগুলো আফ্রিকান মাস্কের আদলে নির্মিত। এটা প্রকৃত অর্থে বাসত্মবের সঠিক অনুকৃতি নয়। মার্শেল ডুশ্যাম্প (১৮৮৭-১৯৬৮) রূপ বা গড়নকে আরো ভেঙেছেন এবং একপর্যায়ে তার কোনো রূপই চোখে ধরা পড়ে না। শিল্পকে উদ্ভট মনে হয়। তাঁর লক্ষ্য ছিল শিল্পকে নির্মাণ নয়, ধ্বংস করা। দ্য ভিঞ্চির মোনালিসা বিকৃতির কারিগরও তিনি। ছবির যে শিরোনাম তিনি দিতেন তার সঙ্গে বিষয়ের কোনো মিল খুঁজে পাওয়া যেত না। তাঁর Nude Descending a Staircase বিশাল এক বিমূর্ত চিত্র। কিন্তু ছবিটির দিকে তাকিয়ে নগ্নতা বা যৌনতার তেমন কিছুই নজরে পড়ে না। তারপরও প্রথাগত নগ্নতার বাইরে একটি নতুন সৃষ্টির দৃষ্টামত্ম হিসেবে ছবিটি বিশেষ গুরুত্ব বহন করে।
ফটোগ্রাফিকে মডেলের বিকল্প হিসেবে অনেক শিল্পী ব্যবহার করেছেন, যদিও শুরম্ন থেকেই তা পর্নোগ্রাফি হিসেবে ব্যবহৃত হতে থাকে। নগ্নতার এই দ্বৈততা একই সঙ্গে বিকশিত হতে থাকে এবং আদর্শায়িত রীতিসমূহ সরে গিয়ে বাসত্মবধর্মিতা জায়গা করে নেয়। এই শতকেই প্রভাববাদীরা এলেন এবং নগ্নিকারা আরো জনপ্রিয় হতে লাগল। রেনোয়ার নগ্নিকারা তাদের ঔজ্জ্বল্য ও কামোদ্দীপক বৈশিষ্ট্যে রম্নবেন্সের কথা মনে করিয়ে দিলো। পৌরাণিক কাহিনির পরিবর্তে প্রভাববাদীদের পরিপার্শ্ব ছিল নগরজীবন। দেগার নগ্নিকাদের চিত্রায়ণ কিঞ্চিৎ আবেগধর্মিতা দিয়ে। মাতিসের মতো উত্তর-প্রভাববাদীরা তাঁদের নগ্নদেহীদের জন্য ধ্রম্নপদী পরিপার্শ্বকে পছন্দ করলেন নতুন বৈশিষ্ট্য ও বাসত্মবতাবর্জিত রঙে। পিকাসোর নগ্নচিত্রে আফ্রিকান মাস্ক ও ঘনকবাদী বৈশিষ্ট্য লক্ষ করা গেল। সমকালীন চিত্রকলায় আমরা দেখতে পাই অবদমিত কামের ফ্রয়েডীয় মনসত্মত্ত্ব এবং অনেকেই মনে করেন যে তা ধীরে ধীরে শিল্প ও অশস্নীলবৃত্তি বা পর্নোগ্রাফির মধ্যকার অস্পষ্ট পার্থক্য রেখা মুছে দিচ্ছে।
ধ্রম্নপদী শিল্পে নগ্নতার অর্থ ছিল একটি ধারণা মূর্ত করে তোলা বা মানুষের বিভিন্ন প্রকাশভঙ্গির বৈশিষ্ট্য তুলে ধরা। রেনেসাঁস আমলে ক্যাথলিক চার্চ শিল্পের সবচেয়ে বড় পৃষ্ঠপোষক ছিল, যার কারণে আমরা জত্তোর মাধ্যমে The Life of Christ ফ্রেস্কো পেয়েছি। যিশুকে ক্রুশ থেকে নামিয়ে কবরে নেওয়া হচ্ছে, তিনি উলঙ্গ বা প্রায়-উলঙ্গ। এছাড়াও যিশুর নগ্ন বা প্রায়-নগ্ন অজস্র ছবি রয়েছে যে প্রসঙ্গে এবং শিল্পের সামগ্রিক নগ্নতা নিয়ে খ্রিষ্টধর্মীয় ব্যাখ্যা রয়েছে। যেমন, অনেক গোঁড়া খ্রিষ্টান প্রশ্ন করেন, ‘শিল্পে প্রদর্শিত নগ্নতা দিয়ে আমরা খ্রিষ্টানরা কী করব?’
এই প্রশ্নের উত্তর পেতে একজনকে নগ্ন ও অশস্নীলবৃত্তির পার্থক্য অনুধাবন করতে হবে। যদি লক্ষ্য হয় নিরাভরণ শরীরের সৌন্দর্য নির্মাণ তবে তা নগ্ন, আর তা যদি হয় অনৈতিকতার প্রশ্রয় তবে তা অশস্নীল। একজন দর্শক কিন্তু ঠিকমতোই একটি নগ্নচিত্রের প্রসঙ্গসূত্র ধরতে পারেন – কোনটার দিকে তাকানো নৈতিকতাবিরম্নদ্ধ আর কোনটার দিকে নয়। তাকানোর উদ্দেশ্য সম্পর্কে আমাদেরই সিদ্ধামত্ম নিতে হবে যে আমরা কি অনৈতিক আকাঙক্ষাকে প্রশ্রয় দিচ্ছি, নাকি কোনো বৈশ্বিক দৃষ্টিভঙ্গির বিরম্নদ্ধাচরণ করছি। নগ্নচিত্রের দিকে তাকানোর সঙ্গে সঙ্গে পাপ ঘটে যায় না, তা নিয়ে মনের নোংরা অলিগলিতে বিচরণ করলেই তা ঘটে। শিল্পে নগ্নতার দীর্ঘ ইতিহাসের কথা এখানে আগেই উলিস্নখিত হয়েছে এবং একথাও বলা হয়েছে যে নগ্নতা প্রদর্শনের অনেক কারণ রয়েছে, যার মধ্যে অন্যতম হলো, মানুষের দেহসৌন্দর্য তুলে ধরা, কিন্তু সেটাই একমাত্র কারণ নয়। বাসত্মববাদিতা আরেকটি অন্যতম কারণ। বিভিন্ন মাত্রার নগ্নতা জীবনের একটি অংশ, এমনকি জনজীবনেরও। আগেকার গণশৌচাগার বর্তমান সময়ের মতো এতটা গোপনীয়তার নিশ্চয়তা দিতে পারত না। শরীরের প্রকাশ স্থান-কাল-পাত্রভেদে কেমন হবে তা শালীনতাবোধের ওপর নির্ভর করে। পক্ষান্তরে শিষ্টাচারপনা শরীরকে পাপের আধার হিসেবে দেখে। খ্রিষ্টানরা শিষ্টাচারপনাকে যে যুক্তিতে খারিজ করে দেয় তা হলো, ঈশ্বর মানুষকে অনেক ভালো জিনিস উপহার দিয়েছেন, যেগুলোকে সঠিকভাবে উপভোগ করতে হয়। মানুষের শরীর তার মধ্যে একটি। স্বর্গ থেকে বিতাড়নের পর নগ্নতা আমাদের কাছে লজ্জার একটি বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। ধর্মীয় প্রসঙ্গসূত্রে শিল্পীরা এই সত্য অনুধাবন করে শিল্পের মাধ্যমে তা উপস্থাপন করে চলেছেন। যেমন, ‘শেষ বিচার’ (Last Judgment) শিরোনামের অনেক ছবি রয়েছে, যেখানে দেখা যাচ্ছে যে বিচারের জন্য জড়ো হওয়া ব্যক্তিরা নগ্ন; যারা আশীর্বাদপ্রাপ্ত বা পুণ্যাত্মা তাদের একটি বস্ত্রখ- মিলবে আর যারা পাপাত্মা তারা নগ্ন অবস্থায় নরকে নিক্ষিপ্ত হবে। ওল্ড টেস্টামেন্টে বর্ণিত আছে, ‘ধর্মগ্রন্থে নগ্নতার প্রতিরূপ ব্যবহৃত হয়েছে ঈশ্বরের সামনে মানুষের অসহায় অবস্থা তুলে ধরার জন্য।’ কিন্তু ধর্মগ্রন্থ বা অন্য যে-কোনো স্থানেই হোক না কেন, নগ্নতার শাব্দিক বর্ণনা বা তার চিত্রের মাঝে তেমন কোনো পার্থক্য নেই। দুটোই মনের মধ্যে নগ্ন শরীরের ভাবনা জাগিয়ে তোলে। নগ্নতা চিত্রায়ণের মাঝে নৈতিক দায়িত্ববোধ থাকা জরম্নরি, কিন্তু ধর্মগ্রন্থে ব্যবহৃত নগ্নতা আর শিল্পকলায় ব্যবহৃত নগ্নতা এক কি না সে ব্যাপারে যথেষ্ট বিতর্ক রয়েছে। অনেক ক্ষেত্রেই শিশু যিশুকে খোলামেলা নগ্ন অবস্থায় দেখা গেছে। তার গুরম্নত্বপূর্ণ কারণও রয়েছে। লিঙ্গ দেখানোর মাধ্যমে তাঁর মানবিক বৈশিষ্ট্যের ওপর গুরম্নত্বারোপ করা হয়েছে অর্থাৎ যিশু যে একাধারে মানব ও ঈশ্বর ছিলেন তা বোঝানো হয়েছে। তাঁর ঐশ্বরিক বৈশিষ্ট্যসমূহ (জ্যোতিশ্চক্র, মেষশাবক ও ক্রুশ) সম্পর্কে সবাই অবগত। কিন্তু তাঁর মানবিক বৈশিষ্ট্য উপলব্ধির জন্য লিঙ্গ চিত্রায়ণের বিষয়টিকে অনেকে ভুলভাবে ব্যাখ্যা করেন। আবার ক্রুশবিদ্ধ যিশু সবসময়ই নগ্ন ছিলেন। যে ছোট্ট একখ- কাপড় তাঁর শরীরের ওপর আড়াআড়ি ফেলে নগ্নতাকে আড়ালের চেষ্টা করা হয়েছে তা কাল্পনিক। জনসমক্ষে তাঁকে নগ্ন দেখানো কি পাপাচার? না, কারণ এর কোনো যৌন প্রসঙ্গসূত্র নেই। আবার শিশুকে সত্মন পান করানোর যে দৃশ্য হামেশাই জনগণ প্রত্যক্ষ করে থাকে তার মধ্যে যৌনতা নেই, আছে মাতৃত্ব। যদি এই দৃশ্য দেখে কারো মনে যৌনাকাঙক্ষা জাগে তাহলে পাপ সেই ব্যক্তির মনে, সত্মন্যদানকারী নারীর চিত্রে নয়। এছাড়া আরো অনেক ধরনের নগ্নতা আছে, যেখানে যৌনতা প্রসঙ্গ হিসেবে আসা অনুচিত। যেমন, সমত্মান জন্মদানের সময়কালীন নগ্নতা, শারীরবিদ্যার বই, আদিবাসীদের নগ্ন ছবি ইত্যাদি। শিশুদের নগ্ন ছবি দেখতে দেওয়ার সঠিক সময় নিয়ে আরেকটি বিতর্ক রয়েছে। এক্ষেত্রে সুস্পষ্ট বক্তব্য হলো, শিল্পকর্মের নগ্নতা সম্পর্কে শৈশব থেকেই শিশুদের সঠিক উপলব্ধিসহ গড়ে তোলা উচিত, নইলে তারা ভুল অনুভূতি নিয়ে বেড়ে উঠতে পারে। নগ্নতা = ‘খারাপ’ এবং আবৃত শরীর = ‘ভালো’ – এমন সরল সমীকরণ শিল্পের ব্যাখ্যায় অচল।
‘নগ্নতা সর্বোৎকৃষ্ট শৈল্পিক প্রকাশ’ – এই মমত্মব্যের পক্ষে-বিপক্ষে ব্যাপক মানুষ আছেন। রম্নচিবাগীশরা বলেন : অস্বীকার করার উপায় নেই যে আজকের দিনেও আদিবাসীরা রয়েছে এবং তারা তাদের শরীরে কোনো আবরণ রাখার কথা কল্পনাই করে না। কিন্তু সভ্যতার এই চরম উন্নতির যুগে যখন পোশাকের বৈচিত্র্যও একটি সাংস্কৃতিক মান অর্জন করেছে এবং শরীর আবৃত রাখা সভ্যরীতির অংশরূপে স্বীকৃত সেখানে নগ্নতা অশস্নীলতা ছাড়া কী? কিন্তু এই যুক্তি নিছক বস্ত্ততান্ত্রিক, শিল্পবোধসম্পন্ন ব্যক্তি তাকে খারিজ করে দেবেন নন্দনতাত্ত্বিক দৃষ্টিকোণ থেকে বিচার করে। এ সম্পর্কে এভারেট সি. ম্যাক্সওয়েল ‘The Value of the Nude in Art’ প্রবন্ধে মমত্মব্য করেছেন, ‘প্রতিটি মতই একটি মানসিক অবস্থা। তাকে সর্বজনীন দৃষ্টিকোণ হিসেবে প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব নয়। একটি জাতির নৈতিকতা তার মানসিক অবস্থা দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হয়। চরম রক্ষণশীল সমাজে ভয়াবহ যৌন-অপরাধ সংঘটিত হয়। বিশুদ্ধ শিল্প হিসেবে নগ্নচিত্রের যে মূল্য তাকে নৈতিকতার কিছু বাঁধাধরা নিয়ম বা অনড় ধর্মীয় বিধান বা আধুনিক সমাজের সংজ্ঞা নির্মাণে ব্যবহৃত কিছু মনুষ্যপ্রণীত আচার-আচরণ দিয়ে খারিজ করে দেওয়া সম্ভব নয়। শিল্প নৈতিকতা-নিরপেক্ষ এমন একটি অকৃত্রিম বিষয় যাকে পরিবর্তনশীল আদর্শ দিয়েও মূল উদ্দেশ্য থেকে বদলে দেওয়া যায় না। তা স্রষ্টা ও প্রকৃতি কর্তৃক মানুষের ওপর অর্পিত এমন এক খাঁটি বস্ত্ত, যা কোনো প্রকার প্রতিবন্ধকতা ছাড়াই ব্যাখ্যা করা সম্ভব।’ ম্যাক্সওয়েলও বিশ্বাস করতেন যে শিল্পে সত্য ও সৌন্দর্যের সর্বোৎকৃষ্ট প্রকাশ হিসেবে নগ্নতার ব্যবহার অপরিহার্য। মানুষের সবচেয়ে বেশি আগ্রহ মানুষকে ঘিরে। তার সবকিছুই কোনো প্রকার কষ্টসাধ্য প্রচেষ্টা ছাড়া উপলব্ধি করা সম্ভব। মনুষ্যশরীর ও শারীরবিদ্যা সব শিল্পজ্ঞানের ভিত্তি। পোশাক চড়ানো শরীর অাঁকতে গেলেও নগ্নতার জ্ঞান প্রয়োজন পড়ে। এমনকি ভীতি, প্রেম, বিষণ্ণতা, হতাশার প্রকাশ দেখাতে গেলেও স্বাভাবিক বা নগ্ন শরীরের ধারণা অপরিহার্য। গ্রিক শিল্পীরা সৌন্দর্য সৃষ্টির আনন্দে নগ্নশরীর অাঁকতেন, কিন্তু সময়ের সঙ্গে সঙ্গে শিল্পের কিছু মানদ- খাড়া করার তাগিদেও নগণতার নির্মাণ চলছে। যদি শিল্প শিল্পীর আনন্দ ও সৌন্দর্যের প্রকাশ হয়ে থাকে, তবে নগ্ন শরীরই বিশুদ্ধ ও খাঁটি প্রকাশ।
আবার নগ্নতার নারীবাদী ব্যাখ্যাও রয়েছে। নারীবাদীরা মনে করেন যে রম্নবেন্সের নগ্নিকা আর হাসলারের পিনমারা পত্রিকার নগ্ননারীদের স্থিরচিত্রের মাঝে তেমন কোনো পার্থক্য নেই। রম্নবেন্সের ছবির কিছু নান্দনিক মূল্য থাকলেও থাকতে পারে, যা পিনমারা পত্রিকার নগ্ন স্থিরচিত্রের নেই। তাছাড়া সবসময়ই নগ্নিকাদের ছবি নির্মিত হয়েছে পুরম্নষের যৌনতার পরিতৃপ্তি ঘটানোর জন্য। একথা সত্য হিসেবে ধরে নিলে সমসত্ম নারীবাদী কি তাহলে পাশ্চাত্য সংস্কৃতির চূড়ায় আগুন লাগিয়ে দেবেন? নাকি ‘নান্দনিক মূল্য থাকলেও থাকতে পারে’ জাতীয় মমত্মব্য আজকের দিনেও তার রক্ষাকবচ হিসেবে কাজ করবে? লিন্ডা নিড তাঁর The Female Nude : Art, Obscenity and Sexuality গ্রন্থে বলছেন যে নান্দনিকতা ও অশস্নীলতা সম্পর্কে আমাদের প্রথাগত ধারণা এই সমস্যার সমাধান দেওয়া দূরে থাক, বরং এই ধারণাকেই বদ্ধমূল করবে। কিছু অনড় নান্দনিক সূত্রের ঘেরাটোপের মধ্যে ফেলে নগ্নচিত্রকলাকে শিল্প হিসেবে ফলাও করার চেয়ে নগ্নিকা রূপায়ণের ঐতিহাসিক কারণ নির্ণয়ের মাধ্যমে একটি তাত্ত্বিক কাঠামো দাঁড় করানোর ওপর তিনি জোর দিয়েছেন। নিডের মতে, নারী-যৌনতা তুলে ধরার মধ্য দিয়ে কীভাবে শিল্প প্রাকৃতিক বিষয়কে সংস্কৃতি ও মানসিক প্রবণতার বিশেষ বৈশিষ্ট্যে রূপামত্মর করে নগ্নিকা সেই প্রতীক নির্মাণ করেছে। এমনকি নগ্নিকার মাঝে যে স্বাভাবিক নান্দনিকতা রয়েছে নারী-যৌনতা তার ধারণাকে পর্যমত্ম তছনছ করে দিয়েছে। মিষ্টি গোলাপি রঙে সত্মনবৃমত্ম চিত্রায়ণ সসত্মা কামজ বৈশিষ্ট্য তুলে ধরে, যা কাঙিক্ষত নয়। পরিশীলিত মাত্রা ও অশস্নীলতার মাঝে পার্থক্য রয়েছে। কিন্তু ১৮৯৫ সালে The Decorator and Furnisher পত্রিকায় শিল্পী নেপোলিয়ন সারোনির একটি সাক্ষাৎকার গ্রহণ করা হয়েছিল। সেখানে তাঁকে প্রশ্ন করা হয়েছিল : নগ্নদেহের শস্নীল ও অশস্নীল উপস্থাপনের অর্থ আপনার কাছে কেমন? উত্তরে তিনি বলেছিলেন : ‘এটা একেবারেই ব্যক্তি অনুভূতির বিষয়।’ এই উত্তরকে পুরোপুরি মেনে নিলে সব দায় এসে পড়ে দর্শকের ওপর। তাহলে শিল্পীর উদ্দেশ্য, শিল্পদক্ষতা, নান্দনিক নিয়মকানুন – যা নিয়ে অনেক আলোচনা হয়েছে – গুরম্নত্বহীন হয়ে পড়ে।
শিল্পের নগ্নতা সম্পর্কে সবচেয়ে গুরম্নত্বপূর্ণ গ্রন্থটি লিখেছেন কেনেথ ক্লার্ক। The Nude শিরোনামের বইটিতে তিনি বলেছেন, ‘নগ্নতা শিল্পের বিষয় নয়, শিল্পের গড়ন’। এ নিয়েও বিসত্মর বিতর্ক রয়েছে, কিন্তু নগ্নশিল্পের মূল বিষয় এটা নয়। এর শস্নীল-অশস্নীলতা প্রসঙ্গই সবসময় মুখ্য আলোচনা বা বিতর্কের বিষয় হয়েছে। ক্লার্ক এ বিষয়ে মমত্মব্য করেছেন যে কোনো নগ্নদেহই একবারে কামোদ্দীপনা-বর্জিত নয়। শিল্পের সব শর্তপূরণ করে নির্মিত হলেও কামজ অনুভূতির জায়গাটি সবার জন্য একই রকমের নয়।
পরিশেষে বলতে হয় যে, নগ্নতা চিত্রায়ণে শিল্পীকে যথেষ্ট দায়িত্বশীলতার পরিচয় দিতে হবে। নগ্নতা চিত্রায়ণের উদ্দেশ্য কী? সৌন্দর্য নির্মাণ নাকি কামোদ্দীপনা জাগানো? একজনের কাছে যা শিল্প অন্যের কাছে তা অশস্নীল হতে পারে। শিল্পীর ক্ষেত্রে নগ্নশরীর চিত্রায়ণের উদ্দেশ্য হতে পারে খাঁটি সৌন্দর্য নির্মাণ বা শরীরের গড়ন তুলে ধরা, কিন্তু দর্শক তা অন্যভাবে গ্রহণ করতে পারেন। জগতের অনেক কিছুর মতোই ভালো উদ্দেশ্য নিয়ে নির্মিত বিষয় বাঁকা দৃষ্টিভঙ্গি বা গ্রহণের ভিন্ন দৃষ্টিকোণের কারণে খারাপ হয়ে দাঁড়ায়। শিল্পকর্মকে সঠিক প্রসঙ্গসূত্রে ও দর্শকের ভাবাবেগ অনুধাবন করে নির্মাণ করাটা শিল্পীর দায়িত্ববোধের মধ্যে পড়ে। শিল্পী দর্শকের অনুভূতির প্রতি সংবেদনশীল হবেন। যদি ছবির মাধ্যমে শিল্পী কাউকে বিপথে চালনা করেন তাহলে তা অপরাধ। কিন্তু এক্ষেত্রে শিল্পী কি এককভাবে দায়ী হতে পারেন? যদি দর্শক তাঁর নিজের দুর্বলতা সম্পর্কে আগে থেকেই অবগত থাকেন, তাহলে তিনি কী দেখবেন আর কী দেখবেন না সেটা তাঁকেই ঠিক করতে হবে। অনর্থক অন্যের শৈল্পিক আবেগ ও সংবেদনশীতাকে আক্রমণ না করাই সুবিবেচনার পরিচায়ক।