হেমা সিবানেসান
প্রিখ্যাত শিল্প-ইতিহাসবিদ ও চিত্রসমালোচক গীতা কাপুর (১৯৯৩) তাঁর ‘ভারতীয় শিল্পে মডার্নিজম কখন ছিল?’ শীর্ষক জ্ঞানগর্ভ রচনায় ভারতের মডার্নিজমকে সেকেলে আধুনিকতাবাদ এবং সেজন্যই তা পাশ্চাত্যের মডার্নিজম থেকে ভিন্নতর বলে বর্ণনা করেছেন। আমেরিকার উচ্চমার্গীয় মডার্নিজমের সঙ্গে ভারতীয় মডার্নিজমের বৈসাদৃশ্যের উলেস্নখ করে কাপুর পাশ্চাত্যের শিল্পীদের মধ্যে অবধারিতভাবে ‘নতুনত্বের মহিমা’ সন্ধানের প্রবণতার বিপরীতে ভারতীয় শিল্পীদের মধ্যে ইতিহাস ও সমাজের বিষয়গুলোর প্রতি পেছন ফিরে তাকানোর প্রবণতা চিহ্নিত করেছেন। অনুরূপভাবে ভারতের আধুনিক শিল্পীদের চিত্রধর্মিতা ও বর্ণনামূলক ঝোঁককে তিনি সাহসী রীতিনিষ্ঠতা, বিমূর্ততা ও চাক্ষুষ অনুভূতিগ্রাহ্যতার বৈশিষ্ট্যপূর্ণ আমেরিকার উচ্চমার্গীয় মডার্নিজম থেকে আলাদা করে দেখেছেন। গীতা কাপুরের যুক্তি, ভারতীয় মডার্নিজমের আশি বছরের সংক্ষিপ্ত ইতিহাস নিয়োজিত ছিল ‘কলুষতাবিদূরণ; … অতীত ও বর্তমানের কাজসমূহের সংকেত উদ্ধার ও ইহজাগতিকীকরণের কাজে’ (পৃ. ৩২৩), যা আবশ্যক ছিল জাতীয়তাবাদ প্রকল্পের জন্য। কাপুরের এই অনুধাবন নির্দেশ করে যে, ভারতে মডার্নিজমের ভিত নির্মাণের মূলে ছিল জাতিধারণার সম্প্রসারিত, উপনিবেশোত্তর বিবেচনা। আর সেটি ব্যষ্টিক ও সামষ্টিক আত্মপরিচয়কে পুনর্গঠন করেছে। তাঁর অনুধাবনের পূর্বানুমান হলো – ভারতে অর্থনৈতিক উদারীকরণের সঙ্গে সঙ্গে মডার্নিজমের অবসান ঘটবে। তবে তা সত্ত্বেও ভারতে মডার্নিজম যেভাবে আবির্ভূত হয়েছিল সে রূপটি দক্ষিণ এশিয়ায় অন্যান্য মডার্নিজমের যে বিকাশ ঘটেছে তার ভিত ও পরিপ্রেক্ষিত হিসেবে থেকে যাবে।
ভারতীয় উপমহাদেশে শিল্পকলার শব্দভা-ারে ‘মডার্নিজম’ শব্দটি এসেছে মোগল শাসন অবসানের পর, যা আবার শিল্পকলায় পৃষ্ঠপোষকতার নতুন একটি পর্যায়কে স্থায়ী করে দিয়েছে। ব্রিটিশ শাসকদের রাজনৈতিক প্রভাব বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে ভারতের ক্ষমতাসীন পৃষ্ঠপোষক শ্রেণি তাদের রম্নচিকে ব্রিটিশদের সঙ্গে খাপ খাইয়ে নিতে চেয়েছিল। এর ফলে ঐতিহ্যবাহী দরবারি শিল্পকলা ও শিল্পশালার অবসান সূচিত হয় এবং এভাবে ক্ষমতার পালাবদল ঘটায় নিজেদের শিল্পের শৈলীও ব্রিটিশদের সঙ্গে খাপ খাইয়ে নিতে হয় দরবারের শিল্পীদের। উনিশ শতকের মাঝামাঝি শিল্পীদের বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে প্রায়োগিক ও শিল্পকৌশলগত প্রশিক্ষণ দেওয়ার জন্য ব্রিটিশরা কলকাতা, বম্বে, লাহোর ইত্যাদি স্থানে চারম্নকলা বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করে। এসব বিদ্যালয় ওইসব অঞ্চলের ঐতিহ্যবাহী শিল্পকলার শিক্ষক এবং শিক্ষানবিশ ও গিল্ড তথা যৌথ সংস্থাভিত্তিক পদ্ধতিকে হটিয়ে দেয়। এছাড়া ঐতিহ্যগত চিত্রশিল্পের চর্চা, কৌশল ও রীতির অবসান ঘটাতেও পুরোপুরি অবদান রাখে। ভারতীয় শিল্পকলার শব্দভা-ারে রিয়ালিজম ও ন্যাচারালিজমের ব্রিটিশ অ্যাকাডেমিক শিল্পরীতির মাধ্যমে যেমন নতুন শব্দ যোগ হয়েছে, তেমনি তা ভারতীয় শিল্পরম্নচিতেও পরিবর্তন ঘটিয়েছে। রাজা রবি বর্মার মতো শিল্পীদের মাধ্যমে এসব শিল্পরীতি জনপ্রিয়তা পেয়েছে এবং যান্ত্রিকভাবে পুনরম্নৎপাদিত প্রিন্টের মাধ্যমে ব্যাপকভাবে প্রচারিত হয়েছে। অন্যদিকে ব্রিটিশ শাসনের বিরম্নদ্ধে ক্রমশ বেড়ে উঠতে থাকা আন্দোলনের পরিপ্রেক্ষিতে আত্মপ্রকাশ ও স্বাধিকারের তাগিদ থেকে এবং নতুন ভারতীয় আত্মপরিচয় প্রকাশের জন্য এই নতুন শব্দ আপন রূপ পরিগ্রহ করেছে।
ভারতীয় শিল্পে আধুনিক ভাষার বিকাশ ঘটেছে ভারতীয় এলিট শ্রেণি ও মধ্যবিত্ত শ্রেণির মধ্যে সৃষ্ট নতুন ধরনের পৃষ্ঠপোষকদের সমর্থনের দ্বারা আর এদের সঙ্গে যুক্ত হয়েছিলেন সহানুভূতিশীল ব্রিটিশ অফিসার ও প্রশাসকগণ। দৃষ্টামত্ম হিসেবে এই নতুন শৈলীর বিকাশে একজন গুরম্নত্বপূর্ণ সমর্থক ছিলেন ই বি হ্যাভেল। এর ফলে প্রথমদিকের অ্যাকাডেমিক চর্চার ভিত তৈরি হয় মোগল মিনিয়েচার চিত্রের পুনরম্নজ্জীবন থেকে পাওয়া ভারতীয় নন্দনতাত্ত্বিকতাকে উৎসাহ প্রদানের মাধ্যমে। এর ফলে অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর, ক্ষিতীন্দ্রনাথ মজুমদার ও দেবীপ্রসাদ রায়চৌধুরী প্রমুখসহ প্রখ্যাত প্রবক্তাদের সমবায়ে সৃষ্ট বেঙ্গল স্কুলের অভ্যুদয় ঘটে। এঁরা বাংলার গ্রামজীবনের আদর্শীকৃত সারল্যে শিল্পের প্রণোদনা খোঁজার কাজে ব্রতী হয়েছিলেন। [তাঁরা এঁকেছিলেন বিবরণধর্মী ছবি।] শিল্প ইতিহাসবিদ পার্থ মিত্র বেঙ্গল স্কুলের শিল্পীদের এই প্রবণতার নাম দিয়েছেন ‘নবগ্রামীণতা’, যা ঔপনিবেশিক শাসন ও পশ্চিমা আধুনিকতার প্রতিষেধক হিসেবে দাঁড়াতে পেরেছিল। এই ‘নবগ্রামীণতা’কে শৈলী ও আকাঙ্ক্ষার দিক থেকে রোমান্টিক ও প্রাচ্যদেশীয় নামে অভিহিত করা যেতে পারে, তবে এর সঙ্গে মিল ছিল বিকাশমান জাতীয়তাবাদের এবং তার যোগ ছিল গ্রামকে স্বয়ংসম্পূর্ণতার রূপকল্প হিসেবে প্রচারিত মহাত্মা গান্ধীর আদর্শের সঙ্গে। স্বরাজের মডেল হিসেবে উপনিবেশবিরোধী ভূমিকা পালনে একটি অবস্থান নেয় এই নবগ্রামীণতাবাদ। দক্ষিণ এশিয়ার সেই সময়কার চিত্রকলায় এ বিষয়টিই বারবার ও স্থায়ীভাবে বিষয়বস্ত্ত হিসেবে উঠে এসেছে।
ঔপনিবেশিক শাসনের নিপীড়ন এবং তা থেকে মুক্ত এক ‘অকৃত্রিম’ ভারতীয় জীবনের পরাদৃষ্টির উদ্গাতা ছিলেন বেঙ্গল স্কুলের শিল্পীরা। তবে শিল্পকলার ইতিহাসবিদ আর শিবকুমার এই অভিমত ব্যক্ত করেছেন যে, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, নন্দলাল বসু, রামকিঙ্কর বেইজ ও বিনোদবিহারী মুখোপাধ্যায়কে নিয়ে গঠিত শামিত্মনিকেতন আন্দোলনই প্রথম সচেতনভাবে শিল্পে পাশ্চাত্য মডার্নিজমের সাম্রাজ্যবাদকে চ্যালেঞ্জ জানিয়েছিল। তাঁরা তাঁদের শিল্পরীতিকে আধুনিকতাবাদবিরোধী কিন্তু আধুনিক অভিজ্ঞতার এক বিকল্প রীতির সংজ্ঞারূপে নিজস্বতাপূর্ণ আধুনিকতাবাদী শিল্পকর্ম বলে বিবেচনা করতেন। এই প্রতি-আধুনিকতা (আধুনিকতার প্রতিরোধ বা বিরোধিতা) সহযাত্রী ছিল অন্য, বিশেষত ইউরোপের সমালোচনামূলক আধুনিকতাসমূহের। পার্থ মিত্রের যুক্তি হলো, শিল্পকলার স্কুল বোহোসের আধুনিকতার প্রতি ওয়ালটার গ্রোপিয়াসের মতাদর্শিক দৃষ্টি জাতীয় চেতনা দ্বারা পরিচালিত ও সৃষ্টিশীল, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের একটি সমন্বিত জীবনযাপনের শিক্ষামূলক ও সামাজিক ধারণায় যা ফুটে উঠেছে। মিত্র মমত্মব্য করেন – ‘১৯২১ সালে লেখা একটি চিঠিতে শিল্পী অসকার শেস্নমার শিল্প-আন্দোলন বোহোসে দুটি আলাদা মতাদর্শের অসিত্মত্বের উলেস্নখ করেন, যেটি আদিমতাবাদের এমন একটি রূপ সেখানে প্রগতি ও প্রযুক্তির অঙ্গীকারের বিপরীতে প্রাচ্যের আধ্যাত্মিক প্রেরণা গ্রহণ করা হয়েছে।’ মিত্র বলেন, ইউরোপীয় শিল্পকলায় মডার্নিজমের ফরম বা প্রকারগুলো প্রাচ্যের চিমত্মাধারা দ্বারা প্রভাবিত, বিশেষত পাশ্চাত্যের মডার্নিজমের ওপর হিন্দু ও বৌদ্ধ দার্শনিক ধারণাগুলো ব্যাপক প্রভাব ফেলেছে। এমনটি ঘটেছে পাশ্চাত্যের আধুনিকতার সংকট দূর করার জন্য নতুন উপায় ও মতাদর্শ প্রতিষ্ঠার জন্যই। মিত্র যুক্তি দিয়ে আরো বলেন যে, এই সমালোচনামূলক আধুনিকতা কেবল পাশ্চাত্য থেকে অন্যান্য সংস্কৃতিতে মতাদর্শিক প্রবাহের একমুখী স্রোত ছিল না, বরং তা ছিল একটি বহুপার্শ্বিক, বিভিন্ন জাতিক ও পারস্পরিক ভাববিনিময়মূলক একটি প্রবাহ, যা আবার আধুনিকতার প্রতি বাঙালির দৃষ্টিভঙ্গি বা মতাদর্শগুলোকেও রূপায়িত করেছে। (পৃ. ১২) এর ফলে ভারতে আধুনিকতাবাদ বিকাশ লাভ করেছিল বহুবিধ ও আংশিকভাবে সমাপতিত বিষয়াবলির এক জটিল বিবেচনা হিসেবে, যা ছিল উপনিবেশ ও বস্ত্তবাদবিরোধী এক নয়া ঐতিহাসিক ও মতাদর্শিক মুহূর্তের সংজ্ঞা নির্মাণের প্রয়াস এবং তার প্রসারমাণ জাতীয়তাবাদের ভেতরে সামষ্টিক আত্মপরিচয়ের একটি বোধকেও নতুন করে জাগিয়ে তুলেছিল।
দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় চিত্রকলার মডার্নিজমের ইতিহাস অতএব অগ্রসর হয়েছে ইতিহাসের সঙ্গে সম্পর্ক রেখে, প্রাথমিকভাবে যার কেন্দ্র ছিল বাংলা। এটি উপনিবেশবাদের প্রতিরোধ তথা আসন্ন জাতীয়তাবাদের দ্বারা সৃষ্ট গতির প্রক্রিয়ার রূপরেখা তুলে ধরে এবং এতে যুক্ত হয়েছিল বস্ত্তবাদবিরোধী ও বহুজাতিক বিবেচনাসমূহ। এসব অবস্থা এটাই বলে দেয় যে, মডার্নিজম হচ্ছে বিষয়কেন্দ্রিক স্বকীয় সত্তা এবং স্থান, ইতিহাস ও সমাজের মধ্যকার সম্পর্কের পরীক্ষা ও পুনঃপরীক্ষার প্রক্রিয়া, যা বিশ্বের সঙ্গে একটি নতুন সম্পর্কের প্রয়োজনীয়তাকেই স্বীকার করে।
২
ইফতেখার দাদি (২০১০) যুক্তি দেখিয়েছেন, পাকিসত্মানে শিল্পীরা জাতিগঠনে পাকিসত্মানি অভিজ্ঞতার যে বৈশিষ্ট্য সেই দুর্বোধ্যতা ও অস্পষ্টতায় সদাসতর্ক বলেই পাকিসত্মানি জাতীয়তাবাদের পর্যালোচনা থেকে দূরত্বমূলক অবস্থান গ্রহণ করেছেন। এর পরিবর্তে তাঁরা স্বকীয় সত্তা, সমাজ, ইতিহাস ও মুসলিম আত্মপরিচয়ের মধ্যকার জটিল ও আত্মগত সম্পর্কগুলো খুঁজতে থাকা একটি নতুন জাতিরাষ্ট্রের আধুনিকতামূলক শর্তগুলোর মধ্যে শিল্পের প্রতি একটি দৃষ্টিভঙ্গি তৈরি করে নিয়েছেন। দাদি যুক্তি দেখিয়ে উলেস্নখ করেছেন, যে সুস্পষ্ট প্রবণতা পাকিসত্মানের আধুনিকতাকে এশিয়ার অন্যান্য দেশের আধুনিকতাসমূহ থেকে আলাদা করে দিয়েছে তা হলো ইসলামি সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যসমূহের পরিপ্রেক্ষিতে পাকিসত্মানি আত্মপরিচয়ের সংজ্ঞা দেওয়ার জন্য ক্যালিগ্রাফি, মিনিয়েচার, অলংকরণ ও স্থাপত্যশিল্পের মতো ঐতিহ্যবাহী ইসলামি শিল্পরীতিসমূহের বিচারমূলক পুনঃপ্রয়োগ। দাদি জাতিত্বের শ্রেণিবিভাগে আয়েশি অবস্থানে (এবং যুক্তি হিসেবে আরো বলা যায়, সাম্প্রদায়িক) পাকিসত্মানি শিল্পীদের মধ্যে অনিচ্ছার ওপর জোর দেন। এ ধরনের জাতীয়তাবাদের ধারণা সম্পর্কে নিশ্চিত শ্রেণিবিভাগ (সামাজিক, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও নৃতাত্ত্বিক) আবশ্যকীয় গণ্য করে; কিন্তু তা দেশবিভাগোত্তর ও ঔপনিবেশিক সময়োত্তর মুসলিম অভিজ্ঞতার নানা জটিলতার সুরাহা করতে পারেনি।
পাকিসত্মানের প্রথমদিকের আধুনিকতাবাদী শিল্পীদের পূর্বধারণা ছিল বস্ত্তত শিল্পে ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতাকে অগ্রাধিকার দেওয়া এবং শৈল্পিক আত্মগততার বিকাশ ঘটানো। বিভিন্ন ধরনের সামাজিক, সাংস্কৃতিক, লৈঙ্গিক, আমত্মর্জাতীয়, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ইত্যাদি বেশকিছু গুরম্নত্বপূর্ণ বিষয়, যা দক্ষিণ এশীয় মুসলিম পরিচয়কে আরো জটিল করতে সাহায্য করে, শনাক্ত করা ও দৃশ্য করার প্রক্রিয়ার জন্য এই আত্মগত প্রকাশের বিকাশ ঘটানোর প্রয়োজন ছিল। এই বিবেচনা থেকে দেখলে পাকিসত্মানে আধুনিকতাবাদী শিল্পপ্রক্রিয়া পাকিসত্মানি জাতিত্বকে যেসব শর্ত দ্বারা সংজ্ঞায়িত করা যেতে পারে তথা পাকিসত্মানি সংস্কৃতির বৈশিষ্ট্যসূচক বহুবিধ, যুগপৎ ও ধারাবাহিকতাহীন প্রভাবকে প্রতিরোধ না করলেও অবশ্যই কিছুটা প্রশ্নবিদ্ধ করেছে।
দৃষ্টামত্ম হিসেবে, ১৯৪৯ সালে জুবাইদা আগা নবগঠিত পাকিসত্মানে প্রথম একটি চিত্রপ্রদর্শনীর আয়োজন করেন। তাঁর এই প্রদর্শনী ছিল প্রবলভাবে বিতর্কিত, কিন্তু তিনি ছিলেন সাহসী ও বেপরোয়া। জুবাইদার চিত্রকর্মে অমৃতা শেরগিল এবং যামিনী রায়ের মতো শিল্পীদের কাজের প্রভাব ছিল, যেহেতু তাঁরা ছিলেন ইতালীয় ফিউচারিজম (ভবিষ্যবাদ) ও রম্নশি কনস্ট্রাক্টিভিজম (নির্মাণবাদ) দ্বারা প্রভাবিত। তাঁর কাজ ছিল বিশেষভাবে বিমূর্ত প্রকৃতির, রংবাদী (colourist), সাহসী এবং বাসত্মবিকপক্ষে সিম্ফনিধর্মী, যেহেতু সেগুলো ছিল আত্মগত নিজস্বতা ও পরিবর্তনশীল বিশ্বের মধ্যকার সম্পর্কের দার্শনিক অনুসন্ধান। তাঁর চিত্রকর্মে ব্যক্তিগত পুরম্নত্বের ওপর আধিক্য থাকলেও প্রসঙ্গের বহুবিধ পারিপার্শ্বিকতা গ্রহণের ক্ষমতাও তাতে ছিল। যামিনী রায় বা অমৃতা শেরগিলের ক্ষেত্রে যেমন ছিল, তেমনভাবে জাতীয় অথবা সামাজিক ধারণার ভিত্তিতে আগার কাজ সহজে অবধারণযোগ্য ছিল না। আবার মুসলিম পরিচয়ের পরকলার মাধ্যমে তা সহজে পাঠযোগ্যও নয়। পারিপার্শ্বিক অবস্থা ও প্রভাব সত্ত্বেও জুবাইদা আগা বরং তাঁর ব্যক্তিগত শৈল্পিক ভাষা ও নানা বৈসাদৃশ্য নিয়ে গঠিত আধুনিকতার সম্পর্কের ওপর বেশি জোর দিয়েছেন। শিল্প হলো একামত্ম ব্যক্তিগত, একক ও আত্মগত আত্মপ্রকাশ – এরূপ ধারণার ওপরই প্রাধান্য আরোপ করেছেন তিনি।
আমরা এখন যে পুরোপুরি আধুনিকায়িত সংস্কৃতির মধ্যে বসবাস করি সেই পরিপ্রেক্ষিতে, পৃষ্ঠপোষকতা (অর্থ প্রদানকারী পৃষ্ঠপোষককে সন্তুষ্ট করার জন্য উৎপাদন) থেকে সৃষ্টিশীল ও আত্মগত আত্মপ্রকাশে শৈল্পিক উৎপাদনের এই সরণের গুরম্নত্ব দক্ষিণ এশিয়ায় শিল্পের অর্থ, ভূমিকা ও ক্রয়ের ক্ষেত্রে এক প্রবল পরিবর্তন নির্দেশ করে। উনিশ শতকে মোগল সাম্রাজ্যের পতনের আগে পর্যমত্ম শিল্পসৃষ্টিতে ব্যক্তিগত আত্মপ্রকাশের কোনো স্থান ছিল না, এবং বিভিন্ন সম্রাট, রাজা ও প্রাদেশিক কর্তাদের দরবারের জন্য যেসব শিল্পী ছবি এঁকেছেন তাঁদের ব্যক্তিগত জীবন সম্পর্কে খুব কমই জানা যায় অথবা কিছু লেখা রয়েছে। পৃষ্ঠপোষকের আগ্রহ ও ইচ্ছাপূরণে শিল্পীরা গিল্ড পদ্ধতির মতো উপায়ে ওয়ার্কশপে সম্মিলিতভাবে ছবি অাঁকতেন। অঙ্কিত চিত্র এবং অধিকাংশ দর্শনযোগ্য শিল্পকর্মের সঙ্গে মূর্তিনির্মাণ রীতিসমূহের মিল থাকত। আর কাজের গুণগত বিচার হতো কারিগরি দক্ষতা ও খুঁটিনাটি বিষয়গুলোর প্রতি মনোযোগ দেওয়ার ওপর অর্থাৎ অত্যমত্ম রীতিবদ্ধ নান্দনিক প্রচলনসমূহের ভিত্তিতে।
মডার্নিজম অবশ্য এইসব ধ্যান-ধারণা থেকে মৌলিকভাবে আলাদা। এক্ষেত্রে শিল্পী হচ্ছেন একটি চিত্রকর্মের এবং সে চিত্রকর্ম অনুধাবনের শর্তসমূহের সৃষ্টিশীল ও একক স্রষ্টা। অতএব একটি চিত্রকর্মের সাফল্য বিচার্য সেই শিল্পীর ইচ্ছা, তাঁর অনন্য পরাদৃষ্টি এবং বিশ্বজগতের প্রতি তাঁর একক সাড়ার ওপর। দক্ষিণ এশিয়ায় শিল্পীর এই দৃষ্টিভঙ্গি কেবল একটি সাংস্কৃতিক সরণের বিষয় ছিল না, এটা ছিল সমাজে শিল্প, শিল্পী ও একক ব্যক্তিসত্তার অবস্থানগত মর্যাদার ক্ষেত্রে সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গি পরিবর্তনেরও একটি বিষয়। এই সত্যটি স্বীকার করা হলে বুঝতে পারা সম্ভব হবে কেন জুবাইদা আগার মতো একজন শিল্পী, যিনি রক্ষণশীল আবহের মধ্যে কাজ করেছেন, মৌলিক ও বিতর্কিত বলে গণ্য হতে পারতেন। এবং আরো বোঝা সম্ভব, কেন আধুনিক শিল্পীদের পরবর্তী প্রজন্মকে পথ দেখানোর জন্য ব্যক্তিকেন্দ্রিক শৈল্পিক প্রকাশের প্রতি তাঁর অঙ্গীকার গুরম্নত্বপূর্ণ।
১৯৬০-এর দশকের মধ্যেই ইসলামি শিল্পকলার সূত্রাবলির আনুষ্ঠানিক পুনরানুসন্ধানের ক্ষেত্র হিসেবে পাকিসত্মানে আধুনিকতাবাদী চিত্রকলা সুপ্রতিষ্ঠা অর্জন করে। দৃষ্টামত্মস্বরূপ, ক্যালিগ্রাফি উলেস্নখযোগ্য মনোযোগ আকর্ষণ করে এবং শিল্পী সাদেকীনকে উপযোগীকরণ ও রূপামত্মরণ প্রক্রিয়ার মাধ্যমে আধুনিক ইসলামি রীতি হিসেবে ক্যালিগ্রাফিকে জনপ্রিয় করার কৃতিত্ব দেওয়া হয়। পরবর্তীকালে সেটি প্রকাশরীতির দিক থেকে গুলগি (আধুনিকতাবাদী; ইতিহাসে পুনরোপযোগিতা ও পুনরোদ্দীপ্তায়নের প্রতি প্রবণতা হিসেবে ইত্যাদি)।
অবশ্য চিত্রশিল্পী জহুর উল আখলাক মডার্নিজমকে দেখেছেন ইতিহাস ও ইসলামি আত্মপরিচয়ের প্রশ্নাবলির প্রতি আরো বেশি ধারণামূলক ও গভীর সমালোচনামূলক অনুসন্ধানের ক্ষেত্র হিসেবে। তাঁর শুরম্নর দিকের গড়ে ওঠা চিত্রকর্মে দেখা গেছে, তিনি ক্যালিগ্রাফির রেখার সঙ্গে হালকা ও গাঢ় উভয় প্রকার রং ব্যবহার করেছেন। ক্যালিগ্রাফির প্রতি তাঁর আগ্রহ ও শ্রদ্ধাবোধ তৈরি হয়েছিল অল্প বয়সেই এবং তা আরো জোরালো হয় জ্যেষ্ঠ চিত্রশিল্পী শাকির আলির সঙ্গে সম্পর্কের মাধ্যমে। এমনকি প্রথমদিকের এসব চিত্রকর্মেও দেখা গেছে আধুনিকতাবাদী বিমূর্ততা এবং ইসলামি শিল্পকলার বিভিন্ন দিক, প্রচলিত রীতি ও নান্দনিকতার মধ্যে সম্ভাব্য টানাপড়েন ও সম্পর্ক অনুসন্ধানের প্রতি তাঁর আগ্রহ। পরবর্তীকালের চিত্রকর্ম ও ছাপার কাজগুলোতে আখলাক পা-ুলিপির পৃষ্ঠা, মোগল উদ্যান ও ইসলামি রাজদরবারগুলোর বৈসাদৃশ্যকে মূর্তিনির্মাণ শিল্পের দৃষ্টামত্ম হিসেবে বিবেচনা করে গ্রিড, জ্যামিতি ও স্থানিক শৃঙ্খলার ইসলামি দৃষ্টিভঙ্গি সন্ধান করেছেন। অন্যান্য কাজে তিনি মিনিয়েচার চিত্রকলার প্রতি বিশেষ মনোযোগ প্রদর্শন করে চিত্রলিখন পদ্ধতি ও চিত্রবিন্যাসের রীতিসমূহ বিবেচনা করেছেন। পরবর্তী পর্যায়ে সমকালীন চিত্রকলার অঙ্কনকৌশল হিসেবে মিনিয়েচারের রূপামত্মরকে উৎসাহ ও সমর্থন জুগিয়েছেন।
মোগল মিনিয়েচার-শৈলীর সঙ্গে আখলাকের সম্পৃক্ততার একটি দৃষ্টামত্ম শাহজাহানের অশ্বারূঢ় তিন পুত্রের একটি সপ্তদশ শতাব্দের চিত্রের ভিত্তিতে অাঁকা চিত্র ‘দ্য থ্রি রাইডার্স’। আখলাকের এই কাজের ভিন্ন ভিন্ন রূপের মধ্যে মোগল যুগের চিত্রকলার বিশেস্নষণ ধরা পড়েছে, যা একটি হারানো ইতিহাস পুনরম্নদ্ধার প্রয়াসের সঙ্গে সঙ্গে নতুন এক মুহূর্তের শর্তাবলি যোজনার কাজও বটে। আখলাকের জীবনীকার Roger Connah লিখেছেন, ‘ইতিহাস পুনরম্নদ্ধার কীভাবে এর প্রতিস্থাপন দ্বারা সিদ্ধ হতে পারে আখলাক তার পথ দেখিয়েছেন। এখানে একটি অস্থির ও বিশ্বাসঘাতক ইতিহাস অস্থিরভাবে রূপামত্মরিত হতে থাকে মূল কাজের সঙ্গে শিল্পী তাঁর সম্পর্ককে যেভাবে রূপামত্মরিত করেন সেভাবে।’ একটি ঐতিহাসিক জাতীয় স্মৃতি পুনরম্নদ্ধারের অসম্ভাব্যতা এবং দেশবিভাগোত্তর দক্ষিণ এশিয়ায় একজন মুসলিম হিসেবে নিজেকে চিহ্নিত করার সমস্যা নিয়ে আখলাক ব্যাপৃত থাকেন।
৩
দক্ষিণ এশিয়াজুড়ে সাম্রাজ্য ও তাদের অপরিহার্য পতনের মাধ্যমে যে বিশাল ও গভীর সামাজিক এবং সাংস্কৃতিক বিচ্ছেদ সৃষ্টি হয়েছে তার দ্বারাই মডার্নিজম অনন্যভাবে প্রতিস্থাপিত হয়েছে। ঔপনিবেশিক শাসন থেকে ভারতের স্বাধীনতা অর্জনের পরিপ্রেক্ষিতে উপমহাদেশ বিভাজিত সার্বভৌম জাতি হিসেবে পুনর্গঠিত হওয়ার ফলে আধুনিকতা প্রকাশের রকমফের এবং নানা ধরনের অভিজ্ঞতার মুখোমুখি হয়েছে। দেশভাগের কারণে আঞ্চলিক বৈশিষ্ট্যের ভিন্নতা কিংবা নিজস্ব পরিচয় শনাক্তকরণ জরম্নরি হয়ে পড়েছিল : বিভিন্ন জাতীয়তাবাদী প্রকল্প আরো জোরদার করার জন্য নতুন সামষ্টিক ও সাম্প্রদায়িক জোট গঠন। বলা যায়, ঔপনিবেশিক শাসন অবসান হওয়ার প্রক্রিয়া ছিল নতুন সত্তা তৈরির প্রক্রিয়া এবং এজন্য দরকার হয়েছিল একদা একীভূত সংস্কৃতিসমূহের নিজেদেরকে পুনরাবিষ্কার করা, বিশ্ব এবং পারস্পরিক সম্পর্কের পরিপ্রেক্ষিতে। সেজন্য দক্ষিণ এশিয়ায় আধুনিকতার ধারণা আসলে সামাজিক রূপামত্মরের প্রক্রিয়া আর সেজন্যই তা সুগভীর রাজনৈতিক অভ্যুত্থানের ফল হিসেবে সামাজিক স্ব-রূপামত্মরণ।
বাংলাদেশে ঔপনিবেশিক শাসন অবসানের পর চিত্রশিল্পে সামাজিক ও রাজনৈতিক পরিচয়ের শর্তাবলি পুনঃসংজ্ঞায়িত করার সুযোগ ব্যক্ত করেছিলেন পরাদৃষ্টিসম্পন্ন শিল্পী ও প্রশাসক জয়নুল আবেদিন। আবেদিন কলকাতার সরকারি আর্ট স্কুলে পড়াশোনা শেষ করেন এবং দেশভাগের প্রাক্কালে ঢাকায় ফিরে আসেন। তাঁর প্রথমদিকের কাজগুলো তিনি করেন বেঙ্গল স্কুলের মূল্যবোধ ও আদর্শের ধরনে, বিশেষত ‘নবগ্রামীণতা’র আদর্শের প্রভাব সেগুলোতে চোখে পড়ে। কলকাতায় থাকাকালে ‘হার্ভেস্টিং’ (১৯৩৮) শিরোনামের একটি তৈলচিত্র তিনি আঁকেন, সেখানে তিনি চিত্রিত করেছেন আদর্শ সামাজিক শৃঙ্খলার প্রতিফলনমূলক গ্রামজীবন। তিনি ঔপনিবেশিক পুঁজিবাদের বাঙালি কৃষকদের ওপর শোষণ ও অত্যাচারের তিক্ততাকে উপেক্ষা করে আদর্শায়িত কৃষকজীবন বর্ণনার মাধ্যমে গ্রামের সরলতা, উৎপাদনশীলতা ও অংশীদারিত্বমূলক শ্রমের চিত্র এঁকেছেন। এই সময়ের চিত্রাবলি ও ড্রইংয়ে জয়নুল পূর্ব বাংলার গ্রামীণ ইতিহাস ও সংস্কৃতিকে সত্য প্রতিপন্ন করার প্রয়াস পেয়েছেন, যা ছিল শহুরে জীবনের নির্যাতনমূলকতার বিপরীত চিত্র।
সমাজ ও ভূমির মধ্যকার সম্পর্কের রূপ মূর্তকারী ও পশ্চিমা বস্ত্তবাদ প্রত্যাখ্যানকারী সাঁওতাল আদিবাসীদের জীবনযাত্রা ফুটিয়ে তোলার মাধ্যমে জয়নুল গ্রামজীবনের দুঃসাহসিকতা আরো জোরালোভাবে তুলে ধরেন। পার্থ মিত্র বলেন, উনিশ শতকের শেষ দিকে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ও শামিত্মনিকেতনসহ কলকাতার জাতীয়তাবাদী শিল্পীরা সাঁওতালদের জীবনচিত্র অঙ্কন করেছেন ‘ঔপনিবেশিক শহুরে সভ্যতার ফাঁদ প্রত্যাখ্যানকারী’ মানুষ হিসেবে এবং তাঁদের ছবিতে মূর্ত হয়েছে ‘প্রকৃত’ ভারতীয় জীবনচিত্রের প্রকাশ (পৃ. ২৯-৩১)। কলকাতায় থাকাকালে জয়নুল আবেদিন জলরঙে দুমকা গ্রামের একগুচ্ছ ছবি অাঁকেন। এসব ছবি ও জলরঙের কাজ তাঁর কলকাতার ‘টি-স্টল’ চিত্রটি থেকে আলাদা। কলকাতাকেন্দ্রিক ছবিগুলোতে শহুরে জীবনের নিপীড়নভাব এঁকেছেন, যা চূড়ামত্ম রূপ পেয়েছে ১৯৪৩ সালের দুর্ভিক্ষ নিয়ে অাঁকা তাঁর বিখ্যাত ড্রইংগুলোতে।
আবেদিনের প্রথম জীবনের চিত্রকর্মে বাঙালি জাতীয়তাবাদের প্রভাব দেখা গেলেও দেশভাগের পর পূর্ব বাংলা পশ্চিম পাকিসত্মানের সঙ্গে যুক্ত হয়ে গেলে আবেদিনের চিত্রকর্ম ও ড্রইং প্রায়শ সম্পর্কিত হয়ে পড়ে জাতিগঠন প্রকল্পের সঙ্গে। তাঁর কাজে সমাজতান্ত্রিক মূল্যবোধের সঙ্গে সম্পৃক্ততা দেখা গেছে। তাতে রূপায়িত হয়েছে কৃষকদের সম্মিলিত শ্রম এবং তার মর্মে রয়েছে বাঙালির লোকশিল্পের নান্দনিকতা। আবেদিনের চিত্রকর্ম পশ্চিম পাকিসত্মানের আধুনিক শিল্পের প্রবণতাসমূহ থেকে সুস্পষ্টরূপে ভিন্ন ছিল। পশ্চিম পাকিসত্মানে গুরম্নত্ব পেয়েছিল বিশেষভাবে রাজনীতিবিমুখ ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যের প্রকাশ এবং প্রায়শ এর সূত্র থাকত মোগল ও ইসলামি চিত্রকলা। জয়নুলের লক্ষ্য ছিল সামষ্টিক মূল্যবোধকে প্রাধান্য দেওয়া, তাঁর দৃষ্টিভঙ্গি ছিল ধর্মনিরপেক্ষ এবং তাঁর মধ্যে আরো ছিল জাতিগঠনের নতুন প্রেক্ষাপটে একজন প্রশাসকের ভূমিকা। দাদি উলেস্নখ করেছেন, বাংলার পলিস্ন-ভূদৃশ্যের অমত্মর্গত চেতনায় তাঁর ‘জাতীয়’ ধারণা ছিল চিত্রকর্মের বিষয় এবং এই মনোভাবই তাঁকে পশ্চিম পাকিসত্মানি শিল্পীদের থেকে আলাদা করে দিয়েছিল। দাদির ভাষায় – ‘একটি আঞ্চলিক ও উপজাতিক নান্দনিকতা সৃষ্টি দ্বারা শিল্পীর কাজ পশ্চিম পাকিসত্মানি আধিপত্যের বিরম্নদ্ধে প্রতিরোধ সৃষ্টি করেছিল …’ এবং তার ভেতরে ছিল জন্মভূমির প্রতি আনুগত্য ও অঙ্গীকারের আবেগময় অনুভূতি।
১৯৫০ সালের দিক থেকে জয়নুল আবেদিন রম্নশ গ্রাফিক ছবির অনুসরণে বাসত্মববাদী চিত্রকর্ম শুরম্ন করেন। তাঁর এসব ছবিতে ছিল গ্রামীণ শ্রমজীবীদের শক্তির ওপর সমাজতান্ত্রিক আস্থার ছাপ যেখানে বর্ণিত হয়েছে গ্রামীণ শ্রমের আধুনিকায়ন ও রূপামত্মরের মাধ্যমে আধুনিকতায় উত্তরণের বিষয়। তাঁর ‘অন দ্য ওয়ে টু ওয়ার্ক’ (১৯৫০) ও ‘ডিগনিটি অফ লেবার’ (১৯৫০) কাজ দুটিতে রেখা ও রঙের ব্যবহার ছিল এলোমেলো ও অস্থির, তবে তাতে ছিল অগ্রযাত্রা, অগ্রগতি ও লক্ষ্যের স্থিরতা। দেহাবয়বগুলো অাঁকা হয়েছে মুখের বৈশিষ্ট্য ছাড়াই এবং সেজন্য একটির সঙ্গে অন্যটির কোনো প্রভেদ নেই। অবশ্য এসবের একটি প্রতীকী অর্থ রয়েছে। ১৯৫৯ সালে জয়নুল আবেদিন ‘দ্য স্ট্রাগল’ নামে বিখ্যাত একটি ছবি অাঁকেন। ছবিটিতে দেখা যাচ্ছে, এক লোক ও একটি মহিষ ভারী বোঝাসহ একটি গাড়ি সামনের দিকে নেওয়ার জন্য তাদের শারীরিক শক্তি প্রয়োগ করছে। শ্রমজীবী সাধারণ মানুষের শ্রমলগ্নতার ছবি এঁকে তিনি তাঁর জাতিগঠন প্রকল্পটি চিত্রায়িত করেন। এসব ছবিতে কৃষক-শ্রমিককে দেখানো হয়েছে নায়ক হিসেবে পরিবর্তনের সক্রিয় উপাদানরূপে, যা জাতিগঠন প্রকল্পের জন্য অত্যাবশ্যক।
১৯৬৯ সালে আবেদিন তাঁর বিখ্যাত ‘নবান্ন’ স্ক্রলটি আঁকেন। এতে তিনি বিভিন্ন পর্যায়ে প্রাচুর্য, ক্রমবর্ধমান ধনক্ষয় ও সবশেষে দারিদ্রে্যর মাধ্যমে বাংলার গ্রামজীবন তুলে ধরেন। ১৯৭০ সালের ফেব্রম্নয়ারি মাসে তিনি অসহযোগ আন্দোলনের প্রতি সহানুভূতি এবং পশ্চিম পাকিসত্মানে অবস্থিত পাকিসত্মান সরকার কর্তৃক পূর্ব বাংলা/পূর্ব পাকিসত্মানের প্রতি বঞ্চনা ও নিপীড়নের প্রতিবাদের প্রকাশ হিসেবে নবান্ন প্রদর্শনীর আয়োজন করেছিলেন। পূর্ব বাংলার কৃষিভিত্তিক ইতিহাসের প্রতি একাত্মতা প্রকাশের জন্য পশ্চিম পাকিসত্মানি নির্যাতনের বিরম্নদ্ধে রাজনৈতিক আন্দোলন সংগঠিত করার এই সংক্ষুব্ধ সময়ে তিনি তাঁর ছবির দর্শকদের স্ক্রলের ওপর নিজ নিজ স্বাক্ষর প্রদান করতে উৎসাহিত করেন। আবেদিনের এই নবান্ন স্ক্রলের কাঠামো, বিষয়ভাবনা ও রাজনৈতিক অভিপ্রায় মনে করিয়ে দেয় ১৯৩১ সালে নিউইয়র্কের মিউজিয়াম অফ মডার্ন আর্টের জন্য সৃষ্ট দিয়েগো রিভেরার বহনযোগ্য ম্যুরালের কথা, যেখানে তিনি কৃষকদের ওপর শাসকশ্রেণির চাপিয়ে দেওয়া সামাজিক বৈষম্য ও নিপীড়নের চিত্র হিসেবে শিল্পকে ব্যবহার করেছিলেন।
এক্ষেত্রে আবেদিন গ্রামের কৃষকদের শৌর্যের চিত্রায়ণ শুধু যে আধুনিকতাবাদী শিল্পে অকৃত্রিমতার আদিম আদর্শায়ন হিসেবে বিকশিত হয়েছিল তা নয়, বরং জমির সঙ্গে অনন্য সম্পর্কের পরিচয়জ্ঞাপক কৃষিভিত্তিক ইতিহাস দ্বারা বৈশিষ্ট্যপূর্ণভাবে রূপায়িত পূর্ব বাংলার সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক সত্তার একটি দৃষ্টিভঙ্গির ওপরও তা গুরম্নত্ব আরোপ করেছিল। পূর্ব বাংলায় গ্রামীণতাবাদের আদর্শ বলতে জমির সঙ্গে মানুষজনের নিবিড় ও শক্তিশালী সম্পর্ক বোঝায়, যেখানে জমি বা ভূমি যেমন একদিকে ছিল সামাজিক ও সম্প্রদায়গত অঙ্গীকার তথা শামিত্ম, স্থিতিশীলতা, সহাবস্থান, আত্মবিশ্বাস ও আশ্রয়ের জায়গা, তেমনি অন্যদিকে এটা ছিল উপনিবেশবিরোধী সংগ্রাম ও স্বাধীনতার লড়াইয়ের পীঠস্থান।
গ্রামীণজীবনের আদর্শায়িত রূপ ছিল পূর্ব বাংলার শিল্পচর্চা সূচনাকারী একটি নিয়মিত বিষয়বস্ত্ত, সেটি তাঁরা শিল্পকর্মে বেশি কাজে লাগিয়েছেন, দৃষ্টামত্ম হিসেবে কামরম্নল হাসান ও সফিউদ্দীন আহমেদ এবং গুরম্নত্বপূর্ণভাবে এস এম সুলতানের কাজে, বিশেষত ১৯৮০-র দশকের রাজনৈতিক উত্তেজনাকালীন সময়ে। এটি ছিল এমন এক বিষয়বস্ত্ত যা রাজনৈতিক আলোড়ন ও অনিশ্চয়তার সময় পূর্ব বাংলার মানুষদের পরিচয় সুরক্ষা করেছে এবং রফিকুন নবী ও রোকেয়া সুলতানার মতো সক্রিয় শিল্পীদের নিকট বারে বারে ফিরে আসা বিষয়বস্ত্ত হিসেবে যেমন থেকে গেছে, তেমনি দৃষ্টামত্মস্বরূপ ওমর চৌধুরীর মতো তরম্নণতর প্রজন্মের শিল্পীদেরও বিষয়বস্ত্ত হয়েছে।
বাংলাদেশের পরিপ্রেক্ষিতে গ্রামীণতাবাদী ভাবাদর্শের মধ্যে একটি স্বতন্ত্র বিষয়বস্ত্ত হিসেবে ভূমির শক্তি ও অধিকার বিশেষভাবে পরিস্ফুট হয়েছে মোহাম্মদ কিবরিয়ার কাজে, যাঁর উজ্জ্বল বিমূর্ত ছবিগুলো যেন ভূমির কাব্যিকভাবে কল্পিত উপস্থাপন। ১৯৬০-এর দশকের শেষ ও সত্তরের দশকের শুরম্নর দিকে যখন পূর্ব বাংলার অনেক শিল্পী মুক্তিযুদ্ধের পথে সামাজিক ও রাজনৈতিক অসমতা ও অধিকারের প্রতিকার সাধনের লক্ষ্যে সংশিস্নষ্ট ছিলেন, তখন কিবরিয়ার বিমূর্ত রীতির ব্যবহার চলমান সহিংসতা ও সংগ্রামের ‘বিভীষিকা থেকে পলায়ন’রূপে প্রতিভাত হয়েছিল। বিমূর্ত রীতি দ্বারা সহিংসতা ও মর্মাঘাতের উপস্থাপন যেন ছিল অসম্ভব। বিমূর্ত রীতির প্রতি কিবরিয়ার অঙ্গীকার, ইচ্ছার তীব্রতা ও অমত্মর্বীক্ষণ তাঁকে তাঁর প্রজন্মের অন্য শিল্পীদের থেকে আলাদা করে দিয়েছিল, যাঁরা ছিলেন সময়ের ক্ষুব্ধতার প্রতি আবয়বিক ও বিষয়ভিত্তিক সাড়ার প্রতি প্রাথমিকভাবে নিবেদিত (অর্থাৎ মুর্তজা বশীর, কামরম্নল হাসান প্রমুখ)। কিবরিয়া বাংলাদেশে আধুনিকতার ভাষার মধ্যে বিমূর্ততাকে প্রথমে নিয়ে আসেননি, তবে তাঁর কাজই বাংলাদেশের চিত্রকর্মে বিমূর্ততাকে গুরম্নত্বপূর্ণ ধরন হিসেবে হাজির করেছে। কিবরিয়ার বিমূর্ত চিত্রণরীতিতে জাপানিদের গভীর প্রভাব রয়েছে। জাপানিদের মতোই শিল্পের মাধ্যমে পৃথিবী ও প্রকৃতির আধ্যাত্মিক ও প্রাণমূলক গুণাবলির সঙ্গে একাত্মতার অনুভূতি তাঁর চিত্রকর্মে উপস্থিত। কাজী গিয়াসউদ্দীনের গীতধর্মী চিত্রকর্মেও একই রকম স্পর্শকাতরতা ভূপ্রকৃতি ও স্থানের ধারণার প্রকাশে খুবই স্পষ্টভাবে দেখা গেছে। এক্ষেত্রে তিনিও বিমূর্ত চিত্রকর্মে জাপানিদের দ্বারা প্রভাবিত হয়েছেন। জাপানি ক্যালিগ্রাফি ও জেন রীতির তুলির কাজ ও কালির কাজের মধ্যে সূক্ষ্মতা ও অতিসাবধানতার যে বৈশিষ্ট্য তার প্রতি তিনি জোর দেন। তবে বিমূর্ত চিত্রকলার এইসব কাজ ইউরোপ ও আমেরিকার বিমূর্ত চিত্রকলা থেকে আলাদা। এসব কাজ যদি অপ্রতিনিধিত্বশীল এবং চিহ্নিতকরণ, রঙের খেলা ও পৃষ্ঠতলের আকর্ষণ সৃষ্টির প্রতি অধিক মনোযোগধর্মী, তবু কিছু উলেস্নখযোগ্য ব্যতিক্রম ছাড়া জাপানি বিমূর্ত শিল্পকলাকে দেশটির ঐতিহ্যবাহী রীতির সম্প্রসারণ কিংবা তার আরো উন্নয়ন বলে গণ্য করা যেতে পারে। এটি জাপানের ঐতিহ্যবাহী চিত্রকর্মের কোনো ব্যত্যয় নয়।
৪
যদি শিল্পায়নপ্রক্রিয়ার পরিণতি হিসেবে পাশ্চাত্যের আধুনিকতাবাদকে নতুনত্ব, ঔদ্ধত্য এবং একক আপসহীন, ব্যক্তিকেন্দ্রিক পরাদৃষ্টির বিশেষ সুবিধা হিসেবে অতীত থেকে বিচ্ছিন্নতা অথবা ‘নতুনের অভিঘাত’ মনে করা হয়, তাহলে দক্ষিণ এশিয়ার আধুনিকতা প্রকৃতই এসব বিবেচনায় কালাতিমন দোষযুক্ত ও অননুষঙ্গী। দক্ষিণ এশিয়ায় আধুনিকতা (মডার্নিজম) ছিল ঔপনিবেশিক শৃঙ্খল থেকে মুক্তির সম্প্রসারিত প্রক্রিয়ার পরিণতি। যদিও এতে ইউরোপ, রাশিয়া, দক্ষিণ আমেরিকা ও এশিয়ার অন্যান্য অংশের নির্দিষ্ট কিছু নান্দনিক আদর্শ ও ক্রামিত্মকালীন অবস্থানের প্রভাব ছিল, তবুও তা অাঁকড়ে ছিল সামাজিক, সাম্প্রদায়িক ও সামষ্টিক বিবেচনাসমূহের পুনর্গঠনকে। নতুনত্বের আবাহনের পরিবর্তে দক্ষিণ এশিয়ায় আধুনিকতা সম্পৃক্ত ছিল কয়েকশ বছরের ঔপনিবেশিক আধিপত্যের পরবর্তী ইতিহাস, সত্যতা এবং ব্যক্তিক ও সম্প্রদায়ভিত্তিক আত্মসংজ্ঞা তৈরির সঙ্গে। সম্ভবত আরো গুরম্নত্বপূর্ণভাবে, দেশভাগের অভিঘাতে একসময়ে পরিবর্তনশীল ও বিভক্ত সম্প্রদায়গুলো একে অপরের থেকে যে আলাদা সেই স্বাতন্ত্র্য নির্ণয়ের প্রয়োজন বোধ করতে শুরম্ন করে। সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক নতুনত্বের সম্ভাবনা যেমন প্রাণে উচ্ছলতা নিয়ে এসেছিল, তেমনি তাদের হৃদয়ে হারানোর ক্ষতও প্রচ-ভাবে দগদগ করছিল। যুক্তিসংগতভাবে বলা যায়, দক্ষিণ এশিয়ার চাক্ষুষ শিল্পকর্মে আধুনিকতা থেকে গেছে একটি চলমান, যদিও অসমান অভিজ্ঞতালব্ধ, বিবেচনা হিসেবে। শৈল্পিক আলোচনা ও উৎপাদনের ক্ষেত্রে ভিন্নধর্মী একগুচ্ছ আবেগ, উদ্বেগ, প্রতিক্রিয়া ও চলরেখার দ্বারা জটিলকৃত প্রভাবশীল বর্ণনামূলক কাজ চিহ্নিত করার মাধ্যমে এটি পশ্চিমা আধিপত্যবাদী অনুধাবনের প্রতি চ্যালেঞ্জ সৃষ্টি করেছে। এটি আধুনিকতার প্রচলিত ছাঁদকে নড়িয়ে দিয়েছে এবং সেইসঙ্গে দেশভাগের ক্ষতি, উত্তেজনা ও ফাটল দ্বারা সৃষ্ট বাসত্মব রূপের পরিপ্রেক্ষিতে আঞ্চলিক ও উপ-আঞ্চলিক অনুধাবনকে জটিল করে তুলেছে। এটি সতর্ক করে দিয়েছে আঞ্চলিক বিবেচনার ভিত্তিতে দক্ষিণ এশীয় শিল্পের মূল্যায়নের বিরম্নদ্ধে। এছাড়া এটি আঞ্চলিক জাতীয়তার জন্য প্রয়োজনীয় আঞ্চলিক বিচ্যুতিকেও চিহ্নিত করতে সমর্থ হয়েছে।
ইংরেজি থেকে অনুবাদ : সুব্রত বড়ুয়া