মৃ ণা ল ঘো ষ
১৯৬০-এর দশকে বাংলার চিত্রকলায় একটা নতুন আন্দোলন জেগে উঠেছিল। সুহাস রায় (১৯৩৬-২০১৬) সেই আন্দোলনের অন্যতম প্রতিভূ ছিলেন। যদিও তাঁর প্রকাশের ধরন ষাটের মূল প্রবণতাগুলি থেকে ছিল অনেকটাই আলাদা। তাঁর চিত্রকলার শিক্ষা ছিল ইন্ডিয়ান আর্ট কলেজে (১৯৫৩-৫৮) স্বাভাবিকতাবাদী রীতিতে। পরবর্তীকালে তিনি প্যারিসের আঁতালিয়ে ১৭-তে এস ডবিস্নউ হেটারের কাছেও ছাপচিত্রে প্রশিক্ষণ নেন (১৯৬৪-৬৬)। তাঁর প্রকাশের মূল ভিত্তিতে ছিল স্বাভাবিকতাবাদ। স্বাভাবিকতাবাদের ভিত্তিতেই এক ধরনের ধ্রম্নপদী চেতনার প্রকাশ ঘটেছে তাঁর ছবিতে। তাঁর ‘রাধা’বিষয়ক চিত্রমালা এর দৃষ্টান্ত। ১৯৬০-এ প্রতিষ্ঠিত ‘সোসাইটি অব কনটেম্পোরারি আর্টিস্টস’ দলের অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা সদস্য ছিলেন তিনি। ষাটের দশকের শেষ পর্যায় থেকে সত্তরের প্রথমার্ধ পর্যন্ত তাঁর যে কাজ, তাতে আধুনিকতাবাদী আন্দোলনের প্রগাঢ় তীব্র সংক্ষুব্ধতা ও প্রতিবাদী চেতনার প্রকাশ ছিল। এখানে অবশ্য অনুভব করা যায়, ষাটের দশকের প্রধান প্রবণতাগুলির সঙ্গে তাঁর একাত্মতা।
তখন সময়ের মধ্যে আশা-নিরাশার একটা দ্বন্দ্ব চলছে। ঔপনিবেশিকতার অবসান ঘটেছে বেশ কিছুদিন হলো। তার প্রথম আলো ও স্বপ্নের ঝলক অনেক স্তিমিত হয়ে এসেছে। বরং খ–ত স্বাধীনতা, উদ্বাস্ত্ত সমস্যা, সাম্প্রদায়িক সংঘাত, অর্থনৈতিক অনিশ্চয়তা, পরিব্যাপ্ত দারিদ্র্য – এ সমস্তই বিপর্যস্ত করছে সমস্ত সচেতন মানুষকে। ষাটের দশকের মধ্য পর্বে ভিয়েতনামে মার্কিনি আগ্রাসন, শেষ পর্বে বাংলায় নকশালবাড়ি আন্দোলন, ১৯৭১-এ বাংলাদেশে মুক্তিযুদ্ধ, তা থেকে সঞ্জাত উদ্বাস্ত্তর মিছিল – এ সমস্ত ঘটনাপ্রবাহ নিয়ন্ত্রণ করেছে শিল্পের গতিপ্রকৃতি।
ষাটের অন্য অনেক শিল্পীর মতো সুহাস রায়ও এই তমসাকে উপেক্ষা করতে পারেননি। তাঁর উদ্বাস্ত্ত হয়ে এদেশে আশা (১৯৪৮), শৈশবের অপরিসীম দারিদ্র্য, অতি শৈশবে, মাত্র দেড় বছর বয়সে, পিতৃহীনতা – এই সমস্ত ব্যক্তিগত দুঃখের সঙ্গে জাতীয় ও আন্তর্জাতিক স্তরের মানবিক অবক্ষয় মিলেমিশে নিয়ন্ত্রণ করেছে তাঁর নিজস্ব প্রকাশভঙ্গি। প্যারিসে তাঁর ছাপচিত্রের শিক্ষা সেই সময় তাঁর ছবির আঙ্গিক গড়ে তুলতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নিয়েছে।
ষাটের শেষ ও সত্তরের প্রথম পর্বের এচিং ও কালি-কলমের রেখার এই ছবিগুলিতে তিনি সামগ্রিক এক তমসা ও মৃত্যুর হাহাকারকে প্রতিধ্বনিত করেছেন। এরকম দু-একটি ছবির কথা আমরা উল্লেখ করব। ভূমিতলে পড়ে আছে একটি মৃতের কঙ্কাল। পঞ্জরাস্থি প্রকটভাবে দৃশ্যমান। একটি হাত আকুল আর্তিতে শূন্যের দিকে উত্তোলিত। মাথাটি দেহ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে কোমরের কাছে প্রকট করোটি রূপে সংস্থাপিত। আর আকাশে উড়ে যাচ্ছে একটি পাখি। আর একটি ছবিতে প্রেক্ষাপটে নিবিড় অন্ধকার। ভূগর্ভ থেকে ওপরে উঠে এসেছে দুটি আর্ত হাত। এরই মধ্যে পাথরের বুক চিড়ে বেরিয়ে আসছে কয়েকটি গুল্ম। পাতার ওপর আলো পড়েছে। বসে আছে নীরব একটি পাখি। ওপরে একটি সরীসৃপ ধাবমান চিত্রক্ষেত্রের এ-প্রান্ত থেকে ও-প্রান্তে। এইরকম তমসাবিধৃত প্রতিমাকল্পের মধ্য দিয়ে এই পর্যায়েই যিশু খ্রিষ্টের আবির্ভাব ঘটেছে তাঁর ছবিতে। ১৯৭০-এর একটি কালি-কলমের ড্রয়িংয়ে দেখা যায়, পরিবৃত আলো-অন্ধকারের প্রেক্ষাপটে দুহাত ওপরে তুলে দাঁড়িয়ে আছে সন্ত-প্রতিম একজন মানুষ। মাথায় তার কাঁটার মুকুট। তাকে যিশু বলে চিনে নেওয়া যায়। এই খ্রিষ্টের প্রতিমা শেষ পর্যায় পর্যন্ত তাঁর ছবিতে নানাভাবে এসেছে। জীবনব্যাপী করুণা ও অন্তর্লোকের আলো – এই দুইয়েরই প্রতীক হয়ে উঠেছে যিশু। তাঁর বিশ্বদৃষ্টি ও জীবন-ভাবনার ইঙ্গিত থাকে এর মধ্যে।
প্রথম পর্বের নিরাশার নিঃসীমতাকে ক্রমশ কাটিয়ে উঠেছেন সুহাস রায়। ১৯৭৪-এ তিনি বিশ্বভারতী কলাভবনে যোগ দেন শিক্ষকতায়। এর আগে ১৯৬০ থেকে ১৯৭৪ পর্যন্ত তিনি ইন্ডিয়ান আর্ট কলেজে অধ্যাপক ও অধ্যক্ষ হিসেবে যুক্ত ছিলেন। আর্ট কলেজ ও ব্যক্তিগত নানা সমস্যায় ভারাক্রান্ত ছিলেন তিনি এই সময়। শান্তিনিকেতনে এসে তা থেকে যেমন তিনি মুক্ত হন, তেমনি শান্তিনিকেতন তাঁর জীবনদর্শন ও শিল্পদর্শনেও আনে গভীর পরিবর্তন।
স্বতন্ত্র এক সৌন্দর্যের অনুভূতি জেগে ওঠে তাঁর মধ্যে। এর শ্রেষ্ঠ প্রকাশ ঘটেছে তাঁর ১৯৮০-র দশকের নিসর্গ রচনাগুলিতে। সবসময়ই স্বাভাবিকতাবাদ ছিল সুহাসের প্রকাশের প্রধান ভিত্তি। নব্য-ভারতীয় ঘরানার ঐতিহ্যচেতনা তাঁকে কখনোই খুব একটা প্রভাবিত করেনি। আশির দশকে অনুপুঙ্খ স্বাভাবিকতায় আঁকা তাঁর নিবিড় বনানীর ছবিগুলি প্রকৃতির প্রতি তাঁর গভীর ভালোবাসাকে অভিব্যক্ত করে। অরণ্যের সম্পৃক্ত অন্ধকারের ভিতর থেকে উদ্ভাসিত হয়ে উঠেছে এক ঝলক অস্তমান সূর্যের আলো বা সামগ্রিক নির্জনতার মধ্যে উড়ে যাচ্ছে একাকী একটি পাখি। স্তব্ধতার মধ্যে এই প্রাণের উদ্ভাস তাঁর জীবনদর্শনের এক স্মারক হয়ে থাকে। এই বনানীর ছবি তিনি তেলরঙে যেমন এঁকেছেন, তেমনি এঁকেছেন কাচের ওপর বিপরীতক্রমে। তখন শান্তিনিকেতনে কে জি সুব্রহ্মণ্যন্ কাচচিত্রে নিরন্তর কাজ করে এই লৌকিক মাধ্যমটিকে আধুনিকতার বিশেষ মাত্রায় উদ্ভাসিত করছেন। তাঁরই প্রেরণায় সুহাসও এই মাধ্যমটি নিয়ে নিবিষ্ট চর্চা শুরু করেন। চিরদিনই তাঁর প্রাকরণিক দক্ষতা ছিল অসামান্য।
শান্তিনিকেতনে এসে দূরপ্রাচ্য, বিশেষত জাপানের শিল্পের সঙ্গে তাঁর নিবিড় পরিচয় হয়। টাইকানের ছবি তাঁকে আকৃষ্ট করে। সেই প্রকরণ আয়ত্ত করেন। এই প্রকরণে তিনি আঁকেন অজস্র কাকের ছবি। এই কাকের ড্রয়িংয়ের মধ্যে সামান্যকে অসামান্য করে তোলার প্রয়াস লক্ষ করা যায়। তাঁর চিত্রচেতনা ক্রমান্বয়ে সহজ সৌন্দর্যের দিকে যেতে থাকে। এর শ্রেষ্ঠ প্রকাশ ঘটে তাঁর ‘রাধা’ চিত্রমালায়। ১৯৯০-এর দশক থেকে তিনি ‘রাধা’তেই একান্ত নিমগ্ন ছিলেন। রাধার পুরাণ-প্রতিমাকে তিনি স্বাভাবিক মানবী-প্রতিমায় রূপান্তরিত করে নেন। ১৯৯০-এর দশক থেকে বাজার কীভাবে শিল্পের বিষয় ও নন্দনকে নিয়ন্ত্রণ করেছে, তাঁর রাধা চিত্রমালা এরই এক দৃষ্টান্ত। রাধা চিত্রমালায় তিনি অনুসরণ করেছেন আদর্শায়িত স্বাভাবিকতাবাদ, যা অনেকটাই ধ্রম্নপদী চেতনার অন্তর্গত। এই ধ্রম্নপদী স্বাভাবিকতাকে তিনি ভারতীয় আদর্শের অন্তর্গত করে তোলেন খাজুরাহোর মন্দির-ভাস্কর্য অনুপ্রাণিত তাঁর ‘মিসট্রেস অব দ্য মুন’ চিত্রমালায়। আলিঙ্গনাবদ্ধ নগ্ন নর-নারীর রূপায়ণে প্রেমের শরীরী রূপের মধ্যেই তিনি আনতে পারেন অলৌকিকের উদ্ভাস। এই দেশ-কাল নিরপেক্ষ, সৌন্দর্যচেতনাই শেষ পর্যন্ত হয়ে উঠেছে তাঁর নান্দনিক দর্শন। এই পর্যায়েরই কিছু ছবিতে স্বাভাবিকতার সঙ্গে তিনি লৌকিককে মিলিয়ে নেন। মধুবনী চিত্রের আদল লক্ষ করা যায় কিছু ছবিতে।
সুহাস রায় শুরু করেছিলেন অমঙ্গলবোধ-সঞ্জাত এক প্রতিবাদী চেতনা থেকে। উচ্চ-আধুনিকতাবাদ বা হাই-মডার্নিজমের লক্ষণ ছিল তাতে। সেখান থেকে তিনি এসেছেন আদর্শায়িত ধ্রম্নপদী স্বাভাবিকতাবাদে। এখানেই ষাটের দশকের অন্য অনেক শিল্পীর সঙ্গে তাঁর পার্থক্য। ষাটের আধুনিকতাবাদী বিস্তারে দুটি প্রবণতার প্রাধান্য লক্ষ করা যায়। একটি ক্ষয় বা ক্ষত থেকে জেগে ওঠা চরম নাস্তির বিশ্লেষণ। অন্যটি সাম্প্রতিকের ক্লিন্নতার ঊর্ধ্বে আদর্শায়িত আলোর সন্ধান। সুহাস রায় এই দুটি ধারার মধ্যে সমন্বয় সাধনের চেষ্টা করেছেন। শেষ পর্যন্ত মানবীয় শরীরী সৌন্দর্যকেই আধ্যাত্মিকতার পরম এক অভিজ্ঞান বলে মনে করেছেন। ষাটের দশকের শিল্পযাত্রায় এটা তাঁর নিজস্ব অবদান বলেও মনে করা যায়।
১৮ অক্টোবর ২০১৬ তারিখে ৮০ বছর বয়সে তিনি কলকাতায় প্রয়াত হন। n