logo

শিল্পী বিনোদবিহারী মুখোপাধ্যায় ও তাঁর শিল্পকর্ম

ত প ন  ভ ট্টা চা র্য

বিনোদবিহারী মুখোপাধ্যায় শুধু একজন অসাধারণ শিল্পী মাত্র নন, তাঁর ছিল অসাধারণ বৌদ্ধিক মেধা। তিনি শিল্প-ইতিহাস সম্পর্কে তাঁর গভীর প্রজ্ঞাকে যেমন কাজে লাগিয়েছেন তাঁর শিল্প সৃষ্টিতে, তেমন তা কাজে লাগিয়েছেন শিল্প-ইতিহাস সম্পর্কীয় প্রবন্ধ বা ব্যক্তিগত অনুভবের বিষয় নিয়ে লেখাগুলোতেও। আধুনিক শিল্প সৃষ্টির জন্য যে চাই শিল্পীজনোচিত প্রজ্ঞা সেই প্রসঙ্গ তাঁর নানা প্রবন্ধে রয়েছে এবং তাঁর নিজের যে সেই ‘শিল্পীজনোচিত প্রজ্ঞা’ প্রভূত পরিমাণে রয়েছে, তা তিনি নিশ্চয়ই অনুভব করেছিলেন। তিনি যেমন ইতালীয় ম্যুরাল-পরম্পরাকে গভীর অধ্যয়ন করেছিলেন, শ্রদ্ধা করতেন শুরুর রেনেসাঁস শিল্পীদের, যেমন জিয়োত্তো ও ম্যাসাচিও তাঁর প্রিয় শিল্পী, তেমন প্রাচ্য শিল্পের গভীরতায় মজেছিলেন তিনি, সারাজীবনের পছন্দের ছিল চীন, জাপানের চিত্রকলাও। এবং আশ্চর্যের কথা, যখন যেভাবে তিনি কাজ করেছেন, প্রতিটি মাধ্যমেই, প্রতিটি  চিত্রভাষায়  তিনি  খুবই  সফল  হয়েছেন।  অর্থাৎ   পশ্চিমের ম্যুরাল-পরম্পরা, প্রাচ্য শিল্পধারা, মুঘল শিল্পশৈলী ইত্যাদি থেকে নির্বাচিত যা, যা তাঁর পছন্দের এবং যা তাঁর নিজস্ব অভিব্যক্তির ক্ষেত্রে কাজে আসবে তা তিনি আত্মস্থ করেছিলেন এবং অনুভব করেছিলেন, শিল্প-ইতিহাস একজন শিল্পীর পক্ষে কতটা দরকারি এবং এ-কারণেই শান্তিনিকেতন, কলাভবনে তিনি অধ্যাপক থাকাকালীন শিল্প-ইতিহাস বিভাগটি নির্মাণে দরকারি কাজগুলো করেন। শান্তিনিকেতনের পাঠ্যক্রমে শিল্প-ইতিহাস বিভাগ খোলাও তাঁর একটি উল্লেখযোগ্য কাজ।

বিনোদবিহারী কলকাতার বেহালা অঞ্চলে জন্মান ১৯০৪ সালের ৭ ফেব্র“য়ারি। শৈশবে যে কেবল রুগ্ণ ছিলেন তা নয়, বরং একটা ফটোগ্রাফে দেখা যায়, তাঁর চোখ দুটো কতটা ক্ষতিগ্রস্ত ছিল। যে-ফটোগ্রাফটির কথা এখানে বলা হচ্ছে, তাতে বালক বিনোদবিহারী দাঁড়িয়ে আছেন তাঁর দুই দাদার মাঝখানে। বৈচিত্র্য হচ্ছে, প্রত্যেকটা বালকের হাতে তিনটি ঢাউস বই। তিন বালকই ধুতি পরে খালি গায়ে রয়েছে। অর্থাৎ ফটোগ্রাফের জন্য তাদের আলাদা করে জামা পরানো হয়নি। কিন্তু প্রত্যেককে ধরিয়ে দেওয়া হয়েছে একেকটা বই। দাদাদের স্বাভাবিক চোখের তুলনায় বিনোদবিহারীর চোখের দশা দেখে অবাক ও দুঃখিত না হয়ে থাকা যায় না। কিন্তু আশ্চর্যের যেটা তা হলো, এই ছেলেটিই একদিন সর্বকালের শ্রেষ্ঠ শিল্পীদের একজন হয়ে উঠবে, এ-কথা বালকের চোখের অবস্থা দেখে ভাবাই যায় না।

যেহেতু চিত্রকলার সঙ্গে জগৎকে দেখার, খুঁটিয়ে লক্ষ করার যোগ রয়েছে তাই বিনোদবিহারীর কলাভবনে ভর্তির সময় শিল্পাচার্য নন্দলাল বসু আপত্তি জানিয়েছিলেন। কিন্তু সেই আপত্তি খারিজ হয়ে যায় স্বয়ং রবীন্দ্রনাথের ব্যগ্রতায়। অর্থাৎ কোথাও বিনোদবিহারীর এই যে শিল্পের মহাযাত্রা, তার কাণ্ডারিরূপে দাঁড়িয়ে আছেন রবীন্দ্রনাথ। কিন্তু তারপর অবশ্যই শিক্ষক নন্দনাল। বিনোদবিহারী ‘চিত্রকর’ প্রবন্ধে লিখেছেন, ‘নন্দলাল না থাকলে আমার আঙ্গিকের শিক্ষা হতো না, লাইব্রেরি ছাড়া আমার জ্ঞান আহরণ করা সম্ভব হতো না, আর প্রকৃতির রুক্ষ মূর্তি উপলব্ধি না করলে আমার ছবি আঁকা হতো না।’

ওরিয়েন্ট নিয়ে রবীন্দ্রনাথের একটা সামগ্রিক উৎসাহ ছিল, জাপানি শিল্পশিক্ষক কয়েকজন বিংশ শতাব্দীর প্রথমেই বাংলায় এসেছিলেন। এসবের সঙ্গে লাইব্রেরিতে জাপানি চিত্রকলার বইগুলোও নিশ্চয়ই উদ্বুদ্ধ করেছিল ১৯৩৬-৩৭ সালে বিনোদবিহারীকে জাপানে, চীনে যেতে এবং জাপানি শিল্পের মর্ম বুঝতে। তার আগেই কিন্তু ভারতীয় আধুনিক শিল্পীরা বেছে নিচ্ছেন প্যারিসকে শিল্পশিক্ষার জন্য, যেমন অমৃতা শেরগিল, বিনোদবিহারী। এই যে ওরিয়েন্টাল আর্ট নিয়ে উৎসাহ তা ইংরেজ ঔপনিবেশিক সময়ে যে পশ্চিমি অ্যাকাডেমিক শিল্পশিক্ষা শুরু হয়েছিল তারও একটা ব্যক্তিগত বিকল্প খোঁজা। এমন তো বলাই যায়। এবং সেই ব্যক্তিগত বিকল্পকেও তিনি শিক্ষক হিসেবে কলাভবনের ছাত্রদের ভেতর সঞ্চারিত করতে চেয়েছেন। এইভাবে বিলিতি যে-শিক্ষা তার বিকল্প এক নতুন ওরিয়েন্টাল শিক্ষা ও সংস্কৃতি সৃষ্টি করেছিল শান্তিনিকেতন। এমন যে রবীন্দ্রনাথও চেয়েছিলেন, তা শান্তিনিকেতনের ‘চীনা ভবন’, ‘নিপ্পন ভবন’ দেখলেও বোঝা যায়।

বিনোদবিহারীর তুলনায় তাঁর সহকর্মী শিল্পী রামকিঙ্কর অনেক বেশি উৎসাহী ছিলেন ইউরোপীয় আধুনিকতার। রামকিঙ্কর ইউরোপ যাননি কিন্তু কলাভবন, লাইব্রেরি যে তাঁকে রসদ জুগিয়েছে রঁদা, সেজান, পিকাসো সম্পর্কে তা বলাই যায়। যদিও রামকিঙ্কর ভারতীয় পরম্পরাগত ভাস্কর্যও গভীরতার সঙ্গে অধ্যয়ন করেছিলেন। এবং নন্দলাল, বিনোদবিহারী ও রামকিঙ্করের কাজে এমন কতগুলো সাযুজ্য রয়েছে, শান্তিনিকেতন, খোয়াই, সুরুল ও কোপাইয়ের চিত্রের সাপেক্ষে, তাদের পরস্পরের ড্রইংয়েও বিচিত্র এক সহমর্মিতা নিয়ে আসে। বিনোদবিহারীর স্থিরতা, অচঞ্চলতার সঙ্গে রামকিঙ্করের জঙ্গমতা, চঞ্চলতা মিশে যায় এক সুরেলা আবহে। তিনজন একাকার হয়ে গিয়েছেন অন্তত ওই অঞ্চলের ভূদৃশ্য আঁকার ক্ষেত্রে।

 

দুই

২০০৬ সালের ৩০ ডিসেম্বর থেকে ২০০৭-এর ১১ ফেব্র“য়ারি পর্যন্ত বিনোদবিহারীর এক পূর্বাপর প্রদর্শনী হয় দিল্লির ন্যাশনাল গ্যালারি অব মডার্ন আর্টে এবং অধুনা ছোট আকারে কিন্তু আরেকটি মূল্যবান প্রদর্শনী তাঁর হয় কলকাতার আকার-প্রকার গ্যালারিতে ২০১২ সালের ১৫ জুন থেকে ১৪ জুলাই পর্যন্ত। দুটি প্রদর্শনী থেকেই স্পষ্ট হয় যে, বিনোদবিহারী দৃশ্যচিত্রের এক গুরুত্বপূর্ণ শিল্পী। কলকাতা থেকে এসে নন্দলাল প্রথম নান্দনিকভাবে বুঝে নিয়েছিলেন বোলপুরের চারপাশের এই রুক্ষ, গভীর দৃশ্যের আকর্ষণ। শহুরে কলকাতা, গলিময় কলকাতা। এত ঘরবাড়ির ঘিঞ্জি কলকাতার বিপরীতে এই যে খোয়াই, সুরুলের শালবন, কোপাই নদীর ধার, কাশফুলের বৈচিত্র্য তা প্রথম শিল্পী নন্দলালকে মাতায়। তারপর মাতায় বিনোদবিহারী ও রামকিঙ্করকে। বিনোদবিহারীর অসংখ্য দৃশ্যকল্পে নির্জনতার উপস্থিতি রয়েছে। যেন মানুষের উপস্থিতি বাদ দেওয়া হয়েছে এই নির্জনতা থেকে। রবীন্দ্রনাথের অসংখ্য কবিতায় ও গদ্যে এমন নির্জন দৃশ্যের বর্ণনা রয়েছে। বিনোদবিহারীর এমন কয়েকটি দৃশ্যচিত্র আছে, যার ধূসরতায়, অসীম শূন্যতায় তিনি তাঁর সত্তাকে খুঁজে পেয়েছেন বলা যায়, এমনি এক দৃশ্যচিত্র হলো খোয়াই (স্ক্রল)। তিনশো তেরো সেন্টিমিটার লম্বা এই ছবিটি আঁকা হয়েছে নেপালি কাগজে টেম্পেরায়। খুবই সীমিত কয়েকটি রং ব্যবহার করেছেন তিনি। কিন্তু এমন এক ধূসরতা, নির্জনতা ও গভীরতা ছবিটিতে এসেছে যে, বিস্মিত করে। তিরিশের দশকের মাঝামাঝি করা এই ছবিটি একটা মাস্টারপিস, এমন বলা যায়। বিনোদবিহারীর দৃশ্যচিত্রগুলোর আরেকটি বৈশিষ্ট্য হলো, শিল্পী নিজে যখন আঁকেন, তখন সম্পূর্ণ নিয়োজিত করেন নিজেকে কাজটায় এবং তা দৃশ্যে ধরাও পড়ে। তিনি রামকিঙ্করের মতো চঞ্চল, গতিসম্পন্ন দৃশ্যচিত্র আঁকেন না। মনকে বিক্ষুব্ধ করে এমন কিছুও তিনি বাদ দেন। একটা নির্লিপ্ততা তাঁর ছবিতে যেমন রয়ে যায়, তেমন রয়েছে তাঁর মনোযোগ এবং গঠন করার ক্ষমতা।

নন্দলাল বসুর ছবিতে যেমন দেশনেতাদের দেখা যায় বা ধর্মীয় বিষয়ের প্রাধান্য দেখা যায় তা বাদ দিয়েছিলেন বিনোদবিহারী। তিনি তুলনায় হয়েছেন অনেক সমাহিত, তাঁর দৃশ্যচিত্রও হয়ে উঠেছে স্তব্ধ, নির্বাক বিস্ময়ের মতো। এমনি এক দৃশ্যচিত্রের স্ক্রল রয়েছে তিরিশের দশকের শুরুর দিকের করা। অসংখ্য গাছ এঁকেছেন এমনভাবে যেন তা একটা পরম্পরাগত চায়নিজ ছবি কিন্তু এমন এক নির্জনতার উপলব্ধি দিতে তিনি সমর্থ হয়েছেন, যা খুবই উল্লেখযোগ্য। দৃশ্য-চিত্রকর হিসেবে নন্দলাল, বিনোদবিহারী ও রামকিঙ্কর ক্রমাগত সরাসরি প্রকৃতির কাছে গিয়েছেন, তাকে দিনের পর দিন উপলব্ধি করেছেন, যে-কারণে তাঁরা এত সফল হয়েছিলেন দৃশ্যচিত্র আঁকতে।

বিনোদবিহারী ১৯১৭ সালে শান্তিনিকেতনে ভর্তি হন এবং ১৯১৯ সালে কলাভবন প্রস্তুত হলে একেবারে প্রথম দিকের ছাত্র হিসেবে যোগ দেন। কিন্তু ১৯২১ সালেই অর্থাৎ সতেরো বছর বয়সে বিনোদবিহারীর দুটি ছবি দেখে তাঁর প্রতিভায় অবাক হতে হয়। একটি ছবি হলো হাসি laughter), টেম্পেরায় করা এটা একটা প্রাকৃতিক দৃশ্য, যেখানে কাশফুল এক অনন্যতায় উপস্থিত। প্রকৃতির সম্পূর্ণতা, উচ্ছ্বাস বোঝাতেই যে-ছবির নাম ‘হাসি’ দেওয়া হয়েছে তাতে সন্দেহ নেই। অপরটি হলো ‘বীরভূমের গ্রীষ্ম দৃশ্য’, কাপড়ের ওপর এটাও টেম্পেরায় করা। ১৯২১ সালের এই ছবিটিতেই এঁকেছিলেন নির্জন দৃশ্যচিত্র। অত্যন্ত সংক্ষিপ্ত প্রকরণে ও বিশেষ নির্বাচিত রং লাগিয়ে বিনোদবিহারী ওই সতেরো বছর বয়সেই এঁকে ফেলেছেন এমন একটা দৃশ্য, যার বৈশিষ্ট্য তাঁর অসংখ্য পরবর্তী দৃশ্যচিত্রেও বর্তমান ছিল। নন্দলালের প্রভাবকে কেমন নিজস্বতায় ব্যক্ত করছেন, তার প্রমাণও এই ছবি দুটি।

দৃশ্যচিত্র আঁকতে গিয়ে বিনোদবিহারীর দিগন্ত আঁকার দিকে ঝোঁক তৈরি হয়। তিনি তিরিশের দশক থেকেই এমন দৃশ্যচিত্র এঁকেছেন, যা অনুভূমিক, লম্বার তুলনায় অনেক বড় অনুভূমিক এই ছবিগুলো। আশ্চর্যের কথা হলো, কলাভবনের দেয়ালে শেষ যে সিরামিক ম্যুরালটি তিনি করেছিলেন ১৯৭২ সালে, তাও লম্বার তুলনায় অনেক বড় অনুভূমিক। এমনভাবেই যেন একটা বৃত্ত সম্পূর্ণ করেন তিনি। কালি-কলমেও এঁকেছেন তিনি অসংখ্য দৃশ্য-ছবি। কালি-কলমেও তিনি একটা বুনোট তৈরি করতেন। দৃশ্যটার ভেতর অবাধে হয়ে ওঠার ব্যাপার থেকেই যায়। কোনো একটা দৃশ্যচিত্র নেই, যাতে চাপিয়ে দেওয়া হয়েছে এমন কিছু রয়েছে। চল্লিশের দশকের শুরুতে তিনি বেশ কিছু বেনারস ঘাটের দৃশ্য আঁকেন। অসংখ্য নেমে আসা সিঁড়ি, উঠোনের উপস্থিতি ও বড় বড় থামের বিপরীতে জল, নৌকো ইত্যাদির মুক্ত দেশ, বিনোদবিহারীর বিষয় হয়ে ওঠে।

বিনোদবিহারীর এই যে জনশূন্য দৃশ্যচিত্রের প্রতি আকর্ষণ, নিয়ন্ত্রিত প্যালেটে আস্থা ও দৃশ্যে বিপুল বিস্তারের উপস্থিতি নির্মাণ, দিগন্তপ্রসারী একটা সামগ্রিকতা তৈরি করা তা পরবর্তীকালের, আপাত কোনো মিল না থাকলেও বিখ্যাত দিল্লিনিবাসী শিল্পী রামকুমারের কাজেও রয়ে গিয়েছে, মনে হয়। রামকুমারের আগে আধুনিক ভারতীয় চিত্রকলায় বিনোদবিহারীই এমন আকর্ষিত হন বেনারস ঘাট অঙ্কন নিয়েও। দৃশ্যচিত্রে কেবল দৃশ্যটাই নয়, শিল্পী উদাসী। একক মনও যে প্রত্যক্ষ করা যায়, তা আমরা অনুমান করি বিনোদবিহারীর দৃশ্যচিত্র দেখার সময়।

 

তিন

Water is like flowers, very fwe people can paint them

well. -Alex katy (বিখ্যাত আধুনিক আমেরিকান শিল্পী)

রবীন্দ্রনাথের কবিতায়, ভাবনায়, সাহিত্যে ফুল, বাগান বারবার এসেছে। ঋতুর যে পূর্ণতা, মাধুর্য তা ফুলের বা ফুলের স্তবকের ভেতর দিয়েই প্রকাশিত। রবীন্দ্রনাথ হতাশা প্রকাশ করতেন এই ভেবে যে, ভারতীয়রা তাদের জীবন, ঘরবাড়ি আরো কেন ফুলে ভরিয়ে রাখেনি, কেন তারা নিয়মিত ফুল দিয়ে ঘর সাজায় না। শান্তিনিকেতনে, বোলপুরের মাটিতে ফুলগাছ হয়ও যেমন, গাছে ফুল থাকেও অনেকদিন। শীতকালের শান্তিনিকেতনে অনেক বাড়িতেই বাগানে ফুল ভরে থাকে। শিল্পী বিনোদবিহারীর দৃশ্যচিত্র ছাড়িয়ে ফুলের দিকেও নজর গিয়েছিল। এঁকেছেনও ফুল – মমতায়, ভালোবাসায় – একটা খেলা যেন।

একজন শিল্পী পূর্ব বা পশ্চিম যেখান থেকেই উৎসাহিত হতে পারেন কিন্তু তিনি বিষয়টিকে আত্মস্থ, ব্যক্তিগত এক অভিব্যক্তি করে প্রকাশ করতে পারেন কি-না সেটাই তাঁর পরীক্ষা। চায়নিজ, জাপানিজ ছবি দিয়ে উৎসাহিত হয়েছেন বিনোদবিহারী। তাদের নন্দন সৌন্দর্যের যে-ধারা তিনি আত্মস্থ করেছিলেন, তার সার্থক প্রকাশ ঘটেছিল এই ফুলগুলো আঁকায়। একজন ঞধড় শিল্পীর সহজিয়া ধরনের মতো তিনি দ্রুততায় তুলি ছুঁইয়ে, ঘষে, রং ঢেলে অপূর্ব ফুলগুলো এঁকেছেন। আমাদের মনে পড়ে যায়, জাপানিজ আর্ট ভ্যান গঘকেও কতটা উৎসাহিত করেছিল এবং সূর্যমুখী ও আরো কত ফুল তিনি এঁকেছিলেন।

কখনো নেপালি কাগজে এঁকেছেন যেমন, কখনো হাতে তৈরি কাগজে, কখনো বা সিল্কে। এবং কতরকম ফুল না তিনি এঁকেছিলেন।

বিনোদবিহারী এঁকেছেন সূর্যমুখী, গোলাপ, অমলতাস, মধুমালতী, দোলনচাঁপা, চালতা – এমনি কত ফুল। আর নানানভাবে ফুটে ওঠা, ফুটতে থাকা পদ্ম ফুল তো আছেই। অবশ্যই ঞধড় চিত্রকরদের কথা মনে আসে, মনে আসে রবীন্দ্রনাথের কবিতাও। এতটাই বিশুদ্ধ, স্পর্শকাতর করে ফুলগুলো তিনি এঁকেছেন। এঁকেছেন জলাশয়ে নানানভাবে থাকা পদ্ম ফুল। খুবই সংক্ষিপ্ত কয়েকটি টানে সেই জলাশয়ে মাছও ঘুরে বেড়াচ্ছে, দেখতে পাই আমরা।

বিনোদবিহারী এই যে নানান ফুল এঁকেছিলেন, তা করেন তিনি জাপান থেকে ফিরে আসার পর। জাপানে তাঁর উৎসাহ ছিল সেসু (sesshu), সোতাসু (Sotasu), কোরিনের মতো শিল্পীদের নিয়ে। নন্দলাল বসুর মতন তিনিও বিলিয়ে দিতেন ছাত্রদের ভেতর এই রকম নানান ফুলের ছবি। তিরিশের দশকের তুলনায় চল্লিশের দশকের এই ছবিগুলোতে তুলির টানটোন বা রঙের ছোপছাপ দেওয়া যে অনেক বদলে গেছে, তা বিনোদবিহারী নিজেই লিখেছিলেন ‘চিত্রকর’ প্রবন্ধে। এমনি ফুল এঁকে তিনি তাঁর স্ত্রী লীলাকেও উপহার দিতেন। বিখ্যাত শিল্পী ও শিল্প-সমালোচক নিলীমা শেখ ‘The flower paintings of Benode Behari Mukherjee’ প্রবন্ধে এ বিষয়ে লিখেছেন – ‘He did not look at flowers as exotica but as the most proximate unit of his environment. Enjoying the directness of the encounter, immediacy was what he would want to translate, rather than use artifice to give it metaphoric significance.’ কিন্তু গভীর এক স্পর্শকাতর অনুভব, বিচিত্র তুলি-কালি-রং আয়ত্তে থাকাতেই এই সহজ সৌন্দর্য সৃষ্টি করা গেছে। রবীন্দ্রনাথের ধারণা ছিল, আর্টে একটা শান্ত ভাব থাকা দরকার, বিনোদবিহারীর এই ছবিগুলো ঠিক তা-ই।

বিনোদবিহারী একটা চোখে দেখতে পেতেন না, অপর চোখটিও সম্পূর্ণ স্বাভাবিক ছিল না। দৃষ্টি হারিয়ে যাওয়ার ভয় নিশ্চয়ই তাঁকে তাড়া করে বেড়িয়েছে। তাই ফুল তো শুধু দেখার নয়, তার সুগন্ধও একটা উপস্থিতি এবং তা নিশ্চয়ই বিনোদবিহারীর পক্ষে আশার কথা হয়ে দাঁড়িয়েছিল। ফুলের উপস্থিতি তিনি যে সারাজীবন টের পাবেন। ফুল তাঁর কাছে অবাক বিস্ময়ে পূর্ণ হয়ে উঠেছে। সহজ বিস্ময় বিমুগ্ধ করেছে ফুল বিনোদবিহারীকে এবং তা-ই রূপান্তরিত হয়েছে ছবিতে। সতেজ উপস্থিতি তৈরি হয়েছে নানান ফুলের।

চার

বিনোদবিহারীর ছবিতে ঘরের অন্দরমহল সাধারণত থাকে না। কিন্তু কেবল একটা ছবিতেই তা রয়েছে, তা হলো ১৯৩৩-৩৫ সালের ভেতর করা ‘Artist in studio’. এই ছবিটি বিনোদবিহারীর আরেকটি শ্রেষ্ঠ ছবি। বলা যায়, এটা বিনোদবিহারীর স্ব-প্রতিকৃতিও। আঁকার গভীরে নিয়োজিত একজন মানুষের ছবি এটা, ঘরেই সাজানো রয়েছে ইজিচেয়ার, টেবিল, মোড়া ইত্যাদি এবং এগুলো ছেড়ে একটা মাদুরে বসে শিল্পী আঁকছেন এবং তিনি পেছনের দরজাও খুলে দিয়েছেন এবং সেখানে দেখা যাচ্ছে নির্জন এক দিগন্ত। আমরা ধরে নিতে পারি, এই শিল্পীর মনও ওই নির্জন দিগন্তের মতো, তাই হয়তো ছবিতে আসছে বিষয় হয়ে, এমন অনুমানও মাথায় আসে। মানুষটা যেন ঘরের সব জিনিস সামনে এগিয়ে দিয়ে পেছনে বসে আঁকছেন। পুরো ছবিটি যেমন অনুভূমিক, তেমন মনে হয় ছবিটি যেন চ্যাপ্টাভাবে উঠে গেছে, যেমন হয় মুঘল মিনিয়েচারে। কিন্তু ছবির  প্রতিটি স্তর, শিল্পীসহ গ্রন্থনা এত নিটোল, সমন্বয় এত ঠাস বুনোট যে, আমাদের মন  গভীরভাবে  আকর্ষিত  হয়।  কর্মরত  শিল্পীকে  মনে  হয় একলা, একান্তবাসী, ছবির পুরো পরিবেশটাই কেমন নিভৃত হয়ে পড়ে। ছবিটিতে রঙের ব্যবহারও খুবই নিয়ন্ত্রিত।

ফুল যেমন এঁকেছেন বিনোদবিহারী স্বতন্ত্রভাবে, তেমন ফুলের বাগানে নারীদেরও এঁকেছেন তিনি। ফুল তুলছে তারা, কখনো বা ফুলের বাগানে নানান ভঙ্গিমায় তারা দাঁড়িয়েছে। প্রকৃতির ভেতর আশ্রমকন্যারা একান্ত হয়ে আছে, এক হয়ে আছে রং, তাই থেকে সহজ সৌন্দর্যের সৃষ্টি হচ্ছে, এমন ছবি অনেক এঁকেছেন তিনি। তিনি একটি ভারসাম্য তৈরি করতেন, একটা সামঞ্জস্য তৈরি করতেন প্রকৃতির পূর্ণতার সঙ্গে ছবির নারী-পুরুষের। এসব ছবিতে নির্জনতা ভেঙে যেত। অসংখ্য মানুষ শোভাযাত্রা করে কোথাও চলেছে, কখনো তারা শোভাযাত্রা-সংগীতে অংশ নিচ্ছে। তেমন ছবিও রয়েছে অনেক। ’৪৮ সালের পর নেপালে চলে গেলে এমন ছবি তিনি বেশ কয়েকটা করেন। তাঁর আরেকটি অনবদ্য সৃষ্টির কথা না বললেই নয়,

সে-ছবিটি হলো ১৯৩২ সালে আঁকা ‘The tree lover’.

ছবিটিতে একটা মোটা মতো লোক গাছের নিচে দাঁড়িয়ে আছে, তার রয়েছে উদাস দৃষ্টি। এমন হতে পারে, শীতকালের ছবি এটা। কেননা লোকটার কাঁধে একটা চাদর রয়েছে এবং দুহাত দিয়েই লোকটা সেই চাদর ধরে আছে। হয়তো ভোরবেলায় বা বিকেলে হাঁটতে বেড়িয়ে মানুষটা একটা বাগানে ঢুকে পড়েছে এবং সে কেবল একটা গাছের নিচে দাঁড়িয়ে থাকা উপভোগ করছে। কোথাও কোনো মাত্রাতিরিক্ত কিছু নেই, না বর্ণ লেপনে, না প্রকাশে। স্থিরতার একটা সহজ উপস্থিতি রয়েছে ছবিটির। মানুষের মোটা শরীরটি, তার পরা পাজামা, খড়মের মতো একটা পাদুকা এমন একটা পূর্ণতা দিয়ে, ভালোবাসা দিয়ে এঁকেছেন বিনোদবিহারী যে, বিস্ময়কর লাগে। এই ছবিটি ওই মোটা লোকটার পোর্ট্রেটও, কেননা মানুষটার একটা ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্য রয়েছে। আর পাঁচজনের থেকে আলাদা বৈশিষ্ট্য তাকে দেওয়া হয়েছে।

১৯৩২ সাল নাগাদ একজন মানুষ শান্তিনিকেতনে ছিলেন, যিনি এমন গাছ ভালোবাসতেন এবং গাছ লাগিয়ে বেড়াতেন। তিনি ছিলেন তেজেস চন্দ্র সেন, শান্তিনিকেতনের এক শিক্ষক। রবীন্দ্রনাথ এর নাম দিয়েছিলেন ‘তরুবিলাসী’। লম্বাটে এই ছবিটিতে কেবল কালো, ধূসর ও নীল রং মিশিয়ে টোন তৈরি করা, ঢোলা পাজামায় সাদা বেশি মেশানো হয়েছে মাত্র। বিনোদবিহারী তেজেস বাবুর বাগানে উপস্থিত হওয়া থেকে উৎসাহিত হয়েছিলেন এই ছবি আঁকতে।

পাঁচ

১৯৪৮-এর অক্টোবর মাসে বিনোদবিহারী একত্রিশ বছর শান্তিনিকেতনে থেকে নেপালের কাঠমান্ডুতে মিউজিয়াম কিউরেটরের চাকরি নিয়ে চলে যান। এই একত্রিশটা বছর একনাগাড়ে শান্তিনিকেতনে থেকে গেলেও কখনো বাইরে থেকেছেন, যেমন কয়েক মাস তিনি জাপানে থেকে আসেন। কিন্তু নেপালে থাকার পর তিনি যাবেন মুসৌরি, দেরাদুন, পাটনা। দশ বছর পর ১৯৫৮-তে তিনি আবার যোগ দেন কলাভবন, শান্তিনিকেতনে, তখন তিনি একেবারেই কিছু আর দেখতে পান না। ১৯৫৭ সালে চোখ অপারেশন হয় তাঁর এবং বরাবরের মতো যে চোখ ছিল তাও যায়। অর্থাৎ ’৪৬-৪৭ সালে হিন্দি ভবনে যে-ম্যুরালটি তিনি করেছিলেন বা ’৪২ সালে চীনা ভবনে যে ম্যুরাল তাঁর করা তা আবার কলাভবনে যোগ দিয়ে তিনি আর দেখেন না।

নেপালে যেসব ছবি এঁকেছেন তিনি, সেগুলোরও সংবেদনশীলতা প্রশ্নাতীত। মধ্যযুগীয় ধর্মীয় শহর হিসেবে আঁকতেন তিনি কাঠমান্ডুকে। মন্দির শহরে নানান শোভাযাত্রা এঁকেছেন তিনি এবং পরেও এসব ছবি এঁকেছেন। এই ছবিগুলোতে তাঁর হিন্দি ভবনের ম্যুরাল ‘মধ্যযুগীয়

সন্তদের জীবন’, তারও রেশ যে রয়ে গিয়েছে তাতে সন্দেহ নেই। কিন্তু এখন আগের তুলনায় দ্রুততার সঙ্গে আঁকেন তিনি। এই ছবিগুলোর গভীরতা ত্রিশ-চল্লিশের দশকের ছবির গভীরতায় পৌঁছোতে পারে না। আগের ছবির তুলনায় অস্থিরতা, চঞ্চলতা, উতরোল এসেছে ছবিতে কিন্তু তা সবসময় সুনির্দিষ্ট রূপ ধরে না বা দানা বাঁধে না। কথাটা বলা হচ্ছে বিনোদবিহারীর সঙ্গে বিনোদবিহারীর তুলনা করে, কোনো সাধারণ শিল্পীর সঙ্গে নয়। রেখার টান, রঙের ছোপ দ্রুততার সঙ্গে ঘটছে তখন, কোথাও মুসৌরি, দেরাদুন দৃশ্যচিত্রের সঙ্গে শিল্পী রামকিঙ্করের প্রচলিত কায়দার যোগাযোগ লক্ষ করি আমরা। চায়নিজ ল্যান্ডস্কেপের সঙ্গে কখনো মিলে যায় বিনোদবিহারীর করা মুসৌরির পাহাড়-চিত্রগুলো। এই কাজগুলোতে মুন্শিয়ানা রয়েছে যেমন তেমন নিঃশেষিত হয়ে যাওয়ার দিকে একটা ঝোঁকও প্রত্যক্ষ করা যায়। বিষয়কে আর আগের মতো অনুভব করেন না তিনি বরং তাঁর একটা গ্রাফিক্যাল রূপ দিয়েই ছবি শেষ করেন।

’৫৭ সালে সম্পূর্ণ অন্ধ হয়ে যাওয়ার পর পরই বিনোদবিহারী কাগজ কেটে তা সেঁটে paper cut-out করতে শুরু করেন। প্রায়শই তিনি ব্যবহার করেছেন উজ্জ্বল রঙিন কাগজ। সাধারণত যে-উজ্জ্বলতা তিনি প্রথমদিকের ছবিতে কখনো আনেননি। বিখ্যাত ফরাসি শিল্পী হেনরি মাতিস ত্রিশের দশকের শেষ থেকেই এই paper cut-out করেছেন এবং এ ছিল তাঁর পূর্বাপর কাজের উত্তরণও। অর্থাৎ মাতিসের কাছে যা ছিল একটা সামগ্রিকতা, তাই বিনোদবিহারীর ক্ষেত্রে হয়ে দাঁড়ায় একটা বিচ্ছিন্নতা। মাতিসের কাজের হারমনি, ব্যালান্সের তুলনায় বিনোদবিহারী অনেকটাই বিক্ষিপ্ত ও সীমাবদ্ধ। কিন্তু আবার উতরেও গিয়েছে এমন কয়েকটা কাজ রয়েছে। সহকারী নিয়ে তিনি যে-কাজগুলো করেছেন তাতে কোনো সন্দেহ নেই। আগে ড্রইং করে দিয়েছেন তিনি, সেইমতো সহকারীকে দিয়ে রঙিন কাগজগুলো লাগিয়েছেন, কখনো অবশ্য খবরের কাগজও ব্যবহার করেছেন। এই paper cut-out কাজগুলোতে তেমন কোনো ওরিয়েন্টাল প্রজেক্ট নেই বিনোদবিহারীর তখন আর, বরং সেই সময় স্মৃতিতে যেভাবে পৃথিবী দেখার অভিজ্ঞতাগুলো আসত, তাই-ই রূপদান করতেন তিনি। তিনি যেন শান্তি পাচ্ছেন, আরাম পাচ্ছেন এই paper cut-out গুলো করে। তা বোঝাই যায়। এ হয়েছিল তাঁর দুঃখিত জীবনে এক আনন্দযোগ।

অন্ধ হয়ে যাওয়ার পর এক ধরনের দ্রুততার সঙ্গে ড্রইং করার প্রবণতা জন্মায়। যেমন বাংলা হরফকে ক্যালিগ্রাফিতে প্রকাশের স্মৃতি তাঁকে এক ধরনের আশাবাদী করে রাখত নিশ্চয়ই, না হলে ’৭০ সালে বারবার ক্যালিগ্রাফি করতেন না ‘জয় তব বিচিত্র আনন্দে’র কথাটি। বিনোদবিহারীর সৃষ্টিশীলতার পরিপ্রেক্ষিতে শান্তিনিকেতন ও রবীন্দ্রনাথের ভূমিকা অস্বীকার করার কোনো উপায় নেই। আর বিনোদবিহারীর ভেতর সৃষ্টির তাগিদ এতটাই ছিল যে, অন্ধ হয়ে যাওয়ার পরও তিনি আবার জড়িয়ে পড়লেন সাহিত্য, শিল্প-ইতিহাস লেখার কাজে। একজন সহকারীকে নিয়ে তিনি লিখতেন। তাঁর লেখা সাহিত্য শুধু মৌলিক নয়, এত মর্মস্পর্শী যে, হৃদয় ছুঁয়ে যায়। শিল্পকথা ও ব্যক্তিগত ভাষ্যকেও কত অনায়াসে মেশাতেন তিনি।

বাংলার শিল্প-সংস্কৃতির পক্ষে এটা গৌরবের যে, এখানকার  শ্রেষ্ঠ শিল্পীরা শিল্পকর্মের সৃজন ও নন্দন নিয়ে কতকগুলো অসাধারণ লেখা লিখেছেন। রবীন্দ্রনাথ, অবনীন্দ্রনাথ, নন্দলাল থেকে বিনোদবিহারী, কে জি সুব্রহ্মণ্যন তাঁদের অন্যতম। বিনোদবিহারীর বাংলা গদ্যের ওপর স্বাভাবিক মুন্শিয়ানা তো ছিলই। তার ওপর তাঁর অসাধারণ শিল্পবোধ, শিল্প-ইতিহাসে জ্ঞান মিলিয়ে যে-গদ্য তিনি লিখেছেন, তা বাংলা সাহিত্যে চিরকালের মতো জায়গা করে নিয়েছে। বিনোদবিহারীকে তুলনা করা চলে এমন এক নদীর সঙ্গে, যিনি জীবনের কোনো বিপর্যয়েই থেমে যান না। বরং বদলে নিতে পারেন তাঁর যাত্রাপথ, হয়ে উঠতে পারেন আরেক গভীরতায় অন্য কোনো মানুষ। প্রবাহের গভীরতা সব অঞ্চলে একরকম নয়, কিন্তু থেমে যায়নি প্রবাহ। এই হলো বিনোদবিহারী।

বিনোদবিহারী নানান পর্যায়ে নানান রকম কাজ করেছেন। ভিন্ন ভিন্ন দেশের শিল্প-ইতিহাসকে আত্মস্থ করেছেন এবং প্রকাশ করেছেন। ব্যক্তিগত অভিব্যক্তির ভেতর ভিন্নতা আনবার জন্য শিল্প ইতিহাসের জ্ঞানকে কাজে লাগিয়ে সফল হন তিনি।

ছয়

বিনোদবিহারীর শ্রেষ্ঠ কাজগুলোর ভেতর পড়ে তাঁর ম্যুরালগুলো, যা ভিন্ন ভিন্ন সময়ে শান্তিনিকেতনে করেছেন। কেবল একটা ম্যুরাল রয়েছে বনস্থলীতে। আধুনিক ভারতীয় শিল্পকলার ইতিহাসে ম্যুরালগুলো অনন্য সম্পদ হয়ে আছে। ১৯৪০-এর আগেও ম্যুরালের কিছু নমুনা তিনি প্রস্তুত করেছিলেন, তা সম্পূর্ণ নষ্ট হয়েছে। অর্থাৎ এখন যে-ম্যুরালটিকে তাঁর প্রথম কাজ বলে চিহ্নিত করতে পারি তা হলো ১৯৪০-এ করা ‘বীরভূমের দৃশ্যচিত্র’, এ-কাজটি তিনি করেছিলেন কলাভবনের ছেলেদের হোস্টেলে। বীরভূমের গ্রামের যে-ভঙ্গি অর্থাৎ গ্রামের মাঝখানে থাকে একটা বড় পুকুর বা সরোবর আর তার চারদিকে নিত্যনৈমিত্তিক দিনযাপন, এই হচ্ছে ম্যুরালটির বিষয়। নির্বাচিত রঙে করা এই কাজটিতে মানুষ ও প্রকৃতির ভেতর সহজ সামঞ্জস্য ও ছন্দ রচনা করা হয়েছে এবং তাতে দর্শক কেবল একাত্ম হয়েই অংশগ্রহণ করতে পারে। যেহেতু হোস্টেলের ছাদে কাজটি করা হয়েছে, ফলে মাথার ওপরে আকাশ দেখার মতো ঘাড় বেঁকিয়ে কাজটা দেখতে হয়। অর্থাৎ সাধারণত আমরা যেভাবে দেখে থাকি, তা বদলে যায় এই দেখার আদলে। এবং কাজটাকে দেখতেও হয় একটা সামাজিকতা হিসেবে এবং তারপর অনুপুঙ্খ বা খুঁটিনাটি নজরে আসে। এত বড় কাজটায় কোথাও কোনো নির্দিষ্টতা নেই। বরং রয়েছে রবীন্দ্রনাথের ভাষায়, ‘আপনাতে আপনার নিগূঢ় পূর্ণতা’।

পুকুরকে কেন্দ্র করে যে-গাছগুলো এঁকেছেন বিনোদবিহারী, তা ভারতীয় মিনিয়েচারে দেখা গাছ বা ফুলের সঙ্গে মিলে যায়। বস্তুত ম্যুরালটির পুরো তল বিভাজনই করা হয়েছে মিনিয়েচারের ঢঙে। এত বড় কাজটায় কোনো নায়ক নেই যেমন, তেমন কোনো পার্শ্বনায়কও নেই। গ্রামের কত রকম পশু এঁকেছেন শিল্পী এবং তারা কত কায়দায়, ঢঙে উপস্থিত। মানুষও পশুর সঙ্গে কত পেশায়, জীবনযাত্রায় মিলিতভাবে উপস্থিত। অন্যথায় ফিগারগুলোর সঙ্গে বা গাছপালা ইত্যাদির সাপেক্ষে যে শূন্য দেশ নির্মাণ করা হয়েছে বা সমতল রয়েছে তাই একটা কাঠামোর মতো ভারসাম্য বজায় রাখে অর্থাৎ গাছপালা, পশুপাখি যে ক্যালিগ্রাফিকভাবে আঁকা তার ভারসাম্য কখনো নষ্ট হয় না। এবং এই ম্যুরালটিতে বিনোদবিহারীর কাম্যও এটাই, একটা সামঞ্জস্য জীবন ও পরিবেশের মানুষের সঙ্গে প্রকৃতির এবং বিশেষ রঙের উজ্জ্বলতার মাত্রাকে নিয়ন্ত্রিত করে তলদেশের সঙ্গে।

মানুষের জটলা নয়, অশ্লীল ভিড় নয়, কিন্তু মানুষের সংঘবদ্ধতায় অনেক মানুষ মনোযোগের সঙ্গে কিছু কাজ করছে, তা বিনোদবিহারীর বিষয় হয়ে দাঁড়ায় তাঁর দ্বিতীয় ম্যুরালে। এই ম্যুরালটির নাম হলো ‘শিক্ষাপ্রাঙ্গণে জীবন’, যা তিনি শান্তিনিকেতনের চীনা ভবনে ১৯৪২ সালে করেছিলেন। এক শিল্পী নির্জন ঘরে ছবি আঁকায় একান্ত মগ্ন, এই ছিল তাঁর বিষয়। ১৯৩৩ থেকে ’৩৫-এর ভেতর আঁকা ‘স্টুডিওতে শিল্পী’ ছবিটির বা তাঁর জাপানের অভিজ্ঞতা যেমন মূর্ত হয়েছিল ১৯৩৭-৩৮-এ আঁকা ‘স্ক্রলের দোকান’ ছবিটিতে, সেখানেও কয়েক জাপানি ধীর হয়ে বসে স্ক্রলের দোকানে কোনো কাজে ব্যস্ত, বলা যায়।

রবীন্দ্রনাথ যখন ‘শান্তিনিকেতন’ করেছিলেন তখনো তাঁর মনে এমন এক সমাহিত, সংঘবদ্ধ জনগোষ্ঠীর কথা এসেছিল নিশ্চয়ই, তাতে কোনো সন্দেহ নেই এবং সেই অর্থে শান্তিনিকেতনকে আশ্রমও ভাবা হয়েছে। বিনোদবিহারীর মনে এমন ভাবনা যে কত সক্রিয় ছিল তার উদাহরণ হলো চীনা ভবনে করা এই ম্যুরালটি। আমরা জানি, চীনা ভবনের প্রবেশপথেই রয়েছে নন্দলাল বসুর করা রবীন্দ্রনাথের লেখা অবলম্বনে ‘নটীর পূজা’ম্যুরালটি। তাই আরেকটি রবীন্দ্রভাবনা বিনোদবিহারীকে উস্কে দিয়েছিল এই ম্যুরালটি করতে, এমন অনুমান করা যায়। তার ওপর রবীন্দ্রনাথের মৃত্যুর এক বছরের ভেতরই এই কাজটা করেছেন বিনোদবিহারী, তখন নিশ্চয়ই শান্তিনিকেতনের রবীন্দ্রভাবনা ক্রমশই মানুষের ভেতর আলোড়ন তুলছিল। রবীন্দ্রভাবনা ও কবিতাকে দৃশ্যগত করে, চাক্ষুষ করে দেখানোর কাজটি নন্দলালসহ কয়েকজন শিল্পীরই বিষয় হয়ে ওঠে।

এই ম্যুরালটিতেই বিনোদবিহারীর আঁকা ফিগারগুলো লম্বাটে হয়ে দেখা গেল, যেমন দেখা যায় বাইজেনটাইন ও মেডিয়েভাল চিত্রকলায়। ম্যুরালটির বাম দিকটায় যেন কোনো বৌদ্ধ আশ্রম এঁকেছেন তিনি, কিছু মানুষকে তো বৌদ্ধ শ্রমণ বলে চিহ্নিত করা যায়। তল বিভাজনে যেমন চ্যাপ্টা আকার দিয়েছেন তেমন জাপানিজ আনুভৌমিক স্ক্রলের মতো ভাগ করা হয়েছে পুরো ম্যুরালটিকে, যেন আমাদের দেখা ধাপে ধাপে চলে ডানদিক বরাবর। এই ম্যুরালটিতে যেভাবে প্রকৃতি ও নারী-পুরুষকে সংস্থাপন করা হয়েছে তা পরবর্তীকালের কে. জি. সুব্রহ্মণ্যনের কাজের কথা মনে আসে। ব্যঞ্জনায়, উপস্থাপনায় নন্দলালের কাজের সঙ্গেও একটা সাযুজ্য দেখি আমরা। ঘরের ভেতরের লোকজন ও ঘরের বাইরের লোকজনকে একই তলে রেখে ও তাদের ভিন্ন ভিন্ন পরিসরের অনুভব সহজ ছন্দ তৈরি করে। নানান মানুষ বা ছাত্রছাত্রীরা এখানে নানান অবস্থায় রয়েছেন। কোনো পড়–য়া যেমন চেয়ারে বসে ঘুমোচ্ছে, খোলা জানালায় দাঁড়িয়ে কোনো যুবতী যুবকের সঙ্গে প্রেম করছে তাও দেখতে পাই বা জানালা দিয়ে উঁকি মারছে কেউ, আবার অনেকে মিলে কোনো গভীর কাজে ব্যস্ত। এই ম্যুরালটিতেও বিশেষ কোনো

নায়ক-নায়িকা নেই, কেবল এক ধারাবাহিক সামগ্রিকতা দেখতে পাই। নন্দলালের মতো বিনোদবিহারীর কোনো কাজ মধ্যবিত্ত রুচিবোধে কোনো আঘাত করে না, এরা উপস্থিত হয় নিরুদ্বেগের ছন্দে।

নেপাল থেকে ফিরে এসে বনস্থলীতে ১৯৫০-এ করা ম্যুরাল ‘নেপাল উৎসবের শোভাযাত্রা’তেও মানুষের একত্রে গমন বিনোদবিহারীর বিষয় হয়ে ওঠে। ম্যুরালটির বামদিকের প্যানেলে যদি শোভাযাত্রার আগমন বিষয় হয়ে ওঠে তবে ডানদিকে শোভাযাত্রার প্রস্থান হলো বিষয়। দ্বিমাত্রিকতা যেমন একটা বৈশিষ্ট্য তবে অপরটি হলো ফিগারগুলোকে লম্বাটে করে দেখানো। নেপালকে সাধারণভাবে একটা মধ্যযুগীয়, ধর্মীয় জীবন হিসেবেই উপস্থিত করেছেন বিনোদবিহারী, যদিও কোনো বিশেষ ধর্মে জোর দেননি তিনি। এখানে ভিড়ের বিপরীতে একা একজন লম্বা মহিলা ও বিশিষ্টতার সঙ্গে এঁকেছেন তিনি। অনেক ফাঁকা পরিসর রেখে শোভাযাত্রার ভিড়কে চিহ্নিত করা হয়েছে। এর পরও বিনোদবিহারীকে দেখা যায় ’৫২-৫৩ সালেও তিনি মানুষের শোভাযাত্রা খোল-করতাল সমেত গান গাইতে গাইতে চলেছে, এমন ছবি জলরঙে ও তেলরঙে এঁকেছেন, যদিও আলোচিত ম্যুরালগুলো তিনি এগ টেম্পেরাতেই করেছিলেন। মানুষের সংঘবদ্ধতা এবং সেই সংঘবদ্ধতায় প্রকৃতির সঙ্গে নিবিড় জোড় বিনোদবিহারীর অনেক কাজের বিষয়, আর হলো মানুষের সঙ্গে তারই নির্মিত স্থাপত্যের সম্পর্ক ও নাটক। স্থাপত্যের সঙ্গে এমনভাবে ফিগারগুলোকে রাখা, যা জাপানি চিত্রকলাকে মনে আনে।

সাত

রবীন্দ্রনাথ বাউল, ফকির-পরম্পরা নিয়ে গভীর উৎসাহ দেখিয়েছেন। জোড়াসাঁকোর ঠাকুরবাড়িতে লালন ফকির এসেছিলেন। মধ্যযুগের

সাধু-সন্তদের জীবন ও দর্শন নিয়ে বিশেষত কবীর, দাদু ইত্যাদি নিয়ে

শান্তিনিকেতনে বিখ্যাত শিক্ষক ও লেখক ক্ষিতিমোহন সেনের উৎসাহের অন্ত ছিল না এবং তিনি খুবই উল্লেখযোগ্য বই এই ধর্মমতগুলি নিয়ে লিখেছেন। কবীরের রচিত দোঁহা বা কবিতার অনুবাদ করেছেন ক্ষিতিমোহন। রবীন্দ্রনাথ গীতাঞ্জলি লিখবার সময়কাল থেকেই মধ্যযুগের সন্ত-কবিদের অনুরাগী। বিনোদবিহারী তাঁর শ্রেষ্ঠতম কীর্তি হিন্দি ভবনের দেয়ালে ‘মধ্যযুগের সন্তদের জীবন’ ম্যুরালটি সম্পূর্ণ করেন ’৪৬-৪৭ সালে। রবীন্দ্রনাথ, ক্ষিতিমোহন, বিনোদবিহারী এই মধ্যযুগের সন্ত-ভাবনার ভেতর বিশ্বমানবতার খোঁজ করেছিলেন। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শেষ হওয়ার পরে পরেই যেমন হিন্দি ভবনে আবহমান কাল ধরে মানুষে মানুষে মিলনের খোঁজ বিনোদবিহারী এই কাজটায় করেছিলেন। তেমন দেশবিভাগজনিত যে-হানাহানি উপমহাদেশের এই দিকটায় তখন ঘটছিল তারও একটা মানবিক বিকল্প হিসেবে এই কাজটা দেখা যায়। এ এক গভীর ও শান্ত প্রতিবাদ।

ভারতবর্ষের ইতিহাসে সহনশীলতা, ক্ষমাশীল একটা ইতিবাচক সমাজের খোঁজ রবীন্দ্রনাথ, গান্ধীজি, নেহরু করেছিলেন। সেই ইতিহাসের চিত্রকল্প বলেও ভাবা যায় এই ম্যুরালটি। করুণাধারা, সহমর্মিতা, সহনশীলতার পটভূমি এই ম্যুরাল। এই ভিত্তিচিত্র শুধু ঈশ্বর ও মানুষ নয়, বরং মানুষ ও মানুষ, যারা নদীর ধারার মতো দৈনন্দিনতার ভেতর আরো সহিষ্ণু হয়ে বেঁচে রয়েছে। এই সাধু ও মানুষেরা, এই সামগ্রিক দেশের জনপদ ও নদীপথের একেকজন হয়ে ওঠে। এখানে স্থাপত্য, প্রকৃতি, মানুষ এমন মিলিত ঐক্য নির্মাণ করে যে, সে-ই হয়ে ওঠে এক মহানদী, মানুষের মিলন স্রোত দিয়ে যা নির্মিত।

সেই সময়ে হিন্দি ভবনের প্রধান ছিলেন হাজারী প্রসাদ দ্বিবেদী। তাঁরই আমন্ত্রণে বিনোদবিহারী ছাত্র ও সহকর্মীদের নিয়ে কাজটি করেন। শুধু আমন্ত্রণ ও কাজ করার সুযোগ দেওয়ার জন্যই হাজারী প্রসাদ উল্লেখযোগ্য হয়ে থাকবেন শিল্প ইতিহাসে।

এই ম্যুরালে নানান বাঁকে রয়েছে ভিন্ন ভিন্ন মধ্যযুগীয় সাধুদের অনাড়ম্বর জীবনযাপনের উদাহরণ এবং সামগ্রিকভাবে তা একটা গভীর আখ্যান রচনা করে। একটা কলধ্বনির মতো আসে ম্যুরালটি দেখার প্রাথমিক অভিজ্ঞতা।

ফ্রেসকো বুয়োনো পদ্ধতিতে করা এই ম্যুরালটি আধুনিক ভারতীয় শিল্পের এক অনন্য উদাহরণ। ম্যুরালটি বিনোদবিহারী করেছিলেন ১৯৪৬ সালের ডিসেম্বর মাস থেকে ১৯৪৭-এর এপ্রিল পর্যন্ত। হিন্দি ভবনের প্রধান হাজারী প্রসাদ নিজেও ছিলেন মধ্যযুগীয় সন্ত ইতিহাসের একজন স্কলার। কবীর নিয়ে তাঁরও রচনা রয়েছে। ফলে এমন বিষয় নির্বাচনে হাজারী প্রসাদের সঙ্গে আলোচনা হয়েছিল নিশ্চয়ই বিনোদবিহারীর। সাধারণত পাঁচজন সাধু, যাঁরা কবিও ছিলেন তাঁদের নিয়ে এই ম্যুরালটি নির্মিত হয়। ম্যুরালটির বাঁদিক থেকে রয়েছেন রামানুজ, কবীর হয়ে সুরদাস, গুরু গোবিন্দ সিং এবং তুলসী দাস রয়েছেন পশ্চিমের দেয়ালে। তুলসী দাসকে বেনারসের দৃশ্যচিত্রের সঙ্গে সম্পূর্ণ একাকার করা হয়েছে। রামানুজকে আঁকার ক্ষেত্রে বিনোদবিহারী পরম্পরাগত ব্রোঞ্জ মূর্তির সহায়তা নিয়েছেন তেমন আরেক সাধককে দেখে মনে হয় শ্রীরামকৃষ্ণের মতন একজন। তুলসী দাস, সুরদাস ও কবীরের নির্বাচিত কবিতা বা দোঁহাও লেখা রয়েছে উত্তরের দেয়ালের ওপর দিকে।

যাঁরা শান্তিনিকেতনে গিয়ে হিন্দি ভবনে এই ম্যুরালটি দেখতে গেছেন, তাঁরাই জানেন, একটা হলের মতো ঘরের দেয়ালের ওপর দিকে এই ম্যুরালটি করা। হিন্দি শিক্ষা শেষে এই ভবন বন্ধ হলে আর ম্যুরালটি দেখা যায় না। একেবারেই অনাড়ম্বর পরিবেশে কাজটি রয়েছে। নির্বাচিত রং করা, একটানা এই চিত্রশৈলী প্রথমেই যেন নিজেকে মহিমায় উপস্থিত করে না কিন্তু পরতে পরতে তারপর অনন্যসাধারণ গল্পকর্মটি নিজেকে উন্মোচিত করে এবং দর্শক একাত্ম হয়ে পড়েন কাজটির সঙ্গে।

বিনোদবিহারীর মধ্যযুগের সাধকেরা সাধনা করেন সমাজের ভেতর থেকেই, তাঁরা সহবত ও মানুষে মানুষে মিলনের শিক্ষা দেন। এখানে সংসারের জীবন, ভেতর ও বাহিরকে সহজ ও সুন্দরভাবে সংঘটিত করা হয়েছে। যেমন কোথায় দক্ষিণের সাধক রামানুজের ক্ষেত্র শেষ এবং ভক্ত কবীরের শুরু তা আপাতদৃষ্টিতে বোঝাই যায় না। মুসলমান সাধক বলতে কবীরকে রাখা হয়েছে। কিন্তু কবীরকে ঘিরেই নানান মুসলমান ফকির, দরবেশের সাক্ষাৎ আমরা পাই। ‘মা ও সন্তান’ এই মোটিফটি বারবার ব্যবহার করা হয়েছে। কবীরের উলটোদিকে দেখতে পাই মা ও সন্তান আপ্লুত দৃষ্টিতে কবীরের দিকে তাকিয়ে আছে। কবীরের চারপাশে তাঁতিদের দেখা যায়, তাদের কাপড় রং করার কাজে ব্যস্তও দেখা যায়। যেভাবে ফিগারগুলো সংঘটিত করা হয়েছে তা বীরভূমের টেরাকোটায় যে-ঐতিহ্য রয়েছে মন্দিরের দেয়ালে তাও মনে করায়। এখানে জীবনযাত্রাকে আঁকা হয়েছে কোনো অতিরিক্ত আবেগমণ্ডিত না করে, কোথাও সাধকের জ্ঞান, উপদেশকে জীবনেরই আরেকটা উপাদান হিসেবে দেখানো হয়েছে।

কোনো বিশেষ মহিলা সাধক এই ম্যুরালে নেই। মধ্যযুগের কোনো মহিলা সাধক থাকতে পারত, যেমন মীরার কথা মনে আসে। অন্যথায় সমাজজীবনের যে-উদাহরণগুলো রাখা হয়েছে তাতে নারী-পুরুষ সমান অধিকার নিয়েই রয়েছে বলা যায়। বেনারসের পটভূমিকায় তুলসী দাস খুবই উল্লেখযোগ্য। আমরা জানি সংস্কৃত রামায়ণ পড়িয়ে লোক, রাষ্ট্রীয় রামায়ণ রচনা করেছিলেন তুলসী দাস। বেনারসের ঘাট, জনজীবন মিশিয়ে দেওয়া হয়েছে যে তারা ভিন্ন থাকে না। তারপর দেখা যায় ভক্ত সুরদাসকে। শরীরের আকার বড়-ছোট করে ফিগারটির উল্লেখযোগ্যতাকে কমানো-বাড়ানো হয়েছে। কিন্তু কোনো হিংসার চিহ্ন কাজটায় নেই। তুলনায় বড়-ছোট হয়েও কোনো অসংগতি হয় না কাজটাতে। একজন মাকেও দেখতে পাই, মুগ্ধ দৃষ্টিতে সুরদাসের দিকে তাকিয়ে আছেন।

কেবল মধ্যযুগীয় শিখ ইতিহাস থেকে গুরু গোবিন্দ সিংকে রাখা হয়েছে। গুরু নানককে না বেছে গুরু গোবিন্দ সিংকে নির্বাচন করায় অবাক লাগে। এই পর্যায়েই গুরুর হাতে তলোয়ার, অন্যদের হাতে বল্লম ইত্যাদি দেখি বা কয়েকজনকে ঘোড়ায় চড়তে দেখি আমরা। কিন্তু তা কেবল নিয়মানুগ, কোনো লড়াই সেখানে ঘটছে না। তার পাশেই জনজীবনকে খুবই মধুর করে আঁকা। সেখানেও মা ও শিশু রয়েছে একটা ছোট ঘরে এক প্রান্তে।

মধ্যযুগ ছাড়িয়ে যে আবহমান জীবনকথা বিনোদবিহারী নির্মাণ করেন, তার একটা ধ্র“পদী আবেদন রয়েছে। কতরকম ভঙ্গিতে জনজীবনের স্রোত বয়ে  গেছে  এই  কাজে। অথচ  সেই  কাজের মূল কথা মানুষে-মানুষে, ধর্মে-ধর্মে সহনশীলতা নির্মাণ করা। সেই অর্থে স্বাধীন ভারত নিয়ে গান্ধী, রবীন্দ্রনাথ যে ভাবনা ভেবেছেন তারও রূপায়ণ এ-কাজটি। এই কাজটি জাতীয় মহাকাব্যের মতো দর্শকের মনে গেঁথে যায়। এবং এই কাজটির ভেতর দিয়েই বিনোদবিহারীর শান্তিনিকেতন জীবনের প্রথম ও সবচেয়ে সৃষ্টিশীল অধ্যায়েরও শেষ হয়।

আট

বিনোদবিহারীর প্রভাব কয়েকজন উল্লেখযোগ্য শিল্পীর ওপর পড়েছে তাতে কোনো সন্দেহ নেই। প্রথমেই মনে আসে বরোদার বিখ্যাত শিল্পী ও

শিল্প-ঐতিহাসিক গুলাম মোহাম্মদ শেখের কথা। অধ্যাপক আর শিবকুমারসহ তিনিই বিনোদবিহারী শতবার্ষিকী প্রদর্শনীটি দিল্লির ন্যাশনাল গ্যালারি অব মডার্ন আর্টে কিউরেট করেন। এ পর্যন্ত ওই প্রদর্শনীটি বিনোদবিহারীর সবচেয়ে বড় প্রদর্শনী।

গুলাম শেখের কাজে যেমন মিনিয়েচার আঙ্গিকে সংস্থাপন থাকে তা বিনোদবিহারীর ‘মধ্যযুগীয় সন্তদের জীবন’ ম্যুরালটির কথা মনে পড়ায়। শেখের অসংখ্য কাজেই কবীর ও অন্যান্য সাধক এসেছেন, যাঁরা অসহিষ্ণুতার বিরোধিতা  করে বিনোদবিহারীর কাজের মতোই। বিনোদবিহারীর মতোই একটা ব্যক্তিগত, প্রগতিশীল ইতিহাস নির্মাণের ঝোঁক শিল্পী গুলাম শেখের। বম্বের বিখ্যাত শিল্পী অতুল  দোদিয়া বিনোদবিহারীর কাজে উৎসাহিত হয়ে কয়েকটি কাজ করেন। তার ভেতর উল্লেখযোগ্য হলো বিনোদবিহারীর করা ‘e…¶‡c«wgK ev The tree lover, 1932’ কাজটি নিয়ে অতুল উত্তর-আধুনিক কায়দায় একটি কাজ করেন। বিনোদবিহারীর অন্ধত্বও তাঁর একটি কাজের বিষয় হয়। এমনই একটা ছবিতে বিনোদবিহারীর একটা সংলাপও অতুল ব্যবহার করেন, ‘Blindness is a nwe feeling, a nwe experience, a nwe state of being’ সংলাপটির গভীরতা আমাদের অবাক করে। অন্ধত্ব কেবল হতাশার বস্তু না হয়ে উত্তরণের কারণ হয়ে ওঠে বিনোদের ভাষ্যে।

শিল্পী অতুল দোদিয়ার কাজে সরাসরি বিনোদবিহারীর কোনো প্রভাব নেই, কিন্তু বিনোদবিহারীর পর অতুল জাপানি চিত্রকলা নিয়ে উৎসাহিত হয়েছেন এবং তাঁর অসংখ্য কাজে জাপানি পরম্পরাগত কাজের ভূমিকা রয়েছে। নিলীমা শেখের কাজেও বিনোদবিহারীর ফিগারের যোগ রয়েছে। অর্পিতা সিংয়ের কাজেও বিনোদবিহারীর উপস্থিতি রয়েছে। যেমন অর্পিতার ‘Devi emerging from the Wednesday market 1990’ বিনোদবিহারীর ফিগারেটিভ স্টাইলের কথা মনে করায়।

বিনোদবিহারী যত বড় শিল্পী, তেমনই বড় চিন্তক ও লেখক, নানান প্রতিকূলতায়, শারীরিক সমস্যায় তিনি অফুরান, অশেষ। তবু শিল্পী হিসেবে তাঁর উচ্চতা দীর্ঘতর।

 

সূত্র নির্দেশ :

 

১.       Benode Behari Mukherjee, A Centenary Retrospective Exhibition. Curated by Gulam Mohammed Sheikh and R. Siva Kumar Vadehra Art Gallery, National Art Gallery, New Delhi, 2007.

২.       Flowers Benode Behari Mukherjee NGMA, The Guild, Mumbai, 2007.

৩.      Works   by   Benode  Behari  Mukherjee,  Akar  Prakar, June-July, 2012.

৪.       চিত্রকর, বিনোদবিহারী মুখোপাধ্যায়, অরুণা প্রকাশনী, কলকাতা-৬।

Leave a Reply