logo

শিল্পকলার আধুনিকতা

যো গে ন  চৌ ধু রী

এটা আনন্দের কথা যে, আজকাল বহু তরুণ-তরুণী শিল্পকলা নিয়ে চর্চা করছেন। চিত্রকলা কিংবা নানা রকমের আধুনিক আঙ্গিকে শিল্প সৃষ্টির মধ্যে তাঁরা বিশেষভাবে নিমগ্ন। শুধুমাত্র কলকাতা বা পশ্চিমবঙ্গ নয়, ভারতবর্ষজুড়েই তরুণ শিল্পীদের কর্মব্যস্ততা চোখে পড়ার মতো। আমাদের তরুণ বয়সে বা তারও আগে, শিল্পকর্মের মাধ্যম ছিল মূলত দ্বিমাত্রিক জলরং বা তেলরঙের চিত্র, ভাস্কর্য, গ্রাফিক চিত্র এবং সেরামিক বা পটারি। বর্তমানে তা সমসাময়িক জীবনের নানা উপকরণ ও মাধ্যম-নির্ভর হয়ে শিল্প সৃষ্টির পরিসরকে বহু গুণ বিস্তৃত করেছে। এখন একটি সমসাময়িক প্রদর্শনীকে ‘চিত্রকলা’ প্রদর্শনী না বলে ‘শিল্পকলা’ প্রদর্শনী বলতে হবে, কারণ, শুধুমাত্র দ্বিমাত্রিক চিত্রকলা এখন আর কোনো প্রদর্শনীতে দেখা যাবে না। এখন শিল্পকলার আঙিনায় এসেছে ভিডিও আর্ট, কম্পিউটার জেনারেটেড চিত্রকলা, কনসেপচুয়াল আর্ট, ইনস্টলেশন কিংবা বহুবিচিত্র মিশ্রিত মাধ্যমসৃষ্ট নতুনতর শিল্পকলা, যা চল্লিশ-পঞ্চাশ বছর আগে এদেশে অভাবনীয় ছিল। মাধ্যম ছাড়া শুধু চিত্রকলার প্রয়োগ-পদ্ধতি বা রীতিনীতির মধ্যেও এসেছে নানা সৃষ্টিশীল পরিবর্তন ও ভাঙচুর। এসবই সাধারণ দর্শকের কাছে নতুনতর এবং বিস্ময়কর। তবে বিদেশ কিংবা পশ্চিমি দেশগুলোতে শিল্পকলার এই পরিবর্তন বেশ কিছুদিন আগে থেকেই শুরু হয়েছে। সেসব ইতিহাস ঘাঁটলেই স্পষ্ট বোঝা যাবে।
আমি প্রতি মাসেই প্রচুর শিল্পকলার প্রদর্শনীর ক্যাটালগ পেয়ে থাকি দিল্লি, মুম্বাই, ব্যাঙ্গালোর, চেন্নাই, কলকাতা, বরোদা – এইসব জায়গা থেকে। তাতে ওখানকার সাম্প্রতিক শিল্পকলার রকমসকম, হাবভাব বুঝতে পারি। তাছাড়া সারা বছর ধরে বহু প্রদর্শনী দেখছি। আজকাল বেশ কিছু আর্ট জার্নাল প্রকাশিত হচ্ছে, তাতে শিল্পকলার বিস্তারিত সচিত্র খবরাখবর পাচ্ছি। এর সঙ্গে রয়েছে অকশন হাউসগুলো, যেমন সদবি, ক্রিস্টি কিংবা স্যাফ্রন আর্ট – তাদের প্রকাশিত পুস্তিকাগুলো শিল্পকলা জগতের অর্থনৈতিক হালচালের সংবাদসমেত আমাদের কাছে হাজির হচ্ছে।
এ-কথা বলতেই হয়, বিগত কয়েক বছরের আর্থিক মন্দায় শিল্পকলা জগতের বাজারে ভাটা পড়লেও এই কর্মকাণ্ডে তার খুব একটা ছাপ পড়েনি। প্রদর্শনী, নতুন গ্যালারির উদ্বোধন, আর্ট সেমিনার ইত্যাদি কার্যক্রমের খুব একটা কমতি নেই। তরুণ শিল্পীরাও, বিক্রিবাট্টার সমস্যা থাকলেও, কেউ কাজ বন্ধ করে বসে নেই। নানা ভাবনায়, নানা উপকরণে তাঁরা সৃষ্টির কাজে ব্যস্ত। এ-কথা মানতেই হবে, ভারতবর্ষজুড়ে তরুণ শিল্পীরা যে
উৎসাহ-উদ্দীপনা নিয়ে যেভাবে নতুনতর সৃষ্টিতে ব্যাপ্ত হয়েছেন, এর আগে এমনটা দেখা যায়নি। অবশ্যই এর পেছনে বাণিজ্যিক অর্থনীতি এবং শিল্পকলা জগতের অধুনাসৃষ্ট পেশাদারিত্বের একটা চোরা সম্পর্ক আছে। তরুণ শিল্পীদের মধ্যে শিল্পকলা জগতে তাঁদের প্রতিষ্ঠার আকাক্সক্ষা এবং আর্থিক প্রতিষ্ঠার প্রতি আকর্ষণ এর একটা কারণ। একই সঙ্গে শিল্পকলাচর্চা এবং সেসব নিয়ে ভাবনা ও পরীক্ষা-নিরীক্ষা চলছে যথেষ্ট পরিমাণে। পাশাপাশি, প্রতিষ্ঠিত শিল্পীরা তাঁদের নিজস্ব কাজের সৃষ্টিশীল ধারাকে যথেষ্ট আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে অব্যাহত রেখেছেন। যেমন দেখতে পাই, রামকুমার, রাজা, কৃষেন খান্না, অর্পিতা সিংহ, নীলিমা শেখ, গণেশ পাইন বা রামাচন্দ্রনের মতো শিল্পীর কাজে। নতুনরা মেতেছেন নতুনতর সৃষ্টির পরীক্ষা-নিরীক্ষায়। আধুনিক প্রযুক্তির কারণে বিদেশের সঙ্গে আরো বেশি যাতায়াত ও যোগাযোগের ফলে তাঁদের শিল্পকর্মের সঙ্গে যুক্ত হয়েছে আন্তর্জাতিক ভাবনা, আকার-প্রকার এবং প্রকরণ, যা এর আগে কখনো দেখা যায়নি।
তরুণ সৃষ্টিশীল শিল্পীদের মধ্যে এখন মূলত তিনটি ধারা দেখতে পাই। একদল শিল্পী মনে করেন, শিল্পকলা হবে আন্তর্জাতিক, তার কোনো দেশকাল সংস্কার নেই। আর একদল মনে করেন, শিল্পকলা আন্তর্জাতিকভাবে পরিচিত হবে কিন্তু তা নির্ভর করবে কোনো বিশেষ উপাদানের ওপর, যা যুক্ত থাকে স্থান-কাল ও সংস্কৃতির সঙ্গে, যা শিল্পীর একান্ত ঘনিষ্ঠ এবং আন্তরিক। আর কেউ কেউ এখনো মনে করেন, শিল্পকলা হবে জাতীয় বা দেশীয় প্রাচীন শিল্পকলা ও সংস্কৃতির প্রতিফলন। অনেক শিল্পীই অবশ্য বাস্তবে এতখানি সচেতনভাবে শিল্প সৃষ্টি করেন না। তাঁদের মধ্যে অনেকে আত্মবিশ্বাস নিয়ে কাজ করেন, আবার অনেকে যথেষ্ট অস্পষ্ট এবং নিজস্ব প্রকাশভঙ্গি, বিষয়বস্তু বা ভাবনা খুঁজতে ব্যস্ত। তরুণ শিল্পীদের ক্ষেত্রে এ বিষয়টি সত্য। তবে এ-কথা ঠিক, পশ্চিম বা পৃথিবীর নানা প্রান্তে, অর্থাৎ পশ্চিম ইউরোপ, চীন, জাপান বা দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় যেসব আধুনিক বা অত্যাধুনিক শিল্পকলার চর্চা হচ্ছে, তা আজকের আধুনিক তরুণ ভারতীয় শিল্পীদের কাজকে যথেষ্ট প্রভাবিত করছে।
এ-কথা মনে রাখতে হবে, আমাদের পরবর্তী পর্যায়ের যেসব শিল্পী আজ ভারতীয় শিল্পকলা জগতে শিল্প সৃষ্টির কাজে ব্যস্ত রয়েছেন, যেমন – অতুল দোদাইয়া, অঞ্জু দোদাইয়া, শিবু নাটেশন, জয়শ্রী চক্রবর্তী, জয়া গাঙ্গুলি, নটরাজ, বৈজু পার্থন, রবীন্দ্র রেড্ডি – তাঁরা ইতোমধ্যেই নিজ নিজ কাজের মধ্য দিয়ে যথেষ্ট প্রতিষ্ঠা অর্জন করেছেন। তাঁদের কাজের মধ্যে যেমন আন্তর্জাতিকতার ছোঁয়া রয়েছে, তেমনই রয়েছে প্রখর ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যের ছাপ কিংবা ভারতীয় সংস্কৃতি বা শিল্পকলার সুস্পষ্ট প্রভাব। ইতোমধ্যেই ভারতীয় শিল্পকলার ক্ষেত্রে তাঁদের অবদান স্বীকৃত হয়েছে।
এখন একটি প্রশ্ন প্রায়ই উঠে আসে দর্শকমহলে, বিশেষ করে তরুণ শিল্পীদের ক্ষেত্রে। তা হলো, আজকাল তাঁরা যেসব অভাবনীয় শিল্প সৃষ্টি করছেন তা কি সত্যি সত্যিই ‘আর্ট’ হচ্ছে না খেয়ালখুশির কাজ, যার কোনো অর্থ বা তাৎপর্য নেই কিংবা তা কোথাও কোথাও সম্পূর্ণত বিদেশি শিল্পকলার অন্ধ অনুকরণ! এই প্রসঙ্গে একটা কথা মনে রাখতে হবে, এক একটা যুগে বহু শিল্পী শিল্প সৃষ্টির কাজে মগ্ন হন। হাজার হাজার চিত্রকলা কিংবা অন্যান্য শিল্পকলার সৃষ্টি হয়ে থাকে। সমসাময়িককালে সেসব শিল্পকলা সমাজে আলোচিত, সমালোচিত বা প্রশংসিত হয়। শিল্পী যতদিন জীবিত থাকেন, মিডিয়া বা সরকারি, বেসরকারি সংগঠনের সঙ্গে, গ্যালারি, চিত্র-সমালোচক, পত্র-পত্রিকা বা সমাজের উঁচু মহলের সঙ্গে যোগাযোগের কারণে তিনি সামাজিকভাবে শিল্পী হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হওয়ার সুযোগ পান। তবে অনেক ক্ষেত্রেই দেখা যায়, শিল্পী হিসেবে সেই  প্রতিষ্ঠা বা নামডাক তাঁর শিল্পকর্মের গুণাগুণের জন্য নয়, যতটা উপরিউক্ত কারণগুলোর জন্য। তাছাড়া সত্যিকারের শিল্পকর্মের গুণাগুণ বোঝা ও তার সঠিক মূল্যায়ন করার মতো দর্শক বা শিল্প-সমালোচকের সংখ্যাও কম। ফলে যেসব শিল্পকর্ম সাধারণভাবে সমাজে পরিচিত বা স্বীকৃত হয় কোনো একটা নির্দিষ্ট সময়ে, তার অনেকটাই সঠিকভাবে হয় না, তার মূল্যায়নও সঠিক থাকে না। ফলে সময়ের সঙ্গে সঙ্গে দেখা যায়, সেইসব শিল্পী এবং তাঁদের সৃষ্ট শিল্পকর্ম পেছনের সারিতে চলে গেছে। এরকম বহু রয়েছে ইতিহাসে। তাছাড়া যে-কোনো সময়ে সৃষ্ট অজস্র শিল্পকলার মাত্র একটা সামান্য অংশ বা গুটিকয়েক শিল্পী উল্লেখযোগ্য হয়ে ওঠেন।
এত যে অসংখ্য শিল্পীর দেশজুড়ে শিল্প সৃষ্টির বিরাট কর্মযজ্ঞ চলেছে, তারও একদিন ঝাড়াই-বাছাই হয়ে মাত্র নির্দিষ্ট কিছু শিল্পকাজ এবং মুষ্টিমেয় কিছু শিল্পী শেষ পর্যন্ত উল্লেখযোগ্য বলে স্বীকৃতি পাবেন। এসব বলার প্রয়োজন হলো এ-কথাটি বোঝাবার জন্য যে, যা কিছু আঁকা হচ্ছে বা যা কিছু ‘সৃষ্টি’ হচ্ছে তার সবকিছুই সঠিক হচ্ছে এটা ভাবা ভুল। তবে এক একটা যুগে সার্থক শিল্প সৃষ্টির পরিমাণ কমবেশি হতে পারে। এক একটা দেশে শিল্প সৃষ্টির সফল আন্দোলন ঘটে ঐতিহাসিক কারণে। তেমন উদাহরণ ইতিহাসে অনেক আছে। সভ্যতা ও শিল্প-সংস্কৃতির কেন্দ্রস্থলগুলো যেমন সময়ের সঙ্গে সঙ্গে রাজনৈতিক, সামাজিক বা অর্থনৈতিক কারণে এক দেশ ও শহর থেকে আরেক দেশ ও শহরে সরে যায়, তেমনি আধুনিক
শিল্প-আন্দোলনগুলোও তার স্থান পরিবর্তন করে সময় ও সভ্যতার বিবর্তনে। এটা আশা করা যায়, বর্তমান সময় থেকে ভারতবর্ষ হয়তো এই রকম এক সফল শিল্পকলা আন্দোলন সৃষ্টির দিকে ক্রমাগত এগোচ্ছে তার উন্নত অর্থনীতি ও সামাজিক উন্নয়নের সঙ্গে সঙ্গে, যেভাবে চীনও তার উন্নত অর্থনীতি ও পৃথিবীজুড়ে যে-প্রতিপত্তি প্রতিষ্ঠা করেছে, তারই ফলস্বরূপ শিল্পকলার ক্ষেত্রেও সে আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠা অর্জন করছে।

আধুনিকতার ডামাডোল
তরুণ প্রজন্ম প্রসঙ্গে এ-কথা বলেছি – শিল্পকলা হিসেবে যা কিছু ‘সৃষ্টি’ হচ্ছে তার অনেকটাই শেষ পর্যন্ত মূল্যবান হিসেবে অবশ্যই গ্রাহ্য হবে না। পাশাপাশি, কিছু কাজ ইতোমধ্যেই সৃষ্টি হচ্ছে, যা আমাদের শিল্পকলার ক্ষেত্রটিকে সমৃদ্ধ করবে। স্বাভাবিকভাবেই, তরুণ শিল্পীরা অবশ্যই বর্তমান সময়ের চলতি শিল্পচর্চা, অর্থাৎ দেশি-বিদেশি উল্লেখযোগ্য শিল্পীর কাজের ধরন-ধারণ, ভাব-ভাবনা, রীতিনীতি থেকে প্রভাবিত হচ্ছেন। সেটা স্বাভাবিক। কিন্তু যখনই শিল্পী তাঁর নিজস্ব খোঁজ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে চলতি শিল্পকলাগুলোর হুবহু অনুকরণ করেন, যার সঙ্গে না আছে নিজস্ব ভাবনা, না আছে নিজস্ব উপলব্ধিগত বিষয়বস্তু বা আঙ্গিক, না আছে তাতে প্রাণের স্পর্শ, তখন তা অবশ্যই দুশ্চিন্তার বিষয় হয়ে ওঠে। আজকাল দেখি, অধিকাংশ তরুণ শিল্পীর মূল ভাবনা হলো তিনি কতখানি সমকালীন রীতিনীতি আকার-প্রকারগুলোকে শিল্পকাজে যুক্ত করতে পারছেন। এ-সময়ে উত্তর-আধুনিক বা উত্তর-উত্তর-আধুনিক ধরন-ধারণগুলো – যেমন নতুনতর মিডিয়ামের ব্যবহার, ভিডিও, ফটোগ্রাফি, ইনস্টলেশন, কম্পিউটার জেনারেটেড আর্ট, নানা ধরনের ত্রিমাত্রিক বস্তুর (যেমন – কাঠ, কাপড়, দড়ি, চেয়ার, টেবিল, আয়না, আলো-অন্ধকার বা কিছু) ব্যবহার নিয়ে তরুণ শিল্পীরা অবশ্যই বেশ ব্যস্ত থাকেন। এই সঙ্গে থাকছে কনসেপ্ট, মেসেজ ও নানা রকমের কনসেপচুয়াল লিটারারি বক্তব্য, সামাজিক বিষয় এবং সমস্যা। আধুনিক যুগে অবশ্যই বিষয় ও আঙ্গিকের যুগোপযোগী পরিবর্তন ঘটতে পারে। সেটা মেনে নিয়েও বলতেই হয়, শিল্পী যদি ‘ভিজ্যুয়াল আর্ট’ বা এমনকি ‘কনসেপচুয়াল’ ভাবগত শিল্প সৃষ্টির কথা ভাবেন তাহলেও তার মধ্যে এমন কতগুলো প্রয়োজনীয় মূল্যবান উপাদানের উপস্থিতি অনস্বীকার্য যা একটি শিল্পকর্মের প্রাণ প্রতিষ্ঠা করে, যার অনুপস্থিতিতে সেই কাজটি ‘শিল্প’ হয়ে উঠতে পারে না। আজকের ‘আঁভা গার্দ’ বা ‘উত্তর-আধুনিক’ শিল্পীদের কাছে বিষয়টি অবশ্যই তর্কসাপেক্ষ বলে মনে হতে পারে। কারণ পশ্চিম বা আন্তর্জাতিক শিল্পকলার জগতে আধুনিক শিল্পকলার সংজ্ঞাই এখন ভিন্নতর। অবশ্যই আমি তাঁদের সঙ্গে সহমত নই। কারণ শিল্পের একটি সমকালীন আবেদন আছে এবং থাকবে, তার আঙ্গিকগত, রূপগত, ভাবগত পরিবর্তন যাই হোক। অনুভবগ্রাহ্যতার বাইরে গিয়ে কোনো শিল্প সৃষ্টি সম্ভব নয়। সর্বকালীন আবেদন থাকে বলেই শিল্পকলা সংগ্রহালয়ে পুরনো দিনের ছবি এখনো আমরা দেখে উপভোগ করি, আনন্দ পাই। বর্তমানে যেসব শিল্পকলা সৃষ্টি হচ্ছে তাকে এমন হতে হবে, যার মধ্যে শাশ্বত গুণ থাকবে এবং বর্তমান ও ভবিষ্যতের শিল্পরসিক মানুষজনের কাছে তা উপভোগ্য হবে। তাই তরুণ শিল্পীদের এ-বিষয়টি বুঝতে হবে যে, শুধুমাত্র আধুনিকতার ডামাডোলে বাহ্যিক অনুভবহীন কোনো ‘শিল্পকর্ম’ যা দর্শকের দৃষ্টি ও হৃদয়কে স্পর্শ করতে পারে না, তেমন আধুনিক শিল্পকর্মগুলো এখনো যেমন অর্থহীন, ভবিষ্যতেও তাই। বর্তমানকালের তরুণ শিল্পীদের কাজের একটা বড় অংশের মধ্যে এই গভীরতর বিষয়টির অভাব চোখে পড়ে। সে-কারণেই তার অত্যাধুনিক বাহ্যিক রূপ-আঙ্গিক থাকা সত্ত্বেও তা মনকে স্পর্শ করে না অনেক সময়েই।

কেউ কারো তুলনা নয়
‘আঁভা গার্দ’ তরুণ শিল্পীদের মধ্যে কারো কারো এমন ধারণা আছে যে, আধুনিক শিল্পকলা সৃষ্টির প্রয়োজনে আধুনিক মিডিয়াম ও আঙ্গিকই একমাত্র মাধ্যম। এটা একেবারেই ভুল ধারণা। সময়ের পরিবর্তনে প্রযুক্তিগত উন্নয়নের ফলে আমাদের দৈনন্দিন জীবনে নানা ধরনের আধুনিক উপকরণ ও বস্তুর অভাব নেই। বিশেষ করে ইলেকট্রনিক মিডিয়ার ব্যবহারের মাত্রা এখন সীমাহীন। এ-কথা ঠিক, আজকের শিল্প সৃষ্টিতে অবশ্যই এসবের অনুপ্রবেশ ঘটবে। তাই বলে দ্বিমাত্রিক কাগজের ওপর জলরং, তেলরঙের মাধ্যমে কোনো আধুনিক শিল্প সৃষ্টি সম্ভব নয়, এটা একেবারেই ঠিক ধারণা নয়। বর্তমানে বহু শিল্পী ক্যানভাস বা কাগজের ওপর অসাধারণ সব অত্যাধুনিক চিত্রকলা সৃষ্টি করছেন। খুব কাছের একটি উদাহরণ দিই।
শান্তিনিকেতন কলাভবনের প্রাক্তন ছাত্রী মিঠু সেন এর আগে এবং এখনো নানা মাধ্যমে কাজ করে থাকেন। একই সঙ্গে তাঁর জলরঙের কাজ, হাতে তৈরি কাগজের ওপর আঁকা, দেশে-বিদেশে প্রশংসিত হচ্ছে। সেগুলোর বিষয়বস্তু অত্যন্ত স্বতন্ত্র এবং অবশ্যই আধুনিক।
প্রকৃতপক্ষে, আধুনিকতার উৎস আধুনিক মন। অত্যন্ত সূক্ষ্ম ও গভীর আধুনিক মননই সৃষ্টি করতে পারে আধুনিক বা তথাকথিত ‘অত্যাধুনিক’ বা ‘উত্তর-আধুনিক’ শিল্পকলা। এমনকি সব থেকে প্রাগৈতিহাসিক মাধ্যম মাটি দিয়েও তা সৃষ্টি হতে পারে। তবে সেই মাটি ব্যবহারের রীতিনীতি ও দৃষ্টিভঙ্গি হবে সম্পূর্ণ আধুনিক ও সৃজনশীল।
এ-কথা ঠিক যে, স্বাভাবিকভাবেই, নতুন শিল্পীরা পূর্ববর্তী শিল্পকর্মকে পেছনে ফেলে ভবিষ্যতের দিকে এগিয়ে যান। অর্থাৎ আঙ্গিক, বক্তব্য ও সমসাময়িক রীতিনীতির মাপকাঠিতে তা পূর্ববর্তী শিল্পীদের কাজ থেকে ভিন্ন। এই কারণে, বিশেষ করে কোনো কোনো তরুণ শিল্পী ধারণা করেন যে, পূর্ববর্তী শিল্প সৃষ্টিগুলোকে অতিক্রম করে আধুনিক শিল্প সৃষ্টিগুলো অনেক এগিয়ে ও উন্নত। এই ধারণাটাও ভুল। প্রকৃতপক্ষে সমস্ত উন্নয়নের নিয়মের মতোই শিল্পকলা সৃষ্টিরও একটা ধারাবাহিকতা আছে। পূর্ববর্তী অবস্থানের ওপর নির্ভর করে পরবর্তী উন্নত অবস্থানটি গড়ে ওঠে সমসাময়িক ইতিহাস, পরিবেশ, প্রযুক্তি ও অর্জিত জ্ঞানের ওপর ভর করে। একথাও ঠিক যে, আরো কয়েক যুগ পরে ভবিষ্যতের পরিবেশ ও প্রযুক্তি বর্তমানের এই অত্যাধুনিকতাকেও ছাড়িয়ে আরো এক নতুনতর আধুনিকতায় শিল্পকর্মকে পৌঁছে দেবে। যে-বিষয়টি বোঝা দরকার, এই প্রতিটি সময়ের সৃষ্ট শিল্পকর্ম তার সময়, জীবন, পরিবেশ, ভাবনা ও শিল্পচর্চার রীতিনীতিকে ধারণ করে থাকে। শিল্পকর্মগুলো সে-হিসেবে ঐতিহাসিক তাৎপর্য বহন করে। কোনো যুগ, সময় বা দেশের শিল্পকর্মই কোনোভাবে কোনো অংশে তুলনাযোগ্য নয়। তবে একটা কথা মনে রাখতে হয়, একটি সার্থক শিল্পকর্ম তার সময়কে অতিক্রম করে বেঁচে থাকে। না হলে একজন শিল্পী এত পরিশ্রম ও প্রচেষ্টা কেন করবেন তাঁর সৃষ্টির কারণে। সেইসব ‘শিল্পকর্ম’ই যুগোত্তীর্ণ হয়, যা সমসাময়িক পরিবেশ, জীবন, ভাবনা বা শিল্প আঙ্গিকের বিশেষ চরিত্রকে ছাড়িয়ে একটি ‘শাশ্বত গুণ’ অর্জন করে শিল্পীর গভীর উপলব্ধি ও অনুভবের ছোঁয়ায়। তাতে যুক্ত হয় এক অলৌকিকতা বা অপার্থিব এক রহস্যময় ‘ম্যাজিক কোয়ালিটি’। তখন প্রাচীন শিল্পকর্ম আর ‘প্রাচীন’ থাকে না। সেইসব প্রাচীন শিল্পকর্ম উত্তর-আধুনিক শিল্পকর্মের পাশাপাশি সমানভাবে মানুষের রস সৃষ্টির উপকরণ হয়ে ওঠে। এ কারণেই পিকাসো, ব্রাঁকুসি কিংবা জিয়াকোমেত্তির ভাস্কর্যের পাশে ‘দিদারগঞ্জের যক্ষী’ কোনো অংশে কম নয়। সে আমাদের গভীরভাবে আকর্ষণ করে। তখন আমরা ভুলে যাই, কোন সময় কোন সভ্যতা থেকে সে উঠে এসেছে। তবে এটা জানি, তার সৃষ্টির পেছনে রয়েছে নির্দিষ্ট সময়, জীবনযাত্রা, পরিবেশ ও শিল্পভাবনা। সমসাময়িককালে তাই শিল্পীরা শিল্প সৃষ্টি করবেন অবশ্যই এই সময়ের সমগ্র জীবন, পরিবেশ ও তথাকথিত উন্নয়নকে ভর করে। কিন্তু এই ‘আধুনিক’ বা ‘অত্যাধুনিক’ শিল্পকলাও নিজ গুণে শিল্পকলার ইতিহাসে স্থান করে নেবে। সে অন্য কোনো শিল্পকলার তুলনাও নয়, প্রতিযোগীও নয়।

Leave a Reply