মৃ ণা ল ঘো ষ
কলকাতায় সাম্প্রতিককালে এরকম ঘটনা বোধহয় ঘটেনি যে ভারতের রাষ্ট্রপতি দিলিস্ন থেকে কলকাতা এসেছেন কোনো একজন শিল্পীর প্রদর্শনী উদ্বোধন করতে। এরকমই একটি বিরল ঘটনা ঘটল ১২ ডিসেম্বর ২০১৫-র সন্ধ্যায়। রাষ্ট্রপতি প্রণব মুখোপাধ্যায় আইসিসিআরের প্রেক্ষাগৃহে উদ্বোধন করলেন প্যারিসপ্রবাসী বাংলাদেশের শিল্পী শাহাবুদ্দিন আহমেদের একক প্রদর্শনী। গ্যাঞ্জেজ আর্ট গ্যালারির উদ্যোগে আয়োজিত এই প্রদর্শনীটি অনুষ্ঠিত হয়েছে আইসিসিআরের দ্বিতলের ‘নন্দলাল বসু গ্যালারি’তে। উদ্বোধনের পর প্রদর্শনীটি চলে গেছে গ্যাঞ্জেজের নিজস্ব গ্যালারিতে। ১৫ ডিসেম্বর থেকে ১৬ জানুয়ারি ২০১৬ পর্যমত্ম সেখানেই দেখানো হয়েছে এই চিত্রমালা, যার শিরোনাম ‘শামিত্ম’।
উদ্বোধনী অনুষ্ঠানটি আর পাঁচটি প্রদর্শনীর উদ্বোধনের চেয়ে ছিল একটু আলাদা চরিত্রের। যেজন্য এদিকটিতে একটু আলোকপাত করা অপ্রাসঙ্গিক হবে না। জাতীয় সংগীত ও স্বাগত ভাষণের পর শিল্পী শাহাবুদ্দিনকে আহবান করা হয় ভাষণদানের জন্য। অনুষ্ঠানটি সঞ্চালিত হচ্ছিল ইংরেজিতে। প্রথা ভেঙে শিল্পী বাংলাতেই তাঁর ভাষণ দেন। তাঁর সমগ্র বক্তব্য ও বলার ধরন তাঁর ছবির গভীরে প্রবেশ করতে আমাদের অনেকটাই সাহায্য করে। অত্যমত্ম আবেগদীপ্ত কণ্ঠে তিনি বলেছেন বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সঙ্গে তাঁর সম্পর্কের কথা, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ব্যক্তিত্ব, শিল্পীর প্রতি বঙ্গবন্ধুর স্নেহ ও অনুপ্রেরণার কথা। কেমন করে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধই তাঁর ছবির বিষয় ও আঙ্গিক নির্ধারণ করেছে, বলেছেন সে-কথাও। তাঁর বলার ভেতরে যে আবেগ ছিল, সেই আবেগই তাঁর সৃজনেরও চালকশক্তি। অত্যমত্ম আবেগদীপ্ত শিল্পী তিনি। পরিপূর্ণভাবে রোমান্টিক। রোমান্টিকতাই তাঁর শিল্প সৃষ্টির মূল উৎস।
রোমান্টিকতার সঙ্গে ভালোবাসার একটা সংযোগ থাকে। অবশ্য ভালোবাসা তো যে-কোনো শিল্প-সৃষ্টিরই মূলগত প্রেরণা। কিন্তু রোমান্টিকতা কেবলই প্রেম নয়। প্রেম থেকে জেগে ওঠা প্রতিবাদী চেতনাই রোমান্টিকতার প্রধানতম এক লক্ষণ। সেই প্রতিবাদও আবেগ থেকেই উৎসারিত হয়। রোমান্টিকতা সম্পর্কে ইংরেজ কবি ওয়ার্ডসওয়ার্থের একটি উক্তি স্মরণ করা যায়। রোমান্টিকতার বৈশিষ্ট্য বোঝাতে তিনি বলেছিলেন, রোমান্টিকতা হলো : ‘স্পনটেনিয়াস ওভারফ্লো অব পাওয়ারফুল ফিলিং’। তীব্র আবেগের এই স্বতঃস্ফূর্ত উৎসারণ শাহাবুদ্দিনের ছবিতে খুব স্পষ্টভাবেই প্রতিভাত হয়। এই আবেগই তাঁর ‘ফর্ম’ বা রূপবিন্যাস পদ্ধতিকেও নির্ধারণ করে। তিনি বর্ণ প্রলেপ করেন অত্যমত্ম দ্রম্নত তুলির টানে। দেখে মনে হয় প্রাথমিক খসড়া বা প্রারম্ভিক রেখারূপের ভূমিকা সেখানে খুবই গৌণ। এই দ্রম্নততায় গড়ে-উঠতে-থাকা তাঁর রূপকল্প বিশিস্নষ্ট হয়। স্বাভাবিকতা থেকে অনেক দূরে সরে যায়। যেন শরীরী আয়তনময়তা অশরীরী সত্তায় রূপামত্মরিত হতে থাকে। তিনি যেন শরীর থেকে ভাব বা ‘আইডিয়া’কে বের করে আনতে চান।
এই প্রদর্শনীতে রয়েছে তাঁর অাঁকা উপমহাদেশের তিন মনীষীর ছবি : রবীন্দ্রনাথ, মহাত্মা গান্ধী ও মুজিবুর রহমান। এই তিনজনকেই তিনি মনে করেন এই উপমহাদেশে বা সমগ্র বিশ্বে শামিত্মর দূত। তাই ‘শামিত্ম’ শীর্ষক এই প্রদর্শনীতে এই তিন মনীষীর প্রতিমাকল্প তিনি পাশাপাশি রেখেছেন আমন্ত্রণপত্রে বা বিভিন্ন ব্যানারে। তাঁর অাঁকার পদ্ধতিতে এই তিনজনের অবয়বও বিশেস্নষিত হয়েছে। স্বাভাবিকতা থেকে সরে গিয়ে প্রজ্ঞা, গরিমা ও যন্ত্রণার আলোকিত উদ্ভাস হিসেবে চিত্রার্পিত হয়েছে। রূপায়ণ-পদ্ধতির এই বৈশিষ্ট্যই তাঁর আবেগদীপ্ত রোমান্টিকতার একটি লক্ষণ। স্বাভাবিকতাবাদী রূপায়ণে তিনি যে খুব দক্ষ শিল্পী এ বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই। সেই উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে আর একটি মুখাবয়বচিত্র দেখার সুযোগ হয়েছিল সেদিন দর্শকদের। অনুষ্ঠান শেষে তিনি রাষ্ট্রপতি প্রণব মুখোপাধ্যায়কে উপহার দেন একটি ছবি। ছবিটি ছিল প্রণব মুখোপাধ্যায়েরই আবক্ষ মুখাবয়ব-চিত্র, বড় ক্যানভাসের ওপর তেলরঙে অাঁকা। সেই ছবিতে আমরা দেখেছি – মুখাবয়বকে তিনি খুব বেশি ভাঙেননি। পূর্ণতার ভেতর দিয়েই প্রজ্ঞাকে পরিস্ফুট করেছেন। তাই রূপ যখন বিশেস্নষিত হয় তাঁর হাতে, তখন বোঝা যায়, শরীর ছাড়িয়ে তিনি চৈতন্যে পৌঁছাতে চান। চৈতন্যের আলোড়নকে উদ্ভাসিত করতে চান।
শামিত্মর প্রতীক হিসেবেই তিনি রবীন্দ্রনাথ, মহাত্মা গান্ধী ও মুজিবুর রহমানের ছবিকে এই প্রদর্শনীর স্মারক বা মুখবন্ধ হিসেবে উপস্থাপন করতে চেয়েছেন। কিন্তু ইতিহাসের নির্মম পরিহাস এই যে, এই তিন মনীষীর শেষোক্ত দুজনকেই হতে হয়েছিল হিংসা ও সন্ত্রাসের শিকার। আর রবীন্দ্রনাথ শেষজীবনে কেবলই বিধ্বসত্ম হয়েছেন স্বদেশে ঔপনিবেশিক শোষণের বিকৃত লালসায় আর আমত্মর্জাতিক সত্মরে ক্ষমতার নির্মম আস্ফালনে। কাজেই শামিত্ম কখনোই নির্দ্বন্দ্ব নয়। ক্রমাগত হিংসা আর মৃত্যু ভেদ করে জেগে উঠতে হয় শামিত্মকে। শাহাবুদ্দিনের প্রদর্শনীটি এই সংঘাতকেই তুলে ধরেছে। এই দ্বন্দ্বাকীর্ণ বাসত্মবতার ভেতর থেকেই তিনি শামিত্ম সন্ধান করেছেন। রোমান্টিকতার এটাও একটা লক্ষণ। যেভাবে প্রবাহিত হচ্ছে এই জীবন ও বিশ্বপ্রবাহ তাতে তৃপ্ত হন না শিল্পী। অমানবিক নৃশংসতা তাঁকে কেবলই বিধ্বসত্ম ও ব্যথিত করে। তিনি একে প্রতিহত করতে চান। গড়ে তুলতে চান মানবতা ও সুস্থতার আলোকিত পরিসর। তাই তাঁর সৃজন-প্রক্রিয়ায় একটা আলোড়ন চলতেই থাকে।
সেদিন তাঁর ভাষণে প্রসঙ্গক্রমে শাহাবুদ্দিন বলেছিলেন ফরাসি রোমান্টিক শিল্পী ইউজেন দ্যলাক্রোয়ার (১৭৯৮-১৮৬৩) কথা। তাঁর ছবির রূপবিন্যাসে যে গতির চঞ্চলতা আছে, তার দ্বারা উদ্বুদ্ধ বা অনুপ্রাণিত হওয়ার কথা বলছিলেন। শাহাবুদ্দিনের ছবির চরিত্র বুঝতে এখানে আমরা ইউরোপীয় রোমান্টিক আন্দোলনের বৈশিষ্ট্য একটু বুঝে নেওয়ার চেষ্টা করতে পারি। ইউরোপে রোমান্টিক আন্দোলনের সূচনা হয়েছিল অষ্টাদশ শতকের শেষ পর্যায় থেকে। ‘এনলাইটেনমেন্ট’ বা আলোকদীপ্তিতে জোর দেওয়া হয়েছিল যুক্তিবাদের ওপর। এই যুক্তিবাদের ভিত্তিতেই গড়ে উঠেছিল শিল্পবিপস্নব। শিল্পবিপস্নবের ফলে উৎসাহিত হচ্ছিল পণ্যায়ন। কলকারখানার বিসত্মারে ধ্বংস হচ্ছিল প্রকৃতি, দূষিত হচ্ছিল পরিবেশ। ব্যবসায়িক মুনাফাই হয়ে উঠছিল জীবনের একমাত্র লক্ষ্য। এরই প্রতিক্রিয়ায় সাহিত্যে ও শিল্পে জেগে উঠেছিল রোমান্টিক আন্দোলন। কাজেই রোমান্টিকতাকে বলা যেতে পারে প্রেম থেকে উদ্ভূত প্রতিবাদী আন্দোলন।
চিত্রকলায় ইংল্যান্ডে রোমান্টিকতার অন্যতম প্রতিভূ ছিলেন জে. এম. ডবস্ন্যু. টার্নার (১৭৭৫-১৮৫১)। ফরাসি দেশে দ্যলাক্রোয়া, থিওডোর গেরিকল্ট (১৭৯১-১৮২৪), পর্ল দেলরোচ (১৭৯৭-১৮৫৬), ফ্রাসোঁয়া রম্নড (১৭৮৪-১৮৫৫) প্রমুখ। টার্নার ছিলেন মূলত নিসর্গের শিল্পী। দ্যলাক্রোয়া বা গেরিকল্ট এঁকেছেন দুরমত্ম সংঘাত ও জঙ্গমতার অবয়বী ছবি। দ্যলাক্রোয়ার ‘লিবার্টি লিডিং দ্য পিপল’ (১৮৩০) বা ‘দ্য ডেথ অব সারডানাপলাস’ (১৭২৭-২৮) ছিল আন্দোলনের ছবি। শরীরী আলোড়নের ছবিও। নিও-ক্লাসিসিজমের পরিম-লের শিল্পী তাঁরা। সেই ধ্রম্নপদী স্বাভাবিকতা থেকে যদিও বেরিয়ে আসতে চাইছেন, তবু রূপায়ণে শরীরী পূর্ণতার আদলকে তখনো ভাঙতে পারেননি। তাই পূর্ণতার মধ্যেই গতি এনেছেন, চঞ্চলতা এনেছেন, এনেছেন সংক্ষুব্ধতা। শাহাবুদ্দিনের ছবিতে সেই জঙ্গমতা আছে কিন্তু শরীরী ডৌলের পরিপূর্ণতা নেই। শরীর ভেঙেছে দুর্মরভাবে। ভাঙতে ভাঙতে কখনো নিরবয়বের দিকেও গেছে।
এটা সম্ভব হয়েছে কেননা শাহাবুদ্দিনের রোমান্টিকতায় সময়ের স্বাভাবিক নিয়মেই মিশেছে অভিব্যক্তিবাদী পরিম-ল। জার্মানিতে এক্সপ্রেশনিস্ট আন্দোলনের সূচনা হয়েছিল ১৯০৫ সালে। এক্সপ্রেশনিস্ট আঙ্গিকের অন্যতম বৈশিষ্ট্য রূপাবয়বের বিশেস্নষণ। এই বিশেস্নষণাত্মক জঙ্গমতা কান্দিনস্কির (১৮৮০-১৯৩৮) ছবিতে, এমিল নোলদে (১৮৬৭-১৯৫৬), ফ্রাঞ্জ মার্ক (১৮৮০-১৯১৬), অস্কার কোকোস্কা (১৮৮৬-১৯৮০) প্রমুখ অভিব্যক্তিবাদী শিল্পীর ছবিতে রয়েছে। এই জঙ্গমতা এসেছে আদিমতার উত্তরাধিকার থেকে। আলতামিরার ঘোড়া, লাস্কোর বাইসন বা আমাদের ভারতের ভিমবেটকার যূথবদ্ধ হরিণের রূপায়ণেও এই তীব্র প্যাশন ও জঙ্গমতা অনুভব করা যায়। আদিমতার উত্তরাধিকার অভিব্যক্তিবাদে জারিত হয়ে শাহাবুদ্দিনের ছবিতে সঞ্চারিত হয়েছে। ভারতীয় আধুনিকতাবাদে যার প্রথম পূর্বসূরি রবীন্দ্রনাথ। তারপর রামকিঙ্কর।
যে-কোনো শিল্প সৃষ্টিতে আবেগ ও মেধা দুটোই প্রয়োজন। এবং এই দুইয়ের ভারসাম্য প্রয়োজন। তবু ব্যক্তিভেদে অনেক সময়ই এর কোনো একটির প্রাধান্য থাকে এক একজন শিল্পীর কাজে। ভ্যান গঘের ছবিতে যখন দেখা যায় আবেগের প্রাধান্য, সেজান তখন অত্যমত্ম মেধানির্ভর। পিকাসোতে যখন দেখা যায় আবেগের ব্যাপ্তি, ব্রাক তখন অনেক সংহত, স্থিরপ্রজ্ঞ। আমাদের দেশের আধুনিকতায় এই দ্বৈতের দুই প্রামেত্ম অবস্থান করেন অবনীন্দ্রনাথ ও রবীন্দ্রনাথ, বিনোদবিহারী ও রামকিঙ্কর। শাহাবুদ্দিনের ছবিতেও আবেগের প্রাধান্য বেশি। আবেগ দিয়েই তিনি মেধাকে চালিত করেন। এই বৈশিষ্ট্য দ্বারাই নিয়ন্ত্রিত হয় তাঁর আঙ্গিক। রবীন্দ্রনাথের মুখাবয়বটিকে তিনি যেভাবে ভেঙেছেন বা বিশেস্নষণ করেছেন তার তুলনা চলতে পারে একমাত্র রবীন্দ্রনাথের আত্মপ্রতিকৃতির সঙ্গে। কিছুটা রামকিঙ্করের রবীন্দ্র-প্রতিকৃতির সঙ্গেও।
শাহাবুদ্দিন মৃত্যুর সঙ্গে লড়ে ছবিকে অাঁকড়ে ধরেছেন জীবনের উজ্জীবনের উপায় হিসেবে। তাঁর জন্ম ১৯৫০ সালে অধুনা বাংলাদেশের ঢাকায়। শৈশব থেকে তাঁর ছবির জগতে আসা পারিবারিক প্রতিকূলতার সঙ্গে যুদ্ধ করে। এক সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন, ‘এই যে আমার হাসি, হাসলে গালে টোল পড়ছে, এটা জন্মগত নয়। লেখাপড়া বাদ দিয়ে ছবি অাঁকতাম বলে বাবা আমাকে মেরেছিলেন। সেটা ছোটবেলার কথা।’ (সাক্ষাৎকার : আবুল হাসনাত। কালি ও কলম, সেপ্টেম্বর ২০১৪)। তারপর ছবি অাঁকার ভেতর দিয়েই নিজেকে প্রমাণ করেছেন। ক্লাস নাইনে পড়েন যখন পাকিসত্মানের করাচিতে আয়োজিত এক প্রতিযোগিতায় ছবি এঁকে পুরস্কৃত হন। নিজের আত্মবিশ্বাস যেমন বাড়ে তাতে, তেমনি পারিবারিক বিশ্বাসও অর্জন করেন।
বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ এলো ১৯৭১ সালে। তখনো ছবিতে নিমগ্ন তিনি। তবু ঝাঁপিয়ে পড়লেন সেই মুক্তিযুদ্ধে। পস্নাটুন-কমান্ডার হয়ে যুদ্ধে লড়েছেন। বনের ভেতর যুদ্ধ করতে করতেই ছবি এঁকেছেন। প্রদর্শনীও করেছেন বনের ভেতরেই। তখনো পাকিসত্মানের সেনাবাহিনী আত্মসমর্পণ করেনি। তার আগেই স্বাধীন বাংলাদেশের বিজয় পতাকা তুলেছেন তিনি। তা নিয়ে এখনো তাঁর গর্বের অমত্ম নেই। উদ্বোধনী ভাষণে উলেস্নখ করেছেন সে কথাও। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ঘনিষ্ঠ সান্নিধ্যে আসেন। প্যারিস যাওয়ার কথা জেনে বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন, ‘প্যারিস যাচ্ছিস, পিকাসোকে মাত করে দিবি।’ ১৯৭৩ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারম্নকলা বিভাগ থেকে চিত্রকলায় স্নাতক শিক্ষা শেষ করেন। ১৯৭৪-এ প্যারিস যান উচ্চশিক্ষার্থে। ১৯৮১ পর্যমত্ম শেখেন École Nationale Supérieure des Beaux-Arts-এ। আঞ্চলিকতা ছেড়ে শিল্পের বিশ্বে উপনীত হলেন এখানে। মুক্তিযুদ্ধ, স্বাধীনতা যে আবেগ জাগিয়েছিল তাঁর ভেতর, সেই আবেগের ভিত্তি থেকেই আত্মস্থ করেন আদিমতা ও অভিব্যক্তিবাদের গতিশক্তি। গড়ে ওঠে তাঁর নিজস্ব আঙ্গিক।
বাংলাদেশের চিত্রকলার আধুনিকতায় যে প্রবহমান ধারা, তা থেকে বেরিয়ে এসে স্বতন্ত্র আঙ্গিক তৈরি করেন তিনি। বাংলাদেশে আধুনিক শিল্পচর্চার পথিকৃৎ ছিলেন শিল্পী জয়নুল আবেদিন (১৯১৪-৭৬)। দেশভাগের অব্যবহিত পরে ১৯৪৭-এর আগস্টেই তিনি কলকাতার আর্ট স্কুলের চাকরি ছেড়ে ঢাকায় যান। সেই সময় কলকাতার আর্ট স্কুলের চাকরি ছেড়ে চলে যান আরো কয়েকজন শিক্ষক-শিল্পী। তাঁদের মধ্যে ছিলেন হাবিবুর রহমান, শফিকুল আমীন, আনোয়ারম্নল হক, সফিউদ্দীন আহমেদ, সৈয়দ আলী আহসান প্রমুখ। ঢাকায় আসার পর জয়নুলের প্রধান কৃতিত্ব ওখানে একটি শিল্পশিক্ষা প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলা। ১৯৪৮-এর নভেম্বরে গড়ে ওঠে গভর্নমেন্ট ইনস্টিটিউট অব ফাইন আর্ট। তিনি এর অধ্যক্ষ নিযুক্ত হন। বলা যেতে পারে, বাংলাদেশে আধুনিক শিল্পকলা-চর্চার শুরম্ন এখান থেকে।
জয়নুল ছাড়াও প্রথম প্রজন্মের শিল্পীদের মধ্যে অগ্রগণ্য কামরম্নল হাসান (১৯২১-৮৮), সফিউদ্দীন আহমেদ (১৯২২-২০১২), আনোয়ারম্নল হক (১৯১৮-৮০), এস এম সুলতান (১৯২৮-৯৩), মোহাম্মদ কিবরিয়া (১৯২৩-২০১১) প্রমুখ। তাঁদের সৃষ্টির প্রধান অভিমুখ ছিল বাংলার লৌকিকের সঙ্গে পাশ্চাত্যের আধুনিক ও আধুনিকতাবাদী আঙ্গিককে সমন্বিত করে তোলার প্রয়াস। এর মধ্যে মোহাম্মদ কিবরিয়ার মতো কেউ কেউ বিমূর্ততার দিকেও গেছেন। ১৯৬০-এর দশকে প্রতিষ্ঠাপ্রাপ্ত শিল্পীদের মধ্যে বিশেষ অভিঘাত সৃষ্টি করেছেন আবু তাহের (জন্ম ১৯৩৪), সমরজিৎ রায়চৌধুরী (১৯৩৭), আবদুল মুকতাদির (১৯৩৬), রফিকুন নবী (১৯৪৩), মনিরম্নল ইসলাম (১৯৪৩) প্রমুখ। প্রথম প্রজন্মের শিল্পীদের সৃজন-প্রক্রিয়াকেই তাঁরা আরো পরিণতির দিকে এগিয়ে নিয়ে গেছেন। স্বদেশ ও বিশ্বের সমন্বয়-প্রয়াস ছিল তাঁদেরও প্রকল্পের লক্ষ্য।
১৯৭০-এর দশকে বাংলাদেশের শিল্পসৃজনে অসামান্য উজ্জীবন ঘটেছিল। মুক্তিযুদ্ধের চূড়ামত্ম দুর্দশা ও কষ্ট এবং জয়ের আনন্দ বাঙালিকে নতুন আশায় উদ্দীপিত করেছিল। ১৯৭৪ সালে বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমী প্রতিষ্ঠিত হয়। প্রথম জাতীয় প্রদর্শনী অনুষ্ঠিত হয় ১৯৮১ সালে। মুক্তিযুদ্ধের অভিজ্ঞতা নিয়ে যাঁরা শিল্পকলার ক্ষেত্রে আবির্ভূত হয়েছিলেন, তাঁদের মধ্যে অগ্রগণ্য শাহাবুদ্দিন। ১৯৭৪-এ তিনি প্যারিস চলে যান। শিক্ষা শেষ করেও সেখানেই থেকে যান। কিন্তু বাংলাদেশ বা ভারতের সঙ্গে তাঁর সংযোগ বিচ্ছিন্ন হয়নি কখনো। প্যারিসে আমত্মর্জাতিক শিল্পের পরিম-লের মধ্যে তিনি তাঁর দেশের অভিজ্ঞতাকে বিশ্বগত মাত্রায় উত্তীর্ণ করতে চেষ্টা করেন। সেই প্রয়াস থেকেই উৎসারিত হয় তাঁর নিজস্ব রূপপ্রকল্প, যেখানে জীবনের সংঘাত আছে, বিপর্যয় আছে, বিপর্যয়ের বিরম্নদ্ধে সংগ্রাম আছে, সেই সংগ্রাম অতিক্রম করে মানবতার জয়যাত্রাও আছে। এসবই প্রতিভাত হয়েছে ‘শামিত্ম’ শীর্ষক আলোচ্য প্রদর্শনীতে।
ক্যানভাসের ওপর তেলরঙে আঁকা মোট ৩৪টি ছবি নিয়ে আয়োজিত এই প্রদর্শনী। প্রকৃতপক্ষে যে ‘শামিত্ম’র সন্ধান করছেন শিল্পী তার মধ্যে ক্ষতও জড়িয়ে থাকে। দৃষ্টান্তস্বরূপ একটি ছবির উল্লেখ করা যেতে পারে। ২০১৫-তে আঁকা ছবিটির শিরোনাম ‘স্বাধীনতা’। দুরন্ত গতিতে একটি মানুষ ছুটছে। ক্যানভাসের
এ-প্রান্ত থেকে ও-প্রান্ত পর্যন্ত কর্ণ-বরাবর বিস্মৃত হয়ে আছে তার শরীর। বাঁ-পায়ের আঙুল স্পর্শ করছে আয়তক্ষেত্রে বামদিকের নিম্নবর্তী কৌণিক বিন্দু। উত্তোলিত বামহাতটি প্রায় ছুঁয়ে ফেলেছে ডানপাশের ওপরের শীর্ষবিন্দু। সমগ্র শরীরটি গতির দ্যোতনায় বিশিস্নষ্ট হয়ে যেন চারপাশের আলোকিত পরিমন্ডলে দ্রবীভূত হয়ে যেতে চাইছে। এই যে শরীর গতির উন্মত্ততায় একে মনে হচ্ছে যেন ক্ষত-লাঞ্ছিত। মাংসপেশির স্বাভাবিক বর্ণ ভেদ করে বেরিয়ে আসছে রক্তের আভা। কোনো এক অজানা লক্ষ্যের দিকে ছুটে যাচ্ছে এই মানব বা মানবী, যুবক বা যুবতী। তার গতির ধরন দেখে মনে হয় সে জানে না, তার এই ছুটে চলার লক্ষ্য কী। শুধু জানে এই গতিই তার লক্ষ্য। তীব্র অভীপ্সায় এই চলতে থাকাই তার স্বাধীনতা।
দুরমত্ম বিস্তৃত তুলিতে বর্ণ প্রলেপ করেন এই শিল্পী। কখনো কখনো হয়তো স্প্যাচুলাও ব্যবহার করেন। এই জঙ্গমতায় শরীর দ্রবীভূত হতে থাকে। মূর্ত থেকে বিমূর্তের দিকে যেতে চায়। অভিব্যক্তির বিশেষ এক মাত্রায় গিয়ে স্থির হয়ে থাকে। না, স্থির হয় না কখনো। স্থিরতাকেই জঙ্গমতায় অভিষিক্ত করতে থাকে। প্রেক্ষাপটে, সমগ্র পরিম-লে উদাত্ত এক আলোকিত আবহম-ল গড়ে তোলেন শিল্পী। শুভ্রতার এই ব্যবহার তাঁর ছবিতে বিশেষ এক মাত্রার সঞ্চার করে। এই আলোর প্রেক্ষাপটেই জীবনের জয়যাত্রা। এই জয়যাত্রার নামই স্বাধীনতা। আর স্বাধীনতার ভেতরই সম্পৃক্ত থাকে শামিত্মর প্রতিশ্রম্নতি।
একেবারে বিপরীত অভিব্যক্তির দ্বিতীয় আরেকটি ছবির উলেস্নখ করা যেতে পারে, যার শিরোনাম ‘উন্ডেড’, ‘আহত’ বা ‘ক্ষত’। আয়তাকার চিত্রপট অনুভূতিকভাবে বিসত্মৃত। পরিমাপ উলেস্নখ করলে আকৃতিটি বোঝা যাবে। বিসত্মার ৮৬.৫ ইঞ্চি আর উচ্চতা ২৮.৫ ইঞ্চি। এরকম এক বিসত্মৃত চিত্রপটে একটি মানব-শরীর ভূমিতে পড়ে আছে। শিরোনাম থেকে বোঝা যায় সে আহত। মৃত না হলেও অচেতন তো বটেই। দেহটি ছড়িয়ে আছে ওরকমই
কর্ণ-বরাবর। ডানপাশের নিম্নবর্তী কৌণিক বিন্দু থেকে বিপরীত দিকের ওপরের কৌণিক বিন্দু পর্যমত্ম। ওপরে আকাশ মেঘাবৃত। যেন বিষাদ ছড়িয়ে আছে। নিম্নভাগে শুভ্রতার প্রাবল্যে যে আলো, তাতেও উজ্জীবনের উদ্ভাস বিশেষ নেই। মৃত্যুর সঙ্গে জীবনের এই সংঘাত যেন স্বাধীনতা বা শামিত্মরও আবশ্যিক শর্ত।
‘দুঃখের মন্থনবেগে’ অমৃত উঠে আসার প্রত্যাশা এই শিল্পীর অনেক ছবিতেই থাকে। ‘Arreter Le Genocide’ তেমনি একটি ছবি। যুদ্ধের অভিজ্ঞতা সংহত হয়ে আছে এখানে। যুদ্ধক্ষেত্রে অজস্র শরীর ভূমিতলে সত্মূপীকৃতভাবে পড়ে আছে। তাদের আর আলাদা করে শরীর বলে চেনা যায় না। কোনো মানবিক পরিচয় নেই। সাদার সঙ্গে ঈষৎ লালের আভা মিশে আছে এক একটি শরীরে। এর মধ্যে দুটি ছবিতে মানুষের মাথাটিকে শনাক্ত করা যায় চুলের কালো রং থেকে। এই কৃষ্ণাভা, কোথাও কোথাও বিচ্ছুরিত রক্তচিহ্ন একাদিক্রমে ছড়িয়ে থাকা মৃতদেহগুলোর একঘেয়ে পৌনঃপুনিকতার মধ্যে খানিকটা ছেদ এনে মৃত্যুর সেই অনিবার্য বিসত্মৃতিকেই যেন আরো প্রগাঢ় করে তোলে। এই ছবিটিতে রূপ বিশিস্নষ্ট হতে হতে প্রায় বিমূর্ততার দিকে গেছে। মৃত্যু তো সবসময়ই বিমূর্ত। এই ভয়ংকর সর্বনাশের ভেতর থেকেই যেন আবার স্বাধীনতার এবং শামিত্মর বীজ অঙ্কুরিত হয়। শিল্পীর নিজের জীবন-অভিজ্ঞতা তাঁকে হয়তো এই প্রত্যয়ের দিকে নিয়ে গেছে।
এই প্রদর্শনীতে কয়েকটি ছবি আছে তিন মনীষীর, শামিত্মর দূত বলে শিল্পী তাঁর শ্রদ্ধাঞ্জলি নিবেদন করেছেন যাঁদের প্রতি : রবীন্দ্রনাথ, মহাত্মা গান্ধী ও শেখ মুজিবুর রহমান। এ প্রসঙ্গ উল্লেখ করা হয়েছে আগেই। ‘গান্ধী-২’ শিরোনামের ছবিটিতে দেখা যাচ্ছে মহাত্মা হেঁটে যাচ্ছেন এক কুয়াশাবৃত পরিম-লের ভেতর দিয়ে। সমগ্র পরিমণ্ডল এবং তাঁর শরীরও নিবিড় এক ছায়াচ্ছন্নতায় আবৃত। ‘বঙ্গবন্ধু-৩’ ছবিটিতে অনেক স্পষ্টতায় আবির্ভাব ঘটেছে বঙ্গবন্ধুর। তাঁর মুখের হাসিটি উজ্জ্বল। শুভ্র আলো পড়েছে মুখে, কাঁধের ওপরে। আর প্রায় বর্গাকার প্রেক্ষাপটের পুরোটাই নিবিড় তমসায় আকীর্ণ। রবীন্দ্রনাথের গানটির কথা মনে আসে ‘নিবিড় ঘন আঁধারে জ্বলিছে ধ্রুবতারা’।
এই প্রদর্শনীতে কয়েকটি পশুর ছবিও আছে, ঘোড়া এবং বাঘ। একদিকে জঙ্গমতা আরেক দিকে ক্ষুধাজনিত হিংসা – এই দুইয়ের প্রতীক হিসেবে উপস্থাপিত এই দুটি পশু চরাচরের পরিব্যাপ্ত শূন্যতার মধ্যে।
শামিত্মর সন্ধানে অভিযাত্রা এই শিল্পীর। সেই শাস্তির অনিবার্য শর্ত স্বাধীনতা। এই স্বাধীনতা অর্জিত হয় অনেক দুঃখের ও মৃত্যুর অভিঘাতের মধ্য দিয়ে। নিজের জীবনের এই অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়েই নিজস্ব তত্ত্ববিশ্ব গড়ে তুলেছেন তিনি। হিংসাদীর্ণ এই বিশ্বে স্বাধীনতার সন্ধানেই মানবসভ্যতার জয়যাত্রা। n