logo

শান্তির অন্বেষায় ইকবাল

মা হ মু দ  আ ল  জা মা ন

গত শতাব্দীর অন্তিম দশকে মোহাম্মদ ইকবাল তাঁর উদ্ভাবনী কৌশল, নিত্য-নিরীক্ষা ও বিষয়ের গুণে বাংলাদেশের চিত্রকলার ভুবনে এক সম্ভাবনাময় চিত্রকর হিসেবে আবির্ভূত হয়েছিলেন। তাঁর স্বাতন্ত্র্য ও শৈলীতে নব্য ভাবনার ছাপ ছিল। তিনি ছবি এঁকেছিলেন তাঁর মতো করে এবং বিষয় ও শৈলীতে বিশিষ্ট হয়ে উঠছিলেন। তাঁর সৃজনভূমিতে এক অনুভূতিময় ও সংবেদনশীল জগৎ সৃষ্টি হয়েছিল। আমরা লক্ষ করছিলাম, তাঁর মানসভুবনে বুদ্ধির দীপ্তির ছাপ। তিনি তখন ক্রমে নিজেকে উত্তরণের জন্য সদা সচেষ্ট ছিলেন। চারুকলায় শিক্ষা গ্রহণকালে মেধার ছাপ স্পষ্ট হয়ে ওঠে এবং তিনি শিক্ষকদের দৃষ্টি আকর্ষণে সমর্থ হন।

আমরা সকলে কিছুটা হলেও জানি যে, গত শতাব্দীর বিশ ও তিরিশের দশকের শিল্পপ্রয়াসে ভারতীয় দর্শনের অধ্যাত্মবোধ, লোকপুরাণ বা মানুষের জীবনের রহস্যময়তা নিয়ে এমন কিছু চিত্র সৃষ্টি হয়েছিল, যা ছিল নানা কারণে তাৎপর্যময়। এ-ধারাকে অনেকে পুনর্জীবন বলে অভিহিতও করেছিলেন। ভারতীয় চিত্রশিল্পে এ-ধারা পরবর্তীকালে শীর্ণ হয়ে পড়েছিল। এ-ধারা থেকেই পরবর্তীকালে লোকঐতিহ্য ও লোকায়িত প্রতিমাকে আধুনিক রূপায়ণে অনেকেই সিদ্ধি অর্জন করেন এবং এই বিশিষ্ট রূপায়ণ ভারতীয় চিত্রকলায় নবধারা বলে বিবেচিত হয়েছিল।

মোহাম্মদ ইকবাল পঞ্চম একক প্রদর্শনীতে সমাজবিচ্ছিন্ন, গৃহত্যাগী, সংসারে উদাসীন মানব-মানবীর যে-চিত্র অঙ্কন করেছিলেন তাতে তাঁর শিল্পীমনের আর্তি ছিল। এইসব মানুষের জীবনের অন্তর্গত বোধকে তিনি বিশ্বস্ততার সঙ্গে রূপায়িত করেছিলেন। বিষয়ের জন্য তাঁকে অবিরাম ‘খুঁজে’ বেড়াতে হয়নি। এ যেন তাঁর কাছে হয়ে উঠেছিল চোখ মেলে দেখা এবং পাওয়া।

সমাজবিচ্ছিন্ন অধ্যাত্মবোধে তাড়িত এই মানুষদের আমরা নানা দেশে এবং বিভিন্ন ধর্মে আস্থাশীলদের মধ্যে দেখতে পাই। ধর্মচেতনায় এঁরা ঈশ্বরের সন্ধানে নিরত চারণের মতো ঘুরে বেড়ান। এই গৃহহীন, কিছুটা জীবন সম্পর্কে উদাসীন মানুষেরা সাধারণ মানুষের সঙ্গে মেশেন। এঁরা হন নির্লোভ, স্বপ্নাশ্রয়ী। যৎসামান্য জামা-কাপড়, ত্রিশূল, মোষের শিংয়ের চোঙা, লাল কাপড়, পাথরের মালা, তাবিজ, জটাধারী মাথা, শ্মশ্র“ধারী মুখমণ্ডল, মাঝেমধ্যে মহিলা সঙ্গী, ঘোড়া ইত্যাদি সঙ্গে নিয়ে তাঁরা ইতিউতি ঘোরাফেরা করেন – গ্রামে-গঞ্জে বা কোনো মেলায় এঁদের দেখা যায়। গঞ্জিকা সেবন এঁদের নিয়মিত আচার। বোধের বাতাসে অতীন্দ্রিয় অদৃশ্য স্পর্শসুখ বা আর্তি তাঁদের সাধনার অপরিহার্য অঙ্গ। এইসব অনুষঙ্গ তাঁদের জীবনের সঙ্গে অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িত। শিল্পী ইকবাল তাঁর শিল্পীজীবনের এক পর্বে এবং সৃজনে এই ব্যবহার্য বস্তুসামগ্রী ঢালাওভাবে ব্যবহার করে নিজেকে আলাদা পরিচয়ে পরিচিত করেছিলেন।

পরবর্তীকালে সন্ন্যাস-জীবনের নানা অনুষঙ্গের পাশাপাশি তিনি অঙ্কন করেছিলেন সাধারণ মানুষের জীবনের বিভিন্ন দিক ও মানুষের নানা অভিব্যক্তির অবয়ব। কষ্ট ও যন্ত্রণার ছায়া ছিল এসব সাধারণ লোকের মুখাবয়বে। অভিনবত্বে, চমৎকারিত্বে ও রং-ব্যবহারের মনোজ সুষমার কারণে তাঁর সৃষ্টির সৃজনভূমি মৃত্তিকালগ্ন ও দেশভাবনার উজ্জ্বল প্রকাশ বলে বিবেচিত হয়েছিল।

মোহাম্মদ ইকবাল জাপান সরকারের বৃত্তি নিয়ে ১৯৯৯ সালে জাপান যান। চিত্রকলায় উচ্চতর শিক্ষা ও গবেষণা তাঁর মানসভুবনকে আরো পরিশীলিত, সমৃদ্ধ, নিরীক্ষাপ্রবণ ও শিল্পের অন্বিষ্টভুবন নির্মাণে সহায়ক ভূমিকা পালন করেছে।

তাঁর সৃষ্টির অভিনবত্বে ও স্বকীয় এক চিত্রভাষা নির্মাণের গুণে তিনি শিক্ষকমণ্ডলী এবং শিল্পবোদ্ধা মহলের দৃষ্টি আকর্ষণে সমর্থ হন।

তিনি এতদিন যে ধারা ও বিষয়কে অবলম্বন করে ছবি অঙ্কন করছিলেন সেই বৃত্ত থেকে সরে এসে শিল্প ও সময়ের বৃহত্তর পরিপ্রেক্ষিত নির্মাণে মগ্ন হন। জাপানে অবস্থান সত্ত্বেও তিনি সাম্প্রতিক জাপানি চিত্রকলার প্রবণতায় প্রভাবিত হননি। বরং সৃজনের নতুন ভুবন নির্মাণে ব্রতী হলেন। তাঁর শিল্পচৈতন্যে এক নিজস্ব পথ নির্মাণের তাগিদ ছিল। এই তাগিদ ও পথ নির্মাণ তাঁকে খ্যাতি ও প্রতিষ্ঠা এনে দিয়েছিল। এই সময়ে করা তাঁর পাঁচটি কাজ পুরস্কৃত হলো। তিনি বাংলাদেশের মুখ উজ্জ্বল করলেন। তাঁর সৃষ্টিতে বিমূর্ত প্রকাশবাদী ছোঁয়া থাকলেও মানুষের অবয়ব গঠন ও রঙের ব্যবহারে এলো নমিত উজ্জ্বলতা। অমিত সম্ভাবনা নিয়ে তাঁর সৃষ্টি হয়ে উঠল আরো পরিণত। মানুষ ও যাপিত জীবনের নানা অভিব্যক্তিকে তিনি পটে তুলে ধরতে সচেষ্ট হলেন। এই সময়ের কাজে তাঁর সাধনা ও সাফল্য নতুন মাত্রা নিয়ে উন্মোচিত হলো।

বেঙ্গল গ্যালারিতে ৬-১৭ এপ্রিল ২০১২ তাঁর যে প্রদর্শনী হলো তাতে চিত্রকর্মের সংখ্যা ছিল ২৫। প্রদর্শনীতে এ-সময়ের ভাবনা খুবই হৃদয়গ্রাহী ভাষা ও শৈলীতে তিনি রূপায়িত করেছেন। সভ্যতার সংকট, যুদ্ধ ও সন্ত্রাস তাঁর শিল্পসত্তায় যে আততি নিয়ে এসেছিল তার যথার্থ অভিব্যক্তি প্রত্যক্ষ করেছি।

২০০৩ সাল থেকে তাঁর সৃষ্টির উদ্যানে মনোগ্রাহীভাবে একধরনের বৃত্ত আমরা দেখতে পাই, যা পৃথিবীর পরিবেশ দূষণজনিত সংকটেরই প্রতীকী রূপ। তিনি তাঁর সৃষ্টির উজ্জীবনী বিভাব দ্বারা প্রত্যাশা করেন এর নিরাময়। হিংসা, যুদ্ধ ও বর্বরতার বিপরীতে তিনি আকাক্সক্ষা করেন শান্তি। এই আকাক্সক্ষার ফল হিসেবেই ২০০৫ সাল থেকে তাঁর শিল্পের ভুবনে অনুষঙ্গ হিসেবে শিশুমুখের নানা অভিব্যক্তির রূপ আমরা লক্ষ করি। এই শিশুমুখগুলোর অভিব্যক্তি, তাদের চোখের দৃষ্টি অনেক বেশি স্পষ্ট। এই অভিব্যক্তি অনেক ক্ষেত্রে অর্থময়। এসব অভিব্যক্তিতে যে বিষাদ ও অনিশ্চয়তাজনিত উদ্বেগ ও উৎকণ্ঠা ক্রিয়াশীল তাতে শিল্পীমনের শান্তির প্রত্যাশা আরো গভীরভাবে উচ্চকিত। পরিবেশের বিপর্যয় ও যুদ্ধের ভয়াবহতায় অনেক ক্ষেত্রে এই শিশুদের নিরাপত্তাহীনতার এক বোধেও তাড়িত হতে দেখা যায়। তাঁকে নস্টালজিয়ায় আক্রান্ত করে। ফলে তাঁর চিত্র-সৃষ্টির ভেতরমুখী চাপে স্বচ্ছ ও অস্বচ্ছভাবে এসে ভিড় করে

বাল্য-কৈশোরের গ্রাম, তাঁর ঘরবাড়ি, গাছপালা, নদী-নৌকা, পুকুর-কুয়ো, মানুষ, হাঁস, ঘোড়া ও মহিষের নানা অনুষঙ্গ।

জাপানের বৃহত্তর শিল্প-পরিমণ্ডলে মোহাম্মদ ইকবালের দীর্ঘদিনের বিচরণ। জিজ্ঞাসা, চিত্রবিদ্যাচর্চায় মোহাম্মদ ইকবালের মধ্যে নব্য চৈতন্যের জন্ম হয়। তিনি দীর্ঘদিন অবস্থান করেন জাপানে। সভ্যতার সংকট, বিশেষত যুদ্ধ তাঁকে বিচলিত করে। পৃথিবীর বিভিন্ন স্থানে সংঘটিত যুদ্ধ, অসহিষ্ণুতা, সন্ত্রাস, দ্বন্দ্ব তাঁর শিল্পের মানসযাত্রায় প্রভাব ফেলে। বিশেষত যুদ্ধের ফলে মানব সভ্যতার বিকাশ ব্যাহত হওয়ায় যে বিপর্যয় সৃষ্টি হয় তাকে উপজীব্য করে তিনি ছবি এঁকে নব্য আরেক ধারার উন্মোচন ও বৈশিষ্ট্যের অধিকারী হন।

আমরা তাঁর কাজে দেখেছি জীবনকে ভালোবাসার অদম্য তাগিদ আর প্রতীকী অভিব্যক্তিতে জীবনের স্বরূপ উপলব্ধির ক্ষেত্রে দক্ষতা। যৎসামান্য রেখাও জীবনের সূক্ষ্ম বোধকে উন্মোচন করতে যেন তৎপর। নতুন জগৎ অন্বেষণের তাগিদ ও শিল্পের আন্তর্জাতিক চেতনা ও আধুনিকতার ধারণা তাঁকে এই সময় আলোড়িত করেছে। এই সময়ের কাজে প্রতিফলিত হয়েছে জীবন-যন্ত্রণার সংকট ও সভ্যতার ধ্বংসাত্মক প্রবণতা।

মোহাম্মদ ইকবালের সৃষ্টিকর্ম অনেকটাই বিমূর্ত। তবে তার মধ্যেই ধরা পড়ে মানুষ ও যাপিত জীবনের নানা অভিব্যক্তি। সভ্যতার পাশাপাশি ধ্বংসেরও যে নীরব খেলা চলে, তাও তিনি ফুটিয়ে তোলেন তুলির আঁচড়ে। আর এর মাধ্যম হিসেবে শিশুর মুখাবয়ব ব্যবহার করেছেন। শিশুর অভিব্যক্তির মধ্যে তিনি খুঁজেছেন যুদ্ধ, মহামারি কিংবা

পরিবেশ-বিপর্যয়ের প্রসঙ্গ। ব্যাখ্যা দিতে গিয়ে শিল্পী বলেন, আমার অবলোকন ও উপলব্ধি শান্তির অন্বেষায়।

যে-কোনো সৃজনশীল মানুষ প্রতিনিয়ত পরিবর্তন প্রয়াসী হয়ে ওঠে। সৃষ্টিকে গহনতা-সন্ধানী ও অতলস্পর্শী করার জন্য বাঁক নেয় নদীর মতো। বিষয়ে বৈচিত্র্যে আনয়ন ও জীবন অনুষঙ্গী সৌন্দর্যধ্যান জীবনের বহুমাত্রিক সংকটের রূপায়ণ তাঁর অন্বিষ্ট হয়ে ওঠে। মোহাম্মদ ইকবাল এই চেতনা থেকেই বর্তমানের সংকটকে চিত্রপটে তুলে ধরার প্রয়াসী হন।

শিল্পী ইকবাল শিশু প্রতিকৃতি এঁকেছেন বিভিন্ন অভিব্যক্তিতে। অধিকাংশই কিছুটা নির্লিপ্ত। চোখে অনেক বেশি সূক্ষ্ম মনোযোগে সুচারু কাজ করেছেন। তেলরঙের তলে আঁচড় কেটে স্কেচের মতো আবহ নির্মাণ করেছেন। শিল্পী এ প্রসঙ্গে বলেন, ‘পৃথিবীর সর্বত্র যে যুদ্ধের ভয়াবহতা, পরিবেশ দূষণসহ অন্তিম অর্থে মানবিক বিপর্যয় ঘটছে, এ জন্য আসলে  শিশুদের মনস্তাত্ত্বিক গঠন বিনষ্ট হচ্ছে সবচেয়ে বেশি। ফলে মানবজাতির ভবিষ্যৎ মারাত্মক হুমকির সম্মুখীন। এ বিষয়টি আমাকে ভাবায়। আমি এ বক্তব্যটিই পৌঁছে দিতে চাই যে, এই সংকটের সমাধানে বড়দের একত্র হয়ে কাজ করতে হবে।’

শিশুদের স্বপ্ন, আকাক্সক্ষা ও শান্তির অন্বেষায় এক প্রতীকের মতো হয়ে ওঠে তাঁর চিত্রগুচ্ছ। তাঁর সৃষ্টিতে শিশুদের চোখে যে অভিব্যক্তির বিচ্ছুরণ দেখি, সেখানে অনিশ্চয়তা প্রাধান্য বিস্তার করে। এই অভিব্যক্তি শুধু মানবিক দলিল নয়, সমকালেও প্রতিচ্ছবি হয়ে ওঠে। একজন সৃজনশীল মানুষ হিসেবে এই মানবিক বোধ রূপায়ণে সার্থকতা অর্জন করায় তিনি হয়ে ওঠেন বৈশিষ্ট্যের অধিকারী। তাঁর প্রজন্মের অনন্য শিল্পী।

মোহাম্মদ ইকবালের সাম্প্রতিক চিত্রচর্চায় ও সাধনায় তাঁর সংবেদনশীল শিল্পী-হৃদয় সভ্যতার বিপর্যয়ে যে কতভাবে বিচলিত হয়েছে কয়েকটি চিত্রে তার স্বাক্ষর আছে। তাঁর সৃষ্টিগুচ্ছে চারপাশের চেনা-অচেনা জগৎ, সামাজিক মূল্যবোধের টানাপড়েন প্রতিফলিত হতে দেখি। এই প্রদর্শনীতে তারই কিছু নিদর্শন রইল।

আমরা তাঁর সাফল্য কামনা করি।

মোহাম্মদ ইকবাল : ১৯৬৭ সালে জন্মগ্রহণ করেন। ১৯৮৯ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা অনুষদ থেকে এমএফএ ডিগ্রি অর্জন করে জাপান সরকারের বৃত্তি নিয়ে জাপান যান। ২০১০ সালে টোকিও ইউনিভার্সিটি থেকে পিএইচ ডি ডিগ্রি লাভ করেন। এ পর্যন্ত তিনি তেত্রিশটি একক প্রদর্শনী এবং বহু দলবদ্ধ প্রদর্শনীতে অংশগ্রহণ করেন। ২০১০ সালে টোকিও অব দ্য আর্টস প্রদত্ত সম্মানজনক নোমুরা অ্যাওয়ার্ডসহ (গ্রান্ড প্রাইজ) আরো পুরস্কার পেয়েছেন। তিনি বর্তমানে চারুকলা অনুষদে (ঢাবি) সহকারী অধ্যাপক হিসেবে কর্মরত আছেন।

Leave a Reply