ই না পু রী
২০১১ সালটা ভারতীয় চিত্রকলার পৃষ্ঠপোষকদের এবং তার গতিপ্রকৃতি-সন্ধানীদের কাছে স্মরণীয় হয়ে থাকবে – ইউরোপজুড়ে অতি মর্যাদাপূর্ণ অনুষ্ঠানে ভারতীয় শিল্পীদের সংশ্লিষ্টতার কারণে। ভেনিস বিয়েনালের একটা ক্ষেত্র আর্সেনালে – যেখানে এককালে ছিল জাহাজনির্মাণের জায়গা, সেখানে – উন্মুক্ত কংক্রিট, ইটের দেয়াল, বিশাল কলাম এবং বিস্তৃত শূন্য অংশে সৃষ্টি হয়েছে বিয়েনালের জাদুকরী এক উদ্ভট পুরী। এর কিউরেটর, সাংস্কৃতিক তাত্ত্বিক রণজিৎ হোসকোট, প্রকোপনভাবে এর নাম দেন, ‘সকলেই একমত যে এটি বিস্ফোরিত হতে যাচ্ছে’। ভারতীয় প্যাভিলিয়নের জন্য তিনি সেইসব শিল্পীকে বেছে নিয়েছিলেন, যাঁরা ইতিহাসের জটিলতা এবং জীবনযাত্রার নিত্যপরিবর্তনশীলতার কথা তুলে ধরেন নিজেদের কাজে। তাঁর ভাষায়, ‘জারিনা হাশমী, প্রণীত সোই, জিজি স্কারিয়া এবং ডিজায়ার মেশিন কালেক্টিভ মিলে বিচিত্র সব আঞ্চলিক আধুনিকতা, ধর্মীয় ধারা, উপসাংস্কৃতিক স্থান, নন্দনতাত্ত্বিক ধরন ও দার্শনিক
চিন্তার ঝোঁকগুলো তুলে ধরেন। তাঁরা সবাই মিলে সেই গন্তব্যে আমাদের পৌঁছে দেন না যার নাম জাতি। বরঞ্চ ভারতের একজন হওয়া বলতে কী বোঝায়, পুনরায় তা কল্পনা করা যায় কি না, এমন এক ভাবনার শুরুতে নিয়ে যান।
জারিনা হাশমীর এচিংয়ে এক যুগাবসানের জন্য শোক এবং দেশবিভাগের নিদারুণ যন্ত্রণায় প্রত্যাবর্তনের যে-চিত্র পাই, তাতে ক্ষীণ রেখার জটাজালে প্রতিফলিত হয় দক্ষিণ এশিয়ার মুসলমানদের আত্মপরিচয়ের বিষয়টি। তার পাশের দেয়ালে প্রণীত সোই নিজের সঙ্গে বিরোধে জড়িয়ে থাকেন – একদিকে আসন্ন বিপর্যয় থেকে পলায়নপর শরণার্থীর দল, তার পাশে ‘কুমারটুলি প্রিন্টার’ নামের স্লাইড-প্রোজেকশন, তার পাশে আবার ওখানেই তৈরি করা ম্যুরাল। জিজি স্কারিয়ার ‘এলিভেটর ফ্রম দি সাবকন্টিনেন্ট’ তিন-পর্দার এক কৌতূহলোদ্দীপক ভিডিও স্থাপনা – আরোহণকালের এসকেলেটরের সত্যিকার যাত্রার অনুকরণ রয়েছে তাতে। দি ডিজায়ার মেশিনের ৩৫ মিলিমিটারের ছবি একটা পরিত্যক্ত তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্রের ওপর রচিত – তা দৃষ্টি আকর্ষণ করে সংঘাতপূর্ণ উত্তরপূর্ব ভারতের দিকে, যেখানে বিশৃঙ্খলার মধ্যেও শিল্পসৃষ্টি এবং কর্মশক্তির প্রবহমানতা বিদ্যমান। এমন একটি প্রয়াস সম্ভবপর হলো সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ের সচিব জওহর সরকার এবং ললিতকলা অকাদেমির চেয়ারম্যান অশোক বাজপেয়ীর বলিষ্ঠ সমর্থনের ফলেই, তাতে অনেকের বহুকালের স্বপ্ন বাস্তবায়িত হয়েছে।
বিয়েনালের মূল অংশের কিউরেটর ব্রাইস কিউরিগর। সেখানে দেখা যায় – দেশের অতি শ্রদ্ধেয় আলোকচিত্রীদের একজন – দয়ানীতা সিংয়ের ‘ড্রিমভিলা’ নামে একগুচ্ছ আলোকচিত্র যা ভারতের বিভিন্ন নগরীতে রাত্রিকালে তোলা হয়েছিল। এতে মানুষের উপস্থিতি নেই, আছে স্থান ও কাঠামোর বিন্যাস – তা কেমন স্বপ্নপুরীর মতো মনে হয়, কখনো চাঁদের আলোয়, কখনো বা শহুরে আলোকমালায় নাটকের দৃশ্যসজ্জার মতো যেন আলোকিত হয়ে উঠছে।
গোল্ডেন লায়ন নামে আকাক্সিক্ষত পুরস্কারটি এবারে লাভ করেছে জার্মান প্যাভিলিয়ন – তার আদলটি গির্জার অভ্যন্তরের মতো। এতে দেখা যায় ক্রিস্টফ শ্লিনজেনসিয়েফের কাজ – মাত্র ২০১০ সালে তিনি ক্যানসারের শিকার হলেন। সুসান গেনশেইমার পুরস্কারটা নিতে গিয়ে যখন বললেন যে, এ হলো প্রয়াত শিল্পী-চিত্রনির্মাতা-নাটক নিয়ে পরীক্ষণরত এক মানুষের প্রতি শ্রদ্ধাঞ্জলি, ৫৪তম ভেনিস বিয়েনালে তিনি যে সম্মানিত হচ্ছেন, তা দেখার আর সুযোগ হলো না তাঁর, তখন তা সবার মর্মই ভেদ করেছিল। সেরা কাজের জন্যে গোল্ডেন লায়ন পুরস্কার এবার পেল মার্কিন শিল্পী মার্কলের ‘দি ক্লক’। আমার নিজস্ব পছন্দ ছিল অবশ্য জাপানি প্যাভিলিয়ন – ভেনিসে থাকার সময়ে আমি সেখানে বারবার গেছি। সেখানে যেতে হতো বর্বর অনুপাতের এক গর্জমান ট্যাংকের পাশ দিয়ে – সেটা আবার একইসঙ্গে কাজ করতো ট্র্যাক মেশিনের আর তার ওপরে এক ক্রীড়াবিদ অক্লান্তভাবে জগিং করে যেতেন (এ হলো মার্কিন প্যাভিলিয়নের একটা অংশ – নিঃসন্দেহে তা সেদেশের ভূরাষ্ট্রীয় নীতির সাক্ষ্য দেয়)। জাপানি প্যাভিলিয়নকে যে আরো অনেকে পছন্দ করতো, তার প্রমাণ পেয়েছি যখন দেখেছি যে, যে-কোনো সময়ে তাতে প্রবেশ করার জন্যে অন্তত শতখানেক লোক লাইনে দাঁড়িয়ে আছে।
হোকুসাইয়ের কাঠের ব্লকপ্রিন্ট থেকে প্রেরণা নিয়ে বিশিষ্ট জাপানি শিল্পী তাবাইমো অ্যানিমেশনের এক ফ্যানটাসি নির্মাণ করেছেন কম্পিউটারে হাজার হাজার হাতে-আঁকা ছবি ঢুকিয়ে দিয়ে – তার ফলটা হয়েছে জাদুকরী। বিয়েনালের প্রধান অংশ গার্দিনির আকর্ষণ এড়িয়ে
এদিকে-ওদিকে ছড়ানো অন্য কয়েকটা প্যাভিলিয়নের সামনে চলে যাই। ভেনিসের অলিগলির গোলকধাঁধার মধ্যে কোথাও তিনতলা জুড়ে বাংলাদেশের দর্শনীয় প্যাভিলিয়ন প্যারাব্ল। শিল্পী তৈয়বা বেগম লিপি হ্যাঙ্গারের সারির পর সারিতে ইন্দ্রিয়পর ব্রেসিয়ার লুব্ধকরভাবে ঝুলিয়ে কিছুটা উসকানিমূলক চিত্রকল্প তৈরি করেছেন। যৌনতাপূর্ণ বলে ভাবছেন? ভেবে দেখুন, ওইসব ব্রা তৈরি করা হয়েছিল দাড়ি কামাবার তিন হাজার ব্লেড দিয়ে! ইমরান হোসেন পিপলু, কবির আহমদ, মাসুম চিশতি, প্রমথেশ দাস পুলক ও মাহবুবুর রহমানের কাজও ছিল বেশ আকর্ষণীয়।
সউদি আরবের প্যাভিলিয়ন দর্শক আকর্ষণ করেছে এবং প্রশংসা পেয়েছে দুই বোন শাদিয়া ও রাজা আলেমের যৌথ কাজের জন্য। তাঁদের ‘ব্ল্যাক আর্ক’ হলো কালো পাথর ও আয়নায় নির্মিত স্মৃতিজাগানিয়া এক স্থাপনা – তাতে মক্কা ও ভেনিসের ছবি পর পর প্রদর্শিত হয় – দুই ব্যবস্থার সাযুজ্য ও বৈপরীত্য প্রকটিত হয় এভাবে। ইসরায়েলি প্যাভিলিয়ন তৈরি করা হয়েছিল কাহিনি, বস্তু ও ভঙ্গিকে পাশাপাশি জায়গা দিয়ে। সিগালিত ল্যানডো নিজের কাজ সম্পর্কে বলেছেন, ‘আমি স্পষ্ট অর্থের বুনন করি – একসঙ্গে তা আমাদের একই নিয়তির একটি কবিতা বা রূপকরূপে পড়া যেতে পারে। একজনের মেঝে হচ্ছে আরেকজনের অনুভূতি।’ তাঁর ভিডিও স্থাপনা আজকেলন হলো গাজায় ঘটমান সংঘাতের মর্মস্পর্শী মন্তব্য-প্রতিবেদন – সেখানে বালুকাবেলায় ছুরিখেলা চলে দু-দলে। মিশরের প্যাভিলিয়ন ‘থার্টি ডেজ রানিং ইন দি প্লেস’ হলো মিশরের বিপ্লব সম্পর্কে একটি ভিডিও স্থাপনা। তাহির স্কোয়ারের আন্দোলনের ছবি তুলতে তুলতে ৩০ বছর-বয়স্ক বাসিওনি অনুভব করেছিলেন, ‘ওরা যদি যুদ্ধ চায়, আমরা চাই শান্তি। আমি নিজের জাতির মর্যাদা খানিকটা পুনরুদ্ধার করতে চাই।’ ঠিক তার পরদিনই তাঁর মৃত্যু ঘটে।
ভেনিসের খালে গন্ডোলা-চালকেরা প্রেমিক-প্রেমিকাদের শোনাচ্ছে সেরেনাদ, তাদের নিয়ে চলেছে পড়োপড়ো বাড়িঘর ও উন্নত প্রাসাদ পেরিয়ে, ভেনিসীয়রা রোজকার মতো জীবন যাপন করে চলেছে।
সে-সময়ে শহরের অন্য প্রান্তে শিল্পপ্রেমীরা ছুটছে আরেক উদ্বোধন অনুষ্ঠানে, আরেক পার্টিতে, আলোকসজ্জার আরেক উন্মত্ত সন্ধ্যায়। দূরে দানবীয় ট্যাংকটা গর্জন করে চলেছে হর্ষোৎফুল্ল মানুষের আনন্দধ্বনির পাশাপাশি।
মঙ্গলবারে পঁপিদু সেন্টারে প্যারিস-দিল্লি-বম্বেতে পৌঁছে দেখি, পদশব্দ ছাড়া সবকিছুই শান্ত – কেননা সেদিন দর্শকসাধারণের জন্য জাদুঘর বন্ধ। যুগ্ম-কিউরেটর সোফি দুপ্লে – যিনি এই উচ্চাকাক্সক্ষী প্রদর্শনীর আয়োজন করেছেন ফাব্রিস বুস্তোর সঙ্গে মিলে – তিনি আমাকে সঙ্গে করে প্রদর্শনী দেখালেন এবং তাঁরা দুজন যেভাবে প্রদর্শনীর বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিয়েছেন, তা ব্যাখ্যা করলেন। হোসকোট যদি এমন এক পথে চলার সিদ্ধান্ত নিয়ে থাকেন, যে-পথে আর কেউ যায়নি, তবে ফরাসি কিউরেটর দুজন তার বিপরীত পথ ধরেছেন – আন্তর্জাতিকভাবে প্রশংসিত ও পরিচিত শিল্পীদেরই কাজ নিয়ে। এই প্রদর্শনীর কেন্দ্রে রয়েছে রবিন্দর রেড্ডির ব্রোঞ্জের বিশাল মাথা, বাকি জায়গাটা ছেড়ে দেওয়া হয়েছে কৃষ্ণরাজ ছোনাট, এন এস হর্ষা, সুনীল গৌড়ে, অমর কানওয়ার, শিল্পা গুপ্তা, নলিনী মালানী, জিতীশ কাল্লাট, অতুল ভাল্লা, ডিভান সুন্দরম্, হেমা উপাধ্যায়, রাক্স মিডিয়া কালেক্টিভ, দয়ানীতা সিং, অনিতা দুবে, নিখিল চোপড়া, রিয়াস কোমু, সুদর্শন শেঠী, সুবোধ গুপ্ত, অতুল দোদিয়া, সারনাথ ব্যানার্জী, কিরণ সুব্বাইয়াহ, ঠুকরাক ও তাগরা, আয়িশা আব্রাহাম, ভারতী খের, সোনিয়া খুরানা, পুষ্পমালা, সুনীল গুপ্ত, সাক্ষী গুপ্ত ও শীলা গৌড়াকে, তার সঙ্গে ফরাসি শিল্পীদেরকে। যাঁরা সমকালীন ভারতীয় শিল্পের জগৎ অনুধাবন করছেন তাঁদেরকে আকর্ষণ করবেন এই প্রদর্শনীর সেইসব শিল্পী যাঁরা নিজেদের একান্ত মৌলিক কাজ দিয়ে সারা বিশ্বে আলোড়ন সৃষ্টি করছেন। পঁপিদু সেন্টার ছাড়াও প্যালে রইয়ালে চলছে ভারতে জাত শিল্পী অনীশ কাপুরের দৃষ্টিনন্দন প্রদর্শনী। বাসেল, লিয়োঁ ও প্রাগেও ভারতীয় শিল্পীরা বেশ ছাপ ফেলেছেন দর্শকদের মনে, শিল্পের সংগ্রাহক ও পৃষ্ঠপোষকদের দিয়েছেন উদ্যাপন করার মতো এক শরৎশেষের কাল!
ইংরেজি থেকে অনূদিত