আ বু ল ম ন সু র
শিল্পগুরু জয়নুল আবেদিনকে তাঁর জন্মশতবর্ষে জানাই সশ্রদ্ধ প্রণতি। বাংলাদেশে জয়নুল আবেদিনকে আমরা শিল্পাচার্য আখ্যা দিয়েছি আর এ দেশে দৃশ্যকলা চর্চার অগ্রপথিক রূপে স্বীকার করে নিয়েছি। এর যথার্থতা নিয়ে কোনো সন্দেহ নেই। একই সঙ্গে এ-ও সত্য, আমরা তাঁকে পূজ্য-সামগ্রী-বিশেষ হিসেবে পৃথক আর দূরবর্তী করেও রেখেছি। এর ফলে জয়নুল আবেদিনের শিল্পকৃতির কোনো বস্তুনিষ্ঠ মূল্যায়নের প্রয়াস তেমন হয়নি বললেই চলে। তাঁর সমকালে জয়নুলের সৃজনকৃতির গৌরব ও গুরুত্ব কোথায় নিহিত তার পরিচয় কখনো স্পষ্ট আকৃতিতে পরিস্ফুট হয়নি। এ ক্ষতি আমাদের সকলের।
জয়নুল আবেদিন এদেশের শিল্পকলা-জগতের অবিসংবাদী পিতৃপুরুষ রূপে স্বীকৃত হলেও সময়ের প্রবহমানতায় তাঁর গুণগ্রাহী ও সমালোচক উভয়ই দলে ভারি হয়েছে, এদেশের আধুনিক শিল্পচর্চায় তাঁর প্রভাব ক্ষীয়মাণ হয়েছে, তাঁর অনুসারী প্রায় নেই বললেই চলে Ñ এতদসত্ত্বেও বাংলাদেশের শিল্পকলা-জগতে তাঁর সর্বোচ্চ আসনটি প্রশ্নাতীতভাবে অটুট রয়েছে। তাঁর সমসাময়িকদের কেউ কেউ প্রায় সমতুল প্রতিভার অধিকারী হওয়া সত্ত্বেও এই ক্ষেত্রটিতে তাঁর আসন অপ্রতিদ্বন্দ্বী। তাঁর পরবর্তী প্রজন্ম তাঁকে বর্জনের মাধ্যমেই শিল্পচর্চায় অধিক ব্রতী হয়েছে, তাঁদের শিল্পচেতনায়ও জয়নুলের ভাবনার অনুগমন লক্ষণীয় নয় Ñ তবু এমনকি আজকের প্রজন্মেও তাঁর আসনটি নিয়ে বিতর্কের অবতারণা নেই। শিল্পচর্চায় ও শিল্পভাবনায় তিনি প্রায় এক নিঃসঙ্গ যাত্রী, অথচ দলপতির বরমাল্যটি তিনি অবলীলায় সর্বজনের স্বীকৃতিতে লাভ করেন। বাংলাদেশের শিল্পজগতে তাঁর অবস্থানের এই উৎক্রমতা জয়নুলের পরবর্তী জীবনের শিল্পজগৎ নির্মিতিতেও অবদান রেখেছে।
শিল্পাচার্য অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর ও নন্দলাল বসুর ছিল বিশাল অনুগামী শিল্পীদল। অবনীন্দ্রনাথ তো ‘বেঙ্গল স্কুল’ রীতির প্রবর্তক পুরুষ, যে রীতির ঢেউ কলকাতা ছেড়ে সুদূর দিল্লি, পাটনা, লাহোর, মাদ্রাজ পর্যন্ত গিয়ে লেগেছিল, সারা ভারতবর্ষব্যাপী যার আবেগী জনপ্রিয়তা স্বাদেশিক চেতনার জোয়ারে ভর করে এক অভূতপূর্ব তুঙ্গ স্পর্শ করেছিল। তাঁর অনুগামীরা প্রায় অনুকারকে পরিণত হয়েছিলেন এবং স্বল্প-প্রতিভাসম্পন্ন শিষ্যরা অনেক সময়ই তাঁর শৈলীকে প্রায় অন্তঃসারশূন্য অনুকরণে পর্যবসিত করেছিলেন।
শান্তিনিকেতনে নন্দলাল ছিলেন অবিসংবাদী ‘মাস্টারমশাই’, তাঁর শান্তিনিকেতন-পর্বের চিত্ররীতি আকর্ষিত ও প্রভাবিত করেছিল অসংখ্য ছাত্রকে Ñ যার মধ্যে ছিলেন বিনোদবিহারী ও রামকিঙ্করের মতো প্রতিভাধর শিল্পী। দুজনই ছিলেন অসাধারণ শিক্ষক, দুই ভিন্ন রীতিতে। অবনীন্দ্রনাথ ছিলেন অতুলনীয় কথক, তাঁর বৈঠকি মেজাজের খোশগল্প শিল্পের দুরূহ তত্ত্বের জগৎ অবলীলায় উন্মোচিত করে দিত, একটি খোলামেলা মজলিশি আবহাওয়ায় তিনি ছাত্রদের আকর্ষিত ও উজ্জীবিত করতেন। তুলনায় নন্দলাল ছিলেন মিতবাক, বলার চেয়ে সঙ্গে বসে কাজ করে তিনি আকর্ষণ করতেন তাঁর শিষ্যদের। জয়নুল আবেদিনও ছিলেন অসাধারণ শিক্ষক। এ ক্ষেত্রে তাঁকে অবনীন্দ্রনাথ ও নন্দলাল উভয়ের মিশ্রণ বলা যেতে পারে। তাঁর ছিল বিশিষ্ট কথনভঙ্গি, যা এক অনন্য আবেশ বিস্তার করতে সক্ষম হতো। নিরভিমানী, প্রাঞ্জল ও প্রায় মেঠো সুরের মতো এক সহজিয়া কথনরীতিতে তিনি আকৃষ্ট ও আবিষ্ট করতে পারতেন শ্রোতাকে। এভাবে তাঁর শিষ্যদের মধ্যে তিনি সঞ্চার করতে সক্ষম ছিলেন শিল্পের প্রণোদনা। তাঁর ব্যক্তিত্বের আকর্ষণই ছিল একটি অনুপ্রেরণা। অন্যদিকে শ্রেণিকক্ষে হাতেকলমে দেখানো ছাড়াও ছুটিছাটার দিনে প্রিয় ছাত্রদের সঙ্গে নিয়ে প্রাকৃতিক পরিবেশে ছবি আঁকা ছিল তাঁর অন্যতম শখের বিষয়। এতদসত্ত্বেও তিনি তাঁর পরবর্তী প্রজন্মকে আকর্ষিতই করেছিলেন, প্রভাবিত করেননি। তাঁর শিল্পরীতি ও শিল্পভাবনা তাঁর প্রথম প্রজন্মের ছাত্রসমাজেও বিশেষ প্রভাব বিস্তার করেনি। তাঁর কোনো অনুগামী প্রায় কখনোই সৃষ্টি হয়নি বললেই চলে। সমসাময়িককালে এ দেশের শিল্পকলা-জগতে পাশ্চাত্য শিল্পের অভিঘাত অবশ্যই এর অন্যতম একটি কারণ।
স্টুডিওকেন্দ্রিক চিত্র নির্মাণের বিরুদ্ধে ইমপ্রেশনিস্টদের আন্দোলনে তাঁর সায় ছিল। পলায়মান তাৎক্ষণিককে চিত্রে বন্দি করার ইমপ্রেশনিস্ট আকাক্সক্ষার সঙ্গেও তাঁর ভাবনার সাদৃশ্য ছিল, কিন্তু বর্ণ ও আলোর বৈজ্ঞানিক প্রয়োগের আগ্রহাতিশয্যে রেখাকে বিসর্জন দিতে তিনি রাজি ছিলেন না। ইমপ্রেশনিস্ট ঢঙে মোটা আঁচড়ে দু-একটি কাজ করেই তাকে পরিত্যাগ করেছেন। সমসাময়িক স্টুডিও-নির্মিত আবেগ-তরল কল্পনাশ্রয়ী বিষয়বস্তুও তাঁর মনঃপূত ছিল না। মানববিবর্জিত শুধু প্রকৃতিও বিষয়বস্তু হিসেবে তাঁকে আর আকর্ষণ করছিল না। ফলে বিষয়ের সন্ধানেও জয়নুলকে পা বাড়াতে হয়েছে নতুনের উদ্দেশে। জয়নুলের বিষয়-অনুসন্ধানের শিকড় প্রোথিত আছে তাঁর স্বদেশ-ভাবনায়, তাঁর সমাজচেতনায়, আপন জনগোষ্ঠীর প্রতি তাঁর দায়বদ্ধতায়। এই দায়বদ্ধতার স্বরূপ কী? পূর্ববঙ্গের পশ্চাদ্পদ গ্রাম-সংস্কৃতির জগৎ থেকে তিনি ছিটকে পড়েছিলেন ভারতীয় রাজনীতি-সংস্কৃতির প্রাণকেন্দ্র কলকাতার উত্তাল পরিমণ্ডলে। ভারতীয় রাজনীতি তখন অদূরবর্তী স্বাধীনতার আবেগ ও উত্তেজনায় টলমল, ভারতীয় মুসলিম তার পৃথক জাতিসত্তার ফেনিল মৌতাতে মশগুল, আর সাম্প্রদায়িকতার বিষবাষ্প ক্রমশ আচ্ছন্ন করছিল উপমহাদেশকে। এই অবস্থা পূর্ববঙ্গের মুসলমান মধ্যবিত্ত জয়নুল আবেদিনের মধ্যে কি প্রতিক্রিয়া সঞ্চার করেছিল? প্রত্যক্ষ রাজনীতি বিষয়ে তাঁর মতামত দুর্লভ, পরবর্তীকালেও সরাসরি রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডে তিনি সমসাময়িক অনেক সহযাত্রীর তুলনায় প্রত্যক্ষ অংশ নিয়েছেন কম। বস্তুত জয়নুল আবেদিনের স্বদেশ-ভাবনায় রাষ্ট্র ও রাজনীতির স্থান ছিল গৌণ, মুখ্য ছিল সমাজ ও সমাজবদ্ধ মানুষ। বিপুলা প্রকৃতির জঙ্গম শক্তিময়তার বিপরীতে যূথবদ্ধ মানুষের সংগ্রামী অবয়বেই তিনি তাঁর সকল বক্তব্যকে উপস্থাপিত করেন। বৈরী প্রকৃতির বিরুদ্ধে লড়ে যাওয়া তাঁর আশপাশের মানুষেরা, যারা হাজারো বছর ধরে একইভাবে যুদ্ধরত, তাঁর কাছে মানব সভ্যতার সকল সংগ্রামের প্রতীক। ফলত প্রাকৃতিক বিপর্যয়ে মানবতার বিড়ম্বনায় তিনি যেভাবে প্রবল প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেন, রাজনৈতিক নিষ্পেষণে দলিত মানুষের প্রতি তাঁর সহানুভূতি ততটা উচ্চকিতভাবে প্রতিভাত হয়ে ওঠে না। দুর্ভিক্ষ মানবসৃষ্ট ও রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রসূত হলেও তা প্রত্যক্ষদৃষ্ট নয় বলে জয়নুলের কাছে এটিও প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের সমতুল্যই ছিল। এর ফলে দুর্ভিক্ষ, বন্যা ও ঘূর্ণিবাত্যা তাঁকে যতটা মহৎ ও বৃহৎ শিল্প সৃষ্টিতে প্রণোদিত করে, ভাষা আন্দোলন বা মুক্তিযুদ্ধ ততটা করে না। তাঁর মানবপ্রেম ধর্ম-বর্ণ-শ্রেণি নির্বিশেষে সকল মানুষকে স্থাপন করেছে প্রকৃতির বুকে অবিরাম সংগ্রামী ভূমিকায়। এই নির্বিশেষ মানবপ্রেম তাঁকে রেখেছে অনেকখানি রাজনীতি-নিষ্পৃহ। তাই বলে এ-ও অনস্বীকার্য যে তাঁর পক্ষপাত ও দায়বদ্ধতা সর্বসময়ই ছিল
অন্ত্যজ কর্মজীবী মানুষের প্রতি এবং এভাবেই রাজনীতি-উচ্চকিত না হয়েও জয়নুল হয়ে ওঠেন বঞ্চিত মানুষের বলিষ্ঠ মুখপাত্র। দুর্ভিক্ষের রেখাচিত্রমালায় তাঁর সহানুভূতি এমনই প্রবল ও প্রতিবাদ এমনই বাক্সময় হয়ে ওঠে যে ভারতীয় কমিউনিস্ট পার্টির পত্রিকা পিপলস ওয়ার তাঁর প্রধান পৃষ্ঠপোষকের ভূমিকা গ্রহণ করে। এই সময় তিনি ‘ফ্যাসিবিরোধী লেখক-শিল্পী সংগঠন’-এর সদস্যও হন। এভাবে রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত না হয়েও জয়নুলের চিত্রমালা একটি রাজনৈতিক ভূমিকা গ্রহণ করে।
মানুষ ও প্রকৃতির টানাপড়েনে মানুষই তাঁর কাছে বরাবর বড় হয়ে প্রতিভাত হয়েছে। মানুষবিহীন নিস্তরঙ্গ প্রকৃতি তাঁকে তেমনভাবে আকর্ষণ করেনি। এমনকি নিষ্পিষ্ট পরাজিত মানুষও তাঁর পটজুড়ে একটি শক্তিমান উপস্থিতি হয়ে বিরাজ করে। দুর্ভিক্ষের রেখাচিত্রমালায় যেমন ক্লিষ্ট মানুষগুলোও এক মনুমেন্টাল অবস্থিতি গ্রহণ করে তেমনই ‘মনপুরা’ চিত্রের দলিত মৃতদেহগুলো পর্যন্ত যেন পুঞ্জ পুঞ্জভাবে ঊর্ধ্বমুখে ফুঁসে উঠতে চায়। এই পরাভব না-মানা শাশ্বত মানবের রূপায়ণ তাঁর মানুষের প্রতি অপরিসীম বিশ্বাস ও ভালোবাসার পরিচায়ক।
দুই
১৯৪৭-এর দেশ বিভাগের পর পূর্ব বাংলায় ফিরে এসে তেত্রিশ বছরের শিল্পী জয়নুল আবেদিন এক ভিন্ন দায়িত্বের মুখোমুখি নিজেকে দেখতে পান। একটি নবীন দেশের এই অংশে সম্পূর্ণ অসংগঠিত একটি চিত্রকলা-আন্দোলনকে গড়ে তোলার দায়িত্ব তাঁর একক স্কন্ধে এসে পড়ে। সদ্য প্রতিষ্ঠিত পাকিস্তান রাষ্ট্রে তখন ধর্মীয় উন্মাদনাময় স্বাতন্ত্র্য প্রতিষ্ঠিত করবার প্রবল আবেগ। তৎকালীন বিরূপ প্রতিবেশের বিরুদ্ধে লড়ে মাত্র এক বছরের মধ্যে ঢাকা আর্ট স্কুল প্রতিষ্ঠা তাঁর অসাধারণ সাংগঠনিক প্রতিভা ও কর্মদক্ষতারই পরিচায়ক। বস্তুতপক্ষে স্বাধীন পাকিস্তানে শিল্পচর্চার চেয়েও প্রতিষ্ঠান ও পরিবেশ গড়ে তোলার কাজে আবেদিনকে এতটাই উদ্যম ও শ্রম ব্যয় করতে হয়েছে যে তাঁর নিজের সৃষ্টিশীলতাকেও অধিকাংশ সময় দায়িত্বের যূপকাষ্ঠে বলি দিতে হয়েছে। পাকিস্তান সরকারের তথ্য ও প্রকাশনা দপ্তরের প্রধান নকশাবিদ হিসেবে এবং পেশোয়ার বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা বিভাগ সংগঠনের কাজে তাঁকে সময় ব্যয় করতে হয়েছে, সরকারি চারু ও কারুকলা মহাবিদ্যালয়ের ভবন নির্মাণের তদারকির কাজে পর্যন্ত তাঁকে ব্যয় করতে হয়েছে অমূল্য সময়।
পঞ্চাশের দশক তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানবাসীর মানস-রূপায়ণে গুরুত্বপূর্ণ ক্রান্তিকাল। ধর্মীয় একতাবোধের কুহক থেকে মুক্ত হয়ে বাঙালি মুসলমানের আত্ম-আবিষ্কারের যাত্রা পাকিস্তানের প্রায় জন্মলগ্ন থেকেই। ’৫২-এর ভাষা আন্দোলন, ’৫৪-এর নির্বাচন এবং ’৫৮-এর সামরিক দুঃশাসনের পটভূমিতে বাঙালি ক্রমশ সচেতন হচ্ছিল তার রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক স্বাধিকার সম্পর্কে। আপন অন্তরভূমে পরিপূর্ণ বাঙালি জয়নুল আবেদিন নিশ্চয়ই বাঙালি মুসলমানের আত্ম-আবিষ্কারের পথে তার বাঙালি সত্তার উদ্বোধনকে অন্তর থেকে সমর্থন জানিয়েছিলেন। কিন্তু রাজনৈতিক বিতর্কে সরাসরি যুক্ত হওয়ার প্রতি তাঁর স্বভাবজ অনীহার কারণে তিনি স্পষ্ট কোনো ভূমিকায় অবতীর্ণ হননি, পরিবর্তে নিজেকে যুক্ত করেছেন সাংগঠনিক ও প্রাতিষ্ঠানিক কাজে। তাঁর আগ্রহ বরাবরই মূর্তমান মানুষে, রাষ্ট্র বা শাসনব্যবস্থার মতো কোনো বিমূর্ত ধারণায় নয়।
শিল্পকলার ক্ষেত্রে তাঁর পরবর্তী প্রজন্ম, তাঁরই ছাত্র-গোষ্ঠী, জয়নুল-অনুরাগী বা অনুগামী ছিল এমন কথা জোর দিয়ে বলা যাবে না। শিক্ষকের ভূমিকায় তাঁর বিপুল প্রভাব সত্ত্বেও অগ্রবর্তী শিল্পী হিসেবে তিনি তাঁদের আদর্শরূপে প্রতিভাত হননি। পঞ্চাশের দশকের মাঝামাঝি তাঁর প্রধান প্রতিভাধর ছাত্ররা অনেকেই ছিলেন রাজনীতিতে বামঘেঁষা, তাঁদের চোখে জয়নুল ছিলেন অনেকখানি এস্টাবলিশমেন্টের অংশ। এই ছাত্ররাই যখন ইউরোপ ঘুরে এসে পুঁজিবাদী পাশ্চাত্যের বিমূর্ত রীতির চর্চা শুরু করলেন
স্থান-কাল-পাত্রের কোনো প্রেক্ষিতকে প্রায় বিবেচনায় না এনে, তখন জয়নুল বেদনার্ত বোধ করলেন; কিন্তু ক্রমশ শক্তিসঞ্চারশীল নবীন শিল্পীগোষ্ঠীটির বিরুদ্ধে স্থান গ্রহণ করতে চাইলেন না। তাঁর নিজের মধ্যেও আত্ম-আবিষ্কারের টানাপড়েন ছিল, ছিল দ্বন্দ্ব ও অনিশ্চিতি।
সাতচল্লিশ-পূর্ববর্তীকালে দ্রুত-সঞ্চরণশীল বাস্তব-অনুষঙ্গী রেখার বলিষ্ঠতা আবেদিনকে যে খ্যাতি এনে দিয়েছিল,
স্বাধীনতা-পরবর্তীকালে পাশ্চাত্য শিল্পের অভিঘাতে আধুনিক শিল্পের পরিবর্তিত প্রেক্ষাপটে তা আর যথেষ্ট ছিল না। আবেদিনের মধ্যেও একটি নিজস্ব শৈলী অর্জনের অভিপ্রায়ে বিভিন্ন পথে নিরীক্ষার প্রয়াস এ সময় লক্ষণীয়। ’৫২-এর ভাষা আন্দোলন ও সমসাময়িক ঘটনাপ্রবাহ বাঙালিত্বের যে ঐতিহ্য-সচেতনতার উদ্বোধন ঘটিয়েছিল সম্ভবত তারই প্রভাব পূর্ব বাংলার সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের প্রতি দৃষ্টিপাত করতে তাঁকে প্ররোচিত করে। এদেশীয় লোকচিত্রকলার সঙ্গে আধাবিমূর্ত জ্যামিতিক আকৃতির মিশ্রণ ঘটিয়ে তিনি অর্জন করতে চাইলেন স্বদেশি আধুনিক একটি শৈলী। কিন্তু নিজেই স্বস্তি বোধ করলেন না এই পরিকল্পিত রীতিবদ্ধ স্থাণুু স্বভাবের চিত্ররীতিতে। পাশ্চাত্য ঢংসমূহের ক্রমবর্ধমান জনপ্রিয়তা তাঁকে ক্রমশ শিল্পজগতে নিঃসঙ্গতার দিকে ঠেলে দিতে থাকে। নতুনের প্রবল উন্মেষের বিরুদ্ধে দাঁড়াতে তাঁর মন সায় দেয়নি, আবার দেশজ সকল উত্তরাধিকার ও প্রেক্ষিতকে প্রায় অস্বীকার করে তাঁদের প্রবল পাশ্চাত্যমুখীনতাকেও আবেদিন স্বাগত জানাতে পারেননি। তাঁর ভিতরে চলতে থাকে এক প্রবল টানাপড়েন। যুগের রুচি এবং সংখ্যাগরিষ্ঠ শিল্পীদের পাশ্চাত্য শিল্পরীতি-বৈচিত্র্যের প্রতি ঝোঁক তাঁর মধ্যেও এক ধরনের সংশয়ের জন্ম দেয়। ক্ষণিকের জন্য তাঁরও হয়তো বিশ্বাস জন্মেছিল যে ওই পথ ছাড়া গত্যন্তর নেই। ষাটের দশক থেকে ক্রমবর্ধমান বিমূর্ততার প্রভাবে জয়নুলও একদা আধাবিমূর্ত ও প্রায়-বিমূর্ত এক্সপ্রেশনিস্ট ঢঙের চিত্র নির্মাণের প্রয়াস চালিয়েছিলেন। কিন্তু শিল্পকলার এই বিমানবিকীকরণ Ñ বিষয়বস্তু হিসেবে চিত্রপট থেকে মানবের অবলুপ্তি, Ñ জয়নুলের আকাক্সক্ষা ও স্বভাবের সম্পূর্ণ বিপরীত। তাই অচিরাৎ আবার ফিরলেন
স্ব-শৈলীতে। এই সময় ঊনসত্তরের গণজাগরণ চাবুক হানল সকল বাঙালির চেতনায়। জয়নুলের প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত হলো ৬৫ ফুট দীর্ঘ ‘নবান্ন’ চিত্রে। এবারও তিনি সরাসরি রাজনৈতিক বক্তব্য এড়িয়ে বাঙালিজীবনের এক আদ্যোপান্ত চিত্র তুলে ধরলেন জড়ানো পটের রীতিতে। বাঙালির কান্না-হাসি-সংগ্রামের সেই চলমান ছবির মধ্যেই মূর্ত হয়ে উঠল তাঁর আত্ম-অনুসন্ধানের নির্যাস। সত্তরের ভয়াবহ ঘূর্ণিবাত্যা তাঁকে আলোড়িত করবে প্রবলভাবে, এটিই স্বাভাবিক। অঙ্কিত হলো ৩০ ফুট দীর্ঘ ‘মনপুরা ৭০’ চিত্র। এখানে আবার দুর্ভিক্ষের রেখাচিত্রমালার স্মৃতি যেন জাগরিত হলো। প্রকৃতি ও মানুষের দ্বান্দ্বিক অবস্থানেই যেন জয়নুল সবচেয়ে ক্ষুরধার হয়ে ওঠেন। মনপুরা চিত্রে শেষবার ঝলসে উঠলেন জয়নুল আবেদিন।
শৈলীর খোঁজে এই সংশয়াকুল যাত্রা, পুনরায় ফিরে আসা তাঁর স্বভাবসুলভ অঙ্কনরীতিতে, Ñ এর মধ্য দিয়েই অতিক্রান্ত হয়েছে তাঁর পরবর্তী শিল্পজীবন। ’৪৭-পরবর্তী সদ্য স্বাধীন দেশে পাশ্চাত্যের সঙ্গে নতুন সংযোগে আধুনিক শিল্পের যে প্রবল অভিঘাত ঘটেছিল তাতে অনেক সময় চোখ ধাঁধিয়ে গিয়েছিল নবীন শিল্পীদের, জয়নুল তা জেনেছিলেন। তিনি বেদনার্ত বোধ করেছিলেন সমসাময়িক শিল্পে দেশজ ঐতিহ্য ও প্রেক্ষাপটের অনুপস্থিতিতে, সর্বোপরি চিত্রপট থেকে মানবের অবলুপ্তিতে। তাঁর শিল্পচেতনায় আস্থা ছিল না এসবে, অথচ তিনি নিজেও এমন একটি দৃঢ় চিত্রশৈলী উদ্ভাবন করতে পারেননি, যা দেশজ প্রেক্ষাপটে প্রোথিত হয়েও আধুনিক শিল্পরুচির সঙ্গে সাযুজ্যময় হবে।
এ ন্যূনতা সম্পর্কে তিনি নিজেও ছিলেন সচেতন। ফলত
দেশের সমসাময়িক শিল্পজগতের সঙ্গে তাঁর সম্পর্ক ছিল এক টানাপড়েনের, Ñ তিনি পুরোপুরি গ্রহণও করেননি তাকে, বর্জনও করতে পারেননি। অন্যরাও তাঁকে গ্রহণ না করে পারেননি, অথচ তাঁরা অনুগমন প্রায় কেউ করেননি।
তিন
বস্তুত জয়নুল আবেদিনের শিল্পসত্তা নির্মিত হয়েছিল একদিকে আবহমান ভারতীয় গ্রাম-জীবনের আদর্শায়িত স্বপ্ন ধারণ করে, অন্যদিকে ঔপনিবেশিক সংস্পর্শে প্রাপ্ত পশ্চিমের ইহজাগতিকতা ও সর্বজনীন মানবতাবোধে উদ্দীপ্ত হয়ে। তিনি যান্ত্রিকায়নের কলুষমুক্ত এক ধরনের স্বনির্ভর শ্রমশীল গ্রামীণ সমাজ ব্যবস্থার স্বপ্ন দেখতেন এবং বিশ্বাস করতেন যে তাতেই স্বদেশের কল্যাণ ও মুক্তি। কিন্তু পশ্চিমা সভ্যতার সংস্পর্শ তাঁকে ঐতিহ্যাশ্রয়ী গ্রাম-সমাজের শ্রেণিবিভেদকে নিশ্চয় স্বীকার করতে বাধা দিত। একইভাবে ভারতীয় শিল্প-ঐতিহ্যে যে আধ্যাত্মিক প্রেরণা ও ধর্মীয় প্রয়োজনীয়তা ক্রিয়াশীল ছিল তাঁর শিল্পবোধে সেটির গুরুত্ব ছিল গৌণ। আমাদের লোকশিল্প-ঐতিহ্যের প্রতি তাঁর শ্রদ্ধাবোধ ছিল অপরিসীম, কিন্তু তাঁর শিল্পচিন্তায় এগুলো প্রভাব-বিস্তারকারী উপাদান হিসেবে বিশেষ ব্যবহৃত হতে পারেনি। এর প্রধান কারণ আবেদিনের শিল্পদৃষ্টিতে সাদৃশ্যমূলক বাস্তবতার প্রতি অন্তর্নিহিত পক্ষপাত, যা ইউরোপীয় প্রাতিষ্ঠানিক প্রশিক্ষণরীতি থেকে প্রাপ্ত। ফলত তাঁর মানসলোক স্বদেশের মাটিতে গভীরভাবে প্রোথিত হওয়া সত্ত্বেও জয়নুল আবেদিন ভারতীয় ধ্র“পদী ঐতিহ্য দ্বারা যেমন অনুপ্রাণিত হতে পারেননি, তেমনই লোক শিল্পকলাও তাঁর শিল্পচৈতন্যে গভীর কোনো প্রণোদনা সৃষ্টিতে ব্যর্থ হয়েছে। তাঁর পূর্ববঙ্গীয় গ্রামজ উত্তরাধিকার তাঁকে গভীরভাবে আকর্ষণ করে রেখেছিল দেশের নাড়িতে, অন্যদিকে ঔপনিবেশিক অভিঘাতের অভিজ্ঞতা তাঁর শিল্পদৃষ্টিতে সঞ্চার করেছিল পাশ্চাত্য রুচিবোধসঞ্জাত বিপ্রকর্ষ। এই দ্বিবিধ আকর্ষণ ও বিকর্ষণের মধ্যেই নির্মিত হয়েছে জয়নুলের শিল্প-ভুবন।
রক্ষণশীল ধর্মীয় পরিবেশ থেকে উঠে এসেছিলেন তিনি অসাম্প্রদায়িক মানবিক বোধের জগতে। তাঁর নিম্ন-মধ্যবিত্ত উত্তরাধিকার যেমন তাঁর মধ্যে স্বতঃস্ফূর্তভাবে সঞ্চার করেছিল তাঁর অতিনিকট থেকে দেখা গ্রামীণ অন্ত্যজ শ্রেণিটির প্রতি সহমর্মিতা, তেমনই পাশ্চাত্য-শিক্ষার স্পর্শ জাগরিত করেছিল তাঁর মধ্যে ইহজাগতিক সর্বজনীন উদার মানবতাবোধ। এই দুয়ের সংমিশ্রণেই রচিত হয়েছে দুর্ভিক্ষের চিত্রমালা, জয়নুল আবেদিনীয় রীতির প্রথম উন্মোচন। দ্রুত সঞ্চরণশীল ক্ষিপ্র ক্ষুদ্র রেখার মোচড়ে মূর্ত হয়েছে বিপর্যস্ত স্বদেশবাসী মানুষের আর্তি। তারা আমাদেরই স্বজন, চিনতে অসুবিধা হয় না। কিন্তু যে রেখাটি ব্যবহার করেছেন জয়নুল, সেটি পাশ্চাত্যে দ্রুত-অবয়ব-অঙ্কন প্রথার। এ রেখা ভঙ্গুর, প্রবহমান নয়, এ রেখাটি কৌণিক ও তীব্র, লীলায়িত ও ছন্দিত নয়। এ রেখা বস্তুর পরিলেখ নয়, বরং অস্থি-সংস্থান এবং ত্রিমাত্রার আভাসদায়ী। অর্থাৎ এ রেখা কোনোভাবেই প্রাচ্যদেশীয় নয়। এমন রেখা পাশ্চাত্যদেশীয় শিল্পীরা ব্যবহার করেছেন শুধুমাত্র দ্রুত কোনো তাৎক্ষণিক পর্যবেক্ষণের কাজে। খসড়া অনুশীলনের এই শৈলীকে ব্যবহার করে জয়নুল কালজয়ী চিত্ররচনা করতে পেরেছেন শুধুমাত্র বিষয়ের সঙ্গে তাঁর প্রখর প্রত্যক্ষ আত্মিক যোগের কারণে এবং তাঁর অপরিসীম মানবিক সহমর্মী বোধের দ্বারা। এই শৈলীকেই যখন তিনি আরো বিস্তৃত করলেন রঙের সংযোজনে ‘মই দেওয়া’, ‘বিদ্রোহী’, ‘গুণ টানা’, ‘সাঁওতাল দম্পতি’ প্রভৃতি চিত্রে Ñ তখনও তাদের রেখার তাৎক্ষণিকতা ও বলিষ্ঠতাই এগুলোর বৈশিষ্ট্য হয়ে রইল, রঙের সংযোগ তাদেরকে ঠিক ‘চিত্রগুণ’ দান করল না। তবুও এগুলো দর্শকের চিত্রে এক প্রবল প্রতিক্রিয়া সঞ্চার করতে সমর্থ। এর প্রধান কারণ হচ্ছে এগুলোর উপাদান উঠে এসেছে একেবারে স্থানীয় জীবনের নির্যাস থেকে এবং তাঁর দ্রুতগামী বলিষ্ঠ রেখায় মানুষের এক অজেয় সংগ্রামী সত্তা বিম্বিত হয়েছে বলে।
বাংলার লোকশিল্প থেকে উপাদান সংগ্রহ করে আবেদিন যখন নিজস্ব শৈলী নির্মাণ করতে চাইলেন তখন বাদ সাধল তাঁর সাদৃশ্যপন্থী দৃষ্টিভঙ্গি, যা বস্তুতে রেখা ও আলোছায়ার মাধ্যমে একটি ত্রিমাত্রিক বাস্তব-আভাস দেখতে আগ্রহী। লোকচিত্রের আড়ষ্ট দ্বিমাত্রিক ফর্মুলাবদ্ধ রূপ, সমতলীয় বর্ণপ্রয়োগ, আলোছায়ার অভাব এবং সর্বোপরি গতিহীনতা তাঁর মানসিকতায় প্রবল বাধার সৃষ্টি করল। লোকচিত্রের একমাত্রিক প্রবহমান রেখা, যা শুধু আকৃতিকেই ঘিরে রাখে, উচ্চাবচের আভাস দেয় না Ñ জয়নুলকে স্বভাবতই আকৃষ্ট করেনি। বিমূর্ততার অভিমুখে যখন যাত্রা করতে চেয়েছেন তখনো চিত্রপটকে মানববিহীন করবার ধারণা তাঁর কাছে অসহনীয় মনে হয়েছে। এমনকি আধাবিমূর্ত ভাংচুর ও বিকৃতকরণের মধ্যে মানুষকে একটি জড়বস্তুর মতো দেখবার যে দৃষ্টিভঙ্গিটি রয়েছে, আবেদিনের শিল্পমানস তাতেও পরিতৃপ্ত ছিল না। অথচ পশ্চিমা একাডেমিক গতানুগতিক বাস্তবানুগ চিত্ররীতির প্রতিও ছিল তাঁর অনীহা। এ কারণে প্রথাগত ‘পোর্ট্রেট পেইন্টার’ বা ‘ল্যান্ডস্কেপ পেইন্টার’ হিসেবেও তিনি নিজেকে দেখতে চাননি Ñ যদিও এসব ক্ষেত্রে সাফল্য অর্জনের জন্য কৃৎকৌশলের যথেষ্ট দক্ষতা তাঁর আয়ত্ত ছিল। তাঁর মানবিক বোধের প্রবল অভীপ্সা তাঁকে গতানুগতিকতার গণ্ডিতে আবদ্ধ হতে দেয়নি। এভাবে জয়নুল আবেদিনের চিত্রমালা তাঁর বিপুল ক্ষমতার এক বিচূর্ণিত রূপ হিসেবে আমাদের সামনে উপস্থিত হয়।
বস্তুতপক্ষে জয়নুল আবেদিনের ভুবন তাঁর মানবসত্তা ও শিল্পসত্তার এক সংশ্লেষিত জগৎ। তাঁর শিল্পসত্তা সংশয়াকুল,
অন্তর্দ্বন্দ্বে বিক্ষত, অথচ শিল্পের প্রতি একনিষ্ঠভাবে অঙ্গীকারবদ্ধ। তাঁর মানবসত্তা স্বদেশ ও মানুষের প্রতি অসীম মমতায় উদ্বেল, অথচ প্রত্যক্ষ রাজনীতির চেয়ে কর্মোদ্যোগ ও সাংগঠনিক কাজে অধিক আগ্রহী। আজ তাঁর অবস্থান সকল বিতর্কের ঊর্ধ্বে গ্রহণীয় হয়েছে তাঁর এই চারিত্রিক বিশিষ্টতার কারণে Ñ শিল্পসৃজনে মানুষ ও সমাজের প্রতি তাঁর দায়বোধ। অতি উচ্চমানের কৃৎকৌশল ও নান্দনিক উৎকর্ষ সত্ত্বেও জয়নুল আবেদিনের শিল্পকর্ম মহাকালের কষ্টিপাথরে চিরস্থায়ী আসন অর্জন করবে কিনা আমরা জানি না; কিন্তু বাংলাদেশের শিল্পকলা জগতে মানুষ জয়নুলের পথিকৃতের ভূমিকা কখনো ম্লান হবে না। মানুষের প্রতি তাঁর অপরিসীম মমত্ববোধ ও দায়বদ্ধতার মধ্যেই তাঁর শিল্পের মূল্য ও যাথার্থ্য। মানুষ জয়নুলের মহানতার মধ্যেই শিল্পী জয়নুলের সার্থকতা অধিক পরিস্ফুট হয়ে ওঠে।