বি শ্বা স ক র বী ফা র হা না
ব্রিটিশরাজের নিবিড় তত্ত্বাবধানে ও বাংলার তৎকালীন গভর্নর লর্ড কার্জনের নেতৃত্বে ১৯০৫ সালে মুসলমান ও হিন্দু সংখ্যাগরিষ্ঠতার ভিত্তিতে বাংলাকে ভেঙে যথাক্রমে করা হয়েছিল পূর্ব ও পশ্চিমবঙ্গ। ব্যাপারটা ছিল নিতামত্মই অভ্যমত্মরীণ এবং প্রশাসনিক এলাকা-ভাগ বিশেষ। তাই সেই বিভক্তির কারণে, নিরাপত্তা বিঘ্নিত হতে পারে ভেবে এক এলাকার মানুষের মনে অন্য এলাকায় পাড়ি দেওয়ার ইচ্ছা জাগেনি – বলা যায়, তার দরকারও পড়েনি। কিন্তু ১৯৪৬-এর সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা ও ১৯৪৭ সালে ভারতবর্ষ থেকে ব্রিটিশ সরকারের বিদায় এবং তার পটভূমিতে র্যাডক্লিফ রোয়েদাদের মাধ্যমে ভারত-পাকিসত্মান সীমামত্ম চিহ্নিত করার আগ পর্যমত্ম বাঙালি হিন্দুর পশ্চিমবঙ্গ-অভিমুখে এবং বাঙালি মুসলমানের পূর্ববঙ্গ-অভিমুখে অভিবাসন নিয়মিতভাবে শুরম্ন হয়নি।
মতামত্মরে, পরস্পরমুখী এই অভিবাসনপ্রক্রিয়া ব্যাপকভাবে শুরু হয় ১৯৫০ সালের শুরুর দিকে ভারতে ও পাকিসত্মানে যাতায়াতের ক্ষেত্রে পাসপোর্ট-পদ্ধতি আরোপের পরে। অতঃপর ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধ চলাকালীন ও তার পরবর্তী সময়ে প্রধানত একমুখী অভিবাসন ঘটে। এ-পর্যায়ে মূলত বাংলাদেশের হিন্দু জনগোষ্ঠীর কিছু অংশ ভারতে গিয়ে স্থায়ীভাবে বসবাস করতে শুরম্ন করে।
হিন্দুসত্মান ও পাকিসত্মানের স্বাধীনতার রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট এবং এ দুই দেশভাগ-পরবর্তী সময়ে বিভিন্ন পরিপ্রেক্ষিতে ঘটে যাওয়া বাঙালি হিন্দুর ও মুসলমানের আরোপিত অভিবাসন ও অভিবাসন-পরবর্তী পুনর্বাসনসংক্রামত্ম জটিলতা নিয়ে চলচ্চিত্র নির্মাণের বিষয়টি নতুন নয়। ইতোপূর্বে ভারত ও বাংলাদেশে নির্মিত বেশকিছু ডকুমেন্টারি ও ফিচার ফিল্মে নানা দৃষ্টিকোণ থেকে চিত্রায়িত হয়েছে দেশভাগের সময় ও দেশভাগ-পরবর্তী উদ্বাস্ত্ত বিপর্যয় থেকে শুরম্ন করে আমত্মঃপরিচয় সংকট বা স্মৃতিকাতরতার মতো সূক্ষ্ম বিষয়গুলো। ভারত-পাকিসত্মান ভাগের পরিপ্রেক্ষিতে তৈরি প্রথম ছবি নিমাই ঘোষ পরিচালিত ছিন্নমূল (১৯৫০)। প্রয়াত পরিচালক ঋত্বিক ঘটক এই ছবিটিতে সহকারী পরিচালক ছিলেন এবং ছবির একটি চরিত্রে অভিনয়ও করেছিলেন। পরবর্তী সময়ে দেশভাগজনিত উদ্বাস্ত্ত সমস্যা ও মানবিক টানাপড়েন ঋত্বিক ঘটকের চলচ্চিত্রে অন্যতম বিষয় হয়ে ওঠে; একে একে নির্মিত হয় নাগরিক (১৯৫২), মেঘে ঢাকা তারা (১৯৬০), কোমল গান্ধার (১৯৬১) ও সুবর্ণরেখার (১৯৬২) মতো ছবিগুলো। সংগত কারণেই আলোচ্য ছবি শঙ্খচিল নির্মিত হয়েছে ঋত্বিক ঘটকের স্মৃতি নিয়ে। এ-প্রসঙ্গে উলেস্নখ্য, মূলত পূর্ব পাকিসত্মান থেকে পশ্চিমবঙ্গে আসা জনগোষ্ঠীর সামাজিক, মানবিক ও আর্থিক বিপর্যয় নিয়ে আগে বেশকিছু ছবি তৈরি হলেও ভারত ও বাংলাদেশের যৌথ প্রযোজনায় নির্মিত শঙ্খচিলই ভারত-বাংলাদেশ সীমামত্মবর্তী মানুষের সাম্প্রতিক জীবনযাপন ও ঘটমান সীমামত্ম-জটিলতা বিষয়ে তৈরি প্রথম পূর্ণদৈর্ঘ্য কাহিনিচিত্র। সুতরাং বিষয় নির্বাচনে বৈচিত্র্য ও সময়োপযোগিতার জন্য প্রথমেই পরিচালক গৌতম ঘোষের জন্য আমত্মরিক সাধুবাদ। ছবিটি ইতোমধ্যেই ভারতে শ্রেষ্ঠ বাংলা কাহিনিচিত্রের জন্য জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কারে ভূষিত হয়েছে।
শঙ্খচিল ছবির কাহিনিকার দুজন – গৌতম ঘোষ ও সায়মন্তী পুততু-। বর্তমান সময়ের মাটিতে পা রেখে কাহিনিকারদ্বয় কখনো পিছু ফিরে দেখেন, কখনো আবার দৃকপাত করেন আপাত সমাধানহীন সমস্যাসংকুল ভবিষ্যতের দিকে। কাহিনির বিসত্মারের সঙ্গে সঙ্গে বাংলাদেশ-ভারত সীমান্ত এলাকায় বসবাসের জটিল অথচ বৈচিত্র্যপূর্ণ দিকটির এবং এই দুদেশের মানুষের মধ্যে সৌহার্দ্যপূর্ণ সম্পর্কের প্রমাণ মিলতে থাকে। ছবির প্রথম-চতুর্থাংশে সীমামত্ম অঞ্চলের সার্বিক জটিলতা ও সাম্প্রতিক ঘটনাবলি দৃশ্যায়নের প্রয়াস থাকলেও খুব দ্রম্নতই দর্শকের মনোযোগ আকৃষ্ট হয় বাংলাদেশ-ভারত সীমামেত্ম অবস্থিত বাংলাদেশের সাতক্ষীরা জেলার জনগোষ্ঠীর জীবনযাত্রার দিকে। অনেকটা প্রতিবেদনধর্মী এই প্রারম্ভাংশের পরই মনোযোগের কেন্দ্রে চলে আসে শিক্ষিত মধ্যবিত্ত সাধারণ একটি পরিবারের আনন্দ-বেদনার ব্যক্তিগত কাহিনির আমত্মরিক বিসত্মার। তবে ছবির একেবারে শেষাংশে গিয়ে সেই ব্যক্তিগত গল্পটিই উন্মোচিত হয় সমষ্টির গল্পের প্রতিভূ হিসেবে।
একেবারে শেষাংশের আগে ঘটনাপ্রবাহে নাটকীয় বা অপ্রত্যাশিত কোনো উপাদান যোগ হয় না। নানারকম মমত্মাজ, যেমন ঘোরকৃষ্ণ মেঘের ঘনঘটার ব্যাকড্রপে রূপসার হেঁটে যাওয়া, রূপসার কল্পনায় রাতের আকাশে আশাতিরিক্ত তারার ভিড় অথবা হাসপাতালে স্যালাইনের বোতলে স্বচ্ছ তরলের সঙ্গে গাঢ় নীল বা রক্তের লাল রং মিশে যাওয়া, সমস্বরে বহু কাকের চিৎকার ইত্যাদির মধ্য দিয়ে ছবির এক-তৃতীয়াংশের পর থেকেই রূপসার আসন্ন মৃত্যুর ইঙ্গিত দর্শক পেতে শুরম্ন করে। দুই ঘণ্টা পনেরো মিনিট দৈর্ঘ্যের এই চলচ্চিত্রে একধরনের অপ্রত্যাশিত মোড় আসে সমাপ্তির ঠিক বারো মিনিট আগে। রূপসার ডেথ সার্টিফিকেট নেওয়ার ঠিক পূর্বমুহূর্তে মুনতাসীর চৌধুরী বাদল হাসপাতালের নথিপত্রে অমত্মর্ভুক্ত তার নাম, ধর্ম ও ভোটার আইডিকে মিথ্যা বলে স্বীকার করে বসে। শুরম্ন হয় অনুপ্রবেশ-আইনের জটিলতা। ‘মেয়ে সুস্থ হয়ে উঠলেও কি তিনি মিথ্যা স্বীকার করার ঝুঁকি নিতেন?’ – মনস্তাত্ত্বিক এ-প্রশ্ন ছবির ক্লাইমেক্স পর্যায়ে এসে কোনো কোনো দর্শককে হয়তো ভাবিত করতে পারে। নিজেদের পরিচয়-গোপনজনিত মিথ্যাচারের গস্নানিবোধ, আর্থিক চাপ ও সমত্মান হারানোর শোক – সব মিলে এক দুঃসহ মানসিক চাপের মধ্যে পড়েই তিনি এ কাজ করেন, আসন্ন সব ধরনের আইনগত জটিলতার কথা জেনেও। যদিও মুনতাসীর ও লায়লার পরিণতি সম্পর্কে শেষ অবধি দর্শক অনিশ্চিতই থেকে যায়, কিন্তু ঠিক এই পর্যায়ে এসেই ওদের কাহিনিটি আর ব্যক্তিগত থাকে না, হয়ে ওঠে পরিস্থিতির নিরম্নপায় শিকার যে-কোনো মানুষের কাহিনি।
শঙ্খচিল চলচ্চিত্রের চিত্রনাট্য রচনা করেছেন পরিচালক গৌতম ঘোষ। ছবির পাত্র-পাত্রীদের সংযত অভিনয় করার পক্ষে অন্যতম সহায়ক ভূমিকা রেখেছে এর বাহুল্যবর্জিত চিত্রনাট্য ও পরিমিত সংলাপ। তবে এ-ছবিতে দু-একটি অসংলগ্ন প্রয়াস ছাড়া সাতক্ষীরা, টাকি ও কলকাতার আঞ্চলিক ভাষাকে প্রায় সম্পূর্ণ এড়িয়ে গেছেন চিত্রনাট্যকার। স্থানোপযোগী আঞ্চলিক ভাষার সঠিক ব্যবহারের মধ্য দিয়ে ছবিটি নিঃসন্দেহে আরো শিল্পোত্তীর্ণ হতে পারত। উপরন্তু, কয়েকটি দৃশ্যের (উদাহরণত, স্কুলের অফিসে, স্বাধীনতা দিবস উদযাপন বা রূপসার অসুস্থতার সময়) স্বাভাবিকতাকে সমুন্নত রাখার জন্য চিত্রনাট্যে প্রধান শিক্ষক হেমমত্মবাবু ছাড়াও মুনতাসীরের আরো কয়েকজন সহকর্মী শিক্ষকের চরিত্রের সংকুলান করা যেত, কাহিনিতে কোনো রদবদল না করেই।
ছবির কাহিনির সঙ্গে চরিত্রগুলোর আবেগ প্রায় সবক্ষেত্রেই সুন্দরভাবে যুক্তিগ্রাহ্য হয়। তবে দেশভাগ নিয়ে প্রবন্ধ লেখার প্রস্ত্ততিপর্বের একপর্যায়ে ইছামতির তীরে বসে মুনতাসীর ঠিক কেন অতটা আবেগাক্রামত্ম হয়ে পড়েন এবং আপন মনে অন্নদাশঙ্কর রায়ের বিখ্যাত পঙ্ক্তি ‘তেলের শিশি ভাঙল বলে খুকুর ’পরে রাগ করো, তোমরা যে সব বুড়ো খোকা ভারত ভেঙে ভাগ করো…’ আওড়াতে আওড়াতে পুরনো চিঠিপত্র ছুড়ে ফেলতে থাকেন – তা ঠিক স্পষ্ট হয় না। আবেগের ওই আত্যমিত্মকতাকে যৌক্তিক ভিত্তি দেওয়ার জন্য বোধ হয় উলিস্নখিত দৃশ্যটির আগে অথবা পরে আরো কোনো ইঙ্গিত বা সিকোয়েন্সের প্রয়োজন ছিল, যেখানে দেশভাগের ও বাস্ত্তহারার বেদনার সঙ্গে মুনতাসীরের ব্যক্তিগত ঘনিষ্ঠতাকে প্রতিষ্ঠিত করে তোলা যায়।
অভিনয় এই ছবির অন্যতম সম্পদ। চরিত্রোপযোগী অভিনেতা নির্বাচনে পরিচালক গৌতম ঘোষও আশানুরূপ দক্ষতা দেখিয়েছেন। সকলেই চরিত্রানুগ ও পরিণত অভিনয় করেছেন এবং অভিনয়ে সংযমের পরিচয় রেখেছেন। বিশেষত রূপসা চরিত্রে রূপদানকারী সাঁঝবাতির (টাইটেল কার্ডে এই বানান দেখানো হয়েছে) পরিমিত অভিনয়ের কথা আলাদাভাবে উলেস্নখ না করলেই নয়। তার সরল অবয়ব ও গৃহপালিত প্রাণিকুলের সঙ্গে বোঝাপড়া রূপসার মতো শামত্ম, নিষ্পাপ, প্রকৃতিপ্রেমী ও সংবেদনশীল গ্রাম্য বালিকার চরিত্র রূপায়ণে তাকে বাড়তি সুবিধা দিয়েছে। তবে পুরো ছবিতেই তার ‘র’-এর উচ্চারণ ছিল ত্রম্নটিপূর্ণ। পরিচালক এ বিষয়ে বাড়তি মনোযোগ ও অভিনেত্রীকে প্রয়োজনীয় প্রশিক্ষণ দিলে এ-সমস্যা কাটিয়ে ওঠা সম্ভব ছিল বলেই মনে হয়।
এ-ছবির সিনেমাটোগ্রাফি, আর্ট ডিরেকশন, মেক আপ এবং সেট, লোকেশন ও কস্টিউম নির্বাচনে আশানুরূপ মুনশিয়ানা ও আমত্মরিক সচেতনতার পরিচয় মেলে। দু-একটি ব্যতিক্রম বাদ দিলে, এডিটিংও যথোপযুক্ত। যেমন – ছবির একটি দৃশ্যে রূপসাকে ঘনকালো মেঘাচ্ছন্ন আকাশ ও বিদ্যুতের চমকের ব্যাকড্রপে একলা হেঁটে যেতে দেখা যায় (মমত্মাজ ১)। খুবই প্রতীকী এই দৃশ্য হঠাৎই কাট করে ঘরের ভেতরে মুনতাসীর ও লায়লাকে দেখানো হয়; ব্যাকগ্রাউন্ডে রেডিওতে বাজে ‘খেলিছ এ বিশ্ব লয়ে’ নজরম্নলগীতিটি (মমত্মাজ ২)। এর ঠিক পরের দৃশ্যেই রূপসা তার বাবাকে ডেকে অজস্র তারার আলোয় আলোকিত রাতের আকাশের দিকে দৃষ্টি আকর্ষণ করে (মমত্মাজ ৩)। দুই কি তিন মিনিটের মমত্মাজ সিকোয়েন্সের পরিবর্তে প্রতীকী ওই মমত্মাজগুলো কাহিনিবিন্যাসের বিভিন্ন পর্যায়ে আলাদাভাবে ব্যবহার করলে ছবির গতির সঙ্গে তা আরো মসৃণ ও স্বাভাবিকভাবে মিশে যেত।
পরিচালক স্বয়ং এই চলচ্চিত্রের সংগীত পরিচালনার দায়িত্বে ছিলেন। হয় পাত্রপাত্রীর মুখে নয় আবহসংগীত হিসেবে, ব্যবহৃত হয়েছে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, কাজী নজরম্নল ইসলাম, মুকুন্দ দাশ, রজনীকামত্ম সেন, জীবনানন্দ দাশ-বিরচিত বেশ কয়েকটি গানের অংশবিশেষ। বাণীগত দিক থেকে সিকোয়েন্সের সঙ্গে সাযুজ্যপূর্ণ হলেও, সম্ভবত সংগীতায়োজনে ও শব্দ সংমিশ্রণে পরিমিতির অভাবের ফলে কয়েকটি গান কিছুটা উচ্চকিত শুনিয়েছে এবং প্রয়োজনের অতিরিক্ত মনে হয়েছে। কয়েকটি গানে বেহালার আওয়াজ সিকোয়েন্সের চাহিদার চেয়ে বেশি চড়া ছিল। প্রসঙ্গক্রমে, ছবিটির সাউন্ড অ্যাফেক্টের প্রশংসা আলাদাভাবে করতেই হয়। বিশেষত, ড্রামবিটের সময়োপযোগী ব্যবহার, এর টেম্পো এবং বেইজ ও নির্বাচন এবং সর্বোপরি স্বাভাবিক বা প্রাকৃতিক শব্দ, যেমন – ঘোরকৃষ্ণ মেঘের গুরম্নগুরম্ন গর্জন, তারস্বরে কাকের চিৎকার অথবা রূপসার হৃৎস্পন্দন ইত্যাদির সঙ্গে ড্রামবিটের ভারী শব্দের মিক্সিং ছবিটির বেশ কিছু দৃশ্যের গুরম্নত্ব ও ভার নিঃসন্দেহে অনেকগুণ বাড়িয়ে দিয়েছে।
বাংলাদেশের প্রেক্ষাপট বা পটভূমি নিয়ে কাজ করার ক্ষেত্রে গৌতম ঘোষের রয়েছে ব্যাপক অভিজ্ঞতা। তাঁর সাম্প্রতিকতম ছবি শঙ্খচিলের (২০১৬) আগেই পদ্মা নদীর মাঝি (১৯৯২) ও মনের মানুষের (২০১০) মতো চলচ্চিত্র নির্মাণের মধ্য দিয়ে পূর্ববঙ্গের অতীতের জীবনযাত্রা ও সংস্কৃতির প্রতি তাঁর নিবিড় শ্রদ্ধা ও আগ্রহের প্রমাণ দিয়েছেন তিনি। এই তিনটি ছবির গল্প কোনোভাবেই তুলনীয় নয়। তারপরও বর্তমান প্রেক্ষাপটে নির্মিত শঙ্খচিল ছবিটি এর বিষয়বৈচিত্র্য, কাহিনির মৌলিকত্ব ও সর্বোপরি এর সময়োপযোগিতার জন্য বাংলাদেশের পটভূমি নিয়ে করা তাঁর সব কটি চলচ্চিত্রের মধ্যে সবচেয়ে বেশি গুরম্নত্বপূর্ণ এবং বাঙালি-অবাঙালি নির্বিশেষে বাংলাদেশি ও ভারতীয় সব দর্শকের মনোযোগের দাবিদার। কিন্তু কিছু প্রশ্ন তবু থেকে যায়।
প্রশ্ন থেকে যায়, বাংলাদেশ-ভারত সীমামত্ম-বাসত্মবতার চালচিত্রের কতটুকু গৌতম ঘোষ তাঁর শঙ্খচিল চলচ্চিত্রের ক্যানভাসে অাঁকতে চেয়েছেন বা পেরেছেন? ফরেন পলিসি ম্যাগাজিনের তৈরি করা পৃথিবীর সবচেয়ে ভয়ংকর এবং বিপজ্জনক কয়েকটি আমত্মর্জাতিক সীমানার তালিকায় বাংলাদেশ-ভারত সীমামত্ম অন্যতম। এই সীমামত্মগুলোতে ২০০০ থেকে ২০১৫ সাল পর্যমত্ম এই পনেরো বছরে নিহত লোকের সংখ্যা ১০৫২। বাংলাদেশ সরকারের পরিসংখ্যান মতে, বাংলাদেশের বিভিন্ন সীমামেত্ম গত পাঁচ বছরে ১৪৬ জন বাংলাদেশি বিএসএফের গুলিতে নিহত হয়েছে। বিএসএফ জওয়ান অমিয় ঘোষের গুলিতে ২০১১ সালে কাঁটাতারের ওপরে নিহত কিশোরী ফেলানী খাতুনের করম্নণ মৃত্যুর দৃশ্যে বিশ্ববাসী হতবাক হয়েছিল। কিন্তু বিএসএফের দায়ের করা তথাকথিত ফেলানী হত্যা মামলার রায়ে ২০১৩ সালে বেকসুর খালাস পান ওই জওয়ান। প্রশ্ন উঠতে পারে, সীমামত্ম-আইনের কঠোরতার নামে এসব নিষ্ঠুরতা, বিচারহীনতা অথবা সাম্প্রতিক বছরগুলোতে বাংলাদেশি নাগরিকদের জন্য ভারতীয় ভিসা আবেদন প্রক্রিয়ায় অনৈতিক ও অনাবশ্যক জটিলতা সৃষ্টি ইত্যাদি হাজারো সমস্যার কতটুকু চিত্রায়িত হয়েছে আলোচ্য চলচ্চিত্রে? ছবিতে শুরম্নর দিকে সীমামত্ম-আইনের কঠোরতা, বিশেষত ফেলানী হত্যার স্মৃতি অবলম্বনে বিএসএফের নিষ্ঠুরতার সামান্য চিত্রায়ণ থাকলেও ছবির প্রথম-চতুর্থাংশের পরে মূলত টিকে থাকে শুধু মানবিকতার গল্প। বিএসএফ, বিজিবি, দুদেশের সাধারণ মানুষ, হাসপাতালের চিকিৎসক ও হাসপাতালকর্মী সবাই তাদের সাধ্যের মধ্যে থেকে মানবিক ও একে অন্যকে সহযোগিতার হাত বাড়াতে চায়; কিন্তু সীমামত্ম-আইনের কারণে তাদের সাধ্য বা কর্মকা– মানবিকতার পরিধি হয় সীমাবদ্ধ। এ চিত্রটিও যে একেবারে ভুল বা মিথ্যা তা নয়। তবে প্রশ্ন করা যেতেই পারে, পরিচালক ঠিক কী উদ্দেশ্যে এই ছবিটি নির্মাণে আগ্রহী হলেন? শুধু বাংলাদেশ-ভারতের সীমামেত্ম বসবাসকারী মানুষদের আনন্দ-বেদনার কাহিনির মর্মস্পর্শী চিত্রায়ণই কি তাঁর উদ্দেশ্য? উদ্ভূত পরিস্থিতিগুলোর জন্য সরাসরি ও স্পষ্টভাবে একমাত্র ভারত-পাকিসত্মান সীমামত্ম-চিহ্নিতকারী সিরিল জন র্যাডক্লিফের রোয়েদাদ ছাড়া অন্য কিছুকে বা অন্য কাউকে সমালোচনা করা থেকে কেন পরিচালক সতর্কভাবে বিরত থাকেন? তিনি কি সবকিছু জেনেবুঝেও রাজনৈতিক সংবেদনশীল বিষয়ে স্পষ্ট করে কিছু বলার দায়িত্ব সযত্নে এড়িয়ে যেতে চান? পক্ষান্তরে কিন্তু এমনও প্রশ্ন করা যায় : পরিচালক কি একজন রাজনীতিবিদ বা ইতিহাসবিদ যে তাঁকে এই সীমামত্মবর্তী মানুষের টানাপড়েন বা দুঃখকষ্টের জন্য কী, কে বা কারা কোন অনুপাতে দায়ী তা সাদা-কালোয় চিহ্নিত করতে হবে? শঙ্খচিলের মতো ছবি তৈরির আগে পরিচালককে অবশ্যই প্রচুর গবেষণা করতে হয়। কিন্তু তাই বলে ছবিটি নিজেই একটি অভিসন্দর্ভ বা গবেষণাপত্র হয়ে যায় না এবং তা বাঞ্ছনীয়ও নয়। এতে শিল্পের সৌন্দর্য ব্যাহত হয়। রং-তুলি বা কালি-কলম দিয়ে একজন আঁকিয়ে তাঁর চিত্রপটে সবই আঁকেন না বা অাঁকতে চান না। একথা অনস্বীকার্য যে, অন্যসব শিল্পমাধ্যমের তুলনায় চলচ্চিত্রই সবচেয়ে বড় ক্যানভাস নিয়ে কাজ করে। তাই পরিচালক সর্বোপরি একজন শিল্পীও বটে। শিল্পী হিসেবে কোনো বিষয়ের প্রতি কম বা বেশি মনোযোগ দেওয়ার পূর্ণ স্বাধীনতা তাঁর রয়েছে। সে বিচারে পৃথিবীর কোনো চলচ্চিত্রই একশ ভাগ সম্পূর্ণ বা অনপেক্ষ নয়, হতেও পারে না। আসলে শিল্পীর সেই সৃষ্টিটিই সবচেয়ে মহান হয়ে ওঠে, যা তাঁর নিজ-সত্তাকে সবচেয়ে বেশি অভিভূত বা বিচলিত করে। সেটাই শিল্পীর সততা। n