logo

লুশিয়ান ফ্রয়েড কাছের মানুষ দূরের মানুষ

রাজীব ভৌমিক
‘আমি সবসময়ই চেয়েছি আমার ছবিতে যেন নাটক থাকে। তাই আমি সবসময় মানুষের ছবিই এঁকেছি। শুরু থেকেই এই মানুষই ছবিতে নাটকের জন্ম দিয়েছে।
মানুষের ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র অঙ্গভঙ্গিরও রয়েছে অসাধারণ গল্প বলার ক্ষমতা।’ – লুশিয়ান ফ্রয়েড

শিল্পী এবং শিল্পের বিষয়বস্ত্তর সম্পর্ক আসলে কেমন হওয়া উচিত? সোজাসাপ্টা রৈখিক, মানে ইংরেজিতে যাকে বলে ‘লিনিয়ার’ তেমন কি? নাকি হওয়া উচিত যৌগিক, ইংরেজিতে যাকে বলে ‘কোয়াড্রেটিক’ – যেখানে বিষয়বস্ত্তকে কখনো কখনো শিল্পী টেনে আনেন বাস্তবের খুব কাছাকাছি একটা অস্বস্তিকর নো ম্যান্স ল্যান্ডে কিংবা শিল্পী নিজেই ঢুকে পড়েন তাঁর সৃষ্টির সীমানায় – যেখানে তাঁর উপস্থিতিটাই একটা অস্বস্তিকর ব্যাপার?
ইংল্যান্ডের ন্যাশনাল পোর্ট্রেট গ্যালারিতে চলছে জার্মান বংশোদ্ভূত ব্রিটিশ শিল্পী লুশিয়ান ফ্রয়েডের (১৯২২-২০১১) পোর্ট্রেটের প্রদর্শনী। প্রদর্শনীর নাম ‘লুশিয়ান ফ্রয়েড পোর্ট্রেটস’। এই ফ্রয়েডকে মনে করা হয় তাঁর প্রজন্মের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ এবং প্রভাবশালী শিল্পী। সত্তর বছরের শিল্পীজীবনে এঁকেছেন অসংখ্য ছবি – যার বেশিরভাগেরই উপজীব্য মানুষ। বন্ধু বানিয়েছেন বহু মানুষকে। তাঁদের রাজি করিয়েছেন মডেল হতে – কখনো রাজপরিবারের সদস্য, কখনো বা আন্ডারওয়ার্ল্ডের কোনো মাফিয়া কিংবা রুপালি পর্দার কোনো মহাতারকা। ফ্রয়েড এঁকেছেন লেই বাওয়ারি, ডেভিড হকনি, ফ্র্যাঙ্ক অরব্যাচ ও ফ্রান্সিস বেকনের প্রতিকৃতি। এই প্রদর্শনীটি তাঁর জীবনের অসংখ্য একক প্রদর্শনীর চেয়ে একটু ভিন্ন। এবারই প্রথম শুধু তাঁর অাঁকা পোর্ট্রেট নিয়েই হয়েছে আয়োজন।
এই যে প্রায় সাত দশক ধরে অক্লান্ত ছবি এঁকে গেছেন ফ্রয়েড – এসব ছবির সত্যিকারের বিষয়বস্ত্ত আসলে কী ছিল? পোর্ট্রেটগুলোর দিকে যদি নজর দিই তাহলে দেখব, তাঁর খুব কাছের মানুষরাই বারবার ঘুরেফিরে উঠে এসেছে – প্রথম স্ত্রী কিটি, দ্বিতীয় স্ত্রী ক্যারোলিন এবং দুই মেয়ে এস্থার ও বেলা।
ফ্রয়েডের দেখার যে চোখ তা-ই তাঁর স্বকীয়তা। মানুষকে তিনি দেখেছেন প্রকৃতির অংশ হিসেবে, প্রাণী হিসেবে। মানুষের শারীরিক অস্তিত্বই তাঁর কাছে সর্বোচ্চ গুরুত্ব পেয়েছে সবসময়। তাই ফ্রয়েডের সৃষ্টিকে চিনতে হলে ক্যানভাসে রঙের কারসাজি বা তুলির অাঁচড়ের মুন্শিয়ানার মতো কেতাবি বিষয় নিয়ে মাথা ঘামাতে হয় না। শুধু দেখতে হয় ছবির চরিত্রটিকে শিল্পী কীভাবে উপস্থাপন করেছেন। ফ্রয়েডের প্রকৃতি দেখার যে চোখ তাতেই মানুষ তার কাছে হয়ে উঠেছে নিসর্গ। তাই ফ্রয়েড যখন নগ্ন মানব বা মানবীকে ফুটিয়ে তুলেছেন তাঁর ক্যানভাসে, সেখানে অশ্লীলতা নয় বরং মানব-শরীরের যে জটিল আবাহন তারই শৈল্পিক রূপ চিত্রিত হয়েছে।
‘লুশিয়ান ফ্রয়েড পোর্ট্রেটসে’র প্রতিকৃতি এবং আত্মপ্রতিকৃতিগুলো খুব মনোযোগ দিয়ে দেখলে বোঝা যাবে, এসব ছবির চরিত্ররা স্রেফ মানব-মানবী নয়। বরং এরা সবাই গোটা মনুষ্য প্রজাতির প্রতিনিধি – হিউম্যান দ্য কমন নাউন। নাটকীয়তার প্রতি ফ্রয়েডের যে আকর্ষণ তাতে তার পোর্ট্রেটগুলো সুবিন্যস্ত ক্লোজআপ না হয়েই যায় না। কোনো কোনো ছবিতে নগ্ন শরীরটা স্রেফ হাড়বিহীন, কোথাও বা পাওয়া যাবে আঘাতের চিহ্ন। রঙের ব্যবহারের ক্ষেত্রেও ফ্রয়েড অবিচল – বিবর্ণ সবুজ আর হলুদ, ডাস্ট ব্লু এবং ক্রোমিয়ান হোয়াইট – অতিঘর্ষণে লাল হয়ে যাওয়া নারীর ঊরুর ভেতর দিক কিংবা স্ট্রেটমার্কের চকচকে গোলাপি।
অনন্য এই প্রদর্শনীতে প্রদর্শিত হয়েছে মোট একশ তিরিশটি ছবি। বিশ্বের নানা প্রান্তের জাদুঘর এবং ব্যক্তিগত সংগ্রহ থেকে আনা হয়েছে এসব ছবি। এদের মধ্যে আছে এমন অনেক ছবি, যা আগে কোথাও প্রকাশ্যে প্রদর্শন করা হয়নি। ফ্রয়েডের সবচেয়ে বিখ্যাত ছবিগুলোর একটি ‘বেনেফিটস সুপারভাইসর স্লিপিং’। ২০০৮ সালে রুশ ধনকুবের রোমান আব্রামোভিচ নিলামে কিনেছিলেন বিশ্বরেকর্ড বাইশ মিলিয়ন পাউন্ডে।
‘লুশিয়ান ফ্রয়েড পোর্ট্রেটস’ – বহুল প্রতীক্ষিত এই প্রদর্শনীটি নিজে উপস্থিত থেকে আয়োজন করার কথা ছিল ফ্রয়েডের। তেমনটাই পরিকল্পনা ছিল আয়োজক ব্রিটেনের ন্যাশনাল পোর্ট্রেট গ্যালারির। কিন্তু প্রকৃতির অনুষঙ্গগুলোকে নিয়ে চিরকাল খেলা করা ফ্রয়েডের দিকে চেয়ে প্রকৃতি নিজেই যে মুচকি হাসছিল তা কি আর তিনি জানতেন? ২০১১ সালের ২০ জুলাই পৃথিবীর মায়া ত্যাগ করেন প্রজন্মের সেরা এই ব্রিটিশ শিল্পী। তাই ৯ ফেব্রুয়ারি শুরু হওয়া এই প্রদর্শনীর যখন পর্দা নামবে ২৭ মে, তখন অভাবটা ঠিকই টের পাওয়া যাবে। এমনি আরো অনেক ২৭ মে পেরিয়ে গেলেও এই অভাব পূরণ হওয়ার নয়।

রাজীব ভৌমিক
১২ এপ্রিল, ২০১২

 

Leave a Reply