ম ই নু দ্দী ন খা লে দ
অন্য কোনো দেশের মানুষ এত আগুনের ফুল দেখেনি। ধরিত্রীমাতা রেগে গিয়ে ফুঁসে উঠলেই সেই আগুনবৃক্ষ ফুলে ছেয়ে যায়। আগ্নেয় পুষ্পবৃষ্টি মেক্সিকোর মানুষের মনটা সবসময়ই উষ্ণ রাখে। তারা আগ্নেয়গিরিকে অভিশাপ মনে করে না, বরং তার পূজা করে। সেই আগুনের ঝরনাতলেই দিয়েগো রিভেরার জন্ম। প্রেমে ও বিদ্রোহের আগুনে জ্বলে এতটাই তিনি স্বদেশকে আত্মায় ধারণ করেছেন যে অনেকে মনে করে নামটার মাঝে তাঁর মাতৃভূমির পরিচয় থাকা সংগত। তাই সে-দেশে অনেকেই তাঁকে ডাকে ‘দিয়েগো মেক্সিকান রিভেরা’ বলে।
ছবি আঁকা মানে বিপ্লবে অংশ নেওয়া। গান গাওয়া, কবিতা-কথাসাহিত্য রচনা করা মানেও তাই। লাতিন আমেরিকার মানুষের মতো এ সত্য অন্য কোনো মহাদেশের মানুষ এতটা অনুভব করেনি। তারা জানে, সবই রাজনীতি। স্পেনীয়রা তাদের প্রাচীন সভ্যতাগুলো ধ্বংস করেছে। ইউরোপের আরো অনেক জাতির হাতেই ধর্ষিত হয়েছে এ মহাদেশের অনেক দেশ। তাই সংস্কৃতিচর্চার অন্য নাম রাজনীতিচর্চা। জনতার চোখের সামনে স্বদেশ পরিস্ফুট থাক, ইতিহাস পাঠ করুক তারা ছবি দেখে, অবগাহন করুক তারা সহস্র বছরের ঐতিহ্যের নদীতে – এই বাসনার তীব্র তাগিদে নানা ভবনের দেয়ালে রিভেরা এঁকে গেছেন দূর-সভ্যতা আজটেকের রানির শোকাহত মুখ, ককেসীয় ইউরোপের উৎপীড়ন, জনতার লাঞ্ছনা ও বিদ্রোহ। তবে শুধু স্বদেশের সুখ-দুঃখের গাথা চিত্রিত করেননি শিল্পী। লাতিন আমেরিকার রাজনীতিসচেতন মানুষ অন্য রকম। তারা পুরো মহাদেশের সুখে উল্লসিত হয়, নাচ-গানে মেতে ওঠে, আর তার দুঃখে কাঁদেই না শুধু, প্রতিবাদ করে এবং সেই প্রতিবাদকে বিপ্লবে রূপ দেয়। মহাদেশটা ঔপনিবেশিক আগ্রাসনের বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ হয়ে হুংকার দেয় – নির্দ্বিধায় আত্মাহুতি দেয় সশস্ত্র বিপ্লবে। এখানে জনতা ও শিল্পী ইস্পাতকঠিন শপথে সমাজতন্ত্র কায়েমের জন্য লড়াই করে।
রিভেরার অনেক ছবিই সাম্যবাদী চিন্তায় পুষ্ট। তাঁর সহযোদ্ধা সিকেইরেজ ও ওরোজকোও জনতাপ্রধান দেয়ালচিত্র বা ম্যুরাল এঁকেছেন। ইতালীয় রেনেসাঁর তিন মহাপ্রতিভা দা ভিঞ্চি-মাইকেলেঞ্জেলো-রাফায়েলের মতোই রিভেরা-সিকেইরেজ-ওরোজকো। অ-পশ্চিমীয় শিল্পের সবচেয়ে বড় শৈল্পিক বিপ্লব মেক্সিকান ম্যুরালিস্টদের দেয়ালচিত্র। কেউ তারা ভাবেনি মেক্সিকোই শুধু তাদের দেশ। পুরো মহাদেশটাই তাদের দেশ – মুক্তিকামী নব্য উপনিবেশবিরোধী সব দেশের জনতারই তারা সহযোদ্ধা। এই গোল পৃথিবীর সবচেয়ে উঁচু দেশ মেক্সিকো। যেন জননী বসুন্ধরার কপাল। সেই কপালে বিচিত্র পীড়নের বলিরেখা। ছবি-আঁকা মাতৃমুক্তি পণ বলে বিপ্লবী রিভেরা তাঁর দেয়ালচিত্রে উড়িয়েছেন স্বদেশের পতাকা। তবে স্বদেশের পতাকারও ওপরে উঁচু দেশের সবচেয়ে উঁচুতে মানে ধরিত্রীমাতার শিরে বেঁধে দিয়েছেন কমিউনিজমের পতাকা। শুধু ছবি আঁকা নয়, নব্য উপনিবেশী শক্তির রক্তচক্ষুকে আগ্নেয় হুমকিতে পুড়িয়ে দিয়েছেন জনতার মিছিলে এসে। পিস্তল হাতে তাড়া করেছেন মানুষরূপী বর্ণবাদী পশুদের। দিয়েগো রিভেরা যেন মেক্সিকোরই আগ্নেয় শিল্প-আত্মা। বিশেষজ্ঞরা বলেছেন, লাতিন আমেরিকায় এ শিল্পী খ্যাতির যে শীর্ষবিন্দুতে পৌঁছেছেন তা নাকি পিকাসোরও ভাগ্যে জোটেনি। জনতাবান্ধব হয়ে শিল্পরচনা করে খ্যাতির যে রঙিন পালকের মুকুট শিল্পী শিরদেশে ধারণ করেছিলেন তা বুনেছিল লাতিন আমেরিকা নামের এক মহাদেশের মুক্তিকামী জনতা, শুধু মেক্সিকোর মানুষ নয়। পাবলো পিকাসো, অঁদ্রে ব্রতোঁ, লেয়ন ট্রটস্কি, এডওয়ার্ড ওয়েস্টন, তিনা মোদোত্তি, ফ্রিদা কাহ্লো প্রমুখের সঙ্গে জড়িয়ে ইতিহাস লিখেছে তাঁর নাম। জনতা ও বন্ধুদের ভালোবাসার রঙিন তরঙ্গে দুলেছেন যেমন, তেমনি জড়িয়েছেন শিল্পী সম্পর্কের জটিলতায় ও ঘৃণার জালেও। সব মিলিয়েই শিল্পের ভুবনে সৃষ্টি হয়েছে রিভেরা-পুরাণ।
দুই
রিভেরাদের পূর্বপুরুষদের আদি পরিচয় পরিষ্কার জানা যায়নি। বাবার দিক থেকে রুশীয় আর মায়ের দিক থেকে রেড-ইন্ডিয়ান, এরকম একটা হিসাব পাওয়া যায়। তবে রিভেরা সংকররক্তজাত অর্থাৎ ক্রেয়ল; এ ধারণাটা তাঁর দেহের গঠন আর অবয়ব পাঠ করলে বোঝা যায়। নিজেকে তিনি বর্ণসংকর মেসিসতো লাতিন আমেরিকান হিসেবে বিশ্বাস করতে ভালোবাসতেন। বাবা-মা দুজনই নিষ্ঠাবান ক্যাথলিক। ১৮৯৪ সালে চার বছর বয়সে রিভেরাকে ভর্তি করা হয় ‘কার্পনতিয়ের ক্যাথলিক কলেজে’। বালক বয়সেই ছবি আঁকার নেশা অন্য সব পাঠ্য বিষয় ছাপিয়ে ওঠে। তাই ছবি আঁকার সান্ধ্যকালীন স্কুল সান কারলোস অ্যাকাডেমিতে গিয়ে একাগ্র ধ্যানে আঁকাআঁকি করে চারুশিল্পের রহস্যে জড়িয়ে যায় তাঁর কৈশোর। সান্তিয়াগো রেবুল স্পেনের মানুষ; নিয়মের প্রতি নিষ্ঠাবান। ছবি আঁকা শিখেছেন নিও-ক্লাসিকাল ধারার ফরাসি গুরুশিল্পী ইনগ্রেসের কাছে। কারলোস অ্যাকাডেমির এই প্রবীণ শিক্ষকের নির্দেশে রিভেরা একাগ্রচিত্তে কপি করতে শুরু করলেন ইউরোপীয় গুরুশিল্পীদের কাজ। অনুশীলনে কব্জিতে জোর এলো। খুব দ্রুত ড্রইং করার ক্ষমতাও আয়ত্ত হলো। কিন্তু মন ভরল না তাঁর। অ্যাকাডেমির আরেক শিক্ষক ফেলিক্স পাররা অবশ্য এককভাবে ইউরোপের চিত্রশিল্প অনুসরণের পক্ষপাতী নন। পাররা রিভেরাকে
প্রি-কলাম্বিয়ান শিল্পে চোখ রাখতে বললেন। তখন থেকেই রিভেরার বোধোদয় হয়; দেশের ঐতিহ্যকে জেনে শিল্পের মুক্তি ঘটবে – আমরা আমাদের মতো বিকশিত হতে পারব। গুরুশিল্পীদের রিপ্রোডাকশন দেখে আর প্লাস্টার অব প্যারিসে গড়া ভাস্কর্যের নমুনা দেখে চর্চা করায় আর আগ্রহ রইল না রিভেরার। ড্রইং খাতা, ইজেল, ক্যানভাস নিয়ে তিনি মেক্সিকোর প্রকৃতিতে গিয়ে বসলেন। প্রকৃতিতে তেমন ফুল-ফসলের সম্ভার নেই। আছে লালচে রুক্ষ মাটি। অদূরে পাহাড়, সুপ্ত আগ্নেয়গিরি। এরই মধ্যে মানুষের বাস। ল্যান্ডস্কেপ এঁকে নিজস্বতার স্বাক্ষর দিলেন রিভেরা। পরিচয় হলো বিখ্যাত ল্যান্ডস্কেপ শিল্পী জেরারদো মুরিওর সঙ্গে। মুরিও মেক্সিকোর শিল্প-আন্দোলনের অগ্রনায়ক। তিনি তত্ত্বে আগ্রহী; শিল্পের কী আদর্শ হবে তা নিয়ে ভাবেন। মেক্সিকোর দেশজ-লোকজ শিল্পে মনঃসংযোগ না হলে স্বকীয়তা আসবে কী করে শিল্পে! ইন্ডিয়ানদের কারুশিল্প গভীর মনোনিবেশে পর্যবেক্ষণ করার জন্য তিনি উদ্বুদ্ধ করলেন রিভেরাকে। গুরুর তাগিদে সত্যিই আশ্চর্য ফসল ফলল। এক যৌথ প্রদর্শনীতে রিভেরার ল্যান্ডস্কেপ বিক্রিও হলো আর সেই সঙ্গে জুটল বৃত্তি – স্পেনে শিল্পের উচ্চশিক্ষার জন্য। উদ্যমী গুরু মুরিওই এ আয়োজনটা করেছিলেন তাঁর মেধাবী শিষ্যের জন্য।
তিন
১৯০৭-এর জানুয়ারি। শীতের বিকেল। ‘আলফোনসা’ জাহাজ মেক্সিকো সাগরের তীরভূমি ছাড়তে শুরু করেছে। জাহাজের সামনে দাঁড়িয়ে আছেন বিশ বছরের তরুণ রিভেরা। স্পেনে গিয়ে শিল্পবিদ্যালয়ের চৌকাঠে পা রাখার ভাবনাটা যেন হঠাৎ কেমন হয়ে গেল। তাঁর মনে হলো, ‘আমি কী সব বোকার মতো ভাবছি। কাণ্ডজ্ঞানহীন যুবকই শুধু বুঝি ভাবে একদিন সে পৃথিবীর মাস্টার আর্টিস্ট হবে। বিশ বছর বয়সটা আসলেই হাস্যকর। তা কী অদ্ভুত স্বপ্নচারী করে তোলে। এটা তো চেঙ্গিস খান বা নেপোলিয়নের জন্যও সত্য। কী ঘটতে যাচ্ছে জীবনে!’ জাহাজের বেগে পাক খাওয়া পানির ওপর সাদা ফেনার দিকে তাকিয়ে স্বপ্নচারী তরুণ বিমূঢ় হয়ে দাঁড়িয়ে রইলেন। তারপর অন্ধকার সাগরে চোখের চেয়ে কান বেশি সজাগ হলো। জাহাজের শব্দ আর শোঁ শোঁ বাতাসের তাড়া খেয়ে ডেক ছেড়ে তিনি চলে এলেন নিজের কক্ষে।
এদুয়ার্দো চিচাররো ই আগেরা স্পেনের নামি শিল্পী। তিনি ছবি আঁকেন বাস্তববাদী রীতিতে। তাঁর স্টুডিওতে কাজ শেখার সুযোগ পাওয়া ভাগ্যের ব্যাপার। রিভেরাকে যেন সুযোগ দেওয়া হয় এই মর্মে শিক্ষাগুরু মুরিও একটি চিঠি লিখে দিয়েছিলেন চিচাররোকে। এই সুবাদে চিচাররোর স্টুডিওতে চিত্রানুশীলনের বিশেষ সুবিধা জুটল রিভেরার। তাঁর এই স্পেনের গুরু তাঁকে অবশ্য স্টুডিও ছাড়তে বললেন। তিনি নবীন শিষ্যকে উপদেশ দিলেন স্পেন ঘুরে দেখার জন্য। স্টুডিওতে বসে কাজ করার সময় সংক্ষিপ্ত করে রিভেরা স্পেনের প্রকৃতি, জনজীবন, সাংস্কৃতিক ধারা আর মিউজিয়মে গুরুশিল্পীদের কাজের কপি করে শিল্পীজীবন রচনা শুরু করলেন।
আবেগ আর বুদ্ধির সমান্তরাল যাত্রা একবিন্দুতে মিশলেই জন্ম নেয় গভীর শিল্প। রিভেরা শিল্পীজীবনের সূচনা-সকাল থেকে শুরু করে রক্তিম সমাপ্তি-সন্ধ্যা পর্যন্ত এ ভাবনায় অনড় ছিলেন। শুধু আবেগের কোনো জায়গা নেই শিল্পের ইতিহাসে। তাই শিল্পের মহাসংগ্রহশালা মাদ্রিদের প্রাদো মিউজিয়ম হলো রিভেরার সাধনার অন্যতম ঠিকানা। নীলবর্ণ সায়রের রহস্যময় যাত্রিক এল গ্রেকো, স্পেস নিয়ে খেলার চৌকস রূপকার ভেলাসকেস আর যাঁর ছবির রহস্যজাল উন্মোচন করার মতো নিপুণ কোনো শিল্পশল্য চিকিৎসক আজো পৃথিবীতে জন্ম নেয়নি সেই ফ্লেমিশ শিল্পী হিয়েরোনোমুস বসের ছবি বিরামহীন কয়েক প্রহর প্রতিদিন অনুকরণ করেছেন রিভেরা। কিন্তু প্রাদো মিউজিয়মে বাস করেন সবচেয়ে ডাকসাইটে যে শিল্পী তাঁর নাম ফ্রানসেসকো গয়্যা। আঠারশো শতকে স্পেনের রাজদরবারে বসে এ শিল্পী যে রোমান্টিসিজমের কুসুমকলি ফুটিয়েছেন প্রাসাদের রমণীদের দেহবল্লরী এঁকে তা রিভেরাকে আকর্ষণ করল না। কিন্তু গয়্যার বিখ্যাত ‘৩ মে’ ছবিটি দেখে চৈতন্যে টান পড়ল তাঁর। দেশ ও দেশের জনতাকে ভালোবাসলে ছবি অন্য রকম হয়ে যায়; এই বোধিতে উত্তীর্ণ রিভেরা স্বভাবতই ভেবেছেন নিজের দেশের মানুষের দুর্দশার কথা। কিন্তু সময়ের মতোই শিল্প এক কুহক। তার শেষ ব্যাখ্যা বলে কিছু নেই। তাকে অনুভবে বুঝতে হয়; কিন্তু সেই বোঝায় মানুষের চলে না। মস্তিষ্ক হিসেব নিতে চায় চোখের পাঠের। ব্যক্তিগত প্রেমে-ঘৃণায়-বেদনায় আর স্বদেশের মানুষের কষ্টে কেঁদে প্রেতায়িত পরিমণ্ডলে ভৌতিক মানুষরূপী জীবের ছবি এঁকে গয়্যা নিজ অস্তিত্বের রূপক রচনা করেছেন। গয়্যার এই পর্বের ছবির নাম ‘ব্ল্যাক গয়্যা’। রিভেরা এই ছবির দিকে তাকিয়ে নিজের শিল্পভাবনার প্রসারতা বাড়ানোর সংকেত পেয়েছেন।
মাদ্রিদের উড়নচণ্ডী শিল্পী-সাহিত্যিক মহলে রামোন গোমেজকে সবাই খুব সমীহ করে। তাঁর মতো মাথা কারো নেই। বুদ্ধি দিয়ে চলেন এই তাত্ত্বিক। স্পেনের দাদাবাদী চিন্তাধারার শিল্পী-সাহিত্যিকদের তিনি বড় দাদা। একদিন তর্কপ্রিয় রিভেরার এই মানুষটির সঙ্গে দেখা হয়ে গেল। দুজনে জমল ভালো; শিল্প আসলে শক্তি, সুন্দরের ধাঁধা নয় – সত্যের বয়ান। দুজনের ভাবনা মিলে গেল। এই সম্পর্কের সুতার টানে রিভেরা বন্ধুত্বে জড়ালেন যে তরুণ শিল্পীদের সঙ্গে তাঁদের নাম পাবলো পিকাসো, হুয়ান গ্রিস, হুলিও গনজালেস।
স্পেনের বন্ধুদের কাছেই রিভেরা খবর পেলেন শিল্পের মাতাল ঘোরকে বোঝার জন্য যাঁরা জীবন পোড়াচ্ছেন তাঁরা থাকেন প্যারিসে। শান-শওকতের প্যারিস নয়। ফরাসি ছাড়াও অন্য দেশের বিবাগী, হাফগেরস্থ, প্রখরবুদ্ধিমার্গী সবাই মিলে মেধায় তাতিয়ে রেখেছে যে জায়গাটা তার নাম মোপারনাস। স্যেন নদীর পাড়ে এখানে আসর জমিয়ে সৃজনের উদ্দাম বেগকে সমবেতভাবে বুঝতে চেয়েছেন এই শিল্পীরা। যদিও ‘স্কুল অব প্যারিস’ বলে বিশ শতকের বিশের দশকের এই শিল্পীকুলকে নামাঙ্কিত করা হয়েছে, তবু ভাবনায়, ভাষায়, এমনকি কোনো আদর্শ লালনের প্রশ্নেও তাঁরা আলাদা। যাই হোক, অনেক ভালোবাসাবাসি হলো, অনেক তর্ক-বিতর্ক এবং হাতাহাতিও হয়ে গেল।
রিভেরার পরিচয় পেয়ে গেল ফ্রান্সের ‘আভোঁ গার্দ’ শিল্পীদল। মুখ ও কবজি দুটোতেই যে জোর আছে এই মেক্সিকানের তা সবাই টের পেল। বর্ণসংকর এই লাতিন আমেরিকান শিল্পীর দৈহিক কাঠামোও যে ঘটনা। বিশাল বপু, ছয় ফুটের ওপরে উচ্চতা, মুখমণ্ডলের ভেতর থেকে একটু বেশি বেরিয়ে আসা চোখদুটি দেখলে ব্যাঙের কথা মনে হয়, কিন্তু পুরো ঠোঁট দুটি যখন মৃদু হাসিতে উজ্জ্বল হয় তখন কারো কারো নির্বাণপ্রাপ্ত বুদ্ধমূর্তির কথাও মনে পড়ে যায়। গায়ে দীর্ঘ পাঞ্জাবির মতো জামা, মোটা কাপড়ের প্যান্ট আর খনিশ্রমিকদের জুতার মতো ভোঁতা ডিজাইনের জুতা আর মেক্সিকান বলেই টুপিটা যেন তাঁর ছাতার কথা মনে করিয়ে দেয়। যখন শুরু করেন তখন অবিরাম চালিয়ে যান
ঠাট্টা-মশকরা, বুদ্ধিদীপ্ত কথন আর সুন্দরী নারী যদি থাকে আড্ডায়, তবে চোখের তারা নাচিয়ে পুরুষের জাদুকরী ঝিলিকরশ্মিতে সেই সুন্দরের লক্ষ্যভেদ করেন। রুশ-বিপ্লব মন্ত্রে পূতপবিত্র কবি মায়াকোভস্কি যখন জানতে পেরেছিলেন যে এই শিল্পী মেক্সিকান কমিউনিস্ট পার্টির অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা সদস্য, তখন তাঁর সঙ্গে দেখা করার জন্য মেক্সিকো গিয়েছিলেন। রিভেরা কবিকে অভ্যর্থনা জানাতে রেলস্টেশনে এসেছিলেন। শিল্পীকে দেখা মাত্রই তাঁর বিশ্বাস করতে এতটুকু অসুবিধা হলো না যে আসলেই এই মেক্সিকান শুধু শিল্পী নন, সাম্যবাদী রাজনৈতিক আদর্শের লড়াকু সৈনিকও। দু-একদিন একসঙ্গে চলাফেরা করার পর কবি দেখলেন আদর্শের প্রশ্নে রিভেরা প্রতিপক্ষের সঙ্গে শুধু তর্কে গরম হন না, বিশাল মুষ্টিবদ্ধ হাত উঁচিয়ে তিনি জনতার শত্র“কে হুমকি দিতেও দ্বিধা বোধ করেন না। কিন্তু শিল্পী বলে কথা, আকাশের দিকে একটা পয়সা ছুড়ে দিয়ে তা মুহূর্তের মধ্যে পিস্তলের গুলিতে লক্ষ্যভেদ করে হো হো হাসতেন এই মেক্সিকান বিপ্লবী চিত্রকর। কবিবন্ধুর এই সার্কাসি তামাশা দেখে মায়াকোভস্কি বুঝতে পেরেছিলেন শিল্পীর কবজিতে শুধু ছবি আঁকার দক্ষতা নয়, শত্র“কে স্থির নিশানায় গুলিবিদ্ধ করার গেরিলা কৌশলও জানা আছে।
১৯০৯-এ রিভেরা গেলেন বেলজিয়ামে। ইচ্ছা তাঁর ওদেশের বিখ্যাত প্রতীকবাদী শিল্পীদের কাজ দেখা। ক্লাসিক বা ধ্র“পদী নিয়মের কাজ মকসো করার প্রতি বিশেষ আগ্রহ ছিল তাঁর। এখানে গ্রীষ্মের এক উষ্ণ বিকেলে তাঁর পরিচয় হয় এক রুশ কন্যার সঙ্গে। মেয়েটির লাবণ্য লজ্জায় লাল হলো রিভেরার চোখের দৃষ্টিতে। নাম তাঁর অ্যানজেলিনা বেলোভ। তারপর তাঁরা প্রেমিক-প্রেমিকা, একসঙ্গে প্যারিসে ফিরে আসা এবং সে যুগলের জীবন সুখে-দুঃখে টিকে ছিল বারো বছর।
বেলোভ সেন্ট পিটার্সবুর্গের বাসিন্দা। শিল্পকলার শিক্ষক। বেলজিয়াম এসেছিলেন উচ্চতর শিক্ষার জন্য। রিভেরার সাথী হয়ে তিনি শিল্পের উচ্চতর শিক্ষার গুরুত্ব একাডেমির চেয়েও নিবিড় পাঠে হৃদয়ঙ্গম করলেন। রিভেরার সঙ্গে তাঁর জীবন বোনা শুরু হলো। তাঁরা এলেন লন্ডনে। এখানে টার্নার, উইলিয়ম ব্লেক, হোগার্থের মতো বাঘা শিল্পীদের কাজ দেখে তাঁরা শিল্পরস পান করলেন। আসতে পথে উত্তর ফ্রান্সে আটলান্টিকের কাছে ফরাসি ব্রেতোঁ প্রদেশের গ্রামজীবন রিভেরাকে শিল্পরচনার তাগিদ দিলো। সতেরোশো শতকের বিখ্যাত ওলন্দাজ শিল্পীরীতিতে এখানকার কর্মজীবী নারীদের ছবি আঁকলেন শিল্পী। অনেক দিনের আশা ছিল প্যারিসের সোসাইটি অব ইনডিপেনডেন্ট আর্টিস্টের আয়োজনে তিনি প্রদর্শনী করবেন। সুযোগটা জোটে ১৯১০-এর গ্রীষ্মে। এ বছরই রিভেরার বৃত্তিকালীন সময় ফুরিয়ে গেল। ইউরোপীয় জীবনযাপনের অভিজ্ঞতায় যে শিল্প তিনি রচনা করেছিলেন তা দিয়ে এক প্রদর্শনী আয়োজনের ডাক পড়ল তাঁর স্পেনে। স্বদেশের সেই প্রথম জীবনে চিত্রবিদ্যা শিক্ষার প্রতিষ্ঠান ‘সান একাডেমি কারলোস’-এ রিভেরার প্রদর্শনীর উদ্বোধন হলো মেক্সিকোর স্বাধীনতার শতবর্ষপূর্তি উপলক্ষে। প্রেসিডেন্ট পরফিরিও দিয়াজের নির্দেশেই করা হয়েছিল এ আয়োজন। কিন্তু এর মধ্যেই নতুন বিপ্লবের আগুনে তাতিয়ে উঠল দেশ। দিয়াজকে ক্ষমতাচ্যুত করা হলো। কিন্তু রিভেরার প্রদর্শনী ব্যাপক সাড়া ফেলল শিল্পীমহলে। শিল্পবোদ্ধা ও শিল্পের সংগ্রাহকরাও তাঁর ছবির গুরুত্ব বুঝে তা কিনে নিজের শিল্পভাণ্ডার সমৃদ্ধ করার জন্য ব্যস্ত হয়ে উঠলেন। এ সময় রিভেরা নাকি কৃষক-বিপ্লবের নেতা গেরিলাযোদ্ধা এমিলিয়ানো জাপাটার হয়ে যুদ্ধেও যোগ দিয়েছিলেন; এমন কথাও শোনা যায়।
প্রদর্শনী সর্বার্থে সার্থক হয়েছিল। বান্ধবী বেলোভকে কণ্ঠলগ্ন করে পেটমোটা অর্থের থলি নিয়ে রিভেরা গেলেন স্পেনের তলেদো শহরে। তলেদো মানে এল গ্রেকোর ছবি দেখার শহর। এই স্প্যানিশ শিল্পী নীল রঙের গতিশীল ইমেজ এঁকে স্পেসের রহস্যকে নরম ভাষায় বুঝিয়েছেন। এল গ্রেকো দেখে রিভেরা অনুভব করলেন যে এখানেই লুকানো আছে নতুন শিল্পরচনার বীজ। বুঝে গেলেন তিনি এখানে আছে কিউবিজমের সূত্র।
১৯১২ থেকে ১৯২৬ পর্যন্ত বেলোভের সঙ্গে রিভেরা জীবনযাপন করেছেন প্যারিসের শিল্পীপাড়া মোপারনাসের ‘রু দু দেপার্ত’-এ। এখানে তাঁর ডাচ শিল্পী পিয়েট মন্ড্রিয়ানের সঙ্গে পরিচয় হয়। এই যোগাযোগে রিভেরা বুঝতে পারলেন যে স্পেসে ফর্মের খেলা এক অফুরন্ত জ্যামিতির চাল। নিরীক্ষানিষ্ঠ রিভেরা সেজানের কাজের প্রেমে পড়লেন। কেননা সেজানই তো কিউবিজমের আদিপিতা। প্রকৃতি আর কিছুই নয়, শুধু কোণ, সিলিন্ডার আর বৃত্তের সমীকরণ, এ কথা তাঁর আজও কেউ ভুল প্রমাণ করতে পারেননি। এই ভাবনারই বিস্তার ঘটিয়েছেন কিউবিস্ট শিল্পীরা। এ সময়ে প্যারিসে অবস্থানরত স্প্যানিশ হুয়ান গ্রিসের কাজ রিভেরাকে প্রভাবিত করে। রিভেরা ‘নাবিকের সকালের নাশতা’ নামে একটা কিউবিক ভাষার ছবি আঁকেন। এটি নির্মিত হয়েছে সিনথেটিক কিউবিজমের নিয়ম মেনে। এই কিউবিজম শুধু নানা বর্ণতলের বাঁধুনি নয়। নানা কোণ থেকে দেখে তবে সত্যকে আবিষ্কার করতে হয়। সত্য দ্বিমাত্রিক নয় – ত্রিমাত্রিক বা বহুমাত্রিক। একই বিষয়ের নানা কৌণিক পাঠে সত্য ক্রমে স্বচ্ছ হয়ে ওঠে। কিউবিজমের এই তত্ত্বকে আরো জাঁকাল ও সত্যের কাছাকাছি নিয়ে আসার জন্য শুধু রং দিয়ে বর্ণতল তৈরি না করে অন্য উপাদানও সেঁটে দেওয়া শুরু হয় ছবির জমিনে। রং ছাড়াও রিভেরা তাঁর ছবিটিতে বালি, সংবাদপত্রের টুকরো কাগজ এবং রঙের পুরো প্রলেপ দিয়ে সত্যকে শিল্পায়িত করেছেন। তাঁর এই সিনথেটিক কিউবিস্ট কাজটিতে একটি মানুষ টেবিলের সামনে বসে আছে। তার এক হাতে গ্লাস আর টেবিলে রাখা থালায় দুটি মাছ। মানুষটির মাথায় লাল টুপি আর তার নিচে লেখা ফরাসিতে ‘পাত্রি’ অর্থাৎ পিতৃভূমি। যদিও জ্যামিতিক বিন্যাসে সত্যকে জানান দেওয়া কিউবিজমের চরম কথা, তবু তা দেশকাল নিরপেক্ষ কোনো গণিতের সূত্র নয়। রিভেরার ছবিতে মাছ দুটির রূপায়ণ বলে দেয় তা কিউবিস্ট আদর্শের অনুসারী নয়, বরং তা লাতিন আমেরিকার লোককলার সঙ্গে সম্পর্কিত।
১৯১৫-তে রিভেরা কিউবিক ভাষায় আঁকলেন তাঁর দেশের বিপ্লবের মহানায়ক এমিলিয়ানো জাপাটাকে। এ ছবির সব অনুষঙ্গই মেক্সিকোর বিপ্লবের কথা বলে। মেক্সিকান টুপি, কাঁধে কম্বলের মতো চাদর, রাইফেল ইত্যাদিকে ভেঙে নতুন বিন্যাস দেওয়া হয়েছে এ ছবিতে। ছবির নাম রাখা হয়েছে ‘জাপাতিস্তা ল্যান্ডস্কেপ’।
প্রথম মহাযুদ্ধ চলছে। যুদ্ধ শুরুর দিন কয়েক আগে বান্ধবী বেলোভকে নিয়ে রিভেরা প্যারিস থেকে স্পেনে ঘুরে আসেন। কারণ সেখানে নিজের দেশের অনেক বিপ্লবী মানুষ দেশান্তরিত হয়ে চলে এসেছেন। স্বদেশের মানুষের কাছে দেশের খবর জানার জন্য সব সময়ই উদগ্রীব ছিলেন রিভেরা। তাঁর ভেতরে যে ইচ্ছেটা সব সময়ই গনগনে আগুনের মতো জ্বলেছে তা হলো সাধারণ খেটে খাওয়া মানুষ তাদের জমি ফিরে পাবেই। আর তা সম্ভব হচ্ছে জননায়ক জাপাটার ডাকে। মেক্সিকোর ঔপনিবেশিক তন্দ্রাজাল তিনি ছিঁড়ে ফেলেছেন। মানুষ জেগে উঠেছে। তাই জাপাটাকে বারবার শ্রদ্ধা জানিয়েছেন মেক্সিকোর এই বিপ্লবী শিল্পী।
রিভেরা ও বেলোভের পুত্রসন্তান জন্ম নিল। রিভেরার কিউবিক-জ্যামিতিতে ফুটল নতুন হাসির ঝিলিক। ছেলেকে স্তন দিচ্ছেন; এই আনত ভঙ্গির বেলোভের চিত্রায়নে কিউবিক গিঁটগুলো তেমন জটিল নয়। মা ও শিশুর আইকন এক সরল জ্যামিতিতে পাঠ করা যায়। তাঁর ছবির জ্যামিতি ললিত হলো বিষয়গুণে; এ কথা সত্য। তবে এ সময় গীতিময় কিউবিজম রচনার পেছনে কাজ করেছে প্রাচ্যশিল্পপ্রেমী মাতিসের সঙ্গে রিভেরার ঘনিষ্ঠতা। রিভেরার জীবনে এই সুখ দীর্ঘস্থায়ী হলো না। ছেলে দিগুয়েতা দুরারোগ্য ইনফ্লুয়েঞ্জায় ভুগে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ল। মাতিসীয় ললিত রেখায় ছেলের মুখটা এঁকে করুণ এলিজি রচনা করলেন শিল্পী। ছেড়ে দিলেন শিল্পী কিউবিজমের ব্যাকরণপাঠ।
কিন্তু কিউবিজম অধ্যয়ন ছেড়ে দেওয়ার কারণ তো আর ছেলের মৃত্যু হতে পারে না। এ সময় শিল্পী ও সমালোচকদের সঙ্গে তাঁর বিরোধ এমন ভয়ংকর রূপ নিল যে রিভেরা ভাবলেন কিউবিক সংঘই ছেড়ে দেবেন। একদিন নৈশভোজের অনুষ্ঠানে এক কাণ্ড ঘটল। শিল্পী ও তাত্ত্বিক লেয়ন রজেনবার্গ আয়োজন করেছিলেন এই রাতের আসরের। তরুণ তুর্কি শিল্পীরা সবাই এলেন পার্টিতে। কিউবিজমের প্রধান মুখপাত্র কবি গিয়োম আপোলিন্যার তখন যুদ্ধে। সময়টা ১৯১৭-র বসন্তকাল। আপোলিন্যার নেই; কবি পিয়ের রভেরদি তখন কিউবিজমের প্রধান তাত্ত্বিক। রিভেরা আর তাঁর বন্ধু অঁদ্রে লোতের কিউবিক শিল্পকর্মকে বিরূপ সমালোচনা করে রভেরদি একটি প্রবন্ধ লিখেছিলেন। মদের নেশায় আর বিতর্কের উন্মাদনায় রিভেরা আর রভেরদির মুষ্টি-লড়াইয়ে শেষ হলো সেই রাতের আসর। টুটে গেল বন্ধুত্বের সুতো। ভাঙল সংঘ। কিউবিজম ছাড়লেন রিভেরা। সম্পর্ক ছিন্ন হলো তাঁর এতদিনের ঘনিষ্ঠজন মেধাবী সখা পিকাসো, ব্রাক, হুয়াব গ্রিস, ফেরনেন্দ লেজের, সবার সঙ্গেই। রোজেনবার্গ কিনেছিলেন রিভেরার এ সময়ের সবচেয়ে বিখ্যাত ছবি ‘জাপাতিস্তা ল্যান্ডস্কেপ’; তাও চলে গেল লোকচক্ষুর আড়ালে। প্যারিসের শিল্পের ও শিল্পীদের ইতিহাসে এ ঘটনাকে তাত্ত্বিক অঁদ্রে সালামো ‘দ্য রিভেরা অ্যাফেয়ার’ বলে আখ্যা দিয়েছেন।
পল সেজানে আকৃষ্ট হয়ে রিভেরা ফিরে এলেন ফিগারেটিভ শিল্প-ভাষায়। সতেরোশো শতকের ডাচ মাস্টারদের স্টিললাইফ, ইনগ্রের ক্লাসিক নিয়ম, রেনোয়ার ইম্প্রেশনিস্ট নরম তুলি এবং অন্যদিকে ফবিস্টদের বর্ণের সংঘর্ষ সবই তিনি পরখ করে দেখতে শুরু করলেন। চিকিৎসক ও শিল্পসমালোচক এলি ফোরকে রিভেরার সৃজনশীলতা বিশেষ মুগ্ধতায় টানল। ১৯১৭-তে ‘লে কন্্স্তাকতুর’ নামে যে বিখ্যাত প্রদর্শনী হয়েছিল তা নিয়ে রিভেরার কাজকে গুরুত্ব দিয়ে এলি রচনা করেছিলেন প্রবন্ধ। বারো বছর পর এই সমালোচক স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে বলেছিলেন, ‘এক যুগ আগে প্যারিসে আমি এক শিল্পীর সাক্ষাৎ পেয়েছিলাম। তাঁর বুদ্ধিটা অতিপ্রাকৃত নিয়মের যেন। তিনি আমাকে তাঁর জন্মভূমি মেক্সিকোর অদ্ভুত সব গল্প শুনিয়েছিলেন। আমার মনে হয় সেই শিল্পীমানুষটি বড় মাপের একজন মিথলজিস্ট অথবা তিনি হয়তো মিথম্যানিয়াক।’
ফ্রান্সে তখন আলবের্তো পানি মেক্সিকোর রাষ্ট্রদূত। পানি নিজের ও তাঁর স্ত্রীর প্রতিকৃতি আঁকিয়েছিলেন রিভেরাকে দিয়ে। তাছাড়া শিল্পীর কয়েকটি ছবিও কিনেছিলেন রাষ্ট্রদূত। এদিকে রিভেরা চাচ্ছেন কী করে বড় মাপের ছবি এঁকে শিল্পীজীবনকে জনতাসম্পৃক্ত রাখা যায়। বিপ্লবী চৈতন্য তাঁর ভেতরে কেবলই ঘুরপাক খাচ্ছে। বন্ধু-সমালোচক এলি ফোর তাঁকে পরামর্শ দিলেন ইতালি গিয়ে ম্যুরাল (দেয়ালচিত্র) দেখার জন্য। সেখানে চার্চে, ক্যাথিড্রালে রেনেসাঁর গুরুশিল্পীরা হাজার হাজার ফুট দেয়াল ম্যুরাল দিয়ে ভরিয়ে রেখেছেন। বিষয় মূলত ধর্ম আশ্রয়ী হলেও তা জনতা প্রতিনিয়ত দেখে। দেখে তো তারা শুধু ধর্মীয় কারণে নয়, সেই সঙ্গে তারা শিল্পও পাঠ করছে। রিভেরা ভাবনায় স্থির হলেন; ইতালি তাঁকে যেতেই হবে। শরণাপন্ন হলেন রিভেরা রাষ্ট্রদূত আলবের্তো পানির। পানির বন্ধু মেক্সিকো সিটি য়ুনিভার্সিটির রেকটর হোসে ভাসকোসেলোজ। রেকটর বন্ধু পানির অনুরোধ রাখলেন। ইতালি ভ্রমণের একটা বৃত্তি জুটে গেল রিভেরার। ১৯২০ সালে ইতালি গিয়ে একটানা সতেরো মাস শিল্পী গভীর মনোযোগে পাঠ করেছেন বিখ্যাত সভ্যতার বিখ্যাত শিল্প। এট্রুসকান, বাইজেনটাইন আর রেনেসাঁর গুরুশিল্পীদের কাজ। ইতালির ত্রয়োদশ শতাব্দীর জত্তো থেকে শুরু করে চতুর্দশ শতাব্দীর মাসাচ্চো, উচ্চেল্লো, আর পিয়েরো দেল্লা ফ্রানসেস্কার কাজে বিপুল আকার মনুমেন্টাল মানুষ দেখে তিনি বুঝতে পারলেন বড় মাপের কাজ কী করে জনতার মনে প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করে। দেয়ালচিত্র বা ম্যুরালে দেশের ইতিহাস, ঐতিহ্য, সংস্কৃতি রূপায়িত করলে মানুষের মনে জাগ্রত হবে দেশবোধ এবং বিপ্লবের পথ হবে সুগম; এই ভাবনার আলোড়নকে অদূর ভবিষ্যতেই রিভেরা শিল্পরূপ দিলেন দেশে ও বিদেশে – জনতার বিপ্লব ও উদ্ভাবনপ্রিয় বিচিত্র পেশার মানুষের নানা কীর্তি সম্প্রচারের লক্ষ্যে।
১৯২০ সালে আলভারো ওবরেগন মেক্সিকোর প্রেসিডেন্ট হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণ করেন। শিল্পপ্রিয় রেকটর ভাসকোনসেলোজের কর্মদক্ষতার সুনাম ছিল। তাই প্রেসিডেন্ট ওবরেগন রেকটরকে দায়িত্ব দিলেন শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের। শিক্ষামন্ত্রী হয়ে ভাসকোনসেলোজ যে পরিকল্পনাগুলো হাতে নিয়েছিলেন তার মধ্যে অন্যতম গণশিক্ষার প্রসার। আর গণশিক্ষা হবে এমন যাতে জনতা দেশের ইতিহাস পাঠ করে নিজের জীবনের উন্নতি ঘটাতে পারে। এ প্রসঙ্গে পাবলিক আর্ট বা জনশিল্প হতে পারে মোক্ষম অস্ত্র। ছবি পাঠ করে যদি সেই উজ্জীবনের পাঠ নেওয়া যায় তাহলে তো সোনায় সোহাগা। শিক্ষায় ও শিল্পে একই সঙ্গে দীক্ষিত করা গেল জনতাকে। শিক্ষামন্ত্রী উদ্যোগ নিলেন বড় বড় ভবনের দেয়ালে ম্যুরাল চিত্র রচনা করানোর।
এদিকে জনতার ডাক শুনতে পাচ্ছেন রিভেরাও। খবর পেলেন দেশে পাবলিক আর্টের মহাপরিকল্পনা হয়েছে। কিন্তু ইতোমধ্যে ব্যক্তিজীবনে জটিলতার জালে আরো কঠিন গিঁট লেগেছে। অ্যানজেলিনা বেলোভের পর আবারো জড়িয়েছেন আরেক রুশ সুন্দরীর প্রেমজালে। এই রুশিনীর নাম মারেভনা। রিভেরা আর মারেভনার মিলনে ভূমিষ্ঠ হয়েছে দেবশিশুর মতো কন্যাসন্তান। আদর করে মাতা মেরির নামের এই ছোট্ট সংস্করণের নাম রাখা হলো মারিকা। কিন্তু নারী, প্রেম, শিশু সব ছেড়ে জনতা ও রাজনীতি হয়ে উঠল রিভেরার প্রধান ধ্যান। ১৯২১-এর মার্চের শেষে ইতালি থেকে ফ্রান্সে ফেরার কিছুদিন পর স্বদেশের উদ্দেশে চিরদিনের জন্য ইউরোপ ছাড়লেন দিয়েগো রিভেরা। তারপর, বেলোভ, মারেভনা ও মারিকার জন্য মেক্সিকো থেকে যথাসম্ভব অর্থ জোগান দিয়ে তিনি এক ধরনের দায়িত্ব পালন করেছেন মাত্র।
ইতালিতে সতেরো মাস অনুশীলনের পর স্বদেশ মেক্সিকোতে ফিরে রিভেরা নতুন জন্ম লাভ করলেন। স্বদেশ যেন এতদিন তাঁর অপেক্ষারই প্রহর গুনেছে। শিল্পীও যেন হঠাৎ করে স্বদেশে এসে স্মৃতি আপ্লুত মনে কেঁদে উঠেছেন। তাঁর মনে হতে লাগল, চারদিকে শুধু নতুন শিল্পভাবনার বীজ অঙ্কুরিত হচ্ছে। সব দিকে কেবলই নতুনত্বের সম্ভাবনা। নতুন নন্দনতত্ত্ব তাঁকে আক্রান্ত করছে। জনতার ভিড়ে, সৈনিকের কুচকাওয়াজে, বাজারে, মাঠে, ঘাটে, উৎসবে, আর শ্রমিকের সমবেত কর্মনিষ্ঠায় – সব জায়গায় যেন মাস্টারপিস জন্ম নেওয়ার সম্ভাবনা উপচে পড়ছে। ‘আমি বিস্ময়ের তুলি-কলমে আঁকছি স্বদেশ ও জনতা। আমি ইউরোপে এতদিন পীড়নে পিষ্ট হয়েছি। এখন আমার সব মোহ, দ্বিধা-দ্বন্দ্ব কেটে গেছে। এখন আমি কী সহজেই না সব অনুভব করি, আঁকি। শ্বাস-প্রশ্বাসের মতো স্বতঃস্ফূর্ত আবেগে কথা বলার মতো বা উষ্ণতায় ঘেমে ওঠার মতোই সরল স্বাভাবিক নিয়মে এখানে এখন আমার ভাবনা বুনতে পারছি। দীর্ঘ পঁয়ত্রিশ বছরের যাতনা সহ্য করে হঠাৎ শিশুজন্মের মতোই আমি আমার শৈলী নিয়ে নতুন জন্ম লাভ করলাম।’ এসব কথা রিভেরা শেষ জীবনে স্মৃতিচারণায় বিশেষ আবেগে বিশদ বিবরণে লিখে গেছেন।
সাংস্কৃতিক সংস্কারের ঘোষণা দিলেন শিক্ষামন্ত্রী হোসে ভাসকোনসেলোজ। দশ বছরের রক্তক্ষয়ী গৃহযুদ্ধের পর মেক্সিকো এখনো তার সঠিক পথ খুঁজে পায়নি। তার দরকার এখন যথার্থ মেক্সিকান আদর্শের অনুসন্ধান ও ব্যাপ্ত মানবতাবোধ। নানা জাতের মানুষের মধ্যে প্রতিষ্ঠিত করতে হবে সৌহার্দ্য। ধর্ম, জাতি, গোষ্ঠী নির্বিশেষে চাই এখন বৈষম্যহীনতা ও সমতা। স্পেনীয় খ্রিষ্টধর্মাবলম্বী প্রভুরা শত শত বছর ভূমিপুত্র ইন্ডিয়ানদের তাদের জমি থেকে উৎখাত করেছে, ধর্ষিত হয়েছে তাদের জন্মদাত্রী ধরিত্রীমাতা। তাই এই সংস্কারের মধ্য দিয়ে অবসান ঘটবে ক্ষমতার অপব্যবহারের। ইন্ডিয়ানরা ফিরে পাবে তাদের ভূমির অধিকার এবং যাপন করবে স্বাধীন জীবন। কোনো বিদ্বেষ নয়; তবে মনোজগৎ থেকে মুছে ফেলতে হবে সব ধরনের ঔপনিবেশিক ভাবনা এবং উনিশ শতকের ইউরোপীয় সংস্কৃতির মতো শিল্প ও জীবনচর্চা। ভাসকোনসেলোজ গণশিল্পের মাধ্যমে মেক্সিকান আদর্শে জনতাকে উদ্বুদ্ধ রাখার জন্য শিল্পীসমাজকে সজাগ হওয়ার আহ্বান জানালেন।
১৯২১-এর নভেম্বর মাস। শিল্পী ও বুদ্ধিজীবী দলের সফরসঙ্গী হলেন শিক্ষামন্ত্রী ভাসকোনসেলোজও। রিভেরাদের মন্ত্রী অনুরোধ জানালেন মেক্সিকোর প্রাচীন কীর্তির সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ নিদর্শনস্থল ‘চিচেন ইতজা’ ও ‘উজমাল’ দেখার জন্য। শিল্পপ্রিয়, জনতাপ্রিয় মন্ত্রীর ভাবনায় ছিল এই যে যাঁরা ভবিষ্যতে শিল্পরচনা করতে যাচ্ছেন তাঁদের ভিত্তি যেন হয় এইসব ঐতিহ্যিক পুরাকীর্তি। কেননা এখানেই মেক্সিকোর সভ্যতার আদর্শ সবচেয়ে বেশি তীব্রতায় শিল্পরূপ পেয়েছে। জনতা যে পুরাকীর্তির সঙ্গে বসবাস করে সেখান থেকেই জন্ম নেবে মেক্সিকোর নতুন শিল্প। রাষ্ট্রের এই ভাবনায় সহৃদয় সায় ছিল সব পক্ষের। যে শিল্পীরা দেশে থেকে শিক্ষা নিয়েছেন এবং যাঁরা ইউরোপ থেকে শিক্ষা নিয়ে এসেছেন, সবাই এক কাতারে দাঁড়িয়ে গেলেন জনতার শিল্প নির্মাণের জন্য।
রাষ্ট্র বলল, দেয়ালচিত্র এঁকে জনতা আর শিল্পকে মুখোমুখি করাতে হবে। রিভেরা দায়িত্ব পেলেন ন্যাশনাল প্রিপারেটরি স্কুলের দেয়ালে ম্যুরাল নির্মাণের। তাঁর এই ম্যুরালকেই ভাবা হয় মেক্সিকোর আধুনিককালের রেনেসাঁর পূর্বরাগ – নতুন শিল্পসৃজনের পরশপাথর। দেশে ফিরে রিভেরা মেক্সিকোর মানুষের প্রাত্যহিক জীবনের কর্মকাণ্ড চিত্রিত শুরু করেন ইজেল পেইন্টিংয়ে। নানা পেশায় নিয়োজিত মানুষ ছিল তাঁর ছবির কেন্দ্রে। ইতালীয় রেনেসাঁশিল্পীদের মতো চারকোলের ড্রইং টেনে তারপর রং চাপাতেন। এবার প্রিপারেটরি স্কুলের কাজে স্পেস হিসেবে বেছে নিলেন বলিভার অ্যাম্ফিথিয়েটারের দেয়াল। অন্য শিল্পীরা কাজ করলেন স্কুলের ভেতরের দেয়ালে; কিন্তু রিভেরার পছন্দ বাইরের দেয়াল। কারণ তা সরাসরি দর্শকের কাছে উন্মুক্ত। ফ্রেসকো পদ্ধতিতে করা একশ বর্গমিটার কাজটির নাম রাখলেন শিল্পী ‘সৃষ্টি’। এই কাজে খ্রিষ্টীয় পুরাণের পাশাপাশি ইউরোপীয় মানুষের জীবনধারা চিত্রায়িত হয়েছে। তবে উজ্জ্বল রং আর দেহগত কাঠামো প্রমাণ করে যে, পৃথিবী সৃষ্টির খ্রিষ্টীয় হিসাবটা এখানে মেক্সিকান সংস্করণ লাভ করেছে এই শিল্পীর হাতে। মাইকেলেঞ্জেলোর সিস্টেন চ্যাপেলের ঈশ্বর যেভাবে মানুষ সৃষ্টি করেছেন তেমন নয়, এক বিপুল মানুষ উত্থিত হচ্ছে মেক্সিকোর সবুজ ভুট্টার বাগান থেকে। এই মানুষের আশপাশে অন্যান্য ঘটনার বিবরণ। কেউ গান করছে, কেউ বা স্তব্ধ হয়ে ঈশ্বরের প্রতি প্রার্থনা জানাচ্ছে। কিন্তু মানুষেরা বিভিন্ন রঙের ও গড়নের। জাতি, ধর্ম ও বর্ণের সহাবস্থানের রূপক রচনা করেছেন রিভেরা – খ্রিষ্টধর্মের মাহাত্ম্য প্রচার করেননি। রিভেরা নিজে বলেছেন, ‘এই ম্যুরালে বিজ্ঞান ও শিল্পকলার উৎস ও মানব ইতিহাসের সারসংক্ষেপ রূপকে প্রকাশ পেয়েছে।’
১৯২২-এর মার্চ মাসে ভাসকোনসেলোজ ঘোষণা দিলেন যে, এবার মেক্সিকোর ম্যুরালশিল্পের মহাপরিকল্পনা নেওয়া হয়েছে। শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের এক হাজার ছয়শো বর্গফুট দেয়ালে ম্যুরাল নির্মাণ করতে হবে। রিভেরা দীর্ঘ চার বছর একাগ্র মনোযোগে কাজ করে এই শিল্প সৃষ্টির কাজ সম্পন্ন করেন। তাঁর এই কাজের নাম ‘মেক্সিকান জনগণের রাজনৈতিক দৃষ্টি’। এখানে রিভেরা [রেড] ইন্ডিয়ানদের নান্দনিক ভাবনা সংযুক্ত করেছেন। তাঁর ছবি যদিও ইতালীয় রেনেসাঁ শিল্পভাষার সঙ্গে সাযুজ্য রেখে রূপায়িত হয়, তবু মেক্সিকোর লোকশিল্পের সরল রূপ আর উজ্জ্বল বর্ণের প্রয়োগে নাকচ হয়ে যায় রেনেসাঁর নিয়ম। ‘খনিশ্রমিক’, ‘ভুট্টা উৎসব’, আখমাড়াইয়ের কলের শ্রমিক, তাঁত-বোনারত মানুষ, ফলবিক্রেতা নারী এসবই স্পষ্ট ফর্মে ও অমিশ্র রঙে সরল বিবরণে উপস্থাপন করেছেন বিভেরা তাঁর ম্যুরালের বিভিন্ন প্যানেলে।
এরই মধ্যে রিভেরা আবার জীবন জড়িয়েছেন এক নারীর সঙ্গে। এই নারী রিভেরার মডেল। লুপে মারিন নামের প্রেমিকার সঙ্গে একই ছাদের নিচে কিছুদিন বসবাস করার পর সিদ্ধান্ত হলো যে তাঁরা বিয়ে করবেন। তাঁদের বিবাহিত জীবনে দুই কন্যা জন্ম নেয়। একজনের নাম গুয়াদালুপ, অন্যটির নাম রুথ।
সৃজনশীলতার মধ্য দিয়েই মানুষ পৃথিবীর পালাবদল ঘটায় এবং উজ্জ্বলতর ভবিষ্যৎ অর্থাৎ জীবনের সুখ কায়েম করতে পারে। এই ভাবনাকে অনেকেই বলেছেন ইউটোপিয়া বা স্বপ্নবিলাস। তবে রিভেরার ম্যুরালের দিকে তাকালে বোঝা যায় জীবনের সংগ্রামী অভিব্যক্তিতে কী বিপুল আশাবাদিতা ফলিয়েছেন তিনি।
মার্ক্সীয় দর্শনে রিভেরা বিশ্বাস করতেন এবং নামও লিখিয়েছিলেন পার্টিতে সদস্য হিসেবে। যদিও তাঁর জীবনী-লেখকেরা জানিয়েছেন যে, রিভেরা মার্ক্সের লেখা আদৌ পাঠ করেননি। কিন্তু মার্ক্সীয় দর্শন তো বিপ্লবীদের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ যোগাযোগের সুবাদে এবং দূরগামী শিল্পদৃষ্টির কারণেও অর্জিত হতে পারে। তাই অনেক তাত্ত্বিক এরকমও ভেবেছেন। আর রিভেরা-ঘনিষ্ঠ দর্শকমাত্রই জানেন যে, লাতিন আমেরিকার খেটে খাওয়া মানুষ এবং তাদের পূর্বপুরুষের ঐতিহ্যকে কী গভীর শ্রদ্ধা জানিয়েছেন শিল্পী তাঁর কাজে। মেক্সিকোর বিখ্যাত সংগঠন ‘রেভোলিওশনারি ইউনিয়ন অব টেকনিকাল ওয়ারকারস, পেইন্টারস অ্যান্ড স্কাল্পচারস’-এর প্রতিষ্ঠাতাদেরই একজন রিভেরা। কোনো তত্ত্বনির্ভরতা যদিও তাঁর স্বভাবের বৈশিষ্ট্য নয়, তবু সেই সংগঠন একান্তভাবে মার্ক্সীয় তত্ত্বের অনুসারী ছিল। তাছাড়া শিল্পী আর মজুরের একতার মধ্য দিয়েই মুক্তি আসবে জনতার, – যাঁরা এই আদর্শে অনড় ছিলেন তাঁদেরই অন্যতম প্রবক্তা রিভেরা। তবে এই ভাবনাকে ইশতেহারে রূপ দিয়েছিলেন মেক্সিকোর আরেক বিখ্যাত ম্যুরালশিল্পী; নাম তাঁর আলফারো সিকেইরেজ। পরে যুক্ত হয়েছিলেন হোসে ক্লেমেনতে ওরোসকো। রিভেরা-সিকেইরেজ-ওরোসকো – এই ত্রিমূর্তি বিপ্লবী শিল্পীদলের একতার প্রতীক হয়ে উঠেছিল শুধু মেক্সিকানদের কাছে নয়, লাতিন আমেরিকার মুক্তিকামী আরো অনেক দেশের জনগণের কাছে এই তিন ম্যুরালিস্টের কাজ ছিল বিপ্লবী প্রেরণার অফুরান উৎস। যা-ই হোক, মার্ক্সের তত্ত্ব পড়–ন, আর না-ই পড়–ন, রিভেরা ১৯২২ সালের শেষে মেক্সিকান কমিউনিস্ট পার্টিতে যোগ দেন। পার্টির শুধু সদস্য হলেন না শিল্পী, সিকেইরেজ ও জাভিয়ের গেররেরোকে নিয়ে গঠন করলেন পার্টির কার্যনির্বাহী কমিটি। এ সময় রিভেরা সত্যিই কমিউনিস্ট নিষ্ঠায় পার্টির দায়িত্ব পালন করেছেন। শ্রমিকশ্রেণি ও লোকশিল্পীরা কী করে তাদের যথার্থ মজুরি পাবে তা নিয়েও তিনি নীতিমালা প্রণয়ন করেন।
পার্টির সিদ্ধান্ত হয়েছিল, রিভেরা দৈনিক ভাতা পাবেন দুই ডলার। এত অল্প অর্থে তাঁর সংসার চালানো কঠিন হয়ে পড়ে। তাই শিল্পী ড্রইং, জলরঙের ছবি এবং পেইন্টিংও বিক্রি শুরু করলেন। খুব দ্রুত আঁকার দক্ষতা ছিল বলে আর্থিক অনটনে পড়তে হয়নি। তাঁর ছবির সংগ্রাহকদের বেশিরভাগই ছিল ট্যুরিস্ট – উত্তর আমেরিকার ধনবান পর্যটক। রিভেরা এ সময় ইন্ডিয়ানদের জীবন-জীবিকার চিত্র অবিরাম এঁকেছেন। যুক্তরাষ্ট্রের সংগ্রহশালায় আজ প্রচুর পরিমাণে যে শিল্পীর কাজ প্রদর্শিত হয় তার বেশিরভাগই ওই পর্যটকদের সংগ্রহ।
১৯২৪ সালে সংস্কারপন্থীরা ওবরেগন সরকারের বিরুদ্ধে আন্দোলনের ডাক দেয়। তাদের দাবির মধ্যে ছিল এত অর্থ ব্যয়ে ম্যুরাল আঁকা বন্ধ করতে হবে। তবে আদর্শগত দ্বন্দ্বটাই ছিল আসল। সংস্কারপন্থীরা বিপ্লবী রাজনৈতিক চেতনাকে মেনে নিতে চায়নি। আন্দোলন সহিংসতায় রূপ নিল। প্রিপারেটরি স্কুলের দেয়ালে নির্মিত সিকেইরেজ ও ওরোসকোর ম্যুরালে আক্রমণ হলো। অনেক বিপ্লবীর সঙ্গে শিল্পীরাও খুঁজলেন নিরাপদ আশ্রয়। মেক্সিকো-সিটি ছেড়ে অন্য প্রদেশে গিয়ে জীবিকার সন্ধান করলেন ওরোসকো। শিক্ষামন্ত্রী ভাসকোনসেলোজ এ ঘটনার তীব্র নিন্দা জানিয়ে চাকরি থেকে অব্যাহতি নিলেন। নাজুক ওবরেগন সরকার উপায়ান্তর না দেখে সমস্ত সরকারি ম্যুরাল পরিকল্পনা বাতিল বলে ঘোষণা দিলেন।
শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের বিশাল দেয়ালচিত্রের একটি প্যানেলের নাম ‘অস্ত্রাগার’। ম্যুরালের এই খণ্ডে রিভেরা বন্ধুদের এঁকেছেন। ছবিটির উপরিভাগে অবস্থান করছেন কিউবার দুঃশাসকের বন্দুকের গুলি এড়িয়ে মেক্সিকোতে রাজনৈতিক আশ্রয় নেওয়া কমিউনিস্ট নেতা হুলিও আন্তোনিও মেইয়া। বন্ধু সিকেইরেজ ছাড়াও আছেন আরো কয়েকজন কমরেড। মেক্সিকোর রাজনৈতিক পট পরিবর্তনের পর মেইয়াকে অবশ্য কমরেডরা সুরক্ষা দিতে পারেননি। কিউবার একনায়ক জেরারদো মাচাদোর চর মেক্সিকোর রাস্তায় রাতের অন্ধকারে তাঁকে হত্যা করে। কিন্তু ম্যুরালের মাঝখানে গোলাপি শার্ট গায়ে মেয়েটি কে! জোড়াভ্রƒ সুন্দরীর নাম আজ রিভেরার চেয়েও বেশি কীর্তিত হচ্ছে। অবশ্য তা তাঁর দৈহিক সুন্দরের জন্য নয়; তাঁর বিপ্লবী ভাবনা, কমিউনিস্ট পার্টিতে যোগদান, রিভেরার সঙ্গে দুবার বিয়ের সম্পর্কে জড়ানো এবং সর্বোপরি তাঁর সৃষ্টি অর্থাৎ তাঁর চিত্রকলাই তাঁকে অমরত্বের আলোর মালা পরিয়েছে। এই বিপ্লবী শিল্পীর নাম ফ্রিদা কাহ্লো। ওই ম্যুরালের কেন্দ্রীয় চরিত্র ফ্রিদা কাহ্লো। তাঁর কমলা রং জামার ওপর সুতোয় বোনা লাল টকটকে তারকা – কমিউনিস্ট প্রতীক। ফ্রিদা অন্য কমরেডদের হাতে তুলে দিচ্ছেন রাইফেল ও বেয়নেট।
তিনা মোদোত্তি ছিলেন বিপ্লবী মেইয়ার বন্ধু। দুই পরিচয়ে তিনি খ্যাতি অর্জন করেছিলেন : এক. প্রলেতারিয়েতের রাজনীতিতে তাঁর আত্মোৎসর্গের প্রতিজ্ঞা আর তিনি ছিলেন বড়মাপের ফটোগ্রাফার। তিনা ইতালীয় বংশোদ্ভূত আমেরিকান। তাঁর যোগাযোগ ছিল সোভিয়েত ইউনিয়নের নেতাদের সঙ্গে এবং স্পেনের গৃহযুদ্ধেও তিনি বিপ্লবীদের কাঁধে কাঁধ মিলিয়েছেন লড়াইয়ের জন্য। ১৯২৩ সালে আমেরিকার বিখ্যাত ফটোগ্রাফার এডওয়ার্ড ওয়েস্টনকে তিনা মেক্সিকো নিয়ে এলেন। শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে রিভেরার ম্যুরাল দেখে তিনি বিস্মিত হন। দেশে ফিরে পরবর্তী সময়ে ওয়েস্টন তাঁর ডাইরিতে এই ম্যুরাল দেখার অভিজ্ঞতা বিস্তারিতভাবে বর্ণনা করেন। তাঁর মনে হয়েছিল, শিল্পকলার এক নতুন পৃথিবী তিনি পাঠ করছেন। এখানে গণমানুষকে ভালোবেসে শিল্প সৃষ্টি হচ্ছে। ধনাঢ্য বা অভিজাতবর্গের সঙ্গে এই শিল্পী ও শিল্পের কোনো সম্পর্ক নেই। জনতাই যে সভ্যতার নায়ক তা এমন চিত্রল ভাষায় কোথায়ই বা আর ব্যাখ্যা পেয়েছে! বিপ্লবী আর শিল্পী এখানে এক সূত্রে গাঁথা। এখানে নেই ইউরোপের মতো সাঁলো বা গ্যালারির নিয়মকানুন। এই ম্যুরালের শিল্পীকে দেশের মানুষ সগর্বে নাম দিয়েছেন : ‘মেক্সিকোর লেনিন’। এর চেয়ে বড় অর্জন আর কী হতে পারে একজন শিল্পীর জীবনে!
রিভেরার কোমরে বাঁধা থাকত ছয় গুলির রিভলবার। প্রয়োজনে তিনি তা গণশত্র“দের দিকে তাক করে হুমকি দিতেন। অন্যদিকে তাঁর কূটনৈতিক ধীও কম ছিল না। ওবরেগন সরকার বিদায় নিলে নিজের অপছন্দের সরকারের সঙ্গেও তিনি ম্যুরাল করার চুক্তি সম্পন্ন করেন। জাতীয় কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের দেয়ালে বিশাল মাতৃমূর্তি ও আরো অনেক কৃষি ও শ্রমজীবী মানুষের সমবায়ী সম্পর্ক আঁকলেন তিনি। ‘মুক্ত পৃথিবী’, ‘পৃথিবীর গান’ – এসব শিরোনাম দেওয়া হলো বিভিন্ন প্যানেলের।
মেক্সিকোতে গির্জার এক বিশেষ রূপ আছে। নাজারিন সম্প্রদায়ের আদর্শের সঙ্গে যোগ রেখে নির্মিত গির্জাগুলোতে ইউরোপীয় স্থাপত্যের তেমন প্রভাব নেই। এগুলো দেশের প্রাচীন যুগের ঘরবাড়ির মতো। আজটেক টেম্পল-পিরামিডের পাশে চাপিনগো চ্যাপেলের দেয়ালে রিভেরা সৃষ্টি করলেন ‘সামাজিক-বিপ্লব’ নামের ম্যুরাল। এই চ্যাপেলের কাজকে এখন তুলনা করা হয় মাইকেলেঞ্জেলোর সিস্টেন চ্যাপেলের সঙ্গে। সমালোচক ও তাত্ত্বিকদের বিচারে চাপিনগো চ্যাপেলের শিল্পকর্ম শিল্পীর শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের কাজের মতোই উঁচু শিল্পমানের।
প্রিপারেটরি স্কুলে রিভেরা যখন ম্যুরালের কাজে ব্যস্ত তখন বান্ধবীদের নিয়ে ফ্রিদা কাহ্লো তা দেখতে আসতেন। মানুষটি দেখতে আদৌ সুন্দর নয়। বিশাল দেহ; কিন্তু মজুরের মতো মোটা আঙুলগুলো কী নিপুণভাবে গড়ে চলেছে শিল্প। সুন্দরী বালিকার জোড়াভ্রƒ প্রজাপতি হয়ে বিস্ময়ের বেগে কপালে উঠে গেল। সেই থেকে রিভেরা তাঁকে চৌম্বক-আকর্ষণে টানতে থাকে। কন্যা তার বাসনার কথা জার্মান বংশোদ্ভূত বাবাকে জানালে উত্তরে শুনতে হলো, ‘হা ঈশ্বর! পরীর সঙ্গে দৈত্যের বিয়ে!’ কিন্তু প্রেম ও শিল্পসৃজনের রহস্যের টানে আগ্নেয় রিভেরার দিকেই এগিয়ে গেল জোনাকি। ইতোমধ্যে রিভেরার সঙ্গে লুপে মারিনের বিবাহ-বিচ্ছেদ হয়ে গেছে। মাঝে তিনা মোদোত্তির সঙ্গেও প্রেমজালে জড়িয়েছেন শিল্পী। এবার তাঁর চেয়ে বয়সে একুশ বছরের ছোট নবযুবতীর সঙ্গে তিনি প্রেমের ও বিপ্লবের শর্তে সম্পর্ক বাঁধলেন।
১৯২৯-এর ২১ আগস্ট দিয়েগো রিভেরা ও ফ্রিদা কাহ্লো আনুষ্ঠানিক আয়োজনে পরস্পরকে বিয়ের সম্পর্কে বাঁধেন। ১৯৫৪ সালে ফ্রিদার মৃত্যু পর্যন্ত দৈত্য ও পরীর জীবন প্রেমে, শিল্প-সৃষ্টিতে ও বৈপ্লবিক কর্মকাণ্ডের মধ্য দিয়ে বিচিত্র কক্ষপথে সমান্তরালে চলেছে।
সড়ক দুর্ঘটনায় পঙ্গু হয়ে গেলেও ফ্রিদা জনতার বিপ্লবে সমর্থন জুগিয়েছেন, থেকেছেন রিভেরার প্রেমলগ্ন আর মৃত্যুশয্যায় শুয়েও শিল্পরচনা করে জয় করেছেন পঙ্গুত্ব – রেখে গেছেন মৃত্যুঞ্জয়ী সৃষ্টি।
রিভেরাকে শেষাবধি কেউ বুঝে উঠতে পারেননি। ফ্রিদার সঙ্গে বিয়ের সম্পর্কে জড়ানোর বছরেই অ্যাকাডেমি অব ফাইন আর্টসের পরিচালকের দায়িত্ব পান শিল্পী। চারুকলার শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানকে কর্মশালা বানিয়ে শিল্পীদের মজুরের মতো অক্লান্ত শ্রমে কাজ করার প্রণোদনা দিয়েছিলেন পরিচালক রিভেরা। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানকে তিনি কি খামারবাড়ি মনে করেন! বিস্মিত হলেন অন্য সংস্কারাচ্ছন্ন কর্তাব্যক্তিরা। অনেক তর্ক-বিতর্কের পর রিভেরা পরিচালক পদে পদাঘাত করে চলে এলেন।
এদিকে পার্টির লোকও তাঁকে পছন্দ করছে না। কেউ ভাবছে রিভেরা সুবিধাবাদী, কারো ভাবনা তাঁর ব্যক্তিগত জীবন নিয়ে। কিন্তু রাজনীতির প্রশ্নে বিপ্লবী শিল্পী কোনো আপসকামিতা প্রশ্রয় দিতে প্রস্তুত নন। যে সরকারের আমলেই রাষ্ট্রের পৃষ্ঠপোষকতায় তিনি ম্যুরাল সৃষ্টি করে থাকুন না কেন, জনতার রাজনীতি ও দেশের ইতিহাস ও ঐতিহ্যের প্রতি ছিলেন তিনি একনিষ্ঠভাবে সচেতন। তাঁর শিল্প তো কোথাও আদর্শচ্যুত হয়নি। রাজনীতিতে তো তিনি সবার চেয়ে লড়াকু। আর ব্যক্তিজীবন! তা তো নদীর মতো; কখন কোন ভূমির ঘ্রাণ তাকে কোথায় নিয়ে যাবে তা কে জানে। স্ট্যালিনের রূঢ় নীতি অনুসরণ করার জন্য কমিউনিস্ট পার্টি তাঁকে সবসময়ই সমালোচনা করেছে। রিভেরার রাজনীতিই সঠিক ছিল, ইতিহাস তা আজ সাক্ষ্য দিচ্ছে এই নব্য উপনিবেশবাদের কালে।
মেক্সিকোর ন্যাশনাল প্যালেসে ম্যুরাল করার সময় রিভেরার বন্ধুত্ব হয় যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রদূত ডি ডব্লিউ মরোর সঙ্গে। মরো শিল্পীর কাজের সমঝদার ছিলেন। তিনি রিভেরাকে করতেস প্যালেসে একটি ম্যুরাল তৈরির প্রস্তাব করেন। চুক্তি হয় মরো বারো হাজার ডলার দেবেন রিভেরাকে। তাছাড়া কাজ শেষে রিভেরাকে যুক্তরাষ্ট্র ভ্রমণের ব্যবস্থা করে দেবেন এবং এ ভ্রমণেরও সব আর্থিক সহায়তা রিভেরা পাবেন মরোর কাছ থেকে। আমেরিকার রাষ্ট্রদূতের সঙ্গে রিভেরার এই চুক্তি মেক্সিকোর কমিউনিস্ট পার্টি অফিসে বিতর্কের ঝড় তুলল। পার্টির সদস্যরা অনেকদিন ধরেই প্রতিক্রিয়াশীল চক্রের সঙ্গে হাত মিলিয়ে রিভেরার ম্যুরাল তৈরির বিষয়টি ঘৃণার চোখে দেখে আসছিলেন। এবার তাঁদের ঘৃণার আগুনে যেন ঘি ঢেলে দেওয়া হলো। সবাই বলতে শুরু করল, ‘রিভেরা কোটিপতি মরোর ও উপনিবেশবাদী উত্তর আমেরিকার চর।’ কিন্তু রিভেরা কোনোকিছুই গ্রাহ্য করলেন না। ফ্রিদাকে নিয়ে তিনি সান ফ্রানসিসকোর উদ্দেশে জাহাজে চড়লেন।
চার
মেক্সিকোর ম্যুরালশিল্পীদের শিল্পকর্মের মাহাত্ম্য ব্যাপক প্রচার ও প্রশংসা কুড়ায় উত্তর আমেরিকা ও ইউরোপে। নতুন শিল্প দেখতে হলে সবাই চলো মেক্সিকো – এই আওয়াজ উঠল শিল্পরসিক মহলে। হাজার হাজার পর্যটক এই শিল্পতীর্থের দিকে ধাবিত হলেন। রিভেরা-সিকেইরেজ-ওরোসকো – এই ত্রিমূর্তি লাভ করলেন লাখো ভক্তের প্রণাম। এই জীবন্ত কিংবদন্তি শিল্পী দলের প্রধান নায়ক রিভেরা এসেছেন তাঁদের দেশে। আমেরিকার শিল্পপ্রেমী ধনকুবের ও প্রতিষ্ঠান তাঁকে একের পর এক কমিশন দিয়ে চললেন শিল্প তৈরির জন্য। ‘ক্যালিফোর্নিয়া স্কুল অব ফাইন আর্টসে’র দেয়াল ও ‘ফ্রানসিসকো প্যাসিফিক স্টক একচেঞ্জে’র দেয়ালও শোভিত হলো রিভেরার শিল্পকর্মে। ম্যুরালের নাম দেওয়া হলো ‘অ্যালিগরি অব ক্যালিফোর্নিয়া’। এখানে কৃষি, যন্ত্রসভ্যতা এবং অ্যারোপ্লেন ও নানা প্রযুক্তিকে শিল্পের অনুষঙ্গ হিসেবে বিবেচনা করলেন রিভেরা। প্রাচীনকাল আর আধুনিক যুগের মানুষের উদ্ভাবন-অভিযানের বিষয়টি সমন্বিত করে দুই আমেরিকার রূপই যেন শিল্পী বোঝাতে চাইলেন।
রকফেলার আর ফোর্ড, দুই শিল্পপতি পরিবারের বাসনা জাগল তাঁদের প্রতিষ্ঠানের দেয়ালে শোভা পাবে রিভেরার শিল্পকীর্তি। এ সময় সান ফ্রানসিসকোতে ম্যুরাল করার পাশাপাশি প্রচুর ইজেলচিত্রও রচনা করেন শিল্পী। মেক্সিকোর ইতিহাস-ঐতিহ্য-পুরাণ আর ফ্রিদার সঙ্গে তাঁর যুগল-বাসের জীবন চিত্রার্পিত করে রিভেরার এত ক্যানভাস ভরে তোলার আসল রহস্য কিছুদিন পর জানা গেল; রকফেলাররা শিল্পীর কাজের এক বিশাল প্রদর্শনীর আয়োজন করেছেন নিউইয়র্কের মিউজিয়ম অব মডার্ন আর্টে (মোমা)। শিল্প নিয়ে মোমায় পৌঁছানো মানে খ্যাতির শীর্ষে ওঠার এক পরিমাপ। ইতোপূর্বে মাতিস ছাড়া আর কারো এ মাপের প্রদর্শনী এই শিল্পতীর্থতুল্য সংগ্রহশালা করেনি। মোমার কর্তাব্যক্তিরাও বুঝতে পেরেছিলেন যে রিভেরার জন্য তাঁদের বিখ্যাত দেয়ালগুলো ছেড়ে দিলে বিনিময়ে তাঁরা কী পাবেন। হাজার দর্শকের লাইন পড়ল প্রদর্শনীর শুরুর দিন থেকে। আর শিল্পসংগ্রাহকদের পুঁজি নতুন গতি পেল রিভেরা-শিল্প বাগে নেওয়ার জন্য। যখন শিল্পে চলছে বুদ্ধির খেলা – বিমূর্তরীতি, কিউবিজম আর তখন প্রায় লোকশিক্ষামূলক দৃষ্টিনন্দন মানুষ আর প্রকৃতি এঁকে এত দর্শক টেনে আনলেন এই মেক্সিকান! আমেরিকার শিল্পী মহলের ঘুম ভেঙে গেল।
নিউইয়র্কের সাফল্যের মৌতাত মিলিয়ে না যেতেই রিভেরার আমন্ত্রণ এলো ফোর্ড পরিবার থেকে। এডজেল বি. ফোর্ড তাঁদের গাড়ি তৈরির কারখানায় রিভেরাকে দিয়ে ম্যুরাল তৈরি করাবেন। কোম্পানি মিটিং করে এ সিদ্ধান্ত নিয়েছে। হেনরি ফোর্ডের ছেলে এডজেল বি. ফোর্ড। তিনিই এখন ফোর্ড মোটর কোম্পানির চেয়ারম্যান। ফ্রেসকো রীতিতে ডেট্রোয়া ইন্ডাস্ট্রির দেয়ালে কাজ শুরু করলেন রিভেরা। কিন্তু কাজটি শেষ করতে হবে মাস কয়েকের মধ্যে। কারণ ‘ফোর্ড মডেল ভি-এইট’ গাড়ি আর রিভেরার চারুশিল্প একই সঙ্গে উদ্বোধিত হোক, এই ছিল অভিজাত ফোর্ড পরিবারের বাসনা। ‘ডেট্রোয়া ইন্ডাস্ট্রি’ বা ‘ম্যান অ্যান্ড মেশিন’ নামের কাজটি যথাসময়ে শেষ হলো। এবার আর ইতিহাস ঐতিহ্য নয় – নয় প্রকৃতি বা পৌরাণিক বিষয় – মোটর কোম্পানির কাজ বলেই বোধ হয় মানুষের বিচিত্র যন্ত্র আবিষ্কারের ঘটনা দিয়ে ফ্রেসকো সম্পন্ন করলেন রিভেরা। কাজটির পরিকল্পনার শুরুতে মেশিন ও যন্ত্রাংশের শত শত স্কেচ করতে হয়েছে তাঁকে। মেশিন ও মানুষের সহাবস্থানের কম্পোজিশন নিয়ে শিল্পীকে ভাবতে হয়েছে অনেক। কাজ দেখে আবারও সমঝদারদের মনে হলো এ শিল্পও মাইকেলেঞ্জেলোর ‘সিস্টিন চ্যাপেলে’র সঙ্গে তুলনীয়। ‘ডেট্রোয়া ইন্ডাস্ট্রি’কে অবশ্য মেশিন-পুরাণ বলে ডাকা যেতে পারে। এই বিশাল বৃত্তান্তের কাজের প্রতিটি দেয়ালের শীর্ষে শিল্পী এঁকেছেন দুটি পৌরাণিক বিশালদেহী মানুষ। এদের সঙ্গে যুক্ত হয়েছে সাদা, কালো, বাদামি, তামাটে চারটি মহাজাতির মানুষের হাত। এই মানুষেরা সবাই মিলে রচনা করেছেন আমেরিকার সভ্যতা। শীর্ষদেশে এই বিবরণ দিয়ে রিভেরা আয়তকার একটি স্পেসে প্রদর্শন করেছেন কয়লা, লোহা, চক আর কালি। এগুলো কেন? কারণ, মোটর তৈরির জন্য এসব উপাদানই লাগে। রিভেরার শিল্প যদিও সরল চোখেই পাঠ করা যায়, তবু তাঁর নির্মিতির গভীরে আছে দার্শনিক মর্মার্থ।
এ যেন চৌদ্দশো শতকের ইতালি। শিল্পীদের নিয়ে চলছে প্রতিযোগিতা। কে কোন মহাশিল্পীকে দিয়ে আঁকাবেন তাঁর আবাসের দেয়াল অথবা নিজের পছন্দের চ্যাপেল-গির্জা। ‘মেডিচি’, ‘স্পোরসা’, ‘এসতে’ প্রমুখ অভিজাত পরিবারের যেমন লড়াই চলছিল রেনেসাঁ সময়ের ইতালিতে অনেকটা তেমনি এক অভিজাত শিল্পপতিদের প্রতিযোগিতা শুরু হলো রিভেরাকে নিয়ে। রকফেলার পরিবার রিভেরাকে সহৃদয় আমন্ত্রণ জানালেন নিউইয়র্কে তাদের সুখ্যাত সেন্টারের দেয়াল শিল্পে মুড়ে দেওয়ার জন্য।
কিন্তু রিভেরা দম্পতির মন ভালো নেই। পুত্রসন্তান জন্ম দেওয়ার মাস তিনেক আগে ফ্রিদার গর্ভপাত হয়। ফ্রিদা গর্ভধারণ করেছিলেন তাঁরা যখন মোমার প্রদর্শনীর জন্য নিউইয়র্কে ছিলেন। তাঁদের মধুর শিল্পময় জীবন হঠাৎ যেন মরুভূমি হয়ে গেল। ডেট্রোয়ার ম্যুরালের এক প্রান্তে একটি ছোট্ট শিশুমুখ এঁকেছেন রিভেরা। এটি যেন তাঁর মৃত পুত্রের এপিটাফ।
শোককে শক্তিতে রূপান্তরিত করে রিভেরা জীবন নবায়ন করলেন। কাজ শুরু করলেন বিখ্যাত রকফেলার সেন্টারে। এবারের বিষয় মানুষের আশা, সম্ভাবনা ও উজ্জ্বল ভবিষ্যৎ অর্জনের জন্য লড়াই। ‘ম্যান এট দ্য ক্রোসরোড’ অর্থাৎ বিশাল চৌরাস্তায় বিচিত্র পেশার, বর্ণের মানুষের মিছিল। তাদের উদ্বেল চাহনি – উজ্জ্বল ভবিষ্যৎ কি খুব কাছেই! এই সম্ভাবনার বীজ অঙ্কুরিত হলো রিভেরার কাজে। তাছাড়া আধুনিক সমরাস্ত্রসজ্জিত সৈনিকদল, সাধারণ জনতার স্লোগান-মুখরিত মুখ – এসব কোন সম্ভাবনার কথা বলছে। আমেরিকার শাসকবর্গ ও পুঁজিবাদী তত্ত্বের সংস্কারপন্থী ভক্তদের অনেকেই দিনে দিনে রিভেরার প্রতি রুষ্ট হয়ে উঠছিলেন। এবার তারা তাদের অভিযোগ স্পষ্ট ভাষায় জানিয়ে পত্র-পত্রিকায় ও মাঠে-ময়দানে সোচ্চার হলেন। শিল্পীর বিরুদ্ধে অভিযোগ অনেক : তিনি ঈশ্বরের বিরুদ্ধে মানুষকে দাঁড় করিয়েছেন, তাঁর কাজে যৌনতার চাপটাও প্রবল ও নগ্ন – তাকে পর্নোগ্রাফি বললেও চলে আর সবচেয়ে বড় কথা হলো তিনি কমিউনিজমের তত্ত্ব প্রচার করছেন শিল্প সৃষ্টির আড়ালে। ক্ষিপ্ত হলেন সমালোচকরাও। তাঁরা বললেন শিল্পের একটা শোভিত সুন্দর রূপ আছে; কিন্তু রিভেরা কর্কশ শ্রমিকের জীবন অমার্জিত ভাষায় প্রকাশ করে চলেছেন। তাঁদের ধারণায় এতে নাকি মানুষের জীবনের নেতিবাচক দিকই অনূদিত হয়েছে রিভেরার কাজে।
রিভেরার পক্ষে দাঁড়ালেন এডজেল ফোর্ড। সাংবাদিক সম্মেলন করে সবাইকে শান্ত হতে বললেন, শ্রদ্ধা অক্ষুণœ রাখার অনুরোধ করলেন শিল্পের প্রতি। রকফেলার পরিবার বিপদে পড়ে গেলেন। জন রকফেলারের বউ অ্যাবি তাঁদের সেন্টারের জন্য নির্মিতব্য রিভেরার পুরো পরিকল্পনা ও লে-আউট আগেই দেখেছিলেন। কিন্তু কাজ সম্পন্ন হওয়ার পথে গিয়ে দেখলেন তাতে লেনিনের মুখ যুক্ত হয়েছে। খবরটা গোপন রইল না। হয়তো রকফেলার পরিবারও তা মেনে নিতে পারেননি। নেলসন ও জন রকফেলার ভ্রাতৃদ্বয় সানুনয় আকুতি জানালেন শিল্পীকে, লেনিনের প্রতিকৃতিটা মুছে ফেলুন। রিভেরা বলে কথা! কমিউনিস্ট শিল্পীর পক্ষে লেনিনের মুখ মুছে ফেলা সম্ভব নয়। এ নিয়ে তর্কের ঝড় উঠল শেষে। রকফেলাররা বললেন, তাঁদেরকে শিল্পী যে ড্রইং-পরিকল্পনা দেখিয়েছিলেন তাতে তো লেনিন ছিল না। রিভেরার সাফ জবাব, শিল্পীকে স্বাধীনতা দিতে হবে।
জনতার রোষ মিছিল করে রাস্তায় নেমে এলো। রিভেরাও পরিষ্কার জানিয়ে দিলেন যে তিনি তাঁর শিল্পে প্রকৃতঅর্থেই পুঁজিবাদের বিষক্রিয়া এবং সমাজতন্ত্রের মন্ত্রে দীক্ষিত মানুষের উত্থানের বৃত্তান্ত সম্প্রচার করেছেন। রাগের আগুনে লেলিহান হয়ে পড়ল জনতার রোষ। ‘মানুষ, ব্রহ্মাণ্ডের নিয়ন্ত্রক’ শীর্ষক রকফেলার সেন্টারের সুবিখ্যাত শিল্প সেই আগুনে পুড়ে ছাই হয়ে গেল। ব্যথিত-চিত্ত শিল্পী ফিরে এলেন স্বদেশ মেক্সিকোতে। রিভেরা দমে যাওয়া মানে সমাজতান্ত্রিক আন্দোলনের পরাজয়। তাই ব্রহ্মাণ্ড বিজয়ী মানুষের গৌরবগাথা নিয়ে রচিত যে শিল্প পুঁজিবাদের আক্রমণে ধ্বংস হয়ে গিয়েছিল তা পুনর্নির্মাণ করলেন শিল্পী নিজের দেশে। কিন্তু আমেরিকানদের সঙ্গে এত ওঠা-বসা,
সুযোগ-সুবিধা নিয়ে শিল্প সৃষ্টি করার বিষয়টা কমিউনিস্টরা সুনজরে দেখতে পারলেন না। তাঁর দিকে সন্দেহের তীর কমিউনিস্ট পৃথিবীর নানা কোণ থেকে তাক করে রাখা হয়েছিল। স্তালিনের সোভিয়েত শিল্পীকে অবাঞ্ছিত ঘোষণা করল; মেক্সিকোর কমিউনিস্ট পার্টির সদস্যরাও ভোট দিলেন রিভেরার বিরুদ্ধে। স্বদেশেও কমিউনিস্ট পার্টি থেকে বরখাস্তের অপমান-বাণে বিদ্ধ হলেন শিল্পী।
তবে শিল্পরচনা তাঁর থেমে থাকল না। পার্টি তাঁকে হটিয়ে দিলে কী হবে, জনতা কিন্তু তাদের বন্ধুত্বের বন্ধন শিথিল করল না। ইতালীয় রেনেসাঁ শিল্পভাষা পুনর্বিশ্লেষণ করে শিল্পিত গভীর ধ্যানে মেক্সিকোর ইতিহাসের মহাকাব্য প্যানেলের পর প্যানেল ছবি এঁকে জনতার সামনে মেলে ধরলেন দিয়েগো মেক্সিকান রিভেরা। এই মহাকাব্যে সবচেয়ে মহিমাযুক্ত করেছেন শিল্পী (রেড) ইন্ডিয়ানদের অতীত ও বর্তমান ইতিহাস চিত্রায়নে। কলম্বাসের আগের সময় অর্থাৎ প্রি-কলাম্বিয়ান বা প্রি-হিস্পানিক কালেরও আগের আজটেক সভ্যতাকে আলোকিত করে সূচনা হয়েছে শিল্পীর কাজ। আজটেকের রানিকে লাতিন আমেরিকার সভ্যতার জননী-বসুন্ধরার মাতৃমূর্তিতে রূপান্তরিত করেছেন রিভেরা। এই জননীকে শীর্ষে রেখে বন্দনা গেয়ে তারপর শিল্পী এগিয়ে গেছেন ইতিহাসের চিত্রল রূপায়ণে।
১৯৩০-এর দশকের শেষে মেক্সিকো শহরের কেন্দ্র থেকে অদূরে রিভেরা-কাহ্লো একটি বাড়ি তৈরি করেন। রিভেরা দম্পতি এ বাড়ির নাম দেন ‘ব্লু-হাউজ’। ফ্রিদার প্রিয় রং নীল। জীবনসাথীর বর্ণ-বাসনাকে রিভেরাও অনুমোদন দিয়েছেন। ১৯৩৭-এর জানুয়ারিতে রিভেরাদের আমন্ত্রণে এ বাড়িতে অতিথি হয়ে এলেন লেয়ন ট্রটস্কি ও তাঁর জীবনসঙ্গী নাতালিয়া সেডোভা। দীর্ঘ দুই বছর এই পরিবার ফ্রিদাদের বাড়িতে থেকেছেন এবং ঘুরে বেড়িয়েছেন বিশাল মেক্সিকোর নানা প্রদেশের সাংস্কৃতিক বৈচিত্র্য অনুভব করার লক্ষ্যে আর জনতার মধ্যে বিপ্লবের সম্ভাবনা পরিমাপ করার জন্য।
কিন্তু মেক্সিকো সরকার বিষয়টা ভালো চোখে দেখেননি। উদারপন্থী মেক্সিকান প্রেসিডেন্ট রিভেরা-ফ্রিদার আকুতিমাখা আবেদনের প্রেক্ষিতেই ট্রটস্কিকে তাঁর দেশে রাজনৈতিক আশ্রয় দিয়েছিলেন এবং এতে শর্ত ছিল যে ট্রটস্কি তাঁর দেশের কোনো রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডে জড়াতে পারবেন না। কেননা দেশটির মঙ্গলের জন্য যা করার দরকার তা সরকার নিজেই করে চলেছেন।
ভূমিপুত্র ইন্ডিয়ানদের জমি ফিরিয়ে দেওয়া হচ্ছে, বিদেশি কোম্পানির হাত থেকে মুক্ত করে তেল-শিল্পকে জাতীয়করণ করা হয়েছে এবং স্পেনের গৃহযুদ্ধের কারণে দেশটির শরণার্থীদের আশ্রয়ও দিয়েছেন মেক্সিকো-সরকার।
১৯৩৭ থেকে ১৯৩৯ পর্যন্ত রিভেরা-কাহ্লো, ট্রটস্কি-নাতালিয়া আর সুররিয়ালিস্ট দম্পতি অঁদ্রে-ব্রতোঁ-লাম্মা মিলনে শিল্পভাবনা, দর্শন আর রাজনীতির আলাপে মুখরিত ছিল সেই নীলবাড়ির সময়।
কিন্তু সময়ের গতি ও রূপ বোঝা বড় দায়। রিভেরা আবারও আমন্ত্রণ পেলেন আমেরিকা থেকে। এখন মহাযুদ্ধের দানব অগ্রসর হচ্ছে। এই দানবের নাম ফ্যাসিইজম। আমেরিকার ঐক্য চাই; ঐক্য চাই সমমনাদের সঙ্গে। প্যান আমেরিকান ভ্রাতৃত্বের শিল্পিত প্রকাশের এখন খুবই প্রয়োজন। রিভেরা এবার যে ম্যুরাল করলেন তা সম্পূর্ণ ভিন্ন নিয়মের। যুক্তরাষ্ট্রের মানুষের সঙ্গে দক্ষিণ আমেরিকার মানুষের সাংস্কৃতিক সেতুবন্ধ সৃষ্টি করলেন পুরাণ, প্রাচীন ইতিহাস ও নানা জাতির মানুষের মহাসম্মেলনের চিত্র এঁকে। যদিও ম্যুরাল, কিন্তু তা এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় নেওয়া যায়। কিন্তু যুদ্ধ শেষ হয়ে গেলে রিভেরা বুঝতে পারলেন আমেরিকার নীতির সঙ্গে সম্পৃক্ত হওয়া সম্ভব নয়। তিনি তাঁর কমিউনিস্ট ভাবনা আর জনতা-দরদি ভাবনা সমন্বিত করে ছবি এঁকে চললেন। মহান করে তুললেন তাঁর চিত্রমালায় স্বদেশ মেক্সিকোর প্রাচীন ইতিহাস আর সমকালের সংগ্রাম। কিন্তু যে-কমিউনিস্ট পার্টি তিনি নিজে গড়ে তুলেছেন সেখানেই আজ তাঁর প্রবেশাধিকার নেই। রিভেরা-চরিত্রের প্রধান বৈশিষ্ট্য এই যে, তা আবেগ দিয়ে অগ্রসর হতে পারে না। বুদ্ধির তীব্র লড়াইকে তিনি সংগ্রামে বিজয়ী হওয়ার পথ বলে মনে করেন। পার্টির অফিসে না গেলে বুদ্ধিতে শান দেওয়া যায় না। অথচ ফ্রিদা কমিউনিস্ট পার্টির সদস্য এবং স্ত্রীকে রিভেরা নিজেই পার্টির সদস্য বানিয়েছিলেন। শেষমেশ ভুল বোঝাবুঝির অবসান হলো তাঁর পার্টির সঙ্গে। এতে ফ্রিদাও বুদ্ধিদীপ্ত ভূমিকা রেখেছিলেন। দু-দুবার আবেদন প্রত্যাখ্যানের পর তৃতীয় আবেদনে রিভেরাকে গ্রহণ করে নিল তাঁর সবচেয়ে স্বস্তির জায়গা মেক্সিকান কমিউনিস্ট পার্টি।
রিভেরা-ফ্রিদাকে জনতাবান্ধব লাতিন আমেরিকার পোশাকে শেষ দেখা গেল ১৯৫৪-র জুলাইয়ের শুরুতে। গুয়াতেমালার প্রেসিডেন্টের সঙ্গে একাত্মতা ঘোষণা করে সিআইএর বিরুদ্ধে প্রতিবাদ মিছিলে অগ্নিশর্মা অভিব্যক্তিতে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে মেক্সিকোর রাস্তায় হাঁটলেন কমরেড দম্পতি রিভেরা-ফ্রিদা।
সিআইএর চরেরা এ-সময় মেক্সিকোর বিপ্লবী সরকারের পতনের জন্য গোয়েন্দা তৎপরতা চালাচ্ছিল। রিভেরার কোমরে এ সময় বাঁধা থাকত রিভলবার। এই অস্ত্র উঁচিয়ে মাঝে মাঝে ফাঁকা গুলিবর্ষণ করে উপনিবেশবাদী শক্তিকে হুমকি দিতেন শিল্পী। কিন্তু এই অগ্নিগর্ভ জুলাই মাসেই অনেক অম্ল-মধুর জটিল জালে বোনা রিভেরা দম্পতির ভালোবাসা ও বিবাদ চিরদিনের জন্য মিটে গেল। ১৯৫৪-র ১৩ জুলাই নীলবাড়ির জোড়াভ্রƒ বিপ্লবী রাজকন্যার হৃদয়-প্রজাপতি হারিয়ে গেল অসীমে। রিভেরা বললেন, ফ্রিদার কফিনে যেন সেঁটে দেওয়া হয় কমিউনিস্ট পার্টির পতাকা; এই তাঁর শেষ ইচ্ছা।
নিজের দেশের লোকশিল্প ও প্রাচীন শিল্পের নিদর্শন সংগ্রহ করে এবং ক্যানভাসে মেক্সিকোকে এঁকে বাকিটা জীবন কাটে রিভেরার। রিভেরার আগে মেক্সিকোর প্রাচীন শিল্পকীর্তি কেউ সংগ্রহ করেননি। তিনি পূর্বপুরুষের কীর্তির দিকে তাকিয়ে স্বদেশের শক্তির উৎস বুঝতে চাইতেন। রিভেরার সেই সংগ্রহ আজ বিশাল জাদুঘর। এখানে এসে মানুষেরা পাঠ করে মেক্সিকোর মানুষের শিল্পিত হৃদয়ের নিদর্শন।
১৯৫৬-র এক সন্ধ্যা। মেক্সিকোর উদার আকাশে পড়ন্ত সূর্য ছড়িয়ে দিয়েছে তার শেষ রংটুকু। রিভেরা চিরকাল স্পেসের পূজারি। দূর-অভিসারী না হলে জীবনও বোঝা যায় না, শিল্পের মাত্রাও প্রসার পায় না। মেক্সিকোর সন্ধ্যার আকাশের সেই রং-রূপ এঁকে মৃত্যুশয্যার দিকে এগিয়ে গেলেন শিল্পী। হৃদরোগ থেকে আর নিষ্কৃতি মিলল না তাঁর। ১৯৫৭-র ২৪ নভেম্বর নিজের স্টুডিওতে সেই সন্ধ্যার ছবি দেখতে দেখতে চিরদিনের জন্য বন্ধ করলেন তাঁর শিল্পদৃষ্টি। মৃত্যুর ঘুমেও ফ্রিদার পাশে রিভেরা শুয়ে থাকতে চেয়েছিলেন সেই নীলবাড়ির কবরস্থানে। কিন্তু শেষ ইচ্ছা তাঁর পূরণ করা হয়নি। ‘রোতুনদা ফেমাস ম্যান’ কবরস্থানের মাটির গভীরেই স্থাপন করা হলো মেক্সিকোর অগ্নিগর্ভা মায়ের অগ্নিপুরুষ রিভেরার কফিন।
সহায়ক গ্রন্থ :
১. আনদ্রিয়া কেটেনমান : রিভেরা, তাসেন, ২০০৩
২. জ্যাকুলিন বারনিৎস : টুয়েনটিয়েথ সেঞ্চুরি আর্ট অব লাতিন আমেরিকা, টেক্সাস প্রেস, ২০০৩
৩. এডওয়ার্ড লুসি স্মিথ : লাতিন আমেরিকান আর্ট অব টুয়েনটিয়েথ সেঞ্চুরি, থেমস অ্যান্ড হাডসন ২০০৪
৪. দ্য গ্রেট আর্টিস্ট ‘রিভেরা’ সিরিজ সংখ্যা-৯৩