logo

রা ন ও য়ে চলচ্চিত্রে সমকালীন বাস্তবতার বোঝাপড়া

বে লা য়ে ত  হো সে ন  মা মু ন

গত ২০০৪, ’০৫ ও ’০৬ সালে আমাদের জাতীয় জীবনে যে ভয়াবহ দুর্যোগ নেমে এসেছিল, যা থেকে এখনো আমরা পুরোপুরি মুক্ত নই এবং যার ক্ষত এখনো শুকিয়ে যায়নি আমাদের মন থেকে, অনেকের শরীর থেকে – সেই সময় নিয়ে চলচ্চিত্রকার তারেক মাসুদ নির্মাণ করেছেন রানওয়ে। রানওয়ে শব্দগতভাবে এমন একটি জায়গা যেখানে বিমান উড্ডয়ন ও অবতরণ করে, নিয়ে আসে মানুষ অথবা অনেক কিছু এবং নিয়েও যায়।
তারেক মাসুদের চলচ্চিত্র রানওয়ে শুধু বিমানবন্দরের অদূরবর্তী কোনো একটি জায়গায় বসবাসকারী পরিবারের গল্প বলেই এ ছবির নামকরণ এমন তা ছবিটি দেখার পর আর মনে হয় না। বরং ‘রানওয়ে’ শব্দটিকে আরো বৃহৎ কোনো অর্থে, আরো ব্যাপকতর অর্থে প্রযোজ্য বলে মনে হয়।
রানওয়ে ছবির পরিবারটি
রানওয়ে ছবিতে একটি নিম্নবিত্ত পরিবারের গল্প বলা হয়েছে। যে-পরিবার অন্য কোনো বিশেষত্ব ছাড়াই এই ছবির বিষয়বস্তু হয়ে ওঠে। এমন পরিবার আমাদের দৃষ্টিসীমার মধ্যে অগণিত, সংখ্যায় তারাই গরিষ্ঠ। সংখ্যায় বেশি বলেই তারা সাধারণত আমাদের চোখে ধরা পড়ে না। তারেক মাসুদের ছবির এই পরিবার নদীভাঙা এলাকার মানুষ। নদীভাঙনের কবল থেকে বাঁচতে জমি বিক্রি করে ভাগ্য পরিবর্তনের আশায় তারা রাজধানী ঢাকায় বসবাস করছে। পরিবারের কর্তা অথবা প্রধান উপার্জনকারী মানুষটি এক মাস হয় কুয়েতে গেছেন বাংলাদেশের আরো কোটিখানেক মানুষের মতো – যাঁদের আমরা প্রবাসী শ্রমিক বলে ডেকে থাকি। এদেশের প্রধান বৈদেশিক মুদ্রা আয়কারী মানুষ তাঁরা। যে কারণে আমরা রানওয়ে ছবিটিকে একজন প্রবাসী শ্রমিকের পরিবারের গল্প হিসেবেও চিহ্নিত করতে পারি। যদিও আমরা সেই শ্রমিককে দেখি না, ছবির কোথাও তাঁর নামও আমরা শুনিনি। তিনি বৃদ্ধ পিতার পুত্র, স্ত্রীর স্বামী এবং সন্তানদের পিতা হিসেবেই উল্লিখিত হন। এমনকি যখন কুয়েত ফেরত একজন সহকর্মী শ্রমিক তাঁর সম্পর্কে কথা বলেন তখনো তাঁর নাম আমরা উল্লিখিত হতে শুনি না। আর তাই রানওয়ে ছবিটি হয়ে ওঠে পিতাহীন একটি পরিবারের গল্প। যে পিতা আছেন গল্পে, স্মৃতিতে এবং কুয়েত অথবা ইরাকে অথবা অন্য কোনো দেশে। যার ভূমিকা রানওয়ে চলচ্চিত্রের পরিবারটিতে কেবলমাত্র মনস্তাত্ত্বিকভাবে হাজির। তিনি এই ছবির পাত্র-পাত্রীদের প্রণোদনা দেন, আশা দেন শারীরিকভাবে না থেকেও। পরিবারে আছেন বৃদ্ধ দাদা, যিনি শারীরিকভাবে অসমর্থ এবং পরিবারের উপার্জনে অক্ষম একমাত্র মানুষ। তিনি পরিবারটির সবচেয়ে বয়স্ক মানুষ, যে-কারণে তাঁকে অনেকটা বিবেকের ভূমিকায় পায় পরিবারটি এবং আমরা দর্শকরাও। পরিবারের কেন্দ্রবিন্দু বলা যায় রহিমাকে, যিনি বাংলার আবহমানকালের মায়ের প্রতিরূপ, যাঁর ভূমিকা পরিবারে সবচেয়ে বেশি। পরিবারে আছে একটি পুত্র ও একটি কন্যা। রুহুল ও ফাতেমা। এই পরিবারের কর্তা যেমন অনুপস্থিত থাকেন প্রবাসী শ্রমিক হিসেবে, যে শ্রম বিভাগটি বাংলাদেশের জনজীবনে গুরুত্বপূর্ণ অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক কারণে, তেমনি আরো গুরুত্বপূর্ণ অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডের সঙ্গে যুক্ত পরিবারের অন্য সদস্যরাও। রহিমা এনজিও থেকে ঋণ নিয়ে গরু পালন করে, দুধ বেচে সংসারে ভাগ্যের মোড় ঘোরানোর চেষ্টায়। কন্যা ফাতেমা গার্মেন্টসে কাজ করে এবং পুত্র রুহুল মাদ্রাসার শিক্ষা শেষ করতে না পেরে বেকার, নানা জায়গায় চাকরির চেষ্টায় রত। এমন একটি পরিবারের গল্পের ভেতর দিয়ে নির্মাতা প্রকৃত অর্থে বাংলাদেশের সমসাময়িক সমস্যাগুলোকেই সামনে নিয়ে এসেছেন, যেখানে এনজিও থেকে ঋণ নিয়ে ভাগ্যবদলের সংগ্রামে হাজির নারী আছেন, আছেন পোশাকশ্রমিক এবং আছে আমাদের সমাজের সুবিধাবঞ্চিত ও কোণঠাসা হয়ে পড়া মাদ্রাসা ছাত্র, যার শিক্ষা তার জীবিকার নিশ্চয়তা দিতে পারে না বিধায় সে বেকার ও জঙ্গিবাদের মধ্য দিয়ে নিজের মুক্তির পথ সন্ধান করে; হতাশাগ্রস্ত জীবন কাটায়। ফলে প্রকৃত প্রস্তাবে রানওয়ের এই পরিবারটি বাংলাদেশের প্রতীক হয়ে ওঠে। বাংলাদেশ একটি রাষ্ট্র হিসেবে এর যে সমস্যা ও সম্ভাবনাগুলো রয়েছে তার প্রায় পুরোটাই এই পরিবারের ভেতর দিয়ে হাজির হয়। তাই রুহুলদের পরিবারটিকে বৃহৎ অর্থে বাংলাদেশের মেটাফোর হিসেবে উল্লেখ করা যায়।

রানওয়ের আরো চরিত্রগুলো
রুহুলের পরিবারের বাইরে এই ছবিতে আরো যেসব চরিত্র আমরা পাই তার মধ্যে প্রধান চারটি চরিত্র হলো রুহুলের মামা, যিনি একটি কম্পিউটারের দোকান চালান। আরিফ এই ছবির অন্যতম প্রধান চরিত্র। যে রাজনৈতিক কর্মী, পরিবার থেকে বিচ্ছিন্ন এবং চরমপন্থার মধ্য দিয়ে ইসলামী শাসন কায়েম করার বিষয়ে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ। আছেন ‘উর্দুভাই’ যিনি একজন মুজাহিদ, পাকিস্তান ও আফগানিস্তানে যুদ্ধ করে এসেছেন। ছবিতে আমরা তাঁকে দেখি প্রশিক্ষক এবং জঙ্গিদলের দলনেতা হিসেবে। আর আছে শিউলি নামের একটি মেয়ে। পোশাকশ্রমিক, রুহুলের বোন ফাতেমার বন্ধু এবং তাদের প্রতিবেশী। রুহুলকে ভালোবাসে এবং নিজের পছন্দ-অপছন্দের বিষয়ে স্পষ্টবাদী। নিজের পিতা যখন একজন নেশাখোরের সঙ্গে তার বিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করে তখন সে বাড়ি ছেড়ে মেসে গিয়ে ওঠে। তবু পিতার পছন্দের কুপাত্রকে সে বিয়ে করে না। ছবিতে আরো কিছু চরিত্র আছে যারা পরিস্থিতির প্রয়োজনে, গল্পের গতির প্রয়োজনে হাজির হয়। রানওয়ে সমকালীন বিষয় এবং মানুষদের নিয়ে বাংলাদেশের সাম্প্রতিক ঘটনাপ্রবাহ তুলে ধরে। এবার তবে একটু ভেবে দেখি, রানওয়ে ছবিতে তারেক মাসুদ আমাদের কী বলেন অথবা বলতে চান?

যে-দৃশ্যাবলির মাঝে গল্প শুরু হয়
একটি বিশাল দানবীয় বিমান অবতরণের দানবীয় আওয়াজে বিমানবন্দরের অদূরের কুটিরে টিনের দেয়ালে ঝোলানো জিনিসপত্র কাঁপতে থাকে এবং এই শব্দ ও জিনিসপত্রের কম্পনের শব্দে একজন বৃদ্ধ উঠে বসে অন্ধকারেই হাতড়ে টিনের জগ থেকে পানি ঢেলে খায়। এভাবেই রানওয়ের গল্প শুরু হয়। দানবীয় উড়োজাহাজের ভীতিকর শব্দে কেঁপে ওঠা ভয়ার্ত বৃদ্ধের মুখ যেন আমাদের ধাক্কা দেয়, একটু নড়ে ওঠে আমাদের দেখার চোখ, মগজেও কিছু আলোড়ন ওঠে। যে-কারণে আমরা দানবীয় বিমানকে শুধু ‘বিমান’ই ভাবতে পারি না। আর অদূরবর্তী কুটিরে থাকা সেই বৃদ্ধ যে বিমানের অবতরণের শব্দে কেঁপে ওঠেন ঠিক তাঁর ঘরের  মতোই, আমরা তাঁর এই ভয় পাওয়াকেও নিছক ‘শব্দে’ ভয় পাওয়া হিসেবে দেখি না। এর অন্য অর্থ আমাদের ভাবতে হয়। পুরো ছবিতেই এ বিমান ওঠানামার শব্দদৃশ্য যখনই হাজির হয়, তা আমাদের সচকিত করে তোলে। ছবির পাত্র-পাত্রীদের গুরুত্বপূর্ণ মুহূর্তগুলোতেই এই বিমানের ওঠানামা কি নিছকই বিমানের ওঠানামা? আমরা তো জানিই যে, যে-কোনো ছবির নির্মাতা কোনো উদ্দেশ্য ছাড়া একটি মাছিকেও তাঁর ফ্রেমের ভেতরে আসতে দেন না। তাহলে তারেক মাসুদ কেন বারবার ছবির বিভিন্ন জায়গায় বিমান উড্ডয়ন ও অবতরণের শব্দ ও দৃশ্য গেঁথে দেন? আমরা একটু লক্ষ করে দেখি যে, ছবিতে যখন কোনো অমঙ্গল ঘটে বা ঘটতে চলেছে তখন এই দৃশ্য-শব্দ হাজির হয়। আবার যখন কোনো মঙ্গলজনক কিছু যেমন কোনো তথ্য অথবা কোনো উপলব্ধি চরিত্রগুলোর মাঝে দেখি তখন এই শব্দদৃশ্য জানান দিয়ে হাজির হয়। ফলে আমরা ভাবতে বাধ্য হই রানওয়ে ছবিতে বিমান ওঠানামার অথবা আকাশের বুকে মানুষের ওপর দিয়ে বিমান উড়ে যাওয়ার দৃশ্য ও শব্দের আলাদা কোনো অর্থ দাঁড় করাতে চান নির্মাতা অথবা এই দৃশ্য-শব্দ নিজেই একটি চরিত্র হয়ে ওঠে অন্য চরিত্রগুলোর মতো!

রানওয়ের গল্পে অন্তর্যাত্রা
ছবির শুরুর দৃশ্যগুলোতে আমরা একজন তরুণের পেছনে হাজির হই। সে অন্য সকল মুসল্লির সঙ্গে ফজরের নামাজ শেষ করে মসজিদ থেকে বের হয়ে আসে। অন্য মুসল্লিরা যখন আমাদের ক্যামেরা কোণের দিকে না এসে সকলেই ডানে অথবা বাঁয়ে চলে যেতে থাকে তখন আমরা দেখি একজন উনিশ-বিশ বছরের তরুণ সোজা ক্যামেরার দিকে মুখ করে সামনে  আসতে  থাকে।  আমরা  বুঝে নিই  এই তরুণই আমাদের গল্প শোনাবে অথবা এর গল্পই আমরা দেখব। এ দৃশ্যের যে মুন্শিয়ানা আমরা দেখি, রানওয়ে ছবিজুড়ে আমরা এমন মুন্শিয়ানার ছাপ অনেক দেখব এবং আনন্দিত হব। সেই তরুণের আমাদের দিকে আসার পরের দৃশ্যে আমরা দেখি একজন নারী একটি বালতি হাতে গোয়ালঘরের দিকে যায়, গাভির দুধ দোয়ানো শুরু করে ঠিক এমন সময় গোয়ালের ওপর দিয়ে সশব্দে একটি বিমান উড়ে যায়।
আমরা যে তরুণকে মসজিদ থেকে বের হয়ে আসতে দেখেছিলাম তাকে দেখি একটি বাসায় ঢোকার মুখে টিফিন-ক্যারিয়ার হাতে বের হওয়া একটি মেয়েকে পাশ কাটায় এবং মেয়েটিকে বলে ‘যাইতেছস’? মেয়েটি বলে ‘হ’। দূর থেকে ওদের কথা-বলা দেখেন গোয়ালঘরে বসা নারীটি। এতে আমরা এদের আন্তঃসম্পর্ক বুঝে উঠি এবং নির্মাতা আমাদের বাড়তি কোনো ঝামেলা ছাড়াই গল্পের মধ্যে প্রবেশ করিয়ে নিতে পারেন। ফলে রানওয়ে ছবির গল্প স্বাভাবিক ছন্দে এবং কোনো বাড়তি জোরাজুরি ছাড়াই এগিয়ে যায় বা যেতে থাকে। আমরা দেখি ফাতেমা যে ওই তরুণ রুহুলের বোন তার বন্ধু শিউলিকে নিয়ে ভোর হওয়ার আগে-আগেই টিফিন ক্যারিয়ার হাতে ছুটে যায় কারখানায়, যেখানে দিনের পুরোটা সময় এবং রাতের বেশ অনেকটা সময় দিয়ে মাস শেষে যতসামান্য টাকা পাবে। কোনো কোনো মাসে পাবে না, দুই বা তিন মাস বেতন না দেওয়া কোনো অসুবিধা নয় এইসব কারখানা মালিকদের এবং তাদের (ফাতেমা ও শিউলিদের) শ্রমে এইসব কারখানার মালিক চড়বে নতুন মোটরগাড়িতে, উড়োজাহাজে, গড়বে প্রাসাদোপম বাড়ি।
আমরা দেখি রুহুল একটি কম্পিউটারের দোকানে যায় এবং তার সম্বোধন থেকে আমরা ধরতে পারি যে কম্পিউটারের দোকান মালিক রুহুলের মামা। প্রায় আইনস্টাইন-মার্কা চেহারা নিয়ে (মামার চেয়ারের পেছনের দেয়ালে আইনস্টাইনের পোস্টারও সাঁটানো দেখা যায়!) মামা রুহুলকে বলেন, ‘ইয়াংম্যান, ইউ আর সো লেট!’ তিনি রুহুলকে আরো বলেন, ‘টাইম সেন্স ছাড়া কিছুই হবে না। বুঝলি, আরে বাবা এইটা সায়েন্সের যুগ।’ আমরা বুঝি রুহুলদের পরিবারে সম্ভবত এই মামা একজন স্বশিক্ষিত ব্যক্তি। কেননা তিনি কথায় কথায় ইংরেজি বলেন এবং আমরা পরবর্তী সময়ে দেখব তিনি নানা বিষয়ে আধুনিক থাকার চেষ্টা করেন। ছবিতে এই সাইবার ক্যাফেটি অনেক কারণেই গুরুত্বপূর্ণ স্থান হয়ে উঠবে। এখানে আরিফ নামের তরুণের সঙ্গে রুহুলের বন্ধুত্ব হয় এবং রুহুল ধীরে ধীরে চরমপন্থার মধ্যে নিজেকে জড়িয়ে নেয়।
ছবিতে প্রথম দিনের মতোই দ্বিতীয় দিনের দৃশ্য শুরু হয় রুহুলের মা রহিমার বালতি হাতে গোয়ালঘরে যাওয়ার দৃশ্য দিয়ে। এর আগের দিনের পুরো চক্রটিতে নির্মাতা আমাদের ছবির প্রায় সব চরিত্রের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেন এবং আমরা গল্পের পরবর্তী অংশে যাওয়ার জন্য পথ খুঁজতে থাকি। দ্বিতীয় দিনের দৃশ্যমালায় নির্মাতা আরো তথ্য এবং চরিত্রগুলোর মনস্তত্ত্বের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেন। গল্পের এইদিন রুহুল মাকে বলে তাদের সমিতি থেকে কিছু টাকা এনে দিতে, যাতে সে ছোটখাটো একটা ব্যবসা শুরু করতে পারে। রুহুলের এই মনোভাব জেনে রাখা আমাদের জন্য গুরুত্বপূর্ণ এ কারণে যে, পরবর্তী সময়ে যখন রুহুল চরমপন্থায় চলতে শুরু করবে তখন এই রুহুলই তার মাকে বলবে ইসলামে ‘সুদ’ নেওয়া এবং দেওয়া হারাম। ফলে তার এই মনস্তাত্ত্বিক পরিবর্তনের কারণ আমরা বুঝতে পারি। গল্পের এই পর্যায়ে যখন রুহুল মামার কম্পিউটারের দোকানে যাবে, আজ আমরা দেখব একজন কাস্টমার দোকানের ফোন থেকে বিদেশে কারো সঙ্গে কথা বলছে। আমরা দেখি ফোনে কথা বলা কাস্টমারটি বিদেশে তার ভাইকে বোঝাতে চেষ্টা করছে যে, একখণ্ড জমি পাওয়া গেছে যা খুব ভালো। সে (বিদেশে থাকা ভাই) টাকা পাঠালেই জমিটা কেনা সম্ভব। ফোনের বিল পরিশোধ করে কাস্টমার চলে যাওয়ার পর রুহুলের মামা বেশ পরিহাস ছলেই বলেন, ‘ইটস ডিউ টু দ্য ল্যাক অব সায়েন্টিফিক নলেজ। আরে বাবা, এ দ্যাশ আর মাত্র ত্রিশ বছরের মধ্যে ডুইবা যাবে। বিদ্যাশের হার্ড আর্ন মানি দিয়া জমি কিনে টাকা নষ্ট কইরা কোনো লাভ আছে? যত সব ফুলিশ থিংকিং!’ মামার এই মন্তব্যের পর দোকানে থাকা একজন তরুণ (আরিফ) মামার দিতে তাকিয়ে বলে, ‘এইটা আপনি ঠিক বললেন না আংকেল। এইগুলো সব পশ্চিমাদের ষড়যন্ত্র। ওরা আমাদের তেল, গ্যাস নেবার জন্য প্রপাগান্ডা ছড়াইতেছে। ওরা চায় আমরা আমাদের ভবিষ্যতের কথা চিন্তা না করি।’
রানওয়ে ছবিতে আরিফ নামের এই তরুণের এটাই প্রথম সংলাপ। ছবির পরবর্তী সময়ে আমরা তাকে আবিষ্কার করব একজন ধীরস্থির এবং ঠাণ্ডা মাথার জঙ্গি হিসেবে। গল্পের এক পর্যায়ে আরিফের সঙ্গে তার স্ত্রী সেলিনার যে কথোপকথন হবে সেখান থেকে আমরা জানতে পারি, জঙ্গি হওয়ার আগে আরিফ অন্য একটি রাজনৈতিক দলের সঙ্গে যুক্ত ছিল। যারা গণতন্ত্রের মাধ্যমে ইসলাম কায়েমের চেষ্টা করে। আরিফ পরবর্তী সময়ে সেই রাজনৈতিক দলের হঠকারিতা ধরতে পেরে সেই রাজনীতি ছেড়ে চরমপন্থার পথ বেছে নেয় এবং এই চরমপন্থার মধ্য দিয়েই সে ইসলাম কায়েমের স্বপ্ন দেখে। ছবির শেষ অংশে আমরা দেখি আরিফ আত্মঘাতী বোমা হামলার মাধ্যমে নিজেকে হত্যা করে। ফলে আরিফ শুধু এই চলচ্চিত্রেরই নয় – সম্ভবত আমাদের চেনাজানা জগতেও একটি আলাদা চরিত্র। আমরা জঙ্গি বলতে আসলে কী বুঝি বা আমাদের কী বোঝানো হয়? আমাদের বোঝানো হয়, জঙ্গি হলো এমন একটি ভয়ংকর প্রাণী, যারা ইসলাম বা অন্য কোনো ধর্মের নামে যে কাউকে হত্যা করতে পারে, যে-কোনো ভয়াবহ ধ্বংসাত্মক কাজ করতে পারে। তাদের কোনো দেশ নেই, ফলে দেশপ্রেম নেই। তাদের কোনো জাতি নেই, ফলে জাতীয় সংস্কৃতি নেই। তারা শুধু ধর্মের অনুসারী এবং ধর্মীয় ব্যাখ্যায় যা হারাম বা খারাপ বা অনুচিত তা মেনে চলে। তাদের সব কিছু তারা ঈশ্বর বা আল্লাহ থেকে আসে বলে মনে করে। ফলে আল্লাহর দুনিয়ায় যা-ই ঘটে তার সবকিছুই আল্লাহর ইচ্ছায় ঘটে বলে তারা বিশ্বাস করে। আমরা আরো জানি যে, এই জঙ্গিরা হবে মূর্খ এবং তারা সব রকম আধুনিকতার বিরোধী। কিন্তু আরিফের চরিত্রটি আমাদের এমন জানাশোনার জগৎকে একটি জোর থাপ্পড় দিয়ে যায়। আমাদের চেনা জগৎকে অচেনা মনে হয়। জঙ্গিবাদবিষয়ক রাজনৈতিক যেসব প্রকল্প আমাদের চারপাশে অহর্নিশ ঘুরতে দেখি তাদের ঠুনকো ও হাওয়াই মিঠাই বলে মনে হয়। জঙ্গি আরিফ যখন বলে ‘এইগুলা সব পশ্চিমাবাদের ষড়যন্ত্র’ তখন আমরা নতুন কোনো তথ্য জানতে তৈরি হই। আরিফ যখন বলে, ‘ওরা আমাদের তেল, গ্যাস নেবার জন্য প্রপাগান্ডা ছড়াইতেছে। ওরা চায় আমরা আমাদের ভবিষ্যতের কথা চিন্তা না করি’ – তখন আমাদের মনে হয় এই আরিফের ‘আমাদের’ আর আমরা যে বলি ‘আমাদের’ এর মাঝে পার্থক্য আদৌ কি আছে? আরিফের বক্তব্যে যে ‘তেল, গ্যাস নেবার প্রপাগান্ডার’ কথা শুনি তা কি আমরা আগেও শুনিনি অথবা প্রায়ই শুনি না? আমাদের বাম রাজনৈতিক দলগুলো কি একই ভাষায় কথা বলে না? তাহলে একজন জঙ্গি এভাবে জাতীয়তাবাদী মনোভাব দেখায় কোথা হতে? আমাদের চেনাজানা জঙ্গিবিষয়ক ধারণা আর এ পর্যায়ে কাজ করে না। আমরা নতুন সংকটের সামনে এসে দাঁড়াই, যেখানে একজন জঙ্গিও দেশের ভবিষ্যৎ নিয়ে ভাবে, যে ভাবনা আমাদের কাছে খুব সম্ভবত সুখকর নয়। এই চ্যালেঞ্জ তারেক মাসুদ তাঁর রানওয়ের মধ্য দিয়ে আমাদের দিকে ছুড়ে দেন।
আমরা রানওয়ে ছবিতে একে একে আমাদের দেশের যে সকল বাস্তবতার মুখোমুখি হই, এর প্রতিটিই অন্যটির সঙ্গে এমনভাবে গাঁথা যে, আমাদের বোধে একটি সামগ্রিক চেহারাই ফুটে ওঠে। আমরা একটি থেকে অন্যটিকে খুব বেশি আলাদা করতে পারি না। অন্তত আমরা যখন ছবিটা দেখি তখন! রানওয়ে ছবিতে রহিমা মানে রুহুলের মা এনজিও থেকে টাকা নিয়ে গরু পালেন। আমরা রহিমার সংলাপ থেকেই জানতে পারি, গরুর দুধ বেচা টাকায় লোন নেওয়া টাকার কিস্তিই শোধ করা যায় না, সেখানে পরিবারের ভরণপোষণ হবে কোথা থেকে? আমরা দেখি  কিস্তিওয়ালা যুবক নতুন মোটরসাইকেলে ভাঙা পথে আসে রহিমার কাছ থেকে কিস্তি তুলে নেওয়ার জন্য, এসে সে তার মোটরসাইকেল থেকে নামে না। বন্ধও করে না – এত তাড়া! রাজসিক ভঙ্গিতে সে টাকার জন্য অপেক্ষা করে। আর ধার বা লোন নেওয়া রহিমা প্রজার ভঙ্গিতে কাঁচুমাচু হয়ে তাকে বোঝানোর চেষ্টা করে যে, রহিমার কন্যা ফাতেমা দুই মাস ধরে গার্মেন্টসে বেতন পায় না। ফলে রহিমা কেমন করে কিস্তি দেবে! তখন কিস্তিওয়ালা যুবক মোক্ষম প্রশ্নটি করে। সে বলে, ‘গার্মেন্টসের সঙ্গে কিস্তির কী সম্পর্ক?’ এবং এখানেই তারেক মাসুদ আমাদের দেখান বাংলাদেশের এনজিওগুলো দেশের উন্নয়নের লক্ষ্যে যে দায়িত্ব পালন করছে তাতে আমাদের দরিদ্র জনগোষ্ঠী আরো দরিদ্র হয়ে যাচ্ছে। ছবির পরবর্তীকালে আমরা দেখব বৃদ্ধ দাদু যখন মুঠোফোন ধরে ‘বিশ্বস্ত ব্যাংক’ শুনতে গিয়ে শুনবেন ‘বিশ্বব্যাংক’, তখন নির্মাতার রসবোধ এবং রাজনৈতিক জ্ঞান ও লক্ষ্য আমাদের কাছে পরিষ্কার হয়ে যাবে। আমরা ধরে নিতে বাধ্য হব যে, যদিও ছবিতে ভুল করেই আমরা ঘটতে দেখি বিশ্বস্ত ব্যাংকের কর্মকর্তা ফোন করেছে ঋণগ্রহণকারীর কাছে ঋণের কিস্তি শোধ করার বিষয়ে জানতে। কিন্তু যিনি ফোন ধরেছেন তিনি শুনলেন ‘বিশ্বব্যাংক’ থেকে ফোন এসেছে। ফলে আমরা বুঝে নিই আমাদের চারপাশের ‘বিশ্বস্ত ব্যাংকে’র আড়ালে বিশ্বব্যাংকের চেহারাটা! আমরা এভাবেই আমাদের দেশের এনজিওগুলোর কর্মকাণ্ড সম্পর্কে ওয়াকিবহাল হই তারেক মাসুদের রানওয়ে চলচ্চিত্রে।
ছবিতে রুহুল যখন একের পর এক চাকরির ইন্টারভিউ দিয়ে ব্যর্থ হচ্ছে তখন আমরা তাকে হতাশ হতে দেখি। কিন্তু রুহুলকে তখনো আমাদের অসহিষ্ণু কিংবা বেপরোয়া মনে হয় না। বরং একদিন রিকশায় করে অন্যত্র যাওয়ার পথে যখন রুহুলের রিকশাচালক সামনে থেকে হঠাৎ ব্রেক করা একটি  গাড়ির কারণে ব্রেক করেও শেষ রক্ষা করতে পারে না
Ñ ফলে গাড়ির বাম্পারে রিকশার চাকা থাক্কা দেয়। তখন গাড়ির মালিক বেরিয়ে এসে অন্যায়ভাবে রিকশাচালককে গালাগালি দিতে থাকে এবং মারতে উদ্যত হয়। এমন অবস্থায় রুহুল এর প্রতিবাদ করে, গাড়ির মালিককে অন্যায় আচরণ করতে নিষেধ করে। এতে গাড়ির মালিক রুহুলকে অশ্রাব্য গালাগালির সঙ্গে উপর্যুপরি মারতে থাকে। অন্যায়ভাবে মার খাওয়া, চাকরি না পাওয়াসহ নানা কারণেই রুহুল মানসিকভাবে বিপর্যস্ত হয়ে পড়ে। সেদিন রুহুল ঘরে ফেরার সময়ে সে যেভাবে দানবীয় বিমানকে পেছনে ফেলে আসে এবং বিমানের বিশাল আকারের বিপরীতে তাকে রীতিমতো দুর্বল ও অসহায় বলে মনে হয়, যা মিশুক মুনীরের ক্যামেরা অত্যন্ত বিশ্বস্তভাবে তুলে ধরে। ফেরার পথে রুহুল যখন দেখে সেই বিশাল বিমানকে সামান্য গুলতি দিয়ে গোলা তাক করছে সাত-আট বছরের একটি শিশু তখন রুহুল তা দেখে স্মিত হাসে, যা এই ছবির একটি দুর্লভ মুহূর্ত বলে মনে হয়। রুহুলের এই হাসি এবং ওই শিশুর যে অনমনীয় ভঙ্গি তা একটি বিশেষ বার্তা বহন করে। তা যেন অপরাজেয় মানবিক অহংকে মূর্ত করে তোলে। ছবির ধারাবাহিকতার জন্যও যা বিশেষ প্রয়োজনীয় মুহূর্ত এবং রুহুলের মনোভাবে আগামীতে যে পরিবর্তন ঘটবে তার ইঙ্গিত তুলে ধরে। আমাদের আধুনিকতম শহরে ও কর্মক্ষেত্রে একজন রুহুলের অনুপযোগী হয়ে যাওয়াকে আমরা রোধ করতে কিছুই করি না, কিছুতেই যেন আমাদের কিছু যায় আসে না। ফলে পুরোমাত্রায় সচেতন থাকার পরও আমরা দেখব পরবর্তী সময়ে জঙ্গিনেতা ‘উর্দুভাই’ যখন ‘আসমানে’ তাদের ‘পরমপিতা’র সঙ্গে দেখা করতে যায় তখন সেই ‘পরমপিতা’ বলেন, কওমি মাদ্রাসা বিলটি যে পাশ করিয়ে দিলাম তাতে আপনাদের মানে ‘উর্দুভাই’দের কাছে তাদের প্রতিশ্র“তি রক্ষা করা হয়েছে। ফলে যারা ক্ষমতায় থাকে তাদের পদের ক্ষমতা নিরঙ্কুশ রাখার জন্য রুহুল, আরিফদের জিহাদি হতে হয়, তারা শহীদ হয়ে সোজা জান্নাতবাসী হয়ে যাবে এমন গল্পে আশ্বস্ত হয়। আর এর মাধ্যমে রুহুল কিংবা আরিফরাও ভাবে তাদের ব্যক্তিগত জীবনের গ্লানি কিংবা ক্ষোভ থেকে পরিত্রাণ পাওয়ার পথে শহীদ হয়ে সোজা জান্নাতবাসী হওয়াই একমাত্র ‘আল্লাহর রাস্তা’। ফলে রানওয়ে পরতে পরতে আমাদের সামনে তার গল্পের ঝাঁপি খুলে ধরে, যা আমাদের মগজে আলোড়ন তোলে, আমরা ভাবতে বাধ্য হই।
রানওয়ে ছবিতে জঙ্গিদের নেতা উর্দুভাইয়ের বয়ান থেকে আমরা শুনি, তাদের সিরিজ বোমা হামলার কারণে দেশের সব সিনেমা হল বন্ধ হয়ে গেছে। যাত্রা, বাউলগানের অনুমতি দিচ্ছে না সরকার, মাজারে বা দরগাগুলোতে বিভিন্ন অনুষ্ঠান বন্ধ হয়ে গেছে। আবার ছবিতে উর্দুভাই যখন তাদের পরমপিতার সাক্ষাতে – তখন যে আলোচনা হয় তাতে আমাদের বুঝতে অসুবিধা হয় না যে, ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দলের এজেন্ডা বাস্তবায়নের জন্যই উর্দুভাইদের মতো লোকজনের তৎপরতার নিরাপত্তা দেয় ক্ষমতায় আরোহণকারীরা। ফলে এ সকল কর্মকাণ্ডের রাস্তা সহজ করার জন্য প্রশাসনিক সহযোগিতা বিপুলভাবে মজুদ আছে। আবার ‘পরমপিতা’ যখন হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করেন এই বলে যে, বিচারকদের ওপর কোনো হামলা হলে তারা আর কোনো প্রটেকশন দেবে না, তখন আমরা দর্শকরা বুঝতে পারি উর্দুভাইদেরও আসলে বলির পাঁঠা বানানো হচ্ছে। তাদের দিয়ে যতটুকু কাজ ক্ষমতাকাঠামোর করিয়ে নেওয়া দরকার ততটুকুই করানো হবে। এর বেশি কিছু করতে গেলে যদি পরমপিতাদের ক্ষমতায় কোনো কারণে সমস্যা হয় তাহলে তাদের
ওপর ‘অ্যাকশন’ নেমে আসবে এবং নেমে আসেও। ফলে বাংলাদেশের ধর্মীয় জঙ্গিবাদ যে আসলে বাংলাদেশের ক্ষমতা-কাঠামোতে থাকা রাজনৈতিক দলগুলোর ছত্রচ্ছায়ায় বেড়ে ওঠা গোষ্ঠী তা তারেক মাসুদ আমাদের দেখান এবং বাংলাদেশের বর্তমান রাজনৈতিক বাস্তবতাও তাই। ফলে আমরা একই সঙ্গে আনন্দিত হই চলচ্চিত্রে এমন গুরুত্বর্পর্ণ বিষয় উঠে আসায় এবং নির্মাতার কলানৈপুণ্যে ও সাহসে আশ্বস্ত হই।
রানওয়ে ছবিতে সিনেমা হলে বোমা হামলার দৃশ্যটি যথেষ্ট বিশ্বাসযোগ্য হয়ে উঠেছে। সিনেমা হলের প্রকৃত পরিবেশ তুলে ধরে নির্মাতা আমরা যারা দাবি করি যে এখন আর সিনেমা হলে যাই না, তাদের সিনেমা হলে ঘুরিয়ে নিয়ে আসেন সিনেমার মধ্য দিয়ে। আমরা দেখি পোশাকশ্রমিকেরা দলে দলে সিনেমা হলে ‘আমাদের’ জন্য অসহনীয় পরিবেশে শাকিব খান, শাবনূর অভিনীত গানে ঠোঁট মিলিয়ে গাইছে ‘কিছু কিছু মানুষের জীবনে ভালোবাসা চাওয়াটাই ভুল’, যারা এই গানে ঠোঁট মিলিয়ে গাইছে তাদের জীবনে আরো অনেক কিছু চাওয়াকেই ভুল প্রমাণ করে রাখা হয়েছে তা যেন চোখের সামনে এনে দেখান নির্মাতা। আমরা যারা সিনেমা হলে যাই না কিন্তু তারেক মাসুদের ছবি দেখি, তাদের জন্য তারেক মাসুদ রানওয়ে ছবির গল্পে দেখান ছবি দেখাটা কত মানুষ কত আনন্দ নিয়েই দেখে। সিনেমা হলে যাওয়াটা তাদের জন্য এখনো উৎসব!
সেই সিনেমা হলে বোমা হামলা হয়। সাধারণ মানুষ হতাহত হয়, ক্ষতিগ্রস্ত হয় সাধারণ মানুষের বিনোদনের ক্ষেত্র। যাত্রা, গান কিংবা বাউলদের আসরে কারা যায়? সেই তো সাধারণ মানুষ। ফলে রানওয়ে ছবিতে আমরা দেখি সাধারণ মানুষের বিরুদ্ধে এক অঘোষিত অলিখিত যুদ্ধ চলে। যারা যুদ্ধের নীলনকশা করে তারা থাকে ‘আসমানে’, তাদের বাহন উড়োজাহাজ। ফলে রানওয়ে ছবিতে যখন বারবার বিমানের শব্দে চারপাশ কেঁপে ওঠে, তখন যেন সাধারণ মানুষের বিরুদ্ধে যুদ্ধের দামামা বাজছে বলে মনে হয়। এই সাধারণ মানুষই বাংলাদেশের প্রবাসী শ্রমিক, পোশাকশ্রমিক, এনজিওগুলোর ঋণগ্রহীতা এবং মাদ্রাসায় পড়া দরিদ্র ছাত্র। রানওয়ে ছবিতে নির্মাতা সমকালীন মোবাইল ফোন বা মুঠোফোন সংস্কৃতিকেও পুরোমাত্রায় হাজির করেছেন। আমাদের দেশের আর কোনো মাধ্যমে অথবা দৃশ্যমাধ্যমে আমরা বলতে শুনিনি ‘মোবাইলের ষাট সেকেন্ড মানে দুই মিনিট’! একটি দেশের প্রায় ষোলো কোটি মানুষের সময়জ্ঞান নিয়ে এমন পরিহাস এদেশের এই মোবাইল ফোন বহুজাতিক কোম্পানিগুলো দিনের পর দিন করে গেছে আর তা আমাদের অন্য কোনো শিল্পমাধ্যমে আসেনি। আমরাও আনন্দচিত্তে ‘ষাট সেকেন্ড মানে দুই মিনিট’ মেনে বিল দিয়েছি আর কোম্পানিগুলো তাদের মুনাফা বাড়িয়েছে। রানওয়ে ছবিতে এই প্রতারণার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ আছে। একজন তরুণ বলেন, ‘ঠিক আছে রাখেন কিন্তু এইটা উচিত অইল না।’ ‘ষাট সেকেন্ড মানে দুই মিনিট’ এটা যে অনুচিত এ-কথা আমরা আরো জোর গলায় বলতে পারিনি। আমাদের এমন অনেক দীনতা এই ছবিতে সরাসরি প্রকাশ পেয়েছে। আমরা রানওয়ে ছবিতে উর্দুভাইকে বলতে শুনি, বিমানবন্দরের নিরাপত্তা বিভাগে তাদের লোক আছে। আমরা দেখি, জঙ্গিরা প্রশিক্ষণ নেয় আফগানিস্তান এবং চেচনিয়ার জঙ্গিদের প্রশিক্ষণ নেওয়ার ভিডিও দেখে। ফলে এইসব জঙ্গির আন্তর্জাতিক কোনো যোগাযোগ আছে কী নেই তা পরিষ্কার হয় না। নির্মাতাও এই বিষয়ে সংযমী থাকেন। বিষয়টা আমাদের দর্শকের ভাবনায় চলতে থাকে। রানওয়ে ছবির শেষ দৃশ্য যেখানে রহিমা তার ফেরত আসা ছেলে রুহুলের মুখ সদ্য দোয়ানো গরুর দুধ দিয়ে দুইয়ে দেন। এই দৃশ্য প্রথমবার রানওয়ে দেখার পর কেমন যেন বাড়তি এবং আরোপিত বলে মনে হয়েছিল। কিন্তু রানওয়ে যখন দ্বিতীয়বার দেখি তখন দৃশ্যটি আর বাড়তি মনে হয় না। আরোপিতও মনে হয় না। এর কারণ হয়তো হবে আমাদের নাগরিক চোখ মায়ের এমন স্নেহের প্রকাশ বাড়াবাড়ি বলে মনে করেছিল। একজন মায়ের হারিয়ে যাওয়া কিংবা বিপথে যাওয়া পুত্রের ফিরে আসার এই উদ্যাপন ‘নাগরিক মন’ দিয়ে ধরা যায় না। যাবে না। এই আবেগ অনেক বেশি বিশুদ্ধ, অনেক বেশি নির্মল। যা প্রথম দেখায় বাড়তি, বাড়াবাড়ি বলে মনে হয়েছিল!
রানওয়ে ছবিতে বিষয়বস্তু এত কেন? ভাবনাটা নিয়ে অনেক নাড়াচাড়া করেছি, উত্তর যা পেয়েছি তাও সরল নয়। রানওয়ে সমকালীন বাংলাদেশ নিয়ে চলচ্চিত্র। সমকালীন বাংলাদেশে মানুষের জীবন অনেক বেশি জটিল, অনেক বেশি ব্যস্ত, অনেক বেশি সংগ্রামমুখর। নিম্নবিত্ত পরিবারগুলোতে একটু বয়স হলেই শিশুদের রোজগার করতে পাঠিয়ে দেওয়ার কারণও তো এই-ই। জীবনযুদ্ধ অনেক নির্মম ও নিষ্ঠুর। যদিও এত কঠিন ও জটিল হওয়ার কথা নয় এদেশের মানুষের জীবন। এদেশের মানুষের আরো একটু ভালো সহজ জীবন প্রাপ্য। কিন্তু দেশটি ষোলো কোটি মানুষের একটি বিশাল বাজার, যা বিশ্বায়িত ভুবনে লোভনীয়। ফলে একে নিয়ে আন্তর্জাতিক মহলে কাড়াকাড়ি আছে, আছে স্থানীয় রাজনৈতিক দেউলিয়াপনা এবং মানুষবিরোধী রাজনীতি। ফলে দেশটি একটি উন্মুক্ত ময়দানে পরিণত হয়েছে – যার কোনো নিয়ন্ত্রণকারী নেই। কোনো কর্তা নেই। ফলে অহর্নিশ লুটপাট এদেশে ঘটে চলেছে। ভুক্তভোগী – সব নিরীহ সাধারণ দরিদ্র মানুষ। যারা নিজেদের ভাগ্য ফেরানোর শত চেষ্টায় শতবার ব্যর্থ হয়, ব্যর্থতা তাদের নিয়তি বলেই মনে হয়! আর তাই এদেশের মেয়েরা হবে ‘বস্ত্রবালিকা’, ছেলেরা হবে মাদ্রাসাছাত্র। সন্তানদের পিতা হবেন দেশান্তরী। আর সন্তানদের মা হবেন সর্বজয়া। তিনিও নিরাপদ নন। এনজিও তাকেও খাবে। তারেক মাসুদ একটি পরিবারের গল্প বলতে চেয়ে বাংলাদেশের সকল প্রান্তিক পরিবারের গল্প বলেছেন। ছবির নাম বাংলাদেশ রাখতে গিয়ে রূপকার্থে হয়তো রানওয়ে রেখেছেন। নির্মাতাকে অভিনন্দন জানাই।

Leave a Reply