রবিউল হুসাইন
গুলশানের বেঙ্গল আর্ট লাউঞ্জে ভারতের স্বনামখ্যাত ভাস্কর কে এস রাধাকৃষ্ণণের ব্যতিক্রমী এক ভাস্কর্য প্রদর্শনী গত ৭ থেকে ২১ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত অনুষ্ঠিত হলো। তার মাধ্যম সব ব্রোঞ্জে এবং ছোট ছোট আকারের মধ্যে সীমাবদ্ধ। এগুলিকে টেবল্-টপ ভাস্কর্য বলা যায়, যেগুলি পরবর্তী সময়ে কোনো প্রতিষ্ঠান বা ব্যক্তির দেখে পছন্দ হলে বড় করে কোনো উন্মুক্ত স্থানে বা অভ্যন্তর পরিসরে স্থাপন করা যেতে পারে, এক বা একাধিক যেমন ইচ্ছে। ভাস্কর রাধাকৃষ্ণণ এমনই করেছেন সবার মতোই। তার বিশেষত্ব হচ্ছে, মানুষের একক এবং দলবদ্ধ উপস্থিতির মর্মকথা। তবে লক্ষ করা যায় সব মানুষের সমাবেশ নিয়ে তাঁর প্রধান চিন্তাভাবনা। এমনকি একজন মানুষের প্রতিকৃতিতে বিধৃত একটি ত্রিমাত্রিক মস্তকের ওপরেও নৌকো-ভর্তি একদল মানুষের বিভিন্ন গতি আর ভঙ্গিতে দৃশ্যমান উলে��ল অবস্থান। এসবে ভাস্কর মানুষের মধ্যে ঐক্য, শক্তি, সমতা, শ্রেণিমুক্তি, বৈষম্যহীন সর্বোপরি এক বহুত্ব, নানাত্ব বা একাধিকত্ব সমাজ ও পরিপার্শ্বের প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ ইঙ্গিত দিয়েছেন। শিল্পীর জন্যে মানুষকে নিয়ে এই পর্যবেক্ষণটিই মুখ্য ও প্রধান স্বপ্ন বলে প্রতীয়মান হয়। বহুমুখী বহুতলবিশিষ্ট মানুষের আকাঙ্ক্ষা ও দূরদৃষ্টির দিকে তাঁর শিল্পকর্মগুলো উৎসর্গীকৃত। কেরালাবাসী রাধাকৃষ্ণণ শান্তিনিকেতনের বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ে ভাস্কর্যশিল্প বিভাগের শিক্ষাপ্রাপ্ত ও ভারতের পথিকৃৎ আধুনিক ভাস্কর রামকিঙ্কর বেইজ এবং শর্বরী রায় চৌধুরীর প্রিয় ছাত্র। তাঁর ভাস্কর্যকর্মে গতি, প্রবহমানতা, পরিসরসংলগ্নতা, পরিসরশূন্যতা, পরিবেশবান্ধবতা ও সংঘবদ্ধতার সঙ্গে উপাদানের সংশি�ষ্টতা খুব স্পষ্টভাবে প্রকাশিত। ভাস্কর্যশিল্প এমন একটি শিল্পমাধ্যম, যেটির ভেতর দিয়ে ত্রিমাত্রিক দৈর্ঘ্য-প্রস্থ-উচ্চতার সঙ্গে বিষয়ের সামঞ্জস্যতা ও তার অন্তর্নিহিত রূপারূপ উপাদানের সঙ্গে বাস্তবায়িত হয় এবং দুটি শক্তিশালী অস্তিত্বের মুখোমুখি হয়ে পড়ে স্বয়ংক্রিয়ভাবে। এদের একটি হচ্ছে পরিসর-পরিবেশ-পারিপার্শ্বিকতা আর একটি সময় বা কাল। তাঁর সৃষ্টি ব্রোঞ্জের সরু শলাকায় এবং যেগুলো বিমূর্ত অভিব্যক্তিতে কিন্তু বাস্তব মূর্ততায় বিভিন্ন গতিশীলতা, মুদ্রা ও শরীরচর্চা ভঙ্গিতে উপস্থাপিত। স্থানীয় দেব-দেবী বা অবতার পূজনীয় মুসুই ও মাইয়া প্রভাবিত দর্শন-মনোভাব তাঁর কর্মে উলে�খ্য, যা তাঁর দেশে খুব প্রচলিত। সেই হিসেবে তিনি নিজস্ব পরিচয় নিয়েই সার্বিকভাবে ভাস্কর্যশিল্পটিকে নিজের মতো গড়ে তুলেছেন, যা একইসঙ্গে আধুনিক ও লৌকিক। শিল্পে, বিশেষ করে সাম্প্রতিক শিল্পচর্চায় বিশ্বায়নের সঙ্গে দৈশিক, আধুনিকতার সঙ্গে লোকসংস্কৃতি আর উন্নয়নের সঙ্গে সংরক্ষণ এইসব দ্বন্দ্ব, বিরোধিতা, সংঘাত বা সংঘর্ষ থাকবে এবং তা চলবেই। এই জটিলতার মধ্যে থেকেই সরলতা খুঁজে পেতে হবে, এটি বর্তমানে সব দেশের শিল্প ও শিল্পীর মধ্যে, বিশেষ করে যেসব দেশ একদা ঔপনিবেশিক শাসনের অধীনে ছিল তাদের জন্যে সম্মুখ সমরে অবতীর্ণ হয়ে নিজের পথে স্বাধীনভাবে চলার একাগ্রতা অর্জন প্রক্রিয়া। শিল্প কোনো সংঘাতের সমাধান দিতে পারে না। শিল্প ও শিল্পীর কাজ সুবোধকে জাগরিত করা এবং যেসব তার সৃষ্টকর্মের মধ্যেই লুকোনো থাকে, দর্শকদের সেটি খুঁজে নিয়ে গ্রহণ করতে হবে এবং সেভাবেই নিবিষ্ট হতে হবে ও জীবনাচরণে কাজে লাগাতে হবে।
রাধাকৃষ্ণণের মাথায় নৌকোতে দেখা যায় নৌকোর মধ্যে অনেক মানুষের গতিময় সংঘবদ্ধ চলাচল। তারা হয়তো শূন্যে উড়ে যাচ্ছে কিন্তু সবাই সবার হাত ধরে, নৌকোর ভেতর থেকে উৎসারিত একীভূত হয়ে এক একক অবস্থায় এবং নৌকোটি সবসহ একজনের মুন্ডিত মস্তকে উপস্থাপিত। বিষয়টি থেকে অনেক ভাবনার জন্ম হয়, বাস্তবমুখী অতিবাস্তবতায় চিন্তাগুলো বিস্তার লাভ করে নানান দিকে, নানান আঙ্গিকে। এখানেই ভাস্করশিল্পীর সাফল্য যে তিনি অনেক অনুভব, বোধ ও দৃষ্টির জন্ম দিতে পেরেছেন, যা বহু অর্থ, বিনিময় আর চাহিদাসম্পন্ন এমন বলা যায়। এরকম দেখা যায় অন্তর্গত সংঘাত – একটি বাঁকানো পাত্রের গহবরে দলবদ্ধ মানুষ; রেলিংয়ে বহমান বাতাস – ওপর দিয়ে সেই ছুটন্ত মানুষের সংঘবদ্ধ উড়ে চলা; অবতীর্ণ মানুষের মিছিল; একটি বৃত্তায়িত কেন্দ্রে সবার মিশে যাওয়া; এরকমই ঘনক কেন্দ্রে; বিশ্বব্যাপী উদ্বাস্ত্ত – মানুষ পৃথিবীর মানচিত্রের উপরিভাগে সংঘবদ্ধ ভঙ্গিতে গতিময়; একটি মাথা মানুষের বয়নজালে গ্রথিত; দেয়ালে মানুষের বাক্স প্রোথিত; মেঘের বিস্ফোরণের মধ্যে মানুষের দল এবং তাকিয়ে ঊর্ধ্বপানে বড় আকারের পুরুষ মুসুই অবাক নয়নে; মানুষের বাক্স-২; ঢালু পথে মুসুইয়ের পৃথিবী উড্ডয়ন; মানুষের জালে একটি বাতি নিমজ্জিত; মুসুই এক মানুষের জালে; পাক খাওয়া বাতাস; জলসিক্ত বাড়ি ইত্যাদিতে। মানুষের একত্রিত শক্তি যে-কোনো বিরূপ অবস্থার মুখোমুখি হয়ে নির্দিষ্ট লক্ষ্যে পৌঁছে দিয়ে জয়লাভে সাহায্য করে। ভাস্কর সেই অন্তর্নিহিত বাণীটি যা ইতিবাচক এবং স্বপ্ন দেখানোর পথে যেতে উৎসাহিত করে, সবার কাছে তাঁর সৃষ্টির মাধ্যমে বলতে চান। এখানে সংগঠিত রূপটিই প্রধান এবং গুরুত্বপূর্ণ। এর পাশাপাশি রাধাকৃষ্ণণ আর একটি বিশেষ রূপ ফুটিয়ে তুলেছেন, সেটি হচ্ছে এককভাবে শারীরবিদ্যা বা ব্যায়াম কিংবা খেলোয়াড়ি ভঙ্গিতে নারী মাইয়ার সুললিত দেহভঙ্গি বিভিন্ন প্রকার ও দৃষ্টিনন্দন বাঁকে স্থাপন। এমনিভাবে এক হাতে ভর করে সম্পূর্ণ শরীর সমান্তরাল দিগন্তে আবার শূন্যের মধ্যে মাইয়া। আবার পুরুষ মুসুইয়ের কাঁধে নারী মাইয়ার উড়ন্ত নৃত্যনির্ভর মুদ্রায় এই নির্ভারমুখী দ্বৈত ভঙ্গি একে অপরের প্রতি পরিপূরকতা, বিশ্বাস ও ভারসাম্যতার বিষয়গুলো খুব প্রণিধানযোগ্য। যেরকম বায়ুশাসিত পুরুষহীন পরিবেশে একক এক হাতে নির্ভর করে স্বাধীন স্বশাসিত আত্মবিশ্বাসী নারী মাইয়া খুব দৃষ্টিনন্দনরূপে প্রতিভাত। মুসুই আর মাইয়া পুরুষ ও নারী সব প্রেমিকা-প্রেমিকের স্থায়ী প্রতিনিধিরূপে সর্বকালের সবার হয়ে দুজনে খেলায় মেতেছে, আনন্দে উদ্ভাসিত, জীবনের জয়গানে উদ্বেলিত এবং সেই সুবর্ণ বহু আকাঙ্ক্ষিত সময়টা যৌথভাবে দুজনে উপভোগ করছে।
এখানে ভালোবাসা আর শান্তি, সবার শেষে এটাই কাম্য। তাই রাধাকৃষ্ণণ তাঁর ভাস্কর্য আয়োজনের নাম দিয়েছেন ‘অন্তর্গত দ্বন্দ্বে মানুষের আরোহণ-অবরোহণ’।
বস্ত্তত সারা বিশ্বব্রহ্মান্ড আদিকাল থেকে এখন পর্যন্ত এভাবে সংঘর্ষ -সংঘাতের মধ্য দিয়ে চলেছে, চলছে এবং চলবে। কিন্তু পরিশেষে শুভবোধ, ন্যায়পরায়ণতা, সততা ও বিশ্বাসই জয়ী হতে উদ্বুদ্ধ করে।
যে-কোনো শিল্পে রূপবদ্ধতা, প্রমাণাদি, ভাব, সামঞ্জস্যতা, বর্ণনা ও সর্বোপরি লাবণ্য-সুষমা প্রধান হয়ে বিচারকের ভূমিকা পালন করে। সমাজের প্রতি শুভ ও শ্রেয়তা, কল্যাণ ও শান্তি, সুখানন্দ ও সৌন্দর্য আনয়নের জন্য শিল্পী ও ভাস্করের একটি দায়বদ্ধতা আছে। সেই লক্ষ্যে ভাস্কর রাধাকৃষ্ণণের ভাস্কর্য সবাইকে নিয়ে একতাবদ্ধ হয়ে বৈরী পরিবেশের বিরুদ্ধে নির্দিষ্ট লক্ষ্যসহ সৎ উদ্দেশ্যে এক ইতিবাচক গঠনমূলক সংগ্রামে নিয়োজিত হতে হবে এবং এভাবেই মানুষের জন্যে জয় অবশ্যই সেই শিক্ষা দেয়।