logo

রাত্রির আবরণ – চিত্রভানু মজুমদারের অবিস্মরণীয় প্রদর্শনী

মৃ ণা ল  ঘো ষ

রাত্রির আবরণ ছড়িয়ে থাকে চাপ চাপ অন্ধকারের ভেতর। গ্যালারির সাতটি কক্ষজুড়ে এই অন্ধকার। অন্ধকার ভেঙে ভেঙে মাঝে মাঝে আলোর আভাসও সঞ্চারিত হয়। আলো ও অন্ধকারের এক দমবন্ধ করা জটিল আবহ তৈরি হয়। সেখানে সময়ের কোনো নির্দিষ্ট পরিসীমা নেই। সীমাহীন অসংজ্ঞায়িত সময়। আর সেই সময় অন্ধকার দিয়ে মোড়া। রাত্রির আবরণ দিয়ে মোড়া। সেই রাত্রি ভেদ করেই একসময় উৎসারিত হয় আলো। সূর্য ওঠে। হাওয়া দেয়। পাখি ওড়ে। সমুদ্রের ঢেউ আছড়ে পড়ে তটভূমিতে। কল্লোলিত হয়ে ওঠে প্রভাত।

অন্ধকার ভেদ করে, রাত্রির আবরণ ভেদ করে আলোরও ইশারা এনেছেন চিত্রভানু মজুমদার। কলকাতার হ্যারিংটন স্ট্রিট বা হো চি মিন সরণির হ্যারিটন ম্যানসনের দুটি তলের সাতটি কক্ষজুড়ে ৯ থেকে ২৫ ফেব্র“য়ারি (২০১২) অনুষ্ঠিত হলো তাঁর বিরাট মাপের একক প্রদর্শনী। ছবি ছিল। ভাস্কর্য ছিল। এসব ছাপিয়ে ছিল বিরাট বিরাট ইনস্টলেশন। কক্ষের চার প্রান্তের দেয়ালজুড়ে ছিল চলচ্চিত্রধর্মী ভিডিওর প্রজেকশন। আলোকচিত্রকে ডিজিটাল প্রিন্টে রূপান্তরিত করে আনা হয়েছিল দেশের মাটি, মানুষ ও প্রকৃতির নানা আখ্যান। জীবন ও মৃত্যুর টানাপড়েন। আর ছিল সংগীত ও ধ্বনির বিচিত্র আবহ। যার ভেতর দিয়ে আজকের এই সময়কে তুলে আনতে চেষ্টা করেছেন শিল্পী। এই সময়ের বিশ্বজোড়া সন্ত্রাস, যা শুধু আর এই সময়ের মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়। সময়হীনতায় পরিব্যাপ্ত। এই হিংসা, সন্ত্রাস, মৃত্যু ভেদ করেও সূর্য ওঠে। পাখি ওড়ে। সমুদ্রের ঢেউ কল্লোলিত হয়ে তীরে আছড়ে পড়ে। রাত্রির গভীর থেকে জেগে ওঠে প্রভাত। এই উজ্জীবনের ধ্বনি চিত্রভানুর এবারের কাজকে বিশেষ মাত্রা দিয়েছে।

সমগ্র প্রদর্শনীটির শিরোনাম দিয়েছেন শিল্পী ‘আনডেটেড : নাইটস্কিন’। সময়ের সীমা ছাড়ানো রাত্রির আবরণ। চিরদিনই চিত্রভানু রাত্রির দ্বারা তাড়িত হয়েছেন। অন্ধকারের গভীর থেকে আলোর সন্ধান করেছেন। আলো-অন্ধকারের দ্বৈত গোড়া থেকেই ছিল তাঁর ছবির বিশেষ এক মাত্রা। ১৯৮০-র দশক থেকে ভারতবর্ষজুড়ে যেসব শিল্পী প্রতিবাদী শিল্পধারা নিয়ে নিমগ্ন কাজ করে যাচ্ছেন চিত্রভানু মজুমদার তাঁদের অন্যতম প্রধান। তাঁর জন্ম ১৯৫৬-তে। ১৯৮০-র দশকের মাঝামাঝি কলকাতার গভর্নমেন্ট আর্ট কলেজ থেকে চিত্রকলায় স্নাতক হয়েছেন। তাঁর পারিবারিক উত্তরাধিকার খুবই সমৃদ্ধ। তাঁর বাবা নীরদ মজুমদার ১৯৪০-এর দশকে প্রতিষ্ঠাপ্রাপ্ত অত্যন্ত বড়মাপের একজন শিল্পী। নীরদ মজুমদারের দাদা কমল মজুমদার ব্যতিক্রমী রীতির একজন প্রখ্যাত সাহিত্যিক। ছবিও এঁকেছেন নিয়মিত। শিল্পী হিসেবে যথেষ্ট খ্যাতির অধিকারী। তাঁদের পারিবারিক উত্তরাধিকারে আধ্যাত্মিকতার একটা আবহ ছিল। ধর্ম ও ঈশ্বরে গভীর বিশ্বাস ছিল। নিজের চিত্রকলায় নীরদ মজুমদার জীবনের প্রথম পর্বেই ফরাসি সংযোগ গড়ে তুলেছিলেন। শিখতে গিয়েছিলেন প্যারিসে। সেই সূত্রে আত্মস্থ করেছেন ফরাসি ইম্প্রেশনিস্ট ও পোস্ট-ইম্প্রেশনিস্ট আঙ্গিক। নিজের ছবির আধ্যাত্মিকতাকে বিস্তৃত করেছেন সেই আঙ্গিকের মধ্য দিয়ে। আলো-ছায়ার বিন্যাসে বর্ণের জ্যামিতির এক বিশেষ ধরনের মধ্য দিয়ে উদ্ভাসিত হতো তাঁর আন্তরচেতনা। ১৯৮০-র দশকের মাঝামাঝি থেকে চিত্রভানু যখন শুরু করেছিলেন তাঁর নিজস্ব রীতির ছবি, তখন সেই বর্ণের জ্যামিতি, সাদা-কালোর মরমি বিন্যাসের কিছু আভাস তাঁর ছবিতেও ছিল। সেই আঙ্গিক-আবহ দ্রুত রূপান্তরিত হয়েছে তাঁর ছবিতে। নীরদ মজুমদারের স্ত্রী মার্গারেট একজন বিদুষিনী, শিল্প ও সংস্কৃতিমনস্ক ফরাসিনী।

জন্মসূত্রে ভারতীয় তথা বাঙালি ও ফরাসি – এই দুটি উত্তরাধিকার নিয়ে বিকশিত হয়েছে চিত্রভানুর শিল্পচেতনা। জাতীয়তার গণ্ডি ছাড়িয়েআন্তর্জাতিকতাতেই অভিষিক্ত করেছেন তিনি তাঁর নিজস্ব প্রকাশ।

১৯৯০-এর দশক থেকে চিত্রভানুর ছবিতে ভাবনা ও আঙ্গিক পরিবর্তিত হতে থাকে। সেই সময় থেকে একই সঙ্গে বিশ্বায়ন ও উত্তর-আধুনিকতার ঢেউ এসে পৌঁছায় আমাদের দেশের সংস্কৃতির পরিমণ্ডলে। বিশ্বায়ন বাস্তবতার ওপরও আনে জোরালো অভিঘাত। সেই অভিঘাতের প্রতিক্রিয়ায় শিল্পকলার ক্ষেত্রে ঘনীভূত হয় প্রতিবাদের আবহ। সেই প্রতিবাদকে সংহত করতে গিয়ে প্রকাশের ভাষাও পালটে যেতে থাকে। উত্তর-আধুনিকতার দর্শন ও নান্দনিকতা প্রগাঢ়ভাবে প্রভাবিত করে এখানকার শিল্পীদের। এতদিন পর্যন্ত চিত্রভাস্কর্যের যে আঙ্গিকের চর্চা চলছিল, সেই আঙ্গিক দিয়ে ১৯৯০-দশক পরবর্তী বিশ্বায়িত বাস্তবতাকে আর প্রকাশ করা যাচ্ছিল না। ফলে উদ্ভাবিত হলো বিকল্প পদ্ধতি, বিকল্প আঙ্গিক। অলটারনেটিভ আর্ট বা ‘কাটিং-এজ আর্ট’ নামে যা এখন পরিচিত। শুধুমাত্র চিত্রের দ্বিমাত্রিকতায় বা ভাস্কর্যের ত্রিমাত্রায় এই বাস্তবতাকে সম্পূর্ণ প্রকাশ করা যাচ্ছিল না। সময়ের চতুর্থ মাত্রাকেও কাজে লাগানো প্রয়োজন হয়ে পড়ল। যান্ত্রিক, বৈদ্যুতিক ও বৈদ্যুতিন প্রযুক্তির ব্যবহার শিল্পকে করে তুলল বহুমাত্রিক। আলোকচিত্র, ডিজিটাল প্রিন্ট, কম্পিউটার প্রযুক্তি, চলচ্চিত্র, শরীরী অভিনয়, নৃত্য, মূকাভিনয় ইত্যাদি সমস্তই হয়ে উঠল এই কনসেপচুয়াল আর্ট বা বিকল্প শিল্পরীতির গুরুত্বপূর্ণ হাতিয়ার। ইনস্টলেশন, ভিডিও, পারফরম্যান্স ইত্যাদি বহুমাত্রিক আঙ্গিক নিয়ে নানা রকম পরীক্ষা-নিরীক্ষা চলতে লাগল। অনেক সময়ই তা হয়ে উঠতে থাকল পাশ্চাত্যের প্রতিফলন বা অনুকরণ। তবু এর মধ্যেই দেশীয় বাস্তবতার সঙ্গে ও ঐতিহ্যের সঙ্গেও সংযোগ স্থাপন করতে চেষ্টা করেছেন অনেক শিল্পী। পাশাপাশি প্রথাগত চিত্রভাস্কর্যের চর্চাও চলছে দেশজুড়ে। কিন্তু বিকল্প মাধ্যমের ঢেউ সেখানেও কিছু পরিবর্তন এনেছে।

এই বিকল্প রীতি নিয়ে যাঁরা অত্যন্ত গুরুত্বের সঙ্গে নানা রকম পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে আসছেন, চিত্রভানু মজুমদার তাঁদের মধ্যে অন্যতম প্রধান। কবিতা, সংগীত, ধ্বনি, অভিনয়, যান্ত্রিক নির্মাণ, আলোর বিভিন্ন উদ্ভাবনময় ব্যবহার, বৈদ্যুতিন প্রযুক্তি, কম্পিউটার প্রযুক্তি, আলোকচিত্র, ডিজিটাল প্রিন্ট, চলচ্চিত্র ইত্যাদি সমস্ত রকম শিল্প ও প্রযুক্তি মাধ্যমকে স্বচ্ছন্দে ব্যবহার করে তিনি গড়ে তোলেন তাঁর শিল্প। আলোচ্য প্রদর্শনীতে এ সমস্ত প্রযুক্তি ও কারিগরির যে বিপুল ব্যবহার – তা তাঁর পূর্ববর্তী সমস্ত কাজকে ছাপিয়ে গেছে। প্রায় পাঁচ বছরের পরিশ্রমে গড়ে তোলা এই প্রদর্শনীতে ইলেকট্রনিক প্রযুক্তির সঙ্গে মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিংকেও যে দক্ষতায় ব্যবহার করেছেন, সে রকম আমাদের দেশে খুব বেশি দেখা যায়নি এর আগে।

আমরা ‘নাইটস্কিন’ প্রদর্শনীর বিস্তৃত আলোচনায় যাওয়ার আগে চিত্রভানুর পূর্ববর্তী একটি ইনস্টলেশন-পারফরম্যান্স প্রদর্শের একটু বিশদ আলোচনা করব, যা থেকে শিল্পীর পূর্ববর্তী প্রকাশের ধরন কিছুটা অনুধাবন করা যাবে। ১৯৯৯-এর অক্টোবরে কলকাতার শেক্সপিয়ার সরণির একটি ভবনে অনুষ্ঠিত এই প্রদর্শনীটি একটি যৌথ প্রয়াস। চিত্রভানু করেছেন ইনস্টলেশন। আর সেই ইনস্টলেশনের পরিমণ্ডলে স্বরচিত কবিতা অভিনয় করেছেন ‘পদাতিক’গোষ্ঠীর বিনয় শর্মা।

বড় কক্ষজুড়ে একটিই মাত্র কাজ। দুপাশের ছাদ থেকে মেঝে পর্যন্ত ত্রিপল ঝোলানো। এই প্রেক্ষাপটে বিভিন্ন ভঙ্গিতে পুঞ্জিত রয়েছে, বেলনাকার মোটা পাইপের মতো নরম ও দীর্ঘ কিছু বস্তু। কাপড়ের খোলের ভেতর নরম পলিফাইবার ভরে তৈরি হয়েছে এগুলো। সাদা, লাল, হলুদ ও বেগুনি – এই চারটি রঙের পাইপগুলো কোথাও কুণ্ডলী পাকিয়ে রয়েছে। কোথাও আলম্বভাবে ঊর্ধ্বোত্থিত হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। কোথাও জড়িয়ে ওপরে উঠে উত্তুঙ্গ পাহাড় তৈরি করেছে। সে রকমই এক উত্তুঙ্গ অবস্থানের ওপর হাত-পা ছড়িয়ে পড়ে আছে কালো পলিথিনে তৈরি যেন মৃত এক মনুষ্য-অবয়ব। ধ্বনির সহযোগে আলো আবর্তিত হয়। অন্ধকারের এই পরিমণ্ডলকে সরীসৃপ বা কৃমি-কীটের জগৎ বলে মনে হয়। এই সমগ্র বিমূর্ত অবিন্যস্ত পরিমণ্ডলে সরীসৃপ-পুঞ্জিত টিলার ওপর অবস্থিত মৃত মনুষ্য শরীরটিই একমাত্র মূর্ত, মৃত্যুর প্রতীক হয়ে ওঠে। যখন প্রকট হয় মানুষের লোভ, মানুষের পাপ, তখন তা এই সভ্যতাকে এক মৃত্যুময় অন্ধকার গহ্বরে নিয়ে যায়। বিনয় শর্মার কবিতার ভেতর দিয়ে এই বিবমিষাদীর্ণ পরিমণ্ডলের একটি ভাষ্য উঠে আসে একবার। ‘we are  cosmic worms in his excrement’ –  এরকম শব্দকল্প একটি অর্থের আভাস দিয়েই অর্থান্তরে চলে যায়। কেননা বিনয়ও জানেন, কোনো নির্দিষ্ট অর্থের রুদ্ধতায় (Bondage of meaning) আটকে থাকতে পারে না কোনো শিল্প-পরিস্থিতি বা জীবন-পরিস্থিতি। তাই কবিতায় একটির পর একটি পৃষ্ঠা উলটে যান তিনি। সরে যেতে চান পরিবৃত সরীসৃপের অর্থ থেকে অর্থান্তরে (‘to run from the meaning of snakes’)। অন্ধকারে নির্মাণের সমগ্র পরিমণ্ডলের ওপর প্রজেক্টর থেকে বিচ্ছুরিত হতে থাকে একটির পর একটি স্লাইড। কিন্তু শেষ পর্যন্ত কোনো অর্থের নির্দিষ্টতায় কি পৌঁছনো যায়? সব অর্থই অর্থান্তরিত হয়ে পৌঁছায় নৈরাজ্যে এসে, যেখান থেকে শুরু হয় আবার নতুন অন্বেষণ।

এই প্রকল্পে উত্তর-আধুনিক দর্শনের দিকে ঝোঁক ছিল বেশি। অনেক বেশি পরিব্যাপ্ত ছিল নিরাশা। কোনো সিদ্ধান্তের নির্দিষ্টতায় পৌঁছানোর অভিপ্রায় বা প্রবণতা ছিল না। এই কাজের পর বারো-তেরো বছর অতিক্রান্ত হয়েছে। আমাদের দেশে উত্তর-আধুনিকতার অভিঘাতের ধরন অনেক পালটেছে। পরিবর্তন এসেছে চিত্রভানুর জীবনভাবনাতেও। তাঁর প্রতিবাদী চেতনার প্রগাঢ়তা অবশ্য কমেনি একটুও। কিন্তু রাত্রির আবরণ ভেদ করে এখন মাঝে মাঝে আলোর আভাস আসছে। উদ্ভাসিত হচ্ছে সুন্দরের মুখ। এখন নির্মাণের নন্দনই গুরুত্ব পাচ্ছে বেশি। আখ্যানের কোনো নির্দিষ্টতার আভাসের দিকে যাচ্ছে না তা। তবু অন্ধকারের উৎস থেকে উৎসারিত হচ্ছে যে আলো, তার সত্যতাও পাচ্ছে বিশেষ এক মাত্রা। অন্ধকার, ধ্বংস, মৃত্যুর তমিস্রা আছে। তবু জীবনের প্রবহমানতাও বিনষ্ট হয়ে যায়নি। ‘মানুষের মৃত্যু হলে তবুও মানব থেকে যায়’ – এই বিশ্বাসে এখন যেন অনেকটাই স্থিত হতে পারছেন শিল্পী।

‘নাইটস্কিনে’ চিত্রভানু আলো-অন্ধকারের দ্বন্দ্বকে তুলে ধরেছেন। নিরাশা থেকে আশায় উত্তরণের সম্ভাবনা খুঁজেছেন। বিভিন্ন পর্যায়ে যে দৃশ্যভাষা ব্যবহৃত হয়েছে এখানে তার কোনো একক রূপ নেই। তা বহুমুখী।

বহুধাবিস্তৃত। সে প্রসঙ্গে আমরা একটু পরে আসব। তার আগে এই ভাষার এককটিকে একটু অনুধাবনের চেষ্টা করা যেতে পারে।

এই প্রদর্শনীর স্মারকপত্রের ভূমিকা লিখেছেন প্রখ্যাত বিদুষী

উত্তর-আধুনিকতার বিশিষ্ট তাত্ত্বিক গায়ত্রী চক্রবর্তী স্পিভাক। তিনি এই ভাষার একককে বলেছেন ‘trace’। ‘Trace’-এর দার্শনিক ব্যাখ্যা করেছেন প্রজ্ঞাদীপ্তভাবে। কাকে বলে ‘Trace’? গায়ত্রী বলছেন, ‘It is not an Ôisness’. এর কোনো বিশিষ্ট অর্থ নেই। ‘A trace does not promise aûthing’. আন্তনিও গ্রামসির অনুসরণে বলেছেন, শুধু কিছু আভাস দিতে পারে ‘trace’, যেমন বনপথে হাতির বিষ্ঠা পড়ে থাকলে আভাসিত হয়, আগে কখনো হাতি গিয়েছিল এ পথে। তাই এই সিদ্ধান্তে পৌঁছে দেন গায়ত্রী – ‘A trace is not … a sign’. ‘Trace’ কোনো ‘চিহ্ন’ নয়। ‘Trace’-এর বাংলা যদি করি আমরা ‘সংকেত’, তাহলে ‘সংকেত’ ও ‘চিহ্নে’র মধ্যে এক ধরনের দ্বৈত তৈরি হয়। আমরা কি বলতে পারি ‘সংকেতে’র নিভৃত রসায়ন থেকেই গড়ে ওঠে ‘চিহ্ন’? আর একাধিক চিহ্নের পারস্পরিক ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়ায় আভাসিত হয় ‘প্রতিমাকল্প’ বা ‘image’। আবার ‘প্রতিমাকল্প’ পরস্পরে সম্পৃক্ত হয়ে গড়ে তোলে সামগ্রিক ‘রূপ’ বা ‘form’। কাজেই ‘ঃৎধপব’ বা ‘সংকেত’ হতে পারে ক্ষুদ্রতম একক। যেমন বস্তুর বা শরীরের ক্ষুদ্রতম একক ‘atom’ বা ‘cell’। বিচ্ছিন্ন করে দেখলে তার কোনো স্বতন্ত্র পরিচয় নেই। গায়ত্রীর ভাষায় ‘isness’ নেই। যেমন কবিতায় একেকটি ‘অক্ষর’। কিন্তু তবু তাদের অনিবার্যতা বা উপযোগিতা প্রশ্নাতীত।

চিত্রভানুর কাজের সমগ্রতায় পৌঁছতে হলে যে এই ‘trace’ বা সংকেত থেকে শুরু করতে হয় বা শুরু করতে চেয়েছেন গায়ত্রী, তার কিছু কারণ আছে।  আর সেই কারণের মধ্যেই নিহিত থাকে তাঁর এবারের রচনাগুলোর বৈশিষ্ট্য বা স্বাতন্ত্র্য। আমরা একটি কাজের নিবিষ্ট অনুধাবনের মধ্য দিয়ে সেটা বুঝতে চেষ্টা করব।

সেই রচনাটিতে পৌঁছনোর আগে আমরা সমগ্র প্রদর্শনীর আবহটিকে একটু দেখে নেব। হ্যারিংটন স্ট্রিটে যে ভবনের দুটি তলজুড়ে হচ্ছিল প্রদর্শনী সেটি ব্রিটিশ যুগের ভিক্টোরিয়ান স্থাপত্যের দৃষ্টান্ত। ঔপনিবেশিক সম্ভ্রান্ততার কিছু স্মৃতি এখনো রয়ে গেছে সেই স্থাপত্যে। বাইরে থেকে সেই ভবনে প্রবেশের মুখ থেকেই প্রদর্শনীর আবহ শুরু হয়ে যায়। আমরা শুনতে পাই একটি সংগীতধ্বনি। ১৯৬৬-র একটি জনপ্রিয় ফিল্ম লাভ ইন টোকিওর আবহসংগীত বাজতে থাকে। তা ভেসে আসে একটি বিশালকায় ধাতব যন্ত্রের ভেতর থেকে। ‘আইসক্রিম ফ্যাক্টরি চিল টিউবস’নামে আইসক্রিম তৈরির একটি যন্ত্র দিয়ে তিনি একটি ইনস্টলেশন করেছিলেন। সেটি কলকাতায় দেখানো হয়েছিল বছর দুয়েক আগে একটি প্রদর্শনীতে। চিল টিউবসের ভেতর থেকে ভেসে আসছিল সেই ধ্বনি। সেই ইনস্টলেশন এখানে রাখা ছিল নিচতলায় গ্যালারিতে প্রবেশপথের মুখে। তা থেকে নির্ধারিত হচ্ছিল লাভ ইন টোকিও ফিল্মের আবহসংগীত। সমগ্র প্রদর্শনীর আবহে ধ্বনিত হচ্ছিল তা। ১৯৬০-এর দশকের এক ধরনের রোমান্টিক আবহের ভেতর দিয়ে আমরা এই প্রদর্শনীতে প্রবেশ করি, যেখানে ছড়িয়ে আছে একবিংশ শতকের রাত্রির আবরণ।

দ্বিতলে উঠে একটি বড় কক্ষে প্রবেশ করি আমরা। প্রদর্শনীর একটি গুরুত্বপূর্ণ কাজ রয়েছে সেই কক্ষজুড়ে। এই কাজটির ভেতর দিয়েই আমরা ‘রাত্রির আবরণ’-এর মূল ভাবনাকে অনুধাবন করতে পারব। বুঝতে পারব ‘trace’ ও ‘sign’ বা সংকেত’ ও ‘চিহ্নে’র পারস্পরিক সম্পর্কও। এই প্রদর্শের মূল ভাবনাকে বোঝাতে শিল্পী ব্যবহার করেছেন কবিতাধর্মী কিছু শব্দ। সেটা পড়ে নিলে আমাদের বুঝতে সুবিধা হয় প্রদর্শের মূল ভাবনা।  ‘Liberated alike from chronology of time and groundedness of geographical space; from the imperatives of history and timetable of memory; these free frames float, barely tethered, in their own reality’. তারপর মাধ্যম হিসেবে লেখা আছে – Suspended self lit metal boxes with digital prints. রচনাকাল ২০০৭।

অনেকটা বিস্তৃত এই কক্ষজুড়ে ছড়ানো রয়েছে অন্ধকার। রাত্রির আবরণ। সেই অন্ধকারের  চরিত্রকে প্রগাঢ় করতে তার ভেতর ছড়ানো রয়েছে উৎসবিহীন রহস্যময় আলো। সেই আলোয় আমরা দেখি কক্ষের এ-প্রান্ত থেকে ও-প্রান্ত পর্যন্ত সারিবদ্ধভাবে ছাদ থেকে ঝোলানো রয়েছে ইস্পাতের তৈরি মাঝারি মাপের অজস্র বাক্স। তার প্রতিটিতে লোহার দরজা রয়েছে দুপাল্লার। সেগুলো খোলা যায়। বন্ধ করা যায়। দর্শক নিজ হাতে খুলে দেখতে পারেন। খুললে দেখা যায়, সেই প্রকোষ্ঠের ভেতর রয়েছে ডিজিটাল প্রিন্টের একটি ছবি। ভেতরে যে অল্প আলো তাতে দৃশ্যমান ছবিটি। এরকম প্রতিটি প্রকোষ্ঠে রয়েছে আলাদা আলাদা ছবি। আলোকচিত্র থেকে ডিজিটালে রূপান্তরিত। তার কোনো কোনোটিতে দেখা যায় নিসর্গের টুকরো টুকরো অংশ। ঝাড়খণ্ডের নিসর্গ। ওখানকার রিখিয়ার সঙ্গে নীরদ মজুমদারের নিবিড় সম্পর্ক ছিল। বাড়ি ছিল তাঁর। এখনো আছে। সেই সূত্রে চিত্রভানুরও সংযোগ আছে রিখিয়ার সঙ্গে সেই ছেলেবেলা থেকে। সেখানকার শুষ্ক আবহের অজস্র আলোকচিত্র ব্যবহার করেছেন এই প্রদর্শনীতে।

হঠাৎই আমরা দেখে চমকে উঠি, পাথুরে জমিতে শুকনো ঘাসের ওপর শায়িত একটি রক্তাক্ত মৃত গো-জাতীয় পশু। মৃত্যু ছলকে ওঠে। একটি গাছের গুঁড়ি। সেটিকেও মৃত পশু মনে হয়। শুকনো পাতা ঝড়ানো থাকে। পড়ে আছে একটি মেয়ের মুখ। মৃত্যুলীন। এরকম অজস্র ডিজিটাল ছবি স্তব্ধ হয়ে আছে ঝুলন্ত প্রকোষ্ঠের ভেতর। এই যে ইস্পাত-প্রকোষ্ঠের ভেতর একেকটি ছবি, এগুলো একেকটি একক। যাকে বলা যেতে পারে ‘trace’ বা সংকেত। আলাদাভাবে এর হয়তো কোনো ‘isness’ নেই। কিন্তু পরস্পর গ্রথিত হয়ে তারা sign বা চিহ্নের দিকে অগ্রসর হয়। চিহ্নের সমবায়ে গড়ে ওঠে একটি আবহ। সেই আবহ বিশুষ্ক প্রকৃতির। সন্ত্রাসের। মৃত্যুর। তার ভেতরই হঠাৎ জেগে ওঠে কালীমূর্তি। পুরাণকল্পের সঙ্গে যুক্ত হয়ে যায় মৃত্যুলীন পরিমণ্ডল। সাম্প্রতিকের ভেতর আদিমতার অনুপ্রবেশ ঘটে। রাত্রির আবরণময় এই যে একটি পরিসর, সহসা এটি ঝঙকৃত হয়ে ওঠে। কক্ষের একেবারে শেষ প্রান্তে রয়েছে মৌচাকসদৃশ একটি দৃশ্য-প্রতিমা। অজস্র ঘুঙুর দিয়ে তৈরি তা। দর্শক যখন দাঁড়িয়ে দেখেন ইস্পাতের ঝুলন্ত প্রকোষ্ঠে সাংকেতিক আলোকচিত্রগুলো আর মৃত্যুময় আঁধারলীনতার পরিমণ্ডলকে অনুধাবন করেন, তখন সহসা ঝমঝম করে বেজে ওঠে সেই সমবেত ঘুঙুরের ধ্বনি। ধীরে শুরু হয়ে উচ্চতায় পৌঁছায়, তারপর আবার ধীরে ধীরে শমিত হতে হতে নিঃশব্দতায় মিলিয়ে যায়। এই ধ্বনির ভেতর থেকে স্পন্দিত হয় সনাতন এই দেশ। অতীত এসে মিশে বর্তমানে। পুরাণকল্প জারিত করে বর্তমানের বাস্তবতাকে বুঝতে চান শিল্পী। আন্তর্জাতিক বা পাশ্চাত্য-অধ্যুষিত এই আঙ্গিক-প্রকল্পের ভেতর খুব সন্তর্পণে মিশে যায় দেশীয় ঐতিহ্যের বাতাবরণ, স্বদেশ ও বিশ্বের সমন্বয়ের ভেতর দিয়েই চিত্রভানু সামগ্রিক রাত্রির আবরণ বিশ্লেষণ করেন।

দ্বিতলের অন্য প্রকোষ্ঠেও রয়েছে আরেকটি ইনস্টলেশন। সেটির শিরোনাম ‘চেম্বার অব নাইট’। একই রকম মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে তৈরি স্টিল স্ট্রাকচারের নানা এককে গড়ে উঠেছে সেই প্রদর্শ। তার বিশদ আলোচনায় যাচ্ছি না আমরা। আমরা বরং উঠে যাই তৃতীয় তলে। সেখানে বিভিন্ন প্রকোষ্ঠে রয়েছে বিভিন্ন প্রদর্শ। কোনোটি চিত্রধর্মী। কোনোটি ভাস্কর্যধর্মী। কোনোটি ইনস্টলেশন। আর রয়েছে দুটি বিপুল মাত্রার ভিডিও, উত্তরণের ইঙ্গিতে সমৃদ্ধ। এর মধ্যে প্রথমে একটি ভাস্কর্যধর্মী রচনার দিকে আমরা দৃষ্টিপাত করব। বিশালকায় গ্রেনেড আকৃতির একটি রচনা এটি। ইস্পাতে তৈরি। এই গ্রেনেডের ভেতর রয়েছে সন্ত্রাস-অধ্যুষিত ধ্বংসের ইঙ্গিত। এর পরিচিতি হিসেবে লেখা রয়েছে : ‘Borne from space to space – a hardened exterior holding within fragile spores ready to burst onto rwa liquid earth willing to receive’. এই ভাস্কর্যধর্মী রচনায় কি ‘trace’ আছে কোনো? হয়তো রয়েছে ক্ষুদ্র এককে। কিন্তু সবটা মিলে হয়ে উঠেছে একটি ‘metaphor’, যা বর্তমান আবিশ্ব সন্ত্রাসের প্রতীক।

এই রকম আরো কিছু প্রদর্শ পেরিয়ে আমরা চলে আসি একটি কক্ষজোড়া ভিডিওতে। ৬.৪৪ মিনিটের ডিজিটাল প্রজেকশন। একটি দেয়ালজোড়া পর্দা নেমে এসে ছড়িয়ে পড়েছে মেঝেতে। তার ওপর প্রক্ষিপ্ত হচ্ছে দৃশ্যাবলি। এর পরিচিতি হিসেবে লেখা রয়েছে : ‘It has no idol. It does not have specific entrance or exit. It reveals itself through what it is not. Four stairs point in four different directions offering the choice of path and trajectory. If the temple structure is itself a skelton, the photographs are skin. The skin operates as a matrix of memory.’ রাত্রির আবরণ ভেদ করে প্রকৃতি উন্মোচিত হয় এই দৃশ্য-নির্ঝরে। সূর্য ওঠে। ভোরের আবহে পাখি ডেকে ওঠে। মৃত্যুমদির অন্ধকার থেকে উত্তরণের ইঙ্গিত বেজে ওঠে।

২০০৯-এ করা আরেকটি ভিডিও ইনস্টলেশনেও আমরা পেয়ে যাই এরকম উত্তরণের কিছু আভাস। যদিও রাত্রির আবরণ সেখানে পাপে অধ্যুষিত। তার ভেতর থেকেই স্বপ্ন জেগে ওঠে। সেই স্বপ্নই হয়তো জীবনকে চেনায়। একটি কক্ষের চারটি দেয়ালজুড়ে একই সঙ্গে বিচ্ছুরিত হয় দৃশ্যাবলি। এর পরিচিতি হিসেবে শিল্পী লেখেন : ‘Nightskin the river heavy with sin/ Nightskin my darkness/ I dream/ why do you hide. নদীকে এখানে প্রায় সমুদ্র মনে হয়। তার ঢেউ তটভূমিতে আছড়ে আছড়ে পড়ে। অন্তহীন স্রোতে পরিপ্লুত হতে থাকে বিশ্ব। পাখি ওড়ে আকাশে। শূন্যতাকে পরিব্যাপ্ত করতে থাকে অসীমের অনুরণন।

প্রদর্শনীজুড়ে বিরাট মাপের, বিরাট মাত্রার অজস্র কাজ। বিকল্প শিল্পমাধ্যম নিয়ে চূড়ান্ত পরীক্ষা-নিরীক্ষা করেছেন শিল্পী। আজকের প্রযুক্তি-অধ্যুষিত বিশ্বায়িত যে জীবনপ্রবাহ, তার ভেতর এক ধরনের যান্ত্রিক বিমূর্ততা আছে। সেই বিমূর্ততার ভেতরই রাত্রি প্রসারিত হয়। রাত্রির নিবিড়তা থেকে উত্তরণের ইঙ্গিতও জাগে। চিত্রভানু এই সামগ্রিক জীবনের আবহকে অভিব্যক্ত করেছেন প্রথাবিরোধী ভাষায়। আজকে শুধু ভারত নয়, সমগ্র বিশ্বশিল্পের প্রেক্ষাপটেই তাঁর এই অবদান বিশেষভাবে স্মরণীয়। এই শান্ত, একটু লাজুক প্রকৃতির, অন্তর্মুখী, ছফুট উচ্চতার সুদর্শন এই মানুষটি আজকের সংঘাতময় আর্ট-পলিটিকসের বাইরে থেকে যে নিবিড়তায় নিরন্তর কাজ করে যাচ্ছেন, আমাদের দেশে তার তুলনা বিরল। এ যুগের বিকল্প শিল্পভাষার প্রধান এক রূপকার হিসেবে নিজেকে তিনি প্রতিষ্ঠা করেছেন। এই প্রদর্শনীটি তাঁর শিল্পীজীবনেরও বিশেষ একটি ল্যান্ডমার্ক বা স্মারক।

Leave a Reply