অ লো ক কু মা র সে ন
সদ্য শেষ হওয়া চার রাতব্যাপী (নভেম্বর ২৮-ডিসেম্বর ১) ‘বেঙ্গল উচ্চাঙ্গসংগীত উৎসব ২০১৩’ বাংলাদেশের সংগীতপিপাসুদের জন্য ছিল এক পরম পাওয়া।
দ্বিতীয়বারের মতো অনুষ্ঠিত হওয়া শাস্ত্রীয় সংগীতের এই মহাযজ্ঞে গতবারের মতো এবারো উৎসব আয়োজনে সহায়তা করেছে কলকাতার আইটিসি সংগীত রিসার্চ অ্যাকাডেমি। সবচাইতে সুখের ব্যাপার, ভবিষ্যতেও এই বার্ষিক মহোৎসবে প্রতিষ্ঠানটি বেঙ্গল ফাউন্ডেশনকে সহায়তা দেবে। শাস্ত্রীয় সংগীতের এতবড় আয়োজন একটি ঐতিহাসিক যুগান্তকারী ঘটনা – যা পৃথিবীর মধ্যে সবচাইতে বড় রাগসংগীতের উৎসব।
পৃথিবী-বিখ্যাত সব সংগীতগুণী, বড় বড় ওস্তাদ আর পন্ডিতরা তাঁদের কণ্ঠ ও বিভিন্ন মার্গীয় যন্ত্রের সুরের মূর্ছনায় সকল দর্শক-শ্রোতাকে বিমোহিত করে রেখেছিলেন। একজন উচ্চাঙ্গসংগীতের কণ্ঠশিল্পী হিসেবে আমার মনে হয়েছে যেন চারটি রাত আমি সুরের ইন্দ্রলোকে অবগাহন করছি। সকল সংগীতপিপাসু, প্রেমী, শিল্পী, সংগীত-সমালোচক, বোদ্ধা এবং সকল সাধারণ দর্শক-শ্রোতা অত্যন্ত সুশৃঙ্খলভাবে এই উৎসবের প্রতিটি পরিবেশনা অত্যন্ত মনোযোগের সঙ্গে উপভোগ করেছেন। উৎসবে তরুণ দর্শক-শ্রোতার সমাগম ছিল সত্যিই প্রশংসনীয়, যা আমাদের সকলের মনে গভীর আশার সঞ্চার করে। শাস্ত্রীয় সংগীত একটি অতি উচ্চমার্গের পরিবেশনা-শিল্প। এই সংগীতের প্রথম স্তরের অন্তর্ভুক্ত ধ্রুপদ, যা মূলত সৃষ্টিকর্তার তুষ্টির জন্য গীত হয়। দ্বিতীয় স্তরে রয়েছে খেয়াল গান – যার মূল উদ্দেশ্য মানুষের জন্য গান। মানুষের মনের বিভিন্ন ধরনের আবেগ-অনুভূতির সঙ্গে একাত্ম হওয়া বা করাই খেয়াল গানের লক্ষ্য। তৃতীয় বা শেষ স্তরে লাইট ক্লাসিক্যাল বা সেমি-ক্লাসিক্যাল স্তরের অন্তর্ভুক্ত ঠুমরি, ভজন, গজল, দাদরা, হরি, কাজরি, চৈতি ইত্যাদি।
এই উৎসবে শাস্ত্রীয় সংগীতের সকল স্তরেরই পরিবেশনা ছিল। বেঙ্গল শাস্ত্রীয় সংগীতের এই দ্বিতীয় আসরটি উৎসর্গ করা হয় বেঙ্গল ফাউন্ডেশনের প্রতিষ্ঠাতা উপদেষ্টা ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক শিক্ষক, জাতীয় অধ্যাপক জ্ঞানতাপস আব্দুর রাজ্জাকের পুণ্য স্মৃতির উদ্দেশে। এবারের শাস্ত্রীয় সংগীতের উৎসব শুরু হয় কত্থক নৃত্য পরিবেশনার মধ্য দিয়ে। সমসাময়িক খ্যাতিমান ও বিস্ময়কর কত্থকশিল্পী বিশাল কৃষ্ণ উৎসবের পর্দা ওঠান তাঁর চমৎকার কিছু পরিবেশনা দিয়ে। নৃত্যশিল্পী হিসেবে বিশাল অতি অল্প বয়সেই বিশেষ দক্ষতার অধিকারী হয়েছেন। তাঁর পেলবতা, ঠমক ও সোমে দাঁড়ানোর প্রতিটি ভঙ্গি বেশ মনোমুগ্ধকর ছিল। শিল্পী তান্ডব ও লাস্যের সামঞ্জস্য বজায় রেখে তাঁর নৃত্যশৈলীর মাধ্যমে দর্শকের মনে অপরূপ রসের সৃষ্টি করেন। কত্থক নৃত্যের গাণিতিক বিদ্যায় পারদর্শী তিনি।
বিশাল তাঁর পরিবেশনা শুরু করেন দেবিকাস্ত্ততি বা কালীর প্রতি ভক্তিরস উপস্থাপনার মধ্য দিয়ে। তাঁর পরবর্তী পরিবেশনা ছিল বাদ্য ও গানের আলাপচারীর মতো ঘুঙুরের আলাপচারী। পরবর্তী নৃত্য ছিল পরন। এই নৃত্যাংশে শুধু পাখোয়াজের বোলের সঙ্গে নটরাজ গোপীকৃষ্ণের তৈরি পরন এবং এতে বিশেষভাবে লক্ষণীয় প্রথম ছুট থেকে শেষ ছুটের মধ্যে কী করে সম্পূর্ণ মঞ্চকে ভ্রমণ করতে হয়। তারপর অফ বিটের মধ্যে তেহাই চক্রদার, তেহাইয়ের মধ্যে ঘোড়ার চলন এবং অভিনয়প্রধান নৃত্য ‘গৎ’ পরিবেশন করেন। বিশাল ময়ূরের নৃত্যোচ্ছ্বাস, থালার মাধ্যমে পায়ের কাজ এবং শুধু ঘুঙুরের আওয়াজ সৃষ্টির মাধ্যমে অগণিত দর্শকের মধ্যে কৌতূহলের সৃষ্টি করেন। সর্বোপরি বিশালের নৃত্য গোধূলির আলোক-আভার মতো রং ছড়িয়েছিল।
বিদুষী গিরিজা দেবী তাঁর স্বতন্ত্র ঢঙে মঞ্চে উপবিষ্ট হলেন এবং ঠাকুমার ঝুলির মতো একে একে পরিবেশন করতে লাগলেন যথাক্রমে খেয়াল, ঠুমরি ও দাদরা। পুরব অঙ্গের একমাত্র জীবন্ত কিংবদন্তি বর্ষীয়ান এই শিল্পী পরিবেশনা শুরু করেন রাগ যোগকোষে বিলম্বিত বন্দিশ ‘এ ঝাঁঝরিয়া বানাকে এ মায়ি ক্যায়সে কর আও তোরে পাস’ দিয়ে (বিলম্বিত একতালে নিবদ্ধ)। তারপর ছিল তাঁর দ্রুত বন্দিশ ‘বহুত দিন বিতি আজহুনা আয়ে মোরি শাম’ (তিনতাল)।
এরপরে মিশ্র তিলোকামোদ রাগে বোল বানাও কি ঠুমরি ‘আও পিয়া মোরে আও জিননা রায়ে রাতিয়া’ তাল যৎ। গানের বাণীকে তিনি এমনভাবে জীবন্ত করে তোলেন, যাতে মনে হয়েছে, তিনি নিজেই প্রতিটি গল্পের মানসকন্যা।
তাঁর বিলম্বিত বন্দিশ পরিবেশনায় রাধার কৃষ্ণের সঙ্গে মিলনের গভীরতম আকাঙ্ক্ষা ফুটে উঠেছিল। তাঁর দ্রুত বন্দিশে ও রাধার অতৃপ্ত হৃদয়ের আবেগময় আবেদন প্রাচুর্যপূর্ণ রূপে অতুলনীয়ভাবে প্রকাশ পেয়েছিল। পরে বিদুষী গিরিজা দেবী তাঁর নিজের রচিত একটি দাদরা ‘পুরব দেশসে আয়ে গোরিয়া যাদুয়া ডার গেয়ি রে’ পরিবেশন করেন।
বাংলাদেশি তবলাশিল্পী চতুষ্টয় – গৌতম সরকার, স্বরূপ হোসেন, ইফতেখার আলম প্রধান ও মো. জাকির হোসেন তাঁদের চমৎকার পরিবেশনার মাধ্যমে দর্শকদের মুগ্ধ করেন। তিনতালে নিবদ্ধ কিরওয়ানি রাগে তাঁরা ‘ধিন ক্রে ধিনধা’ কায়দা দিয়ে তাঁদের তবলা লহরা শুরু করেন। শিল্পীরা বিভিন্ন ধরনের কায়দা, টুকরা চক্রদার এবং চক্রদার তেহাই দেখান। তাঁরা বেনারস, দিল্লি, আজরারা এবং ফররুখাবাদ ঘরানার ঐতিহ্যবাহী রচনাগুলো তাঁদের দলীয় একক বাজনায় ফুটিয়ে তোলেন। শ্রোতারা তাঁদের পরিবেশনা অত্যন্ত গর্ব ও প্রশংসাভরে গ্রহণ করেন।
উদীয়মান সেতারবাদক অয়ন সেনগুপ্ত রাগ মারুবেহাগ (বিলম্বিত ঝাপতাল ও দ্রুত তিনতালে) পরিবেশন করে শ্রোতাদের মন্ত্রমুগ্ধ করে রাখেন। অয়নের রাগদারি, ধ্রুপদ অঙ্গের আলাপ এবং দ্রুত গমকি তান সত্যিই খুব মনোমুগ্ধকর ছিল। বিদুষী কৌশিকী চক্রবর্তীকে শ্রোতৃমন্ডলী করতালি দিয়ে স্বাগত জানান। কেননা তিনি নিজেকে ময়মনসিংহের নাতনি বলে উল্লেখ করেন। তিনি রাগ আভোগী পরিবেশন করেন। আভোগী একটি করুণ রাগ, যেটি রাগ বাগেশ্রীর সঙ্গে বেশ সম্পর্কযুক্ত। কৌশিকীর পরিবেশনায় চমৎকারিত্ব ছিল বেশ, যেমন তাঁর নাটকীয় বিস্তার, আলংকারিক মুড়কি, সারগাম তানের বিভিন্ন কম্বিনেশন ও পারম্যুটেশান, গমকি তান, বিভিন্ন ধরনের তেহাই এবং তার সহযোগে আকার ও সারগাম তানের পরিবেশনা – যেটি তাঁর বাবা বিশিষ্ট শাস্ত্রীয় সংগীতশিল্পী পন্ডিত অজয় চক্রবর্তীর প্রসিদ্ধ গায়কি ঢং। কৌশিকী কয়েকবার অনায়াস ভঙ্গিতে চারটি সপ্তকের ‘সা’ স্পর্শ করেন। শেষে তিনি তাঁর বাবার রচিত যোগরাগে বাঁধা একটি ঠুমরি পরিবেশন করেন।
প্রখ্যাত সরোদশিল্পী পন্ডিত তেজেন্দ্রনারায়ণ মজুমদার রাগ কৌশিকী কানাড়া পরিবেশনার মধ্য দিয়ে তাঁর বাজনা শুরু করেন। রাগ দরবারি কানাড়া ও রাগ মালকোষের সুনিপুণ স্বর সমন্বয়ে গঠিত একটি যৌগিক রাগ কৌশিকী কানাড়া, যাতে দুটি রাগ অঙ্গের যথাযথ রস পাওয়া যায়। পন্ডিত তেজেন্দ্রনারায়ণ প্রথমে আলাপ, জোড় ও ঝালা পরিবেশন করেন; পরে রাগ দরবারি কানাড়া ও রাগ মালকোষের স্বর সমন্বয়ে সুরেলা ও ছন্দোময় মেলবন্ধনে দর্শক-শ্রোতাদের মোহিত করেন। বিশিষ্ট তবলা পন্ডিত যোগেশ শামসি প্রধানত তিনতালে সংগত করেন। পরে দুই পন্ডিত মিলে দর্শকদের বিমোহিত করেন অফ বিট সওয়াল-জওয়াব দিয়ে। পরবর্তী সময়ে পন্ডিত তেজেন তাঁর গুরু ওস্তাদ আলী আকবর খান-সৃষ্ট রাগ ‘চন্দ্রনন্দন’ বাজিয়ে শোনান। চন্দ্রনন্দন একটি করুণ রাগ, যার যোগকোষের সঙ্গে মিল পাওয়া যায়।
পন্ডিত রাজন মিশ্র ও পন্ডিত সাজন মিশ্র প্রথম রাতের শেষ শিল্পীদ্বয় হিসেবে অনুষ্ঠানের ইতি টানেন। তাঁরা প্রথমেই বলেন, ‘সংগীত হচ্ছে আমাদের কাছে প্রার্থনার মতো।’ শিল্পীভ্রাতৃযুগল ঢাকার সংগীতপিপাসুদের মন জয় করেন রাগ ভাটিয়ার পরিবেশনার মধ্য দিয়ে। তাঁদের পরিবেশিত বিলম্বিত বন্দিশ ‘উচাট গেয়ি মোরি নিনদিয়া’ (বিলম্বিত একতানে নিবদ্ধ) সত্যিই সাংগীতিক প্রার্থনার মতো মনে হচ্ছিল, যা পুবার অঙ্গের মাধ্যমে পুনঃপুন প্রকাশ পেয়েছিল। তাঁদের দ্রুত বন্দিশ ‘আয়োপ্রভাত’ (তিনতালে নিবদ্ধ) ছিল দুই ভাইয়ের যুগলবন্দি পরিবেশনার মতো। বিস্তার পরিবেশনার সময়ে পন্ডিতদ্বয় মন্দ্র ও তারসপ্তকে মারওয়া ও বিলাবল অঙ্গ গেয়ে শোনান। পন্ডিত সমর সাহা তবলায় এবং রূপশ্রী ভট্টাচার্য হারমোনিয়ামে চমৎকার সুর ও ছন্দের আবহ তোলেন। পরে মিশ্র ভ্রাতৃদ্বয় মধ্য ও দ্রুত একতালে একই রাগে তারানা পরিবেশন করেন। তাঁদের পরবর্তী পরিবেশনা ছিল রাগ গুর্জরি টোড়িতে বাঁধা একটি বন্দিশ ‘বানকে পাঞ্ছি ভায়ি বাওয়ারি,’ যেটি ওস্তাদ আমির খসরুর রচনা ছিল। একই রাগে তাঁরা একটি তারানা পরিবেশন করেন একতালে। পন্ডিতদ্বয় উদ্বোধনী রাতের পরিবেশনা শেষ করেন ভৈরবী রাগে বাঁধা একটি সানন্দ্রা ‘ভবানী দয়ানী মহাবাক বাণী’ গায়নের মাধ্যমে।
উৎসবের দ্বিতীয় দিন উৎসর্গ করা হয় বর্তমান সরকারি সংগীত মহাবিদ্যালয়ের প্রতিষ্ঠাতা ও সংগীতগুরু পন্ডিত বারীন মজুমদারকে। ওই রাতের পরিবেশনা শুরু হয় বিদুষী আলারমেল ভাল্লির ভরতনাট্যমের দৃশ্যমান কবিতা পরিবেশনার মাধ্যমে। উদীয়মান বেহালাবাদক সাকেত সাহু একটি রোমান্টিক রাগ ‘বেহাগ’ বাজিয়ে শোনান। পরবর্তী সময়ে কর্ণাটকি কণ্ঠশিল্পী, বিদুষী বম্বে জয়শ্রী দক্ষিণ ভারতীয় কয়েকটি রাগ যেমন খরহর প্রিয়া, ধর্মবতী এবং উত্তর ভারতীয় একটি রাগের সম্মিলনে অপরূপ সুরের মালা গাঁথেন। মনোজ শিব (মৃদঙ্গম), গণেশপ্রসাদ (বেহালা) এবং দুজন বাংলাদেশি শিল্পী মহুয়া মঞ্জরি সুনন্দা এবং রুখসানা করিম কানন তানপুরায় এই গুণী শিল্পীকে সঙ্গ দেন।
বাংলাদেশের শাস্ত্রীয় সংগীতশিল্পী অসিত দে প্রথমেই পুরিয়া কল্যাণ রাগে আলাপ দিয়ে তাঁর পরিবেশনা শুরু করেন। ওস্তাদ আমির খানের সবচাইতে সিনিয়র শিষ্য পন্ডিত অমরনাথ ও শ্রীমতী শান্তি শর্মার শিষ্য অসিত দে পুরিয়া কল্যাণের বিলম্বিত বন্দিশ ‘আজ সো বানা’ ঝুমরা তালে শুরু করেন। তাঁর পরিবেশিত বিস্তার অঙ্গ এতই আলংকারিক ছিল যে তার পরপরই তিনি ব্যাহেলওয়া, রাগদারি, খটকা, মীড় এবং ওই রাগের কঠিন কিছু প্রয়োগ দেখান। তিনি খুব সুন্দরভাবে পুরিয়া ও ইমন অঙ্গ গেয়ে দেখান, যা সূর্যের অস্তাচলে ডুবে যাওয়ার বেদনাবিধুর দৃশ্য ও পূর্ণচন্দ্রের মায়ায় শ্রোতাদের অবগাহ করায়। পরে তিনি তিনতালে নিবদ্ধ একটি তারানা (তা নুম দেরে না তা দা রে দানি), একটি দ্রুত একতাল বন্দিশ ‘মন অবোধ মোরা’ পরিবেশন করেন।
বিশিষ্ট সেতারবাদক পন্ডিত পূর্বায়ন চ্যাটার্জিকে ওই রাতের সেরা পারফর্মার বললে অত্যুক্তি হবে না। পূর্বায়ন জয়জয়ন্তী রাগ পরিবেশন করেন। তিনি একে একে তাঁর বাজনার বিশেষত্ব যেমন দ্রুত গমকি তানের সঙ্গে বিস্তর বিস্তারের ভেরিয়েশন দেখান এবং অসম্ভব দক্ষতার সঙ্গে চারটি সপ্তকের সমস্ত নোটের ব্যবহার করেন। সকল সংগীতবিশারদ, রসজ্ঞ ব্যক্তি, সমালোচক, প্রেমী, এমনকি সমগ্র সাধারণ দর্শক-শ্রোতা সেদিন জয়জয়ন্তী রাগের অফুরান সব সাংগীতিক বাগধারা শোনার অনুপম সুযোগ পান। পূর্বায়ন প্রকৃতই সেদিন আর্মি স্টেডিয়ামে সাংগীতিক মহল তৈরি করেন। শ্রোতারা পুরোদমে তাঁর সেতারের প্রতিটি মধুর স্ট্রোক শোনেন, যার সঙ্গে ছিল একটি ভারসাম্যপূর্ণ এবং মিষ্টি রাগদারির চলন। প্রতিটি অঙ্গে তা বিদ্যুচ্চমকের মতো আরোহণ-অবরোহণে সৌন্দর্য তৈরি করে। (পরে তিনি ওস্তাদ আমির খান-রচিত দরবারি কানাড়া রাগের একটি বন্দিশ ‘ইয়ারে মান দিয়া পিয়া’ প্রথমে গেয়ে ও পরে বাজিয়ে দর্শকদের মন্ত্রমুগ্ধ করে রাখেন।) পন্ডিত সত্যজিৎ তালওয়ালকার তাঁর মিষ্টি ঠেকায় তাঁর তবলা লহরা, সাতসংগত ও অপূর্ব সওয়াল-জওয়াবে অংশ নেন। শেষে পূর্বায়ন তাঁর লোকসুরের জাদুতে শ্রোতাদের মুগ্ধ করেন। তাঁর বাজনায় রবীন্দ্রনাথের বাউল সুর ‘ভেঙে মোর ঘরের চাবি’ ও ‘গ্রামছাড়া ঐ রাঙ্গা মাটির পথ’ শ্রোতাদের মনে বাড়তি আনন্দ জাগায়। পূর্বায়নের বাজনা শুনে হাজার হাজার দর্শক তাঁকে দাঁড়িয়ে অভিবাদন জানান।
ওই রাতের প্রধান আকর্ষণ ছিল পন্ডিত অজয় চক্রবর্তীর কণ্ঠের গান শোনা। জীবন্ত কিংবদন্তি এই শিল্পী তাঁর গায়কি শুরু করেন একটি করুণ ও গম্ভীর রাগ ‘মালকোষ’ পরিবেশনা দিয়ে। তবলায় পন্ডিত যোগেশ শামসি, বেহালাবাদক সাকেত সাহু এবং সহযোগী কণ্ঠশিল্পী হিসেবে ব্রজেশ্বর মুখার্জি ও দেবর্ষি ভট্টাচার্য পন্ডিতজির সেই সুদীর্ঘ ও স্মরণীয় সংগীত পরিবেশনায় সঙ্গ দেন। পন্ডিতজি তাঁর নিজ সৃষ্ট বিলম্বিত বন্দিশ ‘খুদা কি মর্জি’ দিয়ে শুরু করেন, যেটি ছিল অত্যন্ত মেডিটেটিভ। তাঁর মধ্যলয় তিনতালের বন্দিশ ‘মানদার দেখা দে সুদামা’ যেন পরমাত্মার অনুসন্ধানে শ্রোতাদের মুগ্ধ রেখেছিল। মনে হয়েছিল যেন তিনি সম্পূর্ণরূপে নিজেকে ঈশ্বরের নিকট প্রার্থনা করেছেন সকলপ্রকার ভুল শোধাবার ও সংকটমোচনের জন্য। পরে তিনি তাঁর গুরু পন্ডিত জ্ঞানপ্রকাশ ঘোষ-রচিত একটি তারানা পরিবেশন করেন। পরবর্তী সময়ে তিনি ভৈরবী রাগের সঙ্গে আরবি সুরের মেলবন্ধনে রচিত ওস্তাদ বড়ে গোলাম আলী খানের একটি ঠুমরি ‘কা করু সজনি’ পরিবেশন করে শ্রোতাদের আনন্দ দেন। শেষে পন্ডিতজি যোগিয়া রাগে বাঁধা একটি বাংলা গান ‘যামিনী হলো যে ভোর বাঁশি বাজে’ দিয়ে তাঁর উপস্থাপনা শেষ করেন।
বর্ষীয়ান সেতারবাদক ওস্তাদ রইস খান ছিলেন ওই রাতের শেষ শিল্পী। তিনি পুত্র ফারহান খানের সঙ্গে যুগলবন্দি ঢঙে রাগ চারুকেশীতে বাজনা শুরু করেন। পরে ওস্তাদজি আফগানি সুর ও বাংলার লোকসুরের মিশেলে একটি কম্পোজিশন বাজিয়ে শোনান। পন্ডিত সমর সাহা অতুলনীয়ভাবে তবলায় স্বর্গীয় ছন্দ তোলেন এবং কতকগুলো অসামান্য অতীত তেহাই সমন্বয়ে পরিবেশনাটিকে সুন্দর করে তোলেন। বেঙ্গল শাস্ত্রীয় সংগীত উৎসবের তৃতীয় রাতে ছিল আর্মি স্টেডিয়ামজুড়ে স্বর্গীয় সুরমূর্ছনার আবহ।
পরদিন সরোদ বাজিয়ে রাজরূপা চৌধুরী শ্যামকল্যাণ রাগের আলাপ দিয়ে সন্ধ্যায় উৎসব সূচনা করেন। প্রথাগত বাজনার ঢং ভেঙে রাজরূপা বিভিন্ন ধরনের ছন্দোময় জোড় বাজান। পন্ডিত যোগেশ শামসি রাজরূপার তিস্রা (৩/৩) ও তেওড়া জাতির (৩/২/২) বাজনার সঙ্গে তাল মিলিয়ে শ্রোতা-দর্শকের মনে এক অনুপম আনন্দের রস সৃষ্টি করেন। তাঁর সুদক্ষ আলাপ এবং দ্রুত সপ্তকে এক অপূর্ব আবেদন তুলেছিল। পরে রাজরূপা বিলম্বিত তিনতালে নিবদ্ধ রাগেশ্রী রাগের একটি বন্দিশ বাজিয়ে শোনান।
প্রতিশ্রুতিশীল কণ্ঠশিল্পী কুমার মার্দুর পরে ‘শুদ্ধ কল্যাণ’ রাগে খেয়াল পরিবেশন করেন। কুমারের বিলম্বিত বন্দিশ ‘তুমা বিনা কউন’ (বিলম্বিত একতাল) এবং দ্রুত বন্দিশ ‘মন্দর বাজো বাজোরে’ (তিনতাল) খুবই চমকপ্রদ ছিল। তাঁর দ্রুত ও সুস্পষ্ট আকার তান ও সুসামঞ্জস্যপূর্ণ লয়ের চলন ছিল মনোমুগ্ধকর। কুমার তাঁর পরিবেশনা শেষ করেন কবীর-রচিত একটি ভজন দিয়ে।
বাংলাদেশের অপরূপ সৌন্দর্য ও ঐতিহ্যের প্রেমে পড়ে পন্ডিত শিবকুমার শর্মা ঝিঁঝোটি রাগে তাঁর বাজনা শুরু করেন। সন্তুরের জীবন্ত এই কিংবদন্তি বাংলার নন্দনতাত্ত্বিক সৌন্দর্য যেমন পল্লীপ্রকৃতি, ঐতিহ্যবাহী জীবনধারা ও উৎসব তৎসহ লোকজ উপাদান – বাউল, ভাটিয়ালি, জারি, সারি, নদী, নৌকা, মাছ, খাদ্য, ফুল, ফল, পাখি, সবুজ – এবং আবেগতাড়িত একটি জাতির উষ্ণতাকে এমনভাবে তাঁর বাজনায় ফুটিয়ে তোলেন, যা ছিল এককথায় মনোমুগ্ধকর। আলাপ অঙ্গে তিনি এমন একটি সাংগীতিক বাগবিধি সৃষ্টি করেন, যা অনায়াসে শ্রোতাদের হৃদয়কে নাড়া দেয়। পন্ডিত শিবকুমার শর্মা পরে একটি কোমল রোমান্টিক ধুন বাজিয়ে শোনান, যেটি ছিল মিশ্র কৌশিক ধ্বনি রাগে নিবদ্ধ।
পন্ডিত স্বপন চৌধুরী একক তবলাবাদন শুরু করেন তিনতালের মূল ঠেকা বা পাল্টা ঠেকা বাজিয়ে, যা লক্ষ্ণৌ ঘরানার প্রসিদ্ধি পায়। তিনি ‘ধেনে ঘেনে’ শিরোনামের একটি রেলা বাজান, যেটি আসলে ওস্তাদ ওয়াজেদ হুসেইন খানের কম্পোজিশন ছিল। পরে তিনি ধেরে ধেরে বোল-সম্পর্কিত একটি রেলা বাজান, যা ছিল মূলত গাণিতিক ছন্দে রচিত ‘রো’, হিসাব-নিকাশি এই ছন্দটি লক্ষ্ণৌ বাজে চর্চিত হয়। তবলার এই কিংবদন্তি কয়েকটি পুরনো গৎ বাজিয়ে শোনান, যা ছিল লক্ষ্ণৌ ঘরানার খলিফা ওস্তাদ আবিদ হুসেন খানের কম্পোজিশন। পরে তিনি গোপুচ্ছ কম্পোজিশন, বিভিন্ন চক্রদার, আকলি গৎ একটি কাব্যিক কম্পোজিশ বাজান, যা ছিল তাঁর ঘরানায় প্রসিদ্ধি পাওয়া। সারেঙ্গিশিল্পী আল্লারাখা কলাবন্ত একটি সুমধুর রাগ ‘চম্পাকলি’তে স্বপন চৌধুরীকে সাতসংগত করেন।
বাংলাদেশি শিল্পী রীনাত ফৌজিয়া, যিনি প্রখ্যাত ওস্তাদ আয়েত আলী খাঁর পৌত্রী, অত্যন্ত সুন্দরভাবে একটি কর্ণাটকি রাগ কিরওয়ানি বাজিয়ে শোনান তাঁর সেতারে। বিদুষী পদ্মা তালওয়ালকার উৎসবে রাগ যোগকোষে গেয়ে শোনান। তাঁর পুত্র সত্যজিৎ তালওয়ালকার তবলায়, তাঁর ছাত্রী রসিকা কণ্ঠ সহযোগিতায় এবং গৌরব চট্টোপাধ্যায় হারমোনিয়ামে তাঁকে সংগত করেন। শিল্পীর মাতৃসুলভ একটি পরিচ্ছন্ন ব্যক্তিত্ব প্রথমেই শ্রোতাদের মুগ্ধ করে। তাঁর সুরেলা ছন্দোময় মুড়কি, পুকার আকার তান, বিলম্বিত তিনতাল বন্দিশ ‘এ সুঘর বর পায়ো’ এবং মধ্যলয় তিনতাল বন্দিশ ‘পীর পরায়ি জানে নেহি’ দর্শক-শ্রোতাকে সুরের সাগরে ডুবিয়ে রাখে। পরে তিনি তিলোকামোদ রাগে একটি তারানা ও মীরার একটি ভজন ‘ম্হারো প্রণাম বাকে বিহারি জি’ গেয়ে তাঁর পরিবেশনা শেষ করেন।
পন্ডিত উদয় ভাওয়ালকর ছিলেন উৎসবের একমাত্র ধ্রুপদ শিল্পী, যিনি দরবারি কানাড়া রাগে সাংগীতিক মূর্ছনা তোলেন। তাঁর গমকি আলাপ এবং মীড় যুগপৎভাবে তিনটি সপ্তকেই ফুটিয়ে তুলছিল এক অপরূপ সুরের মায়া। তাঁর বোলবাট, ব্যাহলওয়া, খটকা মুড়কি, তেহাই পরিবেশনা ছিল এক বিস্ময়কর ভারসাম্যপূর্ণ কণ্ঠজাদুর খেলা। তিনি একটি অতি পুরনো ঐতিহ্যবাহী বন্দিশ ষড়জ, ঋষভ, মধ্যম, পঞ্চম পরিবেশন করেন, যেটি ছিল চৌতালে নিবদ্ধ।
শ্রোতাদের জন্য ওই রাতের শেষ উপহার ছিল এক স্বর্গীয় বংশীবাদন পরিবেশনা, যা পন্ডিত হরিপ্রসাদ চৌরাসিয়া বাজিয়ে শোনান। আনদ্ধ যন্ত্রের দুই মহীরুহ পন্ডিত সমর সাহা তবলায়, পন্ডিত ভবানীশংকর পাখোয়াজে এবং বিবেক সোনার বাঁশিতে সংগত করেন জীবন্ত এই কিংবদন্তিকে। বাঁশির জাদুকর প্রথমেই আন্তরিকভাবে বিশাল শ্রোতৃমন্ডলীকে রাতের শেষ প্রহরে সরব উপস্থিতির জন্য ধন্যবাদ জানান।
হরিজি প্রথমেই রাগ ‘প্রভাতেশ্বরী’ দিয়ে তাঁর পরিবেশনা শুরু করেন। ভৈরবী এবং আহির ভৈরব রাগের যে আকুলতা তিনি দর্শকের সামনে উপস্থাপন করলেন তাতে মনে হচ্ছিল নদী পাড়ি দিতে গিয়ে ছেড়ে যাওয়া কূলের প্রতি যে মায়া তার একটি ব্যথাতুর চিত্রায়ণ ঘটছে। পক্ষান্তরে জীবনের শেষপ্রান্তে এসে যেমন বৃদ্ধ পিতা-মাতা তাঁদের সন্তানদেরকে সংসারজীবনের বৈতরণী পেরোবার সদুপায়সমূহ বাতলে দেন, তারই ছবি ভেসে উঠছিল তাঁর রাগ পরিবেশনায়। সত্যিকার অর্থে, এই ছবিটি প্রচ্ছন্নভাবে এটাই ইঙ্গিত করে যে, আজকে ওঁদের মতো বড় বড় দিকপাল যুগ যুগ ধরে যাঁরা পৃথিবীতে রাগসংগীত প্রচার করে নবীন শিল্পীদের জন্য বিশ্বময় রাগসংগীতের এত বড় একটি জায়গা প্রতিষ্ঠিত করে গেলেন। সুউচ্চ সম্মানের সংগীতের আদর্শ অভিভাবক বলতে ওঁদের চেয়ে প্রকৃষ্ট উদাহরণ তো আর হতে পারে না। রাগ প্রভাতেশ্বরী পরিবেশনের মধ্যে আমার দৃষ্টিতে এমনই একটি বিদায় এবং স্বাগতমের প্রতিচ্ছবি দেখতে পাই। সত্যিই পিতা-মাতার চেয়ে মহান আর কিছু হতে পারে না, ঠিক এটাই যেন ছিল তাঁর বাজনার মূল প্রতিবাদ্য।
এরপরে তিনি রাগ ললিতে একটি অপূর্ব ধুন পরিবেশন করেন। পরিশেষে কীর্তনের ধুন বাজিয়ে পন্ডিত হরিপ্রসাদ চৌরাসিয়া গোটা আর্মি স্টেডিয়ামে বৃন্দাবন ধাম রচনা করেছিলেন। পরিবেশনার শেষে অসংখ্য ভক্ত হরিজিকে কাছ থেকে ছুঁয়ে দেখার জন্য তাঁর দিকে ধাবিত হয় এবং তিনি ভক্তদের মনের আশা পূরণ করেন।
‘বেঙ্গল উচ্চাঙ্গসংগীত উৎসব ২০১৩’ শেষ হয় চতুর্থ ও শেষ রাতে, যেটি উৎসর্গ করা হয়েছিল পন্ডিত রবিশঙ্করকে, তাতে অনেকগুলো স্মরণীয় পরিবেশনা ছিল। ওই রাতের উৎসব শুরু স্বনামধন্য বাংলাদেশি শিল্পী তামান্না রহমানের মণিপুরি নৃত্য পরিবেশনার মাধ্যমে। তামান্না রহমান তাঁর পরিবেশনা শুরু করেন ‘গৌরাঙ্গ আবাহন’ দিয়ে। তাঁর দ্বিতীয় উপস্থাপনা ছিল পৌরাণিক উপাখ্যান ‘কালিয়দমন’-নির্ভর। ভক্তিরস উদ্রেকের মাধ্যমে তামান্না তান্ডব দৃষ্টিকোণের এই নৃত্যটি অসম্ভব সুন্দরভাবে তুলে ধরেন। শিল্পী তাঁর পরিবেশনা শেষ করেন ‘দশাবতার’ দিয়ে, যাতে তিনি শ্রীকৃষ্ণের দশটি অবতারের রূপ তুলে ধরেন মণিপুরি নৃত্যের মাধ্যমে। তামান্নার গুরু কলাবতী দেবী সবগুলো নৃত্যের কোরিওগ্রাফি ও পরিচালনা করেন।
শুচিশ্রী রায় পরে মঞ্চে আসেন এবং রাগ আনন্দী কল্যাণ (নন্দ) পরিবেশন করেন। শিল্পীর বিলম্বিত একতাল বন্দিশ ‘এ বারে সাইয়াঁ’তে তিনি বিশেষ করে বোল বানাও অঙ্গে আগ্রা ঘরানার ঐতিহ্যবাহী লোক উপাদানগুলো গেয়ে শোনান। তাঁর দ্রুত বন্দিশ ‘পায়েল মোরি বাজে’ ছিল তিনতালে নিবদ্ধ। পরে শুচিশ্রী একটি পূরবী ‘সাওয়ারিয়া পেয়ারে মোরি গুঁইয়া’ গেয়ে শোনান।
বিখ্যাত সন্তুরশিল্পী রাহুল শর্মা রাগ ‘গোরক কল্যাণ’ পরিবেশন করেন। তাঁর বিলম্বিত কম্পোজিশনটি ছিল রূপক তালে, যেখানে দ্রুত কম্পোজিশনটি ছিল পাঞ্জাবি, তিনতালে। রাহুল শর্মার বাজনার চলনটি বিভিন্ন লয়কারী দ্বারা সুসজ্জিত ছিল, যেটা রূপকতালের (সাত মাত্রা) সঙ্গে দারুণ লয়দারির সঙ্গে চলছিল। তাঁর লয়কারী উপস্থাপনার মধ্যে অসামান্য সুন্দর ও মিষ্টি মিষ্টি তেহাই পরিবেশনা দর্শকের মনে মুগ্ধতা জাগায়। গোরক কল্যাণ রাগটি খুবই মিষ্টি রোমান্টিক একটি রাগ, যেটি খাম্বাজ ঠাঁটের অন্তর্গত। এই রাগের প্রতিটি সুরের আন্দোলন রোমান্টিক পরমানন্দ জাগায়। রাহুল তাঁর বাজনায় এমনভাবে সুরের পরমানন্দময় ওঠানামা দেখান, যাতে মনে হচ্ছিল যেন বসন্তকালে পাহাড়ের চারপাশে প্রণয়ীযুগল আনন্দে ঘুরে বেড়াচ্ছে। শিল্পী গোরক কল্যাণ রাগের এমন সুন্দর সাংগীতিক বাগবিধি বা musical phrase রে, মা, ধা, মা, রে, সা ব্যবহার করেন, যা শ্রোতাকে অভিভূত করে।
পন্ডিত উলহাস কশলকর তাঁর স্বতন্ত্র ঢঙে সর্বদাই কম শ্রুত রাগ পরিবেশন করতে পছন্দ করেন। এবারও তার ব্যতিক্রম হয়নি। উৎসবে পন্ডিতজি একটি কঠিন রাগ কামোদ পরিবেশন করে সাংগীতিক সাগরে দর্শক-শ্রোতাদের অবগাহন করান। উলহাসজির বিলম্বিত বন্দিশ ‘এ মতিমালানিয়া’ (ঝুমরা তাল) এবং মধ্যলয় তিনতাল বন্দিশ ‘কারে জানে না ডুঙ্গি’ ছিল অতুলনীয় সব পুকার তান, গমক মুড়কি বাদগারি। গুণী এই শাস্ত্রীয় সংগীত শিল্পীর কণ্ঠস্বর প্রক্ষেপণ এবং বোলবাট লয়কারী মধ্য এবং তার সপ্তকে সুরের সৌন্দর্যকে বাড়িয়ে দিয়েছিল। পন্ডিতজি পরে তিনতালে নিবদ্ধ আড়ানা রাগে একটি রোমান্টিক তারানা পরিবেশন করেন।
বিশিষ্ট রুদ্রবীণা মায়েস্ট্রো ওস্তাদ বাহাউদ্দিন ডাগর রাগ ‘চন্দ্রকোষ’ পরিবেশনার মাধ্যমে তাঁর উপস্থাপনা শুরু করেন। রুদ্রবীণা একটি অতি প্রাচীন এবং স্বর্গীয় বাদ্যযন্ত্র, যার সঙ্গে ভগবান শিবের মাহাত্ম্যের অনুষঙ্গ পাওয়া যায়। ওস্তাদ বাহাউদ্দিন ডাগরের গমকি আলাপ, জোড় এবং ঝালা পরিবেশনা উৎসবের শেষরাতেরও প্রায় ত্রিশ হাজার দর্শক-শ্রোতার মনে বিরাট কৌতূহলের উদ্দীপনা জাগিয়েছিল। রুদ্রবীণার স্বকীয় সুরের আন্দোলন সংগীতপ্রেমীদের সে রাতে সত্যিই খুব মুগ্ধ করেছিল। তিনি অতি প্রাচীন এই যন্ত্রটিকে দর্শকদের সামনে সুন্দরভাবে পরিচয় করিয়ে দেন।
সমগ্র দর্শক-শ্রোতা সে রাতে অধীর আগ্রহ নিয়ে সেই কাঙ্ক্ষিত মুহূর্তের জন্য অপেক্ষা করছিলেন, কখন আধুনিক খেয়াল গায়কির পথস্রষ্টা পদ্মশ্রী ওস্তাদ রাশিদ খান স্টেজে উঠবেন। মহান এই শিল্পী স্টেজে উঠতেই মুহুর্মুহু করতালি দিয়ে দর্শক-শ্রোতা তাঁকে স্বাগত জানান।
ওস্তাদ রাশিদ খানের মহান গায়কি, স্বর ও সুর প্রক্ষেপণের উচ্চতা, সৃজনশীল সাংগীতিক চলমানতা, লয়-ছন্দের ওপর অসামান্য দখল, কম্পোজিশনের গভীরতা এবং শব্দসুরের অপরূপ আন্তঃখেলায় কাঙ্ক্ষিত মুড বা আবেগের বহিঃপ্রকাশ তাঁর সংগীতের হলমার্ক হয়ে দাঁড়িয়েছে, যা বিশ্বব্যাপী অগণিত শিষ্য ও ভক্তের হৃদয় জয় করিয়েছে।
ওস্তাদজি সুরমন্ডল নিয়ে একটি গভীর মেডিটেটিভ ও করুণ রাগ ‘মালকোষ’ পরিবেশনা দিয়ে তাঁর সাংগীতিক সিংহদ্বার খোলেন। মানবাত্মা ও অনন্ত আত্মার মধ্যে যে অন্তরঙ্গ বন্ধন সেটাই ছিল ওস্তাদজির বিলম্বিত বন্দিশ ‘তু হ্যায় মালিক মেরো’র (বিলম্বিত একতালে নিবদ্ধ) নির্যাস। মালকোষ রাগের আলাপকে বিরল পুষ্পের মতো প্রস্ফুটিত করবার সময়ে পুনঃপুন ‘মালিক’ শব্দটি উচ্চারণ করে তিনি সৃষ্টিকর্তাকে তুষ্ট করছিলেন। সারেঙ্গিশিল্পী আল্লারাখা কলাবন্ত মূলত প্রার্থনার মতো করে আলাপ ও বিস্তার বাজান বন্দিশ পরিবেশনার মধ্যে যেটা একটা সাংগীতিক মহল তৈরি করেছিল। ‘ইয়াদ আওয়াতে মোহে পিকি বাতিয়া’ ছিল তাঁর দ্রুত বন্দিশ, যা ছিল তিনতালে নিবদ্ধ। তাঁর গায়কি মনে হচ্ছিল যেন বর্ষার রাতের বারংবার বিদ্যুতের চমক। তবলা মায়েস্ট্রো পন্ডিত শুভঙ্কর ব্যানার্জি তাঁর বাঁয়ায় গমক ও তবলায় বিলম্বিত একতাল ঠেকা সৃষ্টি করে, খাঁ সাহেবের পরিবেশনাটিকে সুন্দর ও মনোহর করে তোলেন।
করুণ কষ্টকে রোমান্টিকতায় রূপায়ণ করে, রাশিদ খান পরে অপর একটি বন্দিশ ‘আজ মোরে ঘর আয়ি রে বালমা’ (দ্রুত তিনতালে নিবদ্ধ) পরিবেশন করে এমন এক সাংগীতিক পরম সীমায় পৌঁছেন, যা সংগীতপিপাসুদের চিরকাল মনে থাকবে। ওস্তাদজির শিষ্য কৃষ্ণা বঙ্গানে চমৎকারভাবে স্মরণীয় ওই সংগীতযাত্রায় কণ্ঠ সহযোগ করেন। পন্ডিত জ্যোতি গুহ হারমোনিয়ামের মায়াময় বাজনার জাদুতে অগণিত সংগীতরসিকের মনে বাড়তি আনন্দ জাগান। পরে তিনি তাঁর নিজ সৃষ্ট একটি রাগ ‘সোহিনী বাহারে’ ছোট খেয়াল পরিবেশন করেন (মোরে পিয়া নজর নেহি আয়ে – তিনতাল)।
ওস্তাদ রাশিদ খান তাঁর পরিবেশনা শেষ করেন ওস্তাদ বড়ে গোলাম আলীর একটি কালজয়ী ঠুমরি ‘ইয়াদ পিয়া কি আয়ে’ গেয়ে। ওস্তাদ বড়ে গোলাম আলী তাঁর স্ত্রীর মৃত্যুতে এ ঠুমরিটি রচনা করেন, ওস্তাদ রাশিদ খান সেটাকে যে মার্গে পরিবেশন করেন, তাতে প্রিয়তমার সহিত প্রিয় স্মৃতির মধুর রোমান্টিক ভাব চিত্রিত হয়।
বিদুষী পারভিন সুলতানা শেষ শিল্পী হিসেবে চার রাতব্যাপী এই সংগীত উৎসবের ইতি টানতে মঞ্চে ওঠেন। ঠুমরি কুইন তাঁর পরিবেশনা শুরু করেন সকালের একটি রাগ ‘গুর্জরি টোড়ি’ গেয়ে। তাঁর বিলম্বিত বন্দিশ ‘ঘর আয়ো বালমা’ (একতালে নিবদ্ধ) এবং দ্রুত বন্দিশ ‘জা রে জারে কাগওয়া’ (তিনতাল) শ্রোতাদের মনে সকালের স্নিগ্ধতা জাগায় বিশেষভাবে যখন তিনি তাঁর সপ্তকের ‘সা’তে স্থায়ী হন। পরে তিনি মিশ্র ভৈরবীতে একটি ঠুমরি ‘ইয়াদ সাতায়ে দিন র্যায়েনা মিতওয়া’ পরিবেশন করেন। শাস্ত্রীয় সংগীতের জীবন্ত কিংবদন্তি এই শিল্পী তাঁর পরিবেশনা শেষ করেন তাঁর জনপ্রিয় একটি হিন্দি ছবির গান ‘হামে তুমসে পেয়ার কিতনা’ (কুদরাত) গেয়ে। অনুরোধে গাওয়া গানটি দর্শকরা মুহুর্মুহু করতালি দিয়ে স্বাগত জানান।
সার্বিকভাবে চার রাতব্যাপী অনুষ্ঠিত শাস্ত্রীয় সংগীতের এতবড় মহাযজ্ঞের আয়োজন এতটাই সুশৃঙ্খলভাবে সম্পন্ন হলো, বিশেষ করে এবারের প্রতিকূল রাজনৈতিক পরিস্থিতি ও সহিংসতার মধ্যেও, যা একটি মাইলফলক হয়ে থাকবে। প্রায় নববই হাজার দর্শক-শ্রোতা এতে অংশ নেন। তাতে এটাই প্রমাণিত হয়, বাংলাদেশের মানুষের শুদ্ধ সংগীতের প্রতি অপার প্রেম ও তৃষ্ণা।
অলোক কুমার সেন একজন শাস্ত্রীয় সংগীতশিল্পী। এছাড়া তিনি লঘুসংগীতের বিভিন্ন ধারা যেমন গজল, ভজন ও আধুনিক বাংলা গান অত্যন্ত দক্ষতার সঙ্গে গেয়ে থাকেন। তিনি বাংলাদেশের বিশিষ্ট শাস্ত্রীয় সংগীতগুরু অনিল কুমার সাহা ও ভারতের স্বনামধন্য শাস্ত্রীয় সংগীতশিল্পী ও গুরু পন্ডিত তুষার দত্তের সুযোগ্য শিষ্য।