logo

রবীন্দ্রনাথের আত্মপ্রতিকৃতি

মৃ ণা ল  ঘো ষ
রবীন্দ্রনাথের আত্মপ্রতিকৃতিগুলি তাঁর বাইরের চেহারার সহজ সরল বর্ণনাত্মক আলেখ্য হয়ে ওঠেনি কখনোই। এই ছবিগুলির প্রায় সব কটিতেই তাঁর সত্তার অন্তর্লীন সংঘাত ও যন্ত্রণা প্রতিধ্বনিত হয়েছে। তাঁর জীবনের শেষ পনেরো-ষোলো বছর কেটেছে এই দ্বন্দ্বাতমক সংঘাত ও যন্ত্রণার ভেতর দিয়ে। এই সময় জুড়েই অসামান্য ব্যতিক্রমী সৃজনশীলতায় মগ্ন ছিলেন তিনি। এই পর্বই তাঁর চিত্রসৃষ্টিরও পর্ব। ১৯২৩-২৪-এ যার প্রাথমিক পদপাত, ১৯২৭-২৮ থেকে পরিপূর্ণ ধারায় প্রবাহিত হয়ে শেষ হয়েছে ১৯৪১-এ, তাঁর প্রয়াণের বছরে। নানা বিষয়ের ছবি তিনি এঁকেছেন। এর মধ্যে মানুষের মুখাবয়ব বা প্রতিকৃতি বিশেষ একটি ধারা। এরই মধ্যে এসেছে কয়েকটি আত্মপ্রতিকৃতি। সংখ্যায় খুব বেশি নয়। মোটামুটি বারোটি আত্মপ্রতিকৃতি এখন দেখার সুযোগ পাওয়া যায়। এগুলি ১৯৩২ থেকে ১৯৩৮ সালের মধ্যে অাঁকা।

জীবনের এই শেষ পর্বে কবির চেতনার মধ্যে আলো-অন্ধকারের এক দ্বন্দ্বাতমক টানাপড়েন চলেছে সবসময়ই। এর কিছুটা ব্যক্তিগত, অনেকটাই জাতীয় ও আন্তর্জাতিক ইতিহাস ও রাজনীতির বিপর্যস্ত পরিস্থিতি থেকে সঞ্জাত। ‘সভ্যতার সংকট’ প্রবন্ধে অত্যন্ত দৃপ্ত ভাষায় তিনি এই অবক্ষয়ের চরিত্র বিশ্লেষণ করেছেন। ‘সভ্যতার সংকট’ লেখা হয়েছিল ১ বৈশাখ ১৩৪৮ বা ১৫ এপ্রিল ১৯৪১ তারিখে। এই প্রবন্ধে অবশ্য নিরাশার মধ্যেও কিছু আশার আলোকরশ্মি ছিল, যার প্রকাশ ঘটেছে সমাপ্তির এই কবিতা বা গানে – ‘ওই মহামানব আসে,/দিকে দিকে রোমাঞ্চ লাগে/মর্তধূলির ঘাসে ঘাসে।’

এর কিছুদিন পরে জীবনের একেবারে প্রান্তিক পর্যায়ে পৌঁছে তিনি  একটি ছোট প্রবন্ধ লেখেন ‘সৃষ্টির আত্মগ্লানি’ শিরোনামে। এর রচনাকাল ২ জুলাই ১৯৪১। এটি প্রকাশিত হয়েছিল সুধীন্দ্রনাথ দত্ত-সম্পাদিত পরিচয় পত্রিকার শ্রাবণ ১৩৪৮ সংখ্যায়, তাঁর প্রয়াণের মাসে। এই রচনার সূচনা-অংশটি ছিল এরকম :

‘আদিম অন্ধকারের পথহারা গহবরের ভিতর থেকে পরিব্যাপ্ত হয়ে উঠেছে অপরিসীম অনিদ্রা, অস্বাস্থ্যে আবিল। তার অতলস্পর্শ পঙ্কশয্যা থেকে ক্ষণে ক্ষণে দেখা দিচ্ছে অতিকায় কুৎসিত অর্ধগঠিত জলহস্তীর দল।’ এই প্রবন্ধের সমাপ্তিতে কিন্তু আর কোনো আলো দেখতে পাননি কবি। লেখাটি শেষ হচ্ছে এভাবে :

‘সেই আদিম – সেই ভয়ংকর – সেই আত্মহিংস্রক – সেই নরঘাতী তার চিরকালের গহবরের থেকে হঠাৎ কখন আবার দেখা দেয় – বলে যে, বর্বর এখনো মরেনি, কদর্য এখনো তার রাজ্যের জন্য লড়াই করছে।’

এই যে তমসার দর্শন এটা প্রগাঢ় হতে থেকেছে তাঁর জীবনের শেষ পর্বে। তাঁর ছবিতে এই দর্শনের অনিবার্য প্রতিফলন রয়েছে। কিন্তু তাঁর ছবিতেও অন্ধকার বা বিপর্যয়ই শেষ কথা হয়ে ওঠেনি।

তাঁর শেষ কবিতাটি স্মরণ করতে পারি আমরা। লেখা হয়েছিল বা বলা হয়েছিল উপরোক্ত প্রবন্ধের আটাশ দিন পরে ৩০ জুলাই তারিখে। ‘তোমার সৃষ্টির পথ রেখেছ আকীর্ণ করি/বিচিত্র ছলনাজালে/হে ছলনাময়ী!’ এই যে পথ, এ শুধুই অন্ধকারের পথ নয়। কিছু আলোকিত উদ্ভাসও থাকে তাতে। ‘বাহিরে কুটিল হোক, অন্তরে সে ঋজু’। জীবনের এই সত্যকে পাওয়া যায় ‘আপন আলোকে-ধৌত অন্তরে অন্তরে।’ এই আলো-অাঁধারের দ্বন্দ্বাত্মক ব্যঞ্জনাই নানাভাবে এসেছে তাঁর বিভিন্ন ছবিতে। তাঁর আত্মপ্রতিকৃতিতেও।

রবীন্দ্রনাথের গানেও বারবার এসেছে প্রবল দুঃখের অভিঘাত। কিন্তু গানের ভেতর দিয়ে দুঃখকে অতিক্রম করে তিনি আনন্দে পৌঁছেছেন সহজে। পয়ষট্টি বছর বয়সে পৌঁছেও, যখন তিনি সচেতন, যে যথেষ্ট পুরনো হয়ে গেছেন তিনি, গানে বলছেন, ‘পুরানো জানিয়া চেয়ো না আমারে আধেক অাঁখির কোণে অলস অন্য মনে।’ তখনো তাঁর ভেতর ঝলসে ওঠে এই আলো ‘আমার দিনের সকল নিমেষ ভরা অশেষের ধনে’। ২১ জানুয়ারি ১৯২৭ তারিখে রচিত এই গানের সমসাময়িক কাল থেকেই পরিপূর্ণ মাত্রায় তিনি প্রবেশ করেছেন তাঁর ছবির জগতে। ছবিতে কিন্তু পরিস্ফুট হয় তাঁর অন্য একটি সত্তা, যা বারবারই প্রশ্নাকুল সংশয়ে দীর্ণ। তাঁর আত্মপ্রতিকৃতি এই দ্বন্দ্বাত্মক সংশয় থেকেই সঞ্জাত। যেখানে ‘সেই রুদ্রমানবের আত্মপরিচয়ে বঞ্চিত/ক্ষীণ পান্ডুর আমি/অপরিস্ফুটতার অসম্মান নিয়ে যাচ্ছি চলে -’। পত্রপুটের একটি কবিতায় বলেছিলেন একথা। একদিকে ‘রুদ্রমানবের আত্মপরিচয়’, আর একদিকে ‘ক্ষীণ পান্ডুর আমি’ – এই দুইয়ের এক অসংগতি থেকেই জেগে উঠেছে তাঁর ছবি। আত্মপ্রতিকৃতিতে এই অসংগতির বেদনাই ধ্বনিত হয়েছে বারবার।

একটি বিশেষ ছবির ভেতর দিয়ে আমরা প্রবেশের চেষ্টা করতে পারি তাঁর আত্মপ্রতিকৃতির জগতে। সেই আত্মপ্রতিকৃতিটি অাঁকা হয়েছিল ২৪ এপ্রিল ১৯৩৬ তারিখে। শিল্পীর স্বাক্ষরের সঙ্গে নিজ হাতে তারিখ লেখা আছে সেখানে। শঙ্খ ঘোষ তাঁর নির্মাণ আর সৃষ্টি গ্রন্থের ‘ছবি’ শীর্ষক অধ্যায়টি শুরু করেছিলেন এই ছবিটির উল্লেখে। ‘কালো পাথরের বুক ভেঙে যেন নেমে আসছে আগুনের ঢল,’… এই ছিল ছবিটির প্রাথমিক বর্ণনা। ‘গাঢ় খয়েরি হলুদে মেশানো সেই মুখের ছবি দেখে’… ‘মনে পড়ে কোনো কালো গুহার ক্ষুধিত গহবরের কথা, আগুনের হলকায় ওখানেও যেন নেমে আসছে কোনো ক্ষুভিত ঝর্ণাই।’ এই যে এক রুদ্রতা মেশানো প্রবল সংক্ষোভ থেকে নিজের দিকে তাকানো, এরই বিভিন্ন দৃশ্যরূপ তিনি তৈরি করেছেন তাঁর বিভিন্ন আত্মপ্রতিকৃতিতে। শেষ পর্যায়ের নানা কবিতায় এই সংক্ষুব্ধতার পরিমন্ডল অনেকবারই এসেছে। যেমন পঁচাত্তর বছর বয়সে অাঁকা এই ছবিটির এক মাস পরেই প্রান্তিকের একটি কবিতায় কবি লেখেন – ‘দেখিলাম অবসন্ন চেতনার গোধূলিবেলায়/দেহ মোর ভেসে যায় কালো কালিন্দীর স্রোত বাহি/নিয়ে অনুভূতিপুঞ্জ’। এই সূত্রও শঙ্খ ঘোষের উক্ত প্রবন্ধ থেকে আমরা পাই।

পঁচাত্তর বছর বয়সে তাঁর রচিত গানের সংখ্যা ঊনপঞ্চাশ। এর অনেকগুলিই শ্যামা নৃত্যনাট্যের জন্য রচিত। এর ভেতর ‘পূজা’ ও ‘প্রকৃতি’ পর্যায়ের যে গান আছে, সেখান থেকে দুটি গান যদি আমরা তুলে নি দৃষ্টান্ত হিসেবে, তাহলে দেখা যায়, গানে দুঃখের ভেতরেও সমর্পণের সুরটাই প্রধান হয়ে থাকে। পূর্বোক্ত আত্মপ্রতিকৃতির কয়েক মাস পরে ২৫ জানুয়ারি ১৯৩৭ তারিখে রচিত হয়েছিল এই গান – ‘দুঃখের তিমিরে যদি জ্বলে তব মঙ্গল-আলোক/তবে তাই হোক’। এখানে মৃত্যুর মধ্যেও তিনি পেয়ে যান ‘অমৃতময় লোকে’র সন্ধান। অথবা ‘প্রকৃতি’র অন্তর্গত আর একটি গান ‘ওই মালতীলতা দোলে’। পূর্ববর্তী গানটির কিছুদিন আগে (কার্তিক ১৩৪৩) রচিত এই গানটিতে ‘পরবাসী’ এক ‘বন্ধু’ জেগে থাকে, প্রতীক্ষা করে ‘কোন নিভৃত বাতায়নে’। এ সমস্ত গানে সম্ভাবনার আলো বা সমর্পণের সুরই প্রধান হয়ে থাকে বিরহের মধ্যে, দুঃখ ও মৃত্যুর মধ্যেও। তাঁর ছবিতে, বিশেষত আত্মপ্রতিকৃতিতে এরকম নির্দ্বন্দ্ব আলোর সন্ধান কমই পাওয়া যায়। তাঁর গান ও ছবি তাঁর চেতনার দুই প্রান্তের মধ্যে আন্দোলিত হয়। ছবিতে থাকে এক মগ্ন অাঁধার। আর গানে ‘দুঃখের তিমির’ ভেদ করেই জ্বলে ওঠে ‘মঙ্গল-আলোক’। এই দুইয়ে মিলেই পরিপূর্ণ হয় তাঁর সৃজনের সত্তা।

পূর্বোক্ত আত্মপ্রতিকৃতিটির প্রায় নয় মাস আগে চন্দননগরে অবস্থানের সময়ে তিনি এঁকেছিলেন আর একটি আত্মপ্রতিকৃতি। সেটি রচনার তারিখ ছিল ১ আষাঢ় ১৩৪২ (১৯৩৫)। অন্ধকার ভেদ করে পুঞ্জ পুঞ্জ কিছু আলোক-বিচছুরণে গড়ে উঠেছে দীর্ঘায়ত সন্তপ্রতিম এই মুখ। পুঞ্জিত তমসার অভিব্যক্তি সেখানে। অভিব্যক্তিবাদী বা এক্সপ্রেশনিস্ট আঙ্গিকের সার্থক দৃষ্টান্ত এই মুখাবয়ব। ফর্ম ভাঙার মধ্যেও লক্ষ করা যায় অসামান্য গাঠনিক দৃঢ়তা ও সংহতি। রবীন্দ্রনাথ স্বাভাবিকতাবাদী অঙ্কনশৈলীতে খুব দক্ষ ছিলেন না, এ কথা অনেকেই মনে করেন। এই ছবিটি দেখলে বোঝা যায়, এই ধারণা একেবারেই ঠিক নয়। এই ছবিতে যে গাঠনিক সংহতি, ফর্ম ভেঙেও নিজের মুখের আদলটিকে সম্পূর্ণ বজায় রেখে যেভাবে এর মধ্যে তিনি চেতনার সকরুণ তমিস্রাকে মেলে ধরেছেন অঙ্কনে যথেষ্ট দক্ষতা ছাড়া তা সম্ভব নয়। কিন্তু দক্ষতার থেকেও অতিরিক্ত কিছু ছিল কবির চিত্রসাধনায়। ছিল গভীর এক আত্মদর্শন। আর চুয়াত্তর বছর বয়সে পৌঁছে সেই আত্মদর্শন আলোড়িত হয়েছে মানুষের এই সভ্যতার সমস্ত ভ্রষ্টতার কালিমাকে আত্মস্থ করে। একদিকে তাঁর আশৈশব চর্চিত ঔপনিষদিক প্রজ্ঞা, আর একদিকে সভ্যতার অন্তরে সঞ্চিত পাপ, এই দুইয়ের সমন্বয়ে গড়ে উঠেছিল কবির যে বিশ্বদৃষ্টি তারই প্রকাশ ঘটেছে এই মুখাবয়বটিতে।

আঙ্গিকের দিক থেকে এই ছবিটির মধ্যে পাশ্চাত্যের কোনো এক্সপ্রেশনিস্ট শিল্পীর ছবির প্রচ্ছায়া দেখা যায়। এমিল নোলদের দুটি ছবি এ প্রসঙ্গে উল্লেখযোগ্য। ১৯০৯ সালে কালি-কলম ও জলরঙে অাঁকা একটি ছবি যিশুখ্রিষ্টের মুখ। দ্বিতীয়টি, ১৯১২-তে অাঁকা একটি কাঠ-খোদাই, শিরোনাম ‘প্রফেট’। প্রথম ছবিটিতে যিশুর মুখমন্ডলে শান্ত ও করুণ অভিব্যক্তি দৃশ্যমান। দ্বিতীয় ছবিটিতে সাদা-কালোর তীক্ষ্ণ নাটকীয় বৈপরীত্যে গাম্ভীর্য ও শঙ্কাকুল অন্তর্মুখীনতার ব্যঞ্জনা রয়েছে। ছবির গঠন ও রূপবন্ধের দিক থেকে এই ছবিটির সঙ্গে রবীন্দ্রনাথের চন্দননগরে অাঁকা আত্মপ্রতিকৃতিটির অনেক মিল লক্ষ করা যায়। অভিব্যক্তির     শান্ততার দিক থেকে প্রথমোক্ত ছবিটির সঙ্গেও এর সাযুজ্য রয়েছে। ‘প্রফেট’ ছবিটি রবীন্দ্রনাথের নজরে এসেছিল বলে মনে করা হয়। রবীন্দ্রনাথকে তাঁর ছবির গঠনে অভিব্যক্তিবাদী অন্তর্মুখীনতা খুবই প্রভাবিত করেছিল। অভিব্যক্তিবাদের সঙ্গে আদিমতার নিবিড় সম্পর্ক রয়েছে। এই দুটি আঙ্গিকই হয়ে উঠেছিল রবীন্দ্রনাথের চিত্রসৃষ্টির অন্যতম আঙ্গিকগত উৎস। আলোচ্য আত্মপ্রতিকৃতিটি সেদিক থেকে খুবই প্রাসঙ্গিক। শান্ত-করুণ এক বিনতি আছে এই ছবিতে, তাঁর সাহিত্য বা সংগীতে যার দৃষ্টান্ত বিরল।

এই ছবিটির সঙ্গে দূরতর এক সাযুজ্য লক্ষ করা যায় রামকিঙ্করের করা একটি মুখাবয়ব ভাস্কর্যের। রামকিঙ্করের দুটি রবীন্দ্র-মুখাবয়ব ভাস্কর্য সকলেরই পরিচিত। দুটিই অভিব্যক্তিবাদীরীতির। একটি ১৯৩৮-এ করা। সেখানে বিমূর্তায়ন একটু বেশি প্রগাঢ়। ডান চোখটি যেন ঠিকরে বেরিয়ে আসছে। তীব্র যন্ত্রণাক্ত অভিব্যক্তি। দ্বিতীয়টি আরো একটু পরবর্তী সময়ের। রবীন্দ্রনাথের সামনে বসে মাটির স্কেচটি করেছিলেন রামকিঙ্কর। এন্ড্রুজ তখন সদ্য প্রয়াত হয়েছেন। সেই শোকের ছায়া কবির দেহে-মনে। টেবিলের ওপর অবনত হয়ে লিখছিলেন তিনি। সেই ভঙ্গিটিকেই রূপ দিয়েছেন রামকিঙ্কর। বিষাদময়তায় এই মূর্তিটির বেশি মিল খুঁজে পাওয়া যায় আত্মপ্রতিকৃতিটির সঙ্গে।

দেশে বা বিদেশে রবীন্দ্রনাথের প্রতিকৃতি এঁকেছেন বা গড়েছেন অগণিত শিল্পী। ১৮৮১ সালে জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ঠাকুর এঁকেছিলেন তাঁর মুখের পার্শ্বচিত্র। এর আগে কেউ এঁকেছিলেন কি না, জানা নেই। ১৮৯২-তেও জ্যোতিরিন্দ্রনাথের একটি স্কেচ রয়েছে। তারপর ১৮৯৪-তে অাঁকা অবনীন্দ্রনাথেরপ্যাস্টেল-মুখাবয়ব চিত্রটি অনুপুঙ্খ স্বাভাবিকতাবাদী রীতির অসামান্য দৃষ্টান্ত। তারপর থেকে অজস্র ধারায় আজ পর্যন্তও অাঁকা হয়ে চলেছে রবীন্দ্রনাথের প্রতিকৃতি। গগনেন্দ্রনাথ, নন্দলাল বসু, অসিতকুমার হালদার, মুকুল দে, ধীরেনকৃষ্ণ দেববর্মা, শশী হেশ, অতুল বসু, হেমেন্দ্রনাথ মজুমদার, যামিনী রায় থেকে সত্যজিৎ রায় ও পরবর্তী প্রজন্মের অজস্র শিল্পী। বিদেশি শিল্পীদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য উইলিয়াম রদেনস্টাইন, আর্চার, লিওনার্ড জেনিংস, মীরা রিশার (শ্রীমা), জেকব এপস্টাইন, এলিজাবেথ মাস ব্লুনার, চিনের শিল্পী জু পিয়োঁ, সি এফ এনড্রুজ প্রমুখ। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই কবির শান্ত, সৌম্য, সন্তপ্রতিম মুখটি প্রাধান্য পেয়েছে। রামকিঙ্করের ভাস্কর্যদুটি যেমন বিরল ব্যতিক্রম অন্তর্মুখী অভিব্যক্তি উন্মোচনের দিক থেকে, তেমনি বিষাদ-প্রতিমার রূপায়ণে উল্লেখযোগ্য সি এফ এনড্রুজ ও এপস্টাইনের রচনাদুটি। পরবর্তীকালে বিষাদমগ্ন কবির প্রতিকৃতি অবশ্য আরো অনেকেই এঁকেছেন। এ প্রসঙ্গে একটি ছবি বিশেষ উল্লেখযোগ্য। ১৯১৫ সালে এটি এঁকেছিলেন ম্যাক্স বীরবোহম (Max Beerbohm)। ছবিটির শিরোনাম Mr. William Rothenstein warns Mr. Tagore against being spoilt by accidental success। ছবিটিতে দেখা যাচ্ছে, শীর্ণকায় রবীন্দ্রনাথ দাঁড়িয়ে আছেন। দীর্ঘায়ত মুখমন্ডলে বিষাদমগ্ন করুণাঘন অভিব্যক্তি। সামনে দুহাত তুলে বসে আছেন রদেনস্টাইন। কার্টুনধর্মী এই ছবিটিতে রবীন্দ্রনাথের অভিব্যক্তির বিমর্ষতা লক্ষণীয়। ছবিটি আছে অ্যান্ড্রু রবিনসনের বইতে।

আত্মপ্রতিকৃতিতে একজন শিল্পী তাঁর সত্তার সত্য রূপটিকে তুলে ধরতে চান, একটি বিশেষ সময়ে যে রূপটিকে তিনি সত্য বলে মনে করেন, বাইরের মানুষ যার সন্ধান অনেক সময়ই পান না। ‘নার্সিসিজম’ বা আত্মসচেতনতা যেমন আত্মপ্রতিকৃতির একটি উৎস, তেমনি আত্মকরুণা, জীবনসঞ্জাত গভীর বেদনাবোধ প্রকাশের জন্যও একজন শিল্পী নিজের মুখের ছবি অাঁকেন, যা তিনি অন্য কোনোভাবেই প্রকাশ করতে পারেন না। রবীন্দ্রনাথের আত্মপ্রতিকৃতিগুলি, বিশেষত যে দুটি এ পর্যন্ত উল্লিখিত হলো, তাতে এই বেদনাবোধের প্রকাশই সবচেয়ে বেশি। ভাষার মাধ্যমে সারাজীবন ধরেই রবীন্দ্রনাথ পরিস্ফুট করে গেছেন এই বিশ্বে নিজের অবস্থান। অন্তর্লোকও নানাভাবে উদ্ঘাটিত হয়েছে তাতে। জীবনস্মৃতি ও ছিন্নপত্রাবলী দুটি স্মরণীয় গ্রন্থ, যেখানে কবি নিজেকে অকৃপণভাবে উন্মোচিত করেছেন। তারপরেও সারাজীবন ধরে অজস্র লেখায় নিজেকে উন্মীলিত করেছেন তিনি। তাতে তাঁর বিষাদ, হতাশা, যন্ত্রণা সবই পরিস্ফুট হয়েছে। তবু শেষ জীবনের আত্মপ্রতিকৃতিগুলিতে বিষাদে, কৌতুকে, করুণায় যেভাবে মগ্নসত্তার দৃশ্যরূপ গড়ে তুলেছেন তিনি, তাঁর সাহিত্যে বা গানে এর কোনো বিকল্প নেই। এর ভেতর ‘নার্সিসিজম’ সেভাবে নেই, যেমন আছে ব্যথিত মগ্ন দৃষ্টি, সভ্যতার বিপর্যয়-সম্পৃক্ত গভীরপ্রসারী বিষাদ।

বিশ্বজুড়ে যত শিল্পী আত্মপ্রতিকৃতি এঁকেছেন, সেখানে দোলাচল রয়েছে দুটি প্রান্তের মধ্যে : আত্মগরিমা ও আত্মকরুণা। আত্মতার প্রকাশ আত্মপ্রতিকৃতির প্রধান অবলম্বন। সেই আত্মতা এই দুটি প্রান্তের মধ্যে আন্দোলিত হয়।

১৫১০ সালে জার্মান শিল্পী আলব্রেখট ড্যুরার যখন অনুপুঙ্খ স্বাভাবিকতায় নিজের দন্ডায়মান নগ্ন প্রতিকৃতি অাঁকেন বা যখন নিজেকে উপস্থাপিত করেন খ্রিষ্টের সাজে, তখন করুণার অভিব্যক্তিই প্রাধান্য পায়। রেমব্রান্টের ১৬৬৮ বা ১৬৬৯-এর আত্মপ্রতিকৃতিতে আলো-ছায়ার দ্বৈতের মধ্যেও সমৃদ্ধ এক আত্মগরিমার প্রকাশ থাকে। এই আত্মগরিমার উগ্র প্রকাশ ঘটেছে বিংশ শতকে সালভাদর দালির ছবিতে। স্বাভাবিকতা-সম্পৃক্ত পোস্ট-ইম্প্রেশনিস্ট আঙ্গিকে রচিত ভ্যান গঘের আত্মপ্রতিকৃতিতে যে অন্তর্লীন মগ্নতার প্রকাশ দেখা যায়, আঙ্গিকের দিক থেকে রবীন্দ্রনাথ অনেক দূরবর্তী হলেও সেই মগ্নতাকেই অনেক গভীর থেকে তিনি তুলে আনেন তাঁর আতমপ্রতিকৃতিতে। জাপানের শিল্পী হাকুসাইয়ের ১৮৪৩-এ অাঁকা রেখাভিত্তিক একটি আত্মপ্রতিকৃতিতে দেখা যায় আত্মগরিমা ও আত্মকরুণার দ্বান্দ্বিক সম্পৃক্ততা।

পিকাসো বিভিন্ন পর্যায়ে নানাভাবে এঁকেছেন নিজেকে। নীল-পর্ব থেকে কিউবিস্ট-পর্ব এবং এর পরবর্তী পর্যায়েও নানাভাবে উপস্থাপিত হয়েছে তাঁর নিজের মুখ। আত্মগরিমাকে তিনি এমনভাবে মিশিয়ে দিয়েছেন আত্মকরুণার সঙ্গে যে তা হয়ে উঠেছে এই বিপর্যস্ত বিশ্বের অবক্ষয়ের বিরুদ্ধে তাঁর প্রতিবাদ। গগনেন্দ্রনাথ, নন্দলাল বসু, অতুল বসু থেকে শুরু করে প্রকাশ কর্মকার, গণেশ পাইন, যোগেন চৌধুরী পর্যন্ত আত্মপ্রতিকৃতির যে ধারাবাহিকতা, তাতে জীবনদৃষ্টির নানা দিক উদ্ভাসিত হয়। নন্দলাল বসুর কৌতুকদীপ্ত আত্মরূপায়ণগুলি এর মধ্যে স্বতন্ত্র এক পরিসর জুড়ে থাকে।

আধুনিক যুগে আত্মপ্রতিকৃতি রচনার এই আবিশ্ব প্রেক্ষাপটেও রবীন্দ্রনাথের আত্মপ্রতিকৃতি একেবারেই ব্যতিক্রমী ও স্বতন্ত্র ধারার। আত্মমগ্নতা ও গভীর বেদনাবোধ তাঁর আত্মপ্রক্ষেপের প্রধান উৎস। আত্মগরিমা বা ‘নার্সিসিজমে’র সমস্ত অবশেষ থেকে অনেক দূরে থাকে তাঁর এই প্রকাশ। সেই যে গীতাঞ্জলি পর্বে তিনি লিখেছিলেন ‘সকল অহংকার হে আমার ডুবাও চোখের জলে’ সেই  বাণীরই দৃশ্যরূপ যেন ধ্বনিত হয়েছে তাঁর ছবির বিস্তারে, বিশেষতআত্মপ্রতিকৃতিতে। ‘দুঃখের মন্থনবেগে’ তিনি তুলে এনেছেন ‘অমৃত’। অন্তর্লীন করুণা থেকে আলোছায়াময় ধ্যানমগ্নতার প্রকাশ ঘটেছে তাঁর আত্মপ্রতিকৃতিতে।

ঠিক কতগুলি আত্মপ্রতিকৃতি তিনি এঁকেছিলেন, তার সঠিক সংখ্যা নির্ণয় করা কঠিন। মোটামুটি বারোটি আত্মপ্রতিকৃতি প্রতিক্ষণ প্রকাশিত রবীন্দ্র-চিত্রাবলীতে অন্তর্ভুক্ত হয়েছে। তার মধ্যে মাত্র দুটির কথা আমরা ইতিপূর্বে উল্লেখ করেছি। সোমেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায় তাঁর রবীন্দ্র-চিত্রকলা গ্রন্থে কয়েকটি আত্মপ্রতিকৃতির উল্লেখ করেছেন, যার সবগুলি সাধারণের পক্ষে সবসময় দেখা সম্ভব হয় না। বিশ্বভারতীর রবীন্দ্রভবনে সংগৃহীত আছে সেগুলি। তাঁর লেখার উদ্ধৃতি সূত্রেই এর কয়েকটি উল্লেখ করা যায়। ‘যেমন –  ১. ভাঙা কাঠের আলমারির পাল্লায় রঙিন ছবি; ২. পেনসিলে অাঁকা, ছবিজুড়ে মুখের অংশবিশেষ মাত্র; ৩. অনেকটা জিওম্যাট্রিক্যাল, কালিমালিপ্ত মুখ, ঈষৎ ক্রুদ্ধ দৃষ্টি, আবক্ষ; ৪. পেনসিলে পূর্ণ প্রতিকৃতি, পাহাড় গাছ আকাশ, উজ্জ্বল গম্ভীর পরিবেশে রবীন্দ্রনাথ; ৫. সারস ও আত্মপ্রতিকৃতি – প্রতিকৃতি পটভূমিতে পর্যবসিত – কালো সাদায় অাঁকা; এই ছবিটি যুগোস্লাভিয়া শতবার্ষিকী গ্রন্থের প্রচ্ছদরূপে ব্যবহৃত; ৬. ভূদৃশ্যচিত্রের মধ্যে যেন যোগাসনে ধ্যানমগ্ন মূর্তি, রঙিন; ৭. এক বাংলা মাসিকের মলাটে নিজ মুখ – মুখচ্ছবি ভেদ করে সম্পাদকের নাম সন তারিখ পরিদৃশ্যমান।’

এর দু-একটি রবীন্দ্র-চিত্রাবলীতে আমরা দেখতে পাই। সবগুলি সেখানে নেই।

যে আত্মপ্রতিকৃতিগুলি এখন সকলেরই দেখার সুযোগ আছে, তার কয়েকটি আমরা একটু দেখে নেওয়ার চেষ্টা করব। ১৯৩২-এ অাঁকা একটি আত্মপ্রতিকৃতিতে নিজের এক সম্মুখবর্তী মূর্তি উপস্থাপন করেছেন তিনি। রঙিন কালি ও পোস্টার কালারে অাঁকা। হলুদ, সাদা ও কৃষ্ণাভ লালের বিচ্ছুরণ প্রেক্ষাপট ও অবয়বজুড়ে। নিমগ্ন, বিষণ্ণ, করুণ দৃষ্টি। অন্তর্মুখী শোকার্ত অভিব্যক্তি। নাকটি প্রলম্বিত, তীক্ষ্ণ। কপালে ও নাকের উপরিভাগে আলো বিচ্ছুরিত হচ্ছে। বিষাদমগ্ন চক্ষু দর্শকের দিকে তাকিয়ে আছে। অথচ দৃষ্টি যেন শূন্যে বিলীন।

১৯৩৪-এর কয়েকটি ছবি রয়েছে, যেগুলি বিশ্বভারতী নিউজ মে ১৯৩৪ সংখ্যার প্রচ্ছদে অাঁকা। এগুলি অাঁকা হয়েছে প্রচ্ছদের অন্য ছবির ওপর তুলি চালিয়ে। অন্তত পাঁচটি এরকম আত্মপ্রতিকৃতি পাওয়া যায়। বাকি কয়েকটি আছে, যেখানে তিনি এঁকেছেন অন্যের মুখ। রঙিন কালি ও পোস্টার রঙে অাঁকা এগুলি। এর একটিতে দেখা যায় অন্ধকার প্রেক্ষাপট। তার ভেতর থেকে বেরিয়ে এসেছে আবক্ষ মুখ। মুখের সামনের দিকে পড়েছে এক ঝলক স্তিমিত আলো। উজ্জ্বল চোখদুটি থেকে দৃষ্টি নিবদ্ধ একটু ওপরের দিকে। আত্মবিশ্বাসী অভিব্যক্তি। একটু কৌতুক মেশানো। আর একটি ছবিতে দেখা যাচ্ছে দীর্ঘায়ত আয়তাকার মুখ। মুখের ওপর সবুজ রেখার আলম্ব বিস্তার। গম্ভীর অভিব্যক্তি। উজ্জ্বল চোখদুটি ওপরে তোলা। সামনের দিকে দৃষ্টি প্রসারিত। এই ছবিগুলিতে নিজেকে নিয়ে প্রচছন্ন কৌতুক যেমন আছে, তেমনি অভিব্যক্ত হচ্ছে রহস্যময় অন্তর্দৃষ্টি।

১৯৩৪-৩৫-এ  অাঁকা একটি দাঁড়ানো মূর্তি আছে কাগজের ওপরে পেনসিলে রচিত। পা পর্যন্ত ঢাকা জোববা পরে দাঁড়িয়ে আছেন কবি। লম্বমান হাতদুটি পোশাকের সঙ্গে মিশে গেছে। বিস্রস্ত চেহারায় মুখটিও তত স্পষ্ট নয়। ১৯৩৫-এ চন্দননগরে অাঁকা ছবিটির কথা আমরা বলেছি আগে। ১৯৩৬-এ পেনসিলে অাঁকা একটি অসামান্য আত্মপ্রতিকৃতি আছে। ছবিটিতে স্বাক্ষরের সঙ্গে তারিখ রয়েছে ১০ বৈশাখ ১৩৪৩। দীর্ঘায়ত মুখ। চোখদুটি ছোট। মুখটি আলোয় আবিল। প্রেক্ষাপটে আলম্ব রেখার বিচ্ছুরণ। ১৯৩৬-এ অাঁকা আগুনের হলকার মতো মুখটির কথাও আমরা বলেছি আগে। ১৯৩৮-এর কালি-কলমে অাঁকা একটি ছবিও তাঁর সমৃদ্ধ আত্মপ্রতিকৃতিগুলির অন্যতম। নীমিলিত সংকুচিত চোখ। মুখটি গড়ে উঠেছে সমান্তরালভাবে উপস্থাপিত আলম্ব রেখার ঘন সন্নিবেশে। ধ্যানমগ্নতায় করুণাদীপ্ত এক সংবৃত মুখচ্ছবি পাই এখানে।

কবিতায়, গানে বা অন্য মাধ্যমে যে মনোভঙ্গি বা চেতনারঅন্তর্দীপ্তি প্রকাশ করতে পারেননি রবীন্দ্রনাথ, তাই পরিস্ফুট হয়েছে তাঁর আত্মপ্রতিকৃতিতে। বিশ্বব্যাপ্ত নানা ধারার আত্মপ্রতিকৃতির মধ্যে তাঁর রচনাগুলি অত্যন্ত স্বতন্ত্র একটি পরিসর তৈরি করেছে।

Leave a Reply