সাক্ষাৎকার গ্রহণ : রশীদ আমিন
প্রশ্ন : আপনার এই প্রদর্শনী দিয়েই শুরু করি, আপনার এই প্রদর্শনীটি বেশ সাড়া জাগিয়েছে। নতুন ধরনের এবং বেশ বড় বড় কাজ দেখছি। সবাই খুব প্রশংসা করছে। আপনার এই চমৎকার এবং সফল এক্সিবিশন আমাদের এই শিল্পাঙ্গনে উল্লেখযোগ্য ঘটনা। আপনি নিজে কীভাবে দেখছেন?
রফিকুন নবী : কয়েক বছর পরপর সলো এক্সিবিশনের পক্ষপাতী আমি নই। সলো এক্সিবিশন করাটা আমি কঠিন মনে করি। কঠিন বলতে এরকম যে, আমি কিছু ছবি অাঁকলাম, টানালাম – এটা কোনো ঘটনা নয়; up to mark না হলেও তারপরও টানিয়ে দিলাম, এরকম যাতে না হয় সেই ভাবনা আমার সবসময় থাকে। আমার মনে হয়, যা কিছু করছি তা মানুষকে এত ঘটা করে দেখাবার মতো কিছু নয়। তাই সলো এক্সিবিশন অনেক দেরিতে দেরিতে করি। অনিচ্ছা সত্ত্বেও করি, আর চাপের চোটে করি। যারা আমার শুভানুধ্যায়ী কিংবা আমার কাজের ব্যাপারে যাদের একধরনের অনুসন্ধিৎসা রয়েছে যে, এখন উনি কী করছেন, কেমন করছেন, এই ব্যাপারটা যখন থাকে তখন আবার না করে পারি না। তাদের এই দাবি এড়িয়ে যেতে যেতে একসময় ধরা পড়ে যাই। এরই ধারাবাহিকতা এবারের এক্সিবিশন। আমি সবসময় যা করি তা আমার নিজের মনে করে করি। একজন আর্টিস্টের টেকনিক্যাল ভাবনা-চিন্তা, তারপর কী করতে চায় বা ছবির ব্যাপারটা কীভাবে সাজাবে না সাজাবে, এ ব্যাপারটা তার ভেতরেই থাকে। সেখান থেকে একলাফে বা ঝট করে একটা ধরন থেকে দূরে সরে যাওয়া, সেই চান্সটা কম। একটা ধারাবাহিকতা বা পরম্পরা তো থাকবেই। আমি মনে করি, এবারের এক্সিবিশনে সেই জিনিসটা আছে। তবে কিছু বড় কাজ ছিল, এগুলো বিষয়ের দিক থেকে, কম্পোজিশনের দিক থেকে, টেকনিক্যাল দিক থেকে একই থাকলেও বড় কাজ করতে গিয়ে চেষ্টা করেছি সব বিষয়ে খোলামেলা হওয়ার। এতে বেশ মজা পেয়েছি, ভালোও লেগেছে। এর আগেও বড় কাজ করেছি, তবে এবারের কাজগুলো একটু বেশি বড়। এই এক্সিবিশন করায় ঢাকা আর্ট সেন্টারের সবার বড় একটা ভূমিকা আছে। বিশেষ করে আমার ছাত্র, সহকর্মী এবং শিল্পাঙ্গনে সহযাত্রী নিসার হোসেনের কথা বিশেষভাবে বলব। সে তো একটা জেদ নিয়ে চলে, মানে যে কাজ নিয়ে পড়ে এর একেবারে ফাইনাল রূপ দেখে ছাড়ে। নিসার আমার একজন মহা হিতৈষী ছাত্র। মূলত নিসারের চাপেই বাধ্য হয়েছি বড় কাজ করতে। আমরা আগে একুশে ফেব্রুয়ারিতে বড় বড় ব্যানারে ছবি অাঁকতাম। সিক্সটিজের শেষের দিকে, সেভেন্টিজে করেছি। তো সেইসব জেনেই নিসারের ধারণা তৈরি হয়েছিল যে, আমি বড় ছবি অাঁকি। একদিন বাসায় এসে দেখি বড় বড় ক্যানভাস। কী ব্যাপার? শুনি, নিসার পাঠিয়েছে। অনেকদিন পর সাহস হয় কি হয় না করে করে, কয়েকদিন পর শুরু করলাম – দেখিই না কেমন হয়! তো করলাম এবং দেখলাম, করতে গিয়ে আমার খুব ভালো লাগছে। ছবি যেমনই হোক আমার ভালো লাগল যে, করতে পারলাম এবং করলাম। সেইসব ছবি নিয়েই এক্সিবিশন হলো। দেখলাম, যারা ছবি নিয়ে ইন্টারেস্টেড, যারা ছবি নিয়ে ভালো চিন্তা করে তারা ভালোই বলল। বেশ ভালোভাবেই নিয়েছে। অ্যাকসেপ্ট করেছে। এই হলো আমার এক্সিবিশনের পরিস্থিতি।
প্রশ্ন : এবার আমরা একটু পেছনের দিকে ফিরে যাই – আপনার এই শিল্পচর্চার শুরু এবং চারুকলার শিক্ষাগ্রহণ অর্থাৎ কীভাবে এই অঙ্গনের সঙ্গে জড়িয়ে পড়া – তা জানতে চাই।
রনবী : হুম… কোন জায়গা থেকে শুরু করব বলো! মূল জায়গাটা হলো আর্ট কলেজে ভর্তি হলাম। আর বাড়িতে কিন্তু ছোটবেলাতেই দেখেছি ছবি অাঁকার একটা আবহ। বাবা নিজে নিজে ছবি অাঁকতেন। চাকরি করতেন পুলিশে। সাদা পোশাকের পুলিশ। তিনি ছিলেন একদমই অন্যরকম। অফিস থেকে ফিরেই দেখতাম ছবি অাঁকা নিয়ে বসে যেতেন। তিনি কিন্তু কলকাতা আর্ট কলেজে ভর্তি হওয়ার জন্য পরীক্ষা দিয়েছিলেন, সিলেক্টও হয়েছিলেন। সেই সময় আমার দাদা মারা গেলেন। একমাত্র ছেলে হওয়ার কারণেই হয়তো সাংসারিক দায়বদ্ধতা থেকে বের হতে পারেননি। যেহেতু আমার দাদাও পুলিশ ছিলেন, তখনকার নিয়ম অনুযায়ী সেই কোটাতে পারিবারিক চাপে চাকরি নিলেন। এটা তাঁর স্বভাববিরুদ্ধ ঘটনা ঘটে গিয়েছিল। চাকরি করতে হয় তাই তিনি করে গেছেন। কিন্তু ছবি এঁকে গেছেন নিজের মতো করে। ছবি এঁকে আমাদের দেখাতেন। মুগ্ধ হতাম, ভালো লাগত। ফলে আমারও ছবি অাঁকার আগ্রহ তৈরি হয় এবং অাঁকতামও। স্কুলে সবার মধ্যে প্রচলিত ছিল যে, আমি ভালো অাঁকতে জানি। আমরা আরো কয়েকজন ছিলাম, যারা ভালো অাঁকতাম এবং সবাই তা জানত। আমাদের পাড়ায় একটা সংগঠন ছিল। সেখান থেকে সম্পূর্ণ হাতে লেখা দেয়াল পত্রিকা বের হতো। তার পুরো ভারটা আমার ওপরেই ছিল। পরিবার থেকে এনকারেজ হওয়ায় কখনো ব্যাহত হইনি। ছবি অাঁকলে কখনো কেউ বলেনি যে, ‘খবরদার! ছবি অাঁকা বন্ধ করে এবার লেখাপড়া করো।’ অাঁকার প্রশ্রয়টা ছিল। বিশেষ করে বাবার প্রশ্রয়টা ছিল বেশি। একসময় সবার মুখে মুখে শুনতাম, সবাই বলত যে, ওর অাঁকার হাত তো ভালো, আর্ট কলেজে ভর্তি হয়ে যাক। ম্যাট্রিক পাশের পর একদিন সত্যি সত্যিই সেই দিনটি এলো। ১৯৫৯ সালে ম্যাট্রিক পাশের পর আর্ট কলেজে ভর্তি পরীক্ষা দিলাম। অ্যালাউও হয়ে গেলাম। ভর্তি হলাম। এভাবেই শুরু হলো প্রাতিষ্ঠানিকভাবে শিক্ষাগ্রহণ এবং আনুষ্ঠানিকভাবে শিল্পজগতে প্রবেশ করা। তারপর থেকে এই যে চলছে…।
প্রশ্ন : আপনি আর্ট কলেজে ভর্তি হলেন এবং সেখানে শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিনের মতো শিল্পীর সংস্পর্শে এলেন, পরে সহকর্মী হলেন। আপনার সেই অনুভূতিটা আজ বিশেষভাবে আরেকবার জানতে চাই।
রনবী : আমি নিজেকে খুব ভাগ্যবান মনে করি এই কারণে যে, আমরা যখন আর্ট কলেজে ঢুকলাম তখন যাঁরা শিক্ষক ছিলেন অর্থাৎ জয়নুল আবেদিন থেকে শুরু করে সর্বকনিষ্ঠ এবং তরুণ শিক্ষক কাজী আবদুল বাসেত – সবাই তখন তো বটেই – পরবর্তীকালেও বাংলাদেশের শ্রেষ্ঠতম শিল্পী। এ ব্যাপারে নিজেকে ভাগ্যবান মনে করি। আবেদিন স্যার, কামরুল হাসান, সফিউদ্দীন আহমেদ, আনোয়ারুল হক, আমিনুল ইসলাম, আবদুর রাজ্জাক, মোহাম্মদ কিবরিয়া – এঁদের সবাইকে শিক্ষক হিসেবে পেয়েছি। শুধু মুর্তজা বশীরকে আমি শিক্ষক হিসেবে পাইনি। আর পেয়েছি কি পাইনি সেটা বড় কথা নয়। আরো আছেন দেবদাস চক্রবর্তী, সৈয়দ জাহাঙ্গীরের মতো বড় শিল্পীর কাজ দেখা এবং তাঁদের সংস্পর্শের ভূমিকা কিন্তু শিক্ষকের মর্যাদা থেকে কোনো দিক দিয়েই কম নয়। সেই ভাবগত দিক থেকে তাঁরাও কিন্তু আমার শিক্ষক। আমাদের সময়ের সব শিল্পীকেই আমি শিক্ষক বলে মনে করি। ছবি অাঁকা শেখা বা শিল্পশিক্ষা, টেকনিক, গ্রামার – এসব তো যাঁর যাঁর মিডিয়ায় তাঁরা শিক্ষা দেন। তবে আমরা আকৃষ্ট হতাম তাঁদের দেশভাবনা, দেশকাল এবং রাজনৈতিক ভাবনা, দেশের মানুষ, সমাজচিন্তা, বিভিন্ন সংকট, সাংস্কৃতিক বিশ্লেষণ – আমাদের সংস্কৃতি কী হওয়া উচিত, আমরা কোনদিকে যাব, আমাদের অরিজিন কী, আমাদের কোন দিকটা প্রধান হওয়া উচিত – এ সবকিছুই আমাদের শিক্ষা দিতেন, আমরা তাঁদের কাছ থেকে জানতে পারতাম। আবেদিন স্যার যেহেতু অধ্যক্ষ ছিলেন তাই বেশি ক্লাস নিতেন না। কোনো শিক্ষক অ্যাবসেন্ট থাকলে তিনি তাঁর ক্লাস নিতেন। এছাড়া তিনি হঠাৎ হঠাৎ ক্লাসে আসতেন আর গালগল্প করতেন। এই গল্পের মধ্য দিয়েই তিনি আমাদের শেখাতেন। কোনো বাধ্যবাধকতায় আমাদের ফেলতেন না। বেশ খোলামেলাভাবেই আমাদের শেখাতেন। বায়ান্নর ভাষা আন্দোলনের সময় স্কুলে পড়ি। আমরা দেখেছি আন্দোলনের রূপ। তারপর একটার পর একটা আন্দোলন হয়েছে ভাষা আন্দোলনকে ব্যাকগ্রাউন্ড করে। সে হিসেবে আমাদের কর্তব্য কি শুধু ছবি অাঁকা, না এর সঙ্গে জড়িয়ে যাওয়া? যেমন বলি, রবীন্দ্রবিরোধী একটা আন্দোলন শুরু হলো ষাটের দশকে। সেটা মারাত্মক বলে গৃহীত হলো। আমরা ভাষা আন্দোলন করলাম শুধু কি ‘অ’-‘আ’ প্রতিষ্ঠার জন্য! শুধু মুখের ভাষা স্বাধীন হবে তা তো ছিল না। মুখের ভাষার সঙ্গে আমাদের চলন-বলনের ভাষা, সাহিত্য-সংস্কৃতির ভাষা, সেটা কোন পর্যায়ে থাকবে তার প্রচলন করা, বাঙালি হিসেবে কী করণীয়, কাদের পছন্দ-অপছন্দ করব – এসব ব্যাপার তার সঙ্গে জড়িত। এসব বিষয় সামনে রেখেই কিন্তু আন্দোলন করা। হঠাৎ করে রবীন্দ্রবিরোধী আন্দোলন। সেটা প্রতিহত করতে আন্দোলনমুখী হতে হয়েছে। রবীন্দ্রনাথকে বাদ দিয়ে তো বাঙালির হবে না। তাঁকে তো আর ভাগ করা চলে না। বলা যায় না যে, তিনি ভারতের নাকি বাংলাদেশের। তিনি তো দুই বাংলার, বাঙালির। রবীন্দ্রনাথ মিশে আছেন আমাদের রুচির সঙ্গে, চেতনার সঙ্গে, ভাষার সঙ্গে, সংস্কৃতির সঙ্গে। এরকম বহু আন্দোলন হলো মুক্তিযুদ্ধ পর্যন্ত। তো আবেদিন স্যারকে দিয়েই কথা শুরু হলো তো, সেখানে তিনিসহ কামরুল হাসান, সফিউদ্দীন আহমেদ, রশিদ চৌধুরী, কাইয়ুম চৌধুরী – এঁরা আমাদের এসব চেতনার সঙ্গে সম্পৃক্ত করেছিলেন। এটা তো গেল আর্ট কলেজের কথা, এর বাইরে যাঁরা ছিলেন, যাঁরা ভাষা আন্দোলনের সঙ্গে সরাসরিভাবে নেতৃস্থানীয় ছিলেন তাঁদের মধ্যে এমদাদ হোসেন, আমাদের নিসার হোসেনের বাবা – এঁরাও কিন্তু আমাদের দিকনির্দেশক। এখানে সুযোগ পেয়ে আমি আরেকটি কথা বলব, শুধু আর্ট কলেজকেন্দ্রিক ব্যাপার-স্যাপার নয়; একে ঘিরে দেশের যত বড় বড় লেখক, কবি-সাহিত্যিক, সংস্কৃতজ্ঞ, বুদ্ধিজীবীরা ছিলেন – প্রত্যেকেই আবেদিন স্যারের কারণে বেশ ভালো যোগাযোগ এবং ওঠাবসা করতেন; তাঁরাও এই আন্দোলনে জড়িত ছিলেন। তাই বলি, আমরা আসলে শুরুই করেছি খুব বড়মাপের মানুষের কাছাকাছি থেকে। এসব কারণে মনে করি, ছবি যেমনই অাঁকি, চিন্তাভাবনাটা ওখান থেকেই শুরু হয়েছে।
ষাটের দশকে যে আন্দোলন গড়ে উঠেছিল তাতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রগতিশীল চিন্তাচেতনার ছাত্রছাত্রীরা অগ্রণী ভূমিকা রেখেছিল। আমাদের সঙ্গে তাদের রুচিগত ব্যাপারে মিল ছিল। ফলে আমাদের ওঠাবসা একসঙ্গেই ছিল। এগুলো খুব হেল্পিং সাইড ছিল।
প্রশ্ন : জয়নুল আবেদিনের চিন্তা এবং তার স্কুলিংটা সমাজমুখী, সমাজবাস্তবতার। মানুষের চিন্তা করেছেন, মানুষ নিয়েই তাঁর চিত্রকর্ম। তাঁর সার্থক উত্তরসূরি হিসেবে আপনার কাজেও কিছু প্রতিফলন পাই। বিশেষ করে সাম্প্রতিককালের এক্সিবিশনের কাজেও মানুষের কথা তুলে ধরা, মানুষকে মহিমান্বিত করার বিষয়টা বেশ স্পষ্টভাবে এসেছে। এ প্রসঙ্গে আপনার বক্তব্য এবং সেইসঙ্গে জানতে চাই যে, জয়নুলের স্কুলিংটা বেশ ভালোভাবে প্রতিষ্ঠিত হতে পারত, হলো না কেন?
রনবী : যে-সময় জয়নুল আবেদিন স্যারেরা শিল্পকলার হাতিয়ার হিসেবে সমাজের অগ্রগতিতে নানান কিছু করলেন, শুধু সেই সময়টা ধরে বিচার-বিবেচনা করব তা কিন্তু নয়। মূল্যায়নটা এখানে যে, তাঁদের দূরদর্শিতা কতখানি ছিল। একদম শুরুর দিকের কথা বলি, ১৯৪৭ সালে যখন তাঁরা এলেন এবং আর্ট কলেজ করলেন তখন শিল্পকলার জগৎ এমন একটা ব্ল্যাকহোলের মধ্যে ছিল, কী হবে তা জানা ছিল না। তাঁরা কলকাতায় পড়েছেন, বাস করেছেন, সেখানেই শিল্পচর্চা করেছেন। এখানে এসে যখন আর্ট কলেজ করলেন তখন পুরো ব্যাপারটা অন্যভাবে ভাবতে হয়েছে, কী আছে এখানে যেটা নিয়ে আমরা এগোতে পারি আর আমাদের অর্জিত শিক্ষার সঙ্গে সম্পৃক্ত করতে পারি। এই করে তাঁরা ফোক আর্টের দিকে নজর দিলেন। আমাদের এই মূল্যবান সম্পদ ফোক আর্টকে কীভাবে সম্পৃক্ত করা যায় তা ভাবলেন, তাকে ভালোবাসলেন; এসবই তো দেশাত্মবোধ থেকে জন্ম নেয়। তাঁরা সেসব বিষয় কিন্তু আমাদের জানাবার চেষ্টা করেছেন সবসময়। তাঁরা তাঁদের এই আবিষ্কার চেতনায়, শিক্ষায় ধারণ করে নিজেদের চর্চায় প্রতিফলিত করেছেন। পাশাপাশি এর ভিন্নতাও ছিল। অনেকে বলার চেষ্টা করে বা অভিযোগ করে যে, এই আর্ট কলেজের শিক্ষার কোনো প্রয়োজন নেই। ড্রইং-পেইন্টিং শিখতেই হবে, এমন কী কথা! আর্টিস্ট তো আর্টিস্ট। সে নিজে নিজে চেষ্টা করেই হতে পারে। হ্যাঁ, তা অবশ্যই হতে পারে। সময় পরিবর্তিত হয়েছে। কিন্তু তখন তো ছিল অন্ধকার। পদে পদে, ধাপে ধাপে পুরো জগৎটা সেইসব শিল্পীকে তৈরি করতে হয়েছে। এটা কিন্তু প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার অংশই শুধু নয়, চেতনাগত, ভাব-ভাবনাগতভাবে আমাদের তৈরি করে। সুন্দর রুচি তৈরি করা, দেশকে বাইরে রিপ্রেজেন্ট করা – এসব বিষয়ে কিন্তু তাঁরা সজাগ ছিলেন। আর্ট কলেজের লেখাপড়া এমন এক গ্রামারে সাজালেন, যে-বিষয়গুলো অ্যাকাডেমিক হওয়া প্রয়োজন সেসব বিষয় সেখানে রাখলেন। শিল্পী তো কেউ কাউকে হাতে ধরে বানাতে পারবে না। নিজের মধ্যে যদি থাকে এবং একটা চর্চার মধ্যে থাকে, শিল্পবোধ, শিল্পসত্তা থাকে, তবেই তা সম্ভব। বাবা-মা, আত্মীয়-স্বজন, বন্ধু-বান্ধবের তো স্বপ্ন থাকে যে, তাদের সন্তানরা পড়ালেখা শিখে একটা সচ্ছল জায়গায় যাবে, চাকরি করবে। আর্ট কলেজে পড়ে কী হবে? এখানে তো কোনো ভূত-ভবিষ্যৎ নেই। একেবারে অন্ধকার। যাঁরা শিক্ষাক্রম করেছেন তাঁদের এসবও ভাবতে হয়েছে। ছাত্রদের এমন করে তৈরি করতে হবে, যাতে সব দিক ভালো করে শিখে কাজে লাগাতে পারে। আর সেইসঙ্গে ছিল ক্ষেত্র তৈরি করা যে, এরা পাশ করে কিছু করতে পারবে। সেটাও তাদের তৈরি করতে হয়েছে। ছোট হোক, বড় হোক চাকরি করে বাঁচতে পারবে। সবার তো আর ছবি এঁকে এঁকে বেঁচে থাকা সম্ভব হবে না। তবে এই ছাত্রদের মধ্য থেকেই কেউ কেউ আর্টিস্ট হবে বা চর্চা করতে করতে আর্টিস্ট হবে। সব মিলিয়ে এসব পথ কিন্তু আমাদের সেই শিল্পীদের তৈরি করতে হয়েছে। তাঁরাই পথ দেখিয়ে গেছেন। এই যে, পত্রিকায় কাজ করা, তারপর পাবলিশারদের সঙ্গে কাজ করা। তাদের রুচি তৈরি করা। সব করতে হয়েছে।
প্রশ্ন : এখানে একটু ইন্টারাপ করি, আপনি যে প্রসঙ্গটা বললেন, অনেকটা জনপ্রিয় আবেদন তৈরি করে শিল্পকে মানুষের কাছে পৌঁছে দেওয়া – এই ব্যাপারটা ছিল।
রনবী : হ্যাঁ, সবকিছুর সঙ্গে সম্পৃক্ত হওয়া, যেমন – রাজনৈতিক বলো, কালচারাল বলো; অ্যাক্টিভিস্ট হওয়া মানে সবকিছুর মধ্যে ঢোকা। চারুকলা একটা আলোচিত জায়গা। চারুকলার ছাত্ররা ইনভলভ হয় নানা দিক দিয়ে নানা বিষয়ে। তারা মুক্তচিন্তায় বিশ্বাসী। বিভিন্ন কাজকর্ম করা, ছবি অাঁকা, এক্সিবিশন করা তো লক্ষণীয়। এখন মানুষ দেখছে তাদের ইনভলভনেস। তারপরও এখনো অনেকে জানেই না যে, কেমন ধরনের লেখাপড়া চারুকলার ছাত্রদের করতে হয়। এটা যে এত কঠিন এবং ব্যাপক পড়াশোনা তা জানেই না। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এমনও শিক্ষক আছেন যাঁরা মনে করেন, তাঁদের বুঝি শুধু এই অাঁকিবুঁকি করলেই হয়। এর মধ্যে আবার এমএ, পিএইচডি এসব করার দরকার কী। তাঁরাই কিন্তু আবার বিদেশে গিয়ে শিল্পচর্চার ব্যাপারটা দেখে এসেছেন। কিন্তু বাংলাদেশের ব্যাপার হলেই যেন কেমন সব উলটাপালটা কথা বলেন।
প্রশ্ন : আমাদের দেশ তৃতীয় বিশ্বের দেশ, গরিব দেশ। মানুষের জীবন-জীবিকা খুব একটা সুখকর নয়। তবে শিল্পের ক্ষেত্রে যে অগ্রগতি তার পেছনের শক্তিটা কী বলে আপনি মনে করেন? নিশ্চয় এই ব্যাপকতার এবং উন্নতির পেছনে একটা শক্তি আছে বা শক্তি কাজ করে।
রনবী : ঠিকই বলেছ। যখন বিদেশিরা বাংলাদেশে আসে, দেখে, কিছুদিন থাকে, দেশটাকে অবজার্ভ করে এবং তারা খুব অবাক হয়। এমনকি বলেও। সেদিন আমার এক্সিবিশনেও অনেক অ্যাম্বাসাডর এবং তাঁদের বন্ধুবান্ধব এসেছিলেন। তাঁদের মুখেও একই কথা, কী কন্ট্রাস্ট তোমাদের! আমরা যখন তোমাদের দেশে আসি তখন জেনে আসি যে, এই দেশ অত্যন্ত দরিদ্র, খুব খারাপ অবস্থা, প্রাকৃতিক দুর্যোগ তো আছেই; আবার নিজেরাও রাজনৈতিকভাবে বিভিন্ন দুর্যোগ তৈরি করো। এসব কারণে তোমরা উন্নতি করতে পার না। এসব আমরা এখানে এসে দেখি এবং আরো একটা জিনিস দেখি আর অবাক হই, তা হলো তোমাদের শিল্পের শক্তি। সংগীত-সাহিত্য এমন একপর্যায়ে যে, অবাক না হয়ে পারি না।
প্রশ্ন : সেটা কি একটা শক্তি বলে মনে করেন?
রনবী : শক্তি বলা কঠিন, তবে আমি তো মনে করি, আমাদের দেশের বা অঞ্চলের অভাব বলি, অনটন বলি, যা কিছু আছে তার ভেতর থেকে নির্যাস নিয়েই কিন্তু আমাদের শিল্প। এটাই আমাদের প্রাণশক্তি। যেহেতু এটা রুচির জগৎ, সৃষ্টিশীলতার জগৎ! জাতিগতভাবে বলি, মানসিকভাবে বলি আদি থেকেই কিন্তু তা আমাদের মধ্যে রয়েছে। লোকশিল্পের ব্যাপারটা দেখো, শৈল্পিক যে দিক তা কিন্তু আমাদের দেশের মানুষের মধ্যে স্বভাবজাত হিসেবেই রয়েছে। হয়তো অনেক সময় বিভিন্নভাবে চর্চায় বাধা পায় বলে পিছিয়ে পড়ে। কিন্তু তা সত্ত্বেও সবটা মিলিয়েই একটা অসাধারণ শক্তি। আর তা হাজার হাজার বছর ধরেই আমাদের মধ্যে আছে। লোকশিল্পীরা লোকশিল্প করছে, আধুনিক শিল্পীরা আধুনিকতার চর্চা করছে, যারা অ্যাকাডেমিক ক্ষেত্র নিয়ে থাকতে চায়, কাজ করতে চায় তারা সেই ঢংয়েই কাজ করছে। এসবের মধ্যেও আমাদের সেই প্রাচীন স্বভাবটা আছেই। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে যুগোপযোগী কাজ চলছে। এসব আমাদের মজ্জাগত। সংস্কৃতিতে আছে, চেতনায় আছে।
প্রশ্ন : এবার স্যার আপনার ব্যক্তিগত কাজের প্রসঙ্গে আসি। চারুশিল্পের নানান মাধ্যমে আমরা আপনার আগ্রহ দেখি। জলরং, তেলরং, ছাপচিত্র, ম্যুরাল – সব মাধ্যমেই কাজ করেছেন। আপনি তৈলচিত্রের শিক্ষক, আবার আপনি ছাপচিত্র মাধ্যমেও কাজ করেন। এই যে আপনার নানামুখী আগ্রহ – সেই সম্পর্কে জানতে চাই।
রনবী : শুধু আমি নই, যারা শিল্পকলার সঙ্গে জড়িত মোটামুটি সবারই কিন্তু এই ব্যাপারটা রয়েছে যে, এক মিডিয়া নিয়ে চলা হয়ে উঠে না। আমার তো নয়-ই। শুধু মনে হয় এই মিডিয়া যদি হতো, সেই মিডিয়া যদি হতো। একবার মনে হলো প্রিন্টের ব্যাপারটা ভেবে দেখি কী অবস্থা। আরো আগে কলেজে পড়ার সময় তো প্রাথমিক বিষয়টা শিখেছি; যদিও তা একদমই অ্যাকাডেমিক্যালি। গ্রিসে গেলাম ড্রইং অ্যান্ড পেইন্টিংয়ের জন্য স্কলারশিপ পেয়ে। গিয়ে দেখি প্রিন্টমেকিং ডিপার্টমেন্ট সাংঘাতিক রিচ। ওখানে যে প্রফেসররা আছেন তাঁদের কাজ দেখে অভিভূত হলাম। এচিং মোটামুটি সব দেশেই ভালো অবস্থাতেই আছে। কিন্তু উডকাট – আমরা চিরকাল যে উডকাট দেখেছি, ক্লাসেও ছোট ছোট কাজ করেছি, আবার চায়নিজ, জাপানিজ উডকাটও দেখেছি। কিন্তু এখানকার প্রফেসরদের কাজ দেখে বুঝলাম, উডকাটেও অসাধারণভাবে স্কোপস বের করা যেতে পারে কাঠে। ঠিক করলাম প্রিন্টমেকিংই করব। আমার ইচ্ছা শুনে প্রফেসররা বললেন, ভালো অাঁকলেই তো আর প্রিন্টমেকিং করা যায় না। তুমি তো ড্রইং-পেইন্টিংয়ে অনেক ভালো। সেটাই করো। তাছাড়া তোমার পূর্বঅভিজ্ঞতারও কোনো নমুনা আনো নাই, যা দেখে আমরা বুঝব। মাঝখান থেকে তোমার তিনটা বছর নষ্ট হবে। তখন আমি একটা বড় উডকাট করলাম ব্ল্যাক অ্যান্ড হোয়াইটে। শুধু প্রফেসরকে দেখাতে যে, এটুকু জানলে আমি এখানে ভর্তি হতে পারব কি না। পরে তাঁরা কাজ দেখে অনেক খুশি হলেন এবং মিনিস্ট্রিতে বলে আমাকে প্রিন্টমেকিং ডিপার্টমেন্টে ভর্তির ব্যবস্থা করলেন। শুরু হলো আমার কাজ। একমনে কাজ করতাম আর তাঁদের দেখাতাম। প্রিন্টমেকিংয়ে দুটো সাংঘাতিক বিষয় আছে। একটি হলো ডিজাইন। তুমি কী অাঁকবে তা রিয়ালিস্টিক হোক বা যা-ই হোক, সেটা প্রিন্টে কতখানি স্কোপ পাবে সেটা চিন্তা করতে হয়। আরেকটি হলো টেকনিক্যাল সাইড। চিরাচরিত নিয়মে করবে, নাকি আরো কিছু বুদ্ধির খেলা করবে। প্রিন্টমেকিংয়ে সেই স্কোপগুলো খুঁজতে হয়। কাজ করতে গিয়ে বিভিন্ন সময় কিছু এক্সিডেন্টাল রেজাল্ট আসে। সেটা পরবর্তী সময়ে কাজে কতটা ব্যবহার করতে পার সেই ব্যাপারটা আছে। প্রিন্টে অনেক মজার বিষয় আছে, যেমন কাগজটা উলটো করে প্লেটের ওপর রাখতে হয়, রোলার ঘুরিয়ে পেপারটা যখন প্লেট থেকে ওঠাতে থাকো ততই যেন আনন্দ শুরু হতে থাকে।
প্রশ্ন : আরেকটা বিষয় একটু বলি। আমরা লক্ষ করি আপনার কাজে একটা জলের মতো স্বচ্ছতা থাকে। জলরঙের স্বচ্ছতার বিষয়টি অন্য মাধ্যমগুলোতেও থাকে কি না?
রনবী : জেনেশুনে হয়তো রাখি না কিন্তু থাকে। এটা খুব ভেবেচিন্তেও করি না, জোর করে তো নয়-ই। যারা জলরং করে তারা যে মিডিয়াতেই করুক, জলরং থেকে পাওয়া কিছু ঘটনা বা অভ্যাস অন্য মিডিয়াতেও ঘটে যায়। মনিরুল ইসলামের কথাই বলি। তিনি অত্যন্ত ভালো ওয়াটারকালার করতেন। তাঁর এচিং বা এখন যে পেইন্টিংগুলো করেন তার মধ্যে জলরঙের ট্রান্সপারেন্ট ভাবগুলো কীভাবে যেন চলে আসে। আমি এটাও মনে করি, সব শিল্পীরই জলরংটা একটু জেনে নেওয়া দরকার। করলে হয় কি, রং ব্যবহারের দিকগুলো খুব মজাদার হয়। জলরঙের আরেকটা ব্যাপার হলো ওয়ানটাচ। একবার রং দিয়েছ তো সেটা সাদা দিয়ে বা ঘষে ঢাকতে পারবে না। সেজন্য এটা রং ব্যবহারে মনোবলও তৈরি করে।
প্রশ্ন : আমার আপনাকে নিয়ে একটা লেখার উদ্ধৃতি দিয়ে বলি – ‘সমস্ত ইজম থেকে বিচ্ছিন্ন থেকে তিনি নির্মাণ করেছেন এক ড্রইংশৈলী, যা বাস্তবতা থেকে আহরিত, তবে বাস্তবতার ক্রীড়নক নয়। পশ্চিমা অ্যানাটমিকে ভেঙেচুরে নিজস্ব রেখা তৈরি করা, যা কি না প্রাচ্যদেশীয় ভাবধারায় মহীয়ান।’ তো আপনার এই ড্রইংশৈলী তৈরিতে পশ্চিমা অ্যানাটমি স্টাডি করেছেন কিন্তু তার অনুগত না হয়ে নিজস্ব শৈলী নির্মাণ করেছেন। এ বিষয়টা নিয়ে যদি বলেন।
রনবী : শৈলী তৈরি করা বলব না। এটা চলে এসেছে। যে-কোনো কাজ আমি ড্রইং থেকেই করি। ড্রইংয়ের তো ধরন-ধারণ আছে। আমরা যে অ্যাকাডেমিক শিক্ষা নিই, যে পাশ্চাত্যের কথা বললে তা আমরা অ্যাকাডেমিক শিক্ষাতেও নিই। কিন্তু প্রাচ্যের ড্রইংগুলো যদি দেখো, দেখবে একটা ফ্লো আছে। এই ফ্লো আবার কোথাও ভেঙে দেওয়া, কোথাও চওড়া করে দেওয়া, কোথাও মোটা শুকনো ব্রাশে লাইন দেওয়া – এসবের চর্চা কিন্তু এখানে হয়েছে বহু আগে থেকে। এগুলো আমার পছন্দ। কিন্তু আমার ছবিতে যেটুকু আসে আমার মতো করে। আবেদিন স্যারের স্ট্রং ড্রইং ছিল। কামরুল হাসানের ড্রইং ছিল বলিষ্ঠ। আবেদিন স্যারের কাজেও দেখেছি মোটা শক্ত ব্রাশের রেখা। এসব বিষয় আসলে একেকজনের কাছে তাদের প্রত্যেকের নিজের মতো করে, আলাদা আলাদাভাবে।
প্রশ্ন : আপনার কাজের আরেকটি দিক, তা হলো জটিল করে নয়, সহজিয়ার পথ ধরে উপস্থাপন করা। একটা সাবলীলতা সবসময় লক্ষ করি।
রনবী : দেখতে সহজিয়া মনে হয় হয়তো বা। অাঁকতে গেলে কিন্তু সহজিয়া নয়। আমি বলব, আসলে তা সাবলীলভাবে আসা। এটা খুব চিন্তাভাবনা করে হয়তো আসে না। যেটুকু ড্রইং আসে তা সাবলীলতায় আসে। আমি কখনো শুদ্ধতম ড্রইং করি না, এর পক্ষপাতীও নই। শুদ্ধতম ড্রইং মানে ওয়েস্টার্ন অ্যাকাডেমিক কায়দা। আবার এটা আমরা জানি না তা-ও কিন্তু নয়। সেটা জানার পরই অটোমেটিক্যালি ভাঙার ব্যাপার চলে আসে। আমার নিজের ধারণা, যেহেতু বিষয়ভিত্তিক কাজ করি, ফলে এসবের সঙ্গে ড্রইংয়ের একটা মজা থাকলে ভালো। ড্রইং ভালো জানলে তা ভাঙাও যায়। আমি তো নিজে মনে করি, আপাতভাবে বিষয় থাকে। এখন বিষয়কে যদি অনুষঙ্গ হিসেবে ধরি অর্থাৎ ওটা মেইন নয়, বাকি যে কাজগুলো করলাম সেখানে আমার আলাদা অবজারভেশন আছে। লাইনের, রঙের ব্যবহার বা টোনাল ব্যবহার, স্পেস রাখব কি রাখব না – পজিটিভ-নেগেটিভ সব রকমই ভাবনা হয়। সুতরাং দৃশ্যমান হলো বস্ত্ত। একজন সাধারণ মানুষ যখন দেখেন তখন বস্ত্তটাই দেখেন। আশপাশের যে ধরনগুলো তা কিন্তু দেখেন না। কিন্তু আমি দাবি করব, সেখানে অনেক রকম এক্সপেরিমেন্টও আছে। এটা হয়তো আমার নিজের বলা। কিন্তু তবু বলি, যেমন আমার কাজে আমি পারসপেক্টিভ রাখি না। অাঁকতে গেলে বিষয়ের সঙ্গে প্রকৃতি আলাদা করে ফেলি একদম। অ্যাসেলমেন্ট করি না। মানে এরকম যে, বস্ত্তটা প্রেক্ষাপটে পেস্ট করে দিলাম। রিয়ালিটিতে কাজ করলে এখানে মিনিমাইজ করে দেব, এটা করব, সেটা করব – ঠিক সেটা না। আমি যেটা করি তা হলো কোথাও পারসপেক্টিভ অর্ধেক রাখব, কোথাও রাখব না, কোথাও বার্ডস ভিউ থেকে কোথাওবা নিচে বসে দেখছি এই রকম ভাব আনি। তারপর যেটা করি তা হলো, ভিউয়ার্সকে কনসেন্ট্রেট করানো। এই কনসেন্ট্রেটেড বস্ত্তর মধ্যেও সূক্ষ্মতা থাকবে, যেখানে চোখটাকে নিয়ে যাবে সেটড্রপ পয়েন্টে। এসব ব্যাপার ভাবনাগতও আছে, আবার কিছু অটোমেটিক্যালি আসে। আবার ছবিকে খুবই মিনিংফুল করতে যাওয়ার ব্যাপারটি নেই। এবারের এক্সিবিশনে কিন্তু ক্যাপশনও দিইনি। সবই যেহেতু পরিচিত দৃশ্য, তো সেগুলোকে আমি আমার মতো করে সাজালাম। আমার পছন্দসই দিকগুলো রাখলাম। আবার আলো কোথায় ফেলব, আলোর আদৌ দরকার আছে কি না এগুলো ভাবলাম। এসব বিষয় কখনো হয়তো খুব সাকসেসফুল হয়, কখনো হয়তো বা হয়ও না। তবে নান্দনিক দিকগুলো তো থাকেই। আরেকটা ব্যাপার, চেনা জিনিসকে আমি একেবারে ওলটপালট করে সেমি-অ্যাবস্ট্রাকশনে আনি না। আনার সাহসও করি না। ভেঙেচুরে, ফর্ম আলাদা করে অ্যাবস্ট্রাকশনে যাই না। এসব করার জন্য আলাদা স্কিল, আলাদা চিন্তাভাবনার ব্যাপার আছে। এদিকে আমি যাই না, যাওয়ার সাহসও করি না। আবার কোনোদিন হবে না হয়তো তা-ও না। একসময় অবশ্য প্রায় সেমি-অ্যাবস্ট্রাকশনে গিয়েছিলাম প্রিন্টের কিছু কাজে। তারপর আবার রিটার্ন।
প্রশ্ন : সাহিত্যের প্রতিও আপনার যে আগ্রহ এবং পদচারণা তার প্রভাব আপনার চিত্রে কতটুকু আছে কি নেই, আর থাকলেও তা কতটা?
রনবী : লেখালেখি আমার স্কুলজীবনেও হয়েছে। ছোটবেলায় কিছু পত্রপত্রিকায় ছোটদের পাতায় বের হতো। তা দেখে খুব মজা পেতাম। আর আমার এই লেখালেখি তো আর লেখক বা সাহিত্যিক হওয়ার জন্য নয়। হঠাৎ মনে হয় লিখে ফেলি। আবার ছবি অাঁকার মুড না থাকলে লিখি। এই আর কি। আরেকটা বিষয় আছে – অনুরোধ। এই অনুরোধটাও আবার চাপের মতো। পাবলিশাররা বলল যে, একটা বই দেন; পত্রিকা বলল, লেখা দেন, কখনো বলে ছড়া দেন, উপন্যাস দেন, রম্য রচনা দেন, ছোটদের গল্প দেন। মুডটুড ঠিক থাকলে মাঝে মধ্যে বসে যাই – এই আর কি।
প্রশ্ন : আপনার একটা উপন্যাস টেরাডাকটাইল – সেটা তো মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক।
রনবী : হ্যাঁ, সেটা আমার এথেন্স চলে আসা এবং মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে। আমি এখানে কোনো সাবজেক্ট না। কিছু এখানকার আর কিছু ওখানকার অভিজ্ঞতা। কিন্তু মুক্তিযুদ্ধটা আসল লক্ষ্য ছিল। একটা নবীন স্বাধীন দেশ, যুদ্ধ দেখেছি, যুদ্ধের পরপর দেশের বাইরে গেলাম। ভেতরে ভেতরে অনেক কিছুই কাজ করত। তখন সাপ্তাহিক বিচিত্রার অনুরোধে ঈদ সংখ্যায় সাহস করে লিখে ফেললাম। সবাই বেশ ভালোভাবে নিল। আমাদের ক্রিটিক্যাল বন্ধু হুমায়ুন আজাদ তার সমালোচনায় যদিও বলল – উপন্যাসের এই ফর্ম, সেই ফর্ম এগুলো এমন হলে ভালো হতো; তদুপরি ভালো লেগেছে।
আমার বাড়িতে সবসময় দেখেছি বিভিন্ন পত্রপত্রিকা আসত, তো পঠনপাঠনের অভ্যাস ছোটবেলা থেকেই ছিল। খুবই ছোটবেলায় দেখতাম মামারা সুকুমার রায়ের বই, শনিবারের চিঠি, শিশু সাথী – এরকম পত্রপত্রিকা নিয়ে আসত। এগুলো পড়তাম। রবীন্দ্রনাথ, নজরুল এসব তো আছেই, আরো অনেক বই পড়তাম। একসময় আমি যখন স্কুলে পড়ি, বাবা পূজা সংখ্যাগুলো ঢাকায় এলে কিনে দিতেন। দেব সাহিত্য কুটির থেকে তখন খুব মোটা মোটা বই বের হতো। সেগুলো কেনা হতো। এভাবে সেই ছোটবেলা থেকেই অনেক বই পড়া হয়েছে। তারপর তো আস্তে আস্তে যখন বড় হলাম তখন সাহিত্যের বিভিন্ন দিক নিয়ে আগ্রহ বাড়ল। পড়াও হলো এবং পড়া অব্যাহত থাকল। আমার এই পড়া এখনো হয়, এখনো পড়ি। যখন যা পাই।
প্রশ্ন : সাহিত্যের সঙ্গে শিল্পের কোনো সম্পর্ক খুঁজে পান কি না?
রনবী : ঘটনাগুলো তো সব একই আসলে। কে কী রকম, কোন মাধ্যমটিতে কাজ করবে সেটাই হলো আসল কথা। যিনি লিখছেন তাঁর যে রস, যিনি অাঁকেন তাঁরও একই রস। মাধ্যমগত দিকটি আলাদা। এভাবে যদি বলি তো ঘটনা একই। যিনি কবিতা লেখেন তাঁর যে রস, অনুভূতিগত চেতনা, আবার লেখার ঢং, লেখার ধরন, লেখার টেকনিক এসবই যেমন তাঁদের আছে, আমাদেরও আছে। তাঁরাও যেমন বলেন, কম্পোজিশনটা বেশ ভালো হয়েছে; তো আমরাও আমাদের ছবির কম্পোজিশন বা এসব টার্ম ব্যবহার করি। সব দিক থেকেই কিন্তু ঘটনা একই।
প্রশ্ন : অন্যান্য শিল্পমাধ্যম, যেমন সংগীত, নাটক, নৃত্য – এসব ভিন্ন মাধ্যম থেকে কি আপনি কোনো প্রেরণা পান?
রনবী : ওই যে, আবারও সেই বাড়ির দিকে তাকাতে হয়। আমার বাড়িতে গান-বাজনা কেউ করেনি। কেউ সংগীতজ্ঞ নয়। কিন্তু গান ভালোবাসে সবাই। বাবা, মা থেকে শুরু করে মামা-মামি, আমার ছোট ভাইবোন – সবাই গান পছন্দ করে। বাড়িতে তখনকার সেই কলের গান ছিল। আমার মনে পড়ে, কলের গান সেই ১৯৭৮-এর দিকে শুনতাম। শোনার চর্চা ছিল। কী গান শুনতাম সেটা একটা ব্যাপার, আমাদের গান শোনার চর্চা ছিল, ভালো, শুদ্ধতা, যা ভালো লাগত তা-ই শুনতাম। সেটা ক্ল্যাসিক্যালই হোক অথবা তখনকার আধুনিক। রবীন্দ্রসংগীত বা অতুলপ্রসাদের সংগীত ভালো লাগার একটা শাশ্বত ব্যাপার আছে। ভালো লাগবেই। এখনো যদি আধুনিক গান শুনি হয়তো ভালোই লাগে। একসময় যখন খেতে পাই না ভালো, পয়সাকড়ি নেই, করুণ অবস্থা, বেতন পাই কম – তার মধ্যেও ভালো গান শুনব বলে বিশাল রেডিওগ্রাম কিনে ফেললাম তরুণ বয়সে পয়সা জমিয়ে। আরেকটা কথা, আমার মনে আছে, যে সময় তিন হাজার টাকায় হয়তো রায়েরবাজারের এই সমস্ত জায়গায়, সাতমসজিদ রোডের ওপারে পাঁচ-ছয় কাঠা জমি পাওয়া যায়; আমি তখন গানের রেকর্ড নিয়ে ব্যস্ত। তখন এত ভালো ভালো রেকর্ড বাজারে এলো যে, সাত হাজার টাকার রেকর্ড কিনে ফেললাম। বন্ধু-বান্ধব যখন শুনত বলত, এসব পাগলামি। যাই হোক, তখন এসব জমিজমা, বাড়িঘর নিয়ে ভাবার মতো অবস্থা ছিল না। একটা ঘোরের মধ্যে ছিলাম। গান শোনার ব্যাপারে এখনো যে আগ্রহ কমেছে তা নয়। এখনো যদি বাইরে যাই, প্রথম যে কাজটা করি, আমার তো আর কিছু করার থাকে না – হয় বইপত্র কিনি, না হলে সিডি কিনি। এসব আমার ভালো লাগে।
প্রশ্ন : তো স্যার, আসলে কথা তো শেষ হয় না, হবারও নয়। আপনার দীর্ঘ শিল্পযাত্রার যে উপাখ্যান, তা এই স্বল্প পরিসরে শেষ করা সম্ভব নয়। তবে আপনার এই সাক্ষাৎকারের মধ্য দিয়ে যেটুকু জানা গেল, তাতে নতুন প্রজন্ম অন্তত আমাদের শিল্প ইতিহাসের একটা দিক খুঁজে পাবে। স্যার, আপনাকে অনেক অনেক ধন্যবাদ।
রনবী : আমার পক্ষ থেকে নতুন প্রজন্মের সবাইকে ধন্যবাদ ও শুভেচ্ছা।
টেপ থেকে রূপান্তর : উম্মে সোহাগ