বোরহান উদ্দিন খান জাহাঙ্গীর
রফিকুন নবীর কাজ মিউজিয়ামের শিল্প নয় কিংবা অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক মূল্য থেকে বিচ্ছিন্ন নান্দনিক মূল্যের কাজ নয়। তাঁর কাজ তিনি সমাজকে সমালোচনা করার জন্য ব্যবহার করেননি, তিনি তাঁর কাজ দিয়ে রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক জীবনের ক্ষেত্রে শৈল্পিক চেতনাবোধ তৈরি করতে চেয়েছেন। তিনি ভেবেছেন, শিল্প হচ্ছে শিল্পের ভুবন বিস্তৃত করার এক প্রয়াস, এই প্রয়াসে আছে বিশুদ্ধ পপুলার বিনোদনের এক ঝোঁক। তাঁর কাজগুলো হচ্ছে আবার মিউজিয়ামের সীমানা নতুন করে অঙ্কন করার, একইসঙ্গে শিল্পকে তার সমাজ পরিসর এবং তার দর্শকদের চোখের মধ্যে নিয়ে আসার। তাঁর কাজ প্রবলভাবে ভাবনা-উদ্দীপক, একইসঙ্গে র্যাডিক্যাল। তাঁর কাজ উচ্চ স্তরের, অথচ পপুলার, তাঁর চেষ্টা হচ্ছে জীবনের মধ্যে শিল্প প্রবিষ্ট করিয়ে দেওয়া, সেজন্য তিনি অনবরত তদন্ত করে চলেছেন শিল্পকাজ ও বেঁচে থাকার মধ্যেকার সীমানা ভেঙে ফেলার। সামাজিক অস্তিত্ব তিনি একপক্ষে বুঝবার চেষ্টা করেছেন, অন্যপক্ষে ভাঙার চেষ্টা করেছেন। এই দুই চেষ্টা থেকে তিনি আমাদের চোখ নিবদ্ধ করতে চেয়েছেন প্রাত্যহিক অভিজ্ঞতা ও কাজকর্মের দিকে, যাতে করে শিল্প তৈরি হয় লাইন, কম্পোজিশন, রং, মুড, ফিগার এবং ফ্রেমের নিয়ম মেনে।
এই মুহূর্তে, অনেক কাজ, ভয় তৈরি করে। বিপরীতে, নবীর কাজে ভয় নেই, তাঁর কাজ টেন্ডার, যে-অর্থে শেখভের গল্প টেন্ডার কিংবা রবীন্দ্রনাথের ছিন্নপত্র টেন্ডার। আমরা তাঁর কাজ দেখতে দেখতে তাঁর কাজের মধ্যে প্রবেশ করি। এই প্রবেশ করার অর্থ শিল্প সম্বন্ধে আমাদের ভয় দূর হওয়া। আমরা বুঝতে চাই। নবী এই বোধ থেকে তাঁর এখনকার কাজের কোনো নামকরণ করেননি। যাঁরা দর্শক তাঁরা প্রতিটি কাজের নিজেদের মতো নামকরণ করবেন। দর্শক এভাবে শিল্পের ওপর অধিকার বিস্তার করবেন। শিল্পটি শিল্পীর এবং দর্শকের এবং ক্রেতার : সবার অধিকারের বিষয়। এই অধিকার তৈরি হওয়া শিল্প ক্ষেত্রে সাহস তৈরি করা।
নবীর কাজের কেন্দ্রে তিনভাবে কিংবা তিন ধরনে কিংবা তিন সমালোচনা পদ্ধতি ব্যবহার করে পৌঁছনো যায়। এই পৌঁছনো হচ্ছে চ্যালেঞ্জ, তাঁর কাজের কেন্দ্রে পৌঁছনোর চ্যালেঞ্জ, তাঁকে বোঝার চ্যালেঞ্জ। নবীর কাজ বোঝা ও ব্যাখ্যার জন্য চোখের অভিজ্ঞতা জরুরি। চোখের অভিজ্ঞতা শিল্পকাজের অভ্যন্তরে প্রবেশ করার সবচেয়ে সুচারু উপায়। তিনটা ধরন কিংবা তিনটা পদ্ধতি কিংবা তিনটা সমালোচনা ব্যবহার করে তাঁর কাজের কাছে পৌঁছনো সম্ভব বলে আমি মনে করি। প্রথমটি হচ্ছে ক্রিটিক্যাল পপুলারিজম : এখানে স্বীকার করা হচ্ছে বিকল্পকে, বিকল্পও গ্রহণযোগ্য ব্যাখ্যা, বিভিন্ন পথে কাজের কেন্দ্রে পৌঁছনো সম্ভব। সব ব্যাখ্যাই সঠিক। দ্বিতীয়টি হচ্ছে ক্রিটিক্যাল মনিজম : ক্রিটিক্যাল পপুরালিজমের বিপরীত হচ্ছে এই ব্যাখ্যা : শিল্পকাজের একটি একক ব্যাখ্যা আছে। তৃতীয়টি হচ্ছে ক্রিটিক্যাল অ্যানার্কিজম। শিল্প ক্ষেত্রে সকল ব্যাখ্যাই সমভাবে গ্রহণযোগ্য, ব্যাখ্যার ভিন্নতা সত্ত্বেও। প্রতিদ্বন্দ্বী কিংবা প্রতিযোগী ব্যাখ্যাও দরকার শিল্পকাজের পূর্বাপর বোঝার জন্য। এভাবেই আমি নবীর কাজকে বুঝতে চাই। তিনি আমাদের সাহসী করেছেন এবং আমরাও বিভিন্ন ব্যাখ্যার মধ্যে দিয়ে তাঁকে সাহসী করেছি।
পেইন্টিং সম্বন্ধে ব্যাখ্যা করা কিংবা পেইন্টিং সম্বন্ধে অভিজ্ঞ হওয়ার মধ্যে তফাৎ আছে। খুব সম্ভব শিল্পের অর্থ খোঁজা কিংবা শিল্পের বৈশিষ্ট্য সম্বন্ধে অবহিত হওয়া কিংবা শিল্প সম্বন্ধে অভিজ্ঞ হওয়া তিন ধরনের ব্যাখ্যা তৈরি করে। এভাবে বাস্তবতাবিরোধী : অ্যান্টিরিয়ালিজম দেখা দেয়।
শিল্পের প্রাসঙ্গিক তথ্য তুলে ধরা কি শিল্প সমালোচনা? শিল্পকাজ বোঝার একটা পথ তৈরি করা কি শিল্প সমালোচনা?
কেন্ডাল ওয়ালটনের যুক্তি হচ্ছে : কোনো একটি শিল্পকাজ বোঝার জন্য যে-ধরনের অভিজ্ঞতা দরকার সেটি নির্ভর করছে শিল্পটি কোন ক্যাটাগরির কাজের সঙ্গে যুক্ত। গিয়াকমেটির পাতলা মেটাল স্কাল্পচারের কাজ নিয়ে ভাবা যায়। কোনো সমালোচকের কাছে এসব স্কাল্পচার কিংবা মানুষজনের স্কাল্পচারগুলো দেখতে মনে হয় জীর্ণশীর্ণ, শুকনো, হাড্ডিসার। কিন্তু কোনো সমালোচকের কাছে তা মনে হয় না যদি তিনি এসব কাজকে শিল্পের মেটাল স্কাল্পচারের ধারাবাহিকতায় বোঝার চেষ্টা করেন। তিনি স্কাল্পচারের পাতলা কাঠামোর বদলে তাদের দাঁড়ানোর প্রকাশভঙ্গিমতায় অভিভূত হন। এই প্রকাশভঙ্গিমতা একটি ভিন্ন নান্দনিকতার অভিজ্ঞতা। এক্ষেত্রে কোন ধরনের দেখা সঠিক? এক্ষেত্রে জবাব হচ্ছে : দুধরনের দেখাই সঠিক। এখানে, এই জবাবের ক্ষেত্রে, একটি দ্বিধা কাজ করছে। ডেভিড লুই সমস্যাটা বুঝতে পেরেছেন। তাঁর বক্তব্য হচ্ছে : বিশ্বাস, আকাক্সক্ষা এবং সত্যাসত্য নির্ধারণের ক্ষেত্রে দ্বিধাদ্বন্দ্ব তৈরি হওয়ার কারণ দুই ভিন্ন সমাধান খাপ খেয়ে যায় দুই ক্ষেত্রে।
হাবারমাসের অনুকরণে শিল্পভুবনের ব্যাখ্যার সমস্যা নিয়ে অগ্রসর হওয়া জরুরি। ব্যাখ্যা দুই ভুবনের মধ্যে কমিউনিকেশন প্রতিষ্ঠা করে : শিল্পীর ভুবন এবং সমালোচকের ভুবন। ভিন্ন ভিন্ন ব্যাখ্যা, ভিন্ন ভিন্ন লক্ষ্য, ভিন্ন ভিন্ন মতাদর্শিক কমিটমেন্টের মধ্যে দুই ব্যাখ্যাই নিমজ্জিত। এই ভিন্নতা একই ঘটনার, একই কাজের বিভিন্নতা তৈরি করে। এই বিভিন্নতা দুই ক্ষেত্রেই সঠিক হওয়ার দাবিদার।
এক্ষেত্রে একটি সিদ্ধান্ত নেওয়া জরুরি। সিদ্ধান্তটি হচ্ছে : শিল্পকাজটি সোশ্যাল-কম্যুনাল সিস্টেমের কোন ক্ষেত্রে যুক্ত। কোন কোন শিল্পী এবং কোন কোন সমালোচক নবীর কাজের প্র্যাকটিস শেয়ার করে থাকেন? নবীর সমসাময়িকদের মধ্যে কারা? কেবলমাত্র এক্সপ্রেশনিস্টরা? অ্যাবস্ট্রাক্ট এক্সপ্রেশনিস্টরা? নবীর পূর্ববর্তীরা? যেমন জয়নুল আবেদিনরা? ক্রিটিক্যাল প�ুরালিস্টরা হয়তো বলবেন : এসব ক্ষেত্রে নির্দিষ্ট কোনো জবাব নেই।
শিল্পভুবন গঠিত হয় একটি বিশাল নেটওয়ার্কের মধ্যে দিয়ে। এই নেটওয়ার্ক আবার কম্যুনাল কাঠামো ঢিলেঢালা করে রাখে। প্রতিটি কাঠামোর নিজস্ব গঠনরীতি ও স্টাইল আছে। উদাহরণ দেওয়া যাক। পিকাসো, ব্রাকের মতামত শ্রদ্ধা করতেন, কিন্তু অন্যদের মতামত অবজ্ঞা করতেন। যেমন নবী আবেদিনদের মতামত মানতেন, কিন্তু আমিনুলদের মতামত তেমন মানতেন না। মানা এবং না-মানার মধ্যে দিয়ে একটি বিশেষ শিল্পকাজের যুক্ততা তৈরি হয়। শুধু কি একটি বিশেষ শিল্পকাজ? একজন শিল্পীর কাজের ধারাবাহিকতাও যুক্ততার ভিতর দিয়ে তৈরি হয়। নবীর কাজকে রাজ্জাক কিংবা বাসেতের কাজের পরিসরেও দেখা সম্ভব। এই পরিসরটা তিনজন শিল্পীর কাজকে বুঝতে ও ব্যাখ্যা করতে সাহায্য করে। কিংবা অন্য একটি ব্যাখ্যার আলোক ব্যবহার করা যায় : বাস্তবতার ধারাবাহিকতার আলোক। এভাবে নবীর শৈল্পিক অর্জন দুধরনের যুক্ততা দিয়ে বোঝা সম্ভব। দুই যুক্ততা কি পরস্পরবিরোধী? বোধ হয় নয়। দুই যুক্ততা পরস্পরের ভিতর ছড়ানো। দুই শ্রেণিকরণ সমভাবে সঠিক : প্রতিটি, শ্রেণিকরণ বলা যায়, বেশ ক্রিটিক্যাল – ব্যাখ্যার ডিভিডেন্ড উৎসারিত করে। সেজন্য নবীর কাজ প�ুরালিজমের উদাহরণ।
একজন শিল্পী বহুবিধ ধারার ভিতর কাজ করেন। বহুবিধ ধারার ভিতর কাজ করতে করতে একটি ধারাকে বিশেষ করে তোলেন । নবীর কাজে বিভিন্ন ধারার আনুগত্য বোঝা যায়, তেমনি বোঝা যায় বিভিন্ন ধারার টেনশন। এসব টেনশন বাদ দিয়ে সঠিক ব্যাখ্যায় পৌঁছনো যায় না। আবার টেনশনগুলো স্পষ্ট না করলে ব্যাখ্যা অসম্পূর্ণ থেকে যায়। লিও স্টেইনবার্গ যেভাবে জেস্পার জোনসের ছবি দেখেছেন, সেই দেখাটা নিয়ে অগ্রসর হওয়া যায়। স্টেইনবার্গ শেষ পর্যন্ত বলে ওঠেন, জোনস তাঁকে একটা মৃত শহরে পৌঁছে দিয়েছেন, কিন্তু মৃত শহরের ভয়ংকরতা একেবারে চেনাজানা। শুধু অবজেক্ট থেকে গেছে, মানুষ রচিত সংকেত,
যে-সংকেত, মানুষের অনুপস্থিতিতে অবজেক্ট হয়ে উঠেছে। জোনস যেভাবে প্রত্যাশা করেছেন, সেই প্রত্যাশা কি নবীর কাজে থেকে থেকে উঁকি দেয় না, যখন দেখি অবজেক্টগুলো চেনাজানার বাইরে পৌঁছে গেছে, বিভিন্ন সংকেত দিচ্ছে, চেনাজানাকে মনে হচ্ছে মানুষের অনুপস্থিতি, কখনো কখনো মৃত ল্যান্ডস্কেপের ভয়ংকরতা। এও এক ধরনের বাস্তব, ভয়ংকর বাস্তব। চেনাজানা বাস্তবের উল্টোপিঠ। মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় তাঁর দুটি উপন্যাসে : দিবারাত্রির কাব্য ও চিহ্ন : চেনাজানা বাস্তবের উল্টোপিঠ ধরতে চেয়েছেন, বুঝতে চেয়েছেন ভয়ংকর বাস্তবতা। নবীও চেনাজানা বাস্তবের উল্টোপিঠ ধরতে চেয়েছেন, বুঝতে চেয়েছেন ভয়ংকর বাস্তবতা, আচমকা চিৎকার করে উঠেছেন : বাস্তব যেমন ভয়ংকর তেমনি
অ-সরল। এই অ-সরলতাই তাঁর অন্বিষ্ট। নবীর টোকাইবিষয়ক চিন্তা ট্র্যাডিশনাল বাম রাজনীতি থেকে উদ্ভূত। নবী রাজনৈতিক নির্যাতনকে আইডেনটিফাই করেছেন যুক্তিহীনতার সঙ্গে, একইসঙ্গে নির্যাতনকে মানুষের সামনে উপস্থাপন করেছেন টোকাইয়ের ভাবনার স্রোতের সঙ্গে। টোকাই একটা চরিত্র, টোকাই একটা বক্তব্য, টোকাই মানুষবিষয়ক চিন্তা। নবীর টোকাইবিষয়ক চিন্তার সঙ্গে মিল আছে লিওটারের ড্রিফটওয়ার্কস বইটির। লিওটার যেমন রেটরিকের বিরুদ্ধে বলেছেন, অ্যাবস্ট্রাক্ট আইডিয়ালিটির বিরুদ্ধে নিজস্ব ভাষা ব্যবহার করেছেন, যেমনি নবী টোকাই কার্টুন তৈরি করেছেন রেটরিকের বিরুদ্ধে। এসব রেটরিক রাজনীতির বিরুদ্ধে কিংবা অর্থনীতির বিরুদ্ধে কিংবা মতাদর্শের বিরুদ্ধে। টোকাই এসবের বিরুদ্ধে আমাদের দাঁড় করিয়ে হাসিয়েছেন। কার্টুনগুলো হাসির, কিন্তু যুক্তিনির্ভর, কার্টুনগুলোর দরকার নিজস্ব ভাষার, আর কার্টুনগুলোর দরকার নকশার, ছবির। সেজন্য টোকাইবিষয়ক কার্টুন যেমন কনসেপ্ট তেমনি মেটা-রেটরিক্যাল বক্তব্য। ভাষা, ছবি, বক্তব্য, ঠাট্টা মিলে নবী তৈরি করেছেন ভাষা, ফর্ম এবং ফিগারের সমবায়ে একটা র্যাডিক্যাল রাজনৈতিক সম্ভাবনা। এই সম্ভাবনার মধ্যে মারমুখিতা আছে, ঠাট্টা দিয়ে শক্ত বাস্তব উড়িয়ে দেওয়ার স্ট্র্যাটেজি আছে এবং সর্বোপরি নবীর টোকাইয়ের মধ্যে আছে সংজ্ঞাপনের দক্ষতা এবং বৈজ্ঞানিক নির্মোহ ক্রিয়াশীলতা।
এদিক থেকে নবীর কাজ হচ্ছে আধুনিক কিংবা উত্তর-আধুনিক নান্দনিকতার ক্লাসিক পূর্ব-গঠন। নবী প্রসারিত করেছেন অন্তর্দৃষ্টি রাজনীতি-অর্থনীতি-বাস্তবতার ভিতর। তাঁর সময়কার বামপন্থীদের মতো নবী তাঁর অনেক কাজে দেখিয়েছেন রাজনৈতিক সংগঠন কিংবা রাজনীতি ক্ষমতার ব্যবস্থা পুনরুৎপাদিত করে যার বিরুদ্ধে তার লড়াই। ক্ষমতার ডিসকোর্সের ডিকনস্ট্রাকশনের লক্ষ্য : কী বলা হয় তা নয়, কীভাবে বলা হয় তা-ই। সেজন্য ডিককোর্স একইসঙ্গে ট্র্যাডিশনাল রাজনীতির ডিকনস্ট্রাকশন। এটা তিনি দেখিয়েছেন তাঁর প্রিন্টমেকিংয়ে, জলরঙে এবং তেলরঙের কাজে। প্রাত্যহিক সমাজ প্র্যাকটিস এবং প্রতিষ্ঠান উন্মোচনের নানা কাজে (বিশেষ করে রংপুরে বাংলাদেশ ব্যাংকের ম্যুরালে তিনি
উন্মীলিত করেছেন ট্র্যাডিশনাল রাজনৈতিক ডিসকোর্সের বর্তমান মুহূর্তটাই, যারা ব্যাংকে আসে এবং ম্যুরালটা দেখে তাদের চোখে ভর করে ব্যবস্থার মধ্যে ক্রিয়াশীল নির্যাতনটাই, নবী সাধারণ মানুষের চোখ দিয়ে সমস্তটা দেখেছেন এবং এই দেখার মধ্যে কোনো ভান নেই)।
নবীর কৃতিত্ব এখানটাতে। নবী নিজেকে ট্রেইন করেছেন পেইন্টিংয়ের বিভিন্ন ম্যাটেরিয়াল বোঝার জন্য এবং শিল্পভাষার সম্ভাবনা পরীক্ষা করার জন্য। তাঁর কাছে শিল্পীর জীবন এক হিসাবে রাজনৈতিক জীবন। বিভিন্ন মানুষের জীবন এক হিসাবে ফর্ম খোঁজা ও ব্যাখ্যার নামান্তর। মানুষের ফর্ম রাজনীতির গণতান্ত্রিক ফর্মের মতো, হাতের কন্ট্রোলে থাকলে নৈরাজ্যিক হতে পারে না। নবী এক্ষেত্রে সতর্ক, সজাগ ও হুঁশিয়ার, শিল্পক্ষেত্রে তাঁর অবস্থান নৈরাজ্যের বিরুদ্ধে। তাঁর ফর্ম, তাঁর ফিগার, তাঁর গঠনরীতি মানুষের চোখকে, দর্শকের চোখকে ধাক্কা দেয় না। নবীর দিক থেকে শিল্প নিজের আইডেনটিটি তৈরি করতে সাহায্য করে। এই সাহায্য অবচেতনের ইচ্ছার বিরুদ্ধে, অনেকটা ক্লাসিক্যাল গঠনরীতি নির্মাণের দিকে যাত্রার কথা মনে করিয়ে দেয়। লিওটার যাকে বলেছেন ড্রিফটওয়ার্ক, সেদিকে যাত্রা নয়। এই যাত্রা হচ্ছে সুশৃঙ্খলার দিকে। অন্যদিকে নবী বিষয়বস্তু, মনুষ্যজীবন, কিংবা প্রাণী জীবনের ওপর কর্তৃত্ব বিস্তারে আগ্রহী নন (আবেদিনের মধ্যে এই আগ্রহের কমতি ছিল না)। তিনি বিষয়ের মধ্যে নিজেকে ছড়িয়ে দিয়েছেন। এই ছড়িয়ে দেওয়াটা এক ধরনের জেন মার্ক্সসিজম, এক ধরনের লিবিডিনাল ক্রিয়া। এভাবে তাঁর কাজ বোঝা যেতে পারে।
তিনি প্রভুত্ব বিস্তার কিংবা ক্ষমতা বিস্তারের দিকে তাঁর কাজকে ব্যবহার করেননি। তিনি জাঁ বদ্রিলিআরের মতো, তাঁর বিখ্যাত বইটির মতো : ইন দি শ্যাডো অব দি সাইলেন্ট ম্যাজোরিটিজের মধ্যে নিজের কাজকে বুঝতে চেয়েছেন। বদ্রিলিআর ডিকনস্ট্রাকটিভ অন্তর্দৃষ্টি সমাজের বিভিন্ন ঘটনার ক্ষেত্রে ব্যবহার করেছেন, তেমনি নবী অর্থহীনতার জয়গান না করে ডিকনস্ট্রাকশনকে ব্যবহার করেছেন অন্তর্দৃষ্টিকে সজাগ করার জন্য। সাইলেন্ট ম্যাজোরিটি কিংবা সাধারণ মানুষ প্রত্যাখ্যান করে অর্থ আরোপের চেষ্টা, যুক্তি আরোপের চেষ্টা, শৃঙ্খলা আরোপের চেষ্টা, এমনকি সমাজতন্ত্র আরোপের চেষ্টা। এখানেই সামনে আসে নবীর নব্য-রোমান্টিকতা। সাইলেন্ট ম্যাজোরিটি প্রত্যাখ্যান করে সকল ধরনের রিপ্রেজেন্টেশনাল সিস্টেম, সকল ট্র্যাডিশনাল রাজনৈতিক অর্থ। নবী শিল্পক্ষেত্রে বিপ্পবের ডাক দেননি, তিনি শিল্পের বিস্তৃতি ও মোক্ষ চেয়েছেন। এই মোক্ষের ক্ষেত্রে, তিনি চুপচাপ কাজ করেছেন। সেজন্য তাঁর শিল্প সাধারণ মানুষের শিল্প, সাধারণ মানুষ তাঁর চারপাশে ছড়ানো ভুবন যে-চোখে দেখে, সেই দেখার শিল্প।