র বি উ ল হু সা ই ন
গত ৪-৭ অক্টোবর, ২০১২ এই চারদিন ঢাকার কেন্দ্রীয় গণগ্রন্থাগারের শওকত ওসমান স্মৃতি মিলনায়তনে মুক্তি ও মানবাধিকার বিষয়ক ষষ্ঠ আন্তর্জাতিক প্রামাণ্যচিত্র উৎসব মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরের আয়োজন ও পৃষ্ঠপোষকতায় অনুষ্ঠিত হলো। আমাদের অকালপ্রয়াত দুই প্রতিভা – চলচ্চিত্র নির্মাতা তারেক মাসুদ আর মিশুক মুনীরের স্মৃতির প্রতি প্রদর্শনী উৎসর্গীকৃত। কর্তৃপক্ষ সাত বছর ধরে এই প্রশংসনীয় কার্যক্রম খুব সফলভাবে সমাধা করে যাচ্ছে। এই উৎসবে বাংলাদেশসহ পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে স্বাধীনতা ও মানবাধিকার বিষয়ে নির্মিত প্রামাণ্যচিত্র দেখানো হলো। আন্তর্জাতিক বিভাগে এগারোটি এবং দেশীয় বিভাগে পনেরোটি প্রামাণ্যচিত্র প্রদর্শিত হয় এবং গত বছর থেকে এই বিভাগে পুরস্কার দেওয়ার ব্যবস্থা শুরু হয়েছে। শ্রেষ্ঠ প্রামাণ্যচিত্র নির্মাতা পুরস্কার ও শ্রেষ্ঠ নবীন প্রামাণ্যচিত্র নির্মাতা পুরস্কার – এই দুটি পুরস্কার প্রবর্তিত হয়, যা খুব আশা ও উৎসাহব্যঞ্জক। এবার ২০১০ সালের পর থেকে নির্মিত প্রামাণ্যচিত্রগুলো প্রতিযোগিতায় অংশ নিয়েছে।
কথায় আছে ঘটে যাওয়া ঘটনা, তা যে-কোনো বিষয়ে ঘটুক না কেন, তার প্রমাণসমূহ নিয়ে প্রামাণ্যচিত্র নির্মিত হয় এবং ক্রমান্তরে তা ইতিহাসের প্রামাণ্যকরণে পর্যবসিত হয়ে বাস্তব সত্যে রূপ নেয়। মিথ্যা ঘটনা নিয়ে প্রামাণ্যকরণ প্রক্রিয়ার অনেক কিছু হতে পারে, কিন্তু তা কখনো প্রকৃত প্রামাণ্যচিত্র হিসেবে দাঁড়ায় না। এর প্রকৃষ্ট প্রমাণ গোয়েবলসীয় অপপ্রচেষ্টা – মিথ্যাকে বারবার প্রচার করলেও সেই মিথ্যা কোনোভাবেই সত্যে সত্যায়িত হলো না, তাই প্রামাণ্যকরণ ব্যর্থতায় পর্যবসিত হলো। প্রামাণ্যচিত্র সত্য, সৎ ও সুন্দরকে প্রমাণিত করে মানুষ, ইতিহাস ও প্রকৃতির কল্যাণ এবং শান্তির সপক্ষে। প্রামাণ্যচিত্র সেই সত্যকে প্রচার ও প্রসারিত করে যা জনহিতকর, ইতিবাচক, আনন্দদায়ক, উপভোগ্য, সেবামূলক, জ্ঞান ও বুদ্ধিবৃত্তিক এবং বিনোদনগুণসম্পন্ন। এই বিশেষ চিত্রপ্রক্রিয়া মানুষের স্বপ্ন, আশা-আকাক্সক্ষাকে ঘনীভূত ও দৃঢ়ীকরণ করে সত্যাশ্রয়ী প্রমাণাদিসহ। প্রামাণ্যচিত্রের এই অন্তর্নিহিত আপ্তবাক্য আজ প্রমাণিত সত্য এবং এটাই তার সারাৎসার।
১৯৭১ সালে পৃথিবীর অন্যতম নৃশংস রাজনৈতিক গণহত্যা বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধ ঘটেছিল পাকিস্তানি অশিক্ষিত, বর্বর, জানোয়ারদের দ্বারা। আজ কোনো কোনো অতি মানবতাবাদীরা বলে থাকে, ওটা ছিল গৃহযুদ্ধ; কিন্তু তারা জানে না, গৃহযুদ্ধ দিয়ে স্বাধীনতাযুদ্ধ হয় না এবং গৃহযুদ্ধের মাধ্যমে কোনো দেশ স্বাধীনতা লাভ করে না। আমাদের পরিতাপের বিষয়, আজ পর্যন্ত যুদ্ধাপরাধীদের বিচার হলো না। অথচ যে-কোনো যুদ্ধে বিজয়ীরা বৈধভাবে আইনি ক্ষমতা পায় এবং সেই ক্ষমতার বলে পরাজিত আর তাদের সহযোগীদের যুদ্ধাপরাধী হিসেবে বিচারের ব্যবস্থা করে। জ্ঞানপাপীরা আরো বলে, যুদ্ধাপরাধীদের বিচার করতে হলে মুক্তিযোদ্ধা, যারা পাকিস্তানি আর তাদের দোসর আলবদর, আলশামস, রাজাকারদের নিধন করেছে, তাদেরও বিচার করতে হবে, যেহেতু সেটিও ছিল মানবাধিকার লঙ্ঘন। আশ্চর্য কুযুক্তি। ২৫ মার্চে যারা অতর্কিত নিরস্ত্র ঘুমন্ত জনগণের ওপর আক্রমণ করে নিঃশেষ করল তখন মানবাধিকার কোথায় ছিল? সেইদিন থেকে নয় মাসব্যাপী যুদ্ধে ত্রিশ লাখ মানুষ আত্মাহুতি দিলো, চার লাখ মা-বোন ইজ্জত হারাল, ১৪ ডিসেম্বরে বুদ্ধিজীবী, শিক্ষক, কবি, শিল্পী-সাহিত্যিক হত্যা করল, তখন মানবাধিকার কি শেষ হয়ে গিয়েছিল? যে জয়ী হয় আইন তার পক্ষে যায় – এটাই সর্ব সময়ে সর্ব ইতিহাসে স্বীকৃত সত্য।
বাঙালি জাতি বারবার রাজনীতির ধারাবাহিকতায় একবার ব্রিটিশ ভারতীয়, তারপর পাকিস্তানি এবং শেষে বাংলাদেশি হলো; কিন্তু জাতি হিসেবে সেই বাঙালিই থেকে গেল। এরা এবং এই দেশ হাজার বছর বিভিন্ন ভিনদেশি শাসকগোষ্ঠীর দ্বারা পর্যায়ক্রমে শাসিত হওয়ার পর ১৯৭১-এর ১৬ ডিসেম্বর বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের অসামান্য রাজনৈতিক নেতৃত্বে ও প্রজ্ঞায় সম্পূর্ণ গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া এবং ধারাবাহিকতায় পৃথিবীর মানচিত্রে একটি স্বাধীন ও সার্বভৌম দেশ হিসেবে আত্মপ্রকাশ করল। পৃথিবীর ইতিহাসে আগে এমন কখনো ঘটেনি। বাংলাদেশ পৃথিবীতে একমাত্র দেশ, যেটি সম্পূর্ণভাবে গণতন্ত্রের নিয়ম-প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে পৃথিবীতে প্রথমবারের মতো বাস্তবে রূপ নিল। এরকম এক দেশের স্বাধীনতাযুদ্ধের স্বাধীনতাবিরোধী আর তাদের সহযোগীদের যুদ্ধাপরাধী হিসেবে বিচার হয়নি, এই রূঢ় বাস্তবতার পরিপ্রেক্ষিতে মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর প্রতিষ্ঠা অবশ্যই অতীব প্রশংসার দাবিদার এবং এই সঙ্গে জাদুঘর আয়োজিত মুক্তি ও মানবাধিকার বিষয়ক প্রামাণ্যচিত্র উৎসবের আয়োজন প্রক্রিয়া ও তার ধারাবাহিকতাও তদ্রুপ।
বাংলাদেশের সব জায়গাজুড়েই বধ্যভূমি। প্রতিটি জায়গায় নিরীহ মানুষ প্রাণ হারিয়েছে। নৃশংস যুদ্ধাপরাধীদের বিচার শুরু হয়েছে আজ বহুদিন পর। এরই পরিপ্রেক্ষিতে সমগ্র দেশের মানুষ এর সুষ্ঠু বিচার আশা করছে, যাতে স্বাধীনতাবিরোধীরা তাদের অপরাধের জন্য চরম শাস্তি পায়। সেটা হলেই স্বাধীনতাযুদ্ধ সম্পূর্ণ হবে। অন্যথায় কখনো নয়। মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর তাদের প্রামাণ্যচিত্র প্রদর্শনী আর উৎসবের মধ্য দিয়ে ওই যুদ্ধাপরাধীদের বিচারকাজ যে খুব প্রয়োজনীয় সেই দায়বদ্ধতা ও কর্তব্য গুরুত্বসহকারে সামনে নিয়ে এসেছে এবং বিচারকালীন সময়ে এই সঙ্গে একটি বলিষ্ঠ প্রতিবাদের আবহ সৃষ্টি করতে সমর্থ হয়েছে, যাতে ভবিষ্যতে কোনোদিন কোনো সময়ে কোনো দেশে এইরূপ নৃশংস মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনা না ঘটে। বিশেষ করে নতুন প্রজন্মের কাছে এই বাণী পৌঁছানোর একটি যথাযথ সুবন্দোবস্ত হয়েছে বলে মনে করা যায়।
ঊনবিংশ শতাব্দীতে জন্ম নেওয়া চলচ্চিত্রশিল্প আজ বিংশ ও একবিংশ শতাব্দীতে এসে শিল্পমাধ্যমের একটি গুরুত্বপূর্ণ সৃষ্টিশীল শিল্প হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। প্রযুক্তি, অভিনয়, নাটক, উপন্যাস, কবিতা, ভ্রমণ, আলোছায়া, সাজসজ্জা – সব কর্মযজ্ঞ নিয়ে চলচ্চিত্র একটি যৌগিক দৃশ্যশিল্পে রূপ নিয়েছে। শিল্পের আবেদন সর্বজনীন, কিন্তু যে-দেশে যে-পরিবেশ বা অবস্থায় নির্মিত হয়, সেই আবহে বিরাজিত সামাজিক, রাজনৈতিক, সাংস্কৃতিক ও অর্থনৈতিক বাস্তবতা ঘিরে তা দানা বেঁধে ওঠে।
যুদ্ধ, বিপ্লব ও স্বাধীনতা – এই থিমে উৎসবের আন্তর্জাতিক পর্ব সাজানো হয়েছে, সেখানে মানবাধিকার বিষয়ে চিলির আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন প্রামাণ্যচিত্র নির্মাতা প্যাট্রিসিও গুজম্যানের চারটি দীর্ঘ ছবি চিলি, অবস্টিনেট মেমোরি, নস্টালজিয়া ফর দ্য লাইট, সালভাদর আলেন্দে ও ব্যাটল অব চিলি : পার্ট-১, ২ ও ৩ – এগুলো প্রধানত সেই সময়ে সংঘটিত জনগণ-সমর্থিত সমাজতান্ত্রিক আন্দোলনের বিপরীতে রক্তাক্ত প্রতিবিপ্লবের দৃশ্যশিল্পের মহাকাব্যিক প্রামাণ্য দলিল। এই সঙ্গে কানাডার ড্যানিয়েল সেকুলিচের আফটার মাথ : দ্য রেমনান্টস অব ওয়ার, যুদ্ধের জন্য মানুষের মনে নেতিবাচক মনোবিকার ঘটে তার বিবরণ; ইতালির ক্লার্ক গ্রিনের চে গুয়েভারা : হাস্তা লা ভিক্টোরিয়া সিম্প্রে চে গুয়েভারা, ফিদেল কাস্ত্রো, কিউবার বিপ্লব নিয়ে; যুক্তরাষ্ট্রের পিটার ডেভিসের হার্টস অ্যান্ড মাইন্ডস ১৯৭৪ সালে ভিয়েতনাম যুদ্ধের ওপর নির্মিত এবং যুক্তরাজ্যের রিচার্ড বিয়ামের রেভ্যুলিউশন ১৯১৭ প্রথম বিশ্বযুদ্ধ নিয়ে। নিঃসন্দেহে এরূপ প্রামাণ্যচিত্রের প্রদর্শন উৎসবটিকে মর্যাদাসম্পন্ন করে সবার কাছে গ্রহণযোগ্য করে তুলেছে।
মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর এই সঙ্গে আরেকটি প্রশংসনীয় চলচ্চিত্র বিষয়ক কর্মযজ্ঞ শুরু করেছে। সেটি হলো দেশের প্রকৃত ইতিহাস, সংস্কৃতি, স্বাধীনতা ও মুক্তিযুদ্ধের সঠিক আলেখ্য জানার প্রতি আগ্রহ ও সচেতনতা বৃদ্ধির উদ্দেশ্যে তরুণ শিক্ষার্থীদের জন্য বিশেষ প্রদর্শনীর আয়োজন। জাদুঘর কর্তৃপক্ষ ইতোমধ্যে মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক প্রামাণ্যচিত্র নির্মাণ, শিক্ষা ও সংরক্ষণের জন্য একটি পৃথক বিভাগ স্থাপন করেছে এবং বহু আগ্রহী তরুণ চলচ্চিত্র নির্মাতা এই বিভাগে যোগ দিয়েছেন। মূলত চলচ্চিত্র বিষয়ক আয়োজনের একটি সম্প্রসারিত রূপ এই সাত বছরব্যাপী প্রামাণ্যচিত্র উৎসবে বাস্তবায়িত হয়ে আসছে এবং বলা যায় শুধুমাত্র মুক্তিযুদ্ধ, স্বাধীনতা, মানবাধিকার লঙ্ঘন বিষয়ক এরকম প্রামাণ্যচিত্র উৎসবের আয়োজন আমাদের দেশে এই প্রথম, যা আগে কখনো অনুষ্ঠিত হয়ে ওঠেনি।
জমাটবাঁধা ঘনীভূত সংগীতকে যদি স্থাপত্যশিল্প বলা যায়, তবে স্মৃতিসৌধ হচ্ছে ঘুমিয়ে থাকা ইতিহাস। তাই স্মৃতির মিনার দেখে ইতিহাস ঘুম থেকে জেগে ওঠে। এ কারণে সেই স্মৃতি সংরক্ষণ করতে হয়। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে ইতিহাস রাজনৈতিক ক্ষমতার বলে কেউ কেউ নিজের মতো করে নির্মাণ করতে চায়। কিন্তু তারা ভুলে যায় ইতিহাস মনুষ্য দ্বারা সৃজিত সাহিত্যকর্ম নয়, ইতিহাস নির্মিত হয় সময়, কাল ও পরিপ্রেক্ষিত দ্বারা, সত্য ও সততা দ্বারা, জোরপূর্বক ক্ষমতাবলে কল্পনা, স্বপ্ন বা ভাবনা-চিন্তা দ্বারা নয়। এর পরিপ্রেক্ষিতে উৎসবে আমাদের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস ধরে রাখার উপায়, উদ্দেশ্য ও কার্যকর ব্যবস্থা নেওয়ার আলোকে ‘যুদ্ধ ও স্মৃতি : প্রেক্ষিত বাংলাদেশ’ বিষয়ে একটি আলোচনা সভার আয়োজন করা হয়, যেখানে অধ্যাপক আবু মো. দেলোয়ার হোসেন এবং এ টি এম যায়েদ হোসেন মূল বক্তব্য তুলে ধরেছেন আর আলোচনায় অংশ নিয়েছেন আলী যাকের, মাহমুদুল হোসেন প্রমুখ। শিক্ষার্থীদের জন্য এই আলোচনাপর্বটি খুব সহায়ক ভূমিকা পালন করেছে। সেইসঙ্গে মুক্তিযুদ্ধের সময়ে তৈরি জহির রায়হানের অনবদ্য প্রামাণ্যচিত্র স্টপ জেনোসাইড ও মুক্তিযুদ্ধের পরের ছবি ইয়াসমিন কবিরের বীরাঙ্গনা গুরুদাসী মণ্ডলকে নিয়ে স্বাধীনতা, ফৌজিয়া খানের রবীন্দ্রনাথ সরকারকে নিয়ে, যাকে তার বন্ধু পিয়ারা রাজাকার পাকসেনাদের হাতে বিশ্বাসঘাতী হয়ে তুলে দেয়, তার নির্মম কাহিনি কোথায় পাবো তারে, মুস্তাক আহমেদের মিরপুর জল্লাদখানা নিয়ে হৃদয়বিদারক ডাই মিলিয়ন ৭১, নাহিদুর রহিম চৌধুরীর ইতিহাসের সন্ধানে এবং পাকিস্তানের নিলুফার আকমাতের অসাধারণ এক মিনিটের প্রামাণ্যচিত্র অ্যামনেশিয়া, যেখানে ১৯৭১-এ এদেশে ঘটে যাওয়া নির্মম মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনাবলি, যা পাকিস্তানসহ প্রায় সব দেশেই ঘটে যাচ্ছে সেসবের দৃশ্যকাব্য। মোট ছয়টি প্রামাণ্যচিত্রের এই প্রদর্শনী শুধু আগ্রহী তরুণ চলচ্চিত্র শিক্ষার্থীদের জন্য করা হয়েছিল। এতে তরুণ চলচ্চিত্রকর্মী ও শিক্ষার্থীরা মুক্তিযুদ্ধের ছবি এবং ইতিহাস সম্বন্ধে জানা, নির্মাণ ও সৃজনের ক্ষেত্রে আগ্রহী ও উৎসাহিত হয়ে উঠেছেন।
এগুলো ছাড়া আন্তর্জাতিক অঙ্গনের প্রামাণ্যচিত্রের মধ্যে মোট দশটি ছবি প্রদর্শিত হয়। সেগুলো হচ্ছে ভারতের সৌমিত্র দস্তিদারের এ লেটার টু মাই ডটার – মণিপুর কীভাবে ভারতের অঙ্গরাজ্যে পর্যবসিত হলো সেই বিষয়ে; যুক্তরাষ্ট্রের জন অ্যালপার্ট ও ম্যাথিউ ও’নিলের চায়নাজ আনন্যাচারাল ডিজাস্টার : দ্য টিয়ার্স অব সিচুয়ান প্রভিন্স – এইচবিও টেলিভিশনের জন্য নির্মিত সেখানকার জনগণের প্রকৃতি ও মানুষের দ্বারা অত্যাচারিত ও নিষ্পেষিত হওয়ার কাহিনি; ডেনমার্কের অ্যান্ডার্স অস্টেরগার্ডের বার্মা ভিজে – অস্কার পুরস্কার মনোনীত এই প্রামাণ্যচিত্রে বার্মার একদল সংগ্রামী ও প্রতিবাদী সাংবাদিকের আলেখ্য তুলে ধরা হয়েছে; যুক্তরাজ্যের প্যাট্রিসিও ডেলসো লুকাসের জাস্ট টু কল ইউ ড্যাড – আত্মজৈবনিক এই ছবিটিতে পিয়ানোবাদক বাবা ও তাদের পরিবারের শেকড় সন্ধান বিষয়ক প্রচেষ্টা; নিউজিল্যান্ডের ম্যারি ওয়্যারহ্যাম ও ব্রায়ান লিউয়ের ডিজার্ম – এখানে বার্মা, ইরাক, কলম্বিয়া ও আফগানিস্তানে সংঘটিত বিভিন্ন যুদ্ধে নিরীহ মানুষের আর্তনাদ, মাটিতে পুঁতে রাখা ভয়াবহ মাইনে অতর্কিতে নিহত ও ভাগ্যক্রমে বেঁচে যাওয়া কিন্তু হাত-পা হারানো পঙ্গুদের হৃদয়ভাঙা আলেখ্য চিত্র; ফিনল্যান্ডের পিরজো হনকাসালোর দ্য থ্রি রুমস অব মেলানকলিয়া – আন্তর্জাতিকভাবে পরিচিত ও পুরস্কৃত এই অসাধারণ প্রামাণ্যচিত্রে রাশিয়া ও চেচনিয়ার চেচন যুদ্ধে শিশুরা কীভাবে মানসিকভাবে পর্যুদস্ত হচ্ছে তার স্পষ্ট প্রমাণ শিল্পসম্মত ধারাবর্ণনা, সংলাপ, সংগীত ও সৃষ্টিশীল সম্পাদনায় উজ্জ্বল হয়ে প্রদর্শিত; ভারতের নিষ্ঠা জইনের লক্ষ্মী অ্যান্ড মি, গৃহপরিচারিকার নির্মম জীবিকা নিয়ে যেখানে প্রামাণ্যচিত্রটির পরিচালক ও তাঁর পরিচারিকার সম্পর্ক নিয়ে রূঢ় বাস্তবতাসমৃদ্ধ ছবিটি; ফ্রান্সের আঁলে রেনে তাঁর নাইট অ্যান্ড ফগ ১৯৫৫ সালে কনসেনট্রেশন ক্যাম্প আউশভিৎস ও মায়ডানেকের পরিত্যক্ত জায়গায় সেই সময়ে বন্দিদের নিপীড়িত জীবনযাপন পদ্ধতি নিয়ে তৈরি ও প্রদর্শিত; যুক্তরাষ্ট্রের জিম ব্রাউন-নির্মিত পিট সিগার : দ্য পাওয়ার অব সং, যেখানে আমেরিকার পথিকৃৎ লোকশিল্পী পিট সিগারের জীবনালেখ্য সংরক্ষিত রাখার প্রয়াসে লোকসংগীতের ইতিহাসসহ ব্রুস িপ্রংস্টিন, জোয়ান বেজ, বব ডিলান প্রমুখ প্রখ্যাত সংগীতশিল্পীর সাক্ষাৎকার ইত্যাদি নিয়ে তাদের পিটের প্রতি কৃতজ্ঞতা জানানো ও প্রভাব স্বীকার বিষয় নিয়ে সুন্দর আলেখ্য এবং সবশেষে যুক্তরাজ্যের ফ্লোরেন্স আয়িসি ও কিম লংগিনোট্টোর সিস্টার্স ইন ল, যেখানে ক্যামেরুন দেশের মুসলমানপ্রধান গ্রাম কুম্বা টাউনের সংগ্রামী দুই মহিলা, যাদের পুরুষশাসিত সমাজের বিভিন্ন অন্যায়-অবিচারের বিরুদ্ধে অধিকার প্রতিষ্ঠার আন্দোলন তুলে ধরা হয়েছে। এসব ছবিতে সমাজ-সংসার ও দেশে দেশে বিরাজিত মানবাধিকার লঙ্ঘনের পাশাপাশি সেইসব অন্যায়-অবিচারের বিরুদ্ধে সুষ্ঠু বিচার এবং প্রকৃত ভারসাম্য প্রতিষ্ঠার সর্বজনীন আন্দোলন ও সংগ্রাম চালানোর ধারাবাহিকতা নিয়ে কথা বলা হয়েছে।
বাংলাদেশের প্রামাণ্যচিত্র পর্বে মোট ষোলোটি তথ্যচিত্র দেখানো হয়েছে। এগুলো হচ্ছে তানভীর মোকাম্মেলের ১৯৭১, শাহরিয়ার কবিরের দুঃসময়ের বন্ধু, সেন্টু রায়ের আলতাফ মাহমুদ, সাইফুল ওয়াদুদ হেলালের অপরাজেয় বাংলা, পলাশ রসুলের বাংলা নামে দেশ, এ কে এম আব্দুল্লাহর অগ্নিযুগের ঢাকা, মুস্তাক আহমেদের ডাই মিলিয়ন ’৭১, মাহাবুবুল আলম সাঈফের আহ্বান, আহমেদ-এ-নবীন ও রজত বাপ্পির স্মৃতির পুকুর, ব্রাত্য আমীনের পতাকা, তাসমিয়াহ আফরিন মৌয়ের টোকাই ২০১২, মৃদুল মামুনের সবাই একজাত, মোল্লা সাগরের সাইরেন, শফিকুল ইসলাম কাজলের দি আনসাঙ ব্যালাডস, তানভির আলিম ও আরিফুর রহমানের উইদাউট এনি উইনডো অব হিজ ওন এবং নাসরিন সিরাজ এ্যানীর হাঁরা কয়লা খুনি চাই না। এইসব প্রামাণ্যচিত্রে বীরাঙ্গনা, মুক্তিযুদ্ধ, স্মৃতিপাঠ, শ্রমিকদের বেকারত্ব, উন্মুক্ত কয়লা উত্তোলনে পরিবেশ বিরোধিতা, বধ্যভূমি, জাতীয় পতাকা, স্বাধীনতাযুদ্ধের সহযোগী বন্ধু ও সহযোগীবৃন্দ, মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক ভাস্কর্য, একুশের গান, অগ্নিযুগের ইতিহাস, মুজিবনগর সরকার গঠনের পর শিল্পীদের পোস্টার সৃষ্টি, টোকাই, একজন পশ্চিম পাকিস্তানির সন্তান হয়ে বাংলাদেশের মুক্তিসংগ্রামে অংশ নেওয়া, পাটকল বন্ধ হলে শ্রমিকদের দুর্দশা এবং ব্যতিক্রমী বিষয়ে সমপ্রেমী মানুষদের দুঃখ-কষ্ট, স্বপ্ন-চাহিদা, সমস্যা-সমাধান, সামাজিক অধিকার আর বিচার প্রতিষ্ঠা নিয়ে বিভিন্ন ধরনের দৃষ্টিপাত ও দৃষ্টিভঙ্গি উত্থাপিত হয়েছে।
আলোচ্য প্রামাণ্যচিত্রের মধ্য দিয়ে তরুণ নির্মাতারা যেভাবে সৃজনশীলতার পরিচয় দিয়েছেন তা অবলোকন করে আমরা চলচ্চিত্রশিল্প মাধ্যমে প্রতিভাধর নির্মাতাদের আবির্ভাব সম্বন্ধে খুব আশান্বিত হই। সেই বিচারে এবার বিজ্ঞ বিচারকদের মতামতে শ্রেষ্ঠ প্রামাণ্যচিত্র নির্মাতার পুরস্কার পেয়েছেন সাইফুল ওয়াদুদ হেলাল তার অপরাজেয় বাংলা এবং শ্রেষ্ঠ নবীন প্রামাণ্যচিত্র নির্মাতা পুরস্কারে অভিষিক্ত হয়েছেন ব্রাত্য আমীন পতাকা ছবির জন্য। ছবির বিচারে আলোকসম্পাত, আলোছায়ার খেলা, বিষয়, আয়োজন-গঠন, চরিত্র-প্রকাশ, দৃশ্যসজ্জা, অন্তর্নিহিত সুর, কথা বা বাণী, ইতিহাস ও ঐতিহ্য-সংস্কৃতি সংলগ্নতা ও মগ্নতা, প্রকৃতি-পরিবেশ, সর্বোপরি মুক্তিযুদ্ধের অনিবার্য প্রভাব, প্রয়োজন, চর্চা, দায়বদ্ধতা ও সেসবের সংরক্ষণ প্রক্রিয়ায় ইতিবাচক ভূমিকা রাখার সহায়তা লাভ ও প্রয়াস-চেষ্টায় এগিয়ে নেওয়া ও এগিয়ে আসার চেষ্টা ও আন্তরিকতা এইসব উপাদান মুখ্য হিসেবে বিবেচিত হয়েছে। সবকিছু মিলিয়ে বাংলাদেশের স্বাধীনতা, মুক্তিযুদ্ধ ও যুদ্ধাপরাধীদের বিচার – যাবতীয় আলোচিত বিষয় যা এখন সর্বদা প্রচলিত, প্রচারিত ও প্রসারিত সেসবের একটি জোরালো যুক্তি, সমর্থন ও সহায়তা লাভের আনুকূল্যতা নিঃসন্দেহে এই প্রামাণ্যচিত্র উৎসব দ্বারা অর্জিত হয়েছে – একথা নির্দ্বিধায় বলা যায়।